সাত
জুলি মাযিনির ঠিকানা বের করবার একটা বুদ্ধি খেলেছে রানার মাথায়। কিন্তু নিজে গেলে চলবে না, চিনে ফেলবে, তাই শিখিয়ে পড়িয়ে বাইরে পাঠাল সে গিলটি মিঞাকে। আটটায় বেরিয়ে গেল গিলটি মিঞা, সাড়ে আটটার দিকে বেরিয়ে পড়ল রানাও। দেড়টা-দুটোর আগে ফিরবে না গিলটি মিঞা, ততক্ষণ চুপচাপ বসে না থেকে ভাবল একটু ঘুরে ফিরে এলে মন্দ হয় না।
গনডোলা স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছেই একটা মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠে নিজের নাম শুনে থমকে দাঁড়াল রানা।
‘সিনর মাসুদ রানা না?’
লুইসা পিয়েত্রো। ঝিকমিক করছে সকালের রোদে, যেন চকচকে সিকি। মুখে উজ্জ্বল হাসি, চোখে বিদ্যুৎ। মনে মনে নিজের কপালকে ধন্যবাদ দিল রানা। কিন্তু এখন ভজাতে পারলে হয়। মধুর হাসি হাসল রানা।
‘আরে! আপনি! কি খবর?’
‘ভাল্লাগছিল না, চলে এলাম খানিকক্ষণ গনডোলায় চড়ে যেদিক খুশি ঘুরব মনে করে। আপনার চোয়ালের অবস্থা কি রকম?’
‘সেরে গেছে প্রায়। বেদম ঘুমিয়েছি কাল সারারাত। তা আপনার ভাই কোথায়?’
‘ও ব্যস্ত আছে ওর ব্যবসা নিয়ে। আমার করবার কিছুই নেই বলে বেরিয়ে পড়েছি। একবার ভাবছিলাম আপনার বাসায় গিয়ে দেখি আপনি ব্যস্ত আছেন কিনা, তারপর আবার ভাবলাম কি আবার মনে করবেন আপনি…’
‘কি মনে করব আবার? এ তো আনন্দের কথা। চলুন না?’
‘দেখা তো হয়েই গেল। কোথায় চলেছিলেন? কাজে?’
‘নাহ্, আমারও আপনার মত একই সমস্যা। সময় কাটছিল না বলে চলেছিলাম কলিওনির স্ট্যাচু দেখতে। যাবেন নাকি? গনডোলা চড়াও হবে, একটা মহৎ সৃষ্টিও দেখে আসা যাবে।’
রাজি হয়ে গেল মেয়েটা। এত সহজে রাজি হয়ে যাওয়ায় রানা চট করে ভেবে নিল একবার, ভুল হয়ে গেল কিনা। বাসায় নিয়ে যেতে পারলে সবচেয়ে ভাল হত, বলা যায় না, হয়তো রাজিও হয়ে যেতে পারত। যাই হোক, বড়শিতে যখন গাঁথা গেছে, খানিক খেলালেই উঠে আসবে ডাঙায়। অতি আগ্রহ দেখালে একেবারে ফসকে যাওয়ারও সম্ভাবনা আছে। নিজেকে প্রবোধ দিল সে, ধীরে, বন্ধু ধীরে।
মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করল প্রকাণ্ড চেহারার একজন গনডোলিয়ার। উনিশ বিশ বছরের ছোকরা, কিন্তু তার পেশী দেখলে হিংসের উদ্রেক হবে যে কোন পাকাপোক্ত বডি বিল্ডারের। হাত ধরে গনডোলায় উঠতে সাহায্য করল রানা লুইসাকে। একটু যেন বেশি মাত্রায় ভয় পেল মেয়েটা গনডোলাটা দুলে ওঠায়, প্রায় জড়িয়ে ধরল রানাকে, বসে পড়ল একেবারে ওর গা ঘেঁষে।
‘ইল ক্যাম্পো ডেই সান্তি গিয়োভানিই পাওলো,’ বলল রানা গনডোলিয়ারকে।
গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল মাঝি। ছেড়ে দিল গনডোলা।
‘আপনার ভাই কিসের ব্যবসা করেন?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘কাঁচের। সারা ইউরোপে বত্রিশটা ফ্যাক্টরি আছে আমাদের। ফ্রান্সেরটা বাবাই দেখেন, অন্যান্যগুলো দেখে সিলভিও।’ হাসল লুইসা। ‘বছরে দুবার করে আসতে হয় ওকে ভেনিসে। আমার অবশ্য এই প্রথম।’
‘কাঁচের ব্যবসা করে আপনার ভাই?’
‘অবাক হচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে? পিয়েত্রো গ্লাস ফ্যাক্টরির নাম শোনেননি?’
শিরশিরে একটা অনুভূতি হলো রানার মধ্যে। মেয়েটার ঊরুর উষ্ণ স্পর্শে, না কাজল চোখের মদির চাহনিতে, নাকি কথায়? মনের কোণে কোথায় যেন টুং-টাং করে একটা সাবধানী ঘণ্টা বেজে উঠল।
‘সত্যি শুনিনি। একজন বিদেশীর পক্ষে…’
‘তা ঠিক। ক্যালকাটায় আমাদের একটা শাখা আছে। বাংলাদেশে নেই। কাজেই আমাদের নাম না জানারই কথা আপনার।’
আরও সতর্ক হয়ে গেল রানা। যেন কথার কথা আলাপ করছে এমনি ভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘কলকাতাতেও যেতে হয় নাকি আপনার ভাইকে?’
‘না। গোড়ার দিকে দুবার একবার যেতে হয়েছিল, এখন ওখানকার কর্মচারীরাই দেখাশোনা করে।’
‘এখানে ভেনিশিয়ান কাঁচ কিনতে এসেছেন বুঝি?’
‘হ্যাঁ। গিয়াকোমো পাসেল্লী এখানে আমাদের একটা এজেন্ট। এর নামও নিশ্চয়ই শোনেননি আপনি?’
ভিতর ভিতর ডিগবাজি খেয়ে উঠেছে রানা। মাথা নাড়ল নিরুৎসুক ভঙ্গিতে। ‘মনে পড়ছে না। দুঃখিত।
টুকিটাকি কথা হলো কিছুক্ষণ, তারপর হঠাৎ আন্দাজে একটা ঢিল ছুঁড়ল রানা। ‘আচ্ছা, জুলি মাযিনি নামে একটা মেয়ে বোধহয় কাজ করে পাসেল্লীর দোকানে?’
‘ঠিক বলেছেন। ওকে চিনলেন কি করে?’ অবাক দুচোখ মেলে ধরল লুইসা রানার চোখের দিকে।
‘আমার এক বন্ধুর মুখে নাম শুনেছি। প্রেম আছে দুজনের। ‘কার কথা বলছেন আপনি? অনিল চ্যাটার্জী?’
‘চেনেন নাকি ওকে?’ বিস্ফারিত রানার চোখ।
‘চিনি মানে? আমার ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। খুবই অমায়িক ভদ্রলোক।’
নিজের অজান্তেই সামনে ঝুঁকে এল রানা কিছুটা।
‘কবে শেষ দেখা হয়েছে আপনাদের ওর সাথে? ‘দিন তিনেক আগে। কেন?’
হঠাৎ আড়চোখে গনডোলিয়ারের দিকে চেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল রানা। কি শুনছে লোকটা? বৈঠাটা শূন্যে ধরা, বাইতে ভুলে গেছে, সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁ করে শুনছে ওদের কথা। ঘাড় ফিরিয়ে চাইল ওর দিকে রানা। বলল, ‘কিছু বলবে তুমি?’
সংবিৎ ফিরে পেয়ে সোজা হয়ে গেল ছেলেটা, মাথা নেড়ে নিষেধ করে আবার মন দিল কাজে।
‘কি নাম তোমার?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘বাতিস্তা।’ গম্ভীর মুখে নামটা উচ্চারণ করেই অন্য দিকে মুখ ঘোরাল সে। বোঝা গেল আর কোন আলাপে সে আগ্রহী নয়। এটাও বোঝা গেল, একটি শব্দও এড়াবে না ওর কান। সরল ঔৎসুক্য!
নিশ্চিন্ত হয়ে আবার মন দিল সে লুইসার প্রতি।
‘যাক, ভেনিসেই আছে তাহলে।’ হাসি ফুটে উঠল রানার ঠোঁটে। ‘বেশ অনেকদিন দেখা নেই ওর সঙ্গে। আমি যে ভেনিসে এসেছি জানে না ও। চমকে দেয়া যাবে ওকে। আছে কোথায় ও?’
‘তিনদিন আগে এখানে ছিল,’ একটু যেন উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে লুইসার চোখ-মুখ। ‘ওকে দেখে বেশ ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম এবার আমি আর সিলভিও। মনে হলো কোন বিপদের মধ্যে আছে ও।’
‘বিপদ? তার মানে?’
