অধ্যায় ৭
ফকেনস্ট্রাস থেকে লিমাট কোয়ে’র গ্রসমুনস্টার ক্যাথেড্রালের সামনে এসে পড়লো তারা। লাওয়েনস্ট্রাস শহরটা নদীর ওপারে পশ্চিম দিকে অবস্থিত। মুনস্টার বৃজ দিয়েই ব্যানহফস্ট্রাসে সবচাইতে সহজ আর দ্রুত পৌঁছানো যায়। সেখান থেকে নাশেলস্ট্রাস;
মেরি চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে। এতো কিছুর পরও একটু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে সে। বর্ন তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো সেটা।
…একজন লোক খুন হয়েছে, তার হত্যার খবর প্রতিটি সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিলো।
জেসন বর্নকে টাকা দেয়া হয়েছিলো খুন করার জন্যে, কয়েকটি দেশের পুলিশ ইন্টারপোলে ফান্ড পাঠিয়েছে তাকে ধরার জন্যে। তার মানে কিছু লোক খুন হয়েছে…
কতোজন তোমাকে খুঁজছে, মেইন হের? তারা কি করবে?…তারা কোনোভাবেই ক্ষান্ত দেবে না–বউ বাচ্চাকে খুন করা তো তাদের কাছে কোনো ব্যাপারই না!
পুলিশ নয়। অন্য কেউ।
গ্রসমুনস্টার চার্চের যমজ দুটো টাওয়ার দূর থেকেও রাতের আকাশে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পুরনো এই স্থাপত্যটার দিকে তাকালো জেসন। এ সম্পর্কে তার অনেক কিছুই মনে হচ্ছে, কিন্তু সে কিছুই জানে না। এটা আগেও দেখেছে সে, তার পরও তার মনে হচ্ছে জীবনে প্রথমবারের মতো দেখছে এটা।
আমি কেবল চারনাককে চিনি…খামটা তার মাধ্যমেই আমাকে দেয়া হয়েছিলো…লাওয়েনস্ট্রাস। ৩৭ নাম্বার। তুমিও তো আমার মতোই জানো সেটা।
সে কি জানে? সে কি বলবে?
বৃজটা অতিক্রম করলো তারা। শহরে বেশ লোকজনের ভীড় দেখা যাচ্ছে। এটা অপেক্ষাকৃত নতুন শহর। লাল আর সবুজ বাতি জ্বলছে পালাক্রমে। বর্ন কোনো কিছু ভাবার চেষ্টা করলো না…আবার সবই ভাবতে চেষ্টা করলো।
সত্যের রূপরেখা তার সামনে উপস্থিত হচ্ছে, রহস্যজনক আকার ধারণ করছে সেটা। প্রতিটিই তার আগেরটার চেয়ে বিস্ময়কর আর চমকে দেবার মতো।
সে যে সক্ষম সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয়—মানসিকভাবে সক্ষম—মানে, আরো বেশি কিছু সহ্য করার ক্ষেত্রে।
“থামো! ডাই ডাম ডা! ডাই শিনওয়েরফার সিন্ড অস্ অ্যান্ড সি হাবেন লিংকস সিগনালাইজার্ট। ডাস ইস্ট আইন ইনব্যানস্টাস!”
চোখ তুলে তাকালো জেসন, তার পেটে তীব্র একটা ব্যথা জেঁকে বসেছে। তাদের পাশে একটা টহলগাড়ি। জানালা দিয়ে এক পুলিশ চিৎকার ক’রে কী যেনো বলছে। আচমকা সব কিছু পরিস্কার হয়ে উঠেছে…পরিস্কার আর বিব্রতকর। মেরি সাইড মিরর দিয়ে পুলিশের গাড়িটা দেখেছে। সে গাড়ির হেডলাইটটা বন্ধ ক’রে দিয়ে হাত বাড়িয়ে ডিরেকশনাল সিনগাল দেখিয়েছে বাম দিকে মোড় নেবার জন্যে। ওয়ানওয়ে রাস্তায় বাম দিকে মোড় নেয়াটা ট্রাফিক আইন বিরোধী। হেডলাইট না জ্বালানোটা আরো বড় অপরাধ। এক্ষেত্রে গাড়িটা নির্ঘাত থামানো হবে। আর মেয়েটা চিৎকার দিতে পারবে সাহায্যের আশায়।
বর্ন হেডলাইটটা তাড়াতাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে মেয়েটার দিকে ঝুঁকে এক হাত দিয়ে ডিরেকশনাল সিগনাল দেয়া হাতটা ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে এলো।
“আমি তোমাকে খুন করবো,” শান্ত কণ্ঠে বললো সে। তারপর জানালা দিয়ে পুলিশের উদ্দেশ্যে চিৎকার ক’রে বললো, “দুঃখিত! আমরা বুঝতে পারি নি! পর্যটক তো! আমরা পরের ব্লকে যেতে চাচ্ছি!” পুলিশের লোকটা মেরির কাছ থেকে বড়জোর দুই ফিট দূরে দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে আছে, বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটার নির্বিকার আর ভাবলেশহীন মুখটা দেখে একটু হতভম্ব হয়ে গেছে সে।
বাতিটা বদলে গেলো। “সামনের দিকে এগোও। বোকার মতো কিছু করবে না,” বললো জেসন। গাড়ির ভেতর থেকে পুলিশের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো সে। “দুঃখিত, আবারো বলছি!” চিৎকার ক’রে বললো সে। পুলিশ কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজের সঙ্গীর দিকে ফিরে আবার কথা বলতে লাগলো।
“আমি গুলিয়ে ফেলেছিলাম,” কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো মেয়েটা। “অনেক গাড়ি তো…ওহ্ ঈশ্বর, আমার হাতটা ভেঙেই ফেলেছে…বানচোত।”
মেয়েটার হাত ছেড়ে দিলো বর্ন। তার রাগ দেখে দমে গেলো একটু। সে ভয় পছন্দ করে। “তুমি নিশ্চয় আশা করো না আমি তোমার কথা বিশ্বাস করবো?”
“আমার হাতটা!”
“তুমি গুলিয়ে ফেলেছিলে।”
“তুমিই তো বলেছিলে একটু পরেই আমরা বাম দিকে মোড় নেবো। আমি সেটাই মনে করেছিলাম।”
“এরপর থেকে রাস্তার দিকে চোখ রাখবে।” সে তার কাছ থেকে সরে
আসলেও চোখ সরালো না।
“তুমি একটা জানোয়ার,” মেয়েটা বিড়বিড় ক’রে বললো।
লাউয়েনস্ট্রাসের প্রশ্বস্ত একটা এভিনুতে এসে পড়লো তারা। সেখানে আধুনিক ভবনের মাঝে মাঝে পুরনো দিনের ইট-কাঠের দালানগুলো স্যান্ডউইচ হয়ে আছে। জেসন বাড়িরগুলোর নাম্বার দেখতে লাগলো। কিছু দূর যাওয়ার পর চোখে পড়লো চার তলার কতোগুলো ভবন। এইসব সারিসারি বাড়িগুলো দেখে একটা ছবি ভেসে উঠলো তার মনের পর্দায়। সেই ছবিটার সাথে এই বাড়িগুলোর অনেক মিল আছে। তবে পার্থক্যও আছে। মলিন, পুরনো, খুব বেশি সাজানো গোছানো নয়, ঘষা মাজা নয়… জীর্ণশীর্ণ। জানালা, ভাঙা সিঁড়ি, অসমাপ্ত রেলিং—লোহালক্করের জঞ্জাল পড়ে আছে। জুরিখের একটা অংশ। হ্যা, তারা জুরিখে আছে। ছোট্ট একটা জেলা, শহর থেকে একটু দূরে।
“স্টেপডেকস্ট্রাস,” আপন মনে বললো সে। নিজের মনের পর্দায় ভেসে ওঠা ছবিটা নিয়েই মগ্ন রইলো। একটা দরজা দেখতে পাচ্ছে। ম্রিয়মান লাল, তারই পাশে লাল রঙের সিল্কের মতো একটা পোশাক পরে আছে এক মহিলা। “স্টেপডেকস্ট্রাসের…একটা বোর্ডিং হাউজ।”
“কি?” বর্নের কথাটা মেরিকে চমকে দিলো। ভয়ও পেলো মেয়েটা।
“কিছু না,” মেরির দিক থেকে চোখ সরিয়ে জানালার বাইরে তাকালো সে। “৩৭ নাম্বার,” সারির পঞ্চম বাড়িটার দিকে ইঙ্গিত করে বললো সে। “গাড়ি থামাও।”
প্রথমে নিজে বেরিয়ে এসে মেয়েটাকে বের হতে ইশারা করলো সে। তার পা’টা পরীক্ষা করতে চাচ্ছে বর্ন। গাড়ির চাবিটা নিয়ে নিলো মেয়েটার হাত থেকে।
“তুমি হাটতে পারছো দেখছি,” বললো মেরি। “হাটতে যখন পারছো, গাড়িও চালাতে পারবে।”
“হয়তো পারবো।”
“তাহলে আমাকে যেতে দাও! তুমি যা চেয়েছো সবই তো করেছি।”
“আরো কিছু বাকি আছে,” কথার পিঠে কথা বললো সে।
“আমি যে কিছু বলবো না সেটা কি তুমি বুঝতে পারছো না? তোমাকে আমি আর এই জীবনে দেখতে চাই না…আমি কোনো সাক্ষী হতে চাই না, অথবা পুলিশী কোনো ব্যাপারে জড়াতেও চাই না। কোনো রকম জবানবন্দী, কিংবা সেরকম কিছু দেবোও না! তোমার কোনো কাজের সাথেই আমি আর জড়াতে চাই না। আমি ভয়ে মরে যাচ্ছি…এটাই তো তোমার সুরক্ষা, তুমি কি বুঝতে পারছো না? আমাকে এবার যেতে দাও, প্লিজ।”
“সেটা তো দিতে পারছি না।”
“তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছো না।”
“সেটা নয়। তোমাকে আমার দরকার রয়েছে।”
“কিসের জন্যে?”
“খুবই ফালতু একটা ব্যাপারে। আমার কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। লাইসেন্স ছাড়া কোনো গাড়ি ভাড়া করা যায় না। অথচ আমাকে একটা গাড়ি ভাড়া করতেই হবে।”
“এই গাড়িটা তো তোমার কাছে আছেই।
“বড়জোর আর এক ঘণ্টা পর্যন্ত এটা ব্যবহার করা যাবে। হোটেলে এই গাড়ির মালিক গাড়িটার খোঁজ করবে। গাড়ির নাম্বার আর বর্ণনা জুরিখ পুলিশের কাছে দিয়ে দেয়া হবে। সব জায়গায় খোঁজা হবে এটা। ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ট্রাফিক পুলিশেরাও জেনে যাবে।”
মেয়েটা তার দিকে স্থির চোখে চেয়ে রইলো। তার চোখে মুখে নতুন ক’রে ভীতি আর হতাশা জেঁকে বসলো যেনো। “আমি আর তোমার সাথে যেতে চাই না। রেস্তোরাঁয় লোকটা যা বলেছে সব আমি শুনেছি। আমি যদি আর বেশি কিছু শুনে ফেলি তবে তুমি আমাকে খুন ক’রে ফেলবে।”
“তুমি যা শুনেছো তা আমিও শুনেছি। কিন্তু এর মাথামুণ্ডু কিছুই আমি বুঝছে পারছি না। বরং মনে হচ্ছে তোমার চেয়ে আমি নিজেই কম বুঝেছি। আসো।” মেয়েটার এক হাত ধরে টেনে নিয়ে আরেক হাতে সিঁড়ির রেলিংটা ধরলো যাতে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় খুব বেশি ব্যথা না পায়।
তার দিকে হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো মেয়েটি।
মেইল বাক্সগুলোর দ্বিতীয় সারিতে এম. চারনাক নামটি লেখা আছে। নামটির নিচেই একটা কলিংবেল। সে রিং বাজালো না, পাশের চারটা বোতামে চাপ দিলে কয়েক সেকেন্ড পরেই পাশের ছোট্ট একটা স্পিকার থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এলো। সুইস-জার্মান ভাষায় জানতে চাইলো কে। তবে কোনো জবাব দেয়া হলো না। কলিংবেলে চাপ দিলে লটা খুলে গেলে জেসন দরজাটা খুলে মেরিকে সামনে ঠেলে দিলো।
মেয়েটাকে দেয়ালের পাশে রেখে অপেক্ষা করলো সে। উপর থেকে দরজা খোলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, সিঁড়ি দিয়ে নামার শব্দও শোনা যাচ্ছে এবার।
“ওয়ের ইস্ট দা?”
“জোহান?”
“উ বিস্ট ডু ডেন?”
কোনো সাড়াশব্দ নেই। বিরক্ত হবার শব্দ শোনা গেলো, তারপরই সিঁড়ি দিয়ে নামার শব্দটা। দরজাগুলো বন্ধ।
এম. চারনাক থাকে তৃতীয় তলার ফ্ল্যাট ২সি-তে। বর্ন মেয়েটার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করলো। মেয়েটা ঠিকই বলেছে, সে একা থাকলেই বেশি ভালো হোতো। কিন্তু এ ব্যাপারে আর কিছুই করতে পারবে না সে। মেয়েটাকে তার দরকার আছে।
পোর্ত নোয়ে’তে থাকার সময় সে রাস্তার মানচিত্রগুলো ভালো ক’রে দেখেছে। লুসার্ন এখান থেকে এক ঘণ্টার পথ। আড়াই ঘণ্টা অথবা তিন ঘণ্টার পথ হলো বার্ন। যেকোনো এক জায়গায় যেতে পারে সে। পথের কোনো ফাঁকা জায়গায় মেয়েটাকে নামিয়ে দিয়ে উধাও হয়ে যাবে। কেবল সময়ের ব্যাপার। শতশত কানেকশান কেনার মতো ক্ষমতা তার রয়েছে। তবে তাকে জুরিখ থেকে বের হতে হবে, আর এই মেয়েটা হলো তার বের হবার উপায়।
কিন্তু জুরিখ ছাড়ার আগে তাকে জানতে হবে। তাকে কথা বলতে হবে একলোকের সাথে, যার নাম…
এম. চারনাক। নামটা দরজার বেলের ডান দিকে লেখা আছে। সে দরজার সামনে থেকে সরে গেলো, মেয়েটাকেও টেনে নিলো তার পাশে।
“তুমি কি জার্মান ভাষায় কথা বলতে পারো?” জেসন জানতে চাইলো।
“না।”
“মিথ্যে বোলো না।”
“মিথ্যে বলছি না।”
বর্ন একটু ভেবে হলওয়ের দিকে তাকিয়ে বললো : “বেল বাজাও। দরজা খুললে দাঁড়িয়ে থেকো কেবল। ভেতর থেকে যদি কেউ জবাব দেয় বলবে তোমার কাছে একটা মেসেজ আছে—খুবই জরুরি মেসেজ—ড্রেই এলপেনহসার থেকে এক বন্ধু পাঠিয়েছে।”
“ধরো ভেতর থেকে বললো দরজার নিচ দিয়ে দিয়ে দিতে, তাহলে?”
মেয়েটার দিকে তাকালো জেসন। “বেশ ভালো।”
“আমি আর কোনো মারামারি চাচ্ছি না। কিছু দেখতেও চাচ্ছি না, জানতেও চাচ্ছি না। আমি কেবল চাই—”
“আমি জানি,” সে বাধা দিয়ে বললো। “সিজারের ট্যাক্স আর পুনিক-এর যুদ্ধে ফিরে যাবে। কেউ যদি ওরকম কিছু বলে, সংক্ষেপে বলবে মেসেজটা লিখিত নয়, মুখে মুখে বলতে হবে। যে লোকের বর্ণনা দেয়া হয়েছে কেবল সেই লোকের কাছেই বলতে হবে সেটা।”
“সে যদি বর্ণনাটা জানতে চায়?” মেরি বললো শীতল কণ্ঠে।
“তোমার মাথা দেখছি বেশ ভালো, ডক্টর,” বললো সে।
“আমি যুক্তিবাদী। আমি ভীতও বটে। আমি তোমাকে সেটা বলেছি। আমি কি করবো?”
“বলবে নরকে যাও। তারপর হেটে চলে যাবে।”
মেয়েটা বেল বাজালে অদ্ভুত এক শব্দ হলো। কিছু খামচানোর শব্দ। বাড়তে লাগলো সেটা। তারপর আচমকা থেমে গম্ভীর একটা কণ্ঠ শোনা গেলো।
“জা?”
“আমি তো জার্মান বলতে পারি না।”
“ইংলিশ। ব্যাপারটা কি? তুমি কে?”
“ড্রেই এলপেনহসার থেকে এক বন্ধুর মেসেজ নিয়ে এসেছি।”
“দরজার নিচ দিয়ে দাও।”
“সেটা করতে পারছি না। লিখিত বার্তা নয়। যেরকম লোকের বর্ণনা দেয়া হয়েছে কেবল তার কাছেই মেসেজটা দেবো।”
“তো, এটা কোনো কঠিন কাজ নয়,” কণ্ঠটা বললো। লক্ খোলার শব্দ হলে দরজাটা খুলে যেতেই বর্ন সঙ্গে সঙ্গে খোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো।
“তুমি একটা পাগল!” হুইল চেয়ার থেকে দুটো লাঠির উপর ভর দেয়া লোকটা বললো। “চলে যাও! এখান থেকে চলে যাও!”
“একথা শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি,” বলেই জেসন মেয়েটাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজাটা বন্ধ ক’রে দিলো।
.
মেরি সেন জ্যাককে একটা ছোট্ট জানালাবিহীন শোবার ঘরে থাকতে খুব বেশি বেগ পেতে হলো না। তারা যখন কথা বলতে শুরু করলো তখন মেয়েটি স্বেচ্ছায় এটা করলো। পা বিহীন চারনাক ভয়ে কাঠ হয়ে আছে। তার দোমড়ানো মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে এখন। এলোমেলো ধূসর চুলগুলো ছড়িয়ে আছে কপাল আর কাঁধের উপরে।
“আমার কাছে কি চাও?” জানতে চাইলো সে। “তুমি প্রতীজ্ঞা করেছিলে শেষ ট্রানজাকশনটাই হলো আমাদের শেষ কাজ! আমি আর কিছু করতে পারবো না। কোনো ঝুঁকি নিতে পারবো না। মেসেঞ্জাররা এখানে এসেছিলো। যতো সতর্কই থাকো তারা এখানে এসেছিলো। কেউ যদি ভুল সময়ে একটা ঠিকানা আমার কাছে রেখে যায় তো আমি শেষ হয়ে যাবো!”
“যে ঝুঁকি তুমি নিয়েছিলে সেটা কিন্তু ভালোভাবেই করতে পেরেছিলে,” বর্ন হুইলচেয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে বললো। মনে মনে ভাবতে লাগলো কি বললে তথ্যগুলো সহজে বের করা যাবে। তারপরই খামটার কথা মনে পড়ে গেলো তার। যদি উল্টা পাল্টা কিছু হয়ে থাকে তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। ড্রেই এলপেনহসার-এ এক মোটা লোক।
“এই ঝুঁকির সাথে কোনো তুলনাই চরে না।” চারনাক মাথা নাড়লো। “তুমি আমার জীবনে আসার আগে আমি খুব ভালোই ছিলাম, মেইন হের। একজন বৃদ্ধি সৈনিক যে কিনা যুদ্ধে পা হারিয়েছে। আমি নিতান্তই তুচ্ছ একজন কিন্তু কিছু তথ্য জানি বলে আমার সাবেক কমরেডরা আমাকে মুখ বন্ধ রাখার জন্যে টাকা দিতো। জীবনটা বেশ স্বচ্ছলই ছিলো। খুব জাঁকজমক হয়তো ছিলো না, তবে বেশ চলে যাচ্ছিলো। তারপরই তুমি আমাকে খুঁজে বের করলে…”
জেসন অধৈর্য হয়ে বললো, “খামটার ব্যাপারে বলো—যে খামটা তুমি ড্রেই এলপেনহসারে আমাদের এক বন্ধুর কাছে দিয়েছিলে। সেটা তোমাকে কে দিয়েছিলো?”
“একজন মেসেঞ্জার।”
“কোত্থেকে সেটা এসেছিলো?”
“আমি কি ক’রে জানবো? একটা বাক্সে ক’রে এসেছিলো সেটা, ঠিক যেভাবে এসেছিলো অন্যগুলো। আমি বাক্সটা খুলে পাঠিয়ে দিয়েছি। তুমিই তো সেটা চেয়েছিলে। তুমি বলেছিলে তুমি আর এখানে আসতে পারবে না।”
“কিন্তু তুমি সেটা খুলেছিলে।” প্রশ্ন নয় এমনি বললো জেসন।
“কখনই না!”
“ধরো আমি তোমাকে বলছি, সেখান থেকে টাকা খোয়া গেছে।”
“তাহলে সেটা কোনো পেমেন্ট ছিলো না। ধরে নিতে হবে খামে কোনো টাকাই ছিলো না!” পঙ্গু লোকটার কণ্ঠ চড়া হলো। “যাইহোক, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না। যদি তাই হয় তো তুমি অ্যাসাইনমেন্টটা গ্রহন করতে না। কিন্তু তুমি সেটা গ্রহন করেছো। তাহলে এখন এখানে এসেছো কেন?”
কারণ আমাকে জানতে হবে। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমি এমন কিছু দেখছি আর শুনছি যা আমি একটুও বুঝতে পারছি না। আমি বেশ দক্ষ আর স্বাবলম্বী … কিন্তু কুমড়াপটাশ…আমাকে সাহায্য করো।
বর্ন হুইলচেয়ার থেকে সরে লক্ষ্যহীনভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারী করতে লাগলো। পাশেই একটা বইয়ের সেল্ফ আছে। তার পাশে কতোগুলো ছবি টাঙানো। একদল জার্মান সেনা। কারো কারোর সাথে শেফার্ড কুকুর। কোনো ব্যারাকের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তারা। তাদের সামনে একটা বড় লোহার দরজা; তার উপরে কিছু লেখা আছে। পুরোটা ছবিতে নেই, কেবল ডাচ লেখাটা দেখা যাচ্ছে।
ডাচাও।
তার পেছনের লোকটা নড়ছে, টের পেয়েই জেসন ঘুরে দাঁড়ালো। পঙ্গু লোকটা তার হুইলচেয়ারের পাশে থাকা একটা ক্যানভাস ব্যাগ হাতে ধরে রেখেছে। তার চোখে মুখে আগুন জ্বলছে যেনো। মুখটা বিকৃত হয়ে আছে। হাতটা সরলে দেখা গেলো ছোটো ব্যারেলের একটা রিভলবার, কিন্তু বর্ন নিজের পিস্তলটা নেবার আগেই চারনাক গুলি ক’রে বসলো। গুলিগুলো একসঙ্গে গর্জে উঠলে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভূত হলো তার বাম কাঁধে, তারপর মাথায়—ওহ্, ঈশ্বর! সে তার ডান দিকে ঝাঁপ দিলো। কার্পেটের উপর গড়িয়ে একটা ফ্লোরল্যাম্প ছুঁড়ে মারলো খোঁড়া লোকটার দিকে। আবারো গড়িয়ে হুইল চেয়ারটার পাশে চলে এসে উঠে দাঁড়িয়ে ডান কাঁধ দিয়ে চারনাকের পেছনে এমন জোরে ধাক্কা মারলো যে, পঙ্গু লোকটা চেয়ার থেকে ছিটকে পড়ে গেলো। নিজের অস্ত্রটা নেবার জন্যে পকেটে হাত ঢোকালো জেসন।
“তারা তোমার লাশের জন্যে টাকা দেবে!” পঙ্গু লোকটা চিৎকার ক’রে বললো। মেঝে থেকে উঠে ব’সে নিজের অস্ত্রটা তাক্ করার চেষ্টা করলো সে। “তুমি আমাকে কফিনে ঢোকাতে পারবে না! কার্লোস আমাকে টাকা দেবে! ঈশ্বরের কসম, সে দেবে!”
জেসন বাম দিকে সরে গিয়ে গুলি চালালে চারনাকের মাথাটা পেছন দিকে হেলে পড়লো। গলগল ক’রে রক্ত বের হচ্ছে তার মুখ দিয়ে। মরে গেছে সে।
শোবার ঘরের দরজা থেকে একটা চিৎকার শোনা গেলে জেসন বুঝতে পারলো মেয়েটা চিৎকার দিচ্ছে। তার জিম্মি। জুরিখ থেকে বের হবার তার অবলম্বন। ওহ্, ঈশ্বর, সে তার দৃষ্টি ঠিক করতে পারছে না। তার মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে!
দৃষ্টি শক্তি ফিরে পেলো সে, চেষ্টা করলো যন্ত্রণাটা এড়ানোর। একটা বাথরুম দেখতে পাচ্ছে। দরজা খোলাই আছে, তোয়ালে আর সিঙ্কটা দেখা যাচ্ছে, আর…আয়নাটা। দৌড়ে আয়নাটা ধরে টান দিলে সেটা খুলে মেঝেতে পড়ে ভেঙে গেলো। আয়নার পেছনেই আছে একটা শ্নেলফটা। গজ আর টেপগুলো হাতে নিলো সে। তাকে বের হতে হবে…গুলির শব্দ। গুলির শব্দ হয়েছে। তার জিম্মিকে নিয়ে বের হতে হবে এক্ষুণি! শোবার ঘরে আছে সে। সেটা কোথায়?
কান্না, আর্তনাদ…কান্নাটা অনুসরণ করো! দরজাটার কাছে পৌঁছে লাথি মেরে খুলে ফেললো সেটা। মেয়েটা, তার জিম্মি মেয়েটা—তার নামটা যেনো কি? —দেয়ালের সাথে সেঁটে আছে সে। দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে তার। ঠোঁট দুটো কাঁপছে। মেয়েটার কাছে গিয়ে তার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে উদ্যত হলো সে।
“হায় ঈশ্বর, তুমি তাকে খুন ক’রে ফেলেছো!” চিৎকার ক’রে বললো মেয়েটা। “একজন বৃদ্ধ, যার কোনো—”
“চুপ করো!” তাকে দরজার কাছে টেনে নিয়ে গেলো। তার দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে আসছে। দৌড়াতে শুরু করলো তারা। লোকজনের হৈহল্লা আর দরজা খোলার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। মেয়েটার হাত ধরেছে বাম হাতে, তাই বাম কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে, তার ডান হাতে অস্ত্র। সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে পড়লো তারা।
লবিতে পৌঁছে সামনের ভারি দরজাটা খুলতে বললো মেয়েটাকে। বাইরের রাস্তায় নেমে মেয়েটার হাত ছেড়ে দিয়ে রাস্তার দিকে তাকালো। চেষ্টা করলো সাইরেনের শব্দ শোনার। না, কোনো শব্দ শোনা গেলো না। মেয়েটাকে আবার হাত ধরে টেনে গাড়ির সামনে গিয়ে পকেট থেকে চাবিটা বের ক’রে দিলো। “গাড়িতে ওঠো!”
গাড়ির ভেতরে বসেই সে গজগুলো দলা পাকিয়ে মাথার পাশে চেপে ধরলো রক্ত বন্ধ করার জন্যে। তার মনের গভীরে একটা অদ্ভুত অনুভূতি বলছে ভয়ের কিছু নেই। গুলিটা মাথায় লাগে নি, কেবল ছুঁয়ে গেছে। মাথার ভেতরে ঢোকে নি। “আরে, গাড়ি স্টার্ট দাও! এখান থেকে সরে পড়তে হবে!”
“কোথায় যাবো? তুমি তো কিছু বলো নি?” মেয়েটা শান্ত কণ্ঠে বললো। এখন আর চিৎকার করছে না সে। একেবারে বিস্ময়করভাবেই শান্ত আছে। চেয়ে আছে তার দিকে…তার দিকেই কি চেয়ে আছে?
আবারো দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। “স্টেপডেকস্ট্রাস…” বললো সে।
হয়েছেটা কি? গাড়ি চলছে না কেন? গাড়িটা সামনে এগোচ্ছে না কেন? তার কথা কি মেয়েটি শুনতে পায় নি?
তার চোখ বন্ধ। এবার চোখ খুলে তাকালো। অস্ত্রটা। সেটা তো তার কোলে ছিলো। ওটা নামিয়ে রেখেছিলো ব্যান্ডেজ লাগানোর সময়…মেয়েটা ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে। অস্ত্রটা ফ্লোরে পড়ে গেছে। নিচু হয়ে নিতে যেতেই মেয়েটা তাকে এমন জোরে ধাক্কা মারলো যে, জানালার কাঁচে মাথাটা গিয়ে ঠোকর খেলো। দরজা খুলে মেয়েটি রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে শুরু করলো এবার। মেয়েটা পালিয়ে যাচ্ছে! তার জিম্মি, তার একমাত্র অবলম্বন! লাওয়েনস্ট্রাসের দিকে চলে যাচ্ছে!
সে আর গাড়িতে থাকতে পারলো না। গাড়ি চালানোর দুঃসাহসও দেখালো না। অস্ত্রটা পকেটে রেখে গজগুলো মাথায় চেপে ধরলো রক্ত বন্ধ করার জন্যে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনোমতে দৌড়াতে শুরু করলো সে।
কোথাও না কোথাও একটা মোড় আছে, একটা ট্যাক্সিও আছে। স্টেপডেকস্ট্রাস।
মেরি সেন জ্যাক প্রশ্বস্ত আর ফাঁকা এভিনুটা দিয়ে দৌড়াচ্ছে। হাত নেড়ে চলমান গাড়ি থামাতে চাচ্ছে সে, কিন্তু গাড়িগুলো তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। তার পেছনে একটা গাড়ির হেডলাইটের আলো এসে পড়লে সে হাত তুলে গাড়িটা থামাতে চাইলো। কিন্তু গাড়িটা আরো দ্রুত গতিতে অতিক্রম ক’রে গেলো তাকে। জুরিখে কেউ রাতের বেলায় এরকম ফাঁকা আর অন্ধকার রাস্তায় গাড়ি থামায় না। পাশেই সিল নদী আর ফাঁকা একটা পার্ক রয়েছে।
একটা গাড়ি অবশ্য তার ডাকে সাড়া দিলো। ওটার হেডলাইট বন্ধ আছে, ড্রাইভার মেয়েটাকে দেখে তার পাশে বসা সঙ্গীকে সুইস-জার্মান ভাষায় কথা বললো।
“সেই মেয়েটাই হতে পারে, চারনাক এক ব্লক দূরে অথবা পাশের রাস্তায় বসবাস করে।”
“থামাও, মেয়েটাকে কাছে আসতে দাও। তার তো সিল্কের পোশাক প’রে থাকার কথা…হ্যা, সেই মেয়েটাই তো!”
“অন্যদের ওয়্যারলেসে জানানোর আগে চলো নিশ্চিত হয়ে নিই।”
দু’জন লোক গাড়ি থেকে বের হয়ে এলে যাত্রীটিও পেছন থেকে বের হয়ে ড্রাইভারের সাথে যোগ দিলো।
তারা পরে আছে বিজনেস সুট। চোখেমুখে তাদের হাসির ঝিলিক। ভীত মেয়েটি তাদের দিকে এগিয়ে এলো। তারা রাস্তার মাঝখানে আসতেই ড্রাইভার তাদের উদ্দেশ্যে বললো, “ওয়াজ ইস্ট ল্যাসিয়েট, ফ্রলেইন?”
“আমাকে সাহায্য করুন!” মেয়েটা চিৎকার ক’রে বললো। “আমি… আমি জার্মান বলতে পারি না। নিশ্ট স্প্রেশেন। পুলিশ ডাকুন! পোলিজি।”
ড্রাইভারের সঙ্গী কর্তৃত্বের সুরে মেয়েটাকে শান্ত হতে বললো। “আমরা পুলিশেরই লোক,” ইংরেজিতে বললো সে। “জুরিখের পুলিশ। আমরা নিশ্চিত নই, মিস্। আপনি কি কারিলিওন দুলাক থেকে এসেছেন?”
“হ্যা!” চিৎকার ক’রে বললো সে। “ও আমাকে যেতে দিচ্ছিলো না! আমাকে মারধর করেছে, অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখিয়েছে! ভয়ংকর সব ব্যাপার ঘটে গেছে!”
“সে এখন কোথায়?”
“আহত হয়েছে। ও গুলি খেলে আমি গাড়ি থেকে দৌড়ে পালিয়েছি…তখনও গাড়িতেই ছিলো!” সে লাওয়েনস্ট্রাসের দিকে হাত তুলে দেখালো। “ওখানে। মনে হয় দুই ব্লক দূরে। একটা ধূসর রঙের ক্যু গাড়ি! তার কাছে অস্ত্র আছে।”
“আমাদের কাছেও আছে, মিস্,” ড্রাইভার বললো। “গাড়ির কাছে চলুন। আপনি এখন নিরাপদ। আমরা খুব সতর্ক আছি। জলদি আসুন।
তারা ধূসর রঙের ক্যু গাড়িটার কাছে চলে এলো। গাড়ির হেডলাইট বন্ধ করা আছে। ভেতরে কেউ নেই। ৩৭ নাম্বার বাড়িটার সামনে লোকজন আগ্রহ আর কৌতুহল নিয়ে জড়ো হয়ে কথাবার্তা বলছে। ড্রাইভার পেছনে ঘুরে ভয়ার্ত মেয়েটিকে বললো, “এটা হলো চারনাক নামের এক লোকের বাড়ি। সে কি তার কথা বলেছে কিছু? তার সাথে দেখা করার কথা বলেছে?”
“সে ওখানে গিয়েছিলো। আমাকেও জোর ক’রে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলো। লোকটাকে খুন করেছে সে! ঐ বৃদ্ধ আর পঙ্গু লোকটাকে খুন করেছে!”
“ডার সেন্ডার—শেল,” ড্যাশবোর্ডে থেকে একটা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে ড্রাইভারকে তার সঙ্গী বললো। “উইর সিন্ড জুই স্ট্রাসেন ফন ডা।” গাড়িটা দ্রুতবেগে সামনের দিকে ছুটতে থাকলে মেয়েটা সামনের সিট ধরে রাখলো।
“আপনারা করছেনটা কি? একটা লোক ওখানে খুন হয়েছে!”
“খুনিকে খুঁজে বের করতে হবে,” ড্রাইভার বললো। “যেমনটি বললেন, সে আহত। হয়তো এখনও আশেপাশেই আছে। এই গাড়িটা সে চেনে না, তাকে আমরা সহজেই খুঁজে পাবো। আমাদেরকে অবশ্যই অপেক্ষা করতে হবে। তদন্তকারী দলটি পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত। তবে আমাদের কাজ সম্পূর্ণ আলাদা।” ৩৭ নাম্বার বাড়িটা থেকে কয়েকশো গজ দূরে একটা মোড়ে এসে গাড়ির গতি কমে এলো।
সহকারিটি মাইক্রোফোনে যখন কথা বলতে লাগলো তখন ড্রাইভার তাদের অফিশিয়াল অবস্থাটি ব্যাখ্যা করলো। ড্যাশবোর্ডের স্পিকার থেকে ঘরঘর শব্দ হতেই একটা কণ্ঠ বলে উঠলো, “উইর কোমেন বিলেন জেয়ানিগ। মিনিটেন। ওয়ার টেট।”
“আমাদের বড় কর্তারা খুব জলদিই এসে পড়বে,” সহকারি বললো। “আমরা তার জন্যে অপেক্ষা করবো। সে আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে।”
মেরি সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ ক’রে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। “ওহ্, ঈশ্বর—যদি একটু ড্রিংক করতে পারতাম!”
ড্রাইভার হেসে তার সঙ্গীকে ইশারা করলো। গ্লোভ কম্পার্টমেন্ট থেকে একটা মদের বোতল বের ক’রে মেয়েটার দিক বাড়িয়ে দিলো সে। “আমাদের কাছে অবশ্য কোনো গ্লাস কিংবা কাপ নেই। তবে ব্র্যান্ডি আছে। অবশ্যই মেডিকেলের জরুরি প্রয়োজনে। প্লিজ, পান করুন।”
হেসে বোতলটা হাতে নিলো মেরি। “আপনারা দু’জন খুবই চমৎকার মানুষ, আপনারা জানেন না আমি কতোটা কৃতজ্ঞ। যদি কখনও কানাডায় আসেন তো ফরাসি খাবার আমি নিজে রেঁধে খাওয়াবো আপনাদেরকে।”
“ধন্যবাদ, মিস্,” ড্রাইভার বললো।
.
বর্ন তার কাঁধের ব্যান্ডেজ পরীক্ষা ক’রে দেখলো। নোংরা আর স্বল্প আলোর ঘরে ময়লা লেগে থাকা আয়নাটার দিকে চোখ কুচকে তাকালো সে। স্টেপডেকস্ট্রাসের ব্যাপারে তার ধারণাই ঠিক। লাল রঙের দরজার ছবিটা একেবারে মিলে গেছে। উপরে ভাঙাচোরা জানালার ছাউনি আর জংধরা লোহার রেলিং। ঘরটা যখন সে ভাড়া নিলো তখন তাকে কোনো প্রশ্নই করা হয় নি। যদিও তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন সুস্পষ্ট। তবে বর্ন যখন টাকা পরিশোধ করতে গেলো তখন বিল্ডিংয়ের ম্যানেজারের কথাটা ছিলো উল্লেখ করার মতো।
“মুখ বন্ধ রাখবে এমন একজন ডাক্তার পাওয়া যাবে এখানে।”
“আমি আপনাকে পরে জানাবো।”
আঘাতটা মারাত্মক নয়। একজন ডাক্তার পাওয়ার আগ পর্যন্ত লাগিয়ে রাখা টেপগুলোই কাজ করবে।
কোনো আঘাতের কারণে যদি প্রচণ্ড চাপের অবস্থার সৃষ্টি হয় তবে ঘাবড়ে যেয়ো না, মানিয়ে নেবার চেষ্টা কোরো। ভয় পেয়ো না…
সে ভয় পেয়ে গেছে। তার শরীরের কিছু অংশ জমে গেছে ঠাণ্ডায়। যদিও কাঁধের বুলেটটা আর মাথার চামড়া কেটে যাওয়ায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। তবে ওগুলো অতো মারাত্মক নয় যে, তাকে থামিয়ে দেবে। অবশ্য খুব দ্রুত চলাফেরা করতে পারছে না সে, যদিও তাকে এখন দ্রুত চলাফেরা করতে হবে। বার্তা দেয়া হয়েছে আর সেটা গৃহীত হয়েছে মস্তিষ্কে। চলাফেরা করতে পারবে সে।
একটু বিশ্রাম নিলে ভালোভাবে কাজ করা যাবে। দিন হবার আগেই তাকে রওনা দিতে হবে, জুরিখ থেকে বের হবার অন্য আরেকটা পথ খুঁজে নিতে হবে। দ্বিতীয় তলার ম্যানেজার টাকা-পয়সা খুব পছন্দ করে। এক ঘণ্টার মধ্যে বেখেয়ালী জমিদারকে ঘুম থেকে ডেকে তুলবে সে।
শক্ত বিছানাতে শুয়ে ছাদের বাল্বের দিকে চেয়ে রইলো সে। বিশ্রাম নেবার চেষ্টা করলেও ভাবনাগুলো চলে এলো হাতুড়ি পেটার মতো শব্দ ক’রে।
একজন লোক খুন হয়েছে…
কিন্তু তুমি তো অ্যাসাইনমেন্টটা গ্রহন করেছো…
দেয়ালের দিকে ফিরে চোখ দুটো বন্ধ ক’রে ফেললো সে। কথাগুলো থামাবার চেষ্টা করলো। তারপর অন্য কথাগুলোও চলে এলে উঠে বসলো সঙ্গে সঙ্গে। তার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে এখন।
তারা তোমার লাশের জন্যে টাকা দেবে…কার্লোস টাকা দেবে। ঈশ্বরের কসম, সে দেবেই।
কার্লোস।
.
ক্যু গাড়িটার সামনে এসে থামলো একটা বড়সড় সিডান। তাদের পেছনেই ৩৭ নাম্বার লাওয়েনস্ট্রাস। টহল গাড়িগুলো পনেরো মিনিট আগে এসে পৌঁছেছে। অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা পাঁচের কম হবে না। আশে পাশে বাড়িঘরের লোকজন এসে বাড়িটার সামনে জড়ো হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা। একটা খুন হয়েছে, এক লোক তার নিজের ঘরেই খুন হয়েছে। উদ্বিগ্নতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে সবার। ৩৭ নাম্বারে যা ঘটেছে সেটা ৩২ অথবা ৪০, কিংবা ৫৩ নাম্বারেও হতে পারতো। পৃথিবীতে এসব কী হচ্ছে। জুরিখেও এসব শুরু হয়ে গেলো!
“আমাদের কর্তারা এসে পৌঁছেছে, মিস্। আপনাকে তাহলে তার কাছে নিয়ে যাই?” সহকারী গাড়ি থেকে নেমে মেরির জন্য দরজা খুলে বললো।
“অবশ্যই।” গাড়ি থেকে নামতেই লোকটা তাকে হাত ধরে সাহায্য করলো। রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের আলো গোল্ডরিম চশমায় প্রতিফলিত হচ্ছে।
“আপনি!…আপনি তো হোটেলে ছিলেন! আপনি তো তাদেরই একজন!” লোকটা দুর্বলভাবে মাথা নেড়ে বললো, “ঠিক। আমরা জুরিখ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ। আর কথাবার্তা বলার আগে একটা বিষয় আপনাকে পরিস্কার জানিয়ে দিতে চাই, হোটেল ক্যারিলিওন দুলাকে যাই ঘটুক না কেন, আপনার কিছুই হোতো না। আমরা এ ব্যাপারে খুব সতর্ক ছিলাম। কিছু গুলি হয়তো আপনার খুব কাছ দিয়ে গেছে, তবে সেটার কারণ আপনি ওর খুব কাছাকাছি ছিলেন।”
মেয়েটার আতঙ্ক একটু কমে এলো। “সেজন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।”
“এটা তেমন কোনো ব্যাপার নয়,” লোকটা বললো। “তো, আমি যতোটুকু বুঝি, আপনি তাকে শেষ দেখেছেন গাড়িটার সামনের সিটে ব’সে থাকতে।”
“হ্যা। সে আহত হয়েছে।”
“কতোটা মারাত্মক?”
“বেশ ভালোই। মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে রেখেছে। তার কাঁধ থেকে রক্ত ঝরতে দেখেছি। সে কে?”
“নামে কি আসে যায়। তার তো অনেক নাম। তবে দেখেছেন তো, সে একজন খুনি। খুবই ভয়ংকর খুনি। আর অন্য কেউ খুন হবার আগেই তাকে ধরতে হবে। তাকে আমরা কয়েক বছর ধরেই খুঁজছি। অনেক দেশের অনেক পুলিশই তাকে খুঁজছে। এখন আমাদের সামনে যে সুযোগ এসেছে সেটা আর কারোর পক্ষে কখনও আসে নি। আমরা জানি সে জুরিখে আছে। আহত হয়েছে। এই এলাকায় থাকবে না সে। তবে কতোদূর যেতে পারবে? সে কি বলেছে এই শহর ছেড়ে কিভাবে যাবে?”
“একটা গাড়ি ভাড়া করবে। আমার নামে। তার কাছে কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই।”
“সে মিথ্যে বলেছে। ভূয়া কাগজপত্র নিয়ে ভ্রমণ করছে সে। আপনি তার কাছে অপ্রয়োজনীয় একজন জিম্মি ছিলেন। এখন একেবারে শুরু থেকে বলেন, সে আপনাকে কি কি বলেছে। কোথায় আপনারা গিয়েছেন, কাদের সাথে দেখা করেছেন, যা যা হয়েছে সব বলুন।”
“ড্রেই এলপেনহসার নামের এক রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলো। মোটাসোটা একলোক তাকে দেখে ভয়ে মরে যাচ্ছিলো…” সেন জ্যাক মেরি যা যা তার মনে আসলো বলতে লাগলো। বিশ মিনিট ধরে চললো এই পর্ব।
তারপর অন্য একজন অফিসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। ড্রাইভারকে বললো সে, “ড্রেই এলপেনহসার। শ্নেল!” মেরির দিকে ফিরে বললো। “আমরা সেই লোকটার কাছ থেকেও শুনবো J লোকটা অনেক কিছুই জানে ব’লে মনে হচ্ছে।”
“অনেক কিছু জানে…” মেয়েটা আপন মনে বললো। তার একটা কথা মনে পড়ে গেলো। “স্টেপডেকস্ট্রাস–স্টেপডেকস্ট্রাস। ভাঙা জানালা, ঘরবাড়ি!”
“কি?”
“’‘স্টেপডেকস্ট্রাসের একটা বোর্ডিং হাউজ,’ এটাই সে বলেছিলো। এর পরই আমি গাড়ি থেকে নেমে পালাই।”
ড্রাইভার বললো, “ইচকেনে ডিজে স্ট্রাসে। ফ্রুয়ের গ্যাব এস্ ট্যাক্সটিলফাবরিকেন ডা।”
“আমি বুঝিতে পারছি না,” মেরি বললো।
“পুরনো কাপড়ের কারখানাগুলো হবে,” বললো লোকটা। “অভাগাদের স্বর্গরাজ্য…আরো অনেকের জন্যেও। লস!” সে আদেশ করলো।
গাড়ি ছুটিয়ে চলতে লাগলো তারা।