বাঙালির চোখে সেকালের উত্তর ভারতীয়রা

বাঙালির চোখে সেকালের উত্তর ভারতীয়রা

বাংলাদেশের কথা মনে হলেই আমার স্মরণে আসে জননী জবালার কথা। মনে পড়ে নামগোত্রহীন পুত্রের কাছে অসহায়া জননীর সেই আক্ষেপ—’নাহম এতদ বেদ তাত, যদগোত্রস্ত্বমসি—গোত্র তব নাহি জানি তাত’। ভাষাকল্পে দেশনামের সঙ্গে জননী শব্দটি জুড়ে বৃদ্ধা এক মাতৃকামূর্তি কল্পনা করা আমাদের অভ্যাস। কিন্তু ধরণী যেদিন তরুণী ছিল, সেদিনকার সেই জননী কার পরিচর্যা করে বঙ্গসন্তানকে কোলে ধরেছিল? লুণ্ঠিত-যৌবনা সেই রমণী হয়তো বা জননী জবালার মতোই সন্তানকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল—’গোত্র তব নাহি জানি তাত’।

কিন্তু গোত্র না জানলে কি সন্তানের অনন্ত জিজ্ঞাসা ফুরোয়? তাই ক্ষ্যাপা যেমন করে লোহার কটিবন্ধে পরশমণি লাগিয়ে লাগিয়ে ছুড়ে ফেলে দিত, ঠিক তেমনি করেই মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি বঙ্গদেশের জন্মদাতা পিতাকে। কত শাস্ত্রপুরুষকে জিজ্ঞাসা করেছি—সহজ উত্তরটি মেলে না কিছুতেই। নানাজনের নানা কথা শুনে ভারাক্রান্ত মনের অবসাদ ঘোচানোর জন্য প্রবেশ করলাম ভরতমুনির নাট্যমঞ্চে। নেপথ্যের অবসরে হঠাৎ মনে হল, ভরতমুনি নাটুকে মানুষ; আর দেশ-কালের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ যেমন গভীর, তেমনি পক্ষপাতমুক্ত। ফাঁক বুঝে মুনিকে শুধালাম বাংলাদেশের জন্মকথা জানেন কিছু? ভূয়োদর্শী মুনি চিন্তার সুরে বললেন—তোমাদের মূল কোথায় তা তো জানার প্রয়োজন বোধ করিনি কখনও, তবে নাট্যশাস্ত্রে বিভিন্ন প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কথা অনেকবারই এসেছে। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলার চৌহদ্দিতে যারা থাকে, তাদের কোনো চরিত্রে যদি অভিনয় করতে হয়, তবে তাদের গায়ের রং, মানে মেক-আপ হবে কালো—অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গাস্তু শ্যামাঃ কার্য্যাস্তু বর্ণতঃ। ভরতমুনির আরেক সাকরেদ রাজশেখর, তিনি আবার একটু রসিক মানুষ; গলার স্বরটি হঠাৎই একটু মিহি করে বললেন—পুরুষ-মানুষের কথা থাক, কালো বলেই কি সব খারাপ? গৌড়ী রমণীদের মনোহরণ শ্যাম অঙ্গের লাবণী, আহা ওই অঙ্গ ঘিরেই তো পুষ্পবাণের যত বিলাস; অঙ্গহীন অনঙ্গ, সেও যেন এই অঙ্গ ঘিরে দুলকি চালে ছুটতে থাকে—চক্রীকৃত্য ধনুঃ পৌষ্পম অনঙ্গো বল্গু বল্গতি। তোমাদের সাধারণ মেয়েদেরই এই অবস্থা, সেখানে তোমাদের রাজপুত্রী যারা, তাদের গায়ের রং কিন্তু বেশ ফর্সা নয়তো বা কিঞ্চিৎ হলদেটে, পাণ্ডুবর্ণ।

