বাঙালির চোখে, উত্তর ভারতীয়ের চোখ
মোগল সম্রাট হুমায়ুনের নবনিযুক্ত বাংলার গভর্নর জাহিদ বেগ বাংলায় পা দিয়েই বলে ফেললেন—আমাকে মারবার জন্য খোদাবন্দ কি বাংলার থেকে ভালো জায়গা খুঁজে পেলেন না? মনের এই ভাবকে যদি অভিমান বলি, তাহলে শাজাহানের আদরের দুলাল সুজা যখন বাংলায় এসে সপরিবারে শরীর খারাপ করে নিলেন তখন কি বলব? ভাবে বুঝি একটা রহস্য আছে। সত্যসন্ধানী এক সাহেব এসব রহস্য উদ্ধার করার চেষ্টা করে বলেছেন—মোগল সাম্রাজ্যের মহামান্য আমীর পুরুষেরা বাংলায় এসে চটজলদি প্রচুর টাকাপয়সা কামিয়ে নিতেন, আর সেগুলো খরচ করতেন গিয়ে দিল্লি কিংবা আগ্রার রাজমহলে, মেহফিলখানায়। সাহেব তাঁর জাতভাইদের কথা চেপে গেছেন, কেননা তাঁদের কাজকারবার ছিল একেবারে লোকচক্ষুর অন্তরালে, সাগর পেরিয়ে। যদি বলি প্রামাণ্য কথা বলেন সেই মানুষ, যার কোনো দেশের ওপরই মায়া নেই, তাহলে সাক্ষী মানতে হয় ইবন বতুতাকে। সাত ঘাটের জল খাওয়া শতপথের পথিক ইবন বতুতাও কিন্তু ভারী চালাক মানুষ; যাযাবর হলে কি হবে, আসল সমস্যাটি সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে গিয়ে তিনি বললেন—বাংলা! খোরাসানের লোকেরা বলে, সে নাকি দুজখ—নরক; তবে হ্যাঁ সে নরক নাকি ভালো জিনিসে ভরা—’দুজখ অস্ত পুরই নিয়ামত।’
হায় বাঙালি! সবাই বাংলায় এসেছে, সেই প্রাচীন আর্য পুরুষ থেকে ইংরেজ—’কেহ বা দেখে মুখ কেহ বা দেহ’, সবাই পরখ করে, অন্তরের ভালোবাসা—সে কেউ বাসে না। বিদেশিদের দোষ দিই না, এমনকি মাঝে মাঝে আকবর বাদশাহের মতো ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। তিনি নাকি বাংলার সুবেদারকে বলেছিলেন, দিল্লির রাজমহলে যত ঢাকাই মসলিন আর মালদহের রেশমি কাপড় লাগবে তার জোগান দিতে হবে বাংলাদেশ থেকে কিন্তু তার বদলে বাংলার সুবেদার রাজস্ব ছাড় পেয়েছিলেন এবং তাঁর দেয় ছিল বাৎসরিক মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকা। কিন্তু উত্তরভারতীয় হিন্দু রাজাদের দিকে তাকালে মুসলমান-ইংরেজদের ওপর রাগ কেটে যাবে। বাংলার সম্পদ তাঁরা যা আত্মসাৎ করেছেন তেমনটি কেউ করেননি; যখন যা দরকার তাই তুলে নিয়ে গেছেন বাংলা থেকে। বিশ্বাস না হয় রামায়ণ খুলে দেখুন, রামচন্দ্রের বনবাস কামনায় ভুঁয়ে পড়ে আছেন কৈকেয়ী আর পক্বকেশ বৃদ্ধ দশরথ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন, হ্যাঁগো কি তোমার পছন্দ, একবার মুখ ফুটে বল। যতদূর সূর্যের আলো তত দূর আমার সাম্রাজ্য। এদিকে যেমন আছে দ্রাবিড়, সিন্ধু, সৌরাষ্ট্র তেমনি ওদিকে আছে বঙ্গ, অঙ্গ মগধ। তুমি যা চাও তাই পাবে কেননা বঙ্গ ইত্যাদি দেশে পাওয়া যায় হাজারো রকমের জিনিস—তত্র জাতং বহুদ্রব্যম। একে বৃদ্ধের তরুণী ভার্যা, তাতে মানিনী, তাঁর মান ভাঙানোর জন্যে যেসব দেশে গেলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়, সেসব দেশেও যেতে হবে বইকি! এ ছাড়া এক—একটা করে দিগবিজয় হত আর প্রত্যন্ত রাজ্যগুলির নাভিশ্বাস উঠত। সে কি শুধুই জয়লিপ্সা, না লোভনীয় যা কিছু আমাদের ছিল তাই চালান করার নিয়ম ছিল উত্তরভারতের গর্ভে। স্মরণ করা যেতে পারে রাজসূয় যজ্ঞের আগে পাণ্ডব দিগবিজয়ের কথা। পুণ্ড্রবর্ধনের রাজা বাসুদেবকে পরাস্ত করে মধ্যম পাণ্ডব ভীম নাকি বঙ্গরাজের দিকে ধাবিত হলেন। উত্তরবঙ্গ, পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, রাঢ়ভূমি এবং তাম্রলিপ্ত থেকে তিনি নিয়ে গেলেন বিবিধ ধনরত্ন—চন্দনাগুরুবস্ত্রাণি মণি মৌক্তিক কম্বলম। কাঞ্চনং রজতঞ্চৈব বিদ্রুমঞ্চ মহাধনম।। মজার কথা, এই তালিকাতেও কিন্তু বাংলার বস্ত্রশিল্পের প্রসঙ্গ অনিবার্য—নিশ্চয় মালদহ-মুর্শিদাবাদের সিল্ক নয়তো ঢাকাই মসলিন যেগুলো ভীম নিয়ে গেছিলেন স্ত্রী আর ভাইদের জন্যে।
বাংলার সম্পদ উত্তরভারতীয়রা কী নিয়ে গেছেন কিংবা না নিয়ে গেছেন—তাই নিয়ে আর তর্ক করার মানে নেই, কেননা সে ঘটনা প্রায় স্বতঃসিদ্ধা; এমনকি একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না, যদি বলি—স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের রাজধানী দ্বারকার অর্ধেক সাজসজ্জাই পূর্বভারতের দৌলতে, এমনকি তাঁর ষোলো হাজার মহিষীর সবগুলিই প্রায় আমাদের পাড়ার। সেকালে অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ, পুণ্ড্রবর্ধন, সুহ্ম, মগধ এবং কামরূপ—এই সবগুলি রাজ্য নিয়ে এক বিরাট পূর্বভারতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল। এদের একটির সঙ্গে আরেকটির যেমন ঐতিহ্যগত মিল ছিল তেমনি মিল ছিল সামাজিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক ভাবনায়। পুণ্ড্রবর্ধনের রাজা পৌণ্ড্রক বাসুদেবের রাজ্যসীমা ছিল উত্তরবঙ্গের প্রান্তে করতোয়া পর্যন্ত। ঠিক তার পাশেই কামরূপে রাজত্ব করতেন তাঁরই অভিন্নহৃদয় বন্ধু নরকাসুর (নরক রাজার অসুর উপাধিটি উত্তরভারতীয়দের কল্যাণে) আসামে আসবার পর কৃষ্ণের প্রথম কাজ যদি হয়ে থাকে নরকাসুরকে বধ করা, তাহলে তাঁর দ্বিতীয় কাজই ছিল নরকাসুরের সংগৃহীত সমস্ত বহুমূল্য সামগ্রী দ্বারকায় নিয়ে যাওয়া। পরাজিত রাজার সমস্ত ধন-সম্পদ বিজেতা রাজ্য লুণ্ঠন করেন, এই নিয়ম। কিন্তু লুণ্ঠনের এত সামগ্রী, এত বৈচিত্র্যের কথা বোধ হয় আর কোথাও নেই, যতখানি পাওয়া যায় আমাদের এই প্রতিবেশীর রাজ্য লুণ্ঠনে। হরিবংশের জবানীতে দেখি, নরকাসুরের কোষরক্ষকেরা সব কিছু, এমনকি অন্তঃপুরের রমণীদের পর্যন্ত হতশ্রী করে সমস্ত রত্ন কৃষ্ণের সামনে বিছিয়ে দিয়ে বলেছিল—যা আপনার অভিরুচি, তাবতীঃ প্রাপয়িষ্যামো বৃষ্ণ্যন্ধক নিবেশনে—সব পাঠিয়ে দেব দ্বারকায়। প্রথমদিকে শ্রীকৃষ্ণ, অনেক জিনিসই যেন ‘ডুপ্লিকেট’ হয়ে যাচ্ছে, এমন একটি ভাব দেখিয়ে রত্নগুলি পরীক্ষা করতে লাগলেন—পরিগৃহ্য পরীক্ষা চ। পরিশেষে সর্বম আহরয়ামাস দানবৈ দ্বারকাং পুরীম। দ্বারকাপুরী তখন কেবল তৈরি হয়েছে, কাজেই নরকাসুরের ধনরত্নে আপন রাজধানীর অন্তঃসজ্জার পরিকল্পনাটি মনে মনে ছকে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ ঢুকলেন মণিপর্বতে। এই পর্বতেই নাকি নরকাসুর লুকিয়ে রেখেছিলেন ষোলো হাজার রমণী-মণি, যাদের তিনি ধরে এনেছিলেন দেবতা আর গন্ধর্বদের কাছ থেকে (উত্তরভারত থেকে নয়তো?) কৃষ্ণ তাঁদের বিয়ে করার জন্য সম্পূর্ণ পর্বতটি ধরে উঠিয়ে নিলেন গরুড়বাহনে। কৃষ্ণের সঙ্গে পরে