বাগাল – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

বাগাল

ধানু মোড়লের খড়কাটার কুঠুরিতে ওপরে খড় নিচে খড় মধ্যিখানে বছর আষ্টেক বয়সের এক মানুষ শীতের লম্বাটে রাতগুলোকে ভোর করে। একখানা চটও আছে। গুটিয়ে পড়ে থাকে একপাশে। মোড়ল বলে, ‘তু এত খ্যাদোড় ক্যানে রে হরিবুলা?’

সেই ক্ষুদে মানুষ শুধু দাঁত বের করে।

খ্যাদোড় মানে নোংরা। মোড়লগিন্নি সন্দিগ্ধভাবে খড়গুলোর দিকে তাকাতে আসে। মানুষের হিসিমাখা খড় গরুকে খেতে দেওয়া অধর্ম। ‘বল সত্যি করে, বিছানা লষ্ট করেছিস নিকি?’ মোড়লগিন্নি তর্জনগর্জন করেন।

হরিবোলা নিজের কান ছুঁয়ে তিনসত্যি করলেও সন্দেহ ঘোচে না।

ধানু মোড়ল বলে, ‘উই হুদমুসলোর তিনসত্যির কিছু মুইল্লো আছে? ছেড়ে দাও বরঞ্চ।’

হুদমুসলো মানে গোঁয়ার। এবার মোড়লগিন্নি তাকে মোক্ষম আখ্যাটিতে ভূষিত করে, ‘হাসতে লজ্জা করে না রে ক্যালাগোবিন্দা?’

অর্থাৎ নির্বোধ। হরিবোলার এই তিনি আখ্যা। খ্যাদোড়, হুদমুসলো, ক্যালাগোবিন্দা। আঞ্চলিক ভাষায় নিকৃষ্ট এই শব্দগুলি রোজ সকালে হরিবোলার উপহার লাভ। এরপর তার কাজ শুরু বাসিমুখে গোয়ালঘর থেকে গরুগুলোকে বের করে বাইরে বেঁধে এসে ঘর পরিষ্কার। জমাট গোবর যাবে গোয়ালঘরের পেছনে—গোলাকার স্তূপ হয়ে থাকবে, চারদিক ঘিরে বড় বড় ফুলন্ত মেথো ঘাস। সেই ঘাসের মাথায় একটা গাব্দামোটা ধানফড়িং দেখতে পেলে সে তার শালিখ ছানাটির জন্য ধরার চেষ্টা করবেই। এতে দুদণ্ড সময় যাবে। তখন মোড়লগিন্নি খিড়কির দোরে উঁকি মেরে আবার খ্যাঁক করবে। হরিবোলা গোবরমাখা ভাঙা বালতি আর ফড়িংটাকে মুঠোয় ধরে আবার দাঁত বের করবে। যখন সে তরল গোময় আর মেঝের কাদার মিশ্রণে বালতি ভরছে, তখন ফড়িংটা তার হাফপেন্টুলের দড়ির খোপে ঢুকে গেছে।

এরপর ডোবার ঘাটে হাতপা ধোয়া। বাসনমাজার ছাই পড়ে থাকে সেখানেই। মোড়লগিন্নির ছায়া দেখলে সে ঝটপট সেই ছাই তুলে দাঁতে ঘষতে থাকবে। গিন্নিমা নোংরা একেবারে সইতে পারে না। বলবে, ‘রগুড়ে মাজ দাঁতগুলান—নৈলে আজ খাওয়াদাওয়া বন্ধ।’ কিন্তু গিন্নিমার নিজের দাঁতগুলো কালো কেন, সে কথা তুললেই রাক্ষুসী হয়ে তেড়ে আসবে।

একবোঝা খড় কেটে তবে খাওয়া। অর্থাৎ এককোঁচড় মুড়ি। একটুখানি গুড়ের ডেলা। নৈলে আধখানা পেঁয়াজ।

গরুগুলো রোদ্দুরে তখনও ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে পৃথিবী দেখছে। একটু তফাতে বসে হরিবোলা মুড়ি চিবোচ্ছে। শালিখছানাটি তার কাঁধে। তারও ঘাস ফড়িংটা খাওয়া হয়েছে। তার চোখদুটোও নিষ্পলক পৃথিবী দর্শন করছে।

তারপর এল হেমা গয়লানী দুধ দুইতে। মোড়লগিন্নির কোমরে বাত বলে পা দুমড়ে বসতে পারে না ইদানীং। হেমা যতক্ষণ দুইবে, হরিবোলার কাজ বাছুরটিকে কান ধরে টেনে রাখা। বাছুরটি দুপা ঠোকে। কান ছাড়িয়ে নিতে মাথা এদিক ওদিক করে। হরিবোলা খিটখিট করে হাসে।

কেন হাসে সেই জানে। হেমা ধমকায়, ‘অত হাসি কিসের রে ছোঁড়া সাত-সকালে?’ তারপর দুধ দোহানো শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। হাতে পেতলের চোঙায় দুধের ফেনা। কী মনে করে হরিবোলাকে দেখতে দেখতে বলে, ‘তুই কি শীত-খরা বলতে নাই রে ড্যাকরা ছোঁড়া? এই শীতে মোষের শিঙ নড়ে যায়, আর খালি গায়ে দাঁত ক্যালাচ্ছিস কী করে বাপু?’

পেছন থেকে মোড়লগিন্নির অভিমানে আহত কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ‘উয়াকে কি জামাকাপুড় দেওয়া হয়নি—জিগ্যেস করো না একবার! উটা কি মানুষ ভাবছ তুমি?’ মোড়লগিন্নি ওর বিছানার শোয়ার বিবরণ দিতে থাকে। সেই চটখানির গুটিয়ে পড়ে থাকার বৃত্তান্ত। ভিজে খড়ের কুচ্ছো। লাল গেঞ্জি কিনে দিয়েছিল, দুদিনেই ছিঁড়ে ফালাফালা। বড়ই হুদমুসলো। বেজায় খ্যাদোড়। একের নম্বর ক্যালাগোবিন্দা।

হেমা দুধের পাত্র সমর্পণ করে বলে, ‘তাই বটে বাপু!’ হ্যাঁ গো, আঙাদাসীর কুনো খবর নাই?’

আঙাদাসী মানে রাঙা দাসী। এই হরিবোলার মা। গতবছর হঠাৎ মোড়ল বাড়ি থেকে চলে গেল তো গেলই। গিন্নির সঙ্গে নাকি ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল। গিন্নি বলেছিল, ‘রোজ চাল চুরি করে বেচে আসত। তার ওপর খানকীর স্বভাব। কেমন সাজের ঘটা দেখতে না মাগীর? বাজারী! বেউশ্যে!’

এমন মেয়ে রাঙাদাসীর খবর রাখার দায় পড়েছে কার? মোড়লগিন্নি চটে যায় হেমার কথায়। ‘আবার সাতসকালে ওই অলুক্ষণে পাড়ামাতানীর নাম? অত দরদ থাকলে তুমি লিয়ে এস খবর!’ দুধের পাত্রটি নিয়ে থম থম করে বাড়ির ভেতর যায়। ভেতরে গিয়েও রাঙাদাসীর খেউড়।

হেমা বাঁকা মুখে গুম হয়ে থাকে। তারপর ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে চাপা গলায় বলে, ‘আর তু ছোঁড়ারও বলিহারি যাই রে! হাজার হলেও মা জননী! ধন্যি বাবা, উই পক্ষীটিও মা মা করে চ্যাঁচায়।’

সেও চলে যায়। তখন হরিবোলার চোখ মাঠের দিকে। মাঠের ওপর কুয়াসা জমে আছে। ওই কুয়াসার ভেতর আছে এক নদী। নদীর পারে কাশফুলের বন, বিল-বাঁওড়, হিজল ভাঁড়ুলে বাবলা গাছের টুঙ্গি। কখন সেখানে যাবে, সেই প্রতীক্ষা শুধু। নদী পেরুলেই তো হরিবোলা আর এই হরিবোলাটি থাকে না। তখন যেন চিতে বাঘের বাচ্চা। চেরা গলায় গান জুড়ে দেয়, ‘দড়কা লধির উধারে/যৈবন পড়্যে আছে হে…’ যৌবনের বৃত্তান্ত না জেনেও।

ধানু মোড়ল নদী পর্যন্ত সঙ্গে যায়। হরিবোলার তখন পান্তা খেয়ে পেটটি ঢোল। বাকি দিনটার ক্ষিধের জন্য বরাদ্দ ফের এক কোঁচড় মুড়ি। কিন্তু হরিবোলা তার বদলে দুমুঠো চালই পছন্দ করে। দুধসর নামে এক নালা আছে। তার ধারে ভাঁড়ুলেগাছের নেমে যাওয়া শেকড়বাকড়ে ন্যাকড়ার একদিকটা বেঁধে অন্যদিকে বাঁধা চালগুলো জলে ডুবিয়ে রাখে। দুপুর গড়িয়ে এলে সেই চাল তখন দুধের মত শাদা, ফুলো খই যেন, আর কী স্বাদ! চড় মারলেও মুখ থেকে ছাড়ে না।

নদীর ধারে বাঁধের বটতলায় দাঁড়িয়ে মোড়ল হরিবোলার নদী পেরুনো দেখে তারিয়ে-তারিয়ে।

গমক্ষেতের মুনিশকে শুনিয়ে বলে, ‘ইঃ! যেন চিতেবাঘের বাচ্চা! যতক্ষণ লদির ইধারে, ততক্ষণ নিমুনমুখো ষষ্টি—যেন ক্যালাগোবিন্দাই বটে। যেই লদিটি পেরুলো, আর উইরকম। চেহারিটিও বদলে যায়।’

মুনিশ মুখ তুলে বলে, ‘কার কথা বুলছেন মুরোলমশাই?’

‘এই হরিবুলা হে।’

‘অ, হরিবুলা!’

হরিবোলার চেরা গলার গান ভেসে আসে ওপারের প্রান্তর থেকে, ‘দড়কা লধির উধারে/যৈবন পড়্যে আছে হে…’ মোড়লমশাই প্রত্যঙ্গ চুলকোতে চুলকোতে খিকখিক করে হাসে। ‘অই, শুনছ শালোব্যাটার রসের কথা? এখনও গুয়োর ডিম ভাঙেনি। যৈবন চিনেছে।’

মুনিশ বলে, ‘আচ্ছা মুরোলমশাই, হরিবুলার মায়ের খবর কী?’

‘শুনেছি টাউনে আছে—ওইটুকুনই।’

‘হরিবুলা মায়ের কথা কিছু বুলে না মুরোলমশাই?’

‘নাঃ!’ ধানু মোড়ল মুখ বাঁকা করে গম্ভীর হয়। ‘আমার কাছে কি কষ্টতে আছে? থাউক না। টিকতে পারলে বিভা দুবো। বাড়ির পেছনে জায়গা-থল দুবো। থাউক।’…

রাঙাদাসী এক আশ্চর্য মেয়ে। আশ্চর্য—কারণ তার গায়ের রংটা ছিল বাবুবাড়ির মেয়েদের মতো ফর্সা। চোখদুটো কয়রা—বিড়ালচোখী বলে যাদের। সাজতেগুজতে ভালবাসত। ভালমন্দ জিনিসটাতে ছিল প্রচণ্ড লোভ। গউরের মতো একটা লোক কেমন করে তাকে ভাগিয়ে এনেছিল, সেও এক আশ্চর্য। গউরও অবশ্য একটু শৌখিন এবং টাউনমুখো মানুষ ছিল। রিকশোও চালিয়েছিল মাসকয়েক। তারপর হাঁপের অসুখ বাঁধিয়ে ঝটপট মরে গেল। রাঙাদাসী কোলের ছেলেটাকে নিয়ে সেই থেকে ধানু মোড়লের বাড়ি কাজকর্ম করত। ভিটেমাটি বেচে মোড়লবাড়িতে উঠেছিল শেষে। গিন্নির সঙ্গে কলহ করে টাউনে চলে গেল। গউর তাকে টাউন চিনিয়েছিল, নাকি সে গউরকে, এও একটা আশ্চর্য।

আরও কিছু আশ্চর্য আছে।

রাঙাদাসীর নাকি আরেক নাম ছিল হরিমতী। গউর ডাকত হরিমতী বলে। সেই শুনে সদ্য মুখফোটা ছেলেটাও হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে ভিটেয় চরতে চরতে দুঃখকষ্ট পেলে চেঁচিয়ে ডাকত আধো-আধো ‘হয়ি’ বলে। রাঙাদাসী হাসতে হাসতে বলত, ‘আরে আমার হরিবুলা সোনারে! হরি বলতে শিখেছে আমার ময়না পাখি রে!’ সেই থেকে ছেলেটা হরিবোলা হয়ে গিয়েছিল।

ক্রমে ক্রমে চাউর হয়, মেয়েটা ছিল মল্লারপুরের ঝুমুরদলের। —সেই যারা মেলার আসরে মাঝরাতে কোমর মুচড়ে নাচে এবং গায়, ‘বঁধু, লাও বা না লাও/মুখ দেখে যাও/বাসি কাচের আয়না।’ বাসি ভাতের বাসি ফুলের মতো আয়নাও বুঝি বাসি হয়। নিঝুম দুপুরে মোড়লের ঢেঁকিতে পাড় দিতে দিতে আনমনে রাঙাদাসী বা হরিমতী গুনগুন করে গান গাইত। মোড়লগিন্নি কান করে শুনে বলত, ‘গাইবি তো ঝেড়ে গা দিকিনি বাবু!’ রাঙাদাসী থতমত খেয়ে বলত, ‘উ কিছু লয় গিন্নিমা!’ সে বুঝত, গিন্নি বলছে বটে মুখে, পরে তাই নিয়ে খোঁটা দেবে। বাজারী গানেউলি, ঝুমরি-টুমরি বলতেও বাঁধবে না।

হরিমতী র‍্যাশংকাডে হয়েছিল রাঙাদাসী। সেই র‍্যাশংকাড ধানু মোড়লের জিম্মায় আছে। চিনিটা আর ক্যারাচতেলটার খুব আকাল পাড়াগাঁয়ে লেগেই আছে। লরেন্দ মাস্টের ডিলার। ঠাট্টা করে এখনও বলেন, ‘কী মোড়লমশাই, রাঙাদাসীর কোটা আর কতকাল নেবে? ছেড়ে দিলে আরেক গরিবগুবরোর বেনিফিট হয়।’

 মোড়ল হ্যা হ্যা করে হাসে। ‘আঙাদাসী নাই। উয়ার ছেলেটা কি মিথ্যে মাশাই? তার চিনিটা ত্যালটা লাগে না?

লরেন্দ চোখের নৃত্যে বলেন, ‘তোমার বাগালকেও চিনি দাও বুঝি? কিসে দাও মোড়ল? সরবতে, না গুড়ে?’

ধানু মোড়ল মনে মনে চটে। বলে, ‘ক্যানে? চা। চা খায়।’

‘বলো কী?! চা খায় তোমার বাগাল?’

লোকে হাসলেও রাখাল-বাগাল, মুনিশ-মাহিন্দার আজকাল চা খায়, এও সত্যি। ধানু মোড়লের কথা অবশ্য আলাদা। কিন্তু রাঙাদাসীও চা খেত। তার ছেলে হরিবোলাও মায়ের বাটির তলানিটুকু চুকচুক করে টানত। পরে সেও মায়ের কাছে রোজ সক্কালবেলা বাটিভরা চায়ের দাবি তুলত। তবে ছেলেটা যখন দ্বারকা নদীর ওপারে যেতে শিখল, তখন তার কাছে চা তুচ্ছ হয়ে গেল। দিনে দিনে বদলে গেল সে। রাঙাদাসী অবাক হয়ে তার ছেলের বদলে যাওয়া দেখত।

রাঙাদাসী গউরের কুঁড়েঘরের উঠোনে যে ছেলেকে পায়ের ওপর শুইয়ে তেল-কাজল দিতে দিতে সুর ধরে বলত, ‘আমার ধোন ইস্কুলে পড়বে রে! নেকাপড়া শিখে চাকুরি করে আমাকে খাওয়াবে রে!’— সেই ছেলে যায় দ্বারকা নদীর ওপারে গরুর পাল নিয়ে। তার চুলে থাকে ট্যাঁসকোনা পাখির পালক। তার কাঁধে থাকে শালিখপাখির ছানা। নুড়ি দিয়ে ঘাসফড়িং খোঁজে। কতরকম নাম জানে ঘাস-ফড়িঙের—ঘরপোড়া, তল্লা, বাজ। রুক্ষ কাঁকরে ডাঙায় বেঁটে লালরঙের ফড়িংগুলো ঘরপোড়া। কুপির আলোয় বাঁশের চোঙা থেকে সারাদিনের সংগ্রহ সে মাকে দেখাত। লম্বাটে সবুজ ফড়িং দেখিয়ে বলত, ‘ইগুলান তল্লা।’ বেঁটে, ধূসর ডানা, তলার দিকটা ফিকে সবুজ আর পেট জুড়ে ফুটকি—’ই দ্যাখো মা, বাজ।’ তার পাখিটাও ছিল পেটুক। খাঁচা ছিল না বলে তাকে বেড়াল এসে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হরিবোলা দুদিন পরে আবার একটা নিয়ে আসবেই। তার তখন পাখি-ঘাসফড়িংদের পৃথিবীতে চলাফেরা! ইস্কুলের উল্টোদিকে সেখানে যাবার রাস্তা, সেই রাস্তায় রাঙাদাসীর চোখের সামনে হেঁটে গেল তার হরিবোলাটি। দেখতে দেখতে একটুকুন হয়ে মিলিয়ে গেল কাশকুশের বিশাল প্রান্তরে।

আর প্রতিদিন ফিরে এসে সে মায়ের কাছে সেখানকার গল্প বলত। সিঙাকুড়ির জামগাছটার কাছে কী ঘটেছিল, বাঁওড়ের ধারে কত কুল পেকেছে (সেই কুলের কিছু নমুনাসহ), আজ বলাই সিঙ্গির সঙ্গে মেছুনীদের ঝগড়া হয়েছিল কী নিয়ে—এইসব। সে বলত কাশবনের কথা। জলে শাপলার ঝাঁকের কথা। একলা কোনো হিজলগাছের অন্ধ পেত্নীর কথা, বুড়ো যোগীবর আর একটা হট্টিটি পাখির কথা। দিনমান সে ট্টিট্টি করে ডেকে বেড়ায়। যোগীবরও জানে না তার বৃত্তান্ত। ‘ক্যানে বেড়ায় মা?’ রাঙাদাসী জানে না। চিমটি কেটে বলত, ‘মুখ ধরে যায় না তুর? ইবারে লোক করে ঘুমোদিকিনি!’

হরিবোলা লোক (চুপ) করবে না। এরপর বলবে মাঠকুড়োনি মেয়েদের কথা। শেষে পরামর্শ দেবে। ‘তু ক্যানে যাস নে মা লধির উধারবাগে! বীণামাসিরা যায়। সম্মাই যায়। ভাদুর মা যায়। তু ক্যানে যাস নে মা?’

রাঙাদাসী রাগ করে বলবে, ‘আমার মরণ!’

‘ক্যানে মা, মরণ ক্যানে?’

রাঙাদাসী আস্তে বলবে, ‘আমি মাঠঘাটে কখনও ঘুরিনি বাছা। ছরতে ওদবাতাস সয় না। চেরটাকাল টাউনবাজারে মানুষ হইছি—পারি না।’

প্রেম হরিমতীকে পাড়াগাঁয়ে ভাসিয়ে এনেছিল। সে রাঙাদাসী হয়েছিল। তার প্রেমের বয়স চলে যায়নি, কিন্তু প্রেমিকটি মারা পড়েছিল। এই ছেলেটা না থাকলে রাঙাদাসী আবার হরিমতী হবার জন্য পা বাড়াত। কিন্তু কোলে ছেলে থাকলে হরিমতী হওয়া বড় সমস্যা। সে যেন হরিবোলার বড় হওয়ার দিন গুণছিল। বড় হতেই চলে গেল…

মাঘে যখন দ্বারকা নদীর শিয়রে বুড়ো শিমুল গাছটা মাথায় লাল ফেট্টি জড়াল, ধানু মোড়লের আমের গাছে ফুটল লালহলুদ শিসালো মুকুল, তখন একদিন লরেন্দ মাস্টেরের ভাই মলিন্দ এসে বলল, ‘ও মোড়লমশাই, তোমার বাগাল কোথা?’

ধানু মোড়ল মোড়ায় বসে শনের দড়ি পাকাচ্ছিল ঢ্যারা ঘুরিয়ে। অবাক হয়ে বলল, ‘ক্যানে বাবা মলিন্দ?’

মলিন্দ চোখে ঝিলিক তুলে বলে, ‘রাঙাদাসীর সঙ্গে কাল দেখা হল মেদিগঞ্জের বাজারে।’

মোড়ল শুধু বলে, ‘অ’।

মলিন্দ খিক খিক করে হাসে। ‘সে রাঙাদাসী আর নাই মোড়লমশাই। এক্কেবারে ফিলিম-ইস্টার।’

‘অ’।

‘কী পরনের ডেরেস, কী জেকচার-পশ্চার। ঠোঁটে লিপিস্টিক! বুঝলে তো?

‘অ’।

মলিন্দ আরও হেসে বলে, ‘ধুত্তেরি! খালি অ অ করে। বুঝলে কিছু?

ধানু মোড়ল একটু হাসে। ‘তা না হয় বুইলাম। কিন্তুক কী কথাবাত্তা হল তুমার সঙ্গেতে?

‘প্রথমে তো চিনতেই পারে না, এমন ন্যাকামি মাগীর। তো আম্মো বাবা ছিনে জোঁক। শেষে নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল।’ মলিন্দ বারান্দার চৌকিতে গিয়ে বসে। বিস্তারিত বলার ইচ্ছায় একটা সিগারেট ধরায় এবং মোড়লকেও দেয়।

মোড়ল ফুকফুক করে টেনে বলে, ‘হরিবুলার কথা জিগ্যেস কল্লে না?’

‘বলছি, শোনই না।’ মলিন্দ লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে বলে। ‘প্রথমে তো একথা, সেকথা—গাঁয়ের কার কী খবর। তারপর বললে, হরিবোলা কেমন আছে, কী করছে এইসব। আমি বললাম, মোড়লমশাইয়ের বাড়িতে আছে, ভালই আছে। খারাপ থাকবার তো কথা না। তবে তুমি এখানে কী করছ, তাই বলো।’

 ‘জিগ্যেসা কল্লে তুমি?’

‘হ্যাঁ-অ্যাঁ। আমি বাবা ছিনে জোঁক। না শুনে ছাড়ব না। সেও কিলিয়ার করে বলবে না। শেষে বলল, এক বাবুর বাড়ি কাজ করছে। টাউনবাজারে আজকাল ঝিয়ের অভাব—ভালই মাইনেকড়ি পাচ্ছে।’

মোড়ল বলে, ‘মিথ্যে।’

‘মিথ্যে তো বটেই—সে কি আমি বুঝি না? ঠোঁটে লিপিস্টিক!’ মলিন্দ খ্যা খ্যা করে হাসে। শেষে বললাম, ‘তা তুমি তো দেখছি ভালই আছ। ছেলেটাকে দেখে আসবে না একবার? চলো আমার সঙ্গে।’

‘ত্যাখন কী বল্লে?’

‘বললে সময় পাই না—এত কাজ। পেলেই যাব। নিয়ে আসব।’

মোড়ল নড়ে উঠে সোজা হয়। ‘কী বল্লে, কী বল্লে?’

মলিন্দ আশ্বস্ত করে বলে, ‘নিয়ে যাবে কোথা? ছেলে সঙ্গে থাকলে ও বিজনেস তো পণ্ড। বুঝলে না? শেষে আমাকে সঙ্গে করে জামাকাপড়ের দোকানে গেল। এই দেখ, কীসব কিনে দিয়েছে হরিবোলার জন্যে।’

এতক্ষণে ধানু মোড়লের চোখ পড়ে প্যাকেটটাতে। তাচ্ছিল্য করে তাকিয়ে বলে, ‘কী আছে বলো দিকিনি?’

‘একটা পেন্টুল, একটা জামা। বললে, পায়ের মাপ জানা থাকলে জুতোও কিনে দিতাম। একবার সঙ্গে করে নিয়ে যেতেও বললে। বলে আবার কী মনে হল বললে, ‘থাক। নিজেই যাব একদিন।’ মলিন্দ জামা আর হাফপেন্টুল মোড়লকে দেখিয়ে আবার ভাঁজ করে প্যাকেটস্থ করে। চাপা হেসে বলে, ‘ঠিকানা নির্ঘাৎ বাগানপাড়ার গলি—সে ঠিকানা দেবে কোন মুখে? তাই আসবে বলল।’…

যাবার সময় হঠাৎ ফিরে এসে একটা ছোট্ট ঠোঙাও দিয়ে যায় মলিন্দ। ভুলে গিয়েছিল, রাঙাদাসী তার ছেলের জন্য লজেন্সও কিনে দিয়েছে। নগ্ন চৌকিতে সেগুলো পড়ে থাকে কতক্ষণ। ছুঁতে ইচ্ছে করছিল না ধানু মোড়লের। মোড়ল-গিন্নি জানতে পারলেও সমস্যা। তার বড্ড ছোঁয়াছুঁয়ির বাতিক।

কিন্তু না জানিয়েও থাকা যায় না। দড়ি পাকানো শেষ করে আস্থেসুস্থে উঠে দাঁড়ায় ধানু মোড়ল। কাঁচাপাকা চুল আর গোঁফে হাত বোলায়। তারপর প্যাকেট দুটো বাঁহাতে তুলে চালের বাতায় গুঁজে রাখে।

নদীতে স্নান করে এসে খেতে বসার সময় মোড়ল ফিক করে হাসে। ‘একটা খবর শুনলে গো? আঙাদাসী মেদিগঞ্জতে আছে। যা বলেছিলে তুমি, তাই। বেউশ্যেতে নাম নিকিয়ে বসে আছে। মলিন্দ বলে গেল।’

নাক বাঁকা করে মোড়লগিন্নি বলে, ‘মরুক বারোভাতারি। খাবার সুময়ে উ কী কথা?’

‘নাঃ—বলছি কী, হরিবুলার জন্যেতে জামাপেন্টুল আর লেবেনচুষ পাঠিয়ে দিয়েছে মলিদ্দর হাতে।’

 মোড়লগিন্নির চোখ বড় হয়ে যায়। বিশ্বাস করতে পারে না। বলে, ‘সত্যি নাকিন?’

‘সত্যি বৈকি। বাইরেকার ছাঁচবাতায় গুঁজে থুয়েছি। দ্যাখো গে—পেত্যয় না গেলে।’

মোড়লগিন্নি থম থম করে উঠে যায়। মোড়ল কতক্ষণ তার ফেরার অপেক্ষা করে! ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে সন্দিগ্ধভাবে দ্রুত আহার শেষ করে নেয়। তারপর যখন উঠোনের কোনায় লেবুগাছটার কাছে ঘটি থেকে জল ঢেলে আঁচাচ্ছে, তখন মোড়লগিন্নি তেমনি থম থম করে ফিরে আসে। মুখখানা জ্বলছে দাউ দাউ করে। নাসারন্ধ্র স্ফীত।

মোড়ল একটু হেসে বলে, ‘দেখলে?’

প্রৌঢ়া জবাব দিল না। টিউকলে গিয়ে রগড়ে হাত ধুতে থাকল।…

দিনকতক পরে সন্ধ্যাবেলায় দ্বারকা নদীর ওপার থেকে গরু চরিয়ে বাগাল হরিবোলা ফিরে এসেছে। চেরা গলায় বাইরে যথারীতি ‘গিন্নিমা, আলো’ বলে চিক্কুরও ছেড়েছে। গিন্নিমা লণ্ঠন দেখিয়েছে এবং সে গরুবাছুর গোয়ালে বেঁধে ফেলেছে। তারপর অন্ধকারে ডোবার জলে হাতমুখপা ধোয়াপাখলা করে সর্ষের তেলটুকুনও চেয়ে নিয়েছে। গায়ে-গতরে মেখে উঠনের কোনায় বসে তেমনি চিক্কুর ছেড়েছে, ‘গিন্নিমা! ভাত দ্যাও।’

উঁচু দাওয়ায় লণ্ঠন জ্বলছে। নিচের উঠোনে সেই আলোর হলদে চকরাবকরা ছটা খানিকটা। একটু তফাতে বাড়ির কুকুরটার বিরাট ছায়া পাঁচিলের গায়ে, লেজটা নড়ছে, মুখটা হাঁ। হঠাৎ একমুঠো গিলেই হরিবোলা আরেক চিক্কুর ছাড়ে, ‘গিন্নিমা, গিন্নিমা! আমার জামাপেন্টুল? আমার লেমুনচুষ!’

মোড়লগিন্নি গুম হয়ে বলে, ‘খাবি তো খা দিকিনি বাপু! পরে উসব কথা।’

হরিবোলা হুদমুসলো, সে তো মিথ্যে নয়। দিনমান জানোয়ারের সঙ্গে বনেপ্রান্তরে বাস, বাগগাল। বাগালের গাঁ। একটু পিছিয়ে গিয়ে চ্যাঁচায়, ‘আগে দ্যাও, তমে খাব।’

মোড়লগিন্নি ফুঁসে ওঠে। ‘শুনছ, শুনছ তুমার বাগালের কথা? কেমুন বুলি ফুটেছে শুনছ?’

দাওয়ায় মোড়া থেকে ধানু মোড়ল খুক খুক করে হাসে। ‘অ হরিবুলা? কে তুকে বল্লে জামাপেণ্টুলের কথা?’

হরিবোলার দাঁত চকচক করে। মাস্টেরের ভাই মলিন্দবাবু বুললে, তুর মা তুকে জামাপেণ্টুল দিয়েছে। লেমুনচুস দিয়েছে!’ সুর ধরে আওড়ে সে এঁটো হাতটাও ওপরে তুলে নাচতে থাকে।

মোড়লগিন্নি বেগতিক দেখে চাপা গলায় বলে, ‘উ জিনিস ছুঁতে নাই, হরিবুলা। বয়েস হলে বুইতিস, ক্যানে ছুঁতে নাই। ভাতগুলান খা দিকিন দয়া করে। মুড়ল তুকে নতুন জামাপেণ্টুল কিনে দিবে।’

মোড়ল ঘোষণা করে, ‘দুবো। কটা দিন অপিক্ষা কর! ক’বস্তা চাল বেচতে যাব আড়তে। তুকে লিয়ে যাব। এখুন যা কচ্ছিস, তাই কর।’

ক্যালাগোবিন্দা বাগাল অমনি শান্ত হয়ে বলে, ‘লিয়ে যাবা তো মুরোল?’

‘হুঁ, হুঁ, লিয়ে যাব। তুর মা-জননীকেও দেখে আসবি।’

ঝোঁকের বশে ধানু মোড়ল একথাও বলে ফেলে এবং তারপর ভাবে, বলেই যখন ফেলেছে, মুখের কথা বৈ নয়। কোথায় রাঙাদাসী থাকে, সঠিক জানা নেই—মলিন্দেরও। তবে জানা থাকলেও সাধুগিরি করে মায়ে-ছেলেতে মিলিয়ে দিলে উল্টে হয়তো নিজেরই বিপদ বাধবে। পেটভাতায় এমন খাঁটি বাগাল পাওয়া সহজ নয়। বছর সন মাইনেকড়ি আছে, তার ওপর বাবা-মাকে ধান ধার দাও, এটা দাও, ওটা দাও—সম্বচ্ছর ঝামেলা। হরিবোলার সে ঝামেলা নেই।

রাতে বিছানায় শুয়ে মোড়ল বউকে চুপিচুপি বলে, ‘জিনিসগুলান আস্তাকুড়ে না পুঁতলেও পারতে। মেয়েটা বেউশ্যে হয়েছে, জিনিসগুলান তো হয়নি।’

মোড়লগিন্নি গর্জন করে বলে, ‘থামো তুমি! বুইতে পাল্লে না ক্যানে দিয়েছে, এত যে মুড়লি মেরে বেড়াও গাঁয়ে!’

মোড়ল কেঁচো হয়ে বলে, ‘ক্যানে দিয়েছে বলো দিকিনি?’

‘নোভ দেখাতে। ক্রিমে ক্রিমে নোভ বাড়বে জামাপেণ্টুল পরে। তখন আর তুমার বাগালী করবে ভেবেছ নাকিন? টাউনবাগে দৌড়ুবে না?’

মাথা নেড়ে মোড়ল বলে, ‘ঠিক, ঠিক।’

‘মাগী টোপ ফেলেছিল।’ শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে মোড়লগিন্নি পাশ ফিরে বলে, ‘তমে সত্যি যদি ই বাগে আসে, উয়ার চুল কেটে ন্যাড়া করে ফেরত পাঠাব। নখাই, যদু, মকুন্দ—সবাইকে বলে রেখেছি। ই মাটিতে পা দিয়ে একবার দেখুক না কলঙ্কিনী!’

বিবেচক মোড়ল আস্তে বলে, ‘আহা, ছেলেটা তো উয়ার। চাইলে আইনত ধম্মত…’

 মোড়লগিন্নি বাঘিনীর গর্জনে বলে, ‘তুমি থামো! ভালমানুষী কত্তে হয়, বারোয়ারিতলায় যাও।’

‘আহা, হরিবুলা যদি যেতে চায়?’

‘যাচে না।’ হঠাৎ শান্ত অথবা নিস্তেজ হয়ে যায় প্রৌঢ়া মেয়েটি। ‘লদির উধারে হরিবুলার মন বসে যেয়েছে। তুমি দেখো, উ কক্ষনো যাবে না।’…

যাবে না, কারণ দ্বারকা নদী পার হলেই সে এক অন্য হরিবোলাটি। দিনমান তার চোখে ছবির মতো আঁকা হয় কাশকুশের ধূসর ব্যাপকতা, দাগড়া দাগড়া হলুদ সর্ষে ফুলের ছোপ কাছে এবং দূরে, শালিক পাখির ডিম হয়ে থাকা চিত্রিত নীলাভ আকাশ, আর ওই একলা ওড়া হট্টিটি পাখিটার টি টি টি ডাক। বিলের জলে আকাশ থেকে বাঁকা এক রেখা ঝপাং করে পড়তেই একঝাঁক জলহাঁস ফুটে ওঠে। কখনও বন্দুকের শব্দে বিশাল নৈঃশব্দ খান খান হয়ে যায়, এবং বাতাসে কিছুক্ষণ বারুদের কটু গন্ধ। তারপর আবার সব শান্ত, চুপচাপ। আবার ঘাসফড়িংয়ের কণ্ঠস্বর ছাপিয়ে বাগালছেলের চেরা গলায় চিৎকার, ‘বীণামাসি গো! নে-দে-ছে-এ-এ!’ মোড়লের গরু নাদলে বীণামাসি ছাড়া আর কাউকে দেবে না হরিবোলা। পা দিয়ে গোবরটা থুপথুপ করে গুছিয়ে রাখবে। মাঠকুড়োনি মেয়েটার আসতে দেরি হলেও ওটা আর কেউ ছোঁবে না। অলিখিত আইন এই মাঠের পৃথিবীতে।

এর মধ্যে দিনটা কেটে যায় হরিবোলার। তার ইচ্ছে করে একটা দলের সঙ্গে থাকবে। কিন্তু মোড়লের কড়া নিষেধ। পাঁচজন বাগাল দল বাঁধলেই খেলতে মন দেবে। তখন গরু গিয়ে কার ফসল খাচ্ছে, সেদিকে দৃষ্টি থাকে না। তাই হরিবোলা একলা হয়ে ঘোরে। বাঁওড়ের ধারে গিয়ে যোগীবরের কাছে নানারকম গপ্প শোনে। গরুগুলো আপন খেয়ালে চরে বেড়ায়। ক্রমশ গোচর মাটির সীমানা কমে যাচ্ছে। আবাদ বাড়ছে। বুড়ো যোগীবর বহুদূর দৃষ্টি চালিয়ে বলে ওঠে, ‘সব আবাদ হয়ে যাবে, বুইলি হরিবুলা। বাঁধ হবে-হবে শুনছি। হলে পরে উই উলেকাশের বোন, উই বিল, ই বাঁওড়—সবখানে লাঙল পড়বে। ত্যাখন হরিবুলা, ত্যাখন গরু চরাবি কতি রে, অ্যাঁ?’

খুব হাসে যোগীবর। হরিবোলা বলে, ‘যাঃ!’

‘যাঃ লয়। দেখবি কী হয়।’

হরিবোলা ওসব ভাবে না। কিন্তু বিলের জলে লাঙল পড়ার কথা শুনে সে ভারি অবাক হয়। বলে, ‘যুগীকাকা, ওগো যুগীকাকা! বিলের জলে লাঙল পড়বে কেমুন করে? বলদ ডুবে মরবে না?’ তার টানাটানা চোখ বিলের দিকে প্রসারিত হয়।

‘ওরে বাছা, ত্যাখন কি জল থাকবে? বাঁধ পড়লে বছরে বছরে শুকিয়ে যাবে।’

হরিবোলা অত ভাবতে পারে না। সে যখন হবে, তখন হবে। ‘অ যুগীকাকা, হেজলতলার পেত্নীটার কথা বুলো না। আর দেখা হয়নি তুমার সঙ্গে?’

যোগীবর হাসে। মাথা নেড়ে বলে, ‘হয়েছিল বৈকি! তবে উহ দ্যাখ বাপ, তুর ধলি গরুটা বুঝি মুখ দিলে গমের চারায়।’

হরিবোলা নড়ি তুলে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে দৌড়তে থাকে। মেহদু কসাইয়ের নাম করে শাসায়। বলে, ‘মেহদুকে দুবো—হ্যাঁ!’

গরুগুলোকে সে ভালবাসে। খুঁটিয়ে তাদের শরীর দেখে। ঘা থাকলে দুব্বো ঘাস মচলে ঘসে দেয়—যোগীবরের পরামর্শে। গোঁদল পোকা ছাড়িয়ে দেয় পেট থেকে। কমবয়সী বাছুর গরুটাকে সে কোলে নিয়েই পার করে নালা খানাখন্দ। তখনও তার কাঁধে শালিকছানা। চুলে ট্যাঁসকোনা পাখির পর গোঁজা। কোথাও এই পর পেলে সঙ্গে সঙ্গে সে কুড়িয়ে নেয়। মোড়লের খড়কাটার কুঠুরির নিচু চালে অনেক পর গোঁজা আছে।

এই জীবন হল বাগালের। তারও আছে অনেক রীতিনীতি, অনেক প্রথা, ইতিহাস। হরিবোলা তার অন্তর্গত। তার কপালে আঁকা আছে রাখালফোঁটা। নড়ির ডগায় ঘষে ঘা করে সেই ঘা শুকোলে ওই গোল ফোঁটা কালো হয়ে ফুটে থাকে দুই ভুরুর মধ্যিখানে। এই ফোঁটা দিয়ে দ্বারকার ওপারে রাখালের একদিন অভিষেক হয়। হরিবোলারও হয়েছে। রাখালী ছেড়ে কোথাও যাবে না। গ্রাম থেকে বেরিয়ে এলেই সে নদীপারের এই ব্যাপকতায় উড়ে বেড়ায় পাখপাখালির মতো। এখানে অবাধ স্বাধীনতা তাকে চিতাবাঘের বাচ্চা করে ফেলে। তার চলার ভঙ্গী যায় বদলে। চাহনিতে ফুটে ওঠে বন্য প্রাণীর চাঞ্চল্য। সে গলা ছেড়ে গান গায়, ‘দড়া লধির/যৈবন পড়্যে আছে হে…’ যদিও তার যৌবন এখনও বহুদূরে। সেই যৌবন এলে কি ঘটবে, তাও সে ভাবে না। ফাঁড়িঘাসের বনে, হিজল-জারুল-ভাঁড়ুলে গাছের জঙ্গলে, কিংবা বাঁওড়ের ধারে সবুজ ঘাসে ঢাকা মাটিতে হাঁটতে হাঁটতে তার মনেও হয় না যে একদিন এই বাগালীজীবনের পর তাকে মুনিশ হয়ে ক্ষেতে নামতে হবে এবং তার এই সিধে মেরদণ্ড বেঁকে যাবে ফসলের শীষের দিকে। যে মাটিকে সে পা দিয়ে ছুঁয়েছে, সেই মাটি হাত দিয়ে তাকে ছুঁতে হবে—একথাও বোঝে না সে।

এখন হরিবোলা সে-হরিবোলাটি নয়। তার আদুড় শরীরে এখন ঘাসের গন্ধ, বিলের জলের গন্ধ। খড়কাটা ঘরে কুঁকড়ে শুয়ে নিজের বুকের ওইসব প্রাকৃতিক গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে সে ঘুমিয়ে পড়ে। তার অবচেতনায় সারা রাত দ্বারকা নদীর ওপারের বিস্তীর্ণ তৃণভূমি বুড়ো যোগীবরের মতো পাহারা দেয়।…

 চৈত্রে ধানু মোড়লের মেয়ে-জামাই এসেছে। জামাই খুব সিগারেট খায়। সকালে হরিবোলাকে ডেকে বলে, ‘অ্যাই ছোঁড়া, এক প্যাকেট সিগারেট এনে দে তো! শোন, এই প্যাকেটটা নিয়ে যা। বলবি এই সিগারেট দাও।’

হরিবোলা টাকা নিয়ে দৌড়ুতে থাকে। লরেন্দ মাস্টেরের ভাই মলিন্দ সম্প্রতি মনোহারি দোকান দিয়েছে গ্রামে। সিগারেট সেই বেচে। হরিবোলাকে দেখে বলে ‘দাঁড়া হরিবুলা, কথা আছে।’

হরিবোলা বলে, ‘টক করে সেকরেট দ্যাও বাবু, গোচ্চরাতে যাব।’

মলিন্দ হাসে। ‘দাঁড়া না বাঞ্চোত! কথা আছে।’ সে হরিবোলার হাত থেকে টাকা নেয়। কিন্তু সিগারেট দেয় না। গলা চেপে বলে ‘সেই যে তোর মা জামা পেণ্টুল দিয়েছিল, পরিসনি?’

হরিবোলা মাথা নাড়ে। নির্বিকার মুখে বলে, ‘মুরোলগিন্নি দেয়নি। লেমুনচুষও দেয়নি।’

‘হুঁ। যাবি তোর মাকে দেখতে?’

হরিবোলা নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে।

মলিন্দ চাপা ধমক দেয়, চোখে হাসি। ‘বল না, যাবি নাকি মাকে দেখতে? তোর মায়ের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়। আমাকে বলে তোকে নিয়ে যেতে। যাবি?’

হরিবোলা আস্তে বলে, ‘মুরোল বকবে।’

‘ধুর ব্যাটা! লুকিয়ে যাবি।’

হরিবোলা একটু হাসে এবার। ‘গরুগুলান কে চরাবে?’

‘আর কোনো বাগালকে গছিয়ে দিবি। তারটা একদিন চরিয়ে শোধ করবি।’

এমন প্রথা অবশ্য আছে। তবু হরিবোলা ভাবে। শেষে হাত বাড়িয়ে বলে, ‘জামাইদাদার সেকরেট দ্যাও।’

‘তাহলে যাবি না? অ্যাই ছোঁড়া, মাকে দুঃখু দিবি? তুই তো বড্ড নেমকহারাম।’

হরিবোলা মুখ নামিয়ে পায়ের বুড়ো-আঙুলে মাটিতে আঁচড় কাটে।

মলিন্দ ফিসফিস করে বলে, ‘তোর মা খুব কান্নাকাটি করছিল। গাঁয়ে আসতে সাহস পায় না মোড়লগিন্নির ভয়ে। তাছাড়া…ওসব তুই ছেলেমানুষ, বুঝবি না। মোটকথা, তোর মায়ের আসা কঠিন। তুই আমার সঙ্গে যাবি, চলে আসবি দেখা করে। কেমন?’

হরিবোলা অবশেষে আস্তে মাথাটা দোলায়। তারপর গলার ভেতর বলে, ‘কবে যাবা তুমি?’

‘কাল মাল আনতে যাব। খুব সকাল-সকাল যাব। নদীর ব্রিজে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব। তুই চলে আসবি।…’

এদিন হরিবোলার কেমন ভাবুক চেহারা। গরু নিয়ে গেল কেমন তুম্বো মুখে। মোড়লগিন্নির থাপ্পড় খেয়েও সে মুখ খোলে নি। কিন্তু নদীর ওপারে গিয়ে তার মনটা ভাল হয়ে গেল। যোগীবরের কাছে যেতে ইচ্ছে করছিল না। নিরিবিলি ঘুরে বেড়ালো গরুর পালটা নিয়ে। মায়ের কথা ভেবে খুব খুশি হচ্ছিল হরিবোলা। মায়ের কথা বেশি করে মনে পড়ছিল। মায়ের সেই গানখানাও গেয়ে ফেলল সে ‘বঁধূ লাও বা না লাও/মুখ দেখে নাও/বাসি কাচের আয়না…’

তারপর গেল দুধসরের ধারে। বাগালদের জোট সেখানে ভাঁড়ুলে গাছে ঝাল-ঝুল্লা খেলছে। নালার জলে চিহ্নিত শেকড় থেকে ভিজে চালের ন্যাকড়াটা তুলল সে। তারপর দলটার দিকে তাকাল।

পাতকুড়োকে খুঁজছিল সে। পাতকুড়োর সঙ্গেই তার যত বন্ধুতা। ছেলেটা খুব লক্ষ্মী। চোখে চোখে পড়তেই হরিবোলার চালের লোভে দৌড়ে এল খেলা ছেড়ে। দলপতি তাকে শাসাচ্ছিল, ‘শালোকে পাল থেকে বেংড়ে দুবো!’ কিন্তু গ্রাহ্য করল না সে।

পাতকুড়ো হাসিমুখে বলল, ‘ইদিক বাগে দেখেই বুঝেছি, হরিবুলার চাল ভিজুনো ছিল ন্যালায়। ইঃ, জানলে পরে খেয়ে শ্যাষ করে দিতাম।’

হরিবোলা মিঠে গলায় বলল, দিতিস তো দিতিস! এই লে!’

দুজনে কুড়মুড় করে চাল খায় নাটাকাঁটার ঝোপের আড়ালে। তারপর কথাটা তোলে হরিবোলা। যাবে আর বেলাবেলি ফিরে আসবে। মায়ের কাছে বাসমোটরের ভাড়া চেয়ে নেবে। সাঁকোর কাছে নেমে সোজা এখানে চলে আসবে। গরুগুলো বুঝে নিয়ে বেলা যদি থাকে, চরাবে—নৈলে ডাকিয়ে নিয়ে ফিরে যাবে।

পাতকুড়ো রাজি। গেরস্থর চোখের আড়ালে বাগালে-বাগালে এমন বোঝাপড়া চিরকালের।…

পরদিন সকালে তর সইছিল না হরিবোলার। বাড়িতে জামাই বলে ধানু মোড়ল আজ আর নদী পর্যন্ত আসেনি। নদীর ওপারে পাতকুড়োকে পালটা বুঝিয়ে দিয়ে হরিবোলা দৌড়ুতে থাকে নদীর ধারে-ধারে।

ব্রিজের মাথায় মলিন্দ সাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করছিল। তার বড় গরজ। রাঙাদাসী এখন মেদিগঞ্জের বাগানপাড়ার গলিতে মধুবালা হয়েছে। মলিন্দ তার প্রেম পেয়েছে। যখন রাঙাদাসী গ্রামে ছিল, তখনও মলিন্দ ঘুরঘুর করত বটে, পাত্তা পায়নি। তাছাড়া মেয়েটার মতিগতিও অন্যরকম ছিল।

শুধু অবাক লাগে মলিন্দের, প্রস হয়েও ছেলের জন্য টান থাকে সে কল্পনাও করেনি। বাগানপাড়া গলিতে ঢোকার অভ্যাস তার অনেকদিনের। সেখানে গউরের বউকে দেখে সে চমকে উঠেছিল। কিন্তু মোড়লকে তো এসব কথা বলা যায় না।

টাউনবাজারে এই প্রথম আসা হরিবোলার। সে একেবারে জড়োসড়ো এতটুকুনটি। মলিন্দ সাইকেল থেকে নেমে তার কাঁধ ধরে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যায়। অনবরত বোঝায়, যেন গ্রামের কাকপক্ষীটিও টের না পায়। বারবার বলে, ‘কাউকে বলবিনে তো হরিবোলা? বললে তোকে কেটে ফেলব কিন্তু।’

বন্যপ্রাণীর চাউনিতে হরিবোলা রঙবেরঙের ঘরবাড়ি আর মানুষজন দেখে। ভেবে কূল পায় না এখানে তার মা থাকে!

কতদূর হেঁটে একটা আড়তে সাইকেল জিম্মা দিয়ে মলিন্দ বলে, ‘আয় হরিবোলা!’

এ-গলি ও-গলি আরও কতদূর গিয়ে একটু দাঁড়ায় সে। আবার বলে, ‘আয়!’

গলির দুধারে খোপবন্দী ঘর। টালি বা খাপরুলের ছাউনি। দরজায় বসে ও দাঁড়িয়ে আছে নানাবয়সী মেয়েরা। হরিবোলা পিটির পিটির তাকিয়ে হাঁটে। একটা ঘরের দরজায় পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে চুল শুকোচ্ছিল এক মেয়ে, পরনে লালরঙের শাড়ি। মলিন্দ আস্তে ‘মধুবালা’ বলে ডাকতেই সে ঘোরে।

সেই কয়রা বেড়ালচোখ। সেই রাঙা ছিপছিপে গড়ন। তবু হরিবোলা চিনতে পারে না। মলিন্দ বলে, ‘কী রে ছোঁড়া? মাকে চিনতে পারছিস না! এজন্যেই মোড়ল বলে ক্যালাগোবিন্দা।’

রাঙাদাসী খপ করে হরিবোলাকে ধরে একটানে ঘরে ঢুকিয়ে ভেতর থেকে বলে ‘মলিন্দবাবু, তুমি এখন এস।’

মলিন্দ অবাক। খ্যা খ্যা করে হাসে। ‘বাঃ! তোমার বেশ বিবেচনা মাইরি!’

‘না, না। তুমি এখন এস তো। জ্বালিও না।’

‘হরিবোলাকে মোড়লের কাছে পৌঁছে দিতে হবে না?’

‘না। আমি বাসে তুলে দেব। তুমি যাও।’

‘ঠিক আছে।’…মলিন্দ বেজার হয়ে পা বাড়ায়। দরজা বন্ধ করে দিয়েছে রাঙাদাসী। মনে মনে মলিন্দ অশ্লীল গাল দিতে দিতে কিছুটা এগিয়ে থমকে দাঁড়ায়। উদাস চাউনিতে তাকে দেখতে থাকা একটি মেয়েকে কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে ‘রেট’? মেয়েটি দুহাতের দশটা আঙুল দেখায়।

‘গরজ!’ বলে মলিন্দ তার ঘরেই ঢুকে পড়ে।….

দরজা বন্ধ করে পেছনের একটা ছোট্ট জানালা খুলে দিয়েছে রাঙাদাসী। জানালার ওধারে খালে শুওর চরছে। ওপারে ঝোপঝাড়, তারপর একটা পুরনো বিশাল বাড়ি। ঘরের ভেতরটা ক্রমশ স্পষ্ট হলে হরিবোলা দেখে, তার মা তাকে জড়িয়ে মাথায় গাল রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মায়ের শরীর থেকে বা শাড়ি থেকে মিষ্টি গন্ধ মউমউ করছে। গন্ধটা তার চেনা লাগে। কিন্তু সে নির্বিকার মুখে ঘরের ভেতরটা দেখতে থাকে।

তক্তাপোসের ওপর পুরু বিছানা। এমন বিছানায় কখনও সে বসেনি। দেয়ালে অনেক ছবি ঝুলছে। মাকালীর ছবিটা সে চিনতে পারে। মোড়লের ঘরে এই ছবি আছে। মেঝের ওধারে একটা কেরোসিনকুকার। এনামেলের হাঁড়িকুড়ি। একটা সাদা চওড়া থালা। কেটলি। অনায়াসে ইটের ওপর বসানো সেই চেনা স্যুটকেস—তার ওপরে একটা বড় কালরঙের থলের মতো—হয়তো বাক্স। তাতে কী আছে, দেখতে ইচ্ছে করে হরিবোলার।

দড়ির আলনায় শাড়ি সায়া ব্লাউস এইসব ঝুলছে। তারপর কোণার দিকে দুটো ইট এবং নর্দমার ঘুলঘুলিতে চোখ পড়ে হরিবোলার। ঘরের ভেতর পেচ্ছাপ করে বুঝি? তার মা এমন ‘খ্যাদোড়’ তো ছিল না।

‘হরিবুলা!’

ধরা গলার ডাক শুনে হরিবোলা এবার মুখ তোলে।

‘কী খেয়েছ সকালে?’

‘মুড়ি, গুড়। আর…..’ একটু ভেবে হরিবোলা বলে, ‘মরোলের জামাই বতিচুরের নাড়ু এনেছিল। তাই আধখানা দিয়েছিল।’

‘ভাত খাওনি?’

‘হঁউ পান্তা খেয়ে গোচ্চরাতে গেলাম। তাপরে…’

গালে গাল ঘষে রাঙাদাসী বলে, ‘আমাকে তুর ঘেন্না করছে, বাছ?’

‘উঁ?’ হরিবোলা বোঝে না।

শ্বাস টেনে এবং ছেড়ে রাঙাদাসী বলে, ‘চাট্টি ভাত খা। মাছ আন্না করেছি। আজই তুকে আনবে, জানি না তো!’

রাঙাদাসী মেঝেয় একটুকরো আসন পেতে ছেলেকে ভাত বেড়ে দেয়। হরিবোলা প্রথমে একটু অনিচ্ছা করে, পরে খুশি হয়ে খায়। রাঙাদাসী তাকে খাওয়ায়। মুখে ভাত গুঁজে দেয়। জামাপ্যাণ্টের কথা জিজ্ঞেস করে। হরিবোলা মোড়লের দোষ ঢাকতে মিথ্যে করে বলে, ‘দিয়েছিল।’

‘ই ছিঁড়া পেণ্টুল, খালি গা করে এলি যে?’

হরিবোলা দুধের দাঁতে হাসে। ‘মাঠ থেকে এলাম বুলছি না?’

‘খেয়ে নে। তাপরে লতুন জামাপ্যাণ্টজুতো কিনে দুবো।’

সেইসময় দরজায় খটখট শব্দ আর ডাক, ‘মধু! অ মধুবালা! অসময়ে আবার কোন নরকখেকোকে ঢোকালি লা? বিদেয় করে বেরো! বড়মানুষ এনেছি।’

রাঙাদাসী গর্জন করে বলে, ‘যাও তো মাসি। হবে না এখন!’

‘আচ্ছা লা, আচ্ছা! দেখব, গুমোর কদ্দিন থাকে।’

হরিবোলা জিগ্যেস করে, ‘কে ঝগড়া করছিল মা?’

‘ওই এক মাগী।’ বলে সে ছেলের মুখে গেলাস ধরে। হরিবোলা ঢকঢক করে জল খায়, কিন্তু গেলাসের দুপাশ দিয়ে দুটো বন্যচোখে মায়ের মুখখানা দেখতে থাকে। রাঙাদাসীর বুকটা ধক ধক করে ওঠে চাউনি দেখে।

তারপর রাঙাদাসী ছেলের চুল আঁচড়ে দেয়। ভিজে তোয়ালেতে মুখ মুছিয়ে দেয়। আঙুলের ডগায় করে স্নো তুলে ঘষতে গেলে হরিবোলা মুখ সরায়। কিছুতেই মাখতে চায় না।

ঘরে তালা এঁটে ছেলেকে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে বলে, যখন মন খারাপ করবে, তক্ষুণি চলে আসবি। যেমন আছ মুরোলবাড়ি, তেমুনি থাকো এখন। ভগবান যদি মুখ তুলে তাকায়, মা-বাছা মিলে টাউনে দোকান দুবো।’

এইসব কথা অনর্গল। হরিবোলা কিছু বোঝে না। টাউন বাজারের ভিড়ে হারিয়ে যাবার ভয়ে মাকে আঁকড়ে ধরে হাঁটে।…

বাঁওড়ের কাছে খানিকটা উঁচু টুঙ্গির ওপর যুগীবরের কুঁড়েঘর। খড়-বাঁশের একটা ঝুপড়ি, সামনে খানিকটা মাটি ঝকমক করছে। হিজলগাছের ডালে ঝুলছে দড়ির সিকে, তার মধ্যে দুটো হাঁড়িকুড়িতে তার খাদ্যদ্রব্য। গুঁড়িতে ঝুলছে তার হুঁকো। এই তাঁর সংসার। বহুবছর আগে সে গ্রাম থেকে এখানে এসে নিরিবিলিতে এই সংসার গড়েছে। এক টুকরো খেত ছড়িয়ে আছে সামনে। এই তার সম্পত্তি। সারাবছর সে বিবিধ ফসল ফলায়। তাকে বেচতে যেতে হয় না, নিকিরিরা এখান থেকেই কিনে নিয়ে যায়। গ্রামে সে কখনও-সখনও যায়, সেও নুনতেল কিনতে। হাটবারে একখানি কাপুড় কিনতে। সেও এক হুদমুসলো,—গোঁয়ার মানুষ। কোমরে কোনরকমে গামছা জড়ানো। শীতকালে বড়জোর গেঞ্জির ওপর তুলোর কম্বল। মাথায় পুরনো কাপড়ের টুকরো দিয়ে পাগুড়ির মতো একটা কিছু বানিয়ে নেয়। যখন তার ক্ষেতের শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন সে এক দাম্ভিক সম্রাট। বাগালরা তাকে খুব ভয় পায়। শুধু হরিবোলাকে সে পাত্তা দেয়, পছন্দ করে এবং হরিবোলা কাছে এলেই তার মুখ খুলে যায়। হাঁটুদুমড়ে গমের চারার ভেতর বসে আগাছা ওপড়াতে-ওপড়াতে সে মুখ তুলে বহুদূরে তাকিয়ে অন্বেষণ করে তাকে।

এদিন ছেলেটাকে দেখতে না পেয়ে ভাবছিল জ্বরজ্বারি হয়েছে বুঝি। কিন্তু পড়ন্তবেলায় যখন সে হুঁকো হাতে পা ছড়িয়ে বসে সুখটান দেবার উপক্রম করছে, তখন তার গায়ে এক দীর্ঘছায়া। মুখ ঘুরিয়ে দেখে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। চোখে রোদের ছটাও বটে। চিনতে পারে না।

হরিবোলার গায়ে রাঙা জামা, আনকোরা হাফপেণ্টুল, পায়ে সত্যিকার স্যাণ্ডেল। ফিক করে হেসে বলে, ‘যুগীকাকা, ইগুলান মা কিনে দিয়েছে। মেদিগঞ্জতে যেয়েছিলাম, বুইলা না যুগীকাকা?’ সে দৌড়ে এসে হাঁটু দুমড়ে সামনে বসে পড়ে। কলকল করে বৃত্তান্ত বলতে থাকে।

 যোগীবর খালি ‘হুঁ’ দিয়ে যায়। তারপর হরিবোলা তার হাতে একটা লেমুনচুষ গুঁজে দিলে সে মুঠোয় ধরে রাখে জিনিসটা। একটু পরে বলে, ‘তুর মা মেদিগঞ্জতে থাকে?’

হরিবোলা খিটখিট করে হাসে। ‘তমে তুমি এতক্ষুণ শুনলা কী?’ বলে সে এদিক-ওদিক চেয়ে দেখার পর জামা খুলে ফেলে। স্যাণ্ডেলদুটো খোলে। পেণ্টুলটা খুলতে যায় কুঁড়ের পেছনে। ফিরে আসে আগেকার বাগাল হয়ে। পরনে, ধানু মোড়লের ছেঁড়া পেণ্টুলখানা মাত্র। চাপা গলায় বলে, ‘ইগুলান নুকিয়ে থোব তুমার কাছে। মুরোল জানলে মারবে, বুইলা না?’

যোগীবর মাথা নেড়ে বলে, ‘বুইলাম।’

হরিবোলা জামা-পেন্টুল-স্যান্ডেল গুটিয়ে যোগীবরের হাতে গুঁজে দেয়। তারপর চিতেবাঘের বাচ্চার মতো দৌড়ুতে থাকে। তার চেরা গলার গান ভেসে আসে কুয়াশামাখানো নরম রোদের ভেতর থেকে, ‘বঁধু লাও বা না লাও/মুখ দেখে যাও/বাসি কাচের আয়না…’

যোগীবর সাধুর মতো উদাসীন হেসে হরিবোলার জামা-পেণ্টুল-জুতো দেখতে থাকে। একবার শোঁকেও। নতুন কাপড়ের গন্ধটা বেশ। টাউনবাজারের কথা মনে পড়ে যায়। কতকাল সে টাউনবাজারে যায়নি। শিগগির একদিন যাবে।

দুধসরের নালার কাছে পাতকুড়ো মুখ চূণ করে দাঁড়িয়ে ছিল। হরিবোলা কাছে গেলেও সে কথা বলে না। গরুবাছুরের পাল তখন সবে ঘরমুখো হচ্ছিল। বাগালরা হাঁকিয়ে নিয়ে আসছিল নালার এধারে। বাগালদের দলপতি এসে হরিবোলাকে দেখেই নিষ্ঠুর হেসে ঘোষণা করে, ‘হরিবুলা, আজ তুর মরণ মুরোলের হাতে। তুর পাল ডাকিয়ে খোঁয়াড়ে লিয়ে যেয়েছে দ্যাখ গা যা! গম খেয়ে বিনেশ করেছে, যা তা কথা?’

হরিবোলা চেঁচিয়ে ওঠে, ‘শালা পাতকুড়ো!’ তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাতকুড়োর ওপর। দুজনে পড়ে যায় ব্যানার ঝোপে। জড়াজড়ি খামচা-খামচি চলতে থাকে! দলপতির বয়স বেশি। গায়ে জোর বেশি। সে দুজনকেই চাঁটি মেরে ছাড়িয়ে দেয়। দাঁত বের করে বলে, ‘মা-সোয়াগির ব্যাটা হয়েছে! যাও, এখন মাকে বুলে খোঁয়াড় থেকে ছাড়িয়ে লিয়ে এস।’

পাতকুড়ো কী বলতে যাচ্ছিল, দলপতির থাপ্পড় দেখে থেমে যায়। হরিবোলা কী বলবে ভেবে পায় না। সে শুধু চোখ কচলায়। বাগালদলের চোখে-চোখে ইশারা আর বাঁকা হাসি দেখে সে শুধু আঁচ করতে পারে, যেন ইচ্ছে করেই তাকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। পাতাকুড়োকে তার গরুগুলো চরাতে দেওয়া হয়নি হয়তো। তাই তারা গমক্ষেতে ঢুকেছিল।

যোগীবর হুঁকো টানা শেষ করে কাশতে কাশতে উঠে দাঁড়িয়েছে, হরিবোলা কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এল। যোগীবর বলে, ‘কী রে বাছা? গেলি তো হাসতে হাসতে উঁ?’

তারপর সব শুনে সে অভ্যাসমতো বহুদূরে দৃষ্টিপাত করে। গরুর পাল নিয়ে বাগালেরা ফিরে চলেছে। সূর্য লাল চাকা হয়ে ডুবছে দোমোহানীর দিকে। দূরের ডহরে ধুলো, কাশবনের মাথায় কুয়াশা, বিল থেকে মেছুনীরা উঠে আসছে কাঁধে বিশাল প্রজাপতির ডানার মতো জাল নিয়ে, মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বুনো হাঁসের ঝাঁক—প্রতিদিন দিনশেষের একই ছবি। যোগীবর আস্তে বলে, ‘মুরোলকে যেয়ে বুলগা বাছা, কী আর করবি?’

হরিবোলা ভাঙা গলায় বলে, ‘মুরোল মারবে।’

যোগীবর ঘড় ঘড় করে কেসে এবং হেসে বলে, ‘তাইলে মায়ের কাছে চলে যা বরঞ্চ।’

‘মা বুলেছে মুরোলের কাছে থাকতে।’ হরিবোলা আবার ফুঁপিয়ে ওঠে। ‘মা বুলেছে, য্যাখন খবর দুবো, ত্যাখন আসবি—লৈলে আসবি না।’

‘তুর মা বুলেছে?’

‘হুঁ। বুলেছে য্যখন-ত্যাখন কক্ষুণো আসবি না।’

 যোগীবর বুঝতে পারে না। রাগ করে বলে, ‘তাইলে যা ইচ্ছে কর গা বাছা! দেখি, বাওড়ে জালখানা পেতে আসি—রেতে যদি দুটো মাছ-টাছ পড়ে।’ সে হিজলডালে টাঙানে খোপ-জালখানা পেড়ে নিয়ে থপথপ করে চলে যায়। আর পিছু ফেরে না।

হরিবোলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে চোখ কচলায়।…

ধানুমোড়লের খবর পেতে দেরি হয়নি, দোমোহানীর লোকেরা তার পাল ডাকিয়ে খোঁয়াড়ে নিয়ে গেছে। ছাড়াতে পনের-ষোল টাকার ধাক্কা। এদিকে বাড়িতে জামাই, সেও মোড়লের মেয়েকে টাকার জন্য লেলিয়ে দিয়েছে। ধানু মোড়ল যত, তত তার গিন্নিও টাকা-অন্ত প্রাণ। ধানু মোড়লের মাথার ভেতর আগুন জ্বলে গেছে। গিন্নির তো গলা শুকিয়ে গেছে গাল দিতে দিতে। ঘরে জামাই, তাকে কী? দোমোহানীর খোঁয়াড় থেকে গরুগুলো ছাড়িয়ে আনতে মাঝরাত হয়ে গেল।

মোড়ল গোয়ালে গরু বেঁধে এসে টিউকলে হাত পা ধুতে ধুতে চোখের কোণা দিয়ে কী একটা দেখতে পায় পেয়ারাগাছের লাগোয়া। ভিজে হাতে লণ্ঠন তুলে দেখার চেষ্টা করে বলে, ‘উটা কী?’

মোড়লগিন্নি বলে, ‘বেউশ্যের পুত থাউক বাঁধা।’

পেয়ারাগাছের সঙ্গে গরুবাঁধা দড়িতে ক্ষুদে বাগালটা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা আছে দেখে মোড়লও গলার ভেতর বলে, ‘খানকির পুত থাউক বাঁধা।’

কিন্তু রাত আরও গভীর হলে সেই মোড়ল বিবিধ বিবেচনার পর লণ্ঠনের দম বাড়িয়ে উঠোনে নামে। একটু বুক কাঁপে। মরে-টরে যায়নি তো? কাছে এসে দেখে বাগালের কঠিন প্রাণ—মাঠেঘাটে জলজঙ্গলে রোদ-বৃষ্টি-শীতের ধারাবাহিক প্রহারে কালক্রমে শামুকের খোলের চেয়ে দড়।

তার লিকলিকে বাহু খামচে ধরে মোড়লমশাই তাকে খড়কাটার কুঠুরিতে ঠেলে দেয় এবং নিজের বিছানায় ওমে ফিরে যায়। ওপরে খড়, নীচে খড়, মধ্যিখানে কুঁকড়ে পড়ে থাকে হরিবোলা। আজ রাতে তার অবচেতনায় সেই বিশাল তৃণভূমি রাঙাদাসী হয়ে ফিসফিস করে কথা বলে। তার চিমসে ফাটা ঠোঁটদুটো কেঁপে ওঠে। ঘুমের ঘোরে সে মায়ের দেওয়া লেমুনচুষ চুষতে থাকে। তার দুই ভুরুর মধ্যিখানে আঁকা রাখালফোঁটাটি এখন অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। সে এখন প্রকৃতই রাঙাদাসীর ছেলে হয়ে ঘুমোয়।…

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *