বিদেশী গুপ্তচর – ২.১

এক

মার্সোরিয়ার ক্লক টাওয়ারে ব্রোঞ্জের দুটো দৈত্যের মূর্তি ঢং ঢং পিটিয়ে চলেছে প্রকাণ্ড ঘণ্টা। রাত বারোটা।

সান জাকারিয়া ভেপোরেটি স্টেশনে ল্যাণ্ডিং স্টেজে গনডোলাটা বেঁধে রেখে দ্রুতপায়ে হাঁটছে ওরা ওস্তাদের কোয়ার্টারের দিকে। বার বার পিছু ফিরে, অন্ধকার গলিতে মোড় ঘুরেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে নিশ্চিন্ত হয়েছে ওরা, কেউ অনুসরণ করছে না ওদের।

পথ চলতে চলতে দাড়ি গোঁফ খসিয়ে ফেলল রানা, এখন আর দরকার নেই ওসবের। চিনে ফেলেছে ওরা ওকে। এবার যা হবে সামনা-সামনিই হোক, পুলিসের হাতে ধরা পড়ে ছদ্মবেশের কৈফিয়ৎ দিতে চায় না ও আর। কেন যেন রানার মনে হচ্ছে, ওরা এবার পুলিসের সাহায্য নেবে। মহা বিপদে ফেলে দিতে পারে ওরা যদি পুলিসের সাথে লাইন থাকে।

দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ। টোকা দিতেই ভারি কর্কশ কণ্ঠে প্রশ্ন এল, ‘কে? কি চাই?’

‘আমরা, ওস্তাদ,’ বাতিস্তা বলল। ‘দরজা খুলুন।

‘উঁহুঁ। এই জানালার পাশে এসে দাঁড়াও। চেহারা না দেখে খুলছি না।’

প্রমাদ গুণল রানা। আসল চেহারায় চিনবে না ওকে ওস্তাদ। তবু গিয়ে দাঁড়াল জানালার পাশে।

‘একটাকে চিনলাম, কিন্তু এটাকে আবার কোত্থেকে জোটালে? দেখলে মনে হয় খুনী! আমার আসল সাগরেদ কোথায়?’

‘আসল সাগরেদ আবার কে?’ অবাক হলো বাতিস্তা।

‘আরে ক্যাপ্টেন। সেই দারুণ ছেলেটা। কি নাম যেন…’

‘ইনিই সিনর মাসুদ রানা, ওস্তাদ। দরজা খুলুন। ছদ্মবেশ খুলে ফেলেছেন।’

বিস্ফারিত চোখে রানাকে দেখল পাগলা ওস্তাদ।

‘আরে! এ দেখছি মুহূর্তে মুহূর্তে ভোল পাল্টাচ্ছে। তাজ্জব কারবার! কোন্ ইয়ারে পাস করেছ?’

দরজা খুলে দিতেই ঘরে ঢুকে পড়ল ওরা, ছিটকিনি তুলে দেয়া হলো আবার।

‘কেমন আছে অনিল?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘যেমন ছিল তেমনি। তবে শিগগিরই ভাল হয়ে উঠবে। আউন্স দুয়েক ব্র্যাণ্ডি খাইয়ে দিয়েছি। আমার মনে হয় যত্নের অভাবে এই হাল হয়েছে ছেলেটার, খানিক আদর-যত্ন পেলেই ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তার দেখানো দরকার।’ হঠাৎ খেয়াল করল ওস্তাদ ওদের ভেজা জামা কাপড়। ‘আরে! দু’জনেই দেখছি চুপচুপে হয়ে ভিজে এসেছ। ছেড়ে ফেলো, কাপড় ছেড়ে ফেলো। পাশের ঘরে উনুনে দিলে শুকিয়ে যাবে দশ মিনিটে।

আলমারি থেকে দুটো বেড কাভার বের করে ছুঁড়ে দিল ওস্তাদ ওদের দিকে। খপ করে একটা শূন্যে ধরে খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়াল রানা। মড়ার মত পড়ে আছে অনিল। গলা পর্যন্ত কম্বল দিয়ে ঢাকা। পাল্স্ পরীক্ষা করল রানা। আগের চেয়ে কিছুটা ভাল, কিন্তু খুবই দুর্বল। ভরসা পেল না রানা। একে নিয়ে কি করে কলকাতায় ফিরবে সে?

কাপড় ছাড়তে শুরু করল রানা। পাশের ঘর থেকে তিনজনের জন্যে তিন কাপ গরম কফি নিয়ে এল ওস্তাদ। বাষ্প উঠছে। ওদিকে একবার চেয়েই জিভে পানি এসে গেল রানার। আর ওস্তাদের জিভে পানি এসে গেল রানার পেটা শরীরের দিকে একবার নজর বুলিয়ে।

‘বাহ, বড় সুন্দর ফিগার তো হে তোমার! কোন্ ইয়ারে পাস করেছ?’ ট্রেটা নামিয়ে রেখে এগিয়ে এল ওস্তাদ, রানার বাইসেপ, চেস্ট, থাই আর কাফ মাল্‌ টিপে দেখল, কয়েক পা দূরে সরে গিয়ে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখল আপাদমস্তক, তারপর বলল, ‘এত ব্যাল্যান্সড্ ফিগার সহজে চোখে পড়ে না। তিন বছর আগে এসেছিল একটা ছাত্র, মাত্র গড়ে তুলতে শুরু করেছিলাম, এমন সময় বদলি হয়ে চলে গেল ওর বাপ মিলানোতে। এমন রাগ লেগেছিল আমার। এত করে বললাম… যাকগে, কেউ কোথাও চোট পেয়েছ? মালিশ বা ম্যাসেজ লাগবে?’

