পর্ব ১
পর্ব ২
পর্ব ৩

বর্ন আইডেন্টিটি – ৬

অধ্যায় ৬

যখনই তুমি কোনো চাপের মধ্যে থাকবে নিজের মনটাকে মুক্তভাবে ছেড়ে দেবে, যে চিন্তা এবং ছবি আসুক তোমার মধ্যে, আসতে দাও। কোনো ধরণের জোর ক’রে ভাবতে যেয়ো না। একটা স্পঞ্জ হয়ে যাও। সবকিছুর উপরে কিংবা কোনো কিছুর উপরেই মনোযোগ দিও না। তাহলে হয়তো নির্দিষ্ট কিছু তোমার মনে আপনা আপনিই এসে পড়বে।

গাড়ির পেছনের সিটে কুঁকড়ে প’ড়ে থেকে ডাক্তার ওয়াশবার্নের কথাগুলো মনে করলো বর্ন। কিছু নিয়ন্ত্রণ পুণরুদ্ধার করার চেষ্টা করছে সে। তার আগের আঘাতের জায়গাগুলোতে হাত দিয়ে মেসেজ করলো। ব্যথাটা এখনও আছে তবে আগের মতো অতো তীব্র নয়।

“তুমি আমাকে গাড়ি চালানোর কথা বলতে পারো না!” চিৎকার ক’রে মেরি বললো, “আমি জানি না আমি কোথায় যাচ্ছি। তুমি আমাকে আঘাতও করেছো।” এবার সে একটু নরম কণ্ঠে বললো, “এটা তো অপহরণ, গুণ্ডামি…এসব কিন্তু মারাত্মক ধরনের অপরাধ। তুমি এখন হোটেলের বাইরে আছো। এটাই তো তুমি চেয়েছিলে। এখন আমাকে যেতে দাও। আমি কাউকে কিছু বলবো না। তোমাকে কথা দিলাম।”

“মানে, আমার কাছে প্রতীজ্ঞা করছো?”

“হ্যা!”

“আমিও তো তোমার কাছে প্রতীজ্ঞা করেছিলাম, আবার সেটা ভেঙেছিও। তুমিও তাই করতে পারো।”

“তোমার ব্যাপার আলাদা। আমি সেটা করবো না। আমাকে কেউ হত্যা করার চেষ্টা করছে না, হায় ঈশ্বর! প্লিজ!”

“গাড়ি চালাতে থাকো।”

একটা জিনিস তার কাছে খুব পরিস্কার। খুনিরা তাকে তার সুটকেসটা ফেলে পালাতে দেখেছে। সেই সুটকেস থেকে তারা নিশ্চিত কিছু তথ্য জানতে পারবে : সে জুরিখের বাইরে চলে যাচ্ছে। সুইজারল্যান্ডের বাইরে। বিমানবন্দর আর রেল স্টেশনগুলোতে কড়া নজরদারী করা হবে। আর খুনির কাছ থেকে সে যে গাড়িটা নিয়ে পালাচ্ছে সেটাও খোঁজা হবে।

বিমান বন্দর অথবা রেল স্টেশনে যেতে পারবে না। এই গাড়িটা ছেড়ে তাকে অন্য আরেকটা গাড়িও যোগাড় করতে হবে। তার কাছে অবশ্য টাকা-পয়সা আছে। সঙ্গে রয়েছে ১০০,০০০ সুইস ফ্রাঁ আর ১৬০০ ফরাসি ফ্রাঁ; সুইস টাকাগুলো আছে পাসপোর্ট কেসে। ফরাসি নোটগুলো মানিব্যাগে। যে মানিব্যাগটা মারকুইসের কাছ থেকে নিয়েছে সে। এই টাকা দিয়ে খুব সহজেই প্যারিসে চলে যেতে পারবে।

প্যারিস কেন? যেনো এই শহরটা চুম্বকের মতো তাকে কেবলই টানছে।

তুমি অসহায় নও। তুমি তোমার পথ খুঁজে নেবে…নিজের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে অনুসরণ করো, যুক্তিসঙ্গতভাবে।

প্যারিসে।

“তুমি কি এর আগে কখনও জুরিখে এসেছিলে?” সে তার জিম্মিকে জিজ্ঞেস করলো।

“কখনই না।”

“তুমি আমাকে মিথ্যে বলবে না, বলবে কি?

“বলার তো কোনো কারণ দেখছি না! দয়া ক’রে আমাকে যেতে দাও!”

“কতোদিন ধরে এখানে আছো?”

“এক সপ্তাহ। কনফারেন্সটা এক সপ্তাহের।”

“তাহলে তোমার সময় আছে, আমাকে একটু শহর ঘুরিয়ে দেখাও।”

“আমি হোটেল থেকে খুব একটা বের হই নি। সময় পাই নি।”

“বোর্ডে তোমাদের যে শিডিউল দেখেছি তাতে তোমাদের খুব একটা ব্যস্ততা তো দেখলাম না। পুরো দিনে মাত্র দুটো লেকচার।”

“তারা অতিথি বক্তা। দিনে দুটোর বেশি বক্তৃতা দেয় না। আমাদের কাজ হলো…বিভিন্ন দেশ থেকে আসা দশ থেকে পনেরো জন প্রতিনিধি নিয়ে ছোটো ছোটো কনফারেন্স করা।”

“তুমি কানাডা থেকে এসেছো?”

