।। ১।।
বর্ষাকাল। সকাল থেকে বৃষ্টির বিরাম নেই আজ কলকাতার বুকে। তার স্কুলে ‘রেনি-ডে’র ছুটি ঘোষণা হওয়াতে দুপুরবেলাতেই বাড়ি ফিরে এসেছিল সন্দীপ। তার বাসস্থানটা কলকাতা শহরের মধ্যে হলেও শহরের ব্যস্ততার শব্দ এখানে তেমন প্রবেশ করে না। প্রাচীর ঘেরা বাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে কড়িবরগার ছাদওলা ওই পুরোনো বাড়িটা। বাইরে প্রাচীরের গায়ে ক্ষয়াটে নেমপ্লেটে এখনও অস্পষ্টভাবে লেখা আছে এক সময় এ বাড়ির মালিক ‘প্রফেসর নীলকান্ত সোম’-এর নাম। বিরাট বাড়িটার অধিকাংশ ঘর তালা বন্ধই থাকে। শুধু একতলার তিনটে ঘর ব্যবহার করে সন্দীপ। একলা মানুষ যে। এর চেয়ে বেশি তার প্রয়োজন নেই। বিকাল হয়ে এসেছে। বৃষ্টি হয়েই চলেছে। একতলার থামওলা বারান্দায় বসে সন্দীপ বৃষ্টি দেখছিল। সামনের জমিটা জলে ভর্তি হয়ে গেছে। জল ক্রমশ বাড়ছে। ওপর থেকে নেমে আসা বৃষ্টির ফোঁটা বৃত্ত রচনা করছে জলের ওপর। বাগানের নানা প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে ব্যাঙের ডাক। এছাড়া আর কোথাও অন্য কোনো শব্দ নেই। বর্ষা নামলেই উত্তর কলকাতার একাংশ জলমগ্ন হয়ে পড়ে। সামনের জমিটার জল প্রায় বারান্দা পর্যন্ত উঠে আসে। আকাশের যা অবস্থা তাতে আজও তেমনই হবে বলে মনে হয়। আর এরকম দিন হলেই সন্দীপের মনে পড়ে যায় বহু বছর আগের কথা। গাছের খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটা কাঠের বাড়ির বারান্দায় একলা দাঁড়িয়ে সন্দীপ। খাঁড়ি থেকে জোয়ারের জল ঢুকে প্লাবিত করছে নীচের জমিটা। জল ক্রমশ বাড়ছে। আর তার সঙ্গে সঙ্গে…. এর পরের ঘটনা অবশ্য মনে রাখতে চায় না সন্দীপ। সে ভুলে যেতে চায় সেই ঘটনা। তবুও কেন জানি বর্ষাকাল এলে এরকম দিনে সন্দীপের মনে পড়ে যায় সে জায়গার কথা। আজও তেমনি সামনের জমিতে বেড়ে চলা জলের দিকে তাকিয়ে তার মনখানি চলে যাচ্ছিল বহুবছর আগের সে ক’টা দিনে। হঠাৎ তার চিন্ত জাল ছিন্ন হল একটা শব্দে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দুজন লোক প্রবেশ করছে সামনের কম্পাউন্ডের ভিতর। অচেনা লোক! কারা এরা? তাদের দেখে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল সন্দীপ।
জমা জলে পায়ের গোড়ালি ডুবিয়ে ছপছপ করতে করতে জমিটা পেরিয়ে তারা বারান্দায় ওঠার সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। তাদের মধ্যে একজন প্রৌঢ়, ফর্সা লম্বা চেহারা, মাথায় টাক, চোখে বাইফোকাল। বেশ একটা অভিজাত ভাব আছে তার চেহারা ও পরিচ্ছদে। দ্বিতীয় জনের বয়স বছর পঁয়ত্রিশ হবে। খেলোয়াড়দের মতো ছিপছিপে কিন্তু পেশিবহুল শরীর। পরনে টি-শার্ট আর জিন্স। তার মাথার চুলে একটা লালচে ভাব আছে। আর তার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে সন্দীপের যেটা নজরে পড়ল তা হল লোকটার চোখের মণির রঙ অস্বাভাবিক রকম নীল, আর তার কাঁধের ঠিক নীচে পেশিবহুল ডান হাতে একটা বাঘের উল্কি আঁকা আছে।
বয়সে যে প্রবীণ সে লোকটা সন্দীপকে বলল, ‘আমার নাম ডক্টর নিশীথ লাহিড়ী। এক সময় প্রাণীতত্ত্বের অধ্যাপনা করতাম। এই কলকাতা শহরেই থাকি। আপনি নিশ্চয়ই সন্দীপবাবু? আমি কিছু কথা বলতে এসেছি আপনার সাথে। প্রয়োজনে পরিচয়পত্র দেখতে পারেন। এখন কথা বলার সময় হবে আপনার?’ লোক দুজন অচেনা হলেও তাদের একজনের পরিচয় শুনে ও পোশাক দেখে তাঁদের ভদ্রলোক বলেই মনে হল সন্দীপের। তাছাড়া এই বর্ষা মাথায় নিয়ে লোক দুজন কী কারণে এর সঙ্গে দেখা করতে এল তা জানতে আগ্রহী হল সন্দীপ। সে বলল ‘হ্যাঁ, আমিই সন্দীপ। আপনারা ওপরে উঠে উঠে আসুন। ঘরে আসুন।’
বারান্দায় উঠে সামনের ঘরটাই সন্দীপের বৈঠকখানা। এ ঘরটাকে একসময় প্রফেসর ঘোষও তাঁর বৈঠকখানা হিসেবে ব্যবহার করতেন। নীচু একটা ওক কাঠের টেবিলের দু-পাশে দুটো সাবেকি আমলের সোফা আর সামান্য কিছু জিনিস রাখা আছে ওখানে। ঘরে ঢুকে টেবিলের দুপাশে মুখোমুখি দুটো সোফাতে একদিকে সন্দীপ আর অন্যদিকে সেই লোক দুজন বসল।
যে লোকটা নিজেকে নিশীথ লাহিড়ী বলে পরিচয় দিয়েছেন তিনি ঘরটার চারপাশে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আমি আসলে আপনার কাছে এসেছি প্রফেসর নীলকান্ত সোমের ব্যাপারে কথা বলতে।’
এই অপরিচিত লোকের মুখে প্রফেসরের কথা শুনে চমকে উঠল সন্দীপ। একটু আগেই তো সে তাঁর কথা ভাবছিল! নিশীথ লাহিড়ীর কথা শুনে সন্দীপ নিশ্চিতভাবে বলল, ‘তাই! কিন্তু গত পনেরো বছর ধরে এ বাড়িতে আর থাকেন না তিনি।’
ডক্টর নিশীথ লাহিড়ী বললেন ‘আমি তা জানি। আর এও জানি যে আপনার সঙ্গে তার শেষ দেখা হয়েছিল বছর দশেক আগে সুন্দরবনের জনমানবহীন চামটা দ্বীপে।’
নিশীথ লাহিড়ীর কথা শুনে সত্যিই চমকে উঠল সন্দীপ। সে বলল, ‘আপনি কী করে জানলেন?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘জানি। কেন, কীভাবে সে কথা আপনাকে বলছি। তার আগে আমার সঙ্গীর সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিই। ও হল ফ্রান্সিস গঞ্জালো। পেশায় ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফার। বন্যপ্রাণীর ছবি তুলে বেড়ায় সারা পৃথিবীতে।’
টি-শার্ট আর বাঘের ট্যাটু থাকা লোকটার লালচে চুল আর নীল দেখে লোকটাকে কিছুটা ভিনদেশিই লাগছিল সন্দীপের। লোকটার নামটা পর্তুগীজ। তাই লোকটার পরিচয় শুনে তার দিকে তাকিয়ে সন্দীপ প্রশ্ন করল ‘ফ্রম পর্তুগাল?’
লোকটা কিন্তু তার কথা শুনে মৃদু হেসে পরিষ্কার বাংলাতেই বলল, ‘না, পর্তুগাল নয়। আমি মেদিনীপুরের লোক। মহিষাদলের কাছে একটা গ্রামে আমার জন্ম। আসলে প্রায় পাঁচশো বছর আগে পর্তুগীজদের একটা বড় দল ঘাঁটি গেড়েছিল ওখানে। তারপর স্থানীয় মহিলাদের বিবাহ করে ওখানেই রয়ে গেছিল। তাদেরই উত্তরাধিকারী আমি। আমার নিজের পরিচয় কিন্তু এখন বাঙালি। তবে কুড়ি পুরুষ পরেও আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে আমাদের আদি পূর্বপুরুষ পর্তুগীজ নাবিকদের তিনটে জিনিস এখনও বহন করে আসছি। সে তিনটে জিনিস হল খ্রিস্টধর্ম, পর্তুগীজ নাম-পদবী আর চুলের কটা রঙ বা নীল চোখ। আমার মাতৃভাষা কিন্তু বাংলা। আপনি বাংলাতেই কথা বলতে পারেন।’
সন্দীপ হেসে বলল ‘আচ্ছা। আসলে আপনার নাম শুনে, কটা চুল, নীল চোখ দেখে আমি পর্তুগালের বাসিন্দা ভেবেছিলাম।’ ডক্টর নিশীথ লাহিড়ী বললেন, এবার তাহলে আমার কথায় আসি। এক সময়, আজ থেকে কুড়ি বছর আগে আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জীববিদ্যা নিয়ে অধ্যাপনা করতাম। যদিও আমি প্রফেসর সোমের থেকে অনেকটাই কনিষ্ঠ ছিলাম তবে গবেষণার সূত্র ধরেই তাঁর সাথে আমার আলাপ। তিনি আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন। প্রায় একই বিষয় নিয়ে গবেষণা চালাতাম আমরা। তবে বেশ কিছুটা গোপনে। আমরাই শুধু জানতাম পরস্পরের গবেষণার কথা। কারণ যে বিষয় নিয়ে আমরা গবেষণা চালাচ্ছিলাম তাতে আইনগত কিছু প্রতিবন্ধকতা ছিল। তাই গোপনেই কাজ চালাচ্ছিলাম আমরা। তবে যে যার নিজের মতো। তারপর একদিন আমরা হঠাৎ জানতে পারলাম আমরা ঠিক যে বিষয়ে গবেষণা করছি ঠিক সে বিষয়ে গবেষণার ব্যাপারে আমেরিকার একটা বিশ্ববিদ্যালয় আগ্রহী। যেখানে গবেষণা মানে অর্থ এবং গবেষণার সুযোগ প্রচুর। সম্মিলিত ভাবে আমরা দুজন আবেদন জানালাম সেখানে যোগদানের জন্য। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের চিঠি দিয়ে জানান যে তাঁরা মাত্র একজনকেই এ সুযোগ দিতে পারেন এ কাজের জন্য। তবে কে যাবে সেখানে? প্রফেসর সোম আমার থেকে সিনিয়ার। সুযোগটা তাই তাঁরই পাবার কথা। কিন্তু মহানুভবতা দেখিয়ে তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমিই ওখানে যাও। তুমি আমার থেকে বয়সে পনেরো বছরের ছোট। আমরা যে কাজে নেমেছি তাতে গবেষণা কবে শেষ হবে কেউ বলতে পারে না। তাই তোমারই আমেরিকা যাওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। তাছাড়া প্রাথমিকভাবে আমি যে প্রাণীটার ওপর গবেষণা চালাচ্ছি তাতে কলকাতাতে থাকাই আমার পক্ষে সুবিধাজনক।’ এর পর আমি চলে যাই আমেরিকাতে। প্রায় কুড়ি বছর সে বিদ্যালয়ে কাজ করার পর মাসখানেক হল কলকাতাতে ফিরেছি। আমেরিকাতে যাবার পর প্রথম পাঁচ বছর আমাদের প্রায় নিয়মিত যোগাযোগ ছিল ল্যান্ডলাইন টেলিফোনের মাধ্যমে। তবে গবেষণার গোপনীয়তার স্বার্থে প্রফেসর সোম তাঁর নিজস্ব টেলিফোন ব্যবহার করতেন না। তারপর হঠাৎই একদিন আমাদের মধ্যে সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। দিনের পর দিন তাঁর টেলিফোনের প্রত্যাশায় থেকেও তাঁর কোনো টেলিফোন পাইনি আমি। যাইহোক আমিও তারপর গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। দেখতে দেখতে কীভাবে যেন কুড়িটা বছর কেটে গেল। মাসখানেক হল বিদেশ থেকে কলকাতা শহরে ফিরেছি আমি এবং ফিরেছি এ দেশে পাকাপাকি ভাবে থাকব বলেই। কিন্তু দেশে ফেরার পরই আমার খালি মনে হতে লাগল প্রফেসর নীলকান্ত সোমের কথা। তিনি কেমন আছেন? কোথায় আছেন? তার গবেষণা কী হল? এ বাড়িতে আমি বার কয়েক এসেছি। কিন্তু উত্তর কলকাতার ঠিক কোথায় এ বাড়িটা তা এত বছর পর কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না। এই কুড়ি বছরে কলকাতা অনেক বদলে গেছে। পুরোনো এমন কোনো লোকের সঙ্গেও আমার যোগাযোগ নেই যে আমাকে প্রফেসরের খোঁজ দেবে। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা বা তাঁর ব্যাপারে খবর জানার চেষ্টা করেও যখন তাঁর কোনো খোঁজ পাচ্ছিলাম না তখন অনেকটা কাকতালীয় ভাবেই আমার গঞ্জালোর সঙ্গে যোগাযোগ হয়। যেহেতু আমি জীববিজ্ঞানী তাই বন্য প্রাণ নিয়ে আমার আগ্রহ আছে। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন থেকে কলকাতাতে এক ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফির এগজিবিশন দেখতে গেছিলাম। সেখানেই কথায় কথায় গঞ্জালোর কাছ থেকে আমি প্রফেসর সোমের কথা শুনি। শুনি মানে গঞ্জালো যার সম্বন্ধে শুনে আমাকে বলেছে তিনি প্রফেসর নীলকান্ত সোম বলেই আমার ধারণা।”
এ কথা শুনে সন্দীপ চমকে উঠে বলল, ‘তার মানে? তিনি তো বহুদিন ধরে নিখোঁজ!’
ডক্টর নিশীথ লাহিড়ী এবার গঞ্জালোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি যে কথা আমাকে শুনিয়েছিলে সেটা সংক্ষেপে বলো। তারপর আবার আমি কথা বলব।’
।। ২।।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে গঞ্জালো বলতে শুরু করল, ‘দেখুন আমি একজন ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার। বনেজঙ্গলে আমি ঘুরে বেড়াই বন্য প্রাণীর ছবি তোলার জন্য। এ দেশের বিভিন্ন জঙ্গলে তো বটেই, অনেক সময় বিদেশের জঙ্গলেও। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার হয়ে কাজ করি আমি। মাস তিনেক আগে সুন্দরবনে গিয়েছিলাম আমি। তবে এ দেশের সুন্দরবনে নয়। বাংলাদেশের অন্তর্গত সুন্দরবনে। আপনি হয়তো জানেন যে সুন্দরবনের অধিকাংশ অঞ্চলই বাংলাদেশের অন্তর্গত। নৌকা নিয়ে বেশ কয়েকদিন আমাকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল সুন্দরবনের গভীরে অর্থাৎ কোর এলাকাতে। আবার নৌকোতে মাঝিদের যে সর্দার ছিল তার নাম তাজউদ্দিন। প্রৌঢ় মানুষ। এক সময় সে নাকি জলদস্যুদের কাজ করতো। অর্থাৎ ও দেশ থেকে জলসীমা পেরিয়ে এসে মাছ ধরার ট্রলারে ইত্যাদি নানা জায়গাতে লুঠতরাজ করতো। তারপর আবার ফিরে যেত ওদেশে। তাজউদ্দিনই আমাকে কথাগুলো বলেছিল। তাজউদ্দিনের সঙ্গে আমি একদিন খাঁড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম নদীর চরে কুমিরের ছবি তোলার জন্য। কিন্তু তেমন কোনো কুমিরের দেখা পাচ্ছিলাম না। সেদিন একটা নির্জন খাঁড়ি পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। হঠাৎ একটা নদীর নির্জন চরে দেখি একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে! জায়গাটা দু-দেশের জলপথের সীমান্তবর্তী এলাকা। তাকে দেখেই নদীর চরে নৌকা ভিড়িয়ে দিল। নৌকা থেকে নেমেই তাজউদ্দিন এগিয়ে গেল তার কাছে। তাদের দুজনের মধ্যে কী কথা হয়েছিল জানিনা। কথা শেষ হলে নৌকাটা নদীর চর ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল আর তাজউদ্দিন ফিরে এসে আমাকে বলল, ‘আপনার চিন্তা নেই কত্তা। কাল সকালে কাটাখালির চরে আমি আপনাকে বড় কুমির দেখাব। তার পরদিন সকালে সত্যিই কাটাখালি নামের একটা জায়গাতে নদীর চরে বিশাল একটা কুমির দেখাল তাজউদ্দিন। চরের একদম কাছে তাজউদ্দিন নৌকা নিয়ে গেছিল। কুমিরটা কিন্তু আমাদের দেখে পালানো না। বরং কখনো মুগ্ধ হাঁ করে, কখনও বা লেজ নাড়িয়ে আমাকে নানা ভঙ্গিমায় ছবি তোলার সুযোগ করে দিল। তারপর ধীরে ধীরে আমাদের নৌকার কিছু দূর দিয়ে জলে নেমে গেল। আমার ছবি তোলা হলে সেই বিরাট কুমিরটা জলে নেমে যাবার পর আমি তাজউদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে যে এ সময় ওই বিশাল কুমিরটা থাকবে তুমি জানলে কী ভাবে?’
তাজউদ্দিন জবাব দিল ‘আমি কি আর জানতাম কত্তা! কাল বিকালে যে লোকটাকে নদীর চরে দেখেছিলেন তাকে আমি বড় কুমিরের খোঁজ করছি বলাতেই সে আমাকে বলল যে আজ এই বিরাট কুমিরটা কাঠখালির চরে ঠিক এ সময় এ জায়গাতে থাকবে। দুই বাংলার তামাম সুন্দরবনের কুমিরদের হাল হকিকত ওর জানা।’ আমি প্রশ্ন করলাম, ‘লোকটা কে? বনদপ্তরের লোক?’
তাজউদ্দিন জবাব দিল, ‘ও হল প্রফেসর। ভারতের জলসীমার ভিতর চামটার একটা নির্জন দ্বীপে বহু দিন ধরে লুকিয়ে আছে। কুমিরের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব। আমি যখন জলদস্যুদের কাজ করতাম তখন নিয়মিত যোগাযোগ ছিল ওর সঙ্গে। আমাদের লুঠের মালপত্র ওর কাছে রাখতাম। একবার আমি একটা সাইলেন্সর রাইফেল জোগাড় করে দিয়েছিলাম ওকে। দু-দেশের সীমান্তে এলে এখনও কখনও কখনও দেখা হয় ওর সঙ্গে।’ সাইলেন্সর রাইফেল দিয়েছিল! তেমন এক ঘটনার সাক্ষী তো সন্দীপ নিজেই ছিল! গঞ্জালোর কথা এ পর্যন্ত শুনেই সন্দীপ উত্তেজিত ভাবে জানতে চাইল ‘খাঁড়ির চরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখতে কেমন ছিল?’
গঞ্জালো বলল, ‘আমার ধারণা লোকটার বয়স সত্তর বা তার বেশি হবে। মাথার চুল সব সাদা হয়ে গেছে। লম্বা গড়ন। একসময় মনে হয় ফর্সাই ছিল গায়ের রঙ। কিন্তু নোনা বাতাস আর সূর্যের তাপে সে রঙ এখন তামাটে। লোকটার চেহারার বিশেষত্ব হচ্ছে তার ঠিক নাকের ডগাতে একটা আঁচিল আছে।’ কথাটা শুনেই উত্তেজনায় চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল সন্দীপ। লোকটার চেহারার যা বিবরণ তাতে তো হুবহু মিলে যাচ্ছে প্রফেসর নীলকান্ত সোমের সঙ্গে। সন্দীপ বলে উঠল, ‘তার মানে প্রফেসর এখনও জীবিত আছেন?’
ডক্টর নিশীথ লাহিড়ী বললেন, ‘হ্যাঁ। তবে তাঁর শরীর বিশেষ ভালো নেই। তিনি নাকি আবার সভ্য জগতে অর্থাৎ এই কলকাতা শহরে ফিরে আসতে চান, কিন্তু পারছেন না।’
বিস্ময়ে হতবাক হবার জোগাড় সন্দীপের। সে কোনো রকমে উত্তেজনা সম্বরণ করে আবার চেয়ারে বসে পড়ল। তারপর প্রশ্ন করল, ‘তিনি ফিরে আসতে পারছেন না কেন?’
গঞ্জালো বলল, ‘প্রফেসরের মুখ থেকে তাজউদ্দিন যতটুকু এ ব্যাপারে জেনেছিল তা হল একজন যুবককে প্রফেসর তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সুন্দরবনে যাবার আগে তিনি তাকে তাঁর সম্পত্তি উইল করে দিয়ে যান। তিনি একবার ছেলেটাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন সুন্দরবনে। তাজউদ্দিন নাকি সেই যুবককে একবার দেখেছিল যেবার সে রাইফেল প্রফেসরকে দিতে গিয়েছিল সেবার। তারপর ছেলেটার সঙ্গে প্রফেসরের এমন কোনো ঘটনা ঘটে যায় ফলে প্রফেসরের সেই সঙ্গী সুন্দরবনে প্রফেসরের ডেরা থেকে পালিয়ে আসে। কী ঘটেছিল সে ব্যাপারটা প্রফেসর বলেননি তাজউদ্দিনকে। তবে প্রফেসরের আশঙ্কা সেই যুবক হয়তো ফিরে গিয়ে পুলিশে অভিযোগ জানিয়েছে তার বিরুদ্ধে। প্রফেসর হয়তো ফিরে এলেই গ্রেপ্তার হবেন।’
ডক্টর নিশীথ লাহিড়ী এবার সন্দীপকে প্রশ্ন করল, ‘সেদিনের সেই যুবক নিশ্চয়ই আপনি? প্রফেসর কি খুন করতে গেছিলেন আপনাকে? আপনি কি তাঁর সম্বন্ধে পুলিশে অভিযোগ জানিয়েছিলেন?
সন্দীপ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘হ্যাঁ, সে আমি। হ্যাঁ, ঘটনা একটা ঘটেছিল ঠিকই। ভয়ঙ্কর ঘটনা। তিনি আমাকে খুন করতে যাননি ঠিকই কিন্তু একটা ভয়ঙ্কর এক্সপেরিমেণ্ট চালাতে চেয়েছিলেন আমার ওপর। শেষে একদল বনকর্মী আমাকে তার ডেরা থেকে উদ্ধার করে। তবে আমি ফিরে এসে প্রফেসরের নামে কোথাও কোনো অভিযোগ জানাইনি। কিন্তু আপনারা আমার খোঁজ পেলেন কীভাবে?’
নিশীথ বললেন ‘তাঁর নামে কোনো অভিযোগ করেননি শুনে আশ্বস্ত হলাম। আপনার খোঁজ পেতে আমাকে প্রাইভেট এজেন্সির সাহায্য নিতে হয়েছে। তারা প্রথমে করপোরেশনের ফাইল থেকে এ বাড়ির ঠিকানা উদ্ধার করে। দেখা যায় এ বাড়ির ঠিকানা আগে ছিল প্রফেসরের নামে, তারপর এখন আপনার নামে। তারপর তারা আপনার সম্বন্ধে কিছু খোঁজখবর করতেই আমাদের হিসাব মিলে যায়। আমরা বুঝতে পারি যে আপনিই সেই ব্যক্তি যিনি প্রফেসরের ডেরায় গেছিলেন। যার অভিযোগের আশঙ্কাতে ফিরে আসতে পারছেন না তিনি।’ সন্দীপ বিস্মিত ভাবে বলল ‘আপনি আমার পিছনে প্রাইভেট ডিটেকটিভ লাগিয়েছিলেন?’
নিশীথ বললেন ‘হ্যাঁ, তা বলতে পারেন, তবে কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে নয় এবং কেন আপনার খোঁজ করা এবার আপনাকে বলি।’
এরপর একটু থেমে তিনি বললেন, ‘আমার জীবনে আমি যা কিছু প্রতিষ্ঠা বা অর্থ লাভ করেছি তা প্রফেসর আমাকে বিদেশে যাবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন বলেই। তাঁর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমি চাই তিনি আমাদের মধ্যে শেষ জীবনে আবার ফিরে আসুন। তিনি বৃদ্ধ, অসুস্থ। আমি তাঁকে ফিরিয়ে আনতে যাব। আমি চাই আপনি আমাদের সঙ্গী হন। যেখানে প্রফেসরের ডেরা ছিল সেখানে নিয়ে চলুন। আমরা তাঁকে খুঁজে বার করব। আপনি তাঁকে আশস্ত করলে নিশ্চয়ই তিনি ফিরে আসবেন। এই অনুরোধ নিয়েই আমাদের আসা।’ কথাটা শুনেই সন্দীপের মনে ভেসে উঠল বহু বছর আগের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাগুলোর স্মৃতি। প্রফেসরের কথা—সেই বিশাল কুমিরটার কথা। সুন্দরবন থেকে ফেরার পরও কতবার যে ঘুমের মধ্যে সেই নোনাজলের কুমিরটার দাঁত বার করা বিশাল চোয়ালটার স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে জেগে উঠেছে তার হিসাব নেই। ডক্টর লাহিড়ীর কথা শুনে একটু চুপ করে থেকে সন্দীপ বলল, ‘আমাকে মার্জনা করবেন, আমি সেখানে যাব না।’
নিশীথ সন্দীপকে বোঝাবার ভঙ্গিতে বললেন, ‘দেখুন এটা হয়তো ঠিক যে প্রফেসর আপনার সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ করে ফেলেছিলেন। আবার যতটুকু জানি যে আপনার প্রতি তাঁর অবদানও কম নয়। দশ বছর আগে আপনার প্রতি কোনো ঘটনা ঘটে থাকলে আজ সেটা ভুলে যান। প্রফেসর বৃদ্ধ হয়েছেন। হয়তো বা বেশিদিন বাঁচবেন না। আমাদের প্রতি তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করে চলুন আমরা তাঁকে ফিরিয়ে আনি।’
এ লোকগুলো প্রফেসরের গবেষণার অন্তিম পরিণতি সম্বন্ধে কতটা জানে তা জানা নেই সন্দীপের। সন্দীপ যে ভয়ঙ্কর ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল সে কথা হয়তো এদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না। কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি আর হতে চায় না সন্দীপ। তাই সে ঘটনাটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, ‘এ কথা ঠিকই আমার জীবনে প্রফেসরের অবদান ভোলার নয়। তাঁর প্রতি আমার এখন আর কোনো অভিযোগ নেই। তবে আমি আপনাদের সঙ্গী হতে পারব না।’
ডক্টর লাহিড়ী বললেন, ‘কিন্তু কেন?’
সন্দীপ জবাব দিল, ‘সেটা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
ডক্টর নিশীথ লাহিড়ী বলে উঠলেন, ‘আমাকে মার্জনা করবেন। তবে কি আমি ধরে নেব যে আপনি চাননা যে প্রফেসর ঘোষ ফিরে আসুন? তিনি ফিরে এলে আপনি তাঁর সম্পত্তি ভোগ দখল করছেন সেটা আবার তিনি ফিরিয়ে নিতে পারেন সেই আশঙ্কাতেই কি আপনি তাকে আনতে যেতে চাননা?’
কথাটা যেন চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল সন্দীপের মুখের ওপর। সে বলে উঠল, ‘না এটা সত্যি নয়। তিনি ফিরে এলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি, এই বাড়ি আমি তাঁর হাতে তুলে দেব। আমার এসবের ওপর কোনো লোভ নেই।’
ডক্টর নিশীথ লাহিড়ী হেসে বললেন, ‘হয়তো আপনার কথাই সত্যি। কিন্তু আপনি যদি না যান, তিনি যদি ফিরে না আসেন তবে এই অপবাদ নিয়েই কিন্তু আপনাকে সারা জীবন কাটাতে হবে।’
ডক্টর লাহিড়ী এরপর বললেন, সুন্দরবনের কোর এলাকায় প্রবেশ করার জন্য আমরা বিশেষ অনুমতি পেয়েছি গঞ্জালোর ছবি তোলার আবেদনের সূত্র ধরে। ওই তিনটে দিন আমরা প্রফেসরকে খুঁজে বার করার জন্য কাজে লাগাতে চাই। আজ বুধবার। শুক্রবার সকালে প্রফেসরের খোঁজে জলে ভাসব আমরা। মাঝে একটা দিন সময় আছে আপনি ভাবুন। আমি আমার ঠিকানা-ফোন নম্বর লেখা কার্ড রেখে যাচ্ছি। আর আপনি আপনার ফোন নম্বর দিন। আপনার সিদ্ধান্ত জানার জন্য আমি প্রতীক্ষা করব।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোন নম্বর আদান প্রদান হয়ে গেল। তারপর গঞ্জালোকে নিয়ে সন্দীপের বাড়ি ত্যাগ করলেন ডক্টর নিশীথ লাহিড়ী। বাইরে অন্ধকার নামছে। বৃষ্টির প্রকোপ আরও বাড়ছে। তারা চলে যাবার পর নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ল সন্দীপ। অন্ধকার ঘরে শুয়ে বাইরের বৃষ্টিপাতের শব্দ শুনতে শুনতে সন্দীপ ভাবতে লাগল তার কী করা উচিত? দুঃস্বপ্নের পাশাপাশি প্রফেসরের সাথে তার সুখস্মৃতিগুলোও মনে পড়তে লাগল সন্দীপের। গ্রাম থেকে আসা সহায় সম্বলহীন সন্দীপকে একদিন তাঁর এই নিজের বাড়িতে, আশ্রয় দিয়েছিলেন প্রফেসর। তার পড়াশোনা, চাকরি—সব কিছুরই ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। নইলে সেদিন এই অপরিচিত শহরের বুকে সন্দীপ কোথায় হারিয়ে যেত কে জানে?
।। ৩।।
দুদিন ধরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হবার পর গতরাতে বৃষ্টি থেমেছে। এ দিনের সকালটা রৌদ্রকরোজ্জ্বল, আলো ঝলমলে। অবশ্য আবার যে কোনো সময়ই আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যেতে পারে। তবে ঠিক সকাল আটটায় ছোট লঞ্চটা সুন্দরবনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল তখন প্রভাতী সূর্যের আলো ঝিলিক দিচ্ছে নদীর জলে। মাথার ওপর নীল আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে জেটি সংলগ্ন গৃহস্থবাড়ির পায়রার ঝাঁক। লঞ্চের নিজস্ব লোক বলতে দুজন। সারেঙ আর তার সহকারী। তারা নাকি গঞ্জালোর পূর্ব পরিচিত। লঞ্চের ব্যবস্থা নাকি সেই করে রেখেছিল। ক্রমশ জেটি থেকে দূরে সরে যেতে লাগল লঞ্চটা। সারেঙের কেবিনের পাশেই দাঁড়িয়েছিল সন্দীপ। কিছুটা তফাতে রেলিং ধরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নিশীথ লাহিড়ী আর গঞ্জালো। এগিয়ে চলেছে লঞ্চ। হালের চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে সারেঙ, সন্দীপকে প্রশ্ন করল, ‘আপনি আগে কোনোদিন সুন্দরবনে গেছেন?’
সন্দীপ জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, একবার। দশ বছর আগে।’
সারেঙ বলল, ‘তবে আপনার দেখা সুন্দরবন এখন অনেকটাই বদলে গেছে। মাঝে আয়লা ঝড় হয়েছিল জানেন তো? সে ঝড়ে একেবারে তছনছ হয়ে গেছিল সুন্দরবন। কত মানুষ আর পশু যে মারা পড়েছিল তার হিসাব নেই। ওই ঝড়ের পর আমি একবার সজনেখালিতে মরা বাঘ ভাসতে দেখেছিলাম। গবাদি পশু তো বটেই এমনকী বনের রাজা দক্ষিণ রায়ও নিস্তার পায়নি ওই ঝড় থেকে। প্রচুর হরিণও মারা পড়েছিল। জঙ্গল ভেঙে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল ওই ঝড়। একমাত্র কুমিরদের কোনো ক্ষতি হয়নি জলে থাকে বলে। বরং তাদের লাভই হয়েছিল। জলে ভাসা মানুষ থেকে শুরু করে বাঘের মাংস, সব কিছুই জুটেছিল তাদের ভাগ্যে।’
সন্দীপ বলল, ‘হ্যাঁ, সে খবর জানি। টিভিতে দেখেছিলাম, খবরের কাগজে পড়েছিলাম সেই ভয়ঙ্কর ঝড়ের খবর।’ সারেঙ বলল, ‘তার সঙ্গে চোখে দেখার বিস্তর ফারাক। কতো ছোট-বড় দ্বীপ যে জলের তলায় হারিয়ে গেছে তার হিসাব নেই। যেখানে একসময় দ্বীপ ছিল সেখানে হয়তো এখন নদী, আর যেখানে নদী ছিল সেখানে হয়তো এখন চরা! তার ওপর গজিয়ে উঠেছে সুন্দরী আর গরানের জঙ্গল। খাঁড়িগুলোও তার সঙ্গে সঙ্গে গতিপথ পরিবর্তন করেছে। নতুন নতুন সব খাঁড়ি। এক এক সময় ওদিকে গেলে আমাদেরই পথ গুলিয়ে যায়। রাস্তা ঠিকমতো চেনা যায় না। সজনেখালি থেকে নেতিধোপানি পর্যন্ত তেমন অসুবিধা নেই। কিন্তু তার পরেই সব গণ্ডগোল হয়ে যায়। আসল সুন্দরবন তো ওই নেতিধোপানি থেকে শুরু। যেখানে সত্যিই জলে কুমির ডাঙায় বাঘ।’
সন্দীপ জানতে চাইল, ‘সবই কি তাহলে ওলোট পালোট হয়ে গেছে?’
লঞ্চ এগিয়ে নিয়ে যেতে যেতে সারেঙ বলল, ‘একটা জিনিস অবশ্য আগের মতোই আছে। বরং বলা যেতে পারে সেটা আগের থেকে কিছুটা বেড়েছে। তা হল গা ছমছম পরিবেশ। কত নতুন নতুন খাঁড়ি। দিনের বেলাতে সূর্যের আলো ঢোকে না সেখানে। সেখানে কুমির আর তাদের আড্ডা।’
সন্দীপ বলল, ‘তারা মানে কি বাঘ?’
লোকটা একটু ইতস্তত করে বলল, ‘বাঘ তো আছেই। আর তার সঙ্গে তারা। যে সব মানুষ মারা পড়েছিল আয়লাতে, ভেসে গেছিল নদীর জলে। আপনি বললে বিশ্বাস করবেন না ও সব খাঁড়িতে ঢুকলে আমাদেরও গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়। একবার একটা খাঁড়িতে একটা মানুষের কঙ্কালকে আমি নিজের চোখে বসে থাকতে দেখেছি!’
সন্দীপ কোনো প্রতিবাদ করল না লোকটার এসব কথায়। সন্দীপ নিজে ভূত বা ভগবানে বিশ্বাস করে না। তবে যার যার বিশ্বাস তার কাছে। তাকে পরিহাস না করাই ভালো।
লোকটা কুমিরের প্রসঙ্গ উল্লেখ করায় সন্দীপের একটা পুরোনো প্রসঙ্গ মনে পড়ে গেল। সে সারেঙকে বলল, ‘ওদিকের জঙ্গলে চোরাগাজীখাল বলে যে জায়গাটা আছে সেখানে নদীর চরে একটা বিশাল কুমির শুয়ে থাকত। আমি যেবার এসেছিলাম সেবার দেখেছিলাম। এখনও সে কুমিরটাকে সেখানে দেখা যায়?’
সারেঙ বলল, ‘আপনি কোন কুমিরের কথা বলছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে কুমির ওই দিকে হামেশাই দেখা যায়। আপনি সুন্দরবনের গভীরে চামটা আর হলদি দ্বীপের নাম শুনেছেন হয়তো। তাদের মাঝখান দিয়ে এগোলে খাঁড়িময় এক নতুন দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে আয়লার পর। চামটা আর হলদি যেমন বাঘের ডেরা তেমনই ওই নতুন দ্বীপ নাকি এখন প্রচুর বড় বড় কুমিরের ডেরা। বাঘও নাকি প্রায় ভয়ে এড়িয়ে চলে ওই দ্বীপটাকে। আমার পরিচিত এক সারেঙ একবার ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লঞ্চ নিয়ে গেছিল ওই দ্বীপ দেখতে। কিন্তু তারা নীচে নামতে পারেনি। খাঁড়ির প্রবেশ মুখের চড়ায় এসেছিল বিশাল বিশাল সব কুমির। বন্দুকের ফাঁকা শব্দ করেও তাদের সরানো যায়নি। অগত্যা তাদের ফিরে আসতে হয়েছিল।’ সন্দীপ হয়তো আরও কিছুক্ষণ গল্প করত সারেঙের সাথে। কিন্তু ডক্টর লাহিড়ীর ডাক শুনতে পেল যে—’এদিকে আসুন। ওখানে একলা দাঁড়িয়ে কেন?’
ডাক শুনে সন্দীপ তাদের পাশে গিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়াল। তাদের যাত্রাপথের দুপাশে চোখে পড়ছে ছোট ছোট গ্রাম। আয়লার বাঁধ। ছোট ছোট গ্রামগুলোতে জেলে নৌকা বাঁধা আছে। সন্দীপ তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াবার পর নিশীথ বললেন, ‘আমার কিন্তু বিশ্বাস ছিল যে সেদিন আপনি আমাদের ডাক শেষপর্যন্ত অগ্রাহ্য করতে পারবেন না। আর আপনি প্রফেসরের সম্পত্তি হাতছাড়া হবার ভয়ে তাঁর খোঁজে আসবেন না এ কথা কোনো অবস্থাতেই বিশ্বাস করিনি। ওটা আমি আপনাকে বলেছিলাম আপনাকে খোঁচা দিতে। যাতে ব্যাপারটা ভুল প্রমাণ করার জন্য আপনি এখানে আসতে রাজি হন। আপনি দুঃখ পেলে আমাকে ক্ষমা করবেন।’
সন্দীপ বলল, ‘ওসব কথা এখন থাক। আসলে আমি এখানে এলাম প্রফেসরের আমার জন্য করা কাজগুলো মনে পড়ে গেল বলে। তাঁর প্রতি আমার যে দায়িত্ব আছে তা পালন করার জন্য। আমি জানি আমি আবার হয়তো বিপদে পড়তে পারি। তবু এলাম।’
গঞ্জালো বলল, ‘আমার মনে হয় না যে তাঁর দিক থেকে তেমন কোনো বিপদের সম্ভাবনা আছে। তাছাড়া সেবার আপনি একা গেছিলেন, আর এবার আমরা তিনজন। প্রফেসর ফিরে আসতে চান। তিনি নিশ্চয়ই সে পথ বন্ধ করতে চাইবেন না।’
সন্দীপ এরপর প্রশ্ন করল, ‘আপনাদের যাত্রাপথটা এবার আমাকে বলুন?’
ডক্টর নিশীথ বললেন, ‘আমরা এখান থেকে সোজা সজনেখালি যাব। সেখানে রাত্রিবাস করে পরদিন রওনা হব নেতিধোপানির দিকে। আর তারপর এগোব চামটা আর হলদির দিকে। সেখান থেকে শুরু হচ্ছে আসল সুন্দরবন। তাজউদ্দিনের বক্তব্য অনুসারে চামটার কাছে কোনো দ্বীপে প্রফেসরের ডেরা ছিল বা আছে। চামটার কাছে পৌঁছাবার পর আপনাকে পথ চেনাতে হবে। সেখানে গিয়েছিলেন আপনি।’
সন্দীপ বলল ‘চামটা আর হলদি দ্বীপকে দুপাশে রেখে কিছুদূর এগোলে নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে একটা খাঁড়ি এসে মিশেছে। ওখানে ডানদিকে নদীর চরে বাজে পোড়া একটা বিরাট শিমূল গাছ ছিল। জানিনা সে গাছটা এখনও আছে কিনা? সারেঙ তো বলছিল যে আয়লা ঝড়ে সুন্দরবনের সব কিছু ওলোট পালোট হয়ে গেছে। ওই শিমূল গাছ যেখানে আছে সেখান থেকেই খাঁড়ি বেয়ে প্রফেসর আমাকে নিয়ে গেছিলেন তার ডেরায়। ও জায়গা পর্যন্ত যদি পৌঁছতে পারি অর্থাৎ সেই গাছের জায়গাটা, তবে সেখান থেকে হয়তো আমি প্রফেসরের এক সময়ের বাসস্থানে নিয়ে যেতে পারব। একটা পুরোনো কাঠের বাংলোতে থাকতেন তিনি। নদীতে জোয়ারের জলে প্লাবিত হত জায়গাটা। জানিনা সেটা এখনও আছে কিনা? হয়তো সেটাও আয়লাতে ভেঙে গেছে।’
ডক্টর লাহিড়ী বললেন ‘চামটা আর হলদি তো শুনেছি মোটামুটি বড় দ্বীপ। আগে তো কাল ও জায়গা পর্যন্ত পৌঁছাই, তারপর দেখা যাবে কীভাবে পৌঁছানো যায় আসল জায়গাতে।’
লঞ্চ এগিয়ে চলল। নিজেদের মধ্যে নানা কথা বলতে লাগল সন্দীপরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গরম লাগতে শুরু করল। নীচের কেবিনে গিয়ে শুয়ে পড়ল সন্দীপ। দুপুরে একবার শুধু খাবার জন্য উঠেছিল সে। তারপর আবার টানা ঘুম।
একটা ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙল সন্দীপের। নোঙর ফেলার ঝাঁকুনি। সজনেখালিতে পৌঁছে গেছে লঞ্চ। সন্দীপ ডেকে এসে দাঁড়াল। বিকাল হয়েছে। তবে এখন টুরিস্ট সিজেন নয় বলে লঞ্চের ভিড় নেই, লোকজনও তেমন চোখে পড়ছে না। দু’-একটা ছোট নৌকা রয়েছে নদীর পাড়ে। আর রয়েছে বনরক্ষীদের একটা টহলদারি ছোট লঞ্চ। নদী যেদিকে প্রবাহিত হয়েছে সেদিকে তাকাল সন্দীপ। কালো কালো বিন্দুর মতো ছোট বড় নানা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে সেখানে। গঞ্জালোকে বলা সেই ভূতপূর্ব জলদস্যু তাজউদ্দিনের কথা যদি সত্যি হয় তবে ওই মোহনার দিকে কোনো গভীর দ্বীপে আজও রয়ে গেছেন প্রফেসর ঘোষ।
জেটিতে লঞ্চ নোঙর করার পর লঞ্চ থেকে নামল সবাই। গঞ্জালো বলল, ‘একটা ছোট নৌকা জোগাড় করতে হবে অন্তত তিন-চারজন বসার উপযোগী। সরু খাঁড়ির ভিতরে ঢুকতে হলে সেখানে তো আর লঞ্চ থাকবে না।’
জেটি ছেড়ে গ্রামের ভিতর ঢুকল তারা। সামনে কিছুটা এগোতেই একটা ছোট বাজার মতো জায়গা। সেখানে স্থানীয় জেলে মাঝিদের আড্ডা। শনের ছাউনি দেওয়া বেশ কয়েকটা দোকানঘরও রয়েছে। একটা দোকানে চা-বিস্কুট ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে দেখে সন্দীপ বলল, ‘চলুন চা খাওয়া যাক।’
ডক্টর লাহিড়ী বললেন, ‘এখন চা খাবার ইচ্ছা নেই। আপনি বরং এখানে বসে চা খান। আমরা নৌকার খোঁজ করি।’
সন্দীপ এগিয়ে গেল দোকানটার দিকে। কেঠো বেঞ্চে বসে এক কাপ চা দিতে বলল দোকানিকে। চা দেবার পর দোকানদার জানতে চাইল ‘আপনারা কি ট্যুরিস্ট? এই ভরা বর্ষায় সুন্দরবনে তো কেউ আসে না?’
সন্দীপ হেসে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, টুরিস্ট। আমরা বর্ষাকালে সুন্দরবনের ছবি তুলতে এসেছি।’
লোকটা তার কথা শুনে সন্দীপকে বলল, ‘আমার কাছে কিছু জিনিস আছে আপনাকে দেখাচ্ছি। সামান্য দামে। কিন্তু লক্ষ টাকা দিলেও এ জিনিস এ জায়গা ছাড়া অন্য কোথাও পাবেন না,’ এই বলে সে দুটো কাগজের মোড়ক এনে হাজির করল তার কাছে। তার একটার মধ্যে থেকে বেরোল প্লাস্টার প্যারিসে তুলে আনা বাঘের পায়ের ছাপ। আর অন্যটার থেকে বেরোল কয়েকটা লম্বা লম্বা দাঁত! সেগুলো দেখিয়ে দোকানি বলল ‘এগুলো কুমিরের দাঁত। গায়ে পরলে জ্বর আসেনা।’
সেই দাঁতগুলোর দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল সন্দীপ। তার চোখে ভেসে উঠল বহুদিন আগের এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য! চাঁদের আলোতে জল থেকে মাথা তুলে ড্যাবড্যাবে চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে বিশালাকৃতির এক কুমির! তার হাঁ করা মুখে ভয়ঙ্কর চোয়ালে জেগে আছে এমনই সারসার তীক্ষ্ন দাঁত। যে দাঁত বনের রাজা বাঘকেও ছিঁড়ে ফেলতে পারে! মোহনার কুমিরের দাঁত!
তাকে চমকে উঠতে দেখে দোকানদার বলল, ‘কী হল বাবু?’
সন্দীপ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘কিছু না। জিনিসগুলো ভালো। এ পথেই তো ফিরব। দেখি তখন কিনতে পারি।’ নিশীথ লাহিড়ীরা কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলেন একটা লোককে নিয়ে। নৌকা পাওয়া গেছে। এ লোকেরই নৌকা। নৌকাটাকে অবশ্য এদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হবে না। তার নৌকাটা কিনে নেওয়া হচ্ছে। লঞ্চের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হবে নৌকাটা। সন্দীপরা আবার জেটিতে ফিরে এল। নৌকাটা এনে লঞ্চের সঙ্গে বাঁধতে বেশ অনেকটা সময় কেটে গেল। তারপর বনরক্ষী বাহিনীর লোকরা কৌতূহলবশত তাদের কাছে এসে লঞ্চ আর গঞ্জালোর জঙ্গলে ঢোকার অনুমতিপত্র পরীক্ষা করল। এসব কাজ যখন মিটল তখন নদীর বুকে আবীর গুলে সূর্য অস্ত যেতে বসেছে। ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে সন্দীপ তাকিয়ে রইল দূরের কালো কালো বিন্দু দ্বীপগুলোর দিকে। একসময় অস্পষ্ট হয়ে যেতে লাগল সেই বিন্দু আলো। অন্ধকার নামতে শুরু করল নদীর বুকে।
।। ৪।।
পরদিন ভোরের আলো ফোটার পর সজনেখালি থেকে আসল সুন্দরবনে প্রবেশ করার জন্য রওনা হল সন্দীপদের লঞ্চ। ক্রমশ পিছনে সরে যেতে লাগল সজনেখালির জেটি। এদের যাত্রাপথের দু-পাশে কাছে দূরে জেগে উঠতে লাগল ছোট-বড় নানা দ্বীপ। বর্ষাকাল বলে নদীর জল এখনও বেশি। চরগুলো ডুবে আছে নদীর জলে। সুন্দরী গরান গেঁওর জঙ্গল দ্বীপগুলোতে। কিছু সময় পর লঞ্চ এসে উপস্থিত হল পঞ্চমুখানী। পাঁচ দিক থেকে পাঁচটা নদী বা বড় খাঁড়ি এসে মিশেছে এখানে। তারপর সেই ঘোলাটে জল পাক খেতে খেতে এগোচ্ছে মোহনার দিকে। পঞ্চমুখী থেকে মোহনার দিকের পথই ধরল লঞ্চটা। সন্দীপ দাঁড়িয়েছিল সারেঙের কেবিনের পাশেই। লঞ্চের এ জায়গা থেকে সামনের জলপথ আর নদীর দু-পাশ দৃশ্যমান হয়। একপাশের ডেকে চেয়ারে বসে আছেন ডক্টর নিশীথ লাহিড়ী ও গঞ্জালো। আরও কিছুটা এগিয়ে লঞ্চ প্রবেশ করল একটা বড় খালে। আসল জঙ্গল শুরু হল এবার। সুন্দরী আর বাইনের ঘন জঙ্গল। সূর্যের আলো প্রবেশ করছে না সেখানে। তার গোড়াগুলো জলের নীচে ডুবে আছে। নদীর বিস্তীর্ণ চরগুলোও জলের তলায়। সারেঙ সন্দীপকে বলল, ‘জায়গাটা চিনতে পারছেন? চোরাগাজীখাল। যেখানে আপনি কুমির দেখেছিলেন বলে বলছিলেন।
হ্যাঁ, এই সেই জায়গা। সেখানে নদীর চরে সেবার যাবার পথে বিরাট বড় একটা কুমির দেখেছিল সন্দীপ। আর বনকর্মীরা যখন প্রফেসরের সেই ডেরা থেকে সন্দীপকে নিয়ে ফিরছিল তখন এখানেই জলের মধ্যে থেকে একটা বিরাট বড় কুমির মাথা তুলেছিল। সন্দীপ ভালো করে তাকাতে লাগল জলের দিকে আর দুপাশের জঙ্গলের দিকে। কে বলতে পারে এই দুপাশের কোনো জঙ্গলের আড়াল থেকে লঞ্চটাকে হয়তো লক্ষ করছেন প্রফেসর।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই লঞ্চ পৌঁছে গেল নেতিধোপানিতে। চোখে পড়ল একটা ছোট জেটি। তার দুপাশের নদীর পাড় জাল দিয়ে ঘেরা। যাতে নদী পেরিয়ে বাঘ সেখানে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য। নেতিধোপানিতে বনদপ্তরের একটা ওয়াচটাওয়ার আছে। সাধারণ পর্যটকদের এ পর্যন্তই আসতে দেওয়া হয়। এর পর থেকেই শুরু হচ্ছে সুন্দরবনের ‘কোর এরিয়া’ বা অন্তঃপুর। সেখানে ঘুরে বেড়ায় সেই ডোরাকাটা প্রাণীগুলো। গরান গাছের আড়ালে যাদের চোখ ভাঁটার মতো জ্বলে। জঙ্গলের ভিতর থেকে হলুদ বিদ্যুতের মতো বেরিয়ে এসে যারা ঘাড় কামড়ে ধরে জঙ্গলের ভিতর টেনে নিয়ে যায় মানুষকে। সুন্দরবনের রাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
নেতিধোপানির জেটিতে থামল না লঞ্চ। থামার কথাও নয়, জেটিকে পাশে রেখে সে এগিয়ে চলল। সন্দীপ এবার ডক্টর লাহিড়ীদের কাছে গিয়ে বসল। নিশীথ তার কোলের ওপর সুন্দরবনের একটা ম্যাপ রেখে সেটা মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন। সন্দীপ পাশে বসতেই তিনি বললেন, ‘আশা করি আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমরা চামটাতে পৌঁছে যাব তাই না?’
সন্দীপ জবাব দিল ‘হ্যাঁ, তেমনই মনে হয়। আপনারা সুন্দরবনের এদিকে কখনও এসেছেন?’ নিশীথ বললেন, ‘আমি বিদেশ যাবার আগে কলেজ লাইফে একবার এসেছিলাম।’
গঞ্জালো বললেন ‘আমি বার তিনেক এসেছি বটে ছবি তুলতে এদিকে। তবে নেতিধোপানি পর্যন্তই। বাংলাদেশের সুন্দরবনের কোর এলাকাতে ঢুকলেও এদিকে কোর এলাকাতে ঢোকার অনুমতি মেলেনি। এবারই প্রথম পেলাম।’
নিশীথ বললেন, ‘ভেবেছিলাম আমার মোবাইলের গুগল ম্যাপ থেকে সাহায্য পাব। কিন্তু এদিকে তো দেখছি মোবাইলের টাওয়ারই আসছে না।’
গঞ্জালো বললেন, ‘আমরা তো কোর এলাকাতে প্রবেশ করছি। এসব জায়গাতে স্যাটেলাইট ফোন ছাড়া অন্য কিছু কাজ করে না।’
নিশীথ এরপর বললেন, ‘আমরা যদি আজই প্রফেসর সোমকে খুঁজে বার করতে পারি, তাকে ফিরিয়ে আনতে পারি তবে সেটা বিরাট ব্যাপার হবে। তবে সেটা অনেকটাই নির্ভর করছে, সন্দীপ আপনার ওপর।’
সন্দীপ জবাব দিল, ‘দেখি, কী করতে পারি।’
ডক্টর নিশীথ হঠাৎই প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা আপনি তো দীর্ঘদিন প্রফেসরের সাথে এক বাড়িতে কাটিয়েছেন, এখানেও প্রফেসরের কাছে এসেছিলেন। আশা করি আপনি জানেন যে প্রফেসর কী ব্যাপারে গবেষণা করছিলেন?’
এ প্রশ্নের উত্তর এখন সন্দীপের জানা। এমন কী প্রফেসর সোম তাঁর গবেষণায় কতটা সফল হয়েছেন সেই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটাও জানে। সে কারণে সন্দীপ প্রথমে এখানে আসতে চায়নি। কিন্তু প্রফেসরের গবেষণার অন্তিম পরিণতি তাঁদের বলা উচিত হবে কিনা বুঝতে না পেরে সে শুধু জবাব দিল, ‘শুনেছি জিনতত্ত্বের কোনো এক কঠিন ব্যাপার নিয়ে তিনি গবেষণা করছিলেন। এক প্রাণীর জিন অন্য প্রাণীর দেহে প্রতিস্থাপনের কাজ। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র নই। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারব না।’
এ জবাব দিয়ে সন্দীপ পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘আপনিও তো একই বিষয়ে গবেষণা করছিলেন বলে বলেছিলেন? আপনি কি আপনার গবেষণাতে সফল হয়েছিলেন?’
ডক্টর লাহিড়ী প্রশ্নটা শুনে যেন একটু থমকে গেলেন। তারপর বললেন ‘হ্যাঁ, একই বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করছিলাম। জটিল গবেষণা। যে ব্যাপারে বললে আপনি চট করে বুঝবেন না। পরে ধীরেসুস্থে আপনাকে গুছিয়ে বলব। আপাতত প্রফেসর ঘোষকে কীভাবে খুঁজে বার করা যায় সে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবি।’
সন্দীপের মনে হল নিশীথ যেন গোপনে তার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন কৌশলে।
কথা বলতে লাগল তারা। লঞ্চ এগিয়ে চলল। পূব দিকে এগোতে এগোতে একটা সময় নদীর সঙ্গমে পৌঁছে গেল লঞ্চ। সেখান থেকে দক্ষিণের জলপথ ধরল তারা। বেশ কিছুক্ষণ খাঁড়ি বেয়ে চলার পর পাইলট কেবিন থেকে সারেঙের গলা শোনা গেল ‘চামটা দেখা যাচ্ছে!’
তার কথা শুনে সারেঙের কেবিনের পাশে লঞ্চের সামনের দিকে এসে দাঁড়াল সবাই। হ্যাঁ, অনেক দূরে একটা কালো বিন্দু দেখা যাচ্ছে। ওটা চামটা। সুন্দরবনের অন্যতম ভয়ঙ্কর দ্বীপ। রয়েল বেঙ্গল বাঘের খাস তালুক! যে দ্বীপে নামলে নাকি প্রায় কেউই ফেরে না! নেহাত বরাত জোরে সেখান থেকে ফিরে এসেছিল সন্দীপ। গঞ্জালো খোলে নেমে গিয়ে একটা বাইনোকুলার নিয়ে এল। তার হাত থেকে সেটা নিয়ে তাতে চোখ রাখল নিশীথ। ধীরে ধীরে সেই কালো বিন্দুটা বড় হতে লাগল, কাছে এগিয়ে আসতে লাগল। এক সময় জল কেটে চামটার কাছে পৌঁছে গেল লঞ্চ। চামটা আসলে একটা ভূখণ্ড নয়। ঘনিষ্ঠভাবে থাকা অজস্র ছোট বড় দ্বীপের সমষ্টি। অগুনতি খাঁড়ি এঁকে বেঁকে প্রবাহিত হয়েছে তার মধ্যে দিয়ে। দু-পাশের জঙ্গল সেখানে নুইয়ে থাকে খাঁড়ির বুকে। দিনের বেলাতেও সূর্যালোক যেখানে প্রবেশ করে না। জঙ্গল এত ঘন যে এক হাত দূরের জিনিসও তার ভিতর ঠাহর হয় না। তার আড়ালে লুকিয়ে থাকা শ্বাপদের মাঝে নৌকায় বসে থাকা লোকেদের মাত্র একটা লাফের ব্যবধান হয়। হ্যাঁ, জীবনমৃত্যুর মধ্যে ব্যবধান শুধু একটা লাফের। ও ভাবেই মানুষ তুলে নিয়ে যায় বাঘ। কখনও বা খাঁড়ির গায়ে গাছের নীচে মরা গাছের গুঁড়ির মতো শুয়ে থাকে বিশাল বিশাল মোহনার কুমির। বাঘের মুখ থেকে ফিরে এসেছে এমন দু’-চারজন লোকের দেখা কখনো কখনো সুন্দরবনে মেলে, কিন্তু কুমিরের ওই ভয়ঙ্কর চোয়াল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছে এমন মানুষের দেখা মেলা ভার।
চামটার গায়ে নদীপথে প্রবেশ করার সময় সারেঙ বলে উঠল ‘জয় বনবিবির জয়! জয় বাবা দক্ষিণ রায়ের জয়!
দ্বীপের গা ঘেঁষে এগোতে থাকল লঞ্চ। এবার সন্দীপ ভিতরে ভিতরে উত্তেজনা বোধ করতে শুরু করল। তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইল বনের দিকে। ডক্টর নিশীথ আর গঞ্জালোর দৃষ্টিও বনের দিকে নিবদ্ধ। কিন্তু বনের ভিতর কিছু দেখা যাচ্ছে না। যেন নিশ্ছিদ্র অন্ধকার বিরাজ করছে বনের ভিতর। কোনো শব্দ ভেসে আসছে না। একটা পাখির ডাকও নয়। থমথমে এক রহস্যময় পরিবেশ যেন ঘিরে রেখেছে জঙ্গলটাকে। দ্বীপের পাশ দিয়ে কিছুটা পথ এগোবার পর ডানপাশে শুরু হল হলদি দ্বীপ। বাঘের আর এক ডেরা। সেখানেও বিরাজ করছে একই রকম নৈঃশব্দ। দুটো দ্বীপের মাঝখানের চওড়া খাঁড়ি বেয়ে সন্দীপেরা এগিয়ে চলল। দুপাশের জঙ্গলের নিস্তব্ধতার ছোঁয়া যেন লঞ্চের পরিবেশটাকেও পাল্টে দিয়েছে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। সবারই নজর সামনের যাত্রাপথ আর দুপাশের যাত্রাপথের দিকে।
বেশ কিছুটা পথ এভাবে চলার পর হঠাৎই নদী বাঁক নিল। চামটার ভিতর থেকে আরও একটা বড় খাঁড়ি এসে মিশেছে সেখানে। মুহূর্তের মধ্যে জায়গাটা চিনে ফেলল সন্দীপ। এখানেই তো প্রফেসর তাকে নিতে এসেছিলেন! সন্দীপ সারেঙকে বলল, ‘লঞ্চ থামাও। আমরা, আমাদের জায়গার কাছে চলে এসেছি।’ সারেঙ তাদের সতর্ক করে বলল, ‘এখানে লঞ্চ থামালে বিপদ হতে পারে কিন্তু। যে কোন মুহূর্তে বাঘ বেরিয়ে এসে হানা দিতে পারে লঞ্চে।’
কিন্তু তার কথা শুনে গঞ্জালো বলে উঠল, ‘তুমি লঞ্চ থামাও। বাঘকে ঠেকানোর ব্যবস্থা আমরা করছি।’ এই বলে সে ছুটে গিয়ে খোলের ভিতর থেকে যে জিনিসটা নিয়ে এল তা দেখে চমকে গেল সন্দীপ। একটা বন্দুক! গঞ্জালো মৃদু হেসে বলল ‘ছবি তুলতে বনে বনে ঘুরি তো। এটা আমার সঙ্গে থাকে।’
লঞ্চ দাঁড়িয়ে পড়ল।
নদীর চরে আকাশের দিকে দু-হাত তোলা বাজপড়া শিমুল গাছটা আজ আর দাঁড়িয়ে নেই। শিকড় সমেত সে উপড়ে পড়েছে খাঁড়ির দিকে। হয়তো বা আয়লার ফল। গোড়ার দিকের গুঁড়ির কিছুটা অংশই শুধু জেগে আছে জলের বাইরে। গুঁড়িটা দেখিয়ে সন্দীপ বলল, ‘ওই জায়গা থেকেই প্রফেসর আমাকে তার ডেরায় নিয়ে গেছিলেন।’ ওই যে পাশে একটা সরু খাঁড়ি জঙ্গলের ভিতর ঢুকেছে সেটা দিয়ে।
ডক্টর নিশীথ লাহিড়ী বললেন, ‘তবে ও পথেই যেতে হবে আমাদের।’
সারেঙ বলল, ‘কিন্তু ও খাঁড়িতে তো লঞ্চ ঢুকবে না।’
গঞ্জালো বলল, ‘তবে নৌকা নিয়ে যাব।’
সারেঙ বলল, ‘নৌকা নিয়ে? আমার মনে হচ্ছে, জায়গার বিপদ সম্বন্ধে আপনারা ঠিক বুঝতে পারছেন না।
নিশীথ বললেন, ‘তাহলেও আমাদের যেতে হবে।’
আর এর পরই একটা দৃশ্য দেখতে পেল সন্দীপরা। নির্জন চরে জলে ডুবে থাকা গাছের গুঁড়িটার দিকে তাকিয়ে তারা কথা বলছিল। গুঁড়ির যে অংশটা জলের বাইরে বেরিয়ে ছিল সেটার ওপরটা হঠাৎ যেন নড়ে উঠল। ভালো করে তাকিয়ে সন্দীপরা দেখতে পেল সেই গাছের গুঁড়িটার ওপর শুয়ে আছে বিশাল একটা কুমির। এমনভাবে সে কালো গুঁড়ির সাথে নিজের কালো দেহ মিলিয়ে শুয়ে আছে যে ভালো করে না দেখলে তার উপস্থিতি বোঝাই যায় না! কুমিরটাও এর পর যেন বুঝে ফেলল যে লঞ্চে থাকা লোকগুলো দেখতে পেয়েছে তাকে। ঘাড়টা উঁচু করে কিছুক্ষণ সে তাকিয়ে রইল লঞ্চের দিকে। তাকে দেখেই বুকের মধ্যে একটা ধুকপুকানি অনুভব করল সন্দীপ। এ কি সেই???
লঞ্চের দিকে তাকিয়ে সন্দীপদের দেখল কুমিরটা। তারপর ধীরে ধীরে জলে নেমে গেল।
সারেঙ বলে উঠল, ‘দেখলেন, কেন বললাম কথাগুলো? আয়লার পর এখানে কাছেই একটা দ্বীপ জেগেছে। যেখানে প্রচুর বড় বড় কুমির থাকে। এত কুমির যে তার নামই হয়েছে ‘কুমির দ্বীপ।’ তারা ঘুরে বেড়ায় এসব খাঁড়িতে। এ কথাটা আমি এই মাস্টারবাবুকে কালই বলেছিলাম।’
নিশীথ বললেন, ‘কিন্তু যেতে আমাদের হবেই। নৌকা থামাতে হবে।’
সারেঙ বলল, ‘ঠিক আছে তবে তাই হবে।’
সারেঙ তার সহকারীকে লঞ্চ সামলাবার দায়িত্ব দিয়ে নৌকাতে নেমে পড়ল। একটা গাদা বন্দুকও সে সঙ্গে নিল। অতি প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে একে একে সন্দীপরা তিনজনও নেমে পড়ল নৌকাতে। নৌকাতে বেশ কয়েকটা এমন জিনিস খোলের ভিতর পাওয়া গেল যা কাজে লাগবে সন্দীপদের। এক গোছা প্লাস্টিকের মুখোশ। সুন্দরবনের খাঁড়িতে যেসব জেলেরা মাছ ধরতে যায় বা কাঠ কাটতে যায়, তারা এই মানুষের মুখের মুখোশগুলো মাথার উল্টো দিকে পরে বাঘকে বোকা বানানোর জন্য। সামনে পিছনে যেদিক দিয়েই বাঘ থাকুক না কেন যাতে সে ভাবে মানুষের মুখটা তার দিকেই ঘোরানো। মুখোশগুলো একইভাবে পরে নিল সন্দীপরা। তবুও সারেঙ তাদের সতর্ক করে বলল, ‘আপনারা তিনজন তিন দিকে মুখ করে বসুন। একজন পিছন দিকে। অন্য দুজন দুপাশের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে। আর কেউ কোনো কথা বলবেন না প্রয়োজন না হলে। সারেঙের পিছনে এক দিকের জঙ্গলের দিকে মুখ করে বসল সন্দীপ। নিশীথ লাহিড়ীর বাইনোকুলারটা নিজের কাছে নিল সে। লঞ্চের কাছ ছেড়ে ধীরে ধীরে খাঁড়ির দিকে দাঁড় বাইতে শুরু করল সারেঙ।
খাঁড়িতে প্রবেশ করল নৌকা। এবার যেন সত্যিই অন্য এক পৃথিবীতে প্রবেশ করল তারা। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে এগিয়েছে খাঁড়ি। দু’পাশের গাছপালা প্রায় ঝুঁকে পড়েছে নৌকার ওপর। হাত বাড়ালেই গাছের ডাল ধরা যায়। তবে জঙ্গলের ভিতর এক হাত দূরেও দৃষ্টি যাচ্ছেনা। আর সবচেয়ে অস্বস্তিকর ব্যাপার হল জঙ্গলের নিস্তব্ধতা। যেন কোনো ভয়ঙ্কর ঘটনার প্রত্যাশায় থমকে আছে সব কিছু। মাঝেমাঝেই নানা ছোট ছোট খাঁড়ি এসে মিশেছে সন্দীপদের যাত্রাপথে। তাদের ভিতর দিকে তাকালে অতি বড় সাহসীরও গা ছমছম করবে। এখন বেলা দশটা বাজে। কিন্তু রাত্রির অন্ধকার বিরাজ করছে সেখানে। চলতে লাগল সন্দীপরা। একবার একটা বিরাট সাপ দেখল তারা। একটি জায়গাতে খাঁড়ির ধারে মাটি ভেদ করে উপরে উঠে থাকা শূর্নী বা গাছের শ্বাসমূল জড়িয়ে আছে সাপটা। সুন্দরবনের আর এক মৃত্যুদূত হল এরা। এদের এক ছোবলেই সাবাড় হয়ে যায় মানুষ। বাঘ, কুমিরের কামড়ের চেয়েও প্রতি বছর সুন্দরবনে অনেক বেশি মানুষ মারা যায় সাপের কামড়ে।
চলতে থাকল নৌকা। সন্দীপ যাত্রাপথ অনুমান করে মাঝেমাঝে চাপা স্বরে নির্দেশ দিতে থাকল সারেঙকে। বেশ অনেকটা পথ চলার পর হঠাৎই একটা সরু খাঁড়ির মুখে একটা জিনিস চোখে পড়ল সন্দীপের। খাঁড়িপারে কাদা মাটিতে গেঁথে আছে একটা তক্তা। না, সেটাকে কোনো নৌকার তক্তা বলে মনে হচ্ছেনা। ভালো করে সেটাকে দেখার পর সন্দীপরা বুঝতে পারল সেটা একটা দরজার পাল্লা! এখনও তার গায়ে একটা লোহার কড়া লাগানো আছে। খাঁড়ির ভিতর থেকেই কোনো সময় ভেসে এসে সেটা খাঁড়ির মুখে আটকে গেছে। সন্দীপ বলল, ‘এ খাঁড়িতে নৌকা ঢোকাও।’
নির্দেশ পালিত হল। নৌকা ঢোকানো হল খাঁড়িতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গার ফাঁক দিয়ে কিছু দূরে চোখে পড়ল একটা খুঁটি আর লোহার জালের কিছু অংশ। সন্দীপ বলল, ‘নৌকা চরে লাগাও আমরা পৌঁছে গেছি।’
কথাটা শুনেই উজ্জল হয়ে উঠল নিশীথের চোখমুখ। তিনি বললেন, ‘এত সহজে যে পৌঁছে যেতে পারব ভাবিনি।’ মৃদু দৃষ্টি বিনিময় হল তার আর গঞ্জালোর মধ্যে।
নৌকা থেমে গেল। পাড়ে নামল সবাই। সামনে আর পিছনে বন্দুক নিয়ে গঞ্জালো আর সারেঙ। মাঝে সন্দীপ ও নিশীথ। সে জায়গার দিকে এগোল এরা। জায়গাটার দিকে সন্দীপ যত এগোতে থাকল তত তার বুকের ধুকপুকানি বাড়তে থাকল। এখানে এখন যদি সত্যি প্রফেসরের দেখা মিলে যায় তবে সন্দীপকে দেখে তার প্রতিক্রিয়া কী হবে? এখন কী অবস্থায় আছেন প্রফেসর? সন্দীপ শেষ যে অবস্থায় তাঁকে দেখেছিল তেমনই নাকি? নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনতে শুনতে কাদামাটি ভেঙে হাঁটতে লাগল সে। এখানের চারপাশের নিস্তব্ধতা যেন আরও বেশি গাঢ়, আরও বেশি ভয়ঙ্কর!
।। ৫।।
কিছুটা এগিয়ে সন্দীপরা উপস্থিত হল সেই জালের কাছে। ভিতরের ফাঁকা জমিটার মধ্যে আজও রয়েছে সেই কাঠের বাড়িটা। তবে বাড়িটা অক্ষত অবস্থায় আর নেই। যে শাল কাঠের গুঁড়ির ওপর কাঠের রেলিং দেওয়া বারান্দা সমেত চারটে ঘর দাঁড়িয়েছিল সেই গুঁড়িগুলোর একদিকের অংশ ভেঙে গিয়ে বাড়ির শেষ অংশটা পিছনের খাঁড়ির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বাড়ির শেষ প্রান্তে যে ঘরটাতে প্রফেসর থাকতেন সেদিকের চালটাও উড়ে গেছে। খাঁড়ির দিকে পিছনের বারান্দাটা না দেখা গেলেও সামনের বারান্দার কাঠের রেলিংগুলোর আজ আর কোনো অস্তিত্ব নেই। অধিকাংশ দরজা জানলাই কপাটবিহীন। হয়তো আয়লার সময় বা অন্য কোনো ঝড়বৃষ্টিতে সেগুলো খাঁড়িতে ভেসে গেছে। তার একটা নিদর্শনই তো এই কাঠের বাড়ির কাছে সন্দীপদের পৌঁছে দিল। এক ঝলক দেখেই সন্দীপদের মনে হল এ বাড়িতে বহুকাল আর কেউ থাকে না। বাড়ি আর তার সামনের জমিটা আজ আর সর্বত্র জাল ঘেরা নয়। খুঁটি উপড়ে অনেক জায়গাতেই মাটিতে শুয়ে পড়েছে লোহার জালগুলো। তা মাড়িয়েই সন্দীপরা বাড়ির সামনের জমিতে পা রাখল। কিন্তু কয়েক পা এগিয়েই সুন্দরবনের সারেঙের চোখে ধরা পড়ে গেল সামনের কাদামাটির ওপর আঁকা একটা জিনিস। জোয়ারের সময় বাড়ির পিছনের খাঁড়ির জল উঠে এসে আজও ভিজিয়ে দেয় বাড়ির সংলগ্ন জমিটাকে। সেই নরম মাটির ওপর আঁকা হয়ে আছে বাঘের পায়ের ছাপ! সারেঙের ইশারাতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই। ছাপগুলো পরীক্ষা করার পর সারেঙ বলল এগুলো একটা জোয়ান বাঘের ‘খোঁচ’। অর্থাৎ পায়ের ছাপ। জায়গাটাতে বাঘের আনাগোনা আছে মনে হচ্ছে। সম্ভবত গতকালই ছাপগুলো পড়েছে। সাবধান।
এমনিতেই সন্দীপরা সতর্ক ছিল, সারেঙের কথা শুনে আরও সতর্ক হয়ে গেল সবাই। সাবধানে তারা ঘুরে দেখতে লাগল বাড়ি সংলগ্ন জমিটা। নানা জায়গাতেই রয়েছে সেই বাঘের পায়ের ছাপ। ঘুরতে ঘুরতে তারা উপস্থিত হল বাড়িটার একপাশে ছোট পুকুরের মতো বাঁধানো চৌবাচ্চার সামনে। নিশীথ, সন্দীপকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই বিরাট চৌবাচ্চাটি কী কাজে লাগত জানেন?’
সন্দীপ জবাব দিল, ‘প্রফেসর সর্দার গোসাপ বা মনিটর লিজার্ড পুষতেন তার গবেষণার জন্য। স্থানীয় মানুষরা যাকে ‘তারখেল’ বলে। আমি যখন এসেছিলাম তখন প্রচুর তারখেল ছিল এখানে।’
গঞ্জালো বলল হঠাৎ ‘সুন্দরবন অঞ্চলে প্রচুর তারখেল মেলে। আমি ছবি তুলেছি ওদের।’
জমিটা দেখা হয়ে গেলে হেলে পড়া বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল সবাই। বারান্দার রেলিং অদৃশ্য হলেও ওপরে ওঠার ঢালু কাঠের পাটাতনটা কিন্তু এখনও আছে। নিশীথ বললেন, ‘প্রফেসর এখানে নেই বলেই মনে হচ্ছে। তবুও ওপরে একবার ঘুরে আসা যাক।’
ওপরে বারান্দায় ওঠার জন্য কাঠের পাটাতনে পা রাখল গঞ্জালো। মচমচ শব্দ করে উঠল কাঠের পুরানো পাটাতন। তবুও তাই বেয়ে প্রথমে ওপরে উঠল গঞ্জালো। তারপর এক এক করে নিশীথ ও সন্দীপও। এদিকে মুখ করে একটা মাত্র ঘরের দরজা। অবশ্য আজ আর তার পাল্লা নেই। এ ঘরেই থাকত সন্দীপ। ঘরটাতে প্রবেশ করল তারা। একটা কেঠো টেবিল, একটা চেয়ার আর একটা চৌকি ছিল এ ঘরে। জলে পচে সেগুলো টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে ছড়িয়ে আছে। আরও একটা জিনিস ঘরের কোণে চোখে পড়ল সন্দীপের। একটা মরচে ধরা লোহার খাঁচা। সন্দীপ খাঁচাটা দেখিয়ে বলল, ‘এই খাঁচায় করে জঙ্গল থেকে একটা বাঘের বাচ্চা এনেছিলেন প্রফেসর। আমার সঙ্গে এ ঘরেই শেষ কথা হয়েছিল প্রফেসরের। পূর্ণিমার রাত ছিল। জোয়ারের জল ক্রমশ বাড়ছিল। আর তাতে প্লাবিত হচ্ছিল নীচের জমিটা। প্রফেসর এ ঘরে ঢুকে আমাকে জোর করে একটা ইনজেকশন দেবার চেষ্টা করছিলেন। এমন সময় বাচ্চার খোঁজে এ ঘরে ঢুকল বাঘিনী। সে ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রফেসরের ওপর। ধস্তাধস্তি শুরু হল। ঘর থেকে বারান্দা হয়ে তারা দুজনই একসাথে মাটিতে ছিটকে পড়ল।’
গঞ্জালো বলে উঠল ‘তারপর?’
সন্দীপের চোখে মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠল দশ বছর আগে সামনের জমিটাতে চাঁদের আলোতে দেখা সেই দৃশ্য। বিরাট এক মোহনার কুমিরের চোয়ালের মাঝে আটকে পড়ে ছটফট করতে করতে ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে বনের রানি! তবে গঞ্জালোর কথার উত্তরে বিস্তৃত ব্যাখ্যার মধ্যে গেল না সন্দীপ। সে বলল, ‘একটা বিরাট বড় কুমির- মোহনার কুমির আক্রমণ করল বাঘিনীকে। মারা পড়ল বাঘিনী। বেঁচে গেলেন প্রফেসর নীলকান্ত ঘোষ।’
নিশীথ বললেন, ‘নিশ্চয়ই জোয়ারের জলে ওপরে উঠে এসেছিল কুমিরটা?’
সন্দীপ মৃদু হেসে বলল ‘তাই হবে হয়তো।’
এ ঘরটা দেখা হলে তারা উপস্থিত হল পিছনের বারান্দায়। খাঁড়ির দিকে হেলে পড়েছে সেটা। খুব সাবধানে দেওয়াল ধরে পাশের ঘরগুলোতে ঢোকার জন্য এগোল তারা। সন্দীপের পাশের ঘরটাই সে সময় ছিল প্রফেসরের ভাঁড়ার ঘর, তারপর প্রফেসরের ল্যাবরেটরি। আর তার ওপাশে প্রফেসরের শোবার ঘর। ল্যাবরেটরি দিয়েই প্রফেসরের শোবার ঘর আর ভাঁড়ার ঘরে ঢোকা যেত। সেই ল্যাবরেটরিতেই প্রথম পা রাখল সন্দীপরা। সেখানের বড় বড় টেবিলগুলো সব উইপোকা লেগে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে। নানা যন্ত্রপাতি, কাচের জার ইত্যাদিও ভেঙে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মেঝেতে। ঘরের মাঝখানে একটা হাঁ করা গর্ত। যেখান থেকে কাঠের পাটাতন বেয়ে নীচে নেমে যাওয়া যেত। নিশীথ বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন ঘরটা। সন্দীপের মনে হল ডক্টর নিশীথ নিজে বিজ্ঞানী বলেই হয়তো আগ্রহ নিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন প্রফেসর ঘোষের এই ল্যাবরেটরি। নানা জিনিসপত্র মাঝে মাঝে তিনি উঠিয়ে নিয়ে দেখলেন। এমনকি গঞ্জালোও মাটিতে পড়ে থাকা কিছু জিনিস নিয়ে দেখল। এরপর প্রথমে প্রফেসরের শোবার ঘরে উঁকি দিল তারা। শূন্য ঘর। কিছুই নেই সেখানে। সন্দীপের যত দূর মনে পড়ে সেবার এ ঘরে একটা খড়ের বিছানা আর কিছু জামাকাপড় ছাড়া কিছুই দেখেনি সে। এ ঘরটার মাথার ওপরের চাল উড়ে গেছে। সূর্যের আলোতে সব কিছুই স্পষ্ট দৃশ্যমান। না, কিছুই নেই এ ঘরে। ল্যাবরেটরির অন্য প্রান্তে গিয়ে এবার ভাঁড়ার ঘরটার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল তারা। দরজার পাল্লাগুলো খসে পড়েছে। এ ঘরটাতে কিন্তু আলো প্রবেশ করছে না। গঞ্জালো তার পিঠের ব্যাগ থেকে একটা বড় টর্চ বার করে সেটা জ্বালালো। ঘরে ঢুকল সবাই। নানা ধরনের জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে সেখানে। তার মধ্যে মরচে পড়া করাত, হাতুড়ি, আর কিছু লোহার জিনিসও আছে। সম্ভবত বস্তার মধ্যে রাখা ছিল জিনিসগুলো। চটের বস্তা নষ্ট হয়ে গিয়ে সেগুলো মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
সন্দীপ বলল, ‘এ ঘরটা কিন্তু প্রফেসরের ভাঁড়ার ঘর ছিল।’ টর্চের আলো ফেলে এ ঘরটা যেন আরও বেশি করে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল নিশীথ আর গঞ্জালো। এ ঘরটার মধ্যে কেমন যেন একটা অদ্ভুত বোঁটকা গন্ধ আছে। হয়তো বা এ ঘরে আলো বাতাস প্রবেশ করে না সে জন্যই।
হঠাৎ গঞ্জালো, সন্দীপকে প্রশ্ন করল, ‘আপনি তো এখানে এসেছিলেন আগে। প্রফেসরের ঘরে ডালাওয়ালা, কাঠের কোনো বাক্স দেখেছিলেন? গায়ে লোহার পাত বসানো সিন্দুকের মতো বাক্স? বড় সিন্দুক?’
গঞ্জালোর কথা শুনে সন্দীপ মৃদু বিস্মিত ভাবে বলল, ‘আমার ঠিক খেয়াল পড়ছে না। কিন্তু কেন বলুন তো?’
গঞ্জালো হেসে বলল, ‘এমন কিছু নয়। আসলে তাজউদ্দিনের থেকে আমি শুনেছিলাম যে প্রফেসর নাকি ওই সিন্দুকের মধ্যে কুমিরের ডিম সংগ্রহ করে রাখতেন! বেশ মজার ব্যাপার তাই না? কথাটা মনে পড়ে গেল তাই বললাম।’
সন্দীপ জবাব দিল, ‘ব্যাপারটা বিচিত্র কিছু নয়। প্রফেসর তো সরীসৃপ নিয়ে গবেষণা করতেন। তবে ও বাক্স আমি দেখিনি।’
ডক্টর নিশীথ বললেন, ‘এমনও হতে পারে ওই সিন্দুকের মতো বাক্সটা হয়তো আসলে ইনকিউবেটার বা ডিম ফোটানোর বাক্স। তাজউদ্দিন নামে তোমার ওই মাঝি সেটা চিনতে পারেনি।’ এরপর তিনি হয়তো আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সারেঙ বলল, ‘এ ঘরে একটা গন্ধ পাচ্ছেন আপনারা? এ গন্ধটা কিন্তু ভালো নয়। এ জায়গা ছেড়ে আমাদের তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত।’
নিশীথ বললেন, ‘কেন? এ গন্ধটা তোমার কীসের গন্ধ বলে মনে হচ্ছে?’
একটু চুপ করে থেকে সারেঙ বলল ‘দক্ষিণ রায়ের গায়ের গন্ধ।’
গঞ্জালো এবার সারেঙের উদ্দেশ্যে বলল, ‘দ্যাখো হারান নস্কর। আমাদের কাছে দু-দুটো বন্দুক আছে। তুমি এসব কথা বলে আমাদের ভয় দেখাবার চেষ্টা করছ কেন? তুমি এখানে আসার জন্য যে টাকা চেয়েছিলে সে টাকা আমরা তোমাকে দিয়েছি। এ সব কথা বলে তুমি কি আমাদের তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছো? আমরা এখানে একজনের খোঁজ চালাচ্ছি। বাঘ আসুক বা কুমির। যতক্ষণ না আমরা এখানে তাঁর খোঁজ পাচ্ছি ততক্ষণ এ জায়গা ছেড়ে নড়ব না।’
গঞ্জালোর কথা শুনে সারেঙের নামটা জানতে পারল সন্দীপ। ধমক শুনে মৃদু চুপ করে থেকে হারান বলল, ‘আমি সুন্দরবনের লোক। জলে-জঙ্গলে কোথায় বিপদ ঘটতে পারে সেটা আমি জানি। তাই মাঝে মাঝে আপনাদের সাবধান করছি। ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য নয়। ঠিক আছে আপনারা যা ইচ্ছা করুন। টাকা যখন নিয়েছি তখন যেখানে বলবেন সঙ্গে যাব। তবে যেখানেই যাই না কেন রাতে কিন্তু লঞ্চেই আমি থাকব। সারেঙদের এটাই নিয়ম। এ সব জায়গা ভালো নয়। ও দেশ থেকে সীমানা পেরিয়ে জলদস্যুরা হানা দেয়। লঞ্চ ছিনতাই হয়ে যেতে পারে।’
তার কথার জবাবে গঞ্জালো কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু নিশীথ বললেন, ‘এ সব কথা এখন থাক। প্রফেসর তো এখন এখানে থাকেন না বলেই মনে হচ্ছে। তাঁকে কি ভাবে খুঁজে বার করা যায় তা নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত।’ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল সন্দীপরা। তারপর সামনের বারান্দা হয়ে পাটাতন বেয়ে নীচের জমিতে এসে দাঁড়াল।
ডক্টর নিশীথ বললেন, ‘আমার ধারণা কাছাকাছি কোথাও হয়তো নতুন ডেরা বানিয়েছেন তিনি। আমাদের সে জায়গা খুঁজে বার করতে হবে। আজ-কাল-পরশু আমাদের হাতে তিনটে দিন মাত্র সময় আছে। কাজেই সময় নষ্ট করা যাবে না।
গঞ্জালো বলল, ‘তাজউদ্দিন বলেছিল তিনি এখনও চামটার জঙ্গলেই থাকেন।’
সন্দীপ বলল, ‘কিন্তু অত বড় জঙ্গলে কীভাবে তাকে খুঁজে পাব আমরা?’
নিশীথ বললেন, ‘চেষ্টা তো করতে হবে। চলুন নৌকাতে ফেরা যাক। খাঁড়িগুলো ঘুরে দেখি। তবুও তিনি চারঘণ্টা আজকে সময় পাব তাঁকে খুঁজতে। তবে ও জায়গাকে কেন্দ্র করেই অনুসন্ধান চালাব আমরা। বারান্দার সামনের ঘরটা পরিষ্কার করে ওখানে রাতে থাকব।’
সন্দীপরা এরপর কিছুক্ষণের মধ্যেই সে জায়গা ছেড়ে নৌকায় এসে উঠল। দু’পাশের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে নৌকা চলতে শুরু করল। সতর্ক ভাবে সবাই লক্ষ করতে লাগল দু-পাশের জঙ্গল। কোথাও প্রফেসরের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় কিনা? গঞ্জালো তার ব্যাগ থেকে লম্বা লেন্সের একটা ক্যামেরা বার করে মাঝে মাঝে ছবি তুলতে লাগল। সেই নিস্তব্ধ নিঝুম জঙ্গল, অচেনা অন্ধকার খাঁড়ি, সেই গা-ছমছমে পরিবেশ। সময় এগিয়ে চলল, তার সাথে নৌকাও এগিয়ে চলল। দ্বীপের ঠিক মাঝ বরাবর এগোচ্ছে তারা। হঠাৎ একজায়গায় খাঁড়ির উঁচু পাড়ে লম্বাটে একটা দাগ নজরে পড়ল সন্দীপের। ও দাগ সন্দীপের চেনা। সে হারানকে বলল, ‘এখানে একটু আসুন দেখি। নৌকা আনুন। সন্দীপ উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশটা দেখার চেষ্টা করতে লাগল। সারেঙেরও এবার নজরে পড়ল দাগটা। সে নৌকার দাঁড় তুলে নিয়ে সন্দীপকে বলল, ‘কী দেখছেন আপনি? এখানে কুমির আছে। কথাটা কিন্তু ভয় দেখানোর জন্য বলছি না। এই যে কাদামাটিতে দাগটা দেখুন। বুকে হেঁটে কুমিরের জলে নেমে যাবার দাগ।’
কথাটা শুনে সন্দীপ প্রায় বলেই ফেলতে যাচ্ছিল, ‘সে জন্যই তো এখানে দাঁড়ালাম’। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে সে আবার বসে পড়ে বলল, ‘কিছু না, চলো তুমি।’
নৌকা আবার এগোতে থাকল। ঘণ্টাখানেক চলার পর একটা বড় খাঁড়ির মুখে পৌঁছে গেল তারা। বড় খাঁড়িটা যেদিকে এগিয়ে গেছে সেদিকে দূরে একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। সারেঙের গা ঘেঁষেই বসেছিল সন্দীপ। সে দ্বীপটা দেখিয়েই সারেঙ বলল, ‘ওটা হল কুমির দ্বীপ, আয়লার পর জেগেছে। ওর পিছন দিকে আরও ছোট একটা দ্বীপ আছে।’ এ কথা বলার পর সে নৌকার সবার উদ্দেশে বলল, ‘বেলা তিনটে বাজে। এবার ফিরতে হবে। নইলে আমি আপনাদের নামিয়ে দিয়ে লঞ্চে ফিরতে পারব না। তাছাড়া ওই দেখুন আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। বৃষ্টি নামতে পারে।’
নৌকার মুখ এরপর ঘুরে গেল। যে পথে তারা এসেছিল সে পথেই ফিরে চলল নৌকা। জোরে দাঁড় বাইতে লাগল হারান। তারা যখন বাড়ির কাছে সেই খাঁড়িতে পৌঁছল তখন বিকাল হয়ে গেছে। পরদিন ভোরে আবার আসবে বলে খাঁড়ির পাড়ে তাদের তিনজনকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল সারেঙ।
সন্দীপরা গিয়ে উপস্থিত হল বাড়িটার সামনে। আকাশে মেঘের খণ্ডটা আকারে বড় আর ঘন হতে শুরু করেছে। বর্ষার মেঘ। বৃষ্টি নামতে পারে। হেলে যাওয়া বাড়িটার ওপরে উঠল সন্দীপরা। হাতে হাতে ঘরের মেঝেটা পরিষ্কার করে প্লাস্টিকের চাদর বিছানো হল। এ সব করতে করতেই সূর্য ডুবল আর তার সাথে সাথে মেঘে ঢেকে যেতে লাগল আকাশ। সন্ধ্যার পর থেকেই টিপটিপ করে বৃষ্টি নামল। শুকনো খাবার দিয়ে খাওয়া সারা হল। ঠিক হল, পালা করে বন্দুক নিয়ে রাত জাগবে তারা। প্রথমে সন্দীপ, তারপর ডক্টর নিশীথ আর শেষ রাতে গঞ্জালো। গঞ্জালো আর ডক্টর নিশীথ খাওয়া সেরে শুয়ে পড়ল। আর বন্দুক হাতে রাত পাহারায় বসল সন্দীপ। এক সময় ক্ষীণ চাঁদ উঠল ঠিকই, কিন্তু বৃষ্টির প্রকোপ আরও বাড়তে থাকল। সন্দীপ দরজার দিকে মুখ করে বসে। একবার সে পিছনের জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখল পিছনে খাঁড়ির জল বাড়তে শুরু করেছে। বাঘের কথা ঠিক মাথায় আসছে না সন্দীপের। তার খালি মনে হতে লাগল যে জোয়ারের জলে যদি ভেসে আসে বিরাটাকৃতির কোনো কুমির? তারপর সে যদি কাঠের পাটাতন বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে তখন? কী করবে সন্দীপ? সে কান পেতে থাকল তেমন কোনো শব্দ শোনা যায় কিনা তা শোনার জন্য। বেড়ে চলল রাত। কিন্তু রাত বারোটা নাগাদ মুহুর্মুহু বাজ পড়তে শুরু করল। আর সে শব্দে ঘুম থেকে উঠে বসল নিশীথ আর গঞ্জালো। বাড়িটা কেঁপে উঠছে বাজের গর্জনে। এমনিতেই বাড়িটা খাঁড়ির দিকে হেলে আছে। বাড়িটা যদি বাজের গর্জনে সন্দীপদের নিয়ে হুড়মুড়িয়ে ধসে পড়ে তখন ভয়ঙ্কর বিপদ হবে। অথচ সন্দীপের এত রাতে বাইরে বেরোবারও উপায় নেই। ঘরের মধ্যেই বসে রইল তারা। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি। বাজের শব্দে কাঁপছে ঘরটা।
হঠাৎই বাজের গর্জনের মতোই আরও একটা শব্দ কানে আসতে লাগল সন্দীপের। ও কীসের শব্দ? দরজার সামনে এসে বাইরে তাকাল তারা। আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকের আলোতে তাকে দেখতে পেয়ে গেল তারা। সামনের জমিতে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল একটা বাঘ! অন্ধকারে জ্বলছে তার চোখ। সে যেন বুঝতে পেরেছে বাড়িটার মধ্যে সন্দীপদের উপস্থিতি। বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আক্রোশে মাঝে মাঝে ডাক ছাড়ছে। তার রাজত্বে তাদের উপস্থিতি সে মানতে পারছে না। চিড়িয়াখানার ঘেরাটোপের মধ্যে বাঘ দেখা আর এ বাঘ দেখার মধ্যে বিস্তর ফারাক। মূর্তিমান যমদূত যেন হাজির হয়েছে সেখানে। সন্দীপ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে। হঠাৎ বাঘটা যেন বাড়ির পাশের একটা অংশের দিকে তাকাল। তারপর প্রচণ্ড গর্জন করে বাড়িটাকে বেড় দিয়ে ছুটল সেদিকে। সেটা দেখেই সন্দীপরা তাড়াতাড়ি পিছনের জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বাঘটা এখন বাড়ির পিছন দিকে পৌঁছে গেছে। সন্দীপরা বাজের আলোতে দেখতে পেল বাঘের তাড়া খেয়ে খাঁড়ির জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিশাল একটা কুমির! ঠিক যেখান দিয়ে কুমিরটা জলে নামল সেখানে গিয়ে থমকে দাঁড়াল বাঘটা। তারপর জলের দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড আক্ষেপে একবার গর্জন করে খাঁড়ির পাড় বরাবর ছুটতে ছুটতে সন্দীপদের চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। সন্দীপদের বুঝতে অসুবিধা হল না যে কুমিরটা দেখেই তাকে ধাওয়া করেছিল বাঘটা। কিন্তু জলে নামার সাহস তার হল না। কারণ জলের রাজা বাঘ নয়, এই অতিকায় মোহনার কুমিরগুলো। জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা ডাঙার রাজার নেই।
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাজের শব্দ ধীরে ধীরে কমে গেল। বৃষ্টিও কমে গেল। সন্দীপরা কেউ আর ঘুমোল না বাঘটা যদি আবার ফিরে আসে সেই ভয়ে। তবে বাকি রাতটা তাদের নিরুপদ্রবেই কেটে গেল।
।। ৬।।
ভোরের আলো ফুটল একসময়। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িটা থেকে নীচে নেমে এল সন্দীপরা। দিনের আলো যে কোনো পরিস্থিতিতেই রাতের ভয় কাটিয়ে দেয়। তবে গতরাতের ঘটনা চাক্ষুষ করার পর ডক্টর নিশীথ আর তার সঙ্গী জায়গা সম্বন্ধে বেশ সতর্ক হয়েছে বলে মনে হল সন্দীপের। নীচের জমিতে নামার পর গঞ্জালো একবার তার হাতের বন্দুকটা খুলে দেখে নিল যে তাতে গুলি ঠিক মতো ভরা আছে কিনা। তাছাড়া বন্দুকটা সে কাঁধে না ঝুলিয়ে হাতেই রাখল। ডক্টর নিশীথ প্রথমে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হাতে কিন্তু আজ আর কাল সময়। বৃষ্টি না হলেই বাঁচি। দরকার হলে চামটার কাছের দ্বীপগুলোতে খোঁজ চালাব কাল। দেখা যাক আজ কী হয়?’ এ কথা বলার পর তিনি বললেন ‘সারেঙ ফিরে আসার আগে একবার পিছনের খাঁড়ির দিকটাতে যাওয়া যাক।’ এরপর সেদিকে এগোল তারা তিনজন।
বাড়িটাকে বেড় দিয়ে তারা হাজির হল খাঁড়ির পাড়ে ঠিক সে জায়গাতে যেখান দিয়ে গতরাতে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল সেই বিশাল কুমিরটা। খাঁড়ির পাড়ের কাদামাটিতে স্পষ্ট জেগে আছে গত রাতের বাঘটার খোঁচ অর্থাৎ পায়ের ছাপ। একটা লম্বাটে ঘষটানো দাগ কুমিরের জলে নেমে যাবার চিহ্ন। সেগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ গঞ্জালো কিছুটা দূরে মাটিতে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, ‘আরে ওটা কী?’
জায়গাটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল তারা তিনজন। সন্দীপরা দেখতে পেল সেখানকার ভেজা জমিতে আঁকা হয়ে আছে মানুষের পায়ের ছাপ। কেউ যেন এ জায়গা দিয়ে খাঁড়ি থেকে ওপরে উঠে এসেছিল!
নিশীথ ছাপগুলো দেখে বললেন ‘কাল এখানে আসার পর আমরা একবার এখানে এসেছিলাম ঠিকই কিন্তু আমাদের তিনজনের পায়েই তো জুতো ছিল, আর সারেঙের পায়ে হাওয়াই চটি।’
আর এরপরেই তিনি উৎফুল্ল ভাবে বলে উঠলেন, ‘অন্য মানুষ এখানে কীভাবে আসবে? এ নিশ্চয়ই প্রফেসরের পায়ের ছাপ! তিনি এখানে এসেছিলেন এবং সম্ভবত কাল রাতেই। তারপর হয়তো বাঘ বা কুমির দেখতে পেয়ে অথবা অন্য কোনো কারণে ফিরে গেছেন। হয়তো বা তিনি আমাদের খোঁজেই এসেছিলেন?’
গঞ্জালো বলল, ‘আমারও তাই মনে হয়।’
সন্দীপ হতবাক। তবে কি সত্যিই প্রফেসর এখানে এসেছিলেন? সন্দীপের চোখে ভেসে উঠল গতরাতের সেই দৃশ্য—বাঘের তাড়া খেয়ে খাঁড়ির জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিশাল একটা কুমির!
নিশীথ বললেন, ‘তার মানে প্রফেসর আমাদের কাছাকাছিই কোথাও আছেন। খুঁজে বার করতে হবে তাঁকে। এবার ফেরা যাক।’
খাঁড়ির দিক থেকে বাড়ির সামনের জমিটাতে আসতেই তারা দেখতে পেল জালের বেড়ার ফাঁক গলে ভিতরে আসছে সারেঙ হারান।
সন্দীপের কাছে এসে দাঁড়াল সে। গম্ভীর মুখ। সে প্রশ্ন করল, ‘এখানে রাত কেমন কাটল আপনাদের?’
সন্দীপ জবাব দিল, ‘রাতে বাঘ এসেছিল। তার সঙ্গে একটা কুমির।’
সারেঙ বলল, ‘আমি আপনাদের সাবধান করেছিলাম। কাল আপনাদের নামিয়ে দিয়ে আমি যখন ফিরছি তখন জঙ্গলের আড়াল থেকে কেউ অনুসরণ করছিল আমাকে। আর আজ আমার আসার সময় বিরাট একটা কুমির আমার পিছু নিয়েছিল। আজ ফেরার সময় আপনাদের কাউকে আমার সঙ্গে যেতে হবে। বৈঠা চালানো আর বন্দুক ধরা তো আর একসঙ্গে করা যায় না। নইলে আমি এখানে আর আসব না। আপনারা টাকা ফেরত নিতে পারেন।’
সন্দীপ খেয়াল করল তার কথা শুনে গঞ্জালোর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। সে হয়তো হারান নস্করকে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ডক্টর নিশীথ চোখের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিয়ে সারেঙকে বলল, ‘ঠিক আছে দেখছি আমাদের মধ্যে কেউ যেতে পারে কিনা তোমার সাথে। এখন চলো, তাড়াতাড়ি খাঁড়িতে নামতে হবে।’
খাঁড়ি দিয়ে রওনা হল তারা চারজন। তারপর সেখানে পৌঁছে নৌকাতে চেপে বসল। সন্দীপ জানতে চাইল কীভাবে অনুসন্ধান চালাব আমরা?
ডক্টর নিশীথ বললেন, ‘খাঁড়ির ভিতরেই ঘুরে বেড়াব আমরা, কাল যেমন ঘুরছিলাম। নৌকা থেকে আপনি প্রফেসরকে আহ্বান জানাবেন জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে আসার জন্য।’
সন্দীপ বলল, ‘কীভাবে?’
নিশীথ তাঁর ব্যাগের মধ্যে থেকে ব্যাটারি চালিত একটা হ্যান্ডমাইক বার করে বললেন,’এর সাহায্যে। আপনি প্রফেসরের উদ্দেশে বলবেন যে আপনি তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছেন। তাঁর প্রতি আপনার কোনো অভিযোগ নেই। আপনি চান তিনি ফিরে চলুন।’
পরিকল্পনাটা অভিনব তাতে সন্দেহ নেই। সন্দীপ বলল ‘আচ্ছা বেশ।’
সারেঙ ছোট নোঙরটা উঠিয়ে দাঁড় বাইতে শুরু করল। গহীন খাঁড়ির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলতে শুরু করল নৌকা। কিছুটা এগোবার পর ডক্টর নিশীথ বললেন, ‘নিন, এবার শুরু করুন।’
হ্যান্ডমাইকটা তুলে ধরে সন্দীপ এরপর বলতে শুরু করল, ‘প্রফেসর আপনি কি এখানে আছেন? আমি সন্দীপ বলছি। আমি আপনাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছি। আপনার প্রতি আমার কোনো রাগ-ক্ষোভ নেই। কোথাও কোনো অভিযোগ আমি আপনার বিরুদ্ধে করিনি। আপনি আমার অন্নদাতা। যা হবার হয়েছে। দয়া করে আপনি ফিরে চলুন। প্রফেসর আপনি কি কোথাও আছেন?’
খাঁড়ির দুপাশের অসীম নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়তে লাগল সন্দীপের কণ্ঠস্বর—’প্রফেসর, আপনি কি আছেন? আছেন?’
এ খাঁড়ি ও খাঁড়ি বেয়ে এগিয়ে চলতে লাগল নৌকা। আর সন্দীপ বলে যেতে লাগল তার কথা। এক সময় সে ডক্টর নিশীথকে বলল, ‘এবার আপনারা বলুন।’
নিশীথ বললেন, ‘গঞ্জালোর সঙ্গে তো তাঁর কোনো পরিচয় নেই। আর এত বছর পর তিনি আমার কণ্ঠস্বর চিনতে পারবেন কিনা সে ব্যাপারেও সন্দেহ আছে। আপনিই যেমন বলছেন তেমন বলুন।’
বলে যেতে লাগল সন্দীপ। সময় এগিয়ে যেতে লাগল। মাথার ওপর উঠতে লাগল সূর্য। সন্দীপের খালি মনে হতে লাগল, এই হয়তো কোনো খাঁড়ির বাঁকে আবির্ভূত হলেন প্রফেসর। তবে তেমন কিছু ঘটতে দেখা গেল না। একবার শুধু মাইক্রোফোনের আওয়াজে ভয় পেয়ে হোগলা পাতার জঙ্গলের আড়াল থেকে বাইরে বেরিয়ে জলে ঝাঁপ দিল একটা কুমির। তবে সেটা বিরাট বড় কোনো কুমির নয়। হাত পাঁচেক লম্বা একটা বাচ্চা কুমির। তাকে দেখে সন্দীপরা হেসে ফেলল। সে কখনই প্রফেসর হতে পারে না।
নির্জন খাঁড়ির ভিতর আরও পাক খেতে লাগল নৌকা। কিন্তু প্রফেসরের দেখা মিলল না। ডক্টর নিশীথ একসময় বললেন, ‘এমন হতে পারে কাছাকাছির কোনো দ্বীপে ডেরা বেঁধেছেন প্রফেসর। এই জঙ্গলে যদি তাঁর দেখা না পাওয়া যায় তবে আগামীকাল ভোর পর্যন্ত আমরা কাঠের বাড়িতে অপেক্ষা করব তাঁর জন্য। তারপর লঞ্চ নিয়ে কাছের দ্বীপগুলোতে যাব।’
সন্দীপ বলল, ‘কাছের দ্বীপ বলতে তো ওই কুমির দ্বীপ। যেখানে কীভাবে যাবেন আপনি? ও দ্বীপে তো নাকি নামা যায় না। অবশ্য ওর পিছনে নাকি একটা ছোট দ্বীপ আছে সারেঙ বলছিল।’
গঞ্জালো বলল, ‘আগে তো যাই তারপর দেখা যাবে। প্রয়োজন হলে নামতেও হবে। ওই ছোট দ্বীপটিও দেখব।’
সন্দীপ হেসে বলল, ‘আচ্ছা গঞ্জালো, ডক্টর নিশীথ লাহিড়ী আর আমি নয় প্রফেসর ঘোষের কাছে কৃতজ্ঞ। তাই আমরা বিপদের ঝুঁকি নিয়ে খুঁজছি। কিন্তু আপনার সঙ্গে তো প্রফেসরের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে আপনি কেন প্রফেসরের খোঁজে ডক্টর লাহিড়ীর সঙ্গী হলেন?’
সন্দীপের কথা শুনে গঞ্জালো কয়েক মুহূর্ত যেন থমকে গেল। তারপর সে জবাব দিল, ‘ডক্টর লাহিড়ী যখন বললেন যে তিনি প্রফেসরের খোঁজে এই বাঘ-কুমিরের ডেরা সুন্দরবনে থাকতে চান ও এ ব্যাপারে আমার সাহায্য চান তখন ব্যাপারটার মধ্যে আমি একটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেয়েছিলাম। আমি রোমাঞ্চ ভালোবাসি। যে কারণে কলকাতার রাজপথ, গঙ্গার ঘাট বা মন্দিরের ছবি না তুলে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি করি। তাছাড়া ডক্টর লাহিড়ী আর তাজউদ্দিনের মুখে প্রফেসরের ব্যাপারে আমি যা শুনেছি, তাতে তাঁকে দেখার আগ্রহ প্রবল আমার। তাই এ কাজে আমি ডক্টর লাহিড়ীর সঙ্গী হলাম। প্রফেসরকে খুঁজে বার করার কাজে যোগ দিলাম আর এখানেও এলাম।’
সন্দীপ বলল, ‘এবার আমার কাছে ব্যাপারটা স্পষ্ট হল।’
দুপুর গড়িয়ে গেল। মাইকে বলতে বলতে গলা ধরে এল সন্দীপের। কিন্তু প্রফেসরের দেখা মিলল না। আকাশে আবার মেঘ ঘনাতে শুরু করল গতকালের মতো। কাজেই মুখ ফেরানো হল নৌকার। দ্বিতীয় দিনের অনুসন্ধানে ব্যর্থ হল সন্দীপরা। তাদের হাতে মাত্র আর একটা দিন সময় আছে। তার চেয়ে বেশি দিন অবশ্য থাকা যায় কিন্তু বনরক্ষী বাহিনীরা রাজি হল না। তাদের বিপদ হবে। বিনা পারমিটে কোর এলাকায় থাকার জন্য জেল জরিমানা হতে পারে তাদের। ফেরার পথে বেশ গম্ভীর হয়ে গেল ডক্টর লাহিড়ীর মুখটা।
বাড়িটার কাছাকাছি পৌঁছে সারেঙ জানতে চাইল, ‘আমার সঙ্গে লঞ্চে কে যাবেন?’
গতরাতে যে ঘটনা সন্দীপ প্রত্যক্ষ করেছে তাতে প্রফেসরের ছেড়ে যাওয়া ওই ডেরার চেয়ে লঞ্চে রাত্রিবাস করা অনেক বেশি নিরাপদ। তাই সে বলল, ‘আমার যেতে আপত্তি নেই।’
ডক্টর লাহিড়ী, সারেঙের কাছে শেষ বারের মতো জানতে চাইলেন, ‘সত্যি তোমার সঙ্গে একজনকে যেতেই হবে?’ সারেঙ বলল, ‘হ্যাঁ। একজনকে যেতেই হবে সে বন্দুক ধরে নৌকাতে বসে থাকবে। নইলে আমি আর নাও ফিরতে পারি। হয়তো আমি আজ নৌকা নিয়ে লঞ্চে পৌঁছতেই পারলাম না। আজকে মেঘ আরও ঘন হয়ে আসছে। হয়তো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে। ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন তো?
ডক্টর লাহিড়ী বুঝতে পারলেন সারেঙকে চটিয়ে লাভ নেই। কাজেই তিনি সন্দীপকে বললেন, ‘ঠিক আছে আপনি তবে যান ওর সঙ্গে। কাল যথাসম্ভব ভোরবেলা এখানে চলে আসবেন। আমরা ওই ভাঙা বাড়িটাতেই থাকি। হয়তো প্রফেসর ওখানেই এলেন।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িটার কাছে খাঁড়ির চড়াতে নেমে পড়লেন ডক্টর লাহিড়ী আর গঞ্জালো। আর সন্দীপরা যাত্রা শুরু করল লঞ্চে ফেরার জন্য। যদিও সবে বিকাল হয়েছে। কিন্তু মেঘে ঢেকে গেছে সূর্য। আরও বেশি অন্ধকার ছায়াময় লাগছে খাঁড়িগুলো। এতক্ষণ তারা চারজন ছিল নৌকাতে, কিন্তু দুজন নেমে যাওয়াতে দু-পাড়ের জঙ্গল আরও বেশি ছমছমে মনে হতে লাগল। নিশ্চুপভাবে দাঁড় বাইছে হারান নস্কর। মৃদু শব্দ হচ্ছে জলে তার দাঁড়ের আঘাতে। হঠাৎ সে একপাশের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে চাপাস্বরে বলল, ‘বন্দুকটা হাতে নিন। আজকেও কেউ নৌকাকে অনুসরণ করছে জঙ্গলের আড়াল থেকে!’ এই বলে সে দাঁড়টা জল থেকে তুলে নিল। মৃদু স্রোতের টানে এগোচ্ছে নৌকা।’ সারেঙ খাঁড়ির যে পাড়টা দেখাল সেদিকে কান খাড়া করে সন্দীপ সত্যিই একটা অদ্ভুত খসখসে শব্দ শুনতে পেল। জঙ্গল এত ঘন যে তার ভিতরে কিছু দেখার উপায় নেই। শব্দটা যেন নৌকার সমান্তরালেই এগোচ্ছে জঙ্গলের আড়াল দিয়ে! বাঘ?
সারেঙের বন্দুকটা সেই জঙ্গলের দিকে তাগ করে সোজা হয়ে বসল সন্দীপ। সারেঙ বৈঠা তুলে নিয়ে এরপর খাঁড়ির অপর পাড় ঘেঁষে নৌকা বাইতে থাকল। বেশ অনেকটা পথ নৌকার সঙ্গে এগোল সেই অদ্ভুত শব্দটা। তারপর একসময় থেমে গেল। সারেঙ হারান নস্কর বলল ‘বাঘই হবে। আমি একা থাকলেও নির্ঘাত আমাকে নৌকা থেকে তুলে নিয়ে যেত।’
শেষ পর্যন্ত নির্বিঘ্নেই বাকি পথ পেরিয়ে লঞ্চের কাছে পৌঁছে গেল নৌকাটা। আর সেই মুহূর্তেই বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামল। ডেকে দাঁড়ানো সম্ভব নয় তাই খোলে নেমে গেল সন্দীপ। তাছাড়া গত রাতে ঘুম হয়নি তার। কাজেই ঘুমিয়ে নেবার প্রয়োজন আছে।
।। ৭।।
লঞ্চে ফিরে এসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সন্দীপ। রাত আটটা নাগাদ সারেঙ হারান খাবার দিয়ে গেল। খিচুড়ি আর ডিমভাজা। বৃষ্টি এখনও হয়েই চলেছে। খোলের জানলার কয়েক হাত নীচেই জলস্তর। বৃষ্টি পড়ছে, ছোট ছোট ঢেউ উঠছে জলে দুলছে লঞ্চটা। সম্ভবত মোহনার দিক থেকে জোয়ারের জল প্রবেশ করছে খাঁড়িতে। খাওয়া সেরে আবার শুয়ে পড়ল সন্দীপ। সারেঙ আর তার সহকারীর শোয়ার ব্যবস্থা ওপরে। খোলের ভিতর একলা শুল সে।
রাত ক’টা তখন খেয়াল নেই সন্দীপের। হঠাৎ কেন জানি ঘুম ভেঙে গেল তার। জানলার বাইরে থেকে একখানি চাঁদের আলো এসে পড়েছে অন্ধকার খোলের ভিতর। বৃষ্টি থেমে গেছে। একবার জানলার দিকে তাকিয়ে আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়তে যাচ্ছিল সন্দীপ। ঠিক তখনই তার কানে এল কে যেন বলল, ‘সন্দীপ তুমি আছো? জেগে আছো?’
এটা কি মনের ভুল নাকি সত্যি, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না সন্দীপ। কিন্তু তারপরই স্পষ্ট সে শুনতে পেল আবার কেউ বলল, ‘সন্দীপ তুমি জেগে আছো?’
এবার ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল সন্দীপ। পাশেই রাখা ছিল সারেঙের গাদা বন্দুকটা। সেটা কোলে তুলে নিয়ে জানলার দিকে তাকাল সে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে জানলায় আবির্ভূত হল মুখ! চাঁদের আলো এসে পড়ল তার মুখে। মুহূর্তের মধ্যে তাঁকে চিনে ফেলল সন্দীপ। যদিও লোকটার মুখ দাড়িগোঁফে আচ্ছন্ন, তবুও এ মুখ ভোলা সম্ভব নয় সন্দীপের পক্ষে। প্রফেসর নীলকান্ত সোম! সন্দীপ হতবাক হয়ে চেয়ে রইল জানলাতে উঁকি দেওয়া মুখটার দিকে। প্রাথমিক অবস্থায় সে ঠিক বুঝতে পারছিল না সে কোনো স্বপ্ন দেখছে কিনা? বেশ কিছুটা সময় লাগল তার ধাতস্থ হতে। তারপর সে যে সঠিকই দেখছে তা বুঝতে পেরে প্রফেসরকে বহু দিন বাদে দেখে কেমন যেন ভয় মিশ্রিত আনন্দ অনুভব হল তার। বেশ কিছুক্ষণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল দুজন। প্রফেসর ঘোষ তারপর তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি এখানে এসেছ কেন?’
প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে সন্দীপ জবাব দিল, ‘আমরা আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি।’ প্রফেসর বললেন, ‘সত্যিই কি তাই? কিন্তু এতদিন পর হঠাৎ কেন এলে?’
সন্দীপ জবাব দিল, ‘যা হবার তা হয়ে গেছে প্রফেসর। এবার আপনি ফিরে চলুন। আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আপনার বাড়িটা ঠিক আগের মতোই আছে। আমি আপনার সম্বন্ধে কাউকে কোনো অভিযোগ জানাইনি। আমি ছাড়া আপনার সেই ব্যাপারটা সম্বন্ধে কেউ কিছু জানে না।’
চুপ করে রইলেন প্রফেসর। সন্দীপ তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে। চাঁদের আলোতে জল ঝরছে প্রফেসরের লম্বা লম্বা ভেজা চুল দিয়ে। তবে আগের তুলনায় বেশ শীর্ণ দেখাচ্ছে প্রফেসরকে। হয়তো সেটা তার বয়সজনিত কারণে। তাছাড়া শরীরের প্রতি ভয়ঙ্কর অনিয়ম তো আছেই। কেমন যেন বিষণ্ণতাও জেগে আছে তাঁর মুখে। প্রফেসর তারপর সন্দীপকে বলল, ‘তুমি আমাকে ভিতরে আসতে বলবে না?’
এবার যেন একটু থমকে গেল সন্দীপ। জঙ্গলের মধ্যে কাঠের বাড়িতে ঘটনাগুলোর স্মৃতি জেগে উঠল তার মনে। প্রফেসর মনে হয় সন্দীপের মনের ভাব বুঝতে পেরেই বললেন ‘আমাকে যদি ভয় পাও তবে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে কীভাবে? তাছাড়া তোমার হাতে তো বন্দুক রয়েছে।’
সন্দীপ এবার তাঁর কথায় লজ্জা পেয়ে গেল। সে বলল, ‘আসুন, আসুন, ভিতরে আসুন।’
অনেকটা সরীসৃপের ঢঙেই জানলা গলে খোলের ভিতর নেমে এলেন প্রফেসর। সন্দীপের নাকে এবার স্পষ্ট একটা আঁশটে গন্ধ লাগল। জানলা দিয়ে বাইরে চাঁদের আলো এসে যেখানে খোলের ভিতর একটা আলোকবৃত্ত রচনা করেছে ঠিক সে জায়গাতেই এসে তিনি বসলেন। তার পরনের খাকি পোশাক সম্পূর্ণ ভিজে আছে। সন্দীপ তাঁকে প্রশ্ন করল, ‘গত রাতে কি আপনি ওই কাঠের বাড়িতে গেছিলেন?’
প্রফেসর জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, গেছিলাম। আসলে তোমাদের দেখতে পেয়ে ব্যাপারটা বোঝার জন্যই গেছিলাম। বহুদিন হল আমি ওখানে থাকি না। আয়লা ঝড়ের পর একটা নতুন দ্বীপ জেগেছে সেখানেই থাকি। ওটা এখন একটা বাঘের ডেরা। তুমি যখন এসেছিলে তখন আমি যে বাঘের বাচ্চাটা এনেছিলাম তার মা’টা মারা গেলেও ঘটনাচক্রে বাচ্চাটা বেঁচে গেছিল। সে এখন পূর্ণবয়স্ক বাঘিনী, ওখানেই থাকে। আমার ওপর খুব রাগ ওর। গত রাতে ওখানে গেছিলাম ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওর ভয়ে পালিয়ে আসতে হল।’
এ কথা বলার পর প্রফেসর জানতে চাইলেন, ‘তোমার সঙ্গে যে দুজন লোক তারা কারা?’
সন্দীপ বলল, ‘ওদের একজন একসময়ের আপনার সহকর্মী ডক্টর নিশীথ লাহিড়ী, যাকে আপনি গবেষণার জন্য বিদেশে পাঠিয়েছিলেন। আর একজন হল গঞ্জালো, ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার। নিশীথই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন আপনাকে এখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। এখানে আসার প্রাথমিক পরিকল্পনাটা তাঁরই। আমার মতো তিনিও আপনার প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞ।’
প্রফেসর বিস্মিতভাবে বললেন, ‘নিশীথ ফিরে এসেছে! খাঁড়ির পাড়ে ঝোপের আড়াল থেকে তোমাদের যখন দেখছিলাম তখন তাই তাকে কেমন যেন চেনা মনে হচ্ছিল! পনেরো বছরে ওর চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তখন ওর মাথায় ঝাঁকড়া চুল ছিল। ও দেশে যাবার পরেও কিছুদিন যোগাযোগ ছিল ওর সাথে।’
সন্দীপ বলল, ‘ওই গঞ্জালো বলে ছেলেটা বাংলাদেশে গেছিল সুন্দরবনের ওয়াইল্ড লাইফের ছবি তুলতে। সেখানে এক নৌকার মাঝির মুখে সে আপনার কথা শোনে। লোকটা ভূতপূর্ব জলদস্যু ছিল। ডক্টর নিশীথের সাথে এক ফটোগ্রাফিক একজিবিশনে গঞ্জালোর পরিচয় হয়। সে নিশীথকে আপনার গল্প করে। তারপর তারা আমাকে খুঁজে বার করে। ওই ভূতপূর্ব জলদস্যু সেবার আপনার সঙ্গে আমাকে নৌকাতে দেখেছিল যেবার সে আপনাকে রাইফেল দিতে এসেছিল। তার নাম তাজউদ্দিন।’
কথাটা শুনে প্রফেসর বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার বড় প্রিয় পাত্র ছিল সে। বাঘের কামড়ে মারা গেছে।’
এ সংবাদ অবশ্য জানা ছিল না সন্দীপের। সে এরপর প্রশ্ন করল, ‘আপনি আমাদের সঙ্গে ফিরে যাবেন তো?’
প্রফেসর ভেবে নিয়ে বললেন, ‘নিশীথ যখন এসেছে তখন আমি একটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। আচ্ছা তুমি জানো, নিশীথ তার গবেষণায় সফল হয়েছে কিনা?’
সন্দীপ জবাব দিল, ‘আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছেন পরে বলবেন। তবে তিনি বলেছিলেন আপনারা একই বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছিলেন সে সময়।’
প্রফেসর বললেন, ‘হ্যাঁ, একই বিষয়। জিনতত্ত্ব নিয়ে। তবে আমাদের গবেষণার বিষয় ছিল সম্পূর্ণ উল্টো প্রকৃতির। আমি গবেষণা করেছিলাম এক প্রাণীর কোষে অন্য প্রাণীর জিন প্রতিস্থাপনের কাজ, তাকে প্রকট করার কাজ। তাতে প্রাণীর কী পরিবর্তন হয় তা দেখা। আর সে করছিল উল্টোটা। কোনো প্রাণীর কোষ থেকে কোনো জিনকে সরিয়ে নেওয়ার কাজ, উৎপাটিত করার কাজ। তাতে প্রাণীর কি পরিবর্তন হয় তা দেখা। ওই পদ্ধতিটা আমার জানা নেই। যে প্রাণীর জিন আমি আমার দেহকোষে প্রতিস্থাপিত করেছি তাকে যদি নিশীথ নষ্ট করে দিতে পারে, তবে আমি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারব। আমার এখন নিজের শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। হঠাৎ হঠাৎ প্রকট হয়ে ওঠে সেই জিন।’—এই বলে থেমে গেলেন প্রফেসর ঘোষ।’
‘জিন প্রকট হয়ে ওঠা’—এ কথার মাধ্যমে কী বলতে চাইলেন তিনি তা বুঝতে অসুবিধে হল না সন্দীপের। সে বলল, ‘আপনি এত ভাবছেন কেন? আমরা সবাই তো আছি। আপনি ফিরে চলুন।’
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন প্রফেসর। তারপর তিনি বললেন, ‘আমার বয়স তো হয়ে এল। তার ওপর শরীরের ওপর যে অত্যাচার চলে তাতে আমি কতদিন আর বাঁচব তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আজকাল সত্যিই আমার ফিরে যেতে ইচ্ছা করে। মানুষ হোক বা বাঘ বা কুমির, প্রত্যেকের পিছনেই মৃত্যু এখানে পদে পদে ঘোরে। শেষ কটা দিন যদি ফিরে গিয়ে শান্তিতে বাঁচা যেত….। স্পষ্টই এবার ফিরে যাবার বাসনা প্রকাশ পেল প্রফেসরের কন্ঠে। সন্দীপ বলল, ‘এত ভাববেন না। কালই আপনাকে নিয়ে আমরা কলকাতার দিকে রওনা হব। পরশু এ সময় আপনি নিশ্চিন্তে আপনার বাড়িতে ঘুমোবেন।’
প্রফেসর এবার শেষ প্রশ্নটা করলেন, ‘আচ্ছা আমার কোনো বিপদ হবে না তো?’ সব কিছু ভুলে গিয়ে তুমি আমার পাশে থাকবে তো? তুমি ছাড়া ভরসা করার মতো কেউ আমার নেই।’
সন্দীপ হেসে বলল, ‘ঠিক আগের মতোই আপনি আমাকে ভরসা করতে পারেন। এই মুহূর্ত থেকে যে কোনো বিপদে আমি আপনার পাশে আছি। আমি কথা দিলাম।’
প্রফেসর উঠে দাঁড়ালেন, সন্দীপও উঠে দাঁড়াল। প্রফেসর এগিয়ে এসে সন্দীপের হাত দুটো একটু ইতস্তত করে ধরলেন। কী ঠান্ডা, স্যাঁতস্যাঁতে প্রফেসরের হাত দুটো! কিন্তু সে হাতের স্পর্শে এখন যেন কোনো আতঙ্ক অনুভব করে না সন্দীপ। তার হাত ধরে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন প্রফেসর। তারপর বললেন ‘ঠিক আছে কাল সকালে আমার ওই পুরোনো ডেরাতে তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে। এবার আমি যাই।’
সন্দীপ বলল, ‘আচ্ছা। কিন্তু এখন কোথায় যাবেন আপনি?’
প্রফেসর হেসে বললেন, ‘আমার নতুন আস্তানাতে। আমার এতদিনের সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে একবার দেখা করে আসি। কাল যদি তোমাদের সঙ্গে সত্যি চলে যাই তবে তো আর তাদের সঙ্গে দেখা হবে না।’
সন্দীপ হেসে বলল, ‘আচ্ছা যান। কাল সকাল সকালই আমি পৌঁছে যাব ওই কাঠের বাড়িটার ওখানে। আমি অপেক্ষা করব আপনার জন্য।
ঠিক যেভাবে প্রফেসর জানলার ফাঁক গলে খোলে ঢুকেছিলেন, ঠিক সেভাবেই এরপর জানলা গলে খোলের বাইরে বেরিয়ে গেলেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই জলের মধ্যেই ঝুপ করে একটা শব্দ হল। লঞ্চ থেকে কেউ যেন ঝাঁপ দিল জলে। সন্দীপ এবার ঘড়ি দেখল। রাত আড়াইটে বাজে। আনন্দ-উত্তেজনায় প্রফেসরের কথা ভাবতে ভাবতে বাকি রাতটা কাটিয়ে দিল সন্দীপ।
।। ৮।।
ভোরের আলো ফুটল এক সময়। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সারেঙের সঙ্গে নৌকা নিয়ে জঙ্গলের ভিতর সেই কাঠের বাড়িতে যাত্রা করার জন্য খোল ছেড়ে উপরে উঠে বসল সন্দীপ। সে দেখল সারেঙ আর তার সঙ্গীর মধ্যে কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। সন্দীপ তাদের উদ্দেশে বলল, ‘এই ভোরবেলা তোমরা ঝগড়া করছ কেন?’
সারেঙ হারান নস্কর তার সঙ্গীকে দেখিয়ে বলল, ‘দেখুন না ও বলে কিনা যে একটা বিরাট কুমিরকে ও মাঝরাতে লঞ্চ থেকে জলে ঝাঁপ দিতে দেখেছে! বাঘ হলে নয় ব্যাপারটা বিশ্বাস করতাম। কিন্তু কুমির কি এ ভাবে রেলিং ডিঙিয়ে লঞ্চে উঠতে পারে?’ আমি বলছি, ‘তুই ঘুমের ঘোরে ভুল দেখেছিস। কিন্তু ও মানছে না।’
সারেঙের সহযোগী সন্দীপকে বলল, ‘আমি ওপরের ডেকে শুয়েছিলাম। হঠাৎ ঝপ করে জলে একটা শব্দ শুনলাম। তাকিয়ে দেখি লঞ্চের কাছ থেকে একটা বিরাট কুমির ডুব দিল জলে। আমি নিশ্চিত সে লঞ্চ থেকেই জলে ঝাঁপ দিয়েছিল।’ লোকটার কথা শুনে মনে মনে হাসল সন্দীপ। বন্দুকটা সে সঙ্গেই এনেছিল খোল থেকে। সেটা সে উঁচিয়ে লঞ্চের সঙ্গে বাঁধা নৌকাটা দেখিয়ে হারান নস্করকে বলল, ঝগড়া থামাও। এবার রওনা হতে হবে।’
সারেঙ বলল, ‘হ্যাঁ, চলুন। আজকের দিনটা কাটলে বাঁচি। চামটার খাঁড়িতে ঘুরে বেড়াতে হবে জানলে লাখ টাকা দিলেও আমি আসতাম না।’
সন্দীপ মৃদু হেসে বলল, ‘হয়তো এখানে আর বেশি সময় কাটাতে হবে না তোমাকে। ওই কাঠের বাড়িটাতে যাবার পর ফিরে এসে তাড়াতাড়ি ফেরার পথ ধরব আমরা।
সারেঙ বলল ‘তাই যেন হয় মাস্টারবাবু। পেটের দায়ে লঞ্চ নিয়ে আমি জঙ্গলে আসি। বউ-বাচ্চারা অপেক্ষা করে থাকে কখন আমরা ঘরে ফিরব সে আশাতে।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই লঞ্চ থেকে নৌকাতে উঠে বসল সন্দীপ। হারান নস্কর নৌকা নিয়ে প্রবেশ করল তাদের যাত্রাপথে ছোট খাঁড়ির ভিতর। দাঁড় বাইতে বাইতে সে চাপাস্বরে বললে, ‘আমরা যে সময় যাওয়া-আসা করছি এই সময়টাই বেশি মারাত্মক। এ সময়টাতে বাঘ জল খেতে আসে খাঁড়িতে।’
দিনের প্রথম আলো পাতার ফাঁক গলে প্রবেশ করছে খাঁড়িতে। কিছুটা হলেও অন্ধকার কেটে যাচ্ছে তাতে। অর্ধেক রাস্তা চলার পর হারান হঠাৎ চাপাস্বরে বলল, ‘ডান দিকের জঙ্গলে আবার সেই শব্দ হচ্ছে। ওদিকে বন্দুক তাগ করে রাখুন।’
কান খাড়া করে সত্যিই সন্দীপ শুনতে পেল গতকাল সন্ধ্যার শব্দটা! জঙ্গলের আড়াল থেকে শব্দটা যেন তাদের নৌকার সঙ্গে চলছে! বন্দুকের ট্রিগারে হাত রেখে সেদিকে চেয়ে রইল সন্দীপ। দীর্ঘ সময় ধরে শব্দটা অনুসরণ করল। তারপর যখন তারা সেই কাঠের বাড়িটার কাছের খাঁড়িতে পৌছল তখন মিলিয়ে গেল শব্দটা। হারান নস্কর বলল, ‘যাক এবারের মতো বেঁচে গেলাম।’
হারান নৌকা ভেড়াল খাঁড়ির পাড়ে। নৌকা থেকে নেমে কিছুটা এগিয়ে জালের ফাঁক গলে তারা বাড়িটার সামনের জমিতে প্রবেশ করে দেখতে পেল যে ডক্টর লাহিড়ী আর গঞ্জালো এগিয়ে এসেছে তাদের দিকে। সন্দীপের সামনে এসে দাঁড়াল তারা। সন্দীপ খেয়াল করল তাদের চোখেমুখে রাতজাগা আর উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট। সন্দীপ প্রশ্ন করল, ‘রাত কেমন কাটল?’
ডক্টর নিশীথ জবাব দিলেন ‘খুব ভালো নয়। বাঘটা হানা দিয়েছিল। বাড়িটার ওপর ওঠারও চেষ্টা করেছে। গঞ্জালো গুলি করে তাড়িয়েছে। গুলিতে সম্ভবত আহত হয়েছে বাঘটা।’
সন্দীপ তাঁর কথা শুনে বিস্মিত হয়ে বলল, ‘তাই নাকি! তবে প্রফেসরের মুখে শুনলাম ওটা নাকি আসলে বাঘিনী।’
ডক্টর নিশীথ বললেন, ‘এখানে আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। প্রথমে লঞ্চে যাব। তারপর লঞ্চ আর মাইক নিয়ে প্রফেসরের খোঁজ চালাব চামটা আর কুমির দ্বীপ প্রদক্ষিণ করতে করতে। আপনি মাইকে প্রফেসরকে দেখা দেবার আবেদন জানাবেন।’
সন্দীপ হেসে বলল, ‘তার আর প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না।’
ডক্টর নিশীথ লাহিড়ী বললেন, ‘কেন?’
সন্দীপ জবাব দিল, ‘কাল মাঝরাতে তিনি লঞ্চে এসে দেখা করেছিলেন। তাঁকে ফেরার ব্যাপারে রাজি করানো গেছে। তাঁর এখানেই আসার কথা।’
সন্দীপের কথা শুনে ডক্টর নিশীথ লাহিড়ী আর গঞ্জালো দুজনের চোখে-মুখেই বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠল। ডক্টর নিশীথ বলে উঠলেন, ‘আমার কথা তাঁকে আপনি বলেছেন।’
সন্দীপ জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, বলেছি। আপনি তাঁকে নিতে এসেছেন বলে কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছেন তিনি।’
‘আর আমার ব্যাপারে?’ প্রশ্ন করল গঞ্জালো।
সন্দীপ বলল হ্যাঁ, বলেছি।’
ডক্টর লাহিড়ী বললেন, ‘সত্যি তিনি আসবেন তো?’
সন্দীপ বললেন, ‘আসবেন বলেই মনে হয়। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে এখানে।’
গঞ্জালো বলল, ‘তবে সারেঙের বন্দুকটা আমাকে দাও। আমার বন্দুকে গুলি শেষ। বাঘটা আহত। সে হয়তো কাছেই থাকতে পারে।’
সন্দীপ বন্দুকটা এগিয়ে দিল তাঁর দিকে। নিজের বন্দুকটা ডক্টর নিশীথ লাহিড়ীর হাতে দিয়ে সারেঙের বন্দুকটা নিল গঞ্জালো।
সন্দীপ বলল, ‘প্রফেসর ফিরে এলেই লঞ্চের দিকে যাত্রা করতে হবে। আজই আমরা কলকাতার দিকে যাত্রা করব। তাই তো?’
তার কথার জবাবে ডক্টর লাহিড়ী কী একটা কথা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু খাঁড়িটার পিছনে খাঁড়ির দিক থেকে অস্পষ্ট একটা শব্দ ভেসে এল। সন্দীপরা সেদিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দেখতে পেল খাঁড়ির বুক থেকে পাড়ে উঠে এল একজন লোক! প্রফেসর নীলকান্ত সোম! সন্দীপরা সঙ্গে সঙ্গে এগোল বাড়িটার দিকে। কাঠের বাড়িটার ঠিক সামনের জমিতে প্রফেসর তাদের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন। জল ঝরছে তাঁর চুল বেয়ে। ভিজে সপসপ করছে তার পোশাক। খালি পা। সন্দীপ স্পষ্টই বুঝতে পারল যে সাঁতরে এসেছেন প্রফেসর। দিনের আলোতে বহু বছর পর সন্দীপ প্রফেসরকে দেখল। চেহারাতে ভাঙনের ছাপ পড়েছে। একটু যেন কুঁজোও হয়েছেন তিনি। তবে একই রকম উজ্জ্বল আছে তাঁর চোখ দুটো। প্রফেসর ভালো করে তাকালেন ডক্টর লাহিড়ী আর গঞ্জালোর দিকে। নিশীথ প্রফেসরের উদ্দেশে বললেন, ‘কেমন আছেন প্রফেসর? আমি আপনার খোঁজেই এসেছি।’
প্রফেসর হেসে বললেন, ‘সন্দীপ আমাকে বলেছে সে কথা। তোমাকে দেখে আমদের কী যে আনন্দ হচ্ছে তা বলে বোঝাতে পারব না। তোমার সঙ্গে আমার অনেক জরুরি দরকার। তবে এই পনেরো বছরে তোমার চেহারা অনেক বদলে গেছে, এমন কি গলার স্বরটাও।’
নিশীথ হাসলেন প্রফেসরের কথা শুনে।
প্রফেসর এবার তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা তুমি কি তোমার গবেষণার কাজে সফল হয়েছিলে?’
প্রশ্ন শুনে চুপ করে রইলেন নিশীথ।
প্রফেসর বললেন, ‘চুপ করে থেকো না। ব্যাপারটা আমার জানার দরকার আছে।’
এবারও নিশীথ লাহিড়ী কোনো জবাব দিলেন না।
পাছে প্রফেসর ফেরার ব্যাপারে মত পরিবর্তন করেন সেই ভয়ে সন্দীপ বলল, ‘ঠিক আছে, এসব ব্যাপার নিয়ে লঞ্চে বসে আপনারা দুজন একান্তে আলোচনা করবেন। এখন এ জায়গা ছেড়ে নৌকা নিয়ে লঞ্চের দিকে রওনা হওয়া যাক। বাঘটা হয়তো কাছেই আছে। বলা যায় না সে হঠাৎ এসে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।’ সন্দীপের কথা শুনে প্রফেসর, নিশীথকে বললেন, ‘হ্যাঁ। তাহলে চলো লঞ্চে বসেই কথা বলি। যতক্ষণ না তোমার গবেষণার ব্যাপারটা জানতে পারছি ততক্ষণ আমার মন অস্থির লাগছে। ব্যাপারটা জানার ওপর আমার বাকি জীবনের অনেক কিছু নির্ভর করছে।’
এবার মুখ খুললেন ডক্টর নিশীথ লাহিড়ী। তিনি বললেন, ‘লঞ্চে আমরা ফিরব। কিন্তু তার আগে আপনার কাছে একটা ব্যাপারে খোঁজ নেবার আছে।’
‘কী ব্যাপার? আমার গবেষণার ব্যাপার?’ জানতে চাইলেন প্রফেসর।
ডক্টর নিশীথ লাহিড়ী কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন প্রফেসরের দিকে। তারপর বললেন, ‘আপনার কাছে যে সিন্দুকটা আছে সেটা কোথায়? ওই সিন্দুকের খোঁজেই আমরা আসলে এসেছি।’
‘কীসের সিন্দুক?’ জানতে চাইলেন প্রফেসর।
‘যে সিন্দুকটা জলদস্যু তাজউদ্দিন আপনার কাছে রেখে গেছিল আমরা সেই সিন্দুকটার কথাই বলছি।’—এবার জবাব দিল গঞ্জালো।
প্রফেসর বিস্মিত হয়ে গেলেন তাঁর কথা শুনে। সন্দীপও কম বিস্মিত হল না ডক্টর লাহিড়ী আর গঞ্জালোর কথায়। প্রফেসর এরপর ডক্টর লাহিড়ীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি কে? নিশীথ তো এত লোভী ছিল না!’
আর এ কথা বলার পর প্রফেসর নিশীথ লাহিড়ীকে বললেন, ‘তুমি নিশীথের সেই বৈমাত্রেয় ভাই তমসারঞ্জন নও তো? যার সঙ্গে নিশীথের চেহারার মিল ছিল ঠিকই কিন্তু স্বভাব-চরিত্রে সে ছিল নিশীথের সম্পূর্ণ বিপরীত। কী একটা রাহাজানি নাকি খুনের মামলাতে সে জেলও খেটেছিল।’
একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল ডক্টর লাহিড়ীর মুখে। তিনি বলে উঠলেন, ‘চিনেই যখন ফেলেছেন তখন আর লুকোচুরি খেলে লাভ নেই। আমিই সেই তমসা। যত দূর জানি দাদা তো সাত-আট বছর আগে বিদেশেই মারা গেছে।’ তমসারঞ্জনের কথা শুনে সন্দীপ বলে উঠল ‘আপনি আমাকে মিথ্যা পরিচয় দিয়েছিলেন কেন?’
তমসা বলল, ‘দিয়েছিলাম কারণ তোমাকে এখানে আনার প্রয়োজন ছিল তাই। আমাদের ধারণা ছিল তোমার ডাকে প্রফেসর সাড়া দেবেন তাই।’
এ কথা বলার পর তমসা প্রফেসরকে বলল, ‘দেখুন প্রফেসর, আপনার সঙ্গে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। ক্ষতি করারও ইচ্ছা আমাদের আপাতত নেই। সিন্দুকটা নিতেই আমরা এসেছি। ওটা আমাদের হাতে তুলে দিলেই আমরা চলে যাব।’
গঞ্জালো বলল, ‘হ্যাঁ, ওটা আমাদের হাতে তুলে দিলে আমরা চলে যাব। পর্তুগীজ জলদস্যুদের লুটের মাল ভর্তি পাঁচশো বছরের পুরোনো এক সিন্দুক। মোহনার কাছে কোনো এক দ্বীপে যে সিন্দুক পেয়েছিল তাজউদ্দিন। তারপর সেটা আপনার কাছে জমা দিয়েছিল।’
প্রফেসর বললেন, ‘তুমি এ কথা জানলে কীভাবে?’
গঞ্জালো বলল, ‘জানলাম কারণ আমার পূর্বপুরুষ ছিল পর্তুগীজ জলদস্যু। বাপ-ঠাকুরদার মুখে শুনেছিলাম আমাদের পূর্বপুরুষদের এক সিন্দুক নাকি সুন্দরবনে মোহনার মুখে এক নির্জন দ্বীপে লুকানো ছিল। আমার সঙ্গে জেলে পরিচয় হয়েছিল তাজউদ্দিনের। এ দেশে ডাকাতি করতে এসে ধরা পড়ে এ দেশের জেলে কিছুদিন ছিল। পরে অবশ্য, প্রমাণের অভাবে খালাস পায়। আদালতে সে বলেছিল, ‘আমি নিরীহ বাংলাদেশী মৎস্যজীবী। বুঝতে না পেরে এ দেশের জলসীমা পার করেছিলাম।’ আদালত বিশ্বাস করে তার কথা এবং বাংলাদেশে ফেরত পাঠায় তাকে। আমি ওই সিন্দুকের সন্ধানে তার সাথে বাংলাদেশে গেছিলাম। কিন্তু….। যাই হোক ওটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন বলুন?’
‘যদি না বলি?’ জানতে চাইলেন প্রফেসর।
গঞ্জালো বলল, ‘তবে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকাতে হবে।’ সারেঙ হারান নস্কর এতক্ষণ বিস্মিত হয়ে কথোপকথন শুনছিল। এবার সে বলে উঠল, ‘আপনারা নিজেদের মধ্যে এ কী ঝগড়া করছেন?
গঞ্জালো সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে তারই বন্দুকের নল উঁচিয়ে বলল, ‘একদম চুপ। আমাদের ব্যাপারে নাক গলাবে না। তবে এখান থেকে তোমারও ফেরা হবে না।’
গঞ্জালোর হাতের উদ্যত বন্দুকের মুখে ধমক শুনে থমকে গেল সারেঙ।
তমসা বলল, ‘দেখুন প্রফেসর, সময় নষ্ট করে লাভ নেই। চটপট ব্যাপারটা জানিয়ে দিন।’
সন্দীপ ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, ‘চলে আসুন প্রফেসর আমরা নৌকা করে লঞ্চে ফিরব। দেখি ওরা কী করতে পারে? এই সারেঙ চলো।’
তমসারঞ্জন এবার সন্দীপের দিকে তাকিয়ে বন্দুক উঁচিয়ে বলল, ‘বেশি বাড়াবাড়ি করার চেষ্টা কোরো না। আমার বন্দুকেও কিছু গুলি আছে। সারেঙের বন্দুকটা তোমার কাছ থেকে নেবার জন্য তোমাকে মিথ্যা বলা হয়েছিল। আমাদের কথা না মানলে তোমারও বিপদ হবে।’
প্রফেসরকে কিছু বলার জন্য তাঁর দিকে ফিরতে যাচ্ছিল তমসা। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে তার হাত থেকে বন্দুকটা কেড়ে নেবার জন্য তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সন্দীপ। ধস্তাধস্তি শুরু হল তাদের দুজনের মধ্যে। বন্দুকটা প্রায় তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল সন্দীপ। এমন সময় গঞ্জালো পিছন থেকে এগিয়ে এসে তার হাতের বন্দুকের কুঁদো দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করল সন্দীপের মাথায়। সেই আঘাতে মাটিতে ছিটকে পড়ল সন্দীপ। আর ঠিক এই সময়টাতেই পালাবার জন্য হেলে পড়া বাড়িটার তলা দিয়ে তিরগতিতে খাঁড়ির দিকে ছুটলেন প্রফেসর। ব্যাপারটা খেয়াল করতেই গঞ্জালো গুলি চালাল প্রফেসরকে লক্ষ্য করে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই শুয়ে পড়লেন প্রফেসর, তারপর অসম্ভব রকম ক্ষিপ্র গতিতে বুকে হেঁটে খাঁড়ির জলে লাফিয়ে পড়লেন। গঞ্জালো যখন ছুটে গিয়ে খাঁড়ির পাড়ে উপস্থিত হল ততক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গেছেন প্রফেসর।
উঠে দাঁড়াল সন্দীপ। কিন্তু এখন তমসারঞ্জনের বন্দুক সোজা সন্দীপের দিকে তাগ করা। সে সন্দীপকে বলল, ‘আর কোনো চালাকির চেষ্টা করলেই আমি গুলি চালাব। দেখলে তো গুলি চালাতে আমাদের হাত কাঁপে না।’
আর এরপরই খাঁড়ির দিক থেকে ফিরে এল গঞ্জালো। রাগে জ্বলছে তার চোখ। তমসা তাকে বলল ‘এখনই ওই খাঁড়িটাতে নৌকা নিয়ে যেতে হবে। ওই খাঁড়ির দু’পাশে অনুসন্ধান চালাতে হবে। নিশ্চয়ই খাঁড়ি থেকে সাঁতরে দুপাশের কোনো জঙ্গলে উঠবে প্রফেসর।’
গঞ্জালো সন্দীপকে দেখিয়ে বলল, ‘এর ব্যবস্থা কী করব? শেষ করে দেব এখনই?’
তমসা বলল, ‘আপাতত ওকে হাত-পা বেঁধে বাড়িটার মধ্যে ফেলে রাখি। ফিরে এসে ওর ব্যবস্থা করব। আর আমরা না এলেও ওর ব্যবস্থা বাঘিনীটাই করবে। যে ভাবে বাঘিনীটা কাল ওপরে ওঠার চেষ্টা করছিল তাতে মনে হয় আজও সে নিশ্চয়ই হানা দেবে।’
তমসা সন্দীপের দিকে বন্দুক তাগ করে রইল। গঞ্জালো তার পিঠের ব্যাগ থেকে একটা নাইলনের দড়ি বার করে প্রথমে সন্দীপের হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধল। তারপর বন্দুকের খোঁচা দিতে দিতে তাকে প্রথমে ওঠানো হল বাড়িটার বারান্দাতে। তারপর ঘরের দরজার সামনে পা বেঁধে তাকে পিছন থেকে একটা লাথি মারল গঞ্জালো। সন্দীপ ছিটকে পড়ল ঘরের ভিতর। বাড়ি থেকে নেমে তারপর তারা ভীত সন্ত্রস্ত সারেঙকে নিয়ে রওনা হল বাড়ির পিছনের দিকের খাঁড়িটাতে অনুসন্ধান চালাবার জন্য।
ঘরের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ পড়ে রইল সন্দীপ। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে গেছিল সে। বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল ব্যাপারটা সম্বন্ধে ধাতস্থ হতে। তারপর ধীরে ধীরে সে নিজের দেহটাকে মেঝের ওপর দিয়ে ঘষটে টেনে নিয়ে গিয়ে কোনো রকমে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসল। সে ভাবতে লাগল কী করা যায়? এক সময় নিজের বোকামির জন্য নিজেকেই তিরস্কার করতে লাগল সন্দীপ। তারপর সে আবার চিন্তা করতে লাগল, ‘না এসব ভেবে এখন লাভ নেই। যে ভাবেই হোক মুক্তি পেতেই হবে তাকে। কিন্তু কীভাবে?’
ভাবতে লাগল সন্দীপ। বাইরে বেলা ক্রমশ বেড়ে চলল। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে মেঘও জমতে শুরু করল আকাশে। বেলা দশটা নাগাদ বৃষ্টি শুরু হল। বাইরের সূর্যের আলো কমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের ভিতরের আলোও কমে আসতে লাগল। হঠাৎ ঘরের ভিতর থেকেই বাইরে বারান্দায় ওঠার ঢালটাতে একটা শব্দ শুনতে পেল সন্দীপ। ও কীসের শব্দ? সেই শয়তান দুজন ফিরে এল নাকি সেই বাঘিনী? চোয়াল শক্ত করে সোজা হয়ে বসল সে। শব্দটা নীচ থেকে ওপরে উঠে এগিয়ে এসে থামল ঘরের দরজার সামনে। চৌকাঠের কাছে উঁকি দিল একটা মাথা। বুকে হেঁটে উপস্থিত হয়েছেন প্রফেসর। জল ঝরছে তার শরীর থেকে। বুকে হেঁটে সরীসৃপের মতোই ঘরে ঢুকলেন তিনি। তারপর সন্দীপের কাছে এসে উঠে বসলেন। তাঁকে দেখে সন্দীপ আশ্বস্ত হয়ে বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম সেই বাঘিনী বা শয়তান লোকদুটো ফিরে এল বুঝি!’
প্রফেসর জবাব দিলেন, ‘বাঘিনীটা এখন কদিন এদিকে আর আসবে না।’ সে সাঁতরে অন্য একটা দ্বীপে চলে গেছে। সে কোথায় আছে আমি জানি। তবে শয়তান দুটো অবশ্য ফিরে আসতে পারে আমাকে খুঁজে না পেয়ে, যদিও তাদের নৌকার পাশ দিয়ে সাঁতরে এখানে এলাম।’
সন্দীপ বলল, ‘আপনি বিশ্বাস করুন প্রফেসর আমি ব্যাপারটার সম্বন্ধে কিছু মাত্র জানতাম না। ভুলটা আমারই। আসলে ওরা এমন ভাবে বলল যে আমি বেশি ভাবার সময় পায়নি। ওদের বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম।’
প্রফেসর বললেন ‘আমি আন্দাজ করতে পারছি ব্যাপারটা। লোকগুলো ভয়ঙ্কর। আমার এখন ধারণা হচ্ছে যে তাজউদ্দিনকে বাঘে নয়, এই গঞ্জালোই খুন করেছিল। আমি তাজউদ্দিনের কথা বুঝতে পারিনি তখন। বাংলাদেশ থেকে তাজউদ্দিনকে নিয়ে আমার কাছে সম্ভবত আসছিল ওই গঞ্জালো। পথে হয়তো তাজউদ্দিনের সঙ্গে কোনো মতবিরোধ হয় অথবা সিন্দুকটা আমার কাছ থেকে নেবার ব্যাপারে মত পরিবর্তন করে তাজউদ্দিন। আর তাই গঞ্জালো খুন করে তাকে।’
সন্দীপ বলল, ‘আপনার কেন মনে হচ্ছে খুন করেছিল?’
প্রফেসর বললেন, ‘আমি দেখতে পেয়েছিলাম যে একটা মানুষ এই চামটার এক চরে পড়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখি যে তাজউদ্দিন! তখন তার শেষ অবস্থা। খাবি খাচ্ছে। তার গলার নলি কাটা। সেটা দেখেই আমার মনে কেমন যেন সন্দেহ হয়েছিল। আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, কীভাবে এমন হল? আমার প্রশ্ন শুনে সে নিজের বাঁ হাত দিয়ে ডান বাহুটা ধরে শুধু উচ্চারণ করেছিল, ‘বাঘ’। আমি ভেবেছিলাম হয়তো সেটা বাঘের কামড়ই হবে। ‘বাঘ’ শব্দটা উচ্চারণ করার পরই মারা গেছিল তাজউদ্দিন। এখন বুঝতে পারছি ডান হাতের বাহু দেখিয়ে আসলে বোঝাতে চেয়েছিল যে, যে তাকে মেরেছে তার ডান বাহুতে বাঘ আঁকা আছে। নিশ্চয়ই খেয়াল করেছো যে ওই গঞ্জালোর বাহুতেও বাঘের উলকি আছে?’
সন্দীপ বলল, ‘হ্যাঁ, দেখেছি। আচ্ছা ওই সিন্দুকের মধ্যে কি জলদস্যুদের গুপ্তধন ছিল বা আছে?’
প্রফেসর বললেন, ‘তুমি গুপ্তধন বলতে সোনাদানার কথা বলছ তো? তেমন জিনিস শুধু একটাই ছিল সেখানে। সিন্দুকটা উদ্ধার করে সোজা আমার কাছে এনে রেখে দিয়েছিল। সে সেটা খোলেনি। একদিন সিন্দুকের তালাটা নিজে থেকেই খসে গেল। আমি তালা খুলে দেখলাম একটা জিনিস ছাড়া যা তার মধ্যে ছিল তা সবই কাগজপত্র দলিল দস্তাবেজ। এক সময় হয়তো সে সব নথির দাম ছিল এখন আর নেই। হ্যাঁ ঐতিহাসিকদের হয়তো সেসব কাজে লাগতে পারে কিন্তু ওদের নয়।’
সন্দীপ বলল, তাহলে এ কথাটা ওদের জানিয়ে দিলেন না কেন?’
প্রফেসর বললেন ‘কথাটা ওরা বিশ্বাস করবে না। ভাববে আমিই আত্মসাৎ করেছি ভিতরের সোনাদানা। তাছাড়া ওরা যে প্রকৃতির লোক তাতে সিন্দুকে কিছু পাওয়া যাক বা না যাক ওরা খুন করবার চেষ্টা করবে আমাদের।’ সন্দীপ বলল, ‘তবে আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। ওরা আসার আগেই চলুন পালাই।’
প্রফেসর বললেন, ‘তোমার হাতের বাঁধন আমি এ ভাবে খুলে যাচ্ছি যে একটু চেষ্টা করলেই সে বাঁধন থেকে মুক্ত হতে পারবে প্রয়োজন মতো। কিন্তু ব্যাপারটা যেন ওরা বুঝতে না পারে। তবে আমি এখান থেকে পালাতে পারলেও তুমি পালাতে পারবে না। সেই বাঘিনীটা এখানে না থাকলেও জঙ্গলে আরও বাঘ আছে। খাঁড়িতেও কিভাবে সাঁতার দেবে তুমি। তাছাড়া লোক দুটোরও যদি চোখে পড়ে যাও তাহলে নিশ্চই তোমাকে দেখে গুলি চালাবে ওরা। আমার মাথায় একটা অন্য পরিকল্পনা আছে। সেই মতোই কাজ করে দেখা যাক।’
সন্দীপ বলল, ‘কী পরিকল্পনা?’
প্রফেসর বললেন ‘ওরা ফিরে এলে তুমি ওদের বলবে যে সিন্দুকটা কোথায় আছে তুমি জানো। আমি তোমাকে গত রাতেই বলেছি সে কথা। তারা যদি তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে রাজি থাকে তবে তুমি সেখানে তাদের নিয়ে যাবে।’
সন্দীপ বলল, ‘কোথায়?’
প্রফেসর বললেন, ‘তুমি হয়তো কুমির দ্বীপ দূর থেকে দেখে থাকবে। ওর পিছনে ছোট একটা নতুন’ দ্বীপ দেখতে পাবে। ওটাকে দ্বীপও বলতে পারো, চরও বলতে পারো। আয়লার সময় গজিয়ে উঠেছিল। ওখানেই একটা জমিতে কেয়া গাছের একটা বড় ঝোপের সামনে বাক্সটা পড়ে আছে। আমি তো ওটা ফেলেই দিয়েছিলাম নদীতে। জোয়ারের জলে ভেসে এসে ওখানে আটকে গেছে। ওখানেই পড়ে আছে অনেকদিন ধরে। তবে বাক্সটার নির্ভুল অবস্থান তুমি আগাম ওদের জানাবে না। তুমি ওদের ও দ্বীপে নিয়ে যাবে। তারপর বাক্সটা ওদের দেখিয়ে দেবে। তবে নিজে বাক্সটার কাছে যাবে না। ওই দ্বীপে ওদের নিয়ে যেতে পারলে ওদের একটা ব্যবস্থা করতে পারব বলে মনে হয়। তাছাড়া তোমাকে একটা রিভলভার দিয়ে যাচ্ছি। প্রয়োজন হলে ওটা ব্যবহার কোরো। আর ভয় নেই আমি তোমার কাছাকাছিই থাকব। প্রয়োজন হলে চিৎকার করবে, আমি হাজির হব। তারপর যা হবার তা হবে। তবে আমার কথাগুলো মনে রাখবে। কৌশলে ওদের ও দ্বীপে নিয়ে ফেলতে হবে।’
প্রফেসর এরপর তার হাতের ফাঁস আলগা করে দিলেন। এরপর ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ছোট রিভলভার নিয়ে ফিরে এসে সেটা সন্দীপের কোমরে জামার আড়ালে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘ভাঁড়ার ঘরের একটা পাটাতনের নীচে এটা অনেকদিন আগে লুকিয়ে রেখে গেছিলাম। আজ কাজে লেগে গেল।’
এ কাজ মেটার পর প্রফেসর বললেন, ‘আমি এবার যাচ্ছি। আমি এখন খাঁড়ির পাড়েই থাকব। মন শক্ত করো, ভয় পেওনা। আমার কথাগুলো সব মনে রেখো। আর বাক্সটা শুধু তুমি দেখিয়ে দিও। কাছে যেওনা। আর ওরা যদি এখানে না ফেরে তবে আমি নৌকা এনে তোমাকে কাল নিয়ে যাব।’—এই বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন প্রফেসর।
সময় এগিয়ে চলল। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ঘরের ভিতর পড়ে রইল সন্দীপ। বাইরে বৃষ্টি হয়েই চলেছে অঝোরধারে। প্রফেসরের বলা কথাগুলো সন্দীপ ভাবতে লাগল।
।। ৯।।
বেলা তিনটে নাগাদ বৃষ্টি একটু ধরে এলো। আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই নীচের জমিতে কথাবার্তার অস্পষ্ট শব্দ কানে এল সন্দীপের। নীচ থেকে ওপরে উঠে সন্দীপের ঘরের ভিতর পা রাখল সেই দুই শয়তান। তাদের চেহারাও বিধ্বস্ত। সারা শরীর জলে ভিজে আছে। কাদা মাখা হাত পা। হতাশাজনিত একটা ক্রুদ্ধ ভাব ফুটে আছে তাদের চোখে-মুখে। ঝড়-জলের মধ্যে এতক্ষণ খাঁড়ি-জঙ্গলে প্রফেসরের অনুসন্ধান চালিয়েও তারা তাঁকে খুঁজে পায়নি। গঞ্জালো হিংস্রভাবে সন্দীপকে বলল, ‘তোমার জন্যই বুড়োটা আমাদের হাত ফসকে পালাল। আমাদের সব পরিকল্পনা পণ্ড হোল। এখানে কেন ফিরে এলাম জানো? বাঘের ভরসাতে তোমাকে ফেলে রেখে না গিয়ে নিজের হাতে মারার জন্য। তাজউদ্দিন আমাকে এখানে টেনে এনে প্রফেসর আর সেই সিন্দুকের খোঁজ দিতে অস্বীকার করেছিল। তারপর তার গলা কেটে আমি নদীর চরে ফেলে গেছিলাম। ঠিক তোমাকেও তাই করব।’
তমসারঞ্জনের হাতের বন্দুকও সন্দীপের দিকে তাগ করা। সে এবার বলল ‘সত্যি কথা বলো, প্রফেসর কোথায় থাকে সে কথা কি তোমার জানা? সে বলেছে তোমাকে?’
গঞ্জালো বলল, ‘হ্যাঁ। জানলে বলে ফেল। নইলে এখনই গুলি করব। সত্যিকারের জলদস্যুর রক্ত আজও প্রবাহিত হচ্ছে, জলদস্যুর রক্ত। তাজউদ্দিনের মতো ছিঁচকে জলদস্যু নয়, সত্যিকারের জলদস্যু-হার্মাদের রক্ত। তাদের মতো মানুষ মারতে আমারও হাত কাঁপে না।’
তাদের দুজনের কথাই কথা বলার সুযোগ করে দিল সন্দীপকে। সে বলল, ‘প্রফেসরের নতুন ডেরার খবর জানিনা। তবে….।’ এই বলে থেমে গেল সন্দীপ।
তমসারঞ্জন ধমকের স্বরে বলল, ‘থামলে কেন? তবে কী?’
সন্দীপ বলল, ‘তিনি কোথায় তা না জানলেও সিন্দুকটা কোন জায়গাতে আছে আমি জানি।’
সন্দীপের কথা শুনে তারা দুজনেই চমকে উঠল। তমসারঞ্জন বলল, ‘তুমি জানো কোথায় সে সিন্দুক?’
সন্দীপ বলল, ‘বললাম তো জানি। প্রফেসর আমাকে কাল রাতেই জানিয়েছিলেন সেটা কোথায় আছে।’
গঞ্জালো বলল, ‘তবে সেটা আগে বলিসনি কেন? এখনই বল নইলে গুলি করব।’
সন্দীপ বলল, ‘গুলি করতে পারো ঠিকই। কিন্তু আমাকে মারলে তোমাদের কোনো লাভ হবে না। সিন্দুকের খোঁজ আর কোনোদিন তোমরা পাবে না। আমার একটা শর্ত আছে। তা মানলে আমি সিন্দুকের খোঁজ দেব।’
গঞ্জালো চিৎকার করে উঠে বলল, ‘তুই আমাদের শর্ত শোনাতে চাইছিস এখনও!’
কিন্তু তমসারঞ্জনের শয়তানের মাথা গঞ্জালোর মাথা থেকে বেশি ঠান্ডা। সে গঞ্জালোকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘দাঁড়াও ও আগে কী বলতে চায় শুনি।’
এবার সে সন্দীপকে বলল, ‘বলো তোমার শর্ত?’
সন্দীপ বলল, ‘আমি তোমাদের কাল সে জায়গাতে নিয়ে যাব। সিন্দুকটা তোমরা পেলে আমাকে নিরাপদে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’
কথাটা শুনে তমসারঞ্জন প্রথমে প্রশ্ন করল, ‘কাল কেন? আজ নয় কেন?’
সন্দীপ জবাব দিল, ‘সে জায়গা হল কুমির দ্বীপের ওপাশে একটা নতুন ছোট দ্বীপ। সেখানে তো আর রাতে পৌঁছলে লাভ হবে না। সিন্দুকটা খুঁজে বার করতে হবে। তবে আমাকে মেরে তোমরা যদি সে দ্বীপে যাও তবে সিন্দুক খুঁজে পাবে না। আর সেখানে পৌঁছবার আগে আমাকে মারলেও সিন্দুকের সন্ধান দেব না কিছুতেই।’
তমসারঞ্জন বলল, ‘তুমি ঠিক বলছো তো? সেখানে সিন্দুক না পেলে কিন্তু ওখানেই তোমাকে মেরে জলে ভাসিয়ে দেব।’
সন্দীপ বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। কিন্তু আমার শর্তটা?’
এবার কয়েক মুহূর্ত যেন ব্যাপারটা নিয়ে ভাবল তমসারঞ্জন। তারপর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘আচ্ছা তাই হবে। সিন্দুকটা পেলে তোমাকে আমরা নিরাপদে ফিরিয়ে নিয়ে যাব।’
সন্দীপ নিশ্চিত যে তমসারঞ্জন মুখে এ কথা বললেও মনে মনে সে বলল, ‘সিন্দুক পেলেও তোমাকে খুন করব। এসব ঘটনার সাক্ষী কেউ রাখে নাকি?’
সন্দীপ যেন তার কথাটা বিশ্বাস করেছে এমন ভাব দেখিয়ে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘তবে এই কথাই হল। এবার আমার বাঁধন খুলে দাও!’
গঞ্জালো বলল, ‘তোমার কথা কতটা সত্যি তা আমরা এখনও জানিনা। হাতের বাঁধন সিন্দুক উদ্ধারের আগে খোলা হবে না, তবে হাঁটিয়ে নিয়ে যাবার জন্য পায়ের বাঁধন খুলে দিচ্ছি।’
এরপর তার কাছে এসে পায়ের বাঁধন খুলতে শুরু করল গঞ্জালো। সন্দীপের ভয় হচ্ছিল তার কোমরে গোঁজা রিভলবারের উপস্থিতি যেন সে টের না পেয়ে যায়! কিন্তু সৌভাগ্যবশত তেমন কিছু ঘটল না। পায়ের বাঁধন খোলার পর তাকে দাঁড় করিয়ে ঘরের বাইরে আনা হল। তারপর বাড়িটা থেকে নামিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হল বাড়িটার পিছনের খাঁড়ির দিকে। নৌকাটা এখন সেদিকেই আছে। নৌকায় ওঠানো হল তাকে। সারেঙ হারান নস্করের ভয়ার্ত মুখ দেখে সন্দীপ অনুমান করল যে তার কিছু করার নেই, বন্দুকের নলের সামনে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছে সে। সবাই নৌকাতে ওঠার পর নৌকা ছাড়ার আগের মুহূর্তে সারেঙ বিড়বিড় করে বলল, ‘কুমির!’
পাশেই বসেছিল সন্দীপ। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখল নৌকার বেশ কিছুটা তফাতে খাঁড়ির ধারে শুয়ে আছে বিরাট একটা কুমির! তমসারঞ্জন বা গঞ্জালোও হয়তো বা দেখতে পেল কুমীরটাকে। কিন্তু তারা ব্যাপারটাকে তেমন আমল দিল না। নৌকা রওনা হল খাঁড়ি বেয়ে। সন্দীপ তাকিয়ে রইল কুমিরটার দিকে। নৌকাটা তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে যাবার পর সন্দীপ দেখতে পেল পাড় থেকে জলে নামল কুমিরটা। ভরা বর্ষার খাঁড়ি বেয়ে সে যেন অনুসরণ করতে শুরু করল নৌকাটাকে। একটু ঘুর পথেই লঞ্চের দিকে যেতে হল সন্দীপদের। তারা যখন নৌকাতে করে লঞ্চে পৌঁছাল, তখন সূর্য ডুবতে চলেছে। আকাশে আবার জমতে শুরু করেছে বর্ষার মেঘ। লঞ্চে ওঠার পর সন্দীপকে খোলে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। খোল ছেড়ে উপরে ওঠার সময় গঞ্জালো তাকে বলে গেল, ‘আমাদের যা বলেছিস তুই তার মধ্যে যদি কোনো চালাকি থাকে তবে এটাই শেষ রাত। পা খোলা রইল ঠিকই, কিন্তু ওপরে উঠে পালাবার চেষ্টা করলে বিপদ হবে। আমি ওপরেই আছি।’
কোনো ভাবে খোলের মধ্যে একটা চেয়ারে উঠে বসল সন্দীপ। বাইরে অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গেই খোলের ভিতরের অন্ধকার আরও গাঢ় হতে শুরু করল। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই মুষলধারে বৃষ্টি নামল। অন্ধকার খোলে বসে বৃষ্টির শব্দ শুনতে লাগল সন্দীপ। জল ক্রমশ বাড়ছে। দুলছে লঞ্চটা। রাত আটটা নাগাদ সারেঙ হারান নীচে নামল চালের পাত্র থেকে চাল নেবার জন্য। একটা লন্ঠন তার সঙ্গে। খোলে নামার সিঁড়ির মুখটাতেই দাঁড়িয়ে গঞ্জালো। তার জুতো পরা পা দুটো দেখা যাচ্ছে। সারেঙকে দেখে সন্দীপ বলল ‘আমাকে একটু জল দাও।’
তার গলার শব্দ শুনে ওপর থেকে কর্কশ স্বরে জানতে চাইল, ‘ও কী বলছে?’
সারেঙ বলল, ‘জল চাচ্ছে।’
ওপর থেকে নির্দেশ এল ‘আচ্ছা দাও।’
জলের ড্রাম থেকে একটা গ্লাস জল নিয়ে সন্দীপের কাছে এসে তার মুখে জল ঢেলে দিতে চাপাস্বরে সারেঙ বলল, ‘আপনি না থাকলে এদের এখানে ফেলে রেখে আমরা পালিয়ে যেতাম। সজাগ থাকবেন। কাল আপনাকে নিয়ে পালাবার চেষ্টা করব।’
ওপর থেকে গঞ্জালোর গলা শোনা গেল, ‘এত দেরি হচ্ছে কেন?’
সারেঙ সঙ্গে সঙ্গে সন্দীপের কাছ থেকে সরে গিয়ে চাল নিয়ে ওপরে উঠে গেল।
খোলের জানলার বাইরে তাকিয়ে বসে রইল সন্দীপ। সময় আরো এগিয়ে চলল। বৃষ্টি পড়ছে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁক গলে মাঝে মাঝে উঁকি মারছে চাঁদ। জলস্তর ফুলে উঠছে বৃষ্টি আর জোয়ারের জলে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ সন্দীপ খেয়াল করল একটা কী যেন ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসছে লঞ্চের দিকে! মেঘ চাঁদের বুক থেকে একটু সরে যেতেই জিনিসটাকে চিনতে পারল সন্দীপ। বিরাট বড় একটা কুমিরের খাঁজকাটা পিঠ জেগে আছে জলের ওপর। ভাসতে ভাসতে এর পরই কুমিরটা চলে এল জানলার কাছে। জল থেকে মুখ তুলল প্রাণীটা। চাঁদের আলোতে ড্যাবড্যাবে চোখে সে তাকিয়ে আছে জানলার দিকে। আর তারপরই গুলির শব্দ শোনা গেল! সন্দীপের চোখের সামনে কুমিরটা জলতল থেকে লাফিয়ে উঠেই পরমুহূর্তে জলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। মেঘ ঢেকে দিল চাঁদকে। বাইরে অন্ধকার নেমে এল।
ওপর থেকে গঞ্জালোর উদ্দেশ্যে তমসারঞ্জনের গলা শোনা গেল, ‘শুধু শুধু কুমিরটার জন্য বুলেট খরচা করলে কেন?’
জবাবে গঞ্জালো কী একটা বলল। তারপর সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেল। গুলিটা কি কুমিরটার লেগেছে? এ কোন কুমির? একটা চাপা আতঙ্ক ঘিরে ধরতে শুরু করল সন্দীপকে। কাল যদি প্রফেসর না আসেন তবে কীভাবে উদ্ধার পাবে সে? রাত বেড়ে চলল। আগের দিনের মতোই বৃষ্টি থামল শেষ রাতে।
।। ১০।।
অন্ধকার কেটে গিয়ে ভোর হল। সূর্য ওঠার কিছুক্ষণ পর গঞ্জালো এসে খোল থেকে ওপরে তুলে আনল সন্দীপকে। সামনে দাঁড়িয়ে তমসারঞ্জন। সে সন্দীপকে বলল,’তোমার কথা মতোই কিন্তু আমরা ওই দ্বীপে রওনা হব। যদি ওখানে কিছু না পাওয়া যায় তবে ওখান থেকে আর ফিরে আসা হবে না তোমার।’ সন্দীপ দৃঢ় ভাবে বলল, ‘বলছি তো ওখানেই জিনিসটা আছে।’
তমসারঞ্জন তার হাতের বন্দুকটা নাচিয়ে সন্দীপকে বলল, ‘ঠিক আছে, দেখা যাক।’ তারপর সারেঙকে বলল, ‘লঞ্চ চালু করো। কুমির দ্বীপের পিছনে যে দ্বীপটা আছে সেখানে যাব।’
এঞ্জিন চালু হয়ে লঞ্চের মুখ ঘুরে গেল। ভোরের আলোতে চামটার গা বেয়ে লঞ্চ এগোল সেই অজানা জায়গার দিকে। সারেঙের কেবিনের ভিতর সারেঙ আর তার সহকর্মী। কেবিনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সন্দীপ। তাদের যাত্রাপথটা ভালো করে দেখার জন্য তমসারঞ্জন আর গঞ্জালো বন্দুক হাতে কিছুটা তফাতে রেলিং-এর ধারে গিয়ে দাঁড়াতেই সারেঙ তার সঙ্গীকে বলল, ‘আমরা যদি দ্বীপে নামি তবে সঙ্গে সঙ্গে আবার লঞ্চের এঞ্জিন চালু করে রাখবি।’
এ কথা বলে সে সন্দীপকে বলল, ‘আপনি আমাকে খেয়াল রাখবেন। সুযোগ পেলেই ওদেরকে দ্বীপে ফেলে পালাব। আমি কাল আড়াল থেকে ওদের আলোচনা শুনেছি। ওই দ্বীপে যাবার পর ওরা সজনেখালির দিকে ফিরবে না। লঞ্চ নিয়ে বাংলাদেশের দিকে পালাবে।’
গঞ্জালোরা মনে হয় বুঝতে পারল যে সন্দীপকে সারেঙের কেবিনের কাছে দাঁড় করিয়ে রাখা ঠিক হচ্ছে না। তাই তমসারঞ্জন হাঁক দিল, ‘এই তুমি আমাদের কাছে এসে দাঁড়াও।’
নির্দেশ শুনে হাত বাঁধা সন্দীপ তাদের কিছুটা তফাতে গিয়ে রেলিঙের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সূর্য উঠলেও চামটার জঙ্গলের ঘুম ভাঙেনি। জঙ্গলের ভিতর হারিয়ে যাওয়া খাঁড়িগুলোতে এখনও জমাট বেঁধে রয়েছে অন্ধকার। সন্দীপদের অলক্ষে কোনো শ্বাপদ হয়তো ওই অন্ধকার খাঁড়ির আড়াল থেকে জিভ চাটছে তাদের দেখে! সন্দীপ তাকিয়ে রইল বড় গাঙটা থেকে জঙ্গলের ভিতর চলে যাওয়া খাঁড়িগুলোর দিকে।
কিন্তু এক সময় ধীরে ধীরে পিছনে সরে যেতে লাগল চামটার জঙ্গল। লঞ্চ এবার এগোতে শুরু করল কুমির দ্বীপের দিকে। সন্দীপের চোখের দেখায় দ্বীপটাকে যত কাছে মনে হয়েছিল আসলে দ্বীপটা তত কাছে নয়। খুব ধীর গতিতে সন্দীপদের চোখের সামনে বাড়তে লাগল বিন্দুর মতো কালো দ্বীপের আকৃতি। প্রায় এক ঘণ্টা সময় লেগে গেল তাদের কুমীর দ্বীপের কাছে পৌঁছতে। দ্বীপটাকে বেড় দিয়ে লঞ্চকে এগোতে হবে পিছনের সেই অজানা দ্বীপে যাবার জন্য। গঞ্জালো সারেঙকে বলল, ‘দ্বীপের গা ঘেঁষে লঞ্চ চালাও। বাইরে থেকে দ্বীপটাকে দেখি।’ তার নির্দেশ পালন করে কুমির দ্বীপের একদম গা ঘেঁষে লঞ্চ চালাতে লাগল সারেঙ। খুব বেশি বড় গাছ নেই দ্বীপটিতে। তবে খাঁড়ির পাড়ে জেগে আছে বিস্তৃত চর। কিন্তু সে সব চরে কোনো কুমির চোখে পড়ছে না দেখে বেশ আশ্চর্যই লাগল সবার। তারা সবাই শুনেছে যে এ দ্বীপে নাকি এত কুমির যে পাড়েই নামা যায় না। বিরাট বিরাট সব মোহনার কুমির। তমসারঞ্জন তার দূরবীনটা দিয়ে দ্বীপের ভিতরটা দেখার চেষ্টা করতে লাগলেন। হয়তো তিনি দেখার চেষ্টা করতে লাগলেন দ্বীপে প্রফেসরের কোনো চিহ্ন মেলে কিনা?
তারপর তিনি একসময় বলেই ফেললেন, ‘এ দ্বীপে তো কুমিরের টিকিই দেখছি না। এমনও হতে পারে এখানেই প্রফেসর থাকে, অথবা যে দ্বীপে যাচ্ছি সেখানে থাকে।’
গঞ্জালো বলল, ‘সিন্দুকটা যদি পেয়ে যাই তবে ল্যাঠা চুকে গেল। নইলে এ দ্বীপেও নেমে তল্লাশি চালাব।’ একটাও কুমির চোখে না পড়লেও দ্বীপের শেষ প্রান্তে পৌঁছে অন্য একটা অদ্ভুত ঘটনা দেখতে পেল তারা। কুমির দ্বীপের আড়ালে থাকা নতুন দ্বীপটা এখন সন্দীপদের চোখে পড়ছে। এমন সময় কুমির দ্বীপের একটা চড়াতে তারা দেখতে পেল বিরাট বিরাট তারখেল বা সর্দার গোসাপ। ঘাড় উঁচু করে তারা চেয়ে আছে লঞ্চটার দিকে। প্রচুর তারখেল। যেন দ্বীপের সব তারখেল এসে জমা হয়েছে সেখানে। এতবড় আকারের তারখেল সচরাচর চোখে পড়ে না। গঞ্জালো মন্তব্য করল, ‘এই বড় বড় তারখেলগুলোকে লোকে দূর থেকে কুমির ভাবে না তো?’ তমসারঞ্জন হেসে বলল, ‘হতে পারে।’
আর এর পরই এক অদ্ভুত কাণ্ড করল সে প্রাণীগুলো। একদল তারখেল জলে ঝাঁপ দিয়ে সোজা এগিয়ে আসতে লাগল লঞ্চের দিকে। তারপর তারা ঘিরে ধরল লঞ্চটাকে। গঞ্জালো বলল, ‘বনদপ্তরের লোকরা হয়তো লঞ্চ থেকে ওদের খাবার দেয়। তাই ওরা লঞ্চ দেখে এসেছে।’
কুমির দ্বীপকে পিছনে ফেলে লঞ্চ এরপর এগোল সামনের দ্বীপটার দিকে। তারখেলগুলো কিন্তু তাদের দ্বীপে ফিরে গেল না। ঝাঁক বেঁধে অতি দ্রুত গতিতে লঞ্চের আগে সাঁতরাতে সাঁতরাতে তারাও এগোল নতুন দ্বীপটার দিকে। হয়তো এ দুই দ্বীপের মধ্যে তাদের যাওয়া আসা আছে।’
কাছে এগিয়ে আসতে লাগল সেই নতুন দ্বীপ। এ দ্বীপটাও কুমির দ্বীপের মতো ঝোপজঙ্গলে ভরা। বড় গাছ এখনও তেমন বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়নি। তবে মাকড়সার জালের মতো সরু সরু অসংখ্য খাঁড়ি ঢুকছে দ্বীপ বা চরটার ভিতরে। দ্বীপটার কাছাকাছি পৌঁছে সন্দীপরা দেখতে পেল সেই তারখেলগুলো দ্বীপের একটা খাঁড়ির মধ্যে ঢুকে গেল।
সেই নতুন দ্বীপের গাঁ ঘেঁষে লঞ্চ দাঁড়িয়ে পড়ল। সরু খাঁড়ির ভিতর লঞ্চ ঢুকবে না। তমসা তার দূরবীন দিয়ে দ্বীপের ভিতরটা বেশ কিছুক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করল। দ্বীপটার দিকে। তাকিয়ে সন্দীপেরও যেন মনে হল দ্বীপটা তেমন বিপজ্জনক নয়। দু-একটা পাখির ডাকও যেন জঙ্গলের ভিতর শোনা যাচ্ছে। চামটার দিকে তাকালেই যেমন ভয়ঙ্কর গা ছমছমে ভাব জাগে, নির্জন হলেও তেমন গা ছমছমে ভাবটা যেন এখানে নেই। খাঁড়িগুলো সংকীর্ণ হলেও বড় বড় গাছ না থাকায় সূর্যের আলো মোটামুটি প্রবেশ করছে সেখানে।
নোঙর ফেলা হল। প্রথমে নৌকাতে নামল সারেঙ, তারপর একে একে গঞ্জালো, সন্দীপ আর তমসারঞ্জন। খাঁড়িতে প্রবেশ করল নৌকা। গঞ্জালো জানতে চাইল, ‘কোন পথে যাব আমরা? সিন্দুকটা কোন জায়গাতে আছে?’
সন্দীপ বলল, ‘খুঁজে বার করতে হবে জায়গাটা। কাছে গেলে চিনতে পারব।’
এরপর সন্দীপ বলল, ‘আমার হাতের বাঁধনটা খুলে দিলে হয় না? টাল সামলাতে না পেরে জলে পড়ে যেতে পারি।’
তমসারঞ্জন বলল ‘না, খোলা যাবে না। জলে পড়লে পড়বে। আবার তুলে নেব।’
এগিয়ে চলল নৌকা। দু-পাশে সুন্দরী আর গরানের ছোট ছোট গাছ, ঝোপঝাড়। এই গাছগুলোই একদিন বড় হয়ে খাঁড়িগুলোকে অন্ধকারে ঢেকে দেবে, জঙ্গলের রাজার আস্তানা গড়ে তুলবে এখানে। খাঁড়ির ভিতর ঝোপের আড়ালে পাখি ডাকছে। এক জায়গাতে এই প্রথম কয়েকটা বাঁদরও দেখতে পেল তারা। এক খাঁড়ি থেকে এক খাঁড়ি বেয়ে দ্বীপটার মধ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগল নৌকাটা। কিন্তু সন্দীপের চোখে সেই কেয়া গাছের ঝোপ মিলতে লাগল না। মাথার ওপর রোদ উঠতে শুরু করল।
ঘণ্টাখানেক সময় কেটে গেল। গঞ্জালো একটু অধৈর্য হয়ে বলল, ‘জায়গাটা কোথায়? নাকি মিথ্যা বলে আমাদের ঘুরিয়ে মারছিস?’
সন্দীপ জবাব দিল, ‘না, মিথ্যা বলিনি। এখানেই কোথাও সে জায়গা। নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে।’
সে মুখে এ কথাটা বললেও মনের মধ্যে কেমন যেন ভয় জন্মাতে লাগল তার। প্রফেসর নিশ্চয়ই তাকে মিথ্যা বলেননি। কিন্তু সন্দীপ যদি খুঁজে না পায় তবে এ লোক দুটো নির্ঘাত তাকে গুলি করে এখানে ফেলে রেখে যাবে। আর প্রফেসরই বা কোথায়? তার কিছু হয়নি তো?
নৌকাতে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করতে লাগল সন্দীপ।
আরও সময় কেটে গেল। একটা নতুন খাঁড়িতে প্রবেশ করতে চলেছে নৌকা। তমসারঞ্জনও এবার অধৈর্য হয়ে বলল, ‘শেষ এই খাঁড়িটা দেখব। এখানে যদি জায়গাটা খুঁজে না পাওয়া যায় তবে এই খাঁড়িতেই মেরে রেখে যাব তোমাকে।’
সর্পিল খাঁড়িতে প্রবেশ করল নৌকা। এখানেও দুপাশে বড় গাছ নেই, সবই মাথা সমান উঁচু ঝোপঝাড়। তবে এ খাঁড়ির ভিতর প্রবেশ করতেই কেমন যেন অন্য রকম নৈঃশব্দ অনুভব করল সন্দীপ। কোথাও কোনো পাখি ডাকছে না। কেমন যেন থমথমে চারপাশ। অনেকটা যেন চামটার নিস্তব্ধতার মতো। এগোতে লাগল তারা। কিছুটা এগোবার পরই তারা আবার সেই তারখেলগুলোকে দেখতে পেল। খাঁড়ির একটা পাড়ে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে তারা। তারখেলগুলো ঘাড় উঁচিয়ে দেখলে নৌকাটাকে। তারপর জলে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সামনেই একটা বাঁক। খাঁড়িটা মনে হয় এবার শেষ হয়ে আসছে। বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল সন্দীপের। বাঁক নিল নৌকা। হ্যাঁ, কিছুটা এগিয়েই শেষ হয়েছে খাঁড়িটা। এক পাশে কিছুটা ফাঁকা জমি। আর সেই জমিটার ঠিক মাঝখানে একটা বিরাট কেয়া গাছের ঝোপ চোখে পড়ল সন্দীপের। আর তার পাতাগুলো মাটির দিকে নুইয়ে পড়েছে। জমিটার উল্টো দিকেও একটা খাঁড়ি আছে। নৌকাটা আরও কিছুটা এগোতেই কেয়া গাছের পাতার নীচে সিন্দুকের বাইরে বেরিয়ে থাকা অংশটাও দেখতে পেল সন্দীপ। সে বলল, ‘আমরা এসে গেছি। ওই যে কেয়া গাছের ঝাড়ের নীচে সিন্দুকটা রয়েছে।’
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তমসারঞ্জন ও গঞ্জালোও দেখতে পেল গাছের নীচে রাখা সিন্দুকটা। তাদের মুখমণ্ডলে লোভ যেন এবার প্রকট হয়ে উঠল। ঠোঁটের কোণে ফুঠে উঠল ধূর্ত হাসি। গঞ্জালো সারেঙকে নির্দেশ দিল, ‘পাড়ে নৌকা লাগাও।’ নৌকা থেকে নামার আগে বন্দুক উঁচিয়ে চারপাশটা একবার দেখে নিল গঞ্জালো। না, চারপাশে তেমন কোনো বিপদের সম্ভবনা নেই—এমনই সম্ভবত মনে হল তার। প্রথমে সেই-ই পাড়ে নামল, তারপর তমসারঞ্জন, সব শেষে সন্দীপ। কাদা মাটি ভেঙে শক্ত জমিতে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল সন্দীপ। আর তমসারঞ্জন আর গঞ্জালো এগোল জমির মাঝখানে কেয়া ঝোপের নীচে সিন্দুকটার দিকে। বেশ বড় মাপেরই সিন্দুকটা। সন্দীপ অনুমান করল বেশ লম্বাটে সিন্দুকটা অন্তত পাঁচ-ছ’ ফুট চওড়া হবে। দু’-আড়াই ফুটের মতো অংশ মাটির ওপর জেগে আছে, বাকিটা মাটির ভিতর গাঁথা। গঞ্জালোরা এগোচ্ছে সিন্দুকটার দিকে। প্রফেসর তো বলেছেন ও সিন্দুকে কিছু নেই। ওরা যখন সিন্দুকটা খুলবে তখন কী হবে? বিপদ হয়তো সন্দীপের দিকে এগিয়ে আসছে। কথাটা মনে হতেই সন্দীপ হাতের বাঁধন খুলে ফেলল। কোমরে পিস্তলটা আছে। তেমন হলে একটা শেষ লড়াই দেবার জন্য সন্দীপ প্রস্তুত হল।
সিন্দুকটার কাছে গিয়ে হাজির হল তারা দুজন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে তারা সিন্দুকটা দেখল। সন্দীপ শুনতে পেল তমসারঞ্জন, গঞ্জালোকে বলল, ‘তালা নেই কেন? ভিতরে জিনিসপত্র আছে তো? খোল সিন্দুকটা।’
নিজের বন্দুকটা তমসারঞ্জনের হাতে দিল গঞ্জালো। তারপর ঝুঁকে পড়ে সিন্দুকের ডালাটা খোলার চেষ্টা করতে লাগল। অনেকদিন ডালাটা খোলা না হওয়াতে সেটা খুলতে একটা কসরত করতে হল তাকে। তারপর শব্দ করে ডালাটা ওপরে উঠে গেল। মুখটা হাঁ হয়ে গেল বিরাট সিন্দুকের। তারা দুজন এবার সিন্দুকের ভিতর ঝুঁকে পড়তে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই সন্দীপ স্পষ্ট দেখতে পেল সেই সিন্দুকের ভিতর থেকে উঠে দাঁড়াল একটা বিরাট বড় মাথা! তার পরই নখর যুক্ত প্রচণ্ড থাবার আঘাতে ছিটকে পড়ল গঞ্জালো। আর তমসারঞ্জন দ্রুত সরে আসতে লাগল সিন্দুকের কাছ থেকে। একটা ছোট লাফে সিন্দুকের বাইরে নেমে এসে সূর্যের আলোতে দাঁড়াল প্রকাণ্ড এক বাঘ! না বাঘ নয়, বাঘিনী। আগুন ঠিকরে পড়ছে তার চোখ থেকে। সে বাইরে আসতেই গঞ্জালো উঠে পালাতে যাচ্ছিল। কিন্তু প্রচণ্ড গর্জনে চারপাশ কাঁপিয়ে বাঘিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল গঞ্জালোর ওপর। মাটিতে ধস্তাধস্তি শুরু হল গঞ্জালো আর বাঘিনীর মধ্যে। গঞ্জালোর আর্তনাদ আর বাঘিনীর গর্জনে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে লাগল অরণ্যের নিস্তব্ধতা। পাখির দল ভয় পেয়ে আকাশে উড়তে লাগল। তমসা যেন এরপর কিছুটা ভয় কাটিয়ে উঠল। সঙ্গীকে বাঁচাবার জন্য সে শূন্যে গুলি চালাল। কিন্তু সম্ভবত ঠিক সে মুহূর্তেই গঞ্জালোর ঘাড় ভেঙে দিল বাঘিনী।
ঠিক এই সময় সারেঙের গলার শব্দ শুনতে পেল সন্দীপ। ‘তাড়াতাড়ি নৌকায় উঠে পড়ুন মাস্টারবাবু। আমরা পালাব।’ কথাটা শুনেই নৌকার দিকে এগোল সন্দীপ। তমসা এগোতে যাচ্ছিল মাটিতে পড়া গঞ্জালোর দিকে। কিন্তু হঠাৎ কীভাবে যেন তার চোখ পড়ে গেল সন্দীপের দিকে। সে বুঝল সন্দীপ আর সারেঙ পালাচ্ছে। সে ছুটে এল খাঁড়ির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে পিস্তল বার করে তাকে লক্ষ্য করে ট্রিগার টেনে দিল সন্দীপ। লক্ষ্য ভেদের কোনো প্রশ্নই ছিল না। গুলি বেরোবার অভিঘাতে পিস্তলটা ছিটকে পড়ল খাঁড়ির জলে। কোনোরকমে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে কাদা ভেঙে নৌকাতে উঠে পড়ল সন্দীপ। প্রথম অবস্থায় সন্দীপকে গুলি চালাতে দেখে থমকে গেছিল তমসারঞ্জন। কিন্তু সে যখন বুঝতে পারল যে সন্দীপের হাতে আর পিস্তলটা নেই তখন সে ছুটে এল খাঁড়ির পাড়ে। সারেঙ তখন জলে বৈঠা মারতে শুরু করেছে। চল্লিশ হাত মতো এগিয়ে গেছে নৌকা। খাঁড়ির পাড়ে দাঁড়িয়ে নৌকার দিকে বন্দুক তাগ করল তমসারঞ্জন—সেই ভুয়ো বিজ্ঞানী। সারেঙ বলল, ‘শুয়ে পড়ুন’—এই বলে সে বৈঠা উঁচিয়ে নৌকাতে শুয়ে পড়ল। সন্দীপও সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়ল। গুলি চালাল তমসারঞ্জন। গুলিটা সন্দীপদের কারো গায়ে লাগল না ঠিকই কিন্তু বৈঠাতে গিয়ে লাগল। বন্দুকের গুলি বলে কথা। সট করে দু-টুকরো হয়ে গেল বৈঠা। খাঁড়িতে এখানে স্রোত নেই। কয়েক হাত এগিয়ে থেমে গেল নৌকা। তমসা নামের লোকটা চিৎকার করে বলে উঠল, ‘নৌকা থেকে পালাবার চেষ্টা করলেই গুলি করে মারব।’ এই বলে সে খাঁড়িতে নেমে পড়ল। খাঁড়িটা বেশি গভীর নয়, বুক পর্যন্ত জল। সন্দীপদের আর কিছু করবার নেই। মাথা তুলল তারা। লোকটা বন্দুক তাগ করে বুক জল ভেঙে এগোচ্ছে নৌকার দিকে। ভয়ঙ্কর ভাব ফুটে উঠেছে তার মুখে, যেন সে কোনো সাথীহারা হিংস্র প্রেত! মূর্তিমান জিঘাংসার মতো সে এগোচ্ছে নৌকার দিকে। তার উদ্যত বন্দুকের সামনে অসহায় সন্দীপরা।
তমসারঞ্জন নৌকার প্রায় কাছাকাছি চলে এল। মাত্র হাত দশেক ব্যবধান তার সঙ্গে নৌকার। তার বন্দুকের গুলি বেরোবার ছিদ্রটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সন্দীপ। সম্ভবত সেটা প্রথম সন্দীপের বুকের দিকে তাগ করা। কিন্তু এর পরেই একটা ঘটনা ঘটল। এক পা, এক পা করে নৌকার দিকে এগোচ্ছিল লোকটা। হঠাৎই তার চারপাশে খাঁড়ির জলে জেগে উঠল অসংখ্য বুদবুদ। আর তার পরেই তমসারঞ্জনকে ঘিরে তার চারদিকে জলের ওপর দেখা দিল অনেক জোড়া ড্যাবড্যাবে চোখ। কুমির! কিন্তু এ খাঁড়িতে কুমির এল কীভাবে? এখানে এর আগে তো একটাও কুমির চোখে পড়েনি সন্দীপদের! জলতলের ওপর ভেসে উঠেছে তাদের কালো কাঁটাওলা পিঠ আর মাথা। তমসার চারদিকে যেন ব্যুহ রচনা করেছে! সাত-আটটা কুমির! তারা যেন নৌকার দিকে এগোতে দিতে চাচ্ছে না তমসাকে। তমসারঞ্জনও তার সামনে ভেসে ওঠা কুমিরগুলোকে দেখে প্রথমে থমকে দাঁড়াল। যদিও তার সামনে পিছনে সর্বত্রই কুমির! খুব বড় না হলেও মাঝারি আকৃতির কুমির সব। পিঠ আর ড্যাবড্যাবে চোখ জলের ওপর ভাসিয়ে তারা তাকিয়ে রয়েছে তমসারঞ্জনের দিকে। তমসা থমকে যেতেই তারাও থমকে গেল। স্থির হয়ে ভাসতে থাকল জলের ওপর। কিন্তু এর পরই হয়তো চরম ভুল করে বসল তমসারঞ্জন। তার সামনের একটা কুমিরকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে দিল সে। গুলি খেয়ে জল থেকে ছিটকে লাফিয়ে উঠে জলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল প্রাণীটা। আর তারপরই অন্য কুমিরগুলো এগিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তমসারঞ্জনের ওপর। তমসারঞ্জনের চিৎকার আর তাকে ঘিরে কুমিরগুলোর ভয়ঙ্কর হুটোপুটি শুরু হল। সন্দীপের চোখের সামনে অবতারণা হল এক বীভৎস দৃশ্যর। কিন্তু তার কোনো কিছু করার নেই। অন্য দিকে মুখ ফেরাল সে আর সারেঙ। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য থেমে গেল জলের মধ্যে কুমিরগুলোর দাপাদাপির শব্দ। ভয়ে ভয়ে এরপর সেদিকে মুখ ফেরাল সন্দীপ। কুমিরগুলো এখন অদৃশ্য হয়ে গেছে, শুধু যে জায়গাতে লোকটা ছিল সে জায়গাতে খাঁড়ির জল রক্তবর্ণ ধারণ করেছে! তমসারঞ্জন আর সেখানে নেই। সম্ভবত জলের নীচে তার দেহটাকে টেনে নিয়ে গেছে কুমিরের ঝাঁক। আর এর পরই প্রফেসরের গলা শুনতে পেল সন্দীপ—নৌকা থেকে নেমে এস সন্দীপ। আর ও লোক দুজনের ভয় নেই।’ সন্দীপ দেখল কিছুটা তফাতে খাঁড়ির পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন প্রফেসর!
সন্দীপ আর সারেঙ বিস্মিত হয়ে গেল তাঁকে দেখে। বিশেষত সারেঙ এই জনমানবহীন দ্বীপে প্রফেসরকে দেখে বেশ ঘাবড়ে গেল। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে সন্দীপ বলল, ‘নামব কী করে? এখানে যে কুমির ভর্তি!’
প্রফেসর বলে উঠলেন, ‘ভয় পেওনা। ওরা এখন খাবার নিয়ে ব্যস্ত আছে। তাছাড়া ওরা তোমাকে কিছু করবে না। লোকটা গুলি চালাল বলে মরতে হল।’
প্রফেসরের কথায় আশ্বস্ত হয়ে সন্দীপ, সারেঙকে বলল, ‘তুমি ভয় পেওনা। উনি ভালো লোক। তুমি বৈঠাটা বেঁধে ঠিক করার চেষ্টা করো। আমি ঘুরে আসছি।’
এই বলে জলে নেমে পড়ল সে। তারপর জল ভেঙে এগোল পাড়ের দিকে। পাড়ের কাছে আসতেই প্রফেসর হাত বাড়িয়ে শক্ত জমির ওপর তুলে নিলেন তাকে। তার পিছনে কোনাকুনি ভাবে দেখা যাচ্ছে ফাঁকা জমি, আর সেই কেয়া গাছের নীচে ডালাখোলা সিন্দুকটা। আর এর কিছুটা তফাতে পড়ে থাকা গঞ্জালোর দেহ। সেই সিন্দুকটার দিকে দূর থেকে তাকিয়ে সন্দীপ বলল, ‘ওর মধ্যে বাঘ আছে আপনি জানতেন, তাই না? ওই জন্য আমাকে সিন্দুকের কাছে যেতে বারণ করেছিলেন?
প্রফেসর হেসে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ।’
সন্দীপ বলল, ‘কিন্তু ওই বন্ধ সিন্দুকে বাঘ ঢুকল কীভাবে? আর কেন ঢুকল?
প্রফেসর বললেন, ‘চলো আগে আসল ব্যাপারটা তোমাকে দেখাই। তারপর ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। প্রফেসরের সঙ্গে জমিটার ভিতর এগোল সন্দীপ। তারপর হাজির হল কেয়া গাছের নীচে সিন্দুকটার কাছে। প্রফেসরের ইশারাতে সিন্দুকের ভিতর উঁকি দিতেই অবাক হয়ে গেল সে। সিন্দুকের মধ্যে গুটিসুটি হয়ে পড়ে আছে বিড়ালের আকৃতির সদ্যোজাত দুটো প্রাণী! বাঘের বাচ্চা! এখনও চোখ ফোটেনি ওদের। তারা মাঝে মাঝে তাদের ছোট্ট লাল টুকটুকে জিভটাকে বার করছে মায়ের দুধের খোঁজে। সন্দীপ দেখতে পেল কেয়া গাছের দিকটাতে সিন্দুকটার নীচের অংশটা পচে গিয়ে খসে পড়েছে। বাইরে থেকে সেটা বোঝা যায় না। প্রফেসর কেয়া গাছের ঝোপটা ফাঁক করতেই সন্দীপ দেখতে পেল একটা লম্বাটে গর্ত এসে মিশেছে সিন্দুকের সাথে। ও পথেই সিন্দুকে প্রবেশ করে বাচ্চা দিয়েছে বাঘিনী। বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে প্রফেসর বললেন, ‘সদ্যোজাত বাচ্চাকে অনেক সময় বাঘ মেরে ফেলে। তাই চামটা থেকে এসে এই নিরাপদ সিন্দুকের মধ্যে বাচ্চা দিয়েছে বাঘিনী। এই বাচ্চাগুলো যখন একদিন বড় হবে তখন তারা জঙ্গল শাসন করবে। জলে মোহনার কুমিরের ক্ষমতা বেশি ঠিকই, কিন্তু আজ তোমাকে সত্যি কথা বলি যে, আমার এত বছরের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পেরেছি যে এই সুন্দরবনের জলে-জঙ্গলের রাজা কিন্তু সত্যিই বাঘ।—রয়েল বেঙ্গল টাইগার! যেমন তাদের সৌন্দর্য, তেমনই তাদের সাহস আর বুদ্ধি! সত্যিই বাঘ বনের রাজা!’
সন্দীপ কিছুক্ষণ বাঘের বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকার পর সিন্দুকের ডালাটা বন্ধ করে দিলেন প্রফেসর। তারপর পিছু ফিরে দাঁড়ালেন। কিছুটা তফাতে পড়ে আছে বাঘের কামড়ে সদ্য মৃত গঞ্জালোর দেহটা। সেদিকে তাকিয়ে প্রফেসর বললেন, ‘কাল ওর গুলি থেকে একটুর জন্য বেঁচে গেছি! পাপের বেতন মৃত্যু।’
সিন্দুক আর গঞ্জালোর দেহটার থেকে কিছুটা এগিয়ে এসে মাঝখানে দাঁড়ালেন প্রফেসর নীলকান্ত সোম। আর ঠিক সেই সময় খাঁড়ির জল থেকে একদল তারখেল উঠে এল। সন্দীপ আর প্রফেসরের চারপাশে ঘিরে দাঁড়াল তারা। প্রফেসর তাদের দেখিয়ে সন্দীপকে বলল, ‘এই তারখেল বা সর্দার গোসাপকে চিনতে পারছো? চামটার সেই কাঠের বাংলোর জমিতে চৌবাচ্চায় এরা থাকত। ওদের নিয়ে পরীক্ষা চালাতাম আমি। ওদের দেহ কোষে অন্য এক সরীসৃপের জিন প্রতিস্থাপনের কাজ। তাকে প্রকট করার কাজ। ঠিক যেমন আমি আমার নিজের ওপরও সে পরীক্ষা করেছিলাম। এরা এখন কুমির দ্বীপে থাকে।’—এই বলে থামলেন প্রফেসর।
সন্দীপ তারখেলগুলোর দিকে তাকালো। বেশ কয়েকটা তারখেলের মুখে রক্ত লেগে আছে। তার কারণটা বুঝতে অসুবিধে হল না সন্দীপের। সে বলল, ‘এবার চিনতে পারছি ওদের।’
প্রফেসর বললেন, ‘এবার এ জায়গা ত্যাগ করতে হবে আমাদের। বাচ্চাগুলোর জন্য বাঘিনি মা যে কোনো মুহূর্তেই ফিরে আসবে। সে আবার মোটেই আমাকে পছন্দ করে না।’
সন্দীপ বলল, ‘হ্যাঁ, চলুন। লঞ্চে ফিরে গিয়ে কলকাতার দিকে আমরা রওনা হব।’
কথাটা শুনে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বিষণ্ণভাবে প্রফেসর নীলকান্ত সোম বললেন, ‘আমার যে আর কলকাতায় ফেরা হবে না সন্দীপ। আর যে ক’টা দিন বাঁচব আমি এখানেই বাঁচব।’
সন্দীপ বলে উঠল, ‘কেন কলকাতায় ফিরবেন না কেন?’
প্রফেসর বললেন, ‘কারণ সেটাই আমার পক্ষে ঠিক হবে। জিন নামের যে যাদুকরকে আমি আমার দেহে, প্রবেশ করিয়েছি তাকে দেহকোষ থেকে বাইরে উৎপাটিত করার বিদ্যা আমার জানা নেই।’
সন্দীপ বলে উঠল, ‘আপনি এত ভাবছেন কেন? আমি তো আছি।’
প্রফেসর এবার হেসে উঠে বললেন, ‘তা আছো জানি। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি তো সবার নিয়ন্ত্রণে থাকে না। ধরো আমি আর তুমি কলকাতার জনবহুল ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। ঠিক তখনি হঠাৎ জেগে উঠল আমার দেহের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা সে। প্রকট হয়ে উঠল সেই জিন। তখন কীভাবে ব্যাপারটা সামলাবে তুমি? অথবা পাশের বাড়ির বাচ্চা কোনো ছেলে তোমার বাড়ির বাগানটাতে ঢুকে দেখতে পেল বাগানে শুয়ে আছে প্রকাণ্ড একটা কুমির! কী হবে তখন, তার চেয়ে এখানে থাকাই ভালো। জীবনের বাকি ক’টা দিন তোমাকে বা নিজেকে নতুন কোনো বিড়ম্বনায় ফেলতে চাইনা।’ এর পর তিনি তার পোশাকের ভিতর হাত ঢুকিয়ে একটা ছোট চাকতি মতো বার করে সন্দীপকে দিলেন। সেটা যে সোনার তৈরি আর অনেক পুরোনো তা বুঝতে অসুবিধা হল না সন্দীপের। প্রফেসর বললেন, ‘এই লকেটটা ওই সিন্দুকের এক কোণে পড়েছিল। মজার ব্যাপার হল লকেটটাতেও কাকতালীয়ভাবে কুমিরের ছবি আঁকা। ওটা আসলে ‘মকর’ দেবতার ছবি। হিন্দু নাবিকরা এ লকেট সমুদ্রযাত্রার সময় ব্যবহার করত। তাদের থেকে কোনোভাবে পর্তুগীজ সিন্দুকে এসেছিল লকেটটা। এটা স্মৃতি হিসাবে তোমার কাছে রেখে দাও।’
সন্দীপ শেষবারের জন্য জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি সত্যিই ফিরবেন না?’
প্রফেসর জবাব দিলেন, ‘না, এবার তুমি ফিরে যাও। এখানে থাকা আর নিরাপদ হচ্ছে না।’ প্রফেসরের গলার স্বরের দৃঢ়তা শুনে সন্দীপ বুঝতে পারল প্রফেসরের মত বদলানো তার পক্ষে সম্ভব নয়।
সন্দীপ বলল, ‘আপনি এখন কোথায় যাবেন?’
প্রফেসর হেসে বললেন, ”তুমি তো জানো যে সুন্দরবনের কুমিরদের ‘মোহনার কুমির’ বলে। মজার ব্যাপার হল, আমার এই তারখেলগুলোর এখনও মোহনা দেখা হয়নি। ওদের এখন আমি মোহনায় নিয়ে যাব।’ সন্দীপ তারখেলগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, ‘হ্যাঁ, ওরা শুধু তারখেলই বটে!’ প্রফেসরের থেকে বিদায় নিয়ে খাঁড়িতে নেমে নৌকায় উঠল সন্দীপ। তার উদ্দেশে শেষবারের জন্য হাত নেড়ে তারখেলগুলোকে নিয়ে অন্যদিকে মিলিয়ে গেলেন প্রফেসর নীলকান্ত সোম। ইতিমধ্যে তার বেঁধে বৈঠাটা মেরামত করে নিয়েছে সারেঙ। এগিয়ে চলতে শুরু করল নৌকা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্দীপরা লঞ্চে পৌঁছে গেল। ভয়ঙ্কর এক স্মৃতিকে পিছনে ফেলে রেখে ফেরার জন্য যাত্রা করল সন্দীপরা।
জল কেটে এগিয়ে চলল লঞ্চ। সারেঙ একসময় বলল, ‘খুব বাঁচা বেঁচে গেছি আমরা। সুন্দরবনের বাঘ-কুমির তো ভয়ঙ্কর বটেই তার থেকে বেশি ভয়ঙ্কর ছিল ওই লোকগুলো। কিন্তু ওই দাড়িওলা বুড়ো লোকটা এখানে একলা রয়ে গেল কেন?’
সন্দীপ তার কথায় কোনো একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক তখনই সারেঙের সঙ্গী জলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আরে ওই দেখুন এক ঝাঁক কুমির!’
সন্দীপরা দেখল তাদের লঞ্চ থেকে কিছুটা দূরে এক ঝাঁক কুমির ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলেছে। একটা বিশাল বড় কুমির আর তাকে ঘিরে অন্য কুমিরদের ঝাঁক।’
ব্যাপারটা দেখে সারেঙ কিছুটা বিস্মিত হয়ে স্বগোতোক্তির স্বরে বলল, ‘এক সঙ্গে এভাবে কোনোদিন ঝাঁকবেঁধে কুমির ভাসতে দেখিনি! ওরা কোথায় যাচ্ছে কে জানে?’
সন্দীপ জবাব দিল, ‘ওরা যাচ্ছে মোহনার দিকে।’
—