বাতাসে গুনগুন – ১৫

১৫

নিঝুমকে খুঁজতে খুঁজতে ঈশিতার রুম পর্যন্ত পৌঁছে গেলো নিশাত। তার বড় বোন আর নিঝুম মিলে ক্ষীণ কণ্ঠে কিছু একটা আলোচনা করছে।

— কি কথা বলো তোমরা?

নিশাতের কন্ঠ শুনে চমকে উঠলো দুজনই। নিশাত ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে দুজনের উদ্দেশ্যে বললো,

— সরো দেখি, জায়গা দাও আমাকে। আমি এখানে শোবো

–সরবো কেনো? তুই আমার এপাশে এসে শুয়ে পড় আর নয়তো নিঝুমের ওপাশে যা।

—আমি মাঝেই শোবো।

–তোর কি সবসময় দুজনের মাঝখানে এসে শুতে হবে?

–হ্যাঁ হবে। আমি ছোট মানুষ আমি মাঝখানেই শোবো। যাও, সরো তো এখন। নিঝুম আর ঈশিতা দুপাশে সরে গিয়ে নিশাতকে জায়গা করে দিলো। দুজনের মাঝখানে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লো নিশাত। ভ্রু কুঁচকে নিঝুমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— নিঝুপু, নাহিদ ভাইয়ের সাথে রুম্পার ব্রেকআপ কেনো হয়েছিলো?

নিশাতের প্রশ্ন শোনা মাত্র ঈষিতা আর নিঝুম একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। তবে কি নিশাতও নাহিদের ব্যাপারে আগ্রহী?

— বলো না আপু?

–হঠাৎ নাহিদ ভাইয়াকে নিয়ে জানতে চাচ্ছো?

–এমনি। জানতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। বলো না আপু।

–ঐ তো দুই ফ্যামিলির ঝামেলা ছিলো আগে থেকেই। তবু দুজনের প্রেম হলো। তারপর আর কি যথারীতি দুই পরিবারে হাঙ্গামা শুরু হলো। ভয়াবহ আকার নিলো। এরপর দুজন দুদিকে।

— এতটুকু কেনো? পুরোটা বলো। ওদের প্রেম থেকে শুরু করে একদম শেষ পর্যন্ত।

–আমি নিজে পুরোটা জানলেই তো তোমাকে বলবো।

— তুমি কতটুকু জানো?

— এটা ১২ বছর আগের ঘটনা নিশু। তখন আমি মাত্র ১০ বছরের ছিলাম। ঐ বয়সে প্রেমটেম বুঝার মত এত জ্ঞান আমার ছিলো না। আমি জানতামও না। ফাহিম ভাইয়া এসব জানতো। তবে সব না। কিছু ঘটনা জানতো। কিছু জানতো না। দুই ফ্যামিলির মরুব্বী পর্যায়ে যখন জানাজানি হয়ে গেলো তখন আমি জেনেছি।

— ঐ বাড়ির সাথে এই বাড়ির সমস্যা কি ছিলো?

–ইস্যু আহামরী কিছু না। খুবই সামান্য বিষয়। সামান্য বিষয়ই বাড়তে বাড়তে এই পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। আমাদের আব্বা বরাবরই রাগী মানুষ ছিলো। রাগী মানে অত্যাধিক রাগী। পান থেকে চুন খসলেই আব্বা রেগে যেতেন। ফুফার সাথে একদম বিয়ের দিন থেকে আব্বার মিল হয় না। ফুফা একটু মেয়েলি স্বভাবের। খোঁচা মেরে কথা না বললে উনি শান্তি পান না। আর অহংকারীও বেশ। প্রপার্টি নিয়ে সবসময়ই আমাদের সাথে টক্কর দিতে চাইতেন। আব্বা একটা জমি কিনলে উনারও কিনতে হবে। আমাদের বাড়িতে টাইলস করলে উনারও করতে হবে। কোরবানীতে আমাদের পঞ্চাশ হাজার টাকার গরু কিনলে উনারও কিনতে হবে। সবকিছুতেই উনি বাড়াবাড়ি করতেন। মূলত আব্বার সাথে ঝামেলা হয়েছিলো দাদার সম্পত্তি নিয়ে। আব্বা তো একমাত্র ছেলে ছিলো। বোন ছিলো তিনটা। দাদা কোনো সম্পত্তি ভাগ করে যাননি। দাদা মারা যাওয়ার পর আব্বা একদম সমানভাগে চারজনের জমি ভাগ করেছেন। এমন হয়নি যে আব্বা নিজে বেশি নিয়ে বোনদের কম দিয়েছেন। হিসাবে আব্বা বেশি অংশই পেতেন। তবুও আব্বা নেয়নি। সমানভাগে ভাগ করেছেন। দাদার সম্পত্তি ছাড়াও আব্বার আরও অনেক সম্পত্তি ছিলো। সেগুলো আব্বা তার নিজের ইনকাম দিয়ে কিনেছিলেন। এরপরও ফুফা দাবি করতেন এগুলো নাকি দাদার সম্পত্তি। উনার বউয়ের সাথে অবিচার করা হয়েছে। উনার বউকে প্রাপ্য সম্পত্তি দেয়া হয়নি। ফুফুও ফুফার সাথে একমত ছিলেন। দুদিন পরপরই আমাদের বাড়িতে চলে আসতো এটা সেটা চাইতেন। না দিলেই শুরু হতো উনার কান্নাকাটি। বলতেন, একে তো আমাকে জমিজামা দাওনি তার উপর আমার খোঁজখবরও নাও না। এমনও সময় গিয়েছে আম্মার নতুন শাড়ী, স্বর্নের জিনিস এসে নিয়ে চলে গেছে। এমন না যে উনার শ্বশুরবাড়ির ওরা গরীব। ওরা যথেষ্ট বিত্তশালী ছিলো। তবু এমন করতো। আমার অন্য ফুফুদের কোনো অভিযোগ ছিলো না সম্পত্তি নিয়ে। ছিলো শুধু উনার। শেষ পর্যন্ত ফুফা আর ফুফুর এসব কান্ড আর হজম না করতে পেরে আব্বা চিরতরে ওদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন। কেউ কারো ছায়ায় পা দিবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করলেন। এর কয়দিন পরই ফুফা আমাদের পাশের জায়গায় এসে বাড়ি করে নিলো। জায়গাটা ছিলো দাদার যেটা ফুফুকে দেয়া হয়েছিলো। উনি উনার নিজের বিশাল বাড়ি ফেলে বউয়ের বাপের বাড়ির জায়গায় বাড়ি করলো শুধুমাত্র আমার আব্বাকে আরো রাগানোর জন্য। তখন অবশ্য আমার জন্ম হয়নি। আমি এসব গল্প আম্মার কাছে শুনেছি। জন্মের পর থেকে দেখে আসছি ঐ বাড়ির লোকজন কিছু না কিছু নিয়ে আমাদের সাথে দ্বন্দ্ব করতে চায়। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের সাথে গলা উঁচিয়ে ঝগড়া করতে আসে। আম্মা একবাক্যে আমাদের সবসময় বলে এসেছেন ওরা যা খুশি করুক আমরা যেনো কখনো কোনো উত্তর না দিতে যাই। আমরাও দিতাম না। মাঝেমধ্যে আব্বা উত্তর দিতেন। আব্বা যদি বলতেন একটা উনারা বলতেন পাঁচটা। ফুফুর ছেলেমেয়েগুলো পর্যন্ত আব্বা আম্মার সাথে বেয়াদবি করতো। এমন একটা বাজে পরিস্থিতিতে আমার ভাই আর রুম্পা প্রেম করা শুরু করলো। অবশ্যই আব্বা এই প্রেমের সম্পর্ক মেনে নিবে না। আব্বার বদ্ধমূল ধারনা ছিলো শুধুমাত্র আমাদেরকে অশান্তিতে ফেলে দেয়ার জন্য ফুফু তার মেয়েকে নাহিদ ভাইয়ের পিছনে লাগিয়ে দিয়েছে।

— রুম্পা তোমাদের ফুফাতো বোন?

— হুম। ফুফুর ছোট মেয়ে।

–সত্যিই কি মেয়েটা নাহিদ ভাইকে ভালোবাসতো না? তোমার ফুফুর কথা শুনে প্রেম করেছে?

— আমি জানি না নিশু। কারো মনের খবর আমি কি করে জানবো?

–ওদের প্রেমের খবর লোকজন জানলো কেমন করে?

দুই গ্রাম পরেই এক এলাকায় নাকি বেড়াতে গিয়েছিলো। গ্রাম এলাকায় এসব প্রেমিক প্রেমিকা দেখলে বাপ মা ডেকে এনে বিচার বসায়। হয়তোবা কোনো অন্তরঙ্গ অবস্থায় লোকজন দেখে ফেলেছিলো। ঐ গ্রামের চেয়ারম্যান ফুফার বন্ধু ছিলেন। লোকজন ওদের ধরে চেয়ারম্যানের কাছে নিয়ে গেলো। চেয়ারম্যান ঘটনাটা ধামাচাপা দিয়ে ফুফাকে আর আব্বাকে ডাকিয়ে নিয়ে গেলেন। ব্যস লেগে গেলো আগুন। সেদিনের পর থেকে পুরো একটা মাস কিসের মধ্যে আমরা সবাই দিন কাটিয়েছি বলে বুঝাতে পারবো না। ঘরে কান্নাকাটি আর ঝগড়া নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে গিয়েছিলো। আম্মা কত চোখের পানি ঝরিয়েছেন তার হিসেব নেই। ভাইয়া আর আব্বার মাঝের দ্বন্দ্ব আমরা কেউ মেনে নিতে পারছিলাম না। তখন আমার অন্য ফুফু আর মামারা মিলে সিদ্ধান্ত নিলো রুম্পার সাথে ভাইয়ার বিয়ে দিবে। আব্বা আর ফুফু ফুফাকে উনারা যেভাবে হোক মানাবেই। অনেক বুঝিয়েছে সবাই। কিন্তু কেউ মানে নি। ফুফা আব্বাকে নোংরা কথা বলছিলেন। আব্বা পাল্টা ফুফাকে নোংরা কথা বলছিলেন। কি বিশ্রী অবস্থা! এরপর ওরা দুজনে পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যানও করেছিলো। এক সপ্তাহের মধ্যে রুম্পার অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হলো। বিয়ের ঠিক তিনদিন আগে রাতে ওরা দুজন পালিয়ে গেলো। সারাদিন দুজনই উধাও। বাসা থেকে দুজনই কাপড়চোপর নিয়ে পালিয়েছে। পরদিন সকালে কোত্থেকে রুম্পা একাই ফিরে এলো। মাঝরাতে ফিরলো নাহিদ ভাই। এসেই দরজা আটকে দিলো। এরপরদিন সকালে রুম্পাদের বাড়িতে শুরু হলো গায়ে হলুদের আয়োজন আর আমাদের বাড়িতে নাহিদ ভাইয়ের কান্না। মেয়ে মানুষের মত হাউমাউ করে কান্না করা শুরু করলো। পুরো দুদিন ভাইয়া গেট খুলেনি। কারো সাথে কথাও বলেনি। খাওয়াদাওয়া তো বন্ধই। সেইসাথে আম্মারও খাওয়া বন্ধ। দুদিন পর ভাইয়ার আর কোনো আওয়াজ পাই না। কান্না কিংবা হাঁটাচলারও না। এরপর ফাহিম ভাই বাহির থেকে জানালার গ্লাস ভেঙে দেখে বিছানায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে সে। পরে দরজা ভেঙে ভেতরে গিয়ে দেখে ভাইয়ার শরীরে আগুন জ্বর। তাড়াহুড়ো করে ওকে হাসপাতাল নিলো। সেখানে এডমিট ছিলো তিনদিন। ওকে বাসায় আনা হলো। আমাদের সবার সাথে টুকটাক কথা বললেও আব্বার সাথে কথা বলতো না। আব্বা কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতো। তাও অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে। নিজে থেকে কথা বলতো না। ওর ভাবখানা এমন ছিলো যে রুম্পা আব্বার কারনে ওকে বিয়ে না করে আবার বাড়ি ফিরে এসেছে। সব দোষ আব্বার। আব্বাও প্রচুর রেগে ছিলো ওর উপর। একে তো ঐ পরিবারের মেয়ের সাথে প্রেম করেছে। পালিয়ে বিয়ে করতে চেয়েছে। এত বড় অন্যায় করা সত্ত্বেও উল্টো আব্বার সাথেই কথা বলা বন্ধ করে আরো বেয়াদবি করা শুরু করেছে। রুম্পার বিয়ের পরের মাসেই খবর আসলো সে প্রেগন্যান্ট। এই খবর শোনার পর মাঝেমধ্যে মদ খেয়ে বাড়ি ফেরা শুরু করলো ভাইয়া। আব্বা তো রেগে আরো আগুন। একদিন তো রাগের মাথায় ফুলদানি ছুঁড়ে মেরেছিলো ভাইয়ার কপাল বরাবর। ওর কপালে কাটা দাগটা দেখো না? ঐটা ঐদিনেরই কাটা দাগ। দিনদিন ওর অবস্থা খারাপ হচ্ছিলো। তখন আমার বড় ফুফুর ছেলে কানাডাতে থাকতো। উনি ফোনে আব্বাকে বললো ভাইয়াকে স্টুডেন্ট ভিসায় কানাডা পাঠিয়ে দিতে। তখন অলরেডি ভাইয়ার অনার্স ফাইনাল এক্সাম শেষ। রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। ঐ দেশে দুইবছরের একটা ডিপ্লোমা কোর্স করে ভালো কোনো জব করতে পারবে। আব্বা ফুফাতো ভাইয়ের কথা শুনে সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন ভাইয়াকে কানাডা পাঠাবেন। ভাইয়াও দ্বিমত করেনি। দ্বিমত ছিলো আম্মার। তার ধারনা ছিলো ভাইয়াকে দূরে পাঠালে ও আমাদের কাছে আর ফিরবে না। ওর সাথে আমাদের দূরত্ব অনেক বেশি বেড়ে যাবে। এর সপ্তাহখানেক পর ভাইয়ার রেজাল্ট এলো। ওকে ঢাকায় পাঠানো হলো আইএলটিএস কোর্সের জন্য। সাড়ে চারমাস পর ভাইয়া কানাডায় চলেও গেলো। আম্মার কথাই সত্যি হয়েছিলো নিশু। ওর সাথে আমাদের সবার দূরত্ব বেড়ে গিয়েছে। অনেক বেশি। যেই দূরত্ব চোখে দেখা যায় না। শুধু অনুভব করা যায়। এতগুলো বছরে দূরত্ব মিটে নি। হয়তো আর কখনো মিটবেও না। ১২ বছর হয়ে গেলো। তবুও ভাইয়া ঐ কষ্ট এখনও ভুলতে পারেনি। সেইসাথে অভিমানটাও পুষে রেখেছে বেশ যত্ন সহকারে।

— রুম্পা ফিরে এসেছিলো কেনো?

–জানি না।

–সমস্যা দুই পরিবারে সমান সমান ছিলো। এমন তো না যে শুধু তোমাদের তরফ থেকে সমস্যা ছিলো। যদি তোমাদের তরফ থেকে সমস্যা থাকতো তাহলে বুঝতাম এজন্য তোমাদের প্রতি অভিমান। সেই থেকে দূরে সরে যাওয়া। বিবেচনা করতে গেলে তো সবচেয়ে বেশি দোষ রুম্পার ফ্যামিলির। তাহলে নাহিদ ভাই তোমাদের উপর অভিমান করে আছে কি নিয়ে?

— সেটা নাহিদ ভাই ভালো বলতে পারবে।

— জিজ্ঞেস করোনি কখনো?

— করেছি। উত্তর দেয় না।

মাথা নিচু করে আনমনে ভাবছে নিশাত, যে মানুষটা এত সহজে অন্য মানুষের কষ্ট মুছতে জানে সেই মানুষটা নিজের কষ্ট মুছতে জানে না কেনো?

১৬

মাঝরাতে ঈষিতার দরজায় কড়া নাড়লো নিম্মি। সেইসাথে ব্যস্ত কণ্ঠে নিম্মি বলে যাচ্ছে,

— ভাবী দরজা খুলো।

ড্রইংরুমে বসে টিভি দেখছিলো নাহিদ। এতরাতে নিম্মির আওয়াজ পেয়ে সোফা ছেড়ে ঈষিতার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো সে। চোখ কচলাতে কচলাতে ফাহাদ এসে দরজা খুলে দাঁড়ালো।

— কি সমস্যা?

–নিশাতের জ্বর এসেছে। ভাবী কোথায়?

নিম্মির কথা শোনামাত্র কোনো প্রকার প্রশ্ন ছাড়াই নাহিদ সোজা চলে গেলো নিম্মিদের ঘরটাতে।

আধঘুমে থাকা ঈষিতার কানে নিশাতের জ্বরের খবর পৌঁছোতেই হুরমুরিয়ে শোয়া থেকে উঠলো সে। ঝড়ের গতিতে পাশের ঘরে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,

— শোয়ার সময়ও দেখলাম সুস্থ আছে।

ফাহাদ বললো,

— ঠিকই তো। আমিও তো দেখলাম সুস্থ। জ্বর আসলো কখন রে নিম্মি?

— আমি তো জানি না।

.

ঈষিতা ঘরে গিয়ে দেখে নিঝুম নিশাতের মাথায় পানি ঢালছে। পাশেই নাহিদ দাঁড়িয়ে আছে। ছুটে এসে বোনের কপালে গলায় হাত দিয়ে দেখে গা বেশ গরম। নিঝুমের দিকে তাকিয়ে ঈষিতা জিজ্ঞেস করলো,

— জ্বর আসলো কখন?

–লিয়ে দেখে নিশু জড়োসড়ো হয়ে কাঁপছে। পরে গায়ে হাত দিয়ে দেখে জ্বর এসেছে।

— কি একটা অবস্থা বলো দেখি! শোয়ার সময়ও তো কিছু বললো না যে ওর শরীর খারাপ লাগছে।

–ওকে সেঁচের পানিতে ভেজানো উচিত হয়নি। ওখানের পানি তো অসম্ভব ঠান্ডা। ভুল আমারই হয়েছে। সরি ঈষিতা।

— ভাইয়া এখানে সরি বলার কিছু হয়নি। আপনি ওর ভালো ভেবে ওখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। খারাপের জন্য তো আর নিয়ে যাননি।

— তবুও গিল্ট ফিল হচ্ছে।

— এখানে গিল্ট ফিল করার কি আছে? জ্বর আসতেই পারে।

— ঠিকই তো ভাইয়া। তুমি এভাবে ভাবছো কেনো? নিশু গত তিনমাসে যতটা স্ট্রেসড ছিলো, তুমি তিনদিনে সেটা প্রায় শেষ করে দিয়েছো যেটা আমরা কেউ পারিনি। তুমি ওর ভালোর জন্যই নিয়ে গিয়েছিলে। জ্বর আসলে আসুক। এটা ঔষধ দিয়ে ঠিক করা যাবে। কিন্তু ঔষধ দিয়ে তো আর ওর মনের ক্ষত পূরণ করা যেতো না। ওখানে গিয়ে ও একটু হলেও খুশি হয়েছে। এটাই অনেক। তুমি টেনশন নিও না। আমি কাল সকালেই ডক্টরকে বাসায় আসতে বলবো।

— নিঝুম, তোমরা দুইবোন আজ রাতটা অন্য ঘরে যেয়ে ঘুমাও। এই ঘরে তো ফ্যান বন্ধ থাকবে। এত গরমে ফ্যান ছাড়া থাকবে কি করে? এরচেয়ে ভালো অন্য ঘরে চলে যাও। আমি থাকি এই ঘরে।

নিঝুম বললো,

— আমিও থাকি তোমার সাথে। নিম্মি ওপাশের ঘরে চলে যা।

–না, না। তুমি অহেতুক রাত জাগতে যাবে কেনো? তোমরা সবাই ঘুমাতে যাও। আমি আছি এখানে।

— কারো থাকতে হবে না এখানে। আমি থাকবো। এমনিতেও আমার রাত জেগে অভ্যাস।

নাহিদের কথায় চমকে গেলো ঈষিতা আর নিঝুম। ওরা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। হয়তো চোখের ইশারায় একজন আরেকজনকে কিছু বুঝাচ্ছে। নিঝুম অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

— ভাইয়া তুমি থাকবে এখানে? কেনো? কোনো অসুবিধা?

— না, অসুবিধা হবে কেনো?

–না ভাইয়া আপনি কেনো শুধুশুধু ওর জন্য রাত জাগতে যাবেন? আমিই থাকবো।

— হ্যাঁ ভাইয়া, ঈষিতাই থাকুক। খামোখা তুমি এখানে…….

–এখানে খামোখা কি দেখলি ফাহাদ? নিশু তো সম্পর্কে আমারও কিছু হয় তাই না? তো আমি ওর সাথে থাকতেই পারি। তাছাড়া আমি তো এমনিতেও রাত জাগি। আজ নাহয় ওর সাথে বসে কাটালাম।

— জলপট্টি দিতে হবে কিছুক্ষন পর পর। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ওর জ্বর আসলে ওর সাথে অনবরত গল্প করতে হয়। আর নয়তো কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। একটু অদ্ভুত আচরন করে আরকি। তুমি সামলাতে পারবে?

— এই মেয়ে সবসময়ই অদ্ভুত আচরণ করে ফাহাদ। এটা নতুন কিছু না। আমি পারবো সামলে নিতে। যা তোরা।

— সিওর?

— হ্যাঁ।

— ঈষিতা? ভাইয়া থাকবে এখানে?

নিঝুমের দিকে তাকিয়ে আছে ঈষিতা। চোখের ইশারায় আলোচনা করে নিলো দুজনই।

— আচ্ছা থাকুক তাহলে। আমি তো আছিই। কিছুক্ষন পর পর এসে দেখে যাবো।

–দেখতে হবে না। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও গিয়ে। আছি তো আমি এখানে। তোমাকে টেনশন নিতে হবে না।

— আম্মার ঘর থেকে টেবিল ফ্যানটা তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি। ঐটা একপাশে ছেড়ে বসে থাকো। তাহলেই নিশাতের গায়ে আর বাতাস লাগবে না।

— হ্যাঁ সেটা দিয়ে যা। আর ঈষিতা তুমি একদম নিশ্চিন্তে থাকো। দরকার হলে আমি তোমাকে ডাকবো। ঠিকাছে?

— হুম।

নিম্মি, নিঝুম চলে গেলো অন্যপাশের ঘরে। মায়ের ঘর থেকে ফ্যান এনে নাহিদকে দিয়ে গেলো ফাহাদ।

বিছানায় শুয়ে ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে নিঝুম। মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে

নিশাত আর নাহিদের ভাবনা। নিম্মি ওপাশ থেকে উৎসুক কণ্ঠে নিঝুমকে বললো,

— আপু একটা কথা বলি?

— কি?

— নাহিদ ভাইয়াকে নিশুর প্রতি একটু বেশিই ইন্টারেস্টেড মনে হচ্ছে তাই না?

–তোকে কে বললো?

–বলবে আবার কে? চোখে পড়ে তো।

–কি চোখে পড়ে?

–ভাইয়া ওর সাথে খুব হাসিখুশি হয়ে কথা বলে। ওর সাথে অনেক সময় কাটায়।

— ভাইয়া তো সবার সাথেই হাসিখুশিভাবেই কথা বলে।

উহুম। এটা আলাদা। এজন্যই তো চোখে পড়েছে। তুমি জানো আজ দুপুরে ভাইয়া নিশুর দুহাত ধরে কি যেনো বলছিলো আর নিশু হেসে একদম কুটিকুটি হচ্ছিলো।

–তুই দেখেছিস?

–হ্যাঁ। জানালা দিয়ে দেখেছি। এখন আবার ওর সেবা যত্ন করার জন্য ওর ঘরে থেকে গেলো। ঘটনা সন্দেহজনক।

— নিশু এ ব্যাপারে তোকে কিছু বলেছে?

— উহুম। কেনো যেনো মনে হচ্ছে ঘটনাটা একতরফা। নিশুর তরফ থেকে কিছু নেই। যা আছে নাহিদ ভাইয়ের পাশ থেকে।

–আমারও তাই মনে হয়েছে।

— তার মানে তুমিও খেয়াল করেছো?

— হুম। এটা ফাহাদ ভাইয়া বাদে সবাই খেয়াল করেছে।

–তাহলে কেউ আমাকে বললে না কেনো?

–এখনো আমরা নিশ্চিত না। সবারই সন্দেহ হচ্ছে এই যা। যাক আর কিছু দিন। দেখি পানি কোনদিকে গড়ায়।

–কেমন অদ্ভুত লাগছে ঘটনাটা। নাহিদ ভাই এতগুলো বছর পর কারো সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাচ্ছে তাও আবার এত ছোট একটা মেয়ের সাথে! ভাইয়ার ১৬ বছরের ছোট নিশু। এমন চিন্তাভাবনা তো ভাইয়ার সাথে যায় না।

— খটকা তো আমারও সেখানেই লাগছে। তবে ব্যাপার হচ্ছে কি জানিস? ভাইয়া তো মানুষ তাই না। মানুষের মন বদলাতেই পারে। অসম্ভব কিছু না।

— নিশুকে কি আমি জিজ্ঞেস করবো?

— নাহ্। এখনি না। যাক আরো কিছুদিন।

দেখতে থাক কি হয়।

.

ঘরের টিউবলাইট অফ করে সবুজ রঙের ডিম লাইট জ্বালিয়ে দিলো নাহিদ। নিশাত ঘুমায়নি সেটা সে জানে। এমনিতেই চোখ বন্ধ করে আছে মেয়েটা। লাইট বন্ধ করে নাহিদ পাশে এসে বসতেই নিশাত চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় বললো,

— আমাকে গল্প শোনান।

— কি গল্প?

–রুম্পা সেদিন আপনাকে বিয়ে না করে ফিরে এসেছিলো কেনো?

নিশ্চুপ বসে আছে নাহিদ। নিশাতের প্রত্যুত্তরে কিছুই বলছে না সে। চোখ মেলে তাকালো নিশাত। ডিম লাইটের আবছা আলোয় মানুষটার বিষণ্ন চেহারাটা দেখা যাচ্ছে। এই প্রথম মানুষটাকে এমন বিষন্ন দেখাচ্ছে। এর আগে এমনটা কখনো দেখেনি সে। আচ্ছা প্রশ্নটা কি কষ্ট পাওয়ার মত ছিলো?

হাত বাড়িয়ে নাহিদকে আলতো করে ধাক্কা দিলো নিশাত। মুখ ফিরিয়ে নিশাতের দিকে তাকালো নাহিদ। মুখ বাঁকিয়ে ম্লান হেসে নাহিদ বললো,

— সুস্থ হও। পুরোটা একসাথে শোনাবো। এতটুকু শুনে কিছুই বুঝবে না।

–তাহলে পুরোটাই শোনান।

–বললাম তো, আগে সুস্থ হও।

–আমি এখনই শুনবো।

–আরো অনেক গল্প আমি জানি। সেগুলো শুনো।

–না আমি এই গল্পটাই শুনবো। সেই কখন থেকে শুনতে চাচ্ছি। আপনি ছাড়া আর কেউ এই গল্পটা জানে না। নিঝুপুকে জিজ্ঞেস করলাম। সেও জানে না।

আমাকে অর্ধেক গল্প শুনিয়েছে মেয়েটা। আধা গল্প শুনে এখন আমার আগ্রহ আরো বেড়ে গেছে। না শুনলে শান্তি পাবো না। আমি অসুস্থ একটা মানুষ। আমাকে এতটা অশান্তিতে রাখবেন না প্লিজ। একটা গল্পই তো শুনতে চাচ্ছি। একটু বললে কি এমন হবে?

— মানুষ জ্বর আসলে চুপচাপ থাকে। আর তোমার কথা বলার মাত্রা বেড়ে যায়। আজব অবস্থা!

— আপনি বলা শুরু করলেই তো আমি চুপ হয়ে যাই।

মুচকি হাসলো নাহিদ। বালিশ নিয়ে দেড় হাত দূরে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলো সে। জ্বরের প্রকোপে চোখ জ্বলছে নিশাতের। তবু সে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাহিদের দিকে।

–আব্বা আর ফুফার মাঝে অনেক আগে থেকে শত্রুতা ছিলো সেটা জানো নিশ্চয়ই?

— হুম।

–আমি সবটা জানতাম। তবুও রুম্পাকে ভালোবেসেছি। কেনো বেসেছি আমি নিজেও জানি না। আমার জানালা বরাবর ওর ঘরটা ছিলো। ওকে প্রতিদিন দেখতাম। সকাল বিকাল কোনো একটা সুন্দরী মেয়েকে বারবার চোখের সামনে দেখলে মনে প্রেম জাগা খুব স্বাভাবিক। আমারও তাই হয়েছিলো। বয়স কম ছিলো। আবেগে ভরপুর ছিলাম। কত আর হবে তখন বয়স? ২১ বছর হবে। অনার্স সেকেন্ড ইয়ার পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন। আর ও সদ্য এসএসসি পাশ করে কলেজে উঠা ছাত্রী। উপচে পড়া সৌন্দর্য্য ছিলো মেয়েটার মাঝে। এলাকার বহু ছেলে ওর জন্য পাগল ছিলো। আর ও পাগল ছিলো আমার জন্য। একদম জানালা বরাবর ওর পড়ার টেবিল ছিলো। সারাদিন ও ঐ জায়গাটাতেই বসে থাকতো। সবাই ভাবতো ও পড়ছে। কিন্তু ও আসলে ওখানে বসে থাকতো আমার জন্য। আমাকে দেখামাত্রই মুচকি হাসতো। ঐ হাসির মাঝে কিছু একটা ছিলো নিশু। নেশা জাতীয় কিছু। সম্পর্কে জড়ানোর ইচ্ছা ওপাশ থেকেই আগে এসেছিলো। আমার তরফ থেকে প্রথমে তেমন কিছু ছিলো না। আমি জানতাম এটা দুই পরিবারের মধ্যে ঝামেলা আরো বাড়িয়ে দিবে। তবুও আমি নিজেকে আটকাতে পারি নি। যত দূরে যেতে চাচ্ছিলাম তত ও আমাকে আরো কাছে টানার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। এমনও সময় ছিলো ও আমার ভার্সিটির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে। যেখানে আমি আড্ডা দিতাম সেখানে আশেপাশে ঘুরঘুর করেছে। কতক্ষণ ওকে দূরে সরিয়ে রাখতাম আমি? আমি তো মানুষ তাই না? ভুলে গিয়েছিলাম আমি দুই পরিবারের বিদ্বেষের কথা। সবটা ভুলে গিয়েছিলাম। ভুলে যাওয়াই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

কথা বলার এক প্রান্তে এসে থেমে গেলো নাহিদ। লম্বা নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। নিশাতের মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে নাহিদের এক গ্লাস পানি খাওয়া উচিত। কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠে পানি দেয়ার মত শক্তি আপাতত ওর গায়ে নেই। তবুও সে নাহিদকে জিজ্ঞেস করলো,

পানি খাবেন?

— নাহ্।

— তারপর?

— ও আমাকে খুব ভালোবাসতো। ওর ভালোবাসা আমাকে বাধ্য করেছিলো ওকে ভালোবাসতে। খুব যত্ন নিতো আমার। যদিওবা ও আমার বিয়ে করা বউ ছিলো না, তবুও অধিকার খাটাতো একদম আমার বউয়ের মতই। দূর থেকে যতটা সম্ভব বউয়ের দায়িত্ব সে পালন করতো

— কেমন?

–এই ধরো আমার নখ বড় হয়ে গিয়েছে, ও সেগুলো কেটে দিতো। ওর ব্যাগে রুমাল থাকতো দুইটা। আমার জুতায় ধুলো লেগে আছে। একটা রুমাল দিয়ে সেগুলো ও মুছতো। আবার আমার গায়ের ঘাম মুছে দেয়ার জন্য আরেকটা রুমাল ব্যবহার করতো। বাসা থেকে খাবার নিয়ে এসে আমাকে খাইয়ে দিতো। আমার চুলগুলো এলোমেলো থাকলে যত্ন নিয়ে আঁচড়ে দিতো। আমার শার্টের হাতা এলোমেলো করে কনুই পর্যন্ত গুঁজে রাখার অভ্যাস ছিলো। ও সবসময় শার্টের হাতাগুলো সুন্দর করে ভাজ করে কনুই পর্যন্ত তুলে দিতো। কখনো কখনো আমার ছোট ফুফুর বাড়ি ও বেড়াতে যেতো। দুই চারদিন ওখানেই থাকতো। তখন আমিও ওখানে যেতাম। আমি যা পছন্দ করতাম সব ও নিজে রান্না করতো। আমার চুল শ্যাম্পু করে দিতো। কখনো কখনো ঘষে মেজে গোসলও করাতো। অনেক ধরনের পাগলামি করতো ও। ফুফু হাসতো খুব ওর কান্ড কারখানা দেখে। তখন ও মুখ ভেংচি কেটে বলতো, “আমার বরের লগে আমি কতকিছুই করমু। তুমি হাসো ক্যান?” ও কখনো বলতে চাইতো না ও আমার প্রেমিকা। এমনকি এটা শুনলে খুব রেগে যেতো। সবসময়ই বলতো ওকে বউ বলে ডাকার জন্য। আসলে নিশু ওর ভালোবাসার ধরণটা কেমন ছিলো আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না। পাগল করে ফেলেছিলো ও আমাকে। সম্পূর্ণ পাগল। রুম্পা ছাড়া আমি আর কিছু দেখতাম না, বুঝতামও না। ভালোবাসতাম ওকে আমি। নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসতাম। দুই বছর সম্পর্ক ছিলো ওর সাথে আমার। এই দুই বছরে কতশত স্বপ্ন বুনেছি তার কোনো হিসাব নেই। আমি জানতাম আমাদের কারো পরিবার এই সম্পর্ক মানবে না। আমাদের কাছে একটা পথই খোলা ছিলো। সেটা হলো পালিয়ে বিয়ে করা। ও প্রায়ই বলতো ওকে বিয়ে করার জন্য। আমিই আগাইনি। বেকার ছিলাম তখন। অনার্স পাশ না করলে ভালো একটা চাকরি পেতাম না। হ্যাঁ তখন হয়তো ইন্টার পাশের সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরি পাওয়া যেতো। কিন্তু আমি চাইতাম রুম্পাকে ভালো একটা লাইফস্টাইল দিতে। কোনো অভাবে আমি ওকে রাখতে চাইনি। ইচ্ছে ছিলো গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে ঢাকা চলে যাবো চাকরির খোঁজে। চাকরিটা পার্মানেন্ট হওয়ার পরই ওকে নিয়ে আসবো ঢাকা। বিয়ে করে সংসার গোছাবো। দুই ফ্যামিলির কেউই আমাদের খুঁজে পাবে না। ছোট্ট একটা সংসার হবে আমাদের। দুই রুমের একটা বাসা হবে আমাদের সুখের পৃথিবী। বাসার দেয়ালে দেয়ালে ভালোবাসা লেপ্টে থাকবে। শাড়ীর আঁচল কোমড়ে গুঁজে রুম্পা ঘর গুছাবে। ওর হাতভরা কাঁচের চুড়িগুলো টুংটাং আওয়াজ করবে। যে মেয়েটা এত বছর দূর থেকে আমার যত্ন নিতো সেই মেয়েটা আমার কাছে থেকে যত্ন নিবে। সকালে ঘুম ভাঙবে ওর মুখটা দেখে। রাতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ও আমাকে ঘুম পাড়াবে। বাহির থেকে আমি ঘরে ফিরে আসা মাত্রই আমাকে জড়িয়ে ধরবে। দিনরাত ওর সাথে খুনসুটি চলবে। এই স্বপ্নগুলো আমি জেগে থেকে বুনেছিলাম নিশু। কতটা আবেগ, কতটা ভালোবাসা, কতটা মায়া জড়িয়ে আছে স্বপ্নগুলোতে সে খবর কেউ জানে না। কেউ না। যে জানতো সে আমাকে ফেলে চলে গেলো। আর আমি আমার স্বপ্নগুলো নিয়ে একা পড়ে রইলাম। সম্পূর্ণ একা।

— ও চলে গেলো কেনো?

–বাসায় সব জানাজানি হওয়ার পর ওর বাসার লোকজন অন্য জায়গায় ওর বিয়ে ঠিক করলো। এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা পালিয়ে যাবো। আমার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তখনও রেজাল্ট আসেনি। চাকরিবাকরি কিছুই করি না। তবুও সেই মুহূর্তে বিয়ে করে নেয়াটা সবচেয়ে জরুরী ছিলো। সেইসাথে দুশ্চিন্তা ও ছিলো অনেক। ওকে নিয়ে কোথায় উঠবো, কি খাওয়াবো। শত হোক সে পরের মেয়ে। অন্যের আমানত। ভালোবাসা দেখিয়ে একটা মেয়েকে আমি ঘরছাড়া করে আনলাম, কিন্তু ওর ভরণপোষণ করতে পারলাম না তখন? তখন কি হবে? চাকরি কবে নাগাদ পাবো তারও কোনো ঠিক নেই। শূণ্যের উপর ভাসছিলাম আমি। পুরোপুরি শূণ্য। সে মুহূর্তে আশপাশ পুরোপুরি অন্ধকার দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। ঐ অন্ধকারে আমি শুধু একজোড়া হাত দেখতে পাচ্ছিলাম যে হাত ধরে আমাকে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। ঐ হাতজোড়াই ছিলো আমার তখনকার সম্বল। হাতজোড়া ছিলো রুম্পার। প্ল্যান অনুযায়ী আমরা পালিয়েছিলামও। রাত তখন হয়তো সাড়ে এগারোটা বাজে। বারোটার বাস ছিলো আমাদের। ঢাকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা। পালিয়ে আসার পর থেকে বাসে উঠা পর্যন্ত ও আমার সাথে কোনো কথা বলেনি। আমি যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দিয়েছে মাত্ৰ। ভেবেছিলাম হয়তো টেনশনে আছে তাই কথা বলছে না। বাসে উঠার পর ১৫-২০ মিনিট এভাবেই কেটে গেলো। ও জানালার বাহিরে তাকিয়ে ছিলো। একবারের জন্যও আমার দিকে তাকায়নি। আমি ওর হাতটা ধরলাম। সাথে সাথেই আমার দিকে তাকালো ও। ওর চোখ থেকে অনবরত পানি ঝরছিলো।

আমি দুহাতে ওর চোখের পানি মুছে দিতেই আমাকে বললো,

—বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আব্বা আমারে দেখছে। আমারে বলছে চাইলে আমি উনাগো সাথে নিয়াও বিয়েটা করতে পারি। উনি আমাদের এই সম্পর্ক মাইনা নিবে। কারণ আমার আব্বা আমারে ভালোবাসে। আমি তারে ভালো না বাসতে পারি। উনি ঠিকই আমারে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। আমার জন্য সব শত্রুতা উনি গিইলা ফেলতে রাজি আছে। চাইলে আমি উনারে সাথে নিয়াও বিয়ে করতে পারি আবার উনাদের ছাড়াও করতে পারি। উনি এই সিদ্ধান্ত আমার উপর ছাইড়া দিছে। আমার মনে হইতাছে আমরা অন্যায় করতাছি।

–তো এই কথাটা তুমি আমাকে তখন বললেও তো পারতে। পালানোর কি প্রয়োজন ছিলো।

— আমি বুঝতাছিলাম না আমি কি করমু।

–তোমার আব্বা আম্মা মেনে নিলে খুবই ভালো কথা। চলো ফিরে যাই। উনাদের নিয়েই বিয়ে করবো।

–আব্বা আরও কিছু কথা বলছে।

— কি?

–তোমার আব্বারেও রাজি করাইতে হবে। তাহলে আব্বাও হাসিমুখে নিজে দাঁড়ায়ে থেকে বিয়া দিবে। আর নয়তো বলছে আমারে একাই বিয়া করে নিতে।

— আমার আব্বাকে কেনো থাকতে হবে?

— আমার আব্বা বিয়েতে উপস্থিত থাকলো কিন্তু তোমার আব্বা থাকলো না তখন তো উনি কথা ছড়াবে আমার আব্বা ষড়যন্ত্র কইরা মেয়েরে পেছনে লাগায়ে দিয়া উনার ছেলেকে নিজের আয়ত্নে নিয়া নিছে। তোমার আব্বা কয়দিন আগেও খালাদের ভরা মজলিসে এ কথা আমার আব্বারে শুনাইছে। এখন উনারে ছাড়া আমার আব্বা আমাদের বিয়া করাইলে তো তোমার আব্বা মাইক দিয়া এইসব কথা ছড়াবে। এখন আমার আব্বা কি এসব অপমান সহ্য করবে নাকি?

— তাহলে তুমি চাচ্ছো কি স্পষ্ট করে বলো।

আমরা ফিইরা যাবো। তুমি তোমার আব্বার সাথে কথা বলবা। উনাকে রাজি করাবা।

— কেমন কথা বলছো রুম্পা? আব্বাকে তুমি চেনো না?

— চিনি। আমার আব্বারেও চিনি। আমার আব্বা তো মাইনা নিয়েছে। তুমি তো তোমার বাবার সন্তান। উনি তোমারে অবশ্যই ভালোবাসে। একটাবার কথা বইলাই দেখো উনার সাথে।

আমি ওর কথায় পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। কি বলবো আব্বাকে আমি? কিভাবে বলবো? রুম্পা অসম্ভবকে সম্ভব করার কথা বলছিলো। আমি ওকে ভালোবাসতাম। ওর আবদার আমি ফেলতে পারিনি। কিভাবে কি করবো সেসব ভাবতে ভাবতেই ঢাকা পৌঁছে গেলাম। সময় খুব দ্রুত পেরোচ্ছিলো। কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর মত পর্যাপ্ত সময় মনে হচ্ছিলো আমি পাচ্ছি না। এর আগে কখনো এত দ্রুত সময় কাঁটতে দেখিনি। কি করবো কি করবো না ভাবতে ভাবতেই মনে পড়লো ছোট ফুফার কথা। উনাকে খুব পছন্দ করতো আব্বা। আমার সাথেও উনার সম্পর্ক ছিলো অন্যরকম। ফোন করলাম ফুফাকে। উনাকে সব বললাম। উনি বললো বাড়ি ফিরে যেতে। উনি এখনি রওনা হবেন আমাদের বাড়ির দিকে। আজ রাতেই এর একটা সিদ্ধান্ত হবে। হয় আব্বা আমাকে নিজে দায়িত্ব নিয়ে বিয়ে দিবেন আর নয়তো ছোট ফুফা দায়িত্ব নিয়ে আমাদের বিয়ে দিবেন। তবু আমরা যেনো পালিয়ে বিয়ে না করি। ফুফার কথায় ভরসা পাচ্ছিলাম। ঢাকা থেকে পরবর্তী বাস ধরে ফিরে এলাম বাড়িতে। আমাদের আগেই ছোট ফুফা এসে পৌঁছেছিলেন আমাদের বাড়িতে। রুম্পা আমার সাথেই ছিলো। ওকে নিয়েই আমি বাড়ির ভিতর গিয়েছিলাম। ফোন করে রুম্পার বাবাকে ছোট ফুফা আমাদের এখানে আসতে বলেছিলো। উনিও কিছুক্ষন বাদেই আমাদের বাড়িতে এলো মিমাংসার জন্য। আমি বাড়িতে যাওয়ার পর থেকে আব্বা একটা টু শব্দও করেননি। চুপচাপ মাথা নিচু করে বসেছিলেন। রুম্পার বাবা আসার পর ছোট ফুফা কথা তুলতে না তুলতেই আব্বা মুখে যা আসছিলো তাই বলে যাচ্ছিলেন। রুম্পার বাবাকে গালিগালাজ করে একদম নাজেহাল অবস্থা। আর সেইসাথে মহান এক ডায়লগ একটু পরপর দিয়ে যাচ্ছিলো, আমার পোলারে মেয়ের জামাই বানায়া আমারে হারানোর ধান্ধা করো তাই না? আমার পোলারে আমার কাছ থেইকা দূরে সরায়া আমারে ভাঙতে চাও? রুম্পার বাবা একটা টু শব্দও করেনি। আমি, ফাহাদ আর ছোট ফুফা অনেকবার আব্বাকে থামাতে চেয়েছি। একটাবার ঠান্ডা মাথায় কথা বুঝতে চেষ্টা করার অনুরোধ করেছি। আব্বা শোনেননি। রুম্পা অনবরত কেঁদে যাচ্ছিলো। আমি বুঝতে পারছিলাম ও কষ্ট পাচ্ছে। ওর ভিতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি আমার আব্বাকে থামাতে পারছিলাম না। একটা পর্যায়ে রুম্পা ওর বাবার হাত ধরে আমার আব্বার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো।

বেশ কড়া কণ্ঠে আব্বাকে বললো,

–আপনার প্রতিটা কথার জবাব আমার কাছে আছে। আপনি আমার মায়ের বড় ভাই তাই কিছু বললাম না। শুধু এতটুকুই বলবো আমার বাবা কতটা উদার মনের মানুষ সেটা আমার বাবা আজকে এই সম্পর্ক মাইনা নিয়া প্রমান করেছে। আর আপনি কত ছোট মনের সেটাও আমার বাবাকে এতগুলো অকথ্য কথা বইলা বুঝাইয়া দিছেন। আমার বাবা ভদ্রলোক তাই আপনার কথার উত্তর জানা সত্ত্বেও দেন নাই। চুপচাপ শুইনা গেছেন। সারাজীবন আপনার খারাপটা শুইনা আসছি। আজ নিজ চোখে দেইখা গেলাম আপনি আসলে কতটা খারাপ।

আব্বাকে কথাগুলো বলে রুম্পা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

–আব্বা যদি আমার সুখের জন্য এতবছরের শত্রুতা একমুহূর্তে ভুইলা যাইতে পারে তাহলে আমিও আমার বাবার সুখের জন্য তোমারে ভুলতে পারি। এবং সেইটা একমুহূর্তেই পারি। তোমারে বিয়া করলে আমার আব্বার প্রতিনিয়ত অপমান হইতে হবে। আমার আব্বার অসহায় মুখটা এতক্ষন আমি দেখেছি। আগে কখনো এতটা অসহায় অবস্থায় আব্বাকে আমি দেখি নাই। ভবিষ্যতে দেখতেও চাই না। আজ থেকে তুমি আমার কেউ না। আর চলে যাওয়ার আগে একটা কথা বইলা যাই, তোমার আব্বার কাছে সন্তানের চেয়ে অহংকার বেশি দামী। তোমার আব্বা আজ তোমারে বাছাই না কইরা অহংকার বাছাই কইরা নিলো। তোমার কপাল আসলেই মন্দ। আজ এই মানুষটার জন্যই তোমার আমার সম্পর্কের ইতি ঘটলো।

ও কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে চলে গেলো। আমার মনে হচ্ছিলো আমি পাহাড়ের উপর থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছি। ও চলে গেলো ওর বাবার হাত ধরে। আমি তাকিয়ে দেখছিলাম। ও কিসব বলে গেলো সেগুলো আমার মাথায় ঢুকছিলো না। আমার রুম্পা আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, এটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য ছিলো? ও রাগ করেছে ভালো কথা, কিন্তু এতবড় কথাটা কিভাবে বললো ও আমাকে। ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো? ও কি বাঁচতে পারবে আমাকে ছাড়া?

— আপনি যাননি ওকে আটকাতে?

— গিয়েছি। তবে একটু পর। নিজেকে সামলে নিয়ে তারপর তো যাবো তাই না? – তারপর?

— কিছু সময় পর গিয়েছিলাম ওর বাড়িতে। ও আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো। তখন বুঝতে পারলাম এটা রুম্পা আমাকে রাগ করে বলছে না। সত্যিই বলছে।

— কিভাবে বুঝলেন?

–ওর রাগ করে বলা কথা আর সত্যিকার অর্থে বলা কথার মধ্যে পার্থক্য আমি বুঝতাম নিশাত। ভালোবাসতাম ওকে। ওর সবকিছুই আমার জানা ছিলো।

–তবুও ওকে ফেরানোর চেষ্টা তো করতে পারতেন!

–যে রাগ করে চলে যায় তাকে ফিরানো যায়। যে সত্যিই চলে যায় তাকে কি ফেরানো যায়?

— আন্টি? আন্টি কেনো আংকেলকে কিছু বলেনি।

–আম্মা সেদিন ছিলো না সেখানে। নিম্মি আর নিঝুকে নিয়ে নানীর বাড়ি গিয়েছিলেন। বাসায় শুধু আব্বা আর ফাহাদ ছিলো।

— এজন্যই নিঝুপু আমাকে বললো ও কিছু জানেনা রুম্পার চলে যাওয়ার ব্যাপারে।

–সেদিন রাতের ঘটনা কেউই জানে না নিশাত। আম্মাও না। আব্বা আমাকে, ফাহাদকে আর ফুফাকে এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলতে না করে দিয়েছিলো।

–কেনো?

–আমি জানি না।

— জিজ্ঞেস করেননি?

— নাহ্।

— কেনো?

— সেদিনের পর আমার আর কোনো প্রশ্ন মনে জাগতো না। কি হলো? কেনো হলো? এসব মাথায় আসতো না। একটা প্রশ্নই শুধু মাথায় ঘুরতো আমি বেঁচে আছি কেনো? কি আছে আমার জীবনে? এমন একটা মানুষকে আমার বাবা ডাকতে হয় যে কখনো আমাকে ভালোই বাসেনি। তার কাছে আমার চেয়ে তার অহংকারটা বেশি মূখ্য ছিলো। এমন একটা মানুষকে নিয়ে আমি স্বপ্ন বুনেছিলাম যে আমাকে বুঝলোই না। অন্যের আজেবাজে কথার জন্য আমাকে এতবড় শাস্তিটা দিলো। একবারও ভাবলো না নাহিদ তো কথাগুলো বলেনি। বলেছে নাহিদের বাবা। তাহলে ওকে কেনো কষ্ট দিবো? আব্বার কয়েকটা কথার কাছে আমার ভালোবাসা রুম্পার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেলো। আমার দিকে ফিরে তাকানোর নূন্যতম প্রয়োজনও মনে করলো না। আমি একা হয়ে গেলাম। সম্পূর্ণ একা। আমার ঘরভরা মানুষ ছিলো। একগাদা বন্ধু-বান্ধব ছিলো। পাড়ার বহু মেয়ে আমাকে ভালোবাসতো। চাইলেই কারো সাথে সম্পর্কে জড়াতে পারতাম। এতকিছুর পরও আমি একা ছিলাম। নিজেকে শূন্য মনে হতো। আজও তাই মনে হয়। মেয়েটা আমাকে আজীবনের জন্য শূণ্য করে দিয়ে গেছে। কোনোকিছুই সেই শূণ্যতা পূরণ করতে পারে না। ওর শূণ্যতা আমাকে আজও ভোগায় নিশু। ভুলতে পারি না ওকে। তুমিও তো কাউকে ভালোবেসেছিলে। শূণ্য হওয়ার অনুভূতি কেমন হয় তা জানো নিশ্চয়ই! বুকের ভেতরটা কেমন খাঁ খাঁ করে। মনে হয় কেউ একটু জড়িয়ে ধরুক। কারো উষ্ণতায় নিজেকে মেখে বুকের ভিতরের খা খা অনুভূতিটা একটু কমাই। কাউকে খুঁজে পাইনা জানো? আজকে বারো বছর ধরে একজোড়া হাত খুঁজে বেড়াচ্ছি। যে হাতটা ধরে একটু শান্তি পাবো। যাকে জড়িয়ে ধরে নিজেকে পূর্ণ মনে হবে। কিন্তু কাওকে পাই না। সেই অনুভূতি কাউকে দেখলে হয়না, যেমনটা রুম্পার জন্য হতো। কারো প্রতি ওভাবে মন টানে না আসলে।

নাহিদকে আপাতত সত্যিই অসহায় মনে হচ্ছে নিশাতের। ইচ্ছে হচ্ছে ওকে একটু জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে। শূণ্য হওয়ার কষ্ট সত্যিই নিশাত জানে। আবীর চলে যাওয়ার পর কতটা কষ্ট পেয়েছিলো সে! কতটা একা মনে হতো নিজেকে! এরপর এই মানুষটা আসলো। একটু একটু করে মাত্র তিনদিনে একাকিত্ব ঘুচিয়ে দিলো। শূণ্য হওয়ার অনুভূতিটা সরিয়ে দিলো। যে এতকিছু করলো ওর জন্য সেই মানুষটা এতগুলো বছর এমন বাজে অনুভূতি নিয়ে বেঁচে আছে তার কি কোনো মানে হয়? কান্না পাচ্ছে নিশাতের। বড্ড মায়া হচ্ছে তার জন্য। জড়িয়ে না ধরতে পারুক, অন্তত দুহাত ধরে সান্তনা তো দেয়া যেতেই পারে। শোয়া থেকে কোনোমতে উঠে নাহিদের দুহাত চেপে ধরলো নিশাত। চোখ বেয়ে তার পানি ঝড়ছে। একরাশ বিস্ময় নিয়ে নাহিদ জিজ্ঞেস করলো,

— তুমি কাঁদছো কেনো?

— আপনার মনমতো অবশ্যই কাউকে না কাউকে পাবেন। একদম কষ্ট পাবেন না আপনি। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখবেন। রুম্পা একটা বেয়াদব। এজন্য আপনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। ওকে নিয়ে আর ভাববেন না। আপনি খুব ভালো মানুষ। আপনার ভাগ্যে ওর চেয়ে ভালো কেউ আছে।

— ঠিকাছে ভালো মেয়ে পাবো। কিন্তু তুমি কাঁদছো কেনো?

–আপনার জন্য কষ্ট হচ্ছে।

–আচ্ছা এখন আর কষ্ট পেতে হবে না। সুস্থ হওয়ার পর আবার কষ্ট পেও। নাও শুয়ে পড়ো। এখন কাঁদলে চোখ আরো বেশি জ্বালা করবে।

–হ্যাঁ জ্বলছে তো।

–চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো। আমি ভেজা রুমাল দিয়ে দিচ্ছি চোখের উপর।

চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো নিশাত। ওর বন্ধ করে রাখা চোখের উপর কিছুক্ষণ পরপর পানিতে ডুবিয়ে ভেজা রুমাল দিয়ে দিচ্ছে নাহিদ। মনে মনে নিশাতকে নিয়ে ভাবছে সে। বয়স বাড়লেও মনটা এখনো ছোট বাচ্চাদের মতই রয়ে গেছে মেয়েটার। একদম সহজ সরল। এই মেয়েকে দিয়ে আর যাই হোক ছলচাতুরী সম্ভব না। এমন মেয়ে আজকাল খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিভাবে পারলো আবীর ওকে ছেড়ে চলে যেতে?

১৭

অলস দুপুর। কাঠফাঁটা রোদ জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বিছানায় এসে পড়েছে। জানালার পাশে বিছানার এককোণায় হেলান দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে নিশাত। লম্বা ডাবগাছের পাতাগুলো দক্ষিণা বাতাসে হেলছে দুলছে। কয়েকটা কাক মিলে কা কা শব্দ তুলে গাছগুলোর আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গায়ের জ্বরটা ছেড়েছে অনেকক্ষণ হলো। তবু নিজেকে অসুস্থ মনে হচ্ছে নিশাতের। অজানা এক বিষণ্নতা ঘিরে রেখেছে ওকে। গতরাতে আবছা আলোয় দেখা নাহিদের মুখটা বারবার ভেসে উঠছে। কেমন যেনো বুকের ভিতর খা খা করছে মানুষটার জন্য। কেনো হচ্ছে এমন? এর আগেও তো এমন কত গল্পই শুনেছে। কই কখনো তো এমন হয়নি। তাহলে এই মানুষটার জন্য এত কষ্ট কেনো হচ্ছে? কেনো ইচ্ছে হচ্ছে মানুষটার সব কষ্ট মুছে দিতে? কেনো ইচ্ছে হচ্ছে তাকে পরম মমতায় আগলে ধরে সমস্ত শূণ্যতা কাটিয়ে দিতে?

–কিরে? শরীর কেমন লাগছে তোর?

নিশাতের পাশে বসেই ওর কপালে হাত রাখলো ঈষিতা। বিষণ্ন চোখে বোনের দিকে তাকালো নিশাত।

— জ্বর তো নেই। শরীর দুর্বল লাগছে তাই না?

— নাহ্।

— একা বসে আছিস কেনো? সবাই নাটক দেখছি আমরা। তুইও আয়।

–যাবো না।

–মন খারাপ কোনো বিষয়ে?

— হুম।

— কি নিয়ে?

— নাহিদ ভাইকে নিয়ে?

— কি হয়েছে?

— উনি আমাকে গতকাল উনার গল্প শুনিয়েছে।

— কিসের গল্প?

— রুম্পার।

–আচ্ছা। তারপর?

— পুরোটা বলেছে।

— হুম…..

–এখন আমার উনার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। মনের ভিতর কেমন খচখচ করছে। এমন লাগছে কেনো বলতো? আগেও তো এমন কত ব্রেকআপের গল্পই শুনেছি। কারো জন্য তো এমন কষ্ট হয়নি। উনার জন্য কেনো লাগছে?

— তুই হয়তো উনাকে সবার চেয়ে আলাদা নজরে দেখিস। হয়তো উনি তোর কাছে স্পেশাল কেউ।

— হ্যাঁ তা তো আছেই। স্পেশাল তো বটেই। উনাকে আমার খুব পছন্দ। কিন্তু কষ্ট তো বেশি পাচ্ছি। ইচ্ছে হচ্ছে উনার জন্য কিছু করতে, যেটাতে উনি সারাজীবনের জন্য ঐ কষ্টটা ভুলে যাবে। কি করবো আমি?

বোনের চোখেমুখে নাহিদের জন্য স্পষ্ট মায়া ফুটে উঠতে দেখছে ঈষিতা। খুব আপন কারো জন্য একজন মানুষের চেহারায় যতটা মায়া ফুটে উঠে ঠিক ততটা। এমন মায়া এর আগেও নিশাতের চেহারার ভাঁজে ফুটে উঠতে দেখেছে ঈষিতা। সেটা ছিলো আবীরের জন্য। তবে কি নিশাতের অজান্তেই আবীরের জায়গাটা

— নাহিদ নিয়ে নিলো? ঈষিতা মুচকি হেসে জিজ্ঞিস করলো,

— নাহিদ ভাইকে কতটা স্পেশাল মনে হয় তোর কাছে?

— আমি তো মেপে দেখিনি। কিভাবে বলবো?

–বাচ্চাদের মত আর কতদিন কথা বলবি? এবার তো বড় হো।

–আমি তো বাচ্চাই।

— একটু ভেবে চিন্তে একটা কথা বলতো নিশু।

— কি?

— নাহিদ ভাইয়ের প্রতি তোর কি অন্যরকম কোনো অনুভূতি কাজ করে?

–কেমন?

–এই যেমন খুব কাছের আপন কেউ। যার সাথে সময় কাটালে মন খারাপ আপনাআপনিই কেটে যায়। একধরনের শান্তি কাজ করে।

–হুম তা তো করেই। সত্যি কথা বলতে মানুষটা যাদু জানে। আর নয়তো আবীরকে ভুলে থাকার মত মানুষ কি আমি ছিলাম আপু তুইই বল?

— উহুম।

— ওর জন্য আমার এখন আর কষ্ট লাগে না আপু। মাত্র তিন চারদিনে এমন কি হয়ে গেলো আমি খুঁজে পাই না? আমার ওর জন্য কষ্ট কেনো হয় না আমি বুঝি না। মনে হয় নাহিদ ভাই কোনো এক মন্ত্র পড়ে আমার গায়ে ফুঁ দিয়ে বুঝি আবীরকে আমার মন থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এক কথায় বলতে পারিস লোকটা মন ভালো করার ট্যাবলেট।

— এমন একটা মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেলে মন্দ হয় না, তাই না?

–অবশ্যই না। খুব কপাল ভালো থাকলে এমন মানুষ পাওয়া যাবে। এমন মানুষ তো সবাই খুঁজে।

— যদি মানুষটা তোর হয়?

–মানে?

–বললাম সেই ভাগ্যবান তো তুইও হতে পারিস।

–যাহ্ আপু! এগুলো কেমন কথা? উনাকে কেনো আমি বিয়ে করতে চাইবো?

–তুইই তো বললি এমন মানুষ সবাই চায়।

— ঠিক আছে বলেছি। কিন্তু আমার মনে ওসব কিছু নেই। আমি কখনো ওভাবে ভাবিই না। হ্যাঁ উনাকে বেশ আপন আপন লাগে। কিন্তু উনাকে বিয়ে করবো বা প্রেম করবো এসব চিন্তা কখনোই মাথায় আসে নি আপু।

— তুই এমন চোখ মুখ কুঁচকাচ্ছিস কেনো?

— কুঁচকাবো না? এই বাসার লোকজন এসব শুনলে কি ভাববে? আর নাহিদ ভাই? উনি এসব শুনলে হয়তো আমার সাথে আর কখনো কথাই বলবে না। তুই এমন কথা আর কখনো বলবি না আপু। আমি চাই না এসব আজেবাজে কথার জন্য উনার সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ হোক।

ক্রমশ রেগে যাচ্ছে নিশাত। হয়তো সে এখনো নাহিদের প্রতি থাকা তার অনুভূতি বুঝে উঠতে পারেনি কিংবা ওরকম অনুভূতি জাগেইনি। হয়তো তার ধারণা ভুল। আবার সত্যিও হতে পারে। দ্বিধায় পড়ে গেছে ঈষিতা। দ্রুত পরিস্থিতি সামলে নেয়ার জন্য মুচকি হেসে নিশাতকে বললো,

আরে বোকা, কথা তো তুই আর আমি শুধু বলছি। অন্য কেউ তো আর শুনছে না।

— তবুও তো। এসব ভাবনা আর কখনো ভাববি না আপু।

–আচ্ছা সরি আর ভাববো না। টিভি দেখবি চল।

–না আমি এখানেই বসি। ইচ্ছে হচ্ছে না টিভি দেখতে।

— ইয়ারফোন এনে দিবো? গান শুনবি?

–দে।

–কোথায় রেখেছিস?

— ঐ তো ওয়্যারড্রবের উপরেই।

নিশাতকে ইয়ারফোন এগিয়ে দিয়ে ড্রইংরুমে চলে গেলো ঈষিতা। গভীর মনোযোগে ঘরের সব সদস্য মিলে টিভি দেখছে। ঈষিতা সোফায় গিয়ে বসতেই নিম্মি জিজ্ঞেস করলো,

— এতক্ষণ কি করছিলে? মজার সিনগুলো চলে গেলো।

–নিশুর সাথে বসে একটু কথা বললাম।

–ওকে নিয়ে আসলে না কেনো?

–একা বসে থাকতে নাকি ভালো লাগছে।

–শরীর খারাপ লাগছে আবার?

— নাহ্। মন খারাপ বোধহয়।

.

ফ্লোরে বসে ছিলো নাহিদ। ঈষিতার কথায় ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো ওর দিকে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

–ওর আবার কি হলো?

–কি জানি!

— জিজ্ঞেস করোনি?

— হ্যাঁ।

–বলেনি কিছু?

— উহুম।

–তোমার বোনের কি যে হয় বুঝি না কিছু। এই ভালো এই খারাপ। এত মুড সুইং হয় কেনো ওর?

একরাশ বিরক্তি নিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে নিশাতের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো নাহিদ। ঈষিতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে নিঝুম বললো,

— তোমার বোনের জন্য আমার ভাইয়ের কত চিন্তা দেখছো? নিশাতের মন খারাপ হওয়ার কোনো চান্স নেই। আমার ভাই দৌঁড়ে চলে যাবে ওর মন ভালো করতে।

.

ফিক করে হেসে ফেললো ঈষিতা আর নিম্মি। সোফা থেকে ফ্লোরে নেমে নিঝুমের পাশে বসে ঈষিতা বললো,

— একটু আগে নিশাত কি বলেছে জানো?

— কি?

–নাহিদ ভাই নাকি মন ভালো করার ট্যাবলেট।

বলেই ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো ঈষিতা। সেইসাথে যোগ দিয়েছে নিম্মি আর নিঝুমও।

.

–তোরা কি নিয়ে হাসাহাসি করছিস?

নাহিদের গলার আওয়াজ পেয়ে তড়িৎ গতিতে হাসি থামিয়ে দিলো তিনজনই। অবাক হলো নাহিদ। ওকে দেখে হাসি থামানোর কি হলো?

— কি নিয়ে হাসছিলি তোরা?

— কিছু না তো।

— এমনি এমনি কি মানুষ হাসে? আমাকে দেখে হাসি বন্ধ করলি কেনো?

— কই না তো।

–আমি নিজ চোখে দেখলাম আর তোরা বলছিস না তো। সন্দেহজনক আচরন করছিস।

–আরে অন্য কথা। আমাদের মেয়েদের কথা আরকি।

— ওহ্ আচ্ছা।

— নিশাত আসলো না?

–না। মেয়েটাকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি। শোন টিভি রাখ। সবগুলো যেয়ে রেডি হো।

— কোথায় যাবো?

— নিয়াজ তাঁতীর বাড়ি।

বসা থেকে তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়ালো দুই বোন। ঠোঁটে প্রশস্ত হাসির ঝলকানি। একসাথে দুজনই বলে উঠলো,

— ১০ টা মিনিট সময় দাও। এক্ষুণি রেডি হয়ে আসছি আমরা।

.

হা হয়ে তাকিয়ে আছে ঈষিতা। কে এই নিয়াজ তাঁতী? আর ওরা দুই বোনই বা কেনো এই লোকের বাড়ি যাওয়ার নাম শুনে এভাবে লাফাচ্ছে? নাহিদ ঈষিতার মাথায় আলতো ধাক্কা দিয়ে বললো,

— তুমি বসে আছো কেনো? যাও রেডি হও।

— নিয়াজ তাঁতী কে?

— শাড়ী বানায়। তাঁতের শাড়ী, জামদানী শাড়ী এসব আরকি। এই লোক এখানে বেশ ফেমাস। সবার থেকে কাজ একদম আলাদা। এক্সক্লুসিভ জামদানীর ডিজাইন পেতে চাইলে নিয়াজ তাঁতী বেস্ট।

চোখমুখ মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে গেলো ঈষিতার। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে দৌঁড়ে চলে গেলো নিজের ঘরে।

হেলেদুলে তৈরী হচ্ছে নিশাত। খুব দ্রুত চোখে কাজলের রেখা টানতে টানতে নিঝুম বললো,

— জলদি রেডি হও। অলরেডি সাড়ে তিনটা বাজে। ঐ লোকের বাড়ি এই গ্রামে না। পাশের গ্রামে। যেতে যেতে আধাঘন্টা লাগবে। তারপর ওখানে গিয়ে শাড়ীও তো পছন্দ করতে হবে। উফফ আমি প্রচুর এক্সাইটেড!

–শোন না আপু, আমি দুইটা জামদানী কিনবো। একটা কফি কালার আরেকটা লাল।

— আমি কিনবো তিনটা। সাদা, কুসুম রঙ আর কালো। নিশাত তুমি অবশ্যই মেজেন্ডা কালার শাড়ী কিনবে। তোমাকে দারুন মানাবে। একদম পরীর মত লাগবে।

— আমি কেনো শাড়ী কিনবো? আমি শাড়ী পরি নাকি?

— এতদিন পরো নি। এখন পরবে।

–না শাড়ী আমার কাছে খুব ঝামেলা লাগে।

–আচ্ছা আচ্ছা পরে দেখা যাবে। নাও, জলদি একটু কাজল লাগাও চোখে।

.

নিশাতের হাতে কাজল গুঁজে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো নিঝুম। নাহিদের ঘরে গিয়ে হাসতে হাসতে বললো,

— টাকা বেশি করে নিয়ে নাও। আমরা আজকে অনেকগুলো শাড়ী কিনবো।

–অনেকগুলো মানে?

— আমি তিনটা কিনবো আর নিম্মি দুইটা। ভাবী তো জামদানীর পাগল। কমপক্ষে দুইটা তো নিবেই। নিশাত আর আম্মার জন্যও তো নিবো।

— সবাই একটা করে পাবি।

–মানি না। সবাইকে একটা করে দিলেও আমাকে তিনটা কিনে দিতেই হবে।

–তোদের না সবার বিয়ের শপিং শেষ। আবার এতগুলো শাড়ী কিনবি কেনো? জামদানী তো নেইনি।

— কেনো?

–কাতানের ট্রেন্ড যাচ্ছে এখন তাই।

— তো কাতানই পর। জামদানী পরে কি করবি?

— না। জামদানীও লাগবে।

— গতমাসে কানাডাতে জামদানীর এক্সিবিশন হয়েছিলো। সিমিনের সাথে গিয়েছিলাম দেখতে। মডেলগুলো জামদানীর সাথে সিলভারের জুয়েলারী পড়েছিলো। দারুন লেগেছে প্রত্যেকটা মেয়েকে। তখনই ভেবেছিলাম তোদেরকে একটা করে জামদানী গিফট করবো। সাথে এক সেট সিলভার জুয়েলারী। এখন সিদ্ধান্ত নে কি করবি? একেকজন তিন চারটা করে শাড়ী কিনবি নাকি জুয়েলারী সেট সহ একটা করে শাড়ী কিনবি?

— তিন চারটা শাড়ীও নিবো আবার জুয়েলারীও কিনে দিবা।

— ফকির বানানোর ধান্ধা তাই না?

— ফকির আর বানাতে পারি কোথায়? তোমাকে তো কাছেই পাই না।

হয়েছে এখন কথা অন্যদিকে নিতে হবে না। চল, কিনে দিবো জামদানী। যে কয়টা ভালো লাগে কিনিস।

— জুয়েলারী কি আজই কিনে দিবে?

–এত্ত তাড়া কেনো তোর? আগে শাড়ী কিনে নে, এরপর জুয়েলারী।

নাহিদের বিছানায় বসে পা নাচাতে নাচাতে নিঝুম বললো,

— খুশিতে আমার গড়াগড়ি খেতে মন চাচ্ছে।

–খা খা। তোকে কতদিন হয় আমি গড়াগড়ি খেতে দেখি না। আগে তো কিছু থেকে কিছু হলেই ফ্লোরে শুয়ে গড়াগড়ি করে কান্না করতি।

.

ঈষিতা রেডি হয়ে নাহিদের ঘরে এসে বললো,

— আমি রেডি।

–ওরা রেডি হয়েছে?

— হ্যাঁ।

–আচ্ছা তোমরা বের হও। রিকশা ঠিক করো। আমি আসছি।

— আম্মা তো ঘুমাচ্ছে। ডাকবো?

–না না। ঘুমাক। কাজের মেয়েটাকে বলো গেট আটকাতে। শুধু শুধু আম্মাকে জাগিয়ে লাভ নেই। ফাহাদ যাবে?

— না, দোকান রেখে যাবে না তো।

–আচ্ছা তাহলে ও বাদ। আমরা আমরাই যাবো।

১৮

রিকশায় পাশাপাশি বসে আছে নিশাত আর নাহিদ। মটর চালিত রিকশাটা প্যাডেল চালিত রিকশার তুলনায় একটু দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছে। পুরো রাস্তা ফাঁকা। গ্রামের পূর্বমুখী রাস্তাটা ধরে রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমের আকাশে হেলে পড়েছে সূর্য। তবুও রোদের দাপট মোটেই কমেনি। মধ্যদুপুরের মতই তেজ রয়ে গেছে এখনো। দক্ষিণা বাতাসের চোটে সেই তেজ খুব একটা গায়ে লাগছে না ওদের দুজনের। রাস্তায় লোকজন তেমন কেউ নেই বললেই চলে। হয়তোবা দুপুরে খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রামে সময় কাটাচ্ছে সবাই। নিশাতের বরাবরই গ্রামের রাস্তা ধরে রিকশায় ঘুরে বেড়ানো খুব পছন্দের। ওর মনটাকে অজানা এক খুশি ঘিরে রাখে পুরোটা সময় জুড়ে। গ্রামের রাস্তাগুলোর মাঝে আলাদা একটা ঘ্রান থাকে। মাটি আর গাছপালা মিলে মায়াবী এক ঘ্রান তৈরী হয়। খুব প্রিয় সেই ঘ্রান। তবে আজ সেই প্রিয় ঘ্রানের উপর আধিপত্য খাটাচ্ছে নতুন কোনো ঘ্রান। নাহিদের গা থেকে ভেসে আসা মিষ্টি পারফিউমটার ঘ্রান। তারচেয়েও বেশি আধিপত্য খাটাচ্ছে পারফিউম মাখা মানুষটা। আজ আর গ্রামের রাস্তা, মেটে ঘ্রাণ, সোনালী বিকেল কিংবা দখিনা হাওয়া কোনোটাই ওভাবে নিশাতের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না, যতটা নাহিদ করছে। ঈষিতা কথাগুলো বলে যাওয়ার পর থেকে মনে হচ্ছে সত্যিই নাহিদ তার জীবনে অন্য এক অনুভূতি, যা সবার জন্য অনুভব হয় না। যে অনুভূতি আগলে রাখতে ইচ্ছে হয় জনম জনম। তাহলে কি নাহিদ নিজের জায়গা আদায় করে নিলো তার মনে? এজন্যই কি আজকাল আবীর নামক মানুষটার অভাব টের পায় না সে? কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? আবীরের প্রতি এতবছরের মায়া কিভাবে এই চারদিনের পরিচিত এই লোকটার জন্য কেটে গেলো? এসব ভাবতে ভাবতেই কান গরম হয়ে আসছে নিশাতের। যেই মানুষটার সাথে নির্দ্বিধায় সব কথা বলতে পারে আজ তার সাথে কথা বলতে প্রচন্ড লজ্জা লাগছে। নাহিদকে নিয়ে যত ভাবছে তত বেশি ঘোরের মাঝে তলিয়ে যাচ্ছে নিশাত।

কিছুক্ষণ পরপরই নিশাতের দিকে তাকাচ্ছে নাহিদ। রিকশায় উঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি মেয়েটা। মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বসে আছে। কিছু একটা গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। নিশাতের হাতে আলতো চিমটি কেটে জিজ্ঞেস করলো,

— এ্যাই মেয়ে, মন কি খুব খারাপ?

— উহুম।

— কি ভাবছো?

— কিছু না।

— আমি দেখতে পাচ্ছি কিছু একটা ভাবছো। মিথ্যা বলছো কেনো?

–না তো। সত্যি বলছি।

–অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে কথা বলছো কেনো? তাকাও আমার দিকে।

লজ্জাকে একপাশে রেখে ফ্যাকাশে চেহারা নিয়ে নাহিদের দিকে তাকালো নিশাত।

ভ্রু কুঁচকে নাহিদ জিজ্ঞেস করলো,

— শরীর খারাপ লাগছে?

— না।

— মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেনো?

— খুব দুশ্চিন্তায় বা অসুস্থ থাকলে মানুষের চেহারা যেমন হয় তেমন। কিছু নিয়ে চিন্তা করছো?

.

নাহিদের দু’চোখের দিকে তাকিয়ে আছে নিশাত। মানুষটা ওকে এত বুঝে কেনো? সেই প্রথম দিন থেকেই লোকটা ওকে খুব বুঝে। মনে হয় যেনো কতকাল ধরে এই মানুষটা ওকে জানে। সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মানুষ ওকে এত কেনো বুঝবে? এত যত্ন কেনো নিবে? মন খারাপ হলেই ওর মন ভালো করার জন্য উঠেপড়ে কেনো লাগবে? কি হয় সে নাহিদের? আবীরের শোকে যদি সে ভেসে যায় তাতে নাহিদের কি? তাহলে কি নাহিদের কাছেও সে অন্য এক অনুভূতি যা সবার জন্য অনুভূত হয় না? যে অনুভূতি আগলে রাখতে ইচ্ছে হয় জনম জনম? এজন্যই কি নাহিদ তাকে আগলে রাখে?

—এত মনোযোগ দিয়ে আমার চোখের দিকে কি দেখছো?

নাহিদের কথায় স্তম্ভিত ফিরে পেলো নিশাত। মূহূর্তেই চোখ সরিয়ে নিলো অন্যদিকে। বড্ড অস্থির লাগছে। নিজের হাত দুটো অকারনে কচলে যাচ্ছে।

.

— তুমি খুব বেশি অস্থির হয়ে আছো? কেনো বলো তো?

কৌতুহলী দৃষ্টিতে নাহিদের দিকে তাকালো নিশাত। জিজ্ঞেস করলো,

— আপনি জানলেন কিভাবে?

–তোমার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে। আবার হাত দুটো অকারনে কচলাচ্ছো। কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?

— না।

–আবীরকে নিয়ে কোনো সমস্যা?

–সমস্যা আপনি?

— মানে?

— আপনি আমাকে এত বুঝেন কেনো?

— তোমার কথাটা ঠিক বুঝলাম না।

আমি কিছু মুখ ফুটে বলার আগেই আপনি আমার মনের কথা বুঝে ফেলেন কিভাবে? আমার মন খারাপ থাকলে মন ভালো করার জন্য উঠেপড়ে লেগে যান। কেনো করেন আমার জন্য এসব?

— তুমি কি বিরক্ত হও?

–না। বিরক্ত কেনো হবো?

–তাহলে এভাবে জিজ্ঞেস করছো কেনো?

— জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।

— কারো জন্য কিছু করতে হলে যে তার পিছনে সবসময়ই কারণ থাকতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। তোমাকে কাঁদতে দেখতে ভালো লাগে না। হাসিখুশি ভালো লাগে। তাই এমন করি।

— আর মনের কথা? সেগুলো বুঝেন কেমন করে?

–জানি না তো। কিভাবে যেনো বুঝে যাই।

–অন্য সবার ক্ষেত্রেও কি এমন হয়?

— কি জানি! খেয়াল করিনি তো কখনো। এতকিছু জিজ্ঞেস করছো কেনো বুঝলাম না তো?

— না আপনি তো মনের কথা বুঝে ফেলেন। ভাবলাম পীর আউলিয়া হয়ে গেলেন কিনা! তাই আরকি!

.

সশব্দে হেসে উঠলো নাহিদ। সেই হাসি গভীর মনোযোগে দেখছে নিশাত মানুষটা একটা সঠিক উত্তর দেয়নি। হেলাফেলা ধাঁচের উত্তর দিয়েছে। মানুষ তখনই এধরণের উত্তর দেয় যখন সে কোনোকিছু আড়াল করতে চায়। তারমানে নাহিদও কিছু আড়াল করছে। কিন্তু কি সেটা? তার অনুভূতি?

১৯

পুরো তিনঘন্টা পর বাড়ি ফিরে এসেছে ওরা সবাই। মাগরিবের নামাজ পড়ে ডাইনিং টেবিলে বসে চা খাচ্ছিলেন শালুক। কাজের মেয়ে দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে নিম্মি ঘরে এসে ঢুকলো। মায়ের পাশে চেয়ার টেনে গা এলিয়ে বসে পড়লো সে। মুখে প্রশস্ত হাসির রেখা। শালুক মুচকি হেসে বললেন,

–মনমতো কেনাকাটা হইছে মনে হইতেছে!

— হ্যাঁ। কি যে সুন্দর শাড়ী!

— কত খরচ করাইলি ভাইকে দিয়া?

–সেসব জেনে তুমি কি করবে?

–জানবো না?

— না। শোনো, তোমার জন্যও শাড়ী কিনে এনেছে ভাইয়া। ঘিয়ে রঙের জামদানী আর মিষ্টি রঙের তাঁত। তোমাকে খুব মানাবে আম্মা।

— কে পছন্দ করেছে?

–নাহিদ ভাই।

–আমার জন্য আবার দুটো কিনতে গেলো কেনো?

সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে নিঝুম উত্তর দিলো,

–এত প্রশ্ন না করে মনে মনে খুশি থাকো। ছেলে নিজে পছন্দ করে কিনে দিয়েছে।

— খুশি তো হইছিই।

হাসিহাসি মুখ নিয়ে ঈষিতা বললো,

— ভিতরে আসেন আম্মা। শাড়ীগুলো দেখবেন। আমাদের সবাইকে দুটো করে শাড়ী কিনে দিয়েছে। আর নিঝুমের জন্য এক্সট্রা আরো একটা দিয়েছে। ওর বিয়ে তো। তাই।

— তোমরা গিয়া কাপড় ছাড়ো। হাত মুখ ধোও। আমি চা শেষ কইরা আসতেছি। নিম্মি চেয়ার ছেড়ে উঠতেই শালুক জিজ্ঞেস করলেন,  

–নিশাত আর নাহিদ কই রে?

— ওহ্। ওরা দুজন নদীর ঐপার গিয়েছে। করিম শাহ্-এর ওরস হচ্ছে না?

— হুম।

— মেলা হচ্ছে তো ওখানে। ওরসের মেলা নাকি নিশাত কখনো দেখেনি। তাই ওকে সেখানে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছে।

–আচ্ছা যা।

.

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নাহিদ আর নিশাতকে বিয়ের পোশাকে একদফা কল্পনা করে নিচ্ছেন শালুক। ওদের দুজনকে একসাথে ভাবতেই অজানা কারনবশত মনটা একদম ফুরফুরে হয়ে যায়। নিশাতের মা বাবা আসুক এরপর তাদের কাছে বিয়ের আলাপ রাখা যাবে। ততদিনে নাহয় ছেলেমেয়ের মধ্যে আন্তরিকতাও বাড়তে থাকুক।

.

সরু আধাপাকা রাস্তা। রাস্তার দুপাশে ছোট ছোট মরিচা বাতি দিয়ে সাজানো। আর মাথার উপর লম্বা রশি টানানো। রশিতে তিন চার হাত দূরত্বে একের পর এক লাগানো হয়েছে হলুদ রঙের বাল্ব। রশিটা শুরু হয়েছে একদম নদীর পাড়ের রাস্তার শুরু থেকে। শেষ কোথায় হয়েছে তা জানা নেই নিশাতের। একদম বিয়ে বাড়ির মত লাগছে। নাহিদের পাশাপাশি হাঁটছে নিশাত। অসংখ্য মানুষ যাতায়াত করছে এই রাস্তা ধরে। দূর থেকে মারফতি গানের আওয়াজ ভেসে আসছে। কতটা পথ হাঁটতে হবে তা জানা নেই নিশাতের। অনেকক্ষন ধরেই হাঁটছে সে। তবে হাঁটতে বিরক্ত লাগছে একদমই তা না। বরং অন্যরকম লাগছে হাঁটতে। রাস্তায় যতগুলো মানুষ দেখেছে সবারই চোখে মুখে আনন্দ লেপ্টে আছে। কেউ কেউ হাতভরা ব্যাগ নিয়ে ফিরছে বাসায়। মেলা থেকে অনেক কেনাকাটা করেছে নিশ্চয়ই! এখানকার আমেজটা একদম ঈদ ঈদ লাগছে। ছোট বৃদ্ধ কেউ বাদ নেই। সববয়সী মানুষ আসছে এখানে। বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে গেছে, হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে এমন বৃদ্ধ মহিলা তিন চারজনকে দেখেছে সে। কৌতুহলী কণ্ঠে নাহিদকে জিজ্ঞেস করলো,

— এখানে খুব আনন্দ হয় তাই না?

–হুম। সবধরণের মানুষ একজায়গায় এসে জড়ো হয়। আশপাশের চার

পাঁচগ্রামের লোকজন এসে জড়ো হয় এখানে। বিভিন্ন জেলা থেকেও লোক আসে।

— বুড়ো মানুষগুলোর কষ্ট হচ্ছে। তবুও আসছে এখানে।

–হ্যাঁ। অসুস্থ রোগীও আসে। ভ্যানে বসিয়ে কিংবা লোক ধরাধরি করে নিয়ে আসে ওদের।

.

পিছনে সমস্বরে জিকিরের ধ্বনী শুনতে পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো নিশাত। সাদা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরনে একটা লোক এগিয়ে আসছে। লোকটার মুখভরা দাঁড়ি আর চুলে জট। রশির মত জট পাকানো চুলটা ঘাড় বেয়ে কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। এই লোকটার পিছনে সাত আটজন লোক এগিয়ে আসছে। ওরা সবাই লোকটার সাথে তাল মিলিয়ে জিকির করে যাচ্ছে। এমন চুল জট হওয়া লোক ঢাকায়ও মাঝেমধ্যে দেখতে পায় নিশাত। একটু অদ্ভুত দেখতে এই লোকগুলো। লোকগুলো কেনো অদ্ভুত তা জানা নেই তার। লোকগুলো ওর পাশ কাটিয়ে যেতেই নিশাত নাহিদকে জিজ্ঞেস করলো,

— আচ্ছা ঐ সাদা কাপড় পরা লোকটা এমন কেনো?

–কেমন?

— অগোছালো।

— উনারা এমনই হয়।

— উনারা মানে? উনি আলাদা কেউ নাকি?

— হ্যাঁ আমি যতদূর জানি উনাদের চিন্তা ভাবনা আমাদের চেয়ে আলাদা। জগত সংসারের প্রতি এদের লোভ লালসা একটু কমই থাকে।

— লালন ধাঁচের কেউ?

— উহুম। লালন না। যার মাজারে উরস হচ্ছে তার ভক্ত।

— সব ভক্তরাই কি এমন হয়?

— নাহ্। কেউ বেশি থাকে, কেউ কম থাকে। উনি অন্যান্যদের তুলনায় বেশি ভক্ত।

গল্প করতে করতে বিশাল মাঠের সামনে এসে পৌঁছালো ওরা দুজন। অসংখ্য মানুষের ভীড় এখানটাতে। কেউ কেনাকাটায় ব্যস্ত। কেউবা খাবারের দোকানগুলোতে খাবার খেতে ব্যস্ত। মাঠের শেষ প্রান্তে একটা মঞ্চে মারফতি গানের আসর বসেছে। একদল লোক সেখানে ভীড় জমিয়েছে গান শোনার জন্য। কয়েকজন লোক গানের তালে অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গিতে নেচে যাচ্ছে। উত্তর দিকে সরু রাস্তা ধরে দরগাহতে প্রবেশ করার পথ। পুরো দরগাহ সাজানো হয়েছে গাদা ফুল আর মরিচা বাতি দিয়ে। অগণিত মানুষের ভীড় সেখানে। দরগাহ্’র আশপাশে যতগুলো গাছ ছিলো সবকয়টাকে সাজানো হয়েছে নীল সবুজ রঙের মরিচা বাতি দিয়ে। বিরিয়ানির গন্ধে মৌ মৌ করছে চারপাশ। আশপাশ পুরো জায়গাটা চোখ বুলিয়ে দেখছে নিশাত। ছোটবেলায় বৈশাখী মেলায় যাওয়া হয়েছিলো তিন চার বার। বড় হওয়ার পর আর কখনো মেলায় আসা হয়নি। আর এ ধরণের মেলায় এই প্রথম আসা হলো তার। ভালো লাগছে এত এত মানুষের আনন্দ দেখতে। মাঠের মধ্যেখানে থাকা নগরদোলা, আশপাশে সারিবদ্ধ হওয়া খেলনা, চুড়ি আর হরেক রকম জিনিসের দোকান, বেলুনওয়ালার হাতে থাকা রঙ বেরঙের বেলুন সবকিছুই যেনো ছোটবেলার স্মৃতিগুলো আবার চাঙ্গা করে দিচ্ছে। মনটা ভীষণ অস্থির লাগছিলো। সাথে থাকা মানুষটা সেই অস্থিরতা কাটাতেই তাকে এখানে নিয়ে এলো। সত্যিই অস্থিরতা কেটে গেছে প্রায়। মনের অনেকটা অংশ জুড়ে এখন শুধু ভালোলাগা বিদ্যমান। আর সেই ভালোলাগা অনুভূতির চেয়েও নিশাতের মনে বেশি যে প্রভাব খাটাচ্ছে, সে হলো নাহিদ। তৃপ্তিভরা চোখে মানুষটার দিকে তাকালো নিশাত। আচমকা নিশাতের হাত ধরে নাহিদ বললো,

— আসো নগরদোলায় উঠবে।

চুপচাপ নাহিদের হাত ধরে নগরদোলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নিশাত। তৃপ্তিভরা নয়নে এখনো তাকিয়ে আছে তারই দিকে। কোনদিকে সে হেঁটে চলছে সে খেয়াল তার নেই। খেয়াল করতে ইচ্ছেও হচ্ছে না। মানুষটার সাথে চোখ বন্ধ করে যেদিক খুশি যাওয়া যায়। এবার যেদিকে খুশি সেদিকে নিয়ে যাক। এতকিছু জেনে লাভ কি? সে তো হাত ধরে আছে। এইই যথেষ্ট।

.

শাশুড়ীকে একের পর এক শাড়ী খুলে দেখাচ্ছে ঈষিতা। পাশেই বসে আছে নিঝুম আর নিম্মি। সবকয়টা শাড়ী খোলা শেষে ফিরোজা রঙের একটা জামদানী আর লাল রঙের তাঁতের শাড়ী বের করলো ঈষিতা। শাড়ী দুটোর উপর হাত বুলিয়ে শালুক বললেন,

— এই শাড়ীগুলা নিশাতের তাই না?

–নাহিদ ভাই বললো তার কোন বান্ধবীর জন্য নিচ্ছে। কিন্তু মনে হচ্ছে এগুলো নিশাতের জন্যই কিনেছে।

— মনে হচ্ছে বলছো কেনো ভাবী? এগুলো নিশাতের জন্যই কেনা।

–হ্যাঁ, ভাইয়া নিশুর জন্য নিয়েছে। ও বারবার শাড়ী কিনবে না বলছে দেখে ভাইয়া ঐ কথা বলেছে।

— এই দুইটা শাড়ী সবচেয়ে বেশি সুন্দর হইছে। দ্যাখ নিঝু, তোরে আবার প্রমান দেই। নাহিদ ওরে পছন্দ করে। এইজন্যই সেরা জিনিসটা ওর জন্য নিলো। তোরে আমি বলি তুই তো বিশ্বাস করোস না।

— বিশ্বাস হয়েছে আম্মা। গতকাল রাতেই বিশ্বাস হয়েছে।

–শোনো বউ, আমি কিন্তু তোমার আব্বা আম্মার সাথে কথা বলবো এইবার।

–হ্যাঁ বলেন। ভাইয়া যেহেতু দেশে আছে কথা তো এখনই বলতে হবে।

–আমার ছেলের সাথে নিশাতের বয়সের পার্থক্যটা একটু বেশি তা তো জানোই। এমনিতে আমার ছেলে কি খারাপ তুমিই বলো? আর তো কোনো সমস্যা আমার ছেলের নাই।

— আম্মা আমি কি আপনাকে এটা নিয়ে কিছু বলেছি?

— না। সেইটা বলো নাই। ভাবতাছি তোমার আব্বা আম্মা যদি এইটারে কোনো সমস্যা ধরে?

–এটা নিয়ে সমস্যা করার কি আছে? আব্বা আম্মার কি বয়সের পার্থক্যে বিয়ে হয়নি?

— তা হইছে। কিন্তু জমানা তো বদলাইছে। আগে তো এগুলা কোনো বিষয় ছিলো না। এখন তো চিন্তা ধারা বদলাইছে সবার। নাহিদরে নিয়া আমার চিন্তা একটু বেশিই হয়, বুঝলা?

— জানি আম্মা। আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন। নিশু যেখানে পছন্দ করবে আব্বা ঐখানেই নিশুকে বিয়ে দিবে। ছেলের বয়স,কি করে সেসব খুঁজতে যাবে না। শুধু দেখবে নিশু ভালো থাকবে কিনা। আর আমার আম্মার সবসময়ই চিন্তা থাকে নিশুকে বিশ্বস্ত কোথাও বিয়ে দেয়ার। এই ঘরের চেয়ে বিশ্বস্ত ঘর আর কোথায় হতে পারে? আমার মা নিজের এক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে তো বুঝেছেই। আরেক মেয়ের জন্য কখনোই দ্বিমত করবে না।

— ভালোয় ভালোয় সব ঠিকঠাকমত হইলেই হয়।

.

নগরদোলায় বসে উপর নিচ পালাক্রমে ঘুরে বেড়াচ্ছে দুজন। উজ্জ্বল চোখে চারপাশ দেখছে নিশাত। ঠোঁটের কোণে আহ্লাদী হাসির রেখা। একদৃষ্টিতে নিশাতের দিকে তাকিয়ে আছে নাহিদ। মুচকি হাসির রেখা তার ঠোঁটের কোণেও। নিশাতকে ডেকে সে জিজ্ঞেস করলো,

— ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে তাই না?

— হুম।

— ছোটবেলার স্মৃতি মনে করানোর জন্যই এখানে নিয়ে এসেছি। মন ভালো করার জন্য ছোটবেলার স্মৃতিগুলো আবার উপভোগ করার মত ভালো টনিক আর হয় না। তোমাকে অসম্ভব অস্থির দেখাচ্ছিলো। কথা বলেও তোমাকে স্বাভাবিক করতে পারছিলাম না। তাই ভাবলাম এখানে নিয়ে আসি।

এখান থেকে নেমে আমরা কি করবো জানো?

— কি?

–আমরা ফুচকা খাবো। হাওয়াই মিঠাই খাবো। তারপর তোমাকে চুড়ি কিনে দিবো। পুতুল বসানো ক্লিপ, হেয়ারব্যান্ড কিনে দিবো। মাটির খেলনা, আর কাপড়ের পুতুলও কিনে দিবো। এরপর কুলফি খেতে খেতে নদীর ঘাট পর্যন্ত যাবো। ঠিক আছে?

–এতকিছু কেনো করেন আপনি আমার জন্য?

–ভালো লাগে তাই।

.

একটা মানুষ কতটা তৃপ্ত হতে পারে সে হিসেব জানা নেই নিশাতের। তবে অধিক তৃপ্ত হওয়ার খুশিতে লোকজন পাগল হতে পারে সেটা সে নিজেকে দিয়েই বুঝতে পারছে। এই মুহূর্তে নিজেকে পাগল পাগল লাগছে নিশাতের। অমূল্য কিছুর সুখের অনুভূতি পাচ্ছে সে। যে অনুভূতি হয়তো কোটি টাকা খরচ করেও কেনা সম্ভব না। সামনে বসে থাকা মানুষটাকে তার প্রয়োজন। আজীবন প্রয়োজন। তাকে দূরে যেতে দেয়া যাবে না। আজীবন পাশে পাশে রাখতে হবে। এই মানুষটা পাশে না থাকলে প্রচন্ড কষ্টের দিনগুলোতে কে আগলে ধরবে তাকে? জাদুকরের মত কষ্টগুলো দূর করবে কে?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *