বাপ রে বাপ!
শুভ বুধবার দিনে, বিকেলবেলায়, অশ্লেষা নয়, মঘা নয়, ত্র্যহস্পর্শ নয়, সোমেশবাবু হঠাৎ উধাও হয়ে গেলেন। রহস্যঘন অন্তর্ধান। ইন্দ্রাণী খোঁজ করতে করতে প্রায় পাগল। জানা গেল অফিসে নাকি তিন মাসের ছুটি নিয়েছেন। মেডিক্যাল লীভ। অথচ ওঁকে কেউ অসুস্থ দেখেনি। বেশ ফূর্তিতে ছিলেন ছুটি নেবার সময়ে। বেরোনোর পথে স্টেনো মেয়ে জেনিফারের চুল টেনে দিয়ে গেছেন। অফিস থেকে বেরিয়ে প্রথমেই একটা মিঠে পান খেয়েছেন—তারপর কোনদিকে যে গেছেন সেটা আর কেউ বলতে পারছেন না। অফিসের গাড়ি নেননি। বাড়িতে একটা হেঁয়ালি চিঠি লিখে গেছেন—”ইন্দ্রাণী আই হ্যাড নো চয়েস। এক্সক্যুজ মি—ক্যে সেরা সেরা— হোয়াট উইল বি উইল বি, দ্য ফিউচার’স নট আওয়ার্স টু সী”—আর ডায়েরিতে গোটা গোটা হরফে লিখে গেছেন—উৎকণ্ঠ আমার লাগি যদি কেহ প্রতীক্ষিয়া থাকে, সেই ধন্য করিবে আমারে। আর অফিসের ড্রয়ারে ঠিক জহরলাল নেহরুর মত করে প্যাডের পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে লিখে রেখেছেন—‘The woods are lovely, dark and deep. But I have promises to keep, and miles to go before I leap.’ শেষ শব্দটা ভুল লিখেছেন ; সেটা নিয়েও ইন্দ্রাণী অত্যন্ত চিন্তিত। ব্যাংকে ইনস্ট্রাকশন দিয়ে গেছেন। ড্রয়ারে জয়েন্ট এ্যকাউন্টের চেক বই পাশবই রেখে গেছেন। ছুটির মাইনে নেবার জন্য তিনটি অথরিটি পত্র সই—করা। সঙ্গে আরেকটি খাম—ওপরে লেখা—ফর ক্যালকাটা পুলিশ—ভিতরে নোট—”প্লীজ ডু নট লুক ফর মি। রাদার লুক আফটার মাই ফ্যামিলি। আই’ল বি ব্যাক ইন টাইম।” পুলিশে ইন্দ্রাণীর দাদা কাজ করেন—তিনি গম্ভীর মুখে নোটটি নিয়ে পকেটে পুরেছেন। তারপর অফিসের ডিরেক্টর ঘোষদা, চৌহান আর রনু ব্যানার্জীর সঙ্গে ইন্দ্রাণীর দাদার একটা পরামর্শ সভা হয়েছে। মাস ঘুরতে চলল পুলিশ কিছুই মীমাংসা করতে পারছে না। আপন বড় সম্বন্ধী থাকা সত্ত্বেও? ইন্দ্রাণী দাদাকে যাচ্ছেতাই করছেন। দাদা কেবলই বলেন—’চেষ্টা তো করছি রে। খোঁজ তো করছি রে! এখন তোর কপাল আর আমার হাতযশ!’
তা, দুটোর কোনোটাই বিশেষ কাজে দিচ্ছে না। দু’মাস হয়ে গেছে।
ইন্দ্রাণী এখন কেবলই ভাবেন আর হা—হুতাশ করেন আহা তখন মতটা দিলেই হোতো। তবু ঘরেই থাকতো লোকটা। অত করে হাতে পায়ে ধরে বললেও, ইন্দ্রাণী কিছুতেই রাজী হতে পারেননি। ওঃ, কী বোকামিই হয়েছে। সোমেশ যাই বলুন, ইন্দ্রাণী কেবলই হাউ মাউ করে কেঁদেছেন, আর বলেছেন—’ওরে বাপ রে! সে কি হয়—মা বাবা কী ভাববেন!—বান্টু, মিন্টু, সন্টুর কী হবে?—পাড়ার লোকে কী বলবে?—না, না, না, খবরদার না! এ কী সব্বোনেশে কথা—জম্মেও শুনিনি—ছিঃ’—
সোমেশ একের পর এক বই এনে রাত জেগে পড়েন আর একটা বই শেষ হলেই ইন্দ্রাণীকে পড়ানোর চেষ্টা করেন—পঁচিশ বছরে জগতে কতোবারই তো এমনটি হয়েছে! এই ভারতবর্ষেই কি হয়নি? ‘এই তো বম্বেতেই ফ্যারা রুস্তম আছে’—
একটা করে বই এনে সোমেশ ইন্দ্রাণীকে দেন, আর ইন্দ্রাণী টান মেরে সেই বইটি তক্ষুনি জানলা গলিয়ে ফেলে দেন। বই গিয়ে সোজা পড়ে পাশের বাড়ির সদ্য খোঁড়া গর্তের ক্ষেতে। সোমেশ ডাকেন—
‘বান্টু—মিন্টু—সন্টু।’
—’যাই বাবা!’
—’পাশের বাডির বাগানে একবার যাও তো।’
—’এক্ষুনি নিয়ে আসছি বাবা!’
সোমেশ কাদা ঝেড়েঝুড়ে বই আবার তাকে তোলেন। ইন্দ্রাণী কিছুতেই পড়তেন না।
—’না, না, না—ওসব কেলেঙ্কারি কাণ্ড আমি কিছুতেই হতে দেব না—মরে গেলেও না। না, না, না।’
সোমেশবাবু কত বুঝিয়েছেন—’তোমার বাবা—মার ভাবনার কী আছে? তাঁদের মেয়ে তো জলে পড়বে না? আমরা যেমন আছি তেমনই তো থাকবো? আর পাড়ার লোকে যা খুশি বলুক, ক্ষতি নেই, দু’দিন বাদে পরিবর্তন আসছে না। তাদের ছেলেমেয়ের জীবনে তো কোনও মৌলিক পরিবর্তন আসছে না। তাদের যত্নআত্তি দেখাশুনো শিক্ষাদীক্ষা সবই যেমনকে তেমনই থাকবে তো। ক্ষতি যদি জগতে কারুর হয় ইন্দু, সে কেবল তোমারই! তা আমার জন্য এইটুকু স্যাক্রিফাইস করতে পারবে না? সতী—সাবিত্রীর দেশের মেয়ে তুমি, স্ত্রীরা এখানে স্বামীর জন্যে কী না করেছে?’
—’যে যাই করুক। এমনধারা অন্যায় আব্দার তো বাবা কস্মিনকালেও শুনিনি। না, ওতে মত দিতে পারবো না—না, না!’ ইন্দ্রাণীর সেই এক জেদ।
—”প্লীজ ইন্দু, দেখতে পাচ্ছ না, কী রকম বকচ্ছপ মূর্তি হচ্ছে তোমার স্বামীর! গেঞ্জি পরে লোকের সামনে বেরুতে পারি না, সাঁতারের ক্লাবে যাওয়া তো কবেই বন্ধ হয়েছে—একবার হ্যাঁ বল, লক্ষীটি, বুঝতে পারছো না কী কষ্ট আমার?’
হ্যাঁ এইবারে বুঝতে পারছেন বটে ইন্দ্রাণী। তখন বোঝেন নি। দু’য়ে দু’য়ে চার দিব্যি মিলে যাচ্ছে এতদিনে।
চিরকালই সোমেশের চেহারায় সেই মেয়েলি মিষ্টতাটা আছে, ‘লালিমা পাল (পুং)’ গোছের একটা লাবণ্য, যাকে বলে লালিত্য। আবার স্বভাবেও ইদানীং কেমন কেন একটা বিতিকিচ্ছিরি ভাব দেখা দিয়েছিল, ‘দিন দিন যেন পদিপিসি টাইপের স্বভাব হচ্ছে তোমার’—গাল দিচ্ছিলেন স্বামীকে ইন্দ্রাণী। একেই তো ডাঁটাচচ্চড়ি খেতে ভয়ানক লোভ হয়েছিল, প্লেটের পাশে ডাঁটা চিবিয়ে পাহাড় করছিলেন, শরৎচন্দ্রের স্ত্রী চরিত্ররা যেমন করে থাকেন, যার জন্যে মাঝেমাঝে অফিসে দেরিও হয়ে যাচ্ছিল তাঁর—আর তার চেয়েও ভয়ংকর কথা, বাড়িতে মেয়েরা এলেই আর রক্ষে নেই! অমনি সোমেশবাবু এসে হামলে পড়বেন, ‘বাঃ, বাঃ, কী শাড়ি এটা; অ্যাঁ? মিসেস গুলাটি? দেখি! দেখি! অর্গানজা প্রিন্ট বুঝি? দারুণ তো?’—কিম্বা—’আরে? বালাজোড়া কবে গড়ালেন মিসেস রয়? আগে দেখিনি তো? দারুণ কাজটা করেছে কিন্তু! ক’ভরি সোনায় হলো?’ ইন্দ্রাণীর গা জ্বলে যেত স্বামীর এই মেয়েলিপনায়। গলার স্বরটি তো ঠিক মুখশ্রীর মতনই মধুমাখা, ইদানীং যেন আরো মিষ্টি হচ্ছিল, ফোনে মাঝেমাঝে ওঁকে ওঁদের রিসেপশনিস্ট জেনিফারের সঙ্গে গোলমাল করে ফেলেছেন ইন্দ্রাণী। এ ছাড়া ইদানীং যে কথায় কথায় চোখে জল এসে যাচ্ছিল সোমেশবাবুর, সে ব্যাপারে তো বাড়িসুদ্ধ সকলেরই নজরে পড়ছে।
ভয়ংকর আপশোস হতে থাকে ইন্দ্রাণীর। ইন্দ্রাণী কিছুতেই রক্ত পরীক্ষা করানোর পাগলামিতে সায় দেন নি। সোমেশ ক্ষেপে উঠেছিলেন নিজের রক্তের ক্রোমোজোম টেস্ট করাতে। প্রায়ই খবরের কাগজ পড়তে পড়তে মার্জিনে লিখে ফেলতেন X+YY+YX+X! ইন্দ্রাণী বলতেন, ‘তোমার নতুন করে কিসের এতো প্রমাণ দরকার? বান্টি—মিন্টু—সন্টু তো ঘুরে বেড়াচ্ছে জগত সমক্ষে—’ কিন্তু সোমেশের তাতে শান্তি ছিল না।
—’ওটা তো অতীত। আমি জানতে চাই ভবিষ্যতের কথাটা—’
—’তবে জ্যোতিষীর কাছে চলো।’
—’জ্যোতিষ নয় ডাক্তার। ইন্দু, ডাক্তার! আমাকে জানতেই হবে—বুঝতে পারছো না, এটা তো ইচ্ছাকৃত ঘটনা নয়, যা ঘটে যাচ্ছে, যা ঘটতে চলেছে—বি সায়েনটিফিক—’
ভেবে ভেবে ইন্দ্রাণীর বুক ফেটে যাচ্ছে। ‘সত্যিই তো ওঁর এতে হাত ছিল না। ভগবানের মার। কেন যে তখন ইন্দ্রাণী রাজী হলেন না? ‘কেন যে মত না দিয়ে গোঁয়ারের মতন জেদ ধরে রইলুম! এতো বড় সর্বনাশটা আর হতো না তা হলে!’ এই দু’ নৌকোয় পা রেখে চলা সইতে না পেরে, হয় হিমালয়েই চলে গেছেন, নয়ত আত্মঘাতী হয়েছেন, সোমেশবাবু। হিমালয়ের সম্ভাবনাটা কম নয়, কেননা বুটজোড়া, ওভারকোট আর দস্তানাগুলোও পাওয়া যাচ্ছে না। চিন্তায় চিন্তায় আর কান্নায়—কান্নায়ই বোধহয় অসময় চোখে চালশে চশমা হয়ে গেল ইন্দ্রাণীর। তিন মাস হয়ে ঘুরতে চলল, সোমেশের খোঁজ নেই। ক্রমশ তিনি পাশের বাড়ির গাজর ক্ষেতের মাটিকাদামাখা বইগুলো তাক থেকে নামিয়ে আঁচল দিয়ে ঝেড়েমুছে পড়তে শুরু করলেন—ক্রিস্টিন জর্গেনসেন—এর আত্মজীবনী, ক্যান মরিসের আত্মকথা, ফ্যারা রুস্তমের বিবরণী—পড়তে পড়তে প্রায় স্থির করে ফেলেছেন, দাদার সঙ্গে পরামর্শ করে কাগজে বিজ্ঞাপন দেবেন,—’ সোমেশ কাম ব্যাক। ব্লাড টেস্টিং পারমিটেড; এমন সময়ে একটা টেলিগ্রাম এল—’সোমেশ চৌধুরী এক্সপায়ার্ড থ্রি মান্থস এগো অ্যাট ডক্টর চেঞ্জিংকরস নার্সিংহোম—সোনা।’
ইন্দ্রাণী ধড়াস করে আছাড় খেয়ে পড়লেন সোফার উপরে। তারপরে শুরু হলো হাহাকার—সে কি আছাড়ি পিছাড়ি কান্না—হরিদাসী গঙ্গাঠাকুর হার মেনে গেল; ডাক্তারবাবু এসে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে অজ্ঞান করে ফেললেন, তবে নিশ্চিন্তি। অজ্ঞান হবার আগে ইন্দ্রাণী কেবল বলতে পারলেন, ‘ঐ সোমাটা আবার কে?’
জ্ঞান ফিরতে ইন্দ্রাণী চোখ মেলেই দেখলেন পাশের খাটে তার ফ্যাশনেবল ছোট ননদ শুয়ে শুয়ে ‘ফেমিনা’ পড়ছে। সোহিনী এয়ারহোসটেস, থাকে প্রধানত বম্বেতে। মাঝে মাঝে হুট হাট করে চলেও আসে কলকাতাতে, হিল্লিদিল্লি ঘুরতে ঘুরতে। ইন্দ্রাণী খুশি হয়ে বলেন, ‘তুই এখানে? কবে এলি?’
প্লাক করা ভুরুর ধনুক বেঁকিয়ে নীল রঙ করা চোখের পাতা কাঁপিয়ে ভ্রমরকালো পল্লবের ছায়ায় তিরস্কার ঘনিয়ে এনে সুন্দরী ননদ বললে, ‘ছিঃ ইন্দু, ‘তুই’ বলে না! যাঃ!’
—’আরেঃ! তুমি!’ ইন্দ্রাণী তো হাঁ।
অভিমানে মুচকি হেসে সোমেশ বলল ঠোঁট ফুলিয়ে, ‘আ—হা! আমি না তো আবার কে?’ সে হাসিতে তার ঠোঁটের শকিং পিংক লিপস্টিক থিরথিরিয়ে কেঁপে উঠলো। কেঁপে উঠলো ইন্দ্রাণীর বুকও। এ কে? সরু ভুরুর মাঝখানে নীল টিপ, শ্যাম্পু করা বয়জ—কাট চুল কপালে উড়ে পড়ছে, দু হাতের দশটা নোখে ম্যাচিং শকিং পিংক নেল পলিশ, সেই আঙুল দিয়ে খুব ডেলিকেটলি ”ফেমিনা”টা ধরে আছেন সোমেশবাবু। পাশের বেডসাইড টেবিলে লম্বা গেলাশে কুয়াশা অরেঞ্জ স্কোয়াশ। কপালের উড়ো চুল আস্তে করে সরিয়ে সোমেশ বললেন, ‘কেমন দেখছো? আমার নাম এখন সোমা।’
—’তাই বলো! তুমিই সোমা। আর আমি ভাবছি—’ ইন্দ্রাণীর ভয়টা কেটে গেছে। বাঃ। বেশ তো? তেমন তো কিছু নয়। রাস্তায় হাত—তালি দিয়ে ঢোল বাজিয়ে নাচগান করে বেড়ায় যারা, তাদের মতন তো একটুও দেখাচ্ছে না সোমেশকে? ঠিক সোহিনীর মতো দেখাচ্ছে, যে ছোট ননদটিকে ইন্দ্রাণীর খুবই পছন্দ।
চিরদিনকার মেয়েলি সোমেশ এখন পরমাসুন্দরী হয়ে উঠেছেন। নীল নাইলনের ট্রান্সপ্যারেন্ট নাইটির তলায় সোমেশের ভাইট্যাল স্ট্যাটিসটিকস দেখে তিন ছেলেমেয়ের মা ইন্দ্রাণী রীতিমতো লজ্জা পেলেন। রূপসী বলেও ইন্দ্রাণীর খ্যাতি সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তিনিও ঠিক এতটা রূপসী নন। ইশ কী সরু কোমর! যেন মাছিটি। ঈশ কী ফিগার! অনায়াসে যে কোনো বিউটি কনটেস্টে নামতে পারবেন সোমেশ। বয়স কুড়ি বছর কমে গেছে। ইন্দ্রাণীর রীতিমতো ঈর্ষাই হয়। রাগী গলায় বলে ওঠেন, ‘ছিলে কোথায় এ্যাদ্দিন, শুনি?’
—’কেন টেলিগ্রামেই তো জানিয়েছি। ডক্টর চেঞ্জিংকর—এর নার্সিংহোম। সেখানে কেবল অপারেশনই হয় না, আফটার—কেয়ার ক্লাসেসও হয়, বড় বড় বিউটিশিয়নরা এসে আমাকে চলতে, ফিরতে, বলতে, কইতে, সাজতে, গুজতে শিক্ষা দিয়েছেন। আমাকে কেমন লাগছে? ভালো না? মাত্র তিন মাসে?’
ইন্দ্রাণী এ কথাটার উত্তর না দিয়ে বললেন—’তারপর?’
—’তারপর মানে?’
—’কী করবে ভাবছো এবার? বোনের মতন উড়োজাহাজের গিন্নিপনা? নাকি তেল সাবানের বিজ্ঞাপন?’
—’দূর দূর। এ বয়সে ওসব কি আর হয় গো? আমার লীভও তো শেষ। সোমবারই জয়েন করতে হবে।’
—’তার মানে?’
—মানে তিন মাসের ছুটিতে গেছলুম। ছুটি ফুরিয়েছে, আবার অফিস যেতে হবে। পুনর্মূষিকো!’
—’মানে, ওই চাকরিতেই—?’
—’হ্যাঁ, ওই চাকরিতেই তো। চাকরি বদলানোর কোনো কারণ আছে কি? ইন্ডিয়ান কনস্টিট্যুশানে স্ত্রীপুরুষের ইকোয়াল রাইট এসব ক্ষেত্রে।’
ইন্দ্রাণী চমৎকৃত হলো।
সত্যিই তো। মেয়েমানুষ যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারে, তবে কোনো অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সির একজন সিনিয়র একজিকিউটিভ মেয়ে হয়ে গেলেই বা কার কী? বরং যা চেহারা খুলেছে সোমেশের তাতে একটা লিফটই উল্টে পাওনা হওয়া উচিত। পাবলিক রিলেশনস অফিসারের কাজে এফিসিয়েন্সি বাড়বে বই কমবে বলে তো মনে হচ্ছে না। মনে মনে ভরসা পেয়ে আদুরে গলায় ইন্দ্রাণী বলেন, ‘হ্যাঁ গো, তোমাকে আমি কী বলে ডাকবো তবে এবার থেকে?’
‘কেন? যা বললে এক্ষুনি, তাই বলবে। অবিশ্যি সোমাও বলতে পারো।’ গালে টোল ফেলে হাসলেন সোমেশবাবু। ইন্দ্রাণীর অতিপরিচিত অতিপ্রিয় সেই পুরনো হাসি, শকিং পিংক লিপস্টিকের রেশমী চাদর মোড়া হয়ে কেমন যেন অচেনা দেখাল।
‘তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কিছুই বদলাবে না ইন্দু, ভয় পেও না তুমি—’ হাসলেন সোমা চৌধুরী, ‘আসলে প্রবলেম অন্যত্র। প্রবলেম হবে লীগ্যালি সেকশুয়াল আইডেনটিটি চেঞ্জ করবার সব হ্যাপা পোয়ানো। চাকরিতে, পাসপোর্টে—সর্বত্র নাম বদল, তারপর আগেকার সব সার্টিফিকেটগুলিতে কোর্ট এ্যাফিডেভিট করো—নতুন সিগনেচার করো—চল্লিশ বছরের আইডেনটিটি হঠাৎ বদল করা কি সহজ? উঃ, মা গো!’
—’আমি কি এখন তবে মিসেস সোমা চৌধুরী? মেয়েতে মেয়েতে বিয়ে কি এদেশে আইনসিদ্ধ হয়?’ ইন্দ্রাণীর প্রশ্নে সোমেশের মুখের হাসি শুকিয়ে গেল।
—’বোধহয় তুমি আমাকে ডিভোর্স করতে পারো এই গ্রাউন্ডে কিন্তু সেটা কমপালসরি কিনা সে খোঁজটা নেওয়া হয়নি। ইন্দু, আমাকে তুমি ছেড়ে যাবে না তো ভাই?’ সোমেশের মিঠে সরু গলায় আন্তরিক উদ্বেগ ছলছলাৎ করছে দেখে ইন্দ্রাণীর ধড়ে প্রাণ এলো। যাক প্রাণের টানটা আছে তাহলে। ‘বান্টি—মিন্টু—সন্টু কই?’—সোমেশ প্রশ্ন করেন।
ছেলেমেয়েগুলোকে মামাবাড়িতে নিয়ে গিয়েছে শনি—রবিবারের ছুটিতে। ইন্দ্রাণীর বৃদ্ধ বাবা মাকে সান্ত্বনা দিতেই গেছে তারা, এমন বললেও খুব ভুল হবে না।
‘ট্রাঙ্ককল করতে হবে না, সোমবারই তারা এসে পড়বে। বোলপুর গেছে।’ মনের ভেতরে হালকা একটা বাতাস বয়ে গেল ইন্দ্রাণীর। যাক!
—’তোমার মা—বাবার শরীর ভালো তো? বাবার ছানি কাটার কি হলো?’
আঃ! আরেকবার আরাম পেলেন ইন্দ্রাণী। পারিবারিক দায়িত্ববোধটোধগুলোও সব ঠিকঠাক আছে।
—’কাটাবেন এবারে। তোমার জন্য ভেবে ভেবে দুটো ছানিই পেকে উঠেছে। অমন করে পালাতে হয়?’
—’তা হ’লে তো উপকারই হয়েছে বলতে হবে।’ কনুই দিয়ে ইন্দ্রাণীকে একটা মেয়েলি ধাক্কা দিয়ে মুচকি হাসলেন সোমেশ।
সোমবার দিনে নতুন নামে অফিসে জয়েন করলেন মজ সোমা চৌধুরী। মিস কিংবা মিসেস কিছুই লেখবার দরকার নেই, এই মস্ত সুবিধা হয়েছে আজকাল। সোমেশের পক্ষে আইডিয়াল বন্দোবস্ত। মিসও নন, মিসেসও নন, আর মিস্টার তো ননই।
সোমবার অফিসে হৈ হৈ পড়ে গেল। একমাত্র অফিসের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান রিসেপশনিস্ট, যার সঙ্গে তাঁর মিষ্টি মিষ্টি ভাব ছিল, সেই জেনিফারই কেবল অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আর সবাই ফ্ল্যাট। গোলাপি সিফনের আঁচল উড়িয়ে মজ এস চৌধুরী তাঁর মার্ক ফোর অ্যাম্বাসাডার থেকে নামলেন, গায়ের মৃদুল ফরাসি সৌরভে, চোখের চটুল কটাক্ষে ভুরুতে—চুলেতে—আঁখিপল্লবে ভুবনমোহিনী হয়ে। গেটে বাহাদুর প্রথমে আটকে দিয়েছিল। পরে গাড়ির নম্বর দেখে ছেড়ে দিল। আলগোছে একটা সেলামও ঠুকে দিয়েছিল নেহাৎ অভ্যাসের বশে। সোমেশের অভ্যাস সেলামের উত্তরে কপালে ডান হাতটা আলতো করে ঠেকানো। অভ্যাসমতো সেটা করতেই বাহাদুরের চোয়াল ঝুলে পড়লো।
—’হায় রাম! চাউধ্রি সা’ব।’ চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। ততক্ষণে সোমেশ লিফটে।
বুড়ো লিফটম্যান ইব্রাহিম সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলো ‘কৌনসী ফ্লোর—’ সোমেশ বললেন, ‘ভালো আছো, ইব্রাহিম?’
সড়াৎ করে শ্বাস টেনে ইব্রাহিম তার টুলের ওপর বসে পড়লো, তার হাত লিফটের বোতামে না গিয়ে পড়ল গিয়ে নিজের কপালে হিজিবিজিকাটা ছকে।
—ইন্—শাল্লা! চাউধ্রি সাহাব! তৌবা! তৌবা!’
—’এখন থেকে আর চৌধুরী সায়েব না, ম্যাডাম চৌধুরী বলবে, বুঝলে তো ইব্রাহিম?’ সোমেশ মিষ্টি হেসে বলেন—’কই লিফট চালাও?’
লিফট থেকে নেমে নিজের ঘরে ঢুকলেন বিনা বাধায়। টুলে নিধিরাম ছিল না। একটু পরেই বেল বাজালেন মজ চৌধুরী। নিধিরাম পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে সাহেবের সিটে এক অপরিচিতা সুন্দরীকে দেখে এতদূর অবাক, যে আপত্তি পর্যন্ত করার কথা মনে পড়ল না তার। অনেক ফাইল জমেছে তিন মাসে। ফাইলে চোখ রেখেই অভ্যাসমাফিক সোমেশ বলে, ‘জল।’
—’জগড়নাথ।’ নিধিরাম শব্দ করে ওঠে!
—’এ—কড়ও হলা? সাহাব—অর—স—র—ব—নাসও হই গলা রে—হায়, হায়!’ হাহাকার করে ওঠে নিধিরাম। মুহূর্তের মধ্যে ঘরভর্তি দর্শক জড়ো হয়ে যায়। লাফিয়ে উঠে চৌহান বলল, ‘গুড গ্রেশাস! হোয়াট লাক! চাউধ্রি সাবনে তো দিল ধড়কা দিয়া। একদম জিনৎ আমন, সায়রা বানু—সোমেশ চাউধ্রি ইজ গন, লং লিভ সোমা চাউধ্রি—’
ঘোষদা বলল, ‘বড্ডই আপশোস হচ্ছে কেন যে তোর বৌদিকে বিয়েটা করে ফেলেছিলুম!’
চালু ছোকরা রণু ব্যানার্জী বললে, ‘অ্যাবসলুটলি র্যাভিশিং এস কে! মে আই হ্যাভ আ ডেট উইথ ইউ দিস স্যাটারডে নাইট? লেটস গো ডান্সিং। শ্যাল উই?’
গোলাপি স্লিভলেসে ভূমিকম্প তুলে সোমেশ বললেন, ‘থ্যাংক্যু রণু! আই’ল থিংক অ্যাবাউট ইট!’
কেবল তার বয়স্ক পি.এ. রাধাকৃষ্ণণ খুব গম্ভীর প্রকৃতির লোক। দক্ষিণের মানুষ তিনি, চট করে অবাক হন না বড় একটা। আগে সাদা সাহেবের কাছে কাজ করেছেন, তার বদলে এলেন কালো সাহেব। এমন পুং সাহেবের বদলে না হয় স্ত্রী সাহেব। রাধাকৃষ্ণণের তাতে কি? গম্ভীর মুখে খাতা পেন্সিল নিয়ে বসলেন এসে, চোখেমুখে কোনো বিস্ময় নেই।
‘ইয়েস স্যার? সরি, ইয়েস ম্যাডাম? শ্যাল উই বিগিন?’ ওদিকে অফিসময় ততক্ষণে ঝড় হয়ে যাচ্ছে। সকলেই উত্তেজিত, শশব্যস্ত, সোমেশ চৌধুরী ছাড়া কারুর মুখে কোনো কথা নেই।
হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে বাড়ি ফিরলেন সোমা চৌধুরী। ইন্দ্রাণীও আজ অপ্রস্তুত। প্রতিযোগিতার উচিত স্পিরিটে বিউটি পারলারে গিয়ে মাথার চুলের ডগা থেকে নোখের আগা পর্যন্ত নতুন করিয়ে এনেছেন। একমাত্র প্রবলেম, কোমরটাকে কিছু করা যায়নি। ওখানে সোমেশের একচ্ছত্র জয়। দরজা খুলে এক রূপসী আরেক রূপসীকে রিসিভ করলেন। ঠিক সোহিনী এলে যেমন দোর গোড়াতেই ইন্দ্রাণীকে ‘বউদি ভাই’ বলে জড়িয়ে ধরে, সোমেশ একেবারে তেমনি ঢঙে দরজাতেই ইন্দ্রাণীকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘষে, ‘হ্যালো ডার্লিং’ বলে ঘরে পা দিলেন।
—’ছি! ছি! ও কী হচ্ছে?’ আপনার অজান্তেই বকে ফেলেছেন ইন্দ্রাণী। চোখ টিপে সোমা চৌধুরী বলেন, ‘ওতে কিছু হবে না!’ তারপরেই ভুরু উঁঃচিয়ে ঠোঁট গোল করে কমপ্লিমেন্ট দেন, ‘ঈ—ঈ—শ—শ—কী—ই দারুণ দেখাচ্ছে তোমাকে ইন্দু! চুলটা কোথায় করালে? ফেশিয়ালও করিয়েছ না? বেশ ভালো কাজ তো ওদের।’
এসব কথায় কান না দিয়ে চায়ের কাপে চিনি গুলতে গুলতে ইন্দ্রাণী বললেন, ‘তারপর? আপিসে সবাই তোমায় দেখে কী বললে?’
হাত মুখ ধুয়ে, কাপড় বদলে, হাভানা সিগারটি ধরিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে গায়ে সুতি ডুরের আঁচলটি জড়িয়ে নিয়ে, চায়ের কাপ হাতে সোমেশ গল্প জুড়ে দেন—আপিসে আজ কত কী হলো। বাহাদুর, ইব্রাহিম, নিধিরাম, চৌহান, ঘোষদা, রাধাকৃষ্ণণ, রণু ব্যানার্জী—কেউ বাদ যায় না। কেবল জেনিফারের মুখ ভার করার কথাটা বলেন না। রণু ব্যানার্জীর অফার শুনে চমকে ওঠেন ইন্দ্রাণী।
—’সে কি গো, যাবে নাকি তুমি নাচতে? অ্যাঁ? হায় রে পোড়াকপাল আমার—শেষে কিনা—’
—’দূরদূর! তুমিও যেমন!’ বলে সোমেশ প্রবল একটি কটাক্ষ হানেন, ‘থ্যাংক্যু বলাটা কার্টসি, বুঝলে না?’
এমন সময়ে হরিদাসী এসে বললে, ‘বাবুর কাছে ঘনশ্যামবাবু এয়েচেন।’ গঙ্গাঠাকুর ও হরিদাসী যথাসাধ্য বাবুর সঙ্গে সোজাসুজি কথোপকথন এড়িয়ে চলেছে। তারা একটু বিব্রত বোধ করছে। বোঝাই যাচ্ছে, পাড়ার ভৃত্যকুলের কাছে তাদের মুখ দেখানোর উপায় নেই। বাড়ির কর্তা মেয়েমানুষ হয়ে গেছেন, এমন ধারা অনাচ্ছিষ্টি কাণ্ড কেউ কি বাপের জম্মেও শুনেছে? চোখে দেখা তো দূরস্থান! দু’জনই খুব পুরোনো, ইন্দ্রাণীর শ্বশুর—শাশুড়ির টাইমের লোক। এই সংসারে অপরিহার্য দুজনেই। এই গঙ্গাঠাকুর, এই হরিদাসী, ইন্দ্রাণীর বিয়েতে গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে তাঁর বাপের বাড়ি গিয়েছিল।
—’আঃ! হরিদাসী, ফের!’ বলেছ না দু’দিন ধরে বাবু বাবু করবি না?’ সোমেশবাবু খিঁচিয়ে ওঠেন। প্লাকড ভুরুতে জট পাকিয়ে যায়।
—’কী বলব তবে? মা? আর মাকে তবে কি বলব? আগেকার মতন, বৌদিদি?’ ছানিপড়া চোখ হরিদাসী খুবই সরল ভাবে তাকায়। ইন্দ্রাণীর শ্বশুর—শাশুড়ির মৃত্যুর পর থেকে সোমেশ—ইন্দ্রাণী বাবু—মা ডাকে প্রমোশন পেয়েছেন।
—’তা তো বটে?’ এক মিনিট ভুরু কুঁচকে সিগার কামড়ে চুপ করে থাকেন সোমেশ। তারপরেই মুখ থেকে চুরুট সরিয়ে বলেন, মাকে মা আর আমাকে মেমসাহেব বলবে। বাবু—টাবু বলবে না।’
হরিদাসী একনজরে মুখের পানে চায়—এই সেই লোক, যাকে সে বহুবৎসর কাল ‘দাদাবাবু’ বলবার পর সম্প্রতি ‘বাবু’ বলতে শুরু করেছিল। তারপর ফোকলা গালের গর্তে টোল ফেলে কেমন—কেমন হাসে। হেসে বলে, ‘বেশ! তাই বলব। মেমসায়েবের কাছে ঘনশ্যামবাবু এয়েছেন। হলো তো?’
ঘনশ্যাম সোমেশের ইস্কুলের বন্ধু। রোজ সন্ধ্যেবেলায়, রাতে খাবার আগে পর্যন্ত দাবা খেলাটা তাঁদের কলেজ যুগ থেকেই নেশা। এক পাড়ায় বাড়ি হওয়ার দরুণ এই নেশাটি বিয়ের পরেও ভাঙেনি।
ফরাসী সুগন্ধ বিলিয়ে, আঁচল এলিয়ে, চুল ফুলিয়ে সোমেশ হাস্য বদনে ঘরে ঢুকতেই ঘনশ্যাম চমকে উঠলেন। তারপরেই মুখ ভেংচে চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘এ্যাঃ! ছিছিছি—ই—কী করিচিস রে ব্যাটা সোমা? এ্যাত্তো করে তোকে বারণ কল্লুম—বল্লুম, এটা অ্যামেরিকা বিলেত নয়, ওসব কীর্তি করতে যাসনি, সব্বোনাশ হবে—শুনলিনি? সেই, যা জেদ ধরবি, তাই?’
—’কেন রে ঘনা? বেশ ভালো দেখাচ্ছে না?’ একটু দমে গিয়ে প্রশ্ন করেন সোমেশ। চোখে অনিশ্চয়তা।
—’তোমার মাথা। ঠিক বাঁদরের মতন দেখাচ্ছে।’ মাথা নিচু করে বোর্ড থেকে ঘুঁটিগুলো বাক্সে তুলে ফেলতে থাকেন ঘনশ্যাম।
—’ঘুঁটি তুলে ফেলছিস যে? খেলবি না?’
—’কী খেলব?’
—’ন্যাকামো রাখ!’
—’বলি ন্যাকামোটা কে কচ্চে? রোজ রোজ এসে তোমার সঙ্গে দাবা খেলি, আর পাড়ার লোকে নিন্দে করুক! না রে সোমা, ও কম্মোটি আমি আর পারবো না। গিন্নি এ্যালাউ করবে না। ছেলেপুলে বড় হচ্ছে, তারাই বা কী ভাববে। আমা দ্বারা লীলাখেলা হবে না ভাই।’
—’ঘনা!’ কাতর আর্তনাদ বেরোয় সোমেশের গলা চিরে। ‘এ তুই কী বলছিস ভাই ঘনা? তুই কি পাগল হলি? এ যে আমাদের বিশ বছরের নেশা রে! কে আবার কী বলবে এতে?’
—’ওসব কথা থাক। দ্য পাস্ট ইজ পাস্ট। তুমি বরং এখন থেকে আমার বৌয়ের সঙ্গে সাপলুডো খেলতে যেও রোজ দুপুরবেলায়—আমি কিছু বলব না।’ ঘনশ্যামের গলা অভিমানে বুজে এল, ‘শালা! বিশ্বাসঘাতক! ইস্টুপিড কোথাকার! এতো করে বারণ করলুম!’
সোমেশের চোখের জল আর বাঁধ মানে না। চোখে আঁচল তুলে দেন তিনি। আর ‘ছিঃ ছিঃ’ বলতে বলতে বেরিয়ে যান ঘনশ্যামবাবু। প্রায় দৌড়ে পালালেন।
ঠিক এমনি সময়ে নিচে ভঁক ভঁক করে হর্ন বেজে উঠে। ‘ছেলেমেয়েরা এসে গেছে বলতে বলতে ছুটে এলেন ইন্দ্রাণী। ডুরে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে, সর্বাঙ্গে অপরূপ ঢেউ খেলিয়ে সোৎসাহে উঠে দাঁড়ালেন সোমেশ, সদ্য হারানো বন্ধুর দুঃখু ভুলে। হাতে জ্বলন্ত সিগার, গায়ে কমলাডুরের আঁচল। মাস্কারা—ঘন চোখে অপত্য স্নেহের অমৃতধারা। সারপ্রাইজ!—ছেলেমেয়েরা জানে না বাবা ফিরে এসেছেন।
—’বাবা!’
—’বাবা!’
—’বাবা!’ দুড়দাড় দৌড়তে দৌড়তে সিঁড়ি থেকেই চেঁচাতে চেঁচাতে, উল্লাসে নাচতে নাচতে ঘরে ঢুকল বান্টি—মিন্টু—সন্টু। গেটের কাছে বাবার প্রিয় চুরুটের গন্ধটি পেয়েই তাদের মন নেচে উঠেছে। খবর পৌঁছে গেছে প্রাণে। বাবার গন্ধ! বাবা এসে গেছেন। ঘরে ঢুকেই স্ট্যাচু। বজ্রাহত। নিশ্চুপ।
নিবাত নিষ্কম্প তিনটি স্তব্ধতা। তারপরেই পাঁচ বছরে সন্টুটাও কেঁদে ফেললে, ‘বাবা কই?’ ডুরে শাড়ির আঁচল সামলাতে সামলাতে সন্টুকে কোলে তুলতে যান সোমেশ। তার আগেই সে ছুটে গিয়ে ইন্দ্রাণীর হাঁটুতে মুখ গুঁজেছে। ছোট ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে আঙুল দিয়ে মা দেখান ঐ গ্ল্যামারাস তরুণীটির দিকে—
‘এই তো বাবা।’
—’ন্না—ন্না ও বাবা না। সন্টু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেই থাকে। ছোট্ট শরীরটা গুটিয়ে আরো ছোট দেখায়। বান্টি এখন ক্লাস এইটে, সদ্য গোঁফের রেখার ছায়া পড়েছে ঠোঁটের ওপরে। মিন্টুরাণী পড়ছেন ক্লাস সিক্সে, একটা হালকা প্রজাপতির মতন দেখতে।
গেটে বাবার সিগারের পরিচিত গন্ধটি তাদের তিন মাস ধরে হারানো বাবার পুনরাগমনের খবর দিয়েছিল কিন্তু এ কে এসে বসে আছে বাবার ইজিচেয়ারে। বাবা কই? এ যে ছোটপিসি! আবার ঠিক ছোটপিসিও নয়। অন্য কেউ। এ কে?
নেলপলিশচিত্রিত দশ আঙুল বাড়িয়ে মিষ্টি আদুরে গলায় সোমেশ ডাকলেন, ‘ছি, সন্টু কাঁদে না বাবা। এসো, কোলে এসো—এই দেখ, দেখ না, তোমাদের জন্যে কী সুন্দর ক্যাডবেরি এনেছি’—
সন্টু নড়ল না। বান্টিও নড়ল না। মিন্টুই শুধু পায়ে পায়ে একটু এগোল। সোমেশ ডাকলেন, ‘কই রে আয়? এই দ্যাখ আরেকটা কী মজার সারপ্রাইজ আছে তোমাদের জন্যে—’পাশের ভ্যানিটি ব্যাগটা হাতে নেন সোমেশ। সন্টু নড়ল না।
—’যাও, কাছে যাও—’ ইন্দ্রাণী এবার সন্টু—বান্টি দুই অবাধ্য পুত্রের পিঠে দুই ঠেলা মেরে বললেন, ‘ছিঃ! ও কী হচ্ছে কি? অসভ্যতা?’
—’অমন করতে নেই, সন্টু—বান্টু, বাবা ডাকলে যেতে হয়।’ ছেলে মেয়েদের পেছু পেছু, ঘনশ্যামবাবুও আবার কখন ওপরে উঠে এসেছিলেন। এবার টের পাওয়া গেল। ঘনশ্যামবাবু বললেন, ‘যা, বাবা ডাকছে, অমন কোর না। কাছে যাও। বাবা বলে কথা—ধুতিই পরুক আর শাড়িই পরুক। বাবা, বাবাই। যাও, কাছে যাও—’
—’বাবা বাবাই মানে?’ নেপথ্যে হরিদাসীর গলা পাওয়া গেল। ‘বাবা ডাকছে মানে? এখন কি আর বাবা বলে ডাকলে চলবে নাকি? এখন বলতে হবে মা। কী বলে ডাকবে তোমাকে তোমার ছেলেমেয়েরা, বাবু? এই য্যা!, কী যেন বলে, মেমসায়েব? তোমার ছেলেমেয়েরা তোমায় বাবার বদলে কী নাম ধরে ডাকবে? মেমসায়েব না মা? ঘরের বাইরে থেকে বোমা ফেলতে লাগল হরিদাসী। সোমেশের মনে পড়ল জন মরিস যখন জ্যান মরিস হলেন, তাঁরও তখন বড় বড় সন্তান ছিল। জ্যানের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী—পরিবারের ভাবভালোবাসা তো এতটুকুও নষ্ট হয়নি। কী যোগাযোগে, কী উষ্ণতায়, কোথাও কিছু কম পড়েনি। কিন্তু জ্যানের ছেলেমেয়েরা এখন তাকে কী বলে ডাকে? জ্যান বলে? না ড্যাডি বলে? আত্মজীবনীতে কি সেটার উল্লেখ ছিল না? ভাবতে ভাবতে সোমেশের নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে বেরুল। নাকটি তিনি থুপে থুপে মুছে দিলেন। তবুও মনে পড়ল না।
সন্তু এবার স্পষ্ট গলায় বলল, ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে, ‘না, বাবার কাছে যাব না।’ বান্টি কিছুই বলল না। টেবিলের ওধার থেকে কেবল তাকিয়ে বাবাকে দেখতে লাগল। হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ, কব্জীতে সোনারবালা, আঙুলে জ্বলন্ত হাভানা সিগার, কমলা ধনেখালির ডুরে, কপালে ম্যাচ—করা কুমকুমের টিপ, প্লাক—করা ভুরু, মস্কারা মাখান আঁখিপল্লব, স্লিভলেস ব্লাউজ, ফর্সা পেট—বান্টি শক্ত করে চোখটা বুজে ফেল। ঠোঁটটা একটু কুঁচকে গেল। বান্টি নড়ল না। কেবল মিন্টু আরও এক পা এগোল। মাকে বলল, ‘বাপিয়া এটা কি পারফিউম মেখেছে গো মা? কী মিষ্টি গন্ধটা—’ মিন্টুটা চিরকালের ন্যাকা, এক নম্বরের বাপ সোহাগী মেয়ে। বাবা না ডেকে ওই বাপিয়া ডাকটি সে নিজেই বানিয়ে নিয়েছে।
হরিদাসী জলখাবারের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকছিল। দোরগোড়ায় থমকে দাঁড়িয়ে একগাল ফোকলা হাসি দিল। যেন দিব্যকর্ণ খুলে গেছে তার—এমন উজ্জ্বল হাসিতে কাঁধের ওপর মাথাটি হেলিয়ে বল্লে, ‘বাঃ! এই তো দিব্যি হিল্লে হয়ে গেছে! বাপিয়া! মিন্টুরাণীর ডাকটিই অ্যাদ্দিনে মানিয়েছে সব চে’ ভালো! বাপিয়া! যা বাবা যা, সন্টু বাবু, মিন্টুরাণী, বান্টু, বাবুর কাছে যাও বাছারা। অমনধারা করতিনি’, বাপিয়ারা ডাকলি যেতি হয়—বাপ বলে কথা!’
শারদীয় যুগান্তর, ১৯৮৯