অধ্যায় ৮
খ্যাচ্ ক’রে একটা শব্দ হলো ঘরের বাইরে। কোনো কিছু ভাঙার শব্দ, খুব দূর থেকে। আবার থেমেও গেলো সেটা। চোখ খুলে তাকালো বর্ন।
সিঁড়িটা। ঘরের বাইরে সিঁড়িটা আছে। কেউ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে থেমে গেছে। শরীরের ওজনের কারণে ভাঙা কাঠে শব্দ হয়েছে বলেই সচেতন হয়ে উঠেছে সে। কিন্তু সাধারণ কোনো বোর্ডার হলে এরকমটি করতো না।
সব চুপচাপ।
আবারো খ্যাচ্ খ্যাচ্ ক’রে শব্দটা হলো। এবার খুব কাছ থেকে। জেসন বিছানা থেকে নিমেষে নেমে মাথার কাছে রাখা অস্ত্রটা হাতে নিয়ে দরজার কাছে দেয়ালে সঙ্গে সেঁটে রইলো। পায়ের শব্দটা শুনতে পাচ্ছে এখন—একজন মানুষের সে আর শব্দটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। কেবল গন্তব্যে পৌঁছাতে চাচ্ছে। বর্নের কোনো সন্দেহ নেই কী সেটা; তার ধারণাই ঠিক।
দরজাটা দুম ক’রে খুলে গেলে বর্ন সেটা সজোরে ধাক্কা মেরে আবার বন্ধ ক’রে দিলো। তারপর নিজের সমস্ত ওজন দরজায় প্রয়োগ ক’রে আঁটকে রাখলো অনুপ্রবেশকারীকে। লোকটার শরীরের অর্ধেক অংশ দরজার মাঝখানে। সে চাচ্ছে দরজাটা আরেকটু ফাঁক ক’রে ভেতরে ঢুকে পড়তে। বর্ন এবার আচমকা দরজা খুলে সঙ্গে সঙ্গে লোকটার গলা বরাবর ডান পায়ে লাথি মারলো। বাম হাত দিয়ে লোকটার সোনালী চুল ধরে হ্যাচকা টান মেরে লোকটাকে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে ফেললো সে। লোকটার হাতের অস্ত্র মেঝেতে পড়ে গেলে বর্ন দেখতে পেলো সেটার নলে সাইলেন্সার লাগানো।
জেসন দরজা বন্ধ ক’রে সিঁড়ি থেকে আরো শব্দ আসছে কিনা শুনলো। আর কেউ নেই। অজ্ঞান হওয়া পড়ে থাকা লোকটার দিকে তাকালো সে। চোর? খুনি? কে সে?
পুলিশ? বোর্ডিং হাউজের ম্যানেজার কি পুরস্কারের লোভে এ কাজ করেছে? বর্ন লোকটাকে উল্টিয়ে তার পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের ক’রে হাতে নিলো। ব্যাগের টাকাগুলো সরিয়ে ফেললো সে। জানে, এটা অর্থহীন। তার কাছে খুব বেশি টাকা নেইও। কয়েকটি ক্রেডিটকার্ড আর ড্রাইভিং লাইসেন্সের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সে, কিন্তু পরক্ষণেই তার হাসিটা উবে গেলো। হাসির কোনো ব্যাপার নেই। ক্রেডিটকার্ডের নামগুলো আলাদা আলাদা লোকের, ড্রাইভিং লাইসেন্সটাও অন্য নামে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা লোকটা কোনো পুলিশ অফিসার নয়।
একজন পেশাদার লোক, স্টেপডেকস্ট্রাসের আহত এক লোককে খুন করতে এসেছে। কেউ তাকে ভাড়া করেছে। কে? সে যে এখানে এ কথাটা কে জানে?
মেয়েটা? সে কি মেয়েটার কাছে এই জায়গার কথা বলেছিলো? না, মেয়েটার কাছে নয়। সে হয়তো কিছু বলেছিলো, তবে মেয়েটি সেকথা বোঝে নি। যদি বুঝতো তাহলে এখানে কোনো পেশাদার খুনি আসতো না। তার বদলে বরং বোর্ডিং হাউজটা পুলিশ ঘিরে ফেলতো চারদিক থেকে।
মোটা লোকটার কথা মনে পড়লো বর্নের। সে কি স্টেপডেকস্ট্রাস সম্পর্কে কিছু জানতো? ঐ লোকটা কি তার অভ্যাস আর ধরণ-ধারণ সম্পর্কে জানে? সে নিজেও কি এখানে ছিলো? এখানেই খামটা তার কাছে দিয়েছিলো?
জেসন কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। আমি কেন মনে করতে পারছি না? কখন এই কুয়াশা কাটবে? কখনও কি কাটবে?
নিজেকে কষ্ট দিও না…
জেসন চোখ খুলে সোনালী চুলের লোকটার দিকে তাকালো। ক্ষণিকের জন্যে প্রায় হেসেই ফেলছিলো সে। তার সামনে জুরিখ থেকে বের হবার ভিসাটা পড়ে আছে, আর সে কিনা তার বদলে উল্টাপাল্টা ভেবে সময় নষ্ট করছে। মানিব্যাগটা পকেটে রেখে অস্ত্রটা কোমরে গুজে নিলো। তারপর অচেতন লোকটাকে টেনে তুলে বিছানার উপর রাখলো সে।
কয়েক মিনিটের মধ্যে তাকে ঘরের মেঝেতে রাখা জীর্ণশীর্ণ একটা ম্যাট্রেস পেচিয়ে বিছানার চাদর ছিঁড়ে সেটা দিয়ে মুখ বেঁধে ফেললো। কয়েক ঘণ্টা এখানে সে থাকবে। আর এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জুরিখ ছেড়ে চলে যাবে জেসন।
নিজের পোশাকটা পরে নিলো। কোনো কিছুই নেয়ার মতো নেই, শুধু তার টপকোটটা ছাড়া। পা’টা এখনও ব্যথা করছে, অনেকটা অবশ হয়ে আছে যেনো, তবে সেটা তাকে হাটতে বা চলতে ফিরতে বাঁধা দিচ্ছে না। তাকে একজন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তার মাথাটা…সে তার মাথাটা নিয়ে ভাবতে চাচ্ছে না।
মৃদু আলোর হলওয়ে দিয়ে হেটে গেলো সে। শেষ দরজাটা বন্ধ ক’রে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো। উপর থেকে হাসির রোল শোনা যাচ্ছে। দেয়ালে সেঁটে অস্ত্রটা তুলে নিলো হাতে। হাসিটা এবার মিলিয়ে গেলো। মাতালের হাসি ছিলো সেটা—অর্থহীন।
সিঁড়ি দিয়ে সতর্ক পদক্ষেপে নামতে শুরু করলো সে। চারতলার ভবনের তৃতীয় তলায় আছে। ঘরটা নেবার সময় সবচাইতে উপর তলাটা চেয়েছিলো। কেন? এক রাতের জন্যে একটা নোংরা ঘর ভাড়া নেবার মানেটা কি? আশ্রয় নেয়া?
বন্ধ করো!
দ্বিতীয় তলার ল্যান্ডিংয়ে এসে পড়লো। প্রতিটি ধাপে পা রাখতেই ভাঙা কাঠের খ্যাচ্ খ্যাচ্ শব্দ হচ্ছে। ম্যানেজার যদি কৌতুহলবশত নিচের তলায় তার ঘরে এসে থাকে তবে সেটা হবে তার জন্যে উটকো একটা ঝামেলা।
আরেকটা শব্দ হলো। কোনো কিছুর আঁচরের। কোনো কাঠের উপর কাপড় টেনে নেয়ার শব্দ। সিঁড়ির শেষ মাথায় কেউ লুকিয়ে আছে। নিজের হাটার ছন্দপতন না ঘটিয়ে সে প্রস্তুত হয়ে গেলো অন্ধকারে। ডান দিকের দেয়ালে তিনটি দরজা আছে। উপর তলার প্রত্যেকটির জন্যে একটি করে। তাদের একটাতেই…
আরো কয়েক পা এগিয়ে গেলো সে। প্রথমটা নয়, সেটা খালি আছে। শেষটাও নয়, ওটা দিয়ে কোনো ঘরে যাওয়া যায় না। দ্বিতীয়টিই হবে। হ্যা, দ্বিতীয় দরজাটাই।
বর্ন ডান দিকে সরে এসে অস্ত্রটা বাম হাতে নিয়ে কোমর থেকে সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলটা হাতে তুলে নিলো। দরজা থেকে যখন দুই ফিট দূরে তখনই সে দেয়ালের দিক থেকে ঘুরে গেলো।
“ওয়াজ ইস্ট?…”. একটা হাত বের হয়ে এলো। সঙ্গে সঙ্গে গুলি করলো জেসন। “আহ্!” অবয়বটা হুমড়ি খেয়ে সামনের দিকে পড়ে গেলো। নিজের অস্ত্রটা তাক্ করতে সক্ষম হলো না সে। বর্ন আবারো গুলি চালালো। এবার লোকটার ঊরুতে। লোকটা মাটিয়ে গড়িয়ে কুঁকড়ে উঠলে জেসন সামনে এগিয়ে এসে হাটু মুড়ে বসলো। লোকটার বুকের উপর হাটু রেখে অস্ত্রটা মাথা বরাবর তাক্ করলো সে। নিচু কণ্ঠে কথা বললো বর্ন।
“নিচে কি আরো কেউ আছে?”
“নেইন!” তীব্র যন্ত্রণায় চোখমুখ কুকে বললো সে। “জুই…কেবল আমরা দু’জন। আমরা ভাড়াটে লোক।”
“কে ভাড়া করেছে?
“তুমি জানো সেটা।”
“কার্লোস নামের এক লোক?”
“আমি এ প্রশ্নের জবাব দেবো না। আমাকে খুন করলে করতে পারো।”
“আমি যে এখানে আছি সেটা তুমি কিভাবে জানতে পারলে?”
“চারনাক বলেছে।”
“সে তো মারা গেছে।”
“এখন। কিন্তু গতকালকে তো জীবিত ছিলো। জুরিখে খবর পাঠানো হয়েছে : তুমি বেঁচে আছো। আমরা সব জায়গায় সবার কাছেই গেছি…চারনাক জানতো।”
বর্ন একটু জুয়া খেললো। “তুমি মিথ্যে বলছো!” লোকটার মুখে অস্ত্র ঠেকালো। “আমি চারনাককে কখনও স্টেপডেকস্ট্রান্সের কথা বলি নি।”
লোকটা আবারো চোখ কুচ্কালো। “হয়তো সেটা তোমার করার দরকারও ছিলো না। ঐ নাৎসি শুয়োরটার সবখানেই ইনফরমার ছিলো। এই জায়গাটাই বা কেন বাদ যাবে? সে তোমার বর্ণনা দিতে পেরেছে। সে ছাড়া আর কে পারতো, বলো?”
“ড্রেই এলপেনহসারের এক লোক।”
“এরকম নাম আমরা কখনও শুনি নি।”
“আমরা কারা?”
লোকটা ঢোক গিললো। “ব্যবসায়ীরা…শুধু ব্যবসায়ীরা।”
“আর তোমাদের ব্যবসাটা হলো খুন করা।”
“তোমার সাথে কথা বলাটা অদ্ভুতই বটে। না। তোমাকে তুলে নেয়া হোতো, খুন করা হোতো না।”
“কোথায় নেয়া হোতো?”
“আমাদের গাড়ির ওয়্যারলেসে সেটা জানিয়ে দেয়া হোতো।”
“চমৎকার,” জেসন নির্বিকার কণ্ঠে বললো। “তুমি কেবল দ্বিতীয় সারিরই নও, একেবারে কামলা ধরণের। তোমার গাড়িটা কোথায়?”
“বাইরে।”
“চাবিটা দাও আমাকে।”
“না!”
“তোমাকে যেকোনো একটা বেছে নিতে হবে,” জেসন লোকটার মাথায় অস্ত্র তাক্ করতেই লোকটা জ্ঞান হারালো।
চাবিটা বর্ন খুঁজে পেলে অস্ত্রটা পকেটে রেখে দিলো। এই অস্ত্রটা আরো ছোটো। তবে এতে কোনো সাইলেন্সার লাগানো নেই। বোঝা যাচ্ছে তাকে হত্যা করতে নয়, তুলে নেবার জন্যেই ওরা এসেছিলো। উপরে যে লোকটি গিয়েছিলো সে আসলে সুরক্ষার জন্যে সাইলেন্সার ব্যবহার করেছে। বড়জোর তাকে আহত করতো। কিন্তু একটা তথ্য কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি করলো। দ্বিতীয় তলার লোকটা ছিলো ব্যাক-আপে।
তাহলে সে দ্বিতীয় তলায় ছিলো কেন? সে কেন তার সহকর্মীকে অনুসরণ করলো না? সিঁড়িতে তো থাকতে পারতো? একটু অদ্ভুত লাগছে। তবে এসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। বাইরে একটা গাড়ি আছে, আর সেটার চাবি এখন তার হাতে।
কোনো কিছুই ফেলে রাখা যাবে না। তৃতীয় অস্ত্রটা। সে উঠে দাঁড়িয়ে সেই রিভলবারটা খুঁজে পেলো যেটা ফরাসি লোকটার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলো। বাম পায়ের প্যান্টটা একটু তুলে ইলাস্টিকের মোজার মধ্যে আঁটকে রাখলো অস্ত্রটা।
একটু থেমে নিজের শ্বাস আর ভারসাম্যটা ঠিক ক’রে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো সে। টের পেলো কাঁধের ব্যথাটা আবার বাড়ছে। ক্রমশ অবশ হয়ে উঠছে সেটা। আশা করলো গাড়িটা যেনো কোনো মতে চালাতে পারে।
সিঁড়ির পাঁচ নাম্বার ধাপে এসে চমকে থেমে গেলো সে। শব্দ শোনার চেষ্টা করলো, কিন্তু না, এবার কিছুই শুনতে পেলো না। জেসন তাড়াতাড়ি সিঁড়ির দিয়ে নেমে গেলো। যেভাবেই হোক তাকে গাড়ি চালিয়ে জুরিখে যেতে হবে—কোথাও না কোথাও একজন ডাক্তার খুঁজে বের করতে হবে।
বড়সড় সিডান গাড়িটা খুব সহজেই খুঁজে বের করতে পারলো। গাড়িতে ব’সে একটু স্বস্তি বোধ করলো সে, কারণ গাড়িটার অটোমেটিক শিফট গিয়ার আছে। তার কোমরে থাকা বড় অস্ত্রটার কারণে বসতে অসুবিধা হচ্ছে তাই জিনিসটা পাশের সিটে রেখে দিলো। চাবি ঢুকিয়ে স্টার্ট দিলে গাড়ির ইনজিন চালু হলো না। আরেকটা চাবি দিয়ে চেষ্টা করলো, সেটাতেও কাজ হলো না। ট্রাংকের চাবি হয়তো ধারণা করলো। এবার তৃতীয় চাবিটা দিয়ে চেষ্টা করলো। কিন্তু সেই চাবিটা ঢুকলোই না। কোনো চাবিতেই কাজ হচ্ছে না! ধ্যাত্তারিকা!
তার বাম দিক থেকে শক্তিশালী একটা আলো এসে তার চোখ দুটোকে একেবারে ঝলসে দিলে অস্ত্রটা তুলে নিলো সে। কিন্তু ডান পাশে দ্বিতীয় আলোটা এসে পড়লে তার দরজাটা ধপাস ক’রে খুলে ভারি একটা ফ্লাশলাইট দিয়ে তার হাতে আঘাত করা হলো, আরেকটা হাত সিট থেকে ছিনিয়ে নিলো তার অস্ত্রটা।
“বের হও!” বামপাশ থেকে বলা হলো। তার ঘাড়ে একটা অস্ত্র ঠেকালো কেউ একজন।
সে বের হয়ে এলে চোখে হাজার হাজার আলোর বিন্দু দেখতে পেলো। আস্তে আস্তে চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে এলে প্রথমে তার নজরে পড়লো দুটো বৃত্ত। সোনালী রঙের। সারা রাত ধরে যে খুনি তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে তার চশমাটা। লোকটা কথা বললো। “পদার্থ বিজ্ঞান বলে প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি বিপরীত এবং সমান প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কোনো নির্দিষ্ট মানুষ নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে একই রকম আচরণ করে। তোমার মতো লোককে ধরতে কি করতে হবে সেটা আমরা জানি।”
“খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ এটা,” জেসন বললো। “বিশেষ ক’রে যারা এ কাজে নেমে পড়েছে।”
“তাদেরকে বেশ ভালো টাকা দেয়া হয়। আরো কিছু ব্যাপারও আছে— কোনো নিশ্চয়তা না থাকলেও সেটা আছে। রহস্যময় বর্ন নির্বিচারে হত্যা করে না। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সে হত্যা ক’রে হাত নষ্ট করে না। আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করি।”
“তোমরা হলে ঘোড়ার পাছা।” কেবল এ কথাটিই তার মাথায় এলো। “তবে তোমাদের দু’জন লোকই বেঁচে আছে। যদি জানতে চাও তো কথাটা বললাম।”
আরেক জনকে দেখা গেলো। বেটে লোকটা আরেকজনকে নিয়ে বের হয়ে এলো অন্ধকারাচ্ছন্ন এক কোণ থেকে। মেয়েটা। মেরি সেন জ্যাক।
“হ্যা, এই লোকটাই,” মেয়েটা আস্তে ক’রে বললো। তার চোখে মুখে দৃঢ়তা।
“হায় ঈশ্বর…” অবিশ্বাসে বর্ন মাথা ঝাঁকালো। “এটা তুমি কিভাবে করতে পারলে, ডক্টর?” গলা উঁচিয়ে জানতে চাইলো সে। “ক্যারিলিওন থেকে কি কেউ আমার ঘরটা লক্ষ্য রাখছিলো? তুমি খুবই চমৎকার কাজ করেছো। আর আমি ভাবছিলাম তুমি কোনো পুলিশের গাড়ির সাথে হয়তো ধাক্কা খেয়েছো।”
“এরাই পুলিশের লোক।”
জেসন তার সামনে থাকা খুনির দিকে তাকালো। লোকটা নিজের চশমা ঠিক করছে। “আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করি,” বললো সে।
“সামান্য প্রতিভা,” খুনি জবাব দিলো। “পরিস্থিতিটা যথার্থ ছিলো। তুমিই সেগুলো ক’রে দিয়েছো।”
“এখন কি হবে? ভেতরে লোকটা আমাকে বলেছে আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, খুন করা হবে না।”
“ভুলে গেছো। তাকে কি বলতে হবে সেটাই কেবল বলা হয়েছে।” সুইস লোকটি থামলো। “তাহলে তুমি দেখতে এরকম। আমরা অনেকেই বিগত দু’তিন বছর ধরে ভেবেছি এ নিয়ে। কতো অনুমানই না করা হয়েছে! সে লম্বা, না, সে মাঝারি আকৃতির। তার চুল সোনালী, না, কালো। নীল চোখ, না, একেবারে বাদামী। তার মুখটা খুব তীক্ষ্ণ, না একেবারেই সাধারণ। ভীড়ের মধ্যে চেনা যাবে না। কিন্তু কোনো কিছুই সাধারণ নয়। সবই অসাধারণ।”
তোমার চেহারাটা বদলে ফেলা হয়েছে। চরিত্রটা ঢেকে গেছে। চুলটা বদলে ফেলো, তাহলে দেখবে তোমার চেহারাটা একেবারে বদলে গেছে…. কিছু কিছু কনট্যাক্ট লেন্স আছে যা চোখের রঙ বদলে দেয়…চশমা পরো, দেখবে তুমি একেবারে আলাদা একজন হয়ে গেছো।
সবকিছুই খাপ খেয়ে যাচ্ছে। সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় নি, তবে যতোটুকু জানতে চেয়েছে তার চেয়ে বেশি জেনে গেছে।
“আমি এসব ঝামেলা শেষ করতে চাচ্ছি,” মেরি বললো। “আপনাদের অফিসে গিয়ে যা যা সাইন করতে হবে আমি সাইন করবো। আমাকে আমার হোটেলে ফিরতে হবে। আমাকে তো আর বলতে হবে না আমি কিসের মধ্যে ছিলাম।”
গোল্ডরিম চশমার মধ্য দিয়ে সুইস লোকটা তার দিকে তাকালো। মেয়েটাকে বেটে মতো যে লোক অন্ধকার থেকে বের ক’রে নিয়ে এসেছিলো সে তার হাতটা ধরে ফেললে তাদের দু’জনের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো মেরি।
তারপর বর্নের দিকে তাকালো। মেয়েটার শ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। ভয়ংকর একটা ব্যাপার তার কাছে বোধগম্য হয়ে উঠলে চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে গেলো।
“তাকে যেতে দাও,” জেসন বললো। “সে কানাডায় ফিরে যাচ্ছে। তোমরা তাকে আর কখনও দেখতে পাবে না।”
“একটু বাস্তববাদী হও, বর্ন। সে আমাদেরকে দেখে ফেলেছে। আমরা দু’জন পেশাদার লোক। এই ধান্দায় কিছু নিয়মকানুন আছে।” লোকটা জেসনের থুতনীর নীচে অস্ত্র ঠেকিয়ে তার পকেট হাতরে অস্ত্রটা নিয়ে নিলো। “যেমনটি ভেবেছিলাম,” কথাটা বলেই বেটে লোকটার দিকে ফিরলো, “একে অন্য গাড়িতে নিয়ে যাও। লিমাটে।”
বর্ন জমে গেলো। মেরিকে খুন ক’রে তার দেহ লিমাট নদীতে ফেলে দেয়া হবে।
“দাঁড়াও!” জেসন একটু সামনে এগিয়ে বললো, কিন্তু অস্ত্রের মুখে গাড়ির হুডের কাছে ফিরে আসতে বাধ্য হলো সে। “তোমরা বোকামি করছো! সে কানাডার সরকারের একজন পদস্থ কর্মকর্তা। তারা পুরো জুরিখ চষে বেড়াবে।”
“সেটা নিয়ে তুমি এতো ভাবনায় পড়লে কেন? তুমি তো আর বেঁচে থাকছো না। তোমাকে তারা খুঁজবে না।”
“এটা একটা অপ্রয়োজনীয় কাজ!” বর্ন চিৎকার ক’রে বললো। “আমরা পেশাদার, মনে আছে কথাটা?”
“তুমি দেখছো কি, যাও,” বেটে লোকটার দিকে ফিরে বললো খুনি। “গেহ! শ্নেল! গুইসান কুয়ে!”
“আরে চিৎকার করো, যতো জোরে পারো চিৎকার করো!” চিৎকার ক’রে মেরিকে বললো জেসন। “চিৎকার করো! থেমো না!”
মেয়েটা চেষ্টা করলো চিৎকার দেবার জন্যে কিন্তু প্রচণ্ড জোরে তার গলায় একটা ঘুষি দেয়া হলে চিৎকারটা গলার মাঝ পথেই যেনো আঁটকে গেলো। মেয়েটি রাস্তায় লুটিয়ে পড়লে তার সম্ভাব্য খুনি টানতে টানতে তাকে নাম্বারবিহীন কালো রঙের সিডান গাড়ির দিকে নিয়ে যেতে লাগলো।
“খুবই নির্বোধের মতো কাজ করলে,” বর্নের দিকে চেয়ে বললো খুনি। “তুমি কেবল কাজটাকে আরেকটু ত্বরান্বিত করলে। বলতে গেলে, এখন কাজটা আরো বেশি সহজ হয়ে গেলো। সব কিছুই খুব সামরিক কায়দায় হচ্ছে, তাই না? এটা আসলেই একটা যুদ্ধক্ষেত্র।” টর্চ হাতে লোকটার দিকে ঘুরলো সে। “জোহানকে সিগনাল দাও ভেতরে যাবার জন্যে। আমরা আসছি।”
টর্চটা একবার জ্বললো নিভলো। চতুর্থ লোকটি যে কিনা মৃত্যুদণ্ড পাওয়া মেয়েটাকে গাড়িতে ঢোকাবার জন্যে দরজা খুলেছে মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। মেরিকে গাড়ির পেছনের সিটে ছুড়ে ফেলে দরজাটা সশব্দে বন্ধ ক’রে দেয়া হলো। ঘাতককে মাথা নেড়ে ইশারা করলো জোহান নামের লোকটি।
গাড়িটা রওনা দিলে প্রচণ্ড অসুস্থ বোধ করলো জেসন। গাড়ির ভেতরে একটি মেয়ে আছে যাকে সে তিন ঘণ্টা আগেও দেখে নি। মেয়েটাকে সে খুন ক’রেই ফেললো। “তোমরা আসলেই সৈনিক,” সে বললো।
“একশ’ জন লোককেও যদিও বিশ্বাস করতে পাতাম, আমি তাদেরকে টাকা দিয়ে কিনে নিতাম খুশি মনে। যেমনটি বলা হয়, তোমার সুনামই তোমাকে এগিয়ে নিয়ে যায়।”
“ধরো, আমি তোমাদেরকে টাকা দিলাম। তুমি তো ব্যাংকে ছিলে, ভালো করেই জানো আমার কাছে প্রচুর টাকা আছে।”
“সম্ভবত কয়েক মিলিয়ন, তবে আমি একটা ফ্রাও স্পর্শ করবো না।”
“কেন? ভয় পাচ্ছো?”
“অবশ্যই। সম্পদ অনেকটা সময়ের সাথে সম্পর্কিত। কার কতোটুকু সময় আছে তার উপর সম্পদের মূল্য নির্ধারিত হয়। আমার হাতে তো পাঁচ মিনিটও নেই।” খুনি তার অধীনস্তের দিকে ফিরলো। “তাকে গাড়িতে নিয়ে যাও। কাপড়- চোপড় সব খুলে রেখো। আমি তার নগ্ন ছবি তুলতে চাই—আগে আর পরে। তোমরা তার বিনিময়ে প্রচুর টাকা পাবে। গাড়ি আমিই চালাবো।” আবারো বর্নের দিকে তাকালো সে। “ছবিগুলো প্রথমে পাবে কার্লোস। আর বাকি প্রিন্টগুলো খোলাবাজারে বিক্রি ক’রে বেশ ভালো দাম পাবো ব’লে আশা করছি। ম্যাগাজিনগুলো তো এরকম ছবির জন্যে চড়া দাম দেয়।”
“কার্লোস কেন তোমাকে বিশ্বাস করবে? কেউ তোমাকে বিশ্বাস করবে কেন? তুমিই তো বললে : কেউ জানে না, আমি দেখতে কেমন।”
“সেটা আমি করাতে পারবো,” লোকটা বললো। “জুরিখের দু’জন ব্যাংকার তোমাকে জেসন বর্ন হিসেবে চিহ্নিত করতে এগিয়ে আসবে। সেটাই যথেষ্ট। আমি তো আড়ালে থাকবো।” অস্ত্রধারী লোকটাকে সে বললো, “জলদি করো! আমাকে ক্যাবল পাঠাতে হবে। কিছু টাকা সংগ্রহ করতে হবে।”
একটা শক্ত হাত এসে আঘাত করলো বর্নের কাঁধে। তার গলাটা টিপে ধরলো আঙটার মতো। তার কোমরে, স্পাইনে ঠেকানো হলো অস্ত্র। গাড়িতে টেনে তোলার সময় সারা শরীরে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলো সে। যে লোক তাকে ধরে রেখেছে সে একজন পেশাদার। সে যদি আহত নাও থাকতো লোকটার হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারতো না। অস্ত্রধারী লোকটা হুইলের পেছনে ব’সে আরেকটা আদেশ করলো। “তার হাতের আঙুলগুলো ভেঙে ফেলো।”
অস্ত্রটার বাট দিয়ে পরপর কয়েকটা আঘাত করা হলো তার হাতে। স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় বর্ন বাম হাতটা ডান হাতের উপর রাখলো আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য। তার বাম হাতে রক্ত ঝড়ে পড়তে লাগলে হাতটা মুষ্টিবদ্ধ ক’রে একটা চিৎকার দিলো সে।
“আমার হাত! ভেঙে গেছে!”
কিন্তু তার হাত ভাঙে নি। বাম হাতে আঘাত লেগে রক্ত ঝরলেও ডান হাতটা অক্ষত আছে। বাম হাতের যেখানে আঘাত লেগেছে সেটা উল্লেখযোগ্য কোনো জায়গা নয়।
অন্ধকারে সে তার আঙুলগুলো নড়াচাড়া করলো। তার হাত অক্ষতই আছে। গাড়িটা স্টেপডেকস্ট্রাস থেকে একটা ছোটো রাস্তায় চলে এসেছে। দক্ষিণ দিকে চলতে শুরু করলো এবার। জেসন পেছনের সিটে পড়ে গোঙাচ্ছে। অস্ত্রধারী লোকটা তার জামা কাপড় ছিঁড়ে ফেললে মুহূর্তে তার উর্ধ্বাংশ নগ্ন হয়ে গেলো। পাসপোর্ট, কাগজপত্র, কার্ডগুলো, আর সব টাকা-পয়সা নিয়ে নেওয়া হলো তার কাছ থেকে— এগুলো জুরিখ থেকে বের তার হবার অনিবার্য জিনিস। হয় এখনই করতে হবে, নয়তো আর কখনই করা হবে না। জোরে চিৎকার দিলো সে।
“আমার পা! আহ্, আমার পা-টা?” সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লো বর্ন। অন্ধকারে তার ডান হাতটা উদভ্রান্তের মতো কাজ করছে। পায়ের মোজাটা হাতরে অটোমেটিক অস্ত্রটার বাট পেয়ে গেলো সে।
“না!” তার সামনে থাকা পেশাদার লোকটা গর্জে উঠলো। “তাকে ধরো!” বুঝে ফেলেছে সে।
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। বর্ন অন্ধকারে গাড়ির ফ্লোরে অস্ত্রটা ধরে রাখলে শক্তিশালী সৈনিকটি তাকে জোরে ধাক্কা মারলো। আঘাতের ফলে পড়ে গেলো সে। রিভলবারটা এখন সরাসরি তার আক্রমণকারীর বুকের দিকে তাক্ করা।
পরপর দুটো গুলি করলে লোকটা পেছন দিকে হেলে পড়লো। আবারো জেসন গুলি চালালো, তার নিশানা অব্যর্থ। গুলিগুলো হৃদপিণ্ড ফুটো ক’রে ফেলেছে। লোকটা সিটের উপর মুখ থুবরে পড়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে।
“অস্ত্রটা নামিয়ে রাখো,” সামনের সিটে বসা লোকটার মাথার দিকে অস্ত্র তাক্ ক’রে বর্ন বললো। “ফেলে দাও!”
তার শ্বাস দ্রুত পড়ছে। খুনি অস্ত্রটা ফেলে দিলো। “আমাদের কথা বলতে হবে,” স্টিয়ারিংটা ধরে রেখে বললো সে। “আমরা পেশাদার লোক। আমরা কথা বলবো।” গাড়িটা সামনের দিকে ছুটে চলছে, গতি বেড়ে যাচ্ছে সেটার। এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে যাচ্ছে ড্রাইভার।
“গতি কমাও!”
“তোমার জবাবটা কি?” গাড়িটা আরো দ্রুত ছুটতে লাগলো। সামনে গাড়ি গুলোর হেডলাইট দেখা যাচ্ছে। স্টেপডেকস্ট্রাস জেলাটা ছেড়ে আরো ব্যস্ততম শহরের দিকে প্রবেশ করছে তারা। “তুমি জুরিখ থেকে বের হতে চাও, আমি তোমাকে বের ক’রে দিতে পারি। আমাকে ছাড়া তুমি যেতে পারবে না। আমি স্টিয়ারিংটা ঘুরিয়ে গাড়িটা ক্র্যাশ ক’রে দেবো। আমার হারানোর কিছু নেই, হের বর্ন। সামনে সবখানে পুলিশ আছে। আমার মনে হয় না তুমি পুলিশের দেখা পেতে চাও।”
“আমরা কথা বলবো,” জেসন মিথ্যে বললো। চলন্ত গাড়িতে দু’জন খুনি, এটা একটা ফাঁদ। কোনো খুনিকেই বিশ্বাস করা যায় না। তারা কেউ কাউকে বিশ্বাস করছেও না। দু’জনেই সেটা জানে। বাড়তি আধ সেকেন্ড সময় একজনকে ব্যবহার করতে হবে। “ব্রেক করো,” জেসন বললো।
“আমার পাশের সিটে অস্ত্রটা রাখো।”
জেসন অস্ত্রটা ছেড়ে দিলে খুনির উপর গিয়ে পড়লো সেটা। ভারি লোহার শব্দ হলো। “ফেলে দিয়েছি।”
খুনি এক্সেলেটর থেকে পা সরিয়ে ব্রেকের উপর রাখলে গাড়িটা সামনে পেছনে ঝাঁকি খেলো। বুঝতে পারলো বর্ন। এটা ড্রাইভারের কৌশল। স্পিডমিটারের কাটা বাম দিকে ঘুরছে : ৩০ কি.মি, ১৮ কি.মি, ৯ কি.মি:। গাড়িটা প্রায় থেমেই গেলো। এখনই সময় বাড়তি আধ সেকেন্ড ব্যবহার করার।
পেছন থেকে লোকটার গলা পেঁচিয়ে ধরে তাকে তার সিট থেকে তুলে ফেললো জেসন। তারপর রক্তাক্ত বাম হাতটা দিয়ে লোকটার দু’চোখ পেছন থেকে খাচে ধরলো। এবার গলা ছেড়ে পাশের সিট থেকে অস্ত্রটা হাতে তুলে নিলো বর্ন। বাট দিয়ে লোকটার হাতে আঘাত করলে লোকটা চিৎকার দিলো। তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে অস্ত্রটা। জেসন সামনের দিকে ঝুঁকে লোকটার বুক জড়িয়ে ধরে দরজার দিকে ধাক্কা মারলো। বাম হাত দিয়ে আবার খুনির গলাটা জড়িয়ে ধরলো সে। রক্তাক্ত হাতে স্টিয়ারিংটা ধরে ফেললো জেসন। উইন্ডশিল্ডের দিকে তাকিয়ে ডান দিকে ঘোরালো হুইলটা। গাড়িটা রাস্তার একপাশে রাখা ডাস্টবিনের সামনে থামালে ময়লা আবর্জনার মধ্যে গিয়ে ঢুকে পড়লো সেটা।
তার হাতে আঁটকে থাকা লোকটা প্রাণপনে ছোটার চেষ্টা করছে। এক পর্যায়ে যখন সে প্রায় ছুটে যাবে তখনই জেসন অটোমেটিক অস্ত্রটা দিয়ে গুলি চালালো।
অন্ধকারে নিরব নিথর হয়ে গেলো তার সম্ভাব্য খুনি। তার কপালে একটা লাল বৃত্ত দেখা যাচ্ছে।
রাস্তা দিয়ে কয়েকজন লোক ছুটে এলো তাদের গাড়ির দিকে—একটা দূৰ্ঘটনা ঘটেছে। মৃতদেহটা সিটের উপর ফেলে রেখে ড্রাইভারের সিটে গিয়ে বসলো জেসন। গিয়ারটা ব্যাকে দিয়ে জানালার কাঁচ নামিয়ে সম্ভাব্য উদ্ধারকারীদের উদ্দেশ্যে বললো।
“দুঃখিত! সবকিছু ঠিক আছে! একটু বেশি মদ খেয়ে ফেলেছিলাম।”
লোকজনের ছোট্ট দলটা খুব দ্রুতই যে যার কজে চলে গেলে বর্ন গভীর ক’রে একটা নিঃশ্বাস নিলো। তার শরীরে যে কাঁপুনিটা হচ্ছে সেটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো সে। গাড়িটা সামনের দিকে ছুটিয়ে চললো এবার। স্মৃতি থেকে জুরিখের পথঘাটের ছবিটা হাতরানোর চেষ্টা ক’রে ব্যর্থ হলো সে।
অস্পষ্টভাবে জানে সে কোথায় আছে—কোথায় ছিলো—আর সবচাইতে গুরত্বপূর্ণ হলো, কোথায় গুইসান কুয়ে, যার সাথে লিমাটের সম্পর্ক আছে, সেটা আরো বেশি স্পষ্ট ক’রে জানে সে।
গেহ্! শ্নেল! গুইসান কুয়ে!
গুইসান কুয়ে’তে মেরি সেন জ্যাককে খুন করা হবে। লিমাট নদীতে ফেলে দেয়া হবে তার মৃতদেহ। গুইসান আর লিমাট একটা জায়গায় মিলিত হয়েছে : সেটা লেক জুরিখের মুখে, পশ্চিম তীরের পাদদেশে। হয়তো ইতিমধ্যে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। সেটা জানার কোনো উপায় নেই। তবে জেসন জানে তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। সে যেই হোক না কেন, এটা সে এড়িয়ে যেতে পারে না।
তার ভেতরের পেশাদার সত্তাটা চাইছে সামনের অন্ধকার গলিতে ঢুকে পড়তে। গাড়িতে দুটো লাশ আছে। তারা তার জন্যে বোঝা আর বিরাট একটা ঝুঁকি যা সে সইতে পারছে না। এদেরকে গাড়ি থেকে না সরালে যেকোনো সময় পুলিশ পথে গাড়ি থামিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি মারলেই বিপদ নেমে আসবে।
তার ধারণা বত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যেই লাশ দুটো গাড়ি থেকে সরাতে পারবে সে। কিন্তু এক মিনিটের মতো লেগে গেলো ওগুলো সরাতে। গলির ভেতর একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন দেয়ালের পাশে তাদের ফেলে দেয়া হলো।
গাড়িতে উঠে গলি থেকে গাড়িটা বের ক’রে আবার প্রধান সড়কের উপর চলে এলো জেসন বর্ন।
গেহ্! শ্নেল! গুইসেন কুয়ে!