বিজয়িনী
বনপাহাড়ি রিফ্র্যাক্টরি ওয়ার্কস-এর মহিলামহল উদ্বেগ-আশঙ্কায় বিকল হয়ে পড়েছে। সত্যি বটে, বনপাহাড়ির চারদিকে প্রায় দুর্ভেদ্য জঙ্গল আর ভেতর থেকে মাঝে মাঝেই ভেসে আসে হাতির চিৎকার, বাঘের চাপা গর্জন কিংবা মুমূর্ষু হরিণের অসহায় হাহাকার। কিন্তু মহিলামহলের অশান্তির কারণ এসব কিছুই নয়। এসবে ভয় পেলে কি আর বনপাহাড়িতে চাকরি করা চলে? সকালবেলা উঠে পেছনের বাগানে যদি একটা ময়াল সাপই না-দেখা গেল বা মহুয়া খেয়ে মাতাল ভালুক যদি বসবার ঘরেই না-ঢুকে পড়বার চেষ্টা করছে জানা গেল, তাহলে আর বনপাহাড়িতে থাকার অর্থ কী? ধানবাদের হেড অফিসে গিয়ে থাকলেই হয়! বনপাহাড়ির মহিলামহল, যাঁরা ধানবাদে বদলি হয়ে যান বা সেখানেই চাকরি করেন, তাঁদের খুব তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে থাকেন। বনপাহাড়িতে থাকতে গেলে সাহস থাকা দরকার।
তা সত্ত্বেও কিন্তু আপাতত বনপাহাড়ির মহিলামহলের চিত্তে আর সুখ নেই। কারণ, না বাঘ নয়, সাপ, হাতি, ভালুক, নেকড়ে কিচ্ছু নয়। মহিলাদের হৃদয় আতঙ্কে বিকল করে দিয়েছেন একজন মহিলাই। ইনি মিস প্রহেলিকা পাল, চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট অর্ণব দাসের শালি। এখন তাঁর মেজদির আমন্ত্রণে ইনি বনপাহাড়িতে এসেছেন বিশ্রাম নিতে।
প্রহেলিকা পাল কি রাক্ষুসি-টাক্ষুসি গোছের কিছু? প্রশ্নটা নিতান্তই অবান্তর। কারণ প্রহেলিকা পালের পরিচয় দিতে যাওয়া ধৃষ্টতা। বাংলা সিনেমা যাঁরা দেখেন বা না-দেখে সিনেমা পত্রিকা পড়েন না-পড়ে চোখ খুলে রাস্তা চলতে গিয়ে দু-একটা সিনেমার বিজ্ঞাপনের দিকে তাকিয়ে ফেলেন, তাঁরা সকলেই প্রহেলিকা পালকে চেনেন। এককথায়, পশ্চিম বাংলার অন্ধ এবং কালারা ছাড়া সকলেই তার মুখশ্রীর সঙ্গে সম্যক পরিচিত। ব্রহ্মচারির পতন’ নামক সিনেমায় তিনি চিত্রাঙ্গদার ভূমিকায় প্রথম দর্শকদের সামনে আসেন এবং সেই থেকে তাঁর অব্যাহতগতি বিজয়রথের তলায় যে কত নিষ্কলুষ কঠিন ব্ৰহ্মচর্য ইত্যাদি গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে গেছে, তার আর ইয়ত্তা নেই। রুপোলি পর্দার প্রহেলিকা সত্যিই কুহকময়ী প্রহেলিকা। বাঘা বাঘা নায়করা তাঁর সামনে ভেড়ার মতো কিংবা ভেড়ুয়ার মতো অভিনয় করে থাকেন।
তবে, তাতে আর কী হয়েছে? সিনেমায় তো এমন কত নায়িকাই আছেন, যাঁরা নির্বিকার মুখে বেশ্যা বা নাচউলির পার্ট করে যাচ্ছেন আর বাড়িতে স্বামী-পুত্র নিয়ে সুখে সংসার চালাচ্ছেন। সিনেমার নায়িকা হলেই ভয়ানক কিছু হতে হবে— এমন তো কোনো কথা নেই।
কিন্তু প্রহেলিকা পালের কথা স্বতন্ত্র।
প্রহেলিকা পর্দায় যেমন, ব্যক্তিগত জীবনেও তেমনই। অসাধারণ রূপ আর ছলাকলায় হদ্দবোকা পুরুষমানুষদের ভুলিয়ে তাদের মোটা মাথাগুলো চিবিয়ে খেতে তাঁর মতো ওস্তাদ আর ভূভারতে দ্বিতীয় জন্মায়নি। ওঁর যাবতীয় নর্মসঙ্গীদের ধরে মনুমেন্টের তলায় দাঁড় করিয়ে দিলে নাকি অনায়াসে একটা রাজনৈতিক সভা চালিয়ে দেওয়া যায়। আর কী বিচিত্র সেই লোকারণ্য! ইংরেজিতে নাকি বলে যে— বৈচিত্র্যই হল গে জীবনের মশলা। কথাটা সত্যি হলে, সেই জনসমাগমে গিয়ে দাঁড়ালে বড়োবাজারের মশলাপট্টিতে এসে ঢুকেছি বলে মনে হবে। কে নেই তাতে? কোটিপতি ব্যবসায়ী, ভবঘুরে পকেটমার, দুর্ধর্ষ খেলোয়াড়, দমকলের ঘণ্টাবাজানেওলা, সমাজবাদী, রাজনৈতিক নেতা, কলেজের ফেল্টমারা অসামাজিক ছাত্র বাঙালি, উড়িয়া, সিন্ধি, হিন্দু বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্সিক, মুসলমান, প্রোটেস্ট্যান্ট, ক্যাথলিক ইত্যাদি সকলকেই সেই ভিড়ে খুঁজে পাওয়া যাবে। স্বপ্নসম লোকযাত্রা!
এহেন প্রহেলিকা পালের সান্নিধ্যে এসে যে বনপাহাড়ির মহিলামহল বিহ্বল হয়ে পড়বেন, এতে আর আশ্চর্য কী? কেউ কেউ মনে করতে পারেন যে, প্রহেলিকা পাল সম্পর্কে নানা অতিরঞ্জিত সংবাদ কেউ মহিলামহলকে দিয়েছেন। মোটেই তা নয়। বনপাহাড়ির মহিলামহল কলকাতার বাইরে নিতান্ত গ্রাম্য পরিবেশে থাকলেও মোটেই বোকা বা খবর-টবর রাখেন না এমন নয়। কলকাতার যাবতীয় লেটেস্ট খবরই তাঁদের কাছে পাওয়া যাবে। এমনকী, এমন সব খবর পাওয়া যাবে, যা কলকাতার লোকেরাও ভালো করে জানে না। এই তো সেদিন, কলকাতার শ্রীরাধা গড়াই মারা গেলেন। সেই নিয়ে কলকাতায় কী হইচই। তিনি আত্মহত্যা করেছেন, না তাঁকে খুন করা হয়েছে, বা তিনি আত্মহত্যা করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন, না নিহত হয়েছেন ভেবে আত্মহত্যা করে ফেলেছেন এ নিয়ে রীতিমতো মাথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেল। বনপাহাড়ির মহিলামহল কি তখন পিছিয়ে ছিলেন? কখনোই নয়। সেই যে তাঁদের কয়েক জনের মধ্যে বাক্যালাপ বন্ধ হয়েছে, সে অবস্থা এখনও পর্যন্ত চলছে।
কাজেই, অতিরঞ্জিত ব্যাপারে ঘাবড়াবার পাত্র মহিলামহল নন। তাঁরা ‘আহ্লাদে জগৎ’ নিয়মিত পড়ে থাকেন। সে কাগজে তো আর বাজে খবর ছাপা হতে পারে না। আর ‘আহ্লাদে জগৎ’-এর সামনে প্রহেলিকা, পেছনে প্রহেলিকা, ভেতরে প্রহেলিকা, ফুলুরি খাচ্ছেন প্রহেলিকা, গাড়ি চালাচ্ছেন প্রহেলিকা, ঘুমোচ্ছেন, নাচ্ছেন, শাড়ি ছাড়ছেন বা শাড়ি পরছেন এককথায়— বহুরূপে সম্মুখে প্রহেলিকা। আর বিশেষ ফিচার, ‘ফিসফিস’ তো প্রতি সংখ্যায় প্রহেলিকার নতুন নতুন প্রেমের ফিসি আর রোমাঞ্চকর কাহিনিতে রমরম করছে। প্রহেলিকার যাবতীয় খবর তো এখান থেকেই পাওয়া। অতএব, মহিলামহল যে ঘাবড়েছেন তার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ আছে।
তা ছাড়া, বনপাহাড়ির একটা পুরুষমানুষও কী পুরুষ, না মানুস? মহিলামহল যদি শক্ত করে ধরে না-রাখতেন, তাহলে আজ এসের কী হাঁড়ির হালই না হত! তাদের না আছে ঘটে বুদ্ধি, না আছে ট্যাকে টাকা। গিন্নিরা কোনোরকমে খাইয়ে দাইয়ে রেখেছেন, তাই। তা না-হলে কালে কাকে চিলে তুলে নিয়ে যেত। কিন্তু, সেজন্যে কী কোনো কৃতজ্ঞতা বোধ আছে? যবে থেকে প্রহেলিকা এসেছেন, তবে থেকে কী খুশি খুশি ভাব! বত্রিশপাটি দাঁত যেন বেরিয়েই আছে। অথচ বড়োসাহেবদের বাংলোগুলোর দিকে যাবার কারোর সাহস নেই, কেবল দূরে দূরে ছোঁক ছোঁক করে বেড়ানো। ব্যাচেলার ছেলেগুলো পর্যন্ত হই-হল্লা বন্ধ করে স্টাইল করে হাঁটাচলা করছে। জানে না, বাবুদের দূর থেকে দেখাচ্ছে যেন কতগুলো গোবক ডিঙি মেরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সেদিন বিল্ডিং ওভারসিয়ার ভূপতিবাবুর ডাক পড়েছিল ওদিকের কলোনিতে কী কাজে। ফিরে আসতে না আসতেই এদিকের সবাই মিলে ওঁকে ছেঁকে ধরল। কত ফিসফিয়া কথা, কত খুসখুস হাসি! আসলে কিন্তু সবই বাজে। ভূপতিবাবুর স্ত্রী শোভা বলল, “কিচ্ছু না, কিচ্ছু না। কিছুই দেখেনি। গিয়েছিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফিসার কার্তিক ভৌমিকের বাড়ির রান্নাঘরের ছাদের লিক সারাতে।’ অবিশ্যি কেতো ভৌমিকের বউ সঞ্চারী ভৌমিকটা এক নম্বরের নির্লজ্জ ঢলানি। কিন্তু শোভা তো তার বরকে ভালো করে চেনে, কোনোদিন বেচাল দেখলে ঝ্যাঁটাপেটা করে ভূত বের করে ছেড়ে দেবে না?
কিন্তু, সবাই তো আর সমান হয় না। দুঃখটা তো সেখানেও। ওদিকের লেডিস ক্লাব নাকি আবার ঘটা করে প্রহেলিকাকে পার্টি দিয়েছে। এর কি কোনো মানে হয়? অবশ্য, ওদের কথা আলাদা। ওদের বরেরা সব যা এক-একটি চরিত্র! ঘটে তো কারোর এতটুকুও বুদ্ধি নেই, সন্ধে হলেই খালি মদ খাও আর অন্যের বউয়ের কোমর জড়িয়ে ধরে নাচো। দেখলে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসে! ওরা পার্টি দেবে না তো দেবে কারা? মেয়ে হয়ে যে মেয়েদের সাহায্য করতে হয়, সেকথা কি ওদের একবারও মনে আসে? যেমন ওদের বরেরা, তেমনি ওরা। এক-একটি অবতার!
জুনিয়ার চার্জহ্যান্ড যজ্ঞেশ দত্তের উনিশ বছরের সদ্য বিয়ে হওয়া বউ দোলা চোখ গোল করে বলল, জানো সরমাদি, ওই মিসেস ভাটিয়া না জিং খায়! ও নিজের চোখে দেখেছে।’
ডেসপ্যাচ ক্লার্ক সচ্চিদানন্দ করনের স্ত্রী সরমা বললেন, ‘দুর ছুঁড়ি! শুধু মিসেস ভাটিয়া কেন? মিসেস রায়, মিসেস গোয়েল, মিসেস কাঙ্গা সবাই খায়।
ইঞ্জিনিয়ারিং স্টোর্স-এর সিনিয়র স্টককিপার ব্রজগোপাল দাসের স্ত্রী মালার সঙ্গে আপাতত সরমার কথা বন্ধ। সরমা যা বলবেন, মালাকে তার প্রতিবাদ করতেই হবে। কাজেই মুখের ভেতর তিন খিলি পান চালান করে দিয়ে মালা বললেন, “সবাই মোটেই খায় না। সবাইকে খারাপ বললে নিজেকেই ছোটো করা হয়। মিসেস বালাসুব্রহ্মনিয়মের কথাই ধর না। কী নিষ্ঠাবতী মহিলা। পুজোআচ্ছা নিয়েই আছেন। এরকম ভালো লোক দেখা যায় না।’
সরমা অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভালো হলেই ভালো। তা, হ্যাঁরে টিয়া, জোর গুজব শুনছি, বালসুব্রহ্মনিয়ম সাহেব নাকি প্রোডাকশন থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ম্যানেজার হয়ে আসছেন? সত্যি বলেই তো মনে হয়, না রে?’ বলে চোখদুটো একবার বাঁই করে ঘুরিয়ে নিলেন।
মালা ছাড়া সবাই হেসে উঠল। আর হাসল না টিয়া। টিয়ার বর অ্যাকাউন্টসের কনফিডেনশিয়াল স্টেনো, কাজেই অনেক গোপন তথ্য তার জানা থাকে। কিন্তু, যোগ্য সহধর্মিনী টিয়া কক্ষণো মুখ খোলে না। প্রমোশন বা ডিমোশন কিছু ঘটে যাবার পর বলে, ‘আমি তো এসব অনেক আগেই জানতুম।’ বলে খুব একটা ইমপর্ট্যান্ট মুখ করে।
সরমার প্রশ্নে সেরকম একটা মুখভঙ্গি করে যেন কথাটা ঘোরাবার জন্য টিয়া বলল, ‘ওসব কথা বাদ দিন তো সরমাদি। আমরা বলে মরছি এখন নিজেদের জ্বালায়। বরং বলুন তো, এ কলোনির লেডিস ক্লাব কী ঘেন্নার কাজটাই না করল। ওরা যা ইচ্ছে থাক না, তা বলে কি লজ্জাশরমও থাকতে নেই? একটা নোংরা চরিত্রের মেয়েমানুষ, না-হয় হলই খুব নাম করা, তা বলে তাকেই আদর করে ডেকে এনে পার্টি দিয়ে ধেই ধেই করে স্বামীদের সঙ্গে নাচাতে হবে? নিজেদের স্বামীদের সামলাতে পারিস না, ঠিক আছে। সে আর আমরাই বা ক-জন পারি? কিন্তু তাই বলে নিজে সেধে নিজের স্বামীকে প্রহেলিকার কোলে তুঙ্গে দিয়ে আসব, এ যে কল্পনাই করা যায় না।’
সরমা বললেন, “তা যা বলেছিস টিয়া। সেদিন ক্ষীরোদ দত্তের বউ বাণীর সঙ্গে দেখা হল। বলল, “বি কলোনির” মহিলাসমিতিও নাকি ভীষণ মুষড়ে পড়েছে।’
পারচেস অ্যাসিস্ট্যান্ট ইন্দ্রনাথ ঘোষের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী পরমেশ্বরী বিড়বিড়িয়ে বলল, “কেন? মুষড়ে পড়বার কী আছে? সবসময় গা শুঁকোশুঁকি ওঁরা যা করেন, এঁরাও তার পোঁ ধরেন। এখন মুষড়ে পড়লেই হল? কেন? তোরাও ডবল পার্টি দে! স্বামীদের চ্যাংদোলা করে ধরে প্রহেলিকার খাটে শুইয়ে দিয়ে আয়!’
পরমেশ্বরীর কথা শুনে এত দুঃখেও সবাই হেসে উঠল।
টিয়া ভীষণ সিরিয়াস মুখ করে বলল, ‘এতে এত হাসবার কী আছে? “বি কলোনি” যতই গা শুঁকোশুঁকি করুক না কেন, ওরা তো আর “এ কলোনি”র মতো সমস্ত লজ্জাশরম খুইয়ে বসেনি।’
বোধ হয় এইখানে বনপাহাড়ি রিফ্র্যাক্টরি ওয়ার্কস-এর ভূগোলটা একটু বিশদভাবে বলা দরকার।
বি.আর. ডব্লুর চারটে কলোনি- এ, বি, সি আর ডি। এর প্রথম তিনটে ফ্যাক্টরি এলাকার ভেতরে, শেষটা বাইরে। ফ্যাক্টরিটা মাঝখানে রেখে তার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ‘এ কলোনি’। এখানে থাকেন কোম্পানির হর্তাকর্তারা। প্রকাণ্ড জমি নিয়ে চার কামরার এক-একখানা বাংলো। বাড়ির সঙ্গে বাড়ির কর্তারা মালী, চাকর, বাবুর্চি ইত্যাদিও কোম্পানির কাছ থেকে পেয়ে থাকেন। সেইসঙ্গে এয়ার কন্ডিশনার, ফ্রিজ, কুকিং রেঞ্জ, সোফাসেট, দরজা-জানলার পর্দা ইত্যাদি তো আছেই। এখানে মোট আটটা বাড়ি। এ ছাড়া এই এলাকায় আছে অফিসার্স ক্লাব, সুইমিং পুল ইত্যাদি।
বি কলোনি’ কারখানার উত্তর-পশ্চিম কোণে। দুটো কলোনির মধ্যে একটা মিনি গলফ কোর্স আর একটা রাইফেল রেঞ্জ বিভাজকের কাজ করছে। এই দুই কলোনির মধ্যে তফাত অনেক। এই কলোনির বাড়িগুলো দোতলা। এক-একটা বাড়িতে দু-কামরার চারটে ফ্ল্যাট। এক-একতলায় দুটো করে। এদের বাড়ির কর্তারা পান সিলিং ফ্যান, একটা ফ্রিজ আর একটা সোফাসেট। ব্যাস! এই কলোনির এলাকা ‘এ কলোনি’র এলাকার প্রায় সমান বা সামান্য কম হলেও, এখানে বাড়ি আছে কুড়িটি। এখানকার অধিবাসীদের কোম্পানির খাতায় নাম হল মিডল ম্যানেজমেন্ট’।
কারখানার অপর গোলার্ধে ‘সি কলোনি’। গম্ভীর ‘এ’ আর নার্ভাস বি’ কলোনি থেকে অনেক দূরে। এখানে থাকেন কোম্পানির ‘সুপারভাইজারি স্টাফ’। এখানকার বাড়িগুলো একতলা লম্বাটে। প্রতি বাড়িতে এক কামরার ছ-টা করে ফ্ল্যাট। সামনে একটা বেশ বড়ো ঘর, কোম্পানির সিভিল ডিপার্টমেন্টের ড্রইংয়ে বলা হয় সিটিং কাম বেডরুম। আর তার পেছনে প্রায় সমান মাপেরই আর একটা ঘরকে দেয়াল তুলে সমান তিনভাগে ভাগ করে পর পর বাথরুম, ডাইনিং আর কিচেন করা হয়েছে। খুব যে একটা আরামপ্রদ তা নয়, কিন্তু এটুকু দেওয়ার জন্যেই অনেকে কোম্পানিকে ধন্যবাদ দিয়ে থাকেন। আর তো কিছু এই জঙ্গলে পাওয়া যায় না। এরকম বাড়ি এখানে আছে পঞ্চাশটি। এ ছাড়াও আছে ব্যাচেলারদের প্রকাণ্ড হোস্টেল।
আরও আছে। এখানেই রয়েছে বনপাহাড়ির প্রাণ। আছে রিক্রিয়েশন ক্লাব, মহিলামহল, জাগৃতি যাত্রাসংঘ, বালক সংঘ, পূজা কমিটি, স্পোর্টস কমিটি, লাইব্রেরি, কোঅপারেটিভ স্টোর্স, উপজাতি উন্নয়ন সংস্থা, আবাহন (এঁরা প্রত্যেক বছর একটা নাটক করেন পুজোর সময়), শুচিস্মিত (এঁরা একটা সাহিত্য পত্রিকা বের করে থাকেন), শুক্লসীধু (এঁরা কেবল কাব্য আলোচনা করে থাকেন), তাসের দেশ (এঁরা বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত হয়ে অনবরত তাস খেলে থাকেন), অমর্ত অয়ন (এঁরা কী করেন কেউ জানে না) ইত্যাদি।
ভূগোল এ পর্যন্ত। এখন আবার মহিলামহলে ফিরে আসা যাক।
সরমা বললেন, “ঠিক বলেছিস টিয়া। ওরাও তো একসময় আমাদের সঙ্গেই ছিল। একসঙ্গে ওঠা-বসা করেছি তো। এখন না-হয় গড়ুড় পক্ষী হয়ে ‘বি কলোনি’তে গিয়ে বসেছে, কিন্তু আমাদের মায়ামমতা তো সব নষ্ট হয়ে যায়নি। আর এখানকার জন্য ওদের মন পোড়ে রে! এই কলোনির জীবনটা ওরা পাবে কোথায়? ওরা না ঘরকা, না ঘাটকা। সেকথা থাক। বাণী কিন্তু যা বললে, সেসব কথা শুনে মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেল। আরে, আমাদের এখানে কর্তারা আর কীই-বা করছেন। ‘বি কলোনিতে নাকি একেবারে মৌচাকে ঢিল! ভনভনানির ঠ্যালায় কান পাতা দায়।’ বলে সরমা হাত মুখ নেড়ে একাকার করলেন।
শুনে মহিলামহল একসঙ্গে কলরব করে উঠল, “কী হয়েছে সরমাদি? বাণীদি কী বলেছেন আপনাকে?
সরমা বললেন, “অবিশ্যি হবে নাই-বা কেন? আগুনের বেশি কাছে গিয়ে পড়লে আঁচ তো লাগবেই। তবে, সেই আঁচ লাগানোর জন্যে ‘বি কলোনির বাবুরা নাকি সবাই আজকাল মর্নিং আর ইভিনিং ওয়াক করতে শুরু করেছেন, কারণ ঠিক ওই সময়েই প্রহেলিকা রাইফেল রেঞ্জে আসে হাওয়া খেতে।
পরমেশ্বরী বলল, ‘এত দূর? ওরা সহ্য করছে কী করে?
“না-করে কী করবে বল? আর এ তো কিছুই নয়। শুনলুম, সেদিন নাকি বিদ্যুৎ বোসের সঙ্গে প্রার্থনার প্রচণ্ড ঝগড়া হয়ে গেছে। প্রার্থনা বাপের বাড়ি চলেই যেত, নেহাত…’
শুনে মহিলামহল হাহাকার করে উঠল। দোলা তো প্রায় কেঁদেই উঠল, ‘সে কী! এই যে শুনি, ওঁদের কুড়ি বছরের বিবাহিত জীবনে কক্ষণো নাকি ঝগড়া হয়নি? কেউ জোরে কথাই শোনেনি ওঁদের ঘর থেকে?’
“তাহলে আর বলছি কী! আরও আছে। জগন্নাথ মিত্তিরের বখাটে ছেলেটা, কী যেন নাম? সঞ্জয় বোধ হয়? সে নাকি বিষ্টু অধিকারীর মেয়ে যুথিকাকে গত সাত দিনে একটাও চিঠি লেখেনি।’
মহিলামহল একথায় বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়ে গেল। শোভা কোনোরকমে বলল, ‘এ যে অবিশ্বাস্য! গত চার বছর ধরে পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থেকেও সঞ্জয় ছোঁড়া প্রতিদিন দুটো করে প্রেমপত্র লিখে যূথিকাকে পাঠায় আর আজ কিনা সেটা বন্ধ হয়ে গেল? সে সব চিঠি পড়ে আমাদের সক্কলের মুখস্ত। ছোকরা বানানে একেবারে দিগ্গজ পণ্ডিত, যূথিকা হসসু না দীঘঘু আজও ঠিক করে উঠতে পারল না। কিন্তু বড়ো সুন্দর ভাবগুলো হত গো চিঠিগুলোয়।
‘আরও বলছি। মেজো ইঞ্জিনিয়ার অঞ্জন গুহ নাকি কবিতা লিখছে।’
এবার মহিলামহল মূর্ছা গেল। কে একজন, যেন কঁকিয়ে উঠল, অঞ্জন গুহ! ইঞ্জিনিয়ার অঞ্জন গুহ! হোঁতকা মোটা একলাফেঁড়ে বদরাগী অঞ্জন গুহ!’
টিয়া ভয়ানক চিন্তিত, গম্ভীর হয়ে বলল, ‘এসব কী হচ্ছে, সরমাদি? আমরা কি কিছুই করতে পারি না? প্রহেলিকা আমাদের মাথায় পা দিয়ে নেচে বেড়াবে, আর আমরা অসহায় হয়ে তাই পড়ে পড়ে সহ্য করব? পুরুষমানুষ দেখলেই তার ঘাড়ে গিয়ে পড়বে, বয়সের বাছবিচার নেই, সময়ের বাছবিচার নেই, এই রাক্ষুসিটাকে ঢিট করতে পারে, এমন কেউ নেই?’
২
সুনন্দা বিশ্বাস এতক্ষণ এককোণে চুপ করে বসেছিল। এখন চাপা গলায় বলে উঠল, “আমি যদি একবার প্রহেলিকাকে হাতে পেতুম তো একেবারে মজা বের করে ছেড়ে দিতুম।’
কথাটা সবারই কানে গেল, আর তৎক্ষণাৎ সবাই চুপ করে ভয়ানক গম্ভীর হয়ে গেল।
সুনন্দা বিশ্বাসের কথাটা সত্যি। প্রহেলিকাকে জব্দ করার অস্ত্র যদি কারোর থেকে থাকে বনপাহাড়িতে, তো সে আছে সুনন্দার। ভয়ংকর বিভীষিকা সেই অস্ত্র অবিশ্যি, যদি সেটা ঠিক মতো প্রয়োগ করা যায়।
অস্ত্র থাকলে কী হবে, সুনন্দা আসলে অত্যন্ত ভালো মেয়ে। সে কক্ষনো কারোর ক্ষতি করতে চায় না। এই যে অস্ত্রটার কথা বলা হল, এটা মোটেই তার অহংকারের বস্তু নয়, বরং এটা তার লজ্জা, দুর্ভাগ্য আর একান্ত গোপনীয় যন্ত্রণার ব্যাপার। তবে, বনপাহাড়িতে তো গোপনীয় বলে কিছু নেই, থাকা সম্ভবও নয়, কাজেই তার এই গুপ্তকথাও গোপন নেই মোটেই? প্রাকাশ্যে আলোচনা না করলেও, এ ইতিহাস বনপাহাড়িতে মোটামুটি সকলেই জানে।
৩
আজ থেকে বছর দুয়েক আগে মেকানিক্যাল ড্রাফটসম্যান সুকুমার বিশ্বাসের সঙ্গে বিয়ে হয়ে বনপাহাড়িতে এসেছিল সুনন্দা। দেখতে সে খুব একটা ভালো ছিল না, গায়ের রং-ও ছিল শ্যামলা। কিন্তু যৌবনের একটা আলাদা রং আছে; সেই রঙে সে রাঙানো ছিল। ওর দাদা, জলপাইগুড়ির ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের টাইপিস্ট, আই এ পাশ অগৌরী বোনের বিয়ে দিতে পেরে বেঁচে গিয়েছিলেন।
আর বেঁচে গিয়েছিল সুকুমার। সে সার্থকনামা ছিল না; বরং ওর বন্ধুরা যে ওকে আড়ালে মোটা বিশ্বাস বলে ডাকত— সেটাই ছিল ওর উপযুক্ত বর্ণনা। সেই মস্ত শরীরে তার খিদেগুলোও ছিল বড়ো মাপের। সে লাজুক প্রকৃতির মুখচোরা ছেলে ছিল বলে কারোর কাছেই কিছু চেয়ে বা কেড়ে নিতে পারত না, তাই সে সবসময়েই অল্পবিস্তর ক্ষুধার্ত হয়ে থাকত। সুনন্দা আসার পর এই দীর্ঘদিনের খিদে মেটানোর জন্যে সুকুমার উঠে-পড়ে লেগে গেল। সুনন্দার হাতের রান্না আর যৌবনের রং, দুটো মিলে তাকে একেবারে নেশাগ্রস্ত করে ফেলল। কারখানার সময়টুকু ছাড়া যখন তাকে দেখা যেত, তখন সে খাওয়ার টেবিলে আর যখন দেখা যেত না, তখন সে…। যাক, সেকথা।
সুনন্দার কিন্তু খিদে বেশি ছিল না। কিন্তু প্রথমত, সে শান্ত প্রকৃতির মেয়ে, আর দ্বিতীয়ত, বিয়ের পর নতুন জায়গায় এসে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাওয়ায়, সুকুমারের সমস্ত খিদেই নীরবে মেটাবার চেষ্টা করত। মাঝে মাঝে সুকুমারের কার্যকলাপ হয়তো অত্যাচারের পর্যায়েও উঠে যেত, কিন্তু তখনও ও তার কোনো প্রতিবাদ করত না এবং বোধ হয়, এইসব অত্যাচার সত্ত্বেও সে ধীরে ধীরে তার স্বামী ও সংসারটিকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল।
কিন্তু সৌভাগ্য সুনন্দার কপালে লেখা ছিল না। শরীরের খিদে মেটাতে ভোজন এবং অন্যান্য বিহিত অনুষ্ঠানে সুকুমার এতই অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে, তার রক্তে কোলেস্টেরল যেমন বেড়ে বিপদসীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল, তেমনই আভ্যন্তরিক শক্তি এসে ঠেকেছিল তলানিতে। কাজেই যা হবার হল। মাস দুয়েক আগে হৃদরোগে আক্রান্ত ওর দেহটাকে সহকর্মীরা যখন কোম্পানির ক্লিনিকে নিয়ে এল তখনই তা গতপ্রাণ। সুনন্দার সঙ্গে মৃত্যুর আগে কোনো কথাও বলে যেতে পারল না সুকুমার।
সুকুমারের তিনকুলে কেউ ছিল বলে শোনা যায়নি। আত্মীয় বলতে ছিল ওর সহকর্মীরাই। তারাই যথাসাধ্য শেষকৃত্য সম্পন্ন করল। তারা জলপাইগুড়িতেও খবর দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সুনন্দা বাধা দিয়েছিল। শান্ত প্রকৃতির হলেও সে বোকা মেয়ে ছিল না। ও ভেবে দেখল, এখনই খবর দিলে বউদি হয়তো দাদাকে এমন বুদ্ধি দেবে যে, ও-বাড়ির দরজাই হয়তো কোনোদিন খুলবে না। বরং হঠাৎ গিয়ে পড়লে দাদা একেবারে ফেলে দিতে পারবে না। আর গিয়ে পড়লেই তো হল না। দাদাই বা খাওয়াবে কী? তার চেয়ে যদি সুকুমারের প্রভিডেন্ড ফান্ড, গ্র্যাচুইটি আর লাইফ ইনস্যুরেন্সের টাকাগুলো নিয়ে ওঠা যায়, তাহলে অনেকটা সুবিধে হয়। বাবার সংসারেও সাহায্য হয়, বউদির কটকটানিও কম হয়। টাকা তো বড়ো কম নয়, সব মিলিয়ে প্রায় আটাশ হাজার টাকা। পোস্টঅফিসে রাখলে সুদ যা আসবে, তা যেকোনো সংসারেই লোভনীয়। কিন্তু এ টাকাগুলো তুলতে সময় লাগে। কাজেই, সে সময়টুকু কোম্পানির কোয়ার্টারে থাকবার অনুমতি চেয়ে দরখাস্ত করেছিল সুনন্দা। কোম্পানি সানন্দে সম্মতি দিয়েছিল।
৪
আর, এখান থেকেই হল সুনন্দার ভয়ংকর দুঃস্বপ্নময় যন্ত্রণার সূত্রপাত সুকুমারের মৃত্যুর পর প্রথম কয়েক রাত পাড়ার মেয়েরা পালা করে এসে সুনন্দার কাছে শুতো। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সুনন্দা অনুভব করতে পারল যে, এতে তাদের অসুবিধে হচ্ছে। না হওয়াই অস্বাভাবিক। কাজেই, একদিন সুনন্দা দৃঢ়ভাবে সবাইকে বলে দিল যে, কারোর ওর কাছে রাত্রে শোবার দরকার নেই। ‘সি কলোনি’র মহিলারা একথা মানতে প্রস্তুত ছিলেন না, কিন্তু প্রথমত, সুনন্দার দৃঢ়তার, আর দ্বিতীয়ত, ওর ঠিকে ঝি চিন্তা ওর কাছে রাত্রে শুতে রাজি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সম্মত হলেন।
প্রথম কয়েক রাত এ ব্যবস্থায় ভালোই কাটল। গোলমাল লাগল যেদিন চিন্তা “ডি কলোনি’তে যাত্রা শুনতে যেতে চাইল। ‘ডি কলোনি’র যাত্রা সারারাত হয়, কাজেই সুনন্দা মৃদু আপত্তি করেছিল। কিন্তু চিন্তার গোমড়া মুখ দেখে শেষপর্যন্ত অনুমতি দিয়েই ফেলল। কী আর হবে? একটা রাত তো! চোর-ডাকাতের ভয় নেই। আর যদিও সুকুমারের কোয়ার্টার কলোনির একপ্রান্তে জঙ্গলের ধারে, তা হলেও বা ভয় কী? রাত্রে দরজা না খুললেই হল। তা ছাড়া, চারদিকে বাড়ি। একটা হাঁক মারলে এক দল লোক জুটে যাবে। কাজেই, সুনন্দা আদৌ উদবিগ্ন না-হয়েই একলা রাত কাটাতে প্রস্তুত হল।
রাত এগারোটা নাগাদ ‘সি কলোনি’ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। পুজোর পর থেকেই এখানে ঠান্ডা পড়তে শুরু করে, আর তখন তো অগ্রহায়ণ মাস।
কাজেই, সুনন্দা সব জানলা বন্ধ করে একটা পুজো সংখ্যা নিয়ে শুয়ে পড়েছিল। এগারোটা বেজে গেলে পত্রিকাটা বন্ধ করে চোখ বন্ধ করল সুনন্দা। মাথার কাছে বেডসাইড ল্যাম্পটা জ্বালিয়েই রাখল। এই প্রথম জীবনে একা শুতে কীরকম অস্বস্তি হচ্ছিল, কিন্তু একটু পরেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল।
পৌনে বারোটা নাগাদ হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ, তীব্র আ-উ-উ-উ শব্দে চমকে জেগে উঠল সুনন্দা। একটা রক্ত-জল করা ভয়ার্ত জান্তব আর্তনাদ! সেই একান্ত নির্জন ঘরে সেই অমানুষিক শব্দ সুনন্দাকে প্রথমে একেবারে ভয়ে জড়ীভূত করে ফেলল। অবিশ্যি একটু পরেই বোঝা গেল আর্তনাদটা একটা কুকুরের। বোধ হয় বেচারির ঠান্ডা লেগেছে, তাই জানলার নীচে বসে চিৎকার করে গা গরম করে নিচ্ছে— এই ভেবে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে সুনন্দা আবার ঘুমোনোর জন্যে প্রস্তুত হল।
কিন্তু ঘুমোতে পারল না। ওর মনে হল, ঘরটার মধ্যে কোথায় যেন একটা পরিবর্তন এসেছে। বেডসাইড ল্যাম্পের ম্লান আলোটা ম্লানতর, সারা ঘরে একটা আবছা কুয়াশা যেন ওর দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। মনে হচ্ছে, যেন দেয়ালগুলো বহুদূরে সরে গেছে। ফলে, চারদিকে একটা নিরলম্ব শূন্যতা।
সুনন্দা ভাবল, জানলাটা নিশ্চয়ই ভালো করে বন্ধ করা হয়নি, সেজন্য ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে কুয়াশা ঢুকেছে। আর ঠিক তক্ষুনি, একটা প্রচণ্ড তীব্র শৈত্য ওর মুখের ওপর দিয়ে বয়ে চলে গেল! সেই স্পর্শে ওর সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে উঠল!
এইবার সুনন্দা মনে মনে হেসে উঠল। যাক, বোঝা গেল, জানলাটা সত্যিই বন্ধ করা হয়নি। তা না-হলে, এই ঠান্ডা হাওয়াটা আসবে কোত্থেকে? অতএব, জানলাটা অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার, এই ভেবে সুনন্দা তাড়াতাড়ি খাট থেকে উঠতে গেল। কিন্তু পারল না। সেই ভয়ানক শীতলটা ওর ঠোটের ওপর একটা ভারী অদৃশ্য পাথরের মতো চেপে ধরে ওকে খাট থেকে উঠতেই দিল না।
প্রচণ্ড বিস্ময়ে, আতঙ্কে সুনন্দার বাক্যরোধ হয়ে গেল। ও একটা চিৎকার পর্যন্ত করতে পারল না, কেবল গলার মধ্যে একটা গোঁ গোঁ করে শব্দ হতে লাগল। আর ক্রমশ সেই শীতস্পর্শ ওর সমস্ত শরীরটাকে আবৃত করে ফেলতে লাগল। কিছুক্ষণ বাদে সুনন্দার মনে হল, যেন ওর দেহটা একটা প্রকাণ্ড বরফের চাঁইয়ের নীচে চাপা পড়ে গেছে আর সেই চেপ্টে যাওয়া অবস্থায় ও একটা হিমশৈলের ওপরে চড়ে দুলতে দুলতে মেরুসমুদ্রের ওপর দিয়ে ভেসে চলেছে।
এই সমুদ্রযাত্রা যে কতক্ষণ চলেছিল, সুনন্দার সে জ্ঞান ছিল না । হঠাৎ একটা শব্দের অভিঘাতে সেই ভয়ংকর জগৎ থেকে এক ধাক্কায় ও বনপাহাড়ির ‘সি কলোনি’র বাস্তবতায় ফিরে এল।
কে যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে।
পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে প্রায় বিবস্ত্রা সুনন্দা যখন দরজা খুলে চিন্তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখন ওকে চিনে উঠতে চিন্তার বেশ সময় লেগেছিল।
৫
কিন্তু, ঘটনাটা কী ঘটেছিল, সেটা বুঝে উঠতে চিন্তার একটুও সময় লাগেনি। সেদিন দুপুরের মধ্যেই সে দৃঢ়ভাবে সবাইকে জানিয়ে দিল যে, তার পক্ষে রাত্রে নিজের বাড়ির বাইরে থাকা আর কিছুতেই সম্ভব নয়। কারণ হিসেবে সে যেসব কথা বলল, সেগুলো নিতান্তই অর্থহীন।
পাড়ার মেয়েরা সকলেই বললেন যে, সুনন্দা রাত্রে দুঃস্বপ্ন দেখেই ভয় পেয়েছিল, কিন্তু একথাও বললেন যে, তাঁদের প্রত্যেকের বাড়িতেই ভয়ানক কাজ পড়ে যাওয়ায়, তাঁদেরও কেউই রাত্রে সুনন্দার সঙ্গে শুতে পারছেন না। পাড়ার কয়েকটি নামজাদা ডাকাবুকো ছেলের থাকবার যথেষ্ট আগ্রহ দেখা গিয়েছিল, কিন্তু মা, কাকিমা বা বউদিদের রক্তচক্ষু দেখে তারাও আর এগোতে ভরসা পেল না। কারোর বাড়িতে সুনন্দার পক্ষে আশ্রয় নেওয়ার সম্ভাবনা যে, ছিল না, তা নয়। কিন্তু এ তো আর চোর-ডাকাত নয়, ওর বর্তমান সমস্যাটা কেউই ঘাড় পেতে নিতে উৎসাহ দেখালেন না। আর সুনন্দার মধ্যেও এমন একটা প্রচ্ছন্ন আভিজাত্যবোধ ছিল যে, কারোর পায়ে ধরে সাধাসাধি করার কথা ও চিন্তাই করতে পারত না। কাজেই, সকলের মনের কথা বুঝতে যখন আর ওর বাকি রইল না, তখন দৃঢ়কণ্ঠে বলল, ‘আমার সঙ্গে কারোর থাকবার দরকার নেই! আমি একাই থাকতে পারব।’
নিশ্চিন্ত হয়ে তখন সবাই ভীষণভাবে সহানুভূতি জানাতে লাগলেন। সুনন্দা বলল, ‘আপনারাই বা এত চিন্তিত হচ্ছেন কেন? আপনারা তো ঠিকই বলেছেন, সমস্তটাই আমার দুঃস্বপ্ন। ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়েছিলুম, এরপরে হয়তো আর এরকম হবেই না।’
সকলেই সে আশাই প্রকাশ করলেন বটে, কিন্তু সম্ভবত তা সফল হল না। প্রত্যেক রাত্রেই, অবধারিতভাবে আ-উ-উ-উ করে কুকুরের ভয়ার্ত আর্তনাদ সকলের পিলে চমক দিতে লাগল। সুনন্দার চোখের নীচে কালি গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগল, এমনকী কখনো কখনো গালে বা ঘাড়ে নীল নীল কালসিটেও দেখা যেতে লাগল।
তবুও সুনন্দা দৃঢ়বদ্ধ অধরোষ্ঠে সেই ঘর আঁকড়ে পড়ে রইল। ওর নৈশ অভিজ্ঞতার কথা কারোর সঙ্গে আলোচনা করা ও পছন্দ করত না, আর বিবেচক প্রতিবেশিনীরাও কখনো এ নিয়ে ওকে ঘাঁটাতেন না। ওঁরা বুঝেছিলেন, এই যন্ত্রণার চেয়েও বউদির বাক্যবাণকেই অনেক বড়ো যন্ত্রণা বলে মনে করছে সুনন্দা। কাজেই, যতদিন টাকাগুলো না আসছে, ততদিন দাঁতে দাঁত চেপে এই দুঃস্বপ্নের মধ্যেই থাকবে ও।
কেবল একদিন বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। সেদিন সরমা বলেছিলেন, ‘সুনন্দা, তুমি বিধবার বেশে আর থেকো না। দেখ, মরে গেলেই কি আর সব শেষ হয়ে যায়? যায় না। আর যে স্বামী, সে জীবনেও স্বামী, মরণেও স্বামী। কাজেই, এভাবে থেকে আর কাজ কী?’
সুনন্দা কেঁদে ফেলেছিল। বলেছিল, ‘না সরমাদি, আমি এমনিভাবেই থাকব। যতদিন বেঁচেছিল, ওর অনেক অত্যাচার সহ্য করেছি।
রাতের পর রাত ঘুমুতে দেয়নি। না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শেষপর্যন্ত আমার গ্যাসট্রাইটিস হয়ে গেল। আর এখনও তাই চলবে? আমি কিছুতেই এ বেশ ছাড়ব না। ও দেখুক, আমি এটা চাই না।
৬
এই হল সুনন্দার অস্ত্র। এই অস্ত্রের মুখে যদি একবার প্রহেলিকাকে ফেলে দেওয়া যায়, তখন দেখা যাবে কতখানি তার ক্ষমতা। প্রেমের খেলা খেলতে নাকি প্রহেলিকা কখনোই পেছপা নন, পাত্ৰ-অপাত্ৰ ভেদ নেই, যেকোনো চ্যালেঞ্জই গ্রহণ করতে উৎসুক। এখানে কীরকম খেলা খেলেন, সেটাই দেখবার। তবে, মানুষ ভাবে এক, হয় আর-এক। এ অস্ত্রের মুখে প্রহেলিকাকে ফেলবার সুযোগ কি আর কোনোদিন আসবে?
৭
কিন্তু অঘটন আজও ঘটে। খুব জোরসে প্রার্থনা করলে ভগবানের আসনও যে টলে, তা আর একবার প্রমাণ করলেন বি. আর. ডব্লুর মহিলামহল। সুনন্দার স্বগতোক্তিটা শোনা পর্যন্ত তাঁরা সবাই মিলে অ্যায়সা জোর প্রার্থনা শুরু করে দিলেন যে, শ্রীভগবান নড়েচড়ে না-বসে আর থাকতে পারলেন না।
৮
সেদিন বিকেল থেকে অকালে তুমুল বৃষ্টি নেমেছে। মেঘের অন্তরপথে অন্ধকার থেকেই অন্ধকারে দিন চলে গেছে। চিন্তা রোজ রান্নাবান্না করে রেখে রাত ন-টা নাগাদ বাড়ি যায়, কিন্তু সেদিন বৃষ্টি দেখে হয়তো তাড়াতাড়ি যেতে চাইবে ভেবে সাড়ে সাতটা নাগাদ মহিলামহল থেকে বাড়ির দিকে রওনা হল সুনন্দা। সঙ্গে পাশের ব্লকের দীপক হালদারের স্ত্ৰী প্ৰতিমা।
একই ছাতার তলায় ফিরছিল দু-জনে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই বৃষ্টিধারায় অনুজ্জ্বল স্ট্রিট লাইটের আলোয় নজরে পড়ল সুনন্দার, বাড়ির দরজার সামনে কে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে।
প্রতিমা শিউরে উঠে বলল, ‘ও মা গো!’
বলেই পেছন ফিরে দৌড় দেবার তালে ছিল। সুনন্দা ওর কাঁধ খামচে ধরে বলল, ‘দাঁড়া। মানুষ দেখছিস না, ছায়া পড়ছে?’
প্রতিমা আর দেখবে কী? চোখ তো বুজে ফেলেছে। এখন সুনন্দার কথায় সাহসে ভর করে চোখ খুলল। আর ঠিক তক্ষুনি, এক মুহূর্তের জন্যে হলেও, লক্ষ লক্ষ ফ্লুরোসেন্ট বাতির আলোয় চারদিক উদ্ভাসিত করে বিদ্যুৎ চমকালো। প্রতিমা আর সুনন্দা দু-জনেই একসঙ্গে গলার মধ্যে ঘড়ঘড় করে উঠল— ‘প্রহেলিকা!’
সুনন্দা প্রতিমার ঘাড় ছেড়ে দিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘তুই এক্ষুনি ছাতাটা নিয়ে মহিলামহলে গিয়ে সরমাদিকে খবরটা দে। একে আমি সামলাচ্ছি। আর আজ রাত্রে। তোদের বাড়িতে আমি থাকলে, কোনো অসুবিধে হবে না তো? আমি-না হয় রান্নাঘরে…
প্রতিমা মহিলামহলের দিকে দৌড় শুরু করতে করতে বলল, ‘তোকে আমাদের বড়ো খাটটা ছেড়ে দেব…’
৯
প্রতিমা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘বিশ্বাস করুন সরমাদি, আমি এক চুলও বাড়িয়ে বলছি না। একেবারে স্পষ্ট দেখেছি, ও প্রহেলিকা ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না। কী বিচ্ছিরি পোশাক। মাগো! দেখলে বমি আসে। একটা ইজেরের মতো খাকি হাফপ্যান্ট আর বুক-পকেটওলা হাতগুটোনো শার্ট। ভিজে একদম জুবুডুবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কী রূপ, কী রূপ! একলহমার জন্যে দেখলুম, চোখ ফেরানো যায় না। সিনেমার থেকেও ভালো দেখতে।’
টিয়া ভীষণ চিন্তিত হয়ে বলেন, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। কিন্তু প্রহেলিকা সুনন্দার বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে কেন? নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে। আমাদের একটু গিয়ে দেখা দরকার। সুনন্দার আবার কোনো বিপদ হবে না তো?”
সেনাপতি সরমা মাথা ঠান্ডা রেখে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। বললেন, “তুই আর হাসাসনি টিয়া। ও বাড়িতে সুনন্দার ক্ষতি করে, এমন লোক জন্মায়নি— জন্মাবেও না। এখন আমাদের কারোর গিয়ে কাজ নেই। সবাই মিলে গিয়ে পড়লে প্রহেলিকা ভড়কে যেতে পারে। আর, এই দুর্যেগে আমাদের কত্তারাও বোধ হয় কেউ টের পাননি। কাজেই, গোলমাল না-করে চুপচাপ থাক। প্রহেলিকা যে কারণেই এসে থাক না কেন, সুনন্দা ওকে ঠিক সামলে নেবে। আজ রাত ওকে সুনন্দার ঘরে কাটাতেই হবে।
পরমেশ্বরী হেসে বলল, ‘সরমাদি, আপনি না এতদিন “এ কলোনি”র মিসেসদের গালাগাল করতেন এই বলে যে, তারা স্বেচ্ছায় তাদের সোয়ামিদের প্রহেলিকার কোলে তুলে দেবার তাল খোঁজে। আর এই বেলা?’
সরমা চোখ টিপে বলল, ‘এ সোয়ামি সে সোয়ামি নয় রে, সে সোয়ামি নয়।’
১০
প্রহেলিকা বললেন, ‘এ বাড়িতে আপনি থাকেন? ভেতরে আলো জ্বলছে দেখে কড়া নাড়ছিলুম, কিন্তু কেউ দরজা খুলছিল না বলে ভাবছিলুম ফিরে যাব কি না।’
সুনন্দা বলল, ‘ভেতরে আমার ঝি টি আছে বোধ হয়। সম্ভবত ভয়ে দরজা খুলছে না।’ বলে চিন্তার নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করে দিল।
ভয়ে আধমরা চিন্তা দরজা খুলে সুনন্দার পাশে বিচিত্রবেশিনী প্রহেলিকাকে দেখে বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে দু-জনে ভেতরে ঢুকল।
সুনন্দা বলল, ‘আপনার কি আমার সঙ্গে কোনো প্রয়োজন আছে?’
কাতর মুখে প্রহেলিকা বললেন, ‘ভয়ানক বিপদে পড়ে আপনার কাছে আশ্রয়ের আশায় এসেছি।’
সুনন্দা অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘আমার কাছে? আশ্রয়ের আশায়?’
তেমনই কাতর মুখে প্রহেলিকা বললেন, ‘না, মানে ঠিক আপনার কাছেই, তা নয়। সামনেই এ বাড়িটা পড়ল কিনা, তাই কড়া নাড়লুম। আজ রাত্তিরটা যদি আমাকে একটু থাকতে দেন তো বড়ো ভালো হয়। আপনাদের কি জায়গার অভাব আছে?’
সুনন্দার হৃদপিণ্ডটা গলার কাছে এসে ধড়ফড় করছিল। তা সত্ত্বেও কণ্ঠস্বর যথাসাধ্য অবিচলিত রেখে বলল, ‘না, না, এখানে জায়গার কোনো অভাব নেই। আপনি স্বচ্ছন্দে থাকতে পারেন। কিন্তু, কী হয়েছে আপনার?’
‘দেখুন, আমার পায়ে মাঝে মাঝে একটা খিঁচ ধরে, তখন আমি আর হাঁটতে পারি না। বিশেষ করে বৃষ্টি-টিষ্টি পড়লে এটা হয়। বাতের মতো আর কী। আজ দুপুরে জঙ্গলে গিয়েছিলুম বনমোরগ শিকার করতে। হঠাৎ বৃষ্টি নেমে ভিজে গিয়ে সেই জিনিস হয়েছে। কোনোরকমে টেনে-হিঁচড়ে এ পর্যন্ত এসেছি, আর যেতে পারছি না।’
সুনন্দা ভয়ে ভয়ে বলল, ‘তাহলে “এ কলোনি”তে একটা খবর পাঠাই? আপনাকে গাড়ি করে এসে নিয়ে যাবে?”
প্রহেলিকা মাথা নেড়ে বললেন, ‘না, না, সেজোজামাইবাবু আজ নেই, কাল ফিরবেন। আর অন্য কারোর কাছ থেকে সাহায্যও নিতে চাই না। বোঝেনই তো অনেকেই সুযোগ নেবার চেষ্টা করে।’ বলে মুখ বিকৃত করলেন।
সুনন্দা নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, ‘তাহলে একটু গরম জল করে দিই? সেঁক দিলে আরাম হতে পারে।’
প্রবলবেগে মাথা নেড়ে প্রহেলিকা বললেন, ‘না, না, ওসব সেঁক-টেক দিলে বা ওষুধপত্র খেলে ব্যাথাটা আরও বেড়েই যায়। তা না-হলে সাত-আট ঘণ্টা পরে আপনি চলে যায়। আপনার কোনো চিন্তা নেই। আমি কাল সকালে নিজে নিজেই চলে যেতে পারব।
১১
বিচিত্র বিজাতীয় পোশাক ছেড়ে প্রহেলিকা সুনন্দার দেওয়া শাড়ি-জামা পরে খাওয়ার টেবিলে এসে বসলেন। আঁচলটা গায়ে জড়িয়ে বললেন, “কী সুন্দর শাড়িটা! এই গোলাপি রংটা আমার ভীষণ প্রিয়।’
সুনন্দা মৃদু হেসে বলল, ‘আমারও।’ কিন্তু যেকথা বলল না, তা হল, সুকুমার ওদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে কলকাতা থেকে শাড়িটা কিনে এনেছিল আর তারপর থেকে প্রায় প্রত্যেক রাত্রে ওকে এই শাড়িটা পরতে বাধ্য করত। গোলাপি রংটায় নাকি সুকুমারের চোখে নেশা লাগত।
প্রহেলিকা বললেন, ‘এ কী, আপনি তো কিছুই নিলেন না? আপনার ভাগটা সবই আমাকে দিয়ে দিলেন বুঝি?’
সুনন্দা বলল, ‘না। রাত্রে আমি বেশি খাই না। তা ছাড়া, আমি বিধবা মানুষ, উপোস করা আমার অভ্যেস আছে।’
‘কিন্তু আমি আপনার সামনে বসে খাব, আর আপনি…. ‘
‘আপনার কুণ্ঠিত হবার কোনো কারণ নেই। আজ রাত্রে আমার কিছু না খাবারই কথা। ওই ওপাশের কোয়ার্টারে দীপক হালদার মশায়ের বাড়িতে ওঁর গুরুদেব এসেছেন, আজ তিনি সারারাত ভাগবত পাঠ করবেন। আমার তা শুনতে যাবার কথা ছিল। বেশি খেলে আমি আবার রাত জাগতে পারি না। বড়ো কষ্ট হয়।’
‘কখন ভাগবত পাঠ শুরু হবে? আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো?’
‘পাঠ শুরু হতে দেরি আছে। তবে আজ আর যাই কী করে? আপনি এসেছেন, আপনাকে একা রেখে তো আর আমি যেতে পারি না। ভয়-টয় পেতে পারেন।’
আহত, দুঃখিত মুখে প্রহেলিকা বললেন, ‘আপনি আমার কথা ভেবে ভাগবত পাঠ শুনতে যেতে চাইছেন না? এ কি কখনো হতে পারে? একা থাকলে আমার ভয় পাওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। যে বাড়িতে আপনি একা থাকতে পারেন, সে বাড়িতে আমি ভয় পাব? না মিসেস বিশ্বাস, আপনি নিশ্চিন্ত মনে ভাগবত শুনতে যান। আমার জন্য একটুও চিন্তা করবেন না। রাত্রে একা থাকা আমার অভ্যেস আছে। লোকেশন শুটিংয়ে যখন যাই, তখন তো কত পোড়োবাড়িতে পর্যন্ত একা একঘরে কাটাতে হয়। আমাদের কি ভয় পেলে চলে।’
সুনন্দা মনে মনে বলল, কত তুমি একা একা রাত কাটাও, সে আমাদের জানা আছে। আর লোকেশন শুটিং? গেঁওঞ্ঝড়ে শুটিং করতে গেলে, ফিরে আসার পর গেঁওঞ্ঝড় স্টেটের কুমার বাইধরের সঙ্গে কুমাররানির এমন লাঠালাঠি লেগে গেল যে, কুমারসাহেব তিন মাস হাসপাতালে শুয়ে। আর ভূখাশালির দুর্গে শুটিং করে আসার পর, ভূখাশালির রাজা যিনি বিয়াল্লিশ বছর বয়েস পর্যন্ত অকৃতদার থেকে যাগযজ্ঞ আর শাস্ত্রপাঠ করে করে প্রায় সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছিলেন, সেই যে বিয়ে করতে শুরু করলেন, তাঁকে তখন থামায় কার সাধ্যি! ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশনের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, আজ ভূখাশালির রাজার হারেম ভারতবর্ষের বৃহত্তম, পৃথিবীতে দশ বৃহত্তম আর তৈলকূপের মালিক নন এমন লোকেদের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম। তবে হ্যাঁ, তোমার ভদ্রতাবোধ আছে বটে। তোমার এ গুণটার প্রশংসা করতেই হয়। ভাবতে খারাপ লাগছে যে, তোমার এই সদগুণটার জন্যেই তোমাকে চরম শিক্ষা পেতে হবে। কিন্তু উপায় নেই। এ সুযোগ ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
মুখে মিষ্টি হেসে বলল, ‘আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব, জানি না। চিন্তা চলে যাক, তারপরে না হয় আমি এগোব। সবই এখানে মজুত আছে। একটাই তো ঘর। আপনার কোনো সুবিধে হবে না। আর যদি ভয় পানই, তো জানলাটা খুলে একটা ডাক দেবেন। চারদিকে বাড়ি। অনেক লোক জুটে যাবে।’
তার সেই বিখ্যাত রহস্যময় হাসি হেসে প্রহেলিকা বললেন, ‘আপনার কোনো চিন্তা নেই মিসেস বিশ্বাস। আপনি নির্ভাবনায় ভাগবত পাঠ শুনতে যান।’
১২
বিভ্রান্ত, বিরক্ত, ব্যতিব্যস্ত দীপক হালদার ছাতা মাথায় গজর গজর করতে করতে ব্যাচেলার্স হোস্টেলের দিকে চলে গেলেন। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন বেশি এসে গেলে বা গিন্নির ওপর চটে গেলে অনেকেই ওখানে রাত্রিযাপন করে থাকেন, কারণ সবসময়েই এখানে চার-পাঁচটা বিছানা খালি থাকে— তা সে বিছানার মালিকের নাইট সিফটের জন্যেই হোক বা ব্রেক লিভের জন্যেই হোক।
একটু পরেই সুনন্দা এসে ঘরে ঢুকল। প্রচণ্ড উত্তেজিত প্রতিমা প্রায় ঘণ্টাখানেক লাফাল। তারপর রাত্রি এগারোটা নাগাদ দু-জনে একটা জানলা সামান্য খুলে দুটো চেয়ার পেতে সামনে বসল।
কিন্তু যে উদ্দেশ্যে বসা, সেটা ঠিক সফল হল না। এগারোটা থেকেই একের পর এক এমন বাজ পড়তে লাগল আর বৃষ্টিও এমন জোরে এল যে, তার ফলে আর সব শব্দই যেন চাপা পড়ে গেল। তবু, রাত্রি সওয়া এগারোটা নাগাদ দু-জনেই যেন একইসময়ে একটা ভয়ার্ত কুকুরের ক্ষীণ কাতর কান্নার শব্দ শুনতে পেল।
প্রতিমা প্রায় চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠল, ‘ওই, ওই শুনতে পেয়েছিস? উনি এসেছেন।’
সুনন্দা বলল, ‘মনে হল যেন। কিন্তু ভালো শুনতে পেলুম না।’
‘এই ঝড়জলে আবার কত ভালো শুনবি? আর কী রাতই করেছে! এমন রাতেই তো নাকি ওঁদের…’ বলে কথাটা শেষ না করে দু-হাত জোড় করে কপালে ঠেকাল। বিড়বিড় করে বলল, ‘রাম, রাম।’
১৩
সকাল ছ-টায় সুনন্দা এসে যখন দরজায় টোকা দিল, তখন ওর পেছনে ‘সি কলোনি’র মহিলামহল বৃন্দাবনে ঝাঁকি দর্শনের সময় দর্শনার্থী ভক্তদের মতো উদগ্রীব উৎকণ্ঠায় দাঁড়িয়ে।
একটু পরে প্রহেলিকা যখন এসে দরজা খুললেন, তখনও তাঁর দু-চোখ ঘুমঘোরে আচ্ছন্ন, মুখে একটি ক্ষীণ, পাণ্ডুর কিন্তু দৃষ্টিগোচর হাসি। সামনে সম্মিলিত মহিলাবৃন্দকে দেখে তাঁর চোখ সামান্য বিস্ফারিত হল বটে, কিন্তু সেই দুরাবগাহ দৃষ্টিতে কোনো চাঞ্চল্য দেখা দিল না।
সুনন্দা কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘রাত্রে ভালো ঘুম হয়েছিল তো?’ একটি অলস, মন্থর হাসি হেসে প্রহেলিকা ঘাড় কাত করলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ।’
সমবেত মহিলামহলের গলায় হতাশার চাপা গোঙানির শব্দটা পুরো মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ভিড়ের পেছনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ানোর আওয়াজ পাওয়া গেল।
চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট অর্ণব দাস ড্রেসিং গাউন পরা অবস্থাতেই মহিলাদের ভিড় ঠেলে হন্তদন্ত হয়ে এসে প্রহেলিকার হাত ধরলেন। চাপা গলায় গর্জন করে উঠলেন, ‘শিগগির চলে এসো। যেমন তুমি, তেমনি তোমার সেজদি। তোমাদের দুঃসাহসের আর বাড়াবাড়ির কোনো সীমা পরিসীমা নেই। উঃ, আর কোনোদিন যদি আসতে বলেছি তোমাকে! ইত্যাদি, ইত্যাদি।’ বলতে বলতে টানতে টানতে প্রহেলিকাকে নিয়ে গাড়িতে তুললেন।
অর্ণব দাসের কোনো কথাই অবশ্য প্রহেলিকার কানে গেল বলে মনে হল না। গাড়িতে ওঠার আগে তাঁর রহস্যময় অসাধারণ হাসিটি হেসে সুনন্দাকে বললেন, ‘ধন্যবাদ, মিসেস বিশ্বাস। অনেক, অনেক ধন্যবাদ।’
১৪
মুহামান মহিলামহলের মধ্যে সুনন্দাই প্রথম হেসে উঠল।
সরমা বললেন, ‘তুমি হাসছ সুনন্দা? আমার যে ভীষণ কান্না পাচ্ছে? প্রহেলিকাকে হাতে পেয়েও…’
সুনন্দা বলল, ‘প্রহেলিকার কথা আমি ভাবছিই না সরমাদি। আমি ভাবছি ওর কথা। ও বোধ হয় সত্যিই আমাকে ভালোবাসত। আজ বুঝলুম, ও শুধু আমাকেই চায়, শুধু আমাকে। আজ রাত্রে ও যখন আসবে, আমি আর ভয় পাব না, আর কাঠের মতো শক্ত হয়ে পড়ে থাকব না। প্রহেলিকাকে জব্দ করতে পারিনি হয়তো, কিন্তু প্রহেলিকা আমার কাছে হেরে গেছে সরমাদি। অন্তত একবার প্রহেলিকা হেরে গেছে! তবে দুঃখ এই, প্রহেলিকা ওর এই পরাজয়ের কথা বোধ হয় কোনোদিনই জানতে পারবে না।’
১৫
পরদিন ভোরবেলা চিন্তা গিয়ে সরমাকে ডাকল, “শিগগির একবার আসুন, মা। বউদি যেন কেমন করছে।’
সরমা তাড়াতাড়ি টিফিন করার ভারটা বড়োমেয়ের ওপর দিয়ে ব্যস্তসমস্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন। পাশের বাড়ি থেকে শোভা আর উলটোদিকের বাড়ি থেকে পরমেশ্বরীও তাঁর সঙ্গে যোগ দিল।
পরমেশ্বরী বলল, ‘কাল রাত্রে বোধ হয় একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। সুনন্দার হাসি দেখেই বুঝেছিলুম, ও একটু লাই দেবে। তা কি কখনো দিতে আছে? জ্যান্ত হলেই মাথায় চেপে বসে, আর এ তো…’
১৬
সুনন্দার সমস্ত বিছানা লণ্ডভণ্ড, তার ওপরে সুনন্দা উপুড় হয়ে পড়েছিল। শরীর অল্প অল্প কাঁপছে।
সরমা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কী হয়েছে, সুনন্দা?’
সুনন্দা চুপ।
শরীর ভালো আছে তো?’
সুনন্দা তখনও চুপ ।
‘কাল রাত্রে একটু বেশি ইয়ে করেছে কি? মানে, ব্যাথা ট্যাথা…’
সুনন্দার সমস্ত দেহ এই প্রশ্নে থরথর করে কেঁপে উঠল। বহুক্ষণ চেপে রাখা সুপ্ত-আবেগ প্রবল কান্না হয়ে গলা দিয়ে বেরিয়ে এল।
হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে সুনন্দা বলল, ‘না, না, না, সরমাদি! ও আর কাল রাত্রে আসেইনি। আর ওর আমাকে পছন্দ নয়। অসভ্য, লম্পট, বদমাশ, জলহস্তী, গরিলা, ভূত…!’
১৭
প্রচুর চা এবং প্রচুরতর কটুগন্ধ পাঁচমিনার সিগারেট ধ্বংসের পরেও অমর্তঅয়নের সদস্যরা বিতর্কে একমত হতে পারলেন না। বিতর্কের বিষয় ছিল, প্রেতের চরিত্র কী। সেই চরিত্র খোয়ানো যায় কিনা, জীবসমাজে জীবাত্মার স্থান কোথায় এবং আমরা যে অর্থে কাউকে লম্পট বলি, সেই অর্থে তাদেরও এই বিশেষণে ভূষিত করা যায় কিনা। এইসব প্রশ্নের যখন কিছুতেই মীমাংসা হল না, তখন তাঁরা হাল ছেড়ে দিয়ে ‘সময়ের বেগুনি মাছভাজা’ নামক একটি অ্যান্টিকাব্যনাটকের মহড়া দিতে গেলেন। অবশ্য ইতিপূর্বেই যে সমস্ত অশরীরী শ্রোতারা সেই প্রাসঙ্গিক বিতর্ক শুনতে সমবেত হয়েছিলেন, পাঁচমিনারের প্রবল ধোঁয়ায় ব্যাকুল হয়ে দিগবিদিকে প্রস্থান করতে বাধ্য হয়েছিলেন।