বামাপদবাবু মিতব্যয়ী মানুষ৷ বিয়ে-থা করেননি৷ আত্মীয়-স্বজন-পুষ্যি কেউ নেই৷
দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর অঞ্চলে একটি দোতলা বাড়ির একতলায় ভাড়া থাকেন৷ একা মানুষ৷ মেসে থাকলেই সুবিধা হয়৷ কিন্তু বামাপদবাবু একটু নিরিবিলিতে নিজের মতো থাকতে ভালো-বাসেন৷ লোকের সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেঁষি তাঁর মোটেই পছন্দ নয়৷
বামাপদবাবুর ফ্ল্যাটটা ছোট হলেও ছিমছাম৷ একটা বসার ঘর, এক টুকরো খাবার জায়গা, রান্নাঘর আর শোবার ঘর৷ ঢোকার মুখে একটা ছোট গ্রিলে ঘেরা বারান্দাও আছে৷ একা মানুষ৷ এর বেশি কিছু দরকারও হয় না৷ গত দশ বছর এই বাড়িতে আছেন বামাপদবাবু৷ এরমধ্যে শুধু একবার পর্দা বদলানো ছাড়া আর কোনও পরিবর্তন আশপাশের লোকের চোখে পড়েনি৷ তেমন কোনও গণ্ডগোল না হলে আগামী দশ বছরেও বিশেষ কিছু বদল হবে বলে বামাপদবাবু নিজে অন্তত মনে করেন না৷ তাঁর বাড়িওলারও একই মত৷ এমন নির্ঝঞ্ঝাট ভাড়াটে তো আর সহজে পাওয়া যায় না৷ বছর তিনেক অন্তর শুধু একবার ঘরের কলি ফিরিয়ে দিতে হয়৷ এ ছাড়া আর কোনও চাহিদা নেই৷ অথচ মাস পয়লা ভাড়াটি ঠিক আসে৷ দু-বছর অন্তর ভাড়া কিছুটা বাড়ে৷ তাতেও কখনও আপত্তি হয় না বামাপদবাবুর৷ সকালে বেরিয়ে যান, সন্ধেয় ফেরেন৷ তাই জল-কল নিয়েও কোনও সমস্যা নেই৷
সরকারি অফিসে আপার ডিভিশন ক্লার্কের চাকরি করেন বামাপদবাবু৷ মাইনে-কড়ি খারাপ নয়৷ অন্তত একা মানুষের পক্ষে তো বেশ ভালোই৷ শখ-শৌখিনতাও মোটেই নেই৷ তাই মাসের শেষে হাতে কিছু জমেও৷ বামাপদবাবু নিজে মনে করেন সেটা জরুরি৷ কারণ বিপদে পড়লে কিংবা অসুস্থ হলে টাকাই তো তাঁর ভরসা৷ যদিও গত দশবছরে তাঁর একবারের জন্য মাথাব্যথাও হয়নি৷ তবু মানুষের শরীর তো৷ কখন খারাপ হবে বলা কী আর যায়!
এমনিতে বামাপদবাবুর জীবন একদম নির্দিষ্ট রুটিনে বাঁধা৷ রান্নাবান্না আর ঘরের অন্যান্য কাজকর্মের জন্য একটি মহিলা আছে৷ সে সকালে এসে বেল বাজালে তাঁর দিন শুরু হয়৷ প্রথমেই এক কাপ চা, সঙ্গে খবরের কাগজ৷ তারপর দাড়ি কামিয়ে, স্নান সেরে অফিসের জন্য তৈরি হওয়া৷ ততক্ষণে ওই মেয়েটি দু-বেলার রান্না সেরে, ঘরদোর পরিষ্কার, কাচাকুচি করে নেয়৷ বামাপদবাবুর খাওয়া হয়ে গেলে বাসনপত্রও ধুয়ে ফেলে৷ তারপর রাতের খাবার ফ্রিজে তুলে, বাড়ি তালাবন্ধ করে বেরিয়ে পড়েন৷ অফিসে টিফিন সারেন দুটি মাখন টোস্ট, একটি ডিমসেদ্ধ আর একটি কলা দিয়ে৷ সেগুলো অফিসের বেয়ারাই এনে দেয়৷ পাঁচটা নাগাদ কাজকর্ম শেষ করে অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ি৷ সন্ধেটা আর এক কাপ চা, সকালের বাসি খবরের কাগজ আর টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে দিব্যি কেটে যায়৷ দশটায় রাতের খাওয়া সেরে সোজা বিছানায়৷ বন্ধু-বান্ধব তাঁর নেই৷ আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না৷
এহেন বামাপদবাবুর কিন্তু একটা অদ্ভুত অভ্যাস আছে৷ প্রায় প্রতি রবিবার সকালেই তিনি পার্ক স্ট্রিটের অকশন হাউসে যান৷ কলকাতা শহরটা ইদানীং অনেক বদলে গেছে৷ বড় বড় শপিং মল, উড়ালপুল, তিন থাকের আলো, ডিস্কো থেক, সব মিলিয়ে একটা বেশ ঝাঁ-চকচকে ব্যাপার৷ কিন্তু তার মধ্যেও সাহেবপাড়া পার্ক স্ট্রিটে টিমটিম করে টিঁকে আছে কয়েকটা নিলামঘর৷ পুরোনো জিনিসে ভর্তি৷ কিছু প্রায় নতুন কিছু আবার প্রায় ব্যবহারের অযোগ্য৷ প্রতি রবিবার সকালে নিলাম হয়৷ সস্তায় পুরোনো জিনিস কিনতে লোকজন আসে৷ অনেকে আবার আসে পুরোনো শৌখিন জিনিসের সন্ধানে৷ বামাপবাবুর অবশ্য শৌখিনতার বালাই নেই৷ আর কাজের জিনিসের খোঁজে যে যান তাও নয়৷ আসলে নিলামঘরের পুরোনো জিনিস, রং আর ধুলোর গন্ধ, হাঁকডাক সব মিলিয়ে তাঁর বেশ লাগে৷ সিনেমা-থিয়েটার দেখতে তিনি ভালোবাসেন না৷ টিভিতে সিরিয়াল দেখেন না৷ বই পড়ার নেশাও নেই৷ রবিবার সকালে রুটি আর আলুচচচড়ি খেয়ে বেরিয়ে পড়েন৷ নিলামঘরে ঘুরঘুর করে, এক কাপ ভাঁড়ের চা খেয়ে দুপুর-দুপুর বাড়ি ফিরে যান৷
তবে নিয়মিত না হলেও নিলামঘর থেকে বামাপদবাবু একদম কিছু কেনেননি তাও কিন্তু নয়৷ তাঁর বসার ঘরে সস্তার বেতের সোফাসেটের সঙ্গে রয়েছে একটি কারুকাজ করা কাঠের টেবিল৷ একটা পায়া খানিকটা ভাঙা ছিল বলে টেবিলটা বিক্রি হয়নি৷ বামাপদবাবু জলের দরে সেটিকে কিনে, পায়ার নীচে ইট বসিয়ে দিব্যি কাজ চালাচ্ছেন৷ তাঁর রান্নাঘরে একটু ভারী সুন্দর কারুকাজ করা চিনামাটির টি-পটও আছে৷ ঢাকনা হারিয়ে গেছে বলে সেটিও অনাদরে নিলামঘরে পড়েছিল৷ বামাপদবাবু নিয়ে এসেছেন এবং ঢাকনা সমস্যার সমাধানও করেছেন৷ পটে চা-পাতা আর গরম জল দিয়ে মুখটা একটা বাটি বসিয়ে ঢেকে দেন৷ তাহলেই আর চা তৈরিতে কোনও সমস্যা নেই৷ শুধু কাপে ঢালার সময় একটু সতর্ক থাকতে হয়৷
অভ্যাসমতো সেই রবিবারেও নিলামঘরে এসেছিলেন বামাপদবাবু৷ বর্ষা শেষ হয়ে গেছে৷ কিন্তু আকাশটা মেঘলা মেঘলা৷ বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় একবার ভাবলেন ছাতাটা নিয়ে বেরোবেন৷ কিন্তু তারপরেই মনে হল, শরৎকালের বৃষ্টি তো৷ হলেও এক পশলা ঝরেই থেমে যাবে৷ সেটুকু সময় রাস্তায় থাকলে কোথাও দাঁড়িয়ে নিলেই হবে৷
নিলামঘরে সেদিন ভিড় নেই তেমন৷ মাসের শেষ৷ তাই খদ্দেরও কম৷ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে টুকটাক জিনিসপত্র রাখা আছে৷ বামাপদবাবুকে অবশ্য দোকানের সবাই চেনে৷ তিনি যে কিছু কিনবেন না তাও সবাই জানে৷ তাই তাঁকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না৷ তিনি নিজের মনে ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র দেখতে থাকেন৷ নীলামের ডাক তখনও শুরু হয়নি৷ জিনিসপত্র গোছগাছ চলছে৷ এই সময় হঠাৎ বামাপদবাবুর চোখে পড়ল একটা ছবি৷ ব্রাউন রঙের ফ্রেমে বাঁধানো৷ বোঝাই যাচ্ছে পুরোনো ফ্রেমটাকে খুলে পালিশ করা হয়েছে৷ জলরঙে আঁকা ছবি৷ বেশ ভালো ওয়াশের কাজ৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটা বড় গাছ, যার তলাটা বাঁধানো৷ সেখানে বসে আছে একটা বুড়ো মতো লোক৷ পোশাক-পরিচ্ছদ আর দেহের গঠনেই স্পষ্ট যে লোকটি বেশ হোমরা-চোমরা মোড়ল জাতীয়৷ পাশেই একটা থালায় অনেক মিষ্টি রাখা৷ বুড়োর ঠিক সামনে একটা ঢাকা দেওয়া মস্ত জালা৷ তার ওপর জল দেওয়ার ঘটি লাগানো হাতা৷ বুড়োর পায়ের কাছে একটা কুকুর কিছু খাচ্ছে৷ একটু দূরে দুটো বাচ্চা খেলছে আর দুজন খুব করুণ মুখে হ্যাংলার মতো মিষ্টির দিকে তাকিয়ে বসে আছে৷
ছবিটা খুব মন দিয়ে দেখলেন বামাপদবাবু৷ তাঁর কেবলই মনে হচ্ছিল ছবিটার মধ্যে যেন একটা গল্প আছে৷ কিন্তু ছবির মানুষগুলো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে বলে গল্পটা পুরো জানা যাচ্ছে না৷ বামাপদবাবু বেশ বুঝতে পারছিলেন যে তাঁর খুব ইচ্ছে করছে গল্পটা পুরোটা জানতে৷ অথচ এটা যে বেশ বে-আক্কেলে ইচ্ছে তাও তিনি ভালোমতো জানেন৷ কারণ ছবির মানুষগুলো তো আর কোনওদিনই নড়েচড়ে গল্পের শেষটা তাঁকে বলে দেবে না৷ কিন্তু তবু নিজের ইচ্ছেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না তিনি৷
বামাপদবাবু খেয়াল করলেন ছবির গায়ে দামের টিকিট ঝুলছে৷ তার মানে আজ এটা নীলামে উঠবে৷ একটু পরেই ডাক শুরু হল৷ এই প্রথম বামাপদবাবু বেশ একটু দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগলেন৷ তাঁর ভয় লাগছিল এই বুঝি ছবিটা কেউ কিনে নিল৷ এই বুঝি ছবিটার দাম সাংঘাতিক চড়ে গিয়ে নাগালের বাইরে চলে গেল৷ যদিও কেন এমন হচ্ছে সেটা তিনি নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না৷
কিন্তু ছবিটা তেমন কোনও বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা নয়৷ যিনি এঁকেছেন তাঁর আঁকার হাত অকল্পনীয় কিছু নয়৷ তাই ছবিটার প্রতি খদ্দেরদের কোনও আগ্রহ ছিল না৷ নীলামের শেষদিকে তাই কোনও ডাকাডাকি ছাড়াই বামাপদবাবু কড়কড়ে পাঁচশো টাকা দিয়ে ছবিটা কিনে ফেললেন৷ তারপর ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরতে হল৷ কারণ ততক্ষণে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে৷ জলে ভিজে ছবিটা পাছে নষ্ট হয়ে যায়, সেই ভয়ে ট্যাক্সিতে উঠেই কাচ তুলে দিলেন বামাপদবাবু৷ বৃষ্টির জন্য রাস্তায় জ্যামও হয়েছিল৷ ট্যাক্সি ভাড়া লাগল প্রায় দেড়শো টাকা৷ সব মিলিয়ে সাড়ে ছশো টাকা সম্পূর্ণ বেহিসাবি খরচ৷ এমনিতে এরকম খরচ করার কথা বামাপদবাবু ভাবতেই পারেন না৷ কিন্তু আজ এতগুলো টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ছবিটা যে শেষ পর্যন্ত বাড়ি আনতে পেরেছেন সেজন্য তাঁর মনটা বেশ খুশি খুশি লাগছিল৷
ছবিটা বামাপদবাবু টাঙিয়েছেন তাঁর শোবার ঘরে৷ ঠিক বিছানার পাশের খালি দেওয়ালের মাঝখানে৷ ঘুম থেকে উঠেই তাই ছবিটার দিকে চোখ যায় তাঁর৷ ঘুমোতে যাওয়ার সময়ও চোখ এড়ানোর জো নেই৷ এমনকী মাঝরাতে ঘুম ভাঙলেও উল্টোদিকের জানলা দিয়ে এসে পড়া রাস্তার আলোয় দিব্যি চোখে পড়ে ছবিটা৷ বামাপদবাবু অবশ্য সারাদিনে অনেকবারই ছবিটা দেখেন৷ ইদানীং তো অফিস থেকে ফিরে অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে ছবিটা দেখা তাঁর প্রায় অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে৷
ছবিটা বাড়িতে নিয়ে আসার ঠিক এক সপ্তাহ পরে বামাপদবাবু একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন৷ একটা গ্রামের রাস্তা৷ দু-ধারে চাষের খেত৷ একটু দূরে দূরে কুঁড়েঘর দেখা যাচ্ছে৷ রাস্তা দিয়ে হনহন করে হেঁটে আসছেন একজন বুড়োমতো লোক৷ জামাকাপড় আর ভাবভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় যে তিনি গ্রামের মোড়ল ধরনের কেউ৷ এমন সময় দেখা গেল উল্টোদিক থেকে চার-পাঁচজন ছেলে-মেয়ের একটা দল আসছে৷ নিজেদের মধ্যে হুটোপাটি করতে করতেই তারা আসছিল৷ কিন্তু বুড়োকে দেখেই থমকে গেল৷ আর বুড়োও অমনি নাকে কাপড় দিয়ে চেঁচাতে লাগলেন, অ্যাই ছোটোলোকের দল….খবরদার আমার কাছে আসবি না৷ তোদের হাওয়া গায়ে লাগলে এক্ষুনি আবার চান করতে হবে আমাকে৷ সরকার রাস্তা বানিয়ে দিয়েছে বলে সবাই তার ওপর দিয়ে চলবে নাকি! কতবার বলেছি তোরা পাকা রাস্তায় উঠবি না৷ কথা কানে যায় না তোদের?
বুড়োর চিৎকারে ভয় পেয়ে বাচ্চাগুলো নেমে গেল রাস্তার পাশের নীচু জমিতে৷ আর বুড়োও তাদের দিকে একবার আগুন চোখে তাকিয়ে ফের হনহন করে হেঁটে কোথায় যেন চলে গেলেন৷
ঘুম ভেঙে বামাপদবাবু বুঝতে পারলেন স্বপ্নটা তাঁর হারিয়ে যায়নি৷ দিব্যি স্পষ্ট মনে আছে৷ আর বারবারই মনে হচ্ছে ওই বুড়ো লোকটা যেন চেনা চেনা৷ কোথায় যেন দেখেছেন৷ রহস্যভেদ হল সন্ধেবেলা৷ অফিস থেকে ফিরে অভ্যাসমতো ছবিটা খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে বামাপদবাবু বুঝতে পারলেন স্বপ্নে দেখা বুড়ো লোকটার সঙ্গে ছবির বুড়োর বেশ মিল আছে৷
স্বপ্নটা কিন্তু বামাপদবাবুর পিছু ছাড়ল না৷ দু-দিন পরেই আবার ঘুমের মধ্যে সেই গ্রামটাকে দেখতে পেলেন তিনি৷ এবার স্বপ্নটা একটু বড়৷ বামাপদবাবু বুঝতে পারলেন দীর্ঘদিন ধরে গ্রামে বৃষ্টি হয়নি৷ খরা চলছে৷ গ্রামের লোকেরা তাই একটা পুজোর আয়োজন করতে চাইছে৷ একটা আটচালার নীচে অনেকে বসে আলোচনা করছে৷ ওই বুড়োটা গ্রামের মোড়ল৷ তিনি বসেছেন মাঝখানে৷ ওদের থেকে একটু দূরে মাটিতে উবু হয়ে বসে আছে ছেঁড়া-ময়লা জামাকাপড় পরা কয়েকটা লোক৷ দেখেই বোঝা যায় তারা হতদরিদ্র নীচু জাতের মানুষ৷ তাদের পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে আছে সেই বাচ্চা ছেলে-মেয়েগুলো৷
সেদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বামাপদবাবুর মনে হল ছবিটা যেন একটু বড় হয়ে গেছে৷ কিন্তু সে তো আর সম্ভব নয়৷ তাই ব্যাপারটাকে মনের ভুল বলেই উড়িয়ে দিলেন তিনি৷
স্বপ্নের গল্পটা এবার বামাপদবাবুকে ক্রমশ পেয়ে বসতে লাগল৷ তিনি নিজে গ্রামের ছেলে এবং নীচু জাতের৷ শহরে এখন আর জাত-পাত নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামায় না৷ কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামে নীচু জাতের মানুষকে অচ্ছুৎ করে রাখার প্রবণতা আছে৷ ছোটবেলায় তাঁকেও এজন্য অনেক অপমান, অবহেলা সহ্য করতে হয়েছে৷ অনেক কষ্টে নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা শিখে বড় হয়েছেন৷ তাই যেসব উচ্চবর্ণের মানুষের মধ্যে এরকম মানসিকতা থাকে তাদের প্রতি বামাপদবাবুর ভিতরে ভিতরে একটা রাগ আছে৷ স্বপ্নের বুড়ো কী করে জানার তাই তাঁর ভারী আগ্রহ৷
ইদানীং রোজই স্বপ্ন দেখছেন বামাপদবাবু৷ স্বপ্নের ভিতর গল্পও এগোচ্ছে প্রতিদিন৷ গ্রামের লোকেরা পুজোর আয়োজন করে ফেলেছে৷ পুজো হবে৷ যজ্ঞ হবে৷ কিন্তু পুরোহিত বলেছে তারপর পুজোর প্রসাদী মিষ্টি আর জল নিয়ে রাস্তার মোড়ে বসতে হবে মোড়লকে৷ সারাদিন উপোসী থেকে তিনি তৃষ্ণার্ত মানুষকে জলদান করবেন৷ তবেই বৃষ্টি নামবে৷
এদিকে বামাপদবাবুর রোজকার রুটিনেও ইদানীং বেশ পরিবর্তন হয়েছে৷ সকালে ঘুম থেকে উঠে স্বপ্নের সঙ্গে মিলিয়ে ছবিটাকে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে আজকাল প্রায় প্রতিদিনই তাঁর অফিসে লেট হয়ে যায়৷ কাজেও তেমন মন দিতে পারেন না৷ সারাক্ষণই মনে হয়, কতক্ষণে বাড়ি ফিরে আবার ছবিটা দেখবেন৷ ছবির আয়তনও রোজ একটু একটু করে বাড়ছে৷ ব্যাপারটা যে কাজের মেয়ে বাসন্তীরও নজরে পড়েছে সেটা সেদিন বুঝলেন বামাপদবাবু৷ ঘর মুছতে মুছতে বাসন্তী হঠাৎ বলল, ছবিটা কেমন যেন বড় বড় ঠেকছে না বাবু…….
কই না তো৷ এরকমই তো ছিল….
তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন বামাপদবাবু৷ কিন্তু তাঁর নিজের গলাটা নিজের কানেই কেমন যেন অস্বাভাবিক শোনাল৷ বাসন্তীও কেমন যেন অবাক হয়ে তাঁর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল৷
সেদিনই অফিসে তাঁর সহকর্মী অতুল হঠাৎ ইয়ার্কির সুরে বলল, কী ব্যাপার বামাপদ, আজকাল মুখে কোনও বিদেশি ক্রিম-ট্রিম লাগাচ্ছ নাকি হে? বয়স তো মনে হচ্ছে কুড়ি বছর কমে গেছে৷ চুলেও তো দেখছি রং করে ফেলেছ৷
বাড়ি ফিরে দাড়ি কামানোর আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে দেখলেন বামাপদবাবু৷ সত্যিই বয়স কমে গেছে তাঁর৷ কপালের সামনের দিকের চুল বেশ খানিকটা উঠে গেছিল৷ সেটা আবার ফিরে এসেছে৷ পাকা চুল নেই একটিও৷ কপালের ভাঁজ-টাঁজ উধাও৷ সেদিন রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে ছবিটাকে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে বামাপদবাবু বুঝলেন ছবিটা শুধু বড়ই হয়নি, বদলেও গেছে খানিকটা৷ বুড়ো লোকটা যে গাছের নীচে বসে আছে, তার পিছনে এখন বেশ খানিকটা খোলা জায়গা দেখা যাচ্ছে৷ হালকা হালকা ঝোপঝাড়ও রয়েছে৷
…………………
বামাপদবাবু অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন৷ যাওয়া সম্ভব নয়৷ তাঁর টেবিলের ড্রয়ারে প্রায় হলদে হয়ে যাওয়া একটা ছবি আছে৷ ক্লাস টেনের ফেয়ারওয়েলের ছবি৷ সেখানে আরও জনা পঁচিশেক ছেলের সঙ্গে সদ্য গোঁফ ওঠা তিনিও আছেন এক কোণে৷ তাঁর এখনকার চেহারাটা ঠিক ওরকম৷ শার্টের হাতা গুটিয়ে এখনও কোনওরকমে পরা চলছে৷ কিন্তু বয়স আর একটু কমলে লুকিয়ে বেরিয়ে পাড়ার দোকান থেকে বাচ্চাদের জামা-কাপড় কিনে আনতে হবে৷ বেড়াতে যাচ্ছেন বলে আপাতত বাসন্তীকে আসতে বারণ করেছেন৷ সে একেবারে মাস পয়লা আসবে মাইনে নিতে৷ নিজেই কোনওরকমে ভাতে-ভাত ফুটিয়ে খাচ্ছেন৷
ছবির গল্পটা প্রতি রাতের স্বপ্নেই এখন দ্রুত এগোচ্ছে৷ মোড়লের মোটেই ইচ্ছে নেই গরমের মধ্যে উপোস করে জল-মিষ্টি বিলি করার৷ কিন্তু পুরোহিত বলেছে আর কেউ কাজটা করলে ফল হবে না৷ তাই গ্রামের লোকের চাপে তাঁকে রাজি হতে হয়েছে৷ এদিকে বাচ্চাগুলো ভারী খুশি৷ তারা ঠিক করে ফেলেছে ঘণ্টায় ঘণ্টায় গিয়ে জল-মিষ্টি চাইবে৷ পুরোহিত তো বলেই দিয়েছে সেদিন কাউকে ফেরানো চলবে না৷
গল্পের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছবির আয়তনও ক্রমশ বাড়ছে৷ ছবিটা এখন প্রায় গোটা দেওয়ালটাই ঢেকে ফেলেছে৷ মোড়লের ধুতির ভাঁজ, ঠোঁটের কোণে তাচ্ছ্যিলের হাসি, দূরের বাচ্চাটার চোখের কোলে জল সবই এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷ আর তাতেই যেন ছবিটার আকর্ষণও অনেক বেড়ে গেছে৷ আজকাল কোনওরকমে স্নান-খাওয়া সেরে সারাদিনই ছবিটার সামনে বসে থাকেন বামাপদবাবু৷
অবশেষে পুরোহিতের নির্দেশ মেনে সংক্রান্তির দিন পুজো-পাঠ-যজ্ঞের পর গাছতলায় জল-মিষ্টি নিয়ে বসলেন মোড়ল৷ গ্রামের লোকজন, পথচারী অনেকেই এসে জল-মিষ্টি খেল৷ নীচু জাতের বাচ্চাগুলো কিন্তু ঘুরঘুর করছে আশপাশেই আরা মাঝে মাঝেই লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে মিষ্টিগুলোর দিকে৷ জায়গাটা একটু ফাঁকা হতে, সাহস করে গুটিগুটি এগিয়ে এল তারা৷ তাদের আসতে দেখেই মুখটা শক্ত হয়ে গেল মোড়লের৷ তারপর কীরকম যেন একটা বিচ্ছিরি করে বলল, কী রে মিষ্টি খাবি? আয় আয় এদিকে আয়….
বাচ্চাগুলো এগিয়ে আসতেই থালা থেকে মিষ্টি তুলে নিল মোড়ল৷ তারপর ছোট ছোট বাড়ানো হাতগুলোর বদলে মিষ্টিগুলো পায়ের কাছে বসে থাকা কুকুরটার মুখের সামনে ফেলে দিয়ে ভাঙা দাঁতে নিষ্ঠুর হেসে বলল, কী ভেবেছিলি, আমার হাত থেকে মিষ্টি খাবি? পুরোহিত বলেছে বলে তোদেরও জল দেব আমি! ছোটজাতের ছোঁড়াদের শখ কত! তোদের জল দিলে পুণ্যি হয় না রে, পাপ হয় পাপ….
মোড়লের কথাগুলো শুনতে শুনতে ঘুমের মধ্যেই যেন মাথায় আগুন ধরে গেল বামাপদবাবুর৷ মাথার পাশে রাখা কাচের কাগজচাপাটা তুলে সোজা ছুড়লেন মোড়লের মাথা লক্ষ্য করে৷
মাস পয়লা বেতন নিতে এসে বাসন্তীর অনেক ডাকাডাকিতেও দরজা খুললেন না বামাপদবাবু৷ শেষ পর্যন্ত পুলিশ ডাকলেন বাড়িওলা৷ কিন্তু দরজা ভেঙে দেখা গেল ঘরে কেউ নেই৷ শুধু শোবার ঘরের দেওয়াল জোড়া একটা মস্ত ছবি৷ তাতে একটা বটগাছের নীচে উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটা বুড়ো লোক৷ মাথা থেকে রক্ত পড়ছে৷ তার সামনে রাখা থালা থেকে মিষ্টি তুলে খাচ্ছে কতগুলো বাচ্চা ছেলে-মেয়ে৷
বাসন্তী বলার চেষ্টা করছিল যে এই ছবিটা নাকি আগে অনেক ছোট ছিল আর দেখতেও অন্যরকম ছিল৷ কিন্তু তার কথায় কেউ পাত্তা দেয়নি৷ বামাপদবাবু কোথায় গেলেন? কোনও চিঠিপত্র রেখে গেছেন কিনা, এসব খুঁজতেই ব্যস্ত ছিল সবাই৷ কেউ খেয়ালও করেনি ছবিতে বুড়োর পিছনে, ঝোপের পাশে একটা বাচ্চা ছেলে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তার রাগি মুখটার সঙ্গে, টেবিলের ওপর বামাপদবাবুর পারিবারিক ছবি, যেখানে বাবার হাঁটুতে হাত রেখে দশ বছরের বামাপদবাবু বসে আছেন তার চেহারার অদ্ভুত মিল৷
—