ছয়
‘মনডোলা গলিটা কোনদিকে বলতে পারবে?’
‘নিচ্চয়।’ একগাল হাসল গিলটি মিঞা। ‘ক্যাম্পো সান পোলোর কাচে।’
‘সেটা কোথায়?’
‘রিয়াল্টো ব্রিজের কাচে, স্যার। খালের ওপার। ভাঙাচোরা বাড়িঘর, নোংরা। তা ওদিকটাতেই চলেচেন বুজি?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু তার আগে একটা লোককে খসাতে হবে। সন্ধে থেকে পেছনে লেগে রয়েছে ব্যাটা।’
‘সে ভার আমার ওপর ছেড়ে দিন, স্যার। ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দেব শালাকে।
‘না। ক্যালকেশিয়ান ঘোলে চলবে না, ও ঢাকাই ঘোল খেতে চায়। যা করার আমিই করব। তোমাকে জানানোর উদ্দেশ্য হলো ওর উপস্থিতি টের না পাওয়ার ভান করতে হবে। ঘুণাক্ষরেও টের পাবে না তুমি যে কেউ আমাদেরকে অনুসরণ করছে।’
‘ঠিক আচে। তাই হবে। চলুন তাহালে রওনা দিই?’ পন্টি ডেলা প্যাগলিয়ার দিকে হাঁটতে হাঁটতে আড়চোখে দেখল রানা, থামের গায়ে ঠেলা দিয়ে সোজা হয়ে গেল লম্বা লোকটা। আনমনে হাঁটছে ওদের পেছন পেছন।
‘খুব সরু একটা গলিতে নিয়ে চলো দেখি প্রথমে। ব্যাটাকে খসাতে হবে আগে।’
বাঁ দিকের একটা গলিতে ঢুকে পড়ল গিলটি মিঞা। গোলক ধাঁধার মত গলিগুলো, একটা মিশেছে আরেকটায়, সেটা গিয়ে মিশেছে আরেকটায়, যেন শেষ নেই এর। রাস্তা নির্জন। একটা মোড় ঘুরেই পছন্দসই জায়গা পেয়ে গেল রানা। একটা বাড়ির তিন ফুট উঁচু বারান্দায় উঠে পড়ল সে। গিলটি মিঞাকে বলল, ‘দুজনের পায়ের শব্দ করতে করতে এগিয়ে যাও।’
একগাল হেসে রওনা হলো গিলটি মিঞা। মিশে গেল সরু গলির প্রায়ান্ধকারে। পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল রানা। ঠিক এক মিনিট পরই সাদা টুপি দেখা গেল।
সাবধানে মাথাটা সামনে বের করল অনুসরণকারী, কান পেতে শুনল পায়ের শব্দ, তারপর নিশ্চিন্ত মনে রওনা দিল গলিপথে।
দড়াম করে প্রচণ্ড জোরে একটা লাথি পড়ল লোকটার চোয়ালের ওপর। ভয়ানক ভাবে ঠুকে গেল মাথাটা পাশের দেয়ালে। এত জোরে শব্দ হলো যে ভয় পেল রানা খুলি ফেটে গেছে মনে করে। চট করে ধরে ফেলল লোকটার জ্ঞানহীন দেহটা, আস্তে শুইয়ে দিল মাটিতে।
নিঃশব্দ পায়ে ফিরে এল গিলটি মিঞা। মুখে আকর্ণবিস্তৃত হাসি। ‘বড় জবর মার মেরেচেন, স্যার। এক লাতেই কাত। পকেটে কিছু আচে কিনা দেকব?’
‘দেখো।’
দ্রুত হাত চালিয়ে লোকটার সব পকেট সার্চ করল গিলটি মিঞা। কিছুই পাওয়া গেল না যা দিয়ে পরিচয় জানা যায়। বাঁ বগলের নিচে একটা খাপে পোরা থোইং নাইফ। রক্তের চিহ্ন টের পেল রানা ছুরির ব্লেডে।
সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। যতদূর মনে হচ্ছে, এখন ঘণ্টা খানেক নিশ্চিন্তে ঘুমোবে লোকটা।
‘এবার চলো মনডেলোর দিকে। জলদি।’
মিনিট দশেক এ গলি ও গলি ধরে হাঁটার পর বড় রাস্তায় উঠল গিলটি মিঞা রানাকে নিয়ে। রানা দেখল সামনেই দেখা যাচ্ছে রিয়াল্টো ব্রিজ। মনে মনে গিলটি মিঞার গুণের প্রশংসা না করে পারল না সে। কিন্তু বড় রাস্তায় উঠে মিনিট তিনেক হাঁটার পরই কেমন যেন উসখুস শুরু করল গিলটি মিঞা। খানিক বাদে বলেই ফেলল, ‘আরাকজন আচে বলে মনে হচ্চে, স্যার।’
মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘জানি। অত ব্যস্ত হয়ো না, এটারও ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
ব্রিজের মাঝামাঝি এসে একটা থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ল রানা। জায়গাটায় বেশ ঘন ছায়া পড়ায় এটাই পছন্দ করল রানা।
‘ছায়ায় ছায়ায় এগিয়ে যাও ডবল পা ফেলে।’
বেশ মজার খেলা পেয়েছে গিলটি মিঞা, একগাল হেসে এগোল সে সশব্দে দুজনের পা ফেলে ফেলে।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল রানা। এক মিনিট পার হয়ে গেল। কারও দেখা নেই। দুজনেরই সন্দেহে ভুল হতে পারে? তার নিজের মনটা সন্দেহপ্রবণ হয়ে রয়েছে, সন্ধে থেকে বেশ কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেছে বলে অতি সতর্ক হয়ে রয়েছে ইন্দ্রিয়গুলো, ভুল হওয়া অস্বাভাবিক নয়; কিন্তু গিলটি মিঞার ভুল হবে কেন? বত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে গিলটি মিঞার। ভয়ে ভয়ে, লুকিয়ে, পালিয়ে, সাবধানে কাটিয়েছে সে চোরের জীবন বত্রিশটা বছর। ওর সজাগ চোখ ভুল করতে পারে না। কাজেই অপেক্ষা করতে হবে। ধৈর্য ধরতে হবে। সামান্য ভুলে অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
দূরে গিলটি মিঞার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে এখনও আবছা ভাবে। ব্রিজের শেষ মাথায় চলে গেছে সে, এখনি পৌঁছে যাবে ওপারে। ঠিক মনে হচ্ছে দুজন লোক হেঁটে চলে যাচ্ছে।
আরও আধ মিনিট কাটল, তারপর হালকা পায়ের শব্দ শুনতে পেল রানা। বেশ কাছে। থামের গায়ে মিশে দাঁড়িয়ে রইল ও। গাঢ় রঙের কাপড় পরায় দেখা যাবে না ওকে সহজে, নিজের দিকে একবার চেয়ে নিশ্চিন্ত হলো রানা। খুব সাবধানে উঁকি দিল। কয়েক সেকেন্ড কিছুই দেখতে পেল না, তারপরই চোখ পড়ল ওর কালো স্যুট পরা একজন বেঁটে লোকের ওপর। কষ্ট হলো না চিনতে।
তার মানে লোকটা আচমকা অসাবধান পথিকের সর্বস্ব অপহরণকারী নয়। সাদা আর কালো মিলেমিশে কাজ করছে। খুব সম্ভব ওর পেছনে লাগানো হয়েছে এই দুজনকে গিয়াকোমো পাসেল্লীর দোকান থেকে বেরোবার পরপরই।
লোকটার পদক্ষেপে অতি সতর্কতার লক্ষণ টের পেল রানা। খুব সম্ভব সাদা সঙ্গীর রহস্যজনক অন্তর্ধানে যার পর নাই উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছে সে ভিতরে ভিতরে। কিছুদূর এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা, চেয়ে রইল খালের দিকে। আসলে পায়ের শব্দ শোনার চেষ্টা করছে সে। পনেরো সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে আবার চলতে শুরু করল। পিছু ফিরে চাইল একবার, আবার এগোল।
রানা যে-থামের আড়ালে লুকিয়ে আছে সেটা পেরিয়ে গেল লোকটা প্রায় নিঃশব্দ পায়ে। খালের ওপারে গিলটি মিঞাকে দেখতে পেল সে এবার। বিচিত্র ভঙ্গিতে ওকে পা ফেলে এগোতে দেখে আঁৎকে উঠে থেমে দাঁড়াল। ঝট করে পিছন ফিরে চাইল একবার। তারপর সাঁৎ করে সরে গেল একটা থামের আড়ালে।
ছায়ার মত নিঃশব্দে এগিয়ে এল রানা। মন্ত্রমুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে লোকটা গিলটি মিঞার দিকে। পেছন থেকে দুটো টোকা দিল রানা লোকটার ঘাড়ে। ‘কেঁউ’ করে একটা ভয়ার্ত শব্দ বেরোল লোকটার গলা দিয়ে। এক লাফে সরে গেল তিনহাত তফাতে, এবং ঘুরে দাঁড়াল।
‘কিছু মনে করবেন না, সিনর। ম্যাচ আছে আপনার কাছে?’
বিস্ময়ের ঘোরটা কাটিয়ে উঠতে দুই সেকেন্ডের বেশি লাগল না লোকটার। চিতা বাঘের মত লাফ দিল রানার দিকে। ঝট করে বাঁ দিকে বাঁকা হয়ে পা চালাল রানা। এবার আর অসতর্ক নয় সে। লাথি খেয়ে চাপা একটা গোঙানি বেরোল লোকটার মুখ থেকে। মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মাটিতে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়াল আবার। হাঁপাচ্ছে। শোলডার হোলস্টারে রাখা ছুরিটা বের করবার জন্যে চট্ করে চলে গেল ডান হাতটা কোটের ভিতর। ঠিক এই মুহূর্তটির সদ্ব্যবহার করল রানা। বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে এল এক পা, প্রচণ্ড জোরে ঘুসি চালাল লোকটার চোয়াল লক্ষ্য করে। যন্ত্রণায় চোখ-মুখ বিকৃত হয়ে গেল লোকটার, কিন্তু অবাক হয়ে গেল রানা লোকটার সহ্যশক্তি দেখে, এই অবস্থাতেও বাঁ হাতটা চালাতে ভুল করল না। প্রচণ্ড একটা ঘুসি পড়ল রানার পাঁজরের ওপর। হেভিওয়েট বক্সার নাকি ব্যাটা? মনে হয় জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে লোকটার গ্লাভ্স পরা অবস্থায় রিং-এর ভিতর। বেকায়দা অবস্থায় ছোঁড়া ঘুসির ঠ্যালাতেই ফুস ফুস থেকে সব দম বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো রানার। চট্ করে ধরে ফেলল হাতটা। মুচড়ে ধরে পিছন ফিরে নিজের বাঁ কাঁধের ওপর ফেলল সে হাতটা চিৎ করে, তারপর মারল হ্যাঁচকা টান নিচের দিকে। তীব্র বেদনায় ককিয়ে উঠল লোকটা, পরমুহূর্তে শূন্যে উঠে গেল। রানার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে পড়ল চারহাত তফাতে, প্রথমে গুঁতো খেলো থামের গায়ে, তারপর বালির বস্তার মত ধপাস করে পড়ল মাটিতে উপুড় হয়ে। কোনরকম নড়াচড়ার লক্ষণ না দেখে একটু ঘাবড়ে গেল রানা। লোকটার পাল্স্ দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে সার্চ করল ওর প্রত্যেকটা পকেট। হিপ পকেট থেকে বেরোল রানার মানিব্যাগ। আর কোথাও উল্লেখযোগ্য কিছুই পাওয়া গেল না। হোলস্টারে থ্রোইং নাইফটা নেই দেখে রানার চোখ গেল লোকটার ডান হাতের দিকে। অজ্ঞান অবস্থাতেও ধরা আছে ছুরিটা ছুঁড়ে মারার ভঙ্গিতে।
মানিব্যাগটা নিজের পকেটে ফেলে আর একটু অন্ধকারে টেনে দিল রানা লোকটাকে। দ্রুত এগোল। খালের ওপারে একটা গলির মুখে গিলটি মিঞাকে দেখে এগিয়ে গেল সেইদিকে।
‘এবার কোন্ দিকে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘আসুন আমার পিছু পিছু।’
গলিটা ধরে বেশ কিছুদূর গিয়ে একটা অপেক্ষাকৃত সরু গলিতে ঢুকল গিলটি মিঞা। বলল, ‘এইটেই।’
এ গলির দুই ধারে শত শত বছরের পুরানো ঝুর ঝুরে ভাঙা সব বাড়ি। মনে হয় এখুনি হুড়মুড় করে ঘাড়ের ওপর পড়বে বুঝি। একটি বাতি নেই কোন বাড়ির জানালায়। পকেট থেকে টর্চটা বের করল রানা।
‘এসব বাসায় কোন লোক আচে বলে মনে হয় না, স্যার।’
‘তাই তো মনে হচ্ছে,’ বলল রানা নিচু গলায়। ‘খুব সম্ভব সব ভেঙে আবার নতুন করে বাড়ি তোলা হবে বলে লোকজন সরিয়ে দেয়া হয়েছে।’ একটা দেয়ালের গায়ে লেখা নম্বর দেখে এগোল রানা সামনে। ‘সাঁইত্রিশ নম্বরটা আরও আগে বলে মনে হচ্ছে।’
তিনটে বাড়ি ছেড়েই পাওয়া গেল বাড়িটা। দোতলা বাড়ি। প্লাস্টার খসে যাওয়ায় দাঁত বের করে হাসছে লাল লাল ইঁট। ঠেলা দিতেই খুলে গেল দরজাটা নিঃশব্দে। এত নিঃশব্দে খুলল যে থমকে গেল রানা একটু। চট করে টর্চের আলোটা চলে গেল দরজার হিঞ্জে।
‘তেল দোয়া হয়েচে স্যার, বলল গিলটি মিঞা ফিসফিস করে। ‘মনে হচ্চে লোক আচে।
ভিতরে আলো ফেলল রানা। একটা সরু প্যাসেজ দিয়ে কিছু দূর গিয়ে বাঁ পাশে দোতলায় উঠবার সিঁড়ি।
‘তুমি এখানেই অপেক্ষা করো, আমি ঢুকছি ভিতরে,’ বলল রানা। ‘চোখ কান খোলা রাখবে।’
‘নিশ্চয়।’
দু’পা এগিয়েই বসে পড়ল রানা। কাঠের মেঝে, ধুলো জমে আছে পুরু হয়ে, তার ওপর অনেকগুলো পায়ের ছাপ। মেয়েমানুষের জুতোর ছাপ দেখতে পেল রানা একজোড়া। উঠে দাঁড়াল।
সাবধান করল গিলটি মিঞা। ‘একটু সাবধানে পা ফেলবেন, স্যার। পচা কাটে পা পড়লে একেবারে ঝপাৎ করে পড়বেন পানিতে। নিচে পানি।’
পেছন ফিরে ভ্রূকুটি করল রানা, কিন্তু সেটা দেখতে পেল না গিলটি মিঞা। তাই চাপা গলায় বলল, ‘চুপ করে থাকো, কথা বোলো না।’
সিঁড়ির পাশেই একতলায় ঢোকার দরজা। আস্তে করে হ্যান্ডেলে চাপ দিয়ে ঠেলা দিল রানা দরজাটা। ক্যা…চ করে বিচ্ছিরি একটা শব্দ করে ফাঁক হয়ে গেল দরজা। চট করে ঘরের চারপাশে আলো বুলাল রানা। কেউ নেই ঘরে। অসংখ্য ঝুল, আর ধুলো। কেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধ এল নাকে। প্রকাণ্ড একটা মাকড়সা সড়সড় করে সরে গিয়ে একটা ঘুণে খাওয়া পচা তক্তার নিচে আত্মগোপন করল। দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে সিঁড়ির ধাপ পরীক্ষা করল রানা। ধুলো জমে আছে সিঁড়িতেও। পায়ের ছাপ দেখে পরিষ্কার বোঝা গেল দু’এক দিনের মধ্যেই একাধিক লোক ওঠানামা করেছে এ সিঁড়ি দিয়ে। এক আধটা হাই হিলের ছাপও দেখা যাচ্ছে আবছা ভাবে।
সাবধানে কাঠের সিঁড়িতে কোন রকম আওয়াজ না করে উঠে এল রানা দোতলায়। দুটো দরজা দেখা যাচ্ছে।
কান পাতল রানা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল আধমিনিট। নাক ডাকা তো দূরের কথা কারও নিঃশ্বাস পতনেরও শব্দ নেই। নিঝুমপুরী। প্রথম দরজার হ্যান্ডেলে চাপ দিল সে। নিঃশব্দে খুলে গেল দরজা।
দরজাটা দুই ইঞ্চি ফাঁক হতেই হঠাৎ একটা শব্দ হলো ঘরের ভিতর। আড়ষ্ট হয়ে গেল রানা। খচমচ করে কাগজ নাড়ার শব্দ হলো, তারপর মৃদু একটা ধুপ।
টর্চটা নিভিয়েই চট করে সরে গেল রানা দরজার সামনে থেকে। ডান হাতে বেরিয়ে এসেছে স্টিলেটো। দ্বিগুণ হয়ে গেছে বুকের ভিতর ঢিবঢিব শব্দ। আবার খচমচ আওয়াজ। আবার একটা মৃদু ধুপ শব্দ। পরমুহূর্তে কিচমিচ করে ডেকে উঠল ছুঁচো।
হাঁপ ছাড়ল রানা। ছুঁচোর কেত্তন।
পা দিয়ে কপাটের গায়ে একটা ঠেলা দিয়েই আলো ফেলল সে ঘরের ভিতর।
প্রকাণ্ড একটা ছুঁচো। থতমত খেয়ে গেল প্রথমটায়, তারপর ভয় পেয়ে ছুটে গেল দেয়ালের দিকে, লাফ দিয়ে ধাক্কা খেলো দেয়ালের গায়ে, ধুপ করে পড়ল মেঝেতে, তারপর বিদুৎবেগে অদৃশ্য হয়ে গেল ঘরের অন্ধকার কোণে।
ঘরের মাঝখানে ঢিবির মত উঁচু হয়ে আছে কি যেন। রানার টর্চের উজ্জ্বল আলোটা এসে স্থির হলো সেখানে।
পুরু ধুলোর ওপর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে জুলি মাযিনি। উলঙ্গ। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সে ছাতের দিকে। বাঁ স্তনের নিচে একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন।
.
মস্ত বড় একটা কদাকার মাকড়সা খুব সম্ভব রক্ত চাটছিল, রানাকে এগোতে দেখে ভয় পেল। সড়সড় করে জুলির বুকের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে লুকোবার চেষ্টা করল ঘাড়ের পাশে চুলের অন্ধকারে, জায়গাটা পছন্দ হলো না, চিবুক বেয়ে উঠে ওর নাক, মুখ আর খোলা চোখের ভিতর লোমশ পা ফেলে কপালে উঠল, সেখান থেকে একলাফে মেঝেতে পড়ে সুড়ুৎ করে ঢুকে গেল দুই তক্তার ফাঁকে একটা গর্তে। যেমন ছিল তেমনি শুয়ে আছে জুলি। স্থির।
চিকন ঘাম দেখা দিয়েছে রানার কপালে। সারাটা ঘর ঘুরে এসে আবার স্থির হলো টর্চের আলোটা জুলির ওপর। ছুঁচোটা দৌড়ে পালাল খোলা দরজা দিয়ে। হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়ল রানা মেঝেতে।
শুধু ধর্ষণ নয়, সারা শরীরে জায়গায় জায়গায় সিগারেটের আগুন ঠেসে ধরার চিহ্ন দেখতে পেল রানা। যা জানার জেনে নিয়ে ছুরি মারা হয়েছে ওর হৃৎপিণ্ড বরাবর।
প্রচণ্ড ক্রোধ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল রানার মাথার ভিতর। বহু কষ্টে দাঁতে দাঁত চেপে আত্মসংবরণ করল রানা। আঙুলের উল্টো দিক দিয়ে মেয়েটার গাল ছুঁয়ে দেখল, এখনও গরম। বড়জোর আধঘণ্টা আগে মারা গেছে।
ওকে পিটিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে রেখে নিশ্চয়ই পিছু ধাওয়া করে ধরেছিল জুলিকে ওরা দুজন। তারপর নির্যাতন করে জেনে নিয়েছে অনিলের ঠিকানা। এখানে নিয়ে এসে মেরে রেখে গেছে। অনিলকে এখানে পেয়েছিল ওরা? নিশ্চয়ই পাশের ঘরটায় ছিল অনিল? আছে?
ঘর থেকে বেরিয়ে এল রানা। দরজাটা বন্ধ করে সাবধানে চাপ দিল পাশের দরজার হ্যান্ডেল। দরজাটা এক ইঞ্চি ফাঁক করে সেখানে কান পাতল। কোন শব্দ নেই। তাহলে কি অনিলকেও…
আর এক ইঞ্চি ফাঁক করেই দরজার ফাঁকে টর্চ ধরল রানা। চট্ করে ঘুরিয়ে আনল আলোটা সারা ঘরে। এক নজরে বুঝতে পারল এটাই অনিলের ঘর।
একটা ক্যাম্প খাটের ওপর দুটো কম্বল বিছানো, পাশেই একটা প্যাকিং বাক্সের ওপর কিছু ফলমূল, ক্যাড ফুডের টিন, অর্ধেক মোমবাতি।
কেউ নেই ঘরে।
ঘরের ভিতর চলে এল রানা। মোমবাতিটা জ্বালল। চাইল চারদিকে।
ঘরের কোণে একটা এয়ার ব্যাগ। তার ভিতরের সমস্ত জিনিস ধুলো ভর্তি মেঝের ওপর ছড়ানো। খাটের নিচে একটা ব্রীফকেস। খোলা। ব্রীফকেসের গায়ে অনিলের নামের আদ্যাক্ষর লেখা। এ.সি.-অর্থাৎ অনিল চ্যাটার্জী। মেঝেতে পড়ে থাকা জিনিসগুলোর উপর চোখ বুলাল রানা। একটা বিস্কিটের টিন, রুমাল, গেঞ্জি, আন্ডারওয়্যার, জিলেট শেভিং কিট, পাসপোর্ট, টেক টুথব্রাশ, ফ্রহ্যান্স টুথপেস্ট, পামোলিভ সাবান। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ভালমত সার্চ করা হয়েছে অনিলের প্রতিটা জিনিস। তবু একবার ভাল করে খুঁজে দেখল রানা-কিছুই পাওয়া গেল না।
আর একবার চোখ বুলাল সারা ঘরে। কেন লুকিয়ে ছিল অনিল এই ঘরে? কারা খুঁজছে ওকে? ভারতীয় গুপ্তচরেরা, নাকি ইটালিয়ানরা, নাকি অন্য কেউ? কেন প্রাণ দিতে হলো জুলি মাযিনিকে? কি এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে ফেঁসে গেল অনিল? কোথায় এখন ও? ধরা পড়ল? কাদের হাতে?
হঠাৎ দেখতে পেল রানা রক্তমাখা ব্যান্ডেজ। দরজার কোণে দলা করে রাখা। আহত হয়েছে অনিল? তাই পালিয়ে যেতে পারছে না, এখানে ওখানে লুকিয়ে ফিরছে, সাহায্য চাইছে?
মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিল রানা। এমন কিছু ফেলে যাওয়া চলবে না যাতে জুলির হত্যাকারী বলে ফেঁসে যেতে পারে অনিল। পুলিস যদি প্রমাণ করতে পারে যে এই ঘরের জিনিসগুলো অনিলের তাহলে চার্জশীট দাখিল করবে অনিলেরই বিরুদ্ধে।
হঠাৎ মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন উদয় হতেই চমকে উঠল রানা। অনিলই খুন করেনি তো জুলিকে? কি প্রমাণ আছে রানার কাছে যে ওই সাদা আর কালো স্যুট পরা লোক দুজনই খুন করেছে ওকে? এমনও তো হতে পারে, সাবধান করতে এসেছিল জুলি এখানে, সেই সময় অনিল….
মাথা নেড়ে আজে বাজে চিন্তা দূর করে দিল রানা। এসব আবোল তাবোল ভাবনার শেষ নেই। খামোকা ভেবে লাভ হবে না। দ্রুত হাতে কিছু কিছু জিনিস তুলে ব্রীফকেসের ভিতর সাজিয়ে রাখতে শুরু করল রানা।
‘পুলিস আসচে, স্যার!’ ভীত সন্ত্রস্ত কণ্ঠস্বর।
চমকে দরজার দিকে ফিরল রানা। নিঃশব্দ পায়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে গিলটি মিঞা।
‘কোথায়? কতদূরে?’ প্রশ্নটা করেই হুইসেলের শব্দ শুনতে পেল রানা। বেশ কাছেই।
‘পুলের এ মাতায় এসে গেচে। আমার সন্দো হচ্চে এইদিকেই আসচে ওরা।’
নিজের অবস্থাটা পরিষ্কার টের পেল রানা। পাশের ঘরে ধর্ষিতা মৃতদেহ। এত রাতে এখানে কি করছে সে, তার কোন সন্তোষজনক জবাব নেই। পকেটে বার্গলার্স কিট। ধরা পড়লে সবকিছু চাপবে এখন ওরই কাঁধে। এই কেলেঙ্কারির দায় থেকে ছুটে বেরোনো সহজ হবে না।
মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিল রানা। ‘তুমি তোমার জায়গায় যাও, গিলটি মিঞা। ওরা এই বাড়িতে না-ও আসতে পারে।’ কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে আবার বাজল হুইসেল। রানা বুঝতে পারল, এই গলিতেই ঢুকছে পুলিস। রানার মুখের দিকে চেয়ে রইল গিলটি মিঞা উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে। রানা বলল, ‘বাইরে থেকে দরজার বল্টু লাগিয়ে দিয়ে লুকিয়ে পড়ো কাছাকাছি কোন বাড়িতে। যদি দেখো এ বাড়িতেই ঢুকছে পুলিস, তাহলে তোমার প্যাঁচার ডাকটা একবার ডেকে বাসায় ফিরে যাবে। যাও।’
একটু ইতস্তত করল গিলটি মিঞা রানার নিরাপত্তার কথা ভেবে, কিন্তু তর্ক করল না। দ্রুতপায়ে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে। আধমিনিটের মধ্যেই ব্রীফকেস হাতে নামতে শুরু করল রানা সিঁড়ি বেয়ে।
ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছেই শুনতে পেল প্যাঁচার ডাক। বাকি কয়েক ধাপ প্রায় উড়ে নেমে এল সে। দড়াম করে খুলে গেল বাইরের দরজাটা। পাঁচ ছ’টা টর্চের উজ্জ্বল আলোয় দিনের মত আলোকিত হয়ে গেল সরু প্যাসেজটা।
সাঁৎ করে সরে গেল রানা। ভারী বুটের শব্দ এগিয়ে আসছে। একটা কর্কশ কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে। ‘দুজন থাকো গেটের সামনে। তোমরা এসো আমার সঙ্গে।
সিঁড়ির পাশের দরজার হ্যান্ডেলে চাপ দিল রানা। ক্যাচ শব্দ করে খুলল একটা কবাট। ঢুকে পড়ল ভিতরে। দরজাটা বন্ধ করবার সাহস হলো না আর। দেয়ালের গায়ে সেঁটে সরে গেল দু’পা।
ঢিব ঢিব করছে বুকের ভিতর। টর্চের আলো এসে পড়ল ঘরে। একজন টর্চ হাতে ঢুকে আসছে।
‘ওদিকে না,’ বলল একজন। ‘ওপরে।
তবু খালি ঘরে একবার টর্চ বুলাল লোকটা। দেয়ালের গায়ে সেঁটে দম বন্ধ করে রেখেছে রানা। সরে গেল লোকটা দরজার সামনে থেকে। ধুপ ধাপ আওয়াজ আসছে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠার।
আস্তে করে সরে এল রানা জানালার কাছে। পায়ের নিচে পচা কাঠ ভেঙে পড়বার উপক্রম হলো। চট্ করে জানালার হ্যান্ডেলটা ধরে প্রায় ঝুলে পড়ল রানা শরীরের ওজন কমাবার জন্যে। মাথার ওপর কয়েক জোড়া বুটের শব্দ। আস্তে ছিটকিনি খুলে জানালা টপকে ওপারে চলে গেল রানা। ভিড়িয়ে দিল জানালা। কয়েক ফুট নিচে টলটল করছে পানি। মৃদু একটা ঝুপ শব্দ করে নেমে গেল সে পানিতে।
আন্দাজে ভর করে ব্যাক-স্ট্রোক দিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে রানা। দাঁতে কামড়ে ধরে রেখেছে ব্রীফকেসটা।
চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। আধঘণ্টা পর পৌঁছল ক্লান্ত রানা রিয়াল্টো ব্রিজের কাছাকাছি। মিনিট তিনেক বিশ্রাম নিয়ে উঠে পড়ল পারে। চিন্তা হলো, ফিরবে কি করে?
‘ভিজে তো একেবারে জবজবে হয়ে গেচেন, স্যার!’ গিলটি মিঞার মোলায়েম কণ্ঠস্বর।
‘তুমি যাওনি এখনও?’
‘না স্যার, ভাবলাম খেলাটা একটু দেকেই যাই। নুকিয়ে ছিলাম, লাশটা নিয়ে ওরা বিদেয় হতেই আবার গিয়ে ঢুকলাম ওই বাড়িটায়। আপনাকে কোতাউ খুঁজে না পেয়ে খাল ধরে ধরে এ পর্যন্ত এয়েচি। দেকি কুমীর দেকা যায়। তাই ভেঁড়িয়ে রইচি। মনে করলুম, নতুন মানুষ, এই শহরের গলিঘুঁচি চিনে বাসায় ফেরা কষ্ট হবে আপনার পক্ষে। এই ভেজা কাপড়ে কাউকে কিছু জিগেস করতে গেলেউ সন্দো করবে। তাছাড়া রাস্তায় লোক কোতায় যে জিজ্ঞেস…’
রানার কান খালি পেয়ে পেটের মধ্যে যত কথা আছে সব ঝেড়ে নামাবার উপক্রম করল গিলটি মিঞা। বকবকানিতে কান না দিয়ে দ্রুত কাপড় ছাড়ছে রানা। অনিলের শার্ট এবং প্যান্ট পরে নিল ও। লন্ড্রির চিহ্ন রয়েছে বলে নিয়ে এসেছে সে এগুলো ব্রীফকেসের মধ্যে করে। আঙুল বুলিয়ে চুলগুলো মোটামুটি ঠিক করে নিয়ে পাড় বেয়ে উঠে এল সে রাস্তায়।
দ্রুত পায়ে ফিরে যাচ্ছে ওরা বাসার দিকে। পথে আগাগোড়া সবটা ব্যাপার বলল রানা গিলটি মিঞাকে। সব শুনে গুম হয়ে গেল গিলটি মিঞা। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ চিন্তা করবার পর বলল, ‘মস্ত গ্যাড়াকলে জড়িয়ে পড়েচেন, স্যার। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে কারও সাহায্য পাওয়া যাবে না-না ইন্ডিয়া, না বাংলাদেশ। এদিকে কেসটার কোন সুরাহা হবার তো কোন হদিস দেকচি না। অনিল বাবুকে পেলে নাহায়…’
‘পেতেই হবে আমাদের।’
‘কোতায় খুঁজবেন? সূত্র যা ছিল সব তো ছিঁড়ে গেল। কোতায় পাবেন ওনাকে অন্দোকার হাতড়ে?’
‘ঠিকই বলেছ। এখন একমাত্র উপায় হচ্ছে ওই মেয়েটার আত্মীয়-স্বজনের কাউকে খুঁজে বের করা। তাদের কাছে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু তথ্য পাওয়া যাবে। হয়তো কোন পথ পাওয়া যেতে পারে এগোবার।
সান মার্কোর পেটা ঘড়িতে ঠিক যখন তিনটে ঘণ্টা পড়ল তখন পৌঁছল ওরা বাসায়।
বিশ্রাম দরকার। গিলটি মিঞাকে তার ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে এসে ঢুকল রানা। প্রথমেই জামা-কাপড় ছেড়ে শাওয়ারের নিচে ভিজল সে মিনিট পাঁচেক, তারপর গা-হাত-পা মুছে পরে নিল ঘুমোবার পোশাক। খাটের কিনারে বসে একটা সিগারেট ধরাল। ভ্রূ কুঁচকে মেঝের দিকে চেয়ে রয়েছে সে।
বাঁ হাতে চোয়ালটা ডলতে ডলতে সন্ধে থেকে এ পর্যন্ত সবগুলো ঘটনা আগাগোড়া পর্যালোচনা করল সে মনে মনে। অনেক ঘটনাই ঘটল, কিন্তু কতটা এগোতে পেরেছে ও? এটুকু নিশ্চিত ভাবে জানা গেছে যে ভেনিসেই ছিল অনিল এই কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত। ব্যস। ওকে উদ্ধার করবার ব্যাপারে যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়েছে ও এখনও। এগোতে পারেনি এক পা-ও।
বেঁচে আছে অনিল? নাকি মেয়েটার মত তাকেও শেষ করে ফেলা হয়েছে? কারা কাজ করছে ওর বিরুদ্ধে?
পুলিস খবর পেল কিভাবে? মহা ঝামেলা হয়ে যেত যদি ও ধরা পড়ত ওই বাড়িতে পুলিসের হাতে। ওকে ঝামেলায় ফেলার জন্যেই কি খবর দেয়া হয়েছিল পুলিসে? তৃতীয় কোন অনুসরণকারী ছিল, ওকে ওই বাড়িতে ঢুকতে দেখেই যে ফোন করেছে পুলিসে? নাকি পুলিসই জড়িত আছে এ ব্যাপারে?
চলতে চলতে হঠাৎ যেন একটা প্রকাণ্ড উঁচু প্রাচীরের সামনে হাজির হয়েছে রানা। এগোবার তো নয়ই, ভাবনারও কোন পথ পাচ্ছে না। খামোকা দেয়ালের গায়ে মাথা ঠুকে লাভ নেই। তার চেয়ে একটা ঘুম দিয়ে চাঙ্গা করে নেয়া দরকার শরীরটা।
শুয়ে পড়ল রানা। চোখ বুজতেই ভেসে উঠল ওর চোখের সামনে জুলি মাযিনির লাশটা।
কেন প্রাণ দিতে হলো মেয়েটাকে?