“আমি কানাডা গভর্নমেন্টের বোর্ড অব রেভেনুর ট্রেজারি বোর্ডে কাজ করি।”

“তাহলে তোমার “ডক্টর’ পদবীটা মেডিকেল ডাক্তারের নয়।”

“ইকোনোমিক্স। অক্সফোর্ডের পেমব্রুকের ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।”

“দারুণ ব্যাপার। খুশি হলাম।”

আচমকা একটু দৃঢ়ভাবে মেয়েটা বললো, “আমার বসেরা আমার সাথে রাতে যোগাযোগ ক’রে আমাকে না পেলে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেবে। তারা জুরিখ পুলিশকেও খবর দেবে।”

“আচ্ছা,” সে বললো। “তাহলে এ নিয়ে তো একটু ভাবতে হয়, তাই না?” বর্নের মনে হলো বিগত আধঘণ্টা ধরে এতো সব বিপদ আর মারামারির মধ্যেও মেরি তার পার্সটা হাতছাড়া করে নি। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বললো সে, “তোমার পার্সটা আমাকে দাও তো।”

“কি?” মেয়েটা দ্রুত এক হাত হুইল থেকে সরিয়ে পার্সটা হাতে নিয়ে নিলো যেনো জেসনের কাছ থেকে ওটা রক্ষা করছে সে।

সে তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলো মেয়েটার কাঁধের উপর দিয়ে। তারপর পেছন থেকেই পার্সটা খপ্ ক’রে ধরে বললো, “গাড়ি চালাও, ডক্টর।”

“তোমার কোনো অধিকার নেই…” সে আর কিছু বলতে পারলো না। বুঝতে পারলো, বলে কোনো লাভ নেই।

“আমিও জানি সেটা,” পার্সটা খুলতে খুলতে সে বললো। গাড়ির ছাদে রিডিং ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে ব্যাগের ভেতরটা দেখলো। পার্সের মালিকের মতোই পার্সটার ভেতরও সাজানো গোছানো। পাসপোর্ট, ওয়ালেট, চাবি এবং কিছু কাগজপত্র। সে নির্দিষ্ট একটা মেসেজ খুঁজে দেখলো। হলুদ রঙের একটা খাম ক্লার্ক তাকে দিয়েছিলো। হোটেলে। সে দেখেছে। ওটা খুঁজে পেয়ে বাতিটার কাছে তুলে ধরলো সে। এটা অটোয়া থেকে আসা একটা ক্যাবলগ্রাম।

দৈনিক রিপোর্ট দেয়াটা অগ্রাধিকারমূলক কাজ। ছুটি মঞ্জুর করা হলো। তোমার সাথে দেখা হবে ২৬ তারিখ বুধবার, বিমান বন্দরে। কল কোরো, অথবা ক্যাবল। লিঁও’র বেলে মুইয়ে’তে যেতে ভুলো না। খাবারগুলো অসাধারণ।
পিটার, ভালোবাসা রইলো।

জেসন ক্যাবলটা পার্সে রেখে ভেতর থেকে একটা ছোট্ট দেয়াশলাই বের করলো। ওটার গায়ে একটা নাম লেখা আছে, সেটা পড়লো সে : ক্রোনেনহেইল। একটা রেস্তোরাঁ। কিছু একটা ভাবিয়ে তুললো তাকে। সে জানে না সেটা কি। একটা রেস্তোরাঁর ব্যাপার, শুধু এটুকুই বুঝতে পারছে। দেয়াশলাইটা নিজের কাছে রেখে পার্সটা বন্ধ ক’রে সামনে ঝুঁকে সেটা ড্রাইভারের পাশের সিটে রেখে দিলো সে। “এটাই খালি দেখতে চেয়েছিলাম,” পেছনের সিটে আরাম ক’রে ব’সে দেয়াশলাইটা দেখতে দেখতে বললো বর্ন। “মনে হয় তুমি বলেছিলে অটোয়া থেকে একটা খবর এসেছে। সেটা দেখছি ঠিকই বলেছো। ছাব্বিশ তারিখ আসতে এখনও এক সপ্তাহের বেশি দেরি।”

“প্লিজ…”

একটা সাহায্যের আর্তনাদের মতো শোনালো। কথাটা শুনলেও কোনো জবাব দিলো না সে। পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা এই মেয়েটাকে তার প্রয়োজন আছে, একজন খোড়া লোকের তো ক্রাচের দরকার পড়ে, অথবা যে গাড়ি চালাতে সক্ষম নয় তার তো একজন ড্রাইভারও লাগে। তবে এই গাড়িটা নয়।

“গাড়ি ঘোরাও!” সে আদেশ করলো। “ক্যারিলিয়ন দুলাক’র দিকে ফিরে যাও।”

“হোটেলে?”

“হ্যা,” বললো সে। ঐ ছোট্ট দেয়াশলাইটার দিকেই চেয়ে আছে। “আমাদের অন্য আরেকটা গাড়ি লাগবে।”

“আমরা? না, তুমি এটা করতে পারো না! আমি আর কোথাও—” আবারো সে কথাটা পুরোপুরি বলতে পারলো না। তার আগেই হুইলটা ঘুরিয়ে গাড়িটা ঘুরিয়ে ফেললো। এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে হুইলটা শক্ত ক’রে ধরে রেখে নিজেকে নিয়ন্ত্ৰণ করার চেষ্টা করলো মেরি।

বর্ন দেয়াশলাই থেকে মুখ তুলে মেরির মাথার পেছনে তাকালো। তার লম্বা লাল চুল আলোতে ঝলমল করছে। আবারো তার অস্ত্রটা হাতে নিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে মেরির মাথার পেছনে তাক্ করলো সে। “আমার কথা বুঝতে পেরেছো। তুমি ঠিক তাই করবে যা আমি বলেবো। আমার কথা শুনলে অস্ত্রটা পকেটেই থাকবে! বুঝতেই তো পারছো, আমি জীবন বাঁচানোর জন্যে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। এই অস্ত্রটা ব্যবহার করতে আমি মোটেও দ্বিধা করবো না। আমি চাই তুমি সেটা বোঝো।”

“বুঝেছি।” তার জবাবটা এলো খুবই নিচু কণ্ঠে। মেয়েটার মুখ দিয়ে একটা নিঃশ্বাস বের হয়ে এলে পিস্তলের নলটা সরিয়ে ফেললো জেসন। সে সন্তুষ্ট।

তোমার মনটাকে মুক্ত করে দাও…দেয়াশলাইটা। এই ব্যাপারটা কি? তবে সেটা দেয়াশলাই সংক্রান্ত নয়। একটা রেস্তোরাঁ সংক্রান্ত—কিন্তু ক্রোনেনহেইল নয়। তবে সেটাও একটা রেস্তোরাঁ। খুবই ভারি বিম, মোমবাতি, আলো…বাইরে একটা ত্রিভুজ। সাদা পাথর আর কালো রঙের ত্রিভুজ। তিনটি?…তিনটি কালো ত্রিভুজ। ওখানে কেউ একজন ছিলো…সামনে তিনটি ত্রিভুজ আছে এমন একটা রেস্তোরাঁয়। ছবিটা একেবারে পরিস্কার, খুবই নিখুঁত…খুবই যন্ত্রণাদায়ক। সেটা কি? এরকম কোনো জায়গা কি আসলেই আছে?

নির্দিষ্ট কোনো বিষয় তোমার মনে আসতে পারে…

সেটাই কি এখন হচ্ছে? ওহ্, ঈশ্বর, আমি আর সহ্য করতে পারছি না!

কয়েকশ’ গজ দূর থেকেই হোটেল ক্যারিলিয়ন দুলাকের ঝলমলে বাতিগুলো দেখতে পেলো সে। নিজের পরিকল্পনাটা পুরোপুরি সেরে উঠতে পারে নি। তবে এখানে ফিরে আসার দুটো কারণ রয়েছে। খুনিরা আর ওখানে নেই। অন্যথায় বর্ন নিজেই নিজের তৈরি ফাঁদে পড়ে যাবে। সে দু’জন খুনিকে চেনে। কিন্তু তারা ছাড়া যদি আরো কেউ থেকে থাকে তো সে তাদের দেখে চিনতেও পারবে না।

হোটেলের বাম দিকে প্রধান পার্কিং এলাকাটা অবস্থিত। “গাড়ির গতি কমিয়ে দাও,” জেসন আদেশ করলো। “বাম দিকে রাখো।”

“এটা তো বের হবার পথ,” মেয়েটি প্রতিবাদের সুরে বললো। “আমরা ভুল পথে যাচ্ছি।”

“কেউ আসছে না, যাও! পার্কিংলটে ঢোকো, বাতিগুলো অতিক্রম করো।” হোটেলের প্রবেশদ্বারের সামনের দৃশ্যটা বলে দিলো কেন তাদেরকে কেউ লক্ষ্য করছে না। চারটা পুলিশের গাড়ি সেখানে জড়ো হয়েছে। এখনও গাড়িগুলোর ছাদে বাতি জ্বলছে। সে পোশাক পরা পুলিশ দেখতে পেলো। তাদের পাশে আছে হোটেলের কর্মচারীরা। আর চারপাশে লোকজনের ভীড়। তারা প্রায় সবাই হোটেলের গেস্ট। নানা রকম প্রশ্ন করছে তারা, কথা বলছে। যেসব লোক গাড়ি নিয়ে চলে গেছে তাদের তালিকা পরীক্ষা ক’রে দখা হচ্ছে।

মেরি গাড়িটা পার্কিংলট পেরিয়ে ডান দিকের একটা খালি জায়গায় এনে ইনজিন বন্ধ ক’রে সোজা সামনের দিকে চেয়ে রইলো।

“খুব সাবধানে থেকো,” বর্ন বললো। জানালাটার কাঁচ নামিয়ে দিলো সে। “আস্তে ক’রে দরজাটা খুলে বের হও, তারপর আমার পাশে থেকে আমাকে সাহায্য করো। মনে রাখবে জানালা খোলা আছে, আর অস্ত্রটা আমার হাতেই ধরা। গুলি কিন্তু একদম ব্যর্থ হবে না।” সে যেমনটি বললো মেয়েটি ঠিক তাই করলো, অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে। জেসন দরজা খুলে বের হয়ে এলো। নিজের ওজন এক পা থেকে আরেক পায়ে রাখলে পায়ের রক্ত সঞ্চালন ফিরে এলো। হাটতে পারবে এখন। ভালোভাবে নয় তবে একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, কিন্তু পারবে।

“তুমি কী করবে?” সেন জ্যাক নামের মেয়েটি জানতে চাইলো। যেনো জবাবটা শুনতে সে ভয় পাচ্ছে।

“দাঁড়াও। একটু পরে কেউ না কেউ একটা গাড়ি এনে পার্ক করবে এখানে। হোটেলে যাই ঘটে থাকুক না কেন এটা তো ডিনারের সময়। রিজার্ভেশন আগেই করা হয়েছে। বেশির ভাগই ব্যবসা সংক্রান্ত। ঐসব লোকেরা তাদের পরিকল্পনা বদলাবে না।”

“কোনো গাড়ি যদি আসে তো তুমি কিভাবে সেটা নেবে?” মেয়েটা থেমে গেলো। তারপর নিজেই জবাব দিলো প্রশ্নটার। “হায় ঈশ্বর, যে গাড়িটা চালাবে তুমি তাকে খুন করবে!”

মেয়েটার হাত ধরে ঝটকা মারলে মেয়েটা তার সাদা ফ্যাকাশে মুখটা সরিয়ে ফেললো। তাকে ভয়ের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করছে সে, কিন্তু বেশি করলে, বেশি ভয় দেখালে মেয়েটা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে। “যদি করতেই হয় তাই করবো, তবে আমি মনে করি না সেটা করার দরকার হবে। পার্কিং অ্যাটেন্ডেন্টরা গাড়িগুলো এখানে নিয়ে আসে। চাবিগুলো সাধারণত ড্যাশবোর্ডের উপরে অথবা সিটের নিচে রাখা থাকে। কাজটা খুবই সহজ হবে।”

একটা গাড়ির হেডলাইটের আলো এসে পড়লো তাদের উপর। তাদের দিকেই আসছে গাড়িটা।

ডাইনিং রুমের জন্যে রিজার্ভেশন…একটা রেস্তোরাঁ। জেসন তার সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছে। সময়টা কাজে লাগাবে সে।

গাড়ি থেকে অ্যাটেন্ডেন্ট বের হয়ে এলো চাবিটা সিটের নিচে রেখে। লোকটা তাদের সামনে দিয়ে যাবার সময় তাদের দিকে মাথা নাড়লো। কৌতূহল ব্যতীত নয়। বর্ন ফরাসিতে কথা বললো।

“এই ছেলে! হয়তো তুমি আমাদেরকে সাহায্য করতে পারো।”

“স্যার?” অ্যাটেন্ডেন্ট তাদের কাছে চলে এলো। তবে একটু সতর্কভাবে। হোটেলে যা ঘটেছে তাতে এরকম করাটা স্বাভাবিক।

“আমার খুব একটা ভালো লাগছে না, তোমাদের চমৎকার সুইস মদ একটু বেশি খেয়ে ফেলেছি মনে হয়।”

“বেশি খেলে এমনই হয়, স্যার,” ছেলেটি হেসে বললো, সে এখন একটু স্বস্তি পেলো মনে হচ্ছে।

“আমার বউ বলছিলো শহর ছাড়ার আগে একটু খোলামেলা জায়গায় যেতে।”

“ভালো আইডিয়া, স্যার।”

“ভেতরে কি এখনও হৈহল্লা চলছে নাকি? আমার মনে হয় না পুলিশের জামার উপর বমি ক’রে দেবার আগ পর্যন্ত আমাদেরকে বাইরে যেতে দেবে।”

“এখনও হট্টগোল চলছে, স্যার। সব জায়গাতেই পুলিশ আছে…আমাদেরকে বলা হয়েছে এ নিয়ে কোনো কথা বলতে না।”

“অবশ্যই। কিন্তু আমাদের একটা সমস্যা হয়ে গেছে। একজন সহকর্মী আজ বিকেলে ফ্লাই ক’রে এসেছে, আমাদের সাথে তার রেস্তোরাঁয় দেখা করার কথা, নামটা ভুলে গেছি। আমি সেখানে আগেও গেছি, কিন্তু নামটা ভুলে গেছি। সেটা কোথায় তাও জানি না। খালি মনে আছে রেস্তোরাঁটার সামনে ত্রিভুজ রয়েছে।”

“ওটা তো ড্রেই এলপেনহসার, স্যার। নামটা…খৃ শ্যালে। ফকেনস্ট্রাস সড়কের পাশেই।”

“হ্যা, তাই তো। এটাই তো! এখান থেকে ওখানে যেতে হলে…” বর্ন কথাটা শেষ করলো না। বেশি মদ খাওয়া লোকের পক্ষে এরকমটি করাই স্বাভাবিক।

“বাইরে বেরিয়ে বাম দিকে যান, স্যার। একশ’ মিটার যাবার পর ইউ-টার্ন নিয়ে একটা পাইয়ের কাছে এসে ডান দিকে মোড় নেবেন। সেটাই ফকেনস্ট্রাস। তারপর সিফেল্ড অতিক্রম করলেই রেস্তোরাঁটা দেখতে পাবেন। বিরাট বড় সাইনবোর্ড। সমস্যা হবে না।”

“ধন্যবাদ তোমাকে। এখন থেকে কয়েক ঘণ্টা পরে কি তোমাকে এখানে পাওয়া যাবে, মানে আমরা যখন ফিরে আসবো?”

“রাত দুটো পর্যন্ত আমি ডিউটিতে থাকবো, স্যার।”

“ভালো। তোমাকে একটু বখশিস দিতে হবে।”

“ধন্যবাদ, স্যার। আমি কি আপনার গাড়িটা এনে দেবো?”

“তুমি যথেষ্ট করেছো, ধন্যবাদ। আমার একটু হাটার দরকার।” ছেলেটা সেলুট দিয়ে হোটেলের ভেতরে চলে গেলে জেসন আর মেরি ছেলেটার রেখে যাওয়া গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলো। জেসন একটু খোঁড়াচ্ছে।

“তাড়াতাড়ি করো। চাবিটা গাড়ির সিটের নিচেই আছে।”

“তারা যদি আমাদের থামায় তখন কি করবে? ঐ অ্যাটেন্ডেন্ট ছেলে গাড়িটা চলে যেতে দেখলেই বুঝে যাবে ওটা চুরি করা হচ্ছে।

“আমার তাতে সন্দেহ আছে। আমরা যদি ঠিক সময়ে যেতে পারি তাহলে কোনো সমস্যা হবে না। মানে, সে যখন লোকজনের ভীড়ে ঢুকবে তখনই কাজটা করতে হবে।”

“ধরো সে দেখে ফেললো?”

“তাহলে আমি আশা করবো তুমি খুব দ্রুত গাড়িটা চালাবে।” মেয়েটাকে গাড়ির দরজার সামনে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বললো সে। “গাড়িতে ওঠো এবার।”

অ্যাটেন্ডেন্ট ছেলেটা ঠিকই দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে ছুটে আসতে লাগলো। পিস্তল হাতে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লো জেসন। এবার সে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলো। “ধ্যাত্তারিকা—চাবিটা নাও।”

“ঠিক আছে…আমি ভাবতেও পারছি না।”

“একটু বেশি ক’রে চেষ্টা করো।”

“হায় ঈশ্বর…” সিটের নিচে হাতরিয়ে চাবিটা খুঁজে পেলো মেরি।

“গাড়ি স্টার্ট করো, তবে আমার আদেশের আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।” পার্কিংলটের বাইরে থেকে গাড়ির হেডলাইটের আলো এসে পড়লে জেসন দেখলো সেটা। হয়তো অ্যাটেন্ডেন্ট সেই গাড়িটা পার্ক করার জন্যেই দৌড়ে আসছে। তবে কারণটা অন্যকিছুও হতে পারে। পার্কিংলটে দু’জন অজ্ঞাত লোককে দেখা যাচ্ছে। “চলো। দ্রুত। এখান থেকে এক্ষুণি বের হও।” মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা চালিয়ে এক্সিট পয়েন্ট দিয়ে বের হয়ে গেলো। লেকের পাড়ে আসতেই জেসন বললো, “আস্তে। একটু গতি কমাও।” তাদের সামনে একটা ট্যাক্সি ইউ-টার্ন করছে।

বর্ন নিঃশ্বাস বন্ধ ক’রে জানালা দিয়ে হোটেল ক্যারিলিয়ন দুলাকের প্রবেশ দ্বারটি দেখলো। হোটেল অ্যাটেন্ডেন্টের তড়িঘড়ি ক’রে ছুটে আসার আসল কারণটা বোঝা গেলো এবার। একজন পুলিশের সাথে একদল হোটেল গেস্টের তর্কাতর্কি হচ্ছে। সবাইকে লাইন বেঁধে চেক ক’রে ঢোকানোর ফলে কারো কারো দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাই এই বচসা।

“চলো,” জেসন বললো। “আমাদের কেউ দেখে নি।”

.

তিনটি ত্রিভূজ দেখে তার অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। রেস্তোরাঁর ছাদে বিশাল একটা সাইনবোর্ড। জার্মান ভাষায় লেখা : ড্রেই এলপেনহসার। রেস্তোরাঁর চারপাশে পুরনো দিনের কিছু সংকীর্ণ রাস্তা আছে। ওগুলোতে আধুনিক গাড়ি না চলে বরং ঘোড়ার গাড়ি চললেই বেশি মানাবে। পথের দু’ধারে সারি সারি ল্যাম্পবাতি। দৃশ্যটা দেখেই পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যায়, স্মৃতিভ্রষ্ট লোকটা ভাবলো, যার কিনা ভুলে যাবার মতো কোনো স্মৃতিই নেই।

তারপরও তার একটা স্মৃতি ছিলো, বৈচিত্রময় আর উদ্বেগের। তিনটি কালো ত্রিভূজ, ভারি ভারি বিম। মোমবাতি। সে ঠিকই ধরতে পেরেছিলো। এটা জুরিখের স্মৃতি। তবে অন্য এক জীবনের।

“আমরা এসে গেছি,” মেয়েটি বললো।

“আমি জানি।”

“এবার বলো কী করতে হবে!” এবার চিৎকার ক’রে বললো মেয়েটি। “আমরা তো ওটা পার হয়ে যাচ্ছি।”

“পরের মোড়ে যাও, বাম দিকে মোড় নিও। ব্লকটা ঘুরে এখানে ফিরে আসো আবার।”

“কেন?”

“হায়, আমি যদি সেটা জানতাম!”

“কি?”

“যা বলছি তাই করো।” কেউ ওখানে আছে…রেস্তোরায়। অন্য ছবিগুলো কেন আসছে না? আরেকটা ছবি। একটা মুখ।

তারা রেস্তোরাঁটা আরো দু’বার অতিক্রম ক’রে গেলো। দুই দম্পতি আর চারজন লোক ভেতরে ঢুকছে। বেরিয়ে আসছে এক লোক। দূর থেকে দেখে বোঝা গেলো হোটেলে ভীড় বাড়ছে। বেশিরভাগ জুরিখবাসী রাত আটটার বদলে সাড়ে দশটায় ডিনার করতে পছন্দ করে। সে ব’সে ব’সে অপেক্ষা করছে কিছু একটা তার মনের পর্দায় ভেসে উঠবে এই আশায়। কিন্তু কিছুই এলো না।

“গাড়িটা শেষ গাড়ির পেছনে নিয়ে রাখো। বাকি পথ আমরা হেটে যাবো।” মেয়েটা কোনো কথা না বলে তার কথামতো কাজ করলো। মেয়েটার দিকে তাকালো জেসন। তার চেহারার মধ্যে উদাস একটা ভাব চলে এসেছে। এই হোটেলের ভেতরে যাই ঘটুকনা কেন এই মেয়েকে তার শেষ কাজেও দরকার হবে। তাকে গাড়িতে ক’রে জুরিখের বাইরে দিয়ে আসবে সে। গাড়িটা থামলে মেয়েটা ইনজিন বন্ধ ক’রে চাবি বের ক’রে হাতে নিয়ে নিলো। তার ভাবভঙ্গী একেবারে ধীরস্থির। মেয়েটার হাত খপ্ ক’রে ধরে ফেললো জেসন। আবছায়া অন্ধকারের মধ্যেই তার দিকে তাকালো সে। মেয়েটার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আছে। জেসন মেয়েটার হাত থেকে চাবিটা নিয়ে নিলো।

“এগুলো আমার কাছে থাক,” বললো সে।

“সেটাই ভালো,” সে জবাবে বললো। তার বাম হাতটা তার পাশে দরজার দিকে।

“এখন বের হয়ে হুডের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে,” বর্ন বললো তাকে। “কোনো রকম বোকামী করবে না।”

“কেন করবো? তুমি তো তাহলে খুন করবে আমাকে।”

“ভালো!” জেসন ঘুরে তার পাশের দরজাটা খুলতেই মেয়েটা দরজা খুলে যেই না দৌড় দিতে যাবে অমনি খপ্ ক’রে তার জামার কলারটা ধ’রে ফেললো সে। এরকম কিছুর জন্যে জেসন প্রস্তুতই ছিলো। মেয়েটাকে টেনে গাড়িতে ঢুকিয়ে ফেললো সে। এবার তার চুলগুলো মুঠো ক’রে ধরলো। মাথাটা টেনে নিয়ে এলো তার মুখের কাছে।

“আমি আর এরকম করবো না!” চিৎকার ক’রে কেঁদে বললো মেরি। “আমি, কসম খেয়ে বলছি, আর করবো না!”

বর্ন দরজাটা কোনোরকম ধরতে পেরে সেটা বন্ধ ক’রে দিলো। বোঝার চেষ্টা করলো সে। ত্রিশ মিনিট আগে অন্য একটা গাড়িতে সে যখন মেয়েটার ঘাড়ে অস্ত্র ঠেকিয়েছিলো তখন মেয়েটা বমি করতে উদ্যত হয়েছিলো। এখন অবশ্য সেরকম কিছু হলো না। মেয়েটা এখন শত্রু হয়ে উঠেছে, একটা হুমকীও বটে। দরকার হলে সে মেয়েটাকে খুনও করতে পারবে, কোনো রকম আবেগ ছাড়াই তাকে খুন করতে পারবে সে, কারণ এটাই বাস্তবসম্মত কাজ হবে তার জন্যে।

“কিছু একটা বলো!” চাপা কণ্ঠে বললো মেয়েটি। কয়েক মুহূর্তের জন্যে তার সারা শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো। তার স্তন জোড়া কালো সিল্কের পোশাকের সাথে চেপে আছে। ওঠা নামা করছে নিঃশ্বাসের সাথে সাথে। মেয়েটা এবার আরেকটু ধাতস্থ হয়ে বললো, “আমি বললাম তো এটা আমি আর করবো না।”

“তুমি আবারো চেষ্টা করবে,” শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলো সে। “সময় আসবে যখন তুমি আবারো এরকম করার চেষ্টা করবে, তুমি মনে করবে তুমি সফল হবে। তবে মনে রেখো, আবার যদি চেষ্টা করো আমি তোমাকে খুন করবো। আমি এটা করতে চাই না। এরকম করার কোনো কারণও দেখি না। যদি না তুমি আমার জন্যে একটা হুমকী হয়ে ওঠো। আমি বের হবার আগেই তোমাকে ছেড়ে দেবো।”

“তুমি বলছো তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে,” মেয়েটা বললো। “কখন?”

“যখন আমি নিরাপদ বোধ করবো,” বললো সে।

“সেটা কখন হবে?”

“একঘণ্টা পরে। আমরা যখন জুরিখের বাইরে চলে যাবো, এবং সেখান থেকে অন্য কোথাও। কোথায় এবং কিভাবে যাবো তুমি সেটা জানবে না।”

“আমি কেন তোমাকে বিশ্বাস করবো?”

“তুমি করো কি করো না তাতে আমার কিছু যায় আসে না।” সে মেয়েটাকে ছেড়ে দিলো। “ঠিক হয়ে নাও। চোখ মুছে চুলটা ঠিক ক’রে নাও। আমরা ভেতরে ঢুকবো।”

“ওখানে কি?”

“হায়, সেটা যদি আমি জানতাম!” রেস্তোরাঁটার দিকে তাকিয়ে সে বললো।

“এ কথা তো তুমি আগেও বলেছো।”

মেয়েটার চোখে চোখ রেখে বললো সে, “আমি জানি। তাড়াতাড়ি করো।”

.

রেস্তোরাঁর ছাদে মোটা মোটা বিম। চেয়ার-টেবিলগুলো সব ভারি ভারি কাঠের। ডিপ বুথ আর মোমবাতি আছে সর্বত্রই। একজন একোর্ডিয়ান বাদক ক্রেতাদের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বাভারিয়ান সঙ্গীত বাজিয়ে চলছে।

বড় এই ঘরটা সে এর আগেও দেখেছে। ছাদের বিম, মোমবাতি আর ঘরের গুঞ্জনটাও তার মনের কোথাও ছাপ মারা আছে। অন্য আরেকটা জীবনে সে এখানে এসেছিলো। মাইতরে দ্য স্টেশনের সামনে এসে তারা দাঁড়ালে একজন ওয়েটার তাদেরকে অভ্যর্থনা জানালো।

“হাবেন সি এইনেন টিশ স্কন রিজার্ভিয়েট, মেইন হের?”

“রিজার্ভেশন? না, নেই। তবে আপনাদের অনেক নামডাক শুনেছি। আশা করি আমাদের জন্যে একটা বুথের ব্যবস্থা ক’রে দিতে পারবেন।”

“নিশ্চয়, স্যার। এখনও অতো কাস্টমার আসে নি। এখানে আসুন, প্লিজ।” কাছের একটা কর্নারের বুথে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো। টেবিলের মাঝখানে একটা মোমবাতি জ্বলছে।

জেসন মেরিকে ইশারা করলে সে ব’সে পড়লো।

“দেয়ালের পাশে বসো,” ওয়েটার চলে যাবার পর বললো সে। “মনে রেখো, আমার পকেটে পিস্তল আছে।”

“আমি তো বলেছি, আমি সে চেষ্টা করবো না।”

“আমিও আশা করি তুমি তা করবে না। একটা ড্রিংকের অর্ডার দাও। খাওয়াদাওয়া করার সময় আমাদের হাতে নেই।”

“আমি খেতে পারবো না।” মেয়েটা নিজের কাঁপতে থাকা হাতটা ধরে বললো। “সময় নেই কেন? তুমি কিসের জন্যে অপেক্ষা করছো?”

“আমি জানি না।”

“তুমি এ রকম কথা বলো কেন? ‘আমি জানি না।’ ‘হায়, যদি জানতাম।’ তুমি এখানে কেন এসেছো?”

“কারণ এর আগে আমি এখানে এসেছিলাম।”

“এটা কোনো জবাব হলো!”

“তোমার প্রশ্নের জবাব দেয়ার তো কোনো কারণ আমি দেখছি না।” একজন ওয়েটার এসে হাজির হলে মেরি মদ আর বর্ন স্কচের অর্ডার দিলো, তার দরকার কড়া মদ। রেস্তোরাঁর চারপাশে তাকিয়ে কিছু ভাবার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু কিছুই তার মনের পর্দায় ভেসে উঠলো না।

কিন্তু তারপরই চেহারাটা ঘরের মধ্যে দেখতে পেলো বর্ন। দরজার পাশে একটা বুথে ব’সে আছে। মোটাসোটা দেহের বড় মুখের মানুষটা। লোকটা জেসনের দিকে তাকাতেই বিস্ময় আর অবিশ্বাস তার চোখেমুখে ফুটে উঠলো। বর্ন মুখটা চেনে না। কিন্তু মুখটা তাকে চেনে। লোকটা তার ঠোঁটের কোণ মুছে ঘরের প্রতিটি টেবিলে চোখ ঘোরালো। তারপর আসতে লাগলো তাদের বুথের দিকেই।

“একজন লোক এখানে আসছে,” জেসন মোমবাতির শিখার ওপাশে বসা মেরিকে বললো। “মোটাসোটা এক লোক, আর সে খুব ভয় পেয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। কিছু বলো না। সে যা-ই বলুক না কেন, মুখ বন্ধ রাখবে। তার দিকে তাকাবেও না। একহাত তুলে মাথাটা সেই হাতের উপর রেখে আরাম করছো এমন ভাব করো। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকো, তার দিকে নয়।”

মেয়েটা অবাক হলেও তার কথা মতোই কাজ করলো। যদিও তার হাত কাঁপছে। তার ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে প্রশ্ন। তবে মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোলো না। জেসনই সেই অব্যক্ত প্রশ্নের জবাব দিলো।

“তোমার ভালোর জন্যেই বলছি,” বললো সে। “সে তোমাকে চিনে রাখুক তার কোনো দরকার নেই।”

মোটা লোকটা তাদের কাছে আসতেই জেসন মোমবাতিটা নিভিয়ে দিলে তাদের বুথটা একটু অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেলো। তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিচু আর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কথা বললো লোকটা।

“ডু লিয়েবার গট! তুমি এখানে এসেছো কেন? আমি তোমার কি করেছি যে, তুমি এরকম করলে?”

“এখানকার খাবার আমার খুব ভালো লাগে, তুমি সেটা জানো।”

“তোমার কি কোনো বোধশক্তি নেই? আমার একটা পরিবার আছে। বউ-বাচ্চা আছে। আমাকে যা বলা হয় আমি তাই করি। আমি তো তোমাকে খামটা দিয়ে দিয়েছি, ভেতরটা খুলেও দেখি নি, আমি কিছুই জানি না!”

“কিন্তু তোমাকে টাকা দেয়া হয়েছিলো, তাই না?” জেসন আন্দাজে বললো।

“হ্যা। তবে আমি কিছু বলি নি। আমাদের কখনও দেখা হয় নি। আমি তোমার বর্ণনা কখনও কারো কাছে দেয় নি। কাউকে কিছু বলি নি!”

“তাহলে তুমি এতো ভয় পাচ্ছো কেন? আমি তো কেবল ডিনার করতে এসেছি।”

“তোমাকে অনুরোধ করছি, এখান থেকে চলে যাও।”

“এখন কিন্তু আমি রেগে যাচ্ছি। ঠিক আছে, কারণটা তাহলে বলো।”

মোটা লোকটা তার কপালের ঘাম মুছে দরজার দিকে তাকিয়ে বর্নের দিকে ফিরলো। “অন্যেরা হয়তো এ নিয়ে কথা বলবে। তারা হয়তো তোমাকে চিনে ফেলবে। জেনে যাবে তুমি কে। পুলিশ অনেক ঝামেলা করেছে আমার সাথে, তারা সরাসরি আমার কাছেই আসবে।”

সেন জ্যাক মেরি তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো। জেসনের দিকে তাকিয়ে মুখ ফসকে ব’লে ফেললো সে, “পুলিশ… তারা তাহলে পুলিশ ছিলো!”

মেয়েটার দিকে কটমট ক’রে তাকালো বর্ন, তারপর মোটা নার্ভাস হওয়া লোকটার দিকে ফিরে বললো, “তুমি কি বলতে চাচ্ছো, পুলিশ তোমার বউ-বাচ্চার ক্ষতি করবে?”

“ঠিক তারা নয়—তুমি তো ভালো করেই জানো। তাদের আগ্রহের কারণে আমার পরিবারের কাছে অন্যেরাও আসবে। তোমাকে কতো জন খুঁজছে, মেইন হের? তারা কি করবে জানো না? তারা সব করতে পারে—বউ-বাচ্চার খুন তো কিছুই না। আমার জীবনের জন্যে বলছি। আমি কিছুই বলবো না। বলিও নি। তুমি চলে যাও।”

“তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করছো,” জেসন মদে চুমুক দিয়ে বললো।

“ঈশ্বরের দোহাই, এটা কোরো না!” লোকটা তাদের টেবিলের দিকে ঝুঁকে এলো। “তুমি চাচ্ছো আমি যেনো চুপ থাকি। কথা দিচ্ছি চুপ থাকবো। কথাটা ভারব্রেখারওয়েল্ট-এ ছড়িয়ে পড়বে। কেউ কোনো খবর পেলেই তারা জুরিখ পুলিশে খবর দেবে। পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। কয়েকটা দেশের পুলিশ ইন্টারপোলের মাধ্যমে এজন্যে তহবিল পাঠিয়েছে।” লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আবারো মুখ মুছলো হাত দিয়ে। “আমার মতো একজন লোক পুলিশের সাথে সম্পর্ক রেখে লাভবান হতে পারে, তারপরও আমি কিছুই করি নি। সবই গোপন রেখেছি!”

“অন্য কেউ কি করেছে? আমাকে সত্যি কথা বলো। তুমি মিথ্যে বললে আমি বুঝে ফেলবো।”

“আমি কেবল চারনাককে চিনি। তার সাথেই কেবল আমার কথা হয়েছে, সে স্বীকার করেছে তোমাকে নাকি দেখেছে সে। কিন্তু তুমি তো সেটা জানোই। খামটা তার মাধ্যমেই আমার কাছে এসেছিলো। সে কখনও কিছু বলে নি।”

“চারনাক এখন কোথায়?”

“যেখানে সে সবসময় থাকে। লয়েনস্ট্রাসে তার ফ্ল্যাটে।”

“সেখানে আমি কখনও যাই নি। নাম্বারটা যেনো কতো?”

“তুমি কখনও যাও নি?…” লোকটা চোখ কুচকে তাকালো। “তুমি কি আমাকে পরীক্ষা করছো?”

“প্রশ্নের উত্তর দাও।”

“৩৭ নাম্বার। তুমি তো জানোই, যেমন জানি আমি।”

“তাহলে তো আমি তোমাকে পরীক্ষাই করছি। চারনাককে খামটা কে দিয়েছিলো?”

লোকটা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। “সেটা তো আমার জানা কথা নয়। কখনও জানার চেষ্টাও করি নি আমি।”

“তুমি কৌতূহলীও হও নি কখনও?”

“অবশ্যই না। একটা ছাগল তো আর স্বেচ্ছায় নেকড়ের গুহায় ঢুকতে যাবে না।”

“ছাগলেরা কিন্তু নিখুঁত গন্ধ পায়।”

“তারা খুব সতর্কও হয়, মেইন হের। কারণ নেকড়েরা হয় প্রচণ্ড ক্ষিপ্র আর আক্রমণাত্মক হয়। এক দৌড়েই শেষ হয়ে যাবে সে। ছাগল কখনও নেকড়ের সাথে পারে না।”

“খামের ভেতর কি ছিলো?”

“বললাম তো, আমি সেটা খুলি নি।”

“কিন্তু তুমি জানো তাতে কি ছিলো?”

“আমার ধারণা, টাকা ছিলো।”

“তোমার ধারণা?”

“ঠিক আছে। টাকা। প্রচুর পরিমাণের টাকা ছিলো। এর যদি কোনো অন্যথা হয়ে থাকে, তবে তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। এবার দয়া ক’রে এখান থেকে চলে যাও!”

“শেষ একটা প্রশ্ন।”

“আচ্ছা করো। তারপরই চলে যেয়ো।”

“টাকাগুলো কিসের জন্যে ছিলো?”

মোটা লোকটা বর্নের দিকে চেয়ে রইলো, তার নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে, এখন। কপালে ঘামও দেখা গেলো আবার। “তুমি আমাকে ফাঁদে ফেলছো, মেইন হের। তবে আমি তোমাকে বিমুখ করবো না। এটাকে এক বেঁচে যাওয়া তুচ্ছ ছাগলের সাহস বলতে পারো। আমি প্রতিদিন তিনটি ভাষায় সংবাদপত্র পড়ি। ছয় মাস আগে এক লোক খুন হয়েছিলো। তার হত্যার খবরটা ঐসব পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার খবর হয়েছিলো।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *