আট
ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং।
রিসিভারটা তুলে নিয়ে কানে ধরল রানা।
‘আপনার প্যারিসের কল, সিনর। কথা বলুন।’
‘ধন্যবাদ। হ্যালো, আলফ্রেডো হোটেল?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘ইয়েস, মশিয়ে। রিসেপশন ডেস্ক। পরিষ্কার ইংরেজীতে উত্তর এল।’
‘আপনাদের ওখানে কি চ্যাটার্জী বলে কেউ উঠেছেন? মি.অনিল চ্যাটার্জী?’
‘একটু ধরুন, দেখে বলছি।’
আধ-খাওয়া সিগারেটটা ফেলে দিল রানা অ্যাশট্রেতে। চট্ করে টেনে নিল একটা ছোট্ট সাদা প্যাড, আর বলপেন। কয়েক সেকেন্ড পরই আবার শোনা গেল রিসেপশন ক্লার্কের কণ্ঠস্বর।
‘হ্যালো, মশিয়ে? হ্যাঁ, আমাদের এখানেই উঠেছেন মি. চ্যাটার্জী।’
ভুশ করে আটকে রাখা দম ছাড়ল রানা। লুইসার কথা বিশ্বাস করেনি ও, আশা করেছিল জবাব আসবে না, মশিয়ে, মি. চ্যাটার্জী বলে কেউ ওঠেননি আমাদের হোটেলে। একটু যেন হকচকিয়ে গেল রানা, তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘উনি আছেন?’
‘খুব সম্ভব আছেন। ওঁর রূমে কানেকশন দেব?’
‘দিন। বলুন মাসুদ রানা কথা বলতে চান ওঁর সঙ্গে।’
‘জাস্ট আ মোমেন্ট, প্লীজ।
দশ সেকেন্ড চুপচাপ, তারপর ক্লিক করে রিসিভার তোলার শব্দ হলো। পরিষ্কার বাংলায় ভেসে এল, ‘হ্যালো? অনিল বলছি।’
দেড় বছর আগে সাত দিনের পরিচয়। কথাবার্তা তেমন কিছুই হয়নি, দুজনই ব্যস্ত ছিল কাজে। গল্পের বন্ধুত্ব নয়, কাজের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল ওদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে। এত দূর থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বরটা তাই চিনতে পারল না রানা। চিনবার কথাও নয়।
‘আমি রানা বলছি,’ বলল রানা। ‘চিনতে পারছ, অনিল?’
খানিক চুপ, তারপর উত্তর এল, ‘পারছি।’
‘কেমন আছ, অনিল? বহুদিন পর, তাই না? কি বলো?’
‘হ্যাঁ। বেশ অনেক দিন। দিন যায়, দিন আসে-কি দাম সময়ের? তা কোথায় আছ তুমি? কোথা থেকে বলছ?’
একটি শব্দও যেন শুনতে ভুল না হয় সেজন্যে ঠেসে ধরে আছে রানা রিসিভারটা কানের ওপর। কিন্তু উত্তরটা কেন যেন পছন্দ হলো না ওর। কেমন যেন ছাড়া ছাড়া, কাটা কাটা কথা। সজীব প্রাণবন্ত নয়, কেমন মরা মরা। অস্বাভাবিক।
‘ভেনিস থেকে,’ বলল রানা। ‘তোমার মায়ের একটা চিঠি আছে আমার কাছে। তোমাকে লেখা। উনি ভয়ানক উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছেন তোমার জন্যে।’
‘উদ্বিগ্ন? কেন?’
‘কেন উদ্বিগ্ন সে কথা আমাকে জিজ্ঞেস করছ তুমি?’ রেগে গেল রানা। যার জন্যে এত কিছু, তার নিশ্চিন্ত কণ্ঠ বিরক্ত করে তুলেছে ওকে। ‘সপ্তাহে দুটো করে চিঠি লেখার কথা, সে জায়গায় গত দেড় মাসে একটা চিঠি নেই…উদ্বিগ্ন হবে না মানুষ? এতই ব্যস্ত তুমি যে মাকে দুটো লাইন লেখার সময় হয় না?’