‘আমার লাগবে ওস্তাদ,’ বলল বাতিস্তা। ‘পিঠে।’

‘কফিটা খেয়ে নাও, দিচ্ছি ঠিক করে।’

তাকের উপর থেকে একটা মলমের কৌটা পেড়ে এনে রাখল ওস্তাদ টেবিলে। রানার দিকে ফিরল।

‘এবার কি করবে, ক্যাপ্টেন? একে নিয়ে কি করা যায়?’ অনিলের দিকে ইঙ্গিত করল ওস্তাদ।

‘একে নিয়ে কলকাতায় ফিরে যেতে চাই। আগামীকাল সন্ধের আগে অ্যালিটালিয়ার কোন ফ্লাইট নেই, ভাবছি সম্ভব হলে একটা প্লেন চার্টার করব।’ কফির কাপে চুমুক দিল রানা।

‘যাই করো, একে নিয়ে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পৌঁছতে হবে তোমাকে। সেটা সহজ হবে না। যতদূর বোঝা গেল, যেমন ভাবে পারে বাধা দেবে শয়তানগুলো। ওদের লোকজনও দেখলাম প্রচুর। আমার সব সাগরেদকে ডেকে পাঠাব কিনা ভাবছি। তিন হাজার সাগরেদ এসে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে আমি একটা ডাক দিলে ‘

‘তার দরকার নেই, ওস্তাদ।’ হাসল রানা। ‘আপনার পুরানো সাগরেদদের মধ্যে খুব বড়লোক কেউ আছে?’

‘অনেক আছে। কেন?’

ভেজা কাপড়গুলো শুকোতে দিয়ে ফিরে এসে বসল বাতিস্তা রানার পাশে। একটা কফির কাপ তুলে নিল।

‘তাদের মধ্যে কারও মোটরবোট আছে?’

ছাতের দিকে চেয়ে এক সেকেণ্ড চিন্তা করল পাগলা ওস্তাদ। তারপর বলল, ‘আছে। কেন?’

‘আপনি চাইলে দু’দিনের জন্যে পাওয়া যাবে বোটটা?’

‘আমি চাইলে ধন্য হয়ে যাবে ম্যারিয়ানো। তোমার লাগবে? বোটে করে লিডো যেতে চাইছ? চিন্তা নেই, যখন বলবে তখনই জোগাড় করে দিতে পারব মোটরবোট। কখন লাগবে তোমার?’

‘আগে এর অবস্থাটা ভাল করে বুঝে নেয়া দরকার,’ বলল রানা অনিলকে দেখিয়ে। ‘বিশ্বাস করা যায় এমন কোন ডাক্তার আছে আপনার চেনাজানা?’

মাথা ঝাঁকাল ওস্তাদ। ‘আছে। ডক্টর ভিসকন্টিকে ডেকে আনা যায়। ইউনিভার্সিটির ডাক্তার। একটু বেশি বুড়ো, কিন্তু লোক ভাল। কাছেই থাকে, বেশি দূরে না, ডেকে আনা দরকার?’

‘ডাকলে ভাল হয়।’

‘ঠিক আছে, বাতিস্তার পিঠটা ঠিক করে দিয়েই ডেকে আনছি।’ মৃদু চাপড় দিল বাতিস্তার পিঠে। ‘শুয়ে পড়ো হে, ছোকরা। কি শরীর বানিয়েছ যে ব্যথা লাগে? শুয়ে পড়ো।’

মেঝের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল বাতিস্তা। কৌটো থেকে মলম বের করে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল ওস্তাদ ওর পিঠের উপর। হুম-হাম শব্দ হলো কিছুক্ষণ, তারপর হাফপ্যান্টের পিছনে দুই হাত মুছে নিয়ে উঠে দাঁড়াল ওস্তাদ। উঠে বসে হাত-পা ঝাড়া দিল বাতিস্তা, পিঠ বাঁকিয়ে পরীক্ষা করল ব্যথাটা আছে কিনা, তারপর হাসল।

‘ওস্তাদের হাতে জাদু আছে। গুণ না থাকলে কি আর এতগুলো ছেলে ওস্তাদ বলতেই একেবারে অজ্ঞান হয়ে যায়? ব্যথাটা একেবারে গায়েব।’

‘হয়েছে, হয়েছে। আর তেল মারতে হবে না। দরজা লাগিয়ে চুপচাপ বসে থাকো। সাবধানে থাকবে। আর, কেউ দরজায় টোকা দিলেই হুট করে খুলবে না। বুঝেছ?’

বেরিয়ে গেল পাগলা ওস্তাদ। দরজা লাগিয়ে দিয়ে আবার একবার অনিলের পাস্ দেখল রানা। দুশ্চিন্তা ফুটে উঠল ওর চোখেমুখে। ওয়াটারপ্রুফ সিগারেট কেস থেকে সিগারেট বের করে ধরাল, বসল খাটের কিনারে। বাতিস্তা বসল একটা চেয়ারে।

‘সিনর চ্যাটার্জীর ওপর নির্যাতন করা হচ্ছিল ওই বাড়িতে,’ যেন কথার কথা বলছে এমনিভাবে বলল বাতিস্তা। ‘তার মানে, যা জানতে চায়, জুলির ওপর নির্যাতন করে সেটা জানতে পারেনি ওরা। কিন্তু কি জানতে চায়? কি এমন তথ্য আছে এর কাছে যেটা ওদের না পেলেই নয়? এতখানি মরিয়া হয়ে উঠেছে কেন ওরা?’

‘এর উত্তর আমার জানা নেই, বাতিস্তা। তবে মনে হচ্ছে শিগগিরই জানতে পারব।’

কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই চোখ মেলল অনিল। সোজা চেয়ে আছে রানার মুখের দিকে। স্থির দৃষ্টি। কেমন যেন শিরশির করে উঠল রানার শিরদাঁড়ায়। ভাবলেশহীন, প্রাণহীন, চকচকে, স্থির দৃষ্টি। মনে হচ্ছে মরা মানুষের চোখ। ঠোঁট দুটো একটু কাঁপল অনিলের, মাথাটা একপাশে ফিরল কিছুটা।

‘অনিল! আমি রানা। মাসুদ রানা। শুনতে পাচ্ছ? আমি মাসুদ রানা।’

খুব ধীরে ধীরে রানার দিকে ফিরল অনিল। প্রাণহীন দৃষ্টিটা পার হয়ে গেল রানার মুখ, দেখতে পেল না রানাকে।

‘অনিল! তুমি এখন নিরাপদ। আর কোন ভয় নেই। গলার স্বর আর একটু চড়িয়ে দিল রানা। ‘কোন ভয় নেই। আমি রানা। চিনতে পারছ?’

অনিলের সারা শরীর শিউরে উঠল একবার। হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠল ওর চোখ দুটো। রানার মুখের উপর নিবদ্ধ হলো ওর দৃষ্টি।

‘কোন চিন্তা নেই, অনিল। কোন ভয় নেই। কথা বোলো না এখন, নিশ্চিন্তে ঘুমাও। ডাক্তার আসছে, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

ব্র্যাণ্ডি মিশানো দুধের বাটিটা নিয়ে এল বাতিস্তা। মাথাটা একটু উঁচু করে ধরল রানা, কয়েক চামচ দুধ খাওয়াল ওকে বাতিস্তা। চোখ বন্ধ করতেই বোঝা গেল আর খাবে না। মাথাটা বালিশের উপর নামিয়ে দিল রানা।

রক্তশূন্য মুখটা কুঁচকে কুঁচকে উঠছে থেকে থেকে।

উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে রানা ও বাতিস্তা ওর মুখের দিকে। মিনিট পাঁচেক পর আবার চোখ মেলল অনিল, রানাকে খুঁজে পেয়ে স্থির হলো ওর দৃষ্টিটা রানার মুখে। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না যেন অনিল। ওর বুকের ওপর হাত রাখল রানা আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে।

‘আমার সামনে জুলিকে ওরা…জুলিকে…’ গলাটা ভেঙে গেল অনিলের। যেন নালিশ জানাচ্ছে রানার কাছে। চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এল। টপ টপ ঝরছে বালিশের উপর।

‘এখন কথা বোলো না, অনিল। যা হবার হয়ে গেছে, ওসব নিয়ে ভেবো না এখন। চুপচাপ বিশ্রাম নাও।’

আবার ঠোঁট নড়ল অনিলের। কি বলছে বোঝা গেল না। ওর মুখের কাছে কান নিয়ে গেল রানা। শুনতে পেল, ফিস ফিস করে অনিল বলছে, ‘মরে যাচ্ছি, কিন্তু…তার আগে…আগে…’

‘মরার কথা ভুলে যাও অনিল। ওই বাড়ি থেকে বের করে এনেছি তোমাকে আমরা। আর কোন ভয় নেই। মরবে না তুমি। তোমার মায়ের লেখা একটা চিঠি আছে আমার কাছে, একটু ভাল হয়ে উঠলেই দেব তোমাকে। এ যাত্রায় আর মরণ নেই তোমার। আমি ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে কলকাতায়।’

‘পারবে না।’ দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল অনিল। ‘ওরা…ওরা ভয়ানক – শোনো, রানা…’ ক্রমে দুর্বলতর হচ্ছে অনিলের কণ্ঠস্বর। সামনে ঝুঁকে প্রায় ওর ঠোঁটের কাছে কান ঠেকাল রানা। কি বলল বোঝা গেল না, শুধু দুটো শব্দ শুনতে পেল সে, ‘ডি ফ্যাবোরি…মন্দির…’

‘কি বললে? অনিল, কি বললে?’

আরও কি যেন বলবার চেষ্টা করল অনিল, কিন্তু ঠোঁট দুটো নড়ল কেবল, কোন রকম শব্দ বেরোল না গলা দিয়ে। এইটুকু পরিশ্রমেই বুজে এল চোখ, ক্লান্তি ও দুর্বলতায় জ্ঞান হারাল আবার।

সোজা হয়ে বসল রানা।

‘কি যেন বলবার চেষ্টা করছিল অনিল,’ প্রায় আপন মনে বলল রানা। ‘কি বলতে চাইছিল ও? দুটো মাত্র কথা। ডি ফ্যাবোরি, আর মন্দির। কি বোঝায় এতে? ডি ফ্যাবোরি বলে একটা জায়গা আছে জানি…’

‘ভার্জিন মাদারের একটা মন্দিরও আছে ওখানে,’ বলল বাতিস্তা।

‘ঠিক বলেছ!’ উৎসাহিত হয়ে উঠল রানা। ‘কিন্তু…তাতে কি বোঝায়? কি বলতে চাইছিল ও?’

ঠক ঠক ঠক! টোকা পড়ল দরজায়।

‘কে?’ উঠে গিয়ে জিজ্ঞেস করল বাতিস্তা। ‘জানালার কাছে এসে দাঁড়ান।’

ভাল মত পরীক্ষা করে দেখে নিয়ে দরজা খুলে দিল বাতিস্তা। ওস্তাদের পিছন পিছন ঘরে ঢুকল শুকনো, খিটখিটে চেহারার প্রবীণ এক লোক। তোবড়ানো গালে বয়সের ভাঁজ।

‘ইনি ডক্টর ভিসকন্টি,’ বলল ওস্তাদ।

উঠে দাঁড়াল রানা। ‘আমি মাসুদ রানা।’ হাত বাড়িয়ে হ্যাণ্ডশেক করল। ‘আমার এক বন্ধু গুরুতর অসুস্থ। একটা দলের সাথে গোলমাল বেধেছিল ওর। বিস্তারিত সবকিছু জানি না আমি, গোলমালটা রাজনৈতিকও হতে পারে। ওকে গুলি করে জখম করা হয়েছে। তার ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। ব্যাপারটা গোপনীয়। কাজেই আপনার এই ব্যাপারে মুখ বন্ধ রাখতে হবে।’

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রানার দিকে চাইল ভিসকন্টি। ঘন ভুরু জোড়া কুঁচকানো।

‘আমার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়, সিনর। আপনার বন্ধু যদি জখম হয়ে থাকে, আমার কর্তব্য হচ্ছে পুলিসে জানানো। পুলিসে খবর দিতেই হবে আমাকে।’

‘কিন্তু আমার বন্ধু ভারতীয়। ইটালিয়ান পুলিসের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। ইণ্ডিয়ান হাই কমিশনে জানানো হবে ব্যাপারটা।’

কাঁধ ঝাঁকাল ডক্টর ভিসকন্টি।

‘তবু পুলিসে জানানোই আমাদের নিয়ম। তবে আপনার বন্ধু যদি ভারতীয় হন, সেক্ষেত্রে আমি চেপে যেতে পারি বিদেশী বলে। যাই হোক, রুগীকে দেখা যাক আগে।’

এক মিনিট পরীক্ষা করেই উঠে দাঁড়াল ডাক্তার। গম্ভীর মুখে কাঁধ পর্যন্ত ঢেকে দিল অনিলকে কম্বল দিয়ে।

‘এর অবস্থা খুবই খারাপ। এক্ষুণি হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার। অ্যাকিউট নিউমোনিয়া হয়ে গেছে, তাছাড়া এক্সপোজার ও শক লেগেছে ভয়ানক। গোপনীয়তার কোন উপায় নেই।’

‘এখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায় না?’ বলল রানা। ‘খরচের জন্যে ভাববেন না। হাসপাতালে না নিয়ে যদি ওকে সুস্থ…’

মাথা নাড়ল ডাক্তার।

‘মারা যাবে তাহলে। এক্ষুণি হাসপাতালে নেয়া দরকার। ওখানে উপযুক্ত যন্ত্রপাতি আছে। আধ ঘণ্টার মধ্যে অক্সিজেন টেন্টে না রাখলে বাঁচানো যাবে না একে।’

বাতিস্তার দিকে ফিরল রানা।

‘ঠিক আছে। তুমিও যাবে অনিলের সাথে হাসপাতালে। এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করবে না ওকে। আমি ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে আসছি হাসপাতালে। কয়েকটা কাজ সেরেই আমি চলে আসব, তখন তোমার ছুটি।’

‘অলরাইট, সিনর।’

একটু উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে চাইল ডাক্তার রানার দিকে। ‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে ভদ্রলোক এখনও বিপদমুক্ত নন। ব্যাপারটা পুলিসে জানালেই কি ভাল হত না?’

‘তার আগে আমি ভারতীয় হাই কমিশনারের সঙ্গে কথা বলতে চাই। একে হাসপাতালে নেয়ার কি ব্যবস্থা?’

‘আপনারা যদি ওকে বয়ে নিয়ে গনডোলায় তুলতে পারতেন তাহলে সবচেয়ে ভাল হত। আমি স্ট্রেচারের ব্যবস্থা করতে পারি, কিন্তু এখন সময়ের অনেক দাম। যত তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নেয়া যায়…’

‘আমি কোলে করে নিয়ে যাব ওকে। গনডোলাও রেডি, কোন অসুবিধে হবে না।’

‘বেশ। তাহলে রওয়ানা হওয়া যাক। আমি একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ি, এর জন্যে কেবিনের ব্যবস্থা করে ফেলি গিয়ে। আপনারা আসুন।’ ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম করল ডাক্তার।

ডাক্তারের বাহুতে একটা হাত রাখল রানা। ‘বুলেটটা ভিতরে রয়ে গেছে, না বের করে ফেলা হয়েছে?’

‘সেটা হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে বলা যাবে।’

‘জখমে কি গ্যাংগ্রিনের আভাস পেলেন?’

‘সেই জন্যেই তো এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছি।’

‘বাঁচবে বলে মনে হয়?’

‘চেষ্টার তো ত্রুটি করব না। কিন্তু এখন অনেকখানি নির্ভর করে রুগীর স্ট্যামিনার ওপর। বাঁচবেই, একথা জোর দিয়ে বলা যায় না, তবে চান্স আছে।’

‘আপনার সাথে আমাদের কারও যাওয়ার প্রয়োজন আছে?’

‘না। তার দরকার নেই। আমি সব ব্যবস্থা করে রাখি গিয়ে, আপনারা আসুন।

দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল ডাক্তার ভিসকন্টি। দরজা বন্ধ করে ফিরে এসে ওস্তাদের কাঁধে হাত রাখল রানা।

অনিলকে কোলে তুলে নেয়ার ব্যবস্থা করছিল ওস্তাদ, চমকে চাইল রানার দিকে।

ইশারায় পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে গেল রানা ওস্তাদ এবং বাতিস্তাকে। ফিস ফিস করে বলল, ‘ভুলটা আমারই হয়েছে। ডাক্তার ডাকা উচিত হয়নি।’

‘কেন?’ চোখ কপালে উঠল ওস্তাদের।

‘আপনি নিজে কয়েকটা ব্যাপার পরীক্ষা করে দেখে আসুন পাশের ঘর থেকে, তারপর ব্যাখ্যা দেব।

এদিকের ঘরে এসে অনিলের পালস্ পরীক্ষা করল ওস্তাদ, কাঁধের জখমটা শুঁকে দেখল ব্যাণ্ডেজের কাছে নাক ঠেকিয়ে, বুকে কান ঠেকিয়ে শুনল শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ, ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল তার মুখের চেহারা। ফিরে এসে কটমট করে চাইল রানার দিকে।

‘ব্যাটা থাকতে থাকতেই কথাটা বলনি কেন? এক কিলে হারামজাদার মাথাটা ভেঙে দিতাম আমি।’

দ্রুতহাতে কাপড় পরছে রানা ও বাতিস্তা।

‘শেষ মুহূর্তে সন্দেহটা হলো আমার,’ বলল রানা। ‘আমরা পুলিসে জানাব না শুনে স্বস্তির ভাব ফুটে উঠল ওর মুখে। তাই দেখেই শেষের কয়েকটা প্রশ্ন করলাম। নিজেই তো দেখলেন, গ্যাংগ্রিন-নিউমোনিয়া, সব বাজে কথা। সিলভিওর আদেশে আগাগোড়া মিথ্যে কথা বলছে ডাক্তার।

পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল ওস্তাদ। কঠোর হয়ে উঠেছে মুখের চেহারা। কথা বলেই চলল রানা।

‘আমার যতদূর বিশ্বাস হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছতে পারব না আমরা। তার আগেই আসবে আক্রমণ। খুব সম্ভব গনডোলার ওপর আক্রমণ করবে ওরা। তবু যেতে হবে আপনাদের।’

‘আর অনিল?’

‘বাঁচতে হলে আগে মরতে হবে ওকে। আশে পাশে কোথাও ওকে দু’চারদিন রাখার মত কোন জায়গা আছে?’

‘আছে।’

‘তাহলে শুনুন মন দিয়ে। তুমিও শোনো, বাতিস্তা…’ সংক্ষেপে প্ল্যানটা বুঝিয়ে দিল রানা ওদের। একটানা তিন মিনিট কথা বলে থামল।

‘আর ওর চিকিৎসার কি হবে?’ প্রশ্ন করল ওস্তাদ। ‘আগামীকাল দুপুরের মধ্যে লাইন ক্লিয়ার করে দেব আমি। চিকিৎসার কোন অসুবিধে থাকবে না আর। অবশ্য আমার ধারণা, দু’দিন বিশ্রাম পেলে অনেক ভাল হয়ে যাবে ও এমনিতেই। ডক্টর ভিসকন্টির ওপর রাগ করে লাভ নেই, ওস্তাদ, ওদের সাহায্য না করে উপায় নেই ওর, প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়ে যেত তাহলে। সব ডাক্তারের একই অবস্থা। কিন্তু কাল দুপুরের পর রিপোর্ট করার লোক পাবে না ওরা ভেনিসে।

‘বেশ। তোমার সাথে কোথায় দেখা হচ্ছে আমাদের?’ জিজ্ঞেস করল ওস্তাদ।

‘আমার সাথে দেখা করবেন ডেলা টলেটা প্যালাযোতে। লাইবেরিয়া ভেচিয়ার কাছে। একশো বাহাত্তর নম্বর। ওখানেই পরবর্তী প্রোগ্রাম ঠিক করা যাবে।’

‘আর আক্রমণ না এলে?’ হাসল বাতিস্তা। ‘তাহলে কি বোঁচকা নিয়ে খামোকা হাসপাতালে গিয়ে হাজির হব?’

‘আক্রমণ আসবেই। কিন্তু সাবধান! দেখো, ধরা পড়ো না আবার। তাহলে সব কিছু গোলমাল হয়ে যাবে।’

আর কথা না বাড়িয়ে নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় আলাপ করে বেরিয়ে পড়ল ওস্তাদ অনিল আর বাতিস্তাকে নিয়ে বাড়ির পেছন দরজা দিয়ে। আগাগোড়া প্ল্যানটা মনের মধ্যে নেড়েচেড়ে দেখে সন্তুষ্ট হয়ে লাইট নিভিয়ে বেরিয়ে গেল রানা সামনের দরজা দিয়ে। চারপাশে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে দ্রুত পায়ে এগোল ডি ফ্যাবোরির দিকে।

এত রাতেও ডি ফ্যাবোরি জনাকীর্ণ। মনটা দমে গেল রানার। একদল আমেরিকান ট্যুরিস্ট হাঁটছে ঢিমে তেতালা ছন্দে, হাউ বিউটিফুল, হাউ নাইস, হাউ ডিলাইটফুল বলতে বলতে। তাদের বেশ কিছুটা পিছনে হাঁটছে তিনজন বয়স্কা মহিলা একজন বয়স্ক গাইডের অনর্গল বক্তৃতা শুনতে শুনতে। তারও গজ দশেক পিছনে হাঁটছে একজোড়া নব দম্পতি- খুব সম্ভব হানিমুনে এসেছে। এত লোকের মধ্যে ভাল করে পরীক্ষা করা যাবে না দেয়াল-মন্দিরটা।

একটা থামের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল রানা। লোকজন একটু হালকা হোক।

মন্দিরের কথাটা বলল কেন অনিল? ও কি ওখানে কোন মেসেজ লুকিয়ে রেখেছে? কিংবা কোন জিনিস? মন্দিরের সাথে ওর এই নিখোঁজ হওয়ার কি সম্পর্ক? মন্দিরের কথাটা সজ্ঞানে বলেছিল অনিল, নাকি প্রলাপ বকছিল তখন? কি আছে ওখানে?

পিছন ফিরে চাইল রানা। নতুন কোন ট্যুরিস্ট নেই। সান মার্কোর পিছন দিকটা দেখা যাচ্ছে। মন্দিরটা রিয়াল্টো ব্রিজের কাছাকাছি, জানে রানা। সামনের লোকজন বেশ কিছুটা এগিয়ে যেতেই ধীর পায়ে চলতে শুরু করল। বেশ কিছুদূর এগিয়ে আবার থামল একটা অন্ধকার ছায়ায়। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে মন্দিরটা। একটা ম্লান আলো জ্বলছে দেয়ালের গায়ে। আমেরিকানদের দলটা থেমে দাঁড়িয়ে মিনিট তিনেক হাউ নাইস, হাউ এনচ্যানটিং-এর পর আবার হাঁটতে থাকল সামনের দিকে। প্রবীণ দলটাও বেশি দেরি করল না। কিন্তু নব-দম্পতি প্রেমে পড়ে গেল মন্দিরটার। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে ওরা, নড়বার কোন লক্ষণই নেই।

‘কি অপূর্ব! তাই না?’

‘সত্যি!’ মেয়েটার কোমর জড়িয়ে ধরল ছেলেটা। ঠিক তোমার মত।’

ছেলেটার চোখে চোখ রাখল মেয়েটা। বিভোর হয়ে গেল দু’জন দু’জনাতে।

‘দশ বছর পর একথা বলবে?’ আহ্লাদী ভঙ্গিতে ঘাড় কাৎ‍ করল মেয়েটা।

ঝেড়ে গাল দিল রানা ওদের মনে মনে। কিন্তু তাতে এতটুকু বিচলিত হলো না ওদের মুগ্ধ বিস্ময়। আসলে দর্শনীয় বস্তু দেখতে আসেনি ওরা, আবিষ্কার করছে একে অপরকে নিবিড় ভাবে, টুকরো কথায়।

‘বলব, চেরি। কিন্তু তোমার কি ভাল লাগবে তখন এসব শুনতে? কাচ্চা-বাচ্চা, ক্যাও ম্যাও নিয়ে পাগল হয়ে থাকবে তুমি, আমাকে দেখলেই হয়তো খ্যাঁক করে উঠতে ইচ্ছে করবে তখন তোমার।’

‘যাহ্, কক্ষনো না। আমি ওরকম হব না কোনদিনই।’

হাসল ওরা পরস্পরের দিকে চেয়ে, গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে চুমো খেল।

ওদের ছেড়ে ওদের বাপ-মাকে ধরল রানা এবার। অসহিষ্ণু ভাবে একবার এ পা, একবার ও পায়ের উপর ভর দিয়ে অপেক্ষা করছে সে। বিড় বিড় করে অনর্গল খিস্তি বেরোচ্ছে ওর মুখ থেকে। খুব সম্ভব টনক নড়ল এতে ছোকরার স্বর্গীয় পিতার, কিংবা রানার কাশির শব্দ শুনতে পেল সে, শুভ বুদ্ধির উদয় হলো ওর মধ্যে। ততক্ষণে সশব্দে পা ফেলে এগোতে শুরু করেছে রানা। পিছন ফিরে রানার দিকে একবার চেয়ে মৃদু টান দিল মেয়েটার কোমরে।

‘চলো এগোই, চেরি। খিদেয় নাড়িভুঁড়ি জ্বলছে। সামনের কোন রেস্তোরাঁয় খেয়ে নেয়া যাক।’

হাঁপ ছেড়ে বাঁচল রানা। চলে যাচ্ছে নব দম্পতি। দ্রুত পা ফেলে চলে এল সে মন্দিরটার কাছে।

কিছুই মাথায় ঢুকল না রানার। দেয়ালের গায়ে ছোট একটা গর্ত। মোটা শিকের গরাদ দিয়ে ভিতরটা সুরক্ষিত। ভিতরে ভার্জিন মেরির ছোট্ট একটা মূর্তি। মূর্তির সামনে ফুলদানীতে প্লাস্টিকের আর্টিফিশিয়াল ফুল সাজানো। পাশেই জ্বলছে একটা প্রদীপ।

ছোট্ট মন্দিরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল রানা। কিন্তু অনিলের সাথে মন্দিরের কিভাবে কি সম্পর্কে থাকতে পারে মাথায় এল না ওর। হতাশ হলো যারপর নাই।

ফিরে যাচ্ছিল রানা, দু’পা এগিয়ে থেমে দাঁড়াল ভুরু কুঁচকে। কিছু নিশ্চয়ই আছে। এমন ভাবে কথাটা বলেছিল অনিল যেন মৃত্যুর আগে শেষ মেসেজ দিয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই কিছু একটা নজর এড়িয়ে যাচ্ছে ওর। অনিলের মন্দিরের কথা উচ্চারণ অর্থহীন হতেই পারে না। আবার দেয়ালের ফোকরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল রানা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইল সে প্রত্যেকটা জিনিসের দিকে। তারপর গরাদের ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিল ডান হাতটা। কনুই পর্যন্ত ঢুকে আটকে গেল হাত। বহুকষ্টে ঠেলেঠুলে আরও কিছুদূর ঢুকাল সে হাত, তারপর ফুলদানীটা কাত করল এদিকে।

ফুল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না রানা সেখানে। তবু কাছে টেনে আনল সে ফুলদানীটা। যদি কিছু লুকিয়ে রাখা হয়ে থাকে এখানে, তাহলে সেটা এই ফুলদানীর মধ্যেই থাকবে।

ফুলগুলো বের করে পাথরের মেঝেতে নামিয়ে রাখল রানা। তারপর হাত ঢোকাল ফুলদানীর সরু গর্তের ভিতর। কি যেন ঠেকল হাতে। কিছু একটা জিনিস গুঁজে রাখা আছে নিচের দিকের সরু ফোকরে। দুই আঙুলে ধরে সাবধানে বের করে আনল রানা জিনিসটা। ছোট্ট একটা প্যাকেট। নীল প্লাস্টিক দিয়ে মোড়া।

ফুলগুলো আবার যথাস্থানে রাখতে গিয়েও নিজের অজান্তেই পিছন ফিরে চাইল রানা।

দ্রুতপায়ে আসছে দু’জন লোক। একজনের পরনে সাদা স্যুট, সাদা হ্যাট। ওডি!

সরু গরাদের ফাঁক দিয়ে হাতটা টেনে বের করতে গিয়ে ছড়ে গেল খানিকটা, কিন্তু ব্যস্ততার জন্যে টেরও পেল না রানা। সরে এল দেয়ালের ফোকরের কাছ থেকে।

দৌড়াতে শুরু করেছে ওড্ডি। ওর সাথের লোকটাকেও চিনতে পারল রানা। হয় পপিনি, নয় ওর দলের বাকি দু’জনের একজন। গালে একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন। ওডির পিছনে পিছনে দৌড়াতে শুরু করল সেও।

ঝট করে ঘুরেই ছুটতে শুরু করল রানা। পঞ্চাশ গজ দৌড়ে প্রথম ডানদিকের গলিটায় মোড় নিল সে। বিশ গজ পরেই গ্র্যাণ্ড ক্যানাল। ক্যানালের তীর ঘেঁষে চলে গেছে চওড়া একটা রাস্তা। গলি মুখে এসে দৌড়ের গতি কমিয়ে দিল রানা। বড় রাস্তায় পড়েই দেখতে পেল কয়েক গজ দূরে ধীর পায়ে হাঁটছে বেশ বড়সড় একটা ট্যুরিস্টের দল। নিশ্চিন্তে ঢুকে পড়ল সেই দলে।

আলগোছে বুক পকেটে রেখে দিল রানা প্যাকেটটা। তারপর এঁকে বেঁকে ঢুকে গেল দলের ঠিক মাঝখানটায়। এই মুহূর্তে ওকে আক্রমণ করা সম্ভব নয় ওড্ডির পক্ষে, জানে রানা, কিন্তু সহজে পিছন ছাড়বে বলেও মনে হয় না। নিশ্চয়ই ওরাও ঢুকে পড়েছে এই ট্যুরিস্টের ভিড়ে।

ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে চাইল রানা।

ঠিক পাঁচ ফুট পিছনে রয়েছে ওড্ডি। চোখে চোখে চাইল দু’জন। মধুর একটা হাসি ফুটে উঠল রানার ঠোঁটে। মাথা ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি খবর? কেমন আছেন? ভালো তো?’

ভুরু কুঁচকে কটমট করে চেয়ে রইল ওড্ডি রানার চোখের দিকে। ধ্বক ধ্বক করে জ্বলছে ওর চোখ প্রতিহিংসায়। কোন উত্তর দিল না।

ভিড়ের নিরাপত্তায় গা ভাসিয়ে দিল রানা। ধীর পায়ে হেঁটে চলেছে প্যালাযো ডেলা টলেটার দিকে। নিজেকে ভাগ্যবান মনে করল রানা। একবার বাসায় পৌঁছতে পারলে ওকে বাগে পাওয়া সহজ হবে না এদের পক্ষে। বেশ কিছুদূর হেঁটে আবার পিছু ফিরে চাইল সে।

আছে। ধৈর্যের সাথে ওকে অনুসরণ করে চলেছে। দূরত্ব কমাবার চেষ্টা করছে না।

সান মার্কো পিয়াযার দিকে চলেছে পুরো দলটা। বাসার কাছাকাছি এসেই দ্রুততর করল রানা চলার গতি। সেই সাথে বাঁয়ে কাটতে শুরু করল। ঠেলে ধাক্কিয়ে বামে কাটছে, আর অনবরত ক্ষমা চাইছে সে। হঠাৎ ভিড় থেকে বেরিয়ে পড়ল রানা, বেরিয়েই পেয়ে গেল ওর বাসায় ঢোকার সিঁড়ি। দ্রুতপায়ে উঠে গেল সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে। দরজাটা খুলেই এক পা রাখল হলরূমে।

পিছন ফিরে চাইল রানা।

থামল না ওড্ডি বা তার সাথী। ওর দিকে চাইল না একবারও। এগিয়ে যাচ্ছে ভিড়ের চাপে সামনের দিকে। এত সহজে হাল ছেড়ে দিতে দেখে একটু অবাক হলো রানা, কিন্তু বুঝতে পারল, এত লোকজনের মধ্যে করবার তেমন কিছু নেইও আসলে ওদের।

দরজাটা বন্ধ করে দিল রানা। প্রকাণ্ড একটা হাঁপ ছেড়ে এগোল ওর শোবার ঘরের দিকে।

দুই সেকেণ্ডের স্বস্তি। তিন পা এগিয়েই থমকে দাঁড়াল রানা। ওর ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে। আলো কিসের?

খুব দ্রুত হালকা পা ফেলে একটা টেবিলের ধারে চলে এল রানা। পকেট থেকে নীল প্যাকেটটা বেরিয়ে এসেছে ওর হাতে। টপ করে প্যাকেটটা ছেড়ে দিল সে একটা সূক্ষ্ম কারুকাজ করা তামার ফুলদানীর মধ্যে। দ্রুতপায়ে ফিরে এল ঘরের মাঝখানে।

ঠিক এমনি সময়ে খুলে গেল ওর শোবার ঘরের দরজা। চৌকাঠের উপর দাঁড়িয়ে সিলভিও পিয়েত্রো।

‘স্বাগতম, সিনর মাসুদ রানা!’ অত্যন্ত ভদ্রভাবে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করল সিলভিও রানাকে। মুখে মিষ্টি হাসি। ‘এই অনধিকার প্রবেশের জন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আপনার সাথে জরুরী কথা আছে আমার।

হাসিমুখে এগোল রানা। ‘না, না। এর জন্যে ক্ষমা চাওয়ার কিচ্ছু নেই। আপনাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখার জন্যে আমারই বরং ক্ষমা চাওয়া উচিত। খুব বেশি দেরি করে ফেলিনি তো?’

সোফার উপর বসে আছে লুইসা পিয়েত্রো। দরজার দুপাশে দাঁড়িয়ে গীয়ান আর লাল চুলো সেই লোকটা। দু’জনের হাতে দুটো নাক বোঁচা রিভলভার। রানার দিকে ধরা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *