৫
বিকাল সাড়ে চারটা। সমস্ত শপিং শেষে নিউ মার্কেটের দুই নম্বর গেটের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে ওরা চারজন। চারজনেরই দুহাত ভরা শপিং। রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে তারা। অন্যসময় একসাথে এতগুলো শপিংয়ের ফরমায়েশ ঈষিতা দিলে অবশ্যই রেগে যেতো ফাহাদ। তবে আজ সে রাগছে না। এই শপিংয়ের ব্যস্ততার বাহানায় নিশাতকে একটু হলেও স্বাভাবিক লাগছে। খানিকটা সময়ের জন্য হলেও আবীর নামক পোকাটা ওর মাথার ভিতর নড়াচড়া কম করছে। এসব ভাবতে ভাবতেই নিশাতের দিকে চোখ গেলো ফাহাদের। একদৃষ্টিতে কাউকে দেখছে সে। চোখে পানি ছলছল করছে। দ্রুত ফাহাদ ঘাড় ঘুরালো। আবীর আর তার সাথে একটি মেয়ে হাঁটতে হাঁটতে এদিকটাতেই এগিয়ে আসছে। মেয়েটা আবীরের হাত জড়িয়ে রেখেছে। এটা ওর প্রেমিকা নিশ্চয়ই! হাতে থাকা ব্যাগগুলো রাস্তার উপর ফেলে আবীরের দিকে দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করলো নিশাত। এতক্ষণ পুরো ঘটনা নিম্মি নিঝুমের চোখে না পড়লেও এখন সেটা পড়েছে। হতবিহ্বল হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে তিনজন। কি করবে বা কি করবে না সেসব ভাবতে ভাবতেই ফাহাদও নিজের হাতের ব্যাগ ফেলে ছুটলো নিশাতের পিছু। আবীরের মুখোমুখি নিশাত দাঁড়াতেই ওর হাত টেনে ধরলো ফাহাদ।
–নিশাত চলো।
.
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিশাত। দু’চোখ বেয়ে পানি ঝরছে তার। অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছে সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে। গলা পর্যন্ত এসে আটকে যাচ্ছে কথাগুলো। নিশাতকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো আবীর। মেয়েটার মুখোমুখি হওয়ার পর হচকচিয়ে থমকে গেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়েছে সে। দেরী না করে প্রেমিকার হাত শক্ত করে ধরে চলে যাচ্ছে সে। নিশাত তাকিয়ে আছে সেই হাতজোড়ার দিকে। ফাহাদ নিশাতের কাঁধ জড়িয়ে বললো,
— রাস্তাঘাটে কেঁদো না। মানুষ দেখছে। চোখ মুছো।
কান্না বাঁধ মানছে না নিশাতের। নিঃশব্দে ঠোঁট চেপে কেঁদেই যাচ্ছে ও। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বোনদের ইশারা দিলো ব্যাগগুলো নিয়ে এখানে আসার জন্য। নিশাতের কাঁধ ছেড়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে এসে রিকশা ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছে সে।
নিঝুম ফাহাদের সাথে রিকশা ঠিক করতে লেগে পড়েছে। নিম্মি এসে দাঁড়িয়েছে নিশাতের পাশে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে নিশাতকে দেখছে সে। কতটা অসহায় দেখাচ্ছে মেয়েটাকে! নিশাত নিজের অনুভূতি কখনোই আটকে রাখতে পারে না। সেটা নিম্মির অজানা নয়। তবে রাস্তাঘাটে কান্নাকাটি করার মানুষ সে না। নিজেকে ধরে রাখার এতটুকু ক্ষমতা ওর মাঝে অবশ্যই আছে। কষ্টগুলো হয়তো মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে তাই ক্ষমতাটুকুও হয়তো হারিয়ে গেছে। এই মুহূর্তে নিশাতকে কি স্বান্তনা দেয়া উচিত? কিইবা স্বাস্তনা দিবে ওকে? নিশাত কষ্ট পেয়ো না বা কেঁদো না এ ধরণের কিছু? কাউকে হারানোর কষ্ট কিংবা কান্না কি কোনো মানুষের কথায় থেমে যায়? যায় না তো। গেলে নিশ্চয়ই এতদিনে ওর মা বাবার স্বান্তনায় থেমে যেতো! সামনের দিক থেকে নিঝুম ডেকে বললো,
— নিম্মি, রিকশা পেয়ে গেছি। আয় রিকশায় উঠবি।
নিশাতের দিকে তাকিয়ে নিম্মি বললো,
— চলো, রিকশায় উঠি
নিম্মির পেছন পেছন গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে রিকশায় উঠে বসলো সে। ফাহাদ বললো,
–তোরা বাসায় যা। আমরা রিকশা পেলেই ঐটা নিয়ে চলে আসবো।
— আচ্ছা।
–খেয়াল রাখিস ওর দিকে।
— হুম।
— এক বোতল পানি কিনে দিবো নিশাত? খাবে?
ডানে বামে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালো সে।
— আচ্ছা যাও তাহলে। মামা, একটু সাবধানে নিয়ে যাবেন।
নিশাতদের রিকশা ছাড়তেই চেহারায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফাহাদ বললো,
–শালা মেজাজটাই দিলো খারাপ করে।
–কার কথা বলছো? আবীর না?
–আর কে? এটাকে বলে কপাল। ওকে দেখছিলি তুই? মোটামুটি স্বাভাবিক লাগছিলো কিন্তু ওকে। কপাল খারাপ আসলে বুঝলি। আর নয়তো এই ছেলে আজকে কোত্থেকে মুখোমুখি এসে পড়লো। তার উপর নিশাতকে দেখিয়ে গার্লফ্রেন্ডের হাত আরো শক্ত করে ধরলো।
— একজন প্রতারকের কাছ থেকে কি তুমি ভালো কিছু আশা করো? ও তো এমনই করবে তাই না?
৬
লোহার বড় গেইট। গেইটের একপাশে লাগানো বাগানবিলাসের গাছটা গেটের উপর গোল আকৃতি হয়ে ঝোপের আকার নিয়েছে। ছোট ছোট অসংখ্য রাণী গোলাপী রঙের ফুল ফুটে আছে গাছ জুড়ে। কিছু তাজা ফুল বাতাসের তোড়ে গেইটের কাছে আর উঠোনে ছড়িয়ে আছে। উঠোন পেরিয়ে বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন শালুক। তার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে কাজের মেয়ে দুটো। মিনিট পনেরো আগে ফাহাদ ফোন করে মাকে জানিয়ে রেখেছে আর কিছুক্ষন বাদেই ওরা বাড়ি ফিরবে। সেই থেকে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। মনে মনে কতটা অস্থির হয়ে আছেন তা কেউ জানেনা। এই অস্থিরতা শুধু উনিই জানেন। এতগুলো বছর পর ছেলেকে একটু ছুঁয়ে দেখবেন ভাবতেই খুশিতে কান্না চলে আসছে।
.
হর্ণ বাজিয়ে কালো রঙের একটা গাড়ি এসে ঢুকছে লোহার গেইট পেরিয়ে। ছুটে সামনে এগিয়ে এলেন শালুক। গাড়ি থেকে প্রথমেই নেমে এলো নাহিদ। দৌঁড়ে এসে মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে দাঁড়াতেই ছেলের বুকে আছড়ে পড়লেন তিনি ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন। শক্ত করে দু’হাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন। শান্তি পাচ্ছেন তিনি, কলিজা জুড়িয়ে আসা শান্তি। মায়ের চোখের পানিতে নাহিদের শার্টের বুকের অংশ ভিজে যাচ্ছে। কাঁপা কণ্ঠে ছেলেকে বললেন,
–খিদা লাগছে তোর তাই না? মুখটা শুকায়া গেছে।
— আপনি ভালো আছেন আম্মা?
–খুব ভালো আছি। তোরা সব ভাইবোন আমার চোখের সামনে আছোস এতেই আমার সব সুখ।
— চালের রুটি বানিয়েছেন?
— হো। দেশী মুরগী ভুনাও আছে।
— আসলেই খুব ক্ষুধা লেগেছে। ঘরে চলেন। খাবার দিবেন।
মায়ের হাত ধরে বাড়ির ভিতর যাচ্ছে নাহিদ। ক্ষীণ কন্ঠে মাকে জিজ্ঞেস করলো,
— আম্মা, ফাহাদের শালীর কি কোনো সমস্যা?
–কার কথা বলিস?
— ঐ যে নিশাত মেয়েটা।
— কি সমস্যা হবে?
— গাড়িতে উঠার পর থেকে দেখছি কিছুক্ষন পরপর কেঁদেই যাচ্ছে।
–আসছে ও?
— হ্যাঁ। আমাদের সাথেই তো আসলো।
–কই?
— পেছনে বোধহয়।
ছেলের কথা শুনে তৎক্ষণাৎ পেছনে তাকালেন শালুক। তার দুই মেয়ে আর ছেলের বউয়ের পেছন পেছন গুটিগুটি পায়ে মাথা নিচু করে হেঁটে আসছে নিশাত। হাসিমাখা মুখে কন্ঠস্বর উঁচু করে শালুক জিজ্ঞেস করলেন,
— নিশাত! ভালো আছো আম্মা?
মাথা তুলে তাকালো নিশাত। জোরপূর্বক ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে জবাব দিলো,
— ভালো।
নাহিদ তাকিয়ে আছে নিশাতের দিকে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে মাথা টাথা ঘুরে পড়ে যাবে যেকোনো সময়। কি হয়েছে মেয়েটার? এত মনমরা কেনো হয়ে আছে?
.
রাত আড়াইটা। পুরো ঘরের মানুষ বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। নিজের ঘরের বিছানায় বসে আছে নাহিদ। সামনের ভাঙা দেয়ালটা পেরিয়েই রুম্পার ঘরের জানালা। এখন এই ঘরটাতে কে থাকে তা জানা নেই নাহিদের। তবে একটা সময় এখানে রুম্পা থাকতো। কতশত গল্প আছে এই জানালা জুড়ে যেগুলো আজ শুধুই স্মৃতি। কিছু স্মৃতি থাকে সুখের আবার কিছু কষ্টের। রুম্পা নামক স্মৃতিটা সুখ দিয়ে শুরু হলেও শেষটা খুব বাজে ছিলো। এমনিতে পুরোনো গল্পগুলো নাহিদের মনে পড়ে না। দেশের মাটিতে পা রাখলেই স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভীড় জমাতে থাকে। মেসেঞ্জারে টুংটাং শব্দে অতীত নামক ঘোর কাটলো নাহিদের। স্ক্রিন অন করতেই দেখতে পেলো তার বিদেশি বন্ধু সিমিনের ম্যাসেজ। মুচকি হেসে রিপ্লাই দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।
.
ড্রইংরুমের ফ্লোরে বসে আবীরের আইডিটা দেখছে নিশাত। আইডি জুড়ে শুধু ভালোবাসামাখা স্ট্যাটাস। নিশাত জানে একটা স্ট্যাটাসও ওকে নিয়ে না। নতুন কাউকে নিয়ে। ছবির এ্যালবাম থেকে নিশাতের সাথে সমস্ত ছবি ডিলিট করে দিয়েছে। সেখানে জায়গা করে নিয়েছে নতুন মুখ। কিভাবে পারে মানুষ এত নিষ্ঠুর হতে? কিভাবে পারলো আবীর ওকে দেখিয়ে প্রেমিকার হাত শক্ত করে ধরতে? ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। কিন্তু তার ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে ফ্লোরে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদতে। এভাবে কাঁদা নিশাতের ধাতে কখনোই ছিলো না। খুব জোর গুনগুন শব্দ করে কাঁদতে পারে সে। চিৎকার করে কখনোই না।
.
চ্যাট করতে করতে ডাইনিংরুমে এসেছে নাহিদ। রান্নাঘরের লাইট জ্বালানো। সেই আলো এসে আবছা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ডাইনিংরুম আর ড্রইংরুমে। জগ থেকে মগে পানি ঢালতে যাবে এমন সময় কারো হেঁচকি তোলার আওয়াজ এলো কানে। ড্রইংরুমের মাঝ বরাবর কেউ বসে আছে। আবছা আলোয় মুখ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে সেদিকে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলো নিশাত ফোনের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে পাশাপাশি বসে হাসছে। নিশাত ওদের দেখেই কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলেছে। নিশাতের বরাবর একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে টর্চ হাতে সেদিকে খেয়ালই নেই তার। ফোনের টর্চ লাইট বন্ধ করে ডাইনিংরুম থেকে একগ্লাস পানি হাতে ফেরত এলো নাহিদ। নিশাতের পাশে বসে গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
— পানি খাও।
— নাহিদের কথায় ঘোর কাটলো নিশাতের। পাশে বসে থাকা মানুষটাকে দেখতেই খানিকটা সরে বসলো সে।
— ভয় পাচ্ছো তুমি? আমি নাহিদ। চিনতে পারোনি?
–হুম।
— চমকে গেলে যে!
–……………….
— নাও, পানি খাও।
নাহিদের হাত থেকে গ্লাস নিয়ে এক নিঃশ্বাসে সবটুকু পানি খেয়ে নিলো নিশাত।
–আরেক গ্লাস পানি দিবো? খাবে?
— উহুম।
–সেই সকাল থেকে দেখছি হয় তুমি কাঁদছো আর নয়তো কান্নামুখো হয়ে বসে আছো। কেউ তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিচ্ছো। নিজে থেকে একটা টু শব্দও করছো না। সারাদিনে তোমাকে একবারের জন্যও স্বাভাবিক দেখিনি। এখন প্রায় তিনটা বেজে যাচ্ছে তুমি না ঘুমিয়ে এখানে বসে কাঁদছো। রাতে তুমি কিছুই খাওনি। কি হয়েছে?
— ……………
–ছবির ঐ ছেলেটা কে?
— …………………
–তোমার বয়ফ্রেন্ড? ব্রেকআপ হয়েছে ওর সাথে?
নাহিদের প্রশ্নে আবারো ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে নিশাত। যা বুঝার বুঝে নিয়েছে সে। আর কোনো প্রশ্ন না করে নিশাতের হাত ধরে টেনে তুললো সে। নিঝুম নিম্মির ঘরে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দু’বোনকে ঘুম থেকে উঠার জন্য ডাকলো। ভাইয়ের ডাক শুনে নিঝুম হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠলেও নিম্মি এখনো ঘুমের নেশা কাটিয়ে চোখজোড়া মেলতে পারছে না। কোনোমতে চোখ একটু করে খুলে রেখেছে। ঐ একটু করে খোলা চোখে নিম্মি দেখতে পাচ্ছে তার বড়ভাই নিশাতের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নিশাত কাঁদছে। ঘটনার আগা মাথা কিছুই বুঝতে না পেরে আবার চোখ বন্ধ করে ওপাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেলো নিম্মি। নিঝুমকে নাহিদ বললো,
— কিরে? তোরা কি ঘুমাস নাকি অজ্ঞান হয়ে যাস বুঝলাম না?
— কি হয়েছে? ও তোমার সাথে কেনো?
–জলজ্যান্ত একটা মানুষ তোদের পাশ থেকে উঠে বাহিরে বসে কাঁদছে অথচ তোরা কেউ টের পেলি না। এসব কি হ্যাঁ? খেয়াল রাখবি না একটু?
— ঘুমিয়ে গেলে কি খেয়াল থাকে বলো?
–খেয়াল রাখতে হয় নিঝু
— সরি…… আসলে……
–আচ্ছা বাদ দে। এই মেয়ে, যাও খাটে যাও। এখন ঘুমাও। কাল সকালে উঠে আবার কেঁদো। সারাদিন অনেক কেঁদেছো। আজকে আর না কাঁদলেও চলবে। গুটিশুটি পায়ে নিম্মির ওপাশে গিয়ে খাটে উঠে বসে পড়লো নিশাত। নাহিদ লাইট বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই পিছন পিছন বেরিয়ে এলো নিঝুম। ডাইনিং টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে চেয়ার টেনে বসলো নাহিদ। টেবিলের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে নিঝুম। এক চুমুক পানি খেয়ে নাহিদ জিজ্ঞেস করলো,
— কিছু বলবি?
— ও কি বাসা থেকে বের হয়ে বাহিরে বসে কাঁদছিলো?
— নাহ্। ড্রইংরুমে বসে কাঁদছিলো।
— ওহ।
— একটু খেয়াল রাখিস বুঝলি। আরেকজনের মেয়ে নিয়ে এসেছিস বাসায়। সকাল থেকে যা দেখছি মেয়ের মানসিক অবস্থা তো বিশেষ সুবিধাজনক না। পরে দেখা যাবে এ বাসায় থেকে সুইসাইড এটেম্পট নিলে কেলেংকারী ঘটবে I
–ওকে যথেষ্ট বুঝিয়েছি আমরা সবাই। ও বুঝে না।
–ব্রেকআপ কেইস নাকি?
— হুম।
–কত বছরের প্রেম?
–পাঁচ বছরের।
–মেয়ের বয়স কত?
— ঊনিশ।
মুখ বাঁকিয়ে হাসলো নাহিদ। নিঝুমকে বললো,
— বাচ্চা বয়সের প্রেম তাহলে! চেয়ার টেনে বস এখানে। আমাকে একটু গল্প শুনিয়ে যা। কারো ছোট বয়সের প্রেম কাহিনী শুনতে ভালোই লাগে।
— ঐ তো স্কুল লাইফের প্রেম আরকি। এইটে পড়তো তখন ও। ছেলে ঐ এলাকারই ছিলো।
— সমবয়সী?
— উহুম। হবে হয়তো পাঁচ ছয় বছরের বড়।
–আচ্ছা। তুই দেখেছিস ছেলেকে?
–দেখিনি আবার! কত দেখলাম। নিশাতদের বাসায় যাতায়াত ছিলো ছেলের। ওখানে দেখেছি। ঢাকায় একসাথে ঘুরেছিও আমরা। আমাদের এ বাড়িতেও বেড়াতে এসেছিলো দুবার।
–বলিস কি রে! মেয়ের বাসায় যাতায়াত! আবার এই বাসায়ও এসেছে! বাসায় কি বলে পরিচয় করিয়েছে? বন্ধু?
— নাহ্। যা সত্যি তাই বলেছে। দুই পরিবারই জানতো। রাজিও ছিলো। নিশাতের পড়া শেষ হলেই বিয়ে দিতো ওদের।
— মা-বাবারা কত বদলে গেছে না রে নিঝু? আমাদের সময়ে বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ডের বাসায় যাবে তো দূরের কথা, ছেলেমেয়ে প্রেম করছে এই কথা বাবা-মায়ের কান পর্যন্ত গেলেই আগুন লেগে যেতো। আর এখন…..
অট্টহাসি হাসতে লাগলো নাহিদ। গভীর রাতের নিস্তব্ধতায় সেই আওয়াজ আরো বিকট শোনাচ্ছে। এই ঘটনায় হাসির কি ছিলো সেটা আপাতত খুঁজে পাচ্ছে না নিঝুম। তাই সে হাসছেও না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নাহিদের দিকে তাকিয়ে আছে সে। হাসি থামিয়ে নাহিদ জিজ্ঞেস করলো,
— দুই ফ্যামিলি তো রাজি ছিলো। তাহলে ব্রেকআপ হলো কেনো?
— ফ্যামিলি রাজি থাকলে কি হবে? ছেলের তো রাজি থাকতে হবে। ছয়মাস আগে চাকরিতে জয়েন করলো। তারপর থেকেই একটু একটু পরিবর্তন। মাস দুয়েক ভেঙে যাবে যাবে ভাব। এরপর ফাইনালি চারমাস আগে ব্রেকআপ।
–কারন কি?
— নিশাত নাকি প্রচুর ইমম্যাচিউর। এত ইমম্যাচিউর মেয়ের সাথে সংসার করা সম্ভব না। তাছাড়া আজকাল ওর কথাবার্তা শুনলেই নাকি সেই ছেলের বিরক্ত লাগে। ন্যাকা ন্যাকা আবদার নাকি ধরে।
— ন্যাকা? কি ধরনের ন্যাকা?
— যেমন ধরো আগে আবীর রাত দেড়টা দুইটায় বাসার সামনে এসে নিশাতকে বলতো একটু বারান্দায় আসো, তোমাকে এক মিনিট দেখেই চলে যাবো। তারপর দুই তিন ঘন্টায় একবার হলেও কল করতো। এসবই আরকি। নিশাত এতগুলো বছরে এই অভ্যাসগুলোতে অভ্যস্ত। অভ্যাসগুলো ওর বয়ফ্রেন্ডেরই তৈরী করা। তো উনি জব পাওয়ার পর খুব ব্যস্ততা দেখাতো। নিশাত চাইতো ছুটির দিনগুলোতে এটলিস্ট ওর এই আবদারগুলো পূরন করুক। উনি দেখা যেতো ছুটির দিনেও এই কাজ ঐ কাজের ব্যস্ততা দেখাতো।
–ফালতু অজুহাত। শোন, একটা মানুষ কখনোই এতটা ব্যস্ত থাকে না যে কাজের ফাঁকে তোকে দুই ঘন্টা পরপর একটা কল করে খোঁজ নিতে পারবে না। হোক না সেটা এক মিনিটের জন্যই। ব্যস্ততার মাঝে এক মিনিটের ফোন কলও ভালোবাসার মানুষের জন্য অনেক কিছু। আর রইলো কথা রাতে দেখা করার। সেটাতো সে সপ্তাহে একদিন করতেই পারে। খুব আহামরী কঠিন তো না, তাই না? আর যদি ইমম্যাচিউরিটির কথা আসে তো বলবো পাঁচবছর এই ছেলে কোথায় ছিলো? এতবছরে এটা টের পায়নি?
— ভাবী একই কথাগুলো ঐ ছেলেকে বলেছিলো।
–পরে? কি উত্তর দিলো?
— কিছুই না। চুপ করে শুনেছে শুধু।
সব কথার শেষ কথা ছেলেটা লয়্যাল না। তাই নিশাতকে ফেলে অন্য সম্পর্কে ডুব দিয়েছে। এতবছরের একটা সম্পর্ক এসব তুচ্ছ কারনে কেউ ভেঙে দেয় না। আবীর খুব ভালো আছে। এইতো গতকালই দেখলাম ও গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিশাতকে দেখিয়ে আবার গার্লফ্রেন্ডের হাত শক্ত করে চেপেও ধরেছে। নিশাতই ভালো নেই। আবীরকে মন থেকে সরাতেই পারছে না।
— সরে যাবে।
— কে?
–আবীর।
–কিভাবে?
তোর না জানলেও চলবে। আচ্ছা তুই ঘুমাচ্ছিলি কেনো? তোর না সামনে বিয়ে? বরের সাথে রাত জেগে কথা বলিস না?
মুচকি হেসে নিঝুম বললো,
— নাহ। সামনে বিয়ে। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল ফেললে কেমন লাগবে বলো তো?
ভেংচি কেঁটে নাহিদ বললো,
— এ্যাহ… ডার্ক সার্কেল! শোন এই সময়গুলো আর পাবি না। এখনকার স্মৃতিগুলো পরবর্তী সময়ে সংসার ধরে রাখার জন্য টনিকের মত কাজ করবে।
–এমনভাবে বলছো মনে হয় যেনো সংসার করছো এক যুগ হয়ে গেছে।
— সেদিন আমার বিয়েটা হয়ে গেলে তো এক যুগই হতো।
— ভাইয়া, বারো বছর আগের একটা ঘটনা আর কতদিন মনে আগলে রাখবে?
সবাই সবার জীবনে এগিয়ে গেছে। যার হাত ধরে বাকি জীবন পাড়ি দিতে চেয়েছিলে সে তোমার হাত ছাড়াই ভালো আছে। ভালো নেই তুমি। এতগুলো বছর ধরে একাই ভুগে যাচ্ছো। সেই সাথে আমরাও।
— তোর বরকে আসতে বলিস। ওর সাথে বসে একটু চা-নাস্তা খাবো।
— কথা ঘুরাচ্ছো তুমি।
–যা গিয়ে ঘুমা। সামনে তোর বিয়ে। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়বে। আমিও যাই। ঘুমাই গিয়ে। বোনের সামনে বিয়ে। ব্যাচেলর ভাইয়ের চোখে ডার্ক সার্কেল পড়লে কি আর বেয়াইনদের কাছে দাম পাওয়া যাবে?
.
চেয়ার ছেড়ে হাসতে হাসতে উঠে গেলো নাহিদ। নিঝুম জানে ওর ভাই ঘুমাবে না। নিশাতকে দেখে নিজের অতীতগুলো মনের মধ্যে নাড়াচাড়া দিয়ে উঠেছে নিশ্চয়ই। ওদের গল্প একইরকম না হলেও মন ভাঙার কষ্ট তো একই। দুজনেরই ছোট বয়সের প্রেম। দুজনেরই দীর্ঘ সময়ের প্রেম। এতবছরের লালিত স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার কষ্ট হয়তো দুজনেরই একইরকম। নয়তো কারো একটু কম কারো একটু বেশি।
৭
খুব সকালে ঘুম ভাঙলো নাহিদের। পর্দার ফাঁক গলে বিছানার উপর রোদ এসে ছড়িয়ে পড়ছে। সিমিনের সাথে চ্যাট করতে করতে কখন যে চোখটা লেগে এসেছে টেরই পায়নি সে। বহুবছর পর এই ঘরে বসে সকাল বেলার দেখা পাওয়া গেলো। পর্দা সরিয়ে বাহিরে তাকাতেই চোখ গেলো জানালার কাছের আমগাছটার দিকে। দুটো পাখি পাকা আম ঠুকরে খাচ্ছে। পাখি দুটো দেখতেই মনে পড়ল সিমিনের কথা। ওকে পাখিগুলোর ছবি পাঠালে কেমন হয়? শীত ছাড়া তো দেশে কখনো আসা হয় না তার। পাখির এমন কান্ড হয়তো কখনো দেখতেও পায়নি সে। ছবিটা দেখে খুব খুশি হবে নিশ্চয়ই! বালিশের পাশ থেকে ফোন হাতে নিতেই মায়ের ডাক শুনতে পেলো,
— নাহিদ….
ঘাড় ঘুরিয়ে জবাব দিলো সে,
— হ্যাঁ আম্মা?
–ভেতরে আসি?
–আসেন। আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেনো?
মুচকি হেসে নাহিদের বিছানায় এসে বসলেন শালুক। ছেলের হাতের কব্জিতে হাত বুলিয়ে বললেন,
— তোরে ছাড়া বাড়িটা খালি খালি লাগে। মনে হয় কি জানি নাই।
— ঘরভর্তি লোক আছে। তবুও যদি আপনি বলেন বাড়ি খালি লাগে?
–হুম ঘরভর্তি লোক আছে। তুই তো আর নাই।
চুপ করে বসে রইলো নাহিদ। ইতস্তত ভঙ্গীতে নীল রঙের বিছানার চাদরে প্রিন্ট করা সাদা ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে সে। শালুক জানেন এই ধরণের কথাগুলো তার ছেলে যথাসাধ্য এড়িয়ে চলে। তবুও তিনি বলেন। ওপাশ থেকে এই কথার প্রেক্ষিতে কোনো কথা ফেরত আসবে না সেটাও শালুক জানেন। এরপরও তিনি ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন জবাব শোনার আশায়। মায়ের দিকে তাকিয়ে কথার প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো নাহিদ।
–আম্মা তখন আপনি ঘরে ঢোকার আগে আমার অনুমতি চাইলেন কেনো? আগে তো চাইতেন না।
— আগে তুই ছোট ছিলি। এই ঘরের সদস্য ছিলি। তোর কাপড়চোপর, জুতা, খাবারের প্লেট সবকিছু আমার আগায়া দেয়া লাগতো। নিজে নিজে কিছু করতে পারতি না। এখন তো তুই বড় হইছোস। নিজে নিজে সব কাজ করতে শিখছোস। নিজের আলাদা জগত আছে। তুই তো আর আমার এই ঘরের সদস্য নাই। বহুবছরে একবার বেড়াইতে আসোছ। তাই ঘরে ঢুকার আগে তোরে জিজ্ঞেস করি।
— আপনি কিন্তু আমাকে খোঁচাচ্ছেন।
— আচ্ছা যা, এই কথা বাদ। নাস্তা কি খাবি?
–খুদের ভাত আর ভর্তা করেন।
— আচ্ছা। চা দিয়া যাবো এখন? দেন খাই।
–ইয়ে… নাহিদ?
— হ্যাঁ?
–ঐ দেশে কাউরে পছন্দ হয়?
— কেন আম্মা? আমাকে বিয়ে দিবেন?
কথাটা বলেই অট্টহাসি শুরু করলো নাহিদ। ছেলেকে এই কথা জিজ্ঞেস করলেই এভাবে পাগলের মত হাসতে থাকে। হাসির কারন খুঁজে পায়না শালুক। শুধু এই কথায় না, আরো কয়েকটা বিষয়ে কথা বলতে গেলেই নাহিদ অকারণে এমন পাগলের মত হাসতে থাকে। শালুকও প্রতিবার কারন না খুঁজে পেয়ে ছেলের মুখের দিকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে। বরাবরের মতো আজও ঘটনার ব্যতিক্রম হয়নি। আজও তিনি তাকিয়ে আছেন ছেলের চেহারার দিকে। নাহিদের হাসির গতি খানিকটা কমে এসেছে। মায়ের বোকা বোকা শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে সে বললো,
— কাউকে মনে ধরে না আম্মা।
— নিম্মি তোর সাথে একটা মেয়ের ছবি দেখাইলো সেদিন। ঐটারে বিয়ে কর।
–কোনটা?
–ঐ যে চুল রঙ করা মেয়েটা। সাদা রঙের গেঞ্জি পইরা ছিলো। চোখের নিচে একটা তিলও আছে।
— সিমিনের কথা জিজ্ঞেস করছেন?
— এমনই নাম ছিলো বোধহয়। তুই একটা ছাইরঙা গেঞ্জি পইরা ছিলি।
–হ্যাঁ ঐটা সিমিনই।
–তো ওরে বিয়ে কর।
–ওকে কেন বিয়ে করবো?
–কেন করবি না? খালি খালি রাস্তাঘাটে প্রেম কইরা লাভ কি? বিয়ে কইরা বউ ঘরে তোল।
— আমি ওর সাথে প্রেম করি আপনাকে কে বললো?
— তাইলে ওর কাঁধে হাত রাইখা ছবি তুললি যে!
–ও আমার বান্ধবী আম্মা।
–ওহ আচ্ছা। মেয়েটা মন্দ না। বিয়ে করলেও করতে পারোস।
— আচ্ছা বিয়ে করার শখ হলে জানাবো। আচ্ছা আম্মা, নিশাতকে আপনার কেমন লাগে?
— খুবই ভালো। অন্তর খুব সাফ। প্যাঁচগোচ নাই। কি সুন্দর কইরা হাসি দিয়া কথা বলে!
— আমি তো এখন পর্যন্ত হাসতেই দেখলাম না।
ছেলের কথায় হাসিমুখে আরেকটু সামনে এসে ঝুঁকে বসলেন শালুক। নাহিদের কাঁধে হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
― আব্বা তোর কি নিশাতরে পছন্দ হইছে? বিয়ে করবি?
মুহূর্তেই নাক মুখ কুঁচকে গেলো নাহিদের। বিরক্তিভরা কন্ঠে মাকে বললো,
— কিসের মধ্যে কি আম্মা? এইটুকুন একটা মেয়ে ওকে আমি কিভাবে বিয়ে করবো?
— তাতে কি? বয়সের পার্থক্য কোনো বিষয় না। পার্থক্য যত বেশি সংসার মজবুতও তত বেশি।
—আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি কারণ কানাডাতে ছোটভাই আছে দুই তিনজন বিয়ে করবে বলে সুন্দরী মেয়ে খুঁজছে। নিশাত মেয়েটা সুন্দর। স্বভাব চরিত্র তো আমি জানি না। তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি সংসারদারী করার জন্য এই মেয়ে কেমন হবে?
— বাপ তুই কি নিজের কথা বলতে লজ্জা পাইতাছোস? এজন্য কি আরেকজনের নাম দিয়া নিজের কথা জিজ্ঞেস করতাছোস?
— ধুর আম্মা! আপনাকে বলাই আমার ভুল হয়েছে। যান চা নিয়া আসেন আমার জন্য। চিনি একদম কম দিবেন। আর ভর্তায় ঝাল বেশি দিবেন।
মাকে আর কোনো কথা বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো নাহিদ। কিছু একটা ভাবকে ভাবতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন শালুক। ছেলের কথাটা তিনি কোনদিক থেকে বিবেচনা করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। ছেলে কি আসলেই নিশাতকে অন্যের জন্য পছন্দ করেছে নাকি নিজের জন্য? নিজের জন্য করলে কোনোদিক দিয়েই মন্দ হয় না। নিশাতকে তার খুব ভালো লাগে। নিশাতের বড় বোনকে এই বাড়িতে এনে তিনি ঠকেননি। নিশাতকে এনেও ঠকবেন না। হ্যাঁ মেয়েটার আপাতত পুরোনো প্রেমিকের শোকে মরনদশা লেগে আছে। কিন্তু এসব ব্যাপার না। নাহিদ ওকে সামলে নিবে। নাহিদ তার বউকে যথেষ্ট আদর করবে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই শালুকের। আদরে আদরে সব ভুলে যাবে। হ্যাঁ যদিও ঐ প্রেমিকের তুলনায় তার ছেলের গায়ের রঙটা একটু ময়লা। নাহ্! এটাও বড় ব্যাপার না। আদর পেয়ে প্রেমিকের গায়ের রঙও ভুলে যাবে। বেশ খুশি খুশি লাগছে শালুকের। ইচ্ছে হচ্ছে খুশিটা ঈষিতার সাথে এখনই ভাগাভাগি করে ফেলতে। কিন্তু সম্ভব না। ছেলেকে আরো কিছুদিন নজরে নজরে রাখা দরকার। ভাবগতি বুঝার পরই ঈষিতাকে জানাবেন এ ব্যাপারে। কিন্তু যদি সত্যিই অন্য কারো জন্য হয়ে থাকে তাহলে? না না এসব এখন ভাবা যাবে না। ভালো চিন্তায় ভালো হয়। মন্দ চিন্তায় মন্দ। তিনি এখন ভালোটাই ভাববেন। শুধুমাত্র ভালো।
.
চা হাতে ছেলের রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই চোখ পড়লো মেয়েদের ঘরের দিকে। থমকে দাঁড়ালেন শালুক। ব্রাশ হাতে পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে নিশাত। চোখ ফুলে আছে তার। পুরো চুল আউলে আছে। মোটামুটি রকমে বিধ্বস্থ দেখাচ্ছে তাকে। নিশাতকে জিজ্ঞেস করলেন,
— এত সকালে উইঠা পড়লা যে?
–ঘুম ভেঙে গেছে।
–হাত মুখ ধুইতে যাও?
–জ্বী ঐ বেসিনে যাবো।
–একটা কাজ করো তো। এই কাপটা নাহিদরে দিয়া আসো। রান্নাঘরে আমার একটু কাজ আছে।
নিশাত হাত বাড়িয়ে কাপটা নিতেই শালুকের টনক নড়লো এই আউল ঝাউল অবস্থায় নিশাতকে সেখানে পাঠানো যাবে না। পাঠাতে হবে সুন্দর করে পরিপাটি অবস্থায়। খুব দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে নিশাতকে আটাকালেন তিনি।
— এই নিশাত, দাঁড়াও দাঁড়াও।
— জ্বী খালাম্মা?
— তুমি গিয়ে মুখ হাত ধোও। আমিই চা দিচ্ছি।
–না খালাম্মা আমি দিতে পারবো। সমস্যা নেই।
–না না তোমাকে পাগলের মত লাগতেছে দেখতে। তুমি আগে পরিপাটি হও।
— জ্বী?
–না কিছু না। যাও যাও মুখ ধোও।
— আচ্ছা।
শালুকের হাতে চায়ের কাপ দিয়ে নিশাত হেলেদুলে বেসিনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভদ্রমহিলার কথার অর্থ ঠিক বুঝতে পারলো না নিশাত। চা দিতে হলে কেনো পরিপাটি হয়ে দিতে হবে?
৮
নাস্তার টেবিলে বসে নাস্তা করছে সবাই। নাস্তার প্লেট সামনে রেখে বসে আছে শুধু নিশাত। ভর্তার ঝাল তার সহ্যসীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। কয়েক লোকমা মুখে দেয়ার পর মুখে আর লোকমা তোলার সাহস পাচ্ছে না সে। নাক চোখ থেকে সমানতালে পানি বেরুচ্ছে। ওড়না দিয়ে একবার চোখ মুছছে তো আরেকবার নাক। বোনের এই অবস্থা দেখে খাওয়া ফেলে ঈষিতা গিয়েছে রান্নাঘরে ডিম ভাজতে। নিশাতের উল্টোদিকেই বসে আছে নাহিদ। নিশাতের ঝালে লাল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে মুখটিপে হাসছে আর খাচ্ছে সে। বেশ অনেকটা করে ভর্তা নিয়ে লাল করে ভাত মাখিয়ে বেশ আয়েশ করে খাচ্ছে। নিজের প্লেট থেকে এক লোকমা ভর্তা মাখানো ভাত তুলে নিশাতের মুখের দিকে এগিয়ে দিলো নাহিদ। বললো,
–আমার কাছ থেকে একটু খেয়ে দেখো। দারুন স্বাদ!
মুখ কুঁচকে নাক টানতে টানতে নিশাত বললো,
— মারতে চান আমাকে?
–শোনো বিষ খেয়ে মরার চেয়ে এক লোকমা ঝাল ভর্তা মাখা ভাত খেয়ে মরে যাওয়া ভালো। নাও হা করো দেখি!
— খাবো না আমি।
— মরতে চাও না?
— আমি কখন বললাম মরতে চাই?
— ওহ না মরতে চাইলে খুব ভালো। আমি তো ভেবেছিলাম মরার তীব্র আকাংক্ষা বুঝি মনে নিয়ে ঘুরছো। যাক, আমার ভাত তাহলে আমিই খাই।
নাহিদের কথায় খুবই বিরক্ত লাগছে নিশাতের। লোকটা নিশ্চয়ই গতরাতের বিষয়টা নিয়ে ওকে খোঁচাচ্ছে! নিঝুম তাকিয়ে আছে নিশাতের মুখের দিকে। ওর ভাইয়ের শেষ কথাটা যে নিশাতের মোটেই পছন্দ হয়নি সেটা খুব ভালোই বুঝা যাচ্ছে ওর মুখ দেখে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য হাসতে হাসতে নিঝুম বললো,
–বুঝলে নিশাত, ভাইয়া আগে এত ঝাল খেতো না। ব্রেকআপ হওয়ার পর থেকে প্রচুর ঝাল খায়।
–ব্রেকআপ না। বল যে বলপূর্বক ব্রেকআপ। তখন তো রুম্পার শোকে মনে জ্বালা করতো খুব। মদ খেতে মন চাইতো, বিষ খেতে মন চাইতো। এসব খেয়ে মনের জ্বালা মিটাতে ইচ্ছে হতো। পরে একদিন বন্ধু বললো এসব খাওয়ার চেয়ে নাকি ঝাল খাওয়া ভালো। জিহ্বার ঝালের যন্ত্রণায় নাকি মনের জ্বালা গায়েব হয়। বন্ধুর বাসায় ধানি মরিচের গাছ ছিলো। পুরো গাছ ভর্তি মরিচ। ব্যস, গাছের পাশে বসে একের পর এক মরিচ খেয়েই গেছি। খুব সম্ভবত ২৫-৩০ টা খেয়েছিলাম। বিস্ময়ভরা কণ্ঠে নিশাত জানতে চাইলো,
— আপনার পেট খারাপ করেনি?
টেবিলে বসা সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। রান্নাঘর থেকে ঈষিতা আর তার শাশুড়ীর হাসির শব্দও ভেসে আসছে। বোকা বোকা চেহারা নিয়ে নিশাত বললো,
— এটা মোটেও হাসির কথা ছিলো না। খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। একটা মানুষ এতগুলো মরিচ খেয়ে কিভাবে সুস্থ থাকতে পারে?
হাসির শব্দ আরও দ্বিগুন জোরে শোনাচ্ছে। নিশাতের ভ্রু জোড়া সেইসাথে ক্রমশ কুঁচকে আসছে। নিজের চেয়ার ছেড়ে নিশাতের পাশের চেয়ারে এসে বসলো নাহিদ। ততক্ষণে ঈষিতাও চলে এসেছে রান্নাঘর থেকে। ঈষিতার হাত থেকে ডিমভাজার প্লেট নিয়ে নিশাতের প্লেটে ডিমভাজা দিতে দিতে বললো,
— পেট তো একটু ব্যথা করেছিলো। কিন্তু তখন মূখ্য বিষয় ছিলো মনের জ্বালা কমানো। এইযে তুমিই চিন্তা করে দেখো তো যতক্ষণ তুমি ঝালের যন্ত্রণায় হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলে তখন কি একবারও মনে হয়েছে আবীরের কথা?
— আমি তো তখন খেয়াল করিনি।
–তাহলে আবার খাও। খেয়ে দেখো জিহ্বার ঝালের কাছে আবীর নামক কীড়া হার মানে কিনা?
ঈষিতার মুখের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে নিশাত। চোখজোড়া দিয়ে নির্বাক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো বোনের দিকে,
— আমি কি এখন পাগলা ঝাল খেয়ে কথাটার সত্যতা যাচাই করবো?
ঈষিতা হাসতে হাসতে বললো,
— তাকিয়ে আছিস কেনো? বুদ্ধি কিন্তু মন্দ না। ঝাল খেয়ে দেখতে পারিস। -ট্রাস্ট মি নিশাত। জাদুর মত কাজ করবে। আমি আগে সারাদিন রুম্পা রুম্পা করতেই থাকতাম আর চোখের পানি নাকের পানিতে একাকার হতাম। সেদিন ঐ মরিচগুলো খেয়ে সারাদিনে একবারও রুম্পাকে আমার মনে পড়েনি। এরপর থেকে যখনই ওর কথা মনে পড়তো ঝাল খেয়ে ফ্লোরে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকতাম। ব্যস, রুম্পা আমার মাথা থেকে হাওয়া।
–পরে যদি আমার গ্যাস্ট্রিক বেড়ে যায়? পেট খারাপ হয়?
— কি রে ফাহাদ? বাসায় গ্যাস্ট্রিকের মেডিসিন নেই?
–আছে তো। আর না থাকলেও সমস্যা নেই। দোকান থেকে এনে দিবো। তুমি খাও নিশাত। বেশি সমস্যা হলে হসপিটালেও নিয়ে যাবো।
.
ভর্তার বাটি টেনে নিজের দিকে নিয়ে এলো নিশাত। নাহিদের মত করে ভর্তা মাখিয়ে ভাত খাওয়া শুরু করেছে সে। নাহিদ জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে রেখেছে। চাওয়া মাত্রই যাতে নিশাতকে দেয়া যায়। কিন্তু পানি খাওয়ার নাম নিচ্ছে না মেয়েটা। একের পর এক লোকমা মুখে ঢুকিয়ে যাচ্ছে সে। প্রচন্ড ঝালে পুরো মুখ লাল হয়ে গেছে ওর। তবু থামছে না। ভাত খাওয়া শেষে বাটির অবশিষ্ট অংশের ভর্তাটুকুও খেয়ে শেষ করেছে সে। নিশাতের মনে হচ্ছে তার মাথা থেকে গলা পর্যন্ত কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। সেই আগুনের ধোঁয়া বেরুচ্ছে কানের ছিদ্র আর নিঃশ্বাস দিয়ে। চেয়ার ছেড়ে কোনোমতে হাত ধুয়ে ড্রইংরুমে গিয়ে পুরো ঘর পায়চারী করছে সে। কিছুক্ষণ পর পর নিজের দুই কান চেপে ধরে ক্ষীন কন্ঠে “আ” শব্দে চিৎকার করছে। নিম্মি নাহিদকে বললো,
— অবস্থা তো শোচনীয়।
–ব্যাপার না। ঠিক হয়ে যাবে।
–এক্সপেরিমেন্ট যদি ভুল হয়?
–যা গিয়ে চেক কর। ওকে জিজ্ঞেস কর আবীর প্রথম কবে ওকে আই লাভ ইউ বলেছিলো।
ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো নিম্মি। পেছন পেছন গেলো নিঝুমও। নিশাতকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— এই নিশু, আবীর তোমাকে কবে প্রথম ভালোবাসি বলেছিলো?
একরাশ রাগ বিরক্তি নিয়ে চিৎকার করে উঠলো নিশাত,
–অসভ্য মেয়ে দেখতে পাচ্ছো না আমি ঝালে মারা যাচ্ছি। ঐ বেয়াদবটার কথা জিজ্ঞেস করার সময় এটা?
বাহিরে আবারও হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ফাহাদ নাহিদকে বললো,
–ভালোই থেরাপী শিখেছো দেখা যায়!
প্রতিউত্তরে কিছু না বলে হাসতে হাসতে চেয়ার ছেড়ে ড্রইংরুমে গেলো নাহিদ। নিম্মিকে বললো,
— এই অসভ্য মেয়ে, যা ঘর থেকে একটা হাতপাখা এনে নিশাতকে বাতাস কর।
সোফার উপর থেকে একটা কুশন নিয়ে ফ্লোরে ফেলে বললো,
— হাঁটাহাঁটি না করে আসো এখানে ফ্যানের নিচে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ো।
নাহিদের কথা মোতাবেক খুব দ্রুত ফ্লোরে চিৎ হয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। নিম্মি ঘর থেকে একটা হাতপাখা এনে নিশাতের পাশে বসে ওর মুখ বরাবর বাতাস করছে। হা করে সেই বাতাস মুখের ভিতর ঢুকাচ্ছে নিশাত।
৯
জৈষ্ঠ্যের বিকেল। আর ঘন্টা দুয়েক বাদেই সূর্যাস্ত যাবে। তবুও রোদের তেজ প্রখর। বাহিরে রোদের তোজ খুব বেশি থাকলেও দমকা হাওয়াও কম না। রোদ আর বাতাস যেনো পাল্লা দিয়ে চলছে। বাড়ির বাহিরে জাম গাছটায় বাঁধা দোলনায় নিম্মি আর নিশাত দোল খাচ্ছে। মোটামুটি হাসিখুশি দেখাচ্ছে ওকে।
আগেরদিনের মত বিষণ্ণতা আজ আর নেই। আপাতত নিশাতের কাছে মনে হচ্ছে নাহিদ একজন পীর আউলিয়া পর্যায়ের লোক। কি দারুন একটা সলিউশন দিয়েছে সে! সত্যিই জিহ্বার ঝালে মনে জ্বালা কমে। গত দু’দিন মনে হয়েছে দুঃখে কষ্টে সে বুঝি মারা যাবে। অথচ আজ বেশ ফুরফুরে মনে হচ্ছে নিজেকে। কষ্ট নেই ঠিক তা না। কষ্ট আছে, তবে তুলনামূলক কম। যা আছে সেটা সহনীয় মাত্রায়। মনে মনে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখানে যে কয়দিন থাকবে নাহিদের একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে থাকবে। লোকটা প্রচুর জ্ঞানী। চেহারায় কেমন যেনো জ্ঞানী ভাব, কণ্ঠে গাম্ভীর্য ছাড়াই হাসতে হাসতে হাতে কলমে জ্ঞান শিক্ষা দেয়। এই তিনমাসে সে গুগলে সার্চ করে প্রেমিককে ভুলে থাকার পাঁচটি উপায়, দশটি উপায় সব দেখে নিয়েছে। কোনোটাই ওর কাজে আসেনি। আর এই লোকটার একটা উপায়ই দারুন কাজে লেগে গেলো। লোকটার কাছ থেকে আরো অনেক জ্ঞান নিতে হবে। আজ থেকে এসব গুগল টুগল সব বাদ। সব ভুয়া।
–তোমাকে আমি কখন থেকে গল্প শোনাচ্ছি। তুমি তো মনে হচ্ছে আমার গল্প শুনছো না।
নিম্মির কথায় নাহিদের ভাবনা বন্ধ করে নিম্মির দিকে মনোযোগী হলো নিশাত। চেহারায় দারুন মনোযোগী ভাব এনে বললো,
–কে বললো শুনছি না? শুনছি তো। খুবই মজার গল্প। শোনাও, শোনাও।
–তারপর নিঝু আপু রাগ করে ওর মাথা থেকে একটা উকুন আমার মাথায় ছেড়ে দিলো। ছেলে উকুন দিয়েছে যাতে দ্রুত আমার মাথায় আরও বংশ বিস্তার হয়।
— তুমি কিভাবে জানলে ঐটা ছেলে উকুন ছিলো?
–আপুই বলেছে আমাকে। আমার মাথায় উকুন ছেড়ে দিয়ে বলে, “নে তোর মাথায় ব্যাটা উকুন ছেড়ে দিছি। এইবার বেটি উকুনের সাথে বাসর করবে আর তোর মাথা ডিম দিয়ে ভরে যাবে।” এমনিতেই আমার মাথায় প্রচুর উকুন ছিলো। তার উপর ও এমন একটা কান্ড করলো। আমি খুব রাগ হয়েছিলাম ওর উপর। রাগ করে ওর সাথে দুদিন কথা বলিনি
— ছিঃ! কি নোংরা!
–তুমি কাকে নোংরা বললে? আমাদের দুইবোনকে? উকুনজনিত সমস্যার কারণে?
— না, না। আমি তোমাদের নোংরা বলিনি। ঘটনাটা খুব নোংরা ছিলো সেটা বুঝিয়েছি।
— আমরা দুইবোন এমনিতেও নোংরা না। ঐ উকুনগুলো আমাদের মাথার ছিলো না। ওগুলো আসলে ছোট মামার মেয়ের মাথার উকুন। ছোট মানুষ, কিন্তু মাথায় চুল ছিলো অনেক। যত্ন নিতে পারতো না ঠিকমতো। তাই মাথায় উকুন হয়েছিলো অনেক। এখানে বেড়াতে এসেছিলো। আমাদের দুইজনের সাথে রাতে ঘুমিয়েছিলো। আমাদের মাথায় তখনই উকুন হয়েছিলো অনেক।
নাক মুখ কুঁচকে গেলো নিশাতের। আতঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— ঐ মেয়েটা কি নিঝু আপুর বিয়েতে আসবে?
— হ্যাঁ আসবে তো।
–ও কি আমাদের সাথে ঘুমাবে?
–তোমার মাথায় উকুন চলে আসবে সেই ভয় পাচ্ছো?
–এটা অবশ্যই ভয়ংকর বিষয়
— ভয় পেয়ো না। ঐ ঘটনার পর আপু ওকে ধরে টাক্কু করে দিয়েছিলো। ওর মাথায় এখন আর উকুন নেই।
–আচ্ছা তাহলে…
— ঐ তোরা বকবক না করে আমার সাথে আয়।
নিঝুম নিম্মির সামনে হাতে ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নাহিদ। নিম্মি দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
— আম পারবে ভাইয়া?
— হুম।
— গাছে তো উঠো না বহুবছর। দেখো আবার না ব্যালেন্স হারিয়ে নিচে পড়ে যাও।
— পড়লে পড়বো। নিশাত আমাকে ধরে ফেলবে। কি নিশাত পারবে না আমাকে আগলাতে?
নিশাত অন্যমনস্ক হয়ে আছে। পাশের বাড়ির ছাদে সম্পূর্ণ মনোযোগ ওর। নিম্মি নাহিদ দুজনই তাকালো পাশের বাড়ির ছাদে। দুজন মহিলা কি একটা নিয়ে হাসাহাসি করছিলো। নাহিদ সেদিকে তাকাতেই মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে হাঁটা শুরু করলো।
— এই নিশাত, কি দেখছো ওদিকে?
— আপনি এত ছোট প্যান্ট পড়েছেন কেনো? আরেকটু ছোট হলে তো এটাকে আন্ডারওয়্যারের মত দেখাতো।
–গাছে উঠবো তাই। কেনো? সমস্যা কি?
–ওরা আপনার প্যান্ট দেখে হাসছিলো।
–ওরা আজীবনই আমাদের সবকিছুতেই হাসে। আমাকে দেখে আরো বেশি করে হাসে।
–কেনো?
–ওদের মেয়েকে নিয়ে পালাতে চেয়েছিলাম। আমি পালাতে পারিনি। ওদের মেয়েকে ওরা ঘরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ওরা জিতেছে, আমি হেরেছি। তাই ওরা আমাকে দেখলে বেশি করে হাসে। আর ওদের সাথে আমাদের তিন যুগের শত্রুতা। এই কারনে আমাদের দেখলেই ওদের গায়ে চুল্কানি হয়। চুল্কানি সাড়ানোর জন্য ওরা হাসে। এইবার আসো আমার সাথে।
.
সন্ধ্যা নামার আর আধঘন্টা বাকি। ছোট ছোট দুই ঝুড়ি আম নিয়ে ঘরে এসেছে নিম্মি আর নিশাত। পিছন পিছন এসেছে নাহিদও। নিঝুম আর ঈষিতা মিলে ডাইনিংটেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে স্যান্ডউইচ বানাচ্ছে। নাহিদ ঘরে এসেই ঈষিতাকে জিজ্ঞেস করলো,
— দুধ জ্বাল দিয়ে ডিপে রেখেছো?
–হ্যাঁ। কিন্তু বরফ জমেছে কিনা জানি না।
— ঘন্টাখানেক হয়েছে না?
— হ্যাঁ।
–চলবে। ঘেমে গিয়েছি একদম। গোসল সেরে আসছি।
টেবিলের একপাশে ঝুড়ি রেখে চেয়ার টেনে বসলো নিম্মি। পিছনেই বেসিনের পাশে দাঁড়িয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিচ্ছে নিশাত। নিম্মি ঈষিতাকে জিজ্ঞেস করলো,
— ভাবী, বড় ভাইয়া বরফ করা দুধ দিয়ে কি করবে?
— মিল্কশেইক বানাবে নাকি?
–ভাইয়া বানাবে?
— হুম।
নিম্মির পাশে চেয়ার টেনে নিশাত বসলো। দুই পা নাচাতে নাচাতে বললো,
— বুঝলি আপু, মানুষটা অনেক গুনের।
— কার কথা বলিস?
— নাহিদ ভাইয়ের কথা বলি।
— তোর পছন্দ হয়েছে মনে হচ্ছে!
— খুব! হাসতে হাসতে কত কি বুঝিয়ে দেয়। তোর মনেই হবে না তোকে কেউ জ্ঞান দিচ্ছে। এইযে একটু আগে আম পাড়ছিলো আর আমাকে হাসতে হাসতে কত কি বুঝিয়ে দিলো।
— কি বুঝিয়েছে?
–আমার কিছুদিন ফোন থেকে দূরে থাকা উচিত। হাতে ফোন থাকলেই পুরোনো ম্যাসেজ দেখতে ইচ্ছে হবে। আবীরের আইডিতে ঢুঁ মারতে ইচ্ছে হবে। এগুলো আমার ডিপ্রেশনের মূল কারন। এগুলো থেকে নিজেকে বিরত রাখা উচিত – তুই বুঝেছিস?
— হুম বুঝেছি।
— ফোনটা কি তাহলে কয়েকদিনের জন্য সুইচড অফ রাখবি?
–হ্যাঁ। ঢাকা যাওয়ার আগ পর্যন্ত।
–যাক, সুমতি হলো তাহলে। কারো না কারো কথা অবশেষে তোর মাথায় গেলো।
ঈষিতার পাশ থেকে বিড়বিড় করে নিঝুম বললো,
— হুম আরেকজনকে ভালোই বুঝাতে পারে। অথচ নিজে অতীত নিয়ে বসে থাকে যুগের পর যুগ।
— নিঝু আপু তুমি কি কিছু বললে আমাকে?
–নাহ্। ভাবীকে বললাম মাংসে লবন কম লাগছে। একটু লবন দিবো কি না। তুমি যাও, ঘর থেকে ফোনটা এনে ভাবীকে দাও। ভাবী আলমারিতে তুলে রাখবে।