এগারো
অন্ধকার রাত্রির নিস্তব্ধতা চিরে তীক্ষ্ণ সুরে বেজে উঠল একটা হুইসল।
প্রায় দৌড়ে এগিয়ে চলল ওরা।
মোটা মানুষ, তার ওপর অনিলের বোঝা, হাঁসফাঁস করছে ওস্তাদ। কিন্তু তারই মধ্যে বত্রিশ পাটি দাঁত বেরিয়ে গেছে তার। বলল, ‘বেশ জমেছে, না?’
‘আপনি সোজা নিয়ে ওকে গনডোলায় তুলুন,’ বলল রানা। ‘আমরা দেখছি এদিকটা।
কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল বাতিস্তা, থেমে দাঁড়াল রানা।
‘ওপাশের গলি দিয়ে আরও লোক আসছে, সিনর।’
রানাও শুনেছে পায়ের শব্দ। সমান্তরাল গলি দিয়ে ওদের সঙ্গে সঙ্গেই চলেছে কয়েকজন। পেছনে লোকগুলোও এগিয়ে আসছে দ্রুত।
‘ওস্তাদকে ঠেকাবার চেষ্টা করবে ওই লোকগুলো। চলো আমরা এগিয়ে থাকি।’
জোরে দৌড়াল দুজন। ওস্তাদের সামনে পেছনে গার্ড দিয়ে নিয়ে চলল ওরা। দুজনের হাতেই বেরিয়ে এসেছে দুখানা তীক্ষ্ণধার স্টিলেটো।
‘পিছনের ওরা কিন্তু আমাদের ওভারটেক করবার চেষ্টা করছে না, সিনর,’ বলল বাতিস্তা।
‘জানি,’ বলল রানা দৌড়াতে দৌড়াতে। ‘আমরা যাতে পিছু হটতে না পারি, তারই জন্যে এই ব্যবস্থা।’
গলিমুখে পৌঁছেই থমকে দাঁড়াল রানা। দুহাত তুলে পেছনের দুজনকে থামবার ইঙ্গিত করল। ত্রিশ গজ দূরে গনডোলার কাছে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে তিন-চারজন। অপেক্ষা করছে ওদের জন্যে।
‘দাঁড়ান, ওস্তাদ!’ ফিসফিস করে বলল রানা। ‘এখন জলদি কাজ সারতে হবে। আর সবাই এসে পড়বার আগেই। আমি আর বাতিস্তা চার্জ করছি, আপনি আমাদের পিছু পিছু ছুটে গিয়ে উঠে পড়ুন গনডোলায়। আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবেন না। উঠেই ছেড়ে দেবেন নৌকা। ওকে নিয়ে সোজা চলে যান আপনার বাসায়।’
ফোঁস ফোঁস হাঁপাতে হাঁপাতে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল ওস্তাদ। ছুরিটা গুঁজে রাখল রানা খাপে।
কনুই দিয়ে আস্তে একটা গুঁতো দিল রানা বাতিস্তার পেটে, তারপর বিদ্যুৎবেগে ছুটল সামনের দিকে, ঠিক যেন পিস্তল থেকে ছোঁড়া একটা গুলি। পরমুহূর্তেই ছুটল বাতিস্তা।
ওরা মাঝপথে পৌঁছতেই ওদের দেখতে পেল অপেক্ষমাণ চারজন। একটু হকচকিয়ে গেল এই অতর্কিত আক্রমণের সামনে। সবাই সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে প্রথম ধাক্কার সামনে থেকে। প্রত্যেকে চাইছে প্রথম চোট আর কারও ওপর দিয়ে যাক।
কিন্তু সামলে নিতেও দেরি হলো না ওদের। ছুরি বেরিয়ে এসেছে দুজনের হাতে। ঝিক করে উঠল আবছা আলোয়। ঠিক সময়মত বাঁ দিকে কাত হয়ে গেল রানা। নিচু হয়েই খপ করে ধরল প্রথম লোকটার পা, হ্যাঁচকা টান দিয়ে শূন্যে তুলে ফেলল পা-টা। জোরে একটা ধাক্কা দিতেই আর একজনকে নিয়ে পড়ল সে চিৎ হয়ে মাটিতে।
এদিকে বাতিস্তা ঝাঁপিয়ে পড়েছে দ্বিতীয় ছুরিধারীর ওপর। এত প্রবল বেগে এসে পড়ল যে ছুরি মারার আর সময় পেল না লোকটা, ধাক্কা খেয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেল ভারসাম্য হারিয়ে। তার ওপর পড়ল বাতিস্তা। বন্যজন্তুর মত হুটোপুটি খাচ্ছে ওরা মাটিতে, চার হাত পায়ে মেরে চলেছে একে অপরকে, যে যেখানে পারে।
অনেকগুলো পায়ের শব্দ শুনতে পেল রানা। দ্রুত এগিয়ে আসছে এইদিকে।
বাতিস্তার পিঠে ছুরি বসাতে যাচ্ছিল একজন, লাফ দিল রানা। এক লাথিতে ছিটকে দূরে চলে গেল ছুরি, কিন্তু লোকটা জাবড়ে ধরল রানার কোমর, ঠেলে পেছনে নিয়ে এল কয়েক পা, গাছের শিকড়ে পা বেধে পড়ে গেল রানা, লোকটা পড়ল ওর বুকের ওপর।
প্রচণ্ড শক্তি লোকটার গায়ে। কারাতে, জুডো, সাভাতে, জুজুৎসু, আতে ওয়াযা, ইয়াওয়ারা, আইকিডো-যত যা আছে সব জ্ঞান প্রয়োগ করে বহু কষ্টে একটু কাবু করে আনল রানা লোকটাকে, উঠে বসল ওর বুকের ওপর। ঠিক এমনি সময়ে আর একজন পেছন থেকে চেপে ধরল রানার গলা। হাঁটুটা ঠেসে ধরে আছে সে রানার শিরদাঁড়ার ওপর। সুযোগ বুঝে নিচের লোকটা ছুটিয়ে নিল একটা হাত, এবং ধাঁই করে প্রচণ্ড এক ঘুসি মারল রানার নাকের ওপর। বোঁ করে উঠল রানার মাথা। ধুপধাপ পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল সে, অনেক লোক এগিয়ে আসার, অস্পষ্ট হয়ে গেল শব্দটা।
গলা থেকে হাত ছাড়াবার চেষ্টা করল রানা, পেছন দিকে কনুই চালাবার চেষ্টা করল, কিন্তু লাভ হলো না কিছুই। ক্রমে আরও চেপে বসে যাচ্ছে আঙুলগুলো গলার মাংসে। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে রানার, ভোঁ-ভোঁ করছে কান, মাথার মধ্যে হাতুড়ি পিটছে পালস-বিট। আরেকটা ঘুসি পড়ল ওর চোয়ালের ওপর। প্রাণপণ শক্তিতে ওপর দিকে ঠেলা দিল রানা, কাত হয়ে পড়ল বাঁ পাশে। পিঠের ওপর চেপে বসা লোকটাও পড়ল ওর সঙ্গে। পড়েই এক গড়ান দিল রানা, ঝপাৎ করে পানিতে পড়ল দুজন একসঙ্গে। বেশ গভীর পানি।
পানিতে পড়েই রানার গলা থেকে হাত ছুটে গেল লোকটার। ওপরে ভেসে উঠল রানা। ওর কাছাকাছিই ভেসে উঠল লোকটা, মুখ দিয়ে অনর্গল বেরোচ্ছে ইটালিয়ান গালি।
ঠাণ্ডা পানির সংস্পর্শে এসেই বোধশক্তি ফিরে এসেছে রানার। বড় করে একটা দম নিয়েই ডুব দিল সে। খপ করে লোকটার কোট ধরে টেনে নামিয়ে আনল নিচে। দুই পা দিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরেছে সে লোকটার, অসহায় ভাবে ধরা পড়েছে লোকটা রানার হেড-লকে। ধীরে ধীরে রানার দুই হাত চলে এল লোকটার কণ্ঠনালীর উপর। আধমিনিটের মধ্যে গোটা কয়েক ঝাঁকুনি খেল লোকটার সর্বশরীর, তারপর জ্ঞান হারিয়ে স্থির হয়ে গেল। লোকটার পাছায় জোরে এক লাথি মেরে ওকে তীরের দিকে পাঠিয়ে দিয়ে ভুশ করে ভেসে উঠল রানা পানির ওপর।
‘আপনি নাকি, সিনর মাসুদ রানা?’ বাতিস্তার উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর।
‘হ্যাঁ।’ মাথা ঝাঁকিয়ে চোখের ওপর থেকে চুল সরাল রানা। ব্রেস্টস্ট্রোক দিয়ে চলে এল বাতিস্তার পাশে।
‘ঠিক সময় মতই পানিতে পড়েছিলেন,’ বলল বাতিস্তা। ‘আরও পনেরো বিশজন পৌঁছে গিয়েছিল প্রায়। আপনাকে পানিতে পড়তে দেখে আমিও সোজা ডাইভ দিয়েছি খালে।
‘ওরা কোথায়?’ এদিক ওদিক চেয়ে গনডোলাটা খুঁজল রানা।
‘খালের দুই পারে। অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে।’
‘আর ওস্তাদ?’
‘নিরাপদে চলে গেছে গনডোলা নিয়ে। গনডোলায় ছিল ওদের একজন। ওকে মাথার ওপর তুলে ছুঁড়ে পারে ফেলে ছেড়ে দিয়েছে নৌকা। ও-ই তো আপনার গলা টিপে ধরেছিল।’
‘আমিও ওর গলা টিপে দিয়েছি পানির নিচে। ঠিক আছে, এগোও এবার। শব্দ করো না। খুব সম্ভব দেখতে পাবে না ওরা আমাদের।’
এগোল ওরা, কিন্তু কিছুদূর এগিয়েই ভুল ভাঙল রানার। পরিষ্কার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওদের অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে খালের দুপারে দুটো দল। খালের অন্ধকারতম জায়গায় থেমে দাঁড়াল ওরা কিছুক্ষণ, থেমে গেল পায়ের শব্দ।
বেশ কিছুটা দূরে অস্পষ্ট একটা ছপাৎ শব্দ শুনে প্রমাদ গুণল রানা।
‘বাতিস্তা। একটা গনডোলা আসছে এইদিকে। কাছাকাছি এলেই ডুব দেবে। যদি মাথার ওপর ছপাৎ আওয়াজ পাও, বুঝবে আমাদের ধরতে এসেছে ওটা। কিংবা মারতে এসেছে। সাবধান!’
‘ওস্তাদও হতে পারে, সিনর। হয়তো…’
কথাটা শেষ করবার আগেই বড় একটা কালো গনডোলার ছায়া দেখা গেল। বাতি নেই। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে প্রায় ওদের ঘাড়ে এসে পড়বার উপক্রম করল গনডোলাটা।
‘ডুব দাও।’ প্রায় ধমকের সুরে বলল রানা।
ডুব দিল রানা। কয়েক মুহূর্ত আগে যেখানটায় ওর মাথা ছিল, ঠিক সেই জায়গাটায় চড়াৎ করে জোরে একটা আওয়াজ হলো। মনে মনে হাসল রানা। ঠিক জায়গাতেই মেরেছে গনডোলিয়ার, শুধু সময়ের একটু এদিক আর ওদিক।
চট করে ভেসে উঠল রানা। কাছাকাছিই ভেসে উঠল বাতিস্তা। একই সঙ্গে চোখ গেল দুজনের গনডোলার দিকে।
একটু এগিয়েই থেমে দাঁড়িয়েছে গনডোলা। আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে চালককে। ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে ঘোরাচ্ছে নৌকাটা।
‘গনডোলাটা দখল করে নেয়া যাক, কি বলো?’ চাপা কণ্ঠে বলল রানা। ‘দুজন দুপাশে। ওর বৈঠা থেকে সাবধান।
‘আমি ওর মনোযোগ আকর্ষণ করব, সিনর। আপনি ওর পা ধরে মারবেন খিঁচে টান।
‘ঠিক আছে। এই যে আসছে। ডুব দাও।’
ডুব দিয়ে সরে গেল দুজন দুপাশে।
পানি থেকে বুক পর্যন্ত উঁচু করে ফেলল বাতিস্তা, হাত নেড়ে ইশারা করল গনডোলিয়ারকে।
দুই হাতে বৈঠাটা মাথার ওপর তুলল মাঝি। সামনে এগিয়ে এল রানা, চট করে গলুই ধরে উঠে পড়ল উপরে, থাবা চালাল পায়ের কব্জি লক্ষ্য করে। গনডোলিয়ারের ফুলপ্যান্ট বাধল হাতে। সেটা খামচে ধরে আবার লাফ দিল রানা পেছন দিকে।
একখানা কলজে কাঁপানো আর্তনাদ দিয়ে ঝপাৎ করে পানিতে পড়ল লোকটা বৈঠা ছেড়ে।
ততক্ষণে দ্রুত এগিয়ে এসেছে বাতিস্তা। দমাদম দুটো কিল বসিয়ে দিল গনডোলিয়ারের নাক বরাবর। আর টু শব্দ না করে একরাশ ভুড়ভুড়ি ছেড়ে তলিয়ে গেল লোকটা। সাঁতরে গিয়ে ভাসমান বৈঠাটা নিয়ে এল রানা।
মাঝিবিহীন গনডোলা ধীরে ধীরে চলেছে পারের দিকে।
বৈঠাটা পাটাতনের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে গলুই বেয়ে উঠে পড়ল রানা। বাতিস্তাও উঠে এল। দশ সেকেন্ডে সোজা হয়ে গেল গনডোলা পাকা মাঝি পেয়ে। অন্ধকার ভেদ করে ছুটল ওরা সামনের দিকে। পাঁচ মিনিট পর থেমে গেল পায়ের শব্দ।
ছোট খাল ছেড়ে বড় খালে পড়েছে ওরা। আর অনুসরণ করবার উপায় নেই।
তীরবেগে ছুটে চলেছে গনডোলা।
(আগামী খণ্ডে সমাপ্য)