ভরতমুনি সোজা-সরল মানুষ, কিন্তু রাজশেখরের কথা শুনে মনে ভারী ধন্দ লাগল। সাধারণ মেয়ে-মদ্দার গায়ের রং একরকম, আবার রাজা-রাজড়ার গায়ের রং আরেক রকম—এর মধ্যে নিশ্চয় কোনো রহস্য আছে। ভরতের নাটক দেখা মাথায় উঠল, মীমাংসা করতে চলে গেলাম গুরুগম্ভীর এক আর্য-পুরুষের কাছে, তাঁর নাম আর্যমঞ্জুশ্রী মূলকল্প। মত প্রকাশের ব্যাপারে ইনি বড়ই স্পষ্ট এবং বিনা দ্বিধায় আমাকে জানিয়ে দিলেন—দেখ বাপু, কোনো কুলীন গোছের মুনি-ঋষি কিংবা মহারাজ-চক্রবর্তীর সঙ্গে তোমাদের কুলজী মিলবে না, কেননা তোমাদের ভাষা হল অসুরের ভাষা—অসুরাণাং ভবেদ বাচা গৌড়-পুণ্ড্রোদ্ভবাঃ সদা। ভাষাতাত্ত্বিকের কাছে যেটুকু ‘ক্লু’ পাওয়া গেল, সেটুকুই গিয়ে নিবেদন করলাম এক নৃতাত্ত্বিকের কাছে—তাঁর নাম বৃহদ্ধর্ম পুরাণ। তিনি বললেন—বাংলাদেশের মানুষ দু-রকম—এক বামুন, আর সব সংকর। আমার কথা ঠিক কি না তা কবি-পণ্ডিত কৃষ্ণ মিশ্রকে জিজ্ঞাসা করে দেখ। তিনি তাঁর নাটকে অহংকার বলে একটি রূপক-চরিত্র সৃষ্টি করেছেন, সে তোমাদের জাতভাই, তার বাড়িও বাংলায়—দক্ষিণ রাঢ়ে। এতখানি স্পষ্ট নির্দেশ পেয়ে যখন দক্ষিণ রাঢ়ে গিয়ে পৌঁছেছি, তখন দেখি তিনি বাড়ি নেই। খবর নিয়ে জানা গেল, তিনি গেছেন কাশীতে তাঁর নাতির সঙ্গে দেখা করতে। নাতির ঠিকানা জোগাড় করে হন্তদন্ত হয়ে কাশীতে পৌঁছোতে দেখলাম—বৃদ্ধ অহংকার তখনই আসছেন। বয়স হলে কি হবে, অহংকার কিন্তু ভারী অহংকারী মানুষ; এমনকি তাঁর নাতি, যে তাঁকে কোনোদিন দেখেনি, সেও তাঁকে চিনে ফেলল সহজেই। দুঃখের বিষয়—আমিও তাঁকে চিনে ফেললাম তাঁর হাবেভাবেই, যে হাবভাব বাঙালির একান্ত নিজস্ব। অহংকারের নাতি, দূর থেকে তাঁকে দেখেই বললে—এ নিশ্চয় বাংলাদেশের মানুষ—নইলে, আসছে দেখ—যেন জ্বলতে জ্বলতে ত্রিজগৎ গ্রাস করে ফেলছে অভিমানে, কথা কইছে যেন সবাইকে তিরস্কার করছে আর নিজের বুদ্ধির গর্বে সবাইকে যেন উপহাস করছে। আমি ভাবলাম—ভিন প্রদেশের হাওয়ায়, অন্যকে একটু তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা—এ হয়তো বাঙালির চিরকালের অভ্যেস; তাই বলে কি আর আমার প্রশ্নের জবাব পাব না। সুস্থির হয়ে বসার আগেও অহংকার ভারী চেঁচামেচি করলেন—তিনি কাশীতে এসেছেন না তুরস্কদেশে এসেছেন, বুঝতে পারছেন না, শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণকে কীভাবে আদর করতে হয়, তাও জানে না—ইত্যাদি। সে যাই হোক, কোত্থেকে আসা হচ্ছে—এই প্রশ্নে, বাঙালি অহংকার কিন্তু ভারী সুন্দর জবাব দিলেন, বললেন—গৌড়ের নাম শুনেছ, দুনিয়ার সেরা সেই গৌড়। সেখানে রাঢ় বলে একটি জায়গা আছে—ত্রিভুবনে তার জোড়া মেলে আছে—গৌড়ং রাষ্ট্রমনুত্তমং নিরুপমা তত্রাপি রাঢ়া পুরী। ওইখানেই ভুঁরশুট নগরে আমার বাস। দেশগর্বে যখন অহংকারের মুখ জ্বলজ্বল করছে, তখন সময় বুঝে আমিও প্রশ্ন করলাম—আপনার কুলশীল—মানে, আপনি তো বাঙালি, তাই আপনার বাবা-মা…? প্রশ্ন শুনে, অহংকার একেবারে চাঁচাছোলা জবাব দিলেন, বললেন, হ্যাঁ স্বীকার করি আমার জননী তেমন সৎকুল থেকে আসেননি—নাস্মাকং জননী তথোজ্জ্বলকুলা। আমি কিন্তু সৎ শ্রোত্রিয়বংশের এক মেয়েকে বিয়ে করেছি এবং তাতে করে আমি আমার বাপকে টেক্কা দিয়েছি—তেনাস্মি ততোধিকঃ, কেননা আমার বাবা আর্য-পুরুষ হলেও বিয়ে করেছেন নীচ কুলে। অহংকারের অহংকারী কথা শুনে মনে বিশ্বাস হল, কেননা তরুণী জননীর খবর আর কে রাখে? পুরাণ মুনি বৃহদ্ধর্ম যা বলেছিলেন, সে তাহলে মিথ্যা নয়—বাংলাদেশে ব্রাহ্মণ আর সংকর—এই তাহলে সত্যি।

অনেকগুলো সূত্র জমা হল একসঙ্গে, পথ চলাও এখন অনেক সহজ। তবু বুঝলাম ফরাসি কায়দায় যাকে বলে—’সার্শে লা ফাম’ অর্থাৎ স্ত্রীলোকটিকে খুঁজে বার কর, তেমনি সুপ্রযুক্ত না হলেও আগে খুঁজে বার করা দরকার সেই ভাগ্যহতা রমণীকে, যিনি বঙ্গদেশের জননী। মনে মনে জানতাম, বঙ্গদেশের পুরাকালীন রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক গুরুত্ব নিয়ে মহাকুলীন পুরাণগুলো কিংবা স্বয়ং মহাভারতও তেমন কিছু মাথা ঘামায়নি। বরঞ্চ হরিবংশ, যাকে আমরা মহাভারতের ‘সাপ্লিমেন্ট’ বলি, এ ব্যাপারে প্রায় নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকের মতো পূর্বভারতের পুরাকীর্তি স্মরণে রেখেছে। অগত্যা তাঁরই আশ্রয় নিলাম এবং আমার অনুমানমতো নানান বংশলতিকার ভিড়ে ঠিক খুঁজে পেলাম সেই মাতৃমূর্তি, যিনি ‘দারিদ্র্যদুখে’ না হলেও বহু পরিচর্যা করে বঙ্গসন্তানকে কোলে পেয়েছিলেন। বাংলার চিরন্তনী জননীর নাম সুদেষ্ণা। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কহ গো জননী, মোর পিতার কি নাম, কি বংশে জনম।’ লজ্জায় রাঙা হয়ে (লজ্জার কারণ বুঝেছি পরে) মনের মধ্যে কী যেন চেপে রেখে তিনি বললেন—তোমরা পাঁচ ভাই—অঙ্গ, বঙ্গ, সুহ্ম, পুণ্ড্র আর কলিঙ্গ। মনুষ্যযোনিতে জাত দানবরাজ বলির ছেলে তোমরা—তোমরা ‘বালেয়’। মুখের ভাব দেখে আর কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস হল না। কিন্তু ত্রিকালদর্শী ব্যাস, যিনি হরিবংশের আড়াল থেকে আমাকে ঠিক লক্ষ রাখছিলেন, তিনি বললেন—বৎস, পূর্বভারত নিয়ে মহাভারতের ওপর তোমার যে অনুযোগ, তা আমার অজানা নয়, তবে দেখ, যাহা নাই ভারতে, তাহা নাই ভারতে। বাংলার সন্তান হিসেবে, তোমার যতটুকু দরকার তা কিন্তু মহাভারতের মধ্যেই আমি লুকিয়ে রেখেছি, শোনো তবে—

এক মুনি ছিলেন, তিনি গর্ভাবস্থাতেই শাপগ্রস্ত, তাঁর মায়ের নাম মমতা, পিতা উতথ্য। কোনো কারণে উতথ্য দূর দেশে গেছেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁরই ছোটভাই বৃহস্পতি মমতার সহবাস আকাঙ্ক্ষা করেন। মমতা বাধা দিয়ে বলেন, তাঁর গর্ভে উতথ্যের বেদবেদাঙ্গ-পারদর্শী শিশু তিলে তিলে বড় হচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত বৃহস্পতি বাধা না মানলে গর্ভস্থিত শিশুই পা দিয়ে মাতৃ-ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করে বাধা দেয় বৃহস্পতিকে। মুখে বলে—তাত, এখানে স্থান হবে না দুজনের। তা ছাড়া, মনে রেখ, আমি আগেই এসেছি এই জায়গায়। অসময়ে যুক্তি শুনে বৃহস্পতি শাপ দিলেন, সেই থেকেই তিনি অন্ধ, নামও দীর্ঘতমা। জন্মান্ধ হলে কি হবে, বয়সকালে তাঁরও বিয়ে হল, বউ বড়ই ঝগড়াটে, নামটিও তেমনি—প্রদ্বেষী। তা এই ঝগড়ার কারণেই হোক কিংবা মনস্তাত্ত্বিকদের ফরমুলা মতো হয়তো বা গর্ভাবস্থাতেই অতিরিক্ত ‘শকড’ হওয়ার ফলে তিনি বশিষ্ঠের কামধেনুর কাছে ‘গোধর্ম’ শিখে গেলেন। গোধর্ম মানে প্রকাশ্য-মৈথুন। যত্রতত্র এই অভ্যাসে আশ্রমের ঋষিরা এবং তাঁর আপন স্ত্রী-পুত্রেরাও তাঁকে দিলেন তাড়িয়ে। অন্ধ ঋষিকে তারা ভেলায় করে ভাসিয়ে দিল। যথাযোগ্য স্থানে, যথোচিত শাপ-টাপ দিয়ে ভেলায় করে ভাসতে ভাসতে মুনি এসে পৌঁছোলেন এই পূর্বদেশে, যেখানে এলেই আর্য-ব্রাহ্মণদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। আরও বড় কথা যেখানে সোনার তূণ কাঁধে নিয়ে মানুষের মধ্যে জন্মেছেন অসুররাজ বলি—’জাতো মানুষযোনৌ তু স রাজা কাঞ্চনেষুধিঃ’। নদীতে স্নান করতে করতে অসুররাজ দেখতে পেলেন ভাসমান মুনিকে। তাঁকে স্বাগত করে নিয়ে এলেন আপন গৃহে—নিয়োগ প্রথায় নিজের স্ত্রীর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করতে। মুনিকে অন্ধ দেখে অসুররানীর একেবারে পছন্দ হল না। ধাত্রেয়িকা দাসীকে পাঠিয়ে দিলেন নিজেকে বাঁচাবার জন্য। আচারবান আর্যদের তৈরি-করা এই অসভ্য নিয়োগপ্রথা তাঁর ভাল না লাগলেও উপায় ছিল না। বংশরক্ষার তাড়নায় বলি আবার অনুরোধ করেন সুদেষ্ণাকে। মুনি তখন সুদেষ্ণার অঙ্গ স্পর্শ করে বর দিলেন—অঙ্গ, বঙ্গ, সুহ্ম, পুণ্ড্র এবং কলিঙ্গ নামে তাঁর পাঁচ পুত্র হবে এবং তারা সব আপন নামের দেশে রাজত্ব করবে।

বঙ্গদেশের জন্ম নিয়ে আমরা যে এই ভণিতাটুকু করলাম তার কারণ স্বয়ং দীর্ঘতমার জন্ম এবং তাঁর ঔরসে অসুররানীর গর্ভে বঙ্গ, পুণ্ড্র, সুহ্ম ইত্যাদির জন্ম—আমাদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক ইতিহাসে প্রতিফলিত হয়েছে। অসুররাজ বলি ছিলেন আমাদের রাজা, তাঁর কাঁধের সোনার তূণে ছিল আমাদের উত্তরাধিকার। সেখানে দীর্ঘতমার মতো যাঁরা বেদ আর ব্রাহ্মণ্য নিয়ে ভেসে এসেছিলেন তাঁরা উত্তর ভারতের কৃষ্টিতে দীর্ঘতমার মতোই বিতাড়িত এবং ঘৃণিত। যিনি জন্মলগ্নেই মাতার কুক্ষি থেকেই বাধা দিয়েছিলেন আগন্তুক পুরুষশক্তিকে, তেমনি আমরাও চিরকালই আঘাত হানার চেষ্টা করেছি আর্যপুরুষদের আগ্রাসী বীর্যবত্তায়, বলেছি—আরে! আমরা যে আগে থেকেই এখানে আছি, আবার তোমরা কেন? বাংলাদেশে আর্যদের সুসমাচার পৌঁছানোর আগে মিলনবিধিতে বাধা ছিল না কোনো, বোধ করি দীর্ঘতমারও সে বালাই ছিল না, নইলে প্রকাশ-মৈথুন শিখে তাঁকে বিতাড়িত হতে হত না। এমনকি বাংলাদেশে আসার পরেও অসুরের সংসারে বিষম ধাতুর মিলন ঘটাতে দীর্ঘতমার কোনো বাধা বা দ্বিধা হয়নি।

প্রাতঃস্মরণীয় রমেশ মজুমদার থেকে আরম্ভ করে নীহাররঞ্জন—সবাই এ কাহিনীর সূত্রমাত্র উল্লেখ করেছেন কিন্তু কেউ একবার ঋকবেদের দিকে অঙ্গুলি-সংকেত করে বলেননি যে, এই দীর্ঘতমা প্রায় শ’আড়াই উদার ঋকমন্ত্রের রচয়িতা। কেউ বলেননি যে, এই দীর্ঘতমা সেই পুরাকালেও নিজের সম্বন্ধে কত সচেতন। দেবতার কাছে তিনি প্রার্থনা করেন—অহোরাত্রির বিবর্তনে তিনি যেন বুড়ো না হয়ে যান; মাতৃস্থানীয়া নদী (হয়তো বা যা তাঁকে এই পূর্বদেশে বয়ে নিয়ে এসেছে) যেন তাঁকে গ্রাস না করে। দেবতাকে আবাহন করার জন্য যে মন্ত্র রচনা করা হয়েছে, তার মধ্যেও (ভাবতে অবাক লাগে) উত্তর-ভারতীয় আর্যপুরুষদের ওপর দীর্ঘতমার অসীম বিরক্তি ফুটে উঠেছে। নিজের সম-মানের মানুষগুলির হাতে নিশ্চয় তাঁকে অপমানিত হতে হয়েছিল, সেই জন্যই হয়তো এই ক্রোধোদ্গার—দাসেরা এই সংকুচিতাঙ্গ বৃদ্ধকে নিম্নমুখে (নিশ্চয় নিম্নমুখী নদী-প্রবাহে বাংলাদেশের দিকে) প্রক্ষেপ করেছে। ত্রৈতন (আর্যদের উপাস্য দেবতা, জেন্দ আবেস্তায় থ্রেতন) এই বৃদ্ধের মস্তক ছেদন করেছে, স্বয়ং দাস আঘাত করেছে বুকে আর উরুতে।

উত্তুরে ব্রাহ্মণদের বাঁচানোর জন্য স্বয়ং সায়নাচার্য দাস শব্দটিকে সাধারণ্যে ব্যবহৃত একটি গালাগালি হিসেবে চালাতে চেয়েছেন। মানে, আমরা যেমন শালা বলি, তেমনি দাস মানে ‘গর্ভদাস’। হায় সায়ন, দাস মানে যে আর্যেতর মানুষদের বোঝায় এ তো আপনার ব্যাখ্যাতেই পেয়েছি। আপনার মুশকিল হয়েছে এই কারণে, যে স্বয়ং ব্যাসদেব মহাভারতে লিখেছেন—সমস্ত আচারপরায়ণ আর্যপুরুষেরা একযোগে দীর্ঘতমাকে আশ্রম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন; হুংকার দিয়ে বলেছিলেন, ‘পাপাত্মানং ত্যজামহে’। আশ্রমবাসী মুনিঋষিদের চেহারা ছিল ‘ক্রুদ্ধা মোহাভিভূতাঃ’। কাজেই তাঁদের মধ্যে ত্রৈতন বলে কেউ দীর্ঘতমার মাথাও ফাটিয়ে দিয়েছিলেন হয়তো। স্বয়ং দাস, মানে সেখানকার ব্রাহ্মণ সমাজের পালের গোদা। সে হয়তো দীর্ঘতমার বুকে আর পায়ে মেরেছে লাথি। যদি বলি—ব্রাহ্মণেরা এসেছেন, বশিষ্ঠও এসেছেন; তাহলে এমন বাক্যে বশিষ্ঠের মর্যাদা বাড়ে। কিন্তু যদি বলি, দাসেরা মেরেছে, ত্রৈতনও মেরেছে; তাহলে এমন বাক্যে দাস শব্দের সঙ্গে একযোগে ব্যবহৃত ত্রৈতন শব্দের মর্যাদা দাসেদের থেকে কম না হলেও সমগোত্রীয় তো বটেই। অথচ ত্রৈতন বৈদিকযুগের উপাস্য দেবতা এবং ঠিক সেই কারণেই ত্রৈতনের পাশেই অনার্যত্বসূচক দাস শব্দটি রাখতে সায়নের আপত্তি। তিনি ভাবতেও পারেননি, স্বয়ং আর্যপুরুষ যে গালাগালি আমাদের মতো বাংলাদেশি অনার্যদের দিয়ে থাকেন, সেই বাংলাদেশকে ভালোবেসে তাঁদেরই এককালের একজন স্বয়ং দাস বলে সম্বোধন করবেন তাঁদেরই। উত্তরাখণ্ডের মানুষগুলির ওপর দীর্ঘতমার ক্রোধ শেষ হয় না, ‘পাড়ায় এলে দেখে নেব’—প্রায় এমনি এক ভঙ্গিতে তিনি বলেন—আমিও মমতার ব্যাটা—মামতেয় দীর্ঘতমা, দশকাল গিয়ে আমি বুড়ো হয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু যারা কাজ-কাম করে ফল পেতে চায় আমি এখনও তাদের নেতা এবং সারথি।

বাংলার কৃষ্টি, গৌরব, শিক্ষা, অহংকার সম্বন্ধে যাঁরা সচেতন, তাঁরা গর্বিত বোধ করবেন এই কথা ভেবে যে, আমরা এমনই এক পিতার ঔরসে জন্মেছি যিনি অনন্ত জিজ্ঞাসা নিয়ে দেবতাকে প্রায় ‘চ্যালেঞ্জ’ করে বলেছেন—যে শিশুর হাড়গুলো সব জোড়া দেওয়া ছিল না, সে যখন অস্থিযুক্ত অবস্থায় জন্মাল তখন কে তাকে প্রথম দেখেছে—কো দদর্শ প্রথমং জায়মানম? বুঝলাম, এই মাটি থেকে সে তার জীবনীশক্তি আর রক্ত সংগ্রহ করেছে কিন্তু আত্মা এল কোত্থেকে? সেকালের প্রেক্ষাপটে এমন প্রশ্নকে শুধুমাত্র প্রগতিশীল বলে প্রশংসা করলে কম বলা হয়, কিন্তু প্রশংসাও যে একেবারে মূক হয়ে যাবে, যখন বাঙালির সমস্ত নিন্দাপঙ্কে তিলক টেনে দীর্ঘতমা উচ্চারণ করেন—এই আকাশ আমার পিতা, নাভি আমার বন্ধু আর এই বিপুলা পৃথিবী আমার মা।

অসুররানীর গর্ভে দীর্ঘতমার যে পুত্রেরা জন্মেছিল তারা বোধহয় পিতৃঋণ শোধ করতে পেরেছে। কোনোদিন তারা উত্তর ভারতের ধামাধরা হয়ে থাকতে চায়নি তারা তাদের কাঁচা ঘরে যে কৃষ্টি গড়ে তুলেছিল, সযত্নে তাই লালন করেছে। লোকে বলে সাংখ্যদর্শনের প্রবক্তা কপিল মুনি নাকি এই বাংলাদেশের লোক এবং ঐতিহাসিকেরাও প্রায় তাই স্বীকার করেন। লোকপ্রসিদ্ধি মানলে গঙ্গাসাগর সঙ্গমে কপিলের সুনামটুকুও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমরা বলি—তিনি অবশ্যই বাংলাদেশের মানুষ, না হলে এমন অনার্যসুলভ ট্র্যাডিশনকে প্রশ্রয় দেয়? কি সাংঘাতিক কথা! কপিলের মতে, ঈশ্বর বলে কিছু নেই, কেননা তার প্রমাণ নেই—ঈশ্বরাসিদ্ধিঃ প্রমাণাভাবাৎ। কপিলের মতে, কেউ ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেনি, তাঁকে অনুমানও করা যায় না; এমন কোনো বস্তুও নেই যার সঙ্গে ঈশ্বরের সম্বন্ধ আছে কিংবা যার ভিত্তিতে ঈশ্বরের অনুমান হবে। যদি বলি বেদে আছে, তাহলে কপিলের উত্তর হবে বেদে ঈশ্বরের থেকে প্রকৃতিই শ্রেষ্ঠতরা। কপিল ভাবেন—ঈশ্বর স্বীকার করলেই বা কি লাভ, অস্বীকার করলেই বা কি ক্ষতি? বরঞ্চ তার প্রসঙ্গ ত্যাগ করে ‘আত্যন্তিক দুঃখনিবৃত্তি’র চেষ্টা করলে আত্মজ্ঞানের দ্বারাই মুক্তি হবে।

এই যে কথাবার্তা—তাতে উত্তর ভারতের সমস্ত দার্শনিকেরা বিব্রত বোধ করেছেন, শেষে সাংখ্যমত ভাগ করে কপিলের ঘাড়ে চাপানো হল নিরীশ্বর সাংখ্য। তবে কপিলের একান্ত নিজস্ব শানিত যুক্তিতক্কো যা ছিল তা উত্তর ভারতের অস্তিবাদী দার্শনিকেরা ফেলতেও পারেননি, গিলতেও পারেননি। মহাভারতের আগের যুগে যুক্তিতক্কো দিয়ে সাংখ্যসূত্র লিখব আবার বসে বসে গালাগালিও শুনব এমন মানুষ কপিল নন। অস্তিবাদী উত্তর ভারতীয় পণ্ডিতদের ভ্রুকুটি-কুটিল কটাক্ষের একটুও তোয়াক্কা না করে কপিল বাসা বাঁধলেন বাংলার নির্জন প্রান্তে গঙ্গাসাগর সঙ্গমে। কিন্তু তাঁর রেহাই নেই, তাঁকে কোনোমতেই উপেক্ষা করতে না পেরে স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণ পর্যন্ত অর্জুনের কাছে বিভূতি দেখিয়ে বলেছেন—সিদ্ধ মহাত্মাদের আমি হলাম কপিল মুনি—গন্ধর্বানাং চিত্ররথঃ সিদ্ধানাং কপিলো মুনিঃ, ভাগবতের মধ্যে তিনি ভগবানের অবতার। আর যায় কোথা? শুধু উত্তর কেন, ভগবত্তার গন্ধ পেয়ে সমগ্র ভারত পৌষ সংক্রান্তিতে কপিল মুনির নির্জনবাসের বিলাসটুকু ঘুচিয়ে দেয়, অথচ তিনি নিজেই নিরীশ্বরবাদী।

মুনিঋষির কথা দিয়ে এই প্রবন্ধ আরম্ভ হওয়ায় কেউ যেন মনে না করেন বাঙালির শেষ কথা এখানেই। আসলে বাঙালির প্রশংসা করতে গেলে কেউ নবদ্বীপের নব্যন্যায় দেখাবেন কেউ বা বর্তুল চোখে চৈতন্যদেবের থেকেও গদগদভাবে চৈতন্যদেবের দিকেই তাকাবেন। অথচ ও দুটিকে স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়েও বাঙালির ভাবধারা, অভ্যাস আনন্দ ছড়িয়ে আছে আরও ছোট ছোট অনেক কিছুতেই। স্বীকার করি, সেকালে একটি কালিদাস বা ভবভূতি এদিকে জন্মাবার প্রয়োজন বোধ করেননি, ভরত কিংবা আনন্দবর্ধনের মতো বড় মাপের আলংকারিকও বঙ্গদেশের ধার মাড়াননি; অথচ আত্মতুষ্ট বাঙালি কীরকম রসিয়ে রসিয়ে বলেছে, কাব্যকলার ললিত বুদ্ধি সেও আমাদেরই আছে আবার তর্ক করার কূটবুদ্ধি সেও আমাদেরই আছে—কাব্যে’পি কোমলধিয়ো বয়মেব নান্যে, তর্কে’পি কর্কশধিয়ো বয়মেব নান্যে; তবে বাঙালির এক অসম্ভব দক্ষতা আছে; সামনে একটি ‘মডেল’ পেলে, তাকে রপ্ত করতে বাঙালির সময় লাগে না। যে দেশে বেদ-ব্রাহ্মণের ছিটেফোঁটা চর্চা ছিল না, তাঁরা বেদচর্চা করে এমন বৈদিক হলেন যে উত্তর ভারতের ধ্বজাধারী লক্ষ্মণ সেনের মহামন্ত্রী হলায়ুধ মিশ্র নিজেই যেন একটু ঈর্ষা বোধ করেছেন। সবাই বেদ পড়ছে—এ তাঁর সহ্য হয়নি, ফলে বাঙালির বেদ-পড়ার ওপর যেমন তাঁর রাগ, তেমনি রাগ গিয়ে পড়েছে বেদের ওপরেও। তাঁর আক্ষেপ—বেদের কথা কার ঘরে না পৌঁছেছে, কুতূহলবশে বেশ্যানারীর মতো শ্রুতিদেবী কার না কণ্ঠলগ্ন হয়েছে—কণ্ঠে কেন ধৃতা ক্ষণং ন কুতুকাদ বেশ্যাঙ্গনেব শ্রুতিঃ।

এই ‘কুতুক’, মানে কুতূহলই বাঙালি কীর্তির রহস্য। এর সঙ্গে ‘জেদ’ কথাটিও আমরা জুড়ে দিতে চাই কেননা নৈষধচরিতের কবি শ্রীহর্ষ (আমি মনে করি তিনি অবশ্য বাঙালি) ‘খণ্ডন-খণ্ড-খাদ্য বলে’ একটি কট্টর দর্শনের গ্রন্থ লিখেছিলেন। অবাঙালি দ্বিতীয় বাচস্পতি মিশ্র তাঁর ‘খণ্ডনোদ্ধার’ গ্রন্থে এই শ্রীহর্ষের প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেছেন—তিনি নাকি ‘উত্তান-গৌড়’—মানে একগুঁয়ে সেই গৌড়বাসী। এই একগুঁয়েমি আর কুতূহলের বশেই কিন্তু গৌড়বাসীদের যত সুনাম। যেমন সেই অষ্টম শতাব্দীর প্রথমার্ধে কাশ্মীরের রাজা হয়েছিলেন জয়াপীড়। পিতামহ ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের আদর্শে শাসন চালাতে গিয়ে বেরিয়েছিলেন রাজ্য-জয় করতে। এদিকে তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁর রাজ্য কেড়ে নিলেন তাঁর নিজের শালা জজ্জ। বিশ্বাসী অনুচরদের সঙ্গে নিয়ে জয়াপীড় প্রথমে এলেন প্রয়াগে। তারপর সবাইকে ছেড়ে ভাগ্যান্বেষণের তাগিদে এসে পৌঁছোলেন এই শ্যাম বঙ্গদেশে। অঞ্চলটা মোটামুটি রাজশাহী-দিনাজপুর জুড়ে বাংলাদেশের উত্তর দিকটা, যার নাম তখন ছিল পুণ্ড্রবর্ধন। দেশ দেখে তাঁর ভারী ভালো লাগল; যেমন তার ধনসম্পদ, তেমনি সেখানকার মানুষগুলির ব্যবহার আর তেমনি তাদের রাজা জয়ন্ত। পড়ন্তবেলায় বাংলাদেশের প্রথম সন্ধ্যার মায়া যখন জয়াপীড়ের মনে প্রায় রং ধরিয়েছে, ঠিক তখুনি কার্ত্তিকেয়-মন্দির থেকে গানের সঙ্গে ভেসে এল নূপুরের ধ্বনি। একে কাশ্মীরের মানুষ তাতে নাচ-গানের মেহফিল, জয়াপীড় একটুও দেরি করলেন না মন্দিরে প্রবেশ করতে। কিন্তু এ কি! দেবনর্তকী কমলার নৃত্যভঙ্গি, তার হাবভাব—সব যে মিলে যাচ্ছে ভরতের নাট্যশাস্ত্রের সঙ্গে। উত্তরাশার কৃষ্টির সঙ্গে পূর্বাশার এমন অদ্ভুত মিল দেখে জয়াপীড় বসে পড়লেন কার্ত্তিকেয় মন্দিরের দরজার পাশে।

আসল কথা ভারতের অন্যান্য প্রদেশগুলোতে তখন ভরতের নাট্যশাস্ত্র অবলম্বনে নাচ-গান-অভিনয়ের নানান ঘরানা তৈরি হচ্ছিল, যেমনটি কাশ্মীরেও। কিন্তু কাশ্মীর যেমন তা রপ্ত করেছিল, বাংলাও সহজেই তা রপ্ত করে নিয়েছিল শুধু জেদে আর কুতূহলে—না হলে কাশ্মীর-রাজপুত্রের মন ভরত না। বাংলাদেশ নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে নিজস্ব অবদান রাখতে শুরু করেছিল সেই দশম-একাদশ শতাব্দী থেকেই, যখন সাগর নন্দীর ‘নাটকলক্ষণরত্নকোশ’ লেখা হয়ে গিয়েছিল।

ভরতের নাট্যচর্চায় বাংলাদেশের আদর দেখাতে গিয়ে আসল কথাই বলতে ভুলে গিয়েছি। কার্ত্তিকেয় মন্দিরের দরজার পাশে জয়াপীড় তো সুখাসনে বসলেন। রাজপুত্র বটে, রাজোচিত হাব-ভাব লুকিয়ে রাখবেন কী করে। নাচের তারিফ করতে করতে কেবলই তিনি পেছন দিকে হাত বাড়ান। ওদিকে দেবনর্তকী কমলা—পরদেশী মুসাফিরের সঙ্গে নজর মিলিয়ে তারও বুঝি বা তালভঙ্গ হল। বিদগ্ধা রমণী ঠিক বুঝল—বড় ঘরের ছেলে বটে। নৃত্যের অবসরে কমলা এক সখীকে পাঠিয়ে দিল ঠিক জয়াপীড়ের পিছনে। তারপর ঠিক যখন নাচের তাল সমে এসে পড়েছে, অমনি জয়াপীড় পিছন দিকে হাত বাড়াতেই, সখী হাতে গুঁজে দিল একটি মিষ্টি পানের খিলি। তারপর অনায়াসের মোহ ভাঙতেই জয়াপীড়ের মনে হল—আরে! এ তো কাশ্মীর নয়, অমনি অপাঙ্গের ভঙ্গিতে, মধুর বচনের আতিথ্যে জয়াপীড় একেবারে এসে পৌঁছালেন দেবনর্তকী কমলার ঘরে। কাশ্মীরের রাজপুত্র ধরা পড়লেন বাংলার এক শ্যামা মেয়ের বাহুবন্ধনে।

অনামা এক কবি, ভাবে বুঝি তিনিও বিদেশি, তিনি বলেছেন—বেশঃ কেষাং ন হরতি মনো বঙ্গবারাঙ্গনানাম—বাংলার বারবনিতার মনোহরণ বেশ কার না মন হরণ করে? এমনকী স্বয়ং ধোয়ী, যিনি জয়দেবের উপাধিতে ‘কবিক্ষ্মাপতিঃ’, তিনি পর্যন্ত পবনদূত রচনার অবসরে লুকিয়ে লুকিয়ে নজর দিতেন লক্ষ্মণ সেনের পাশে দাঁড়ানো বাররামাদের দিকে এবং এদের দেখে কবির নাকি লক্ষ্মী-ভ্রম হত—লক্ষ্মীশঙ্কাং প্রকৃতিসুভগাঃ কুর্বতে বাররামাঃ। সে যা হোক বঙ্গবারাঙ্গনাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে আমার উৎসাহ নেই তত। কাশ্মীর-বঙ্গের হৃদয়বন্ধনের সেই মিশ্র সুর স্বয়ং কলহন তাঁর রাজতরঙ্গিনীতে লিখে রেখেছেন এবং তাঁর কথামতো সব জানাজানি হতেই পুণ্ড্রবর্ধনের রাজা জয়ন্ত ভারী আদর করে নিয়ে গেলেন জয়াপীড়কে। তারপর রাজলক্ষ্মীর মতো জয়ন্তের মেয়ে কল্যাণদেবীকে বিয়ে করে বিনা যুদ্ধেই জিতে নিলেন পঞ্চ গৌড় রাজ্য।

কামসূত্রকার বাৎস্যায়ন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশীয় রমণীদের যে বিচিত্র রতিক্ষমতার বর্ণনা দিয়েছেন তা ভাবতেও ভয়-ভয় করে। বাঙালির ভাগ্যে বঙ্গরমণীর বর্ণনায় বাৎস্যায়ন যে ভারী সংযত তার কারণ কিন্তু এই নয় যে, তিনি বাঙালি মেয়েদের ব্যাপারে পক্ষপাতদুষ্ট। বরঞ্চ তিনটি মোক্ষম বিশেষণের বিভূষণে যে মৃদুভাষিণী, অনুরাগবতী এবং কোমলতনু বাঙালি মেয়ের চেহারা আমরা কামসূত্রে পাই—তাই বাঙালি মেয়েদের যথার্থ রূপ। বাংলার কবি ধোয়ীর কল্পদৃষ্টিতে বাংলার বারাঙ্গনাই কত মঙ্গলময়ী—প্রকৃতিসুভগা, সেখানে বাংলার মেয়ে কল্যাণদেবীর মধ্যে যে কলহন কাশ্মীর-রাজলক্ষ্মীর সম্ভাবনা দেখবেন তাতে আর আশ্চর্য কি? রাজ্য-হারানো জয়াপীড় বাংলার স্নিগ্ধ প্রকৃতির মতো সেই মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন কাশ্মীরের পথে। রাজ্য পুনরুদ্ধার করে জয়াপীড় যখন সিংহাসনে বসলেন, বাংলার মেয়ে তখন তাঁর হৃদয় এমনই জুড়ে বসেছে যে তিনি তাঁকে বরণ করলেন মহাপ্রতিহারীর পদে। কাজেই আজকের যেসব সানন্দা বঙ্গনারীরা স্বামীর সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে রোজগার করেন, তাঁরা অষ্টম শতাব্দীর এই বঙ্গরমণীর উদাহরণে উৎসাহিত বোধ করবেন বইকি! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জয়াপীড় বাংলাদেশের প্রথম সন্ধ্যার মতো সেই কমলাকেও ভোলেননি; কল্যাণদেবীর নামে যেমন কাশ্মীরে কল্যাণপুর গ্রাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তেমনি দেবনর্তকীর ঋণও তিনি শোধ করেছিলেন তাঁর নামে বসতি প্রতিষ্ঠা করে—তার নাম কমলাপুর।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *