বাতাসে গুনগুন – ৩৫

৩৫

মা বাবার সাথে বোনের শ্বশুরবাড়ি এসেছে নিশাত। বাড়িভর্তি লোকজনের সাথে হেসেখেলে কথা বলে যাচ্ছে। একটুখানি কথা বলার আশায়, নিশাতের একটু মনোযোগ পাবার আশায় আশপাশ দিয়েই ঘুরঘুর করছে নাহিদ। নিশাত কি তাকে দেখছে না নাকি দেখেও না দেখার ভান করছে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। পেছন থেকে তার কাঁধে কেউ স্পর্শ করলো। ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে পেলো আমজাদ সাহেব হাসিমাখা মুখ নিয়ে তারই দিকে তাকিয়ে আছে। আমজাদ সাহেবকে দেখে নিজেও ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে নিলো। কিন্তু কোথাও একটা সংকোচ আর লজ্জা কাজ করছে তার মাঝে। হাসিমাখা মুখেও স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে সেই সংকোচ আর লজ্জা। আমজাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,

— কেমন আছো নাহিদ?

— জ্বী আংকেল ভালো। আপনি ভালো আছেন?

— হ্যাঁ। সেই কখন এসেছি! আসার পর থেকে দেখছি অস্থির হয়ে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছো। আমি ড্রইংরুমেই ছিলাম। অথচ আমাকে খেয়ালও করোনি তুমি। কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?

— না… নাহ্ তো। কোনো সমস্যা নেই। আসলে অনেক মানুষ তো তাই আপনাকে খেয়াল করিনি। সরি আংকেল।

— না, না সরি বলার কিছু নেই। আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি কি যেনো নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে আছো। এজন্যই আমাকে চোখে পড়েনি। ব্যাপার না।

— না, আংকেল আমি অন্যমনস্ক না তো। আন্টিকে দেখেছি আমি। কথাও হয়েছে।

–ওহ্ আচ্ছা! অন্যমনস্ক হলে তো আর আন্টিকে দেখতে পেতে না।

–জ্বী আংকেল।

–গায়ে হলুদের কাজ কতটুক আগালো?

.

–কেমন আছেন নাহিদ ভাই?

নিশাত! এটা নিশাতেরই কণ্ঠ! নাহিদ জানে পিছন থেকে নিশাতই কথাটা জিজ্ঞেস করছে ওকে। হৃৎস্পন্দন ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে তার। গলাটাও মুহূর্তেই শুকিয়ে যেনো কাঠ হয়ে গেলো। নিশাতের দিকে মুখ ঘুরিয়ে ক্ষীন কন্ঠে নাহিদ জবাব দিলো,

— হুম। এইতো আছি। তুমি ভালো আছো?

— হ্যাঁ। বাবা তুমি চা খাবে? সকালে তো চা খেয়ে আসোনি?

–খেয়েছি। আসার পরপরই ঈষিতা চা দিয়েছে।

–আচ্ছা। আমার এককাপ খাওয়া দরকার। গলা খুসখুস করছে।

–তাহলে খেয়ে নে।

–হ্যাঁ যাচ্ছি। আমি ভেবেছিলাম তুমি খাওনি। তাই জিজ্ঞেস করতে এসেছিলাম আরকি।

বেশ সাবলীল ভঙ্গিতে কথা বলে চলে গেলো নিশাত। একদৃষ্টিতে ওর চলে যাওয়া দেখলো নাহিদ। কেমন একটা দায়সারাভাবে তাকে জিজ্ঞেস করলো কেমন আছেন। নিজে আর কিছু বললোও না, ওকে কিছু বলার সুযোগও দিলো না। ড্রইংরুম ছেড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো নাহিদ। মাথার তালুতে বিন্দু বিন্দু ঘামের উপস্থিতি টের পাচ্ছে সে। ঠান্ডার মাঝেও কেনো ঘামছে সেই কারন জানা নেই নাহিদের। নিশাতের সাথে কথা বলার আগ পর্যন্ত যতটা না অস্থির ছিলো, নিশাত কথা বলার পর মনে হয় অস্থিরতা আরো বেড়ে গেছে। নিশাতের কাছ থেকে এমন নির্লিপ্ত আচরন আশা করেনি সে। ওর হাবভাবে মনে হচ্ছিলো নাহিদ নামের কাউকে সে ভালোবাসে না। আর দশটা দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের মত সেও একজন। আসলাম, দেখলাম আর কুশলাদি বিনিময় করলাম। ব্যস, এতটুকুই। একনজর ভালোভাবে তাকিয়ে দেখার ইচ্ছা পর্যন্ত নেই।

বড় কেকের প্যাকেট হাতে নিয়ে বাড়ির উঠোনে পা রাখতেই ফাহাদ দেখতে পেলো নাহিদ টিউবওয়েলের কাছে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নিচু করে কিছু একটা ভাবছে। নাহিদের তো এখন বাজারে থাকার কথা ছিলো। ভাইকে সন্ধ্যার মেহমানদের জন্য শসা, টমেটো আর কোক কেনার দায়িত্ব দিয়ে কেক আনতে গিয়েছিলো সে। এগিয়ে ভাইয়ের মুখোমুখি দাঁড়ালো ফাহাদ। জিজ্ঞেস করলো,

— বাজারে যাওনি?

— উহুম।

— কেনো?

— লোক পাঠিয়ে দিয়েছি।

–তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?

–এমনি।

–কোনো সমস্যা হলে বলতে পারো।

— তোরা তো সব একজোট হয়েছিস আমার বিরুদ্ধে। তোদের কাছে সমস্যার কথা না বলাই ভালো।

— আমরা কি করলাম?

— কিছুই করিসনি

সেখান থেকে চলে এলো নাহিদ। ভাইয়ের দিকে বোকা বোকা চেহারা নিয়ে তাকিয়ে রইলো ফাহাদ। ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেলো নিশাত ড্রইংরুমের ফ্লোরে বসে ছেলের বাড়ির ডালা গুছাচ্ছে। ওকে সাহায্য করার জন্য বসে আছে ছোট মামীর দুই ছেলে। সোফায় বসে মেয়ের কাজ করা দেখছেন আমজাদ সাহেব। যত্নসহকারে ডালায় একে একে জিনিস সাজাচ্ছে সে। সোফার পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে নিশাতকে দেখছে নাহিদ। আমজাদ সাহেবের পাশে এসে বসলো নাহিদের মামী। আমজাদ সাহেবকে বললো,

— আপনার মেয়ে ফিরনি রান্না করেছে একটু আগে। আধাঘন্টায় অর্ধেক বাটি ফিরনি শেষ। সন্ধ্যায় স্টেজে রাখার জন্য আবার বানাতে হবে মনে হচ্ছে।

— হ্যাঁ আমার মেয়ের হাতের ফিরনি খুবই স্বাদ। আমার তো ডায়বেটিস, ডলি খুব চেঁচামেচি করে খাওয়ার সময়। মন ভরে একটু খেতেও পারি না।

— আব্বু, অহেতুক প্রশংসা করো না তো।

–যা বলছি সত্যি বলছি। আমার মেয়ে সব রান্না পারে। শুধু ফিরনি কেনো! ওর সব রান্নাই অসাধারণ।

— হ্যাঁ নিঝুমও এই কথাটা রান্নাঘরে বলছিলো। এমন একটা মেয়ে খুঁজছিলাম আমার বোনের ছেলের জন্য। ও খাবারদাবার খুব পছন্দ করে। ওর প্রথম শর্তই হচ্ছে মেয়ের রান্না চমৎকার হতে হবে। নিশাতের রান্নার হাত ভালো, দেখতেও সুন্দরী। ভাবছি প্রস্তাবটা আপনার কাছেই রাখবো কি নাকি।

— আমার মেয়ে একটা হীরার টুকরা। আপনি বিচক্ষন মানুষ তাই হীরা চিনেছেন। আশপাশে তো এমন কত গরু ছাগল আছে আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিয়েছে। নিম্মির বিয়ে শেষ হোক। এরপর আপনার সাথে ধীরে সুস্থে কথা বলবো বিয়ে নিয়ে। কেমন?

দেয়াল ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো নাহিদ। চেহারা কুঁচকে বললো,

— নিশাতকে কি তোমার বাবুর্চি মনে হয় মামী?

— বাবুর্চি কেনো মনে হবে?

— তো তোমার রাক্ষস ভাগ্নের জন্য ওকে নিতে চাচ্ছো কেনো? সারাদিন ওকে দিয়ে রান্না করাবে।

— সারাদিন কেনো রান্না করাতে যাবে? ওদের বাসায় কাজের লোক আছে দুইজন।

ওর রান্না ভালো, দেখতেও সুন্দরী তাই বিয়ের প্রস্তাব দিতে চাচ্ছি। আমার বোনের ছেলে মাঝেমধ্যে ওকে দিয়ে রান্না করাবে। বউ হিসেবে এতটুকু তো করতেই পারে। কি নিশাত পারবে না?

— ফিরনি মজা হলেই বিয়ের প্রস্তাব দিতে হবে এমন নিয়ম কোথায় পেয়েছো?

–তুমি এত রেগে কথা বলছো কেনো?

রাগে গজগজ করতে করতে বাহিরের রান্নাঘরে চলে গেলো নাহিদ। শালুক বসে রান্না করছেন। পাশেই বসে আছেন ডলি। পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ঈষিতা আর নিঝুম। ঈষিতা আর নিঝুমকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে মায়ের হাত টেনে ধরলো নাহিদ।

— বাইরে আসেন একটু।

— কেন?

–কথা আছে।

— রান্না করি দেখোস না?

— ঈষিতা আছে। ও দেখবে। আপনি আসেন।

শালুকের পাশ থেকে ডলি বললেন,

— ছেলে কি নিয়ে যেনো রেগে আছে। আপনি ভিতরে যান আপা। আমরা আছি এখানে। আপনি আগে ওর কথা শুনে আসেন।

.

পিড়ি ছেড়ে উঠে এলেন শালুক। শাড়ীর আঁচল ঠিক করতে করতে রান্নাঘর থেকে কয়েক কদম দূরে বড় সজনে গাছটার নিচে এসে দাঁড়ালেন। কিঞ্চিৎ চিন্তিত ভঙ্গিতে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,

— কি হইছে? এত পেরেশান লাগতাছে কেন তোরে?

— আপনারা সবাই এমন করছেন কেনো আমার সাথে?

— কি করলাম?

–মামী নিশাতের বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে কেনো? কার বিয়ে?

— নিশাতের সাথে উনার বোনের ছেলের।

— কি জানি! আমি তো এই বিষয়ে কিছু জানি না।

— আপনি জানেন। এখন অস্বীকার করছেন।

— আমি সত্যিই জানিনা।

–মামী আপনার সাথে কথা না বলেই ওখানে প্রস্তাব দিয়ে দিলো?

— দিতেই পারে।

— আপনার কাছে এটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে?

–মেয়ে বড় হইছে তো বিয়ের প্রস্তাব আসতেই পারে।

–তো আমি?

— তুই কি?

— আমি কি জানো না?

— দেখ, তোরে নিয়া উনাদের কাছে আমি আর কোনো প্রস্তাব রাখতে পারবো না। আমি কথা পাকা করার পর তুই একবার না করছোস। নিজেই বিয়ে ভাঙছোস। তবুও মাইয়্যা তোর সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করছে। তুই’ই ফিরায়া দিছোস। সব নষ্ট কইরা এখন ঠিক করতে চাইলেই তো ঠিক করা যায় না।

— তারমানে আপনিও চাচ্ছেন ওর অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যাক?

–আমার চাওয়ার কোনো মূল্য আছে নাকি? মূল্য থাকলে তুই আমার কথা শুনতি।

–আমাকে মাফ করা যায় না আম্মা? সেই কবে থেকে আপনার কাছে মাফ চাচ্ছি। এইবার তো মাফ করো।

— মাফ তোরে আমি কবেই করছি নাহিদ। তুই খুব ভালো কইরাই জানোস আম্মা আর যাই হোক তোর উপর রাগ কইরা থাকতে পারে না। তোর হাজার বেয়াদবি, অবহেলার পরও তোরে মাফ করবেই।

— উনাদের সাথে একটু কথা বলেন না আম্মা। গতকাল ফুফুও প্রস্তাব দিলো। কখন ওর অন্য জায়গায় বিয়েশাদী হয়ে যায় বলা যায় না। আপনি কি চান আমি আবার কষ্ট পাই?

–…………………

— দেখো আম্মা, এমনিতেই নিশাতের বিয়ের মিথ্যা গল্প শুনিয়ে পুরা একবছর

–আমাকে যথেষ্ট যন্ত্রণা দিয়েছেন। ঐ একবছর আমি কত কষ্টে ছিলাম কেউ জানে না। এতগুলা দিন শাস্তিই তো দিয়েছেন আম্মা। প্লিজ আম্মা, আমাকে আর শাস্তি দিয়েন না। আপনি কথা বললেই পুরো সমস্যাই সমাধান হয়ে যাবে।

দেখ নাহিদ, আমার হাতে এখন কিছুই নাই। নিশাতের আব্বা আম্মার হাতেও নাই। নিশাতই তোরে বিয়ে করতে রাজি না। ওরে তো এখন জোর কইরা বিয়ে দিবে না তাই না?

— ও বলেছে এই কথা?

— হ্যাঁ। তুই নিঝুমের কাছে ওর কথা জিজ্ঞেস করার পর ঈষিতার সাথে এই বিষয়ে কথা বলছিলো। ঈষিতা ওর আম্মারে জানাইছিলো এটা। বেয়াইন নাকি কথা বলছিলো নিশাতের সাথে। ও সাফ সাফ না কইরা দিছে।

–তো ও কাকে বিয়ে করবে?

— ও কাউরেই বিয়ে করবে না। ও তোরে এখনও ভালোবাসে নাহিদ।

— ভালোবাসে তো বিয়ে কেন করবে না?

— জানি না রে বাবা।

–ও কি বলছে আমাকে এখনও ভালোবাসে?

— ওর মা বলছে আমারে। ঈষিতাও বলে। ওর ফোনে তোর ছবি টাঙানো। টাকার ছোট ব্যাগে তোর ছবি আটকায়া রাখছে। ভালোবাসে দেইখাই তো এমন করে। আর নয়তো কি করতো?

.

মেয়ের পাশে ফ্লোরে বসে আছেন আমজাদ সাহেব। দুই পা সামনের দিকে মেলে দুলাচ্ছেন তিনি। মিনমিনে স্বরে হাসতে হাসতে মেয়েকে বললেন,

— কানাডিয়ান গরুটা রেগে ফুলে ফেঁপে বোম হয়ে আছে বুঝলি। এইযে তুই ওকে পাত্তা দেসনি, তার উপর ওর মামী ওরই সামনে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে এগুলো ওর হজম হচ্ছে না। কখন বার্স্ট ফার্স্ট হয়ে যায় কে জানে!

— ……………

— তুই এসেছিস পর থেকেই তোর আশপাশে ঘুরঘুর করছিলো। গরুটা তোর এটেশন সিক করতে চাচ্ছিলো বুঝলি? ওকে খেয়াল করেছিলি তুই?

–হ্যাঁ। আমি ইচ্ছে করেই তাকাইনি। তবে বাবা উনাকে ঐ খোঁচাটা না দিলেও পারতে।

— কোন খোঁচার কথা বলিস?

–আশপাশে গরু ছাগল আছে তোমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিয়েছে।

–বলবো না? ও তো আস্ত একটা গরু। এটা ওকে বলে স্মরণ করালাম সে একটা গরু। আর নয়তো আমার মেয়েকে রিজেক্ট করে নাকি? ওকে আমি আরো খোঁচাবো। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে একদম ঝাঁঝরা করে দিবো। তোর চোখের পানির শোধ নিবো না ভেবেছিস?

৩৬

চারদিকে মানুষের কোলাহল। স্টেজে বসে আছে নিম্মি। একে একে লোকজন স্টেজে উঠে হলুদ লাগাচ্ছে তাকে। কয়েকটা ক্যামেরা তাক করে আছে ওর দিকেই। আজ সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু নিম্মি হলেও, নাহিদের মনোযোগ কেবল অন্য কারো দিকে আটকে আছে। মানুষটা নিশাত। এক কোণায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ যাবৎ নিশাতকেই দেখছে সে। নিশাত আসার পর থেকেই দূর থেকে শুধু দেখেই যাচ্ছে। সকালে দু লাইন বাক্য বিনিময় হয়েছিলো। ব্যস, অতটুকুই। আর কোনো কথা হয়নি। দেখেও না দেখার ভান করে বারবার পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। এমন একটা ভাব মনে হয় যেনো আশপাশে নাহিদ নামে কেউই নেই। অনেক অনেক পরিবর্তন এসেছে মেয়েটার মাঝে। ওর চুলগুলো আগের চেয়ে লম্বা হয়েছে। নাক ফুড়িয়েছে। বড় সাদা পাথরের একটা নাকফুল পরেছে নাকে। শাড়ী পরে অনায়াসে হেঁটে বেড়াতে শিখেছে। এখন আর আঁচল কিংবা কুঁচি কোনোটাই সামলাতে অসুবিধা হয় না। টুকটাক কাজগুলো বেশ মনোযোগ সহকারে করে যাচ্ছে। বেশ হাসিখুশি মুখে বরপক্ষকে শরবত দিয়ে যাচ্ছে। কথাবার্তা, চালচলন সবকিছুতেই পরিবর্তন চলে এসেছে। এই গোছানো নিশাতকে সে রেখে যায়নি। রেখে গিয়েছিলো একটা অগোছালো আর বাচ্চামিতে ভরপুর মেয়েকে। বছর দেড় যেতে না যেতেই মেয়েটা কত বড় হয়ে গিয়েছে! সংসার করার উপযুক্ত হয়ে গিয়েছে। নাকফুলটার জন্য চেহারায় বেশ পরিবর্তন লাগে। আজ শাড়ী পরাতে একদম বউ বউ লাগছে। বরপক্ষের বহু ছেলের নজরে ইতিমধ্যে পড়েও গেছে সে। সেসবই খেয়াল করছে নাহিদ। দুইদিনের মধ্যে বিয়ের প্রস্তাবও চলে আসবে নিশ্চয়ই! নিশাত রাজি হলে হয়েও যেতে পারে। নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে প্রচুর। যেটা তার হওয়ার কথা ছিলো সেটা কেনো অন্য কারো হবে? রুম্পার মত নিশাতকেও কি এখন হারাতে হবে? এবারও কি নিজের সুখ সে আগলে রাখতে পারবে না? নাহিদের ইচ্ছে হচ্ছে এক্ষুনি ওকে সবার চোখের আড়াল করে ফেলতে। সবার থেকে দূরে সরে একান্তে বসে ওর সাথে দু’দন্ড কথা বলতে। কতদিন হয় ওর সাথে বসে একটু কথা বলা হয়নি। সেবার মেয়েটা বলেছিলো আপনার সাথে কথা না বলে কিভাবে থাকবো? সেই মেয়েটাই আজ তাকে চোখের সামনে পেয়েও কথা বলতে চাচ্ছে না। এড়িয়ে যাচ্ছে। বারবার এড়িয়ে যাচ্ছে। সময়ের সাথে বুঝি সব মানুষই বদলে যায়!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদ থেকে নিচে নেমে এলো নাহিদ। নিজের রুমে ফিরে পাতলা হুডিটা গায়ে চেপে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। মন খারাপের সময়গুলোতে মানুষ সহ্য হয় না তার। দম আটকে আসে। একটু নির্জন জায়গার প্রয়োজন হয়। যেখানে কেউ থাকবে না। থাকবে শুধু সে আর তার একাকিত্ব।

ভরা জোছনা। কারো গুনগুন কন্ঠে গান ভেসে আসছে পুকুর ঘাট থেকে। কৌতুহলী নাহিদ ঘাট বরাবর আসতেই দেখতেই পেলো গায়ে একটা চাদর পেঁচিয়ে চুলগুলো মেলে ঘাটের সিঁড়িতে বসে আছে নিশাত। পুকুরের পানিতে পা ভিজিয়ে রেখেছে। থেমে থেমে পানির মাঝে মৃদু পা দুলাচ্ছে আর গুনগুন করে গান গাইছে,

“সখী ভাবনা কাহারে বলে
সখী যাতনা কাহারে বলে
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী
ভালোবাসা ভালোবাসা
সখী ভালোবাসা কারে কয়
সে কি কেবলই যাতনাময়”

.

সকাল থেকে যে সুযোগটা খুঁজছিলো এতক্ষণে সেই সুযোগটা পেলো নাহিদ। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো সে। পিছন থেকে মৃদুস্বরে ডাকলো,

— নিশু?

গান থামিয়ে দিলো নিশাত। ঘাড় ফিরিয়ে নাহিদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো। বললো,

— দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? বসুন আমার পাশে।

–এতো শীতের মধ্যে ঠান্ডা পানিতে পা ভিজিয়ে রেখেছো কেনো? উপরের সিঁড়িতে উঠে বসো।

–উহুম। এখানেই আমার ভালো লাগছে। পা ভিজিয়ে দেখুন। আপনারও ভালো লাগবে।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে নাহিদ।

— কি? দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? আসুন তো! বসুন আমার সাথে।

নাহিদকে হাত ধরে টেনে সিঁড়িতে বসালো নিশাত। ঠোঁটের কোণে এখনো সেই মুচকি হাসি লেগে আছে। নিষ্পলক নিশাতকে দেখছে নাহিদ। চাঁদের আলোয় সাদা নাকফুলটা চিকচিক করছে। কয়েকটা চুল এসে গালের পাশে পড়ে আছে। গায়ে হলুদের মেকআপ ধুয়ে এসেছে। চোখের কাজল লেপ্টে আছে। তবুও অদ্ভুত সুন্দরী দেখাচ্ছে। হাতে থাকা কাঁচের চুড়িগুলো এখনো খুলেনি। রয়ে গেছে দু হাতে। অনেক কিছু বলার ছিলো নিশাতকে। কেনো যেনো কিছুই বলতে পারছে না নাহিদ। এ যেনো অন্য নিশাত! ইচ্ছে হচ্ছে চুপচাপ বসে সারারাত ধরে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে।

.

–আমার দিকে এভাবে প্রেম প্রেম ভাব নিয়ে তাকিয়ে থাকবেন না নাহিদ ভাই। আমার অস্বস্তি হয়।

অপ্রস্তুত হয়ে গেলো নাহিদ। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো সে। পা-জোড়া পানিতে ভিজিয়ে নিশাতের সাথে তাল মিলিয়ে দুলিয়ে যাচ্ছে।

কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকার পর নাহিদ বললো,

এতরাতে এখানে একা বসেছিলে যে!

–এমনিই। ভালো লাগে এখানে আসতে, তাই আসি। আপনি চলে যাওয়ার পর আপনাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছি ছয়বার। প্রতিবারই ভরা পূর্নিমার সময় আসতাম শুধুমাত্র এখানে এসে বসে থাকার জন্য। এখানে কেমন একটা নেশা নেশা ভাব আছে তাই না?

—হুম।

— জোনাকিগুলো থাকলে খুব ভালো লাগে। শীতের সময়টাতে দেখা যায় না। গতবারও এসেছিলাম। পাইনি।

–একাই আসতে সবসময়?

— হুম।

— এখানে একা বসে থাকতে ভয় লাগে না?

— উহুম। বললাম না এখানে কেমন একটা নেশা আছে। কোনোকিছুর নেশায় ডুবে থাকলে কি মানুষের ভয় লাগে নাকি?

–শাড়ী পরা শিখে গেছো তাই না?

— হ্যাঁ।

— নিঝুমের বিয়ের সময় তো পরতে পারতে না। মনে আছে তোমাকে বিয়ের এক সপ্তাহ আগে থেকে শাড়ী পরিয়ে প্র্যাকটিস করানো হয়েছিলো?

— হুম।

প্রথমদিন তো শাড়ী পেঁচিয়ে পড়ে গেলে। আঁচলটাও সামলাতে জানতে না। মোট পাঁচটা সেফটিপিন দিয়ে আঁচল আটকাতে হতো তোমার।

— আমি তখন অনেককিছুই পারতাম না। এখন পারি।

— হুম, দেখতেই পাচ্ছি। সবচেয়ে ভালো যেটা পারো সেটা হলো কাউকে দেখেও না দেখার ভান করা।

মুখ বাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো নিশাত। নাহিদ বললো,

— তুমি আমাকে সামনে পেয়েও কথা না বলে এড়িয়ে চলে যাবে এটা আমি কখনো ভাবতেই পারিনি।

–কেনো ভাবতে পারেননি?

–সেবার আমি চলে যাওয়ার আগে তুমি আমাকে বলেছিলে আমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারবে না।

–হুম, ঠিকই বলেছিলাম।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিশাত। সিঁড়ি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

—রাত অনেক হয়েছে। যাই ঘুমাই।

নিশাতের হাত চেপে ধরলো নাহিদ। মাথা নিচু করে বললো,

–এখানে বসে গল্প করো আমার সাথে। ঘুমাতে হবে না।

–আবার আমার বদঅভ্যাস করতে চাচ্ছেন?

–মানে?

–আপনার সাথে রাত জেগে সময় কাটানোর বদঅভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো। আপনি আমার বাজে অভ্যাসে পরিণত হয়েছিলেন। আপনি চলে যাওয়ার পর খুব কষ্ট পেতে হয়েছে এই অভ্যাসটার জন্য। আপনাকে ফোন করতেই থাকতাম। মেসেঞ্জারে নক করতেই থাকতাম। আপনি কখনো আমার ফোন রিসিভ করেননি। ঘুম আসতো না আমার। কতরাত জেগে কাটিয়েছি তার কোনো হিসাব নেই। ঘুম আসতো না একদম। সারারাত আপনার সাথে একটু কথা বলার জন্য ছটফট করতাম। এঘর ওঘর ভূতের মত ঘুরে বেড়াতাম। অনেক কষ্টে ঐ অভ্যাস ছাড়তে পেরেছি। বলতে পারেন এক প্রকার যুদ্ধই করেছি নিজের সাথে। ঐ বাজে অভ্যাসে আর ফিরতে চাই না। দেখি, এবার হাতটা ছাড়ুন। অনেক কষ্টে ফিরে পাওয়া ঘুম আমার! না ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করতে চাই না।

হাত ছাড়িয়ে নিলো নিশাত। একপাশে পড়ে থাকে জুতাজোড়া পায়ে পরে ধীরে ধীরে উঠে আসছে সে। পিছন পিছন উঠে আসছে নাহিদও।

— ভালোবাসি নিশাত।

— জানি আমি।

–ভালোবাসি জেনেও আমাকে দূরে সরিয়ে রাখবে?

— হ্যাঁ রাখবো।

–কেনো?

নিশাত থমকে দাঁড়ালো। অভিমানভরা কন্ঠে বললো,

–আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই।

৩৭

কাকডাকা ভোর। এলোমেলো চুল আর চেহারায় একরাশ ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফিরলো নাহিদ। বাড়ির বেশিরভাগ মানুষই ঘুমাচ্ছে। ঘুম ভেঙেছে কেবল কয়েকজনের। যে যার যার মত কাজে ব্যস্ত। নিজের ঘরে যাওয়ার সময় চোখ পড়লো বোনদের ঘরের দিকে। সবাই লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। লেপ ছাড়া গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে শুধু নিশাত। তার অংশের লেপটুকু পায়ের কাছে পড়ে আছে। ঘুমের ঘোরে গা থেকে সরে গিয়েছে হয়তো। এত শীতেও কি মেয়েটা টের পাচ্ছে না ওর গা থেকে লেপ সরে গিয়েছে? নিঃশব্দে বোনদের ঘরে ঢুকলো নাহিদ। নিশাতের দিকে উপুর হয়ে পায়ের কাছ থেকে লেপটা টান দিতেই ওয়াশরুমের ছিটকিনি খোলার আওয়াজ পেলো নাহিদ। ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখলো নিঝুম দরজা খুলে বেরিয়ে আসছে। ভাইকে নিশাতের দিকে উপুর হওয়া অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস করলো, – তুমি এখানে কি করো?

— তুই কি রাতে এখানেই ছিলি?

–হ্যাঁ। কিন্তু তুমি কি করছো?

—ওর গা থেকে লেপটা সরে গিয়েছে। ঠিক করে দিতে এসেছি। একটু খেয়াল রাখবি না! শীতের জন্য মেয়েটা কেমন জড়োসড়ো হয়ে আছে!

— তুমি যাও। আমি করে দিচ্ছি।

— এসেছি যেহেতু আমিই করে দিচ্ছি।

নিশাতের গায়ে লেপ ঠিকঠাক মত বিছিয়ে দিচ্ছে নাহিদ। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো নিঝুম। অজানা কোনো কারণবশত নিশাতকে নিয়ে নাহিদের এই যত্নগুলো আদিখ্যেতা মনে হয় নিঝুমের। ভালো লাগে না এই আদিখ্যেতা। নিশাতের গায়ে লেপ বিছিয়ে নিঝুমের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো নাহিদ। শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— তুই আমার উপর প্রচুর বিরক্ত এটা তোর মুখ দেখেই আমি বুঝতে পারি। কিন্তু কেনো?

–কেনোর উত্তরটা হয়তো আমার চেয়ে বেশি তুমি ভালো জানো।

— আমি তোর কাছ থেকে জানতে চাই।

— নিশাতকে নিয়ে তোমার এই আদিখ্যেতা আমার পছন্দ হচ্ছে না।

— আদিখ্যেতার কি দেখলি?

–আর নয়তো কি? এত বয়সের পার্থক্যে প্রেম ভালোবাসা অসম্ভব। ওর সাথে সংসার করা অসম্ভব। এখন সেই মেয়েকে কেনো বিয়ে করতে চাচ্ছো? বয়সের পার্থক্য কি কমে গিয়েছে? তুমি জানতে নিশাত তোমাকে ছাড়া কষ্ট পাবে। একবারও ওর কথা ভাবলে না। চলে গেলে নিজের মত করে। একটাবারও ওর সাথে যোগাযোগ করলে না। কত রিকোয়েষ্ট করেছে ওর সাথে একটু যোগাযোগ করার জন্য। একবার তো কলটা রিসিভ করে কথা বলতে পারতে। তুমি বলো নি। একবারও ভাবোনি নিশাত তো অসুস্থও হয়ে যেতে পারে। ওকে এতখানি কষ্ট দেয়ার পর এখন এসে ওর গায়ে লেপ বিছিয়ে দিচ্ছো। ও শীতে কষ্ট পাচ্ছে সেটা ভেবে আফসোস করছো। এটা কি আদিখ্যেতা না? ওর আশপাশে ঘুরঘুর করেই যাচ্ছো কথা বলার জন্য এটা কি আদিখ্যেতা না? কি ভাবো তুমি? কেউ কিছু দেখে না? সবাই সব দেখে। সবাই সব বুঝেও। এসব ছাড়ো। ও নিজেকে নিজের মত গুটিয়ে নিয়েছে। ওকে ওর মতন থাকতে দাও। নিজের সাথে আর জড়াতে চেয়ো না।

— মানুষ কি ভুল করে না? আমি কি ফেরেশতা?

— ভুল তো মানুষ বারবার…..

.

— এই ভোরে কি ঝগড়া করা খুব জরুরী? বাসায় মানুষ আছে। রাত পোহালে আমাদের বোনের বিয়ে। এমন সময় তোদের দুজনের ঝগড়া করা কি উচিত? দরজায় দাঁড়িয়ে এক নিঃশ্বাসে ক্ষীণ কন্ঠে বললো ফাহাদ। চেহারায় তার বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আবারও সে বললো,

–এমন ঝগড়াটে চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? যা গিয়ে আম্মা আর ঈষিতার সাথে কাজ কর। আর নয়তো লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমা। আমি আর কোনো ঝগড়া শুনতে চাই না। ভাইয়া, তুমি বেরিয়ে আসো। নিজের ঘরে যাও।

— তুই আয় তো একটু আমার সাথে। কথা আছে।

নিঝুমদের ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির বাহিরে চলে এলো নাহিদ। পেছন পেছন বেরিয়ে এলো ফাহাদও। বাড়ির পিছন দিকে গিয়ে থামলো দুজন। জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে নাহিদ বললো,

— ফাহাদ, মানুষই তো ভুল করে। আমাকে দিয়ে নাহয় একটা ভুল না হয় হয়ে গিয়েছে, তাই বলে সবাই মিলে আমার পিছনে এভাবে উঠেপড়ে লাগবি? একটু তো আমার হয়ে কথা বল। তুই তো আমাকে চিনিস। চিনিস না বল? তোর কি মনে হয় নিশাতকে বিয়ে করে আমি কোনো কষ্টে রাখবো?

এখানে প্রশ্ন কিন্তু সুখে রাখা বা কষ্টে রাখা নিয়ে না। আর ভুল তোমার কখনও হয়না ভাইয়া, ভুল আমাদের হয়। বারবার আমরাই ভুল করি। আমরা তোমাকে ভালোবেসে ভুল করি। শুধু নিশাত না ভাইয়া। তুমি কখনোই কারো ভালোবাসা অনুভব করতে পারোনি। একমাত্র রুম্পা ছাড়া এই জীবনে তুমি কাওকেই ভালোবাসো নি। আমরাই একতরফা তোমাকে ভালোবেসে গিয়েছি।

— আমি তোদের ভালোবাসি না? এটা কে বললো তোদের?

–যাকে ভালোবাসো তাকে কখনো অবহেলা করা সম্ভব না। তুমি সবসময় নিজের ভালোবাসাকেই বড় করে দেখেছো। কে তোমাকে ভালোবেসেছে সেসব নিয়ে তুমি কখনোই ভাবো নি। ভাবার প্রয়োজনও মনে করোনি। রুম্পাকেই শুধু

ভালোবেসেছিলে। এতগুলো বছর শুধু ওর ভাবনা নিয়েই পড়ে ছিলে। তোমার মা, ভাইবোন নামক কেউ এই পৃথিবীতে আছে সেসব কি কখনো মনে ছিলো তোমার? ইচ্ছে হলে কথা বলেছো, ইচ্ছে না হলে কথা বলোনি। ইচ্ছে হলে দেশে এসেছো, না হলে আসোনি। আম্মা তোমাকে একনজর কত ছটফট করতো জানো? তোমার সাথে একটু কথা বলার জন্য কত অপেক্ষা করতো। আমরা কল করতে থাকতাম, কিন্তু তুমি কল রিসিভ করতে না। আমরা জানতাম তুমি ইচ্ছে করে কল রিসিভ করছো না, তবুও মনকে মিথ্যা স্বান্তনা দিতাম তুমি ব্যস্ত আছো তাই কল রিসিভ করছো না। তুমি অকারণে আমাদের অবহেলা করেছো। তবুও আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করতাম। তোমাকে ভালোবাসতাম। এতগুলো বছর তুমি এমন এক বিষয় নিয়ে আমাদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছো যেটার জন্য আমরা কোনোভাবেই দায়ী না। রুম্পা চলে গিয়েছিলো স্বেচ্ছায়। অথচ দোষ দিলে আব্বার উপর। অভিমান করলে আমাদের উপর। আব্বা কখনোই তোমার মন্দ চায়নি ভাইয়া। আব্বা তোমাকে ভালোবাসতো, তাই চায়নি ওরকম একটা পরিবারে তুমি আত্মীয়তা করো। তুমি সেদিন রাতে শুধু আব্বার রাগারাগি আর রুম্পার বাবার চুপ হয়ে সব সহ্য করাই দেখলে। আড়ালে কি ছিলো তা তো দেখলে না। রুম্পার বাবা ইচ্ছে করে সেদিন চুপ ছিলো। সে জানতো আব্বা অকথ্য ভাষায় কথা বলবে। কারন এর আগে আব্বাকে সে ইচ্ছেমত শুনিয়ে রেখেছে। তুমি ওকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পরদিন দুপুরে আব্বাকে দোকানে গিয়ে অনেক কথা শুনিয়ে এসেছে। আব্বা একদম চুপ ছিলো। কিছু বলেনি। কারন দোষ তোমারও ছিলো। রাতে যখন তোমরা ফিরে এলে তখন তখন এই লোক মুখে কুলুপ এঁটে সাধু সেজে গেলো। আর আব্বা সেই কথাগুলোই ফিরিয়ে দিয়েছিলো যেগুলো রুম্পার বাবা দুপুরে আব্বাকে শুনিয়ে গিয়েছে।

— কিন্তু রুম্পার বাবা তো আগেরদিন রুম্পাকে বলেছিলো আমাদের বিয়ে মেনে নিতে তার অসুবিধা নেই। আব্বা মেনে নিলে সেও আব্বার সাথে মিলে ধুমধাম করে আমাদের বিয়ে দিবে।

–পুরোটা ওর নাটক ছিলো। ওর মতো একটা বদমাইশ লোক এত সহজে এই সম্পর্ক মেনে নিবে ভাবলে কি করে? তবে তুমি তো অন্ধ ছিলো। দেখতে কি করে বলো? আমি জানি না রুম্পার মনে আসলে কি ছিলো। কিন্তু ভাইয়া ও যদি তোমাকে ভালোইবাসতো তাহলে আব্বার বলা কয়েকটা কথার কারণে তোমাকে ছেড়ে দিতো? রুম্পার বাবাকে জন্মের পর থেকে দেখে এসেছি আমাদের আব্বার সাথে শত্রুতা করতে। কম ক্ষতি করার তো চেষ্টা করেনি। তুমি সব জানতে। জানা সত্ত্বেও তুমি রুম্পাকে ভালোবেসেছো। ওকে একবারও ছেড়ে যেতে চাওনি। আর রুম্পাও জানতো ওর বাবার কীর্তিকলাপ। আমাদের আব্বার কথা শুধুমাত্র একদিন ওর বাবা চুপচাপ শুনেছে এটা মেয়ের সহ্য হয়নি। সেদিনই তোমাকে ছেড়ে চলে গেলো। আর কোনো সম্পর্কই রাখলো না। অথচ আমাদের আব্বার খারাপ ব্যবহার কোনোদিক দিয়েই অযৌক্তিক ছিলো না। ঐ লোক যা যা করেছে আব্বার সাথে, এরচেয়ে ভালো ব্যবহার আব্বার কাছে আশা করাই উচিত না। তাছাড়া খারাপ ব্যবহার তো আব্বা করেছিলো। তুমি তো করোনি। তাহলে তোমাকে ফেলে চলে গেলো কেনো? ও না তোমাকে খুব ভালোবাসতো! মাত্র কয়েক মুহূর্তে সব ভালোবাসা শেষ হয়ে গেলো?

— ……………….

–একবারও তুমি আব্বার দিকটা বিবেচনা করলে না। চোখ মেলে দেখতে চাইলে না ঘটনা কোথা থেকে কোথায় গড়ালো। আব্বা তোমাকে যতটা ভালোবাসতো ততটা ভালো কখনো আব্বা আমাদের বাসেনি। আম্মাও না। তুমি তাদের বড় সন্তান ছিলে। তোমার প্রতি ভালোবাসা সবসময়ই আমাদের বাকি তিনজনের তুলনায় একটু বেশিই ছিলো। আব্বা জানতো আব্বার কোনো দোষ ছিলো না। তবুও আব্বাকেই তুমি দোষী ভেবেছো। নিজের মা-বাবা সব বাদ দিয়েছিলে তুমি। আব্বা তোমার এই দূরে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারেনি ভাইয়া। খুব কষ্ট পেয়েছিলো। খুব বেশি। সে কষ্ট হয়তো তুমি কখনই অনুভব করতে পারবে না। তবুও তোমার প্রতি আব্বার ভালোবাসা নূন্যতম কমেনি। মরণের আগ পর্যন্ত তোমার কথাই বলে গিয়েছে। মারা যাওয়ার আট দশ মিনিট আগেও আম্মাকে বলেছিলো, “নাহিদের সাথে আমার আর দেখা হইলো না। ও আসলো না আমারে দেখতে। ও আসলে বইলো বাবার কবর যেনো জেয়ারত কইরা আসে। দূর থেইকাই ছেলেটারে একটু দেখমু।” মানুষটা চলে গিয়েছে ভাইয়া। তোমার অবহেলা নিয়েই দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছে। তোমার কিছু আসে যায়নি। এতগুলো বছরে একবারও যাওনি আব্বার কবর জেয়ারত করতে। একদিন আমরাও চলে যাবো ভাইয়া। একে একে সবাই চলে যাবো। আমাদের প্রতি তোমার অবহেলা আজীবনই থাকবে। এই অবহেলা কখনো শেষ হবে না আমরা জানি। তবুও আমরা তোমাকে ভালোবাসি। তুমি যদি ভেবে থাকো আমরা তোমার পিছনে উঠে পড়ে লেগেছি তাহলে এটা তোমার ভুল ধারণা। হ্যাঁ নিঝুম হয়তো একটু রেগে কথা বলছে। কিন্তু ভেবো না ও চায় না নিশাতের সাথে তোমার সম্পর্কটার সুন্দর একটা পরিণতি হোক। আমরা সবাই চাই। কিন্তু নিশাত তো চায় না। হ্যাঁ এটা ঠিক ও তোমাকে ভালোবাসে। তবে ও তোমার কাছ থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্তই নিয়েছে। তোমার কি ধারনা ওর সাথে আমরা এ ব্যাপারে কথা বলিনি? বলেছি। ও আমাদের কথা শুনবে না। এটা একান্তই ওর ব্যাক্তিগত ব্যাপার ভাইয়া। এখন ওকে তো আমরা এটা নিয়ে জোর করতে পারবো না।

দুচোখে পানি ছলছল করছে নাহিদের। বাবার কথা ভেবে খুব বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। সেইসাথে খুব বেশি আত্মগ্লানিতেও ভুগছে। নিজের কষ্ট নিয়েই একতরফা ভেবে গেলো। পিছনে ফেলে আসা মানুষগুলো তাকে ছাড়া কষ্টে আছে সেসব তো কখনো ভেবে দেখলো না। বাবা থেকে শুরু করে নিশাত পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনাতে শুধু মুদ্রার একপিঠ নিয়েই ভেবে গেলো সবসময়। কখনো অপরপিঠ নিয়ে ।ভেবে দেখেনি। এটাকে কিসের নাম দিবে সে? বোকামি নাকি অন্যায়? অনুশোচনাবোধ ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। মুহূর্তেই মনে হচ্ছে এই বুঝি নিঃশ্বাস আটকে এলো। কাঁপা কণ্ঠে ফাহাদকে জিজ্ঞেস করলো,

–আব্বার কবরে নিয়ে যাবি আমাকে?

–সারারাত ঘুমাওনি। বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তোমাকে। হাত মুখ ধোও। নাস্তা করো। আমার একটু কাজ আছে। দশটা নাগাদ কবরস্থানে নিয়ে যাবো।

— ফাহাদ?

— হুম?

–কথাগুলো আমাকে আগে বললেও তো পারতি।

— কিভাবে বলতাম? সুযোগ দিয়েছো কখনো বলার?

–আব্বা বেঁচে থাকতে বললে হয়তো কষ্ট নিয়ে আব্বাকে মরতে হতো না!

— তুমি তো তখন কথাই বলতে চাইতে না। আব্বা মারা যাওয়ার পর কিছুটা স্বাভাবিকভাবে আমাদের সাথে কথা বলা শুরু করেছো।

–আমাকে পারলে মাফ করে দিস।

দু’চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছে নাহিদের। দ্রুত পায়ে সেখান থেকে সরে গেলো সে। বাড়ির ভিতর এসে সরাসরি মায়ের রুমে ঢুকলো। খাটে বসে ছোট মামী আর নিশাতের মাকে নিম্মির বিয়ের গহনা দেখাচ্ছেন শালুক। মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো নাহিদ। ছেলের এমন আচরণে হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন তিনি। ছেলেকে শক্ত করে ধরে জিজ্ঞেস করলেন,

— কি হইছে?

শালুকের ঘরের সামনে দিয়েই দাঁতব্রাশ করতে করতে রান্নাঘরে যাচ্ছিলো নিশাত। ভিতর থেকে কান্নার আওয়াজ আসতেই সেই ঘরে গেলো সে। নাহিদকে এভাবে কাঁদতে দেখে মুখের ভিতর থেকে ব্রাশ বের করে বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে নিশাত। মনে মনে ভাবছে, লোকটা এভাবে কাঁদছে কেনো?

কোনো উত্তর না পেয়ে ছেলেকে মৃদু ধাক্কা দিলেন শালুক। জিজ্ঞেস করলেন,

— কি রে? কি হইছে?

কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাহিদ বললো,

— আমি অনেক অন্যায় করেছি আম্মা। আপনাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি। অকারণে সবাইকে দূরে সরিয়ে রেখেছি। আর আপনারা আমাকে ভালোবেসেই গিয়েছেন। আমি শুধু নিজেকে নিয়েই ভেবেছি। বাকিদের নিয়ে কখনো ভাবি নি। কখনো ভালোও বাসিনি। আব্বা আমাকে কত দেখতে চেয়েছিলো! আমি আর একটা দিন আগে আসলেই আব্বা আমাকে দেখতে পারতো। আমি আসিনি। অকারণে আব্বাকে দোষ দিয়েছি। আব্বার কাছে তো মাফ চাওয়ার সুযোগ পেলাম না। পারলে আপনারা আমাকে মাফ করে দিবেন।

–তোর মাফ চাইতে হইবো না। তুই বুঝতে পারছোস এটাই অনেক।

নাহিদকে দেখে কান্না পাচ্ছে নিশাতের। কিন্তু সে কাঁদবে না। নাহিদের জন্য কেনো কাঁদবে সে? আবারও মুখের ভিতর ব্রাশ ঢুকালো নিশাত। ঘষে ঘষে দাঁত ব্রাশ করছে সে। ব্রাশ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। অনিচ্ছাবশত চোখ থেকে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো নিশাতের। জোর করেও চোখের পানি আটকাতে পারলো না সে।

৩৮

খোলা চুলগুলো পাঞ্চক্লিপ দিয়ে আটকে নিচ্ছিলো নিশাত। এসময় আচমকা পাঞ্চক্লিপটা ভেঙে দু’ভাগ হয়ে গেল। নিশাত ঠোঁট বাঁকিয়ে ভাঙা পাঞ্চক্লিপটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো। ভাবছে, হুট করে এটা ভেঙে গেল কেন? সে তো জোরে চাপও দেয়নি। এই মুহূর্তে নিশাত তার হাতে থাকা ক্লিপের ভাঙা দুটো অংশের সাথে মানুষের মনের মিল খুঁজে পাচ্ছে খুব। বিশেষ করে তার মনের। একটা সময় তার মনটাও একইভাবে ভেঙে গিয়েছিলো। পার্থক্য শুধু এই ক্লিপটা ভেঙে দু’ভাগ হয়ে গেছে আর তার মনটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিলো। নিষ্ঠুরের মত আচরণ করেছিলো নাহিদ। সব মনে আছে নিশাতের। কিচ্ছু ভুলেনি সে। নির্ঘুম রাত, অস্থিরতায় কাটানো দিন, শত অপেক্ষার বিনিময়ে নাহিদ তাকে একরাশ অবহেলা বাদে আর কি দিয়েছিলো সেই তিনমাসে? আজ যখন সে ভাঙা মনটা নিয়েই ভালোভাবে বাঁচতে শিখে গেছে, নাহিদ নামক আসক্তিটা আবারো তার চারপাশে ঘুরঘুর করতে শুরু করেছে। কেনো ফিরে আসতে চাচ্ছে? কেনো আপন করে নিতে চাচ্ছে? ওকে দূরে ঠেলে যাকে আপন করে নিয়েছিলো থাকুক না তাকে নিয়ে। কোনো প্রয়োজন নেই বিয়ে শাদীর। যে যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে।

–কি করছিস?

নিশাতের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ঈষিতা। ভাঙা পাঞ্চক্লিপটা জানালার বাহিরে ছুঁড়ে দিয়ে বললো,

— কিছু না।

–ছাদে সবাই গান বাজনা করছে। ওখানে না গিয়ে এখানে একা বসে আছিস কেনো?

— এত মানুষের ভীড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না আপু।

— শরীর খারাপ লাগছে?

–উহুম।

— তাহলে?

— এমনিতেই।

–কিছু কথা বলার ছিলো তোর সাথে।

— হুম বলো।

–নাহিদ ভাইয়ের বিষয়টা কি আরেকবার একটু ভেবে দেখবি?

–উনাকে বিয়ে করতে বলছো?

— হুম।

— তাহলে আবীর কি দোষ করেছে? বিয়ে তো তাহলে আবীরকেও করতে পারি।

— আবীর আর নাহিদ ভাইয়ের ব্যাপারটা এক না নিশু। আবীর তোর সাথে

রিলেশনে ছিলো। আর নাহিদ ভাই তোর প্রতি অনুভূতিগুলো তখন বুঝতে পারেননি তাই ঐ একটা ভুল করে ফেলেছে।

— উনি অনুভূতি বুঝতে পারেনি? কেনো বুঝতে পারেনি? আমাকে তো উনি বলেছিলো আমি ইমম্যাচিউরড। নিজের অনুভূতি বোঝার মত ম্যাচিউরিটি নাকি আমার নেই। উনি তো ম্যাচিউরড। তাহলে উনি কেনো নিজের অনুভূতি বুঝলো না? দেখ আপু আমার এসব নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না। অন্য কথা থাকলে বলতে পারিস। না থাকলে ছাদে যা। গিয়ে নাচ গান দেখ।

নিশ্চুপ বসে আছে ঈষিতা। নাহিদ দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাহিরে। নিশাতের আচরন কাঁটার মত গায়ে বিঁধছে তার। তবে এই আচরণ তার প্রাপ্য ছিলো। নিজের ভুলের শাস্তি সে পাচ্ছে। এখানে কাওকে দোষারোপ করা যাবে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে এসে ঢুকলো নাহিদ। ঈষিতাকে বললো,

–একটু বাহিরে যাবে? নিশুর সাথে কথা ছিলো।

বিছানা ছেড়ে চুপচাপ উঠে এলো ঈষিতা। যাওয়ার সময় দরজার পর্দাজোড়া লাগিয়ে দিয়ে গেলো সে। শান্ত কণ্ঠে নাহিদ নিশাতকে বললো,

— এই মেয়ে, ভালোবাসো না আমাকে?

–হ্যাঁ বাসি। তো?

–তো আমাকে বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়?

–ভালোবাসলেই বিয়ে করতে হবে এমন কোনো নিয়ম আছে?

— নেই?

— না, নেই।

–তাহলে ভালোবাসো কেনো?

–আমি কাকে ভালোবাসবো আর কাকে বাসবো না সেটা আমার ইচ্ছা।

–রাগ করে থেকে লাভটা হচ্ছে কোথায় বলো তো একটু? কষ্ট তুমিও পাচ্ছো, আমাকেও দিচ্ছো। তুমি শুধু একবার হ্যাঁ বললেই সব কিছুর সমাধান যায়।

সমাধান তো সেই কবেই আপনি করে চলে গিয়েছেন। নতুন করে আমি আর কি সমাধান দিবো?

— কি সমাধান করেছি আমি?

— আমাকে ছেড়ে চলে গিয়ে সমাধান করেছেন। যাওয়ার আগে তো আপনার মা বোনকে বলেই গিয়েছেন আপনি দূরে চলে গেলেই সব সমাধান হয়ে যাবে। হলোই তো সমাধান।

–কোথায় হলো সমাধান? আমি তো চেয়েছিলাম তুমি আমাকে ভুলে যাও। নিজের মত করে বাঁচতে শিখো। এজন্যই দূরে চলে গিয়েছিলাম।

— আপনার ইচ্ছা মত সব হবে তাই না? আপনার ইচ্ছা হলে আপনাকে ভুলে যেতে হবে। আবার আপনার ইচ্ছা হলে আপনাকে বিয়ে করতে হবে। সবকিছুতে আপনারই জোর চলবে? আপনার ইচ্ছা মত তো সব হবে না নাহিদ ভাই। আপনি আপনার নিজের ইচ্ছার মালিক, আমার ইচ্ছার না। আমার যা ইচ্ছা হবে আমি তাই করবো। আমার ইচ্ছা আপনাকে আমি ভালোবাসবো তো বাসবো। আমার ইচ্ছা আপনাকে বিয়ে করবো না তো করবো না। এখানে কারো কোনো হস্তক্ষেপ চলবে না। আপনার ইচ্ছেমত সবসময় সবকিছু হবেও না।

— এটা তুমি কেমন জেদ ধরছো নিশাত?

–সব প্রশ্নের উত্তর জানতে আসবেন না নাহিদ ভাই। সিমিনের সাথে যখন বিয়ে ঠিক করে ফেললেন তখন কি আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেনো ওকে বিয়ে করছেন? করিনি। আপনি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটাকে মেনে নিয়েছি। আপনাকে আর একবারের জন্যও বিরক্ত করিনি। এখন আপনাকেও আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। কোনো ধরণের প্রশ্ন আপনি আমাকে করতে পারবেন না।

— এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কি তুমি ভালো আছো নিশাত?

–কেউ বাঁচে ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে আর কেউ বাঁচে ভালোবাসার মানুষটার স্মৃতিগুলো নিয়ে। আমি দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ। আর দশটা সম্পর্কের মত আপনার সাথে আমার কয়েক বছর কিংবা কয়েক মাসের সম্পর্ক ছিলো না। আপনার সাথে সময় কাটিয়েছি আমি গুনেগুনে কয়েকটা দিন মাত্র। আমার এই ছোট্ট জীবনে পাওয়া সেরা কয়েকটাদিন। সেই কয়টা দিন আমি মন খুলে হেসেছি। মন খুলে বেঁচেছি। আপনাকে আমি যেতে দিতে চাইনি। আপনি আমার হতে চাননি। আপনাকে জোর করার সাধ্য আমার ছিলো না। তাই হয়তো চলে যেতে পেরেছেন। কিন্তু ঐ যে আপনার সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো, সেই স্মৃতিগুলো আঁকড়ে রাখার সাধ্য আমার ছিলো। সেগুলোই আঁকড়ে ধরে আছি। বিশ্বাস করেন, সেই স্মৃতিগুলো আমার জন্য কি তা কাউকে বুঝাতে পারবো না। আমি চোখ বন্ধ করে যখনই স্মৃতিগুলো হাতড়ে বেড়াই আমার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে। মনে হয় আপনি আমার পাশেই আছেন। আমার হাত ধরে আমাকে বলছেন, “নিজের মত বাঁচতে শিখো নিশু।” আমি বাঁচতে শিখেছি নাহিদ ভাই। আপনার দেয়া একগাদা স্মৃতি নিয়ে আমি খুব ভালোভাবে বেঁচে আছি। আপনাকে ছাড়াই ভালো আছি। আমি আপনাকে বিয়ে করবো না। আমার আশায় বসে থাকলে আপনার সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই হবে না। এরচেয়ে ভালো হবে আপনি চলে যান। সিমিনকে বিয়ে করে নিন। সুখী হবেন। আমার মত একটা বাচ্চা মেয়েকে গলায় ঝুলিয়ে আজীবন আপনাকে ভুগতে হবে না।

— কেনো আমার স্মৃতি নিয়েই তোমাকে বাঁচতে হবে? আমি তো আছি। তোমার পাশে থেকে বাঁচতে চাচ্ছি।

— আমি এসব নিয়ে আর কথা বলতে চাই না প্লিজ।

ঘর থেকে বের হতে যাচ্ছিলো নিশাত। বিছানা ছেড়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে দরজা আটকে দিলো নাহিদ। বললো,

— কথা শেষ না করে তোমাকে কোথাও যেতে দিবো না।

–আর কি কথা বাকি আছে?

–আমার কথা শুনবে না? না শুনে চলে যাবে কেনো?

— দিনের পর দিন আপনার একটু কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করেছি। বিনিময়ে এতটাই অবহেলা পেয়েছি যে এখন আর আপনার কথা আমার শুনতেই ইচ্ছা হয়না।

–না হলেও শুনতে হবে।

— কেনো শুনতে হবে? যেই মানুষটাকে এত অবহেলা করেছেন সেই মানুষটাকে এখন ঘরের দরজা আটকে জোর করে আপনার সাথে কথা বলার জন্য বাধ্য করতে লজ্জা হয় না আপনার?

— না, হয় না। আমি নির্লজ্জ।

.

রাগে চেহারা কুঁচকে গিয়েছে নিশাতের। দাঁত কিটমিট করছে তার। নাহিদকে পাশ কাটিয়ে দরজার ছিটকিনিতে হাত লাগাতেই নিশাতকে একটানে বুকে জড়িয়ে ধরলো নাহিদ। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে ছটফট করে যাচ্ছে নিশাত। নিশাত যত নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাচ্ছে তত বেশি নাহিদের বাহুডোরে আটকা পড়ে যাচ্ছে। আজ কোনোভাবেই নিশাতকে ছাড়বে না নাহিদ। কথা শুনিয়ে তবেই যেতে দিবে। আলতো করে নিশাতের মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে আর ক্ষীণ কণ্ঠে বলছে,

–শান্ত হও নিশু। কথাগুলো একটু শুনো। তারপর চলে যেও। আমি আটকাবো না।

— ছাড়ুন আমাকে।

–বললাম তো, কথাগুলো শুনো। এরপর চলে যেও।

— আমি চিৎকার করা শুরু করলে কিন্তু সবাই আপনাকেই গালমন্দ করবে।

–তোমার করতে ইচ্ছে হলে করতে পারো। কে কি বললো সেসব নিয়ে আমি কখনো ভাবিনি, আজকেও ভাববো না। আমার যা বলার তা বলেই তোমাকে যেতে দিবো। এর আগে না। এখন তুমি চিৎকার করো আর ঘরে আগুন লাগিয়ে দাও সেসব আমার দেখার বিষয় না।

চুপ হয়ে গেলো নিশাত। নাহিদের কথায় স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে আজকে কথা না শুনিয়ে ছাড়বে না। চিৎকার করে তামশা করারও কোনো মানে হয় না। নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা থামিয়ে শান্ত হয়ে নাহিদের বাহুডোরে বন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে।

–মানছি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। কষ্ট আমিও তো কম পাইনি নিশু। নিজের ভুল বুঝতে পারার সাথে সাথেই তোমার কাছে ফিরে আসতে চেয়েছি। তখন এই বাসার সবাই বললো তুমি বিয়ে করে ফেলেছো। কতটা অসহায় মনে হচ্ছিলো নিজেকে তা তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না। আমি ভেবেছিলাম চিরতরে তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি। নিজের ভুলের জন্য ভালোবাসার মানুষকে চিরতরে হারানোর কষ্ট কি তা তুমি বুঝবে না। তুমি তোমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় যদি ঐ কয়দিনে কাটিয়ে থাকো তো আমিও আমার জীবনের সেরা সময়গুলো ঐ কয়দিনে কাটিয়েছি। তুমি এতগুলো দিন ঐ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে ছিলে, আমিও ঐ স্মৃতিগুলো নিয়েই বেঁচে ছিলাম। তোমার কাছ থেকে দূরে চলে গিয়েছি, সিমিনের সাথে বিয়ে ঠিক করেছি ঠিকই। কিন্তু তোমাকে খুঁজেছি সবসময়। সিমিনের সাথে বিয়ে ভেঙেছে কেনো জানো? কারন সিমিনের মাঝে আমি তোমাকে খুঁজতাম। নিজের অজান্তেই তোমাকে খুঁজে বেড়িয়েছি। তখন একবারের জন্যেও বুঝিনি আমি কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। সর্বক্ষণ অস্থির লাগতো। মনে হতো কিছু একটা নেই। কিছু একটা আমি খুঁজে পাচ্ছি না। পরে যখন বুঝতে পারলাম তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি জানতে পারলাম ততদিনে খুব দেরী করে ফেলেছি। তোমাকে অন্য কেউ নিয়ে গিয়েছে। যেই সুখ আমার হওয়ার কথা ছিলো সেটা এখন অন্য কারো ঘরে। তাও আবার আমারই ভুলের জন্য। এই অনুশোচনা কতটা জঘন্য তা তুমি জানো না। এই অনুভূতিটাকে খুব সাধারণ কিছু ভেবো না নিশাত। এই এক যন্ত্রণা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি পুরো একটা বছর। তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হতো খুব। পারতাম না তোমার সাথে কথা বলতে। আমি তো জানতাম তুমি অন্যের ঘরে আছো। তোমাকে কল করে বিরক্ত করার মানে হয় না। তখন মনে পড়তো কিভাবে তোমার কল আর টেক্সটগুলো ইগনোর করে গিয়েছি। অনুশোচনার মাত্রা তখন দ্বিগুন বেড়ে যেতো। বারবার শুধু মনে হতো কেনো নিশুর কল রিসিভ করলাম না? কেনো ওর সাথে একটু কথা বলতাম না? মাঝে মধ্যে এসব ভেবে এতটাই অস্থির হয়ে যেতাম মনে হতো আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। কেউ যেন আমার গলা টিপে ধরে রেখেছে… তখন অসহ্য রকমের যন্ত্রণা শুরু হতো। স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমিয়ে থাকতাম। এছাড়া আর কোনো উপায় সামনে থাকতো না। তোমার মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠতো। কানাডা চলে আসার দুদিন আগে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ভালোবাসি বলেছিলে। সেই কাঁপা কন্ঠের ভালোবাসি কথার আওয়াজ কানে বাজতে থাকতো। মনে হতো তোমাকে ছিনিয়ে নিয়ে আসি তোমার হাজবেন্ডের কাছ থেকে। সহ্য করতে পারতাম না নিশাত। গত একটা বছরে দিনরাত শুধু দোয়া করেছি তোমার সাথে ঐ লোকের ডিভোর্স হয়ে যাক। কোনো এক সকালে ঘুম থেকে উঠেই যেনো দেশ থেকে খবর পাই নিশাতের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। পাগলের মত এই একটা বছর কাটিয়েছি। অনুশোচনা আর আফসোসে প্রতি মুহূর্ত কাটানোর চেয়ে বাজে অবস্থা একটা মানুষের আর কি হতে পারে?

চুপচাপ নাহিদের বুকের সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে আছে নিশাত। নিঃশব্দে কাঁদছে সে। নাহিদের গেঞ্জির বুকের অংশ ভিজে যাচ্ছে নিশাতের চোখের পানিতে।

— কষ্ট পেয়েছি তো আমি। এবার আমাকে মাফ করো।

নিজের অজান্তেই নাহিদের গলা জড়িয়ে ধরলো নিশাত। অভিমানভরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাহিদকে বললো,

— কোনো মাফ নেই আপনার। আমাকে কষ্ট দিয়েছেন তো দিয়েছেন। এবার আপনি সারাজনম কষ্ট পেয়ে পেয়ে শেষ হয়ে গেলেও ক্ষমা পাবেন না। আমি আপনাকে বিয়েও করবো না। আমাকে আপনি দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন। আমিও আপনাকে দূরেই সরিয়ে রাখবো। আজীবন দূরত্ব থেকেই যাবে আমাদের মাঝে। চলে যান আপনি। আর কখনো আমার সামনে আসবেন না।

— তুমি তো আমার গলা ধরে রেখেছো। যাবো কিভাবে?

মুহূর্তেই নাহিদের গলা ছেড়ে দিলো নিশাত। এক ধাক্কায় দূরে সরিয়ে দিলো নাহিদকে। দরজার ছিটকিনি খুলে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে বোনের ঘরে চলে গেলো সে। ঈষিতার ঘরের দরজার দরজা আটকে বিছানায় গা এলিয়ে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলো। দম আটকে আসছে নিশাতের। শত চেষ্টা করেও নাহিদের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারছে না সে। বারবার সেদিকে মন ছুটে যাচ্ছে। ভিতর থেকে একটা কথাই বারবার ভেসে আসছে,

“ও হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতটা শক্ত করে ধরে নে নিশাত।”

নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত লাগছে। আর যুদ্ধ করতে পারছে না সে। ভালোবাসার মানুষকে এত কাছে পেয়েও দূরে সরিয়ে রাখার মত এত ক্ষমতা তার নেই। বাহির থেকে দরজায় ধাক্কা পড়ছে। থেমে থেমে নাহিদ ডেকে যাচ্ছে ওকে,

— নিশু, এ্যাই নিশু। দরজাটা খুলো।

এতবার নাহিদের ডাক উপেক্ষা করার মত ক্ষমতা নিশাতের নেই। সত্যিই নেই। মানুষটা ঘরের দরজায় কড়া নেড়ে গেলেও শব্দটা বেশি হচ্ছে তার মনের দরজায়। তুফান বয়ে যাচ্ছে মনের ভিতর। মনের দরজা আর বন্ধ করে রাখা সম্ভব না। এবার দরজা খুলতেই হবে।

চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো নিশাত। গুটিগুটি পায়ে এসে দরজা খুলে নাহিদকে বললো,

–শুনছেন, আমার পালিয়ে বিয়ে করার খুব শখ ছিলো। আমার শখটা পূরণ করবেন?

মুখ বাকিয়ে মুচকি হাসলো নাহিদ। নিশাতের হাত ধরে বললো,

— খুব বেশি রাত হয়নি। সবেমাত্র আটটা বাজে। চলো আমার সাথে। আজই তোমার শখ পূরন করবো।

নাহিদের পাশে রিকশায় বসে আছে নিশাত। নাহিদ তার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। এমনভাবে ধরে রেখেছে যেন হাতের বাঁধনটা একটু আলগা হলেই নিশাত পালিয়ে যাবে। সারাজীবনের জন্য সে হারিয়ে ফেলবে নিশাতকে। নিশাতকে হারানোর ভয় নাহিদের চোখেমুখে স্পষ্ট। নিশাত তা বুঝতে পেরে আপন মনেই মুচকি হেসে উঠলো, সাথে কালো রঙের চাদরটা একহাত দিয়েই আরো ভালোভাবে গায়ে মুড়িয়ে নিলো। হীম শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে গা ঘেঁষে। আজ সেই বাতাসে কোনো এক অজানা নেশা খুঁজে পাচ্ছে নিশাত। ক্রমশ সেই নেশায় সে ডুবে যাচ্ছে। পাশে বসে গুনগুন করে গান গাইছে নাহিদ। মাতাল করা বাতাসে সেই গুনগুন ভেসে বেড়াচ্ছে নিশাতের চারপাশে। চোখ বন্ধ করে এই মাতাল করা অনুভূতিটুকু প্রাণভরে অনুভব করে নিচ্ছে সে। চোখ বন্ধ করতেই নাহিদের গুনগুন ছাড়াও বাতাসের মধ্যে আরো একজনের গুনগুন শুনতে পাচ্ছে নিশাত। নিজের কণ্ঠস্বর চিনে নিতে তার বেশি সময় লাগলো না। তার মানে বাতাসের মাঝে এই লুকিয়ে থাকা নেশা আর গুনগুন সব মিলিয়ে প্রকৃতির এই মনোমুগ্ধকর আলোড়ন সবই কি তাকে ঘিরে? হয়তো! ভালবাসার মানুষটা পাশে থাকলে প্রকৃতিও তখন নিজের রঙে সাজতে শুরু করে। নাহিদ তাকে বিয়ে করার জন্য কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা নিশাত জানে না। জানতেও ইচ্ছে করছে না আপাতত। নিয়ে যাক যেখানে খুশি। সেসব নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। এই মানুষটা শুধু আজীবন পাশে থাকলেই হলো।

(সমাপ্ত)  

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *