বিছন
কুরুডা ও হেসাডি গ্রামের উত্তরে জমি ঢেউখেলানো, একেবারে শুকনো রোদে জ্বলা। বৃষ্টির পরও এখানে ঘাস জন্মায় না। মাঝে মাঝে ফণীমনসার জঙ্গল ফণা তুলে থাকে, কয়েকটি নিমগাছ। এই দগ্ধ ও আন্দোলিত প্রান্তর, যেখানে মোষ চরতে দেখা যায় না, তারই মাঝামাঝি একটি ডোঙা—আকারের নাবাল জমি। জমিটি আধাবিঘা হবে। উঁচু পাড়ে উঠলে তবে জমিটি চোখে পড়ে এবং সবুজের সমারোহ দেখে ব্যাপারটি ভূতুড়ে লাগে।
আরও ভূতুড়ে লাগে, জমির মাঝে কাঠের খুঁটির ওপর মাচা ও ছাউনি দেওয়া ঘর দেখে। এই জমিতে ঘর খুব অস্বস্তিকর। দর্শকের চোখে। কেননা এ রকম ঘর থাকে ফসল পাহারা দিতে। এ জমিতে শুধু আনারস গাছের মতো সকণ্টক এলো গাছ। মোষেও খায় না। এলোর আঁশ থেকে পৃথিবীর অন্যত্র অত্যন্ত মজবুত দড়ি হয়। ভারতে এলো গাছ বুনো ঝোপ বলে গণ্য।
সব চেয়ে ভূতুড়ে দৃশ্যটি দেখা যায় সন্ধ্যার মুখে। কুরুডা গ্রামের দিক থেকে লম্বা লম্বা পা ফেলে একটি মানুষ এদিক পানে আসে। কাছে এলে দেখা যায় সে বুড়ো, চামড়া পাকানো—পাকানো, কোমরে কপনি, কোমর থেকে একটি কাঁথার বটুয়া ঝুলছে। হাতে ওর লাঠি থাকে ও এলো গাছের গায়ে এলোপাথাড়ি লাঠি মারতে মারতে ও মাচানের কাছে যায়। গাছের ডাল—কাটা, অত্যন্ত নড়বড়ে এক মই ধরে ও ওপরে ওঠে। চকমকি ঠুকে বিড়ি ধরায়, বসে থাকে মাচানে। প্রত্যহ। অন্ধকার ঘনালে কোনো এক সময়ে ও চাট্টি পেতে ঘুমিয়ে পড়ে প্রত্যহ।
প্রত্যহ কুরুডা গ্রামে দুলন গঞ্জুর বুড়ি স্ত্রী ওর উদ্দেশে গাল পাড়ে সে সময়ে। স্বাধিকারে কেননা বুড়োর নাম দুলন গঞ্জু। এই গাল পাড়ার ব্যাপারটি ওর ছেলে—বউ—নাতি— নাতনির পছন্দ নয়। কিন্তু কিছু করারও নেই ওদের। কিছু বললে বুড়ি ওদের গাল দেবে। আর ধাতুয়াকে মাইয়ার গাল দেবার, ঝগড়া করার ক্ষমতা তল্লাটে বিদিত। ঝগড়া কোঁদলে ওর দক্ষ ও পেশাদারি কোন্দল ক্ষমতাকে আহ্বান জানানো হয়। ও গিয়ে প্রতিপক্ষের ঊর্ধ্বস্তন সাতপুরুষের প্রথম পুরুষকে ধরে গাল দিতে শুরু করে। সাধারণত ও তৃতীয় পুরুষে পৌঁছলেই প্রতিপক্ষ রণে ভঙ্গ দেয়।
সবাই ওকে সমীহ করে। জরুরি অবস্থায় যখন তামাডিতে হাঙ্গামা বাধে, এ গ্রামেও পুলিশ এসেছিল জিজ্ঞেসবাদ করতে। ধাতুয়ার মা পুলিশকে আগুন ছিটিয়ে গাল দিতে দিতে গ্রাম ছাড়িয়ে ছাড়ে। পুলিশ যাদের খোঁজে এসেছিল তাদের একজন গোয়ালের মাচায় লুকিয়েছিল। ধাতুয়ার মা, ‘আয়, সব ঘর দেখ, আয় মড়াখেকোরা’ ব’লে এমন চেঁচায় যে চেঁচানিতেই প্রমাণ হয়, গ্রামটি একেবারে নিরাপদ।
তাতেও ক্ষান্ত হয় না ও, বলে, দেখ, এখন গ্রামে পাবি শুধু বুড়ো বুড়ি আর ছেলে। তাদের দেখবি? তাদের ধরবি?
পুলিশ চলে গেলে পর ধাতুয়ার মা পলাতক ছেলেটিকে ধুইয়ে দেয় বাক্যবাণে, বোতোমি! চিরকাল তোর আড়বুঝো বুদ্ধি! একটা বুড়ি বকরির তোর চেয়ে বেশি বুদ্ধি আছে। সে রাজপুত মহাজনের পায়ে টাঙি মেরেছিস, বেশ করেছিস। গলায় মারলে পাপ বিদেয় হত। তা পালাবি তো বনে? জঙ্গলে পালিয়ে থাকবি তো? গ্রামে ফেরে কোন বোকাটা? যা বনে যা!
ধাতুয়ার ক্ষমতাও নেই, সে আর লাটুয়া মাকে বলে, বাপকে গাল পেড় না।
তাহলেই মা জ্বলে উঠবে। বুড়ো এখন ছেলেদের বড়ো ভালোবাসার জন হয়েছে। মা বুড়ি বকরি, অকেজো। বাপের স্বরূপ জানবে ছেলেরা? মা জানে।
চার বছর বয়সে মায়ের বিয়ে হয়। চোদ্দোয় পড়তে মা ‘গওনা’য় ঘর করতে আসে। মা হাড়ে হাড়ে জানে ও বুড়োর স্বভাব। কাঁটাবুনো জমির জমিদার যে রাজ্য পাহারা দেয় একা, তাকে সাপে কাটলে বা বাঘে খেলে বিধবা হবে কে? ধাতুয়া আর লাটুয়া? তাদের মুরোদ আছে, ওই অফলা জমি দেখিয়ে বছর বছর বিছন আনার? সরকারি সার এনে বেচে দেবার? পহানের হাল—ভৈঁষা দেখিয়ে বছর বছর হাল—বলদের টাকা বের করার?
ছেলেরা চুপ করে যায়। মা ঘন ঘন হুঁকো টানে ও ‘আমি না মরলে তোরা আমার দাম বুঝবি না,’ এই মোক্ষম কথাটি বলে শুয়ে পড়ে। বউরা ফিসফিস করে ছেলেদের বলে, যাক, একটা দিন কাটাল।
মা অন্ধকারকে উদ্দেশ করে বলে, একদিন মরে থাকবে ওখানে। দেখতেও পাব না।
ছেলেরা জানে, এলো বন পাহারা দিতে মাচানে রাতে—থাকা ব্যাপারটি খুবই অবাস্তব, স্বাভাবিক নয়। কিন্তু বাবাকে ওরা স্বাভাবিক মানুষের হিসেবে ফেলে না। বাবা অত্যন্ত জটিল, অন্ধকার স্বভাবী, দুর্বোধ্য। গঞ্জুদের কাজ, মৃত পশুর চামড়া ছোলা। বাবা একবার, দুর্ধর্ষ রাজপুত মহাজন, দশটা বন্দুকের মালিক লছমন সিংয়ের কয়েকটা মোষ মেরে ফেলে সেঁকো বিষ দিয়ে। লছমন সিংয়ের গ্রাম তামাডিতে বসে। তারপর চামড়া ছুলে বেচে দিয়ে আসে। লছমন সিং স্বভাবতই নিজের শরিকী ভাই দৈতারি সিংকে সন্দেহ করে। ফলে যে গৃহযুদ্ধ লাগে, এখনো তা সম্পূর্ণ থামেনি।
তারপরেও বাবা টিকে আছে। তাতেই প্রমাণ হয়, বাবা অন্য মাপের মানুষ। বেঁচে থাকার কৌশল ভাবতে ভাবতে বাবা কোনোদিন ছেলে বা নাতির সঙ্গে কথা কইতে সময় পেল না।
মা—ও কম যায় না। মা—র হাড়পাকা শরীরে খাটবার ক্ষমতা এত বেশি, সাহস, জেদ, রাগ এত বেশি, যে মা—ও সাধারণ মাপের বাইরের মানুষ।
বাবা ও মাকে ওরা জীবনে বসে কথা কইতে দেখেনি। কিন্তু বাবা যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে, তখন মাকে ডেকে উঠোনে বসায়। হুঁকো ধরিয়ে দেয়, বলে, এ ধাতুয়াকে মা! একটা বুদ্ধি বাতলা। তোর বুদ্ধি গ্রামে সবাই নেয়, পুলিশ তোকে ভয় পায়।
—কি খচড়াই কথা ভাবছ? কাকে ধোঁকা দেবে না যখ দেবে?
মার কথায় চড়াসুর থাকে, ঝাঁজ থাকে না তখন। দুজনে নীচু গলায় সলা—পরামর্শ করে। এ রকম ঘটনা বছরে—দেড়বছরে একবার ঘটে।
অন্য সময়ে বাবা—মায়ের সঙ্গেও কথা বলে না। মা বলে, এর চেয়ে আমি বাপের বাড়ি চলে যাব।
বাবা ধূর্ত হেসে আস্তে বাতাসকে বলে, হ্যাঁ। টুরা গ্রামে তোর বাবার মস্ত মকান।
মায়ের বাপ—মা—ভাই কেউ নেই। মা তা জানে। তবু বলে আর বাবাকে ধূর্ত হেসে টিপ্পনী কাটবার সুযোগ দেয়।
এররকম বাপ আর মা ধাতুয়া ও লাটুয়ার, কিছু করবার নেই। পাহাড়টা কেন পশ্চিমে, কুরুডা নদী কেন বয়ে চলে, তা নিয়েও কিছু করার নেই যেমন। শনিচরী বলে, তোর বাবা আর মা দুজনেই পাগলা। বাবা তোর পুরো পাগল। পাগল না হলে, যখন থেকে জমি পেল, পাহারা দিচ্ছে, অথচ ধান বোনে না?
কথায় বলে পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা। ও জমিটা পাওনা জমি, কিন্তু ওতে চোদ্দো পয়সার ফয়দাও ওঠার নয়।
জমিটি উক্ত লছমন সিংয়ের। বেশ কয়েক বছর আগে সর্বোদয় কর্মীরা অঞ্চলটিতে জমি মালিকদের দোরে দোরে ঘুরতে থাকেন। তাদের বেলাও শনিচরী বলত, বাবু জাতের পাগল এরা। জমি মালিকদের মনে এরা আফসোস আনবে। জমি মালিক আপনা হতে বলবে, ইশ! আমার এত জমি, আর এদের মোটে জমি নেই? তখন তারা জমি নিয়ে দেবে। যেদিন দেবে সেদিন আমি চৌকিতে বসব, মাটঠা মাখন খাবো, দুবেলা ভাত রাঁধব।
কিন্তু জমি মালিকরা তখন স্বশ্রেণীর জমি মালিকদের হজিমত দেবার উদ্দেশ্যে নিষ্ফলা—পাথুরে—বন্ধ্যা জমি দিতে থাকল কিছু কিছু। পাঁচশো—সাতশো হাজার—দু—হাজার বিঘা আবাদি জমি সকলেরই আছে। ধান—ভুট্টা—গম—মাড়োয়া—সর্ষে—অড়হর সবাই চাষ করে। চীনেবাদামের চাষ এখন খুব লাভজনক। কিছু অনাবাদি জমি দিয়ে দিলে এসে যায় না কিছু।
জমি দেবার ব্যাপারটি সর্বার্থসাধক। জমি দেওয়া হল। সর্বোদয়ী নেতারা ও কর্মীরা ভারতভূমে উপহাসের পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের মুখ রইল। কুরুডা—বেলটের রাজপুত— কায়স্থ—জোতদার—মহাজনরা কি জম দিল না? তাহলে তাদের হৃদ—পরিবর্তন ঘটেছে? নিশ্চয়। ব্যস। সর্বোদয়ী মিশন সার্থক। তারপরই তারা মধ্যপ্রদেশ ডাকাতদের হৃদ—পরিবর্তন ঘটাতে যান। জমিমালিক ও ডাকাত দু—শ্রেণীর হৃদয়ে অনুশোচনা না আসা পর্যন্ত তাদের মিশন সম্পূর্ণ হয় না।
জমি দেবার ব্যাপারটি সর্বার্থসাধক। বাঁজা জমি বেরিয়ে গেল। গ্রহীতদের কিনে রাখা গেল। সরকারের কাছে নিজেদের খুঁটি আরও শক্ত হল। শেষপাতে রসগোল্লার মতো সর্বোপরি রইল নিজেকে করুণাময় জানার আনন্দ।
সে সময় দুলন গঞ্জু উক্ত জমিটি পায়। জমিটি সে নিতে চায়নি। কিন্তু লছমন সিংয়ের প্রতাপ অত্যন্ত বেশি। সে চোখ রাঙিয়ে বলল, একেই বলে ছোটোলোক। আজ আমার মনে ভালো ভাব এসেছে দিচ্ছি। ব্যাটা কাল কি আর ভালো থাকব?
দুলন বলল—হুজুর মা—বাপ।
তবে? নাবাল জমি, বর্ষায় জল হুড়হুড়িয়ে নামে, যা চষবি তাই হবে।
বর্ষায় পাড়ধোয়া রাঙা জল নামে ও থিতোয়। কিন্তু চতুর্দিকে যে বন্ধ্যা পাথর। সেই কাঁহা মুল্লুকে গিয়ে কে চষবে জমি? ফলনা জমি হলে লছমন সিং ফেলে রাখত? দুলন গিয়েছিল টাকা কর্জ করতে। জমি মালিক হয়ে ফিরে এল।
গ্রামের সবাই বলল—বড়োলোকের বদখেয়াল! ঘিয়ের পরোটা খেয়ে খেয়ে ওর মাথা গরম হয়েছে। কাল ভুলে যাবে।
যদি না ভোলে?
আরে ফেলে রাখবে। আরা—ছাপরায় সর্বোদয়ীদের কথায় এমনি জমিই সব দিয়েছে। যারা নিয়েছে, তারা আবার মহাজনকে জমি বেচে দিয়েছে, বাঁধা দিয়েছে। তুমিও দেবে।
ও জমি নেবে কে? মহাজন তো নিজের নাম কিনছে, ওটা ঘাড় থেকে নামাচ্ছে।
দুলন আরও কথা বলত। পহান ওকে ভীষণ ধমক দিল। অনেক সমস্যা আছে ওদের। দুলনের ঘাড়ে ওই বিদঘুটে জমি চাপাবার সমস্যা তার কাছে কিছু নয়।
দুলন গজর গজর করল।
ওর বউ বলল, ওঃ! জমি থেকে ফয়দা ওঠাবে কি করে, তাই ভাবছে। মুখে কত নাকারা! কোনোদিন কেউ হদিশ পেল না ওর।
এই জমি থেকে ফয়দা?
শনিচরী পরদিন সব শুনেমেলে বলল—কেন? এ ধাতুয়াকে মাইয়া! জমি পেলে ধাতুয়ার বাপ চলে যাবে তোহরি! বিড্ডি আফিসে! জমি চাষের খরচ, বিছন স—ব দিবে সরকার!
একথা শুনে তবে দুলনের মুখে হাসি ফুটল। চোখ দুটি স্বপ্নে ধূসর হয়ে গেল ওর।
কোনো কোনো রূপকথায় গাই গাভীন না হয়েও দুধ দিয়ে চলে। দুলনের মতো মানুষও বোঝেনি, আফলা জমিটি কীভাবে তার সংসার চালনায় সাহায্যে আসবে।
জমি একদিন দলিল—পত্তর হয়ে তার হাতে এল। গঞ্জুপাড়ায় দুটি টানা ঘর একই দালানের কোলে, সেই ঘরেই বাস, রান্নাবান্না, সব। এই ওর পৃথিবী। দালানের একপাশে আগড় দিয়ে স্বামী—স্ত্রী ঘুমোয়। এ হেন নিঃসম্বুলে লোক কোমরভাঙা হয়। চারদিকে ওর রাজপুত জোতদার ও মহাজন টাহাড়ের হনুমান মিশ্র ব্রাহ্মণ। তিনি এ অঞ্চলের বিশেষ প্রভাবী মানুষ। এ হেন জায়গায় বাস করে, সর্বদা উচ্চ বর্ণের শাসনে থেকে, দুলনের কোমর ভেঙে যাওয়াই স্বাভাবিক ছিল।
কিন্তু বাঁচবার তাগিদে ও, জোর খাটিয়ে নয়, ফিচলেমি করে সর্বদা প্রতি পরিস্থিতি থেকে ফায়দা তুলে নেয়। বলে নয়, কৌশলে ও ছলে ওকে প্রবল সব প্রতিপক্ষকে বোকা বানিয়ে চলতে হয় বলে ঘাঁৎ—ঘোঁৎ ওর নখদর্পণে।
ধাতুয়ার মা বলল, খুব বড়ো জমি, খুব ফলনা জমি, ফসল রাখতে গোলা করতে বল বাপকে, অ ধাতুয়া। লাটুয়া রে, তোরা বাপ জমিদার বন গেইল, জমিদার!
এ সব কথা বলল বটে, কিন্তু গ্রামের লোকেরা এবং ও, দু—দলই অপেক্ষা করতে থাকল। দুলন কী করে তা দেখার জন্যে।
দুলনের একক এবং সুকৌশলী লড়াই গ্রামের লোকেরা খুব তারিফের চোখে দেখে। লছমন সিংয়ের মোষের মামলা সবাই জানত, কেউ বলে দেয়নি। দৈতারি সিংয়ের বাড়িতে একটা কুমড়ো বেচে ও একবার দৈতারির বউ, একবার দৈতারির মার কাছে দাম নেয়। লছমন সিংয়ের বাড়ি থেকে যখন ছট পরবের কলা—মুলো—সবজি—ফল গোরুর গাড়িতে চাপিয়ে কুরুণ্ডা নদীর পারে আনা হয়, ও পাশে গিয়ে নিজেই সঙ্গে হাঁটে ও কাল্পনিক পাখি তাড়ায় চেঁচিয়ে এবং সমানে কিছু কিছু সরায়। গ্রামের লোককে ও জীবনেও কিছু দেয় না। তবু গ্রামবাসী ওকে খাতির করে। ওরা যা পারে না, ও তা পারে।
জমি পেতেই দুলন লছমন সিংয়ের হাঁটু ছুঁয়ে বলল, মালিক পরোয়ার! জমি দিলে তো চাষ করি কী করে? বি. ডি. আপিস থেকে কিছু পাব না। আহাহা, অমন জমি, পেয়েও কাজে লাগবে না।
কেন? বি. ডি. অফিস তোকে সব দেবে।
না হুজুর। ছোটো জাত।
ছোটো জাত তো একশোবার। মনে থাকে না তোদের, তাতেই জুতো—লাথি খাস। সে তো আছিসই। কিন্তু আমি যাকে জমি দিচ্ছি, তাকে মদত দেবে না? কে বি. ডি. বাবু?
কায়স্থ হুজুর। বলে রাজপুতরা গাঁওয়ার, মূর্খ। খুব রেডিও শোনে আর বাঁ—হাতে ধরে জল খায়, চা খায়।
রাম রাম! ছি ছি ছি।
দেখে এলাম হুজুর।
আমি লিখে দিচ্ছি।
লছমন সিং লেখাপড়ায় মহাপণ্ডিত। ভকিল রাখে ও। ভকিল দুলনের হাল বলদ কেনার দফা—দফা ঋণ, সার ও বিছন পাবার ন্যায্যতা বিষয়ে কায়েথী হিন্দিতে অত্যন্ত জবরদন্ত এক আর্জি লিখে দিল। বি. ডি. ও. তোহরিতে থাকতে পারেন,—তোহরি, লছমনের গ্রাম তামাড়ি থেকে দূরেও বটে, কিন্তু তাঁর ধড়ে মাথা একটি। লছমনের সঙ্গে ও হনুমান মিশ্রের সঙ্গে কোনো ঠোকাঠুকি না করতে তাঁকে বলেছেন স্বয়ং এস. ডি. ও.।
তখনি তিনি মেনে নিলেন সব। নেংটি পরা দুলনকে অত্যন্ত নরম গলায় বোঝালেন, বিছন দুলন পাবে, সারও পাবে। হাল—বলদের টাকা একবারে পাবে না। খানিক টাকা বায়না করে হাল বলদ এনে দেখাতে পারলে বাকি টাকা পাবে।
দুলন গ্রামে এসে পহানকে বলল, সরকার কানুন করে, কিন্তু বুঝে না কিছু। হাল—বলদ লোকে টাকা দিয়ে কেনে। দফায় দফায় টাকা নিয়ে বেচে কে? তোমার হাল বলদ দাও।
সেই হাল বলদ দেখিয়ে দুলন টাকা নিয়েছে। এক বছর অন্তর অন্তর। যেবার টাকা নেয়, সেবারই বলে মরে গেল হুজুর।
টাকা নেয়। সার নিয়ে তোহরিতেই বেচে দিয়ে আসে। বিছনের বোরা কাঁধে বয়ে আনে।
বিছন ও খায়।
বিছনের ধান সিজিয়ে চাল করা চারটিখানি কথা নয়। তাই করে ও। প্রথমবারই বউ বলেছিল, এত বিছন! কত জমি তোমার?
সে জমি মাপলে মাপা যায় না।
সে কি?
আমাদের পেট। খিদের কি মাপ হয়? পেটের জমিন বাড়তে থাকে! হুই আঁদলা জমিতে যেয়ে ধান বুনব? পাগল তুই?
কী করবে?
সিজা, ভান, খাব।
বিছন খেয়ে মরবে?
এততে মরলাম না। আকালে ইঁদুর খেলাম কত? বিছন খেয়ে মরব? মরলে জানব, ধানের ভাত খেয়ে মরেছি। স্বর্গে যাব।
একবার বিছনের ভাত খেতেই ধাতুয়ার মা বুঝল, এর চেয়ে মিষ্টি জিনিস সে জীবনে খায়নি।
সুখাদ্যটির কথা সে গ্রামে সগর্বে বলে বেড়াল। কে এমন সধবা আছে গ্রামে, যে বলতে পারে তার মরদ কত বুদ্ধি ধরে, কত কৌশলে গোরমেনকে বোখা বানিয়ে বিছনের ধানের ভাত খাওয়ায় পরিবারকে?
গ্রামের সবাই খুব খুশি হল। গোরমেন তাদের কোনোদিন কোনো দেখভাল করে না। গোরমেনের বি. ডি. ও. তাদের কোনোকালে চাষে মদত দেয় না। গোরমেনের বুনিয়াদি স্কুলে তাদের ছেলেরা কখনো ঢুকতে পায় না। লছমন সিং বা দৈতারি সিং ওদের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে পেট—ভাতায় বা চার আনা রোজে ফসল কাটিয়ে নেয়। এ নিয়ে যথেষ্ট টেনশন চলছে। কেননা পাশের ব্লকের গঞ্জু—দুসাদ—ধোবিরা লাথ ও ভাত দুই পাচ্ছে আট আনা রোজ। পঁচিশ পয়সা বাড়াবার জন্যে গ্রামবাসীরা খুব আগ্রহী। সব জেনেও হাঙ্গামা বাধলে এসডিও পুলিশ নিয়ে এসে কিষাণদেরই ধরে নিয়ে যান। লছমন সিং বা দৈতারিকে কিছু বলেন না।
গোরমেন লছমন সিংয়ের। গোরমেন লছমন সিং দৈতারি সিং হনুমান মিশ্রের। এ হেন গোরমেনকে বোকা বানায় যে, সে যদি দুলন গঞ্জু হয়, তাহলে তাকে গ্রামের লোকে তারিফ করবে বইকি।
জমিটি কামধেনুর মতো দুলনকে বছরে শ—ছয়েক টাকা দিতে থাকল। কিন্তু তখনও দুলন ঘরেই ঘুমোত। দাওয়ার কোণে, মাচানে, ধাতুয়ার মার পাশে। ধাতুয়ার মার কাশি ও হাঁপানি আছে। মাচানের নীচে রামছাগল বেঁধে রেখে ঘুমোয়। দুটো ঘরে দু—ছেলে। বউ ছেলেপুলে নিয়ে। গম—মাড়োয়া—ভুট্টার বোরা, হাঁড়ি—কলসি, জ্বালানি কাঠ, সবই দুই ঘরে। ও জমির আয়ে সব সময়টা চলে না। তখন বাপ ও দুই ছেলে জন খাটে বনে যায় মেটে আলুর খোঁজে, তোহরি গিয়ে মাল টানে। মিশ্রজির ফলবাগিচায় যায়। সবার মতো।
এরই মধ্যে চলে এল তামাডির করণ দুসাদ। বহোৎ শানদার আদমি। লছমনের খেতে মজুরি খাটত। মালিক পরোয়ারের সঙ্গে মজুরির লঢ়াই করকে য়ো জেহেল চলা গিয়া। জেলে, হাজারীবাগ জেলে ও বিহারের আরও আরও বন্দিদের সঙ্গ পায়।
তারা ওকে ”দুসাদ” বলে ঘেন্না করে নি। সম্মান করেছে লড়াকু বলে। অবাক হয়ে জেনেছে, কোন সংগঠনের মদতে নয়, অসাগর শোষণে ঘুরে দাঁড়িয়ে ওরা দুশো কিষাণ, দুর্ধর্ষ লছমন সিংয়ের পাকা গম জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তারা ওকে বোঝায়, এইভাবে লড়াই গড়ে ওঠাই সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। লড়াইয়ের প্রয়োজনে লড়াই গঠন। সেজন্যে নিজের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে লড়াই করা।
যারা বলে, তারা নির্যাতিত হত, মাঝে মাঝে অনশন করত। তখন কর্তৃপক্ষ তাদের পেটাত। মেরে—মেরে মেরে ফেলত কতজনকে। তবু, তারপরেও ওরা করণকে বলত লড়াকু, ঠিক কাজ করেছ তুমি, কখনো লড়তে ভুল না।
ফলে করণ দুসাদের মনের স্তরে প্রচুর ভাঙচুর হয়। যে করণ, লছমন সিং অবস্থা মরিয়া করে তুললে তবে লড়াইয়ের কথা ভেবেছিল সেই করণ, বেরিয়ে আসার পর সকলকে বলল, লড়াইয়ের পরিস্থিতি আজও আছে। ও অবস্থা সঙিন করবে, তখন রুখে দাঁড়াব, তখন গুলি খাব, তখন জেলে যাব কেন? আগে থেকেই জোট বাঁধব। সব বলে কয়ে নেব ওর সঙ্গে। ফসল কাটার সময়ে পুলিশকে থাকতে বলব। আমাদের দাবি তো খুব সামান্য। আমরা হরিজন আর আদিবাসী। এই জংলা জায়গায় আমরা ভালো মজুরি পাব না। আট আনার লড়াইটাই করব। মেয়ে—মরদ—ছোটো ছেলেমেয়ে সকলকে আট আনা করে দাও। চার আনা ও দিচ্ছে। বাড়তি চার আনার জন্যে এ আমাদের ”পঁচিশ পয়সার লড়াই।”
খবরটি শুনেই দুলন করণকে কুরুডায় ডাকে। সন্দেহী মন ওর। কথা বলে লোকজন থেকে দূরে ওর সেই জমির পাড়ে বসে। করণ দুসাদ বয়সে প্রৌঢ়, রোগা, ছোটোখাটো মানুষ। হাজারীবাগে বন্দিদের সঙ্গে দু—বছর থাকার ফলে নতুন—অর্জিত ব্যক্তিত্ব তার।
জাত—পাঁত সব ঝুটা। বরামতন ঔর বড়া আদমি কো বনা হুয়া য়ো ছুতাছুত।
এ কথা বলে ও দুলনকে ঘাবড়ে দেয়। দুলন মনে মনে পলকের জন্যে ঘাবড়ায়। তারপর, ঘাগু লোক তো! বলে, ও তো লিখাই—পড়াই বাবুরা বলেই থাকে। এখন কাজের কথা শোন। ও লছমন সিং আর বি.ডি.ও আর এস.ডি.ও. আর দারোগা চার গেলাসের ইয়ার। আগে তুই তোহরির আদিবাসী দফতর আর হরিজন সেবা সঙ্ঘে যা। ওদের জানিয়ে রাখ। ওরাও তোর সঙ্গে থানা—এস.ডি.এ. করুক।
কেন? আমরা কি কমজোরী?
বহোৎ কমজোরী করণ। ভুল করিস না। সরকারি সবাই লছমনকে মদৎ দেবে। সে বন্দুক ফুটালে দেখবে না, তোরা লাঠি উঠালে ধরবে। হরিজন সেবা সঙ্কে মদনলালজী আছে। সাচাই আদমি। সবাই চেনে। সঙ্গে রাখ।
করণ কথাটি মানে। মদনলালের ভোটের পুল বেজায় জোরদার। অতএব এস.ডি.ও. এবং দারোগা আগে লছমনের সঙ্গে গোপন বৈঠক সারেন। পরে মদনলালের কথায় রাজি হন।
অত্যন্ত নির্বিঘ্নে ভুট্টা কাটা ও তোলা হল। আট আনা মজুরি মেলে। করণ দুসাদ হিরো বনে যায়। রূপকথা সত্যি হয়।
তারপর লছমন হঠাৎ দুলনকে বলে, কাল জমিতে থাকবি। কেউ যদি জানে আমি এ কথা বলেছি, লাশ ফেলে দেব তোর।
উক্ত কাল যখন রাত পোহালে আজ হয় সেদিন এস.ডি.ও. যান রাঁচি, দারোগা যান ডাকাত ধরতে সুদূর পুরুডিহা।
বিকেল না ফুরোতে, অস্ত রবির রশ্মি আভায় লছমন সিং অন্যান্য রাজপুত জ্ঞাতিভাইদের নিয়ে তামাডির দুসাদ পাড়া আক্রমণ করে।
আগুন জ্বলে, মানুষ পোড়ে, ঘর ভাঙে।
রাতে দুলনের সামনে নবোদিত চন্দ্রমা এক অপার্থিব, নীরব চলচ্চিত্র মেলে ধরে। ঘোড়ার পিঠে লছমন সিং। দুটি ঘোড়া পাশাপাশি রেখে, পিঠে মাচান ফেলে একাধিক লাশ। দশজন অনুচর লছমনের।
করণ ও তার নির্বিরোধী ভাই বুলাকির লাশ, লছমনের বন্দুকের নির্দেশে দুলন জমিতে পোঁতে। সভয়ে, মাথা নীচু করে কোদালে কুপিয়ে গভীর গর্ত খুঁড়ে। লছমন পাড়ে দাঁড়িয়ে তত্ত্বাবধান করে ও পান চিবোয়। তারপর বলে, একটা কথা বলবি তো কুত্তা, করণ দুসাদ বানিয়ে ছেড়ে দেব। শিয়াল লাকড়াকে বিশ্বাস নেই, লাশ উঠাবে। কালই এখানে মাচা বাঁধবি। রাতে থাকবি। করণ যে আগুন জ্বালিয়েছে, আমি রাজপুতের বাচ্চা, এখন থেকে লাশ পড়বে। দুলন মাথা নাড়ে। বেঁচে থাকার তাগিদে ও বলে, তাই হবে।
পরদিন পুলিশ আসে। খুবই হইচই হয়। শেষে জানা যায়, ঘটনাকালে করণ ছিল না ওখানে রিপোর্টাররা কিছুতেই ”এ ট্রু হরিজন স্টোরি” লিখতে সক্ষম হন না। লছমনের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলে না। অগ্নিসংযোগের জন্যে লছমনের এক অনুচরের কিছুদিন জেল হয়। সরকার থেকে গৃহহারা পরিবারগুলির গৃহনির্মাণে যৎসামান্য আর্থিক সাহায্য আসে।
সেই থেকে দুলন জমিতে থাকে। প্রথমে এটি খ্যাপামি বলে গণ্য হয় ও ছেলেরা ওকে নিরস্ত করতে চেষ্টা করে। কোনো কথাই, এই স্টেজে দুলনের কানে যায় না। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলে ও রক্ত চোখে চেয়ে থাকে ঠোঁট এঁটে। তারপর মাথা নেড়ে হাতের খেঁটে তুলে বলে, রাত না উঠাস ধাতুয়া! মাথা ভেঙে দেব তোর।
বিরাট বিস্ফোরণ ঘটে ওর মনের স্তরে ধস নামে, স্তরবদল ঘটে যায়। সোজা, এত সোজা সব লছমনদের কাছে? দুলন জানত, মানুষের জন্য যেমন বহু আচারে—নিয়মে জড়িত, মৃত্যুও তাই। কিন্তু লছমন সিং এই সব প্রাচীন ও সম্মানী রীতিনীতি কত নগণ্য, তাই প্রমাণ করে দিল। কত সোজা! ঘোড়ার পিঠে দুটি লাশ, এবং নিশ্চয় তামাডির নাকের ডগা দিয়ে অসীম ঔদ্ধত্যে লাশ আনা হয়। লছমন জানে, লাশ আনার ব্যাপার লুকোবার দরকার নেই। যারা দেখল, তারা কিছুই বলবে না। তারা লছমনের নীরব ও তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে পরোয়ানা পড়েছে, যো মু খোলে গা, য়ো ভি লাশ বনে গা। এরকম আগেও ঘটেছে। আবারও ঘটবে। আকাশে আগুন ও আর্ত মরণোম্মুখদের চিৎকার ছুঁড়ে দিয়ে মাঝে মাঝে হরিজন বা অছুতদের বুঝিয়ে দিতে হয় সরকারি কানুন—অফিসার নিয়োগ ও সংবিধানে ঘোষণা কিছু নয়। রাজপুত রাজপুতই থাকে, ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণই থাকে, দুসাদ—চামারা—গঞ্জু—ধোবি, এরা থাকে ব্রাহ্মণ—কায়স্থ—রাজপুত—ভুঁইহার—কুর্মিদের নীচে। রাজপুত বা ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ বা ভুঁইহার বা যাদব বা কুর্মি, স্থানবিশেষে হরিজনদের মতোই, হরিজনদের চেয়েও গরিব হতে পারে। কিন্তু জাতের কারণে তাদেরকে জ্বলন্ত আগুনে ছুঁড়ে ফেলা হয় না। খাণ্ডবকানন দহনে কিছু অরণ্যবাসী ব্রাত্য কৃষ্ণাঙ্গকে ভক্ষণ থেকে অগ্নিদেব অছুত নরমাংসে আজও আসক্ত।
সমগ্র ব্যাপারটি দুলনের মনে বিপর্যয় ঘটায়। এর আগে ওর ছিল সারফেস ধূর্তামি। টিকে থাকার জন্য! এখন ওকে মনের নীচে দুটি শবদেহ লুকিয়ে রাখতে হয়। শবদেহগুলি মনের নীচে পচতে থাকে। জমিতে মাটির নীচে প্রোথিত করণ ও বুলাকি মাংসের ওজন হারিয়ে ক্রমে নির্ভার হয়। দুলনের মনোজগতে মৃতদেহের ওজন বাড়ে। দুলনের চেহারা বিবর্ণ হয়, মুখের কথা আরও কমে। কাউকে বলতে পারে না ও। গুরুভার বহন করছে নিয়ত। বেঁধে মার খেতে হয়। মুখ খুললে কুরুডার দুসাদপট্টিতেও আগুন জ্বলবে, বাতাসে ছাই উড়বে, পোড়া মাংসের দুর্গন্ধ।
ক্রমে দিন যায়। করণ ও বুলাকি, দুটি মানুষ যে নিখোঁজ হয়ে গেল, তা সবাই বাধ্য হয়ে ভুলে যায়। তোহরি থেকে এদিকে বরুডিহা, ওদিকে ফুলঝর অবধি রেলপথ বসে। আদিবাসী ও হরিজন বিষয়ে অত্যাচার ঘটলে সে বিষয়ে তখনি তদন্ত ও ব্যবস্থা করার জন্য, কেস তৈরি করে আদালতে পেশ করার জন্য থানা ও এস. ডি. ও.—কে অঞ্চল বুঝে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়। ঢাই গ্রামে পঞ্চায়েতি কুয়ো খোঁড়া হয়। ঢাই নিম্নবর্ণ ও আদিবাসী গ্রাম। অঞ্চলটি এইভাবে আধুনিক সময়ের কাছে আসতে চেষ্টা করে খোঁড়া পায়ে।
ফলে লছমন সিংহের প্রতাপ আরও বাড়ে। সরকারি নির্দেশ উড়িয়ে দিয়ে সে খেতমজদুরদের চল্লিশ পয়সা মজুরি দেয়, হনুমান মিশ্রের মন্দিরে শিবের মাথার সোনার গোখরো সাপ গড়িয়ে দেয়। বি.ডি.ও. কে স্কুটার, দারোগাকে ট্রানজিস্টার কিনে দেয় এবং করণ ও বুলাকির নিজস্ব দেড় বিঘা জমি পুরোনো ঋণের দায়ে দখল করে।
এ ব্যবস্থায় সবাই সন্তুষ্ট থাকে। কিন্তু সহসা খেতমজদুর বিষয়ে সরকারি সার্কুলার আসে এবং আসেন জনৈক নতুন এস.ডি.ও.। ইনি বামপন্থী বলে অভিযুক্ত এবং এঁকে অন্তিম বাঁশ দিয়ে সাসপেনড করাই যেহেতু প্রশাসনের শুভেচ্ছা, সেহেতু এঁকে ফসল কাটার দেড় মাস আগে তোহরিতে বদলি করা হয়।
তোহরি অঞ্চলটির কৃষি—শ্রমিক শ্রেণী হরিজন ও আদিবাসী। জমি মালিক জোতদার ও মহাজন উচ্চবর্ণ। অঞ্চলটির বিশেষ সমস্যা হল মালিক বিষয়ে খেতমজদুরদের গভীর অবিশ্বাস। সেই কারণেই কৃষিতে প্রার্থিত উন্নতি ঘটছে না এবং মাথাপিছু আয় বাড়ছে না। আয়—ব্যয়—স্বাস্থ্য—শিক্ষা সমাজচেতনা সবই থেকে যাচ্ছে সাব—নর্মাল স্তরে। এখানে প্রয়োজন আলোকপ্রাপ্ত, দরদি, মানবিক হৃদয় অফিসার।
এস.ডি.ও. বোঝেন, এভাবে তাঁকে বাম্বু দেওয়া হল। তিনি শ্বশুরকে বলেন, আপনার জিত হল। ব্যাঙ্কের কাজটা দেখুন। এগ্রো—ইকনমিকসের ছাত্র, পেয়ে যেতে পারি। নইলে যেখানে পাঠাচ্ছে, সেখানে থাকলে আপনার একমাত্র মেয়ে বিধবা হবেই হবে।
বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করে আসেন বলেই এস. ডি. ও. অত্যুৎসাহে খেতমজদুরদের জানান, তোমরা পাঁচ টাকা আশি পয়সা মজুরি পাবার অধিকারী। উক্ত মর্মে তিনি জোতদারদেরও জানান। লছমন সিংয়ের জমি—ফসল ও খেতমজদুর, সুবিস্তৃত তামাডি—বুরুডিহা—কুরুডা—হেসাড়ি—চামা—চাই সকল গ্রামে। বুরুডিহার গ্রাম—মোড়লের ছেলে, আসরফি মাহাতো বলে, করণের কথা মনে আছে। তিন বছরেও ভুলি নাই। কিন্তু এস. ডি. ও. এখন ভালো লোক। তবে কেন মোরা চল্লিশ পয়সা পেট—ভাতায় ফসল কাটি? পাঁচ টাকা আশি পয়সা! পেটভাতা চাই না, পাঁচ টাকা চল্লিশ দিয়ে পুরা মজুরি দিক।
একদা করণকে যেমন, আজ আসরফিকেও তেমনি যত্নে বোঝায় দুলন। বলে, করণ চেঁচাল বিস্তর। তাতে তামাডির দুসাদপট্টি জ্বলে গেল।
করণ কোথা? বুলাকি কোথা?
কে জানে?
বেঁচে নাই।
এ কথা বলিস কেন?
মেরে জঙ্গলে গাঢায় ফেলে দিয়েছে।
জানি না। তবে হাকিম সামনে রেখে কাজ করিস।
করব।
হাকিম যেন পরের মদতটা দেয়। সেবার মজুরি দিল। পরে আগুন জ্বালাল।
বলব।
প্রতি অঞ্চলের প্রতি সংঘর্ষ আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য প্যাটার্নিস্টিক। লছমন সিং বলে, অত দেব না। দু—টাকা নাও, জল খাই।
মজুরি দিন হুজুর পরোয়ার।
দেব?
লছমন সিংয়ের চোখ অত্যন্ত নরম ও দরদি হয়ে উঠল। সে বলল, ভেবে দেখি! তোমরাও ভাব। দেওয়াটা যে উচিত, তা তো গাধাতেও বোঝে। তবে কি জান? তুমি তো এস. ডি. ও.—র কথা বলছ? তাঁকে বোল, এ তল্লাটে মখখন সিং, দৈতারি সিং, রামলগন সিং, হুজুরী প্রসাদ মাহাতো কেউ দিচ্ছে না। আমি একা মার খাব? আসরফি ভীরু অথচ জেদি হেসে বলল, মার খাবেন হুজুর? গম পেষাই কল আপনার, আপনার মকান কত দূর থেকে দেখা যায়, আপনি মার খাবেন?
হাসিটিকে লছমন সিং ধরে নিল উদ্ধত তাচ্ছিল্য বলে এবং বলল যে দু—টাকার কথা বললাম তো আমরা বলে—কয়ে নিয়েছি। জমি রেখে আমরা সরকারের কাছে চোরদায়ে ধরা পড়েছি যেন। তোমাদের যার যেটুকু জমি আছে, সরকারি মদত পাও। আমার জমি দিয়েছি দুলনকে। ও হারামি চাষ করে না, অথচ বছর বছর বিছন নেয়। জানবর! বিছন খায়। সে খাক গে। আমরা কোনো মদত পাই, সার—বিছন—ফসলের পোকামারা ওষুধ, সব কিনতে হয়। আমার কথা এস. ডি. ও. কে বোল।
দুলনকে আসরফি বলে—সাবধান! ও হারামি জানে চাচা, যে তুমি জমি চষ না, ফসল উঠাও না।
দুলনের মনে শবদেহের ভার আরও ভারী হয়। লছমন সিং তাকে বলেছে ও জমিতে বিছন ফেলে বছর কয়েক চাষ করিস না দুলন।
দুলন অত্যন্ত দুঃখে আসরফির জন্যে আন্তরিক উদ্বেগে বলে, উসিকো বিশোয়াস মৎ যাইও বেটা। তোহার বাবা হামানি কো ধাতুয়া—লাটুয়াকো জনম—কাম কি থ।
—নায় চাচা।
আসরফি যথেষ্ট ঘুরচক্কর মারতে থাকে এস. ডি. ও. এবং লছমনের মাঝখানে। দুলন আরোই বিষণ্ণ হয় ও কোনো দুর্যোগ আশঙ্কা করে ছেলেদের খিঁচিয়ে বলে ছোটলোকের ছেলে ছোটলোকই থেকে যায়। জমি ভাঙিয়ে বুড়ো বাপ যা আনছে তাই খাচ্ছে। অন্য কোনো ছেলে হলে কাছাকাছি কোনো কলিয়ারিতেও চলে যেত। কেন মাটি কামড়ে পড়ে আছিস?
ধাতুয়া ভাসা ভাসা শান্ত চোখ তুলে সবিস্ময়ে বলে, এবার আমরা ডবল মজুরি পাচ্ছি বাবা।
দুলন আর কিছু বলে না। তোহরি চলে যায়, ব্লক আপিসে, বলে —এবার ফসল তুলে রবি দেব। মদত চাই।
বি. ডি. ও. সম্ভবত যে জমি চষা হবে না তার জন্যে বিছন দিয়ে চলার অকাট্য কারণ জেনেছেন। তিনিও এই চক্রান্তে লছমন ও দুলনের দলে চলে আসেন ও দেঁতো হেসে বলেন, দেখব।
দুলন দেখে ওঁর বাড়িতে সুউচ্চ গাছ। এত উঁচু পেঁপে গাছ দেখা যায় না।
সে বলে, য়ো পাপিতা গাছ এত্তা উঁচা কৈসে হইল? হাঁ বাবু?
বি.ডি.ও. গভীর আত্মপ্রসাদে হাসেন। বলেন, ও জায়গাটা পরে আপিসের কম্পাউন্ডে পেয়েছি। গরমের সময়ে পাগলা কুকুর মেরে ওখানে গর্তে ফেলত। পচা হাড় মাংসের সার পেয়েছে, বড়ো হবে না গাছ?
—সে সার ভালো?
—খুব ভালো। মুসলমান গরিব লোকের কাঁচা গোরের উপর ফুল গাছ কেমন ঝাঁপালো হয়?
কথাগুলি দুলনের মনে শবদেহ—ভার কিঞ্চিৎ লঘু করে। গ্রামে ফিরে দুলন ভরদুপুরে জমি দেখতে যায়। হ্যাঁ সত্যিই তো। করণ ও বুলাকি তাহলে ওই পুটুস ঝোপ ও এলো গাছগুলি! চোখ ফেটে জল আসে ওর। করণ, তুই মরেও মরলি না। কিন্তু পুটুস গাছ, এলো গাছ তো কারও কাজে লাগে না, মোষ—ছাগলে খায় না। আমাদের হক নিয়ে লড়তে গেলি। গম হয়ে, ভুট্টা হয়ে রইলি না কেন? নিদেন পক্ষে চীনা ঘাস? চীনা ঘাসের দানা সিজিয়ে ঘাটো রেঁধে খেতাম।
সুগভীর দুঃখে ও তামাডিতে গেল ও লছমন সিংয়ের সবজি বাগানে কেউ নেই দেখে মাঠের দিকের বেড়া ও তার উপড়ে ফেলে দিল। হর—হর—হর শব্দ করে কয়েকটি মোষকে ঢুকিয়ে দিল খেতে। তারপর ঘুর পথে এসে সদর দেউড়ি দিয়ে ঢুকে লছমন সিংকে বলল, মালিক পরোয়ার। এক খৎ লিখ দিয়া যায়। হাসপাতালে ভরতি হব। খাঁসি আর বুকে ব্যথা।
—ফসল কাটা হয়ে গেলে খৎ দেব।
—বহোৎ আচ্ছা জী পরোয়ার।
আবার দুলনের বুকে শবদেহ গুরুভার হল। নিজের মনের অতলকে চিন্তার খন্তায় খুঁড়তে খুঁড়তে ফিরল। করণ ও বুলাকিকে সরে জায়গা ছেড়ে দিতে বলল।
—ফসল কাটা হয়ে গেল! তবে করণ ও বুলাকির সেথো হয়ে আসছে কেউ?
ধান কাটা চলছে চলছে। বহু বিতর্কের পর আড়াই টাকা রোজ ও জলখাই। ঘোড়ায় চড়ে স্বয়ং লছমন তদারক করছে। পুলিশ আনুষ্ঠানিকভাবে দাঁড়িয়ে দেখে গেল শান্তিপূর্ণভাবে ধান কাটা হচ্ছে। সাতদিনের দিন মজুরি মিলল সবাকার।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে এস. ডি. ও. পুলিশ নিয়ে ফিরে গেলেন।
আট দিনের দিন ঝড় উঠল। বাইরের মজুর নিয়ে ধান কাটাচ্ছে লছমন সিং। আসরফি ও অন্যরা বিপন্ন, ভয়েও জেদে রুক্ষ।
—এ আপনি করতে পারেন না।
—কে বলে পারি না? পারছি তো। কুত্তার বাচ্চারা দেখে নে পারছি।
—কিন্তু—
—দিয়েছি ফসল কাটতে, দিয়েছি মজুরি! ব্যস—খেল খতম!
মারমুখী আসরফিদের দেখে বাইরের মজুররা কাস্তে নামায় ও এক জায়গায় জড়ো হয়। গুলির শব্দ। বাইরের মজুররা পালাচ্ছে, পালাল।
গুলির শব্দ।
গুলিতে কটা লাশ পড়েছিল তার হিসেব নেই। দুলনদের হিসেবে এগারোটি। লছমন সিং ও পুলিশের হিসেবে সাতটি। আসরফির বাপ একধারে নিষ্পুত্র হল। দু—ছেলে, মোহর ও আসরফি নিখোঁজ। খোঁজ মিলল নো চামা গ্রামের বহুবন কৈরি ও বুরুডিহার পারশ ধোবির। ঘরে ঘরে কান্নার রোল। এস. ডি. ও. আসতে তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছে নিহত ও নিখোঁজদের বাপ মা—বউ—ছেলেমেয়ে। এস. ডি. ও—র মুখে পাথর পাথর কাঠিন্য। লছমন সিংয়ের নামে পুলিশ কেস করবেন বলে গ্রামবাসীদের কথা দিচ্ছেন। রিপোর্টারদের সব বলছেন, ঘুরে দেখাচ্ছেন। ওয়ারেন্ট বের করে না আনা পর্যন্ত লছমন সিং ইজ নট টু লীভ হোম।
এবং জ্যোৎস্না রাতে, হিমেল বাতাসে মধুময় পরিবেশে লছমন সিং আসে। এ অঞ্চলের সবই প্যাটার্নিস্টিক, এবং মহত্তম পশু চতুষ্পদ ঘোড়া, চারটি ঘোড়া চারটি লাশ আনে। এবার দুলনের সঙ্গে লছমনের অনুচররাও হাত লাগায়। গভীর গভীর গর্ত দরকার। জমি বর্ষার জলে ও শরতের হিমে সরস। চারটি লাশ পড়ে ঝপাঝপ। দুলনের অন্তরে গুরুভার গুরুতরো হয়।
আরও আজীব মানুষ হয়ে যায় দুলন। বি. ডি. আপিস থেকে ঝগড়া করে আরও বেশি বিছন আনে। হাল—বলদের টাকা। তারপর এক মাস যেতে না যেতে কয়েকটি এলো গাছকে দেখে সান্ত্বনা পায়। অনেক সতেজ, অনেক সবুজ কয়েকটি এলো ও পুটুস গাছ ভারতের জরুরি অবস্থায় দক্ষিণ—পূর্ব বিহারের অনাদৃত অঞ্চলে খেতমজদুর কাম হরিজন হত্যার নীরব দলিল হয়ে প্রত্যহের সূর্যের প্রণাম নেয়। লছমন বেকসুর খালাস পায়। জরুরি অবস্থা। এস. ডি. ও. ডিমোটেড হন মালিক—খেতমজদুর এর শান্তিপূর্ণ সম্পর্ককে উসকানি দিয়ে খেতমজদুরদের প্ররোচনা দেবার জন্য। লছমন ও অন্যান্য জোতদার—মহাজন হনুমান মিশ্রের মন্দিরে বর্বর ধুমধামে পুজো দেয়, রুপোর বিল্বপত্র একশো আটটি এবং ঘোষণা করে, যে টাকা—টাকা মজুরিতে, বিনা জলখাই, ফসল কাটাবে, সেই কুত্তার বাচ্চা ও কুত্তীর বাচ্চি যেন আসে। অন্যথায় বাইরের কিষাণ আসবে। জরুরি অবস্থায় সর্বত্র হাহাকার। কংগ্রেসি মস্তান লোগ বাইরের কিষাণ আনার ঠিকাদারি নিয়েছে। এবার খেলা আরও দুরন্ত মজার। প্রত্যেকের মজুরি থেকে উক্ত ঠিকাদারকে চার আনা দিন দিন দিতে হবে। ঠিকাদারের লোক হও বা না হও। উক্ত মস্তানরা কথা দিয়েছে, বন্দুক হাতে ওরা ফসল কাটিয়ে নেবে এবং যে ট্যাঁ—ফোঁ করবে, তার চামড়ায় পেট্রল ঢেলে আগুন দিয়ে এ অঞ্চলে বদমায়েশি চিরতরে ঘোচাবে।
দুলন মনে গুরুভার নিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় এবং ধাতুয়া—লাটুয়ার মুখের দিকে চেয়ে ভাবে ছেলেদের নিয়ে পালাবে না কি? কোথায় যাবে? মাতৃভূমি দক্ষিণ—পূর্ব বিহারে কোথায় দুলন গঞ্জু নিরাপদ?
কোথায় বহিরাগত লছমন সিং নেই?
হোলির দিনে ও কান পেতে গানও শোনে না! কিন্তু হঠাৎ হোলির উল্লাস থেমে যায় কোনো আশ্চর্য গান শুনে। মৌয়ামাতাল ধাতুয়া টুইলা বাজিয়ে চোখ বুজে গাইছে :
‘কোথা গেল করণ?
বুলাকি কোথায়?
কেউ তাদের খোঁজ দেয় না কেন?
তারা পুলিশের খাতায় হারিয়ে গেছে।
কোথায় আসরফি হাজাম?
তার ভাই মোহর?
মহুবন আর পারশ কোথায়?
কেউ তাদের খোঁজ দেয় না কেন?
তারা পুলিশের খাতায় হারিয়ে গেছে।
করণ লড়েছিল পঁচিশ পয়সার লড়াই
আসরফি লড়েছিল পাঁচ টাকা চল্লিশ পয়সার লড়াই
বুলাকি আর মোহর
দাদাদের সঙ্গে এগিয়ে গিয়েছিল।
মহুবন জানত নেশা ধরানো মৌয়া বানাতে
পারশ জানত হোলির দিনে নাচতে,
ওরা সবাই পুলিশের খাতায় হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে।’
গান শেষ হল। সবাই নিশ্চুপ। হোলির রং খাক হয়ে গেল, হোলির নেশা কেটে গেল। দুলন উঠে দাঁড়াল।
—কে এই গান বাঁধল?
—বাবা, আমি।
দুলান হোহো করে কেঁদে উঠল। বলল, ভুলে যা ও গান। তুইও খোয়ে যাবি পুলিশের খাতায়।
দুলন চলে এল ওর জমিতে। নেমে গেল জমির মাঝখানে। অসম্ভব ফিসফিসে গলায় বলল, তোরা গান বনে গেলি। শুনতে পাচ্ছিস? গান বনে গেলি। আমার ছেলে ধাতুয়ার বাঁধা গান বনে গেলি। গান ব’নে গেলি, গান ব’নে গেলি, ধান বনলি না, বনলি না চিনা ঘাস—এখন আমার কলিজা হতে নেমে যা রে, আমি আর পারি না!
দোল পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় এলোগাছের সতেজ পাতা ও পুটুস ফুলের গুচ্ছ হেসে লুটোপুটি খেল। এমন হাসির কথা ওরা কখনো শোনেনি। দুলনের বুকের নীচে ধাতুয়ার জন্যে অজানা ভয়। মাচানে উঠতেই ও ধাতুয়ার গানটি শুনতে পেল। এখন সবাই গাইছে। কিন্তু পুলিশের খাতায় হারিয়ে যায়নি ওরা। দুলন কোনোদিন সব কথা বলতে পারবে না। লছমন সিংয়ের থাবা।
একদিন জরুরি অবস্থার অবসান হয়।
একদিন ভারতের মুক্তিসূর্য মজা দেখতে গদি ছেড়ে নীচে নামেন ও কিছুকাল দম নিয়ে পুনর্বার গদিতে ওঠার জন্যে ছোটাছুটি শুরু করেন। একদিন আবার লছমনের ফসল পাকে।
দু—বছর অকাল—খরা—শস্যহানির পর এ বছর ধান ঢেলে দেয় মাটি। আদিগন্ত ধানখেতে মাচান বসে সার সার। পাখ—পাখালি রাতেদিনে পাকা ধানে এসে পড়ছে।
দু—বছর আগে যে ছিল কাংগ্রেসি এবং মাস্তান এবং খেতমজুর জোগাবার ঠিকাদার—সেই এবার নাম থেকে ”কাংগ্রেসি ও মস্তান” ডক্টরেট দুটি বাদ দিয়ে খেতমজদুর জোগাবার ঠিকাদার হয়ে দেখা দেয়। তার সঙ্গে তারই মতো টেরিক্লথশোভিত, কালো চশমা পরিহিত বন্দুক—উঁচানো সঙ্গী চতুষ্টয়। অমিতাভ বচ্চনের গলায় এই মার্সেনারি লছমনকে বলে আপনাদের দিন খতম এখন। স্ট্রাইক ভাঙা, খেতমজদুর জোগান দেওয়া ও ফসল কাটানো, সবই পেশাদারদের হাতে চলে এসেছে। সাউথ—ইস্টার্ন বিহারে আমি মার্সেনারি সার্ভিস দিই। আপনি না চাইলেও আমিই দেব। পাঁচ হাজার টাকা। আগাম।
—পাঁচ হাজার?
—তা হলে সরকারি মজুরি দিন।
—না না।
—সরকারি মজুরি না দিয়ে নাফা করবেন আশি হাজার। পাঁচ হাজার দেবেন না?
—দেব।
—ব্যস। গ্রামের নাম মজদুরদের নাম দিন। কোই হাংগামা উঠানেবালা হ্যায়?
—না।
—ঠিক আছে। আমাকে মখখন সিং আর রামলগন সিংকেও সার্ভিস দিতে হবে। ঠিক সময়ে চলে আসব আমি। আর হাঁ ওদের মজুরি দেবেন পাঁচ সিকা। আমার বাট্টা চার আনা।
—টাকা—টাকা।
—পাঁচ সিকা। আমি, অমরনাথ মিশ্র, বেশি কথা বলি না।
—টাহাড়ের মিশ্রজির আপনি কে লাগেন?
—ভাতিজা। আমার সার্ভিসের প্রথম ক্যাপিটাল চাচাজিই দিয়েছেন। এইভাবে সব কথা হয়ে যায়। পরে হনুমান মিশ্র লছমন সিংকে বলেন, হাঁ হাঁ, আমারই ভাতিজা। ছেলেদের সারফেস কলিয়ারি কিনে দিলাম, বললাম তোকেও দিই? না, ও নাখারা কাম ও করবে না। খুব এলেমদার ছেলে। ওর সার্ভিস ইলেকশনের ক্যান্ডিডেট নেয় হরতালী কারখানার মালিক নয়। সারফেস কলিয়ারিতে লেবার জোগায় ও। খুব এলেমদার! তিনটে বিয়ে করেছে। তিন টাউনে তিনজনকে রেখেছে। সকলকে মকান করে দিয়েছে। আগেকার সরকারে ওর খুব কদর ছিল। আমার একটা ছেলেও ওর মতো এলেমদার হল না।
লছমন সিং খুব বর্বর রাজপুত। স্বরাজ্যে সঞ্জয়। কিন্তু লছমনও বোঝে, ভাড়াটে মার্সেনারি যখন নিজের সার্ভিস চাপিয়ে দেয়, তখন তাকেও মেনে নিতে হবে। না দিলে লছমন, মখখন ও রামলগনের কাছে বোকা বনবে।
ধান কাটা শুরু হয়। বাইরের মজুর নয়, নিজেরাই কাটছে ধাতুয়ারা। পাঁচ সিকা রোজের ওপর জলখাই মকাইয়ের ছাতু—লঙ্কা—লবণ। ধাতুয়ার মা দুই ছেলের জন্যে বুনো করমচার আচার দিয়ে দেয় সঙ্গে।
দুলন মাচানে বসে থাকে। বসে থাকে কিসের প্রতীক্ষায়। ধানকাটা চলছে, চলছে। গান গেয়ে ধান কাটছে মেয়েরা, দূর থেকে ওদের গান একঘেয়ে ঘুমপাড়ানি গানের মতো শোনায়। কিন্তু দুলনের ঘুম আসে না।
‘কে কেড়ে নিয়েছে দুলনের ঘুম?
ঘুম পুলিশের খাতায় হারিয়ে গেছে।’
ধাতুয়া ও লাটুয়া ফেরা অবধি দুলন বাড়িতে থাকে। তারপর আসে জমিতে। বৃষ্টিতে পাড়ধোয়া জল পেয়ে শরতের হিমে ভিজে সরস মাটিতে এলো গাছগুলি বন্য ও উদ্ধত। পুটুস ফুলে গাছ ফেটে পড়ছে। দুলনের চোখে ঘুম আসে না।
প্রত্যাশিত গন্ডগোল বাধে মজুরি মেটাবার দিনে। অমরনাথ সেদিন তার বাট্টা দাবি করে। লছমন বলে, কোনো খুনজখম করবে না। আমার সঙ্গে বাট্টা কেটে নেবার কথা নেই। ওদের সঙ্গে ফয়সালা কর।
—কতজনের সঙ্গে? অমরনাথ হায়নার মতো হাসে, আপনি দিয়ে দিন।
সব চেয়ে রুখে ওঠে ধাতুয়া, দুলনের ছেলে। সেইজন্যই লছমন সিং বাট্টার ব্যাপারে ঢুকতে চায় না। ও অছুতকে বন্দুক তুলে জব্দ করতে জানে শুধু। এই একজনকে ও গুলি করতে চায় না। দুলন ওর কাছে প্রয়োজনীয়।
অমরনাথ বলে, কুত্তাদের সঙ্গে আমি বলব কথা? পাঁচশো লোকের পাঁচ সিকা থেকে রোজ এক সিকে হিসাবে পনেরো দিনে হয় আঠারো শো পঁচাত্তর টাকা। দিয়ে দিন।
—না হুজুর! আমরা দেব না। ধাতুয়া চেঁচিয়ে ওঠে। লছমন নিশ্বাস ফেলে। আবার প্যাটার্নিস্টিক হতে হবে ওকে। আবার বন্দুক তুলতে হবে। করণ যায়, আসরফি আসে, আসরফি গেল, ধাতুয়া।
—পনেরো দিনের পনেরো টাকা নিয়ে ঘরে যাব? আঠারো টাকা বারো আনা পাব না? সে কথা হয়নি? দিন তো বেশি টানিনি আমরা?
—ধাতুয়া বুঝে কথা বলিস।
টাকা দেয় অমরনাথকে লছমন সিং। তারপর বলে, কথা বলিস না ধাতুয়া। চলে যা।
করণ ছিল দাবি জানবার লোক, আসরফি ছিল রুক্ষ। ধাতুয়া কোনোদিন জানে নি ওদের মজুরি কেটে অমরনাথকে বাট্টা দেবার ব্যাপারে ও এরকম জেদের সঙ্গে দাবি জানাতে পারবে। বেরিয়ে এসে ও বলে, তোরা যা। আমি ফয়সালা করে তবে আসব।
আবার ও লছমন সিংয়ের সামনে আসে। বলে, ওই পঁচিশ পয়সার হিসাব চুকিয়ে না দিলে আমরা কাল থেকে ধান কাটব না। ভালো খেতগুলো বাকি আছে। নিজেরা কাটব না আর কাউকে কাটতে দেব না।
—পুলিশ তার বাট্টা নিতে এসেছে বলে এখন বেঁচে গেলি ধাতুয়া।
—পুলিশকে আপনি ডরান?
ধাতুয়া চলে যায় কিন্তু ওর শেষ কথাটি লছমনকে জ্বালিয়ে রেখে যায়। তবু ধাতুয়া দুলনের ছেলে বলে এবং দুলন লছমনের অত্যন্ত গোপন করবার মতো কাজের সহায়ক বলে লছমন একটা দিন ছোটোলোকেদের সময় দেয়।
পরদিন সবাই আসে এবং কেউ কাজ করে না। লছমন ব্যর্থ ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে। মার্সেনিদের পাওয়া যাবে না। তারা মখখন সিং ও রামলগন সিংয়ের কাছে মদত দিতে গেছে। নিমেষে বাইরের লেবার মেলাও সহজ নয়। বিকেলের আলো ঢলে পড়তে লছমন তার সঙ্গীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়। তরসালে কাজ হয় যদি, গোলিও মৎ চালাও। পাকা ধানের মধ্য দিয়ে ঘোড়া চড়ে লছমনের অনুচররা যায়। চম্বলের দস্যুদলের সিনেমা দেখে দেখে ওরাও পরে খাকি সবুজ য়ুনিফর্ম। ওরা এগিয়ে আসে। এরা উঠে দাঁড়ায় এবং অপেক্ষা করে।
—কুত্তার বাচ্চারা কুত্তীর বাচ্চিরা শোন।
—তু হো কুত্তাকে বাচ্চা!
কে চেঁচিয়ে বলে। ওরা বন্দুক তোলে। এরা আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় ঢুকে পড়ে খেতে। ধানের আড়ালে অদেখা হয়। কিছুক্ষণ চলে কথার মিসাইল। তারপর অনিবার্য গুলি। একাধিক। ধান খাওয়া ছেড়ে পাখির ঝাঁক আকাশে ওড়ে। খেতের ভেতর হয় কার গলায় রক্ত গার্গলের শব্দ। চেনা শব্দ।
তারপর ঘোড়ার পায়ে বসে যায় বসতে থাকে ধারাল কাস্তে ও হেঁসো ঘোড়া ছোটে সওয়ার নিয়ে। ওরা বেরিয়ে ছুটে পালায়। লাটুয়া ও পরম ছোটে তোহরির দিকে।
ভীষণ, ভীষণ কষ্টকর অপেক্ষা করে দুলন। সন্ধে পেরিয়ে রাত করে আসে লাটুয়া।
—ধাতুয়া কোথায়?
—আমি তো দেখিনি। আসেনি দাদা? আমি তো থানায় গেলাম।
—ধাতুয়া কোথায়?
—পুলিশ নিয়ে এলাম আমরা। পুলিশ এখানেও আসবে। সেই এস. ডি. ও বাবা। সে আবার এসেছে। ও ভি আয়েগা।
—ধাতুয়া!
দুলনের অন্তরে অন্তরে শবদেহগুলি নড়ছে কেন? কাকে জায়গা করে দিচ্ছে? কাকে? দুলন সব বোঝে ও উঠে দাঁড়ায়।
—কোথায় যাও?
জমিতে।
—ছেলেটা এল না, তুমি, তুমি, তুমি কি পাগল না পিশাচ?
—চুপ কর হারামজাদি।
দুলন বেরোয়, ছুটতে থাকে। ধাতুয়ার গান, ধাতুয়ার গান,
‘কোথায় গেল করণ?
বুলাকি কোথায়?
তারা পুলিশের খাতায় হারিয়ে গেছে।’
ভাসা—ভাসা চোখ। হাতে জরুল। তু মৎ খো যাইও ধাতুয়া, মৎ খো যাইও। এলো গাছ, পুটুস গাছ, তোমরা হেসো না আজ রাতে।
ধাতুয়া আছে, ধাতুয়া আছে।
লছমন সিং। একটি লোক। লোকটির মুখ চোখ রক্তাক্ত। লছমন তাকে মারছে। লাথি মারে। লোকটি পড়ে যায়।
ওরা দুজন, ঘোড়া তিনটে।
লছমন ওর দিকে তাকায়। কাছে আসে, বলে,
—দুলন?
—ধাতুয়া?
—আফসোস, আফসোস দুলন, মানা কী তো য়ে জানবর গোলি চালায়।
লছমন আবার লোকটাকে লাথি মারে। বলে, গোলি চলানেবালা মস্তান!
—ধাতুয়া?
—জামিনে।
—কৌন ডালা?
—ওহি জানবর।
—ও?
—হ্যাঁ কিন্তু জবান খুলবি না দুলন। তোর বউ, বেটা, বেটার বউ, নাতি কেউ থাকবে না। ঔর, ঔর টাকা নিয়ে যাবি। পুলিশ ডেকেছে তোর ছেলে। পুলিশকে আমি জরুর কিনে নেব। কিন্তু জানিস, তোর ছেলে বলেই লাটুয়াকে ছেড়ে দিয়েছি। আমার বন্দুকের একটা গুলিও তো আজ খরচ করি নি। লাটুয়াকে একটা গুলিতে ফেলে দিতে পারতাম। দিই নি।
ওরা চলে যায়। সাতটি শব নিয়ে দুলন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। পড়ে যায় পাড়ে। গড়িয়ে পড়ে জমিতে। বন্য ও হিংস্র এলো পাতার কাটায় ক্ষতবিক্ষত হতে—হতে, গড়াতে—গড়াতে থামে এক সময়ে।
যথারীতি এবারকার তদন্ত শেষ হয় না। এস.ডি. ও. হস্তক্ষেপ করেন। গোলি চালানেবালা মস্তান ও অমরনাথ জেলে যায়।
ধাতুয়া আর ফেরে না।
দুলন শুধু ভাবে আর ভাবে। অবশেষে পাগল হবার সিদ্ধান্তই নেয় ও। কেন না বৈশাখী বৃষ্টি পেতেই জমি থেকে এলো ও পুটস নিশ্চিহ্ন করতে থাকে।
—কোথায় গেল? ভর দুপুরে? শুধোয় ওর বউ। লাটুয়ার বউ বলে, কাস্তে আর খন্তা নিয়ে জমিতে গেল শ্বশুর।
—মানা করলি না?
আমি কথা বলি?
ছুটে যায় বউ শোকতাপ ভুলে। পাড়ে উঠে চেঁচায়, হ্যাঁ তুমি পাগল হলে? ওহ জঙ্গল সাফ করতে নেমেছ?
—ঘর যা।
—ঘর যাব কি?
—ঘর যা।
—বউ কাঁদতে কাঁদতে পহানের কাছে যায়। পহান চলে আসে। বলে, ধাতুয়া আসবে দুলন। পাগলামি করিস না ছেলের শোকে। তাত লাগবে।
দুলন বলে, ঘর যাও পহান। তোমার ছেলে নিখোঁজ হয়েছে, না আমার?
—তোর।
—এ জমি তোমার, না আমার?
—তোর।
—তবে? পাগল হলে হয়েছি, না হলে না হয়েছি। শালার জমিকে দেখছি আমি।
—লাটুয়াকে ডেকে নে তবে।
—না আমি একা সব করব।
চাষ—কাজ ও করে না, কিন্তু করলে ওর হাত খুবই ভালো, তা মনে পড়ে পহানের। পহান দুলনের বউকে বলে, চল ঘরে চল। যা মনে নেয় করুক ও। তোকে তো তোহরি যেতে হবে।
দুলনের বউ লাটুয়ার সঙ্গে বার বার তোহরি যায় ও থানায় ধাতুয়ার বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়।
কয়েকদিন জঙ্গল সাফ করে দুলন। জমি তৈরি করে। তারপর বিছন এনে বলে, এ বিছনে ভাত হবে না জমিতে রুইব।
—ওই জমিতে!
—হ্যাঁ।
বিছন ছেটাতে ছেটাতে দুলন মন্ত্রের মতো বলে চলে, তোমাদের এলো আর পুটুস করে রাখব না। ধান বনিয়ে দিব। ধাতুয়া? ধান বনিয়ে দিব।
চারা যখন ওঠে, সবাই দল বেঁধে দেখতে আসে। কোথায় লাগে লছমন, মখখন আর রামলগনের সারালো মাটির চারা। এ চারাগুলি যেমন সতেজ, তেমনি পুষ্ট।
—পোড়ো জমি, নতুন চারা। সবাই বলে। দুলন অত্যন্ত বিরক্ত হয়। সকলকে তাড়িয়ে দেয়। ও একা চষবে, একা রুইবে, একা চারার সবুজ লাবণ্য দেখবে।
পহান বলে, লছমন সিং দেখলে হিংসেয় মরে যেত।
—কে? দুলন নিস্পৃহ।
—লছমন সিং।
—কোথায় সে?
—গয়া গিয়ে বসে আছে। শ্বশুরালে।
—ও!
তারপর ধানগাছ বড়ো হয়। উঁচু, সুপুষ্ট, সতেজ গাছ। ঝেঁপে ধান হয়। ধান পাকে। এবার দুলনের চূড়ান্ত পাগলামি প্রকাশ পায়।
ও বলে, ধান কাটব না।
—কাটবে না? এই বর্ষা গেল, কত কষ্টে পাড় কেটে জমা জল বের করলে, রাতেদিনে ওখানে রইলে, ঘর থেকে ঘাটো আর জল বয়ে বয়ে আমি মরলাম, ধান কাটবে না?
—না। আর তোরাও কেউ জমিনে আসবি না। আমার কাজ আছে।
—কি কাজ? বসে থাকা?
—হ্যাঁ, বসে থাকা।
যে জন্যে বসে থাকা তা হল। ফসল কাটার সময় লছমন ফিরল। দুলনের ধান চাষের কথা ওর কানে গেল। ধাতুয়ার খুনের পরে এক বছর কেটেছে। আবার লছমন আত্মস্থ।
লছমন দুলনের কাছে এল। দুলন জানত, ও আসবে। দুলন জানত।
—দুলন!
—মালিক পরোয়ার?
—উঠে আয় এখানে।
—এ কী, আপনি একা?
—বাজে কথা রাখ। এ কী?
—কী?
—জমিনে ধান কেন?
—চাষ করেছি।
—কী কথা ছিল?
—আপনি বলুন।
—কুত্তার বাচ্চা, জমিনে তুমি ধান চাষ করবে সেই কথা ছিল? বনঝোপ থাকবে…
দুলন নীচে, লছমন ঘোড়ার পিঠে। দুলন লছমনের পা ধরে হঠাৎ ভীষণ জোরে টানল। পড়ে গেল লছমন। বন্দুক ছিটকে গেল। দুলনের হাতে বন্দুক। লছমন কিছু বোঝার আগেই ওর মাথায় বন্দুকের বাঁট পড়ল। লছমন চেঁচিয়ে উঠল। দুলন বন্দুকের বাঁট কলার বোনে মারল। খটাস শব্দ।
—কুত্তার বাচ্চা, জানবর… লছমন সভয়ে দেখল দুলনের সামনে ও কাঁদছে। ওর চোখে যন্ত্রণায় ও আতঙ্কে জল। সে, লছমন সিং মাটিতে, দুলন গঞ্জু দাঁড়িয়ে? দুলনকে পা চেপে ধরতে গেল, ও ককিয়ে উঠল। দুলন ওর হাতে পাথর মেরেছে। লছমন বুঝল, ডান হাত বহুদিনের মতো অকেজো হল।
—জানবর! কুত্তা!
—কী কথা ছিল মালিক? চাষ করব না। কেন করব না? তুমি লাশ পুঁতবে, আমি হব লাশের জিন্মাদার। কেন হবে? নইলে তুমি গ্রাম জ্বালাবে, আমাকে নির্বংশ করবে। খুব ভালো। কিন্তু মালিক সাত—সাতটা ছেলে। শুধু বন—ঝোপ—কাঁটাগাছ হবে তাদের গোরে? তাই ধান বুনেছি, জান? সবাই বলে পাগল, আমি পাগলই হয়েছি। আজ আর তোমায় যেতে দিব না মালিক, আর ফসল কাটাতে দিব না। গুলি চালাতে, ঘর জ্বালাতে, মানুষ জ্বালাতে আর দিব না। অনেক ফসল কাটলে তুমি।
তোকে পুলিশ ছেড়ে দেবে?
না দিলে না দিবে। তোমার লোকজন? তারাও হয়তো মারবে। মারে নি কবে মালিক? পুলিশ বা কবে মারে নি? আবার মারলে এবার মরতে হলে মরব। একবার তো সবাই মরে। ধাতুয়া কি আগে মরেছিল?
এ সময়ে নিজেকে সম্পূর্ণ অসহায় জেনে লছমনের মনে মৃত্যুভয় হল। মৃত্যুভয় হলেও রাজপুত কখনো দক্ষিণ—পূর্ব বিহারে অন্ত্যজ জাতির কাছে নত হতে পারে না। যদি পারত, তবুও অন্ত্যজ জাতি রাজপুতকে সব সময়ে প্রাণদান করতে পারে না। দুলন পারল না।
লছমন উঠতে গেল সর্বশক্তিতে, চেঁচাতে গেল, বাঁ—হাতে পাথর নিতে গেল, দুলন বলল, কা আফসোস মালিক! গঞ্জুর হাতে মরলে!
পাথর দিয়ে ছেঁচতে থাকল ও লছমনের মাথা। ছেঁচে চলল। লছমন হত্যায় অভ্যস্ত, গুলির দাম জানে, হত্যা ওর ভেতরকে বিচলিত করে না। ও হলে এক গুলিতে দুলনকে মারত।
দুলন হত্যায় অভ্যস্ত নয়, পাথরের কোনো দাম নেই, এই হত্যা ওর দীর্ঘদিনের অন্তঃসংগ্রামের পরিণাম! ও পাথর ছেঁচে চলল।
এক সময়ে আর পাথর ছেঁচার দরকার থাকল না। উঠে দাঁড়াল দুলন। একে একে কাজ সারতে হবে। ঘোড়ার লাগাম ধরে এগিয়ে নিয়ে পাছায় লাঠি মেরে ও ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। যেখানে ইচ্ছে যাক। তারপর বন্দুক সমেত লছমনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে টানতে টানতে বহুদূর গেল। একটি খানায় ফেলল ওকে। তারপর পাথরের পর পাথর গড়াতে থাকল। পাথরের পর পাথর। ভেতর থেকে হাসি উঠে আসছে। ঘৃণ্য ওঁরাও— মুণ্ডা হয়ে গেলে মালিক পরোয়ার? পাথরে চাপা পড়লে? পাথরের সমাধি হল?
পাথুরে পাড়ে কাঁকরমাটিতে কোনো দাগ থাকার কথা নয়। কিন্তু পাড়ের পুটুস গাছের সপত্র ডাল ভেঙে ও ধস্তাধস্তির জায়গাটি ঝাড়ু দিল। তারপর মাচানে উঠল।
লছমনের খোঁজ কয়েকদিন ধরে চলে। যেহেতু সে কারও সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিত না, সেহেতু সে দুলনের কাছে আসার কথা কারুকেই বলেনি। না বলাই স্বাভাবিক, কেননা দুলনের ওপর ও যেজন্য নির্ভর করত, তা গোপন রাখার ব্যাপার। ওর শাগরেদদের যারা যারা জানত, তারাও চেপে গেল। মালিক পরোয়ার স্বয়ং যখন নিখোঁজ, ঘোড়া যখন দৈতারির ধানখেতে চরছিল, তখন খুঁচিয়ে ঘা করে লাভ কি? লছমনের চাকর বলল, রোজকার মতো দুধ—মিছরি খেয়ে ঘোড়ায় বেড়াতে গেলেন। কোথায় গেলেন, কি করে বলব?
খুবই অবাক কাণ্ড, হায়েনাদের চেঁচামেচি শুনে তবে লোকজনের টনক নড়ে। সেও পাঁচ দিন বাদে। পাঁচ দিন ধরে মাংসাশী পশুগুলি পাথরের ফাঁকে মাংসের গন্ধ পেয়ে চে�চিয়েছে ও অশেষ চেষ্টায় কিছু পাথর সরিয়ে ওরা মুখটি শুধু খেতে পেরেছে। মৃতদেহ লুকোবার কৌশলী ধূর্তামি+ধান খেতে ঘোড়া ইত্যাদি কারণে দৈতারি সিংয়ের ওপর সন্দেহ বর্তায়। লছমনের ছেলে তাতে মদত দেয় এবং প্রাচীন দ্বন্দ্বের ইতিহাস থাকার ফলে দৈতারি কিছুদিন নাজেহাল হয়। প্রমাণাভাবে পুলিশ ভঙ্গ দেয় এবং দৈতারি ও লছমন—পুত্র প্রাচীন বিবাদের ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে চলে। কোনো পর্যায়েই দুলনে সন্দেহ বর্তায় না। বর্তানো স্বাভাবিক নয়। কোনো অবস্থাতেই দুলন লছমনকে মারবে, তা ভাবা যায় না।
ওদিকে লছমনকে নিয়ে খোঁজ তল্লাশ চলতে থাকে, এদিকে মাচান থেকে নেমে আসে এক প্রসন্ন, নতুন দুলন। পহানকে কি বলে সে, ফলে একদিন বিকেলে পহানের আঙিনায় কুরুডার সবাই সমবেত হয়। দুলন বলে, কোনোদিন কিছু দিই নাই হাতে তুলে কারুকে।
সকলে বিস্মিত হয়।
দুলন বলে, আমার ধান দেখে তোমরা সবে ভালো বললে। সেই ধান কাটলাম না, সবে বললে পাগল আমি। সে চাষ করার কালেও বলেছ। পাগলকে পাগল বলেছ। তা এই পাগলের কথাটা রাখ।
বল!
লছমনের মৃত্যুতে সবাই এক ধরনের স্বস্তি পাচ্ছে। তার ছেলে বাপের ভূমিকায় নামবে কি না, আজই ভাবতে ইচ্ছে করছে না।
আমার ধান তোমাদের লেগে বিছন। এই বিছন নাও।
দিয়ে দিচ্ছ?
হ্যাঁ নাও, কেটে নাও। কেন এমন হল, সে অনেক কথা—
সার দিয়েছ?
হ্যাঁ সার, খুব দামি সার। দুলনের গলাটা যেন ঘুড়ি কাটা সুতোর মতো হারিয়ে যায়। তারপর গলা সাফ করে দুলন বলে, তোমরা কাট। আমাকেও চারটি দিও। আবার রুইব, আবার।
সময় এলে ওরা খেতে নামবে, ধান কাটবে, এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে দুলন তার জমির দিকে ফেরে। আশ্চর্য! পাড়ে দাঁড়িয়ে ও ধানগুলি দেখে।
করণ, আসরফি, মোহর, বুলাকি, মহুবন, পারশ ও ধাতুয়ার মাংসমজ্জার সারে পুষ্ট পাকা ধানে আশ্চর্য প্রসন্নতা। বিছন হবে বলে। বিছন মানে বেঁচে থাকা। দুলন আস্তে আস্তে মাচানে ওঠে। মনের মধ্যে একটা সুর। অবাধ্য। ফিরে ফিরে আসছে। ধাতুয়া গানটা বেঁধেছিল। ‘ধাতুয়া’—বলতে গিয়ে দুলনের গলা কেঁপে গেল। ধাতুয়া তোদের হম বিছন বনা দিয়া।