পর্ব ১
পর্ব ২
পর্ব ৩

বর্ন আইডেন্টিটি – ৫

অধ্যায় ৫

লিফটের দরজা বন্ধ হতে শুরু করলো। ওয়্যারলেস হাতে লোকটা ইতিমধ্যেই লিফটের ভেতরে ঢুকে পড়েছে, অস্ত্র হাতে তার সঙ্গী বন্ধ হতে থাকা দরজার মাঝখানে কাঁধটা ঢুকিয়ে দিলো। তার হাতের অস্ত্রটা বর্নের মাথার দিকে তাক্ করা।

হঠাৎ ভয় পেয়ে জেসন ডান দিকে ঝুঁকে গেলো, তারপর আচমকা কোনো রকম পূর্বসতকর্তা ছাড়াই বাম পা’টা শূন্যে তুলে হাটু দিয়ে অস্ত্র ধরা লোকটার হাতে আঘাত করলো সে। এর ফলে লোকটা একটু পেছন দিকে হেলে পড়লে অস্ত্রটা একটু উপরে উঠে গেলো। শোনা গেলো দুটো ভোঁতা গুলির শব্দ। দরজার ফাঁক দিয়ে লিফটের ছাদের মোটা কাঠে গিয়ে বিঁধলো গুলি দুটো। এবার এক ঝটকায় ঘুরে দ্বিতীয় লোকটার পেটে কাঁধ দিয়ে সজোরে আঘাত করে বসলো বর্ন। এক হাতে ওয়্যারলেস ধরা লোকটাকে কাঁধে তুলে চেপে ধরলো লিফটের দেয়ালে। হাতের ওয়্যারলেসটা ছিকে মেঝেতে পড়ে গেলে ওটা থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এলো।

“হেনরি? ক্যভা? কুয়েসে কুইজে পাসি?”

জেসনের মনের পর্দায় ভেসে উঠলো আরেকজন ফরাসি লোকের ছবি। একেবারে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত, চোখেমুখে অবিশ্বাসের ছাপ। চব্বিশটা ঘণ্টা আগে রুই সারাসিনের লো বুক দ্য মার-এর ঘটনা সেটি। সেই লোকটা জুরিখে মেসেজ পাঠাতে কোনো সময়ই নষ্ট করে নি। তারা যাকে মৃত ভেবেছিলো সে বেঁচে আছে। খুব ভালোভাবেই বেঁচে আছে। তাকে খুন করো!

বর্ন তার সামনের লোকটাকে ফরাসিতেই বললো। “কতোজন এসেছো? কোথায় আছে তারা?”

“তুই নিজেই খুঁজে বের কর্, শুয়োরের বাচ্চা!”

লিফটটা দোতলার লবির মাঝামাঝি এসে পড়েছে। জেসন লোকটার কান প্রায় ছিঁড়েই ফেললো। তার মাথাটা দেয়ালে সজোরে আঘাত করলে ফরাসি লোকটা চিৎকার দিয়ে ব’সে পড়লো মেঝেতে। বর্ন তার হাঁটু দিয়ে লোকটার বুকে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করলে লোকটার হোলস্টার টের পেলো। ওভারকোটটা এক ঝটকায় দু’হাতে খুলে বগলের নিচ থেকে হোলস্টারে রাখা ছোটো পিস্তলটা হাতে তুলে নিলো সে। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ে গেলো, কেউ এই লিফটের স্ক্যানারটা বন্ধ ক’রে রেখেছে। কোয়েনিগ। মনে পড়লো তার। লোকটার হা-করা মুখের ভেতরে পিস্তলটা ঢুকিয়ে দিলো। “আমাকে বলো, না হলে তোমার মাথার খুলি উড়ে যাবে!” লোকটা জিভ দিয়ে ঠেলে নলটা বের ক’রে দিলে জেসন অস্ত্রটা তার গালে ঠেকালো।

“দু’জন। একজন লিফটের পাশে, অন্যজন নিচের রাস্তায়, গাড়ির কাছে।”

“কি ধরনের গাড়ি?”

“পিয়াজিও।”

“রঙ?” লিফটটা ধীরগতির হয়ে থামতে যাচ্ছে।

“বাদামী।”

“লবিতে থাকা লোকটা, সে কি রঙের পোশাক পড়েছে?”

“আমি জানি না।”

জেসন অস্ত্রটা এবার লোকটার মাথায় ঠেকালো। “তোমাকে জানতেই হবে!”

“কালো রঙের কোট!”

লিফট থেমে গেলে বর্ন ফরাসি লোকটাকে তার নিজের পায়ে দাঁড় করালো। দরজা খুলে যেতেই বাম দিক থেকে এগিয়ে এলো কালো রঙের রেইনকোট আর অদ্ভুত এক গোল্ডরিমের চশমা পরা এক লোক। চশমার পেছনে থাকা চোখ জোড়া পরিস্থিতি বুঝে ফেললো সঙ্গে সঙ্গে। ফরাসি লোকটার গাল বেয়ে রক্ত পড়ছে। পকেটে ঢোকানো হাতটা যখন বের হলো দেখা গেলো সেই হাতে আরেকটা সাইলেন্সার লাগানো অটোমেটিক পিস্তল। সেটা তাক্ করলো মার্সেই থেকে আসা লোকটার দিকে। জেসন ফরাসি লোকটাকে দরজার সামনে ঠেলে দিতেই পরপর তিনটি ভোঁতা শব্দ শোনা গেলো। চিৎকার ক’রে উঠলো ফরাসি লোকটি, তার হাত দুটো শেষবারের মতো উঠলো বাঁধা দেবার জন্যে। একটু পিছিয়ে মার্বেল ফ্লোরে পড়ে গেলো সে। গোল্ডরিম চশমা পরা লোকটার ডান পাশে থাকা এক মহিলা চিৎকার দিয়ে উঠলো। তার সঙ্গে যোগ দিলো আরো কয়েকজন। তারা প্রাণপণে পুলিশকে ডাকতে শুরু ক’রে দিলো!

বর্ন জানতো ফরাসি লোকটার কাছ থেকে নেয়া রিভলবার সে ব্যবহার করতে পারবে না। এটার কোনো সাইলেন্সার নেই। গুলির শব্দ হলে সে ধরা প’ড়ে যাবে। অস্ত্রটা কোটের পকেটে ঢুকিয়ে ফেললো সে। চিৎকাররত মহিলাকে পাশ কাটিয়ে লিফটম্যানের ইউনিফর্মের কাঁধটা খামচে ধরলো। অস্ত্র হাতে কালো রেইনকোর্ট পরা খুনির দিকে ছুড়ে মারলো বিস্মিত হতভম্ব লোকটাকে।

জেসন মূল প্রবেশদ্বারের কাঁচের দরজা দিয়ে বের হয়ে যাবার সময় লবিতে হৈহট্টগোল আর ভীতিকর অবস্থাটা চরমে পৌঁছালো। যে লোকটা আধ ঘণ্টা আগে জেসনকে প্রথম অভ্যর্থনা জানিয়ে ছিলো ফরাসি ভাষায়, দেয়ালে রাখা একটা ফোনে চিৎকার ক’রে কী যেনো বলছে সে। তার ঠিক পাশেই পোশাক পরা এক রক্ষী অস্ত্র হাতে দরজার সামনে বাঁধা দিতে উদ্যত হলো। হৈহট্টগোলের মধ্যেও সবার চোখ তার দিকে। বের হওয়াটা মুহূর্তেই একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ন রক্ষীর চোখের দিকে তাকালো না। টেলিফোনে কথা বলতে থাকা লোকটার দিকে তাকালো সে।

“গোল্ডরিম চশমা পরা লোকটা!” চিৎকার ক’রে বললো বর্ন। “সে-ই, আমি দেখেছি তাকে!”

“কি? আপনি কে?

“আমি ওয়ালথার এপফেলের বন্ধু! আমার কথা শোনো! ঐ যে, কালো রেইনকোট আর গোল্ডরিম চশমা পরা লোকটা!”

আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা কয়েক হাজার বছরেও বদলায় না। একজন উচ্চ পদস্থ অফিসারের নাম উল্লেখ করাতে দ্রুত কাজ হলো।

“হের এপফেল!” লোকটা এবার রক্ষীর দিকে ফিরলো। “তুমি তার কথা শুনেছো! গোল্ডরিম চশমা পরা লোকটা।”

“জি, স্যার!” রক্ষী সামনের দিকে ছুটে গেলো।

জেসন আস্তে ক’রে কাঁচের দরজা দিয়ে বের হয়ে পেছনে ফিরে বুঝতে পারলো তাকে দৌড় দিতে হবে, কিন্তু জানে রাস্তায় যদি গাড়ির কাছে কেউ থেকে থাকে তবে তাকে দৌড়াতে দেখলে চিনে ফেলবে, হয়তো তার মাথায় গুলি করবে সে।

রক্ষী কালো রেইনকোট পরা লোকটাকে অতিক্রম ক’রে দৌড়ে চলে গেলো। লোকটা তার চারপাশের হৈহট্টগোল আর লোকজনের ছোটাছুটির মধ্যেও খুব ধীরে সুস্থে হাটছে। কোনো চশমা প’রে নেই এখন। মূল প্রবেশ পথের দিকে এবার পা বাড়ালো সে, বর্নের পেছন পেছন। হাটার গতিও বাড়িয়ে দিয়েছে।

বাইরের ফুটপাতে হৈ হট্টগোলটা জেসনকে রক্ষা করলো। ব্যাংকের ভেতরের অবস্থা বাইরে চাউড় হয়ে গেছে। কয়েকটা পুলিশের গাড়ি ব্যাংকের দিকে ছুটে আসছে সাইরেন বাজিয়ে।

ডান দিকে মোড় নিয়ে লোকজনের ভীড়ে মিশে গেলো জেসন। একটা দোকানের সামনে এসে আশ্রয় নিলো সে। মোড়ে রাখা গাড়িটা তার টার্গেট। সে পিয়াজিও গাড়িটা দেখতে পেলো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকেও। তারও একটা হাত ওভারকোটের পকেটে ঢোকানো। পনেরো সেকেন্ডের মধ্যেই পিয়াজিও গাড়ির ড্রাইভার কালো রেইনকোর্ট পরা লোকটার সাথে যোগ দিলো। এবার গোল্ডরিম চশমাটা পরে নিজের দৃষ্টিটা ঠিক ক’রে নিলো সে। লোক দু’জন সামনে এগোতে এগোতে চারপাশে তাকাচ্ছে। বিশেষ ক’রে ব্যানহফস্ট্রাস ব্যাংকের দিকেই তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।

তাদের এই বিভ্রান্ত হওয়াটা বুঝতে পারলো বর্ন। সে ব্যাংকের কাঁচের দরজা দিয়ে বের হবার সময় কোনো রকম ভয়ার্ত ছিলো না। নির্বিকারভাবে বের হয়ে লোকজনের সাথে মিশে গেছে। তাই পিয়াজিও’র ড্রাইভার তাকে দেখে নি, চিনতে পারে নি।

গোল্ডরিম চশমা পরা লোকটা তার চশমা খুলে পিয়াজিও গাড়ির জানালার ভেতর ছুড়ে ফেলতেই ঘটনাস্থলে পুলিশের প্রথম গাড়িটা এসে হাজির হলো। সে ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তেই গাড়িতে ব’সে ইনজিন স্টার্ট ক’রে দিলো ড্রাইভার। এরপর খুনি যে কাজটা করলো সেটা জেসন কোনোভাবে কল্পনাও করতে পারে নি। ব্যাংকের কাঁচের দরজার সামনে জড়ো হওয়া পুলিশের যে দলটা ব্যাঙ্কের ভেতরে যেতে উদ্যত তাদের সাথে যোগ দিলো সে।

বর্ন দেখতে পেলো পিয়াজিও গাড়িটা ঘটনাস্থল থেকে চলে যাচ্ছে। আশেপাশের সব লোক আস্তে আস্তে ব্যাংকের সামনে জড়ো হতে লাগলো। কৌতুহলী হয়ে ব্যাংকের ভেতরে উঁকি মারছে তারা, কথা বলছে একে অন্যের সাথে।

একজন পুলিশ অফিসার বেরিয়ে এসে কৌতূহলী লোকজনদেরকে সরিয়ে দিতেই একটা অ্যাম্বুলেন্স ছুটে এলো ঘটনাস্থলে। অ্যাম্বুলেন্সটা এসে থামলো ঠিক যেখানটায় পিয়াজিওটা ছিলো। জেসন আর দেখলো না। তাকে ক্যারিলিয়ন দুলাকে গিয়ে সব কিছু গোছাতে হবে। জুরিখ ছাড়তে হবে। সুইজারল্যান্ড ছাড়তে হবে। যেতে হবে প্যারিসে।

প্যারিস কেন? সে কেন তার টাকা-পয়সা প্যারিসে ট্রান্সফার করলো? এই কথাটা তার তখন মনে হয় নি যখন সে এপফেলের অফিসে ব’সে ছিলো। সবই একটা ঘোরের মধ্যে করা হয়েছে। তার সহজাত প্রবৃত্তি এই কাজটা করিয়েছে। যেনো প্যারিস কোনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। কেন?

আবারো, সময় নেই…সে দেখলো অ্যাম্বুলেন্সের ক্রু’রা একটা স্ট্রেচার নিয়ে ব্যাংকের ভেতর থেকে বের হয়ে আসছে। একটা দেহ, মাথা ঢাকা, তার মানে মারা গেছে। সে কিছুই বুঝতে পারলো না।

রাস্তার মোড়ে একটা ট্যাক্সি দেখতে পেয়ে দৌড়ে গেলো জেসন। তাকে জুরিখ থেকে পালাতে হবে। মার্সেই থেকে একটা খবর পাঠানো হয়েছে, মৃত লোকটি এখনও বেঁচে আছে। জেসন বর্ন বেঁচে আছে। তাকে হত্যা করো। জেসন বর্নকে হত্যা করো!

হায় ঈশ্বর, কেন?

.

সে আশা করেছিলো ক্যারিলিওন দুলাকের সহকারী ম্যানেজার ফ্রন্ট ডেস্কেই থাকবে। কিন্তু সে ওখানে নেই। তারপর বুঝতে পারলো। লোকটার নাম কিস্টোসেল? হ্যা, স্টোসেল। একটা নোট লিখতে হবে। তার আচকা চলে যাওয়ার জন্যে কোনো ব্যাখ্যার দরকার নেই। পাঁচশ’ ফ্রাঁ খুব সহজেই কাজটা ক’রে দেবে। স্টোসেলকে এই প্রস্তাবটাই দেবে সে।

নিজের ঘরে এসে তার শেভিং যন্ত্রপাতিগুলো একটা সুটকেসে রেখে ফরাসি লোকটার কাছ থেকে নেয়া পিস্তলটা পরীক্ষা ক’রে ডেস্কে ব’সে হের স্টোসেলের কাছে একটা নোট লিখলো। তাতে একটা বাক্য যোগ করলো, যা খুব সহজেই তার ভেতর থেকে চলে এসেেেছ–একেবারে সহজে।

…আমি আপনার সাথে খুব শীঘ্রই যোগাযোগ করবো, আমার পরিচিত কেউ মেসেজ দিয়ে গেলে সেটা আমাকে পাঠিয়ে দেবেন। আমি আপনার উপর আস্থা রাখছি, আপনি তাদের দিকে লক্ষ্য রাখবেন, তাদেরকে আমার হয়ে অভ্যর্থনা জানাবেন।

যদি তথাকথিত ট্রেডস্টোন সেভেনটি-ওয়ান থেকে কোনো রকম যোগাযোগ হয় তো সে সেটা জানতে চাইবে।

সে খামের ভেতর পাঁচশ’ ফ্রাঁর একটা নোট ঢুকিয়ে খামের মুখ বন্ধ ক’রে সুটকেসটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে হলওয়ে দিয়ে লিফটের কাছে চলে এলো। লিফটের সামনে চারজন আছে। একটা বোতাম চেপে পেছনে তাকালো সে। গেইমেনশেফট ব্যাংকের কথাটা মনে পড়ে গেলো তার। একটা বেল বাজলে তৃতীয় লিফটটার বাতি জ্বলে উঠলো। চমৎকার। তাকে যতো দ্রুত সম্ভব এয়ারপোর্টে যেতে হবে। জুরিখ থেকে, এই সুইজারল্যান্ড থেকে তাকে পালাতে হবে। তার খবরটা জায়গামতো পৌঁছে গেছে।

লিফটের দরজাটা খুলে গেলো। দু’জন লোক এক লাল চুলের মেয়ের দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তারা তাদের মধ্যে কথাবার্তা থামিয়ে নতুন আগতকে মাথা নেড়ে আমন্ত্রণ জানালো। সুটকেসটার দিকে তাকিয়ে একটু সরে দাঁড়ালো, তারপর দরজাটা বন্ধ হতেই আবার কথা বলতে শুরু করলো তারা। তাদের বয়স হবে মধ্য ত্রিশ, ফরাসিতে কথা বলছে। মেয়েটা পালাক্রমে দু’জন পুরুষের দিকে তাকাচ্ছে আর হাসছে। খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে তাদেরকে।

“আগামীকালের কনফারেন্সের পর তুমি তাহলে দেশে ফিরে যাচ্ছো?” বাম দিকের লোকটা জানতে চাইলো।

“আমি নিশ্চিত নই। অপেক্ষা করছি, দেখি অটোয়া থেকে কি বলে তারা,” মেয়েটি জবাব দিলো। “লিওঁতে আমার আত্মীয়স্বজন আছে; তাদের সঙ্গে দেখা করতে পারলে ভালোই লাগতো।”

“এটা অসম্ভব,” ডান দিকের লোকটা বললো। “একদিনে এই কনফারেন্সের সারসংক্ষেপ করার জন্যে স্টিয়ারিং কমিটিকে দশজন লোক খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের সবাইকে আরো এক সপ্তাহ থাকতে হবে এখানে।”

“ব্রাসেলস্ এটা অনুমোদন করবে না,” প্রথমজন হেসে বললো। “হোটেলটা খুবই ব্যয়বহুল।”

“তাহলে যেভাবেই পারি অন্য কোথাও চলে যাই,” দ্বিতীয়জন মেয়েটির দিকে চোখ টিপে বললো। “আমরা অপেক্ষা করছি তুমি ঠিক এই কাজটাই করো, তাই না?”

“তুমি একটা বদ্ধ উন্মাদ,” মেয়েটি বললো। “তোমরা দু’জনেই পাগল, এটাই আমার সর্বশেষ সিদ্ধান্ত।”

“তুমি তা নও, মেরি,” প্রথমজন বললো। “মানে পাগল। গতকালের তোমার প্রেজেন্টেশনটা ছিলো অসাধারণ।”

“সেটা এমন কোনো আহামরি কিছু ছিলো না। রুটিনমাফিক কাজ, একেবারেই বিরক্তিকর।”

“না, না!” দ্বিতীয় জন ভিন্নমত পোষণ করলো। “খুবই দারুণ ছিলো। আমি তো একবর্ণও বুঝতে পারি নি। তবে মনে রেখো, আমারও কিছু প্রতিভা আছে।”

“পাগলামী…”

লিফটটা থামতে শুরু করলে প্রথম লোকটা আবারো কথা বললো। “চলো, হলের পেছনে গিয়ে বসি। আমরা বেশ দেরি ক’রে ফেলেছি, বার্তেনেলি লেকচার শুরু করে দিয়েছে। অবশ্য এতে খুব কোনো কিছু হবে না। তার চক্রাকারে প্রয়োগ করার তত্ত্বটি বার্জিয়ার অনুদানের টাকার সাথে ওঠানামা করে।”

“তার আগে,” মেয়েটি হাসতে হাসতে বললো। “সিজারের ট্যাক্স। যদি না সেটা পুনিকের যুদ্ধ হয়ে থাকে।”

“তাহলে পেছনেই যাচ্ছি,” মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়ে দ্বিতীয় লোকটি বললো। “ওখানে গিয়ে আমরা ঘুমাতে পারি। সে স্লাইড প্রজেক্টর ব্যবহার করে; খুবই অন্ধকার থাকবে।”

“না, তোমরা দু’জন যাও, আমি তোমাদের সাথে কিছুক্ষণ পরে যোগ দিচ্ছি। আমাকে কিছু টেলিগ্রাম পাঠাতে হবে, আর এক্ষেত্রে আমি টেলিফোন অপারেটরকে মোটেও বিশ্বাস করি না।” দরজা খুলে গেলে তিনজন চলে গেলো। দু’জন একসাথে লবির দিকে গেলেও মেয়েটি চলে গেলো ফ্রন্ট ডেস্কের কাছে। বর্ন চললো তার পেছন পেছন। কয়েক ফিট দূরে একটা সাইনবোর্ড উদাস হয়ে পড়তে লাগলো সে।

স্বাগতম :
ষষ্ঠ বিশ্ব অর্থনৈতিক কনফারেন্সের সদস্যগণকে
আজকের আলোচ্যসূচী :
বেলা ১ টায় : মাননীয় জেসন ফ্রেজিয়ার, এম.পি ইউনাইটেড কিংডম।
সুট : ১২
সন্ধ্যা ৬টায় : ড. ইউজিনো বার্তেনেলি,
ইউনিভার্সিটি অব মিলান, ইতালি।
সুট : ৭
রাত ৯টায় : চেয়ারম্যানের বিদায়ী ডিনার।
হসপিটালিটি সুট :

“রুম ৫০৭। অপারেটর বললো আমার জন্যে নাকি একটা ক্যাবলগ্রাম এসেছে।”

ইংরেজি। লালচে চুলের মেয়েটি এখন তার পাশে কাউন্টারের সামনে এসে ইংরেজিতে কথা বলছে। কিন্তু মেয়েটি তো বলেছিলো ‘অটোয়া থেকে খবরের জন্যে অপেক্ষা করছে সে।’ তাহলে সে একজন কানাডিয়ান।

ডেস্ক ক্লার্ক শ্লটগুলো চেক্ ক’রে ক্যাবলটা নিয়ে ফিরে এলো। “ড. সেন জ্যাক?” সে জানতে চাইলো খামটা হাতে নিয়ে।

“হ্যা। ধন্যবাদ।”

ক্লার্ক বর্নের দিকে ফিরতেই মেয়েটি ঘুরে খামটা খুলে ফেললো। “জি, স্যার?”

“আমি এই নোটটা হের স্টোসেলের জন্যে রেখে যেতে চাচ্ছি,” সে ক্যারিলিয়ন দুলাকের খামটা কাউন্টারে রেখে দিয়ে বললো।

“হের স্টোসেল আগামীকাল সকাল ছয়টার আগে ফিরবেন না, স্যার। বিকেল চারটায় তিনি চলে যান। আমি কি আপনার সাহায্যে আসতে পারি?”

“না, ধন্যবাদ শুধু এটা তাকে দিলেই চলবে।” এরপরই জেসনের মনে পড়ে গেলো : এটা জুরিখ। “তেমন জরুরি কিছু না,” সে আরো বললো। “তবে আমার জবাব পাওয়ার দরকার আছে। সকালে দিলেই হবে।”

“অবশ্যই, স্যার।”

বর্ন সুটকেসটা হাতে নিয়ে লবিটা অতিক্রম করতে লাগলো। হোটেলের বাইরে কয়েকটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। সূর্য ডুবে গেছে এখন। জুরিখে রাত নেমেছে। এখনও এখান থেকে ইউরোপের যেকোনো জায়গায় যাওয়ার জন্যে ফ্লাইট রয়েছে। মধ্যরাত পর্যন্ত এটা থাকবে…

হাটা থামিয়ে দিলো সে। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। যেনো সমস্ত শরীর জুড়ে এক রকম অবশ একটা ভাব বিরাজ করছে। কাঁচের দরজার ওপাশে যা দেখতে পেয়েছে তা একেবারেই অবিশ্বাস্য। বাইরে দাঁড় করানো ট্যাক্সিওয়ালার সামনে বাদামী রঙের পিয়াজিও গাড়িটা এসে থেমেছে। এবার দরজা খুলে একজন লোক বেরিয়ে এলো—কালো রেইন কোট আর গোল্ডরিম চশমা পরা এক খুনি। অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো আরেক জন লোক, তবে এই লোকটা গাড়ির ড্রাইভার নয়। আরেকজন খুনি। সেও রেইনকোট পরা। বড় পকেটটাতে একটা শক্তিশালী অস্ত্র আছে বোঝাই যাচ্ছে। এই লোকটা গেইমেনশেফট ব্যাংকের রিসেপশনরুমে বসেছিলো। এই লোকটাই সাইলেন্সার লাগানো একটা পয়েন্ট ৩৮ রিভলবার বের ক’রে দুটো বুলেট ছুড়ে দিয়েছিলো তার মাথা লক্ষ্য করে।

কিভাবে? তারা কিভাবে তাকে খুঁজে পেলো?…তারপরই মনে পড়ে গেলে একটু অসুস্থ বোধ করলো সে। কতোই না অসতর্ক ছিলো, কতোই না হালকাভাবে নিয়েছিলো!

আপনি কি জুরিখে থাকাকালীন সময়টা উপভোগ করছেন? ব্যাংকের ভেতর অপেক্ষা করার সময় ওয়ালথার এপফেল তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো।

খুবই। আমার ঘর থেকে লেকটা দেখা যায়। চমৎকার দৃশ্য, খুবই প্রশান্তির, শান্তির।

কোয়েনিগ! কোয়েনিগকে সে বলেছিলো তার রুম থেকে লেক দেখা যায়। জুরিখের কতোগুলো হোটেল থেকে লেক দেখা যায়? বিশেষ ক’রে থ্রি-জিরো একাউন্টের মালিক থাকার মতো কোনো হোটেল থেকে, দুটো? তিনটে?… কোত্থেকে যেনো নামগুলো তার মাথায় চলে এলো : ক্যারিলিয়ন দুলাক, বোর অলাক, ইদেন অলাক। আরো কি আছে? না, আর কোনো নাম এলো না। খুঁজে বের করাটা কতোই না সহজ! কতো সহজেই না সে কথাটা বলেছিলো। কতো বোকাই না সে!

সময় নেই। খুব বেশি দেরি হয়ে গেছে। কাঁচের দরজা দিয়ে সে দেখতে পেলো। ঠিক একইভাবে খুনিরাও দেখতে পেলো তাকে। দ্বিতীয় লোকটা প্রথম দেখতে পেলো তাকে। সঙ্গে সঙ্গে সে গোল্ডরিম চশমা পরা লোকটাকে ইশারা করলে সে পকেট থেকে অস্ত্র বের করতে উদ্যত হলো। দু’জনেই অস্ত্র বের করে এক সঙ্গে দরজা দিয়ে ঢুকতে লাগলো। শেষ দিকে এসে আলাদা হয়ে গেলো তারা। একজন কাঁচের থাকলো দরজার সামনে। ফাঁদ পাতা হলো। তাকে বাইরে যেতে দেবে না।

তারা কি এরকম একটা জনাকীর্ণ হোটেল লবিতে ঢুকে একজনকে খুন করতে পারবে ব’লে ভাবছে?

অবশ্যই তারা সেটা করতে পারবে। লোকজনের ভীড় আর হৈহল্লা তাদেরকে আড়াল করবে। দুটো, তিনটে ভোঁতা গুলির শব্দ হবে, লোকজনের দৌড়াদৌড়ি আর হাউকাউয়ের মধ্যে নির্বিঘ্নে বের হয়ে যেতে পারবে তারা।

সে তাদেরকে তার কাছাকাছি আসতে দেবে না। পিছু হটে গেলো সে। তার চিন্তাভাবনায় ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কতো সাহসী তারা? তারা কি ক’রে ধরে নিলো সে সাহায্যের জন্যে, বাঁচার জন্যে লোকজনকে চিৎকার ক’রে ডাকবে না? তারপরও জবাবটা পাওয়া গেলো পরিস্কার। খুনিরা একটা ব্যাপারে নিশ্চিত : সে এ ধরণের সাহায্য কামনা করতে পারবে না— পুলিশেরও দ্বারস্থ হতে পারবে না। জেসন বর্নের জন্যে সমস্ত কর্তৃপক্ষই নিষিদ্ধ…কেন? তারা কি তাকে খুঁজছে?

হায় ঈশ্বর, কেন?

বিপরীত দিকের দুটো দরজা খুলে ফেলা হলো। ঘুরে দাঁড়ালো বর্ন। লিফট আছে, দরজা আছে, আছে করিডোর-ছাদ আর অনেকগুলো ঘর। এই হোটেল থেকে বের হবার রাস্তা আছে কমপক্ষে এক ডজন।

অথবা আছে কি? নাকি ক্যারিলিয়ন দুলাকের কেবলমাত্র দুটো অথবা তিনটে বের হবার পথ রয়েছে? লোকজনের সাহায্যে খুব সহজেই তাহলে সেগুলো আঁটকে রাখা যাবে। একজন লোককে আঁটকানো খুব সহজ কাজ।

একজন। নির্ঘাত একজন লোকই টার্গেট। কিন্তু ধরা যাক সে একা নয়? ধরা যাক তার সাথে আরো লোক রয়েছে? দু’জন লোক আর একজন লোক তো এক কথা নয়। তবে একজন লোক সবার মাঝে মিশে থাকতে পারবে—বিশেষ ক’রে মানুষের ভীড়ে, এই রাতের বেলায়। দৃঢ় প্রতীজ্ঞ খুনি ভুল কাউকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকবে। খুব বেশি ভয়ার্ত অবস্থার সৃষ্টি হলে আসল টার্গেট হয়তো ফসকে যেতে পারে।

নিজের পকেটের অস্ত্রটার ওজন টের পেলো সে। তবে জিনিসটা তার সাথে আছে ব’লে কোনো স্বস্তি বোধ করলো না। ব্যাংকে এটা ব্যবহার করা এমনকি দেখানোটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো—এখনও এটা ব্যবহার করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। সে লবির মাঝখানে চলে এসে ডান দিকে মোড় নিলো, সেখানে আরো বেশি লোকজন রয়েছে। এটা একটা আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের প্রাক সান্ধ্যকালীন সেশন। হাজার হাজার লোভনীয় পরিকল্পনা তৈরি করা হবে, তর্কবিতর্ক হবে। দেনদরবারও চলবে সামনে। দেয়ালের পাশে একটা মার্বেলের কাউন্টার আছে। একজন ক্লার্ক ব’সে ব’সে হলুদ রঙের কাগজ হাতে নিয়ে পেন্সিল দিয়ে কী যেনো করছে। ক্যাবল গ্রাম। কাউন্টারের সামনে দু’জন লোক। একজন বয়স্ক, আর অন্যজন গাঢ় লাল রঙের পোশাক পরা, লাল চুলের এক মেয়ে…লাল চুলের। লিফটের সেই মেয়েটি।

বর্ন পেছনে তাকালো। খুনিরা লোকজনের ভীড় ঠেলে বেশ ভদ্র আর মার্জিতভাবেই এগিয়ে আসছে তার দিকে। একজন ডানে, অন্যজন বাম দিক থেকে। তারা তাকে দেখলেই দিক বিদিক না তাকিয়ে সে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াবে। তারপরই শোনা যাবে সেই ভোঁতা শব্দগুলো। তাদের পকেটগুলো গান পাউডারের উত্তাপে একটু পুড়ে যাবে কেবল…

সে কি তাদের নজরদারীতে রয়েছে?

তাহলে পেছনের আসনগুলোতেই যেতে হবে…আমরা ওখানে ঘুমাতে পারবো। সে স্লাইড প্রজেক্টর ব্যবহার করে, খুব অন্ধকার থাকবে।

জেসন ঘুরে আবারো লাল চুলের মেয়েটার দিকে তাকালো। ক্যাবলটা শেষ ক’রে ক্লার্ককে ধন্যবাদ জানিয়ে চোখ থেকে হর্নরিমের চশমাটা খুলে পার্সে রেখে দিলো সে। মেয়েটা তার থেকে আট ফুটেওে কম দূরে আছে।

বার্তেনেলি এখন লেকচার দিচ্ছে…

কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসে গেছে। সময়ক্ষেপন করা যাবে না। বর্ন তার সুটকেসটা বাম হাতে নিয়ে মহিলাকে অনুসরণ করতে করতে পেছন থেকে এসে মহিলার বাহুটা ধরে ফেললো।

“ডক্টর?…”

“ক্ষমা করবেন?”

“আপনি একজন ডক্টর না?”…সে মেয়েটার হাত ছেড়ে দিয়ে অবাক হয়ে তাকালো।

“সেন জ্যাক,” মেয়েটা বললো, সেন্ট শব্দের ফরাসি উচ্চারণটা ব্যবহার করলো সে। “আপনিই তো লিফটে ছিলেন।”

“আমি বুঝতে পারি নি আপনিই সেই লোক,” জেসন বললো। “আমাকে বলা হয়েছে বার্তেনেলি কোথায় লেকচার দিচ্ছে সেটা আপনি জানেন।”

“ডান দিকের হলে। সুট নাম্বার সাত।”

“আসলে, সেটা কোথায় আমি চিনি না। জায়গাটা দেখিয়ে দেবেন কি? আমি দেরি ক’রে ফেলেছি, তার বক্তব্যের উপরে আমাকে নোট নিতে হবে।”

“বার্তেনেলির বক্তব্যের উপরে? কেন? আপনি কি কোনো মার্কসবাদী সংবাদপত্রের সাথে আছেন নাকি?”

“নিরপেক্ষ কোনো প্রতিষ্ঠানে,” জেসন বললো। অবাক হয়ে ভাবলো কথাটা কোত্থেকে এলো। “আমি বেশ ক’জন লোকের বক্তব্য নেবো। অবশ্য আমার বসেরা মনে করে না তার কথার কোনো দাম আছে।”

“হয়তো নেই, তবে তার কথাও শোনা দরকার। তার বক্তব্যে কিছু নিমর্ম সত্যও রয়েছে।”

“আমি হারিয়ে ফেলেছি, কিন্তু তাকে আমার খুঁজে বের করতেই হবে। হয়তো আপনি তাকে দেখিয়ে দিতে পারেন।”

“আমার মনে হয় না আমি আপনাকে ঘরটা দেখিয়ে দিতে পারবো। আমাকে একটা ফোন করতে হবে।” মেয়েটি তার পার্স বন্ধ ক’রে ফেললো।

“প্লিজ, তাড়াতাড়ি করুন!”

“কি?” তার দিকে তাকালো মেয়েটা, তবে দয়াপরবশ হয়ে নয়।

“দুঃখিত, আমার খুব তাড়া আছে।” সে ডান দিকে তাকালো, দু’জন লোক তার থেকে বিশ ফুটেরও কম দূরে আছে এখন।

“আপনি তো দেখছি খুবই অভদ্র একজন,” সেন জ্যাক নামের মেয়েটি শীতল কণ্ঠে বললো।

“প্লিজ।”

“এই যে, এখান দিয়ে।” একটা প্রশ্বস্ত করিডোর দেখিয়ে সেটার পেছনে ইঙ্গিত করলো সে।

ওখানে লোকজনের ভীড়টা একটু কম। তারা পৌঁছে গেলো লাল ভেলভেট মোড়ানো দরজাগুলোর দিকে। প্রতিটি দরজার উপরে লাল রঙের সাইন দেখা যাচ্ছে। সাইনগুলো নির্দেশ করছে কনফারেন্স রুম এক, দুই, তিন, ইত্যাদি। হলওয়ের শেষ মাথায় ডাবল-ডোরের একটা দরজা, সেটার উপরে লেখাটা বলছে এটা সুট নাম্বার সাত।

“ঐ যে, ওখানে,” সেন মেরি জ্যাক বললো। “সাবধানে যাবেন, খুবই অন্ধকার। বার্তেনেলি স্লাইডের সাহায্যে লেকচার দিচ্ছে।”

“সিনেমা হলের মতো,” মন্তব্য করলো বর্ন। পেছনে তাকিয়ে দেখলো গোল্ডরিমের চশমা পরা লোকটা করিডোর দিয়ে আসছে। তার সঙ্গীটি তার পেছনেই।

“…তাকে দেখলেই চিনতে পারবেন। সে মঞ্চের নিচে ব’সে আছে, পর্দার দিকে মুখ ক’রে কথা বলছে।” সেন জ্যাক নামের মেয়েটি বলেই চলে যেতে উদ্যত হলো।

“কি বললেন, মঞ্চ?”

“মানে, উঁচু একটা জায়গা। প্রদর্শনের জন্য ব্যবহার করা হয়।”

“ওখানে কি বের হবার কোনো পথ আছে? কোনো দরজা?”

“আমার কোনো ধারণা নেই। আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তাহলে যাই, আমাকে আবার একটা ফোন করতে হবে। প্রফেসরের লেকচার উপভোগ করুন।” কথাটা বলে ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হতেই বর্ন হাতের সুটকেসটা মেঝেতে রেখে মেয়েটার একটা হাত খপ্ ক’রে ধরে ফেললো। মেয়েটা কটমট চোখে তাকালো তার দিকে। “হাত ছাড়ুন।”

“আমি আপনাকে ঘাবড়ে দিতে চাই না, কিন্তু এ ছাড়া আমার কিছু করারও নেই।” খুব শান্ত কণ্ঠে বললো সে, তার চোখ মেয়েটার কাঁধের পেছনে। খুনিরা তাদের হাটার গতি শ্লথ ক’রে দিয়েছে। নিশ্চিত একটা ফাঁদ। “আপনাকে আমার সাথে আসতে হবে।”

“পাগল নাকি!”

সে মেয়েটার কাঁধ ধরে ঘুরিয়ে তার মুখোমুখি করলো। তারপর পকেট থেকে অস্ত্রটা বের ক’রে আড়াল ক’রে রাখলো মেয়েটার পেছনে, যাতে ত্রিশ ফিট দূরে থাকা লোকগুলো সেটা দেখতে না পায়। “এটা আমি ব্যবহার করতে চাই নি। আপনাকে আঘাত করারও কোনো ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু প্রয়োজন হলে দুটোই আমি করবো।”

“হায় ঈশ্বর…”

“চুপ করুন। যেমন বলছি তেমন করুন। তাহলে কোনো সমস্যা হবে না। আমাকে এ হোটেল থেকে বের হতে হবে, আপনি আমাকে সাহায্য করবেন। বের হলেই আপনাকে আমি ছেড়ে দেবো। তার আগে নয়। আসুন। আমরা ভেতরে যাবো।”

“আপনি এটা করতে পারেন না।”

“হ্যা, অবশ্যই পারি।” পিস্তলটা দিয়ে মেয়েটার পেটে খোঁচা মেরে তাকে ধাক্কা মারলো সে। “চলুন।” দরজাটা খুলে ফেলতেই করিডোর থেকে একটা শব্দ শুনতে পেলো।

“শ্নেল!”

অন্ধকারে প্রবেশ করলো তারা, কিন্তু সেটা সাময়িক। চারকোনা একটা পর্দার আলোর কারণে ঘরে একটু আলো আছে। শ্রোতাদের মাথাগুলোও দেখা যাচ্ছে। ঠিক সিনেমা হলের মতো অবস্থা।

স্পিকারের একটা ভারি কণ্ঠের শব্দ শোনা গেলো এবার।

“আপনারা খেয়াল করবেন, সত্তর এবং একাত্তর সালে কতিপয় নেতা বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিলেন। পরবর্তী স্লাইড, প্লিজ।” ঘরটা একেবারে অন্ধকার হয়ে গেলো। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই আরেকটা স্লাইড ভেসে উঠলো পর্দায়।

“স্লাইড নাম্বার বারো, প্লিজ!”

জেসন মেয়েটিকে সামনের দিকে ধাক্কা দিলো। শেষ সারির দিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে সে। লেকচার হলটার আকার কতোটুকু সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা করলো। একটা লাল বাতির খোঁজ করছে : বের হবার পথ। দেখতে পেলো সেটা! মঞ্চের পেছনে, পর্দারও পেছনে। এ ছাড়া আর কোনো বের হবার পথ নেই। সুট নাম্বার সাত-এ মূল প্রবেশদ্বার ছাড়া আর কোনো দরজাও নেই। তাকে বের হবার পথের দিকেই যেতে হবে। মঞ্চের উপর দিয়ে।

“মেরি—পার ইসি!” পেছনের সারির একটা আসনের বাম দিক থেকে একটা চাপা কণ্ঠ ডাকলো।

“নন, শেরি। রেস্তে আভেক মোয়ে।” দ্বিতীয় ফিসফিসানিটা এলো ঠিক মেরির সামনে থেকে। মেরির সামনে এসে গতিরোধ করলো লোকটা।

“অন নু এ সেপেয়ার। ইর নি এ প্লাস দ্য শেইজে।”

বর্ন মেয়েটার পাঁজরের কাছে চেপে ধরলো অস্ত্রটা। বার্তাটা খুব পরিস্কার। জেসন হাফ ছেড়ে বাঁচলো কারণ মেয়েটার চেহারা খুব ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না। “প্লিজ, আমাদেরকে যেতে দাও,” মেয়েটা ফরাসিতে বললো। “প্লিজ।”

“এটা কি? এটা কি তোমার ক্যাবলগ্রাম, মাই ডিয়ার?”

“একজন পুরনো বন্ধু,” বর্ন বললো।

শ্রোতাদের মধ্য থেকে একটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। “স্লাইড বারো কি দেয়া হবে না! পার ফাভোর!”

“আমাদেরকে শেষ সারিতে বসা কারো সাথে দেখা করতে হবে,” জেসন বলতে লাগলো। পেছনে ফিরে তাকালো আরেকবার। প্রবেশদ্বারটি খোলা। তার মাঝখানে একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। চোখের গোল্ডরিমের চশমাটা কেবল স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। জেসন মেয়েটার হতবাক হওয়া বন্ধুটিকে পাশ কাটিয়ে তাকে দেয়ালের পাশে নিয়ে গিয়ে ক্ষমা চাইলো।

“দুঃখিত, আমাদের খুব তাড়া আছে।”

“তুমি খুবই বাজে ব্যবহার করছো!”

“হ্যা, আমি জানি।”

“স্লাইড বারো! মা চে ইনফামিয়া!”

প্রজেক্টরে কোনো সমস্যা হচ্ছে। আরেকটা ছবি পর্দায় ভেসে উঠলে জেসন মেয়েটাকে নিয়ে অন্যপ্রান্তের দেয়ালের কাছে চলে এলো। ওখান থেকে একটা সংকীর্ণ পথ চলে গেছে মঞ্চের দিকে। মেয়েটাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে এক কোণে নিয়ে গিয়ে নিজের শরীরের সঙ্গে মেয়েটাকে চেপে ধরলো সে। তার মুখের সামনে মুখ রাখলো বর্ন।

“আমি চিৎকার করবো,” মেয়েটা চাপা কণ্ঠে বললো।

“তাহলে আমি সোজা গুলি করবো,” বললো সে। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো খুনি দু’জন ভেতরে ঢুকে পড়েছে। তারা দু’জন নিজেদের মাথা দুটো স্প্রিংয়ের মতো চারপাশে ঘোরাচ্ছে। নিজেদের টার্গেট খুঁজে বেড়াচ্ছে শ্রোতাদের মাঝে।

লেকচারারের কণ্ঠটা কিছুটা ক্ষুব্ধ শোনাচ্ছে এখন। “একো! সন্দেহগ্রস্তদের জন্যে আমি আজকে সন্ধ্যায় বক্তব্য দিচ্ছি—এখানে পরিসংখ্যানগত প্রমাণ রয়েছে! আরো শতশত বিশ্লেষণ আমি প্রস্তুত করেছি। বাজার যারা চালায় তাদের হাতেই বাজার ছেড়ে দাও।”

কিছু হাত তালি পড়লো। স্পষ্টতই বক্তার পক্ষে রয়েছে সংখ্যালঘু শ্রোতা। বার্তেনেলি আবারো পর্দার দিকে পয়েন্টার দিয়ে কিছু বলতে শুরু করলো। আবারো পিছু হটে গেলো জেসন। চশমা পরা খুনি কিছু একটা দেখতে পেয়ে তার সঙ্গীটিকে বাম দিকে ইশারা তল্লাশী করতে বললো। সে ডান দিকটা দেখবে। তল্লাশীটা শুরু হয়ে গেলো। গোল্ডরিম চশমা পরা লোকটা তাদের একেবারে কাছে এসে পড়েছে। খুনিকে থামাতে এখন গুলি করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। যদি সিটগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন সরে যায়, অথবা যে মেয়েটাকে সে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে রেখেছে সে যদি ভয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে, কিংবা তাকে ধাক্কা মেরে ছুটে পালায়…অথবা সে যদি খুনিকে মিস্ করে তবে সে একেবারে ফাঁদে পড়ে যাবে। যদি খুনিকে মিস্ নাও করে, গুলি করতে সক্ষমও হয়, তাহলেও আরেকজন খুনি রয়ে যাবে এ ঘরে। সে নির্ঘাত একজন দক্ষ শুটারই হবে।

“দয়া ক’রে তেরো নাম্বার স্লাইড।”

এই তো সময় হয়েছে। এখনই!

প্রজেক্টরের আলো নিভে গেলে ঘরটা একেবারে অন্ধকারে ডুবে গেলো। মেয়েটাকে ধরে মুখোমুখি করলো বর্ন। “কোনো রকম শব্দ করলে আমি তোমাকে খুন করবো!”

“আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি,” খুব ভয় পেয়ে নিচু কণ্ঠে মেয়েটা বললো। “তুমি একটা উন্মাদ।”

“চলো এবার!” মেয়েটাকে নিয়ে মঞ্চের দিকে যাবার সংকীর্ণ পথটার দিকে ছুটলো সে। প্রজেক্টরের আলো জ্বলে উঠলো আবার। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার ঘাড় ধরে তাকে হাটু মুড়ে বসতে বাধ্য করলো সে, নিজেও সেভাবে ব’সে পড়লো। দু’পাশের চেয়ারের সারির আড়ালে খুনিদের কাছ থেকে লুকিয়ে পড়লো তারা। আঙুল দিয়ে মেয়েটাকে খোঁচা মেরে তাকে হামাগুঁড়ি দেবার ইঙ্গিত করলো জেসন…আস্তে আস্তে এগোও। মেয়েটা বুঝতে পারলো। হাটু মুড়েই সে কাঁপতে কাঁপতে এগোলো।

“এই বক্তৃতার উপসংহার হলো একেবারেই তর্কাতীত,” লেকচারার উচ্চকণ্ঠে বললো। “মুনাফা করার প্রবণতা উৎপাদনের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। কিন্তু শত্রুতামূলক ভূমিকাকে এর সাথে কখনও গুলিয়ে ফেলবেন না। সক্রেটিসের মতে, মূল্যের বা মূল্যবোধের অসমতা ধ্রুব। স্বর্ন কোনো লোহা বা পিতল নয়। আপনাদের মধ্যে কে এটাকে অস্বীকার করতে পারে? স্লাইড চৌদ্দ। দয়া ক’রে দেবেন কি!”

আবারো অন্ধকার নেমে এলো।

মেয়েটাকে তুলে দাঁড় করিয়ে মঞ্চের দিকে ছুটলো সে। তারা মাত্র তিন ফিট দূরে আছে এখন।

“কোসা সাকসিদ? ব্যাপারটা কি, প্লিজ? স্লাইড চৌদ্দ!” আবারো ঘটলো ব্যাপারটা! প্রজেক্টরটা ফেঁসে গেছে। অন্ধকারটা প্রলম্বিত হবে। জেসন মেয়েটাকে ধরে মঞ্চের পেছনে ‘এক্সিট’ লেখাটার দিকে ছুটে চললো। “মঞ্চে উঠে এক্সিট দিয়ে বের হয়ে যাও। আমি তোমার পেছনেই আছি। থামলে অথবা চিৎকার করলে সোজা তোমাকে আমি গুলি করবো।”

“ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে যেতে দাও!”

“এখন নয়।” সে জোর দিয়ে বললো। বের হবার অন্য কোনো দরজা আছে। সেখানে লোকজন তার জন্যে অপেক্ষা করছে। “যাও!”

সেন জ্যাক নামের মেয়েটি দৌড়ে চলে গেলো মঞ্চের কাছে। ওখানেই পৌঁছাতেই মেয়েটাকে ধরে মঞ্চের উপর তুলে দিলো বর্ন। প্রজেক্টরের আলো আবারো জ্বলে উঠলে মঞ্চটা একেবারে আলোর বন্যায় ভেসে গেলো যেনো। মঞ্চে দু’জন মানুষ দেখে শ্রোতাদের মধ্যে হৈহল্লা শুরু হয়ে গেলে ক্ষুব্ধ বার্তেনেলির কণ্ঠটাও শোনা গেলো।

“ই ইনসোফরিবাইল। সি সোনো কমিউনিস্তি কুই!”

অন্যরকম শব্দও শোনা গেলো—তিনটি— মারাত্মক, তীক্ষ্ণ, আচমকা, একটা অস্ত্র থেকে বের হওয়া ভোঁতা শব্দ—একটা নয়, দুটো। মঞ্চের পাটাতনের কাঠে এসে লাগলো গুলিগুলো। মেয়েটাকে ধাক্কা মেরে শুইয়ে দিলো জেসন। সে নিজেও নিচু হয়ে উইং স্পেসের দিকে ছুটলো, তার সঙ্গে টেনে নিলো মেয়েটাকেও।

“দা ইস্তার! দা ওবেন!”

“শ্নেল! দার প্রজেক্তর!”

হলের মাঝখান থেকে চিৎকারটা ভেসে এলে প্রজেক্টর ঘুরে গেলো ডান দিকে, উইংয়ের দিকে—তবে পুরোপুরি নয়। শেষে এক্সিট-এর দিকে প্রজেক্টরের আলোটা প্রক্ষেপন করা হলো।

কাঁচ ভাঙার শব্দ শোনা গেলে দেখা গেলো দক্ষ নিশানায় ‘এক্সিট’ সাইনের লাল বাতিটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না। সে দরজার হাতলটা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে।

লেকচার হলে নেমে এলো চরম বিশৃঙ্খলা। বর্ন মেয়েটার জামার কলার ধরে দরজার দিকে ছুটে চললো। কয়েক মুহূর্তের জন্যে মেয়েটা প্রতিরোধ করলে বর্ন সজোরে একটা চর মারলো তার গালে।

দরজার কাছে পৌঁছাতেই ডান দিকের দেয়ালের পাশে এসে কয়েকটা বুলেট এসে বিঁধলো। খুনিরা দৌড়ে কাছে চলে আসছে তাদের নিশানা অব্যর্থ করার জন্যে। তারা মুহূর্তেই পৌঁছে যাবে, গুলিও করবে সঙ্গে সঙ্গে। তাদের কাছে এখনও যথেষ্ট গুলি রয়ে গেছে, এটা বর্ন জানে। তবে কিভাবে এটা জানে সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই।

বাহু দিয়ে দরজায় সজোরে আঘাত করতেই সেটা খুলে গেলো। সেন জ্যাক নামের মেয়েটিকে টেনে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলো সে।

“থামো!” মেয়েটি চিৎকার ক’রে বললো। “আমি আর যাবো না! তুমি একটা উন্মাদ! আমি জানি ওগুলো গুলির শব্দ!”

জেসন খোলা দরজাটা পা দিয়ে লাথি মেরে বন্ধ ক’রে দিলো। “উঠে দাঁড়াও!”

“না!”

“দুঃখিত, তুমি আমার সঙ্গেই আসছো।” হাতটা বাড়িয়ে বললো সে, “উঠে দাঁড়াও। একবার বের হতে পারলেই তোমাকে ছেড়ে দেবো, কথা দিচ্ছি।” কিন্তু যাবেটা কোথায়? আরেকটা টানেল দেখা যাচ্ছে। তবে সেখানে কোনো কার্পেট দেখা যাচ্ছে না। কোনো পালিশ করা দরজা বা বাতি জ্বলা সাইনও নেই। এটা হলো লোডিং এলাকা। মেঝেটা কংক্রিটের। দু’পাশের দেয়ালে পাইপ লাগানো। সে ঠিক পথেই আছে; প্রদর্শনীর জন্যে অনেক বড় বড় জিনিস আনা নেয়ার সুবিধার্থে এই রকম জায়গা থাকারই কথা।

দরজাটা! তাকে সেটা আঁটকাতে হবে! মেরি উঠে দাঁড়িয়েছে। সে মেয়েটাকে এক হাতে ধরে এক্সিট দরজাটার লক্ ক’রে দিলো।

মেয়েটা এবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো তার হাত থেকে ছোটার জন্যে। মেয়েটার হাত ধরে সে মোচড় দিলে মেয়েটা একটা আর্ত চিৎকার দিলো। তার চোখে জল এসে গেছে। ঠোঁট দুটো কাঁপছে। মেয়েটাকে ধরে দৌড়াতে লাগলো সে।

কয়েকটা আঘাতের শব্দ হলো পর পর। খুনিরা মঞ্চের দরজাটা খোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু লটা খুবই শক্ত।

মেয়েটা নিজের শরীর একেবারে ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ার চেষ্টা করলো। একেবারে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়েছে সে। বর্নের কোনো উপায়ই রইলো না। সে মেয়েটার বাহু ধরে এমন জোরে চাপ দিলো যে, যন্ত্রণার চোটে মেয়েটার দম বন্ধ হবার উপক্রম হলো। মেয়েটা কেঁদে ফেললো আবার। উঠে দাঁড়িয়ে সামনে এগোতে লাগলো সে। তারা সিমেন্টের একটা সিঁড়ির কাছে এসে পড়েছে। সেটা শেষ হয়েছে নিচের একটা লোহার দরজার কাছে। এটাই হলো লোডিং ডক্‌ এলাকা। দরজার পেছনেই হোটেলের পার্কিংলট। সে প্রায় পৌঁছেই গেছে। কেবল বের হওয়া বাকি।

“আমার কথা শোনো,” ভয়ে কাঠ হয়ে থাকা মেয়েটাকে বললো সে।

“তুমি কি চাও আমি তোমাকে ছেড়ে দেই?”

“হায় ঈশ্বর, হ্যা! দয়া ক’রে তাই করো!”

“তাহলে আমি যা বলছি তাই করবে। আমরা বাইরে একেবারে স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে বের হবো। তুমি আমার বাহু ধরে রাখবে, আমি আস্তে আস্তে হাটবো। পার্কিংলটের শেষ প্রান্তে রাখা গাড়িগুলো পর্যন্ত নিচু কণ্ঠে কথা বলবো আমরা। দু’জনেই হাসবো—খুব উচ্চশব্দে নয়। স্বাভাবিকভাবে। যেনো আমরা কোনো মজার কথা মনে ক’রে হাসছি। বুঝেছো?”

“আরে পনেরো মিনিট ধরে আমার সঙ্গে কোনো মজার জিনিসই ঘটছে না,” সে প্রায় বিড়বিড় ক’রে কথাটা বললো।

“এরকমটি ভান করবে। আমি হয়তো ফাঁদে পড়ে গেছি। যদি পড়ে থাকি তো সেটা আমি পরোয়া করি না। তুমি বুঝেছো?”

“আমার মনে হয় আমার হাতের কব্জিটা ভেঙে গেছে।”

“ভাঙে নি।”

“আমার বাম কাঁধ, বাম হাত। নড়াতে পারছি না। ওগুলো অবশ হয়ে গেছে।”

“কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। তোমার কিছুই হয় নি। সব ঠিক আছে।”

“তুমি একটা পশু।”

“আমি বাঁচতে চাই,” সে বললো। “আসো। মনে রেখো, আমি দরজাটা খুললে আমার দিকে তকিয়ে হাসবে, মাথা দোলাবে।”

“এটা হবে আমার জীবনের সবচাইতে কঠিন কোনো কাজ।”

“মরার চেয়ে এটা অনেক বেশি সহজ।”

মেয়েটা তার আহত হওয়া হাত জেসনের হাতের নিচে রেখে দরজা খুলে বের হয়ে এলো। বর্ন তার পকেটে থাকা পিস্তলটা ধ’রে রেখেছে। চারপাশে তীক্ষ্ণ নজর রাখছে সে। লোভিং ডকের দরজার উপরে একটা বাল্ব জ্বলছে। সেটা নির্দেশ করছে বাম দিকে নিচের পেভমেন্টের প্রতি। সে তার জিম্মিকে ওখানে নিয়ে গেলো।

মেয়েটা তার কথা মতোই কাজ করলো। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই দেখা গেলো তার ভয়ার্ত চেহারাটা। জেসন তার দিকে তাকাতেই সে জোর ক’রে হাসার চেষ্টা করলো। চোখের জল গালে শুকিয়ে গেছে, কাছ থেকে সেটা বোঝা যায়। মেয়েটার চেহারা ঠিক কোনো মুখোশের মতোই ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে এখন। বাতাসের ঝাপটায় চুলগুলো দুলে উঠলে সেই মুখোশে একমাত্র জীবন্ত জিনিসটা চোখে পড়লো যেনো।

একটা কাষ্ঠ হাসি মেয়েটার গলা দিয়ে বের হলো। মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে যাবার থেকে খুব বেশি দূরে নেই। তবে জেসন এটা ভাবতে চাইছে না। তাকে চারপাশে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে এখন। ৬টা ৩০ বাজে। এই জায়গাটা কর্মচারীরা ব্যবহার করে। নাইট শিফটের কর্মচারীরা ডিউটিতে চলে গেছে ব’লে সব কিছু স্থির হয়ে আছে। কতোগুলো গাড়ি পার্ক করা আছে। তীব্র আলোর কাছে পোকারা উড়ছে।

একটা খ্যাচ্ খ্যাচ্ শব্দ হলো। লোহার উপর লোহার ঘর্ষণের। ডান দিক থেকে আসছে শব্দটা, সামনের সারি সারি কোনো গাড়ি থেকে। কোন্ গাড়ি থেকে? কোন্ গাড়ি থেকে? সে এমনভাবে মাথাটা পেছন দিকে হেলালো যেনো তার সঙ্গী কোনো জোক্ বলেছে। এই ফাঁকে আশপাশের গাড়িগুলোর জানালার দিকে তাকালো সে। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলো না।

কিছু একটা? ওখানে, কিন্তু খুবই ছোটো, চোখে পড়ার মতো নয়…খুবই অবাক করার মতো। ছোট্ট একটা সবুজ রঙ, জ্বলজ্বল ক’রে জ্বলছে। ওটা নড়লো… ওগুলো নড়ে গেলো।

সুবজ। ছোট্ট…বাতি? আচমকা তার অতীতের কোনো স্মৃতি ভেসে উঠলো তার চোখের সামনে। সে চেয়ে আছে দুটো আড়াআড়ি চিকন লাইনের দিকে-একটা ইনফারেড স্কোপ রাইফেলের স্কোপ দিয়ে।

খুনিরা কিভাবে জানলো? অসংখ্য জবাব আছে। এর আগে গেইমেনশেফট ব্যাংকে ওয়্যারলেস ব্যবহার করা হয়েছিলো। এখানেও কেউ এরকম কিছু ব্যবহার করেছে হয়তো। সে একটা টপকোট পরে আছে, তার জিম্মি পরে আছে পাতলা সিল্কের পোশাক। রাতটা খুবই ঠাণ্ডা। কোনো মেয়ে এরকম পোশাকে বাইরে বের হবে না।

সে সঙ্গে সঙ্গে বাম দিকে ঘুরে ঝুঁকে পড়লো সেন মেরি জ্যাকের দিকে। তার কাঁধটা চাপ দিলো মেয়েটার পেটে। আবার সিঁড়ির ওখানে নিয়ে গেলো মেয়েটাকে। এক নাগারে ছোটো ছোটো ভোঁতা শব্দ হতে লাগলে তাদের চারপাশে পাথরের গুঁড়ো ছিটকে পড়তে শুরু করলো। সে ডান দিকে ঝাঁপ দিয়ে গড়িয়ে প’ড়ে সেই অবস্থায়ই পকেট থেকে পিস্তলটা বের ক’রে ফেললো। তারপর সোজা সামনের দিকে থাকা গাড়ির জানালা বরাবর গুলি চালালো; রাইফেলটা ওখান দিয়েই বের হয়ে আছে। পর পর তিনটা গুলি করলো সে।

গাড়ি থেকে একটা আর্তনাদ ভেসে এলো। আর্তনাদটা প্রচণ্ড জোরে কান্নায় বদলে গেলো, তারপর ঘোৎঘোৎ একটা শব্দ হবার পরই থেমে গেলো সেটা। বর্ন যেভাবে ছিলো সেভাবেই শুয়ে রইলো। অপেক্ষা করছে, শুনছে, দেখছে। আবারো গুলি করার জন্যে প্রস্তুত হলো সে।

সব কিছু চুপচাপ। উঠে দাঁড়াতে গেলো সে…কিন্তু পারলো না। কিছু একটা হয়েছে। নড়তে পারছে না। তারপরই বুকে তীব্র ব্যথাটা অনুভূত হলো। স্পন্দনটা এতো জোরে হচ্ছে যে, সে কুঁকড়ে গেলো। দু’হাতে মেঝেটা ধরে কোনো রকম সামলে নিয়ে মাথাটা ঝাঁকালো। নিজের দৃষ্টি সংহত করার চেষ্টা করলো সে। যন্ত্রণাটা ভুলে থাকার চেষ্টাও করলো। তার বাম কাঁধ, তার পাঁজরের নিচে—তার বাম ঊরু—হাটুর উপরে, কোমরের নিচে, তার আগের আহত হওয়ার জায়গাগুলো, যেখান থেকে মাত্র একমাস আগে কয়েক ডজন সেলাই খোলা হয়েছে। এই নাজুক জায়গাগুলোতে চোট লেগেছে। তার জয়েন্ট আর পেশীগুলো এখনও পুরোপুরি সেরে ওঠে নি। ওহ্ ঈশ্বর!

তাকে উঠে দাঁড়াতে হবে। খুনির গাড়ির কাছে যেতে হবে। খুনিকে ওখান থেকে বের ক’রে পালাতে হবে। অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে সেন মেরি জ্যাকের দিকে তাকালো সে। মেয়েটা এক হাতে পাশের দেয়াল ধরে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াচ্ছে। মুহূর্তেই সে দৌড় দেবে। চলে যাবে। সে তাকে যেতে দেবে না! মেয়েটা হোটেলে ঢুকে চিৎকার চেঁচামেচি করবে। লোকজন জড়ো করবে, আর কেউ এসে খুন করবে তাকে। মেয়েটাকে থামাতেই হবে।

সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে প’ড়ে মেঝেতে গড়িয়ে দেয়ালের পাশে চলে এলো সে। উঠে দাঁড়িয়েই মেয়েটার মাথা বরাবর তাক্ করলো অস্ত্রটা।

“আমাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করো,” বললো সে। নিজের দুর্বল আর কম্পিত কণ্ঠটা শুনতে পেলো।

“কি?”

“আমাকে সাহায্য করো!”

“তুমি বলেছিলে আমি যেতে পারবো। কথা দিয়েছিলে কিন্তু।”

“সে কথা আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি।”

“না, দয়া ক’রে সেটা কোরো না।”

“অস্ত্রটা তোমার মাথার দিকে তাক্ করা আছে, ডক্টর। তুমি আমাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করো, নইলে গুলি ক’রে তোমার মাথার খুলি উড়িয়ে দেবো।”

.

গাড়ি থেকে মৃতলোকটাকে টেনে বের ক’রে মেয়েটাকে হুইলে বসতে বললো সে। তারপর পেছনের দরজা খুলে গাড়ির ভেতরে হামাগুড়ি দিয়ে পেছনের সিটে শুয়ে পড়লো যাতে বাইরে থেকে তাকে দেখা না যায়।

“গাড়ি চালাও,” সে বললো। “আমি যেভাবে বলবো সেভাবেই গাড়ি চালাবে।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *