পর্ব ১
পর্ব ২
পর্ব ৩

বর্ন আইডেন্টিটি – ৪

অধ্যায় 8

কারাতেল থেকে জুরিখের এয়ার ফ্রান্সের ইকোনোমি ক্লাশের সেকশনটা একেবারে কাণায় কাণায় পূর্ণ। সংকীর্ণ আসনগুলো প্লেনের ঝাঁকিতে আরো বেশি অস্বস্তিকর লাগছে। মায়ের কোলে শুয়ে চিৎকার ক’রে কাঁদছে একটা বাচ্চা। বাকি বাচ্চা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে নিজের কান্না দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে; বাবা মার ভয়ে অথবা কোনো কিছুর আশ্বাসে। বেশিরভাগ যাত্রীই চুপচাপ আছে। কেউ কেউ পান করছে মদ। কতিপয় লোক চেষ্টা করছে জোর ক’রে হাসার যা তাদের ভীতিটাকেই প্রকাশ করছে। বিমান যাত্রা অনেকের কাছেই ভীতিকর, কিন্তু কেউই এই ভীতিটাকে জয় করতে পারে না। যখন মানুষ নিজেকে মাটি থেকে ত্রিশ হাজার ফিট উপরে ধাতব কোনো বাক্সে আবদ্ধ করে তখন সে যারপরনাই হুমকীর মুখে পড়ে যায়। কোনোভাবে নিচে পড়ে গেলে তার শরীরটা মাংসের দলা হয়ে যাবে। সে সময়ে একজন মানুষের মনে কী ধরনের প্রশ্ন ঘুরপাক খাবে? কিভাবে প্রতিক্রিয়া করবে?

রোগীটি সেই জবাব খোঁজার চেষ্টা করলো। এটা তার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে বসে আছে জানালার পাশে, তার চোখ বিমানের ডানার দিকে, প্রচণ্ড শক্তিশালী বাতাসের আঘাতে সেই ধাতব ডানাটি কাঁপছে। বাতাসের স্রোত একে অন্যকে ধাক্কা দিচ্ছে। মনুষ্য তৈরি খোলনলচেটাকে আঘাত করছে আর বুঝিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতির অসীমতায় এই মনুষ্যসৃষ্ট জিনিসটা একেবারেই তুচ্ছ। বাইরে থেকে এক আউন্সের একটা আঘাতেই বিমানটা ভেঙে পড়তে পারে। বিস্ফোরিত হয়ে লোকগুলোসহ ছিটকে পড়তে পারে খোলা আকাশেই।

সে কি করবে? কি করার কথা ভাববে? মৃত্যুর সীমাহীন ভীতি ছাড়া কি সে অন্যকিছু ভাবতো? এটা নিয়েই তাকে আরো ভাবতে হবে। পোর্ত নোয়ে’তে ডাঃ ওয়াশবার্ন এটাই তার মধ্যে ঢোকানোর চেষ্টা করেছেন। ডাক্তারের কথাগুলো আবার মনে পড়ে গেলো তার।

যখনই তুমি খুব চাপযুক্ত পরিবেশে পড়বে—নিজেকে তার মধ্যে প্রোথিত করবে, কোনোভাবেই বিযুক্ত করবে না। যতোটা মুক্তভাবে সম্ভব মানিয়ে নেবার চেষ্টা করবে; কথা আর ছবিগুলো তোমার মাথায় প্রবেশ করতে দেবে। সেগুলোর মধ্যেই তুমি ক্লু খুঁজে পাবে।

রোগী জানালা দিয়ে চেয়ে রইলো। সচেতনভাবেই নিজের অবচেতন মনটাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করলো সে। কাঁচের বাইরে প্রকৃতির হিংস্রতার দিকে চোখ দুটো স্থির ক’রে রাখলো যাতে ছবি আর শব্দ তার স্মৃতিতে ভরে উঠে ।

তারা এলো—আস্তে আস্তে। আবারো অন্ধকার দেখা যাচ্ছে। বিক্ষুব্ধ বাতাসের শব্দ ক্রমাগতভাবে বাড়তে লাগলো যতোক্ষণ না সে ভাবলো তার মাথাটা বুঝি বিস্ফোরিত হয়ে যাবে। তার মাথা…বাতাস তার মাথা এবং মুখের বাম দিকে এসে ঝাপটা মারছে। তার শরীরের চামড়া পুড়িয়ে ফেলছে। বাম কাঁধটাকে রক্ষা করার জন্যে তুলতে বাধ্য হলো সে… বাম কাঁধ। বাম হাত। তার হাতটা উঠে গেলো। তার বাম হাতের আঙুলগুলো একটা সোজা ধাতব জিনিসের প্রান্ত ধরে রেখেছে। ডান হাতটা ধরে রেখেছে…একটা স্ট্র্যাপ। স্ট্র্যাপটা ধরে কিছু একটার জন্যে অপেক্ষা করছে সে। একটা সিগনাল, একটা ফ্লাশিং লাইট অথবা কাঁধে একটা মৃদু চাপড়, অথবা দুটোই। একটা সিগনাল। সেটা এলো। ডুবে গেলো সে অন্ধকারের মধ্যে। একটা শূন্যতার মধ্যে তার শরীরটা উল্টে পাল্টে যাচ্ছে, ভেসে যাচ্ছে রাতের আকাশে। সে…প্যারাসুট পরে আছে।

“ইতেভু মালাদে?”

পাশে বসা নার্ভাস প্যাসেঞ্জার তার বাম হাতটা স্পর্শ করলে ভেঙে গেলো তার উন্মাদগ্রস্ত দিবাস্বপ্নটা—হাতটা একটু উপরে তোলা ছিলো। হাতের আঙুলগুলো এমনভাবে ছড়ানো ছিলো যেনো সেগুলো কোনো কিছুকে প্রতিরোধ করছে। তার ডান হাতটার বাহু তার বুক চেপে আছে। সেই হাতের আঙুলগুলো ধরে আছে কলারটা, কাপড়টাকে খামচে ধরে রেখেছে সে। তার কপাল বেয়ে দরদর ক’রে ঘাম ঝরছে। এটা ঘটছে। অল্প সময়ের জন্যে অন্য কিছুর উদয় হলো।

“ক্ষমা করবেন,” হাতটা নামিয়ে বললো সে। “উ মভোয়া রেভে,” সে অর্থহীনভাবেই বললো কথাটা।

ছেদ পড়লো একটা। এজন স্টুয়ার্ডসের হাসি হাসি মুখটা দেখা গেলো আবার। বিব্রতকর যাত্রীরা একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে।

রোগীটি তার চারপাশে তাকিয়ে কিছুই বুঝতে পারলো না। তার চোখ আর কানে যেসব ছবি আর শব্দ এসেছিলো সেগুলো নিয়ে ভাবছে সে। একটা প্লেন থেকে লাফ দিচ্ছে…রাতের বেলা…নীল, ধাতব, আর স্ট্র্যাপ তার বুকে কোমরে জড়িয়ে আছে। প্যারাসুট পরে আছে সে। কোথায়? কেন?

নিজেকে অত্যাচার করা বন্ধ করো!

নিজের এই ভাবনাটা দূর করার জন্যে বুক পকেট থেকে বদলে ফেলা পাসপোর্টটা বের করলো সে। যেমনটি প্রত্যাশা করা হয়েছিলো, ওয়াশবার্ন নামটি উদয় হলো আবার। জিওফ্রে আর. বদলে জর্জ পি. করা হয়েছে দক্ষতার সাথেই। অক্ষরগুলো তুলে নতুন নামটি বসানো হয়েছে। ছবিটা ঢোকানো হয়েছে আরো দক্ষতায়। এটাকে আর রাস্তার পাশে সস্তা কোনো আর্কেড থেকে তোলা ছবি ব’লে মনে হচ্ছে না। আইডেন্টিফিকেশন নাম্বারটা অবশ্যই একদম ভিন্ন, নিশ্চয়তা দেয়া আছে কোনো ইমিগ্রেশনের কম্পিউটারে এটা ধরা পড়বে না। যতোক্ষণ না আসল মালিক তার পাসপোর্টটা সাবমিট করছে ইন্সপেকশনের জন্যে। সেই সময় থেকে এটা হয়ে যাবে ক্রেতার দায়িত্ব। বেশ ভালো পরিমাণ টাকা দেয়া হয়েছে কাজটা নিখুঁতভাবে করার জন্যে। ইন্টারপোল আর ইমিগ্রেশনের সাথে কানেকশান না থাকলে এটা করা সম্ভব নয়। ইউরোপিয়ান সীমান্তগুলোর কাস্টমস্ অফিসার আর কম্পিউটার ক্লার্কদেরকে এজন্যে নিয়মিত টাকা দেয়া হয়। তারা খুব কমই ভুল করে।

জর্জ পি. ওয়াশবার্ন। এই নামটিতে মোটেও অভ্যস্ত নয় সে। নামটি পাসপোর্টের সত্যিকারের মালিকের। যে কিনা নিজের পরিচয় লুকিয়ে পালিয়ে আছে প্রত্যন্ত এক অঞ্চলে। কিন্তু সে চাচ্ছে নিজের পরিচয় উদঘাটন করতে। জানতে চাচ্ছে সে কে।

অথবা সে কি করেছে?

যাইহোক, প্রশ্নের জবাবটা নিহেত আছে জুরিখে। আর জুরিখে আছে…

“মেদামে এত্ মেঁসিয়ে। নু কমেকোয়াঁ নতর দিসেন্তে পোর লায়ারোপোর্তে দ্য জুরিখ।”

.

সে হোটেলের নামটি জানে : ক্যারিলন দুলাক। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে সে কোনো রকম না ভেবেই এই নামটি বলেছিলো। কোথাও কি সে এই নামটি পড়েছে? এই নামটি কি সে প্লেনের সামনের সিটগুলোতে স্বাগতম জুরিখ লেখাটার নিচে দেখেছে?

না। লবিটা সে চেনে। যেভাবেই হোক না কেন, ভারি পালিশ করা কালো রঙের কাঠটা তার কাছে পরিচিত। আর বিশাল কাঁচের জানালা, যেটা দিয়ে লেক জুরিখ দেখা যায়, সেটাও। এখানে এর আগেও এসেছে সে। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানেও এর আগে এসেছে মার্বেলের কাউন্টারের সামনে অনেক দিন আগে।

ডেস্কে বসা ক্লার্কের কথায়ও সেটা আরো নিশ্চিত করে বোঝা গেলো। সেটা যেনো আঘাত হানলো বিস্ফোরণের মতো।

“আপনাকে আবার দেখতে পেয়ে ভালো লাগছে, স্যার। অনেক দিন পরে এলেন।”

তাই নাকি? কতোদিন পরে? আরে বাবা, তুমি আমার নাম ধরে ডাকছো না কেন? ঈশ্বরের দোহাই লাগে। আমি তোমাকে চিনি না। আমি আমাকেও চিনি না। আমাকে সাহায্য করো। দয়া ক’রে সাহায্য করো!

“হ্যা, অনেক দিন পরে,” সে বললো। “একটু সাহায্য করুন তো। আমার হাতটা একটু মচকে গেছে, লিখতে খুব সমস্যা হচ্ছে। আপনি যদি রেজিস্ট্রেশনটা ক’রে দেন, তাহলে আমাকে কেবল স্বাক্ষর করে দিলেই হবে।” রোগীটি তার নিঃশ্বাস বন্ধ ক’রে রাখলো।

হয়তো কাউন্টারের এই ভদ্রলোক তার নামটা আবারো বলতে বলবে, অথবা নামের বানানটি কি সেটা জানতে চাইবে?

“অবশ্যই।” ক্লার্ক একটা কার্ডে লিখতে লাগলো। “আপনি কি হোটেলের ডাক্তারকে দেখাবেন?”

“পরে দেখাবো। এখন না।”

ক্লার্ক লিখে কার্ডটা উল্টো ক’রে তার সামনে তুলে ধরলো স্বাক্ষর করার জন্যে। মি: জে. বর্ন। নিউইয়র্ক, ইউ.এস.এ।

সে কার্ডটার দিকে সম্মোহিতের হয়ে রইলো। তার একটা নাম আছে নামের একটা অংশ। একটা দেশ এবং যে শহরের সে থাকে তার নামও।

জে. বর্ন। জন? জেমস? জোসেফ? জে-তে কি হয়?

“কোনো ভুল হয়েছে কি, হের বর্ন?” ক্লার্ক জানতে চাইলো।

“ভুল? না, মোটেও না।” কলমটা তুলে নিলো সে। তাকে কি তার নামের প্রথম অংশটা লিখতে হবে? না। ক্লার্ক যেমনটি লিখেছে সে ঠিক তেমনটিই লিখবে।

মি: জে. বর্ন।

সে নামটা যতোটা সম্ভব স্বাভাবিকভাবে লিখলো, নিজের মনটাকে একেবারে মুক্ত করে, যে ছবি আর শব্দ আসতে পারে সেটার সুযোগ ক’রে দিয়ে। কিন্তু কিছুই এলো না। সে অনেকটা অপরিচিত একটা নামই স্বাক্ষর করলো। তার কোনো অনুভূতিই হলো না।

“আপনি আমাকে ঘাবড়ে দিয়েছিলেন, মেইন হের,” ক্লার্ক বললো। “আমি ভাবছিলাম, হয়তো আমি কোনো ভুল ক’রে ফেলেছি। খুব ব্যস্ত একটা সপ্তাহ গেছে। দিনটা ছিলো আরো ব্যস্ততম। কিন্তু তারপরও আমি খুবই নিশ্চিত ছিলাম।”

সে যদি ভুল করতো? যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির মিঃ জে. বর্ন ভাবতেই পারলো না সম্ভাবনাগুলোর কথা। “আপনার স্মরণ শক্তির ব্যাপারে আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিলো না…হের স্টসেল,” রোগীটি ক্লার্কের পেছনের দেয়ালে লেখা নামটি পড়ে বললো। কিন্তু লোকটা ক্যারিলন দুলাকের অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার।

“আপনার দয়া, স্যার।” অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার একটু সামনে ঝুঁকে বললো। “আমার মনে হয় আপনি এখানে সচরাচর যেরকম রুম আর সার্ভিস পেতেন সেরকম কিছুই আজকে চাচ্ছেন?”

“কিছু হয়তো বদলে যাবে,” জে. বর্ন বললো। “এর আগে আপনাকে কি বলা হয়েছিলো?”

“ডেস্কে যেই ফোন করুক অথবা খোঁজ করুক, তাকে যেনো বলা হয় আপনি হোটেলে নেই। আর আপনি যেখানেই থাকুন না কেন আপনাকে সেটা জানিয়ে দিতে হবে। কেবল আপনার নিউইয়র্কের ফার্মটি বাদে। ট্রেডস্টোন সেভেনটি- ওয়ান, কর্পোরেশন, আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে।”

আরেকটা নাম! এটা সে ওভারসিস কল ক’রে জেনে নিতে পারে। টুকরো টুকরো তথ্য জড়ো হচ্ছে। উত্তেজনা আর আনন্দ ফিরে এলো।

“ঠিক আছে। আমি আপনার কর্মতৎপরতার কথা ভুলবো না।”

“এটা জুরিখ,” লোকটি জবাব দিলো। “আপনি সব সময়ই খুব উদার, হের বর্ন। পেইজ—হিয়ের হের, বিত্তে!”

পেইজের পেছন পেছন লিফটের দিকে যাওয়ার সময় কয়েকটা বিষয় বেশ পরিস্কার হয়ে গেলো বর্নের কাছে। তার একটা নাম আছে, আর হোটেলের ম্যানেজার কেন এতো দ্রুত তার নামটি স্মরণ করতে পারলো সেটাও বুঝতে পারছে সে। তার একটা দেশ আছে, শহর আছে এবং একটা ফার্মও আছে যেখানে সে চাকরি করে—অথবা করতো। আর যখনই সে জুরিখে আসতো তখনই তাকে অপ্রত্যাশিত এবং অযাচিত ভিজিটরদের কাছ থেকে রক্ষা করার জন্যে কিছু ব্যবস্থা নেয়া হোতো। এই ব্যাপারটাই সে বুঝতে পারলো না। কেউ নিজেকে পুরোপুরি রক্ষা করবে নাহয় একদমই রক্ষা করবে না। এতো ঢিলেঢালা প্রক্রিয়ায়, এরকম একটি হোটেলে নিজেকে কতোটুকুই বা রক্ষা যাবে? মুহূর্তেই তার মনে হলো, এটা যেনো বাচ্চা-ছেলেপুলের চোর-পুলিশ খেলা। আমি কোথায়? চেষ্টা করো আমাকে খোঁজার। আমি উচ্চস্বরে কিছু বলে তোমাদের একটা ইঙ্গিত দেবো।

তবে এটা কোনো পেশাদার কাজ নয়। কিন্তু বিগত আটচল্লিশ ঘণ্টায় সে যা শিখেছে তাতে তার মনে হচ্ছে সে একজন পেশাদার লোক। এ সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই, তারপরও এ নিয়ে কোনো তর্ক করা চলে না।

.

নিউইয়র্কের অপারেটরের কণ্ঠটা ক্ষীণ শোনালো। মেয়েটার বক্তব্য খুব পরিস্কার আর চূড়ান্ত। “এ ধরনের কোনো কোম্পানি আমাদের তালিকায় নেই, স্যার। আমি সব তালিকা চেক ক’রে দেখেছি, একেবারে সাম্প্রতিক তালিকাটাও, ট্রেডস্টোন নামের কোনো কোম্পানি নেই নামের পরে যে সংখ্যাটা উল্লেখ করেছেন, তারও কোনো হদিস পাওয়া যায় নি।”

“হয়তো তারা একটু সংক্ষেপে লিখে দিয়েছে…”

“এই নামে কোনো ফার্ম বা কোম্পানি নেই, স্যার। আমি আবারো বলছি, আপনার কাছে যদি প্রথম অথবা দ্বিতীয় কোনো নাম থাকে, অথবা প্রতিষ্ঠানটি যেধরনের কাজ করে সেটা যদি বলতেন তো সাহায্য করতে পারি।”

“নাম ছাড়া আমার কাছে কিছু নেই, ট্রেডস্টোন সেভেনটি-ওয়ান, নিউইয়র্ক, সিটি।”

“এটা খুবই অদ্ভুত নাম, স্যার। আমি নিশ্চিত, তালিকায় নামটা থাকলে খুব সহজেই আমি খুঁজে দিতে পারতাম। আমি দুঃখিত।”

“আপনাকে কষ্ট দিলাম, ধন্যবাদ।” জে. বর্ন ফোনটা রেখে দিলো। এরকম দিকবিহীনভাবে এগোনো যাবে না। নামটা এক ধরনের কোডের মতো। এ দিয়ে হয়তো কোনো ঠিকানা বোঝানো হয় নি।

বুরোর দিকে এগোলো সে, ওখানে তার মানিব্যাগ আর সিকো ঘড়িটা রেখেছিলো। মানিব্যাগটা পকেটে রেখে সিকো ঘড়িটা হাতে পরে নিলো বর্ন। আয়নায় তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললো, “তুমি জে. বর্ন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, নিউইয়র্কের বাসিন্দা, আর ‘০৭১৭১২০১৪২০৬০’ সংখ্যাটা তোমার জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস।”

.

রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে অভিজাত ব্যাংক ব্যানহফস্ট্রাসের ভবনটা দারুণ দেখাচ্ছে। ডাঃ ওয়াশবার্নের রোগী সেই ব্যাংকে প্রবেশ করলো। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই বুঝতে পারলো এখানে এর আগেও সে এসেছে। তবে অন্যসব ছবির মতো এই জায়গার ছবিটা ততোটা শক্তিশালী নয়। তার মধ্যে এক ধরণের অস্বস্তির ভাব উদ্রেক হলো, কিন্তু এরকম গেইমেনশেট ব্যাংকে ঢুকে এইসব বাজে অনুভূতি বাদ দিতে হবে, নইলে উল্টাপাল্টা কিছু ঘটে যাবে।

কিন্তু এখন আর এটা বাদ দেয়া গেলো না।

“বহুঁখ মঁসিয়ে। ভু দিসাইরেজ…?” ব্যাংকের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা এক ভদ্রলোক জানতে চাইলো। ফরাসিতে বলার কারণ হয়তো ক্লায়েন্টের পোশাক আশাক।

“আমাকে একটা ব্যক্তিগত আর গোপনীয় ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে হবে,” জে. বর্ন জবাব দিলো ইংরেজিতে। নিজের স্বতঃস্ফূর্ত ইংরেজি উচ্চারণ শুনে আরেক বার সে নিজেই চমকে গেলো। ইংরেজি ব্যবহার করা হয়েছে দুটো কারণে : সে ব্যাংকের কর্মচারিটির ধারণা ভুল প্রমাণ ক’রে দিতে চায়, আর পরবর্তী ঘণ্টায় কোনো কিছু ভুলবোঝাবুঝি হোক সেটা চায় না।

“ক্ষমা করবেন, স্যার,” লোকটা বললো। তার ভুরু কিছুটা কুচকে আছে। ক্লায়েন্টের টপকোটটা ভালো ক’রে দেখছে সে। “আপনার বাম দিকের লিফটে স্যার, তৃতীয় তলা। ওখানকার রিসেপশনিস্ট আপনাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবে।”

যে রিসেপশনিস্টের কথা বলা হলো সে মধ্য বয়স্ক, ছোটো ছোটো ক’রে চুল কাটা আর চশমা পরা এক লোক। “আপনি কি সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের সাথে কোনো গোপনীয় এবং ব্যক্তিগত ব্যাপারে জড়িত, স্যার?” জানতে চাইলো সে। ক্লায়েন্টের বলা কথাটাই সে প্রতিধ্বনিত করলো।

“হ্যা।”

“আপনার স্বাক্ষর, প্লিজ,” ব্যাংকের একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বললো লোকটা। সেখানে দুটো স্বাক্ষর করার ঘর রয়েছে।

ক্লায়েন্ট বুঝতে পারলো কোনো নামের দরকার নেই। হাতে লেখা সংখ্যাটা একজনের…সেটি একাউন্টের মালিকের। এটাই সাধারণ নিয়ম। ওয়াশবার্ন বলেছিলেন।

রোগী সংখ্যাগুলো লিখলো। নিজের হাত দুটো রিলাক্স করলো যাতে লিখতে সুবিধা হয়। কাগজটা ফিরিয়ে দিলে সেটা ভালো ক’রে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কতোগুলো কাঁচের দরজার দিকে ইঙ্গিত করলো রিসেপশনিস্ট।

“আপনি যদি চতুর্থ ঘরটিতে অপেক্ষা করেন তাহলে খুব জলদি একজন এসে আপনাকে সাহায্য করবে।”

“চতুর্থ রুম?”

“বাম দিক থেকে চতুর্থ দরজা। ওটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই লক্ হয়ে যাবে।”

“তার কি খুব একটা দরকার আছে?”

রিসেপশনিস্ট চমকে তার দিকে চেয়ে রইলো। “এটা তো আপনার অনুরোধেই করা হচ্ছে, স্যার,” ভদ্রভাবে বললো সে। নিজের বিস্মিত হওয়ার ভাবটা সৌজন্যতার আড়ালে লুকিয়ে ফেললো। “এটা হলো থ্রি-জিরো একাউন্ট। এই একাউন্ট হোল্ডাররা ফোন ক’রে আগেই একটা প্রাইভেট প্রবেশদ্বারের ব্যবস্থা করার কথা বলতে পারেন।”

“আমি সেটা জানি,” ওয়াশবার্নের রোগী মিথ্যে বললো, তবে খুবই দক্ষতার সাথে। “আসলে খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে আছি।”

“তাহলে ভেরিফিকেশন ক’রে দিচ্ছি, স্যার।”

“ভেরিফিকেশন?” আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের মি: জে. বর্ন কথাটা না বলে পারলো না। কথাটার মধ্যে আৎকে ওঠার একটা ভাব আছে।

“স্বাক্ষর ভেরিফিকেশন, স্যার,” লোকটা চশমা ঠিক করতে করতে বললো। “এক কাজ করেন, স্যার। চার নাম্বার রুমে গিয়ে অপেক্ষা করেন।” কথাটা অনুরোধের মতো নয় আদেশের মতোই শোনালো।

“অবশ্যই। কেবল একটু তাড়াতাড়ি করতে বলুন, বুঝলেন?” রোগীটি বলেই চতুর্থ রুমে ঢুকে পড়লো। দরজাটা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেলে দরজার খোলা কাঁচের দিকে তাকালো সে। এটা সাধারণ কোনো কাঁচ নয়। ভাঙতে গেলে অ্যালার্ম বেল বেজে উঠবে আর তার ঠিকানা হবে চৌদ্দ শিকের ভেতরে। ঘরটা খুব ছিমছাম। দুটো চামড়ার চেয়ার আর একটা ছোটো টেবিল রয়েছে। বিপরীত দিকে আছে দ্বিতীয় আরেকটা দরজা। সেটা অবশ্য লোহার তৈরি। তার পাশেই তিনটি ভাষায় ম্যাগাজিন আর পত্রিকা রাখা আছে। রোগী চেয়ারে ব’সে হেরাল্ড ট্‌বিউন- এর প্যারিস সংস্করণটি হাতে তুলে নিলো। ছাপা অক্ষরগুলো পড়লেও সেগুলো তার মাথায় ঢুকলো না। যেকোনো মুহূর্তে ডাক আসতে পারে। সে কেবল কৌশলটা নিয়ে ভাবছে। স্মৃতিবিহীন কৌশল। কেবলমাত্র প্রবৃত্তির তাড়ণায়। অবশেষে লোহার দরজাটা খুলে গেলে একজন লম্বা আর পরিপাটী পোশাক পরা লোককে দেখা গেলো। হাত বাড়িয়ে সুইস টানে ইংরেজি বললো লোকটা

“আপনার সাথে দেখা হওয়াতে খুব খুশি হয়েছি। দেরির জন্যে ক্ষমা করবেন। সত্যি বলতে কি, এটা একটু হাস্যকর হয়ে গেছে।”

“কি রকম?”

“আমার মনে হয় আপনি হের কোয়েনিগকে ভড়কে দিয়েছেন। থু-জিরো একাউন্ট হোল্ডাররা আগেভাগে না জানিয়ে খুব একটা আসেন না তো। সে আবার ব্যতিক্রম কিছু প্রত্যাশা করে না। সবসময় রুটিনমাফিক কাজ ক’রে অভ্যস্ত। ব্যতিক্রম কিছু হলেই তার দিনটা মাটি হয়ে যায়। কিন্তু আমার কাছে এরকম ব্যাপার ভালোই লাগে। আমি ওয়াল্টার এপফেল। প্লিজ, আসুন।” ব্যাংকের অফিসার রোগীর হাতটা ছেড়ে দিয়ে লোহার দরজাটার দিকে ইঙ্গিত করলো। দরজার ওপাশে ঘরটা ইংরেজি ‘ভি’ অক্ষর আকৃতির। কালো রঙের ছাদ, দামি দামি সব আসবাব আর প্রশস্ত একটি ডেস্ক। ডেস্কের পাশেই একটা জানালা।

“তাকে ঘাবড়ে দেবার জন্যে আমি খুবই দুঃখিত,” জে. বর্ন বললো। “আমার আসলে হাতে সময় খুব কম, তাই এমনটি করেছি।”

“হ্যা, সে এ কথা বলেছে।” এপফেল ডেস্কের ওপাশে গিয়ে চেয়ারে বসার জন্যে ইঙ্গিত করলো তাকে।

“বসুন। দুয়েকটা ফরমালিটিজের পরই আমরা কাজের কথায় আসবো।” তারা দু’জনেই ব’সে পড়লো। অফিসার এবার সাদা রঙের ক্লিপবোর্ড ফাইল বাড়িয়ে দিলো গ্রাহকের উদ্দেশ্যে। ফাইলে যে কাগজ আছে তাতে দুটো স্বাক্ষরের জায়গায় দশটি ফাঁকা জায়গা রয়েছে। “আপনার স্বাক্ষর, প্লিজ। কমপক্ষে পাঁচটি হলেই হবে।”

“আমি বুঝতে পারছি না। এইমাত্র তো দিলাম।”

“হ্যা, তা দিয়েছেন। সেটা ঠিকই আছে। এটা ভেরিফিকেশন কনফার্ম করার জন্যে।”

“তাহলে আবার কেন?”

“বার বার স্বাক্ষর নেয়া হয় এজন্যে যে, যদি সেটা আসল মালিকের না হয় তবে সহজেই বোঝা যাবে। একটা গ্রাফোকোলজিক্যাল স্ক্যানার সঙ্গে সঙ্গে এটা ধরতে পারবে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, এ নিয়ে আপনার কোনো দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই।” এপফেল একটা কলম বাড়িয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বললো। “সত্যি বলতে কি, আমি না, কোয়েনিগই এরকমটি করতে বলেছে।”

“সে খুবই সতর্ক একজন লোক,” রোগীটি বললো। কলমটা নিয়ে লিখতে লাগলে চতুর্থ স্বাক্ষরের সময় অফিসারটি তাকে থামিয়ে দিলো।

“এতেই হবে, আর তো কোনো প্রয়োজন দেখছি না। খামোখাই সময় নষ্ট করা।” এপফেল কাগজটা নেবার জন্যে হাত বাড়ালো। “ভেরিফিকেশন বলছে সব ঠিক আছে। এটার ভিত্তিতে দেয়া রিসিপ্ট পেলেই একাউন্টটা আপনি ব্যবহার করতে পারবেন।” কাগজটা একটা লোহার ড্রয়ারে রাখতে রাখতে বললো সে। ডেস্কের একপাশে একটা বোতাম চাপলে উজ্জ্বল একটি আলো জ্বলে উঠে আবার নিভে গেলো। “এটা স্বাক্ষরটাকে সরাসরি স্ক্যানারে পাঠিয়ে দেবে।” অফিসার বলতে লাগলো। “প্রোগ্রাম করা আর কি। সত্যি বলতে কি, আবারো বলছি, তার আসলে কোনো দরকারই নেই। আমরা যদি একেবারে গদর্ভ না হই তবে কেউই আমাদেরকে বোকা বানাতে পারবে না।”

“কেন পাবে না? কেউ যদি এতো দূর পর্যন্ত এসে পড়ে তাহলে সুযোগ নেবে না কেন?”

“এই অফিস থেকে বের হবার একটাই মাত্র দরজা আছে। আমি নিশ্চিত আপনি ওয়েটিং রুমের লক্ করার শব্দটি শুনতে পেয়েছেন?”

“কাঁচের মধ্যে অ্যালার্মের তারও দেখেছি,” রোগীটি আরো বললো।

“তাহলে তো আপনি বুঝেছেনই। কেউ উল্টাপাল্টা করলেই ফাঁদে পড়ে যাবে।”

“কারো কাছে যদি অস্ত্র থাকে?”

“আপনার কাছে সেরকম কিছু নেই।”

“কেউ তো আমাকে তল্লাশী করে নি।”

“লিফটেই কাজটা করা হয়েছে। চারটা ভিন্ন ভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে। আপনার কাছে কোনো অস্ত্র থাকলে লিফটা প্রথম আর দ্বিতীয় তলার মাঝখানেই থেমে থাকতো।”

“আপনারা সবাই খুব সতর্ক।”

“আমরা সর্বোত্তম সেবা দেয়ার চেষ্টা করি, স্যার।” ফোনটা বেজে উঠলে এপফেল জবাব দিলো, “হ্যা?…আসছি।” ব্যাংকের অফিসার তার গ্রাহকের দিকে তাকালো। “আপনার একাউন্ট ফাইলগুলো আসছে।”

“খুব জলদি হলো দেখছি।”

“হের কোয়েনিগ কয়েক মিনিট আগে স্বাক্ষর ক’রে দিয়েছেন। সে স্ক্যানারের ফলাফলের জন্যে অপেক্ষা করছিলো কেবল।” এপফেল একটা ড্রয়ার খুলে চাবি বের করলো। “আমি নিশ্চিত সে হতাশ হয়েছে। সে খুব নিশ্চিত ছিলো কিছু একটা ঘাপলা আছে।”

লোহার দরজাটা খুলে গেলে রিসেপশনিস্ট একটা ধাতব বাক্স নিয়ে প্রবেশ করে বাক্সটা ডেস্কের উপর রাখলো সে, পাশেই আছে এক বোতল পেরিয়ার মদ আর দুটো গ্লাস।

“আপনি কি জুরিখে আপনার সময় উপভোগ করছেন?” অফিসার জিজ্ঞেস করলো নিরবতা ভাঙার জন্যেই।

“খুব। আমার রুম থেকে লেক দেখা যায়। চমৎকার দৃশ্য, খুবই প্রশান্তির।”

“দারুণ,” এপফেল বললো, এক গ্লাস মদ ঢেলে দিলো গ্রাহকের জন্যে। “আপনার একাউন্ট, স্যার,” রিং থেকে একটা চাবি বেছে নিয়ে বললো। “আমি কি কেস্‌টা খুলবো, নাকি আপনি নিজেই সেটা খুলবেন?”

“খুলুন। আপনিই খুলুন।”

অফিসার চেয়ে রইলো। “খুলবো বলতে আমি তালা খোলার কথা বলছি, বাক্স খুলতে নয়। এটা তো আমার খোলার কথা নয়। এটা আপনাকেই খুলতে হবে।”

“কেন নয়?”

“আপনার বাক্স খোলার দায়িত্ব আমার নয়।

“ধরুন আমি ব্যবসায়িক কাজে লেনদেন করবো? টাকা ট্রান্সফার করবো, কারো কাছে পাঠাবো, তো আমাকে কি করতে হবে?”

“সেটা উইথড্রল ফর্মে আপনার সংখ্যা আর স্বাক্ষর নিয়ে করা যাবে।”

“অথবা অন্য কোনো ব্যাংকে পাঠালে — সুইজারল্যান্ডের বাইরে?”

“তাহলে একটা নামের দরকার হবে। সে ক্ষেত্রে ঐসব পরিচয় আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়বে

“খুলুন।”

অফিসার খুলতে লাগলে ওয়াশবার্নের রোগীটি নিঃশ্বাস বন্ধ ক’রে রাখলো। তার পেটে তীক্ষ্ণ একটা ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। এপফেল একটা কাগজ বের ক’রে একাউন্টের মালিককে দিলো।

গেইমেনশেফট লেটারহেডের এবং টাইপ করা অক্ষরে নিচের কথাগুলো ইংরেজিতে লেখা। এটা যে গ্রাহকের মাতৃভাষা সেটা নির্ঘাত বলা যায়।

একাউন্ট : ০১৭১৭১২০১৪২০৬০
নাম : মালিকের নির্দেশে গোপন করা হলো।
একসেস : আলাদা আলাদা কভারে সিল করা আছে।
 ডিপোজিটের বর্তমান জমা : ৭৫০০০০০ ফ্রাঁ

আস্তে ক’রে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রোগী। অঙ্কটার দিকে তাকিয়ে রইলো সে। এরকমটি কোনোভাবেই প্রত্যাশা করে নি। বিগত পাঁচ মাসে তার যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে এটা তার মধ্যে সবচাইতে বেশি ভীতিকর। অঙ্কটার পরিমাণ আমেরিকান ডলারে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন!

৫০০০০০০!

কিভাবে? কেন?

কাঁপতে থাকা হাতটা নিয়ন্ত্রণ করে সে স্টেটমেন্টের এন্ট্রিটা হাতে তুলে নিলো। সংখ্যাটা অনেক, অঙ্কটা অভাবনীয়। ৩০০,০০০ ফ্রাঁ’র কম হবে না। তেইশ সপ্তাহ আগে পাঁচ থেকে আট সপ্তাহ অন্তর অন্তর টাকা তোলা হয়েছে। সবচাইতে শেষ স্টেটমেন্টটার দিকে তাকালো সে। প্রথমে এটা সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংক থেকে ট্রান্সফার করা হয়েছে। বিশাল অঙ্কের টাকা। দুই মিলিয়ন, সাত লক্ষ মালয়েশিয়ান ডলার। সেটা ৫১৭৫৫০০০ সুইস ফ্রাঁ’তে বদলে নেয়া হয়েছে।

স্টেটমেন্টটার নিচে সে টের পেলো দুটো আলদা খাম আছে। কাগজটা তুলে নিলো। খামটাতে কালো বর্ডার দেয়া আছে। উপরে টাইপ করা কিছু লেখা :

আইডেন্টি : কেবলমাত্র মালিকের প্রবেশাধিকার।

আইনী বিধিনিষেধ : প্রবেশ-রেজিস্টার্ড অফিসার, ট্রেডস্টোন সেভেনটিওয়ান কর্পোরেশন, প্রাপক প্রেরকের কাছ থেকে লিখিত আদেশ পাবেন। ভেরিফিকেশনের বিষয়।

“এটা আমি একটু চেক্ ক’রে দেখতে চাই,” গ্রাহক বললো।

“এটা আপনার সম্পত্তি,” জবাব দিলো এপফেল। “আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি, এটা একেবারে অক্ষত ছিলো।”

রোগী এনভেলপটা হাতে নিয়ে উল্টে দেখলো। ফ্ল্যাপে ব্যাংকের সিল দেয়া আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খামটা কেউ খোলে নি। খামটা ছিঁড়ে কার্ডটা বের ক’রে পড়লো সে :

মালিক : জেসন চার্লস বর্ন

ঠিকানা : তালিকাভুক্ত নয়।

নাগরিকত্ব : ইউ.এস.এ

জেসন চার্লস বর্ন। জেসন। ‘জে’তে তাহলে জেসন! তার নাম জেসন বর্ন। বর্ন দিয়ে কিছুই বোঝায় না, ‘জে. বর্নও অর্থহীন, কিন্তু জেসন বর্ন-এর সম্মিলিত রূপটি পূর্ণতা পেলো। সে এটা মেনে নিতে পারে। এটা সে মেনেই নিয়েছে। সে হলো জেসন চার্লস বর্ন, একজন আমেরিকান; নিজের হৃদস্পন্দনটা শুনতে পাচ্ছে। স্পন্দনের শব্দে তার কানে তালা লাগবার যোগাড় হলো। পেটের যন্ত্রণাটা আবারো শুরু হলো। এটা কি? তার কেন অন্ধকারে তলিয়ে যাবার অনুভূতি হচ্ছে?

“আপনার কি কিছু হয়েছে?” এপফেল জিজ্ঞেস করলো। “কিছু হয়েছে কি, হের বর্ন?”

“না। সব ঠিক আছে। আমার নাম বর্ন। জেসন বর্ন।”

সে চিৎকার করছে? ফিফিস্ করছে? সে বলতে পারবে না।

“আপনার নাম জানতে পারাটা আমার সৌভাগ্য, মি: বর্ন। আপনার পরিচয়টা গোপন থাকবে। আপনাকে গেইমেনশেফট ব্যাংকের একজন অফিসার কথা দিচ্ছে।”

“ধন্যবাদ। আমাকে প্রচুর পরিমাণের টাকা ট্রান্সফার করতে হবে, আপনার সাহায্য লাগবে আমার।”

“এটাতো আমার সৌভাগ্য। আপনার কি ধরণের সাহায্য লাগবে বলুন কেবল। আমি খুশি মনে ক’রে দেবো সেটা।”

মদের গ্লাসটা তুলে নিলো বর্ন।

.

এপফেলের অফিসের লোহার দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সে পাশের ঘরে চলে যাবে, তারপর রিসেপশন রুম এবং লিফটের কাছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে সে ব্যানহফস্ট্রাসে রেজিস্টার্ড হবে।

অবশেষে সে পেরেছে। ডা: জিওফ্রে ওয়াশবার্ন একটি অসম্ভব মূল্যবান জীবন বাঁচিয়েছেন। ৫০০,০০০০ সুইস ফ্রাঁ মার্সেই’র একটা ব্যাংকে ট্রান্সফার হয়ে গেলো। ওয়াশবার্নের নাম উল্লেখ না করেই একটা কোডের মাধ্যমে তার ব্যাংক একাউন্টে টাকাটা চলে যাবে। ডাক্তার মার্সেই’তে গিয়ে কোডটা বললেই টাকাগুলো তার হয়ে যাবে। টাকাগুলো পাবার পর ডাক্তারের কি রকম অবস্থা হবে সেই ছবিটা বর্ন কল্পনা করলো। এই বিপুল পরিমাণ টাকা দিয়ে ডাক্তার কী করবে সেটা ডাক্তারের ব্যাপার।

দ্বিতীয় ট্রান্সফারটা হলো প্যারিসের রুই মেদেলিনে, জেসন সি. বর্নের নামে একটা একাউন্টে, ৪৫০০,০০০ ফ্রাঁ। বর্নের স্বাক্ষর সংবলিত একটি কার্ডও সেইসাথে ঐ নির্দিষ্ট ব্যাংকে পাঠিয়ে দেয়া হলো যাতে সে ওখান থেকে টাকাটা তুলতে পারে। কোয়েনিগ আশ্বস্ত করলো তিন দিনের মধ্যেই এসব কাগজপত্র প্যারিসে পৌঁছে যাবে।

তৃতীয় ট্রান্সফারটা সেই তুলনায় খুবই ছোটোখাটো বলা চলে। এক লক্ষ ফ্রা নগদে তোলা হলো এপফেলের অফিস থেকে স্বাক্ষর ক’রে।

ব্যাংকে ডিপোজিটের পরিমাণ রইলো ১৪০০,০০০ সুইস ফ্রাঁ, সেটাও যেকোনো বিচারে কম বলা যাবে না।

কিভাবে? কেন? কোত্থেকে এলো এসব টাকা?

মাত্র এক ঘণ্টা বিশ মিনিটেই পুরো কাজটা সম্পন্ন হয়ে গেলো। কোয়েনিগ সব শেষে এপফেলকে ফোন করলে সে একটা ছোট্ট কালো বর্ডার দেয়া খাম নিয়ে এলো।

“উনে ফিশে,” সে ফরাসিতে বললো।

এপফেল খামটা খুলে একটা কার্ড বের ক’রে কার্ডটা ভালো ক’রে দেখে কোয়েনিগের কাছে দিয়ে দিলো। “কাজ শুরু করা হোক,” বললো সে।

চলে গেলো কোয়েনিগ।

“কি হলো?” জানতে চাইলো বর্ন।

“কেবলমাত্র বিরাট অঙ্কের টাকা ছাড় করবার ব্যাপারে এরকমটি করা হয়। আমাদের ব্যাংকের নিয়ম আর কি।” অফিসার একটু হেসে আশ্বস্ত করলো তাকে।

তালাটা ক্লিক্ ক’রে খুলে গেলে বর্ন ঘোলাটে কাঁচের দরজাটা খুলে হের কোয়েনিগের ব্যক্তিগত এলাকা থেকে বের হয়ে এলো। অন্য দু’জন লোক এসে বসে পড়লো রিসেপশন রুমের ডেস্কের বিপরীত দিকে। যেহেতু তারা ভিন্ন ভিন্ন রুমে বসে নি তাই বর্ন ধারণা করলো তাদের কেউই থ্রি-জিরো একাউন্টের মালিক নয়। সে অবাক হয়ে ভাবলো তারা কোনো নাম অথবা সংখ্যা লিখছে কি না। তবে লিফটের কাছে আসতেই এইসব ভাবনা বাদ দিয়ে বোতাম চাপলো। চোখের কোণে তাকিয়ে কারোর নড়াচড়া টের পেলো সে। কোয়েনিগ মাথা নেড়ে দু’জন লোকের দিকে তাকিয়ে সায় দিলো। লিফটের দরজাটা খুলতেই তারা উঠে দাঁড়ালে বর্ন ঘুরে তাকালো তাদের দিকে। ডানপাশের লোকটি তার ওভারকোটের পকেট থেকে একটা ওয়্যারলেস বের ক’রে খুব সংক্ষেপে দ্রুত কিছু বললো।

বাম পাশের লোকটি তার ডান হাত রেইন কোটের নিচে লুকিয়ে রেখেছে। হাতটা যখন বের করলো দেখা গেলো হাতে একটা অস্ত্র, কালো রঙের একটা পয়েন্ট ৩৮ ক্যালিবারের অটোমেটিক পিস্তল, ব্যারেলে সাইলেন্সার লাগানো।

বর্ন লিফটে ঢুকতেই পেছন থেকে ছুটে এলো ঐ লোক দুটো।

শুরু হয়ে গেলো ভয়ংকর এক উন্মাদনা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *