অধ্যায় ৯
ট্রাফিক লাইটে লাল বাতি জ্বলে থাকা চার রাস্তার একটা মোড়ে এসে পড়লো সে। বাম দিকে কয়েক ব্লক দূরে আকাশে রঙধনুর মতো বাতির আলো উঠতে দেখলো। একটা বৃজ! লিমাট নদী! সিগনালটা সবুজ হলে বাম দিকে মোড় নিলো জেসন।
ব্যানহফস্ট্রাসে আবার ফিরে এসেছে সে। গুইসান কুয়ে এখান থেকে কয়েক মিনিটের পথ। প্রশ্বস্ত এভিটা নদীর তীরে অবস্থিত। কিছু দূর যাবার পর একটা পার্ক দেখতে পেলো। গ্রীষ্মে এখানে জুরিখবাসী ভীড় করে। গাড়ি রাখার জায়গাটাতে প্রবেশ করলে সাদা মেঝেতে ভারি শেকল দেখতে পেলো সে। দুটো পাথরের পোস্টের সথে ঝুলানো আছে সেগুলো। কিছু দূর যাবার পর আরেকটা শেকলের কারণে তার গতিরোধ হলো। তবে এই শেকলটা আগেরটার মতো নয়। একটু আলাদা, একটু অদ্ভুত। গাড়ি থামিয়ে কাছে এসে দেখলো। তাকে খুন করতে আসা একজনের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া টর্চলাইটটা নিয়ে নিলো গাড়ির সিট থেকে। ভারি শেকলটার উপর আলো ফেললো সে। এটা আবার কি? পার্থক্যটা কি?
শেকলটা নয়। শেকলটার নিচে যেটা আছে সেটা। চাকার দাগ। এখানকার পরিস্কার জায়গায় একমাত্র দাগ।
বর্ন টর্চটা বন্ধ ক’রে গাড়িতে রেখে দিলো। তার শার্ট ছিঁড়ে গেছে। সে তার শার্ট থেকে আরেকটু ছিঁড়ে নিয়ে সেই ছেড়া কাপড়টা দিয়ে নিজের বাম হাতের ক্ষতস্থান বেধে ফেললো। এখন সে প্রস্তুত।
অস্ত্রটা হাতে নিয়ে সেটার ক্লিপ পরীক্ষা ক’রে দেখলো। গুলি ভরা আছে। দুটো গাড়ি তাকে অতিক্রম করার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করলো সে। তারপর হেডলাইট বন্ধ ক’রে একটা ইউ-টার্ন নিয়ে শেকলের পাশেই পার্ক করলো গাড়িটা। তারপর গাড়ি থেকে নেমে কাছের শেকলটা নিঃশব্দে নামিয়ে রেখে গাড়িতে ফিরে এলো আবার।
আস্তে ক’রে গাড়িটা চালিয়ে বাতিবিহীন একটি পার্কিং এরিয়াতে ঢুকে পড়লো সে। সেখান থেকে দুশো গজ দূরেই সমুদ্রের দেয়ালটা দেখা যাচ্ছে। এই দেয়াল কোনো সমুদ্রের পানি আঁটকে রাখে না, আঁটকে রাখে লিমাট নদীর জলস্রোত। ওপাড়ে পুরনো শহরের উপকূল দেখা যাচ্ছে। বাতিগুলো স্পষ্ট ক’রে দিচ্ছে শহরটার অবস্থান।
ডান দিকে। ডান দিকটায় একটা কালো রেখা দেখা যাচ্ছে—অস্পষ্ট, ক্ষীণ, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে। একশ’ গজ…এখন নব্বই, পঁচাশি; গাড়ি থামালো সে। খোলা জানালা দিয়ে অন্ধকারে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। আরো ভালো ক’রে দেখার চেষ্টা করলো। নদী থেকে আসা বাতাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে এখন।
শব্দ। একটা চাপা আর্তনাদ। ক্ষীণ, চাপা কণ্ঠের…ভয়ের গোঙানী। তারপরই রুক্ষ্ম একটা চপেটাঘাতের শব্দ। তারপর আরেকটা। আরো কয়েকটা। একটা চিৎকার হলো এবার। এরপর যেনো একটা মুখ চাপা দেয়া হলো। চুপ হয়ে গেলো একেবারে।
গাড়ি থেকে নিঃশব্দে নেমে পড়লো বর্ন। ডান হাতে অস্ত্র আর রক্তাক্ত বাম হাতে একটা টর্চ। অন্ধকারে খুব সতর্ক পদক্ষেপে সে এগোতে লাগলো। প্রথমেই তার নজরে পড়লো ছোট্ট সিডান গাড়ির দোমড়ানো মোচড়ানো বাম্পারটা। স্টেপডেকস্ট্রাসে এই গাড়িটাই দেখেছিলো সে। রাতের বেলায়ও সেটার ঔজ্জ্বল্য স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
পরপর চারটা চাপড় মারার শব্দ হলো। উন্মাদের মতো চড়থাপর দেয়া হচ্ছে, চাপা আর্তনাদ আর গোঙানী ভেসে এলো গাড়ির ভেতর থেকে!
অনেক কষ্টে একটু নিচু হয়ে গাড়ির পেছনের জানালার দিকে চুপিসারে চলে এলো জেসন। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো সে। তারপর আচমকাই টর্চের আলো ফেলে শব্দ করলো ভড়কে দেবার জন্যে।
“নড়েছো তো মরেছো!”
ভেতরের দৃশ্যটা দেখে গা গুলিয়ে উঠলো তার। মেরির গায়ের জামা কাপড় ছিড়ে ফেলা হয়েছে। সে প্রায় নগ্ন। তার অর্ধনগ্ন দেহে দুটো হাত থাবার মতো বিচরণ করছে। তার স্তন দুটো দলাই মলাই করছে, পা দুটোকে ফাঁক করে রাখা হয়েছে। ফুলপ্যান্টের জিপার থেকে উদ্যতভাবে বের হয়ে আছে ঘাতকের লিঙ্গ। খুন করার আগে সে চূড়ান্ত অবমাননা করছে মেয়েটাকে।
“বের হ, শূয়োরের বাচ্চা!”
ঝন্ ঝন্ ক’রে কাঁচ ভাঙার শব্দ হলো। মেরিকে ধর্ষণ করতে উদ্যত লোকটা বুঝতে পেরেছে। মেয়েটা খুন হয়ে যাবে এই ভয়ে বর্ন গুলি করলো না। সে মেয়েটাকে সরিয়ে গাড়ির জানালায় জুতো পায়ে লাথি মারলে কাঁচের টুকরো জেসনের চোখে মুখে এসে লাগলো। চোখ বন্ধ ক’রে ফেলে একটু পিছু হটে গেলো সে।
দরজাটা ধপাস ক’রে খুলতেই একটা বিস্ফোরণ হলো। সুতীব্র আর উষ্ণ যন্ত্রণা হলো বর্নের ডান দিকটায়। তার কোটের কিছু অংশ ছিঁড়ে গেছে। রক্তে ভিজে একাকার হয়ে গেছে তার ছেঁড়া ফাড়া শার্টটা। টুগার টানলেও মাটিতে গড়িয়ে থাকা অবয়বটা আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছে। আবারো গুলি করলো সে। কিন্তু বুলেটটা শক্ত মেঝেতে লেগে ছিটকে গেলো। ঘাতক গড়িয়ে চলে গেলো দৃষ্টি সীমার বাইরে…অদৃশ্য হয়ে গেলো অন্ধকারে।
জেসন জানে এখন যেখানে আছে সেখানে থাকতে পারবে না। যদি থাকে তো নির্ঘাত মৃত্যু। নিজের খোড়া পা টেনে খোলা দরজাটার আড়ালে চলে গেলো সে।
“ভেতরেই থাকো!” মেরির উদ্দেশ্যে বললো চিৎকার ক’রে। মেয়েটা প্রচণ্ড ভয়ে গাড়ি থেকে বের হতে যাচ্ছিলো। “উফ্! ভেতরেই থাকো!”
একটা গুলির শব্দ হলে বুলেটটা গাড়ির দরজায় বিদ্ধ হলো। দেয়ালের উপর দিয়ে আবছায়া মূর্তিটাকে দৌড়ে যেতে দেখেই দু’বার গুলি করলো বর্ন। দূর থেকে একটা উফ্ ধ্বনি শোনা গেলে আশ্বস্ত হলো সে। লোকটাকে আহত করতে পেরেছে, খুন করতে পারে নি। তবে ঘাতক এখন আর আগের মতো কর্মক্ষম থাকবে না।
আলো। মৃদু আলো…চারকোনা। এটা আবার কি? তারা কারা? সে বাম দিকে তাকিয়ে যা দেখতে পেলো সেটা সে আগে কখনও দেখে নি। একটা ছোট্ট ইটের কাঠামো সমুদ্র দেয়ালের পাশে দুলছে। ভেতরে বাতি জ্বালানো আছে। ওয়াচম্যানের স্টেশন। ভেতরে কেউ গুলির শব্দটা শুনতে পেয়েছে হয়তো।
“ওয়াজ ইস্ট লস? ওয়ের ইস্ট ডা?” একটা লোক চিৎকার ক’রে বললো—এক কুঁজো লোক—আলোকিত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তারপরই একটা টর্চের আলো অন্ধকারে এসে পড়লে বর্ন সেখানে তাকালো। আশা করলো আলোটা ঘাতকের উপর গিয়ে পড়বে।
তাই হলো। দেয়াল ধরে হামাগুঁড়ি দিচ্ছে সে। জেসন উঠে দাঁড়িয়েই গুলি করলো। গুলির শব্দ হতেই টর্চের আলোটা এসে পড়লো তার ওপর। সে এখন টার্গেট। অন্ধকার থেকে দুটো গুলি ভেসে এলো, একটা বুলেট জানালার গুলে গিয়ে লাগলে ছোট্ট লোহার টুকরো বিদ্ধ হলো তার ঘাড়ে। রক্ত পড়তে লাগলো সেখান দিয়ে।
এবার দৌড়ানোর শব্দ শোনা গেলো। ঘাতক আলোর উৎসটার দিকে ছুটে যাচ্ছে।
“নেইন!”
সে ওটার কাজে পৌঁছে গেছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে এক হাত দিয়ে ধাক্কা মারলে আলোটা নিভে গেলো। জানালার আলোতে জেসন দেখতে পেলো ঘাতক ওয়াচম্যানকে টেনে সরিয়ে নিচ্ছে, বৃদ্ধলোকটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার ক’রে তাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে সে।
বর্ন দেখলো। অসহায়ের মতো গাড়ির হুডের উপর রেখে দিলো অস্ত্রটা। তার সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
চূড়ান্ত একটা গুলির শব্দ হলো, তার সঙ্গে চাপা একটা আর্তনাদ। আবারো দৌড়ানোর শব্দ। ঘাতক বৃদ্ধলোকটাকে খুন ক’রে পালাচ্ছে। পালাতে সক্ষম হলো সে।
বর্ন আর দৌড়াতে পারলো না। তীব্র যন্ত্রণাটা অবশেষে তাকে চলৎশক্তিহীন ক’রে ফেলেছে। দৃষ্টিও ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। মেঝেতে গড়িয়ে পড়লো সে। কেউ নেই। তাই কোনো কিছু পরোয়া করলো না।
সে যেই হোক না কেন, পালাতে দাও। পালাক সে। মেরি গাড়ি থেকে হামাগুঁড়ি দিয়ে বের হয়ে এলো। তার হাতে তার জামা-কাপড়গুলো। চোখে মুখে তীব্র আতংক। অবিশ্বাসে জেসনের দিকে চেয়ে আছে সে। তার চোখে মুখে এখন বিস্ময় আর দূবোর্ধ্যতা।
“চলে যাও,” চাপা কণ্ঠে বললো সে, আশা করলো মেয়েটা যেনো তার কথা শুনতে পায়। “ওখানে একটা গাড়ি আছে, চাবিটাও আছে ভেতরে। এখান থেকে চলে যাও। সে হয়তো অন্যদেরকে নিয়ে ফিরে আসবে। আমি জানি না।”
“তুমি আমার জন্যে ফিরে এসেছো!” তার কণ্ঠে বিস্ময়।
“চলে যাও! গাড়িটা নিয়ে চলে যাও, ডক্টর। কেউ যদি তোমার গাড়ির পথ আঁটকায় তাকে গাড়ি চাপা দিয়ে দেবে। পুলিশের কাছে চলে যাও…সত্যিকারের পুলিশ। বোকা মেয়ে, বুঝলে।” তার কণ্ঠটা শুকিয়ে এলো। পেটে শীতল একটা অনুভূতি হচ্ছে। আগুন আর বরফ। আগেও তার এরকম হয়েছে। একসঙ্গে। কোথায় যেনো?
“তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছো,” তার কণ্ঠটা বেশ কাঁপা কাঁপা শোনাচ্ছে। “তুমি আমার জন্যে ফিরে এসেছো। আমার জন্যেই এসেছো, আমার…জীবন… রক্ষা করেছো।”
“কথা বাড়িয়ো না।”
“তুমি মুক্ত। তুমি চলে যেতে পারতে, কিন্তু তুমি তা করো নি। ফিরে এসেছো আমার জন্যে।”
মেয়েটা হামাগুঁড়ি দিয়ে তার কাছে আসছে, ঝাঁপসা দৃষ্টিতে দেখতে পেলো সে। মেয়েটা তার মুখ স্পর্শ করলো, মাথায় হাত দিলো। থামো! আমার মাথায় হাত দেবে না! আমাকে ছেড়ে চলে যাও!
“তুমি কেন এটা করলে?” মেয়েটার কণ্ঠ শোনা গেলো।
মেয়েটা তাকে প্রশ্ন করছে। সে কি বুঝতে পারছে না? সে তো তার প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে না।
মেয়েটা করছে কি? সে একটা কাপড় ছিঁড়ে তার ঘাড়টা পেঁচিয়ে দিচ্ছে। এরপর জেসনের কোমরের বেল্ট আলগা ক’রে তার পোশাকের বড় অংশ দিয়ে ডান উরুটা চেপে ধরলো।
“তোমার জন্যে নয়।” অবশেষে সে শব্দ খুঁজে পেলো। অন্ধকারের মধ্যে শান্তি চাচ্ছে—এর আগেও যেমনটি সে চেয়েছিলো, তবে কখন, কোথায় সেটা মনে করতে পারলো না। মেয়েটা তাকে ছেড়ে গেলে সে প্রশান্তি খুঁজে পাবে। “ঐ লোকটা…সে আমাকে দেখে ফেলেছে। সে আমাকে চিনতে পারবে। ঐ লোকটাই আমি তাকে চাই। এখন চলে যাও!”
“আরো আধডজন লোকও তোমাকে চিনতে পারবে,” মেয়েটা জবাব দিলো। তার কণ্ঠে অন্য একটা সুর। “আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না।”
“আমাকে বিশ্বাস করো!”
এখন সে তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। তারপরই দেখা গেলো সে আর নেই। চলে গেছে। তাকে ছেড়ে চলে গেছে। প্রশান্তিটা খুব দ্রুত চলে এলো। গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে নিজের ভাবনাগুলোকে মুক্ত ক’রে দিলো সে।
একটা শব্দ। কোনো গাড়ির শব্দ। সে আমলে নিলো না। এটা তার স্বাধীনতাভাবে ভাবনার জগতে ডুবে থাকাতে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। এরপরই টের পেলো একটা হাত তার শরীর স্পর্শ করছে। আরেকটা। আস্তে ক’রে তাকে তুলে ওঠালো। “আসো,” কণ্ঠটা বললো। “আমাকে সাহায্য করো।”
“আমাকে ছেড়ে দাও!” বেশ জোরেই বললো সে। কিন্তু তার কথাটা আমলে নেয়া হলো না বলে একটু ভড়কে গেলো।
আবারো চোখে মুখে বাতাসের ঝাপটা লাগলো, তবে এই বাতাসটা জুরিখের বাতাস নয়। অন্য কোনো জায়গার। একটা সিগনাল এলো, একটা বাতি জ্বলে উঠলে উঠে দাঁড়ালো সে।
“ঠিক আছে। তুমি ঠিকই আছো,” যে কণ্ঠতা তার কথা শোনে নি সে-ই বললো। “তোমার পা তোলো। তোলো!… হ্যা, ঠিক আছে। এবার গাড়ির ভেতরে ঢোকো। আস্তে আস্তে। ঠিক আছে।”
সে পড়ে যাচ্ছে। ঘন কালো আকাশ থেকে! তারপরই পতনটা থেমে গেলো, সব কিছুই থেমে গিয়ে স্থির হয়ে পড়লো যেনো। নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দটা শুনতে পাচ্ছে সে। পায়ের শব্দও। সে পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে…আর দরজা বন্ধ করার শব্দ। তারপরই চারপাশ থেকে কিছু হৈহল্লা।
নিজের ভারসাম্য হারিয়ে আবারো পড়তে লাগলো কিন্তু একটা হাত তাকে ধরে ফেললো। নিচে নামিয়ে রাখলো তাকে। তার মুখে ঠাণ্ডা কিছু অনুভূত হলো এবার। তারপর আর কিছুই টের পেলো না। আবারো তলিয়ে যেতে লাগলো সে। একেবারে নিকষ কালো অন্ধকারে।
.
একটু দূরে, তবে খুব বেশি দূরে নয়, একটা কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। দৃষ্টি শক্তি আস্তে আস্তে ফিরে এলে দেখতে পেলো একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। বড়সড় একটা ঘরের বিছানায় শুয়ে আছে সে। গায়ে একটা চাদর। ঘরে দু’জন মানুষ, একজন ওভারকোট পরা, তার পাশে এক মহিলা…পরে আছে গাঢ় লাল রঙের স্কার্ট আর সাদা ব্লাউজ। তার চুলের রঙের লাল।
মেরি সেন জ্যাক? হ্যা, সে-ই তো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চামড়ার ব্যাগ হাতে এক লোকের সাথে ফরাসিতে কথা বলছে।
“মূলত বিশ্রাম নিতে হবে,” লোকটা বললো।
“আমি যদি নাও থাকি, যে কেউ সেলাইগুলো খুলে দিতে পারবে। এক সপ্তাহ পরে খুলতে হবে।”
“ধন্যবাদ, ডাক্তার।”
“আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনি বেশ উদারতা দেখিয়েছেন। আমি এখন যাবো। হয়তো আপনার সাথে দেখা হবে, হয়তো হবে না।” ডাক্তার এ কথা বলে চলে যেতেই মেয়েটা দরজার ছিটকিরি লাগিয়ে ঘুরে দেখতে পেলো বর্ন তার দিকে তাকিয়ে আছে। আস্তে আস্তে সতর্কভাবে বিছানার কাছে চলে এলো সে।
“আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছো?” মেয়েটা জানতে চাইলো।
মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।
“তোমার অনেক জায়গায় চোট লেগেছে,” সে বললো, “খুবই বাজেভাবে। তবে তুমি শান্ত থাকলে হাসপাতালে আর যাবার দরকার হবে না। উনি ডাক্তার ছিলেন…তোমার টাকা থেকে আমি তাকে টাকা দিয়েছি। একটু বেশিই দিয়েছি কারণ সে মুখ বন্ধ রাখবে। এটা অবশ্য তোমারই আইডিয়া, গাড়ি চালানোর সময় তুমি বলছিলে তোমাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, কিন্তু টাকা দিয়ে তার মুখ বন্ধ রাখতে হবে। তোমার কথাই ঠিক। কাজটা তেমন কঠিন কিছু না।”
“আমরা কোথায়?” সে জানতে চাইলো।
“জুরিখ থেকে বিশ মাইল দূরে লেজবুর্গ নামের একটা গ্রামে। ডাক্তার লোকটি পাশের শহর ওলেনের। সে তোমাকে আবার এক সপ্তাহ পরে দেখতে আসবে। অবশ্য তুমি যদি এখানে থাকো তো।”
“কিভাবে?” সে উঠে বসার চেষ্টা করলেও শক্তির অভাবে কুলোতে পারলো না। মেয়েটা তার কাঁধ ধরলো, যার অর্থ শুয়ে পড়ো।
“আমি বলবো কি হয়েছে, আর তাতে হয়তো তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে খাবে তুমি। তেমনটিই আমি আশা করি, কারণ তা যদি না হয় তবে আমি কোনো জবাব দেবো না।” সে তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো, তার কণ্ঠে নিয়ন্ত্রনের ছাপ স্পষ্ট। “একটা পশু আমাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করছিলো—এরপরই সে আমাকে খুন করতো। আমার বাঁচার কোনো আশাই ছিলো না। স্টেপডেকস্ট্রাসে তুমি তাদেরকে থামাতে চেষ্টা করেছিলে, আর যখন পারছিলে না, আমাকে চিৎকার করতে বললে। তুমি তখনও আমাকে বাঁচানোর জন্যে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েছিলে। পরে, কিভাবে জানি তুমি তাদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে গেলে—আমি জানি না। তবে আমি জানতাম তুমি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছো। তুমি আমাকে খোঁজার জন্যে ফিরে এলে।”
“তোমাকে না, তাকে খোঁজার জন্যে,” জেসন কথার মাঝখানে বললো। “আমি তাকে খুঁজছিলাম।”
“তুমি আমাকে একথা আগেও বলেছো, আমি তোমাকে তার জবাব দিয়েছি। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না। এজন্যে নয় যে, তুমি একজন যাচ্ছেতাই ধরণের মিথ্যুক। বরং তোমার এ কথাটা বাস্তবের সাথে খাপ খায় না। আমি পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করি। মি: ওয়াশবার্ন অথবা মি: বর্ন, কিংবা তোমার নাম যাই হোক না কেন। আমি তথ্য আর যুক্তিতে বিশ্বাস করি। সেগুলো দিয়ে বিচার করি। দু’জন লোক তোমাকে খোঁজার জন্যে বিল্ডিংয়ে গিয়েছিলো, আমি শুনেছি তারা বেঁচে আছে। তারা তোমাকে চিনতে পারবে। আরো আছে ড্রেই এলপেনহসারের মালিক। সেও পারবে। তুমিও আমার মতো জানো, এটা সত্যি। না, তুমি আমাকে বাঁচানোর জন্যেই ফিরে এসেছিলে।”
“বলে যাও,” সে বললো, তার কণ্ঠে শক্তি ফিরে আসছে। “কি হলো?”
“আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। খুব কঠিন সিদ্ধান্ত। ঠিক করেছি তোমাকে সাহায্য করবো। কিছু সময়ের জন্যে—কয়েক ঘণ্টার জন্যে হয়তো—তবে আমি তোমাকে বের হতে সাহায্য-করবো।”
“তুমি পুলিশের কাছে গেলে না কেন?”
“তাই তো করতে যাচ্ছিলাম, তবে আমি বুঝতে পারছি না, কেন যাই নি সেটা তোমাকে বলবো কিনা। হয়তো ধর্ষণের কারণে, তবে আমি জানি না। আমি তোমাকে সত্য কথা বলছি। সব সময়ই জেনেছি, ধর্ষণ হলো একজন নারীর জন্যে সবচাইতে ভয়ংকর একটি অভিজ্ঞতা। সেটা এখন আমি বিশ্বাস করি। তুমি যখন ঐ লোকটার দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড রাগে ফেঁটে পড়লে…আমি তোমার চেহারাটা দেখেছি। যতোদিন বেঁচে থাকবো সেটা আমি কোনো দিনও ভুলবো না।”
“পুলিশ?” সে আবারো বললো।
“ড্রেই এলপেনহসা’র সেই লোকটা বলেছিলো পুলিশ তোমাকে খুঁজছে।” সে একটু থামলো। “তোমাকে আমি পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারি না। তখনও পারি নি। এখনও পারবো না।”
“আমি কে এটা জেনেও?” জানতে চাইলো সে।
“আমি কেবল জানি আমি কি শুনেছি, কি দেখেছি। একজন আহত লোক নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাকে বাঁচাতে ফিরে এসেছিলো, এটাই আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
“এটা তো বুদ্ধিমানের কথা হলো না।”
“আমি বুদ্ধিমানই, মি: বর্ন। আমার ধারণা তারা এ নামেই তোমাকে ডেকেছে। আমি খুবই বুদ্ধিমতি।”
“আমি তোমাকে মেরেছি। তোমাকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছি।”
“তোমার জায়গায় আমি হলে, মানে লোকজন আমাকে খুন করার জন্যে হন্যে হয়ে পিছু নিলে—আমিও একই কাজ করতাম।”
“তাই তুমি জুরিখের বাইরে আমাকে নিয়ে এলে?”
“হুট ক’রে নয়। আগে নিজেকে আমার শান্ত করতে হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। আমি খুব হিসেব ক’রে চলি।”
“আমিও সেটা দেখতে পাচ্ছি।”
“আমি খুব বিধ্বস্ত আর বিপর্যস্ত ছিলাম। আমার জামাকাপড়ের দরকার ছিলো, চিরুণী আর মেকআপও। আমি কোথাও যেতে পারছিলাম না। নদীর তীরে একটা টেলিফোন বুথ খুঁজে পেলাম। আশেপাশে কেউ ছিলো না। তাই আমি হোটেলে আমার এক কলিগকে ফোন করলাম “
“ঐ ফরাসি আর বেলজিয়ানটাকে?” জেসন জানতে চাইলো।
“না, তারা বার্তেনেলির লেকচার শুনছিলো। আর তারা যদি আমাকে তোমার সাথে মঞ্চের উপর দেখে চিনে থাকে তো আমার নামটা তারা পুলিশে দিয়ে দিয়েছে। আমি আমাদের দলের এক মহিলাকে ফোন করেছি। সে বার্তেনেলিকে ঘৃণা করে। নিজের ঘরেই ছিলো সে। আমরা এক সঙ্গে অনেক বছর ধরে কাজ করছি। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমি তাকে বললাম সে যদি আমার সম্পর্কে কোনো কিছু শুনে থাকে তবে সেটা যেনো আমলে না নেয়, আমি একদম ঠিক আছি। কেউ যদি আমার খোঁজ করে তবে যেনো বলে দেয়, আমি আমার এক বন্ধুর সাথে আছি—সারা রাত তার সাথেই থাকবো। আমি বার্তেনেলির লেকচার থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেছি।”
“খুবই হিসেবি,” বর্ন বললো।
“হ্যা,” মেরি একটা বাঁকা হাসি হাসলো। “আমি তাকে আমার ঘরে যেতে এললাম—তার পাশেই আমার ঘরটা আর হোটেলের লোকজনও জানে সে আমার গান্ধবী। আমার জামাকাপড়, মেকআপ একটা সুটকেসে নিয়ে তার ঘরে রাখতে এললাম, তারপর পাঁচ মিনিট পর ফোন করবো ব’লে তাকে জানালাম।”
“তুমি যা বললে সে সব মেনে নিলো?”
“বললাম না সে আমার বান্ধবী। হয়তো জানতে চাচ্ছিলো, তবে আমি ঠিক আছি ভেবে আর জানতে চায় নি। তার বিশ্বাস, আমি সত্যি কথা বলছি।”
“বলে যাও।”
“আমি তাকে ফোন করলে ওগুলো নিয়ে আসা হলো।”
“তার মানে বাকি দু’জন ডেলিগেট তোমার নাম পুলিশকে জানায় নি। তোমার ঘরটার দিকে তো তাদের নজর রাখার কথা।”
“আমি জানি না, সেটা তারা করেছে কিনা। তবে সেরকম কিছু করলে আমার বান্ধবীকে তারা ঘরে ঢোকার আগেই জিজ্ঞাসাবাদ করতো।”
“সে আছে ক্যারিলিওনে, আর তুমি নদীর তীরে। তাহলে তুমি তোমার জিনিসগুলো কিভাবে পেলে?”
“খুব সহজ। একটু কৌশল করেছি। সে রাত্রিকালীন একজন ওয়েটারকে বলেছে আমি হোটেলের একজন লোককে এড়িয়ে চলতে চাচ্ছি। বাইরে কোথাও আছি। আমার রাতের জামাকাপড়গুলো খুব দরকার। সে ওগুলো আমার কাছে পৌঁছে দিতে পারবে কিনা। তারপরই একটা গাড়িতে ক’রে হোটেলের একজন ওয়েটার সুটকেসটা নদীর পাড়ে নিয়ে এলো।”
“সে কি তোমাকে দেখে অবাক হয় নি?”
“সে খুব বেশি কিছু দেখার সুযোগ পায় নি। আমি গাড়ির পেছনের ডালাটা খুলে গাড়ির ভেতর থেকেই বলেছি সুটকেসটা ওখানে রেখে যেতে। স্পেয়ার চাকাটার পাশে আমি একশ’ ফরাসি ফ্রাঁ রেখে দিয়েছিলাম।”
“তুমি কেবল হিসেবিই নও, একেবারে অসাধারণ একজন।”
“হিসেবীরা অসাধারণই হয়।”
“ডাক্তার কিভাবে খুঁজে পেলে?”
“এখানেই। মনে আছে, আমি তোমাকে বেশ ভালোভাবে কাপড় দিয়ে বেঁধে দিয়েছিলাম রক্তপাত বন্ধ করার জন্যে। তোমার জামাকাপড় বদলানোর সময় টাকাগুলো পেলাম। তখন আমার মনে পড়লো তুমি বলছিলে ডাক্তার দেখাবে, টাকা দিয়ে তার মুখ বন্ধ রাখবে। তোমার কাছে হাজার হাজার ডলার আছে।”
“এটা তো ভগ্নাংশ মাত্র।”
“কি?”
“না, কিছু না।” সে ওঠার চেষ্টা করলো আবার। কিন্তু খুবই কষ্ট হলো। “তুমি কি আমাকে ভয় পাও না? তুমি যা করেছো তার জন্যে ভয় পাও না?”
“অবশ্যই, তবে আমি এও জানি তুমি আমার জন্যে কি করেছো।”
“যা ঘটেছে সেসব বিচার করলে তুমি খুবই বিশ্বস্ত একজন।”
“তাহলে তুমি পরিস্থিতি সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত নও। তুমি এখনও খুব দুর্বল। আর অস্ত্রটা আমার কাছে আছে। তাছাড়া তোমার কাছে কোনো কাপড় চোপড়ও নেই।”
“কিছুই নেই?”
“এক জোড়া মোজাও নেই। আমি সব ফেলে দিয়েছি। একটা প্লাস্টিকের মানিব্যাগ নিয়ে নগ্ন হয়ে রাস্তায় বের হলে তোমাকে খুবই বোকা বোকা দেখাবে।”
বর্ন তীব্র যন্ত্রণায়ও হেসে ফেললো। লা সিওতাত আর মারকুইস দ্য শ্যামফোর্দের কথা মনে পড়ে গেলো তার।
“খুবই হিসেবী,” সে বললো।
“খুউব।”
“তারপর কি হলো?”
“আমি ডাক্তারের নাম লিখে হোটেলের বয়কে দিয়ে এক সপ্তাহের জন্যে ঘরটা ভাড়া নিলাম। হোটেল বয় দুপুরে তোমার জন্যে খাবার নিয়ে আসবে। আমি এখানে সকাল পর্যন্ত থাকবো। এখন প্রায় ছ’টা বাজে। একটু পরেই ভোর হয়ে যাবে। তখন আমি হোটেলে ফিরে যাবো আমার বাকি জিনিসগুলো নিয়ে আসার জন্যে, বিমানের টিকেট সগ্রহ করার জন্যে। আর তোমার কোনো কথা না বলার আপ্রাণ চেষ্টা করবো আমি।”
“ধরো তুমি তা করতে পারলে না? ধরো তোমাকে চিনে ফেললো কেউ?”
“আমি সেটা অস্বীকার করবো। রাতের বেলা ছিলো। পুরো হোটেলে আতঙ্ক আর হৈচৈ হচ্ছিলো।”
“এখন আর তোমাকে হিসেবী ব’লে মনে হচ্ছে না। অন্তত জুরিখ পুলিশের মতো নয়। আমার কাছে আরো ভালো উপায় আছে। তোমার বন্ধুকে ফোন ক’রে বলো তোমার সব জিনিসপত্র গোছগাছ ক’রে সুটকেসে ভরে তোমার বিল-টিল সব চুকিয়ে দিতে। আমার কাছ থেকে যতো বেশি সম্ভব টাকা নিয়ে কানাডার প্রথম প্লেনটা ধরো।”
মেয়েটা তার দিকে চেয়ে মাথা নাড়লো। “খুবই প্রবলুব্ধকর।”
“এটা আসলে খুবই যুক্তিযুক্ত।”
কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মেয়েটা জানালার কাছে চলে গেলো। ভোরের প্রথম আলোর দিকে তাকালো সে। জেসন তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো সে কিছুই করতে পারবে না। মেয়েটা যা অনুভব করবে তাই করবে, কারণ ভীতি থেকে সে এখন মুক্ত। এমন একটা ভীতিকর ব্যাপার থেকে যা কোনো পুরুষ কখনই বুঝবে না। মৃত্যু থেকে। আর সে যা করেছে, তাতে সে সমস্ত নিয়ম-কানুন ভেঙেছে। মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে নিচু কণ্ঠে কথা বললো, তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে এখন।
“তুমি কে?”
“তুমি তো শুনেছো তারা কি বলেছে।”
“আমি শুধু জানি আমি কি দেখছি! কি অনুভব করছি!”
“তুমি যা করেছো সেটার বৈধতা দেবার চেষ্টা করো না। তুমি করেছো। এই যা।”
ওহ্ ঈশ্বর, তুমি আমাকে মুক্তি দিতে পারতে। তাহলে আমি একটু শান্তি পেতাম। কিন্তু এখন তুমি আমার জীবনের একটি অংশ ফিরিয়ে দিয়েছো, আমাকে আবারো লড়াই করতে হচ্ছে। সেটাকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
আচমকা মেয়েটি তার বিছানার কাছে এসে দাঁড়ালো, তার হাতে অস্ত্র। সেটা তার দিকে তাক্ করা, তার কণ্ঠ কাঁপছে। “তাহলে কি আমি আমার ভুলগুলোকে শুধরে নেবো? আমি কি তবে পুলিশ ডেকে তোমাকে তুলে দেবো তাদের হাতে?”
“কয়েক ঘণ্টা আগে হলে আমি বলতাম তাই করো। এখন সেটা বলতে পারছি না।”
“তাহলে তুমি কে?”
“তারা বলেছে আমার নাম জেসন বর্ন। জেসন চার্লস্ বর্ন।”
‘তারা বলছে’ মানে কি?”
সে অস্ত্রটার দিকে তাকালো। সত্যি ছাড়া আর কিছুই বলার নেই—যেহেতু সে সত্যিটা জানে। “মানে?” সে প্রতিধ্বনি করলো। “আমি যতোটুকু জানি, তুমিও ততোটুকু জানো, ডক্টর।
“কি?”
“তুমি হয়তো আরো কিছু শুনবে। হয়তো তাতে তোমার ভালোই লাগবে। অথবা খারাপ। আমি জানি না। আমি জানি না তোমাকে আর কি বলবো আমি।”
অস্ত্রটা নামিয়ে রাখলো মেরি। “আমাকে বলো।”
“আমার জীবনটা শুরু হয়েছে আজ থেকে পাঁচ মাস আগে ভূমধ্যসাগরীয় ছোট্ট একটা দ্বীপ পোর্ত নোয়ে’তে…”
.
সূর্যের আলো উঁকি মারছে। জেসন বালিশে হেলান দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সব কথা বিস্তারিত জানিয়েছে মেয়েটাকে। আর কিছুই বলার নেই। মেরি একটা হাতাওয়ালা চেয়ারে ব’সে চুপচাপ শুনে গেছে। তার বাম পাশে একটা টেবিলে সিগারেট আর অস্ত্রটা রাখা। স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে সে। এমনকি সিগারেট টানার সময়ও তার চোখ খুব একটা নড়লো না। সে একজন টেকনিক্যাল এ্যানালিস্ট। সমস্ত তথ্য মূল্যায়ন করছে। সত্যটা বের করছে ছেঁকে ছেঁকে, যেমন গাছ সূর্যের আলোকে ছেঁকে নেয়।
“তুমি খালি বলো, ‘আমি জানি না,’ ‘হায়, আমি যদি জানতাম।’ তোমার চোখে চোখ রেখে মাঝে মাঝে আমি ভয় পেয়ে যেতাম। জিজ্ঞেস করতাম তুমি কি করবে। তুমি বলতে, ‘আমি যদি সেটা জানতাম।’ হায় ঈশ্বর, তুমি কতো ভয়ঙ্কর অবস্থার ভেতর দিয়ে এ পর্যন্ত এসেছো…”
“তোমার সাথে আমি যা করেছি তারপরেও তুমি এরকমটি ভাবতে পারছো?”
“এ দুটো সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার,” সে একটু ভেবে বললো।
“আলাদা—”
“তুমি যখন আমাকে চারনাকের ঘরে নিয়ে গেলে তখন আমি তোমাকে বলেছিলাম তোমার সাথে আমি যেতে চাই না। আমি নিশ্চিত ছিলাম, আমি যদি আরো বেশি কিছু জেনে যাই, তুমি আমাকে খুন করবে। তখনই তুমি সবচাইতে বিস্ময়কর আর অদ্ভুত কথাটা বলেছিলে। তুমি বলেছিলে, তুমি যা শুনেছো, সেটা আমার চেয়েও কম ঢুকছে তোমার মাথায়। এসবের মাথামুণ্ডু তুমি আমার চাইতেও কম বুঝতে পারছো। আমি ভেবেছিলাম তুমি উন্মাদ হয়ে গেছো।”
“আমি তো একরকম উন্মাদই। একজন উন্মাদ স্মরণ করতে পারে, আমি তাও পারি না।”
“তুমি কেন আমাকে বলো নি, চারনাক তোমাকে খুন করার চেষ্টা করেছিলো?”
“সময় ছিলো না, আর আমারও মনে হয় নি তাতে কিছু আসে যায়।”
“তখন তোমার কাছে সেটা মনে হয় নি—আমার মনে হয়েছে।”
“কেন?”
“কারণ আমার ধারণা, যে তোমাকে প্রথমে খুন করার চেষ্টা করবে না তাকে তুমি গুলি করবে না।”
“চারনাক তাই করেছিলো, আমাকে আহত করেছিলো সে।”
“আমি কিন্তু সেটা জানতাম না। তুমি আমাকে বলো নি।”
“বুঝতে পারছি না।”
মেরি একটা সিগারেট ধরালো। “এটা ব্যাখ্যা করা কঠিন। তবে আমাকে জিম্মি ক’রে রাখার সময়, আঘাত করার সময়, কিংবা অস্ত্র ঠেকিয়ে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাবার সময়—ঈশ্বর জানে, আমি খুব ভড়কে গিয়েছিলাম। ভয়ে মরে যাচ্ছিলাম। তবে আমি তোমার চোখে অন্য কিছু দেখেছিলাম। এটাকে তুমি এক ধরণের অনীহা বলতে পারো।”
“তোমার বক্তব্যটা কি?”
“আমি নিশ্চিত নই। হয়তো এটা ড্রেই এলপেনহসারে বলা কথাতেই ফিরে যেতে হবে। মোটা লোকটা তোমার কাছে এলে তুমি আমাকে দেয়ালের দিকে মুখ ক’রে থাকতে বলেছিলে। হাত দিয়ে ঢেকে রাখতে বলেছিলে আমার মুখ। ‘তোমার নিজের ভালোর জন্যেই,’ তুমি বলেছিলে। ‘তোমাকে তার চেনার কোনো দরকার নেই।’”
“আসলেই তাই।”
‘তোমার নিজের ভালোর জন্যেই,’ এটা তো কোনো পেশাদার খুনির আচরণ হতে পারে না।”
“এখনও তোমার বক্তব্যটা বুঝতে পারলাম না।”
“গোল্ডরিম চশমা পরা লোকটা আমাকে বুঝিয়েছিলো যে, তুমি হলে মারাত্মক একজন খুনি। তোমার হাতে আরো অনেক খুন হবার আগেই তোমাকে থামাতে হবে। চারনাকের ব্যাপারটা জানলে আমি তার কথাটা বিশ্বাস করতাম না। তাছাড়া, পুলিশের লোক ওরকম আচরণ করে না, তারা অন্ধকার আর জনাকীর্ণ জায়গায় অস্ত্র ব্যবহার করে না। তুমি তোমার জীবন নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছো—তুমি খুনি নও।”
বর্ন তার হাতটা তুলে ধরলো। “আমাকে ক্ষমা করবে, আমার কাছে এটা ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি ক’রে বিচার করা হচ্ছে ব’লেই মনে হচ্ছে। তুমি বলেছো, তুমি তথ্যকে সম্মান করো—তাহলে সেটাই করো। আবারো বলছি : তারা কি বলেছে সেটা তুমি শুনেছো—তুমি কি দেখেছো, ভাবছো, সেটা বাদ দাও—তুমি কিছু কথা শুনেছো। টাকা ভর্তি খাম আমাকে দেয়া হয়েছে একটা কাজ করার জন্যে। সেই কাজটা আমি গ্রহণ করেছিলাম। গেইমেনশেফট ব্যাংকে আমার একটা একাউন্ট আছে, তাতে আছে পাঁচ মিলিয়ন ডলার। কোত্থেকে আমি সেগুলো পেলাম? আমার মতো একজন লোক—যার কিছু বিষয়ে দক্ষতা আছে—সে কিভাবে টাকাগুলো পেলো?” জেসন ছাদের দিকে চেয়ে রইলো। যন্ত্রণাটা আবার ফিরে এসেছে। “এগুলো সত্য। ডক্টর মেরি সেন জ্যাক। তোমার চলে যাওয়ার সময় হয়েছে।”
মেরি চেয়ার ছেড়ে উঠে সিগারেটটা মাটিতে পিষে ফেললো। অস্ত্রটা হাতে নিয়ে বিছানার কাছে চলে এলো সে। “নিজেকে নিন্দা করতে তুমি খুবই বিচলিত, তাই না?”
“আমি তথ্যকে সম্মান করি।”
“তাহলে তুমি যা বললে তা যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে আমারও কিছু বাধ্য বাধকতা রয়েছে। রয়েছে না? একজন আইনকানুন মানা সামাজিক মানুষ হিসেবে আমার উচিত জুরিখ পুলিশকে জানিয়ে দেয়া, তুমি কোথায় আছো।” অস্ত্রটা তার দিকে তাক্ করলো মেরি।
বর্ন তার দিকে তাকালো। “আমি ভেবেছিলাম—”
“কেন নয়?” সে একটু জোরে বললো। “তুমি একজন অপরাধী, যেকিনা এই ব্যাপারটা শেষ করতে চাচ্ছে, তাই না? তো, আমার মনে হয় তোমার কিছু বোঝা উচিত। আমি বোকা নই। আমি যদি মনে করতাম তারা যা বলেছে তুমি তা-ই, তাহলে আমি এখানে থাকতাম না, তুমিও থাকতে না। তোমার কোনো তথ্য নেই। তোমার কেবল আছে উপসংহার। তোমার নিজের ধারণা ঐসব লোকের বক্তব্যের উপর ভিত্তি ক’রে তৈরি হয়েছে, যারা একেবারেই যাচ্ছেতাই ধরণের।”
“ব্যাংকের একাউন্টে পাঁচ মিলিয়ন ডলার আছে। সেটার কথা ভুলে যেয়ো না।”
“কিভাবে ভুলবো? আমি তো অর্থনীতিরই মানুষ। সেই একাউন্টটার ব্যাপারে তুমি যা ভাবছো, হয়তো আসল ঘটনা তা নয়। ব্যাংকে নিশ্চয় কিছু বৈধ কাগজপত্র ছাড়া একাউন্ট খোলা যায় না। সেটা তো অনুসন্ধান করা যেতে পারে— হয়তো অনুপ্রবেশও করা হতে পারে—কোনো কর্পোরেশনের কোনো সার্টিফাইড ডাইরেক্টর, হয়তো তার নাম সেভেনটি ওয়ান। এটা তো কোনো ভাড়াটে খুনির বেলায় প্রযোজ্য নয়।”
“কর্পোরেশনটা হতে পারে নামমাত্র। সেটা তালিবদ্ধ নয়।”
“টেলিফোন বুকে? তুমি খুবই আনাড়ী। তোমার ব্যাপারে ফিরে আসি এবার। আমি কি পুলিশকে ডাকবো?”
“তুমি আমার জবাবটা জানো। আমি তোমাকে থামাতে পারবো না, তবে আমি চাই না, তুমি তা করো।”
মেরি অস্ত্রটা নামিয়ে ফেললো। “আমি সেটা করবোও না। তারা যা বলেছে সেটা আমি বিশ্বাস করি না।”
“তাহলে তুমি কি বিশ্বাস করো?”
“বলেছি তো, আমি নিশ্চিত নই। আমি কেবল জানি এখন থেকে সাত ঘণ্টা আগে এক পশুর খপ্পরে ছিলাম, তার মুখ আমার পুরো শরীর চষে বেড়িয়েছে। তার হাতের থাবা ছিলো আমার উপর…আমি জানতাম আমি মরে যাচ্ছি। তারপর এক লোক আমার কাছে ফিরে এলো—লোকটা পালিয়ে যেতে পারতো—কিন্তু নিজের জীবন বাজি রেখে ফিরে এলো সে। আমার ধারণা আমি তাকে বিশ্বাস করি।”
“ধরো, তোমার ধারণা ভুল?”
“তাহলে আমি মারাত্মক একটি ভুল ক’রে ফেলেছি।”
“ধন্যবাদ। টাকাগুলো কোথায়?”
“ব্যুরোতে। তোমার পাসপোর্ট কেস আর মানিব্যাগে আছে। তার সাথে ডাক্তারের নাম আর এই ঘর ভাড়ার রসিদটাও রয়েছে।”
“আমি কি আমার পাসপোর্টটা পেতে পারি? ওটাতে সুইস টাকাগুলো আছে।”
“জানি।” মেরি সেগুলো তাকে দিলো। “আমি ঘরটার জন্যে তিনশ’ আর ডাক্তারকে ডেকে আনার জন্যে দুশ’ ফ্রাঁ দিয়েছি। ডাক্তারের বিল হয়েছিলো সাড়ে চারশ’, তার সঙ্গে মুখ বন্ধ রাখার জন্যে আরো দেড়শ’ দিয়েছি। সব মিলিয়ে এগারোশ’ ফ্রাঁ।”
“তোমাকে টাকার হিসেব দিতে হবে না,” বললো সে।
“তোমার জানা দরকার আছে। আচ্ছা, তুমি এখন কি করবে?”
“তোমাকে টাকা দেবো, যাতে তুমি কানাডায় ফিরে যেতে পারো।”
“সেটা পরে হবে।”
“পরে আমার মত বদলেও যেতে পারে। যে ছেলেটাকে দিয়ে ডাক্তার ডেকে এনেছো তাকে কিছু টাকা দিয়ে আমার জন্যে কিছু জামাকাপড় কিনে আনতে বলো।” কতোগুলো টাকা মেয়েটার দিকে বাড়িয়ে দিলো জেসন।
“এ তো পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁ’রও বেশি।”
“আমি তোমাকে বিশাল ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি।”
মেরি সেন জ্যাক টাকাগুলোর দিকে তাকালো। তারপর বাম হাতের অস্ত্রটার দিকে। “আমি তোমার টাকা চাই না,” অস্ত্রটা টেবিলের উপর রেখে সে বললো।
“কি বলতে চাচ্ছো?”
সে ঘুরে হাতাওয়ালা চেয়ারে ফিরে গেলো। চেয়ারে বসতে বসতে তার দিকে তাকালো আবার। “আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই।”
“একটু দাঁড়াও—”
“প্লিজ,” মেয়েটা বাঁধা দিয়ে বললো। “আমাকে কোনো প্রশ্ন কোরো না। অন্তত এখন কিছু বোলো না।”