কোন জবাব নেই। দশ সেকেন্ড পেরিয়ে গেল। প্যারিসের রাজপথে ব্যস্ত গাড়িঘোড়ার অস্পষ্ট আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে রানা। মনে হলো দ্রুত শ্বাস নেয়ার শব্দ শুনতে পেল সে আবছাভাবে।
‘হ্যালো? লাইনে আছ তুমি, অনিল?’
‘হ্যাঁ।’ ভাবলেশহীন কণ্ঠস্বর। ‘কি যেন বলছিলে?’
‘দেড় মাস কোন চিঠি না পেয়ে তোমার মা খুবই দুশ্চিন্তায় আছেন।’ গলাটা একটু চড়িয়ে দিল রানা।
‘দেড় মাস? নাহ্, এতদিন হবে কি করে? লিখেছিলাম তো! আমার মনে হচ্ছে চিঠি লিখেছি আমি।’
‘পৌঁছে যেটা দিয়েছিলে সেটা ছাড়া আর একটা চিঠিও পাননি উনি তোমার। লেখোনি বলেই পাননি। কি নিয়ে এত ব্যস্ত তুমি, অনিল?’
‘দেড় মাস…’ কথাটা শেষ না করেই থেমে গেল কণ্ঠস্বর। আবার চুপ। প্যারিসের রাজপথে চলমান একটা ফোক্সওয়াগেন গাড়ির হর্নের আওয়াজ ভেসে এল। বিরক্ত হয়ে আবার কথা বলতে যাচ্ছিল রানা, এমনি সময় একটা আবছা শব্দ শুনে শির শির করে উঠল ওর বুকের ভিতরটা। মনে হলো ফোঁপাচ্ছে একটা পুরুষ কণ্ঠ। কাঁদছে অনিল!
‘অনিল!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রানা। ‘কি হয়েছে তোমার? তুমি অসুস্থ?’
খানিকক্ষণ চুপচাপ, তারপর ভাঙা গলায় উত্তর এল, ‘জানি না। আমি…আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছি, রানা। এখানে কেন আছি আমি জানি না। কি করছি আমি জানি না। দোহাই লাগে তোমার, রানা, বাঁচাও…বাঁচাও আমাকে!’
‘দাঁড়াও অনিল, শোনো! আমি আসছি। যেখানে আছ সেখানেই থাকো তুমি। ঘাবড়িয়ো না, কোন চিন্তা নেই। অ্যালিটালিয়ার ফ্লাইট না থাকলে প্লেন চার্টার করব আমি লিডো এয়ারপোর্ট থেকে। পাঁচ ছয় ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব আমি তোমার কাছে। যেখানে আছ সেখানেই থাকো, অন্য কোথাও যেয়ো না। আর যাই ঘটে থাকুক না কেন, সহজ ভাবে গ্রহণ করো সেটাকে। সব ঠিক হয়ে যাবে, কিচ্ছু ভেবো না। বুঝেছ?’
‘জলদি …জলদি এসো, রানা…আমি বোধহয় বাঁচব না, রানা!’ ককিয়ে উঠল অনিল।
চট করে ভুরু জোড়া কুঁচকে গেল রানার। ওভার অ্যাকটিং! রানার সতর্ক কান এড়াল না সেটা।
‘এক্ষুণি আসছি আমি,’ বলল রানা। জানালা দিয়ে দেখতে পেল দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে লুইসা পিয়েত্রো এই বাসার দিকে। অদ্ভুত সুন্দর ছন্দ মেয়েটার চলায়। নিষ্ঠুর এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল রানার ঠোঁটে। ‘কিচ্ছু ভেবো না তুমি। সব ঠিক হয়ে যাবে। আসছি আমি, কেমন? রাখলাম।
মাউথপিসটা বাঁ হাতের তালু দিয়ে চেপে ধরে ডান হাতের নখ দিয়ে জোরে খড়খড় করে আওয়াজ করল রানা রিসিভারের গায়ে। যেন বন্ধুর বিপদে ব্যস্ত হয়ে নামিয়ে রাখল সে রিসিভার একটা কিছু ব্যবস্থা করবার জন্যে।
এয়ারপিস কানে চেপে ধরে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল রানা।
কাজ হলো কৌশলে। আবছা হাসির শব্দ শুনতে পেল রানা। একটা পুলকিত কণ্ঠস্বর ফরাসী ভাষায় বলল, ‘শুধু টোপ না, বড়শি, ফাত্না, এমন কি ছিপ পর্যন্ত গিলে ফেলেছে ব্যাটা!’
আরেকটা ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ‘শাট আপ! ইউ ব্লাডি সোয়াইন! রিসিভার নামাও!’ ক্লিক করে কেটে গেল লাইন।
.
রিসিভার নামিয়ে রেখে কপালের ঘাম মুছল রানা। আরাম করে সোফায় হেলান দিয়ে সিগারেট ধরাল।
‘আসতে পারি?’
উঠে দাঁড়াল রানা, হাত বাড়িয়ে সামনে ঝুঁকে কেতাদুরস্ত আহ্বান জানাল।
‘এসো, লা সিনোরিনা। হাসল ওর মেয়ে ভুলানো হাসি। ‘তোমারই অপেক্ষায় আছি।’
অবাক চোখে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল রানা লুইসাকে। ‘এইটুকু সময়ের মধ্যে কাপড় বদলে ফেলেছ? অপূর্ব লাগছে কিন্তু।’ এগিয়ে এসে চুম্বন করল রানা ওর ঠোঁটে, তারপর হাত ধরে নিয়ে এসে বসাল একটা সোফায়, নিজে বসল পাশে। ‘তোমার জন্যে খবর আছে।
‘কি খবর?’ অবাক আয়ত চোখ মেলে ধরল লুইসা রানার চোখে।
‘আলফ্রেডো হোটেলে ফোন করেছিলাম। এই একটু আগে। কথা হয়েছে অনিলের সঙ্গে।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। ভয়ানক অসুস্থ মনে হলো ওকে। আজই দেখা করার জন্যে বায়না ধরেছে।
‘যাচ্ছ তুমি?’
‘ভাবছি যাওয়া উচিত। তোমার কাছে যা শুনলাম, আর ওর সঙ্গে কথা বলে যা বুঝলাম, মনে হচ্ছে যাওয়া উচিত আমার। আমার মনে হয় নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছে ওর। শেষের দিকে রীতিমত ফোঁপাতে শুরু করেছিল।
‘আহ্-হা! বেচারা!’
লুইসার কণ্ঠে সহানুভূতি ঝরে পড়ল। অভিনয়টা এতই আন্তরিক যে খুঁত ধরবার উপায় নেই। বহু কষ্টে হাসি চাপল রানা।
‘তুমি যাবে নাকি আমার সঙ্গে?’ লুইসার একটা হাত তুলে নিল রানা নিজের হাতে। ‘নারীর সহানুভূতি অনেক উপকারে আসত ওর এই বিপদের সময়। যাবে?’
‘কিন্তু আজ আর কাল যে সিলভিওর দুটো বিজনেস পার্টি আছে। আমি না থাকলেই যে নয়।
‘তাহলে অবশ্য জোর নেই। কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছে না। ভেবেছিলাম ছুটির কটা দিনকে জীবনের স্মরণীয় দিন করে রাখব তোমাদের সাথে আনন্দে কাটিয়ে। বাধা পড়ে যাচ্ছে। যাব কিনা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। তোমাকে ছেড়ে যাবার কথা ভাবতেও ইচ্ছে করছে না। স্বার্থপর হয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে। কি করি বলো তো?’
‘আমার মনে হয় তোমার যাওয়াই উচিত। বেচারা এই বিদেশে একা কষ্ট করছে, দেখার কেউ নেই, একটু সহানুভূতি দেখাবারও কেউ নেই। এখন না যাওয়াটা অমানুষের কাজ হয়ে যাবে।’
মনে মনে রানা বলল…ওরে ছুঁড়ি। এ দেখছি সোফিয়া লোরেনকেও হার মানাবে। মুখে বলল, ‘ঠিক আছে। তুমি যদি বলো, যাব আমি। কিন্তু চিরকাল দুঃখ থেকে যাবে আমার মনে। কোনদিন ভুলতে পারব না ওকে সাহায্য করতে গিয়ে তোমাকে হারিয়েছিলাম আমি।’
‘আমাকে হারাতে হবে কেন?’ একটু যেন অবাক হলো লুইসা।
‘বারে, হবে না? প্যারিস থেকে আর ভেনিসে ফিরে আসতে পারব মনে করেছ? অবস্থা ভাল দেখলে অবশ্য আমার এক সঙ্গীর সাথে ওকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়ে ফিরে আসব আমি ভেনিসে। কিন্তু ওর অবস্থা যদি যা ভাবছি তাই হয়, তাহলে ওকে নিয়ে সোজা কলকাতায় পৌঁছে দিয়ে তারপর নিস্তার পাব। তার মানে খুব সম্ভব আজই তোমার সাথে আমার শেষ দেখা।’ কণ্ঠস্বরটা করুণ করে আনল রানা শেষের দিকে।
কাছে সরে এসে রানার কাঁধে মাথা রাখল লুইসা। এক হাতে রানার চুলে আঙুল বোলাতে বোলাতে বলল, ‘এসো আজকের দিনটাকেই ইতিহাস করে রাখা যাক। এই হঠাৎ দেখা, হঠাৎ ভাল লাগা, আর হঠাৎ বিচ্ছেদকেই আমাদের জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা করে রাখি।’
বানানো কথা, কিন্তু শুনতে মন্দ লাগল না রানার। দুনিয়াটা বড় বিচিত্র। কত মিথ্যা, কত প্রবঞ্চনা, কত ভুল, আর কত মায়া রঙিন করে রাখে জীবনটাকে। কোনটাই মূল্যহীন নয়।
আর একটু সরে এল রানা, আর একটু কাছে টেনে নিল ওকে। আদরে আদরে বুজে এল লুইসার চোখ।
রানার কানের লতিতে আস্তে একটা কামড় দিল লুইসা।
‘কখন যাচ্ছ?’
‘লিডো থেকে একটা এয়ার-ট্যাক্সি চার্টার করব। রওয়ানা হব ঠিক দুটোর সময়।’
এই খবরটুকুর জন্যেই মেয়েটার এখানে আগমন, রানা জানে। ওকে ভেনিস থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে এরা। রানা যে সত্যিই আজ প্যারিস রওয়ানা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এ খবরটা শুনে একটা স্বস্তির ভাব ফুটে উঠল লুইসার চোখে মুখে। নিশ্চিন্ত হয়ে এবার দিনটা স্মরণীয় করে তোলার চেষ্টায় মন দিল। বিচ্ছেদের কথা ভেবে উথলে উঠল ওর প্রেম।
একসময় উঠে গিয়ে দ্রুতহাতে সবকটা জানালার কার্টেন টেনে দিল ওরা। আবছা আঁধার হয়ে গেল ঘরটা। পায়ে পায়ে চলে এল খাটের কাছে। ভুলে গেল স্থান, কাল, পাত্র।
কখন যে নিঃশব্দ পায়ে ঘরে ঢুকেছিল গিলটি মিঞা, আধ হাত জিভ কেটে ‘না আউযুবিল্লা’ বলে ছুটে পালিয়ে গেছে, টেরও পেল না কেউ।
ঠিক একটার সময় বাইরে থেকে লাঞ্চ খেয়ে আবার ফিরে এল ওরা আঁধার ঘরে।
‘তোমাকে কোনদিন ভুলতে পারব না আমি, রানা।’
‘আমিও না।’
‘মিথ্যে কথা বললে। কতজন এসেছে তোমার জীবনে, আরও কত আসবে, আমি হারিয়ে যাব তাদের ভিড়ে।’
‘তোমার জীবনে যারা আসবে, আমি হারাব তাদের ভিড়ে।’
‘না।’ কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে রানার ঠোঁটে আলতো করে চুমো খেলো লুইসা। ‘এই প্রথম জানলাম, সত্যিকার প্রেম কাকে বলে। বিশ্বাস করো, জানতাম না আমি। আরও কয়েকজন পুরুষ এসেছে আমার জীবনে, আজ বুঝতে পারছি, তারা সবাই স্বার্থপর। তোমাকে হারাতে হবে ভাবতে সত্যিই খারাপ লাগছে এখন।’
জবাব দিল না রানা। কথাটা বিশ্বাস করবে কি অবিশ্বাস করবে তা নিয়ে ভাবল না একটিবারও। এ মেয়ে শত্রুপক্ষের মেয়ে। জুলি মাযিনির নির্মম হত্যার পিছনে হাত আছে এরও জেনে হোক, না জেনে হোক, একটি জীবনের নিষ্ঠুর পরিসমাপ্তির জন্যে দায়ী লুইসাও।
রানার প্রশস্ত বুকে মাথা রাখল লুইসা। ‘না যদি পাও? যদি গিয়ে দেখো আলফ্রেডো হোটেল ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে অনিল, তাহলে? তাহলে আবার ফিরে আসবে আমার কাছে?’
‘আসতে পারলে সুখী হতাম লুইসা। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে খুঁজে বের করতে হবে আমার ওকে। যেমন করে পারি। কিন্তু সে প্রশ্ন আসছে কেন? ওই হোটেলেই থাকতে বলেছি ওকে, ওখানেই পেয়ে যাব।
ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল লুইসা। ‘আমার সব কথাই তো শুনেছ, এবার তোমার কথা কিছু বলো। ঠিক কি ধরনের বিজনেস করো তুমি? প্রত্যেক বছরই বিদেশে আসতে হয়?
ইনডেন্টিং ব্যবসার বানানো গল্প শোনাল রানা সবিস্তারে। বলল আগামীবার যখন ইউরোপে আসবে তখন যেমন ভাবে হোক খুঁজে বের করবে লুইসাকে। আবার মিলবে দুজন, আবার ভালবাসবে।
ঘড়ি দেখল রানা। এতক্ষণ কি করছে গিলটি মিঞা? এই মেয়ের কাছ থেকে যতটা জানার জেনে নিয়েছে সে, এখন দূর হলেই বাঁচে। কিন্তু সাপের সম্মোহনে আটকা পড়া ব্যাঙের মত নড়তে পারছে না মেয়েটা। সোয়া একটা বাজতেই উঠে বসল রানা বিছানায়।
‘সময় নেই হাতে। প্যাক করে তৈরি হয়ে নিতে হবে আমাকে দুটোর মধ্যে।’
‘চলে যেতে বলছ?’ করুণ দৃষ্টিতে চাইল লুইসা রানার চোখে।
‘না, সিনোরিনা। আমাকে চলে যেতে হচ্ছে।’
‘আর পনেরোটা মিনিট দেবে না আমাকে?’ কাঙালের মত মাথা নাড়ল লুইসা। ‘প্লীজ, রানা।’
রানা হাসতেই কৃতার্থ হয়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল লুইসা রানার বুকে। চুমোয় চুমোয় ভরে দিল সারা গা।
‘জীবনে কারও জন্যে কাঙালেপনা করিনি আমি, রানা। বিশ্বাস করো। চলে যাবে মনে করলেই নিজেকে নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত মনে হচ্ছে। উহ্, কি করে বোঝাব তোমাকে আমার মনের অবস্থাটা?’
মিনিট দশেক চুপচাপ। তারপর ঝড়ের বেগে নিঃশ্বাস। তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল লুইসা। দুই হাতে চোখ ঢেকে কাঁদল ঝরঝরিয়ে। অবাক চোখে দেখল রানা মেয়েটাকে।
দু’মিনিটেই সামলে নিয়ে উঠে বসল লুইসা খাটের ধারে। ব্যস্ত হাতে জামা ঠিক ঠাক করল। হাতের পৌঁছায় চোখ মুছল বার কয়েক। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়াল রানার সামনে। রানার একটা হাত তুলে নিয়ে নিজের গালের ওপর চেপে ধরল।
‘ভায়া খণ্ডিওস্, মাই ডার্লিং, ভায়া খণ্ডিওস্।’
দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল লুইসা। রানার হাত ছেড়ে দিয়ে হ্যান্ড-ব্যাগটা তুলে নিল সাইড টেবিলের ওপর থেকে। দরজা পর্যন্ত গিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে চাইল রানার দিকে।
রানা দেখল, কোরবানির ছাগল জবাইয়ের আগের রাতে যেমন কাঁদে, তেমনি নিঃশব্দে কাঁদছে লুইসা পিয়েত্রো। দরদর করে জল ঝরছে চোখ থেকে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে অব্যক্ত ব্যথায় গোঙাচ্ছে ওর ভিতরটা।
চলে গেল লুইসা পিয়েত্রো।
.
পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল রানা। এ কি করল সে? খেলা খেলা মজা করতে গিয়ে এ কী কাণ্ড বাধিয়ে বসল? খেলাতে গিয়ে নিজের জালে আটকে গেছে লুইসা পিয়েত্রো, অন্য কোন পরিস্থিতি হলে প্রাণ ভরে হাসত রানা, কিন্তু কেন যেন হাসি তো এলই না, কেমন একটা টনটনে ব্যথা অনুভব করল সে বুকের ভিতর।
একেই বুঝি মোহ বলে? রানা জানে, প্রেম নয়-মোহে পড়েছে মেয়েটা। কিন্তু এরও দাম আছে, জীবনের চলার পথে এটাও তুচ্ছ করবার ব্যাপার নয়। কোনকিছুই ফেলনা নয়। এসব মানুষেরই মনের অভিব্যক্তি। এখন এটাই সত্য।
হ্যাঁ। এ কান্নায় কোন ভেজাল নেই। অন্তর থেকেই আসছে এটা।
মাথা ঝাড়া দিল রানা। কেটে যাবে। কেটে যাওয়ার জন্যেই আসে মোহ। কিন্তু যদি কোনদিন প্রয়োজন হয়, এ মেয়েটার বুকে ছুরি ঢোকাতে পারবে ও? লুইসা পারবে ওর কপাল লক্ষ্য করে পিস্তল ছুঁড়তে? মানুষের সব কিছুতেই কী আশ্চর্য জটিলতা! প্ল্যান- প্রোগ্রাম করে রানাকে বাঁদর নাচ নাচাতে এসেছিল মেয়েটা। দলের নেতা সিদ্ধান্ত নিয়েছে রানাকে ভেনিস থেকে তাড়াতে হবে, এখানে রানার উপস্থিতি বাঞ্ছনীয় নয়, তাই একে পাঠানো হয়েছে রানাকে ভুল পথে পরিচালনা করবার জন্যে। কর্তব্য সম্পাদন করেছে মেয়েটা, করতে গিয়ে আটকে গেছে মোহ জালে। এর কোনও ওষুধ নেই। জীবনের এ এক বিচিত্র খেলা। এ খেলার আদি অন্ত বুঝতে পারে না রানা।
খোলা দরজায় এসে দাঁড়াল গিলটি মিঞা।
‘কোতাউ চললেন নাকি আবার?’
‘হ্যাঁ। এসো। খোঁজ বের করতে পারলে?’
‘নিচ্চয়। আমি হাত দিয়েচি, কিন্তুক হোইনি, কোন্ কাজটা আচে বলুন? একেবারে নাড়ী-নক্ষত্ত, সব বিত্তান্ত নিয়ে এসেচি। বাপের সাথে থাকত মেয়েটা। ল্যাংড়া বুড়ো। ছোট এক ভাই আচে।’
‘থাকে কোথায়?’
‘ফনডামেন্ট নোভে ওটিভিয়ানি রেস্তোরাঁর কাচেই ওদের একটা ছোট্ট বাসা আচে। দশ নম্বর বাড়ি।’
‘বাপটা জানে যে মেয়ে মারা গেছে?’
‘জানে। মাচির মত ভ্যান ভ্যান করছে পুলিস ওর চারপাশে। একেবারে পাথর হয়ে গেচে বুড়ো। মেয়ের আয়েই চলত সংসার। একোন্ আর উপার্জনের কেউ রইল না।
‘ওটিভিয়ানি রেস্তোরাঁটা ঠিক কোথায়?’
‘রিও ডি প্যানাডার কাচে। চলুন না, যকোন বলবেন নিয়ে গিয়ে হাজির করব।’
‘না। আমার একাই যেতে হবে। তুমি আজ প্যারিস চলে যাচ্ছ।’ গিলটি মিঞার চোখ বড় হয়ে যেতে দেখে হাসল রানা। ‘আমিও যাচ্ছি। পড়ুয়া পর্যন্ত। বসো, বলছি সব।’
রানাকে জিনিসপত্র গোছগাছ করে সুটকেসে তুলতে দেখে এগিয়ে এল গিলটি মিঞা।
‘আমাকে দিন, স্যার। আমি গুচিয়ে দিচ্চি।’
‘তুমি বসো ওই সোফায়। যা বলি মন দিয়ে শোনো।’
বসল না কিছুতেই গিলটি মিঞা। বলল, ‘ধরে নিন বসেই আচি। বলুন, শুনচি মন দিয়ে।
আজকের ঘটনা আগাগোড়া সবটা বলল রানা। চুপচাপ শুনে গেল গিলটি মিঞা, একটি কথাও বলল না। রানার বক্তব্য শেষ হতে প্রথমে নাক চুলকাল, তারপর কান চুলকাল, তারপর মাথার পেছনটা।
‘এই যদি অবস্তা হয়, তাহালে আর বেহুদা যাচ্চি কেন?’
‘বলছি। আগে কি করতে হবে শুনে নাও। তুমি আলফ্রেডো হোটেলে গিয়ে খোঁজ করবে অনিলের। আমার যতদূর বিশ্বাস, কাউকে পাবে না ওখানে। কিন্তু যদি পাও’ পকেট থেকে অনিলের ছবি বের করে দিল রানা, ‘এই ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখে নেবে। ছবিটা মিলে গেলে ওকে বলবে জরুরী তার পেয়ে আমি লন্ডনে চলে গিয়েছি, প্যারিসের চাথাম হোটেলে একটা স্যুইট ভাড়া করে থাকতে বলেছি তোমাদের দুজনকে, আমি আসছি আগামীকাল সন্ধ্যায়। যদি চেহারা না মেলে তাহলে ওদের বুঝতে দেবে না যে তুমি কিছু টের পেয়েছ, বলবে, জরুরী তার পেয়ে আমাকে লন্ডন চলে যেতে হয়েছে, দিন সাতেক পরে দেখা করব ওর সঙ্গে, তোমাকে পাঠিয়েছি ততদিন ওকে ওই হোটেলেই থাকবার অনুরোধ জানাবার জন্যে।
‘আর যদি কাউকে না পাই?’
‘তাহলে ছবিটা দেখাবে রিসেপশন ক্লার্ককে। অনিলকে চিনতে পারে কিনা দেখবে। আমার মনে হয় পারবে না। সঠিক খবরটা জানা দরকার আমার।’
‘আর ইতিমধ্যে এরা মনে করবে যে আপনি এ শহর ছেড়ে চলে গেচেন, অতচ নুকিয়ে নুকিয়ে এদের কাজকম্মো দেকবেন। এই তো?’
‘ঠিক বলেছ, ওদের কাজকর্মও দেখব, নিজের কাজকর্মও করব। লিডো থেকে এয়্যার-ট্যাক্সি ভাড়া করব আমরা। ওখানে এদের লোক নজর রাখতে পারে, কাজেই আমিও উঠব তোমার সঙ্গে প্লেনে। পড়ুয়ায় নেমে ফিরে আসব আমি এখানে ছদ্মবেশে। সারাগাত হোটেলে উঠব। ওখানেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে তুমি।’
‘আর এই বাড়িটা?’
‘সাতদিনের ভাড়া দেয়া আছে, আমরা ফিরে তো আসছিই, তাছাড়া মালপত্রও সব নিচ্ছি না। ক্ষতি কি, থাকুক এটা পাঁচদিন খালি পড়ে।’
‘আরাকটা কতা। টাকা আসচে কোত্থেকে? আপনার কাচে যা আচে সে তো পেলেন ভাড়া করতেই…’
‘ও নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না, গিলটি মিঞা। সারাগাত ক্যাসিনোতে জুয়ো খেলব দরকার হলে।’
যে কোন ধরনের জুয়া খেলায় রানার আশ্চর্য ভাগ্যের কথা জানা আছে গিলটি মিঞার। তাই বিনা দ্বিধায় মেনে নিল রানার বক্তব্য। টাকার চিন্তা দূর হলো।
‘এবার তোমার মালপত্র গুছিয়ে নাও। আমি ফোন করি এয়ারপোর্টে।’