কল্পনা চাকমার ডায়েরি, চিঠিপত্র ও ছবি
কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচারের দাবি : রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও প্রতিরোধ
কল্পনা চাকমা অপহরণের প্রতিক্রিয়া : বিভিন্ন লেখকদের লেখা

বাঘাইছড়ির পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি : কল্পনা ত্রিপুরায় একথা বিশ্বাস করে না চাকমারা – মনির হোসেন

বাঘাইছড়ির পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি, কল্পনা ত্রিপুরায় একথা বিশ্বাস করে না চাকমারা – মনির হোসেন

বাঘাইছড়ি থেকে ফিরে মনির হোসেন : কল্পনা চাকমা অপহরণ ও এর প্রতিবাদে অবরোধ কর্মসূচী পালনকালে ৩ জন মারা যাওয়ার ঘটনার প্রায় ২ মাস পরেও রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়িতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। নিরাপত্তাহীনতার কারণে উপজাতি এবং বাঙালিরা পরস্পরের এলাকায় না যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। চাকমারা বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় না আসার কারণে বাঘাইছড়ি থানার সবচেয়ে বড় বাজার ‘কাচালং বাজার’ বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। এদিকে বাঘাইছড়ি থানার একজন থানার পুলিশ কর্মকর্তা কল্পনা চাকমাকে অপহরণের একটি নতুন সম্ভাব্য নেপথ্য কারণ বর্ণনা করেছেন।

কল্পনা অপহরণ : নতুন সম্ভাব্য কারণ

বাঘাইছড়ি থানার সেকেন্ড অফিসার গোলাম ফারুক কল্পনা চাকমাকে অপহরণের নেপথ্যের কারণ হিসেবে তার ব্যক্তিগত অভিমত জানিয়ে বলেন, এর আগে একজন বাঙালিকে অপহরণের জের হিসেবে এ ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি জানান, চলতি বছরই ১৪ মার্চ কল্পনা চাকমাদের গ্রাম নিউ লাল্যাঘোনা থেকে ৩/৪ কিলোমিটার দূরে এক স্থান থেকে একজন বাঙালি ইসহাককে অপহরণ করা হয়। এর জন্য দায়ী করা হয় চাকমাদেরকে। স্থানীয় চাকমা-বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে এক শালিসে চাকমা নেতৃবৃন্দ এই ঘটনায় ইসহাকের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার সিদ্ধান্তে রাজি হন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১১ হাজার টাকা পরিশোধ করে বাকি টাকা আর দেয়া হয়নি বলে বাঙালি সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। কাচালং ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আবু তালেব বলেন, ইসহাকের পরিবারকে বাকি টাকা না দেয়ার জন্যই চাকমারা কল্পনার অপহরণের ঘটনা সাজিয়েছে। কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাঘাইছড়ি থানার ওসি শহিদউল্লাহ ছুটিতে বাড়ি যাওয়ায় তার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হয়নি।

বর্তমান পরিস্থিতি

কল্পনা চাকমা অপহরণ এবং এর প্রতিবাদে অবরোধ কর্মসূচী পালনকালে চাকমা বাঙালিদের মধ্যে সৃষ্ট দাঙ্গায় ৩ জন চাকমা যুবক নিহত হওয়ার পর প্রশাসনের উদ্যোগে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে কয়েকটি বৈঠক হলেও এখন পর্যন্ত চাকমারা বাঙালিদের বসতির দিকে এবং বাঙালিরা চাকমা পাড়ায় যাচ্ছে না। থানার সেকেন্ড অফিসার জানান, থানার পাশেই অবস্থিত কাচালং বাজারটি মূলত চাকমাদের ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে। এই বাজারের প্রায় সকল দোকানী ও ব্যবসায়ী বাঙালি আর ক্রেতাদের সিংহভাগই চাকমা। কিন্তু কল্পনা চাকমাকে অপহরণ ঘটনার পর এখন পর্যন্ত চাকমারা এ বাজারে আসছে না। ফলে অবস্থা দাঁড়িয়েছে এমন যে দোকানপাট খুলে দোকানীরা বসে থাকলেও ক্রেতা নেই। সেকেন্ড অফিসার আশংকা প্রকাশ করে বলেন যে, চাকমারা আর কিছুদিন এই বাজারে না আসলে বাজারটির স্বাভাবিক মৃত্যু হবে। বাঘাইছড়ি থানার টিএনও হাসান জাহাঙ্গীর আলম বলেন যে, পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। তিনি অবশ্য এও স্বীকার করেন যে, বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থিত স্কুলে-কলেজে চাকমা ছাত্রছাত্রীরা সহজে আসছে না। আবার চাকমা গ্রামে অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা যাচ্ছে- না-।

চাকমাদের সঙ্গে আলাপের সময় তারা জানান, বাঙালি পাড়ার পাশ দিয়ে রাস্তা অতিক্রমের সময় চাকমাদের ওপর হামলা করা হয়। স্থানীয় প্রশাসন এসব ব্যাপারে থাকে উদাসীন। বরং চাকমারা কোন অভিযোগ জানাতে গেলে তাদের নামেই উল্টো মিথ্যা মামলা দেয়া হয়। আর চাকমাদের নামে কোন মামলা থাকলেই পুলিশ ও নিরাপত্তাবাহিনী তাদেরকে গ্রেফতারের জন্য উঠেপড়ে লাগে। পক্ষান্তরে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে কোন বাঙালির নামে মামলা করা হলেও তাদেরকে গ্রেফতারের চেষ্টা করা হয় না বরং আসামিরা পুলিশের সঙ্গেই চলাফেরা করে।

অপরদিকে বসতিস্থাপনকারী বাঙালিরা জানান, কোন চাকমা পল্লীর পাশ দিয়ে বাঙালিরা যাওয়ার সময় তাদের ওপর আক্রমণ করা হয়। পাহাড়ে গরু-ছাগল চড়াতে গেলে সেসব কেড়ে নেয়া হয়। কল্পনা চাকমা এখন ভারতের ত্রিপুরায়- এ তথ্য কোন চাকমাই বিশ্বাস করে না। কল্পনা চাকমার মা, ভাই, পাড়া-প্রতিবেশীসহ সবাই এ তথ্যকে এক বিভ্রান্তিকর প্রচারণা বলে অভিহিত করেন। কল্পনা চাকমার বড় ভাই কালিন্দিকুমার চাকমা বলেন, ‘আমি আমার বোনকে ফেরত চাই। সরকার কিংবা নিরাপত্তা বাহিনী যদি মনে করে কল্পনা ত্রিপুরায় আছে তাহলে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা হোক।’

অন্যদিকে বাঙালি সম্প্রদায়ের প্রায় সবাই মনে করে যে, কল্পনা চাকমা অপহরণ একটি সাজানো ঘটনা। এর সঙ্গে সেনাবাহিনী কিংবা ভিডিপি সদস্যদের জড়িত থাকার প্রশ্নই উঠে না। কারণ তারা শুধুমাত্র নিরাপত্তা রক্ষার কাজেই নিয়োজিত। ইউপি সদস্য আবু তালেব এবং পুলিশ কর্মকর্তা গোলাম ফারুক-এর সঙ্গে যোগ করে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সেনাবাহিনী না থাকলে বাঙালিদেরকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। কারণ সেনাবাহিনীই বাঙালিদেরকে নিরাপত্তা দিয়ে রাখছে।

বাঘাইছড়ির বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে দুই সম্প্রদায়ের লোকজনই জানান যে, অস্ত্র বিরতি শুরু হওয়ার পর থেকে বাঘাইছড়িতে বাঙালি এবং চাকমারা মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই পাশাপাশি বাস করছি। কিন্তু গত ৬ মাস ধরে অবস্থা বদলে গেছে। নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামের সুগত চাকমা জানান, ৬ মাস আগেও নিউ লাল্যাঘোনা আর্মি ক্যাম্পের যিনি দায়িত্বে ছিলেন তিনি সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু গত মার্চ মাসের দিকে একজন লেফটেনেন্ট পর্যায়ের কর্মকর্তা এর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে পরিস্থিতি বদলে যায়। ইউপি সদস্য আবু তালেব ঐ কর্মকর্তা সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি কাউকে খাতির করেননি, কঠোরভাবে আইন মেনে চলেছেন।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *