তিন
রঞ্জন চৌধুরী। নামটা শুনলে মনে হয় কোন ছেলে ছোকরা হবে হয়তো। আসলে বয়স আটান্ন বছর। বেঁটে খাটো, ধুতি-শার্ট এবং তার ওপর পুরানো ছাঁটের কোট পরা সাদাসিধে লোকটিকে দেখলে যে কেউ মনে করবে কোন সরকারী অফিসের হেড ক্লার্ক, বড়জোর সেকশন অফিসার। আসলে ভদ্রলোক ভারতীয় সিক্রেট সার্ভিসের চীফ। এমন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, ডাকসেঁটে চীফ আর আসেনি এই ডিপার্টমেন্টে।
অফিসার্স ক্যান্টিন থেকে খাওয়া সেরে লাউঞ্জের নির্জন কোণে পার্কের দিকে খোলা একটা জানালার ধারে বসলেন তিনি। বেয়ারা কফি দিয়ে গেল এক কাপ। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে বসে রইলেন চুপচাপ। গভীর কোন চিন্তায় মগ্ন।
কফির কাপে চুমুক না দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল রানা, তারপর উঠে গিয়ে দাঁড়াল রঞ্জন চৌধুরীর টেবিলের পাশে।
‘এই যে! কেমন আছেন? বসতে পারি?’
ঝট করে রানার মুখের দিকে চাইলেন চীফ। রানাকে দেখে একটু অবাক হলো দৃষ্টিটা। মুহূর্তে সামলে নিয়ে বললেন, ‘নিশ্চয়ই। কেমন আছেন? আমি জানতাম আপনি এতক্ষণে রওয়ানা হয়ে গিয়েছেন ভিয়েনার পথে।’
‘কাল যাচ্ছি।’ বসল রানা চীফের মুখোমুখি।
‘ওখান থেকে সোজা ফিরে আসবেন, না আরও কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে আছে?’
‘ভাবছি একটু ভেনিস ঘুরে আসব।’
‘দ্যাটস্ গুড। ফেস্টিভ্যালটা দেখার জন্যে তো? আমি শুনেছি, দারুণ নাকি ওদের লা সেনেরেন্টোলা।
ফেস্টিভ্যাল সম্পর্কে আলোচনায় রানার তেমন উৎসাহ নেই লক্ষ করে সরাসরি রানার চোখের দিকে চাইলেন রঞ্জন চৌধুরী। ভুরু নাচালেন। ‘কি খবর?’
‘একটা ব্যাপারে আপনার সাহায্য দরকার।’
ভুরু জোড়া সামান্য একটু কুঁচকে উঠেই আবার সোজা হয়ে গেল। ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। কি ব্যাপারে?’
‘অনিল চ্যাটার্জীর ব্যাপারে আমি আগ্রহী।’
স্থির দৃষ্টিতে রঞ্জন চৌধুরীর মুখের দিকে চেয়ে কথাটা উচ্চারণ করল রানা, আশা করেছিল এ প্রশ্ন শুনে চীফের কি প্রতিক্রিয়া হয় সেটা লক্ষ করলে কিছুটা আঁচ করতে পারবে সে ব্যাপারটা। কিন্তু কোনরকম কোন প্রতিক্রিয়া টের পাওয়া গেল না তার মধ্যে। কোটের পকেট থেকে একটা চারমিনারের প্যাকেট বের করে খুলে এগিয়ে ধরলেন তিনি রানার দিকে, রানা একটা বের করে নিতেই নিজেও ঠোঁটে লাগালেন একটা, রানার গ্যাস লাইটারের আগুনে ধরিয়ে নিলেন সিগারেট। লম্বা করে গোটা কয়েক টান দিয়ে ঠোঁট থেকে আঙুলের ফাঁকে নিয়ে এলেন সিগারেটটা। রানার চোখের ওপর স্থির হলো তাঁর দৃষ্টি।
‘অনিল, না? অনিল চ্যাটার্জী। হুম। তা, আপনি তার ব্যাপারে উৎসাহী কেন?’
‘নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে আমরা এক সঙ্গে কাজ করেছিলাম কিছুদিন। ওর সততা আর দেশপ্রেম আমাকে মুগ্ধ করেছিল। ভাল লেগেছিল ছেলেটাকে। ওর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না শুনলাম।
‘আমিও তাই শুনেছি,’ বললেন রঞ্জন চৌধুরী। কফির কাপে চুমুক দিলেন আরেকটা। ‘আজকাল সবকিছুতেই ভেজাল। কফির সে স্বাদ আর নেই। সেই ছাত্রজীবন থেকে খাওয়ার পর এক কাপ করে কফি খাওয়ার অভ্যাস…’
‘কি হয়েছে ওর?’
চোখ মিটমিট করলেন রঞ্জন চৌধুরী।
‘কার কি হয়েছে?’
মৃদু হাসল রানা। ‘এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন আপনি, মিস্টার চৌধুরী। অনিল নিখোঁজ। আমি জানতে চাই কি হয়েছে ওর।
‘আমি জানি না। সত্যিই জানি না।’ কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উঠবার উপক্রম করলেন রঞ্জন চৌধুরী। ‘এবার আমাকে উঠতে হয়। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। সন্ধের সময় আবার একটা থিয়েটার দেখার নেমন্তন্ন রয়েছে-সস্ত্রীক। অফিসের কাজে দেরি করে ফেললে একেবারে কুরুক্ষেত্র বেধে যাবে। কি যে মজা পায় ওরা এসবে এসবে বুঝি না। থিয়েটার-ফিয়েটারে আমার কোনদিনই…’
‘বিপদে পড়েছে অনিল?’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রঞ্জন চৌধুরী।
‘বড় নাছোড়বান্দা লোক আপনি, মশায়।’ সিগারেটে একটা টান দিয়ে বললেন, ‘সেটা সম্ভব। আমি ঠিক জানি না, এবং সত্যি বলতে কি খুব একটা কেয়ারও করি না। উঠি এবার।
একটু সামনে ঝুঁকে এল রানা। ‘এক মিনিট। অনিলকে আমি সৎ ছেলে হিসেবে জানি। ওর মা আজ এসেছিলেন আমার কাছে। আপনি যদি এভাবে এড়িয়ে যান তাহলে অন্যত্র খবর সংগ্রহ করতে হবে আমার।’
একটু যেন থমকে গেলেন রঞ্জন চৌধুরী। দৃষ্টিটা একটু কাত করে ভাবলেন তিন সেকেন্ড, তারপর অমায়িক ভঙ্গিতে ফিরলেন রানার দিকে। ‘ছোট্ট একটা উপদেশ দেব আপনাকে। নিজের চরকায় তেল দিন। এ ব্যাপারে আপনার কিছুই করবার নেই। ভেনিস যাচ্ছেন যান, ফূর্তি করে ফিরে যান নিজের দেশে।
কঠোর হয়ে গেল রানার মুখটা। বলল, ‘ধন্যবাদ! অনিলকে খুঁজে বের করতে চাই আমি। আপনার সাহায্য না পেলে অন্য রাস্তা দেখতে হবে আমাকে।’
রানার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন রঞ্জন চৌধুরী, রানার চোখে মুখে দেখলেন অনমনীয় দৃঢ়-সংকল্প। মুচকে হাসলেন তিনি।
‘আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারছি না বলে দুঃখিত। শুধু এটুকু বলতে পারি, নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল মেরেছে অনিল চ্যাটার্জী, এখন আর কারও কিছু করবার নেই। ওকে নিয়ে কারও মাথা ঘামানোও উচিত বলে মনে করি না আমি। আপনাকে এতটা খোলাখুলি ব্যাপারটা বললাম এই জন্যে যে আমি চাই না আপনি এর মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে জলটাকে আরও খানিকটা ঘোলাটে করে তুলুন। ইস্ আ ম্যাটার অফ স্টেট-এর বেশি আর কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এর ভেতর নাক গলাবেন না। আরও সহজ করে বলতে হবে?’
চৌধুরীর চোখে চোখ রাখল রানা। বলল, ‘না। কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারলাম না আমি। গতকাল যে ছিল আপনাদের বিশ্বস্ত কর্মচারী হঠাৎ আর তার ভালমন্দে কিছুই এসে যায় না আপনাদের, চোখ উল্টে নিচ্ছেন বেমালুম; এটা কেমন উদ্ভট ঠেকছে আমার কাছে। কিন্তু সেটা আপনাদের ব্যাপার, আপনারা বুঝবেন। তবে বলতে বাধ্য হচ্ছি, অনিলের মায়ের সঙ্গে আপনারা যে ব্যবহার করেছেন, যেভাবে হেস্তনেস্ত করেছেন সন্তানের সংবাদ জানার জন্যে ব্যাকুল এক বৃদ্ধা মাকে
অবাক চোখে রানার মুখের দিকে চেয়ে ছিলেন রঞ্জন চৌধুরী, হঠাৎ হেসে উঠলেন।
‘এই সব ভাবালুতা ত্যাগ করবার ট্রেনিং দেয়া হয় না আপনাদের? এরকম সস্তা আবেগ আপনাকে কত বড় বিপদের মধ্যে ফেলতে পারে সে শিক্ষা দেননি আপনাদের চীফ?’
‘তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, সব কিছুর গোড়ার কথা মনুষ্যত্ব। এখানে কিছুর সাথে কোন আপোষ নেই। সবার ওপরে স্থান দিতে হবে একে। শিখিয়েছেন, মনুষ্যত্বকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রয়োজন হলে নিজের প্রাণটা বিসর্জন দিতে দ্বিধা কোরো না। কারণ, এটা নষ্ট হয়ে গেলে ওই প্রাণের আর কোন দাম থাকে না।’
বাঁকা করে হাসলেন রঞ্জন চৌধুরী।
‘ইটস্ আ ডেঞ্জারাস গেম, মাই ডিয়ার ইয়াং ম্যান। হয় মারো, নয় মরো। ওইসব ভাবালুতা হয়তো বই পুস্তকে বেশ মানানসই মনে হতে পারে, বাট নট ইন প্র্যাকটিকাল মেটিরিয়ালিস্টিক ওঅলড। এনি ওয়ে, আপনি বা আপনার চীফ যদি ভাব জগতে বিচরণ করে আনন্দ লাভ করেন, আমার আপত্তির কিছুই নেই। আপনাদের ভাবের বোঝা আমাদের ঘাড়ে না চাপালেই আমরা খুশি হব। যাই হোক, আপনার শেষ প্রশ্নটার উত্তর দিয়েই আমি উঠব। অনিলের মা-র সঙ্গে যে ব্যবহার করতে আমরা বাধ্য হয়েছি, সেটা আমাদের দোষ মনে করলে আপনি মস্ত ভুল করবেন। অনিল যা করেছে সেটা করার আগে তার একবার মায়ের কথা ভাবা উচিত ছিল। চলি। দেখা হবে।’
চলে গেলেন রঞ্জন চৌধুরী। এক দুর্ভেদ্য দুর্গ। স্নেহ মায়া মমতা ঢুকতে পারবে না ওখানে, এমনই কড়া পাহারা। অ্যাশট্রেতে টিপে মারল রানা চারমিনারটা। অনিল সম্পর্কে কিছুই বলেননি চৌধুরী, তবু কয়েকটা টুকরো কথার তাৎপর্য মনে মনে বিচার না করে পারল না সে। বোঝা যাচ্ছে, অনিলের নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে এরা পরিষ্কার ভাবে ওয়াকিফহাল। এটা ভারতের রাষ্ট্রীয় ব্যাপার-স্বীকার করেছেন চৌধুরী। নিজের পায়ে কুড়োল মেরেছে অনিল, এখন আর কারও কিছু করবার নেই। ভাবনার কথা। মনে মনে স্থির করল রানা, এদের হয়তো করবার কিছুই নেই, কিন্তু আমার করবার কিছু থাকতেও পারে। আশাবাদী হওয়াই ভাল।
মিনিস্ট্রি অফ ফরেন অ্যাফেয়ার্সের কল্যাণ দাশগুপ্তের কাছে গিয়েও ঠিক একই রকম ধাক্কা খেলো রানা। একটি কথাও বের করা গেল না। অনিলের ব্যাপারে কিছুই জানে না তারা। ঠেসে ধরায় বলল খোঁজ খবর নিয়ে সপ্তাহ খানেক পরে জানাবার চেষ্টা করবে। উঠে আসবার আগে উপদেশ দিল-’আমার মনে হয় তোমার এ ব্যাপারে নাক না গলানোই ভাল। এ থেকে দূরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। অনিল সম্পর্কে কিছুই যদি না জানবে তাহলে এই উপদেশ কি করে দিচ্ছে জিজ্ঞেস করায় লজ্জিত হাসি হেসে বলেছে-তোমার যা খুশি ভাবতে পারো, আমি এর বেশি আর কোন সাহায্য করতে পারছি না, রানা।’
ইন্টেলিজেন্সের ডি.আই. জি. সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে তার অজান্তে দু’একটা তথ্যের ভাঙা অংশ উদ্ধার করা গেল মাত্র, আর বিশেষ কিছুই উপকার হলো না।
সবারই ইঙ্গিত যেদিকে, সেটা মেনে নিতে কেমন যেন দ্বিধা হচ্ছে রানার। অনিলকে বিশ্বাসঘাতক, রাষ্ট্রদ্রোহী ভাবতে পারছে না কিছুতেই। সত্যেন বাবু স্বীকার করেছেন যে অনিলের মা-র পিছনে গোয়েন্দা লাগানো হয়েছে। কিন্তু কেন? পাসপোর্ট যখন আটকে দেয়া গেছে তখন মিসেস অরুণা চ্যাটার্জী যে দেশের বাইরে যেতে পারছেন না সেটা নিশ্চিত। তাহলে কি ওরা সবাই আশা করছে গোপনে অনিল দেখা করবে ওঁর সঙ্গে? কি হয়েছে অনিলের? ধরা পড়েছে কারও হাতে, নাকি আনুগত্য পরিবর্তন করেছে? কার্ডটার কথা ভাবল রানা-আটকে গেছি, ছুটতে পারছি না। শরীরটাও খারাপ। এর মানে কি? হয় বন্দী হয়েছে, নয় লুকিয়ে আছে কোথাও ভেনিসের কাছাকাছি। খুব সম্ভব আহত অবস্থায়। অথচ ভারতীয় এমব্যাসীতে গিয়ে উঠতে পারছে না সাহায্যের জন্যে। রানার কাছে সাহায্য চাওয়া যায়, কিন্তু তার নিজের দেশের সরকারের কাছে সাহায্য চাওয়া যায় না। কেন?
নানান কথা ভাবতে ভাবতে ফিরে এল রানা হোটেলে। ঘরে ঢুকেই থমকে গেল রানা। একটা সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসে সিগারেট ফুঁকছে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স-এর চীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটার শ্রীমান হাত-কাটা সোহেল। রানা থমকে দাঁড়াতেই এক চোখ বন্ধ করে সিগারেটটা ধরল সে রানার বুক লক্ষ্য করে।
‘হ্যান্ডস্ আপ। এক চুল নড়লেই তোমার মাথার খুলি…’ রানাকে তেড়ে আসতে দেখে এক লাফে সোফাটা ডিঙিয়ে ওপারে গিয়ে দাঁড়াল। চোখমুখ পাকিয়ে সিগারেটটা ধরে রেখেছে সে এখনও রানার বুকের দিকে। ‘কোথায় ছিলি এতক্ষণ?’
‘তোর তাতে কি রে, শালা? তুই চোরের মত ঢুকেছিস কেন আমার ঘরে?
‘চোপরাও, ইতর কাঁহিকে। এটা তোর ঘর? জানিস তুই তোর সমস্ত হোটেলের বিল কাকে পে করতে হয়? এই বান্দাকে। এ ঘর আমার।’
‘সে তো খুব ভাল কথা, তবে আর সোফার আড়ালে কেন? সামনে এসো না চাঁদ।’
‘মারবি না তো?’
‘ঠিক আছে, মাপ করে দিলাম। যা বলবার সংক্ষেপে বলে দূর হয়ে যা। কাজ আছে মেলা।’
আশ্বাস পেয়ে আবার সোফা টপকে এপারে চলে এল সোহেল। বসল দুজন। ইন্ডিয়া কিং-এর প্যাকেট বাড়িয়ে ধরল সোহেল রানার দিকে। পুরো প্যাকেটটাই মেরে দেবার ইচ্ছে ছিল রানার, কিন্তু খুলে দেখল মাত্র একটা সিগারেট রয়েছে ওর মধ্যে। রানাকে নিরাশ হতে দেখে হাসল সোহেল, আঙুল দিয়ে দেখাল নিজের ফুলে থাকা বুক পকেট। আগেই সব সিগারেট বের করে পকেটে রেখেছে সে। রানা সিগারেট ধরিয়ে নিতেই কাজের কথায় এল সোহেল।
‘আমাকে পাঠানো হয়েছে তোর বস্ হিসেবে তোকে একটু ধমক-ধামক দেয়ার জন্যে। আজকের ফ্লাইট ক্যান্সেল করলি কেন? নিজের কাজ ফেলে কি গোলমাল পাকাতে শুরু করেছিস তুই এখানে বল তো?’
‘কি করেছি?’
‘এমন একটা ব্যাপারে অনর্থক নিজেকে জড়াতে যাচ্ছিস যার সঙ্গে তোর বা বাংলাদেশের কোন সম্পর্ক নেই। তোকে সাবধান করে দেয়ার হুকুম হয়েছে আমার ওপর।’
‘তাই নাকি?’ ধীরে সুস্থে ধরাল রানা সিগারেটটা। ‘তা কে পাঠাল তোকে?’
‘বুড়ো’
বিস্মিত হলো রানা। ‘কি বললি?’
‘বুড়ো।’ একই সুরে পুনরাবৃত্তি করল সোহেল। ‘বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের চীফ মেজর জেনারেল রাহাত খান। এইবার ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করা গেছে?’ একটু থেমে আর একটু ব্যাখ্যা করল সোহেল। ‘আমি এসব কিছুই জানি না, সন্ধ্যার ফ্লাইটে দিল্লী যাওয়ার কথা, হঠাৎ আধঘণ্টা আগে বড় সাহেবের মেসেজ এল। খুব সম্ভব রঞ্জন চৌধুরী যোগাযোগ করেছিল ঢাকায় বড় সাহেবের সঙ্গে। ওদের ধারণা তুই অনর্থক তোর নোংরা নাক গলাচ্ছিস ওদের ঘরোয়া ব্যাপারে। বিরক্তিকর মাছির মত ভনভন করছিস ওদের চারপাশে। ওরা চায় তুই যেন তোর দামী মাথাটা অন্যখানে গিয়ে ঘামাস।
হাসির ভঙ্গি করল রানা। ‘ঠাট্টা করছিস?’
‘তোর ভগ্নিপতি হিসেবে সে রাইট আমার আছে, কিন্তু ঠাট্টা নয় দোস্ত, প্রয়োজন হলে গাঁট্টা চালাবে এরা। অত্যন্ত সিরিয়াস ব্যাপার।’ কথাগুলো বলতে বলতেই টের পেল সোহেল ক্রমে কঠোর হয়ে যাচ্ছে রানার চোখ-মুখ। বিপদসংকেত টের পেয়ে চট করে যোগ করল, ‘দ্যাখ, রানা, তুই ভাল করেই জানিস, তোকে বিরত করবার উপায় নেই। কিন্তু দুই দেশের সম্পর্কের কথাটাও তো ভাবতে হবে। আমার যা মনে হচ্ছে ব্যাপারটার মধ্যে প্যাঁচ আছে, খুবই উঁচু লেভেলের ব্যাপার। এ ব্যাপারে তোর আগ্রহ দেখে এরা ভয়ানক ভাবে চঞ্চল হয়ে উঠেছে-ঠিক ভীমরুলের চাকে ঢিল পড়ার মত অবস্থা।
‘কোন্ ব্যাপারে আমার এত আগ্রহ দেখতে পাচ্ছে এরা?’ যেন রীতিমত অবাক হয়ে গেছে এমনি ভাব করল রানা। বুঝতে পেরেছে সে, এখন ভান না করলে কথা আদায় করা যাবে না সোহেলের কাছ থেকে।
বার কয়েক চোখ মিটমিট করল সোহেল।
‘তুই জানিস না কোন্ ব্যাপারে কথা হচ্ছে?’
‘অনিল বলে একটা ছেলেকে চিনি। তার মা এসেছিলেন আজ। ওকে পাওয়া যাচ্ছে না। কথা দিয়েছি সম্ভব হলে খোঁজ করে বের করবার চেষ্টা করব ওকে। ব্যস, এই। কেন যে এতে রঞ্জন চৌধুরী বা মেজর জেনারেলের এত হাঁসফাঁসানি শুরু হয়ে গেছে বুঝতে পারছি না।
‘তোর জানা নেই যে অনিল চ্যাটার্জী সিক্রেট সার্ভিসের লোক?’
‘তাতে কি এসে গেল? সিক্রেট সার্ভিসের লোক বিপদে পড়ে না? টোকিয়ো থেকে তোকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসিনি একবার?’
‘আমি দেশদ্রোহী ছিলাম না।’ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সোহেল রানার চোখের দিকে।
‘অনিল চ্যাটার্জী দেশদ্রোহী?’
‘তা আমি জানি না। সব কথা আমাকে ভেঙে বলার প্রয়োজন বোধ করেননি মেজর জেনারেল। তবে যেটুকু আঁচ করছি, চৌধুরী তাঁকে তাই বুঝিয়েছে। খুব সম্ভব ধরা পড়েছে সে কোন ইন্টারেস্টেড পার্টির হাতে। অথবা যোগ দিয়েছে ওদের সঙ্গে স্বেচ্ছায়। চৌধুরীর কাছে দুটোই সমান। অনেক গোপন তথ্য বেরিয়ে পড়বে অনিল মুখ খুললে। আমার বিশ্বাস মুখ খুলেছে অনিল।’
খানিক চুপচাপ সিগারেট টানল রানা, তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘অতএব?’
‘অতএব বুঝতেই পারছ। তোমার উবগারের উৎসাহ একটু দমন করতে হবে। এটা অফিশিয়াল অর্ডার। যদি ভায়োলেট করো, নিজ দায়িত্বে করবে। আর বিদেশে যদি কোন বিপদে পড়ো, দৌড়ে গিয়ে যে এমব্যাসীতে উঠবে, সেটা চলবে না। ইটালির কোথাও বাংলাদেশ বা ভারতীয় এমব্যাসীতে আশ্রয় মিলবে না তোমার।
উঠে দাঁড়াল সোহেল। হাত বাড়িয়ে দিল রানার দিকে।
‘কি জানাব বুড়ো মিঞাকে? কবুল?’
‘জানিয়ে দিস, ভেবে দেখব আমি। এটাও বলিস, এক অসহায় মা সাহায্য চেয়েছিল রানার কাছে তার সন্তানের মহা বিপদের সময়।’
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুই বন্ধু চেয়ে রইল পরস্পরের চোখের দিকে। ইস্পাতের মত দৃঢ় দুই পুরুষ। মেজর জেনারেল রাহাত খানের নিজ হাতের গড়া বাংলাদেশের দুই সোনার টুকরো। সোহেলের ডান চোখটা সামান্য একটু ছোট হয়েই আবার সমান হয়ে গেল। হাত ছেড়ে দিয়ে দরজার দিকে এগোল সোহেল লম্বা পা ফেলে। কোটের একটা হাত দুলছে কেবল, আরেকটা হাত ঝুলে আছে স্থির হয়ে।
ছোট্ট একটা ভাড়াটে বাড়ি, পশুপতি বসু লেনের শেষ মাথায়। সন্ধের একটু আগে পৌঁছল রানা। ট্যাক্সি বিদায় করে দিয়ে কড়া নাড়ল।
দরজা খুলেই রানাকে দেখে মধুর হাসি ফুটে উঠল মায়ের মুখে।
‘এসো বাবা, এসো, ভেতরে এসো।’
সাদামাঠা একটা ড্রইং-রূমে রানাকে বসিয়ে এক্ষুণি কাজটা সেরে আসছি বলে চলে গেলেন ঠাকুর ঘরের দিকে। রানা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল ঘরটা, দেয়ালে ঝোলানো অনিলের বাবার ছবি, বুকশেল্ফ্ফ্ ভর্তি বিপ্লবাত্মক বই, খটখটে টেবিল-চেয়ার, সবকিছুতেই মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাপ। রাজনৈতিক চেতনা এবং আদর্শবাদের ছাপও টের পেল রানা।
বৃদ্ধা এসে বসলেন। মনে মনে গুছিয়ে নিল রানা।
‘তেমন কোন সংবাদ সংগ্রহ করতে পারিনি, কিন্তু কয়েকটা তথ্য জানতে পেরেছি। ঠিক কতটা আপনাকে বলা উচিত বুঝতে পারছি না।’
‘আমি সহ্য করতে পারব, বাবা। যা জেনেছ বিনা দ্বিধায় বলতে পারো।’
রানা বুঝল মনটা শক্ত করে নিয়ে বসলেন বৃদ্ধা ঋজু ভঙ্গিতে। ভরসা পেল। শুরু করল, ‘কয়েকজন লোকের সঙ্গে দেখা করে জানতে পারলাম, ও গুপ্তচর বিভাগের কর্মচারী হিসেবেই গিয়েছিল রোমে। এবং একটা কিছু অঘটন ঘটেছে।
চোখ বুজে এক সেকেন্ড টিপে রেখে আবার খুললেন বৃদ্ধা। ‘সত্যিই তাহলে বিপদের মধ্যে আছে অনিল। ধরা পড়েছে, তাই না?’
একটু ইতস্তত করে রানা বলল, ‘সেটা কেউ বলতে রাজি নয়। তবে আমার মনে হয় ধরা পড়েনি ও। ধরা পড়লে কার্ডটা পাঠাতে পারত না। কিন্তু কার্ডটা নকলও হতে পারে, কিংবা ওকে দিয়ে জোর করে লেখানো হয়ে থাকতে পারে আমাদের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাবার জন্যে। যদি কার্ডটা নকল না হয়, কিংবা গায়ের জোরে লেখানো না হয়ে থাকে তাহলে আমার বিশ্বাস এখনও মুক্ত আছে ও, খুব সম্ভব লুকিয়ে আছে কোথাও।’
‘এরা কোনরকম সাহায্য করবে না অনিলকে?’ নিজের হাতের দিকে চেয়ে বললেন বৃদ্ধা।
‘মনে হয় না। আমিও যেন কোনরকম সাহায্য করতে না পরি, সেজন্যে অনিলের ব্যাপারে খোঁজ খবর করতে দেখেই এরা ঢাকায় আমার হেড অফিসের সাথে যোগাযোগ করেছে। আমার ওপর হুকুম হয়েছে যেন নিজের কাজ সেরে ফিরে আসি। যেন অনিলের ব্যাপারে নাক না গলাই।’
‘এ রকম ব্যবহারের নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে? আমার পিছনেও পুলিস লাগানো হয়েছে। তোমার কি মনে হয় অনিল এদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে?’
‘আমি আপনার কাছে এসেছি আজ বিশেষ করে এই কথাটাই জানাবার জন্যে।’ সরাসরি চাইল রানা বৃদ্ধার মুখের দিকে। ‘অনিলকে আমার চেয়ে অনেক ভাল করে চেনেন আপনি। আপনার কি মনে হয় ওর দ্বারা একাজ করা সম্ভব?’
থমকে গেলেন বৃদ্ধা কয়েক সেকেন্ড।
‘বড় কঠিন প্রশ্ন করলে, বাবা। কোন মাকে তার নিজের ছেলের সম্পর্কে এ প্রশ্ন করতে নেই। তবু তুমি যখন জানতে চাইছ, আমি সততার সাথে তোমার এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার চেষ্টা করব।’ খানিকক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবলেন বৃদ্ধা মাথা নিচু করে, তারপর চাইলেন রানার চোখে। ‘না। একাজ অনিলের পক্ষে অসম্ভব। ও যে পরিবারের ছেলে, যে আদর্শের ছত্রছায়ায় মানুষ হয়েছে, কখনোই ও একাজ করতে পারে না।
মস্ত বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রানা। ‘আপনি বাঁচালেন আমাকে। কথা যখন দিয়েছিলাম, আমার সাধ্যমত করতে আমাকে হতই। কিন্তু এখন জানলাম, আমি অন্যায় কিছু করছি না, সত্যের জন্যেই কাজ করছি। দ্বিধা রইল না আর।
‘আমার কথা বিশ্বাস করলে তুমি?’
‘নিশ্চয়ই।
‘এরা বাধা দেবে তোমাকে, সাহায্য করতে চাইলে। তাছাড়া তোমার হেড আপিসের হুকুম…’
‘অমান্য করব।’ হাসল রানা। ‘আমাকে আমার অফিস সে লাইসেন্স দিয়েছে। ওদিক থেকে কোন অসুবিধে হবে না।’
‘এদিক থেকে?’
‘হতে পারে। আবার না-ও হতে পারে। আগে থেকে কিছুই বলা যাচ্ছে না। যা হয় হবে।’
‘ভারতের হয়ে অনিল যে কাজ করত, তুমি কি বাংলাদেশের হয়ে সেই কাজই করো, বাবা?’
একটু থমকে গেল রানা। তারপর হাসল।
‘অনেকটা। হঠাৎ একথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?’
‘সেজন্যেই তোমার সাহায্য চেয়েছিল অনিল। বুঝতে পারছি। কাজটা যে অত্যন্ত বিপজ্জনক, তাও বুঝতে পারছি। হঠাৎ মনে হচ্ছে, স্বার্থপরের মত কাজ করছি না তো আমি? নিজের ছেলেকে সাহায্য করার জন্যে আরেকজনের ছেলেকে অনুরোধ করছি বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে, সেটা কি উচিত হচ্ছে? আমার কাছে অনিল যতটা মূল্যবান, তোমার মায়ের কাছে তুমি তার চেয়ে কোন অংশে কম মূল্যবান নও, বাবা।’
হেসে ফেলল রানা। ‘ও, এই কথা? এ নিয়ে কিচ্ছু ভাববেন না আপনি। আমার মা-ই নেই, তার আবার মূল্য! কোন মূল্য নেই আমার।’
রানার হাসি মুখের দিকে চেয়ে হাসি হাসি হয়ে উঠেছিল বৃদ্ধার মুখটাও, কথা শুনে মিলিয়ে গেল হাসিটা। অদ্ভুত একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন বেপরোয়া ছেলেটার দিকে। কথা বলেই চলল রানা।
‘অনিলের বিরুদ্ধে কি প্রমাণ রয়েছে এদের হাতে জানা নেই আমার। কেউ কোন কথা বলছে না। সব জায়গাতেই ঢাক ঢাক গুড় গুড়। এখন একমাত্র উপায় দেখছি ভেনিসে গিয়ে খোঁজ খবর করা। কাল রওনা হচ্ছি আমি ভিয়েনার উদ্দেশ্যে। ঠিক তিনদিন পর পৌঁছব ভেনিসে। ওখানে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে খোঁজ খবর শুরু করব আমি। ওখানে ওর পরিচিতদের দু’একজনের নাম বলতে পারবেন?’
খানিক চিন্তা করে বললেন বৃদ্ধা, ‘ঠিক মনে তো পড়ছে না, বাবা। একটু বসো, আমি অনিলের কয়েকটা চিঠি নিয়ে আসি। জুলি মাযিনি বলে একটা মেয়ের কথা প্রায় চিঠিতেই লিখত। আসছি।’
চিঠিগুলি ঘেঁটে জানা গেল সান মার্কোর কাছে একটা গ্লাসফ্যাক্টরিতে কাজ করে মেয়েটা। মালিকের নাম গিয়াকোমো পাসেল্লী। ওখানে যাতায়াত ছিল অনিলের। আঁচ করা গেল মেয়েটার ব্যাপারে কিছুটা দুর্বলতাও হয়তো ছিল। আরও জানা গেল ভেনিসে গেলে মডার্নো হোটেলে উঠত সে। রিয়াল্টো ব্রিজের কাছাকাছি কোথাও হোটেলটা। এছাড়া আর বিশেষ কিছুই নেই চিঠিতে।
‘আচ্ছা, বছর খানেকের মধ্যে তোলা অনিলের একটা ছবি দিতে পারবেন?’
‘আছে।’
উঠতে যাচ্ছিলেন বৃদ্ধা, রানা বলল, ‘আর একটা কথা, ইচ্ছে করলে ছেলেকে একটা চিঠি দিতে পারেন। ওকে যদি খুঁজে পাই, আপনার লেখা একটা চিঠি পেলে খুবই ভাল লাগবে ওর।’
টলমল করে উঠল বৃদ্ধার চোখ দুটো, কিন্তু উঠে দাঁড়ালেন সামলে নিয়ে। মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘বড় ভাল ছেলে তুমি, বাবা। সমুদ্রের মত বিরাট তোমার মনটা। ধন্য তোমার স্বর্গবাসিনী মা!’
দশ মিনিট পর চিঠি আর ফটোগ্রাফ পকেটে পুরে উঠে দাঁড়াল রানা। মৃদু হেসে বিদায় নিল। কিছুটা হেঁটে বাগবাজার স্ট্রীটে উঠে ট্যাক্সি নিল। ড্রাইভারকে বলল, ‘সোজা চলো কন্টিনেন্টাল হোটেলে।’
রঞ্জন চৌধুরীর কথাগুলো মনে এল রানার। নিজের পায়ে কুড়োল মেরেছে অনিল। এখন আর কারও কিছুই করবার নেই। অনিল যা করেছে সেটা করার আগে তার একবার মায়ের কথা ভাবা উচিত ছিল।
কি করেছে অনিল?