বিদেশী গুপ্তচর – ১.১০

দশ

ঠিক দশটার সময় ক্যাশ কাউন্টার থেকে প্লেকগুলো ভাঙিয়ে নিল রানা। কোটের দুই পকেটে ভরল পাঁচ হাজার লিরার নোটগুলো। ঈর্ষাকাতর দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে ওর দিকে আর সবাই যারা বাজি ধরেছিল। তাক লাগিয়ে দিয়েছে ওদের রানার আশ্চর্য কপাল। ওদের ঈর্ষার কারণ রানার অস্বাভাবিক জয়, অথবা ওদের নিজেদের পরাজয় নয়। হারজিত আছে খেলাতে। খেলোয়াড় ও দর্শকদের মধ্যে এমন খুঁজলে হয়তো এক আধ জন পাওয়া যাবে যারা এর চেয়ে বেশি টাকা জিতেছে জীবনে কোন না কোন সময়। ঈর্ষার আসল কারণ রানার ঠিক সময় মত খেলা বন্ধ করা। জেতা টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে বা যেতে পারছে এটা কল্পনাও করতে পারে না ওরা। নেশায় পেয়ে যায় ওদের। বোর্ড থেকে তোলা টাকা বোর্ডেই রেখে যেতে হয় ওদের, বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সৌভাগ্য হয় না। হারতে হারতে জেদ চেপে যায়, হারিয়ে যায় কাণ্ডজ্ঞান। তেমনি হয় জিততে জিততে। আশ্চর্য লোকটার সংযম! উঠে যাচ্ছে!

সবার জন্যে এক পেগ করে ব্র্যান্ডির অর্ডার দিল রানা। টেবিলে এসে দাঁড়াল আর সবার খেলা দেখবার জন্যে। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরপরই চোখটা চট করে ঘুরে আসছে লাউঞ্জের ওপাশের দরজার ওপর থেকে। ঘড়ি দেখল। দশটা পাঁচ। দেরি করছে কেন বাতিস্তা?

পাঁচজন বেয়ারা দ্রুত সার্ভ করছে সবার ব্র্যান্ডির গ্লাস। রানার এই অপ্রত্যাশিত আপ্যায়নে খুশি হলো সবাই। জিতে নিয়ে যাওয়ার বেয়াদবি মাফ করে দিল বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই। একজন বলেই বসল, আমার এই দশ হাজারী প্লেক দুটো আপনি নিজের হাতে একটু চেলে দেবেন, সিনর গামাল? হারলে আপনার কোন দোষ নেই, জিতলে অর্ধেক আপনার।

হাসল রানা।

‘অর্ধেক লাগবে না। রাখুন না, লালে রাখুন। আপনি নিজেই রাখুন।

‘না। আপনার হাতে।’ প্রায় জোর করে গুঁজে দিল লোকটা প্লেক দুটো রানার হাতে।

হাতে কাঠি তুলে নিল আবার ক্রুপিয়ে ব্র্যান্ডির গ্লাসটা একজন বেয়ারার হাতে ধরিয়ে দিয়ে। ছোট্ট একটা নড করল রানার দিকে চেয়ে। প্লেক দুটো লাল ঘরে রেখে দিল রানা। ব্যস হিড়িক পড়ে গেল সবার মধ্যে লালে রাখার। হুড়মুড় করে যে যত পারল রাখল লালে। কালো ঘরে শুধু একটা লিরার প্লেক।

ঘুরল রুলেতের চাকা। ছোট্ট আইভরি বলটা ছুটে বেড়াতে লাগল থালার মধ্যে। উৎসুক চোখে চেয়ে রয়েছে সবাই ক্রমে থেমে আসা থালাটার দিকে। রানা চাইল লাউঞ্জের ওপাশের দরজার দিকে। আসছে না কেন এখনও? কোন বিপদে পড়ল? নাকি গীয়ান বা ওড্ডিকে ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে অনুসরণ করেছে? মাথা ঠিক রাখতে না পেরে ঢুকে পড়েনি তো বাড়িটার ভিতর?

কমে এসেছে চাকার গতি। সাদা বলটা ডাবল জিরো, অর্থাৎ সবুজ দুটো ঘরের একটায় জমে বসতে গিয়েও কেমন একটা পাক খেয়ে সরে গেল আবার। সব কজন দর্শকের পিলে চমকে উঠেছিল ওটার সবুজ প্রীতি দেখে, ভুশ করে দম ছাড়ল একসঙ্গে। সবুজে পড়লে কেউ পেত না একটি পয়সাও।

লাউঞ্জের ওপাশের দরজা দিয়ে ঢুকল বাতিস্তা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এগোল রানা সেদিকে। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ নয়। সবাই যদি দানটা হেরে যায় তাহলে বিশ্রী একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। আর যদি জেতে তাহলে টানা- হেঁচড়া পড়ে যাবে ওকে নিয়ে, ছাড়তে চাইবে না কিছুতেই। প্রত্যেকটা চোখের দৃষ্টি আঠার মত লেগে আছে হাতির দাঁতের ছোট্ট সাদা বলটার গায়ে, দম বন্ধ করে লক্ষ করছে ওটার মতিগতি, এই সুযোগে কেটে পড়াই ভাল। ক্যাসিনোর কাঁচের দরজার কাছাকাছি এসে শুনতে পেল রানা ক্রুপিয়ের পরিষ্কার কণ্ঠস্বর:

‘টোয়েনটি এইট-রেড-হাই অ্যান্ড ইভেন।

‘হো’ করে এত প্রচণ্ড এক সমবেত উল্লাসধ্বনি উঠল যে রানার মনে হলো ক্যাসিনোর ছাতটা সাঁ করে উড়ে গিয়ে ঢাকায় পড়বে। শব্দের ধাক্কায় ছিটকে বেরিয়ে গেল সে দরজা দিয়ে। বাতিস্তাকে লিফটে ওঠার ইঙ্গিত করে নিজেও উঠে পড়ল। লিফট এসে থামল ছ’তলায়। লম্বা করিডর ধরে হেঁটে বাঁদিকে সবশেষে ঘরটায় নিয়ে গেল রানা ওকে।

‘কি খবর, বাতিস্তা? বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে তোমাকে?’ খাটের কিনারে বসে একটা গদি আঁটা চেয়ারে বসবার ইঙ্গিত করল রানা ওকে।

‘হ্যাঁ। বেশ গরম খবর আছে!’ বসল বাতিস্তা। ‘খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?’

‘হ্যাঁ। ওই রেস্তোরাঁয় বসেই সেরে নিয়েছি।’

‘বেশ। শুরু করো তাহলে।’ নড়েচড়ে বসল রানা।

পকেট থেকে একটা কাগজের টুকরো বের করল বাতিস্তা। লিখে নিয়ে এসেছে। চোখ বোলাল নোটের ওপর।

‘ঠিক আটটা সাতে দেখলাম গিয়াকোমো পাসেল্লীকে। হন হন করে হেঁটে এসে টোকা দিল দরজায়। ভেতর থেকে কে যে দরজা খুলে দিল, দেখতে পেলাম না। ও ভেতরে ঢুকে পড়তেই বন্ধ হয়ে গেল দরজা।’ আবার একবার নোটের দিকে চাইল বাতিস্তা। ‘আটটা পঁয়তাল্লিশে তিনজন গুণ্ডা প্রকৃতির লোক ঢুকল বাড়িটায়। চেহারা আর চালচলনে বোঝা গেল ভয়ঙ্কর লোক এরা, কেউ কারও চেয়ে কম নয়। একজনের চেহারাটা চেনা-চেনা লাগলেও প্রথমে চিনতে পারিনি, এই হোটেলে আসার পথে মনে পড়েছে। মাস তিনেক আগে ওর ছবি বেরিয়েছিল কাগজে। সিসিলির দুর্ধর্ষ গুণ্ডা পপিনি। খুন করে ফেরারি রয়েছে সে, খুঁজছে পুলিস। যাই হোক, ওদের একজনের হাতে একটা সুটকেস ছিল। মনে হলো সদ্য এসে পৌঁছেচে ভেনিসে। দরজায় টোকা দিল, দরজা খুলল সাদা হ্যাট পরা সেই লোকটা, ওরা ঢুকে যেতেই আবার বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

