বিদেশী গুপ্তচর – ১.৫

পাঁচ

এগারোটা বাজতে পাঁচ মিনিটে পৌঁছল রানা ফ্লোরিয়ানে। এত রাতেও লোকজনের কমতি নেই। জায়গা পাওয়া মুশকিল। তার ওপর ক্যাবারে দেখতে গেলে একেবারে ভিতরে ঢুকতে হয়, ওখান থেকে চত্বরের দিকে লক্ষ রাখা যাবে না।

ঘুরে ফিরে দেখে কাফেতে একটা খালি টেবিল পেয়ে বসে পড়ল রানা। ক্যাবারের বাজনা ভেসে আসছে কানে, বিচিত্র সব ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছে দেশ-বিদেশের ট্যুরিস্টরা, দূর থেকে স্টীমার আর লঞ্চের ভেঁপু ভেসে আসছে মাঝে মাঝে এইসব বিশৃক্মখল শব্দ ছাপিয়ে। সবটা মিলিয়ে এক মহা জগাখিচুড়ি। এক পেগ ব্র্যান্ডির অর্ডার দিয়ে টেবিলের নিচ দিয়ে লম্বা করল রানা পা দুটো। সিগারেট ধরাল একটা।

মর্ডানো হোটেলে কিছুই জানা যায়নি। অনিলকে চিনতে পারল ম্যানেজার, কিন্তু কোন খোঁজ দিতে পারল না ওর। এ-ও বলল, ভেনিসে এলে ওর হোটেল ছাড়া কোথাও উঠবে না অনিল চ্যাটার্জী—যখন উঠেনি, তার মানে সে ভেনিসে আসেনি।

অথচ রানা জানে ভেনিসেই আছে অনিল। কার্ড জাল হলে অবশ্য অন্য কথা, কিন্তু ওটা জাল নয় বলেই ওর ধারণা। তাই যদি হবে তাহলে সরাসরি অরুণা চ্যাটার্জীর ঠিকানায় পাঠানো হলো না কেন সেটা? কেন মামা বাড়ির ঠিকানায় পাঠানো হলো এস.ও.এস? কেন রানার সাহায্য চাওয়া হলো?

যাই হোক, সবকিছু নির্ভর করছে এখন এই কাঁচ ফ্যাক্টরির মেয়েটার ওপর। মেয়েটা যদি আসে, এসে পৌঁছলেই অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। বাইরে পিয়াযার দিকে চেয়ে খুঁজল রানা মেয়েটাকে জনারণ্যে। বুঝতে পারল এই ভিড়ে মেয়েটাকে খুঁজে বের করা ওর পক্ষে অসম্ভব। ওকেই খুঁজে নিতে হবে মেয়েটার। ক্যাবারের কথা বলে এসেছে সে, সেখানে ঢোকার মুখে পাহারায় বসে আছে সে দারোয়ানের মত। এখন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করবার নেই ওর।

পাশের টেবিল ছেড়ে উঠে গেল একজন গর্দান মোটা বেঁটে লোক বিল চুকিয়ে দিয়ে।

সাদা স্যুট ও সাদা হ্যাট পরা একজন লম্বা লোক একটা থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বসল খালি টেবিলটায়। এক পেগ হুইস্কি অর্ডার দিয়ে সান্ধ্য পত্রিকা মেলে ধরল সামনে অলস ভঙ্গিতে।

ভুরু জোরা সামান্য কুঁচকে গেল রানার। মর্ডানো হোটেল থেকে বেরোবার সময় লোকটাকে দেখেছে না সে? হঠাৎ মনে পড়ল গিলটি মিঞাকে নিয়ে খাওয়া সেরে বাসায় ফিরবার সময়ও একটা ব্রিজের ওপর দেখেছে সে লোকটাকে এক নজর। এখানেও সেই একই লোক। ব্যাপার কি? অনুসরণ করছে? চেহারাটা একটু ভাল করে দেখে রাখা দরকার। সামান্য একটু কাত হয়ে বসল রানা যাতে অলক্ষ্যে লক্ষ্য করা যায় লোকটাকে।

লম্বা একহারা চেহারা, কিন্তু এক নজরেই বুঝল রানা প্রয়োজনের সময় দুর্ধর্ষ হয়ে উঠতে পারে এই লোকটা। একেবারে পেটা শরীর। শক্ত চোয়াল, ধূর্ত চোখ। হাতের কব্জি দেখলেই বোঝা যায় অসুরের শক্তি আছে লোকটার গায়ে। সেই সঙ্গে রয়েছে চিতাবাঘের দ্রুততা।

সতর্ক হয়ে গেল রানা। কড়া মাল। বেকায়দা অবস্থায় এর হাতে পড়লে দুঃখ আছে কপালে।

পিয়াযার দিকে চোখ বুলাল রানা আবার। ঘড়ি দেখল। সোয়া এগারোটা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই অর্ধেক পথ এসে গেছে মেয়েটা। পৌঁছে যাবে সাড়ে এগারোটার মধ্যেই। ফরমোজা গলি দিয়ে যদি শর্টকাট করে তাহলে পৌঁছবে পাঁচ মিনিট আগেই।

সাদা হ্যাট পরা লোকটা একবারও চাইল না রানার দিকে। একেবারে ডুবে আছে খবরের কাগজে। সন্দেহটা অমূলক কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ আসতে শুরু করল রানার মধ্যে। মিছেমিছিই অতি সতর্ক হতে যাচ্ছে সে? হতে পারে আজ সন্ধ্যে থেকে বারতিনেক দেখেছে সে এই লোকটাকে অথবা এর মতই অন্য কোন লোককে। তাতে কি? একটা লোককে তিনবার দেখলেই ভয় পাওয়ার কি আছে? হয়তো ওই লোকটাও সন্দেহ করতে আরম্ভ করেছে ইতিমধ্যে রানাকে, তাই অত মনোযোগ দিয়ে পড়ছে খবরের কাগজ, ভাবছে, সন্ধ্যে থেকে তিন-তিন বার দেখা হলো কেন এই ব্যাটার সঙ্গে, গুণ্ডা বদমাশ নয়তো?

যাই হোক, সাবধানের মার নেই। ঠিক এগারোটা পঁচিশ মিনিটে বিলের জন্যে ডাকল রানা বেয়ারাকে। বিল এবং টিপ্‌স্‌ দিয়ে সহজ ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল।

রানার এই উত্থানে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না লোকটা। বেয়ারার দিকে চেয়ে খালি গ্লাসটা নাড়ল, আর এক পেগ হুইস্কির অর্ডার দিল।

ঠাসাঠাসি করে রাখা টেবিল চেয়ারের গায়ে ধাক্কা না দিয়ে অতি সাবধানে বেরিয়ে এল রানা কাফে থেকে এঁকেবেঁকে। বাইরে বেরিয়ে একটা থামের আড়ালে এমন ভাবে দাঁড়াল যেন কাঁচের জানালা দিয়ে সাদা হ্যাট পরা লোকটার গতিবিধি লক্ষ্য করা যায়।

ভ্রূক্ষেপও করল না লোকটা। একবার চেয়েও দেখল না কোন্ দিকে গেল রানা। এমন মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে যে মনে হয় এটাই তার একমাত্র নেশা ও পেশা, এরই ওপর নির্ভর করছে ওর জীবন-মরণ। সন্দেহ প্রশমিত হলো রানার।

বেশ কিছুটা দূরে একটা থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে রানার দিকে চেয়ে রয়েছে একজন কালো হ্যাট, কালো স্যুট পরা মোটাসোটা বেঁটে লোক।

রানার দৃষ্টিটা ছুটে বেড়াচ্ছে পিয়াযার জনারণ্যের ওপর।

হতাশ হয়ে পড়তে যাচ্ছিল রানা, এমনি সময় দেখতে পেল মেয়েটাকে। একটা আলোকিত দোকানের প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা রানার দিকে চেয়ে। সেই কালো ইউনিফর্মটাই পরে আছে, কিন্তু মাথায় একটা স্কার্ফ এমন ভাবে জড়িয়েছে যেন মুখের খানিকটা অংশ ঢাকা পড়ে। তবু চিনতে কষ্ট হলো না রানার, এ মেয়ে সেই মেয়েই। ফিগারটা দেখে মনে মনে অনিলের রুচির প্রশংসা না করে পারল না সে।

ভিড় ঠেলে এগোতে শুরু করল রানা। বেশ কিছুদূর এগিয়ে একবার পেছন ফিরে তাকাল। যেন ওর গতিবিধির প্রতি কোন লক্ষই নেই লোকটার, তেমনি নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে ডুবে আছে খবরের কাগজে। সন্দেহটা সম্পূর্ণ দূর হয়ে গেল ওর।

বেঁটে লোকটাও দেখতে পেল মেয়েটাকে। একটু ঘুরে রওয়ানা হলো সে মেয়েটার দিকে। যেদিকটায় ভিড় কম সেদিকটা বেছে নিয়েছে সে, ফলে সে যে মেয়েটার দিকে এগোচ্ছে সেটা বোঝার উপায় নেই, তার ওপর ভিড় হালকা বলে রানার আগেই পৌঁছে যেতে পারবে সে মেয়েটার পেছনে।

এক মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে রইল মেয়েটা। রানা ত্রিশ গজের মধ্যে এসে পড়তেই হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে মার্সেরিয়ার দিকে হাঁটতে শুরু করল সে।

রানা চলল পেছন পেছন

বেঁটে মোটা লোকটা কমিয়ে দিল চলার গতি। রানার থেকে বেশ কিছুটা ডাইনে এবং কয়েক হাত পেছনে চলল সে।

খবরের কাগজের আড়াল থেকে দেখল লম্বা লোকটা, চলে যাচ্ছে রানা। বিল চুকিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। কাফে থেকে বেরিয়েই আঁচ করে নিল সে, কোনদিকে চলেছে রানা। পেছনে পেছনে অনুসরণ না করে সোজা বাঁ দিকে রওয়ানা হলো, যাতে ঠিক সময় মত ওদের কাছাকাছি পড়া যায় বড় রাস্তায়।

পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে রানা মেয়েটাকে। একবারও পিছু ফিরে না চেয়ে হেঁটে চলেছে মেয়েটা। রানা ওকে ওভারটেক করবার চেষ্টা করল না। মেয়েটার সমান গতিতেই এগোচ্ছে সে। কারণ মেয়েটা ইচ্ছে করলেই থেমে দাঁড়িয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে পারে, তা যখন করছে না তখন নিশ্চয়ই সে চায় না, রানার সঙ্গে তার এই ব্যস্ত রাজপথে দেখা হোক। যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে সেদিকে যাওয়াই ভাল।

আলোকোজ্জ্বল দোকান-পাটগুলো ছাড়িয়ে কিছুদূর এগিয়েই ডানদিকে একটা প্রায়ান্ধকার গলিতে ঢুকে পড়ল মেয়েটা। ঢুকে পড়ল রানাও। বেশ কিছুদূর গিয়ে ঝট্ করে পেছনে ফিরল রানা একবার। কিন্তু তার আগেই সরে গেছে মোটা লোকটা একটা দেয়ালের আড়ালে। কান পেতে রানার পায়ের শব্দ শুনছে সে।

রানা বাঁয়ে মোড় নিতেই সাদা হ্যাট পরা লোকটা এগিয়ে এল।

‘ওইদিক দিয়ে ঘুরে যাও তুমি,’ বলল মোটা লোকটা। ‘আমি যাচ্ছি পেছনে পেছনে।

নিঃশব্দ পায়ে দৌড় দিল দু’জন দু’দিকে। সাদা হ্যাট পরা লোকটা রানা যে পথে চলেছে তার সমান্তরাল একটা গলিতে অদৃশ্য হয়ে গেল, ওদেরকে সামনে থেকে ধরার জন্যে।

মোড় নিয়েই দেখল রানা, গলিটা জনশূন্য। কেউ অনুসরণ করলে দূর থেকেই দেখা যাবে তাকে। বেশ কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে পদক্ষেপ দ্রুততর করল সে। ততক্ষণে আরেকটা মোড় ঘুরেছে মেয়েটা।

এই মোড়টা ঘুরেই দেখতে পেল রানা, কয়েক পা এগিয়ে থেমে দাঁড়িয়েছে মেয়েটা ওর জন্যে।

‘কিছু মনে করবেন না, আপনার নামটা জানতে পারি?’ ফ্যাসফেঁসে গলায় জিজ্ঞেস করল মেয়েটা।

‘মাসুদ রানা। থেমে দাঁড়িয়ে উত্তর দিল রানা। আপনি কে? জুলি মাযিনি?’

‘হ্যাঁ।’ অবাক হলো মেয়েটা সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনের মুখে নিজের নাম শুনে। এদিক ওদিক চাইল। ‘কেউ অনুসরণ করছে না তো আপনাকে, সিনর মাসুদ রানা?’

সাদা হ্যাট পরা লোকটার কথা মনে পড়ল রানার। একটু ইতস্তত করে বলল, ‘মনে হয় না। অনিলের কি খবর? কোথায় আছে ও?’

‘ভয়ানক বিপদের মধ্যে আছে অনিল। পাগলের মত খুঁজছে ওরা ওকে। আপনাকেও খুব সাবধানে…’

‘কারা?’ প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল রানা। ‘কারা খুঁজছে ওকে?’

চট্ করে রানার হাত ধরল মেয়েটা। মড়ার মত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ওর মুখটা।

‘শুনতে পাচ্ছেন!’

কান খাড়া করল রানা। দ্রুত হালকা পায়ের শব্দ। যে গলিটা ছেড়ে ওরা এই গলিতে ঢুকেছে সেই গলিপথ ধরে এদিকে আসছে কেউ।

‘আসছে!’ চাপা ফ্যাসফেঁসে গলায় বলল মেয়েটা। ‘কে যেন আসছে এদিকে!’

‘ভয় নেই,’ বলল রানা। ‘কেউ আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। অনিল কোথায়?’

‘মনডোলো লেনের ৩৭ নম্বর…’ আঁৎকে উঠে থেমে গেল জুলি। একজন কালো স্যুট পরা বেঁটেমত মোটা লোক এগিয়ে আসছে ওদের দিকে।

রানার কব্জি খামচে ধরল মেয়েটা। বিবর্ণ মুখে একটা বাড়ির বারান্দার দিকে সরে গেল। রানাও সরল একটু লোকটাকে পথ করে দেয়ার জন্যে। গলিগুলো বড় বেশি সরু। ঢাকার তাঁতিবাজারকেও হার মানায়। রানা ভাবল, বহুদিনের পুরানো শহর বলেই হয়তো এ রকম।

কাছাকাছি এসেই হঠাৎ থেমে দাঁড়াল লোকটা। রানা প্রস্তুত হয়ে যাচ্ছিল, এমন সময় সদ্য প্যাকেট থেকে বের করা একটা সিগারেট দেখাল লোকটা ওকে। ‘কিছু মনে করবেন না, সিনর। ম্যাচ আছে আপনার কাছে?’

‘আছে।’ লোকটাকে যত শীঘ্রি সম্ভব ভাগাবার জন্যে চট্‌ করে পকেটে হাত দিল রানা।

বিদ্যুৎবেগে এক পা এগিয়ে এল লোকটা, রানার হাতটা বের করে আনার আগেই প্রচণ্ড জোরে ঘুসি মারল রানার পেটে।

মুহূর্তের মধ্যে পেটের পেশীগুলো শক্ত করে না নিলে এই এক ঘুসিতেই লিভার ফেটে মারা যেতে পারত রানা। ব্যথায় কুঁচকে গেল রানার চোখ-মুখ, সামনের দিকে বাঁকা হয়ে গেল শরীরটা। কিন্তু এক হাত পকেটে ভরা অবস্থাতেই দ্বিতীয় ঘুসি থেকে বাঁচার জন্যে ঝট্ করে মাথাটা সরিয়ে নিল সে একপাশে। থুতনি স‍ই করে মারা ঘুসিটা চোয়ালে লেগে সাঁ করে বেরিয়ে গেল কানের পাশ দিয়ে।

বাঁ হাতে ঘুসি মারল রানা একটা। ঘুসিটা লাগল লোকটার পাঁজরের নিচে ঠিক হৃৎপিণ্ড বরাবর। ঘোঁৎ করে একটা শব্দ বেরোল লোকটার মুখ দিয়ে। বেকায়দা অবস্থাতে চালানো রানার ঘুসির ওজন চমকে দিয়েছে ওকে। পিছিয়ে গেল এক পা। রানার ডান হাতটা বেরিয়ে আসছে কোটের পকেট থেকে, কাজেই আর কোন রকম সুযোগ না দেয়াই স্থির করল সে। দমাদম দুটো ঘুসি মারল রানার পাঁজরের উপর। এর কোন দরকার ছিল না, প্ৰথম ঘুসিতেই আসলে কাবু হয়ে গিয়েছিল রানা। টলটলায়মান অবস্থায় আরও দুটো ঘুসি খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে। হামাগুড়ি দিয়ে উঠে বসল রানা, তারপর উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। হাঁটুতে জোর নেই, ঠক-ঠক করে কাঁপছে পা দুটো। সেই অবস্থায় টের পেল পালিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা, দৌড়াচ্ছে প্রাণপণে।

দড়াম করে পড়ল শেষ ঘুসিটা চোয়ালের ওপর। মাত্র ছ’ইঞ্চি দূর থেকে মারা ঘুসিটা খেয়ে বন্ করে ঘুরে উঠল রানার মাথা। একরাশ সর্ষেফুল দেখা গেল। ছিটকে গিয়ে ওপাশের দেয়ালের গায়ে ধাক্কা খেলো রানা, তারপর ঝুপ করে পড়ে গেল মাটিতে। এবং জ্ঞান হারাল।

.

একটা সুরেলা নারী কণ্ঠ শুনে জ্ঞান ফিরল রানার।

‘মারা গেছে নাকি মানুষটা?’

রানা অনুভব করল তার শরীরটা নেড়েচেড়ে দেখছে কেউ। একটা পুরুষ কণ্ঠ বলল, ‘না, জ্ঞান হারিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’

হামাগুড়ি দিয়ে উঠে বসবার চেষ্টা করল রানা। মাথাটা এপাশ-ওপাশ নাড়ল বন্য জন্তুর মত। চোখ মেলল। দামী কাপড়-চোপড় পরা দুজন তরুণ-তরুণী। উদ্বিগ্ন দুজোড়া চোখ চেয়ে রয়েছে ওর মুখের দিকে। রানাকে চোখ মেলতে দেখে মনে হলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

‘দয়া করে নড়াচড়া করবেন না এখন। এক আধটা হাড়গোড় ভেঙে গিয়ে থাকতে পারে।’ নরম গলায় বলল লোকটা।

‘না। ঠিকই আছি।’ উঠে বসল রানা। চোয়ালটাতে হাত বুলাল। পাকস্থলীতে কেমন যেন একটা চাপা ব্যথা অনুভব করছে সে। কপালের একপাশ ফুলে আছে, টের পেল হাত দিয়ে ছুঁয়ে। ডান হাতটা ওপরে তুলল সে। ‘একটু সাহায্য করুন।’

চট্ করে রানার হাত ধরল মেয়েটা। উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল রানাকে।

উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলে নিতে খানিক সময় লাগল রানার। সারা শরীর অবশ হয়ে গিয়েছিল, ধীরে ধীরে ফিরে আসছে আবার ওর শক্তি। গলিটার এপাশ থেকে ওপাশ চোখ বুলাল রানা একবার। তারপর বলল, ‘নাহ্, কিছু হয়নি। ঠিকই আছি।’ হাত-পা ঝাড়া দিল। ‘কাউকে দেখতে পেয়েছিলেন?’

‘না। পথ হারিয়ে ঘুরছি আমরা। আপনার ওপর আর একটু হলে হুমড়ি খেয়েই পড়ছিলাম। সত্যিই ঠিক আছেন তো?’

‘হ্যাঁ। কোন ভুল নেই তাতে। ধন্যবাদ। পকেটে হাত দিল রানা। কোটের পকেট থেকে মানিব্যাগটা গায়েব। নিজের ওপরই চটে গেল রানা। এতবড় ভুল করল সে কি করে? সেই মেয়েটার কপালে কি ঘটল কে জানে!

‘ছিনতাই হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল মেয়েটা।

‘সেই রকমই মনে হচ্ছে।

রাগে ফেটে পড়ল মেয়েটার সঙ্গী। ‘আশ্চর্য এই ইটালিয়ানগুলো! সব গুণ্ডা বদমাইশ। এখান থেকে সরে পড়া দরকার। আমরা হোটেল গ্রিটিতে উঠেছি। ইনি আমার ছোট বোন, লুইসা পিয়েত্রো। আমার নাম সিলভিও পিয়েত্রো। আমাদের যদি হোটেলে পৌঁছে দেন তাহলে দু’পেগ ভালো ব্র্যান্ডি খাওয়াতে পারি।’

‘আহ্, সিলভিও, নিশ্চয়ই ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে। আগে খানিকটা বিশ্রাম দরকার ওর।

‘না, ঠিক আছি।’ মেয়েটার দিকে ছোট্ট একটু বো করল রানা। ‘আমার জন্যে ভাববেন না। কোন অসুবিধে নেই এখন আর। আপনাদের রাস্তা চিনিয়ে দেব আমি, কিন্তু চেহারার যে হাল হয়েছে, এই অবস্থায় এখন হোটেলে না যাওয়াই ভাল। আমি বাসায় ফিরব। আমার নাম মাসুদ রানা।’

‘মাসুদ রানা!’ এক পা এগিয়ে এল মেয়েটা। রানার মুখটা পরখ করে দেখবার চেষ্টা করছে আবছা আলোয়। ‘আমি তো চিনি আপনাকে! কোথায় যেন পরিচয় হয়েছিল আপনার সঙ্গে? ওমা, আজই তো আপনার সঙ্গে একই ট্রেনে ফিরলাম লিডো এয়ারপোর্ট থেকে। বান্ধবীকে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম। আপনার পাশের সীটেই বসেছিলাম আমি। চিনতে পারছেন?’

রানার মনে পড়ল অপূর্ব সুন্দরী একটা মেয়ের পাশে বসে এসেছে সে লিডো থেকে ভেনিস। দু’এক টুকরো আলাপও হয়েছিল। কোন রকম ঘনিষ্ঠতার চেষ্টা করেনি সে কাজে আসছে বলে, কিন্তু স্পষ্ট অনুভব করেছিল আশ্চর্য এক আমোঘ আকর্ষণে টানছে মেয়েটা ওকে। তাজা, উষ্ণ একটা আকর্ষণ আছে মেয়েটার মধ্যে।

‘চিনেছি এবার,’ বলল রানা। ‘কিন্তু আপনারা কি ইটালিয়ান নন?’

‘বাবা ইটালিয়ান, কিন্তু মা ফরাসী। আমরা ফ্রান্সে মানুষ হয়েছি।’ হাসল মেয়েটা। ‘নব্বই ভাগ ফরাসী, দশ ভাগ ইটালিয়ান আমরা।’

‘চলুন, এগোনো যাক,’ বলল রানা। দুটোকে ভাগানো দরকার। ওর মাথায় একমাত্র চিন্তা এখন জুলি মাযিনি। কি হলো মেয়েটার? ধরা পড়ল শত্রুপক্ষের হাতে, নাকি কিছুক্ষণ আগের ব্যাপারটা সত্যিই একটা ছিনতাইয়ের ঘটনা? অনিলের সঙ্গে কোন যোগ নেই এর? কোনটা ঠিক জানতে হবে রানাকে। খুব শীঘ্রি। ‘আপনাদের বড় রাস্তায় তুলে দিয়ে যাই।’

উজ্জ্বল আলোয় এসে রানা দেখল, ভাই-বোনের প্রায় একই চেহারা। বোনের ওপর ভাইয়ের প্রভাব, না ভাইয়ের ওপর বোনের প্রভাব বোঝা গেল না। দুজনেই দেখতে ভাল। বাইশ থেকে সাতাশের মধ্যে বয়স। চকচকে বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, মুখে কোমল একটা অমায়িক ভাব, সাজপোশাক সর্বাধুনিক, দামী।

হাত বাড়িয়ে দিল সিলভিও রানার দিকে। ‘অসংখ্য ধন্যবাদ। ব্যাপারটা কি ঘটেছিল জানার জন্যে দারুণ কৌতূহল হচ্ছে। জানি জিজ্ঞেস করাটা অভদ্রতা, তাছাড়া এখন আপনার বিশ্রাম দরকার। পরে কোন একদিন যদি আপনার মুখে ঘটনাটা শুনতে পেতাম…’

‘নিশ্চয়ই। আমি আছি আরও সাতদিন। এর মধ্যে একদিন আপনাদের হোটেলে গিয়ে শুনিয়ে আসব গল্পটা। ডেলা টলেটা বলে একটা প্যালাযোতে আছি আমি, স্যানসোভিনোর লাইবেরিয়া ভেচিয়ার কাছে। আপনারাও সময় পেলে একটা ফোন করে চলে আসতে পারেন যে কোন সময়। চলি এখন, কেমন?’

‘আপনি দুর্দান্ত লোক, সিনর মাসুদ রানা,’ বলল মেয়েটা। ‘চোয়ালে কপালে যে দাগ দেখছি তাতে আঘাতের পরিমাণ বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। এতবড় আঘাত হজম করাটা সোজা কথা নয়!’

বিনীত হাসি হাসল রানা। ‘ও কিছু নয়। অভিনয় করছি আসলে। বাসায় পৌঁছেই কান্নায় ভেঙে পড়ব। চলি, গুড বাই।’

দ্রুত পায়ে হেঁটে চলল রানা বাসার দিকে।

কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলে দিল গিলটি মিঞা। অবাক হয়ে দেখল রানার বিধ্বস্ত চেহারা। এরকম মাঝেমধ্যে দেখে অভ্যাস আছে ওর। কোন প্রশ্ন করল না।

ঘরে ঢুকেই কাপড় ছাড়ল রানা প্রথমে। একটা নেভি ব্লু রঙের প্যান্ট, গাঢ় কালচে-সবুজ রঙের শার্ট, আর কালো চামড়ার জ্যাকেট পরল। জুতো জোড়া বদলে রবার সোলের একজোড়া মোকাসিন পায়ে দিল। সুটকেসের গোপন একটা কম্পার্টমেন্ট থেকে বেরোল একটা ফল্স্ ঘড়ি-ঘড়ির মত কাঁটা-ডায়াল সবই আছে কিন্তু ভিতরে কোন যন্ত্রপাতি নেই। ব্যান্ডটা খুললেই ভারী একটা ধারাল অস্ত্রে পরিণত হবে সেটা। একটা খাপে পোরা স্টিলেটো বেঁধে নিল রানা ডান ঊরুতে চামড়ার স্ট্র্যাপ দিয়ে। প্যান্টের পকেটের নিচ দিকটায় সেলাই নেই, হাত ঢুকিয়ে অনায়াসে বের করে আনা যায় ছুরিটা দরকারের সময়। তালা খোলার জন্যে বার্গলার্স কিট বের করে রাখল রানা হিপ পকেটে। বাঁ পকেটে রাখল একটা শক্তিশালী টর্চ, ইচ্ছে করলে এর রশ্মিকে ছোট করে দশ ফুট দূরে একটা সিকির সমান আলো ফেলা যায়। হাজার লিরার গোটা কয়েক নোট শার্টের বুক পকেটে রেখে খাটের ওপর বসল রানা। সিগারেট ধরাল।

ধরে নিতে হবে, বেঁটে বক্সারটা অনিলের শত্রুপক্ষের কেউ। সাধারণ চোর বা গুণ্ডা হতে পারে, কিন্তু সতর্কতার খাতিরে ওকে বিরুদ্ধ-পক্ষের কেউ বলে ধরে নেয়া উচিত। তাহলে কি জুলি মাযিনির পরিচয় জেনে গেছে ওরা? ধরে ফেলেছে ওকে? অত্যাচারের মুখে যা জানে বলে দিতে বাধ্য হবে জুলি তাহলে? ধরা পড়ে যাবে আত্মগোপনকারী অনিল?

নাহ্ বড় বোকামি হয়ে গেছে। আরও অনেক সতর্ক হওয়া উচিত ছিল ওর। কিন্তু অনুশোচনা করে কোন লাভ নেই। কিসের বিরুদ্ধে সতর্ক হবে সে? অচেনা শত্রুর কাছ থেকে সতর্ক থাকা যায় না। কাদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যাপারে নিজেকে জড়িয়েছে অনিল, কে মিত্র, কে শত্রু কিছুই জানে না রানা-এই অবস্থায় কিভাবে সাবধান হবে সে?

তবে এবার আক্রমণ যেদিক থেকেই আসুক না কেন, অত সহজ হবে না ওকে কাবু করা। এখন একমাত্র ভয় পুলিসকে। এই সব যন্ত্রপাতি সহ পুলিসের হাতে ধরা পড়লে বারোটা বেজে যাবে ওর।

মনডোলা লেনের ৩৭ নম্বর বাড়ি-এর বেশি আর কিছুই জানা যায়নি মেয়েটার কাছ থেকে।

ওখানেই কি লুকিয়ে আছে অনিল? গলিটাই বা কোথায়? ভেনিসের অসংখ্য গলির কোন্‌টা মনডোলা লেন? কি করে খুঁজে পাবে রানা?

একটা ঘন ছাই রঙের শার্ট ও প্যান্ট পরে এসে দাঁড়াল দরজার কাছে গিলটি মিঞা। প্রস্তুত। ‘কোতাউ চললেন, স্যার? আমাকে নেবেন?’

রানা না নিলেও সে যে গোপনে অনুসরণ করবে ওকে তাতে কোন সন্দেহ নেই। মৃদু হেসে সায় দিল রানা। সুচইটার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘বাতিটা নিভিয়ে দাও দেখি?’

ঘরটা অন্ধকার হয়ে যেতেই জানালার পাশে এসে দাঁড়াল রানা, পর্দাটা ফাঁক করল। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে রাস্তা।

রাত এখন সোয়া একটার কম নয়। কিন্তু এখনও দলে দলে চলেছে ট্যুরিস্টরা সান মার্কোর দিকে। গতি অপেক্ষাকৃত শ্লথ, এই যা তফাৎ-লোকজন প্রচুর রাস্তায়।

মিনিট দুয়েক চেয়ে রইল রানা রাস্তার দিকে। তারপর এক টুকরো কঠোর হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটে। নিঃশব্দ, নিষ্ঠুর হাসি।

সান মার্কোর দিকে পিছন ফিরে একটা থামের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তন্দ্রালু, অলস দৃষ্টিতে ট্যুরিস্টদের দিকে চেয়ে রয়েছে একজন লম্বা লোক। পরনে তার সাদা স্যুট, সাদা হ্যাট।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *