এক
চৌরঙ্গীর কন্টিনেন্টাল হোটেল।
বিদায়ের আগে এক কাপ কফি খাচ্ছে রানা লাউঞ্জে বসে। কফিটা এরা বানায় ভাল। সুটকেস গোছানোর ভার গিলটি মিঞার ওপর ছেড়ে দিয়ে নেমে এসেছে ও চার তলার স্যুইট থেকে। ট্যাক্সির জন্যে বলা হয়েছে পোর্টারকে, এতক্ষণে এসে গেছে হয়তো। যাত্রার সব আয়োজন শেষ। ভিয়েনায় চলেছে ও ইন্টারপোলের এক গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে।
কফির কাপে তৃতীয় চুমুক দিয়েই কান খাড়া হয়ে গেল রানার।
‘আচ্ছা এই হোটেলে মাসুদ রানা বলে কেউ উঠেছেন কি?’ কণ্ঠস্বরটা কাঁপা কাঁপা।
চট করে চোখ তুলল রানা। এক বৃদ্ধা। বয়স ষাট-পঁয়ষট্টির কম হবে না। সম্ভ্রান্ত চেহারা। বেশিরভাগ চুলই পাকা। হাতের চামড়া ঝুলে পড়েছে, জরজর, কোঁচকানো। বাঁ হাতে একটা স্কুলটীচারী ছাতা আর উনিশশো ছত্রিশ মডেলের ভ্যানিটি ব্যাগ। ডান হাতে রিসেপশন কাউন্টারের ব্রাস-রেল আঁকড়ে ধরে পুরু লেন্সের চশমার ভিতর দিয়ে চেয়ে রয়েছেন বৃদ্ধা ব্যস্ত ক্লার্কের মুখের দিকে। রানা লক্ষ করল, পা দুটো কাঁপছে মহিলার, মনে হচ্ছে ব্রাস-রেল ছেড়ে দিলেই পড়ে যাবেন হুড়মুড় করে।
মুখ না তুলেই জবাব দিল রিসেপশন ক্লার্ক, ‘উঠেছিলেন, কিন্তু আজ চলে যাওয়ার কথা, খুব সম্ভব চলে গেছেন।’
‘কোথায়?’ ফ্যাকাসে হয়ে গেল বৃদ্ধার মুখটা।
‘জানি না,’ ঝাঁঝাল কণ্ঠে কথাটা বলে বিরক্ত দৃষ্টিতে চাইল ক্লার্ক মহিলার মুখের দিকে, সম্ভ্রান্ত চেহারা চিনতে ভুল করল না,
ঘাড় ফিরিয়ে দেখল চাবি ঝোলানো বোর্ডটার দিকে, একটা মোটা রেজিস্টার উল্টে দেখল। ‘দেড়টায় ফ্লাইট। আর পঁয়তাল্লিশ মিনিট আছে।’ হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল সে। ‘এতক্ষণ পর্যন্ত কি করছে লোকটা ঘরে বসে?’ হাত বাড়িয়ে টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে নিয়ে কানে ধরল ক্লার্ক, পরমুহূর্তে চোখ গেল তার পোর্টারের দিকে, সেদিকে ইঙ্গিত করে বলল মহিলাকে, ‘ট্যাক্সি এসে গেছে। দেখা হবে না এখন। ওই দেখুন মালপত্র নামছে।
পাশ ফিরে দেখলেন মহিলা ব্যস্ত-সমস্ত পোর্টারকে, সুটকেসের ওপর ‘মাসুদ রানা’ লেখা লেবেলটা পড়লেন। দ্রুতপায়ে বাইরে বেরিয়ে গেল পোর্টার দুই হাতে দুটো সুটকেস নিয়ে। শূন্যদৃষ্টিতে সেদিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন মহিলা, চলে যাওয়ার জন্যে এক পা বাড়িয়ে টলে উঠলেন, মাথাটা বোধহয় ঘুরে উঠল, চট্ করে একটা চেয়ার ধরে সামলে নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন।
শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রাখল রানা, তারপর উঠে এসে দাঁড়াল বৃদ্ধার সামনে।
‘আপনার কি খুবই জরুরী দরকার ছিল?’
‘হ্যাঁ, বাবা।’ ফোঁস করে আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মহিলা। চোখ দুটো ঘোলাটে। কাঁপা গলায় বললেন, ‘মহা ভুল হয়ে গেল। আরও আগে রওয়ানা হওয়া উচিত ছিল। ট্রামে-বাসে যা ভিড়, উঠতেই পারলাম না। হেঁটে এসেছি, তিন মাইল।’
‘খুব বেশি সময় লাগবে? মানে, কথা কি অনেক বেশি?’
‘না বাবা। বেশি কথা নয়। কিন্তু বুঝতে পারছি, এখন তার দম ফেলবারও সময় নেই। ভুল হয়ে গেছে আমার। এত ব্যস্ততার মধ্যে-’
ঘড়ি দেখল রানা বলল, ‘আচ্ছা, কি ব্যাপারে কথা বলুন তো?’
সরাসরি রানার মুখের দিকে চাইলেন বৃদ্ধা। ‘আমার ছেলের ব্যাপারে।’ আশার আলো ফুটে উঠল দুই চোখে। ‘তুমি পারবে বাবা দেখা করিয়ে দিতে?’
‘কিছু মনে করবেন না, আমার আগেই পরিচয় দেয়া উচিত ছিল—আমিই মাসুদ রানা। চলুন না ট্যাক্সি করে দমদম যাওয়ার পথে আপনার কথা শুনব?’
রানার পরিচয় জেনে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল বৃদ্ধার, কিন্তু শেষের কথাটায় ম্লান হয়ে গেল আবার। চট করে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে নিচু গলায় বললেন, ‘আমার পেছনে পুলিসের লোক লেগে আছে। ওরা ধরে ফেলবে। উঠতেই দেবে না তোমার ট্যাক্সিতে।
হঠাৎ রানার মনে হলো মহিলা পাগল নয়তো? কিন্তু তাহলে ওর নাম জানল কি করে? ঘড়ি দেখল আর একবার। গিলটি মিঞাকে দেখা গেল হন্তদন্ত হয়ে আসছে এদিকে লিফট থেকে নেমে। সময় নেই। কি করবে বুঝতে পারছে না রানা।
রানার ভাবটা লক্ষ করলেন মহিলা। বললেন, ‘ঠিক আছে, যত সংক্ষেপে পারি বলছি। অনিলকে চেনো তুমি?’
‘অনিল-মানে, অনিল চ্যাটার্জী?’ বসে পড়ল রানা সামনের চেয়ারে।
চোখ দুটো সামান্য একটু বিস্ফারিত হয়ে গেছে রানার। ভাল করেই চেনে সে অনিলকে। দেড় বছর আগে একসঙ্গে কাজ করেছে ওরা একটা অ্যাসাইনমেন্টে। তুখোড় ছেলে। ভারতীয় গুপ্তচর বিভাগের সেরা এজেন্টদের একজন অনিল চ্যাটার্জী। ইনি কি তারই মা? তাহলে এঁর পিছনে পুলিসের লোক কেন?
‘হ্যাঁ। আমি তার মা। দেড় মাস আগে রোমে গিয়েছিল ও। পৌঁছে চিঠি দিয়েছিল, কিন্তু তারপর থেকে আর কোন খবর নেই।’ চোখ দুটো ছলছল করে উঠল বৃদ্ধার। ‘যখনই বাইরে যায়, যেখানেই থাকুক সপ্তাহে দুটো করে চিঠি দেয় ও। কিন্তু এবার কোন খবর নেই ওর।
‘ওর অফিসে জানিয়েছেন?’
‘সবাইকে জানিয়েছি। কেউ কোন সাহায্য করবে না। ও ফরেন সার্ভিসের লোক, মিনিস্ট্রি অফ ফরেন অ্যাফেয়ার্সে জানিয়েছি, পুলিসকে জানিয়েছি, কোন লাভ হয়নি। এমন ভাব দেখাচ্ছে সবাই যেন অনিলের কিছু হয়ে থাকলে ওদের কিছুই এসে যায় না। আমার মন বলছে ভয়ানক কিছু একটা ঘটে গেছে। নিজে যাব মনে করে আমার পাসপোর্টটা রিনিউ করবার জন্যে দিয়েছিলাম দুই সপ্তাহ আগে, ওরা বলছে হারিয়ে গেছে সেটা, আবার নতুন করে অ্যাপ্লাই করতে হবে। তার আগে থেকেই আমার পেছনে লোক লেগে গেছে, যেখানেই যাই না কেন, আমাকে অনুসরণ করছে সাদা পোশাক পরা দুজন পুলিস। এখানেও এসেছে পেছন পেছন।
মহিলা পাগল কিনা সে সন্দেহটা আবার একবার উঁকি দিল রানার মনের কোণে। গিলটি মিঞা এসে দাঁড়াল পাশে। চঞ্চল হয়ে উঠল সে রানাকে নির্বিকার চিত্তে গল্প করতে দেখে।
‘ট্যাক্সি ভেঁড়িয়ে আচে, স্যার। যাবেন না? হাতে আর সোমায় নেই।’
‘বাইরে দুজন টিকটিকি রয়েছে, ওদের সঙ্গে খানিক গল্প-গুজব করোগে যাও। ভেতরে ঢুকতে দেবে না।’
দুই সেকেন্ড অবাক হয়ে চেয়ে রইল গিলটি মিঞা রানার মুখের দিকে, তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে। রানা ফিরল বৃদ্ধার দিকে।
‘আমার কাছে কি সাহায্য আশা করছেন?’ সরাসরি প্রশ্ন করল রানা।
‘তা আমি ঠিক জানি না, বাবা। অনিল দেখা করতে বলছে তোমার সঙ্গে।’ ব্যাগ থেকে একটা রঙিন পিকচার-পোস্টকার্ড বের করলেন বৃদ্ধা, রানার হাতে দিয়ে বললেন, ‘গতকাল এসেছে এটা।
কার্ডটা উল্টে-পাল্টে দেখল রানা। ভেনিসের ব্রিজ অফ সাইজের (দীর্ঘশ্বাসের সেতু) রঙিন ছবি। ইটালিয়ান পোস্ট অফিসের সীলে তারিখ দেখা যাচ্ছে পাঁচদিন আগের। প্রাপকের নাম অরুণা ভট্টাচার্য, ২৬/২ যদুনন্দন গোস্বামী লেন, কলিকাতা ৬। পরিষ্কার হস্তাক্ষরে একটা ছোট্ট চিঠি, ইংরেজিতে লেখা। বাংলা মানে করলে দাঁড়ায়:
কাজে আটকে গেছি, ছুটতে পারছি না। শরীরটাও খারাপ। কাগজে দেখলাম, মাসুদ রানা ভিয়েনায় আসছে। ওকে আমার প্রীতি জানিয়ো। সেরা তিনটে হোটেলের যে কোন একটায় পাবে। অবশ্যই দেখা করবে। ইতি-এস.ও.সলিল।
অবাক হয়ে বৃদ্ধার মুখের দিকে চাইল রানা।
‘কার চিঠি এটা? অনিলের নয়! আপনার উদ্দেশেও লেখা
নয়। অথচ আমার নাম…’
‘এ চিঠি অনিলেরই।’ কাঁপা গলায় বললেন বৃদ্ধা। ‘ওরই হাতের লেখা। ঠিকানাটা ওর মামা বাড়ির। বিয়ের আগে আমার নাম ছিল অরুণা ভট্টাচার্য। সলিল ওর বাবার নাম। এস.ও. সলিল মানে সান অফ সলিল, তার মানে অনিল। আজ সকালে পৌঁছে দিয়ে গেছে এটা আমার কাছে আমার ভাইপো। আবার পড়ে দেখো বাবা, ও কিছু একটা বলতে চাইছে তোমাকে এই চিঠিতে নিশ্চয়ই বিপদে পড়েছে কোন।
আবার একবার কার্ডটার দিকে চেয়েই মনে মনে চমকে গেল রানা। ‘পিপল হু ক্রসড় দা ব্রিজ অফ সাইজ ওয়্যার কনডেমড।’ অনিল বোঝাতে চাইছে বিপদে পড়েছে সে, হয় আত্মগোপন করে আছে নয়তো বন্দী হয়েছে—বেরোতে পারছে না। চিঠির শেষে নাম সই করবার ছলে এস.ও.এস. বিপদসংকেতটা এবার আর ওর চোখ এড়াল না। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিল রানা। ঘড়ি দেখল-কাঁটায় কাঁটায় একটা।
গিলটি মিঞা এসে দাঁড়াল আবার। অস্থির হয়ে উঠেছে বেচারা। জীবনে এই প্রথম সত্যিকার অর্থে বিদেশ চলেছে সে। উৎসাহ আর উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে সকাল থেকে।
‘সোমায় নেই, স্যার। ট্যাক্সিআলা বলচে এখুনও রওনা দিলে হয়তো…’
‘বাইরের দুজন কি করছে?’ প্রশ্ন করল রানা।
‘গোমড়ামুকো ভূত, স্যার। কতা বলে না। উই উদিকে পানের দোকানে…’
‘ঠিক আছে। তুমি এক কাজ করো, আজকে যাচ্ছি না আমরা, ট্যাক্সি বিদায় করে দিয়ে মালপত্র ঘরে তোলার ব্যবস্থা করো। আর আজকের টিকিটগুলো ক্যান্সেল করে কালকের জন্যে রিজার্ভেশনের ব্যবস্থা করো। পারবে না?’
‘নিচ্চয়।’ বারকয়েক রানা ও বৃদ্ধার মুখের দিকে চাইল গিলটি মিঞা, তারপর হাসল। ‘ব্যাপারেশন খারাপ!
দ্রুতপায়ে চলে গেল গিলটি মিঞা। অত্যন্ত বিব্রত বোধ করলেন বৃদ্ধা। বললেন, ‘তোমার অনেক ক্ষতি…’
‘কিচ্ছু না। এজন্যে ভাববেন না আপনি।’ উঠে দাঁড়াল রানা। চলুন, উপরে গিয়ে আগাগোড়া সবটা ব্যাপার শোনা যাক।’