রানার বাড়িয়ে ধরা সিগারেটের প্যাকেটের দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে নিষেধ করল বাতিস্তা। খায় না। কাগজের ওপর চোখ বোলাল কয়েক সেকেন্ড, তারপর শুরু করল আবার।

‘এরপর আধঘণ্টা কিছুই ঘটল না। তারপর বেরিয়ে এল গিয়াকোমো পাসেল্লী। মাথা উঁচু করে আত্মগরিমার ভঙ্গিতে ঢুকেছিল লোকটা বাড়িটায়, কিন্তু বেরিয়ে যখন এল তখন সম্পূর্ণ আলাদা এক মানুষ। যেন বিধ্বস্ত এক অসুস্থ লোক, বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত, ভাবলেশহীন মুখ, চলার ভঙ্গি শ্লথ, শিথিল। মনে হলো ভয়ঙ্কর কিছু দেখে বেরিয়ে এসেছে ও বাড়িটা থেকে। পরিষ্কারভাবে এত কিছু দেখতে পেয়েছি এই জন্যে যে সবুজ দরজা দিয়ে বেরিয়েই সোজা এই কাফের দিকে এগিয়ে এল পাসেল্লী। আমি চট করে একটা খবরের কাগজে মুখ আড়াল করলাম আমাকে চিনে ফেলবে মনে করে। কিন্তু তা না করলেও চলত। কোনদিকে চেয়ে দেখবার মত মানসিক অবস্থা ছিল না ওর। সোজা এসে একটা টেবিলে বসে ব্র্যান্ডির অর্ডার দিল পাসেল্লী। প্রায় ঢক ঢক করে পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিন পেগ ব্র্যান্ডি খেয়ে দাম দিয়ে কোনদিকে না চেয়ে কারও সঙ্গে একটি কথা না বলে উঠে গেল পাসেল্লী। পকেট থেকে যখন মানিব্যাগটা বের করল, লক্ষ করলাম থরথর করে কাঁপছে ওর হাতটা। দশ মিনিট চুপচাপ-তারপর আরও দুজন লোক ঢুকল বাড়িটায়। দুজনেরই পরনে দামী পোশাক-পরিচ্ছেদ। একজনের বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ মত হবে, ক্লিন-শেভড়, দেখতেও দারুণ হ্যান্ডসাম, মাথায় সোনালী চুল, এক নজরেই বোঝা যায় খুবই ধনীলোকের ছেলে, মনে হয় কোনদিন খেলাধুলা বা শরীরচর্চার ধার কাছ দিয়েও যায়নি।’

রানা বুঝে নিয়েছে এ লোক সিলভিও পিয়েত্রো ছাড়া আর কেউ নয়। সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ফেলে বালিশে আধশোয়া হয়ে হেলান দিয়ে বসল। জিজ্ঞেস করল, ‘সঙ্গের লোকটা?’

‘এর সঙ্গের লোকটাকে ভেনিসের সবাই চেনে। ডক্টর আমানান্তি। বিরাট ডাক্তার। বড়লোকদের মধ্যে ওর দারুণ পসার।’

তড়াক করে উঠে বসল রানা।

‘এই দুজন ঢুকল ওই বাড়িতে?’

‘হ্যাঁ। ডাক্তারের হাতে ব্যাগ দেখে মনে হলো রোগী দেখতে এসেছে। ওই ঢুকল আগে, তারপর ঢুকল ছেলেটা। দেখে মনে হলো আগেও দেখে গেছে ডাক্তার এই রোগীকে এক আধবার। আমার মনে হচ্ছে সিনর চ্যাটার্জীকে ওই বাড়িতেই রাখা হয়েছে।

‘আমারও তাই মনে হয়,’ বলল রানা। ‘ডাক্তারের উপস্থিতি দেখে এই সন্দেহটা আসাই স্বাভাবিক। যাক, তারপর কি হলো?

‘দশটা বাজতে দশ মিনিটে বেরিয়ে এল ডাক্তার আমানান্তি, চলে গেল। আরও পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে উঠে পড়লাম আমি। ঠিক সময়েই উঠেছিলাম, কিন্তু রাস্তায় পড়ে গেলাম একদল ট্যুরিস্টের ভিড়ে। ওদের ঠেলে ধাক্কিয়ে পথ করে নিয়ে এখানে এসে পৌঁছতে দেরি হয়ে গেল কিছুটা। যাই হোক, এবার আমাদের পরবর্তী প্রোগ্রাম কি? আক্রমণ?’

ডান হাতের তালুতে গাল ঘষল রানা। চিন্তা করল মুখচোখ বাঁকিয়ে। তারপর বলল, ‘এই মুহূর্তে কমপক্ষে কজন লোক আছে ওই বাড়িতে? তিন, দুই, পাঁচ, আর এক, ছয়। আরও থাকতে পারে। আমরা দুজন পারব না তা নয়, কিন্তু কষ্ট হবে। আর একজন হলে ভাবতাম না। তাছাড়া অনিলকে যদি ওখানে পাওয়া যায় তাহলে ওকে নিরাপদে বের করে আনার জন্যেও লোক দরকার। লোক যখন নেই তখন কিছু একটা কৌশল বের করতে হবে আমাদের। এক কাজ করা যায়—’

হঠাৎ এক লাফে উঠে দাঁড়াল বাতিস্তা। নিজের মনেই বলে উঠল, ‘পাগলা ওস্তাদকে বললে কেমন হয়?’

‘পাগলা ওস্তাদটা কে?’

‘আমাদের ইউনিভারসিটির অ্যাথলেটিক কোচ। খুব সম্ভব সারা ইউরোপের সেরা কোচ ভদ্রলোক। মনে-প্রাণে স্পোর্টসম্যান। খুবই ভাল লোক। ওঁকে বললেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন উনি সাহায্য করতে। খুবই ভালবাসেন আমাকে।’

‘ভদ্রলোককে বিশ্বাস করা যায়? নির্ভরযোগ্য?’

‘হানড্রেড পারসেন্ট।

‘এই গোলমালের মধ্যে জড়াতে চাইবেন উনি? এসব ভয়ঙ্কর লোকদের বিরুদ্ধে যেতে চাইবেন?’

‘চলুন না, গিয়ে দেখা যাক?’

‘সাহায্য পাই বা না পাই, আজই আক্রমণ করতে হবে আমাদের। কাজেই তোমার চেহারাটা একটু বদলে দিই, এসো। তোমাকে এই শহরেই থাকতে হবে তো, আমি চাই না চিনে ফেলুক ওরা তোমাকে।’

দশ মিনিটের মধ্যে চমৎকার একজোড়া গোঁফ গজিয়ে গেল বাতিস্তার নাকের নিচে। পাল্টে গেল সিঁথি। গালে-কপালে কয়েকটা দাগ পড়তেই বয়স বেড়ে গেল আরও বিশ বছর। বিছানার চাদর দিয়ে ছোটখাট একটা ভুঁড়ি তৈরি হলো জুৎসই গোছের।

টেলিফোন করে ডেস্ক-ক্লার্ককে জানিয়ে দিল রানা, অতিরিক্ত জরুরী কোন দরকার না হলে যেন তাকে বিরক্ত করা না হয়, ঘুমাবে সে। কেউ কোন গোলমাল করলে আস্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে।

দরজায় তালা মেরে ইমার্জেন্সি ফায়ার-এসকেপের ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল ওরা নিচে। সবার অলক্ষ্যে বাঁ পাশের গলিপথ ধরে এগিয়ে পড়ল এসে রাস্তায়।

.

