বান্ধবগড়ের রাজাসাহেব
শেষ ফরেস্ট লজে খোঁজ নিয়ে গাড়ির কাছে এসে সৈকত বলল, ‘না রে, কোনো ঘর খালি নেই৷ অনেক করে ম্যানেজারকে অনুরোধ করলাম৷ রেজিস্টার দেখাল লোকটা৷ সাতদিনের আগে কোনো ঘর পাওয়া যাবে না৷ কী ডিসিশন নিবি বল?’
বুঝতে পারলাম, ঘর বুকিং না করে বান্ধবগড়ে আসাটা যথেষ্ট বোকামি হয়েছে৷ টুরিস্ট সিজন৷ এই সময় সারা দেশ থেকে লোক মধ্যপ্রদেশের এই বান্ধবগড়ে বাঘ দেখতে আসে৷ কলকাতা থেকে গাড়ি নিয়ে লং ড্রাইভে আজই বান্ধবগড়ে পৌঁছেছি আমরা৷ গাড়িটা একটা ছোট্ট চা-গুমটির সামনে দাঁড় করানো৷ গুমটির কাঠের বেঞ্চে বসে ছিল ত্রিদিব৷ আমি দাঁড়িয়ে গাড়ির বনেটে হেলান দিয়ে৷ সৈকতের কথা শুনে ত্রিদিব বেশ হতাশ ভাবে বলল, ‘তা হলে কী হবে? বাঘ দেখা ভাগ্যে নেই৷ বরং এখান থেকে অমরকণ্টক বা খাজুরাহো চলে যাই৷’
দরজা খুলে আমরা গাড়িতে উঠতে যাব, এমন সময় একজন হিন্দিতে বলল, ‘সাহেবরা এখানে এসে বাঘ না দেখেই ফিরে যাবেন?’
গলা শুনে পিছনে ফিরে দেখি, একজন লোক৷ মাঝবয়সি, মাথায় পাগড়ি, পরনে ধুতি-ফতুয়া, দেখে স্থানীয় বলেই মনে হচ্ছে৷
লোকটা মুহূর্তখানেক চুপ থেকে বলল, ‘আমি আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করতে পারি৷ বাঘও দেখাতে পারি৷’
ত্রিদিব বিস্মিত হয়ে বলল, ‘তাই নাকি! আপনি কি হোটেল-টোটেলের লোক?’
সে বলল, ‘না, আমি হোটেলের লোক নই৷ তবে এখানে সব হোটেলের লোকই আমায় চেনে৷ আমার নাম মঙ্গল সিংহ৷ এখানে থেকে ঘণ্টা চারেক দূরে জঙ্গলের ভিতরে এক জায়গায় থাকি৷ জায়গাটাকে বলে ‘‘রাজাসাহেবের হাভেলি’’৷ আমি সেখানে আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করব৷ বাঘও দেখাব৷’ কথাগুলো বলে আমাদের উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইল৷
লোকটার কথা বলার ভঙ্গিতে এমন একটা আহ্বান আছে যে, আমরা ‘না’ করতে পারলাম না৷ মঙ্গল সিংহকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম৷ চালকের আসনে ত্রিদিব৷ মঙ্গল সিংহ ত্রিদিবের পাশের সিটে বসে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে চলল৷ পর্ণমোচী বৃক্ষ, বিশেষত শালের জঙ্গল আর ঘাসবন৷ মঙ্গল সিংহের নির্দেশে কখনো তার মধ্যে দিয়ে, কখনো জঙ্গলকে বেড় দিয়ে এগিয়ে চললাম৷ ক্রমশ ঢুকতে লাগলাম গভীর অরণ্যের মধ্যে৷ দূরে নীল আকাশের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আছে সাতপুরা পাহাড়৷ আমার এগোচ্ছি সেদিকেই৷ মঙ্গল সিংহ মাঝেমধ্যে বলতে লাগল জঙ্গলের নানা খবর৷ যাত্রাপথেই আমরা দেখতে পেলাম, একদল চিতল হরিণ আর একটা ক্রেস্টেড সার্পেন্ট ঈগল৷
গাড়ি থেকে নেমে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম৷ এমন ঘন জঙ্গলের মধ্যে এত বড় বাড়ি! বাড়িটা অবশ্য অনেক পুরনো তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে৷ দোতলার কারুকাজ করা রেলিং, ছাদের কারনিস সব খসে গিয়েছে৷ দেউড়ির দু’পাশে অস্ত্র হাতে দাঁড়ানো পাথরের মূর্তির মাথা ভাঙা, স্তম্ভের ইট বেরিয়ে পড়েছে, পলেস্তরাহীন দেওয়াল৷
জানতে চাইলাম, ‘জঙ্গলের মধ্যে এত বড় বাড়ি কে বানিয়েছিল?’
মঙ্গল সিংহ বলল, ‘পুরো বান্ধবগড়টাই একসময় মেওয়ারের মহারাজাদের প্রাইভেট শিকার খেলার জায়গা ছিল৷ তাঁরাই বানিয়েছিলেন৷ রাজপুরুষরা শিকার খেলতে আসতেন৷ বহু সাহেবও এসেছেন৷ হাভেলির ওই যে ওখানে উঁচু ছাদওয়ালা জায়গাটা দেখছেন, ওখানে হাতি রাখা থাকত৷ তারপর এক সময় রাজরাজড়ার যুগ শেষ হয়ে গেল, শিকার খেলাও শেষ হয়ে গেল আর তার সঙ্গে এর রমরমাও৷ তবে এখনও এটা প্রাইভেট প্রপার্টি৷’
ত্রিদিব বলল, ‘এখন কারা থাকে?’
মঙ্গল সিংহ একটু হতাশ ভাবে বলল, ‘কে আর থাকবে? শুধু আমি আর রাজাসাহেব৷’
‘রাজাসাহেব মানে?’ জানতে চাইল সৈকত৷
মঙ্গল সিংহ জবাব দিল, ‘উনি একজন রাজ বংশধর৷ প্রায় নববই বছর বয়স৷ আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব৷ এবার ভিতরে চলুন!’
বাড়িটার অধিকাংশ ঘরই বাসযোগ্য নয় বলেই মনে হল৷ কোনো ঘরে তেমন কোনো আসবাবও নেই৷ বেশ কয়েকটা ঘর-অলিন্দ পেরিয়ে আমাদের নিয়ে দোতলার একটা বারান্দায় উঠে এল মঙ্গল সিংহ৷ বারান্দাসংলগ্ন বেশ কয়েকটা ঘর৷ এ জায়গাটা বেশ সাফসুতরো৷ বারান্দায় ওঠার পর তিনটে জিনিস আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল৷ দেওয়ালের গায়ে টাঙানো আছে একজন যুবা রাজপুরুষের বিরাট তৈলচিত্র৷ তার পরনে জরির পোশাক, গলায় মুক্তোর মালা, মাথায় পালক গোঁজা, রত্নখচিত পাগড়ি৷ আর এ ছবির দু-পাশে টাঙানো একটা স্টাফ করা বিরাট বাঘের মাথা, অন্য পাশে একটা বন্দুক৷ বাঘের চোখ দুটো যেন এখনও জ্বলছে৷ মঙ্গল সিংহ বলল, ‘রাজাবাবুর ছবি৷ বন্দুকটা দিয়ে বাঘটা শিকার করেছিলেন তিনি এই হাভেলির কাছাকাছি জঙ্গলের মধ্যে৷’ কথা বলতে-বলতে আমাদের থাকার জন্য একটা ঘর খুলে দিল মঙ্গল সিংহ৷
দুই
হাভেলির হাতায় কয়েকটা চেয়ার পেতে আমাদের বসার ব্যবস্থা করে দিয়ে গিয়েছে মঙ্গল সিংহ৷ আলো বলতে পাশে রাখা একটা হারিকেন৷ অন্য কোনো আলো নেই চারপাশে৷ খাওয়া-দাওয়া সারা৷ রাত প্রায় আটটা বাজে৷ মঙ্গল সিং বলে গিয়েছে, কাল ভোর পাঁচটায় আমাদের বাঘ দেখাতে নিয়ে যাবে৷ আমরা যেন রাত নটায় শুয়ে পড়ি৷ রাতে হয়তো ঘর থেকেই বাঘের ডাক শোনা যেতে পারে৷ চারপাশেই তো জঙ্গল৷
পরদিন ভোরে বাঘ দেখব আমরা৷ তাই ভিতরে-ভিতরে বেশ উত্তেজিত৷ জায়গাটাও বেশ পছন্দ আমাদের৷ অন্য টুরিস্টদের কোনো হল্লা নেই এখানে৷ কিছুটা তফাতেই চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে আছে গভীর শালবন৷ গল্প করছিলাম আমরা৷ দেখছিলাম, হাভেলির একটা মহল থেকে বেরিয়ে কে এগিয়ে আসছে? মঙ্গল সিংহ নাকি?
লোকটা আমাদের কাছে এসে দাঁড়াতেই বুঝলাম, মঙ্গল সিংহ নয়৷ তার পরনে খাকি পোশাক, ব্রিচেস, হাই হিল বুট, কাঁধে বন্দুক৷ দীর্ঘদেহী একজন লোক৷ তবে বয়সের ভারেই সম্ভবত এখন কিছুটা ন্যুব্জ৷ লোকটা সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি এই হাভেলির রাজাসাহেব৷ পরিচয় করতে এলাম৷’
রাজাসাহেব! মানে যিনি বাঘ মেরেছিলেন? মেওয়ারের রাজবংশধর?
সম্ভ্রমের সঙ্গে তাঁর দিকে তাকালাম আমরা৷ মঙ্গল সিংহ তাঁর যা বয়স বলেছিল, ততটা না হলেও আশি বছর হতেই পারে৷ ভ্রু, বিরাট গোঁফ সব দুধসাদা হয়ে গিয়েছে, চামড়াও কুঁচকে গিয়েছে৷ তবে তাঁর অবয়ব বলে দিচ্ছে, একসময় বেশ শক্তিশালী পুরুষ ছিলেন৷ বয়স তাঁকে পরাস্ত করতে পারেনি৷
আমাদের পরিচয়ের পর তিনি বললেন, ‘কাল সকালে তো নিশ্চয়ই আপনারা বাঘ দেখতে যাবেন৷ তা মঙ্গল যখন বলেছে তখন ঠিকই দেখাবে৷ বান্ধবগড়ে এখন অনেক বাঘ আছে৷’
এরপর একটু থেমে তিনি বললেন, ‘তবে সেই রাজা-বাঘের মতো কোনো বাঘ নেই৷ যার মাথা আপনারা দেখেছেন সম্ভবত৷, পঞ্চাশ বছর আগে যে বাঘটা আমি শিকার করেছিলাম৷ বান্ধবগড়ের রাজা-বাঘ, নরখাদক বাঘ!’
তার কথা শুনে সৈকত বলে উঠল, ‘আপনার বাঘ শিকারের গল্পটা আমাদের বলবেন? শিকারকাহিনি আমরা বইয়ে পড়েছি৷ কোনো শিকারির মুখ থেকে গল্প শুনিনি৷’
রাজাসাহেব কিছু দূরের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জায়গাটা এখান থেকে খুব কাছেই৷ ওই জঙ্গলের মধ্যে একটা নালার ধারে যেখানে মাচায় বসে শিকারটা করেছিলাম৷ মাচা এখনও বাঁধা আছে৷ চলুন, ওখানে বসে আপনাদের গল্প শোনাব৷’
গল্প শোনার আকর্ষণ আমাদের আছে, কিন্তু এত রাতে শালের জঙ্গলে ঢোকা কি ঠিক হবে?
রাজাসাহেব বললেন, ‘ভয় পাচ্ছেন? আমার বন্দুক তো আছেই৷ জীবনে কোনো দিন দুটো গুলি ছুড়িনি৷ এক গুলিতেই নিকেশ হয়ে যেত শিকার৷’ কথাগুলো বলে বিড়বিড় করে তিনি যেন বললেন, ‘সাহস ছিল বটে মহেন্দ্র সিংহের!’ এ কথার মানে ঠিক ধরতে পারলাম না৷
গা ছমছমে শালের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মিনিট দশেক হেঁটে আমরা পৌঁছে গেলাম সেখানে৷ শালগাছের খুঁটির উপর ফুট দশেক উঁচু একটা মাচা৷ এ মাচাটা পরে তৈরি৷ কাঠের পাটাতনের সিঁড়ি বেয়ে আমরা মাচার উপরে উঠে বসলাম৷
সামনে কিছুটা তফাতে মানুষ সমান উঁচু ঝোপঝাড়৷ সে জঙ্গল কিছুটা এগিয়ে শেষ হয়েছে একটা শীর্ণ নদীর মরা খাতে৷ নালার ওপাশে শুরু হয়েছে গভীর জঙ্গল৷ সে জঙ্গল উঠে গিয়েছে চন্দ্রালোকিত সাতপুরা পাহাড়ের ঢালে৷
সেই পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রাজাসাহেব বলতে শুরু করলেন তাঁর গল্প, ‘দেশ তখন স্বাধীন হয়েছে৷ আমাদের রাজত্বও চলে গিয়েছে৷ রাজপরিবারের সন্তান হিসেবে এই হাভেলির মালিকানা পেয়েছিলাম আমি৷ আসতাম আমার সমবয়সি মহেন্দ্র সিংহের টানে৷ তারা ছিল পুরুষানুক্রমে শিকারি৷ যেসব রাজা-মহারাজা এখানে শিকারে আসতেন, তাঁদের সঙ্গ দিত ও৷ জঙ্গলে পথ চিনিয়ে শিকারিদের কাছে পৌঁছে দিত শিকারিদের৷ তবে মহেন্দ্রর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঠিক প্রভু-ভৃত্যের ছিল না৷ সে ছিল আমার অভিন্ন হূদয় সহচর৷ আমরা একসঙ্গে ছেলেবেলায় কত ঘুরে বেড়িয়েছি এই বনে৷ মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে তার সাহায্যে এই বনে বাঘ শিকার করেছি আমি৷ তবে শিকার ব্যাপারটা যে ঠিক নয় সেটা বোঝার বয়স তখন আমার ছিল না৷ শরীরে রাজার রক্ত, ছেলেবেলাতেই বন্দুক হাতে তুলে নেওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক৷ তবে আমার নরখাদক বাঘ শিকারের ঘটনাটা আরও পরের৷ তখন আমার বছর পঁচিশেক বয়স৷ আমি বেড়াতে এসেছি এখানে৷ ঠিক সেই সময় বাঘটা হানা নিতে শুরু করল এখানে৷ ওই যে নালাটা দেখছেন, ওর ভিতরেই ডেরা বাঁধল বাঘটা৷ এ নালা চলে গিয়েছে অনেক দূর পর্যন্ত৷ দুপাশে ঘন জঙ্গল৷ বাঘের লুকিয়ে থাকার পক্ষে আদর্শ জায়গা৷ আমাদের প্রাক্তন প্রজারা আমাকে এসে ধরল, বাঘটাকে মারার জন্য৷
‘মহেন্দ্র সিংহকে নিয়ে আমি জঙ্গলে বেরোতে শুরু করলাম বাঘটাকে মারার জন্য৷ তাকে চাক্ষুষ না করলেও তার ‘খোঁচ’ অর্থাৎ পায়ের ছাপ দেখে আমরা বুঝতে পারলাম বাঘটা একটা পূর্ণবয়স্ক প্রকাণ্ড বাঘ৷ দৈর্ঘ্যে প্রায় বারো ফুট হবে লেজের ডগা পর্যন্ত৷ ওজন হবে তিনশো কেজি৷ পরে বুঝেছিলাম আমাদের অনুমান মিথ্যে ছিল না৷
‘যাই হোক, বাঘটা ছিল অসম্ভব ধূর্ত৷ মানুষখেকো বাঘ যেমন হয়৷ আমরা জঙ্গলে খুঁজে বেড়াই তাকে৷ কিন্তু কিছুতেই তার নাগাল পাই না৷ কোনো-কোনো পথে তার পায়ের ছাপ দেখে বুঝি, যখন আমরা তার সন্ধানে ঘুরছি, ঠিক তখন সে আমাদের নিঃশব্দে অনুসরণ করেছে, কোনো অসতর্ক মুহূর্তে শিকারিকে শিকারে পরিণত করার জন্য৷ সপ্তাহ তিনেক ব্যর্থ অভিযান চলল আমাদের৷ শুধু একটা জিনিস বুঝতে পারলাম আমরা৷ সে ইদানীং আমাদের খুব কাছাকাছি ছায়ার মতো ঘুরছে৷ তার পায়ের ছাপ সে কথাই বলছে৷
‘‘মহেন্দ্র একদিন বলল, ‘এভাবে কিছু হবে না৷ বাঘটা যখন কাছাকাছি আছে, তখন মাচান বেঁধে টোপের ব্যবস্থা করা যাক৷’ আমিও রাজি হলাম তার প্রস্তাবে৷ ঠিক এই জায়গাতেই মাচান বাঁধা হল৷ কারণ, ওই নালাটা এখান থেকে দেখা যায়৷ ওখান থেকেই তো উঠে আসে বাঘটা৷ ছাগলের টোপ নীচে বেঁধে এই মাচানে রাত জাগতে শুরু করলাম আমরা৷
‘ছ-টা রাত পেরিয়ে গেল কিন্তু সে সামনের ওই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ঝাঁপাল না আমাদের রাইফেলের সামনে৷ অথচ প্রতি ভোরেই আমরা দেখি, রোজই সে আমাদের চোখ এড়িয়ে নালা থেকে উঠে এসে আশ্রয় নিয়েছে সামনের ওই ঝোঁপ জঙ্গলে৷ সেখান থেকে মাচায় বসা আমাদের লক্ষ করেছে৷ তারপর আবার ফিরে গিয়েছে৷ খোঁচ দেখে ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারছি৷
‘‘ষষ্ঠ রাতেও যখন কিছু হল না, তখন সেদিন হাভেলিতে ফিরে মহেন্দ্র আমাকে বলল, ‘এভাবেও কিছু হবে না বলেই মনে হচ্ছে৷ বাঘটার ছাগলের প্রতি আগ্রহ নেই৷ ওর আগ্রহ মানুষ অর্থাৎ আমাদের উপর৷ বিশেষত, তোমার উপর৷ হয়তো তা তোমার এই জমকালো পোশাক আর পাগড়ির জন্য৷ আমি খেয়াল করে দেখেছি৷ তুমি জঙ্গলে যে পাশ দিয়ে হাঁটছ, সে পাশ ধরেই সে অনুসরণ করে আমাদের৷ অর্থাৎ ও শিকার হিসেবে তোমাকেই পছন্দ করছে৷ আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে৷’
‘কী প্ল্যান?’ জানতে চাইলাম৷ সে যা বলল তাতে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম৷ মহেন্দ্র বলল, ‘তোমার পোশাকটা আমায় আজ তুমি পরতে দেবে৷ আর আমার খাকি পোশাক পরবে তুমি৷ ছাগল নয়, আজ রাতে আমি তোমার পোশাক পরে টোপ হব মাচার নীচে৷ আর উপরে থাকবে তুমি৷ আজ চাঁদনি রাত৷ ও তোমার নজর এড়াতে পারবে না৷ আর তারপর তুমি…৷’ তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আমি বলে উঠলাম, ‘কী বলছ তুমি? এ যে আত্মহত্যার শামিল! না, এ কাজ করা যাবে না৷’
‘‘মহেন্দ্র হেসে বলল, ‘তুমি ঘাবড়াচ্ছ কেন? বাঘ যত দ্রুত ঝাঁপাক, একটা গুলির সুযোগ তুমি পাবেই৷ তাতেই কাজ হবে৷ তোমার সঙ্গে বহু শিকারে গিয়েছি আমি৷ তোমার হাতের উপর আমার ভরসা আছে৷’
আমার নিশানার উপর নিজের যথেষ্ট ভরসা আছে৷ তবুও তাকে বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগলাম আমি৷ ব্যাপারটা যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার জেদের কাছে হার মেনে গেলাম আমি৷ সেদিন বিকেলে আমার পোশাক পরল মহেন্দ্র আর তার পোশাক গায়ে দিয়ে দুজন হাজির হলাম এখানে৷ মহেন্দ্র রইল নীচে৷ আর আমি বন্দুক নিয়ে মাচায় উঠে বসলাম৷ এক সময় জঙ্গলে অন্ধকার নামল, তারপর চাঁদ উঠল৷ ঠিক আজ রাতের মতোই চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত জঙ্গল৷ সময় কাটতে লাগল৷ ঘণ্টা তিন-চার দাঁড়িয়ে থাকার পর মহেন্দ্র আমাকে একটা ইশারা করে ওই ঝোঁপ ভেঙে এগোতে শুরু করল নালার দিকে৷ তার উদ্দেশ্য বুঝতে পারলাম আমি৷ সে নালার দিকে এগোচ্ছে নরখাদকটাকে প্রলুব্ধ করে তার পিছন-পিছন এখানে টেনে আনার জন্য৷ ভয়ংকর ব্যাপার! কিন্তু তখন তাকে বাধা দেওয়ার উপায় নেই৷ চিৎকার করলে বাঘটা কাছাকাছি থাকলে মহেন্দ্রের আরও বিপদ হতে পারে৷ আস্তে-আস্তে সে হারিয়ে গেল নালার দিকে৷’’
আমরা তন্ময় হয়ে তার গল্প শুনছিলাম৷ সৈকত বলল, ‘তারপর? তারপর কী হল?’
রাজাসাহেব তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘চুপ-চুপ, একদম চুপ৷ ওই তো দেখুন, মহেন্দ্র নালা থেকে উঠে আসছে,’ ফিসফিস করে কথাগুলো বলে তাঁর রাইফেলটা কাঁধের উপর উঠিয়ে নিলেন রাজাবাবু৷ তাঁর কথা শুনে নালার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম আমরা৷ সত্যিই নালার দিক থেকে এদিকে আসছে একজন মানুষ৷ চাঁদের আলোয় তার গায়ের জরির পোশাক ঝলমল করছে৷ এ কী করে সম্ভব? পঞ্চাশ বছরের পুরনো গল্প চোখে দেখা যায় নাকি?
লোকটা এক সময় আমাদের বেশ কাছাকাছি চলে এল৷ রাজাবাবুর বন্দুকের নল ঘুরতে শুরু করেছে লোকটার চারপাশের জঙ্গলের উপর৷ হঠাৎ একটা লক্ষ্যে স্থির হয়ে গেল তাঁর বন্দুকের নল৷ জ্বলে উঠল বন্দুকের উপর লাগানো টর্চ৷ সেই আলোয় আমরা দেখতে পেলাম, আলোটা ঝোপের উপর যেখানে গিয়ে পড়েছে, সেখান থেকে উঁকি মারছে একটা প্রকাণ্ড বাঘের মাথা৷ টর্চের আলোয় জ্বলজ্বল করছে তার হিংস্র চোখ৷ আর এর পরক্ষণেই কানফাটানো গর্জন করে উঠল রাজাসাহেবের হাতের বন্দুক৷ পর মুহূর্তেই টর্চের আলো নিভে গেল৷ রাজাসাহেব চিৎকার করতে থাকলেন, ‘পেরেছি! পেরেছি! মহেন্দ্র আমি পেরেছি৷’
হতবাক আমরা, ব্যাপারটা কী ঘটল কিছুই বুঝতে পারছি না৷ আর এর পরই নীচ থেকে সেই লোকটা ছুটে মাচার কাছে এসে উপরে উঠে এল৷ আমরা দেখলাম, রাজার পোশাক পরা লোকটা মঙ্গল সিংহ৷ তাকে দেখে একটু ধাতস্থ হয়ে আমি বিস্মিত ভাবে বললাম, ‘এ সব কী ব্যাপার, আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না৷ রাজাসাহেব সত্যি বাঘ শিকার করলেন নাকি? ওই তো ওখানে এইমাত্র বাঘ দেখেছি আমরা৷’
মঙ্গল সিংহ প্রথমে বলল, ‘কোথায় দেখেছেন?’ তারপর অচৈতন্য রাজাসাহেবকে তুলে ধরে বললেন, ‘এঁকে মাচা থেকে নামিয়ে হাভেলিতে নিয়ে যেতে সাহায্য করুন আপনারা৷’
তিন
হাভেলিতে ফিরে এসেছি আমরা৷ রাজাসাহেবকে তাঁর ঘরে শুইয়ে এসে বারান্দায় আমাদের মুখোমুখি দাঁড়াল মঙ্গল সিংহ৷ ঠিক সেখানে, যেখানে রাজাসাহেবের ছবিটা দেওয়ালের গায়ে টাঙানো আছে৷ মঙ্গল সিংহ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘আপনারা যা দেখলেন, তা সবই সাজানো ঘটনা৷’
আমি বললাম, ‘তার মানে?’
সে বলল, ‘আপনারা নিশ্চয়ই রাজাসাহেবের মুখ থেকে তাঁর বাঘ শিকারের গল্প শুনেছেন? বাকিটা আমি আপনাদের শোনাচ্ছি৷
‘সত্যি সেই রাতে মহেন্দ্র সিংহের প্রাথমিক উদ্দেশ্য সফল হল৷ নরখাদকটা ছিল নালার মধ্যে৷ মহেন্দ্র সিংহকে রাজাসাহেব ভেবে তার পিছন-পিছন উঠে এল বাঘটা৷ কিন্তু ধূর্ত বাঘটা এমন ভাবে ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে গুড়ি মেরে এল যে, মাচায় বসা রাজাসাহেব প্রথমে দেখতে পাননি তাকে৷ মাচার নীচে এসে দাঁড়াল মহেন্দ্র সিংহ৷ সেও সম্ভবত টের পায়নি বাঘটার উপস্থিতি৷ আর এর পরই বাঘটা একটা ঝোপ থেকে বেরিয়ে কোনাকুনি ভাবে ঝাঁপ দিল তাকে লক্ষ করে৷ রাজাসাহেবও সঙ্গেসঙ্গে গুলি চালালেন, কিন্তু প্রথমবার তাঁর গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল৷ তবে দ্বিতীয় গুলিটা ফুঁড়ে দিল নরখাদকের হৃৎপিণ্ড৷ দুটো গুলির মধ্যে ছিল মুহূর্তের ব্যবধান৷ তবু তারই মধ্যে যা ঘটার ঘটে গেল৷ রাজাসাহেব যখন মাচা থেকে নীচে নামলেন৷ তখন মাটিতে পড়ে থাকা দুটো দেহই ছিল প্রাণহীন৷ ওই মুহূর্তের ব্যবধানেই নরখাদকটা দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল মহেন্দ্র সিংহের ঘাড়ে৷
‘এ ঘটনার পর রাজাসাহেবের মনে ধারণা জন্মাল যে, মহেন্দ্রের মৃত্যুর জন্য তিনিই দায়ী৷ এ গ্লানি থেকে মুক্ত হতে পারলেন না তিনি৷ থেকে গেলেন এই হাভেলিতে৷ মহেন্দ্রর শিশুপুত্রকে তিনি মানুষ করার দায়িত্ব নিলেন৷ কিন্তু পরে মাথাটাও খারাপ হল৷ চাঁদনি রাত হলেই তিনি বন্দুক হাতে বেরিয়ে পড়তে শুরু করলেন জঙ্গলে৷ তাঁর মনে হয়, নরখাদকটা আর মহেন্দ্র আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে জঙ্গলে৷ তিনি এক গুলিতে বাঘটাকে সাবাড় করে ফিরিয়ে আনবেন তাঁর মহেন্দ্রকে৷ কিন্তু ব্যাপারটা তো বিপজ্জনক৷ বাঘ তো আজও আছে জঙ্গলে৷ তাই রাজাসাহেবকে শান্ত করার জন্য আমি একটা কাজ করি৷ আমি নিজেই চাঁদনি রাতে মহেন্দ্র সাজি৷ নরখাদকের সেই পুরোনো মাথাটা নিয়ে গিয়ে ঝোপের মধ্যে রাখি৷ রাজাসাহেব বন্দুক নিয়ে মাচায় বসেন৷ তাতে অবশ্য সত্যি গুলি থাকে না, থাকে ফাঁকা কার্তুজ৷ ওতে শুধু আগুন আর শব্দ হয়৷ আমি যখন নালা থেকে উঠে আসি, তখন ঝোপের উপর আলো ফেলে বাঘের মাথাটা দেখতে পেয়ে গুলি চালান তিনি৷ ব্যাপারটাকে সত্যি ভেবে এর পর বেশ কিছুদিন শান্ত থাকেন রাজাসাহেব৷ আমার পরিচয়টা এবার বলি, আমিই হলাম মহেন্দ্র সিংহের সেই ছেলে৷’
মঙ্গল সিংহের গল্প শুনে আশ্চর্য হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম৷ সে চলে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘তবে বাঘ কিন্তু দেখা হয়ে গিয়েছে আপনাদের৷’
আমি বললাম, ‘মানে?’
‘আজ জঙ্গলে যাওয়ার পর খেয়াল হল, (স্টাফ করা বাঘের মাথা-টা) নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছি৷ এই তো এখনও আপনাদের সামনেই টাঙানো আছে মাথা-টা৷ যাকে আপনারা জঙ্গলে দেখেছেন, সেটা আসল বাঘ৷ আপনারা খেয়াল না করলেও মাচায় ওঠার পর আমি তাকে দূরে চলে যেতে দেখেছি৷ প্রকাণ্ড একটা বাঘ! সাধারণত ও বাঘটা এদিকে আসে না৷ রাজাসাহেবের বন্দুকে গুলি ছিল না৷ ইচ্ছে করলেই ও মাচা থেকে টেনে নিয়ে যেতে পারত কাউকে৷ কাল তার সঙ্গে আপনাদের মোলাকাতের চেষ্টা করব৷’
পরদিন মঙ্গল সিংহের দৌলতে সত্যি তার দেখা পেলাম আমরা৷ জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গায় বিরাট একটা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আমাদের গাড়ির কিছুটা তফাতে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়াল সেই মহাকায় শাদূল৷ রাজকীয় তার দাঁড়াবার ভঙ্গিমা৷ সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে তার ডোরাকাটা হলুদ দেহ৷ ভাবখানা এমন, সে যেন আমাদের খেয়ালই করেনি৷ আমরা নিস্পন্দ হয়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে৷ মঙ্গল সিংহ চাপা স্বরে মন্তব্য করল, ‘বান্ধবগড়ের আর-এক রাজাসাহেব! অরণ্যের রাজা!’
ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে পড়ল গত কাল রাতে শোনা মঙ্গল সিংহের কথাগুলো, ‘রাজাসাহেবের বন্দুকে গুলি ছিল না৷ ইচ্ছে করলেই মাচা থেকে টেনে নিয়ে যেতে পারত কাউকে৷’
মঙ্গল সিংহের ডাকই সংবিত ফিরল আমাদের৷ সে বলল, ‘চলুন, এবার হাভেলিতে ফিরতে হবে৷ রাজাসাহেব সেখানে অপেক্ষা করছেন৷’