বিয়ে হবে বলে হরিবংশকার এই রমণীদের—দেবগন্ধর্ব কন্যা, ব্রত-উপবাসে তন্বঙ্গী তথা কুমারী করে রেখেছেন এবং প্রতিবেশী রাজার চরিত্র রক্ষার্থে আমরাও তাই বিশ্বাস করতে ভালোবাসি। কিন্তু আসল কথা হল, আমাদের মেয়ে থেকে আরম্ভ করে ধনসম্পদ—সবই দিয়েছি উত্তরভারতের গ্রাসে। এমনকি কৃষ্ণের মতো অসুর-হন্তা (শ্বশুরহন্তা?) জামাইকে কত আদরে রেখেছি—তা বুঝবেন—এই সেদিনও ওপার বাংলার পাবনা-নিবাসী রাজর্ষি বনমালী রায় নিজের মেয়ের সঙ্গে কৃষ্ণের বিয়ে দিয়ে তার ঘর করে দিয়েছেন বৃন্দাবনে। মন্দিরের নাম দিয়েছেন জামাই-বিনোদ।
এত সব দিয়েও কিন্তু জামাই-বিনোদদের প্রশংসা-মূক মুখ থেকে এতটুকু ভালো কথা বেরোয়নি পূর্বভারতীয় মানুষগুলির জন্য। এর কারণ কী? সবচেয়ে বড় কারণ অবশ্য রাজনৈতিক, যে রাজনৈতিক কারণে কৃষ্ণ নিজে পশ্চিমভারতের অধিবাসী হলেও তাঁকে উত্তরভারতীয়দের মধ্যে গণনা করতে আমার ক্ষুদ্র ভৌগোলিক বুদ্ধিতে বাধে না। ব্যাপারটা একটু খুলেই বলি। মহাভারতের কবি ব্যাসদেবের জন্ম যদিও যমুনার মধ্যে কোনো দ্বীপে এবং তাঁর গায়ের রঙ যদিও বেজায় কালো, তবুও উত্তর-ভারতীয় আর্য রাজনীতির সঙ্গে তিনি বেশ ভালোই জড়িয়ে গিয়েছিলেন। তার প্রধান কারণ হয়তো তখনকার রাজনীতিতে হস্তিনাপুরের প্রাধান্য আস্তে আস্তে প্রকট হয়ে উঠেছিল এবং তাও তাঁর আপন ঔরসজাত পুত্র ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডুর মাধ্যমে। রাজসূয় যজ্ঞের আগে প্রধানত তাঁর নির্দেশে পঞ্চপাণ্ডবের চারজন চারদিকে দিগবিজয়ে যাত্রা করেন। কিন্তু পূর্বে যাবেন কে, কিংবা উত্তরে যাবেন কে এই সিলেকশনের মধ্যেই ব্যাসদেবের রাজনৈতিক বুদ্ধির পরিচয় তবে মহাভারতকার যত সহজে পুণ্ড্র-বঙ্গ তাম্রলিপ্তে ভীমের দিগবিজয় করিয়ে দিয়েছেন, ব্যাপারটা তত সহজে হয়নি। আমাদের কোনো জিনিসই আমরা খুব সহজে ছেড়ে দিইনি এবং রাজনীতি জিনিসটা যেহেতু বাংলার মানুষ চিরকালই ভালো বোঝে, তাই আমরা সমস্ত সমস্যার মোকাবিলা করেছি রাজনৈতিক ভাবেই—যদিও সে রাজনীতি চিরকালই উত্তর ভারতের বিরোধী রাজনীতি, তাতে আখেরে লাভ হয় না কিছু, সমস্যা বরং বাড়ে। তবুও সেইখানেই আমাদের অহংকার, সেইখানেই আমাদের নিজস্বতা।
মহাভারতের আমলে বাংলাদেশ তো অখণ্ড ছিল না—বঙ্গ, সুহ্ম, তাম্রলিপ্ত, অঙ্গ (যার খানিকটা আজও রাঢ়ভূমিতে সংলগ্ন), হরিকেল, পুণ্ড্রবর্ধন—এই সব দেশ নিয়েই বাংলা। এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিধর রাজা ছিলেন পুণ্ড্রবর্ধনের পৌণ্ড্রক বাসুদেব, যিনি কৃষ্ণের সমান ক্ষমতাশালী বলে নিজেকে মনে করতেন। তাঁর উপাধিও ছিল বাসুদেব। রাজসূয় যজ্ঞের আগে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে লম্বা-চওড়া একটি বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতায় পূর্বভারতীয় কতগুলি রাজার নাম করে, তাঁদের অসামান্য ব্যক্তিত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যুধিষ্ঠিরের মনে এক অদ্ভুত ভয়ের সৃষ্টি করেন স্বয়ং কৃষ্ণ। এই রাজাদের মধ্যে অন্যতম হলেন পৌণ্ড্রক বাসুদেব, যিনি ‘বঙ্গ-পুণ্ড্র-কিরাতেষু রাজা বলসমন্বিতঃ’ (কিরাতেরা এখন দার্জিলিং আর কাঠমাণ্ডুর মাঝামাঝি পাহাড়ী এলাকায় বাস করে নেপালীরা ওদের বলে ‘কিরান্তী’)। জরাসন্ধের জামাই কংস যখন কৃষ্ণের হাতে মারা যান তখন জরাসন্ধের বাহিনী মথুরা আক্রমণ করলে বঙ্গ-পুণ্ড্রবর্ধনের রাজারা বন্ধুত্বের খাতিরে জরাসন্ধের অ্যালায়েড আর্মিতে যোগদান করেছিলেন। অনেক বিশেষণহীন রাজার মধ্যে হরিবংশ পৌণ্ড্র বাসুদেবকে বড় সম্মান দিয়ে উল্লেখ করেছেন—পৌণ্ড্রকো বলিনাং বরঃ—বলবানদের মধ্যে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ। মনে রাখা দরকার তখনকার দিনের হস্তিনাপুর এখনকার দিল্লির মতো; কিন্তু তখনকার মগধ এখনকার মগধের মতো হস্তিনাপুরের ধামাধরা ছিল না। বরঞ্চ আর্য সমাজের প্রধান প্রতিভূ কুরুবীর দুর্যোধনও জরাসন্ধের সম্মিলিত বাহিনীতে যোগ দিয়ে সম্মানিত বোধ করেছিলেন। হরিবংশের লিস্টিতে হাজারো রাজনামের গড্ডালিকাপ্রবাহে ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রদের ক্ষীণধারাটি যেমন করে মিশেছে, তাতে স্পষ্ট বুঝি, দুর্যোধনের আহামরি কোনো মর্যাদা ছিল না এবং পাণ্ডবদের কোনো নামই তখন শোনা যায় না। জরাসন্ধের পৌনঃপুনিক আক্রমণে মথুরাপুরী যখন বিধ্বস্ত হয়ে গেছে এবং কৃষ্ণ যখন দ্বারকার আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছেন ঠিক তখুনি জরাসন্ধ নিজেদের সংহতিটুকু ঝালিয়ে নেবার জন্য একটি বিবাহপর্বের উদ্যোগ করেন। পূর্বভারতীয় সংহতিরক্ষার এই চেষ্টাকে হরিবংশ বলেছে—নৃপান উদযোজয়ামাস। শিশুপালের সঙ্গে বিদর্ভরাজ, ভীষ্মকের মেয়ে রুক্মিণীর বিয়ে ঠিক করে তিনি নিজেই বরকর্তার মতো সবাইকে সংবাদ পাঠালেন। জরাসন্ধ যখন বর নিয়ে বিদর্ভের বিবাহ-বাসরে পৌঁছেছেন তখনও বোধহয় তাঁর সংশয় ছিল—কাজটা ঠিক হল তো? ঠিক এই সময়ে জরাসন্ধের দোলাচল মনের স্থিরতা নিয়ে আসলেন সেই বাঙালি রাজা পৌণ্ড্র বাসুদেব। হরিবংশ চলছে—অনুজ্ঞাতশ্চ পৌণ্ড্রেণ বাসুদেবেনধীমতা—পুণ্ড্রবর্ধনের রাজা বুদ্ধিমান বাসুদেব জরাসন্ধের এই কাজ সম্পূর্ণ সমর্থন করলেন। সমর্থনের ব্যাপারে অন্য কোনো রাজার নাম যেহেতু এখানে আসেনি তাতে বুঝি বাংলার এই রাজা কত শক্তিশালী ছিলেন এবং একমাত্র তাঁরই অনুমোদন কত জরুরি ছিল জরাসন্ধের পক্ষে। হরিবংশ অবশ্য মহাভারতের মত না মেনে, বলেছেন তখনকার বঙ্গ ছিল জরাসন্ধেরই অধিকারে—অঙ্গবঙ্গকলিঙ্গানাম ঈশ্বরঃ স মহাবলঃ। তখনকার বঙ্গ মানে কিন্তু অখণ্ড বাংলার নদ-নদীসংকুল নীচের দিকটা উত্তর-পূর্বে যার সীমা প্রায় ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত। অবশ্য বঙ্গের রাজা জরাসন্ধই হোন আর পৌণ্ড্রক বাসুদেবই হোন, সমগ্র উত্তর তথা পশ্চিম ভারত এঁদের দুজনকেই যমের মতো ভয় পেত। যাই হোক রুক্মিণীর সঙ্গে শিশুপালের বিয়ে হল না। কৃষ্ণ হয়তো ভেবেছিলেন রুক্মিণীকে বিয়ে করে তাঁর বিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে বিবাদ খানিকটা মিটিয়ে নেবেন, কারণ রুক্মিণীর বাবা ভীষ্মক এবং ভাই রুক্মী—এঁরা দুজনেই ছিলেন জরাসন্ধের গোষ্ঠীভুক্ত। কিন্তু অতর্কিত রুক্মিণী-হরণে বিরোধ আরও বেড়েই গেল। জরাসন্ধ এবং পৌণ্ড্রক বাসুদেব আবার যুদ্ধে জড়িয়ে গেলেন কৃষ্ণের বিরুদ্ধে।
পুরাণকারদের মতে এই যুদ্ধে কৃষ্ণ জয়লাভ করেছিলেন। কিন্তু পুরাণকর্তারা এই যুদ্ধজয়ের যত কৃতিত্ব কৃষ্ণ-বলরামের ওপর চাপালেও স্বয়ং কৃষ্ণ নিজেও বোধ হয় সন্দিহান ছিলেন তাঁর আপন কৃতিত্বে। তিনি বুঝেছিলেন তাঁর ‘স্ট্র্যাটিজি’ ফলবতী হয়নি। রুক্মিণীবিবাহের পর থেকেই কৃষ্ণ তাই কুরু-পাণ্ডবদের ঘরোয়া ব্যাপারে অংশ নিতে থাকেন এবং পাণ্ডবদের প্রকাশ্য মদত দিতে থাকেন। ঠিক এই কারণেই পশ্চিমভারতের মানুষ হলেও কৃষ্ণকে উত্তরভারতীয় রাজনীতির সূত্রধার হিসেবে কল্পনা করে নিতে আমাদের বাধে না। মহাভারত কিংবা পুরাণগুলি যতই বলুন না কেন যে, ধর্ম যেখানে কৃষ্ণও সেখানে এবং ধর্মের কারণেই কৃষ্ণের উত্তরভারতীয় রাজনীতিতে আগমন, কিন্তু আমরা অন্তরে জানি, কৃষ্ণ যদি আদৌ ঐতিহাসিক ব্যক্তি হন, তবে তিনি পাণ্ডবদের মদত দিয়েছেন একমাত্র রাজনৈতিক কারণে এবং তা বাংলার পৌণ্ড্রক বাসুদেবের মতো ব্যক্তিত্ব এবং বিহারে জরাসন্ধের মতো সাংঘাতিক মানুষকে ঠেকিয়ে রাখবার জন্যে। রাজসূয়ের আগে কৃষ্ণ যে বক্তৃতা দেন, সেখানে তাই কর্ম, যোগ, জ্ঞান—এসব কিছুই নেই; যা আছে তা শুধু শতেক রাজার এক লিস্টি, তারা প্রত্যেকেই জরাসন্ধের ‘অ্যালাই’ এবং তারা নাকি দড়ি-বাঁধা ষাঁড়ের মতো জরাসন্ধের আজ্ঞা বহন করেন। এমনকী গীতা, যাতে দার্শনিক তত্ত্বের শেষ নেই কোথাও, সেখানেও একেবারে অন্তিম শ্লোকে—যেখানে ধর্ম, সেখানে কৃষ্ণ—এমন কথা আসেনি, বরঞ্চ বেশ ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে জানিয়েছে—জয় সেখানে হবেই, যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণঃ যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ। কাজেই বুদ্ধিযোগের ঈশ্বরের সঙ্গে পার্থের মতো ধনুর্ধরের যোগাযোগ শুধুই ধর্মের জন্যে এ কথা বিশ্বাস করতে মন চায় না।
মূল কথায় ফিরে আসি আবার। আঠারো বার যাকে জরাসন্ধের গদাঘাত সহ্য করতে হয়েছিল এবং অন্তত তিন-চারবার যাকে বাংলা-বিহার-আসাম-উড়িষ্যার সম্মিলিত বাহিনীর চাপের কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছে, সেই কৃষ্ণের পক্ষে বোঝা অসম্ভব ছিল না যে, সৈন্য-সামন্ত দিয়ে এঁদের সঙ্গে এঁটে ওঠা যাবে না; বরঞ্চ আলাদাভাবে, একে একে এঁদের মেরে ফেলা দরকার। মহাভারতের কবি এখানে ‘পলিটিক্স’টা ছুঁয়ে গেছেন মাত্র, কিন্তু সেই জায়গাটা চেপে ধরেছেন টীকাকার নীলকণ্ঠ। তাঁর মতে কৃষ্ণের ভাবটা হল এই—রাজসূয় যজ্ঞের সমস্ত সফলতা নির্ভর করছে বিপক্ষ নৃপতিদের পরাজয়ের ওপর। বিশেষত এক জরাসন্ধের সঙ্গে যুদ্ধ লাগলেই বাংলা-আসাম এবং উড়িষ্যা সবাই আসবে যুদ্ধ করতে এবং সেই জরাসন্ধ ন শক্যো’য়ং রণে হন্তং সর্বৈরপি সুরাসুরৈ—দেবাসুর কেউ তাকে মারতে পারবে না। তার থেকে ‘প্রধানমল্ল নিবর্হণ-ন্যায়েন’, মানে পালের গোদাটাকে আগে মেরে ফেলা দরকার এবং সেই জরাসন্ধকে মারতে হবে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে সামনাসামনি যাকে মহাভারত বলেছে ‘প্রাণ যুদ্ধেন জেতব্যঃ। এ ব্যাপারে কৃষ্ণ নিজের বনমালা—বিভূষিত কিংবা চক্রধারী চেহারাকেও মোটেই বিশ্বাস করেননি বরং বেছে নিয়েছেন হৃষ্ট-পুষ্ট ভীমকে, দ্বন্দ্বযুদ্ধে যিনি অনন্য। তারপর একটি রণভেরীও বাজল না, বাজল না যুদ্ধ আরম্ভের শঙ্খ, রাতের অন্ধকারে স্নাতক ব্রাহ্মণের বেশ ধরে যোগেশ্বর কৃষ্ণ এবং ভীম-অর্জুন প্রবেশ করলেন মগধের রাজধানীতে জরাসন্ধের সৌধ-প্রাঙ্গণে। সৈন্য-সামন্ত নিয়ে জরাসন্ধকে সতর্ক হবার একটুও ‘চান্স’ না দিয়েই ভীমের দ্বারা হত্যা করানো হল জরাসন্ধকে এবং সেখানেও যোগেশ্বর কৃষ্ণের বুদ্ধিযোগ ছিল।
জরাসন্ধের মৃত্যু সাময়িকভাবে সমস্ত পূর্বভারতীয় রাজাদের মনোবল ভেঙে দিয়েছিল। রাজনৈতিক দিক থেকে পাণ্ডবদের রাজসূয় যজ্ঞের সংঘটনাও তাই জরাসন্ধের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই। পূর্বভারতীয় রাজাদের রাজনৈতিক আভিজাত্যের কথা মনে রেখেই সেদিকটা জয় করতে পাঠানো হয়েছিল ভীমকে। রাজনীতির মনস্তত্ত্ব যাঁরা জানেন, তাঁরা বুঝবেন, জরাসন্ধ হন্তা ভীমের যে একটা ‘ইমেজ’ তৈরি হয়েছিল পূর্বভারত জয় করার ব্যাপারে সেই ইমেজটা যথেষ্ট কাজে লেগেছে নইলে পুণ্ড্রবর্ধনের বাসুদেব, কিংবা অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, কামরূপের রাজারা ভীমকে সহজে ছেড়ে দিতেন না। জরাসন্ধের মৃত্যুর জন্যই যেহেতু পূর্বভারতীয় সমস্ত রাজাদের ‘অ্যাক্সিস’ ভেঙে গিয়েছিল, তাঁরা তাই সাময়িকভাবে উত্তর ভারতের সঙ্গে আপোস করে নিয়েছিলেন। রাজসূয় যজ্ঞের সুবাদে ভীম যে অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছিলেন সেটি আবার কাজে লাগল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পূর্বে। মনে রাখা দরকার ঝানু রাজনীতিবিদ কৃষ্ণ পূর্বভারতীয় সমস্ত পরাক্রমশালী নৃপতিকেই শেষ করে দিয়েছিলেন এই মহাযুদ্ধের আগে। জরাসন্ধ তো আগেই গেছেন। ঠিক তাঁর পরে কিংবা আগেই গেছেন আসামের নরকাসুর, কেননা বনবাসের সময় অর্জুন কৃষ্ণকে ধন্যবাদ দিয়েছেন আসামের পথ পরিষ্কার করে দেওয়ার জন্য। তা ছাড়া পাণ্ডব দিগবিজয়ের সময়েও নরকাসুরের ছেলে ভগদত্ত ছিলেন আসামের রাজা। কাজেই দুই শক্তিশালী প্রতিবেশী—মগধের জরাসন্ধ এবং প্রাগজ্যোতিষপুরের নরকাসুর মারা যাওয়ায় সাময়িকভাবে বাংলার রাজা পৌণ্ড্রক বাসুদেবের পক্ষে যুদ্ধ করার কোনও মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। কিন্তু বন্ধুহানির প্রতিশোধ নিতে তিনি নিজেই এক সময় লাখো সৈন্য নিয়ে ছুটলেন দ্বারকায়। কৃষ্ণ জানতেন পৌণ্ড্রকের পক্ষে স্থির থাকা সম্ভব নয় এবং তিনি এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন। বৃষ্ণি-যাদবদের আপন দুর্গে গিয়ে দূর-প্রবাসী এই বাঙালি রাজার পক্ষে যুদ্ধ জয় করা হয়তো সম্ভব হয়নি কিন্তু জরাসন্ধ নরকাসুরের মতো দুর্দম প্রতিবেশীকে পাশে না পেয়েও যে ক্ষমতা তিনি দেখিয়েছেন, তার প্রশংসা আমার থেকেও স্বয়ং কৃষ্ণই করেছেন বেশি। কৃষ্ণ বলেছেন, এই বাঙালি রাজার ধৈর্য এবং বীরত্ব দুটোই হজম করা শক্ত। মনে রাখা দরকার পৌণ্ড্রক বাসুদেবকে হত্যা করতে হয়েছিল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগেই এবং তা অবশ্যই পাণ্ডবদের জয়ের পথ সুগম করতে।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা এবং আসাম—এরা সবাই কিন্তু দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করেছে এবং তা করেছে কৃষ্ণপক্ষে পাণ্ডব চন্দ্রের উদয় সহ্য করতে না পেরে। দুর্যোধন যেহেতু পূর্বভারতীয় সম্মিলিত বাহিনীর এককালের অংশীদার, তাই পূর্বভারতীয় রাজারা তাদের পুরানো এক আর্যবন্ধুকে সমর্থন করেছে ক্রম প্রতিষ্ঠীয়মান অন্যতর আর্যনৃপতির ধ্বংসের জন্য। অবশ্য কৃষ্ণের সঙ্গে বদ্ধ-শত্রুতাও দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দেওয়ার অন্যতম কারণ। তবে, যা আগেই বলেছিলাম, রাজনীতিতে বাংলাদেশ চিরকালই উত্তর ভারতের বিরোধী কক্ষে এবং তাতে সমস্যা চিরকালই বেড়েছে বই কমেনি।
মহাভারত, হরিবংশ এবং পুরাণগুলো থেকে যতটুকু তথ্য পাওয়া যায় তাতে নিঃসন্দেহে বলা চলে প্রাচীন বাংলার এক ধরনের স্বাতন্ত্র্য ছিল এবং সে স্বাতন্ত্র্য সামাজিক ক্ষেত্রে যেমন সপ্রকাশ, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তাই। সামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের স্বাতন্ত্র্য থাকার ফলে জৈন, বৌদ্ধের মতো বেদ-বিরোধী ধর্ম বাংলাদেশ সহজে গ্রহণ করতে পেয়েছিল। আবার রাজনীতির ক্ষেত্রে পৌণ্ড্র বাসুদেবের ঐতিহ্য আমরা বহুকাল পোষণ করেছি, যদিও শশাঙ্ক আর পাল রাজাদের আমলে সেন আর বর্মণদের আমলে বাংলার স্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে মিশে গেছিল উত্তরভারতের অনুপান। তবে এও সত্যি, ‘দিবে আর নিবে’—এই নীতিতেই তো সভ্যতা গড়ে ওঠে। আমরা যেমন ওদের কাছ থেকে বেদ-ব্রাহ্মণ্য এবং আরও কিছু শিখেছি, ওরাও তেমনি আমাদের কাছে উদারতা, সহৃদয়তা ছাড়াও আরও অনেক কিছু শিখেছে। ভাবতে পারেন হাতির মতো প্রকাণ্ড জন্তু উত্তরভারতীয়রা পোষ মানাতে পারেনি এবং তা শিখিয়েছি আমরাই। স্বর্গত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশাই বাঙালির এই হাতি পোষা এবং নৌ-যুদ্ধের গৌরব নিয়ে ভারী গর্ব বোধ করতেন। দশরথের বন্ধু লোমপাদ, আমাদের পাশের ঘরের মানুষ, তাঁর রাজ্যের খানিকটা এখনও আমাদের রাঢ়ভূমিতে মিশে আছে। প্রধানত তাঁরই শখে বাঙালির হাতি-পোষার ক্ষমতা উত্তরভারতে স্থানান্তরিত হয়। শাস্ত্রী মশায়ের দৃঢ় ধারণা ‘হস্ত্যায়ুর্বেদ’ নামে যে মহান গ্রন্থটি তা রচিত হয়েছে বহুকাল আগের বাংলাদেশে এবং এর রচয়িতা পালকাপ্য স্বয়ং বাঙালি। হাতির কথায় আবার মহাভারতের কথা মনে পড়ে গেল। সবাই জানে বাঙালির বন্ধুত্ববোধ অতুলনীয় এবং কখনও সেই বন্ধুত্ববোধ জন্ম দিয়েছে প্রতিশোধ-স্পৃহার। স্বয়ং হস্তিনাপুরের লোক হওয়া সত্ত্বেও ব্যাসদেবকে তাই মাঝে মাঝেই বাঙালির প্রশংসায় নামতে হয়েছে। বাংলার রাজা যখন দেখলেন ঘটোৎকচের জ্বলন্ত শক্তিশেল উদ্যত হয়েছে দুর্যোধনের দিকে তখন তিনি পাহাড়ের মতো বিরাট হাতিটিকে নিয়ে সরথ দুর্যোধনকে আড়াল করে দাঁড়ালেন। রাগের চোটে ঘটোৎকচ তাঁর শূল দিয়ে মেরে বসলেন শত্রুর পথরোধকারী সেই হাতিটিকেই অথচ ওই শূলটি দিয়ে দুর্যোধনকেই হয়তো মারা যেত। বাঙালি হস্তী-বিদ্যায় কুশল, তাই বাঙালি রাজা যতক্ষণে হাতির হাওদা থেকে নেমে পড়েছেন, ততক্ষণে দুর্যোধনও সময় পেয়ে তৈরি হয়ে নিলেন ঘটোৎকচের বিরুদ্ধে। এই সব বন্ধুত্বের কথা, এই সব বীরত্বের কথা—স্বাতন্ত্র্যের কথা মহাভারতের যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গেই কি শেষ হয়ে গেছে।
হাতির কথা বাদ দিলে নৌযুদ্ধেও আমাদের স্বাতন্ত্র্য ছিল। কুশীনগরে ভগবান বুদ্ধের যেদিন ‘পরিনির্বাণ’ হচ্ছিল, ঠিক সেইদিন বাঙালির ছেলে বিজয়সিংহ সাতশো লোককে, এক জাহাজপানা নৌকোয় চাপিয়ে সিংহলে নেমে পড়েন। বুদ্ধের আগ্রহ ছিল, বিজয় লঙ্কাদ্বীপে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করবেন বলে, কিন্তু অজন্তা পাহাড়ে বাঙালি বিজয়ের যে নৌকোখানা আঁকা আছে তার চেহারা দেখে অবধি খালি মনে হয় নৌযুদ্ধে বাঙালির ক্ষমতা ছিল অপরিসীম। দণ্ডীর দশকুমারচরিতের এক কুমার যখন তাম্রলিপ্ত থেকে এক জাহাজ সমুদ্রে নিয়ে যাচ্ছিল তখন রামেষু নামে এক যবনের জাহাজ তাম্রলিপ্তের জাহাজটিকে ডুবিয়ে দেয়।
শাস্ত্রীমশায়ের মতে এই ‘রামেষু’ হলেন মিশরদেশের ‘রামেসিস’; দশকুমারচরিত রচনার সময় এই রামেসিসের স্মৃতি জাগরূক থাকায়, যবন রামেষুকে দিয়ে বাংলার জাহাজডুবি করে দণ্ডী বিমলানন্দ লাভ করেছেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি নৌযুদ্ধে আমাদের সঙ্গে এঁটে ওঠা খুব কঠিন ছিল। তার প্রমাণ আছে হাজারো। তাছাড়া কুমার-পালের রাজত্বে তাঁর সেনাপতি বৈদ্যদেব যে কৃতিত্ব দেখিয়ে ছিলেন, তা খোদাই করা আছে কমৌলি লিপিতে। তাঁর ‘নৌবাট-হীহীরবে’ শত্রুপক্ষের হাতিরাও পালাবার জায়গা পায়নি। স্বয়ং কালিদাসের রঘু দিগবিজয় করতে এসে দেখেছিলেন, বাঙালিরা তৈরি আছে তাদের নৌবহর নিয়ে—’বঙ্গান নৌসাধনোদাতান।’
কালিদাসের রঘু বাংলাদেশে আসলে আমরা হারব, মহাভারতের ভীম দিগবিজয় করতে আসলে আমরা হারব—এই নিয়ম। তাঁদের গরিমার কথা, যুদ্ধজয়ের কথা লিখে রাখবার জন্য কবিপণ্ডিত ছিলেন অনেক, কিন্তু ম্লেচ্ছ, পাপ, অসুর দস্যু এই সব উত্তর ভারতীয় উপাধিতে বিভূষিত বাঙালির গরিমার কথা লিখে রাখবার জন্য বাঙালিও পাওয়া যায়নি, সেইখানেই দুঃখ। একমাত্র রাজতরঙ্গিনীকার কলহন, যিনি আপন দেশের মহান রাজা ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের দোষ সম্পূর্ণ স্বীকার করে নিয়েও মুক্ত-কণ্ঠে বাঙালির জয়গান করেছেন। ললিতাদিত্যের দোষ, তিনি গৌড়ের রাজাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছিলেন, কিন্তু কতিপয় গৌড়বাসী প্রভুহত্যার প্রতিশোধ-স্পৃহায় কাশ্মীরের জনপ্রিয় বিষ্ণুবিগ্রহ পরিহাসকেশবকে যে গুঁড়িয়ে ফেলার পরিকল্পনা করেছিল, কলহন তাতে গৌড়বাসীদের একটুও দোষ দেখতে পাননি। বরঞ্চ ভুলবশত পরিহাসের বদলে রামস্বামীর ধ্বংসগুলি গৌড়বাসীরা যখন ছড়িয়ে দিচ্ছিল, রাস্তায় রাস্তায় তখনই তাদের মেরে ফেলা হলে, কলহন যেন দুঃখই পেয়েছেন মনে মনে। স্বয়ং বিধাতাও নাকি গৌড়বাসীদের অননুকরণীয় রাজভক্তি ভাষায় বর্ণনা করতে পারবেন না।
গৌড়বাসীদের গৌরবের অনুপস্থিতিতেই যেন রামস্বামীর মন্দিরটি আজও বিগ্রহশূন্য আর পৃথিবী ভরে আছে গৌড়বাসীদের যশে। অন্তত কলহনের মত তাই এবং রাজতরঙ্গিনীর বর্ণনার ভাবে তাকে প্রকাশ করার একমাত্র উপায়—’বঙ্গালবাণী’—
সেদিন শুভ্র পাষাণফলকে পড়িল রক্তলিখা।
সেদিন শারদ স্বচ্ছ নিশীথে
প্রাসাদ কাননে নীরবে নিভৃতে
স্তূপপদমূলে নিবিল চকিতে শেষ আরতির শিখা।।