পর্ব ১
পর্ব ২
পর্ব ৩

বর্ন আইডেন্টিটি – ৩৫

অধ্যায় ৩৫

ট্যান ট্যান ক’রে রেডিওতে রক সঙ্গীত বাজছে, সেই গানের তালে তালে স্টিয়ারিংয়ের উপর দু’হাত রেখে চাপড় মারছে ইয়েলো ক্যাবের ড্রাইভার। ট্যাক্সিটা সেভেনটি ফার্স্ট স্ট্রটের পূর্ব দিকে মোড় নিতেই ইস্ট রিভার ড্রাইভ থেকে আসা গাড়িগুলোর মাঝখানে আঁটকা পড়ে গেলো। এখন সকাল ৮টা ৪৫ বাজে। কিন্তু নিউইয়র্কের ট্র্যাফিক জ্যামটার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। এতো সকালেও সেটা জেঁকে বসেছে।

পেছনের সিটে গুটিসুটি মেরে ব’সে আছে বর্ন, কালো টুপি পরে সানগ্লাসের আড়াল থেকে বাইরের সারি সারি গাছের রাস্তাটা দেখছে সে। এখানে এর আগেও এসেছে, এ ব্যাপারে সে একদম নিশ্চিত। এখানকার পথঘাট, বাড়িঘর সবই তার চেনা। একটা বাড়ির ছাদে বাগান দেখতে পেলো। ঠিক এরকম আরেকটি বাড়ি আছে পার্কিং এলাকাটার কয়েক ব্লক পরেই। বিশাল একটা ফ্রেঞ্চ দরজার একটা বাড়ি। সেই বাড়ির ভেতর একটা ঘর আছে। সেই ঘরটাও তার চেনা।

সেই বাড়িটা তার চেনা, সে জানে বাড়িটা খুব কাছেই। তার বুকের স্পন্দনটা টের পেলো। যতোই সামনে এগিয়ে যাচ্ছে ততোই তার স্পন্দনটা বাড়ছে। এই জায়গাটা দেখতে ঠিক প্যারিসের পার্ক মশিউর মতো।

আদ্রে ভিলিয়ার্সের কথা ভাবলো সে। শার্ল দ্য গল এয়ারপোর্ট থেকে কেনা একটা নোটবুকে তার যতো দূর সম্ভব মনে পড়ে সবই লিখেছে। সেই বুলেটবিদ্ধ অবস্থায় পোর্ত নোয়ে থেকে মার্সেই, জুরিখ আর প্যারিস—বিশেষ করে প্যারিস। আদ্রে ভিলিয়ার্সের হাতে পড়লে এটার ভালো ব্যবহার হবে। মেরির পক্ষেও সম্ভব হবে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া। কেনেডি এয়ারপোর্ট থেকেই নোটবুকটা একটা খামে ভরে পার্ক মশিউ’র ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছে সে। এটা পৌঁছাতে পৌঁছাতে সে মরেও যেতে পারে, বেঁচেও থাকতে পারে। কার্লোস তাকে খুন করবে, নয়তো সে কার্লোসকে খুন করবে। কেবল এই ব্যাপারেই সে নিশ্চিত।

এইতো সেটা! কালো রঙের দরজাটাতে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। দরজাটা খুবই ভারি কাঠের। কিন্তু উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন রাইফেল আর হেভি ক্যালিবারের অটোমেটিক অস্ত্রকে প্রতিরোধ করতে পারবে না সেটা। এখানে সে ছিলো—কিন্তু এ জায়গা সম্পর্কে তার মধ্যে যে আবেগের সঞ্চার হচ্ছে সেটা ঠিক ধরতে পারছে না। তার দু’চোখে জল এসে যাচ্ছে, গলা শুকিয়ে আসছে। তার মনে হচ্ছে এই জায়গাটা তার শরীরেরই একটা অংশ। কিন্তু তার নিজের বাড়ি নয় এটা। বাড়িটার দিকে তাকিয়েই মনে হচ্ছে এসব। কিন্তু কিছু একটা আছে—ফিরে আসার এক ধরণের তুমুল উত্তেজনা। যেখানে শুরু সেখানেই ফিরে এসেছে সে। তার ইচ্ছে করছে ট্যাক্সি থেকে নেমে ভারি দরজাটার কাছে দৌড়ে চলে যেতে, দু’হাতে দরজায় ধাক্কা মারতে।

আমাকে ভেতরে ঢুকতে দাও! আমি এসেছি! আমাকে ভেতরে আসতে দাও! তোমরা কি বুঝতে পারছো না?

আমাকে ভেতরে ঢুকতে দাও!

তার চোখের সামনে অসংখ্য ছবি ভাসছে, কানে আসছে অনেক শব্দ। মাথাটা দপ দপ ক’রে ব্যথা করছে এখন। একটা অন্ধকার ঘরে সে—সেই ঘরে—একটা পর্দার দিকে চেয়ে আছে যেখানে অনেকগুলো ছবি একের পর এক ভেসে উঠছে।

কে সে? দ্রুত। তুমি খুব দেরি ক’রে ফেলেছো! তুমি একজন মৃত মানুষ। এই রাস্তাটা কোথায়? এটা তোমার কাছে কি মনে হচ্ছে? ওখানে কার সাথে তুমি দেখা করেছো? কি? ভালো। সহজ ক’রে বলো। যতো কম সম্ভব, বলো। এই যে তালিকাটা : আটটি নাম আছে। কনটাক্টগুলো কোটা? দ্রুত! এই যে আরেকটা খুনের মেথড। তোমার কোটা?…না, না! ডেল্টা হয়তো এটা করবে, কেইন নয়! তুমি ডেল্টা নও, তুমি তুমি নও! তুমি হলে কেইন। তোমার নাম বর্ন। জেসন বর্ন। ধরতে পারো নি। আবার চেষ্টা করো। মনোযোগ দাও! বাকি সব বাদ। অতীতকে মুছে ফেলো। তোমার কাছে আর এটার অস্তিত্ব নেই। তুমি এখানে যা তুমি কেবল তাই!

ওহ্ ঈশ্বর। মেরি এটা বলেছিলো।

হয়তো তোমাকে যা বলা হয়েছে কেবল তাই তুমি জানো…বার বার যেটা তোমাকে বলা হয়েছে। কিন্তু তুমি স্মরণ করতে পারছো না…

কারণ…ওগুলো তোমার নয়।

তার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতে লাগলো। সে কার্লোসকে লিখেছে সে ফিরে আসছে…সেইসব কাগজ-পত্র নিয়ে যা তার ‘চূড়ান্ত প্রটেকশন’।

এখন সে বুঝতে পারছে তার পরিচয়টা এই বাড়ির ভেতরে রয়েছে। তার পরিচয়। কার্লোস আসুক আর না আসুক, তাকে এটা খুঁজে বের করতে হবেই!

আচমকা একটা উন্মাদনা পেয়ে বসলো তাকে। নিজের মাথাটা পাগলের মতো এপাশ ওপাশ দোলাতে লাগলো এইসব চিন্তা দূর করার জন্যে। এখনও তার দু’কানে শব্দ আর চিৎকারগুলো হচ্ছে—চিৎকারটা তার নিজেরই। কণ্ঠটাও তার। কার্লোসের কথা ভুলে যাও। ফাঁদটার কথা ভুলে যাও। ঐ বাড়িটার ভেতরে যাও! ওখানেই আছে। ওখানেই শুরুটা আছে।

বন্ধ করো এটা!

পরিহাসটা খুবই ভীতিকর। সেই বাড়িতে কোনো চুড়ান্ত সুরক্ষা নেই, কেবল তার জন্যে একটা সর্বশেষ ব্যাখ্যা আছে। আর কার্লোর্স ছাড়া এটা খুবই অর্থহীন হবে। যারা তাকে শিকার করছে তারা সেটা জানে, তবে তারা এটা এড়িয়ে যায়। এজন্যেই তারা তাকে মৃত দেখতে চায়। কিন্তু সে খুব কাছে এসে পড়েছে…তাকে এটা খুঁজে বের করতেই হবে। ওখানেই সেটা আছে।

বর্ন চেয়ে দেখলো লম্বা চুলের ড্রাইভার রিয়ার ভিউ আয়না দিয়ে তার দিকে চেয়ে আছে। “মাইগ্রেন,” জেসন চট ক’রে বললো। “এই ব্লকটা আবার ঘুরে আসুন। আমি একটু তাড়াতাড়ি এসে পড়েছি। আমি আপনাকে বলবো কোথায় আমাকে নামিয়ে দিতে হবে।”

“আপনার টাকা আপনার খুশি, মিস্টার।”

ব্রাউনস্টোন ভবনটা এখন তাদের পেছনে। বর্ন পেছন দিকে তাকিয়ে সেটা দেখলো। কার্টুনিটা কমে আসছে, তার মধ্যে জেঁকে বসা ভীতিটাও মিহঁয়ে যাচ্ছে। শুধু ব্যথাটা রয়ে গেলো। তবে এটাও চলে যাবে। সে জানে। কয়েক মিনিট খুবই অসাধারণ কেটেছে। তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণটা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিলো। এটা আর হতে দিতে পারে না সে। ফাঁদটা নিজেই সব কিছু। বাড়িটা আবার তাকে দেখতে হবে। ওটা আবার ভালো ক’রে নিরীক্ষণ করতে হবে। সারা দিন কাজ করতে হবে তাকে, নিজের কৌশলটাকে করতে হবে আরো পরিশুদ্ধ। নিজের ভেতরকার বহুরূপীটাকে কাজে লাগাতে হবে। ষোলো মিনিট পরে এটা একদম নিশ্চিত হয়ে যাবে।

আচমকা সব কিছু আলাদা ব’লে মনে হচ্ছে। সবই বদলে গেছে। ব্লকের যানবাহনের গতি কমে আসছে। পথে আরেকটা ঝক্কির আর্বিভাব হলো। একটা ভ্যান ব্রাউনস্টোন বাড়িটার সামনে এসে থেমেছে। ওভার-অল পরা কিছু লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট আর কফি খাচ্ছে। কাজ শুরু হবার জন্যে অপেক্ষা করছে তারা। কালো রঙের ভারি দরজাটা খুলে গেলে সবুজ জ্যাকেট পরা এক লোক বেরিয়ে এলো। বাম পকেটের উপরে কোম্পানির নামটি লেখা আছে। ফয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে, তার হাতে একটা ক্লিপবোর্ড। ট্রেডস্টোন গুটিয়ে ফেলা হচ্ছে! কয়েক ঘণ্টা পরে এটা একেবারে শেষ হয়ে যাবে। এটা তো হতে পারে না! তাদেরকে থামতে হবে!

জেসন সামনের দিকে ঝুঁকলো, তার হাতে টাকা, মাথার ব্যথাটা চলে গেছে। এখন তাকে সব দ্রুত করতে হবে। তাকে ওয়াশিংটনে ককলিনের কাছে পৌঁছাতে হবে। দেরি করা যাবে না, এখনই! ককলিন তাদেরকে এসব কাজ বন্ধ করতে বলবে! তার পুরো কৌশলটা ভিত্তি হলো অন্ধকার…সব সময় অন্ধকার। একজন গুপ্তঘাতক একটি পাথরের বাড়িতে রাতের বেলায় ঢুকবে। রাতের বেলায়। রাতেই এটা ঘটবে! এখন নয়! সে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো।

“এই যে, মিস্টার!” খোলা জানালা দিয়ে ড্রাইভার চিৎকার ক’রে বললো।

জেসন নিচু হয়ে উঁকি মেরে বললো, “কি হয়েছে?”

“আমি ধন্যবাদ দিতে চাইছিলাম। এটা আমাকে—”  

হিস্ ক’রে তার কাঁধের উপর দিয়ে কিছু একটা চলে গেলো! তারপরই একটা আর্তনাদ। বর্ন ড্রাইভারের বাম কানের পাশ দিয়ে ঝরে পরা রক্তের দিকে চেয়ে রইলো। রাস্তার পাশে কোনো ভবনের জানালা থেকে করা গুলিতে লোকটা মরে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে শুইয়ে পড়লো জেসন। তারপরই গড়িয়ে বাম দিকে চলে গেলো সে। আরো দুটো ভোঁতা শব্দ হলে গুলি দুটো গাড়ির পাশে এসে বিধঁলো।

এটা তো অবিশ্বাস্য! শিকার শুরু হবার আগেই তাকে মার্ক ক’রে ফেলা হয়েছে! কালোর্স আছে এখানে। ঐ জায়গায়! সে কিংবা তার কোনো লোক কোনো একটা বাড়ির ছাদে অথবা জানালা থেকে নজরদারি করছে অস্ত্রসহ। কিন্তু এভাবে জানালা থেকে খুন করাটা তো পাগলামী। পুলিশ আসবে, রাস্তাটা ব্লক হয়ে যাবে। এমনকি পাল্টা ফাঁদটা নস্যাৎ হয়ে যাবে। আর কার্লোস তো পাগল নয়! কিছুই মাথায় ঢুকছে না। তাকে ফাঁদটা থেকে বের হয়ে আসতে হবে…পাল্টা ফাঁদটা থেকে। তাকে ফোনের কাছে যেতে হবে। কার্লোস আছে এখানে! ট্রেডস্টোনের দোরগোড়ায়! সে তাকে ফিরিয়ে এনেছে। তাকে সত্যি ফিরিয়ে এনেছে। এটা তারই প্রমাণ।

সে উঠে লোকজনের ভীড়ের মধ্যেই দৌড়াতে লাগলো। রাস্তার মোড়ে এসে মোড় নিলো ডান দিকে বুথটা বিশ ফিট দূরে। কিন্তু সেটাও একটা টার্গেট। এটা সে ব্যবহার করতে পারবে না। রাস্তার ওপাশে ছোট্ট একটা সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে টেলিফোন। সে এক দৌড়ে রাস্তাটা পার হয়ে যাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু রাস্তা দিয়ে ছুটে চলা যানবাহনগুলোর জন্যে আরেকটু হলে সে মরতেই বসেছিলো। কার্লোসের হয়ে তারাই সেই কাজটা ক’রে ফেলেছিলো প্রায়। এই পরিহাসটাও ভীতিকর।

“সিআইএ সত্যিকার অর্থে একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং অর্গানাইজেসন, স্যার,” ফোনের অপরপ্রান্তের লোকটা একটু ঠাট্টাচ্ছলেই বললো কথাটা। “আপনি যে ধরণের কর্মকাণ্ডের কথা বলছেন সে রকম কিছু আমরা করি না। সত্যি বলতে কি চলচ্চিত্র আর কল্পকাহিনীর লেখকেরা এইসব উদ্ভট কাহিনী ছড়িয়ে থাকে।”

“আরে রাখুন আপনরা বকবকানি। আমার কথা শুনুন!” রেগেমেগে জেসন বললো। “আমাকে কেবল বলুন, ককলিন এখন কোথায়। এটা খুবই জরুরি!”

“উনার অফিস তো আপনাকে বলেছেই, উনি গতকাল বিকেলে চলে গেছেন, এই সপ্তাহের শেষে ফিরে আসবেন। যেহেতু আপনি বলছেন আপনি উনাকে চেনেন, তাহলে তো আপনারই ভালো করে জানা উচিত উনার কিছু শারিরীক সমস্যা রয়েছে। প্রায়শই উনি ফিজিক্যাল থেরাপি করাতে যান

“আপনি এসব বলা বন্ধ করুন! আমি তাকে প্যারিসে দেখেছি দু’রাত আগে। সে ওয়াশিংটন থেকে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে গিয়েছিলো।”

“আমরা ইতিমধ্যেই চেক্ ক’রে দেখেছি,” ল্যাঙ্গলে’র লোকটা কথার মাঝখানে বললো, “এক বছরে মি: ককলিন দেশের বাইরে যান নি।”

“তাহলে লুকিয়ে গেছে! সে ওখানে ছিলো! আপনারা কোনো কোড চাচ্ছেন, মরিয়া হয়ে বর্ন বলতে লাগলো। “আমার কাছে সেগুলো নেই। তবে ককলিনের সঙ্গে কাজ করে এমন কেউ কথাগুলো চিনতে পারবে। মেডুসা, ডেন্টা, কেইন…ট্রেডস্টোন! কেউ না কেউ চিনবেই!”

“কেউ চিনবে না। আপনাকে সেটা আগেই বলা হয়েছে।”

“যে বলেছে সে জানে না। এখানে এমন লোক আছে যারা এটা জানে। বিশ্বাস করুন!”

“আমি দুঃখিত। আমি আসলেই কিছু—”

“ফোনটা রাখবেন না!” আরেকটা পথ আছে। যেটা সে ব্যবহার করার কথা ভাবে নি। তবে এছাড়া আর কিছুই নেই। “পাঁচ-ছয় মিনিট আগে, আমি সেভেনটি- ফার্স্ট স্ট্ট-এ গিয়েছিলাম। ওখানে কেউ আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছিলো।”

“খুন…আপনাকে?”

“হ্যা। আমি ট্যাক্সি থেকে বের হয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে উপুড় হয়ে কথা বলতে গেলেই দূর থেকে আমাকে গুলি করা হয়। ভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে যাই কিন্তু ড্রাইভার মরে গেছে। এটা সত্য, আর আমি জানি এই ব্যাপারটা আপনারা চেক্‌ ক’রে দেখতে পারেন। এরই মধ্যে ওখানে আধ ডজন পুলিশের গাড়ি পৌঁছে গেছে। আপনাদের তো চেক্ ক’রে দেখার অনেক উপায় আছে। এটা চেক্ ক’রে দেখেন। তবেই বুঝতে পারবেন আমার কথাগুলো কতোটা সত্যি।”

ওপাশে একটু নিরবতা নেমে এলো। “যেহেতু আপনি মি: ককলিনকে চাচ্ছেন, অন্ততপক্ষে উনার নামটা উল্লেখ করেছেন, আমি অবশ্যই এটা চেক্ ক’রে দেখবো। আপনার সাথে কিভাবে যোগাযোগ করতে পারি?”

“আমি এই লাইনে থাকবো। এই কলটা ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট কার্ডে করা। ফরাসি ইসু। নাম শামফোর্দ।”

“শামফোর্দ? কিন্তু আপনি বলেছেন—”

“প্লিজ।”

“আমি আসছি।”

অপেক্ষাটা অসহ্য লাগছে তার কাছে। এক মিনিট পরে ল্যাঙ্গলের লোকটা ফিরে এলো।

“আমার মনে হয় এই সংলাপটি শেষ পর্যায়ে এসে গেছে, মি: বৰ্ন অথবা মি: শামফোর্দ। নিউইয়র্কের পুলিশকে ফোন ক’রে জানা গেছে এ রকম কোনো ঘটনা ওখানে ঘটে নি। আপনি ঠিকই বলেছেন, আমাদের চেক্ করার অনেক উপায় আছে। আমি আপনাকে বলছি এরকম ভূয়া খবর দেয়ার জন্যে কিন্তু আইনে কঠোর শাস্তির বিধান আছে। ভালো থাকবেন, স্যার।”

একটা ক্লিক ক’রে শব্দ হলে লাইনটা কেটে গেলো। অবিশ্বাসের চোখে বন ফোনটার দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কয়েক মাস ধরে ওয়াশিংটনের লোকেরা তাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়িয়েছে, তার মুখ চিরতরে বন্ধ করার জন্যে তাকে হত্যা করতে চেয়েছে। কারণটা কি জেসন জানে না। অথচ এখন যখন সে নিজেকে তাদের কাছে উপস্থিত করছে, তারা তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। এখনও তারা তার কোনো কথা শুনছে না! কিন্তু ঐ লোকটা শুনেছে! তারপর লাইনে ফিরে এসে এমন একটা ঘটনা আর হত্যাকাণ্ডকে অস্বীকার করেছে যা আদতেই কিছুক্ষণ আগে ঘটেছে। এটা তো একবারেই অসম্ভব। ঘটনাটা ঘটেছে।

জেসন ফোনটা রেখে বুথ থেকে বের হয়ে আস্তে আস্তে ফুটপাত দিয়ে হাটতে লাগলো। নিজের কোটাট খুলে হাতে রেখে নিয়ে নিলো। চোখের সানগ্লাসটাও খুলে ফেলেছে। সে তাড়াহুড়া ক’রে সেভেনটি-ফার্স্ট স্টুটের চার রাস্তার মোড়ে এসে পড়লো।

মোড়ের দিকে রাস্তা পার হবার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকা একদল লোকের মাঝে ঢুকে পড়লো জেসন। মাথাটা বাম দিকে ঘোরালো। ট্যাক্সিটা নেই। নিখুত অপারেশন ক’রে যেভাবে শরীরের ক্ষতিকর জিনিস সরিয়ে ফেলা হয় ঠিক সেভাবে ওটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ঘটনাটা যে ঘটেছে তার কোনো চিহ্নই নেই।

বর্ন এবার বিপরীত দিকে পা বাড়ালো। দক্ষিণ দিকে। তাকে একটা স্টোর খুঁজে বের করতে হবে। তাকে তার গায়ের চামড়া বদলে ফেলতে হবে। বহুরূপী আর অপেক্ষা করতে পারবে না।

.

পিয়েরে হোটেলের সুটে বৃগেডিয়ার জেনারেল আরউইন আর্থার ক্রফোর্ডের মেরিকে আর্টকে রাখা হয়েছে। মেরি ভীষণ ক্ষেপে আছে। “আপনি আমার কথা শুনছেন না!” সে অভিযোগের সুরে বললো। “আপনারা কেউই শুনছেন না। আপনাদের কি কোনো ধারণা আছে, তার সঙ্গে আপনারা কি করেছেন?”

“আমরা সবাই সেটা বেশ ভালো করেই জানি,” অফিসার জবাব দিলো। “আমি কেবল আপনাকে আবারো বলতে পারি যা ইতিমধ্যেই আপনাকে বলা হয়েছে। আমরা জানি না কি শুনতে হবে। যা শুনছি তার সাথে বাস্তবতার কোনো মিলই খুঁজে পাচ্ছি না। সে নিজেও কিছুই বুঝতে পারছে না। আমরা কি ক’রে বুঝবো, বলুন?”

“সে সাত মাস ধরেই এসব বোঝানোর চেষ্টা ক’রে যাচ্ছে! কিন্তু আপনার কেবল লোক পাঠিয়ে তাকে খুন করতে চেয়েছেন। আপনারা কেমন লোক, বলুন তো?”

“ত্রুটিযুক্ত, মিস্ মেরি। তবে ভদ্রলোক। আর এজন্যেই আমি এখানে এসেছি। আমি তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। মানে, যদি আমরা পারি তো তাকে বাঁচানোর চেষ্ট করবো।”

“ঈশ্বর, আপনারা আমাকে অসুস্থ ক’রে ফেলবেন দেখছি!” মেরি মাথা ঝাঁকিয়ে নিলো একটু। তারপর নরম কণ্ঠে বললো, “আপনারা যা বলবেন আমি তাই করবো, আপনারাও সেটা জানেন। এই ককলিন লোকটার সাথে কি যোগাযোগ করতে পারেন না?”

“আমি নিশ্চিত আমি সেটা করতে পারবো। আমি সেই বাড়িটার সামনে থেকে সরবো না যদি না সে আমার সাথে যোগাযোগ করে। সে হয়তো আমাদের চিন্তার বিষয় নয়।”

“কার্লোস?”

“হয়তো অন্যেরা।”

“আপনি কি বলছেন?”

“আমি সেটা যেতে যেতে বলবো। আমাদের একমাত্র ভাবনা হলো ডেল্টার সাথে যোগযোগ করা।”

“জেসন?”

“হ্যা। আপনি যাকে জেসন ব’লে জানেন।”

“সে আপনাদেরই একজন, শুরু থেকেই আপনাদের সাথে ছিলো,” মেরি বললো। “নিশ্চিহ্ন করার মতো কোনো ব্যাপার নেই, দরকষাকষির করার জন্যে কোনো পেমেন্ট অথবা ক্ষমার চাওয়ার কি কিছু আছে?”

“নেই। আপনাকে সময় মতো সবই জানানো হবে। কিন্তু এখন সেই সময়টা আসে নি। একটা আনমার্ক গাড়ির ব্যবস্থা করেছি আপনার জন্যে, আপনি সেটাতে ক’রে ঐ বাড়িটার আশেপাশে থাকবেন, আপনাকে একটা বাইনোকুলার দেয়া হবে। আপনি তো তাকে অন্য সবার চেয়ে ভালো ক’রে চেনেন। হয়তো আপনিই তাকে চিহ্নিত করতে পারবেন। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, আপনি যেনো সেটা করতে পারেন।”

মেরি ক্লোসেটের দিকে গিয়ে তার কোটাট তুলে নিলো। “একরাতে সে আমাকে বলেছিলো সে একজন বহুরূপী…”

“তার মনে পড়েছে তাহলে?” ক্রফোর্ড কথার মাঝখানে বললো।

“কি মনে পড়েছে?”

“কিছু না। কঠিন পরিস্থিতিতে সবার অলক্ষ্যে চলাফেরা করার প্রতিভা তার রয়েছে। এটাই আমি বলতে চেয়েছিলাম।”

“দাঁড়ান।” মেরি আর্মির লোকটার দিকে এগোলো। “আপনি বলছেন জেসনের সঙ্গে আপনাকে যোগাযোগ করতে হবে। একটা ভালো উপায় আছে। তাকে আমাদের কাছে আসতে দিন। আমার কাছে। আমাকে সেই বাড়ির সামনে থাকতে দিন। আমার কথা শুনে রাখুন, সে আমাকে দেখবে। আমার কাছে খবর পাঠাবে!”

“ওখানে যে আছে তার হাতে দু’দু’জন টার্গেট তুলে দেয়ার কথা বলছেন?”

“আপনি আপনার নিজের লোককে চেনেন না, জেনারেল। আমি বলেছি ‘আমার কাছে খবর পাঠাবে’। সে কাউকে পাঠাবে, একজন নারী অথবা পুরুষকে ভাড়া ক’রে পাঠাবে আমার কাছে মেসেজটা পৌঁছে দিতে। আমি তাকে চিনি। সে এটা করবে। এটাই একমাত্র নিশ্চিত উপায়।”

“আমি এটা করার অনুমতি দিতে পারি না।”

“কেন পারে না? আপনারা তো সবই বোকার মতো, অন্ধের মতো করেছেন! অন্তত এই একটা জিনিস বুদ্ধিমানের মতো করেন!”

“আমি পারবো না। হয়তো এতে ক’রে সমস্যাটা সমাধান হবে, কিন্তু আমি সেটা করতে পারবো না।”

“আমাকে কারণটা বলুন।”

“ডেল্টার কথা যদি ঠিক হয়, কার্লোস যদি তার পিছু পিছু চলে আসে ওখানে, ঝুঁকিটা হবে খুবই মারাত্মক। ছবি দেখে কার্লোস আপনাকে চেনে। সে আপনাকে খুন করবে।”

“আমি স্বেচ্ছায় এই ঝুঁকিটা নিচ্ছি।”

“কিন্তু আমি নিচ্ছি না। এটা করতে হলে আমাকে আমার সরকারের সাথে কথা বলতে হবে।”

“আমার মনে হয় না আপনাকে তা করতে হবে।”

“এটা অন্যেদের হাতেই ছেড়ে দিন। আমরা কি এবার বের হতে পারি, প্লিজ?”

.

“জেনারেল সার্ভিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন,” নির্লিপ্তভাবে সুইচবোর্ডের অপারেটর জবাব দিলো।

“মি: জে. পেত্রোচিলি, প্লিজ,” আলেকজান্ডার ককলিন বললো। তার কণ্ঠটা খুবই চিন্তাগ্রস্ত শোনাচ্ছে। নিজের কপালের ঘাম হাত দিয়ে মুছে নিলো সে। “একটু জলদি করুন!”

“সবাই দেখি বেশ তাড়ায় আছে— কথাটা মিইয়ে গেলো। তার বদলে আরেকটা রিংয়ের শব্দ হলো।

“পেত্রোচিলি, রিক্লেমেশন ইনভয়েস ডিভিশন।”

“আপনারা করছেন কি?” সিআইএ’র লোকটা গর্জে উঠে বললো।

“এখন কোনো গর্দভের বোকা বোকা সব প্রশ্ন শুনছি।”

“তাহলে আরো শুনুন। আমার নাম ককলিন, সিআইএ থেকে বলছি। ফোর- জিরো ক্লিয়ারেন্স। এর মানে কি আপনি জানেন?”

“বিগত দশ বছর ধ’রে আপনার লোকেরা কি বলছে তার কিছুই আমি বুঝতে পারি নি।”

“এটা আপনি ভালো করেই বুঝবেন। এটা করতে আমার এক ঘণ্টা লেগে গেছে, তবে আমি নিউইয়র্ক থেকে একটা কোম্পানি সরিয়ে ফেলার কাজে নিয়োজিত ডিসপ্যাচারের সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছি। সে বলেছে তার কাছে আপনার স্বাক্ষর করা একটা ইনভয়েস রয়েছে যাতে ১৩৯ নাম্বারের সেভেনটি-ফার্স্ট স্টটের ব্রাউনস্টোনের সব আসবাব সরিয়ে ফেলার আদেশ আছে।”

“হ্যা, সেটা আমার মনে পড়েছে। তো হয়েছে কি?”

“আপনাকে এই আদেশটা কে দিয়েছে? এটা তো আমাদের জায়গা। আমরা গত সপ্তাহে সব ধরণের যন্ত্রপাতি সরিয়ে ফেলেছি, কিন্তু আবারো বলছি, এর বেশি করার অনুরোধ তো করি নি।”

“একটু ধরুন,” বুরোক্র্যাট বললো। “আমি সেই ইনভয়েসটা দেখেছি। মানে, ওটা স্বাক্ষর করার আগে আমি বেশ ভালো করেই প’ড়ে দেখেছি। আপনারা আমাকে কৌতুহলী ক’রে তুলছেন। আদেশটা সরাসরি ল্যাঙ্গলে থেকে এসেছে।”

“ল্যাঙ্গলের কার কাছ থেকে?”

“আমাকে একটু সময় দিন, বলছি কে দিয়েছে। আমার কাছে ওটার একটা কপি আছে। আমার ডেস্কেই সেটা আছে।” ড্রয়ার খোলা আর কাগজপত্র ঘাটাঘাটির শব্দটা শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর লাইনে আবার লোকটার গলা শোনা গেলো। “এই যে, সেটা, ককলিন। আপনাদের এডমিনিস্ট্রেটিভ কনট্রোল।”

“তারা জানে না তারা কি করছে। অর্ডারটা বাতিল ক’রে দিন। ওখান থেকে লোকজনকে চলে আসতে বলুন। এক্ষুণি!”

“ভূতূরে অডার আমরা নেই না।”

“কি?”

“তিনটার বাজার আগে আমার ডেস্কে একটা লিখিত রিকুইজিশন পাঠান। আর সেটা পেলে আমরা আগামীকালকে কাজ শুরু করবো। সব কিছু আগের জায়গায় রেখে দেবো।”

“সব আগের জায়গায় রেখে দেবেন?”

“ঠিক। আপনারা বলবেন চলে আসতে আমরা চলে আসবো, আপনারা বলবেন রেখে দিতে আমরা রেখে দেবো। আপনাদের মতোই আমাদের কিছু নিয়ম-কানুন আছে। আমরা সেটাই অনুসরণ করি।”

“যন্ত্রপাতিগুলো—সব কিছু ধার করা! এটা এজেন্সির কোনো অপারেশন নয়।”

“তাহলে আপনি আমাকে কল করছেন কেন? এটা দিয়ে আপনি করবেন কি?”

“বুঝিয়ে বলার মতো সময় আমার নেই। খালি ঐসব লোককে ওখান থেকে তুলে আনুন। নিউইয়র্কে ফোন ক’রে তাদেরকে চলে যেতে বলুন। এটা ফোর- জিরো অর্ডার।”

“একশ’ চার হলেও কোনো লাভ হবে না। আপনি এখনও বায়বীয় কথা বলছেন। দেখুন মি: ককলিন, আপনি আমি দু’জনেই জানি আমার যা দরকার তা না পেলে আমি আপনার কোনো কথাই রাখতে পারবো না। বৈধভাবে করুন। সঠিকভাবে করুন।”

“আমি এজেন্সিকে জড়াতে পারছি না!”

“তাহলে আপনি আমাকেও জড়িত করবেন না।”

“ঐসব লোককে চলে যেতেই হবে! আমি আপনাকে বলছি” ককলিন ব্রাউনস্টোনের নিচে তাকাতেই বোবা হয়ে গেলো। প্যারালাইজ হয়ে গেলো তার সমস্ত চিন্তাভাবনা। ওভার কোট পরা লম্বা এক লোক কংক্রিটের সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে। তারপর খোলা দরজাটার সামনে এসে সে দাড়িয়ে রইলো। এটা ক্রফোর্ড। সে কি করছে? এখানে সে কি করছে? তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। পাগল হয়ে গেছে! সে স্থির একটি টার্গেট; সে ফাঁদটা ভেঙে ফেলতে পারে!

“ককলিন? ককলিন…?” ফোনটা রেখেই সিআইএ’র লোকটা চিৎকার ক’রে বললো।

ককলিন ছয় ফুট দূরের একটি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাট্টাগোট্টা এক লোকের দিকে তাকালো। লোকটার হাতে টেলিস্কোপ লাগানো একটা রাইফেল। এলেক্স লোকটার নাম জানে না, জানতে চায়ও না।

“দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ওভারকোট পরা বৃদ্ধলোকটাকে দেখেছো?” সে জিজ্ঞেস করলো।

“দেখেছি। আমরা যাকে খুঁজছি এই লোক সেই লোক নয়। তার বয়স অনেক বেশি।”

“ওখানে গিয়ে তাকে বলো রাস্তার ওপর পারে একজন খোঁড়া লোক তার সঙ্গে দেখা করতে চায়।”

.

বন থার্ড এভিনুর পুরনো কাপড়ের দোকানের দিকে গেলো। মোটা কাঁচের সামনে এসে তাকে কেমন দেখাচ্ছে সেটা ভালো করে দেখার জন্যে একটু থামলো। কালো উলের টুপিটা তার কপাল ঢেকে রেখেছে। আর্মিদের জ্যাকেটটা তার সাইজের চেয়েও বেশ বড়। লাল চেকের ফ্লানেল শার্ট আর মোটা রাবার সোলের জুতা পরে আছে সে। তাকে কেবল এই সব কাপড়চোপড়ের সাথে মানানসই একটা ভঙ্গীতে হাটতে হবে। একজন শক্তসামর্থ্য লোকের হাটা। এই হাটাটা তাকে রপ্ত করতে হবে। এরকম কিছুতে সে এর আগে অভ্যস্ত ছিলো। কিন্তু তার আগে তাকে একটা ফোন করতে হবে। সামনের ব্লকে সে একটা ফোন বুথ দেখতে পেলো বর্ন।

“বেলকিন মুভিং অ্যান্ড স্টোরেজ,” ব্রনক্স-এর অপারেটর বললো।

“আমার নাম জেসন বর্ন,” অধৈর্যের সাথে বললো। “আমার মনে হয় আমার একটা সমস্যা হয়ে গেছে। আশা করি আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন।”

“চেষ্টা করবো, স্যার। সমস্যাটা কি?”

“সেভেনটি-ফার্স্ট স্ট্রটে আমি আমার এক বন্ধুর বাড়িতে যাচ্ছিলাম — বন্ধুটি কয়েক দিন আগে মারা গেছে। তাকে আমি একটা জিনিস দিয়েছিলাম, সেটাই নিতে যাচ্ছিলাম আর কি। ওখানে গিয়ে দেখি আপনাদের ভ্যানটা বাড়ির সামনে। আমার মনে হয় আপনাদের লোক আমার জিনিসটা সরিয়ে ফেলেছে। এ ব্যাপারে কি আমি কারো সঙ্গে কথা বলতে পারি?”

“ডিসপ্যাচারের সাথে কথা বলুন, স্যার।”

“তার নামটা কি জানতে পারি?”

“কি?”

“তার নামটা।”

“অবশ্যই। মুরে। মুরে সুমাখ। আমি তার সঙ্গে সংযোগ দিয়ে দিচ্ছি আপনার।”

দুটো ক্লিক ক’রে শব্দ হলে একটা কণ্ঠ লাইনে শোনা গেলো।

“সুমাখ।”

“মি: সুমাখ?”

“হ্যা।”

বর্ন আবারো তার গল্পটা বললো। “অবশ্যই আমি আমার অ্যাটর্নির কাছ থেকে একটা লেটার এনে দিতে পারবো। কিন্তু জিনিসটার মূল্য খুব বেশি নয় –

“জিনিসটা কি?”

“একটা ফিশিং রড। খুব দামি না, তবে জিনিসটা আমার খুব প্রিয়। পুরনো ফ্যাশনের। পাঁচ মিনিট পর পর ফেঁসে যায় না।”

“হ্যা, বুঝেছি কি বলতে চাচ্ছেন। আমিও শিপহেড বে-তে মাছ ধ’রে থাকি। পুরনোগুলোই বেশি ভালো।”

“আমার মনে হয়, আপনি ঠিকই বলেছেন, মি: সুমাখ। আমি জানি ঠিক কোন্ ক্লোসেটে সে ওটা রেখেছে।”

“হায়রে ফিশিং রড। ঠিক আছে। ওখানে গিয়ে ডুগান নামের এক লোকের কাছে যান, সে হলো ঐ কাজটার সুপারভাইজার। তাকে বলবেন আমি বলেছি আপনি ওটা নিতে পারেন। তবে আপনাকে একটা স্বাক্ষর করতে হবে। সে যদি ধানাই-পানাই করে তাকে বলবেন বাইরে এসে আমাকে ফোন করতে। ঐ বাড়ির ফোনটা বিচ্ছিন্ন করা আছে।”

“মি: ডুগান। ধন্যবাদ আপনাকে মি: সুমাখ।”

“হায়রে জায়গাটা একেবারে নাস্তানাবুদ হয়ে আছে!”

“কি বললেন?”

“কিছু না। কিছু গর্দভ ফোন ক’রে আমাদের বলেছে এখান থেকে বের হয়ে যেতে। টাকাও সেধেছে। বিশ্বাস করতে পারেন?”

কার্লোর্স। জেসন এটা বিশ্বাস করতে পারলো।

“খুবই খারপ কথা, মি: সুমাখ।”

“আপনার মাছ ধরার মঙ্গল কামনা করছি,” বেলকিন্সের লোকটা বললো।

বর্ন লেক্সিংটন এভিনুর সেভেনটিয়েন্থ স্ট্রটের পশ্চিম দিকে পা বাড়ালো। সে যেটা খুঁজছিলো সেটা তিন ব্লক পরে পেয়ে গেলো : আর্মি নেভির সারপ্লাস স্টোর। ভেতরে ঢুকে পড়লো সে। আট মিনিট পরে চারটা ধূসর রঙের মোটা কম্বল, ছয়টা মেটাল বাকলসহ ক্যানভাস স্ট্র্যাপ নিয়ে বের হয়ে এলো। তার জ্যাকেটের পকেটে দুটো রোড-ফ্লেয়ার। জিনিসগুলো কাঁধের উপর ফেলে সে সেভেনটি ফার্স্ট স্টুটের দিকে চললো। বহুরূপী জঙ্গলের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিচ্ছে। এই জঙ্গলটা তাম কুয়ানের মতোই ঘন আর বিপদসঙ্কুল।

ট্রেডস্টোন সেভেনটি-ওয়ানের সমস্ত গোপনীয়তা যেখানে লুকিয়ে আছে সেখানে যখন এলো তখন ১০টা ৪৮ বাজে। সে তার শুরুর দিকে ফিরে এসেছে—আর যে ভয়টা তার মধ্যে উদ্ভব হলো সেটা শারীরিক ক্ষতির কোনো ভীতি নয়। সে এর জন্যে প্রস্তত। সে তার জন্মস্থানে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। ওখানে গিয়ে সে কি খুঁজে পাবে সেটা নিয়েই খুব ভয়ে আছে—তার মনে পড়ে যাচ্ছে।

বন্ধ করো এই ভাবনাটা! ফাঁদটাই সব কিছু। কেইন হলো চার্লি, ডেল্টা হলো কেইন!

রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা ক’মে আসছে। লোকজন বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। তাদের হাটার মধ্যে কোনো তাড়াহুড়ার ভাব নেই। জেসন রাস্তাটা পার হয়ে ট্রেডস্টোনের কাছে চলে এলো। পঞ্চাশ গজ দূরেই ব্রাউনস্টোন ভবনটা। কম্বল আর স্ট্র্যাপ জায়গা মতো আছে; একজন ক্লান্ত, ধীর গতির শ্রমিক এক পরিপাটী পোশাক পরা দম্পতির পেছন পেছন এগিয়ে যাচ্ছে। সে বাড়িটার সিঁড়ির সামনে এসে দেখতে পেলো দু’জন বলশালী লোক একটা চাদরে ঢাকা পিয়ানো বাড়ির বাইরে বে ক’রে নিয়ে আসছে। বর্ন তাদের উদ্দেশ্যে চিৎকার ক’রে ডাকলো। তার কণ্ঠটা একটু ফ্যাসফ্যাসে শোনালো।

“এই যে! ডুগান কোথায়?”

“আপনি কি মনে করেন; সে কোথায় থাকার কথা?” দু’জনের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ লোকটি পাল্টা বললো। “একটা বালের চেয়ারে ব’সে ব’সে বাল ফেলছে।

“আরে, সে তো একটা ক্লিপবোর্ডের চেয়ে বেশি ভারি কিছু ওঠাচ্ছে না,” কালো লোকটা বললো। “ভুলে গেছিলাম, সে তো একজন অফিসার, তাই না, জো?”

“সে হলো একটা পাংচার হওয়া ফুটা বল। তার সাথে আপনার কি কাজ?”

“সুমাখ আমাকে পাঠিয়েছে,” জেসন বললো। “সে এখানে আরেকজন লোককে চাচ্ছে, আর এসব জিনিস আপনাদের দরকার হবে। আমাকে বলেছে এটা নিয়ে আসার জন্যে।”

“মুরে হারামজাদা!” কালো লোকটা হেসে বললো। “আপনি নতুন, না? আপনাকে তো আগে কখনও দেখি নি। আপনি এসেছেন আমাদের সাহায্য করতে?”

“হ্যা।”

“এইসব জিনিস এক্সিকিউটিভের কাছে নিয়ে যান,” জো নামের লোকটা বললো। “সে এটা দেখবে, তাই না, পিট?”

“হ্যা, ঠিক তাই।”

বর্ন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের অতিক্রম ক’রে ভেতরে প্রবেশ করলো। তার সামনে সংকীর্ণ একটা করিডোর, ত্রিশ ফুটের মতো হবে, যার শেষ মাথায় আছে একটা দরজা আর ডান দিকে ঘোরানো একটা সিঁড়ি। এই সিঁড়ি দিয়ে সে হাজার বার উঠেছে নেমেছে। এই করিডোরটা ব্যবহার করেছে তার চেয়েও বেশি। সে ফিরে এসেছে। তার মধ্যে অদ্ভুত এক উত্তেজনা অনুভূত হচ্ছে। অন্ধকার করিডোরটা দিয়ে সে এগোতে লাগলো। যে ঘরে কেইনের জন্ম হয়েছে সেই ঘরের দিকে। সেই ঘরটা। কাধের স্ট্র্যাপটা শক্ত ক’রে ধরলো, নিজের হাতের কাঁপুনিটা বন্ধ করার জন্যে।

.

আমোর্ড প্লেটেড সরকারী সিডানের পেছনের সিটে ব’সে আছে মেরি, সে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে এলো। বাইনোকুলারটা জায়গা মতোই আছে। কিছু একটা ঘটেছে। সে নিশ্চিত নয় সেটা কি। তবে সে আন্দাজ করতে পারছে। কয়েক মিনিট আগে একজন গাট্টাগোট্টা লোক ব্রাউনস্টোন বাড়িটার সামনে দিয়ে চলে গেছে। জেনারেলের সামনে এসে হাটার গতিটা কমিয়ে এনেছিলো সে, অবশ্যই কিছু একটা বলেছে জেনারেলকে। এরপর লোকটা হেটে গেলে জেনারেল তাকে অনুসরণ করতে শুরু করলো।

ককলিনকে পাওয়া গেছে।

জেনারেল যা বলেছে তা যদি সত্য হয়ে থাকে তবে সিঁড়িটা হবে খুবই ছোট্ট। ভাড়াটে অস্ত্রধারী, তাদের নিয়োগদাতার কাছেও অচেনা। তার কাছেও তারা অচেনা। একজন লোককে খুন করার জন্যে ভাড়া হয়েছে…একগাদা ভুল কারণে! ওহ্, ঈশ্বর, সে তাদের সবাইকে ঘৃণা করে। ঘিলুবিহীন বোকা সব লোক। অন্য মানুষের জীবন নিয়ে খেলে। খুব কমই জানে তারা, অথচ মনে করে তারা অনেক জানে।

তারা কোনো কিছুই শোনে নি! তারা শুনবে, কিন্তু ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাবে, আফশোস ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। অন্ধত্ব থেকে দুর্নীতির জন্ম হয়। আর বোকামী এবং বিব্রতকর কিছু থেকে আসে মিথ্যে। ক্ষমতাবানদেরকে বিব্রত কোরো না। নাপাম বোমা ভিয়েতনামে এটা প্রমাণ ক’রে দিয়েছে।

মেরি বাইনোকুলারটা ঠিক ক’রে নিলো। বেকিন্স কোম্পানির একজন লোক সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তার কাঁধে কম্বল আর স্ট্র্যাপ। এক বৃদ্ধ দম্পতির পেছনে পেছনে হাটছে সে। জ্যাকেট আর কালো টুপি পরা সেই লোকটা থামলো। দরজার সামনে একটা পিয়ানো নামাতে থাকা দু’জন লোকের সাথে সে কথা বলছে। এটা কি? একটা কিছু আছে…অদ্ভুত কিছু। মেরি লোকটার চেহারা দেখতে পাচ্ছে না। সে যেখান থেকে দেখছে সেখান থেকে চেহারাটা ভালো ক’রে দেখার কথাও নয়। তবে লোকটার ঘাড় আর মাথাটা…সেটা কি? লোকটা সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছে, একজন ক্লান্ত শ্রান্ত লোক। মেরি বাইনোকুলারটা সরিয়ে ফেললো। খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো সে।

ওহ্ ঈশ্বর! আমার জেসন। তুমি কোথায়? আমার কাছে আসো। আমার কাছে ধরা দাও। এইসব অন্ধ আর হৃদয়হীন লোকগুলোর কাছে আমাকে রেখে চলে যেয়ো না।

ক্রফোর্ড কোথায়? সে তার কাছে প্রতীজ্ঞা করেছে প্রতিটি জিনিস তাকে জানিয়ে করবে। সব জানাবে। মেরি তাকে বিশ্বাস করে না। তাদের কাউকেই না। তাদের বিদ্যা-বুদ্ধির উপরেও তার কোনো আস্থা নেই। ক্রফোর্ড কোথায়? ড্রাইভারের কাছে মেরি জানতে চাইলো। “জানালাটা কি নামাবে? দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।”

“দুঃখিত, মিস্,” সাদা পোশাকের আর্মির লোকটা বললো। “আমি আপনার জন্যে এয়ারকন্ডিশন ছেড়ে দিচ্ছি।”

দরজা-জানালা নিয়ন্ত্রণ করার বোতাম ড্রাভারের সামনে। ড্রাইভার আর পেছনের সিটের মধ্যে রয়েছে কাঁচের একটা দেয়াল।

.

“আমি এর এক বর্ণও বিশ্বাস করি না!” ককলিন বললো। খোঁড়াতে খোঁড়াতে রেগেমেগে সে জানালার কাছে ফিরে গেলো আবার। বাইরে তাকিয়ে উদাসভাবে বললো, “একটা বর্ণও বিশ্বাস করি না!”

“অ্যালেক্স, তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে না,” ক্রফোর্ড পাল্টা বললো। “সমাধানটা খুব সহজ। খুবই সহজ।”

“তুমি সেই টেপটা শোনো নি। তুমি ভিলিয়ার্সের কথা শোনো নি!

“আমি মেয়েটির কথা শুনেছি। সে বলেছে আমরা কোনো কথা শুনছি না… তুমি শুনছো না।”

“তাহলে মেয়েটা মিথ্যে বলেছে!” ককলিন হুট ক’রে ঘুরে বললো। “সে অবশ্যই মিথ্যে বলছে! আর কেনই বা বলবে না? সে তো তার প্রেমিকা। তাকে বাঁচানোর জন্যে সে সবই করবে।”

“তুমি ভুল করছো, আর এটা তুমিও জানো। আসল কথা হলো, সে এখানে এসেছে তোমার কথা ভুল প্রমাণ করার জন্যে। তুমি যা বলেছো সেটা আমি যে মেনে নিয়েছি তা ভুল, এটা প্রমাণ করতেই সে এতোদূর চলে এসেছে।”

ককলিন জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, লাঠি ধ’রে রাখা তার ডান হাতটা কাঁপতে শুরু করেছে এখন। “হয়তো…হয়তোবা…” সে আর কথাটা শেষ করতে পারলো না। ক্রফোর্ডের দিকে অসহায়ের মতো চেয়ে রইলো কেবল।

“আমাদেরকে সমাধানের পথেই থাকতে হবে?” অফিসার শান্ত কণ্ঠে বললো। “তুমি খুব ক্লান্ত, অ্যালেক্স। তুমি কয়েক দিন ধরে ঘুমাও নি। একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছো। আমার মনে হয় না আমি সেই কথাটা শুনেছি।”

“না।” সিআইএ’র লোকটা মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো। তার চোখেমুখে তিক্ততা। “না, তুমি সেটা শোনো নি, আর আমিও সেটা তোমাকে বলি নি। হায় আমি যদি জানতাম কোত্থেকে শুরু করতে হবে।”

“আমি জানি,” ক্রফোর্ড বললো। দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা খুলে ফেললো। “আসো।”

পাট্টাগোট্টা লোকটা এগোলো, তার চোখ দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা রাইফেলটার দিকে। দু’জন লোকের দিকে তাকিয়ে সে মাথা দোলালো, যেনো ব্যাপারটা সে বুঝতে পেরেছে। “এটা কি?”

“এক্সারসাইজটা বাতিল করা হয়েছে,” ক্রফোর্ড বললো। “আমার মনে হয় তুমি সেটা বুঝতে পেরেছো।”

“কোন্ এক্সারসাইজের কথা বলছেন? তাকে রক্ষা করার জন্যে আমাকে ভাড়া করা হয়েছে।” অস্ত্রধারী অ্যালেক্সের দিকে তাকালো। “আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনার আর কোনো প্রটেকশানের দরকার নেই, স্যার?”

“আমরা কি বলতে চাচ্ছি সেটা তুমি জানো,” ককলিন উত্তেজিতভাবে বললো। “সব সিগনাল বন্ধ, সব বন্ধ।”

“সব মানে কি? আমি তো কোনো ব্যবস্থার কথা জানি না। আমার নিয়োগের শর্তগুলো খুব পরিস্কার। আমি আপনাকে রক্ষা করছি, স্যার।”

“বেশ ভালো,” ক্রফোর্ড বললো। “এখন আমাদেরকে জানতে হবে বাইরে তাকে কে রক্ষা করছে?”

“কে, কোথায়?”

“এই ঘরের বাইরে, এই অ্যাপার্টমেন্টে। অন্য কোনো ঘরে, রাস্তায়, গাড়িতে, সম্ভবত। আমাদেরকে জানতে হবে।”

গাট্টাগোট্টা লোকটা রাইফেলটার কাছে গিয়ে সেটা তুলে নিলো। “আমার মনে হয় আপনারা ভুল বুঝেছেন। আমাকে একজনের জন্যে ভাড়া করা হয়েছে। অন্য কাউকে যদি এ কাজে নিয়োগ দেয়া হয় সেটা আমার জানা কথা নয়।”

“তুমি তাদেরকে চেনো না!” ককলিন চিৎকার ক’রে বললো। “তারা কারা? কোথায় তারা?”

“আমার কোনো ধারণা নেই…স্যার।” বগলে রাইফেলটা চেপে রেখে অস্ত্রধারী লোকটা বললো। তার রাইফেলের নলটা মেঝের দিকে নামানো। দুয়েক ইঞ্চির মতো সেটা উপরে উঠে গেলেও সেটা কারোর নজরে পড়লো না। “আমাকে যদি কোনো দরকার না লাগে তবে আমি চলে যাচ্ছি।”

“তাদের সঙ্গে কি তুমি যোগাযোগ করতে পারবে?” বৃগেডিয়ার কথার মাঝখানে বললো। “আমরা এর জন্যে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা দেবো।”

“আমাকে ইতিমধ্যে বেশ ভালো টাকা দেয়া হয়েছে, স্যার। যে কাজ আমি করতে পারবো না সেই কাজের জন্যে আমার টাকা নেয়াটা ঠিক হবে না। আর এটা অব্যাহত রাখাটাও অর্থহীন।”

“একজন মানুষের জীবন বিপদাপন্ন!” ককলিন চিৎকার ক’রে বললো।

“আমারটাও,” অস্ত্রধারী দরজার দিকে হেটে যেতে যেতে বললো। অস্ত্রটা আরেকটু উপরে উঠলো এবার। “বিদায়, ভদ্রমহোদয়গণ।” সে বাইরে চলে গেলো।

“হায় ঈশ্বর!” অ্যালেক্স জানালার দিকে আবার মুখ ক’রে গর্জে বললো। “আমরা কি করবো?”

“প্রথমে, এই মুভিং কোম্পানিকে আগে স’রে যেতে বলো। আমি জানি না এটা তোমার কৌশলে কি ভূমিকা পালন করছে, কিন্তু এটা এখন কেবল জটিলতাই সৃষ্টি করছে।”

“আমি পারবো না। তবে চেষ্টা করবো। এর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা যখন আমাদের যন্ত্রটা বের করেছিলাম এজেন্সি কনট্রোলরা তখন আমাদের শিটগুলো তুলে নেয়। তারা সেই স্টোরটা বন্ধ হতে দেখে আমাদেরকে এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্যে জিএসএ’কে বলে।”

“এরকম দ্রুত গতিতে,” মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ক্রফোর্ড বললো। “সন্ন্যাসী এই যন্ত্রটা স্বাক্ষর ক’রে আড়াল ক’রে রেখেছিলো। তার স্টেটমেন্টটা এজেন্সিকে দায়মুক্ত করেছে। এটা তার ফাইলে আছে।”

“আমরা যদি চব্বিশ ঘণ্টা সময় পাই তবে সেটা দারুন হবে। আমরা জানি না আমরা এমনকি চব্বিশ মিনিট সময় পাবো কিনা।”

“আমাদের সেটা দরকার পড়বে। একটা সিনেট তদন্ত কমিটি হবে। রাস্তাটা বন্ধ ক’রে দাও।”

“কি?”

“আমার কথা তো শুনলেই রাস্তাটা বন্ধ ক’রে দাও! পুলিশকে খবর দাও। তাদেরকে বলো সব কিছু দড়ি দিয়ে ঘিরে ফেলতে!”

“এজেন্সির মাধ্যমে? এটা তো আভ্যন্তরীণ ব্যাপার।”

“তুমি না করলে আমিই করবো সেটা। পেন্টাগনের মাধ্যমে, প্রয়োজন হলে জয়েন্ট চিফের মাধ্যমে। আমাদের চোখের সামনে থাকার পরও আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো আর অজুহাত খুঁজবো! রাস্তাটা ঘিরে ফেলো। দড়ি দিয়ে এই জায়গাটার চারপাশ ঘিরে রাখো। একটা ট্রাকে পিএ সিস্টেম নিয়ে আসো। মেয়েটাকে দিয়ে মাইক্রোফোনে কথা বলাও! সে যা বলতে চায় বলতে দাও তাকে। মেয়েটার কথাই ঠিক। সে তার কাছে আসবেই!

“তুমি জানো তুমি কি বলছো?” ককলিন জানতে চাইলো। “অনেক প্রশ্ন উঠবে। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও। সব ফাঁস হয়ে যাবে। সবাই জেনে যাবে।”

“আমি এ ব্যাপারে সচেতন আছি,” বৃগেডিয়ার বললো। “যাই ঘটুক না কেন সে এটা করবেই। তবে আমি একজন লোকের জীবন বাঁচাতে চাইছি, তাকে যদিও আমি পছন্দ করি না। কিন্তু এক সময় তাকে আমি সম্মান করতাম, মনে হয় এখন তাকে আরো বেশি সম্মান করি।”

“আরেক লোকের কি হবে? কার্লোর্স যদি এখানে আসলেই থেকে থাকে, আপনি তাহলে তার জন্যে একটা দরজা খুলে দিচ্ছেন। আপনি তাকে পালিয়ে যাবার সুযোগ ক’রে দিচ্ছেন।”

“আমরা কার্লোর্সকে সৃষ্টি করি নি। আমরা কেইনকে সৃষ্টি করেছি, তাকে অপব্যবহার করেছি। আমরা তার স্মৃতি আর মনটাকে কেড়ে নিয়েছি। তার কাছে আমরা ঋণী। যাও, মেয়েটার কাছে যাও। আমি ফোনটা ব্যবহার করবো।”

.

বর্ন বাড়ির শেষ দিকের বিশাল লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়লো। ভেতরের দৃশ্যটা তার চেনা, আবার অচেনাও লাগছে। এগুলো তার স্বপ্নের ভগ্নাংশ—কিন্তু খুব মজবুত—ক্ষণস্থায়ী নয়। লম্বা এক টেবিলে হুইস্কি ঢালা হচ্ছে, আর্ম চেয়ারে লোকজন ব’সে কথা বলছে, চারপাশে বইয়ের শ্নেলফ কিছু জিনিস লুকিয়ে রাখা হয়েছে—–একটা বোতাম চাপলেই সেটা উন্মোচিত হয়। এটা সেই ঘর যেখানে একটা মিথের জন্ম হয়েছিলো। যে মিথটা পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছিলো আর বিস্ফোরিত হয়েছিলো ইউরোপে।

তার মধ্যে আবার ছবি আর শব্দ তেড়ে আসছে এখন। আলোর ঝলকানি, তারপরই পর্দায় কিছু ছবি ভেসে উঠছে, তার কানে কতোগুলো কণ্ঠ চিৎকার ক’রে কী যেনো বলছে।

কে সে? দ্রুত। তুমি অনেক দেরি করছো! তুমি মরে গেছো! এই রাস্তাটা কোথায়? এটা তোমর কাছে কি ব’লে মনে হয়? ওখানে তুমি কার সঙ্গে দেখা করেছো?…হত্যা করার পদ্ধতি। কোটা তোমার? না!…তুমি ডেল্টা নও, তুমি তুমি নও!…তুমি এখানে যা তুমি কেবল তাই। এখানে তুমি যা হয়েছো!

“আরে, তুমি আবার কে?” দরজার পাশে একটা আর্ম চেয়ারে বসা এক বড়সড় লাল মুখের লোক চিৎকার ক’রে তাকে বললো। তার হাটুর উপর একটা ক্লিপবোর্ড রাখা। জেসন তাকে অতিক্রম ক’রে ভেতরে ঢুকে পড়েছিলো। খেয়াল করে নি।

“আপনি ডুগান?” বর্ন জানতে চাইলো।

“হ্যা।”

“সুমাখ আমাকে পাঠিয়েছে। বলেছে আপনাদের আরেকজন লোকের দরকার।”

“কিসের জন্যে? আমার কাছে পাঁচজন তো আছেই। আর এই জায়গার বালের হলওয়েটা দিয়ে দু’জন মানুষও চলাফেরা করতে পারে না। পাছায় পাছায় ঘষাঘষি হয়।”

“আমি জানি না। সুমাখ আমাকে পাঠিয়েছে, এটাই কেবল আমি জানি। সে আমাকে এইসব জিনিস আনতে বলেছে।” বর্ন কম্বল আর স্ট্র্যাপগুলো মেঝেতে ফেলে রাখলো।

“মুরে নতুন একটা মাল পাঠিয়েছে? মানে এটা তো নতুন।”

“আমি”

“জানি, জানি! সুমাখ তোমাকে পাঠিয়েছে। সুমাখকে জিজ্ঞেস করো।”

“আপনি সেটা করতে পারবেন না। সে আপনাকে বলতে বলেছে সে নাকি শিপহেড-এ যাচ্ছে। আজকের বিকেলে ফিরে আসবে।”

“ওহ্, দারুণ! সে আমাকে এই সব জঞ্জালের মধ্যে রেখে মাছ ধরতে গেছে…তুমি নতুন। আমাদের সাহায্য করতে এসেছো?”

“হ্যা।”

“এটাই হলো মুরের সৌন্দর্য। আমার খালি আরেকটা ফুটা বল দরকার। দুটো বড়সড় গাধার পাছা আছে, আর এখন হলে চারটা ফুটা বল।”

“আপনি চাচ্ছেন আমি এখান থেকে শুরু করি? আমি এখান থেকে শুরু করতে পারবো।”

“না! তুমি উপর থেকে শুরু করবে, বুঝলে?”

“হ্যা, বুঝেছি।” জেসন কম্বল আর স্ট্র্যাপগুলো নেবার জন্যে উপুড় হলো। “এইসব জঞ্জাল এখানেই রেখে যাও——এটা তোমার দরকার নেই। উপরে যাও। একেবারে উপর তলায়। একটা একটা ক’রে আসবাব বের করবে।”

বর্ন সিঁড়ি দিয়ে উপর তলায় উঠে গেলো। সেখানে আরেকটা ঘরের দিকে যাচ্ছে সে। ল্যান্ডিংয়ে কোনো আলো নেই। কয়েক মুহূর্তের জন্যে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। কোন্ ঘরটা? তিনটি দরজা আছে, দুটো হলওয়ের বাম দিকে, অন্ধকারে খুব একটা দেখা যাচ্ছে না, আরেকটা ডান দিকে। সে বাম দিকের দ্বিতীয় দরজার দিকে পা বাড়ালো। এটাই সে ঘর। নব্‌টা ধরে ঘোরাতেই দরজাটা খুলে গেলো। অন্ধকার, তবে পুরোপুরি নয়। ঘরের এক দিকে ছোট্ট একটা জানালা আছ। কালো পর্দায় ঢাকা। সেই পর্দার ফাঁকফোকর দিয়েই বাইরে থেকে আলো আসছে। বর্ন সেদিকে গেলো। একটা ফাঁক! অন্ধকারে একটা ফাঁক! সে ঘুরে গেলো, এই দৃষ্টি বিভ্রমে একটু ভড়কে গেলো সে। কিন্তু এটা কোনো বিভ্রম নয়! অন্ধকারে ডায়মন্ডের মতো একটা কিছু চমকালো। স্টিলে আলো প্রতিফলিত হয়েছে।

অন্ধকারে একটা চাকু তার মুখ বরাবর ছুটে এলো।

“আপনি যা করেছেন তার জন্যে আমি আপনার মৃত্যু দেখে খুশিই হবো, “ ককলিনকে চমকে দিয়ে মেরি বললো। “এই ভাবনাটা আমাকে ক্ষেপিয়ে তুলছে।”

“তাহলে আপনাকে বলার মতো আমার আর কিছু নেই,” খোঁড়াতে খোঁড়াতে জেনারেলের দিকে যেতে যেতে সিআইএ’র লোকটা জবাবে বললো। “অন্য রকম কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে—সেটা আপনি এবং সে নিতে পারে।”

“পারে কি? সে কোত্থেকে শুরু করবে? যখন সেই লোকটা মার্সেই’তে খুন করার চেষ্টা করেছিলো? রুই সারাসিনে? যখন তারা জুরিখে তার পিছু নিয়েছিলো? প্যারিসে যখন তাকে গুলি করা হয়েছিলো? আর পুরোটা সময়েই সে জানতো না কেন এসব করা হচ্ছে। সে করবেটা কি, বলেন?”

“বেরিয়ে আসবে! শুধু বেরিয়ে আসবে, ধরা দেবে!”

“সে তাই করেছিলো। আর সে যখন তা করলো, আপনারা তখন তাকে খুন করার চেষ্টা করলেন।”

“আপনি তো সেখানে ছিলেন! তার সঙ্গেই ছিলেন। আপনার তো স্মৃতিশক্তি রয়েছে।”

“ধরে নিচ্ছি আমি জানতাম কার কাছে যেতে হবে, আপনি কি আমার কথা শুনবেন?”

ককলিন মেরির দিকে সরাসরি তাকালো। “আমি জানি না,” বলেই ক্রফোর্ডের দিকে ঘুরে বললো, “হয়েছে কি?”

“ওয়াশিংটন আমাকে দশ মিনিটের মধ্যে ফিরে যেতে বলেছে।”

“কিন্তু, হয়েছে কি?”

“আমার মনে হয় না তুমি সেটা শুনতে চাইবে। স্টেট এবং মিউনিসিপ্যাল ডিক্রির উপর ফেডারেল হস্তক্ষেপ ঘটেছে। ক্লিয়ারেন্স নিতে হবে।”

“হায় ঈশ্বর!”

“দ্যাখো!” সেনাবাহিনীর লোকটা আচমকা জানালার দিকে উপুড় হয়ে তাকালো। “ট্রাকটা চলে যাচ্ছে।”

“কেউ ভেতরে ঢুকেছে,” ককলিন বললো।

“কে?”

“আমি সেটা খুঁজে বের করবো।” সিআইএ’র লোকটা ফোনের কাছে গেলো। টেবিলে কতোগুলো কাগজে টেলিফোন নাম্বারগুলো তাড়াহুড়া ক’রে লেখা হয়েছে। সে একটা নাম্বার বেছে নিয়ে ডায়াল করলো। “সুমাখকে দিন…প্লিজ…সুমাখ? আমি সিআইএ’র ককলিন বলছি। আপনাকে কে বলেছে?”

ডিসপ্যাচারের গলাটা লাইনে শোনা গেলো। “কে বলেছে মানে, কি বলেছে? আমার পিছু ছাড়ুন! আমরা কাজ করছি, আর সেটা শেষ করতে যাচ্ছি! সত্যি বলতে কি, আপনি একজন বাচাল—”

ককলিন ফোনটা আছাড় মেরে রেখে দিলো। “হায় জিশু…ওহ্ জিশু!” তার হাতটা কাঁপতে লাগলো। সে আবারো ফোনটা তুলে নিয়ে ডায়াল করলো। তার চোখ টেবিলে রাখা কাগজগুলোর দিকে। “পেত্রোচিল্লি? ককলিন বলছি।”

“আপনার কথাটা তখন ঠিক মতো শুনতে পাই নি। হয়েছে কি?

“সময় নেই। এজেন্সি কনট্রোলের যে ইনভয়েস, সেটা কে স্বাক্ষর করেছে?”

“কে স্বাক্ষর করেছে, মানে? যে বড় বেড়ালটা সব সময় স্বাক্ষর ক’রে থাকে। ম্যাকগিভার্ন।”

ককলিনের চেহারাটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। “এটাই আমি ভয় পাচ্ছিলাম,” নিচু কণ্ঠে বলে সে ফোনটা রেখে দিয়ে ক্রফোর্ডের দিকে ঘুরলো। “জিএসএ-এর আদেশটা এমন একজন স্বাক্ষর করেছে যে কিনা দু’সপ্তাহ আগেই অবসর নিয়েছে।”

“কার্লোস…”

“ওহ্, ঈশ্বর!” মেরি চিৎকার ক’রে উঠলো। “যে লোকটা কম্বল আর স্ট্র্যাপ বহন করছিলো! যেভাবে সে হাটছিলো, ঘাড় ঘোরাচ্ছিলো। এটা তো সে-ই! জেসন! সে ভেতরে ঢুকেছে।”

আলেকজান্ডার ককলিন জানালার দিকে ফিরলো। তার চোখ রাস্তার ওপাশে কালো দরজাটার দিকে। সেটা এখন বন্ধ।

.

হাতটা! গায়ের রঙ…কালো চোখ। কার্লোস!

ধারালো চাকুটা বর্নের গালের চামড়ায় পোচ বসিয়ে দিলে সে তার মাথাটা দ্রুত সরিয়ে ফেললো। চাকু ধ’রে রাখা হাতটাতে রক্ত লেগে রয়েছে। সে তার ডান পা’টা দিয়ে অদৃশ্য আক্রমণকারীর হাটুতে আঘাত হেনে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বাম পায়ের গোড়ালী দিয়ে লোকটার হাটুতে আঘাত করলো। কার্লোসও ঘুরে গিয়ে চাকু মারলো, এবার একেবারে বর্নের পেটের দিকে। জেসন পিছু হটে দু’হাত দিয়ে ক্রশ ক’রে বাঁধা দিলে তার দু’হাতের ফাঁকে আক্রমণকারীর চাকু ধরা হাতটা আঁটকে গেলো। জেসন সেই হাতটা ধরে এমনভাবে মোচড় দিলো যাতে ক’রে হাত থেকে চাকুটা ছুটে যায়। কিন্তু ছুটলো না। জেসন এবার চাকু ধরা হাতটা খপ্ ক’রে ধরে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে কাঁধ দিয়ে খুনির বুকে আঘাত করলো। কিন্তু কার্লোস সরে গেলে একটা ঝাঁকি খেলো সে। অবশ্য জেসন অন্ধকারে চাকুটা মেঝেতে পড়ে যাবার শব্দ শুনতে পেলো। শব্দটা যেখান থেকে এসেছে জেসন সেখানে ঝাঁপ দিলো। একই সময়ে নিজের বেল্টে থাকা অস্ত্রটাও হাতে নেবার চেষ্টা করলো এক হাতে। সে মেঝেতে পড়তেই একটা জুতার হিল তার মাথার পাশে এসে সজোরে আঘাত করলো—আঘাতের তীব্রতায় ভড়কে গেলো সে। খুব দ্রুত গড়িয়ে সরে গেলো। দেয়ালের সাথে ধাক্কা লাগার আগ পর্যন্ত গড়ালো বর্ন। তারপর হাটুর উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অন্ধকারের মধ্যেই চেষ্ট করলো কিছু দেখার। জানালার পর্দার ফাঁক গ’লে আসা একটা আলোর রেখায় সে একটা হাত দেখতে পেয়ে সেদিকেই ঝাঁপ দিলো। তার নিজের হাতের পাঞ্জা দুটো এখন বাঘের থাবা হয়ে গেছে। আর হাত দুটো যেনো ভারি কোনো হাতুড়ি। হাতটা ধরে ফেলতেই কব্জিটা মোচড়ে ভেঙে ফেললে একটা আর্ত চিৎকারে পুরো ঘরটা ভরে গেলো। সেই চিৎকারের সাথে ভোঁতা একটা গুলির শব্দ। বর্নের কাঁধে গিয়ে বিদ্ধ হলো একটা বুলেট। তীব্র যন্ত্রণায় পিছু হটে গেলো সে। সশস্ত্র লোকটার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে জাপটে ধরে একটা ধারালো কোণযুক্ত আসবাবের সাথে চেপে ধরলো তাকে। বিক্ষিপ্তভাবে আরো দুটো গুলি ক’রে কার্লোস দ্রুত স’রে গেলে জেসনও বাম দিকে ঝাঁপ দিয়ে অন্ধকারেই সামনে থেকে আসা শব্দটার দিকে তাক্ ক’রে গুলি চালালো। শব্দটা কানে তালা লাগিয়ে দিলেও লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারলো না। দরজা বন্ধ হবার শব্দ শুনতে পেলো সে। খুনি হলওয়ে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে এখন।

বুক ভরে দম নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে দরজার দিকে এগোলো বর্ন। দরজার কাছে পৌঁছাতেই তার মন বললো দরজার সামনে থেকে সরে যেতে। তাই করলো সে। দরজার পাশে সরে গিয়ে দরজার মাঝখানের হাত দিয়ে ঘুষি মারলো। যা ঘটলো সেটা খুবই ভয়ঙ্কর একটি ব্যাপার। একটা অটোমেটিক অস্ত্র গর্জে উঠলে দরজাটার কাঠের গুঁড়ো ছিটকে তার চোখেমুখে এসে লাগলো। অস্ত্রটা থামতেই অস্ত্রটা তুলে দরজার দিকে গুলি চালালো জেসন। পাল্টা গুলি ছুটে এলে সে দরজার পাশে দেয়ালে পিঠ দিয়ে সেঁটে রইলো। প্রতিপক্ষের গুলি থামতেই আবার গুলি চালালো সে। এখন দু’জন লোক মাত্র কয়েক ইঞ্চির ব্যবধানে আছে। একে অন্যেকে খুন করতে উদ্যত তারা। কার্লোসকে ফাঁদে ফেলো। কার্লোসকে খুন করো!

এরপরই জেসন বুঝতে পারলো তারা আর খুব বেশি কাছাকাছি নেই। পায়ের শব্দটা তার কানে এলো। সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে যাবার শব্দ। কার্লোস নিচে চলে যাচ্ছে, শূয়োরের বাচ্চা সাপোর্ট চাইছে। বৰ্ন তার মুখে এবং ঠোঁটের রক্ত মুছে ভাঙা দরজাটা দিয়ে বের হয়ে সংকীর্ণ করিডোরে এসে নিজের অস্ত্রটা চোখ বরাবর সোজা সামনের দিকে তুলে রাখলো। হাটা চলা করতে কষ্ট হলেও সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় নিচ থেকে চিৎকার আর চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পেলো সে।

“আরে তুমি করছো কি, অ্যাঁ? পিট! পিট!”

দুটো কর্কশ কাশির শব্দ শোনা গেলো।

“জোয়ি! জোয়ি!”

একটা ভোঁতা শব্দ হলে মাটিতে কোনো মানুষের পড়ে যাওয়ার আওয়াজটা শোনা গেলো স্পষ্ট।

“হায় ঈশ্বর! সর্বনাশ—!”

আরো দুটো কর্কশ কাশির শব্দ শোনা গেলো, তারপরই একটা মরাকান্না। তৃতীয় আরেকজন মরলো।

তৃতীয় লোকটা কি বলেছিলো? দুটো পাছামোটা গর্দভ আর চারটা ফুটা বল। মুভিং ভ্যানটা আসলে কার্লোসের অপারেশন! গুপ্তঘাতক সঙ্গে ক’রে দু’জন লোক নিয়ে এসেছিলো। কার্লোসসহ তিনজন লোক সশস্ত্র, আর সে কিনা একটা অস্ত্র নিয়ে তাদের মোকাবেলা করতে এসেছে। এই ভবনের এক কোণে সে এখন আঁটকা পড়ে গেছে। কার্লোস এখনও এই ভবনের ভেতরে আছে। ভেতরে। সে যদি বের হয়ে যেতে পারে তবে কার্লোসই উল্টো আঁটকা প’ড়ে যাবে।

হলওয়ের সামনের দিকে কালো পর্দায় ঢাকা একটা জানালা আছে। নিজের ঘাড়টা চেপে ধরে ওদিকে ছুটে গেলো জেসন। তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। সেই ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে বুকের দিকে। পর্দাটা টেনে ছিঁড়ে ফেললো। জানালাটা ছোটো, কাঁচ লাগানো আছে। খুবই মোটা আর শক্ত। সহজে ভাঙা যাবে না। কিভাবে এটা ভাঙবে সেটা যখন ভাবছে তখনই তার নজর গেলো নিচের সেভেনটি-ফার্স্ট স্টুটের দিকে। ভ্যানটা নেই! কেউ এটা চালিয়ে নিয়ে গেছে…কার্লোসের এক লোকই এটা করেছে! তার মানে দু’জন রয়ে গেছে এখানে। তিনজন নয়। আর সে আছে উপরে। উপরে থাকাটা সব সময়ই একটু বেশি সুবিধার। বর্ন একটু ঝুঁকে নিচু হয়ে বাম দিকের প্রথম দরজার কাছে গেলো। এটা সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের ঠিক উল্টোদিক। দরজাটা খুলে সে ভেতরে ঢুকে পড়লো। একটা সাধারণ শোবার ঘর : ল্যাম্প, ভারি আসবাব, দেয়ালে ছবি। কাছের একটা ল্যাম্প ধরলো সে। সেটার ইলেক্ট্রক প্লাগটা টেনে খুলে সেটা টেনে নিয়ে এলো রেলিংয়ের কাছে। মাথার উপর তুলে কাঁচের দিকে ছুড়ে মারলে কাঁচটা ভেঙে খান খান হয়ে গেলো। আবারো শোনা গেলো গুলির শব্দ। ছাদের দিকে গুলিগুলো বিধলে জেসন চিৎকার ক’রে উঠলো। চিৎকারটাকে একটা কান্নায় পরিণত হলো, তারপর একটা চাপা আর্তনাদ দিয়ে থেমে গেলো সেটা। রেলিংয়ের পেছনে গেলো এবার। অপেক্ষা করলো। নিঃশব্দে।

এটা ঘটছে। সে সতর্ক পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে; খুনি দ্বিতীয় তলার ল্যান্ডিংয়ে আছে এখন। পায়ের আওয়াজটা খুব কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে। আরো জোরে জোরে শব্দ হচ্ছে। দেয়ালে একটা মৃদু ছায়া দেখা গেলো। এখনই। জেসন প্রচণ্ড দ্রুততায় ল্যান্ডিংয়ের সামনে এসে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকা লোকটার দিকে পরপর চারটা গুলি করলো। লোকটার কলারের চারপাশে গুলিগুলো বিদ্ধ হলে রক্ত বের হতে লাগলো ফিনকি দিয়ে। খুনি তীব্র একটা আর্তনাদ দিয়ে সিঁড়ি থেকে নিচে গড়িয়ে পড়লো। তার হাতে একটা অটোমেটিক অস্ত্র।

এবার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলো বর্ন। আর এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করতে চাচ্ছে না সে। তাকে যদি দ্বিতীয় তলায় যেতে হয় তো এখনই যেতে হবে। কার্লোসের লোকটার দেহ টপকে যাবার সময় বর্ন জানতো লোকটা কার্লোর্স নয়, তার একজন সৈনিক। লোকটা লম্বা আর শ্বেতাঙ্গ। তার চেহারা নর্ডিক অথবা উত্তর ইউরোপিয়ানদের মতো। কোনো মতেই লাতিন নয়।

দ্বিতীয় তলার হলওয়ে দিয়ে দৌড়াতে লাগলো জেসন। অন্ধকার জায়গা খুঁজছে সে। একটু থেমে শুনতে পেলো দূর থেকে একটা তীক্ষ্ম ঘর্ষনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। নিচ থেকে আসছে সেটা। সে জানে এখন তাকে কি করতে হবে। খুনি এখন নিচের তলায় আছে। আর যে শব্দ হচ্ছে সেটা ইচ্ছাকৃত নয় যে, একটা ফাঁদ ব’লে মনে হবে। কার্লোস আহত হয়েছে—হাটুর আঘাতটা কিংবা কব্জির মোচড়টা তাকে এমনভাবে আহত করেছে যে, সে দেয়াল ঘেষে অথবা আসবাব ধরে ধরে এগোচ্ছে। কিছু সময়ের জন্যে তার ভারসাম্য হারিয়ে গিয়েছিলো। কেবল এটাই জেসনের জানা দরকার ছিলো। আবার হামাগুঁড়ি দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোতে লাগলো সে যেখানে মৃতদেহটা প’ড়ে আছে। তাকে কয়েক মুহূর্তের জন্যে থামতে হলো। রাক্তপাতের ফলে তার শক্তি ক’মে আসছে। বুকের ক্ষতস্থানটা চেপে ধরলো রক্ত বন্ধ করার জন্যে। এতে কোনো লাভ হবে না। বেঁচে থাকতে হলে তাকে এই ভবন থেকে বের হতে হবে। বর্ন আর কেইন যেখানে জন্ম নিয়েছে সেখান থেকে চলে আসতে হবে তাকে। মৃত লোকটার হাতে থাকা অটোমেটিক অস্ত্রটা নিয়ে নিলো। সে এখন প্ৰস্তত।

মরে যাচ্ছে সে, সেই সঙ্গে প্রস্ততও হচ্ছে। কার্লোর্সকে ধরো। ফাঁদে ফেলো তাকে…খুন করো! কার্লোর্সকে! সে বের হতে পারবে না; এটা সে জানে। সময় তার পক্ষে নেই। এটা ঘটার আগে তার শরীরের সমস্ত রক্ত বের হয়ে যাবে। শেষটাই শুরু : কেইন হলো কার্লোসের জন্যে আর ডেল্টা হলো কেইনের জন্যে। কেবল একটা যন্ত্রণাদায়ক প্রশ্নই রয়ে গেলো : ডেল্টা কে? এতে আর কিছু যায় আসে না। এটা সে পেছনে ফেলে এসেছে। খুব জলদিই একটা অন্ধকারে তলিয়ে যাবে সে, হিংস্র কোনো অন্ধকারে নয়, প্রশান্তির এক অন্ধকারে…এইসব প্রশ্ন থেকে মুক্তি পাবে চিরতরে।

আর তার মৃত্যুতে মেরিরও মুক্তি আসবে। তার ভালোবাসা মুক্তি পাবে। ভদ্রলোকেরা এটা দেখবে, সেই দলে থাকবে প্যারিসের এক ভদ্রলোক যার ছেলে রুই দুবাক-এ নিহত হয়েছে। যার নিজের জীবন ঐ খুনির বেশ্যা একেবারে ধ্বংস ক’রে দিয়েছে। নিজের হাতের অস্ত্রটার ক্লিপ চেক্ ক’রে নিলো নিঃশব্দে, সে ঐ লোকটার কাছে করা প্রতীজ্ঞা রাক্ষা করবে, যে সব অচেনা লোকের সাথে তার চুক্তি আছে সেটা পালন করবে। এ দুটো ক’রে সে নিজেকে প্রমাণ করবে। জেসন বর্ন এই দিনে মারা গিয়েছিলো। সে আবারো মরবে, তবে সঙ্গে কার্লোসকে নিয়ে মরবে। এজন্যে সে একেবারে প্রস্তুত।

সিঁড়িতে নিচু হয়ে বুকের উপর শুয়ে পড়লো সে। নিজের রক্তের গন্ধ পাচ্ছে। পেরিয়ে যাচ্ছে সময়। আস্তে আস্তে সিঁড়ির উপরে শেষ ধাপে এসে পড়লো। পকেটে রাখা লেক্সিংটন এভিনু থেকে কেনা রোড-ফ্লেয়ারগুলো থেকে একটা বের করলো জেসন। এখন সে বুঝতে পারছে কেন এগুলো সে কিনেছিলো। তাম কুয়ান-এর বিস্মৃত অতীতে ফিরে গেছে সে। ফ্লেয়ারের সলতেটা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে পকেট থেকে প্লাস্টিকের লাইটারটা বের ক’রে করে নিলো জেসন বর্ন।

সিঁড়ির ল্যান্ডিংটা অন্ধকার আর সুনশান। সব বাতি নিভিয়ে রাখা হয়েছে…বাতি? বাতি? কয়েক মিনিট আগে এখানের হলওয়েতে যে সূর্যের আলো দেখা গিয়েছিলো সেগুলো কোথায় গেলো? হলওয়ের শেষ মাথায় একটা বড় ফ্রেঞ্চ দরজা দিয়ে আলোটা এসেছিলো—সেই ঘরটা করিডোরের ওপাশে। কিন্তু এখন সে কেবল অন্ধকার দেখতে পাচ্ছে। দরজাটা বন্ধ। তার নিচের আরেকটা যে দরজা আছে সেটাও বন্ধ ক’রে রাখা হয়েছে। কার্লোস তাকে বেছে নিতে বাধ্য করছে। কোন্ দরজাটার পেছনে? নাকি খুনি আরো ভালো কোনো কৌশল ব্যবহার করছে? সংকীর্ণ আর অন্ধকারাচ্ছন্ন হলওয়েটাতেই কি সে ঘাপটি মেরে আছে?

কাঁধে একটা তীক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করলো বর্ন। সে জায়গা দিয়ে গল গল ক’রে বের হচ্ছে রক্ত। তার ফ্লানেল শার্টটা ভিজে গেছে। আরেকটা সতর্ক বার্তা : খুব কমই সময় হাতে রয়েছে।

দেয়াল ঘেষে এগোতে লাগলো সে, হাতের অস্ত্রটা অন্ধকার করিডোরের রেলিংয়ের পোস্টের দিকে তাক্ করা। এখনই! সে টুগারে চাপ দিলে গুলির আঘাতে পোস্টটা গুঁড়িয়ে রেলিংটা ভেঙে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রটা নামিয়ে বাম হাতে থাকা ফ্লেয়ারটায় লাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলো সে। তারপর টুগার টিপে নিচের দিকে একটা গুলি করলো। একটা ঝালর বাতি ভেঙে যাবার শব্দ শোনা গেলো নিচের কোনো ফ্লোর থেকে। আর ঠিক তারপরই—আলো! ফ্লেয়ারটা জ্বলতেই তীব্র আলোয় জায়গাটা ভরে গেলো। জঙ্গলে আগুন প্রজ্বলতি করা হয়েছে। চার দিকে মৃত্যুর উৎকট গন্ধ আর ঘন জঙ্গল, সে আছে মাঝখানে।

ডেল্টাকে আলমানাক। ডেল্টাকে আলমানাক। পরিত্যাক্ত! পরিত্যাক্ত! কখন ও নয়। এখন তো নয়ই। কার্লোসের জন্যে কেইন আর কেইনের জন্যে ডেল্টা। কার্লোসকে ফাঁদে ফেলো। খুন করো তাকে!

বর্ন উঠে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, বাম হাতে ফ্লেয়ার আর ডান হাতে অস্ত্র। সামনের দরজাটা লাথি মেরে খুলে ফেললো সে। টেবিলে রাখা ট্রফি আর ছবির ফ্রেমগুলো তার গুলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো চারদিকে। থেমে গেলো সে। বিশাল শব্দ নিরোধক আর অভিজাত ঘরটাতে কেউ নেই। এই জঙ্গলে কেউ নেই। সে ঘুরেই হলওয়েতে চলে এলো। গুলি ক’রে ফুঁটো ক’রে ফেললো দেয়ালগুলো। কেউ নেই। সংকীর্ণ অন্ধকার করিডোরের শেষ মাথায় একটা ঘরেই কেইনের জন্ম হয়েছিলো। সেখানেই কেইন মারা যাবে, তবে একা নয়।

ফ্লেয়ারটা ডান হাতে নিয়ে পকেট থেকে আরেকটা ফ্লেয়ার বের করলো সে। প্রথম ফ্লেয়ারটার আগুন দিয়ে জ্বলালো দ্বিতীয় ফ্লেয়ারটা। ফ্লেয়ারের আগুন এতোটাই তীব্র যে, তার দু’চোখ ঝলসে গেলো। দুটো ফ্লেয়ারই বাম হাতে ধরে সামনের দরজার দিকে এগোতে লাগলো সে। কোনো রকম সামলে নিলো নিজের ভারসাম্য। তার দু’পা টলতে শুরু করেছে। দরজাটা খোলাই আছে। দরজার লকটা ভাঙা। খুনি স্বেচ্ছায় এটা করেছে। কিন্তু দরজার দিকে তাকিয়ে জেসন সঙ্গে সঙ্গে একটা জিনিস বুঝে গেলো; না, কার্লোস জানে না। এটা তার অতীতেরই একটি অংশ। যে ঘরে কেইন জন্ম নিয়েছে সেই ঘরের অংশ। দরজার সামনে এসে অস্ত্রটা দু’পায়ের ফাঁকে আঁটকে এক হাতে দরজার নবটা ধরে দরজাটা একটু ফাঁক করেই ফ্লেয়ার দুটো ঘরের ভেতর ছুঁড়ে মারলো বর্ন। দরজার পেছনের স্টিলের প্লেটে স্টেনগানের গুলিগুলো আঘাত হানলে পুরো ঘরটা জুড়ে, বলতে গেলে পুরো বাড়িটা জুড়েই গুলির শব্দে ভরে উঠলো।

গুলি করা থেমে গেলো। চূড়ান্ত আঘাত হানার সময় এসে গেছে। এখনই। অস্ত্রটার টুগারে আঙুল রেখে কাঁধ দিয়ে সজোরে দরজায় আঘাত ক’রে ভেতরে ঢুকেই মেঝেতে গড়িয়ে পড়লো জেসন। সেই অবস্থায়ই গুলি চালালো সামনের দিকে, অর্ধ চক্রাকারভাবে। গুলির উৎস যেখানটায় সেখানে অস্ত্রটা তাক্ করতেই তার দিকেও পাল্টা গুলি ছুটে এলো। অন্ধকার ঘরে শোনা গেলো একটা ভয়ার্ত আর্তচিৎকার। জেসন সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলো জানালাগুলো পর্দায় ঢেকে দেয়া হয়েছে। তাহলে এই ঘরে এতো আলো আসলো কোত্থেকে…উজ্জ্বল আলো। ফ্লেয়ারের সুতীব্র আলোকেও সেটা ছাপিয়ে গেছে?

পর্দাটা! সিলিং থেকে একটা বিশাল রূপালি পর্দা টাঙানো আছে। বরফ-শীতল আগুন জ্বলছে সেখানে। উঠে দাঁড়িয়ে টুগারটা আবার চাপার জন্যে প্রস্তত হলো সে—–চূড়ান্ত একটা বিস্ফোরণ। শেষ গুলিটা ছোঁড়া হয়ে গেছে। ঘরের এক কোণে সাদা ওভারহল আর সিল্কের স্কার্ফ পরা এক লোকের মুখের দিকে অস্ত্রটা ছুঁড়ে মারলো সে।

মুখটা! সে এই মুখটা চেনে! আগে এই মুখটা সে দেখেছে! কোথায়… কোথায়? মার্সেই’তে? হ্যা…জুরিখে নয়? প্যারিসে? হ্যা এবং না! চেনা চেনা লাগলেও অচেনা লাগছে। কিন্তু সে তো লোকটাকে চেনে! কেবল নামটা খুঁজে পাচ্ছে না!

দ্রুত পিছু হটে একটা ভারি কপার ড্রাই-বারের পেছনে যেতেই সঙ্গে সঙ্গে গুলিগুলো তার দিকে ছুটে এলো, দুটা…তিনটা। দ্বিতীয় বুলেটটা তার বাম হাতের বাহুর মাংস ভেদ ক’রে চলে গেলো। কোমরের বেল্ট থেকে আরেকটা অটোমেটিক নিয়ে নিলো সে, তার পিস্তলে এখনও তিনটি গুলি আছে। সেগুলোর একটাই খুঁজে নেবে কার্লোসকে। প্যারিসে একটা ঋণ রয়ে গেছে, আর তার চুক্তিটাও তো সমাধা করতে হবে। এই খুনির মৃত্যু হলে তার ভালোবাসার মানুষটি অনেক বেশি নিরাপদ থাকবে। পকেট থেকে লাইটারটা বের ক’রে হুকের সাথে ঝুলে থাকা কাপড়ে আগুন ধরিয়ে দিলো সে। কাপড়টা ডান দিকে ছুড়ে মেরেই বাম দিকে ঝাঁপ দিলো জেসন। আগুন লাগা কাপড়টা কার্লোসের দিকে ছুটে যেতেই বর্ন হাটুর উপর ভর দিয়ে উঠে বসলো। অস্ত্রটা টার্গেটের দিকে তাক্ ক’রে পর পর দুটো গুলি চালালো সে।

অবয়বটা একটু টলে গেলেও প’ড়ে গেলো না। বরং সে একটা সাদা প্যান্থারের মতো সামনের দিকে দু’হাত প্রসারিত ক’রে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সে করছেটা কি? তারপরই জেসন বুঝতে পারলো। খুনি বিশাল রূপালি পর্দাটার এক কোণ ধরে সিলিংয়ের সাথে আটকে থাকা লোহার ব্রাকেটটা টেনে খুলে ফেলার চেষ্টা করছে। সেটা সিলিং থেকে খুলে সোজা জেসনের উপর এসে পড়তে লাগলে একটা ভয়ার্ত চিৎকার দিলো সে। আচমকাই সেটা কার্লোসের চেয়েও বেশি ভীতিকর ব’লে মনে হলো তার কাছে। তার উপর পড়তে থাকা পর্দাটার দিকে গুলি চালালো। হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলো পর্দাটা। কিন্তু এও বুঝতে পারলো, শেষ গুলিটা খরচ ক’রে ফেলেছে সে। কেইন নামের কিংবদন্তিটাকে কার্লোস নিজের চোখে দেখে চিনে ফেলেছে। সে গুলিগুলোর হিসাব করেছে এখন।

খুনি তার দিকে ঝুঁকে এসে জেসনের মাথার দিকে অস্ত্রটা তাক্ করলো। “তোমার মৃত্যুদণ্ড, ডেল্টা। নির্দিষ্ট দিনেই হচ্ছে। যা তুমি করেছো তার জন্যে এই দণ্ড।”

বর্ন একটু পিছু হটে ডান দিকে উদ্‌ভ্রান্তের মতো সরে গেলো; অন্ততপক্ষে সে কোনো কিছু না ক’রে মরবে না! গুলির শব্দে প্রকম্পিত হলো পুরো ঘরটা। জেসনের মনে হচ্ছে তার ঘাড় দিয়ে যেনো কোনো গরম সুই ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। তার দু’পায়ে বিদ্ধ করেছে সেটা, তার কোমরটাও বিদ্ধ করেছে। গড়াও! গড়াও!

আচমকা গুলির শব্দটা থেমে গেলো। অনেক দূর থেকে কাঠ আর লোহার উপরে আঘাত করার শব্দ শুনতে পেলো সে। শব্দটা ক্রমশ বাড়ছে। লাইব্রেরির বাইরে একটা প্রচণ্ড জোরে শব্দ হলো অবশেষে। তারপরই লোকজনের চিৎকার আর চেঁচামেচি। সেই সাথে বাইরে সাইরেনের আওয়াজ।

“এখানে! সে এখানে!” কার্লোস চিৎকার ক’রে বললো।

এটা তো একেবারেই অস্বাভাবিক! খুনি হুরমুর ক’রে ঢোকা লোকজনকে তার দিকেই ইঙ্গিত করছে। তার দিকে! কারণটা একেবারেই বোধগম্য হচ্ছে না। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না!

ওভারকোট পরা লম্বা এক লোক দরজাটা ধপাস ক’রে খুলে প্রবেশ করলো ভেতরে। তার সাথে আরেকজন। কিন্তু জেসন তাকে দেখতে পাচ্ছে না। তার চোখে কুয়াশা নেমে এসেছে। দৃশ্য আর শব্দ ঘোলা হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। সে শূন্যে ভাসছে, ডিগবাজি খাচ্ছে। দূরে…বহু দূরে চলে যাচ্ছে।

কিন্তু এরপরই যে জিনিসটা সে দেখতে পেলো সেটা সে দেখতে চায় নি প্রশ্বস্ত কাঁধ আর সরু কোমরের লোকটা ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে মৃদু আলোর করিডোরটা দিয়ে চলে যাচ্ছে। কার্লোস। সে ফাঁদটা উল্টে দিয়েছে। হৈহল্লার মধ্যে শিকারীকেই ফাঁদে ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে সে!

“কার্লোস…” বর্ন জানে তার কথাটা কেউ শুনতে পাবে না। তার রক্তাক্ত মুখ দিয়ে যা বের হলো সেটাকে ফিফিসানি বলা চলে। জোর ক’রে সে আবারো বলার চেষ্টা করলো। “ঐ যে কার্লোস। ঐ যে…কার্লোস!”

তার কথায় কিছুই হলো না। বিশৃঙ্খল এক অবস্থা। ভয়ার্ত কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। ভয়ে ভয়ে কিছু আদেশ করা হচ্ছে। আস্তে আস্তে একটা অবয়ব তার দৃষ্টির গোচরে এলো। একজন লোক খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তার কাছে আসছে, যে লোকটা তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো প্যারিসের এক গোরস্থানে। আর কিছুই বাকি নেই! সে হামাগুড়ি দিয়ে জ্বলতে থাকা ফ্লেয়ার দুটোর কাছে এগোলো। একটা ফ্লেয়ার হাতে নিয়ে এমনভাবে ধরলো যেনো জিনিসটা একটা অস্ত্র। লাঠি হাতে এগিয়ে আসা খুনির দিকে তাক্ করলো সেটা।

“আসো! আসো! কাছে আসো, বানচোত! আমি তোমার চোখ ঝল্‌সে দেবো! তুমি মনে করছো তুমি আমাকে খুন করবে, পারবে না! আমিই তোমাকে খুন করবো! আমি তোমার চোখ ঝলসে দেবো!”

“তুমি বুঝতে পারছো না,” পঙ্গু লোকটা কম্পিত কণ্ঠে বললো। “ডেল্টা, আমি ককলিন। আমি ভুল করেছিলাম।”

ফ্লেয়ারটা তার হাত আর চোখ ঝলসে দিচ্ছে!…উন্মাদনা। তার চার দিকে এখন বিস্ফোরণ, চোখ ঝল্‌ল্সে কানে তালা লাগার জোগার হলো। জঙ্গল! তাম কুয়ান! ভেঁজা আর উষ্ণ দুর্গন্ধ নাকে আসছে প্রতিটি বিস্ফোরণের সাথে, কিন্তু তারা পৌঁছে গিয়েছে সেখানে! ঘাঁটিটা তাদেরই! তার বাম দিকে একটা বিস্ফোরণ হলো, সে দেখতে পেলো সেটা! মাটি থেকে উপরে, দুটো গাছের মাঝখানে ঝুলছে, বাশেঁর একটা খাঁচা। ভেতরের লোকটা নড়ছে। সে বেঁচে আছে! তার কাছে যাও। তাকে উদ্ধার করো!

তার ডান দিক থেকে একটা কান্নার শব্দ ভেসে এলো। ধোঁয়ার মধ্যে কাশছে, নিঃশ্বাস নিচ্ছে। রাইফেল হাতে এক লোক হাটু সমান ঝোঁপঝাড়ের দিকে খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে যাচ্ছে। এটা তো সে-ই। আলোতে সোনালী চুলটা দেখা গেলো। প্যারাসুট জাম্প দিয়ে তার একটা পা ভেঙে গেছে। বানচোত! এই জঘন্য লোকটা তাদের সাথেই ট্রেনিং নিয়েছে। তাদের সঙ্গেই মানচিত্র নিয়ে পড়াশোনা করেছে। তাদের সঙ্গেই তো উত্তর ভিয়েতনামে গিয়েছে…সব সময়ই তাদেরকে ফাঁদে ফেলতো! ওয়্যারলেস হাতের এক বিশ্বাসঘাতক, যে শত্রুদেরকে বলে দিতো জঙ্গলের ঠিক কোথায় তাদের অবস্থান। তাম কুয়ান!

এটা তো বর্ন। জেসন বর্ন। বিশ্বাসঘাতক, আবর্জনা! তাকে ধরো! তাকে যেতে দিও না। খুন করো তাকে! জেসন বর্নকে খুন করো! সে তোমার শত্রু! ফায়ার!

সে পড়ে গেলো না! যে মাথাটা ফেঁটে চৌচির হয়ে গেছে সেটা এখনও সেখানেই আছে। তার দিকে আসছে! হচ্ছেটা কি? পাগলামী। তাম কুয়ান …

“আমার সাথে আসো,” পঙ্গু লোকটা বললো, জঙ্গল থেকে বের হয়ে অভিজাত এই ঘরের অবশিষ্ট যা কিছু আছে সেখানে প্রবেশ করলো সে। সেই ঘরে। “আমরা তোমার শত্রু নই। আমাদের সঙ্গে আসো।”

“চলে যাও আমার সামনে থেকে!” বর্ন আবারো আক্রমণাত্মকভাবে এগিয়ে এলে প’ড়ে থাকা পর্দাটা ঠিক তার পেছনে রইলো। এটাই তার আশ্রয়, তার মৃত্যুর চাদর, যে চাদরটা এক লোকের জন্মের সময় মেলে ধরা হয়েছিলো। তার কফিনের আচ্ছাদন। “তুমি আমার শত্রু! আমি তোমাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মরবো। আমি আর কিছু পরোয়া করি না। এখন আর কিছুই যায় আসে না! তুমি কি বুঝতে পারছো না? আমি হলাম ডেল্টা! কেইন হলো চার্লির জন্যে আর ডেল্টা হলো কেইনের জন্যে! তুমি আর আমার কাছ থেকে কি চাও? আমি ছিলাম, আমি নেই! আমি আছি, আমি নেই! বানচোত! বানচোতের দল। আয়! কাছে আয়!”

আরেকটা কণ্ঠ শোনা গেলো, গম্ভীর একটা কণ্ঠ, শান্ত আর নির্লিপ্ত। “মেয়েটাকে নিয়ে আসো।”

দূর থেকে ভেসে আসা সাইরেনের আওয়াজটা থেমে গেলো। অন্ধকার নেমে এলে সেই অন্ধকারের স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গেলো জেসনকে। সে তলিয়ে যাচ্ছে। এক অন্ধকার আর হিংস্র গহ্বরে সে তলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। ওজনহীন এক জগতে প্রবেশ করছে সে…স্মৃতি। রাতের আকাশে একটা বিস্ফোরণ হলো এবার, কালো পানি থেকে একটা অগ্নিকুণ্ডলী উঠে আসছে। এরপরই মেঘের ভেতর থেকে কিছু কথাবার্তা ভেসে এলো তার কানে।

“জেসন, আমার ভালোবাসা। আমার একমাত্র ভালোবাসা। আমার হাতটা ধরো। শক্ত ক’রে ধরো, জেসন। শক্ত ক’রে ধরো, ডার্লিং।”

অন্ধকারের সাথে এলো নির্মল, এক প্ৰশান্তি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *