দশ
ইণ্ডিয়ান কনসুলেটের প্রকাণ্ড একটা গাড়িতে এয়ারপোর্টের দিকে চলেছে রানা ও গিলটি মিয়া। ড্রাইভারের পাশে বসে আছে একজন আর্মড় গার্ড। পিছনে দুটো মোটর সাইকেলে করে চলেছে দু’জন স্টেন-গানধারী সিপাই। সতর্ক। প্রস্তুত।
কনসাল ভীমসেন নায়ার খুবই দ্রুত কাজ করেছেন বলতে হবে। আসলে কনসুলেটের উপর এই সশস্ত্র হামলায় খেপে একেবারে আগুন হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এখানে ওখানে ফোন করে ঠাণ্ডা জুরিখ শহর গরম করে তুলেছিলেন। রানার বক্তব্য শুনে, এবং নীল প্যাকেটটার মধ্যে ভারতের জন্যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে আঁচ করতে পেরে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন আরও বেশি। কথা দিলেন, রানার এত কষ্ট স্বীকার করে এত দূর থেকে বয়ে আনা প্যাকেটটা তিনি যথেষ্ট সাবধানতার সাথে ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে করে কলকাতায় পৌঁছবার ব্যবস্থা করবেন। এতসব উত্তেজনার মধ্যেও গোপনে একবার কলকাতার সাথে যোগাযোগ করতেও ভুললেন না ভীমসেন।
রঞ্জন চৌধুরীর সাথে তাঁর কি কথা হয়েছিল রানা জানে না, কিন্তু পনেরো মিনিট পর যখন ভীমসেন নায়ার আবার এসে ঢুকলেন ওয়েটিং রূমে, স্পষ্ট অনুভব করতে পারল রানা, বিন্দুমাত্র সন্দেহের চিহ্নও নেই তখন আর তাঁর মনে। রানার নিরাপত্তার কথা ভেবে গাড়ি আর গার্ডের ব্যবস্থা করে ফেললেন দশ মিনিটের মধ্যে। টেলিফোনে বুক করে ফেললেন টিকেট। এখন বাকি শুধু প্লেনে উঠে বসা। সাধ্যমত সবই করেছেন ভদ্রলোক।
‘এ যাত্রা বোধায় বেঁচে গেলুম, স্যার। দূর থেকে এয়ারপোর্টের বাতি দেখে একগাল হাসল গিলটি মিয়া। ‘উফ্, কম ধকলটা যায়নি এ ক’টা দিন! কিন্তুক মজাও লেগেচে দারুণ। কি বলেন? পেলেনে উটে এমন এক ঘুম দোব না…’
রিসেপশন অফিসের কাছে থেমে দাঁড়াল গাড়িটা।
‘আপনারা একটু অপেক্ষা করুন, আমি জেনে আসি কত নম্বর রানওয়েতে রয়েছে প্লেন।’
গার্ডটা গাড়ি থেকে নেমে যেতেই গাড়ির দুই পাশে এসে দাঁড়াল মোটর সাইকেল আরোহী দু’জন। সতর্ক। প্রস্তুত। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাইছে চারদিকে।
তিন মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল গার্ডটা রিসেপশন অফিস থেকে।
‘এই যে আপনাদের টিকেট।’ অ্যালিটালিয়ার মার্কা মারা দুটো টিকেট এগিয়ে দিল গার্ড। ‘দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে আপনাদের। বে ফাইভে আছে প্লেনটা। আপনারা উঠবার আগে ওটা সার্চ করে দেখার অর্ডার আছে আমার ওপর। অবশ্য সার্চ করতে বেশিক্ষণ লাগবে না।’
‘লাগুক, লাগুক!’ সোৎসাহে বলল গিলটি মিয়া। ‘ভাল করে খোঁজো বাওয়া, বোম-টোম থাকলেই গেচি।’
গাড়িতে উঠে বসল গার্ড। টারমাকের উপর দিয়ে বে- ফাইভের দিকে চলল গাড়ি দ্রুত বেগে। ওখানে একটা রিসেপশন রূমের সামনে জনা পাঁচেক লোক দাঁড়ানো।
পিছন দিক দিয়ে ঘুরে ভি. আই. পি. লেখা একটা দরজা সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িটা।
‘ভেতরে ঢুকে পড়ুন, স্যার,’ বলল গার্ডটা। ‘বাইরে একজন পাহারা দেবে, আর আমরা বাকি দু’জন যাব প্লেনটা সার্চ করতে। অল ক্লিয়ার দেখলে আমি ডাকব আপনাদের।’
‘ঠিক আছে,’ বলল রানা।
দ্রুত পায়ে চলে এল রানা ও গিলটি মিয়া কামরার মধ্যে। ঘরের ভিতরটা একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরীক্ষা করে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল গার্ড, কি যেন আদেশ দিল কাউকে, তিন সেকেণ্ড পর চলে গেল মোটর সাইকেল দুটো।
ফোমের সোফায় বসে এক কান থেকে আর এক কান পর্যন্ত হাসল গিলটি মিয়া।
‘খাতিরটা দেকেচেন, স্যার? আরও অনেক আগেই কোনও কনসুলেটে যাওয়া উচিত ছিল আমাদের। তাই না?’
জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল রানা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলাল বাম থেকে ডাইনে। এত সহজে ছেড়ে দেবে ওদের সিলভিও? শেষ চেষ্টা করবে না একবার?
‘সরে আসুন, স্যার।’ বলল গিলটি মিয়া। ‘জানালার কাচে না দাঁড়ানোই ভাল। বলা তো যায় না…’ আঁৎকে উঠে থেমে গেল গিলটি মিয়া। ওরা যে দরজা দিয়ে ঢুকেছিল তার উল্টো দিকের দরজাটা ফাঁক হয়ে গেছে। সেই ফাঁকে দেখা যাচ্ছে একটা পয়েন্ট ফোর ফাইভ কোল্ট অটোমেটিক। পিস্তলধারী এক পা এগিয়ে আসতেই চিনতে পারল সে সিলভিওকে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘এই সেরেচে! এ-লোক থাকে পাতায় পাতায়।
‘এক পা নড়লে মারা যাবে, মাসুদ রানা,’ বলল সিলভিও চাপা গলায়। গিলটি মিয়াকে বলল, ‘তুমিও বসে থাকো চুপচাপ!’
পাঁই করে ঘুরল রানা। লাফ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল কলজেটা বুকের ভিতর থেকে, পারল না। ধুপধাপ ধুপধাপ হাতুড়ি পিটে চলেছে হৃৎপিণ্ড।
সিলভিওর পিছু পিছু ঘরে ঢুকল লুইসা পিয়েত্রো।
‘এই যে রানা, কেমন আছ?’ হাসল লুইসা। ‘বিদায় না নিয়েই চুপি চুপি পালিয়ে যাচ্ছিলে যে?’
গোলাপী সিল্কের ব্লাউজ আর কালো একটা স্কার্টের উপর চমৎকার একখানা থ্রী-কোয়ার্টার মিংক কোট পরেছে লুইসা। স্বর্গের অী মনে হচ্ছে ওকে দেখে। এগিয়ে এসে একটা সোফায় বসল লুইসা, রানার দিকে চেয়ে হাসল মিষ্টি করে।
‘এই যে, কি খবর!’ অনেক কষ্টে মুখের ভাব অপরিবর্তিত রেখে বলল রানা। জ্যাকেটের পকেটে রাখা লাল নোট বইটা স্পষ্ট ভেসে উঠল ওর চোখের সামনে। ‘কিন্তু তোমাদের এবারের আবির্ভাবটা একটু অতিরিক্ত বিপজ্জনক হয়ে গেল না? দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন গার্ড, আরও দু’জন রয়েছে খুব কাছেই।’
‘ও নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না,’ বলল সিলভিও। ‘বাইরের গার্ড আমার লোক। নোট বইটা এবার দিয়ে দাও লক্ষ্মী ছেলের মত। ওটা পেলে তোমাদের যাত্রায় আর কোন বিঘ্ন ঘটাব না আমি। না দিলে মারা পড়বে এক মিনিটের মধ্যে।’
‘আমাদের মেরে এয়ারপোর্ট থেকে পালাতে পারবে না তুমি, সিলভিও। খামোকা ভয় দেখিয়ো না। সারা এয়ারপোর্টে যত গার্ড আছে সব তোমার লোক, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
‘কথা বাড়িয়ো না, মাসুদ রানা। ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছেচি আমি। কেউ ঠেকাতে পারবে না আমাকে। দিয়ে দাও বইটা!’ আশ্চর্য রকম জ্বলজ্বল করছে সিলভিওর চোখ দুটো।
‘প্লীজ, রানা!’ কথা বলে উঠল লুইসা। ওর চোখে মিনতি আর উদ্বেগ। ‘দিয়ে দাও ওটা। ও যা বলছে ঠিক তাই করবে। কি লাভ অনর্থক প্রাণ দিয়ে? নোট বইটা দিয়ে দিলে সত্যিই ছেড়ে দেবে ও তোমাকে। কথা দিয়েছে ও।’
বেশ খানিকটা সামলে নিয়েছে রানা। মিষ্টি করে হাসল লুইসার দিকে চেয়ে।
‘অপূর্ব সুন্দর লাগছে তোমাকে, লুইসা। মনে হচ্ছে তোমার অনুরোধ রক্ষা করে ফেলতাম যদি আমার পক্ষে সম্ভব হত। আসলে সত্যিই নোট বইটা আমার কাছে নেই।
‘কোন রকম ধোকাবাজি আর খাটবে না, মাসুদ রানা।’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল সিলভিও। ‘দশ সেকেণ্ড সময় দেব তোমাকে, তারপর গুলি করব!’
ওর চোখের দিকে চেয়ে বুঝতে পারল রানা, সত্যিই গুলি করবে সিলভিও।
‘ওটা কনসালকে দিয়ে দিয়েছি আমি। এতক্ষণে ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে পোরা হয়ে গেছে। নিরাপদে পৌঁছে যাবে ওটা কাল কলকাতায়।’
‘মিথ্যে কথা!’ গর্জে উঠল সিলভিও।
নিরুপায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল রানা। সহজ ভঙ্গিতে এসে বসল লুইসার পাশে।
‘বিশ্বাস না করলে আমার কি করার আছে, বলো? সার্চ করে দেখতে পারো,’ মৃদু হেসে বলল রানা।
‘ঠিক আছে, তাই করছি।’ রানার উপর থেকে চোখ না সরিয়ে এক-পা পিছিয়ে গেল সিলভিও, দরজাটা একপাট খুলে ডাকল, ‘গীয়ান! ভেতরে এসো!’
লুইসার একটা হাত তুলে নিল রানা নিজের হাতে। হাত বুলাল নরম মিংক কোটের হাতায়।
‘সুন্দর কোটটা। মিংক পরলে অসুন্দরীকেও সুন্দর লাগে দেখতে, আর সুন্দরীকে লাগে অপূর্ব। তোমাকে আমার কেমন লাগছে বলতে পারবে?’
‘সুন্দরী…’ কথাটা বলেই টের পেল লুইসা এই ধরনের আলাপের উপযুক্ত সময় এটা নয়। রানার চোখে স্থির হলো ওর উদ্বিগ্ন দৃষ্টি। সরাসরি কাজের কথায় এল সে। ‘সত্যিই নেই ওটা তোমার কাছে?’
‘আল্লার কসম!’ হাসল রানা। ‘তোমার ভাই আমাকে এ বোকা মনে করে কেন? আমি তো জানতাম এয়ারপোর্টে শেষ চেষ্টা করবে ও বইটা আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে। ওটা আমার কাছে রাখার চেয়ে কনসুলেটের ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে পাঠানো হাজার গুণ নিরাপদ।
গীয়ান এসে ঢুকল ঘরে। কটমট করে চাইল রানার চোখের দিকে। রানা টের পেল নিশপিশ করছে ওর হাত, ছটফট করছে ভিতর ভিতর প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে।
‘এই দু’জনকে সার্চ করো, গীয়ান!’ বলল সিলভিও। ‘কি খুঁজছি তা তো তোমার জানাই আছে। জলদি!’
মাথার উপর হাত তুলে উঠে দাঁড়াল রানা। গিলটি মিয়ার দিকে চেয়ে বলল, ‘কোন গোলমাল কোরো না, গিলটি মিয়া। যা বলে, করো। এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই এখন।’
সার্চ শুরু করল গীয়ান।
বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রয়েছে গিলটি মিয়া।
রানার সারা শরীর সার্চ করে সরে দাঁড়াল গীয়ান। সিলভিওর দিকে ফিরল।
‘নেই।’
‘এবার ওই লোকটা,’ বলল সিলভিও।
পিস্তলের ইঙ্গিতে মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়াল গিলটি মিয়া। দক্ষ হাতে ওকেও সার্চ করল গীয়ান, তারপর সরে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ল। নেই।
‘এবার সন্তুষ্ট হয়েছ?’ বসে পড়ল রানা। পারলে না, সিলভিও। হেরে গেলে শেষ পর্যন্ত। ওটার কলকাতায় পৌঁছানো আর ঠেকানো গেল না। কালই রওনা হয়ে যাবে ওটা সশস্ত্র প্রহরায়।
‘ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগের কথাটা আমাকে না বললেই ভাল করতে মাসুদ রানা।’ চতুর একটুকরো হাসি খেলে গেল সিলভিওর ঠোঁটে। ‘দাঁড়াও, এখনই তার প্রমাণ দিচ্ছি।’ গীয়ানকে ইঙ্গিত করতেই রিভলভার বের করে তাক করে ধরল সে রানার বুকের দিকে। কোণের টেবিলের উপর রাখা টেলিফোনের দিকে এগিয়ে গেল সিলভিও।
‘ইণ্ডিয়ান কনসুলেট দিন দয়া করে,’ বলল সিলভিও মাউথপিসে। পনেরো সেকেণ্ড চুপচাপ থেকে বলল, ‘ সুকান্ত পালিতকে দিন দয়া করে।’ আবার খানিক চুপ। ‘পালিত? এই কিছুক্ষণ আগে একটা জিনিস দিয়েছে মাসুদ রানা তোমাদের বসের হাতে।’ তিন সেকেণ্ড বিরতি। ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছ! নীল প্লাষ্টিক মোড়া। দেখেছ ওটা তুমি?’ বিরতি। ‘আমি জানি, কলকাতায় যাচ্ছে।’ আবার বিরতি। ‘কি বললে? তোমারই ওপর ভার পড়েছে? ভেরি গুড! শোনো। ওটা আমার দরকার। বুঝতে পেরেছ? আধঘণ্টার মধ্যে আমার হাতে পৌঁছে দিতে হবে ওটা।’ কয়েক সেকেণ্ড বিরতি। হেসে উঠল সিলভিও। ‘অবশ্যই। এ চাকরি তোমার আজই শেষ। কাল থেকে আর যেতে হবে না কনসুলেটে। ঠিক আছে, রাখলাম। আধঘণ্টা পর আমার ওখানে আসছ তুমি।’ রিসিভার নামিয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে ফিরল সিলভিও রানার দিকে। ‘শেষ পর্যন্ত কে হারল, মাসুদ রানা? পালিতের হাতেই ভার দেয়া হয়েছে ওটা ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে ভরে কলকাতা পাঠাবার।’ হাসল তৃপ্তির হাসি। ‘কি লাভ হলো? এত ছোটাছুটি, এত দৌড়ঝাঁপ, এত লোকক্ষয়- কে জিতল শেষ পর্যন্ত?’
রেগে উঠে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল রানা, ওর ঠোঁটের ওপর একটা আঙুল রাখল লুইসা।
‘প্লীজ, রানা! হারজিত তো সব কিছুতেই আছে। সব সময় জিতলে চলে না, মাঝে মাঝে হারতেও হয়। চেষ্টার তো তুমি কোন ত্রুটি করোনি। মেনে নাও। ও ভয়ানক চতুর আর হারামী লোক। তাছাড়া তুমি তো একা, আর ওর হয়ে কাজ করছে হাজারটা লোক। ভয়ঙ্কর সব লোক। তুমি পারবে কেন?’
হাসল সিলভিও। ‘ঠিকই বলেছে লুইসা। মনের মধ্যে রাগ পুষে রাখবেন না, সিনর মাসুদ রানা। একটা ভয়ঙ্কর দুর্ধর্ষ সংস্থার সাথে একা লড়ে আপনি আপনার পাঞ্জার যে জোর দেখিয়েছেন, আমি আজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রাখব সে কথা। চলুন, আপনাকে প্লেনে তুলে দিই এবার।’ অস্ত্র পকেটে পুরল সিলভিও, কিন্তু হাতটা রয়ে গেল পকেটেই। গীয়ানও তাই করল। ‘চলুন। দয়া করে বিদায়ের আগে আর কোন রকম গোলমাল পাকাবার চেষ্টা করবেন না। খেয়াল রাখবেন দুটো পিস্তল আপনাদের দু’জনের হৃৎপিণ্ড লক্ষ্য করে প্রস্তুত আছে সর্বক্ষণ।
‘তুমি আসবে না আমাকে সী অফ করতে?’ জিজ্ঞেস করল রানা লুইসাকে।
‘নিশ্চয়ই!’
দ্রুত পায়ে এগোচ্ছে ওরা টারমাকের উপর দিয়ে প্লেনের উদ্দেশে। রানার কনুই জড়িয়ে ধরেছে লুইসার কনুই। আবার কবে কোথায় দেখা হবে সে ব্যাপারে নিচু গলায় কথা হচ্ছে ওদের মধ্যে।
ছুটে এল একজন সুন্দরী এয়ার হোস্টেস।
‘আপনি সিনর মাসুদ রানা?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি আমরা। উঠে পড়ুন।’
‘যাচ্ছি। উঠে পড়ো, গিলটি মিয়া, আমি আসছি এক্ষুণি।’
তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল গিলটি মিয়া, সিঁড়ির মাথায় গিয়ে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে চাইল রানার দিকে। গেল কোথায় নোট বইটা!
লুইসার দিকে ফিরল রানা। একটা হাত চলে গেল ওর ক্ষীণ কটিতে। কাছে সরে এল লুইসা। আলতো করে ছোট্ট একটা চুমো খেলো রানা ওর ঠোঁটে। বলল, ‘আবার দেখা হবে।’
চোখ দুটো টলটল করে উঠল লুইসার। বলল, ‘ভায়া খণ্ডিওস্, মাই ডার্লিং।’
সান্ত্বনা দেয়ার ভঙ্গিতে বার দুই হাত বুলাল রানা লুইসার বাহুতে, তারপর হঠাৎ ঘুরে তরতর করে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে। শেষ ধাপে উঠে টা-টা করল সবাইকে। ঢুকে গেল ভিতরে।
বন্ধ হয়ে গেল দরজা। সিঁড়ি সরে চলে গেল।
গিলটি মিয়ার দিকে এগোতে গিয়েও থমকে গেল রানা। হাসিমুখে ডাকল ওকে অনিল। তরতাজা হয়ে উঠেছে বিশ্রাম পেয়ে।
‘পাশের সীটটা খালি আছে, রানা। বসে পড়ো।’
একসাথে গর্জে উঠল চারটে এঞ্জিন। রওনা হবে এখুনি। বসে পড়ল রানা।
‘ওরা জানে মারা গেছ তুমি,’ বলল রানা। ‘এসো যাবার আগে ওদের ভূত দেখানো চমকে দেয়া যাক।’
দু’জন চাইল জানালা দিয়ে বাইরে।
আর্ক লাইটের নিচে দাঁড়িয়ে আছে লুইসা, সিলভিও আর গীয়ান। হাত নাড়ল রানা।
রানার পাশের মুখটা দেখেই আঁৎকে উঠল ওরা তিনজন। হাঁ হয়ে গেছে ওদের মুখ, বিস্ফারিত তিন জোড়া চোখ। ধীরে ধীরে নড়তে শুরু করল প্লেনটা। শেষ চমক দিয়ে দিল রানা ওদের। পকেট থেকে ছোট্ট একটা লাল নোটবই বেরিয়ে এল, সেটা নেড়ে টা-টা করল ওদের।
মুহূর্তে বুঝতে পারল ওরা, মস্ত ধোঁকা দিয়েছে রানা, কনসুলেটে জমা দেয়নি, নোটবইটা সাথে নিয়েই চলে যাচ্ছে সে। ঠেকাবার কোন রাস্তা নেই আর।
হতাশা, বিক্ষোভ, ক্রোধ, প্রতিহিংসা, এবং পরাজয়- সবগুলো ভাবের খেলা দেখতে পেল রানা সিলভিওর মুখে। নিজের অজান্তেই কয়েক পা দৌড়ে এল সিলভিও প্লেনের সাথে সাথে, তারপর দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল টারমাকের উপর।
রানওয়ের দিকে ছুটল প্লেনটা।