প্রচণ্ড শব্দে নাক ডাকছিল স্টেফানো মন্টিনির।

আস্তে করে ঠেলা দিতেই খুলে গেল দরজা। রানা দেখল আধমনী একটা ভুঁড়ি উঠছে নামছে, থরথর করে কাঁপছে ঘরের আসবাব-পত্র। বিপুল বিক্রমে ঘুমাচ্ছে বাতিস্তার ওস্তাদ। প্রকাণ্ড মোটা। লম্বা হবে বড়জোর পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি, কিন্তু গোটা দশেক রানাকে একসঙ্গে কষে বাঁধলেও ওর সমান মোটা হবে কিনা সন্দেহ। এক একটা বাহু রানার ঊরুর মত। মাথা ভর্তি টাক, কানের পাশ দিয়ে ঘাড়ের পেছন দিকে সামান্য চুলের আভাস পাওয়া যায়-পঁচাত্তর ভাগ পাকা। বয়স পঞ্চাশ কি পঞ্চান্ন। কাঁচা পাকা গোঁফ জোড়া ঠোঁটের দু’পাশ দিয়ে নেমে এসেছে নিচের দিকে, মিশেছে থুতনির কাছে গজানো ইঞ্চিখানেক লম্বা দাড়ির সঙ্গে।

পাশ ফিরল ওস্তাদ। ক্যাচম্যাচ করে মহা আপত্তি জানাল খাটের উৎপীড়িত স্প্রিং। সেদিকে মোটেই লক্ষ না দিয়ে হালকাভাবে শুরু হলো আবার নাসিকা গর্জন। ক্রমে বাড়তে বাড়তে উঠে যাবে চরম পর্যায়ে।

এর কাছে কতটা সাহায্য পাওয়া যাবে বুঝে নিয়েছে রানা, নিঃশব্দে ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত করল সে বাতিস্তাকে। কিন্তু ততক্ষণে ডাক দিয়ে ফেলেছে বাতিস্তা।

‘ওস্তাদ।’

তড়াক করে উঠে বসল ওর ওস্তাদ। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল ওদের দুজনকে।

‘কি চাই?’ গম্ভীর গমগমে কণ্ঠস্বরে কেঁপে উঠল ঘরটা।

‘সাহায্য চাই, ওস্তাদ’ বলল বাতিস্তা।

‘ওস্তাদ!’ অবাক হয়ে আবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল বাতিস্তাকে। ‘আমি তোমার ওস্তাদ না। এত সুন্দর একটা শরীরে যে ওই…ওই’…আঙুল দিয়ে বাতিস্তার ভুঁড়িতে খোঁচা দেয়ার ভঙ্গি করল স্টেফানো মন্টিনি, ‘ওই রকম একটা ভুঁড়ি গজাতে দেয়, আমি তার ওস্তাদ নই। কেউ হও না তুমি আমার। কোন্ ইয়ারে পাস করেছ?’ কটমট করে চাইল ওস্তাদ বাতিস্তার দিকে।

রানা দেখল এই গতিতে এগোলে পরিচয়পর্ব শেষ হতেই মেলা সময় লেগে যাবে। চট করে বলল, ‘বাতিস্তার বোনকে যারা খুন করেছে তারা আমার এক বন্ধুকে আটকে রেখেছে একটা বাড়িতে…’

আঁৎকে উঠল স্টেফানো মন্টিনি। ‘কি বললে! আমাদের বাতিস্তার বোনকে খুন করেছে? কোন্ শুয়োরের বাচ্চা?’ এক লাফে নেমে পড়ল খাট থেকে। ‘দাঁড়াও, আমি কাপড়টা পরে নিচ্ছি এক্ষুণি।

বিনা দ্বিধায় ন্যাংটো হয়ে গেল পাগলা ওস্তাদ রানা ও বাতিস্তার সামনে। আলনা থেকে এমন একটা টাইট-ফিটিং জাঙ্গিয়া টেনে নিয়ে পরল যেটার পায়ের ফাঁক গলে ঢুকে যাবে আস্ত রানা। একটা হাফ প্যান্ট আর একখানা স্পোর্টস জ্যাকেট চড়িয়ে ফিরল রানার দিকে।

‘তোমরা কে? মেরে ফেলেছে তারপর এসেছ খবর দিতে। মারার আগে আসতে পারোনি? বাতিস্তা কোথায়?’

‘আমিই বাতিস্তা, ওস্তাদ। ইনি সিনর মাসুদ রানা, বাংলাদেশের লোক। আমরা দুজনেই ছদ্মবেশে আছি। ওস্তাদের চোখ কপালে উঠতে দেখে চট করে যোগ করল বাতিস্তা, ‘সব ভেঙেচুরে বলবার সময় নেই, ওস্তাদ, হাতে একেবারেই সময় নেই। দেরি হলে হয়তো ওদের আর পাব না। এখুনি আক্রমণ করতে হবে আমাদের। আপনি যাবেন কিনা বলুন।

‘যাব মানে? একশোবার যাব। কিন্তু… তুমিই ঠিক বাতিস্তা তো? আর ইউ শিওর? আমি কিন্তু একেবারেই চিনতে পারছি না।’ বাতিস্তার কাপড়ের ভুঁড়িটা একটু টিপে দেখল ওস্তাদ।

‘আমাদের দুজনের তুলনায় লোক একটু বেশি বলেই এত রাতে আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি।’ বলল রানা বিনীত ভাবে। ‘পথে চলতে চলতে যতটা সম্ভব সংক্ষেপে আপনাকে জানাব আমরা ব্যাপারটা। রওয়ানা হওয়ার আগে আপনার একটা কথা জেনে রাখার দরকার, ওস্তাদ-কাজটা কিন্তু বিপজ্জনক। ওরা সশস্ত্রও হতে পারে। আশা করছি ওই বাড়িতে জনাছয়েক লোক আছে, কিন্তু আসলে এর দ্বিগুণ লোকও থাকতে পারে। আমাদের কারও পক্ষেই প্রাণ নিয়ে ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নাও হতে পারে। আপনি ইচ্ছে করলেই না করে দিতে পারেন, কিছুই মনে করব না…’

কটমট করে চাইল ওস্তাদ রানার দিকে। ‘বড় বেশি কথা বলো হে তুমি, ছোকরা। কোন্ ইয়ারে পাস করেছ? ভুলেই গেছ আমাকে? চলো, আগে বাড়ো। দেখা যাবে আজ আমার ট্রেনিং কে কতটা মনে রেখেছ।’ বাতিস্তাকে ঘর থেকে বেরোবার ইঙ্গিত করে বলল, ‘আর বাতিস্তা, অবশ্য তুমি যদি সত্যিই বাতিস্তা হও, তোমার বোনের মৃত্যু সংবাদে আমি সত্যিই দুঃখিত। তোমার বোনই তো তোমার পড়ার খরচ চালাত, তাই না? আ-হা-হা। আমার যদি অনেক টাকা থাকত…’

‘আপনার চেহারাটা একটু পাল্টে নিলে হত না, ওস্তাদ? আমি তো কাজ সেরে চলে যাব বাংলাদেশে, আপনাকে থাকতে হবে ভেনিসেই।’

‘তিন হাজার অ্যাথলেট এসে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে আমি একটা ডাক দিলে।’ হাসল ওস্তাদ। ‘ভয় নেই, আমার কোন ক্ষতি করবার আগে তিন হাজার বার চিন্তা করবে যে-কোন লোক। চলো।’

.

শুনে তাজ্জব হয়ে গেল পাগলা ওস্তাদ।

‘কি এমন জিনিস রয়েছে তোমার বন্ধুর কাছে যার জন্যে এতসব কাণ্ড করতে, এমনকি জুলির মত একটা নিরপরাধ মেয়েকে হত্যা করতেও বাধল না ওদের?’

গনডোলা ছেড়ে দিল বাতিস্তা।

‘আমি জানি না, ওস্তাদ,’ বলল রানা। ‘সেইটাই জানতে হবে আমাকে।’

‘তোমার বন্ধু কি কোন বে-আইনী কাজে লিপ্ত?’

‘তা-ও জানি না, ওস্তাদ। কিন্তু এটুকু জানি, যা-ই করে থাকুক অনিল চ্যাটার্জী, বিচার পাওয়ার অধিকার ওর আছে। এভাবে কুকুরের মত তাড়া খেয়ে মরতে দিতে পারি না আমরা ওকে বিদেশ-বিভূঁইয়ে।

‘তা ঠিক। এবার কি প্ল্যান করছ বলো। বাড়িটার পেছন দিক থেকে ঢুকতে চাও?’

‘আগে দেখে নিই পেছনটা, তারপর কিভাবে কি করা যায় স্থির করা যাবে।’

লম্বা কালো গনডোলা নিঃশব্দে এগিয়ে চলল অন্ধকার ভেদ করে। সরু খাল, বাড়িটার পেছন ঘেঁষে চলে গেছে পশ্চিমে। প্রকাণ্ড একখানা চাঁদ আলো করে রেখেছে আকাশটাকে, কিন্তু লম্বা বাড়িগুলোর গায়ে আটকে যাওয়ায় খালে এসে পড়তে পারছে না ওটার আলো। সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকার বাড়িগুলো, ছাদের কার্নিসে কার্নিসে ভৌতিক আলোর খেলা। খুক করে গলা পরিষ্কার করল বাতিস্তা।

‘লণ্ঠনটা কমিয়ে দিন, সিনর। এসে গেছি।’

প্রায় নিভিয়ে দিল রানা মৃদু আলোটা। আধ মিনিটের মধ্যেই একটা দোতলা বাড়ির পেছনে থেমে দাঁড়াল গনডোলা। বৈঠা রেখে এগিয়ে এল বাতিস্তা।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল রানা বাড়ির পেছন দিকটা। আলোর আভাস মাত্র নেই। পনেরো ফুট ওপরে একটা ব্যালকনি দেখা যাচ্ছে, তার ফুট দশেক ওপরে মোটা গরাদ দেয়া ছোট একটা জানালা। ব্যালকনিতে আসার জন্যে নিশ্চয়ই দরজা আছে একটা, পাশে একখানা জানালা থাকাও বিচিত্র নয়, কিন্তু অনেকক্ষণ ঠাহর করে বোঝা গেল না পরিষ্কার। ওই ব্যালকনি ছাড়া আর কোন জায়গা দিয়ে ভিতরে ঢুকবার উপায় দেখতে পেল না রানা।

‘একটা হুক আর কিছু দড়ি পেলে এই ব্যালকনি দিয়ে ঢোকা যায় ভেতরে।’ পকেট থেকে টর্চটা বের করল রানা, ‘জানালা- দরজা আছে কিনা দেখে নেয়া যাক।’

টর্চের মুখটা অ্যাডজাস্ট করে সূক্ষ্ম একটা রশ্মিতে পরিণত করল রানা আলোটাকে। একটা বন্ধ দরজার ওপরের অংশ দেখা গেল কিছুটা। একটা জানালারও সামান্য কিছুটা অংশ দেখা গেল, কিন্তু তাতে গরাদ আছে কিনা বোঝা গেল না।

‘রশি হুক আছে আমার কাছে, সিনর। উঠে যাব ওপরে?’

‘দাঁড়াও, এখন না। ওস্তাদ, গনডোলা চালাতে পারেন?’

‘পারি মানে? বাতিস্তাকে ইন্টার-ইউনিভারসিটি গনডোলা চ্যাম্পিয়ান বানাল কে?’

‘ভেরি গুড। চলো বাতিস্তা ওস্তাদকে বাড়ির সামনেটা একটু দেখিয়ে আনা যাক।’

নিঃশব্দে ঘুরল গনডোলা, কিছুদূর গিয়ে ঘ্যাস্ করে থামল একটা গলিমুখের কাছাকাছি। দু’তিনটে মোড় ঘুরে ক্যাম্পো ডেল সালিযোতে পড়ল ওরা। দূর থেকে আঙুল তুলে দেখাল রানা।

‘ওই যে সবুজ পেইন্ট করা দরজা দেখা যাচ্ছে, ওই বাড়িটা।’ কথাটা বলতে না বলতেই খুলে গেল দরজাটা। বেরিয়ে এল সিলভিও পিয়েত্রো। বন্ধ হয়ে গেল দরজা। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল সিলভিও, এদিক ওদিক চাইল, তারপর সোজা হাঁটতে শুরু করল রানার দিকে। চট করে গলির ভিতর ঢুকে অন্ধকার থামের আড়ালে আত্মগোপন করল ওরা। কিন্তু তার প্রয়োজন ছিল না। কিছুদূর সোজা হেঁটে এসে ডান দিকের একটা গলিতে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল সিলভিও।

‘অনিল ছাড়া এখন রইল আর পাঁচজন। কমপক্ষে পাঁচজন—আসলে আরও বেশি হতে পারে। কাজেই ওদের তাক লাগিয়ে না দিতে পারলে কাবু করা মুশকিল হবে। অনিল যদি এই বাড়িতে থাকে, তাহলে ওকে বের করে আনাও এক মহা সমস্যা হবে। ওকে এখান থেকে সরাতে হলে যদি স্ট্রেচারের দরকার হয় তাহলে তো বিকট ঝামেলা।’ অনেকটা আপন মনে বলছিল রানা কথাগুলো, হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফিরল বাতিস্তার দিকে। ‘তুমি ওস্তাদকে নিয়ে বাড়িটার পেছন দিকে চলে যাও। ব্যালকনি দিয়ে ঢুকে পড়ো বাড়ির ভেতর। এখন থেকে ঠিক দশ মিনিট পর সামনে দিয়ে ঢুকব আমি।’

‘একা?’

‘হ্যাঁ। সামনে পেছনে দুই দিক থেকে চমকে দিতে হবে ওদের। আমি না ঢোকা পর্যন্ত চুপচাপ থাকবে, কোন গোলমাল করবে না। আর একটা কথা, আমাদের প্রথম কাজ অনিলকে উদ্ধার করা, প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ আসবে পরে। কাজেই ওড্ডি বা গীয়ানকে যদি পাইও, প্রতিশোধ নিতে গিয়ে এক সেকেন্ড বেশি সময় ব্যয় করব না আমরা। রাজি?’

‘রাজি। কিন্তু, সিনর, জানালায় যদি লোহার বার থাকে, আর দরজা যদি ভেতর থেকে আটকানো থাকে তাহলে? আপনি একা ওই বাঘের খাঁচায় ঢুকে পড়লে কি উপায় হবে?

‘পেছন দিয়ে যদি ঢুকতে না পারো তাহলে যত তাড়াতাড়ি পারো সামনে চলে আসবে। ঠিক আছে?’

‘ঠিক আছে।’

‘আর আমি?’ এতক্ষণে কথা বলল পাগলা ওস্তাদ। ‘আমার কি করতে হবে?’

‘বাতিস্তা যদি ওই ব্যালকনি দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতে পারে তাহলে আপনি গনডোলা নিয়ে ফিরে আসবেন এখন ওটা যেখানে আছে সেইখানে। তারপর সামনে দিয়ে ঢুকবেন বাড়িটায়। যদি ওদের কাবু করতে পারি তাহলে সামনের দরজা দিয়ে বেরোতে হবে আমাদের অনিলকে নিয়ে। যান, রওনা হয়ে যান, ওস্তাদ।’

রানার কাঁধের ওপর একখানা আড়াইমনী হাত রাখল পাগলা ওস্তাদ। ‘কাজটা তোমার জন্যে একটু বেশি বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে না? প্রথমে আমি সামনে দিয়ে ঢুকলে কেমন হয়?’

‘দেখুন ওস্তাদ, আপনাকে আগেই বলেছি, এই খেলায় আমি ক্যাপ্টেন, আমার আদেশ মানতে হবে। ভুলই হোক আর ঠিকই হোক, আমি যা বলি তাই করতে হবে খাঁটি স্পোর্টসম্যানের মত। আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না। দুই মত দুই পথ হয়ে গেলে অনর্থক তর্কাতর্কি করে সময় নষ্ট হবে। বুঝতে পেরেছেন?

‘পেরেছি বাবা, পেরেছি। আজকালকার ছেলে তো নয়, একেবারে পেরেক। আমার প্রস্তাব তুলে নিচ্ছি আমি।’

‘তবু ভাল, কাজে নেমে তারপর প্রশ্ন তোলেননি, কাজ শুরুর আগেই উঠেছে কথাটা। ব্যাখ্যা দেয়ার সুযোগ আছে আমার। আমাদের তিনজনের মধ্যে দুজন গনডোলা চালাতে জানে, একজন জানে না। একজনকে ওদের চিনে ফেলবার সম্ভাবনা আছে, দুজনকে চিনবে না। আমাদের কাজ হচ্ছে ওদের অবাক করে দিয়ে পরাস্ত করা, এবং অনিলকে গনডোলায় তুলে নিয়ে পলায়ন। তার জন্যে ওটাকে বাড়ির পেছন থেকে বেয়ে এ গলির মুখে নিয়ে আসা দরকার।’ হাসল রানা। ‘এবার রওনা হয়ে যান, ওস্তাদ, চিন্তা করে বের করুন দেখি আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তার মধ্যে কোন খুঁত পাওয়া যায় কিনা।

ওদের বিদায় করে দিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল রানা। অপেক্ষা করতে ভাল লাগে না ওর। অপেক্ষার সময় যেন কাটতেই চায় না। নানান চিন্তা আসতে শুরু করল ওর মাথায়। পেছন দিয়ে ঢুকতে পারবে তো বাতিস্তা। যদি না পারে তাহলে সামনের দিকে ফিরে আসতে কত সময় লাগবে? ততক্ষণ পারবে সে টিকে থাকতে? কজন লোক আছে এ বাড়ির ভিতর? অনিলকে পাওয়া যাবে তো এখানে? পাওয়া গেলে আপাতত খোঁজার শেষ। কিন্তু যদি না পাওয়া যায়? শেষ না দেখে পুলিসের সাহায্য নেবে না, স্থির করেছে সে। পুলিসের সাহায্য চাইলেই যে কতটা পাওয়া যাবে সে ব্যাপারেও সন্দেহ আছে ওর। কার কাছে খবর পেল পুলিস যে সেই ভাঙা বাড়িটায় জুলির লাশ পাওয়া যাবে?

রঞ্জন চৌধুরীর ব্যবহারটা কেমন যেন গোলমেলে ঠেকেছে রানার কাছে। এমন ভাব দেখাল যেন বিশ্বাসঘাতকতা করেছে অনিল, ঢাকায় মেজর জেনারেলকে অনুরোধ করেছে, রানা যেন এ ব্যাপারে নাক না গলায় রানার ওপর সেরকম আদেশ জারি করতে। চারদিকে ঢাক ঢাক গুড় গুড়। অথচ অনিল সেই ভারতেই ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে কেন? অনুতপ্ত? উঁহু, মেলে না।

শেষ বারের মত ঘড়ি দেখল রানা। দেয়ালের গায়ে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। অন্ধকার গলি থেকে বেরিয়ে এল সে। দৃঢ়, লম্বা পদক্ষেপে এসে দাঁড়াল সবুজ দরজাটার সামনে। সিঁড়ি বেয়ে তিন ধাপ উঠে জোরে তিনটে টোকা দিল দরজার গায়ে।

বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। কিন্তু আবার টোকা দেয়ার জন্যে রানা যেই হাত তুলল, ওমনি ঘটাং করে খুলে গেল দরজার বল্টু। দু’ফাঁক হয়ে গেল দরজা। চৌকাঠের ওপর দাঁড়িয়ে বেঁটে মোটা গীয়ান। ভুরু কুঁচকে চাইল রানার মুখের দিকে। মুহূর্তে চিনতে পেরেছে সে মিশরীয় ট্যুরিস্টকে।

‘কি চাই এখানে?’ কর্কশ কণ্ঠে প্রশ্ন করল গীয়ান।

‘ডক্টর আমানান্তির একটা জরুরী কল আছে।’ কথাটা বলতে বলতে গীয়ানকে প্রায় ঠেলে ঢুকে এল রানা বাড়ির ভিতর। ‘উনি এখানে আছেন শুনে এসেছি।

‘নেই। ছিলেন, কিন্তু কিছুক্ষণ আগে…’

কথাটা আর শেষ করতে পারল না গীয়ান, হুঁক করে একটা চাপা আওয়াজ বেরোল ওর মুখ দিয়ে, বাঁকা হয়ে গেল ভুঁড়ির ওপর প্রচণ্ড এক ঘুসি খেয়ে। পরমুহূর্তে চোয়ালের ওপর পড়ল রানার বজ্রমুষ্টির লেফট্‌হুক।

পা ভাঁজ হয়ে পড়ে যাচ্ছিল, ধরে ফেলল ওকে রানা। কানের কাছে মুখ নিয়ে মধুর কণ্ঠে বলল, ‘তোমার নিজের দাওয়াই দিলাম একটু। কেমন বুঝছ, মটু মিঞা?’

ঘাড়ের ওপর একটা মাঝারি ওজনের রদ্দা মেরে একটু আড়ালে টেনে নিয়ে শুইয়ে দিল রানা ওকে মেঝের ওপর। ওর শরীর ডিঙিয়ে এসে বন্ধ করে দিল সামনের দরজাটা। যাক, বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়েছে সে। দ্রুত চোখ বোলাল চারপাশে বাড়ির নকশাটা মোটামুটি বুঝে নেয়ার জন্যে।

সামনেই সিঁড়ি। ডানদিকে বেশ লম্বা একটা করিডর। করিডরের দুপাশে দুটো এবং শেষ মাথায় একটা বন্ধ দরজা দেখা যাচ্ছে। কম পাওয়ারের বাতি দিয়ে স্নানভাবে আলোকিত প্যাসেজটা।

কান খাড়া করল রানা। শেষ মাথার ঘর থেকে কয়েকজনের কথাবার্তার আওয়াজ আসছে, তাছাড়া সব চুপচাপ।

সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠাই স্থির করল রানা। কিন্তু রওনা হতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। দোতলার কোন একটা ঘরের দরজা খুলে গেল। ঝট করে সরে এল রানা সিঁড়ির নিচে, ছায়ায়।

ধুপধাপ পায়ের শব্দ এসে থামল সিঁড়ির কাছে।

‘গীয়ান? কে এল?’

রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে ওড্ডির মুখের একাংশ দেখতে পেল রানা। কুঁচকে আছে ভ্রূ।

সিঁড়ির নিচে অপেক্ষা করছে রানা। প্রস্তুত।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল ওড্ডি। অর্ধেক নেমেই দেখতে পেল সে গীয়ানের জ্ঞানহীন দেহটা। থমকে দাঁড়িয়ে ভাল করে লক্ষ করে দেখল সে।

নিচু গলায় কি একটা গালি দিল ওড্ডি, তারপর দুড়দাড় করে নেমে এল বাকি ধাপ কটা। নিচু হয়ে ঝুঁকে গীয়ানকে দেখল সে, কিন্তু সে শুধু এক সেকেন্ডের জন্যে, সিঁড়ির নিচে রানা সামান্য একটু নড়ে উঠতেই ঝট করে ফিরল এদিকে।

আধ সেকেন্ড পরস্পরের চোখের দিকে চেয়ে রইল ওরা। তারপর লাফ দিল রানা।

রানা আশা করেছিল বাঁ দিকে সরবে ওড্ডি, কিন্তু সরল ডানদিকে। একহাতে গলা টিপে ধরল রানা ওড্ডির, অন্য হাতে ঘুসি চালাল থুতনির নিচে। কিন্তু কোনটাই তেমন কার্যকরী হলো না লক্ষ্য সামান্য একটু ভ্রষ্ট হয়ে যাওয়ায়।

হাড্ডির মত শক্ত ওড্ডির হাত। এক হাতে ঠেকিয়ে দিল রানার ঘুসি, সামান্য একটু কাত হয়ে দড়াম করে মারল রানার পাঁজরার ওপর প্রচণ্ড একটা হুক। এক পা পিছিয়ে গেল রানা, গলা থেকে হাত ছুটে গেলেও চট করে ধরে ফেলল ওর কোটের কলার, হ্যাঁচকা টান দিল।

শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল ওড্ডি। সাঁই করে লাথি মারল রানা ওর পায়ের কব্জিতে। হুড়মুড় করে পড়ল ওডি মাটিতে, পড়েই বাঁ পা-টা রানার বুকে বাধিয়ে জোরে ধাক্কা দিল।

‘ইউজিনো! রিককি! পপিনি!’ তারস্বরে ডাক ছাড়ল সে রানাকে আবার বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে। উঠে বসতে যাচ্ছিল, শুয়ে পড়ল আবার প্রচণ্ড ঘুসি খেয়ে।

দুপাট খুলে গেল করিডরের শেষ মাথার দরজাটা। ইয়া লম্বা চওড়া এক লোক বেরিয়ে এল সরু প্যাসেজে। তার পেছনে তার চেয়েও প্রকাণ্ড আরও দুজন লোক। সামনের লোকটাকে এক হাতে সরিয়ে দিয়ে নিজে আগে আসার চেষ্টা করছে পিছনের লোকটা। দ্রুত এগোচ্ছে ওরা।

কে কার আগে আসবে তাই নিয়ে সরু প্যাসেজে একে অন্যের বাধা সৃষ্টি করছে ওরা, এই সুযোগে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল রানা ওড্ডিকে ছেড়ে। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল সে। পাগলের মত সামনের দিকে ঝুঁকে এল ওড্ডি। রানার বাঁ পা-টা দ্বিতীয় ধাপ ছেড়ে চতুর্থ ধাপে উঠতে যাবে, এমন সময় দুই হাতে খপ করে চেপে ধরল সে পায়ের কব্জি, মারল টান। হুড়মুড় করে পড়ে গেল রানা সিঁড়ির ওপর উপুড় হয়ে।

জোরে ঠুকে গেল কপাল, অন্ধকার হয়ে আসতে চাইল ওর চোখ। কিন্তু মন শক্ত করল রানা। এই অবস্থায় জ্ঞান হারানো মানে অবধারিত মৃত্যু। প্রাণপণ শক্তিতে অন্ধের মত পা ছুঁড়ল পেছন দিকে। ওড্ডির কাঁধের ওপর পড়ল লাথিটা! পা ছেড়ে দিয়ে দড়াম করে আছড়ে পড়ল সে প্রথম লোকটার পায়ের ওপর।

একলাফে ওড্ডিকে টপকে এগিয়ে এল দ্বিতীয় লোকটা। ভয়ঙ্কর চোখ মুখ। ধরে ফেলবার চেষ্টা করল রানাকে। সাঁৎ করে সরে গেল রানা, উঠে দাঁড়াল, এবং আচম্বিতে কনুই চালাল পেছন দিকে। সোলারপ্লেক্সাসের ওপর আচমকা গুঁতো খেয়ে ব্যথায় বিকৃত হয়ে গেল লোকটার মুখ, হামাগুড়ি দিয়ে বসে পড়ল সিঁড়ির ওপর।

আছড়ে-পাছড়ে আরও তিন ধাপ উঠল রানা, এমন সময় খপ করে ধরে ফেলল একজন রানার বাঁ হাতের কব্জি। তৃতীয় লোকটা। মাথা ভর্তি লাল চুল। নিচু হয়ে সিঁড়ির এপাশে চলে এসেছিল সে, হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে রেলিং-এর ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলেছে।

হ্যাঁচকা টানে রেলিং-এর গায়ে ধাক্কা খেলো রানা। হাতটা ছাড়াবার চেষ্টা করল। আঙুল তো নয়, রানার মনে হলো লোহার সাঁড়াশি দিয়ে চেপে ধরেছে ওর কব্জি। আশ্চর্য শক্তি লোকটার গায়ে, ছাড়ানো গেল না হাত।

সিঁড়ির ওপর হামাগুড়ি দিয়ে বসে ব্যথায় কাতরাচ্ছে কনুইয়ের গুঁতো খাওয়া লোকটা, বন্য জন্তুর মত মাথা নাড়ছে এপাশ ওপাশ। এক লাফে ওকে ডিঙিয়ে উঠে এল প্রথম লোকটা। ঠোঁট সরে গেছে দাঁতের ওপর থেকে, দুই চোখে প্রতিহিংসার বিষ। প্রচণ্ড এক ঘুসি তুলল লোকটা রানার তলপেট লক্ষ্য করে। ওই এক ঘুসিই রানার জন্যে যথেষ্ট ছিল, কিন্তু লাগাতে পারল না জায়গামত। আশ্চর্য ক্ষিপ্র বেগে শরীর বাঁকিয়ে সরে গেল রানা ছয় ইঞ্চি। দ্রাম করে পড়ল ঘুসিটা রেলিং-এর ওপর। কেঁপে উঠল সারা বাড়ি।

আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল লোকটার চোখ-মুখ। আরেকটা ঘুসি তুলল। ঠিক এমনি সময় বাতিস্তা এসে দাঁড়াল সিঁড়ির মাথায়, একবার চোখ বুলিয়েই বুঝে নিল অবস্থাটা, মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিল। সিঁড়ির তোয়াক্কা না রেখে ঝাঁপ দিল বাতিস্তা, পা আগে, মাথা পিছনে।

উড়ে এসে পড়ল বাতিস্তা লোকটার বুকের উপর, দু’পা নেমে গেল লোকটা, হোঁচট খেলো হামাগুড়ি দেয়া লোকটার গায়ে পা বেধে, হুড়মুড় করে পড়ল নিচে সানের ওপর, ওর বুকের ওপর পড়ল বাতিস্তা।

ডান হাতে রেলিং-এর ওপর ভর দিয়ে এক লাফে টপকাল রানা ওটা। ধপাস করে লাল-চুলো দৈত্যটার কাঁধে বসে পড়ল। দুই পায়ে যত জোরে সম্ভব দমাদম উল্টো লাথি মারতে শুরু করল সে লোকটার পেটে। রানাকে কাঁধে নিয়ে হুড়মুড় করে দেয়ালের গায়ে গুঁতো মারার চেষ্টা করল লোকটা বার কয়েক, সেদিকে সুবিধে করতে না পেরে রানার মাথাটা চুর করে দেয়ার জন্যে হঠাৎ সানের উপর পড়ল সে চিৎ হয়ে। রানার দুই ঊরু চেপে ধরে আছে বুকের ওপর যেন সে নড়াচড়া করতে না পারে। পতনের অর্ধেকটা পথ চুপচাপ থাকল রানা, লোকটা যেই সম্পূর্ণভাবে ভারসাম্য হারাল ওমনি জোরে এক মোচড় দিল। ঘুরে যাচ্ছে লোকটার দেহটা। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চট করে রানার ঊরু ছেড়ে দিয়ে নাক-মুখ ঠুকে যাওয়া থেকে বাঁচল লোকটা একহাতে মেঝে ধরে, অপর হাতে হ্যাঁচকা টান দিয়ে নামিয়ে দিল রানাকে কাঁধ থেকে। পর মুহূর্তে ক্যাক করে চেপে ধরল রানার কণ্ঠনালী। দম বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো রানার।

বিনা দ্বিধায় ডান হাতের তর্জনীটা ঠেসে ধরল রানা দৈত্যটার বাঁ চোখে। চিৎকার করে উঠল লোকটা। আরও জোরে খোঁচা দিল রানা। কণ্ঠনালীর ওপর থেকে খসে গেল বজ্র আঁটুনি। পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে লোকটা। দড়াম করে হাঁটুর একটা গুঁতো পড়ল ওর তলপেটে, পরমুহূর্তে কাঁধের পাশে পড়ল কারাতের এক তীব্র রদ্দা। ছিটকে গিয়ে রেলিং-এর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে।

বাতিস্তাকে বুকের ওপর নিয়ে সিঁড়ির ওপর থেকে নিচের মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়েই জ্ঞান হারিয়েছিল লোকটা প্রচণ্ড জোরে মাথাটা ঠুকে যাওয়ায়, কিন্তু কোনরকম ঝুঁকি নিল না বাতিস্তা, সটান উঠে দাঁড়িয়ে ঝপাং করে পড়ল আবার ওর বুকের ওপর দুই হাঁটু ভাঁজ করে। মড়াৎ করে শব্দ এল রানার কানে

উঠে দাঁড়িয়ে রানার দিকে ঘুরতে যাচ্ছিল বাতিস্তা, ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর ওড্ডি। রেলিং-এর গায়ে ছিটকে পড়া লোকটার কণ্ঠনালী টিপে ধরে এইদিকে চেয়েছিল রানা, পরিষ্কার দেখতে পেল বাতিস্তার খেলা। সেকেন্ড দশেক দমাদম ছোট ছোট ঘুসি মারল বাতিস্তা ওড্ডির নাকে-মুখে-বুকে-পেটে। প্রতিটা ঘুসি পড়ার সঙ্গে যেভাবে কেঁপে কেঁপে উঠল ওড্ডির শরীরটা, রানা বুঝল, ঘুসি তো নয়, আধমনী হাতুড়ির আঘাত পড়েছে ওর ওপর। হঠাৎ একপাশে কাত হয়ে গেল বাতিস্তা, আঙুলগুলো সোজা রেখে দড়াম করে জুডো চপ মারল ওড্ডির নাভির ছয় আঙুল ওপরে। বাঁকা হয়ে গেল ওড্ডি, ব্যথায় বিকৃত ওর চোখমুখ। দড়াম করে আরেকটা জুডো চপ পড়ল ওড্ডির ঘাড়ের পেছনে। ঝুপ করে পড়ল মেঝের ওপর ওড্ডির জ্ঞানহীন দেহ।

কনুইয়ের গুঁতো খাওয়া লোকটা ছুরি বের করে ফেলেছে একটা। কণ্ঠনালী ছেড়ে দিয়ে এক লাফে রেলিং টপকাল রানা। বাতিস্তার বুক লক্ষ্য করে ছুঁড়বার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে খপ করে ধরল রানা লোকটার কব্জি। বেকায়দা মত একটা চাপ পড়তেই ছুরিটা খসে গেল হাত থেকে। কিন্তু রানার কৌশলই ফিরিয়ে দিল লোকটা। বাম হাতের কনুই দিয়ে মারল রানার তলপেটে।

রানার সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসছিল বাতিস্তা, এমনি সময় করিডরের ডান পাশের একটা দরজা খুলে বেরিয়ে এল একজন লোক। এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল বলে টের পায়নি কিছুই, ধাঁই-ধুই আওয়াজ বেড়ে যাওয়ায় বেরিয়ে এসেছে কি হচ্ছে দেখার জন্যে। চোখের সামনে এই প্রলয়ঙ্কর অবস্থা দেখে মুহূর্তে শক্ত হয়ে গেল ওর সর্বাঙ্গের পেশী। চাপা একটা হুঙ্কার ছেড়েই লাফ দিল সামনের দিকে। একলাফে এসে পড়ল বেচারা বাতিস্তার খপ্পরে। গোটা চারেক ঘুসি খেয়ে হাঁটু ভাঁজ হয়ে পড়ে গেল লোকটা, বাতিস্তা পড়ল ওর ওপর।

সিঁড়ির ওপর লোকটা ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই সামলে নিল রানা। তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা, কিন্তু এখন এদিকে লক্ষ দিতে গেলে চলবে না। ডান হাতের জুডো হোল্ডটা ছাড়লেও চলবে না। সামনের দিকে ঠেলা দিয়ে লোকটার ভারসাম্য নষ্ট করে দিল রানা, তারপর দ্রুত দুই ধাপ নেমে এসে প্রাণপণ শক্তিতে থ্রো করল। রানার কাঁধের ওপর দিয়ে শূন্যে উঠে গেল লোকটার শরীর। ঠিক এমনি সময় দড়াম করে খুলে গেল সামনের দরজা। ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকল পাগলা ওস্তাদ।

উড়ন্ত লোকটার দিকে একনজর চেয়েই বাতিস্তার দিকে ফিরল ওস্তাদ। ঘাড় গুঁজে ঝুঁকে রয়েছে বাতিস্তা নবাগতের ওপর, হাত দুটো পিস্টনের মত কাজ করে চলেছে দ্রুত। ছটফট করছে লোকটা প্রচণ্ড হাতুড়ির ঘা খেয়ে, দুর্বল হয়ে আসছে ক্রমে।

চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিরতিশয় দুঃখিত হলো ওস্তাদ। পরিষ্কার বুঝতে পারছে সে, খেলাটা ধাপুড়-ধুপুড়-ধাঁই হয়েছে। নিয়ম কানুন মানেনি কেউ। আর সহ্য করতে না পেরে বলে উঠল, ‘আহ্-হা। কী করছ বাতিস্তা! ফাউল হচ্ছে তো।’

রানার ছুঁড়ে দেয়া লোকটা মাটিতে পড়েই উঠে দাঁড়াল আবার। দমাদম কয়েকটা ঘুসি মেরে বসল ওস্তাদের ভুঁড়ির ওপর। করুণ ভাবে মাথা নাড়ল ওস্তাদ।

‘এভাবে মারতে হয় না, বাছা। নিজের গার্ডটা রাখতে হয় সব সময়। নইলে…’

প্রচণ্ড এক থাবড়া পড়ল লোকটার নাকের ওপর। ছিটকে গিয়ে গীয়ানের শরীরে হোঁচট খেয়ে দেয়ালের গায়ে আছড়ে পড়ল লোকটা, সেখান থেকে ঝুপ করে পড়ল মাটিতে। দু’পা এগিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরল ওস্তাদ। একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে ছুরি তুলেছে গীয়ান গোক্ষুরের ফণার মত।

‘ছুরির তো কথা ছিল না!’ অবাক হয়ে গেল ওস্তাদ। ‘নিরস্ত্র লোকের বিরুদ্ধে ছুরি? কোন্ ইয়ারে পাস করেছ? তোমার কি আক্কেল বলতে কিছু নেই?’

ওস্তাদকে কটমট করে চাইতে দেখে একটু যেন থতমত খেয়ে গেল গীয়ান। সিঁড়ির ওপর থেকে লাফ দিল রানা। ঝট করে একটু সরে গিয়ে ছুরি চালাল গীয়ান। কব্জিটা ধরে ফেলল রানা ঠিক সময় মত, কিন্তু জুডো হোল্ডে ধরার আগেই ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নিল গীয়ান ওর হাতটা। আঙুলগুলো সোজা রেখে সাঁই করে মারল রানা কারাতে চপ নিচ থেকে ওপরে। নাকের নরম হাড়ের ওপর পড়ল আঘাতটা, গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এল নাক দিয়ে। পরমুহূর্তে কারাতের কোপ পড়ল ওর কনুই থেকে ইঞ্চি তিনেক নিচের নার্ভ সেন্টারে, খসে গেল ছুরি।

‘কী যা-তা মার মারছ!’ এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল ওস্তাদ রানাকে। ‘তোমাদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না। সবকিছু গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছ! বাম পা-টা সামনে, ডান পা পিছনে রাখো, এই রকম। তারপর মারো নক আউট পাঞ্চ, এই রকম।’

করিডরের মাঝামাঝি গিয়ে লুটিয়ে পড়ল গীয়ান, আর উঠল না।

জ্ঞানহীন দেহটা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল বাতিস্তা, এগিয়ে এল এদিকে। হাঁপাচ্ছে হাপরের মত।

‘কোথাও জখম হননি তো, সিনর?’ হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল বাতিস্তা।

নিজের গলায় হাত বোলাল রানা। কয়েকটা আঁচড় লেগেছে নখের, জ্বলছে। বলল, ‘না। তোমার?’

‘ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে পিঠে সামান্য ব্যথা লেগেছে। তেমন কিছুই নয়।’ এপাশ ওপাশ চাইল। ‘এবার কি করতে হবে, সিনর?’

জ্ঞানহীন দেহগুলো টেনে এনে সিঁড়ির নিচে জমা করতে শুরু করেছে ওস্তাদ, প্রত্যেকের জখম পরীক্ষা করে দেখছে এবং ঝেড়ে গাল দিয়ে চলেছে রানা ও বাতিস্তাকে অপদার্থ, অমানুষ, হৃদয়হীন, পাষণ্ড এবং ফাউল-প্লেয়ার বলে। ধমকে উঠল বাতিস্তার দিকে চেয়ে।

‘হাঁ করে কি দেখছ? দড়ি নিয়ে এসো লম্বা দেখে।’

রানার ইঙ্গিতে করিডরের দুপাশের দুটো এবং শেষ মাথার ঘর খুঁজে নাইলনের একটা শক্ত লম্বা রশি নিয়ে এল সে।

রানা বুঝল, নিচ তলায় নেই অনিল। যদি থাকে, ওপরে আছে। দরজায় বল্টু লাগিয়ে দিয়ে এগিয়ে এল। বাতিস্তার পিঠে মৃদু চাপড় দিল।

‘ওয়েল-ডান্। তুমি ওস্তাদকে সাহায্য করো, আমি ওপরটা দেখছি। দরজায় টোকা পড়লে খুলো না।’

একেক বারে তিন ধাপ করে উঠতে শুরু করল রানা সিঁড়ি দিয়ে। দোতলাতেও তিনটে ঘর। প্রথম দুটো ঘরে কেউ নেই। তৃতীয় ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল রানা। বাইরে থেকে বল্টু লাগানো এ ঘরে।

বল্টুতে হাত দিতেই ঢিব ঢিব শুরু হয়ে গেল রানার বুকের ভিতর। এ বাড়িতে যদি থাকে অনিল তাহলে এই ঘরে আছে। যদি তাই হয় তাহলে বলতে হবে খুব কম সময়ের মধ্যেই ওকে খুঁজে বের করতে পেরেছে সে। কিন্তু…কি অবস্থায় দেখবে সে অনিলকে? জীবিত, না…

বল্টু খুলে ঠেলা দিল রানা দরজায়।

ছোট একটা ঘর। দুটো মদের বোতলের মাথায় বসানো মোমবাতি জ্বলছে। একটা ক্যাম্পখাটে শুয়ে আছে একজন, একটা ফুলপ্যান্ট ছাড়া পরনে আর কিছুই নেই। ব্যান্ডেজ দেখা যাচ্ছে বাঁ কাঁধে। মুখটা দেখা যাচ্ছে না অন্ধকারে। ভৌতিক ছায়া ফেলছে মোমবাতির কম্পমান শিখা।

দ্রুতপায়ে এগিয়ে মোমবাতিসুদ্ধ একটা বোতল তুলে নিল রানা হাতে। একবিন্দু নড়ল না শায়িত লোকটা।

মোমবাতি হাতে এগিয়ে গেল রানা বিছানার পাশে।

যদিও বহুদিন দেখা নেই, চিনতে একটুও কষ্ট হলো না রানার। সারা গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, কিন্তু সেই মুখ, সেই চোখ, নাক-ভুল নেই তাতে। শুয়ে আছে অনিল চ্যাটার্জী। চারিত্রিক দৃঢ়তার ছাপ রয়েছে ওর চেহারায়। পাশেই টেবিলের ওপর একটা পাত্রে কিছু রক্ত মাখা তুলো, ব্যান্ডেজ, আর একটা পয়েন্ট থ্রী এইট ক্যালিবারের বুলেট।

নিঃসাড় পড়ে আছে অনিল। ফ্যাকাসে রক্তশূন্য চেহারা। চোখ বন্ধ। হঠাৎ রানার মনে হলো অনিলের মৃতদেহের দিকে চেয়ে রয়েছে সে। পরমুহূর্তে সামান্য একটু উঁচু হলো বুক, নাকের কাছে দুটো আঙুল নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করল রানা মৃদু শ্বাস- প্ৰশ্বাস।

পাল্স বিট দেখার জন্যে ওর বাম হাতটা তুলে নিয়েই চমকে উঠল রানা। অনেকগুলো খয়েরী পোড়া দাগ। সিগারেট ঠেসে ধরে নির্যাতন করা হয়েছে ওকে। এমন কিছু তথ্য আছে অনিলের কাছে যেটা সংগ্রহ করা শত্রুপক্ষের একান্তই দরকার। নির্যাতনের মুখে কি নতি স্বীকার করেছে অনিল?

অনিলের বুকের ওপর হাত রাখল রানা। নাড়া দিল মৃদুভাবে।

‘অনিল। শুনতে পাচ্ছ?

একটুও নড়ল না অনিল। বোঝা গেল না রানার কথা শুনতে পাচ্ছে কিনা। বুকের সামান্য ওঠানামা দেখেই বুঝতে হচ্ছে যে বেঁচে আছে এখনও।

ঘরে ঢুকল ওস্তাদ। ‘পেলে ওকে?’

‘হ্যাঁ। জুলির মতই ওর ওপরও নির্যাতন চালানো হয়েছে।’

‘মরে গেছে?’ এগিয়ে এল ওস্তাদ, অনিলের অবস্থা দেখে উল্টো শিস দিল ঠোঁট গোল করে। চট করে পালস্ বিট দেখে নিল একবার।

‘মরেনি, কিন্তু আধ-মরা। এখান থেকে বের করি কি করে ওকে?’ এদিক ওদিক চাইল রানা। ‘যে করে হোক গনডোলা পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যেতে হবে ওকে।’

বাতিস্তা এসে ঢুকল ঘরে। লম্বা পা ফেলে এসে দাঁড়াল খাটের পাশে। বলল, ‘আমি আর ওস্তাদ মিলে ওকে ধরে…’

‘তোমাকে লাগবে না। আমি একাই পারব। তোশক দিয়ে মুড়ে নিলে সোজাই থাকবে। আমি নিচ্ছি, তোমরা দুজন গার্ড দাও আমাকে সামনে পিছনে। অবস্থা বেশি ভাল মনে হচ্ছে না।’

প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চাইল রানা ওস্তাদের মুখের দিকে। উত্তর দিল বাতিস্তা।

‘আরও একজন ছিল এ বাড়িতে। পালিয়ে গেছে। নিচের একটা ঘরের ওপাশের দরজা ভিড়ানো ছিল, ধাক্কা দিতেই খুলে গেল।’

তোশক দিয়ে মুড়ে কোলে তুলে নিল ওস্তাদ অনিলের অজ্ঞান দেহ। দ্রুত পায়ে নেমে এল ওরা নিচে।

সিঁড়ির নিচে শক্ত করে বেঁধে ফেলে রাখা ছ’জনের কারও হুঁশ নেই। একনজর দেখে নিয়ে সামনের দরজার বল্টু খুলে ফেলল রানা। সাবধানে মুখটা বের করল বাইরে।

এমনি সময়ে তীক্ষ্ণ শব্দে টেলিফোন বেজে উঠল বাড়ির ভিতর কোথাও। একসাথে চমকে উঠল ওরা তিনজন। দরজা দিয়ে মুখ বের করে রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত দেখল রানা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে। জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই রাস্তায়। একটি মাত্র বাতি জ্বলছে কাফের সাইন বোর্ডের মাথায়।

বেরিয়ে এল রানা বাইরে। পিছু পিছু ওস্তাদ। দরজাটা টেনে ভিড়িয়ে দিয়ে বাতিস্তা এল সর্বশেষে।

দ্রুতপায়ে ঢুকে পড়ল ওরা অন্ধকার গলিতে। মোড় নেয়ার আগে হঠাৎ থেমে দাঁড়াল রানা। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাইল পিছনের প্রত্যেকটা ফেলে আসা গলিমুখের দিকে।

সড়সড় করে গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল রানার। প্রত্যেকটা গলিমুখে এসে দাঁড়িয়েছে চারজন করে লোক। সবার দৃষ্টি ওদের দিকে ফেরানো। বিশ পঁচিশজন লোক একসাথে এগোচ্ছে এইদিকে।

‘পা চালান, ওস্তাদ,’ বলল রানা। ‘আমাদের ঠেকাবার চেষ্টা করা হবে এখন। সামনের দিকে ক’জন আছে আল্লাই মালুম।’

‘কত আর থাকবে, বড়জোর বিশ পঁচিশ জন আরও? এদের পিটিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে না? কোন ইয়ারে পাস করেছ?’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *