বারান্দার জানালা – মহাশ্বেতা দেবী
আজকের দিনটা বেশ খারাপ যাচ্ছে বিনির। বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া, অঙ্ক ম্যামের কাছ থেকে বাইরে তাকিয়ে থাকবার জন্য বকুনি আরও কতকি! বিনি জানালার ধারে বসেছিল টিফিন টাইমে। ক্লাসের মেয়েরা সব একে একে টিফিন নিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে। অন্যদিন হলে বিনিও যেত কিন্তু আজ ওর যা মনখারাপ, কিছুই করতে ইচ্ছা করছে না। বেঞ্চে এসে বসেছে কয়েকটা মেয়ে। অন্য ক্লাসেরই মনে হচ্ছে। সবার গায়ে একরকম ইউনিফর্ম। জোরে জোরে কথা বলছে ওরা। বিনির বেশ রাগ হতে লাগল।
একসময় মেয়েগুলো আর তাদের হাসিঠাট্টা সমস্ত বিরক্তির সীমা ছাড়িয়ে গেল। বিনি আর ওখানে বসে থাকতে না পেরে উঠে দাঁড়াল। গটগট করে বেঞ্চ থেকে বেড়িয়ে চলে এল বারান্দায়। বারান্দার জানালাগুলোতে শিক নেই মোটে, সব বড় বড় ফাঁক। মেয়েরা জানালার ধারে বসে বসে টিফিন খাচ্ছিল। একটা ফাঁকা জানালা খুঁজে নিতে খুব একটা অসুবিধা হল না বিনির। টানা বারান্দার একেবারে একটেরেতে জানালাটা। ওদিকে ছাত্রীদের ভিড়টা অনেক কম। প্রায় কোন ছাত্রীই নেই বলা যেতে পারে। আসলে ওই জায়গাটা সবাই একটু এড়িয়েই চলে। জায়গাটার সম্বন্ধে অনেকের অনেকরকম বিশ্বাস। কেউ বলে ওখানে নাকি ভূতেরা থাকে, কেউ বলে ওখানে গুপ্তধন আছে, আবার কেউ বলে ওখানে নাকি কিছুই নেই। কিন্তু যে যাই বলুক ওই কোণটাতে বিশেষ কেউ সাহস করে যায় না। বিনিরা যখন আরও ছোট ছিল, তখন একবার গুজব ছড়ালো, একজন টুয়েলভের দিদিকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ কেউ বলল ওরা নাকি ওই দিদিটাকে দেখেছে ওই কোণে যেতে তারপর ওইখানে যে দরজাটা আছে সেটা খুলে ঢুকতে, কিন্তু তাকে আবার কেউ নাকি বেরিয়ে আসতে দেখেনি। দিদিটাকে আর কোনদিন স্কুলে দেখাই যায়নি। তারপর থেকে তো জায়গাটার আরও বদনাম হয়ে গেল।
আজ বিনির মন খারাপ। ওর মাথায় কিছুই ঢুকল না। কোন চিন্তাভাবনা না করেই ওই জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। এদিক দিয়ে স্কুলের পেছনে যে ফাঁকা মাঠ সেটাকে বেশ ভালো করে দেখা যায়। মাঠটাতে সূর্যের খাড়া রোদ্দুর এসে পড়ছে। গরমে সমস্ত ঘাস শুকিয়ে হলুদ হয়ে গেছে। একটা লোকও নেই। বিনি জোর দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা । ওর ফাঁকা মাঠ দেখতে একটুও ভালো লাগছিল না। সেখানে তো দেখার কিছুই নেই। খালি শুকনো হলুদ ঘাস – আর কিছু না। বিনি চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল বোধহয়। চোখ খুললেই তো সেই একই জিনিস দেখতে হবে। কিন্তু চোখ খুলতেই সে যা দেখল, তা সে ভাবতেই পারেনি। জানালার বাইরে কোথায় ফাঁকা মাঠ, কোথায় হলুদ, মড়া ঘাস ! সব ভ্যানিশ! একেবারে উধাও। তার বদলে জানালার বাইরে দেখা যাচ্ছে নীল সমুদ্র, হলদে সমুদ্র-সৈকত, দূরে দেখা যাচ্ছিল পাম গাছ।
বিনি আঁতকে উঠল। এ কী? জানলা থেকে চোখ ফিরিয়ে এদিক ওদিক তাকাল। নাঃ কোন সমুদ্র-টমুদ্র নেই, সেই একঘেয়ে স্কুল আর দূরে কিছু ইউনিফর্ম পড়া মেয়ে দাঁড়িয়ে গল্প গুজব করছে। আবার জানালার দিকে তাকাল বিনি, কিন্তু দ্বিতীয় বারও ও দেখল নীল সমুদ্র, সমুদ্র সৈকত, আর পাম গাছের সারি। এবার রীতিমত ভয়ই পেয়ে গেল বিনি। তাড়াতাড়ি সবচেয়ে কাছের যে অন্য জানালা রয়েছে তার কাছে চলে গেল দেখতে। কিন্তু এ কী? এই জানালাটার বাইরে তো সমুদ্র-সৈকত নেই, পাম গাছও নেই। রয়েছে শুধু ফাঁকা মাঠ আর হলুদ ঘাস। বিনি আবার ওর নিজের জানালার দিকে হাঁটা লাগাল। মনে মনে নিজেকেই প্রশ্ন করল, ‘আমি কী দেখছি? আমি কি পাগলই হয়ে গেলাম?’
এইবার বিনি আশা করেছিল যে জানালার বাইরে ও আবার হলুদ ঘাসে ভরা মাঠই দেখবে। ঠিক আশা করেনি, চেয়েছিল। কিন্তু এবারও জানালার বাইরে সেই একই দৃশ্য। নীল সমুদ্র, হলদে সমুদ্র সৈকত, আর দূরে পাম গাছের সারি। এবার কিন্তু বিনির ব্যাপারটা খুব একটা খারাপ লাগল না। দৃশ্যটা তো খুবই সুন্দর। ও দেখতে লাগল, চোখ বড় বড় করে দেখতে লাগল। সত্যি! কি সুন্দর সমুদ্রটা। কি নীল। বেশ মুগ্ধ হয়ে গেল বিনি।
চমক ভাঙল বেলের শব্দে। টিফিনের বেল পড়ল তবে। বিনির কিন্তু এই তার নিজস্ব সমুদ্রটাকে ছেড়ে চলে যেতে একদমই ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু যেতে তো হলই। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে যে। বাকি সারাদিন বেশ অন্যমনস্ক হয়ে থাকল বিনি। সব সময় চোখের সামনে ভাসছিল সেই নীল সমুদ্র, হলদে সমুদ্র সৈকত আর দূরে পাম গাছের সারি।
পরদিন টিফিনের সময় ব্যাপারটাকে পুরোপুরি আজগুবি মনে হল। কী করে হতে পারে? সেই জানালাটার কাছাকাছি আসতে আসতে তো একেবারেই ধরে নিয়েছিল বিনি যে আজ আর দেখা যাবে না সেই অদ্ভুত দৃশ্য। আজ আবার অন্যদিনের মতন দেখা যাবে ফাঁকা মাঠ আর হলুদ ঘাস। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল বিনি জানালাটার দিকে। আজকে কী দেখবে তার চিন্তায় ওর বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। জানলাটার সামনে এসে দাঁড়াল বিনি। চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল ও উত্তেজনায়। চোখ খুলতেই দেখে, না, আজকে আর সমুদ্র নেই, কিন্তু তার বদলে আজ রয়েছে পাহাড়।
জানালা থেকে দেখা যাচ্ছিল দূরে বরফের টুপি পরা সারি সারি পাহাড়, তার সামনে সারি সারি পাইন গাছ। ঝকঝকে নীল আকাশ, তাতে পেঁজা তুলোর মতন ভাসছে মেঘের দল। গতকালের সমুদ্রের চাইতেও এটা বেশি ভালো লাগছিল বিনির। জানালার ধারেই বসে পড়ল সে, হাতে টিফিন বাকসো যেমন ছিল তেমনিই পড়ে রইল, বিনি চেয়ে রইল বাইরের দিকে, মন্ত্রমুগ্ধ চোখে। মনটা কেমন যেন খুশি খুশি লাগছিল ওর। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। জানালাটা এমন কিছু দেখায় যা অন্য জানালা দিয়ে দেখা যায় না, আর এই ব্যাপারটা জানে শুধু সে, আর কেউ নয়।
বন্ধুদের সঙ্গে ভাব হয়ে গেছিল অবশ্য তারই কয়েকদিন পরই। তবুও টিফিন টাইমে বিনিকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে দুষ্কর হয়ে গেল। বিনি যেতে চায় না। বলে, ‘তোরা যা আমি জানালার ধারে বসে খেয়ে নেব।’ বন্ধুরা বুঝে উঠতে পারে না যে জানালার ধারে ও এমন কী পেল যে ও তাদের সাথে টিফিনও খাবে না? কিন্তু সে কথা তো জানে খালি বিনি, আর কেউ নয়। বিনি কাউকে বলেওনি এ ব্যাপারে। বলে কী লাভ? কেউ কি বিশ্বাস করবে ওর গল্প? ওর জাদু জানালা ওর মনের মধ্যেই সযত্নে রাখা রইল, কিন্তু তা আর কেউ জানতে পারল না।
তারপর কেটে গেছে কত বছর। কত গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-শীত-বসন্ত কেটে গেছে তারপর। বিনির মেয়ে টিনা যায় এখন স্কুলে। তবে যে সে স্কুলে নয়, বিনিরই ছোটবেলার স্কুলে, ক্লাস ওয়ানে। তারপর একদিন টিনা মুখ কালো করে বাড়ি ফিরল। বিনি জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল? মন খারাপ মনে হচ্ছে?’
টিনা উত্তরে বলল, ‘আজকে আমার সব বন্ধুরা আমার সাথে আড়ি করে দিয়েছে। কেউ আমার সঙ্গে কথা বলছে না। ’
বিনি আলতো করে হেসে জবাব দিল, ‘আচ্ছা টিনা, তুই এক কাজ করিস। দো’তলার বারান্দার একদম শেষে যে জানালাটা আছে সেখানে একবার যাস। দেখবি ভাল লাগবে।’
টিনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন মা, কী আছে ওখানে?’
টিনা রহস্যময়ভাবে হেসে বলল, ‘দেখিস!
সমাপ্ত