‘এমন তাড়াহুড়ো করে চলে গেল, কেমন একটু অপ্রকৃতিস্থ মনে হলো আমার কাছে। সিলভিওকে বললাম, ও বলল, ও-ও লক্ষ করেছে ব্যাপারটা। অস্বাভাবিক চঞ্চল দেখাচ্ছিল ওকে।
‘তাড়াহুড়ো করে কোথায় চলে গেল?’
‘প্যারিস। তিনদিন আগে প্যারিসে চলে গেছে অনিল।’
নিরতিশয় হতাশ হলো রানা। ‘ধুশ শালা, দেখা হলো না তবে এবার। গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছে গনডোলা। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল রানা। ‘এই যে এসে গেছি।’ হাত ধরে নামাল লুইসাকে। ছেলেটাকে বলল, ‘তুমি অপেক্ষা করবে, না ভাড়া নিয়ে বিদায় হতে চাও?’
‘অপেক্ষা করব।’ গম্ভীর মুখে নৌকোটা বাঁধছে ছেলেটা।
ইকোয়েস্ট্রিয়ান-স্ট্যাচুর ওপর নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিল রানা। মনের মধ্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে চলেছে অন্য চিন্তা। মুখে সে অনর্গল বলে চলেছে কলিওনি কে ছিল, কেমন ভাবে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির গুরু ভেরোশিও তৈরি করেছিল এই মূর্তি। জানাল, পৃথিবীতে এই অপূর্ব মূর্তির সমকক্ষ আর একটি মাত্র মূর্তি আছে, সেটা হচ্ছে ডোনাটেলোর গাটামেলাটা।
মনের মধ্যে চিন্তা চলেছে, অনিলের প্রসঙ্গ উঠে পড়া একটা দৈব-সংযোগ, না ইচ্ছাকৃত ব্যাপার? গনডোলা স্টেশনে হঠাৎ দেখা হয়ে গেছে লুইসার সঙ্গে, না এ দেখাটা পূর্ব-পরিকল্পিত? গত রাতে পথ হারিয়ে রানাকে অজ্ঞান অবস্থায় খুঁজে পেয়েছিল দু’ভাই বোন, নাকি সেটাও সাজানো? এরা কি অনিলের শত্রুপক্ষ, না বন্ধু? লুইসাকে কি পাঠানো হয়েছে রানাকে চোখে চোখে রাখার, কিংবা ভুলিয়ে অন্য কিছুতে ব্যস্ত রাখার জন্যে?
নাহ্ বড় বেশি ভাবছে সে। এসব ভাবনার কোন কূল কিনারা নেই। সতর্ক থাকলে আপনিই বেরিয়ে আসবে সব কিছু। সর্বদা সতর্ক, প্রস্তুত থাকতে হবে ওকে। বড় বেশি জটিল হয়ে উঠেছে সবটা ব্যাপার ক্রমে। স্রোতে ভেসে যেতে হবে এখন বেশ কিছুদূর, নইলে বোঝা যাবে না নদীর জল ঠিক কোনদিকে বইছে, কোথায় ঘূর্ণিপাক।
গির্জাটাও দেখল ওরা ঘুরে ফিরে। কখন যে রানার হাতে ধরা পড়েছে ওর হাতটা খেয়াল করেনি লুইসা, কিংবা খেয়াল না করার ভান করেছে; কখন যে হাঁটতে হাঁটতে নির্জন জায়গায় চলে এসেছে লক্ষ করেনি, লক্ষ করতে হলো যখন হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল রানা ওর চোখে চোখ রেখে। সংবাদটা ঠিকই পৌঁছল ওর মনের গভীরে, রানার চোখে যে মদির আকর্ষণ দেখতে পেয়েছে তার অর্থ ব্যাখ্যা করে নিতে ভুল করল না। রানার বাঁ হাতটা জড়িয়ে ধরেছে ওর ক্ষীণ কটি। চোখে কপট শাসানি ফুটিয়ে তুলে ঠোঁটে লাজুক হাসি হাসল লুইসা। অমোঘ আকর্ষণে সেঁটে গেল রানার গায়ে। চিবুকটা একটু উঁচু করে প্রস্তুত হলো দুটি তৃষিত অধর। চোখ দুটো ভেজা ভেজা।
গোরস্থানের পিছনে বেশ কিছু জায়গা ঝোপঝাড়। মাঝে মাঝে বেঞ্চ পাতা। নির্জন। যেন কি এক ঘোরে পড়ে চলে এল ওরা জঙ্গলের ধারে। হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেল লুইসা, থমকে দাঁড়াল।
‘এখানে না, প্লীজ।’
‘কোথায়?’
‘তোমার বাসায়।’
লুইসার চোখে চোখ রেখে হাসল রানা। আনত হলো লুইসার দৃষ্টি, রানার কোটের একটা বোতাম খুঁটছে। চিবুক ধরে মুখটা উঁচু করল রানা।
‘কবে? কখন?’
জবাব দিল না লুইসা। বাঁ হাতে জড়িয়ে ধরল রানার কনুই, টানল গনডোলার দিকে।
চলতে শুরু করল দুজন। ঘাড় বাঁকিয়ে রানার মুখের দিকে চাইল লুইসা।
‘রাগ করোনি তো, রানা?’
উত্তর না দিয়ে হাসল রানা।
‘রাগ করারই কথা অবশ্য। ইটালিয়ান আইন কি বলে জানো?’
‘কি বলে?’
‘এই যে একটু আগে বারণ করলাম, এই অপরাধে আমার এক বছরের জেল হয়ে যেতে পারত, যদি আমি তোমার স্ত্রী হতাম।’
‘যাহ!’
‘সত্যি। জেল হোত তুমি নালিশ করলে।
‘স্বামী না হয়েও যদি নালিশ করে বসি?’
হা-হা করে হাসল লুইসা। ‘তাহলে তোমার জেল হবে। ভালই হবে।’
গনডোলায় উঠে পড়ল দুজন। লুইসার লিপস্টিক মুছে যাওয়া ঠোঁটের দিকে চেয়ে চোখ সরিয়ে নিল ছোকরা গনডোলিয়ার। এর ফলে সচকিত হয়ে উঠল লুইসা। চট্ করে হ্যান্ডব্যাগ খুলে ছোট্ট একটা আয়না বের করে দেখল নিজেকে। কপট রাগের ভঙ্গিতে ভ্রূকুটি করল রানার প্রতি।
‘কী অবস্থা করেছে! দস্যু কোথাকার!’
একটা ছোট্ট রুমাল বের করে ঠোঁট মুছে নিয়ে নিজেকে আবার মেরামতের কাজে লাগল লুইসা।
তিনদিন আগে প্যারিস চলে গেছে অনিল-কথাটা চমকে দিয়েছে আসলে রানাকে। যদি সত্যি হয়, তাহলে ও মিছেমিছেই খুঁজে মরছে ওকে এখানে। কিন্তু কথাটা কি সত্যি? ভুল খবর জেনেছে লুইসা, নাকি মিথ্যে কথা বলছে?
ভেবেচিন্তে দেখে অনিলের প্রসঙ্গটা আবার তোলার সিদ্ধান্ত নিল রানা। সিগারেট ধরাল একটা।
‘বড় খারাপ লাগছে একটুর জন্যে অনিলকে মিস করে। ও থাকলে ভেনিসের ছুটিটা খুব জমত।’
‘হ্যাঁ। খুবই ভাল লোক। আমাদের সাথে খুবই সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে নিয়েছে। অনেকটা পারিবারিক বন্ধুও বলতে পারো। নিয়মিত আসা যাওয়া, খোঁজ খবর করা, ক্রিসমাসে উপহার দেয়া, সব দিক থেকে যথার্থ বন্ধু যাকে বলে। তাছাড়া সৎ লোক। ভুলেও কোনদিন আমার প্রতি আবছা ইঙ্গিতেও কোন রকম আগ্রহ প্রকাশ করেনি। গলাটা খাটো করে বলল, ‘তোমার মত নয়।’
হাসল রানা। বলল, ‘ওর তো জুলি মাযিনি আছে। আমার কে আছে? অভাবে স্বভাব নষ্ট।’ আগের প্রসঙ্গে ফিরে গেল চট করে। ‘প্যারিসে চলে গেছে, ঠিক জানো তুমি?’
‘জানি। আমরা দুজন ওকে ট্রেনে তুলে দিয়ে এসেছিলাম। এমন তাড়াহুড়ো করতে দেখিনি আর ওকে কোনদিন। মনে হচ্ছিল যেন কেউ তাড়া করছে ওকে, ও পালাচ্ছে। ভীত সন্ত্রস্ত একটা ভাব।’
‘কি হয়েছে জিজ্ঞেস করোনি ওকে?’
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল লুইসা।
‘করেছিলাম। কিন্তু কিছুতেই বলল না। সিলভিও-ও বারকয়েক জিজ্ঞেস করল, যে-কোন বিপদ ঘটে থাকুক না কেন সাধ্যমত সাহায্য করবে বলে আশ্বাস দিল, কিন্তু কিছুতেই মুখ খুলল না ও। বলল, এটা এমন একটা ব্যাপার যা আমাদের না জানাই ভাল। জানলে নাকি আমরাও বিপদে পড়তে পারি। প্যারিসে পৌঁছতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ওর অবস্থা দেখে আমরাও আর বেশি চাপাচাপি করলাম না। আমরা একটা পার্টিতে যাচ্ছিলাম, এমনিতেই দেরি হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কিছুতেই ছাড়ল না আমাদের, জেদ ধরল ওকে স্টেশনে পৌঁছে দিতেই হবে। খুব সম্ভব পথে কোন রকম আক্রমণের ভয় পাচ্ছিল ও। আমরাও বেশি তর্ক না করে পৌঁছে দিলাম ওকে স্টেশনে। সেই থেকে মনটা খারাপ হয়ে আছে সিলভিওর।
‘অদ্ভুত ব্যাপার,’ বলল রানা। ‘কতদিন ধরে ভেনিসে আছে ও? রোমে ইন্ডিয়ান এমব্যাসিতে কাজ করত না অনিল?’
‘হ্যাঁ। তবে কাজটা ঘোরাঘুরির। যেসব মাল ভারত আমদানী করে সেসব সরেজমিনে পরীক্ষা করার কাজ ছিল ওর। সেই সূত্রেই তো সিলভিওর সাথে বন্ধুত্ব। পিয়েত্রোর প্রচুর মাল যায় ভারতে। দিন পাঁচেক আগে আমরা ভেনিসে এসে দেখলাম ও এখানে।
‘প্যারিসে কোথায় উঠেছে ও বলতে পারবে?’
‘হ্যাঁ। টেলিফোনে আলাপ করতে পারো ওর সঙ্গে। হোটেল আলফ্রেডো। পৌঁছেই চিঠি দিতে বলেছিলাম আমরা, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন চিঠি পাইনি। এখানকার কাজ শেষ হলেই আমরা প্যারিসে যাচ্ছি। তোমার কথা বলব ওকে।’
‘প্রথম যখন দেখা হলো তখনই ওকে অস্বাভাবিক মনে হলো, না উৎকণ্ঠা ভাবটা পরে এসেছে ওর মধ্যে?’
‘পরে। আমরা যখন পৌঁছলাম, স্টেশনে রিসিভ করল ও আমাদের। বরাবরের মত হাসি খুশি, ভাল মানুষ। কোথায় উঠেছে জিজ্ঞেস করায় বলল বন্ধুর বাসায়। কোন্ বন্ধু সেকথা আমরাও জিজ্ঞেস করিনি, ও-ও বলেনি। রাতে একসাথে ডিনার খেলাম বেশ হৈ-চৈ করে। পরদিন সকালে আসার কথা ছিল ওর, কিন্তু এল না। ওই সময়েই কিছু একটা ব্যাপার ঘটেছিল খুব সম্ভব। তিনদিন আগে আমরা পার্টিতে যাওয়ার জন্যে বাইরে বেরোচ্ছি, এমনি সময়ে এসে হাজির হলো, চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা, ভয়। ওর চাপাচাপিতে বাধ্য হলাম আমরা ওকে স্টেশনে পৌঁছে দিতে।’
‘তারপর থেকে আর কোন সংবাদ নেই ওর?’
‘না।’
‘হোটেল আলফ্রেডোতে উঠেছে ও সেটা জানলে কি করে?’
‘ও-ই বলেছে। আমরা এখান থেকে প্যারিস যাচ্ছি শুনে ওই হোটেলে দেখা করতে বলল।
প্রসঙ্গটার ইতি টানল রানা। ‘যাক, কপাল খারাপ, দেখা হলো না। আবার কবে যে দেখা হবে কে জানে।’
‘টেলিফোনে কথা বলতে পারো,’ বুদ্ধি দিল লুইসা। ‘তোমার কথা শুনলে ও হয়তো চলেও আসতে পারে।’
‘ঠিক,’ বলল রানা। ‘একটা ফোন করব একসময়।’
চতুর্থ বারের মত আড়চোখে লক্ষ করল রানা গনডোলিয়ারের ঔৎসুক্য। হাঁ করে গিলছে ওদের সব কথা।
চটুল গল্পে মেতে গেল রানার এবার। হালকা রসিকতায় হেসে খুন হয়ে গেল লুইসা, ঢলে পড়ল রানার গায়ে। হাসতে হাসতে নামল ওরা গনডোলা থেকে। ছোকরা গম্ভীর
ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল রানা ওকে, ‘কিছু বলবে, বাতিস্তা?’
প্রবল ভাবে মাথা নাড়াল ছেলেটা। ‘না।’
মোড়ে এসে থেমে দাঁড়াল লুইসা। কেটে পড়ার মতলব টের পেয়ে চোখ পাকাল রানা।
‘খবরদার। কোর্টে নালিশ ঠুকে দেব কিন্তু।’
‘ভয় নেই, পালাচ্ছি না। তুমি যাও লক্ষ্মী, আমি আসছি কিছুক্ষণের মধ্যে। সিলভিওকে বলে আসি যে তোমার সাথে লাঞ্চ খাচ্ছি। নইলে হারিয়ে গেছি মনে করে মহা চিন্তায় পড়ে যাবে ও।’
চোখে চোখে চেয়ে হাসল দুজন।
গ্রিটি হোটেলের দিকে চলে গেল লুইসা। বাসার দিকে রওনা হলো রানা। ভাবল, ভালই হলো। এখুনি ট্রাঙ্ক-কলটা সেরে নেবে ও। অনিল সত্যি প্যারিসে আছে কিনা জেনে নেয়া দশ মিনিটের কাজ। যদি থাকে, ওর সঙ্গে কথা বলার পর পরবর্তী কর্মসূচী ঠিক করা যাবে। কিন্তু সত্যিই কি আলফ্রেডোতে পাওয়া যাবে ওকে? লুইসা যা বলছে তা যদি সত্যি হয়, যদি সত্যিই তিনদিন আগে প্যারিসে চলে গিয়ে থাকে অনিল, তাহলে গত রাতের এতসব ঘটনা কিসের জন্যে? ওকে অনুসরণ করা হচ্ছে কেন? কেন খুন করা হলো জুলিকে?
এর একমাত্র ব্যাখ্যা হচ্ছে, আত্মগোপন করার প্রয়োজনে কৌশল অবলম্বন করেছিল অনিল। হয়তো আক্রমণ আসতে পারে ভেবেই লুইসা এবং সিলভিওকে নিয়ে গিয়েছিল স্টেশনে। ট্রেনেও উঠেছিল, কিন্তু পরের স্টেশনে নেমে আবার ফিরে গিয়ে লুকিয়ে ছিল মনডেলো লেনের সেই ভাঙা বাড়িতে। এইভাবে শত্রুপক্ষের চোখে ফাঁকি দিয়ে ভেনিসেই থাকতে চেয়েছিল হয়তো অনিল। বেঁটে-মোটা আর সরু-লম্বার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যেই এই কৌশল? কিন্তু এ কৌশল দিয়ে ওদের চোখে ধুলো দেয়া সম্ভব হয়নি অনিলের পক্ষে। ওরা বের করে ফেলেছে, জুলি মাযিনি জানে কোথায় লুকিয়ে আছে অনিল, ওর উপর নির্যাতন করে বের করে নিয়েছে ঠিকানাটা। তারপর ধরে ফেলেছে অনিলকে। নাকি পালিয়ে গেছে আবার অনিল?
ব্যান্ডেজের কথাটা মনে আসতেই পালাবার সম্ভাবনাটা নব্বই ভাগ বাতিল করে দিল রানা। ধরে নিতে হবে, ধরা পড়েছে অনিল, এখন বের করতে হবে, কাদের হাতে ধরা পড়ল। কারা এরা?
বাসায় পৌঁছে দেখা গেল ফেরেনি এখনও গিলটি মিঞা। রানা আশা করছে পুলিস নিশ্চয়ই যাবে জুলির কাজের জায়গায়, জিজ্ঞাসাবাদ করবে গিয়াকোমো পাসেল্লীকে, জানাজানি হয়ে যাবে জুলির মৃত্যুর খবর। ওর মৃত্যুতে ফ্যাক্টরি ছুটি হোক বা না হোক, সহকর্মিনীরা যে একবার জুলির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের কাছে যাবে সহানুভূতি জানাতে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ওদের পিছু নেয়ার আশায় ঘুরঘুর করবে গিলটি মিঞা আশেপাশে কোথাও, চিনে আসবে বাড়িটা।
ভালই হলো। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ফিরে না এলেই বাঁচা যায়।