অধ্যায় ৩৪
উত্তর-পশ্চিম প্যারিসের লেভালোয়ে’র চার্চের উপর সকালের প্রথম আলোটা এসে পড়লো। মার্চের সকাল খুবই ঠাণ্ডা, রাতের বৃষ্টির জায়গায় ভোরের কুয়াশা জেঁকে বসেছে। শহরের একদল বৃদ্ধ নারী পরিস্কার-কর্মী কাজ শেষ ক’রে ফিরে যাচ্ছে। ঐসব বৃদ্ধ মহিলাদের সঙ্গে ছেঁড়াফাড়া পোশাক পরা একদল বৃদ্ধলোকও আছে—ঠাণ্ডার কারণে নিজেদের ওভারকোটের গলা ধ’রে রেখেছে তারা। তাদের পকেটে আছে মদের বোতল।
ঐসব বৃদ্ধের ভীড়ে একজন বৃদ্ধ বেশ তাড়াহুড়ো ক’রে হাটছে। তবে তার মধ্যে অনিচ্ছাও আছে—এমনকি ভয়ও হতে পারে সেটা—তার ফ্যাকাসে মুখে। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় তার মধ্যে কোনো রকম দ্বিধা রইলো না। এরকম সময়ে চার্চে প্রাথর্না করার জন্যে একটু অদ্ভূতই বটে। তাসত্ত্বেও ভিক্ষুকটি সোজা চলে গেলো প্রথম বুথের দিকে। পর্দাটা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো সে।
“অ্যাঙ্গেলাস দোমিনি।”
“আপনি কি সেটা নিয়ে এসেছেন?” পর্দার ওপাশে থাকা আবছায়া অবয়বটা ফিফিস্ ক’রে বললো। রাগে তার কণ্ঠটা কাঁপছে।
“হ্যা। সে এটা আমার হাতে এমনভাবে দিয়েছে যেনো সে একেবারে বিপর্যস্ত, আমাকে বলছিলো এক্ষুণি চলে যেতে। সে তার কাছে থাকা কেইনের চিরকুটটা পুড়িয়ে ফেলেছে, আর বলেছে যদি এসবের একবর্ণও প্রকাশিত হয় সে সোজা অস্বীকার করবে।” বুড়ো লোকটা পর্দার নিচ দিয়ে কাগজটা দিয়ে দিলো।
“সে মেয়েটার কাগজ ব্যবহার করেছে—” খুনি চাপা কণ্ঠে বললো। একটু পরই পর্দার ওপাশ থেকে মৃদু একটা যন্ত্রণার শব্দ শোনা গেলো। অনেকটা কান্নার মতো।
“আমি তোমাকে স্মরণ করতে বলবো, কার্লোস,” ভিক্ষুক অনুনয় ক’রে বললো। “খবরটা যে বয়ে নিয়ে এসেছে সে তো খবরটার জন্যে দায়ি নয়। আমি যে এটা শুনেছি তা অস্বীকার করতে পারতাম। তোমার কাছে এটা নিয়ে আসার জন্যে রাজি নাও হতে পারতাম।”
“কিভাবে এটা হলো? কেন?…”
“লাভিয়া। তাকে অনুসরণ ক’রে সে পার্ক মশিউ’তে চলে গিয়েছিলো। তারপর তারা দু’জনে চার্চে আসে। আমি তাকে নুয়েলে সুর সেইন-এ দেখেছি যখন আমি তোমার জন্যে ওখানে গিয়েছিলাম। আমি সেটা তোমাকে বলেছি।”
“আমি জানি। কিন্তু কেন? সে তাকে আমার বিরুদ্ধে অনেকভাবে ব্যবহার করতে পারতো! কিন্তু এটা করলো কেন?”
“এটা তার চিরকুটেই লোখা আছে। সে পাগল হয়ে গেছে। অনেক বেশি বাড়াবাড়ি ক’রে ফেলেছে, কার্লোস। লোকটার সোর্স আর কনট্রোল সব শেষ হয়ে গেছে; সে এমন এক জায়গায় নিজেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে যে, সে জানে না সে কি?”
“সে জানে…” কথাটা বেশ শান্ত কণ্ঠে বললো সে। “ডেল্টা হিসেবে নিজেকে উল্লেখ ক’রে সে আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে সে জানে। আমরা দু’জনেই জানি কোত্থেকে এটা এসেছে, কোত্থেকে সে এসেছে।”
ভিক্ষুক একটু চুপ মেরে বললো, “এটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে সে এখনও তোমার জন্যে বিপজ্জনক। সে ঠিকই বলেছে। ওয়াশিংটন তাকে স্পর্শ করবে না। তারা হয়তো তাকে স্বীকারই করবে না। এতে ক’রে তাকে হয়তো তার মুখ বন্ধ রাখার জন্যে একটা বা দুটো সুবিধা দেয়া হতে পারে।”
“যে সব কাগজের কথা সে বলেছে?” গুপ্তঘাতক জানতে চাইলো।
“হ্যা। বার্লিনে, প্রেগে, ভিয়েনাতে পুরনো সব দিনে–তারা বলতো চূড়ান্ত পেমেন্ট।”
বর্ন ‘চুড়ান্ত প্রোটেকশন’ ব্যবহার করবে, একটা ছোটোখাটো দ্বন্দ্ব। সেগুলো এমন সব কাগজপত্র যাতে প্রাথমিক সোর্স-কনট্রোল আর অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে সব কিছু বিস্তারিতভাবে আছে। এই ক্ষেত্রে এটার ব্যবহার পুরো স্ট্র্যাটেজিটাকে ধ্বংস ক’রে ফেলবে। খুনখরাবি হবে, এজেন্টের জন্যে আর কোনো এভিনু খোলা থাকবে না। এটা এমন কিছু নয় যা তুমি নভগোরোদ-এ শিক্ষা নিয়েছো। সোভিয়েতদের এরকম কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। সোভিয়েত ডিফেক্টররা অবশ্য এইসব ব্যাপারে জোর দেয়।”
“তাহলে তো তারা দোষারোপ করে?”
“কিছুটা তো নিতেই হয়। যে ম্যানিপুলেটেড হয়েছে তার বেলায়। বিব্রত হওয়াটা সবসময়ই এড়িয়ে যাওয়া হয়। তবে এটা তোমাকে আমার না বললেও চলে। তুমি এই টেকনিকটা বেশ ভালোভাবেই ব্যবহার করো।”
“‘জঙ্গলে সেভেনটি-ওয়ান স্ট্ট…’” কালোর্স তার হাতের কাগজটা পড়ে বললো। “‘তাম কুয়ান-এর মতো ঘন একটি জঙ্গল’…এবার হত্যাকাণ্ডটি ঠিক সময় মতোই সংঘটিত হবে। কেইনকে এবার মরতেই হবে, আর ডেল্টা যা করেছে তার জন্যে তাকে মরতে হবেই। এনজেলিক—তোমাকে আমি কথা দিচ্ছি।” কার্লোস একটু থামলো। “বর্ন কখন তার বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে, সে ব্যাপারে কি ভিলিয়ার্সের কোনো ধারণা আছে?”
“সে এটা জানে না। আমি তো তোমাকে বলেছিই, সে একেবারে উন্মাদের মতো হয়ে আছে।”
“তাতে কিছু যায় আসে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ফ্লাইট কিছুক্ষণ আগেই ছেড়ে চলে গেছে। সে ওরকম একটাতেই থাকবে। আমি নিউইয়র্কে তার সঙ্গে যাবো। আমি সময়টা হারাতে চাই না। আমার চাকু প্রতীক্ষা করছে। আমি তার মুখের চামড়া তুলে ফেলবো। আমেরিকানরা তাদের কেইনকে পাবে মুখহীন অবস্থায়! তখন তারা এই বর্ন কিংবা ডেল্টাকে তাদের যা খুশি একটা নাম দেবে।”
.
নীল স্ট্রাইপের ফোনটা আলেকজান্ডার ককলিনের ডেস্কে বেজে উঠলো। এই ফোনটার সাথে সরাসরি কম্পিউটার রুম আর ডাটা ব্যাঙ্কের সংযোগ আছে। ফোনটা ধরার মতো কোনো লোক এখন অফিসে নেই।
হঠাৎ করেই সিআইএ’র এক্সিকিউটিভ খোঁড়াতে খোঁড়াতে দরজা দিয়ে অফিসে ঢুকলো। টেলিফোনটার কাছে পৌঁছেই হাতের লাঠিটা রেগেমেগে ছুড়ে ফেলে দিলো সে। গত রাতেই ব্রাসেলস্ থেকে এন্ড্রুজ এয়ারফিল্ডে অবতরণ করেছে। না ঘুমানোর ফলে তার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। ট্রেডস্টোন ধ্বংসকারী লোকটা খুব ক্লান্ত। ওয়াশিংটন আর দেশবিদেশের গোপন-অপারেশনের কয়েকটি ব্রাঞ্চে আধডজন ফোন করেছে সে। বিগত চব্বিশ ঘণ্টার ভুলভ্রান্তিগুলো শোধরানোর চেষ্টা করেছে। তাকে ইউরোপের সর্বত্র অ্যালার্ট ক’রে দিতে হয়েছে। বর্ন বেঁচে আছে আর খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। সে তার ডি.সি’র কন্ট্রোলকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে। দশ ঘণ্টার মধ্যে সে যেকোনো জায়গায় চলে যেতে পারে। সমস্ত বিমানবন্দর আর রেল স্টেশনে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। সবগুলো আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্ক সচল করা হয়েছে। তাকে খুঁজে বের করো! হত্যা করো!
“হ্যা?” ককলিন ডেস্কে বসেই ফোনটা তুলে নিয়ে বললো।
“কম্পিউটার ডক-১২ থেকে বলছি,” পুরুষ কণ্ঠটা বললো। “আমরা হয়তো কিছু একটা পেয়েছি। অন্ততপক্ষে, স্টেটের কাছে এর উপর কোনো কিছু নেই।”
“কিসের?”
“যে নামটি আপনি আামদেরকে চার ঘণ্টা আগে দিয়েছেন। ওয়াশবার্ন।”
“সেটার কি হয়েছে?”
“একজন জর্জ পি. ওয়াশবার্ন প্যারিস থেকে নিউইয়র্কে এসেছে ফ্রান্সের একটি ফ্লাইটে ক’রে, আজ সকালে। ওয়াশবার্ন নামটি খুবই কমন। সে নিতান্তই একজন ব্যবসায়ী হতে পারে, কিন্তু যেহেতু তার স্ট্যাটাস ন্যাটো-ডিপ্লোমেটিক, আমরা সেটা স্টেটের সাথে একটু চেক্ ক’রে দেখেছি। তারা কখনও এ নামটি শোনে নি। ফরাসি সরকারের সাথে এই নামে কোনো লোক ন্যাটোর পক্ষ হয়ে কোনো রকম নিগোশিয়েশনের কাজে জড়িত নয়।”
“তাহলে তাকে কিভাবে ক্লিয়ার করা হলো? তাকে কে ডিপ্লোমেটিক পরিচয়টা দিয়েছে?”
“আমরা প্যারিসে চেক্ ক’রে দেখেছি, এটা খুব সহজ কাজ নয়। বোঝা যাচ্ছে এটা কনসিলার মিলিতেয়ার ব্যবস্থা করেছে।”
“কনসিলার? আমাদের লোকদেরকে তারা কিভাবে ক্লিয়ার দেয়?”
“এটা আমাদের লোক অথবা তাদের লোক হতে হবে এমন ব্যাপার নয়। এটা যে কেউ হতে পারে। হোস্ট কান্ট্রির একটি সৌজন্যতা। তাছাড়া ওয়াশবার্নের পাসপোর্টটা এমনকি আমেরিকানও নয়, বৃটিশ।”
একজন ডাক্তার আছে, ইংরেজ এক ভদ্রলোক। নাম ওয়াশবার্ন…এটা তো সে! এটা হলো ডেল্টা, আর ফ্রান্সের কনসিলার তাকে সহযোগীতা করেছে। কিন্তু নিউইয়র্কে কেন? নিউইয়র্কে তার জন্যে আছেটা কি? আর প্যারিসের এমন উঁচু পর্যায়ের কে তাকে এরকম সহযোগীতা করার ব্যবস্থা ক’রে দিলো? তাদেরকে সে কি বলেছে? ওহ, যিশু! তাদেরকে সে কতোটুকু বলেছে?
“ফ্লাইটটা কখন এসে পৌঁছেছে?” ককলিন জানতে চাইলো।
“আজ সকাল সাড়ে সাতটায়। এখন থেকে প্রায় একঘণ্টা আগে।”
“ঠিক আছে,” ককলিন বললো। “তুমি এটা দিয়ে দিয়েছো, এবার রিল থেকে সব মুছে ফেলো। বুঝেছো?”
“বুঝেছি, স্যার। মুছে ফেলবো।”
ককলিন ফোনটা রেখে দিলো। নিউইয়র্ক? ওয়াশিংটন নয়, নিউইয়র্ক! ওখানে তো আর কিছু নেই। ডেল্টা তা জানে। সে যদি ট্রেডস্টোনের কারোর পিছু নেয় –তার পিছু নেয়—তবে সে সরাসরি ডালেস এয়ারপোর্টে নামবে। নিউইয়র্কে আছেটা কি? আর ডেল্টাই বা কেন ওয়াশবার্ন নামটি ব্যবহার করবে? সে তো জানেই এই নামটা খুব দ্রুত পিকআপ করা হবে। আমেরিকায় ঢোকার সাথে সাথেই এটা জানাজানি হয়ে যাবে। সে খালি ট্রেডস্টোন অপারেশনটাই ফাঁস ক’রে দেবে না, সে আর কতো গভীরে যাবে কে জানে। কেইন হিসেবে সে যেসব নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেছে, লিসেনিং পোস্ট, ভূয়া কনসুলেট যা আসলে ইলেকট্রনিক গোয়েন্দাগিরি…এমন কি মেডুসার কথাও। কনসিলারের সাথে তার কানেকশানই প্রমাণ করে সে কতোটা উঁচু স্তরে যেতে পারে। সে ইঙ্গিত করছে, সে যদি এরকম কোনো লেভেলে অনুপ্রবেশ করতে পারে তো কোনো কিছুই তাকে থামাতে পারবে না। তাকে কী থেকে থামাবো? তার উদ্দেশ্যটা কি? তার কাছে কয়েক মিলিয়ন ডলার আছে। সে তো উধাও হয়ে যেতে পারতো!
ককলিন মাথা ঝুঁকালো। মনে করলো। একটা সময় ছিলো যখন সে ডেল্টাকে উধাও হয়ে যেতে দিতো। বারো ঘণ্টা আগে প্যারিসের এক গোরস্থানে সে তাকে এটা বলেও ছিলো। কিন্তু ডেল্টা উধাও হয় নি! সে এক উন্মাদ বক্তব্য নিয়ে ফিরে এসেছে। অস্বাভাবিক দাবি করছে…এরকম বন্য কৌশল কোনো অভিজ্ঞ ইন্টেলিজেন্স অফিসার চিন্তাও করবে না। তার কাছে যে বিস্ফোরক তথ্যই থাকুক না কেন, সে যতো গভীরেই অনুপ্রবেশ করুক না কেন, কোনো সুস্থ মানুষ মাইনফিল্ডে ফিরে আসবে না, যার চারপাশে রয়েছে অসংখ্য শত্রু। যতো ব্ল্যাকমেইলই তুমি করো না কেন সেটা তোমাকে ফিরিয়ে আনবে না…
সুস্থ মানুষ নয়। সে মোটেও সুস্থ নয়। ককলিন চেয়ারে ব’সে পড়লো।
আমি কেইন নই। সে কখনও তা ছিলো না। আমি কখনও সেটা ছিলাম না! আমি নিউইয়র্কে ছিলাম না…এটা কার্লোস। আমি নই, কার্লোস! যদি আপনার কথা অনুযায়ী সেভেনটি-ফার্স্ট স্টুট-এ সেটা হয়ে থাকে, এটা সে করেছে। সে জানে!
কিন্তু ডেল্টা তো সেভেনটি-ফার্স্ট স্ট্ট-এর ব্রাউনস্টোনে ছিলো। তার আঙুলের ছাপ আছে। পরিবহনের মেথডটা এখন বোঝা যাচ্ছে : এয়ার ফ্রান্স, কনসিলারের সহায়তা…আসল কথা হলো : কার্লোস এটা জানতে পারবে না।
আমার মনে অনেক কিছুই আসছে… অসংখ্য মুখ, দালানকোঠা…আমি কার্লোসের ব্যাপারে হাজারো তথ্য জানি, কিন্তু আমি জানি না কেন!
ককলিন চোখ বন্ধ করলো। একটা কোড যেটা ট্রেডস্টোনের শুরুতে ব্যবহার করা হোতো। সেটা কি? এটা মেডুসা থেকে এসেছে…কেইন হলো চার্লি আর ডেল্টা হলো কেইন। এটাই সেটা। কেইন কার্লোসের জন্যে। ডেল্টা-বর্ন কেইন হয়ে উঠলো, আর সেটা কার্লোসের জন্যে একটা ফাঁদ হিসেবে।
ককলিন চোখ খুললো। জেসন বর্ন ইলিচ রামিরেজ সানচেজকে প্রতিস্থাপন করবে, এটাই ছিলো ট্রেডস্টোন সেভেনটি-ওয়ান-এর পুরো পরিকল্পনা। এটা করা হয়েছিলো কার্লোসকে পাকড়াও করার জন্যে।
বর্ন। জেসন বর্ন। একেবারেই একজন অজ্ঞাত লোক, এমন একজন লোক যে কিনা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চাপা প’ড়ে ছিলো। কিন্তু সে বেঁচে আছে; এটাও পরিকল্পনাটার একটি অংশ।
ককলিন ডেস্কে ফাইলগুলো খুঁজে দেখলো। যে ফাইলটা চাচ্ছে সেটা পেয়েও গেলো। এটার কোনো টাইটেল নেই। কালো রঙের এক্স অক্ষরটার পরই একটি আদ্যাক্ষর আর দুটো সংখ্যা, নির্দেশ করছে এটাই হলো ট্রেডস্টোনের আসল ফোল্ডার।
টি-৭১ এক্স। ট্রেডস্টোন সেভেনটি-ওয়ান-এর জন্ম।
সে ফাইলটা খুললো, কী দেখতে পাবে সেটা নিয়ে সে একটু ভীতও বটে। দণ্ডাদেশের তারিখ। তাম কুয়ান সেক্টর। মার্চ ২৫…
ককলিন ডেস্কের ক্যালেন্ডারটার দিকে তাকালো।
মার্চ ২৪।
“ওহ্ ঈশ্বর,” সে চাপা একটা আর্তনাদ ক’রে ফোনটা হাতে তুলে নিলো।
.
ডাঃ মরিস পানোভ বেথেসডার নাভাল এনেক্সের তৃতীয় তলায় অবস্থিত সাইক্রিয়াটুক ওয়ার্ডের ডাবল দরজাটা দিয়ে প্রবেশ ক’রে কাউন্টারের নার্সদের দিকে এগোলো। এক পোশাক পরা নার্সের দিকে তাকিয়ে হাসলো সে যে কিনা কিছু ইনডেক্স কার্ড নাড়াচাড়া করছে, আর তার পাশে কটমট চোখে চেয়ে আছে একজন সিনিয়র নার্স। বোঝাই যাচ্ছে নার্সটি কোনো রোগীর ফাইল ওলটপালট ক’রে ফেলেছে।
“এ্যানির চোখ রাঙানিকে ভয় পেয়ো না,” পানোভ বললো নাভার্স নার্সের উদ্দেশ্যে। “এই ঠাণ্ডা আর অমানবিক চোখের আড়ালে বিশুদ্ধ গ্রানাইটের এক হৃদয় আছে। আসলে, সে দু’সপ্তাহ আগে পাঁচ তলার পাগলদের ওয়ার্ড থেকে পালিয়ে এসেছে, কিন্তু কথাটা আমরা ভয়ে কাউকে বলি নি।”
নার্স খিল খিল ক’রে হেসে ফেললো। কিন্তু সিনিয়র নার্স বিরক্ত হয়ে মাথা দোলালো। এমন সময় কাউন্টারে রাখা ডেস্কের ফোনটা বেজে উঠলো।
“ফোনটা কি ধরবে, ডিয়ার,” তরুণীটিকে এ্যানি বললে সে মাথা নেড়ে ফোনের কাছে চলে গেলো। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে সিনিয়র নার্স বললো, “ডাক্তার মো, আপনার উপস্থিতিতে আমি কিভাবে তাদের মাথায় এসব ঢোকাতে পারবো, বলবেন কি?”
“ভালোবাসার সাথে, ডিয়ার এ্যানি। ভালোবাসার সাথে। কিন্তু তোমার সাইকেলের চেইনটা ফেলে দিও না।”
“আপনি শোধরাবেন না। বলুন, আপনার পাঁচ-এ’র রোগী কেমন আছে? আমি জানি আপনি তাকে নিয়ে পেরেশানে ছিলেন।”
“এখনও আছি।”
“আপনি নাকি সারা রাত থাকবেন।”
“রাত তিনটায় একটা সিনেমা আছে টিভিতে, আমি সেটা দেখতে চাই।”
“সেটা করবেন না, মো,” সিনিয়র নার্স বললো। “ওসব দেখার বয়স আপনার হয় নি।”
“হয়তো সেসব না দেখার জন্যেও আমার বয়সটা একটু বেশি হয়ে গেছে, এ্যানি। ধন্যবাদ।”
আচমকাই পানোভ আর নার্স সচেতন হয়ে উঠলো যে, ডাক্তারকে পেইজ করা হয়েছে। তরুণী নার্স ডেস্কের মাইক্রেফোনটা দিয়ে কথা বলছে।
“ডা: পানোভের ফোন—”
“আমি ডা: পানোভ,” সাইক্রিয়াটুক মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো। “আমরা চাই না কেউ জানুক, এ্যানি ডোনোভান আসলেই আমার পোল্যান্ডের আম্মাজান। কে ফোন করেছে?”
তরুণী নার্স পানোভের আই.ডি কার্ডের দিকে চেয়ে জবাব দিলো, “মি: আলেকজান্ডার ককলিন নামের একজন, স্যার।”
“ওহ্?” পানোভ চমকে গেলো। এলেক্স ককলিন পাঁচ বছর ধরেই তার একজন রোগী ছিলো, তারা যখন রাজি হলো সে মানিয়ে নিতে পারবে ততোদিন পর্যন্ত সে অধীনেই ছিলো। অনেক কিছুই আছে কিন্তু তারা তার জন্যে খুব কমই করতে পেরেছে। “আমি কোথায় ফোনটা নিতে পারি, এ্যানি?”
“এক নাম্বার রুমে,” হলের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে নার্স বললো। “ওটা খালি আছে। আমি ফোনটা ওখানে ট্রান্সফার ক’রে দিচ্ছি।”
পানোভ দরজার দিকে যাবার সময় এক ধরণের অদ্ভুত অনুভূতিতে আক্রান্ত হলো।
“মো, আমি খুব দ্রুত কিছু জবাব চাই,” ককলিন ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে বললো। “আমি খুব দ্রুত জবাব দিতে অভিজ্ঞ নই, এলেক্স। আপনি কেন এখানে এসে আমার সাথে দেখা করছেন না?”
“এটা আমার ব্যাপারে নয়, অন্য কারোর জন্যে।”
“কোনো খেলা খেলবেন না, দয়া ক’রে। আমার মনে হয় এসব করার বয়স আমাদের নয়।”
“কোনো খেলা নয়। এটা ফোর-জিরো এমার্জেন্সি, আমার সাহায্যের দরকার।”
“ফোর-জিরো? আপনার একজন স্টাফকে ডাকুন। এরকম ক্লিয়ারেন্সের জন্যে আমাকে কখনও অনুরোধ করা হয় নি।”
“আমি পারবো না। এটা খুবই কঠিন একটি অবস্থা।”
“তাহলে সেটা ঈশ্বরের কানে কানে বলুন।”
“মো, প্লিজ! আমাকে কেবল সম্ভাবনাগুলো কনফার্ম করতে হবে, বাকিটা আমি নিজেই ক’রে নিতে পারবো। আর পাঁচ সেকেন্ড সময়ও নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে নেই। একজন লোক হয়তো ঘুরে বেড়াচ্ছে কোনো ভূতের বারোটা বাজাতে, সে যাকে ভূত মনে করবে তাকেই শেষ ক’রে দেবে। সে ইতিমধ্যেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ লোককে খুন করেছে, মনে হয় না সে এই ব্যাপারটা আদৌ জানে। আমাকে সাহায্য করুন। সাহায্য করুন!”
“যদি পারি তো করবো। বলুন।”
“দীর্ঘ দিন ধরে খুবই নাজুক আর প্রচণ্ড চাপের পরিস্থিতিতে আছে এক লোক, পুরো সময়টা একেবারে ডিপ কভারে রয়েছে। সে নিজেই একটা টোপ বা ফাঁদ—খুবই দৃশ্যমান আর নেতিবাচক। বিরামহীন চাপ দেয়া হয়েছে সেই দৃশ্যমানতাকে বজায় রাখার জন্যে। উদ্দেশ্যটা হলো ফাঁদটার সমজাতীয় একটি টার্গেটকে এই ব’লে ফাঁদে ফেলা যে, টোপটা তার জন্যে একটা হুমকি। এতে ক’রে টার্গেট প্রকাশ্য হবে…আপনি কি আমার কথাটা বুঝতে পারছেন?”
“এ পর্যন্ত বুঝতে পারছি,” পানোভ বললো। “আপনি বলছেন তাকে খুব চাপের মধ্যে রাখা হয়েছে। তার পারিপার্শ্বিকতাটা কি রকম?”
“অসম্ভব হিংসাত্মক আর বন্য।”
“কতো দিন ধরে?”
“তিন বছর।”
“বাপরে বাপ,” মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বললো। “কোনো বিরতি নেই?”
“একদমই না। দিনে-রাতে চব্বিশ ঘণ্টা, বছরে তিনশ’ পয়ষট্টি দিন। তিন বছর। এমন একজন হিসেবে আছে যা তার নিজের পরিচয় নয়।”
“কখন আপনারা এই বোকার দল শিখবেন? এমনকি সবচাইতে বাজে বন্দী শিবিরের বন্দীরাও নিজেদেরকে নিজের মতো করেই ভাবে। অন্যদের সাথে কথা বলে—” পনোভ একটু থামলো। ককলিনের কথাটার অর্থ বোঝার চেষ্টা করছে সে। “এটাই তো আপনার পয়েন্ট, তাই না?”
“আমি ঠিক নিশ্চিত নই,” ইন্টেলিজেন্স অফিসার বললো। “এটা অস্পষ্ট, ঘোলাটে এমনকি স্ববিরোধীও বটে। আমি যেটা আপনাকে জিজ্ঞেস করতে চাই সেটা হলো, এরকম লোক কি এইসব পারিপার্শ্বিকতায় ভাবতে শুরু করবে…মানে, বিশ্বাস করতে শুরু করবে যে, সে নিজেই একটা ফাঁদ?”
“জবাবটা তো নিশ্চিত। আপনি জানতে চাইলেন ব’লে খুব অবাক হচ্ছি। অবশ্যই সে ভাবতে শুরু করবে। সম্ভবত তাই করবে। সে যদি এটা বিশ্বাস করতে না শুরু করে তবে এতো দীর্ঘদিন ধরে সে ওরকম পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারবে না। অভিনেতা কখনও মঞ্চ থেকে নামতে পারবে না যদি নাটকটা শেষ না হয়।” ডাক্তার থেমে এবার আরো সতর্কভাবে বলতে লাগলো। “কিন্তু এটা বোধহয় আপনার প্রশ্ন নয়, তাই না?”
“না,” ককলিন জবাব দিলো। “আমি আরো একধাপ সামনে যাবো। ফাঁদটা বাদে এটাই একমাত্র ব্যাপার যা আমার বোধগম্য হচ্ছে।”
“দাঁড়ান,” পানোভ তীক্ষ্মভাবে বাঁধা দিয়ে বললো। “আপনি ওখানেই থামুন। আপনি এখন যা নিয়েই ব্যস্ত থাকুন না কেন আমি কোনো ব্লাইন্ড ডায়াগনোসিস করি না। কোনোভাবেই না, চার্লি। এটা আপনি করতে পারেন, আমি পারি না—কোনো কনসালটেশন ফি দেন আর না দেন।”
“‘কোনোভাবেই না, চার্লি,’ এটা কেন বললেন, মো?”
“কি বলতে চাচ্ছেন, আমি কেন এটা বললাম? এটা একটা পদবাচ্য। আমি এটা সব সময় শুনে এসেছি। নোংরা নীল জিন্স পরা বাচ্চাছেলের দল আর আমার প্রিয় সেলুনের পতিতাদের কাছ থেকে।”
“আপনি কি ক’রে জানলেন আমি একটা বিষয় নিয়ে ব্যস্ত?” সিআইএ’র লোকটা জানতে চাইলো।
“কারণ আমাকে বই-পুস্তক পড়তে হয়। আর আপনিও খুব অস্পষ্ট ক’রে কিছু বলেন নি। আপনি একজন ক্লাসিক প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়ার বর্ণনা দিচ্ছেন যার একাধিক পারসোনালিটি রয়েছে। এটা এমন নয় যে, আপনার লোকটা ফাঁদ-এর ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছে, বরং ফাঁদটা নিজেই টার্গেটে রূপান্তরিত হয়েছে। এটা নিয়েই আপনি বিচলিত, অ্যালেক্স। আপনি বলছেন আপনার লোকটা তিন জন লোক : সে নিজে, ফাঁদ আর টার্গেট। আমি আবারো বলছি, কোনোভাবেই না, চার্লি। আমি কোনো এক্সামিন করা ছাড়া কোনো কিছু নিশ্চিত ক’রে বলবো না!”
“আমি আপনাকে কোনো কিছু নিশ্চিত ক’রে বলতে বলছি না! আমি কেবল জানতে চাই এটা সম্ভব কিনা। ঈশ্বরের দোহাই লাগে, মো। একজন ভয়ঙ্কর লোক অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর লোকজনকে খুন করছে। সে এমন সব লোকদের খুন করছে যাদের হয়ে সে তিন বছর কাজ করেছে। আর এ কাজটা সে করছে, তাও মনে হয় সে জানে না। একটা নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট জায়গায় গেছে ব’লে অস্বীকারও করছে অথচ সেই জায়গায় তার আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। সে বলছে তার মনে কিছু ছবি, কিছু শব্দ আসছে—কিন্তু সেগুলোকে সে ঠিক ধরতে পারছে না। সে দাবি করছে সে কখনও ফাঁদ ছিলো না। কখনই ছিলো না! কিন্তু সে তো তাই! এটা কি সম্ভব? এটাই কেবল জানতে চাইছি। প্রচণ্ড চাপ এবং প্রতিদিনকার অসহ্য অবস্থার ফলে কি সে এভাবে তিন তিনটি ব্যক্তিতে ভেঙে পড়তে পারে?”
পানোভ কয়েক মুহূর্তের জন্যে নিঃশ্বাস বন্ধ ক’রে রাখলো। “এটা সম্ভব,” সে আস্তে ক’রে বললো। “যদি আপনি যা বললেন সেগুলো সত্য হয়ে থাকে। এটাই আমি বলবো, কারণ আরো অন্যান্য সম্ভাবনাও রয়েছে।”
“ধন্যবাদ আপনাকে।” ককলিন একটু থামলো। “শেষ একটা প্রশ্ন। ধরুন একটা তারিখ আছে একটা মাস আর একটা দিন—সেটা টোপটার ডোসিয়েরের জন্যে জন্যে গুরুত্বপূর্ণ।”
“আপনাকে আরো নির্দিষ্ট ক’রে বলতে হবে।”
“বলছি। ঐ দিনটিতে ফাঁদের জন্যে যার নামটা নেয়া হয়েছিলো তাকে খুন করা হয়েছিলো।”
“তাহলে তো সেটা ওয়ার্কিং ডোসিয়েরের অংশ নয়, তবে আপনার লোক সেটা জানতো। আমি কি ঠিক বলছি?”
“হ্যা, সে জানতো সেটা। বলা যায় সে ওখানেই ছিলো। সে কি স্মরণ করতে পারবে?”
“ফাঁদ হিসেবে নয়।”
“অন্য দু’জন হিসেবে?”
“ধরে নিচ্ছি টার্গেটও সেটা জানতো। যদি জেনে থাকে সেক্ষেত্রে আমার জবাবটা হবে হ্যা।”
“আরেকটা জায়গা আছে, যেখানে স্ট্র্যাটেজিটা প্রণয়ন করা হয়েছে, যেখানে ফাঁদটাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যদি আমাদের লোক সেই জায়গার আশেপাশে যায় আর সেটা যদি মৃত্যুর তারিখের দিন হয়ে থাকে, সেটা কি তার মনে উদয় হবে?”
“হবে, যদি মৃত্যুর আসল জায়গার সাথে সেটার কোনো সংযোগ থাকে। কারণ টোপটা সেখানেই সৃষ্টি হয়েছে। এটা সম্ভব। অবশ্য সেটা নির্ভর করছে সেই মুহূর্তে কোন্ ব্যক্তি তার উপরে ভর ক’রে আছে তার উপর।”
“ধরুন, সে নিজেই টার্গেট?”
“এবং সে জায়গাটা চেনে?”
“হ্যা, কারণ তার আরেকটা অংশ সেটা জানে।”
“তাহলে সে সেখানে যাবে। এটা ঘটবে অবচেতন মনের শক্তিতে।”
“কেন?”
“ফাঁদটাকে খুন করার জন্যে। সে যা দেখবে তাই খুন করবে। তবে প্রধান উদ্দেশ্য হবে ফাঁদটি। সে নিজে।”
.
ফোনটা রেখে দিলো আলেকজান্ডার ককলিন। তার চিন্তাভাবনাগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরতে লাগলো। নিজেকে ধাতস্থ করার জন্যে বন্ধ ক’রে ফেললো দু’চোখ। প্যারিসের বাইরে একটি গোরস্থানে সে ভুল করেছে। একজন লোককে ভুল কারণে খুন করেতে চেয়েছিলো সে। আসল কারণটি তার বোধগম্যতার বাইরে। সে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন লোকের মোকাবেলা করছে। এমন একজন, যার সমস্যা, যন্ত্রণা আর দুঃখগুলো বিশ বছরের ট্রেনিংয়েও ব্যাখ্যা করা হয়ে ওঠে নি। সত্যি ক’রে কেউ কিছু জানে না। একজন কার্লোস ফাঁদে পড়বে, আজকে খুন হবে, আরেকজন তার জায়গা দখল করবে। আমরা কেন সেটা করবো…ডেভিড?
ডেভিড। অবশেষে আমি তোমার নামটা বললাম। এক সময় আমরা বন্ধু ছিলাম, ডেভিড…ডেল্টা। আমি তোমার বউ আর বাচ্চাদের চিনি। আমরা এশিয়ার এক পোস্টে ব’সে কয়েকবার ডিনার করেছি, মদ পান করেছি। তুমি ছিলে প্রাচ্যে কর্মরত ফরেন সার্ভিসের সবচাইতে সেরা অফিসার, আর এটা সবাই জানতো। তুমি নতুন এক পলিসির মূলচাবিকাঠি হতে যাচ্ছিলে। তারপরই এটা ঘটলো। মেকং-এ আকাশ থেকে মৃত্যু। তুমি বেঈমানী করেছো, ডেভিড। আমরা সবাই হেরে গেছি, তবে মেডুসায় আমাদের মধ্যে একজনই ডেল্টা হবে। তোমাকে অতো ভালো ক’রে চিনি না—দুয়েকবার ডিনার আর মদ খেলে তো ঘনিষ্ঠ হওয়া যায় না। তবে আমাদের মধ্যে অল্পকয়েকজন পশু হয়ে উঠেছিলো। যেমন তুমি, ডেল্টা। এখন তোমাকে মরতে হবে। তোমাকে আর কেউ বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না।
.
“চলে যাও, প্লিজ,” মতঁমার্ত্রের ক্যাফে’তে মেরির মুখোমুখি বসতেই জেনারেল ভিলিয়ার্স তার সহকারীকে বললো। কিন্তু সহকারী মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বুথ থেকে দশ ফিট দূরে দাঁড়িয়ে রইলো। ক্লান্ত বৃদ্ধ লোকটি মেরির দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি কেন আমাকে এখানে আসার জন্যে চাপাচাপি করছিলে? সে চাচ্ছে তুমি প্যারিসের বাইরে চলে যাও। আমি তাকে কথা দিয়েছি তোমাকে নিরাপদে পাঠিয়ে দেবো।”
“প্যারিসের বাইরে, এসব ছেড়েছুড়ে,” মেরি বললো, বুড়ো লোকটার বিষন্ন মুখটার একপাশ স্পর্শ ক’রে। “আমি দুঃখিত। আমি আপনার জন্যে আরেকটা বোঝা হতে চাই না। রেডিওতে আমি খবরটা শুনেছি।”
“বিকারগ্রস্ত সব কাজ,” সামনে রাখা ব্র্যান্ডিটা তুলে নিয়ে ভিলিয়ার্স বললো। “তিন ঘণ্টা ধরে পুলিশের সাথে মিথ্যে কথা ব’লে যাচ্ছি। এমন একজন লোককে অপরাধের জন্যে গালিগালাজ ক’রে যাচ্ছি যে লোকটা আসলে আমি নিজেই।”
“বর্ণনাটা খুবই নিঁখুত। তাকে চিনতে কেউ ভুল করবে না।”
“সে নিজেই এটা আমাকে দিয়েছে। সে বলেছে এটাই হলো একমাত্র পথ। কার্লোস কেবলমাত্র আমার পুলিশের কাছে যাওয়াতেই বুঝতে পারবে ব্যাপারটা। একটা মানুষ শিকার অভিযান সৃষ্টি করা। অবশ্য, তার কথাই ঠিক।”
“তার কথাই ঠিক,” মেরিও একমত হলো। “কিন্তু সে প্যারিসে, ব্রাসেলসে কিংবা আমস্টারডামে নেই।”
“কি বললে, বুঝলাম না?”
“আমি চাই আপনি আমাকে বলুন, সে কোথায় আছে এখন।”
“সে নিজেই তোমাকে সেটা বলবে।”
“সে আমার কাছে মিথ্যে বলেছে।”
“তুমি কি ক’রে নিশ্চিত হলে সে মিথ্যে বলেছে?”
“কারণ আমি জানি কখন সে আমার কাছে সত্য বলে। আমরা দু’জনেই সেটা বুঝি।”
“দু’জনেই…? আমি বুঝতে পারছি না।”
“আমার মনে হয় না আপনি বুঝতে পারবেন। আমি নিশ্চিত সে আপনাকে বলে নি। সে যখন আমার কাছে ফোনে মিথ্যে বলে একটু ইতস্তত করে, জানি কথাগুলো মিথ্যে। তবে রেডিওর খবরটা শোনার আগে আমি বুঝতে পারি নি। বর্ণনাটা খুবই নিখুত। এমনকি তার মাথার একটি দাগসহ দেয়া হয়েছে। তখনই আমি জানতাম সে আর প্যারিসে নেই। অথবা প্যারিসের পাঁচশ’ মাইলের মধ্যে নেই। অনেক দূরে চলে গেছে সে। যেখানে এইসব বর্ণনা খুব একটা কাজে আসবে না। যেখানে কার্লোস তার পিছু পিছু যাবে, তাকে তাদের কাছে ধরিয়ে দেয়া হবে যাদের সাথে জেসনের চুক্তি আছে। আমি কি ঠিক বলেছি?”
ভিলিয়ার্স মদের গ্লাসটা নামিয়ে রাখলো। “আমি কথা দিয়েছি, তোমাকে নিরাপদে রাখা হবে। তোমার কথা তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“তাহলে আমি আরো পরিস্কার ক’রে বলার চেষ্টা করছি,” মেরি সামনের দিকে ঝুঁকে এসে বললো। “রেডিওতে আরেকটা রিপোর্ট ছিলো, সেই খবরটা আপনি শোনেন নি। তখন আপনি পুলিশের ওখানে ছিলেন। আজ সকালে র্যামবোয়ে’র গোরস্থানে দু’জন লোক খুন হয়েছে। একজন সেন গার্ভেই’র খুনি হিসেবে পরিচিত। অন্যজন প্যারিসে বসবাস করা সিআইএ’র সাবেক এক কর্মকর্তা। খুবই বিতর্কিত এক লোক, যাকে এক ভিয়েতনামি সাংবাদিক হত্যার দায়ে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছিলো।”
“তুমি কি বলতে চাচ্ছো ঘটনাগুলোর সাথে সম্পর্ক রয়েছে?” বুড়ো লোকটি জানতে চাইলো।
“জেসনকে আমেরিকান অ্যাম্বাসি গত রাতে নির্দেশ দিয়েছিলো গোরস্থানে যেতে। ওয়াশিংটন থেকে আসা এক লোকের সাথে ওখানে দেখা করার কথা ছিলো তার।”
“ওয়াশিংটন?”
“হ্যা। আমেরিকান ইন্টেলিজেন্সের একটি ছোট্ট দলের সাথে তার একটি চুক্তি আছে। গতরাতে তারা তাকে খুন করার চেষ্টা করেছিলো। তারা মনে করে তাকে খুন করতেই হবে।”
“হায় ঈশ্বর, কেন?”
“কারণ তারা তাকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না। তারা জানে না দীর্ঘদিন ধরে সে কোথায় ছিলো অথবা কি করেছে সে। আর সেও তাদেরকে সেটা বলতে পারছে না।” মেরি চোখ দুটো বন্ধ ক’রে একটু থামলো। “সে জানে না সে কে। সে এও জানে না তারা কারা। গতরাতে ওয়াশিংটন থেকে আসা লোকটা তাকে খুন করার জন্যে খুনি ভাড়া করেছিলো। সেই লোকটা কোনো কথা শুনবে না। তারা মনে করে সে তাদের সঙ্গে বেঈমানী করেছে, তাদের কাছ থেকে মিলিয়ন ডলার চুরি করেছে। এমন সব লোককে খুন করেছে যাদেরকে সে কখনও দেখে নি। তবে তার কাছে এসবের কোনো পরিস্কার জবাবও নেই। তার কোনো স্মৃতি নেই বললেই চলে। একেবারে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে গেছে।”
ভিলিয়ার্সের দোমড়ানো মুখটাতে বিস্ময় ছড়িয়ে পড়লো। “‘মিথ্যে অভিযোগ…’ সে আমাকে কথাটা বলেছিলো। তাদের সব জায়গাতেই লোকজন রয়েছে…আমাকে দেখামাত্রই হত্যা করার আদেশ দেয়া হয়েছে। আমাকে একদল লোক তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে যাদেরকে আমি চিনি না, জানি না। সবই মিথ্যে অভিযোগে।’”
“একেবারেই মিথ্যে অভিযোগে,” মেরি কথাটা জোর দিয়ে ব’লে বৃদ্ধের হাতটা ধরলো। “তাদের আসলেই সবখানে লোকজন রয়েছে। তারা দেখামাত্রই তাকে খুন করবে। সে যেখানেই যাক না কেন, তারা অপেক্ষা করবে।”
“সে কোথায় গেছে সেটা তারা কিভাবে জানবে?”
“তাদেরকে সে-ই বলবে। এটাই তার কৌশলের অংশ। আর সেটা যখন সে করবে তখন তারা তাকে হত্যা করবে। সে তার নিজের ফাঁদেই পা দিচ্ছে।”
ভিলিয়ার্স কিছুক্ষণ চুপ মেরে রাইলো। অবশেষে নিচু স্বরে কথা বললো সে। “হায় ঈশ্বর, আমি একি করেছি?”
“আপনি যা ভেবেছেন সেটা ঠিকই ছিলো। সে আপনাকে যা বুঝিয়েছে সেটাও ঠিক। আপনি নিজেকে এজন্যে দোষ দিতে পারেন না। অথবা তাকে।”
“সে বলেছে তার যা হবে সবই সে লিখে জানাবে। যা তার মনে আসে তাও জানাবে। তার জন্যে সেই বক্তব্যটা দেয়া কতোটা যন্ত্রণার ছিলো কে জানে! আমি চিঠির জন্যে আর অপেক্ষা করতে পারছি না, মাদামোয়াজেল। আমরা অপেক্ষা করতে পারি না। তুমি আমাকে সব বলো। এখনই।”
“আপনি কি করতে পারবেন?”
“আমেরিকান অ্যাম্বাসিতে যাবো। অ্যাম্বাসেডরের কাছে সব বলবো।”
মেরি একটু উদাস হয়ে গেলো। তার দু’চোখে অশ্রু। “সে আমাকে বলেছে তার জীবনটা শুরু হয়েছে ভূমধ্য সাগরের ছোট্ট একটা দ্বীপ ইল দ্য পোর্ত নোয়ে’তে…”
.
কনসুলার অপারেশন ডাইরেক্টরের অফিসে পররাষ্ট্র সচিব রেগেমেগে ঢুকলো। এই ডিপার্টমেন্টটা গোপন অপারেশন পরিচালনা ক’রে থাকে।
“মি: সেক্রেটারি?…আমি আপনার অফিসের মেসেজ পাই নি, স্যার। আমি এক্ষুণি উপরে আসছি।”
সেক্রেটারি একটা হলুদ রঙের কাগজ ডাইরেক্টরের ডেস্কে আছাড় মেরে রাখলো। কাগজটার উপরে ছয়টি নাম বড়বড় ক’রে লেখা।
বর্ন। ডেল্টা। মেডুসা। কেইন। কার্লোস। ট্রেডস্টোন
“এটা কি?” সেক্রেটারি জানতে চাইলো। “আমি জানতে চাইছি এসব কি?” ডাইরেক্টর কনস্-অপ একটু সামনের দিকে ঝুঁকে এলো। “আমি জানি না, স্যার। এগুলো নাম, এটা অবশ্য বুঝতে পারছি। কোনো কোড হবে হয়তো। মেডুসার নামটা অবশ্য আমি শুনেছি। আর কার্লোস মনে হয় ঐ কুখ্যাত খুনিটাই হবে। কিন্তু বর্ন, কেইন অথবা ট্রেডস্টোন নামটি আমরা কখনও শুনি নি।”
“তাহলে উপরে আমার অফিসে এসে এইমাত্র আমার সাথে প্যারিসের একজনের ফোনালাপের টেপটা শুনে এ বিষয়ে জ্ঞান অর্জন ক’রে যান!” সেক্রেটারি বিস্ফোরিত হলো। “সেই টেপে অসাধারণ কিছু জিনিস আছে। তার মধ্যে অটোয়া আর প্যারিসের খুনখারাবির কথাও রয়েছে। আর মতেঁই’তে আমাদের ফার্স্ট সেক্রেটারির সাথে একজন সিআইএ’র অদ্ভুত সব কাজকারবারের কথাও আছে তাতে। এমন সব জিনিস আছে ঐ টেপে যার সম্পর্কে পররাষ্ট্র দপ্তর কিছুই জানে না অথচ ইউরোপের সব পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে! আমারা কূটনৈতিক সংকটে প’ড়ে গেছি। কানাডিয়ান সরকারের একজন মহিলা অর্থনীতিবিদ জুরিখে হত্যার আসামী হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমরা একজন ফেরারিকে আশ্রয় দিতে বাধ্য হচ্ছি, কারণ সেই মেয়েটা যদি তার মুখ খুলে, সব সত্য বলে দেয়, তাহলে আমাদের পাছা আর আস্ত থাকবে না! আমি জানতে চাই এসব হচ্ছেটা কি? আপনার ক্যালেন্ডারের সব বাতিল ক’রে দিন— সব কিছু মানে সব কিছুই। এই পুরো বিষয়টা জানতে যদি আপনাকে সারাটা দিন-রাত এখানে আমার সাথে থাকতে হয়, আপনাকে তাই করতে হবে। একটা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে যে জানে না সে কে। আর তার মাথায় যে গোপন তথ্য রয়েছে সেটা দশটি কম্পিউটারে রক্ষিত তথ্যের চেয়েও নাকি বেশি!”
.
প্রায় মধ্য রাতের পরই ক্লান্ত কনসুলার ডাইরেক্টর সংযোগটা পেলো। আরেকটুর জন্যে কানেকশানটা মিস্ করতো। প্যারিসের ফার্স্ট সেক্রেটারিকে এক্ষুণি বরখাস্ত করা হবে হুমকি দিলে সে আলেকজান্ডার ককলিনের নামটা বলেলো। কিন্তু ককলিনকে কোথাও পাওয়া গেলো না। সে ওয়াশিংটনে এসে পৌঁছেছে ব্রাসেল্স থেকে একটা মিলিটারি বিমানে ক’রে সকাল বেলায়। কিন্তু ল্যাঙ্গলে’তে সাইন আউট করেছে দুপুর ১টা ২২মিনিটে। কোনো ফোন নাম্বার রেখে যায় নি—এমনকি কোনো জরুরি নাম্বারও। আর ডাইরেক্টর ককলিনের ব্যাপারে যা জানতে পারলো তাতে দেখা গেলো ভুলটা খুবই অসাধারণ।
সিআইএ’র এই লোকটাকে সবাই হাঙ্গর-শিকারী বলেই ডাকে। সে সারা বিশ্বে এমন সব স্বতন্ত্র কৌশল পরিচালনা ক’রে যাতে বিচ্যুতি আর বিশ্বাসঘাতকতার সন্দেহ থেকে যায়। প্রায় সব স্টেশেনে এই লোকটার অনুমোদন অথবা নিষেধাজ্ঞাকে আমলে নেয়া হয় যেকোনো সময়। এটা তো যুক্তিসঙ্গত নয় মোটেও। আরো যেটা অস্বাভাবিক সেটা হলো তার ফোন লগটা কাটাকুটি করা। বিগত দুই দিনের কোনো রেকর্ড নেই সেখানে। অথচ সিআইএ এ ব্যাপারে কড়াকড়ি নিয়ম মেনে চলে। নতুন সরকারের নতুন আদেশ হলো ট্রেস করা যায় এরকম জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। যাইহোক, কনস্-অপ’র ডাইরেক্টর শেষপর্যন্ত একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পেরেছে : ককলিন মেডুসায় ছিলো।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের ধমকিতে ডাইরেক্টর ককলিনের বিগত পাঁচ সপ্তাহের ফোন কলগুলো খতিয়ে দেখতে অনুরোধ করেছে। ডাইরেক্টর তার পেন্টাগনের সোর্সকে ফোন ক’রে একটা বিষয়ে খোঁজ নিতে বললো : মেডুসা। বৃগেডিয়ার জেনারেল আরউইন আর্থার ক্রফোর্ড, বর্তমান পদবী আর্মির ইন্টেলিজেন্স ডাটা ব্যাঙ্কের অফিসার ইন চার্জ, সায়গনের সাবেক গোপন অপারেশন কমান্ডার—এখনও যেটা গোপনীয়। মেডুসা।
ডাইরেক্টর কনফারেন্স রুমের ফোনটা তুলে নিলো, এটার সাথে সুইচবোর্ডের বাইপাস রয়েছে। সে বৃগেডিয়ারের ফেয়ারফ্যাক্সের বাড়িতে ফোন করলে চতুর্থবার রিং হবার পর জেনারেল ফোনটা ধরলো। নিজের পরিচয় দিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের লোকটা জেনারেলকে ফিরতি ফোন করার অনুরোধ জানালো।
“আমি কেন এটা করবো?”
“এটা ট্ৰেডস্টোন সংক্রান্ত একটি ব্যাপার।”
“ঠিক আছে, আমি আপনাকে একটু পরে ফোন করছি।”
আঠারো সেকেন্ড পরেই সে ফোনটা করলো, দুই মিনিটের মধ্যেই ডাইরেক্টর স্টেট ইনফর্মেশন-এর রূপরেখাটা দিয়ে দিলো।
“এ সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না,” বৃগেডিয়ার। “শুরু থেকেই এ ব্যাপারে একটি কনট্রোল কমিটি ছিলো, প্রচলনের এক সপ্তাহের মধ্যেই ওভাল অফিস একটি প্রাথমিক সামারি দিয়ে ছিলো। আমাদের উদ্দেশ্যের জন্যে এর প্রয়োজন ছিলো, আপনি হয়তো সেটা জানেন।”
“এটার সাথে কি এক সপ্তাহ আগে ঘটে যাওয়া নিউইয়র্কের ঘটনাটার কোনো সম্পর্ক আছে? এলিয়ট স্টিভেন্স—মেজর ওয়েব এবং ডেভিড অ্যাবোট? পরিস্থিতিগুলো বদলে ফেলা হয়েছে ব’লে কি বলতে পারি?”
“আপনি বদলে ফেলার ব্যাপারে অবগত আছেন?”
“আমি কনস্-অপ-এর হেড, জেনারেল।”
“অবশ্যই। স্টিভেন্স বিবাহিত ছিলো না। বাকিটা বোধগম্য। ডাকাতি এবং হত্যাকাণ্ডই বেশি পছন্দনীয় ছিলো। জবাবটা ইতিবাচক।”
“বুঝেছি…আপনাদের বর্ন গতকাল সকালে নিউইয়র্কে এসে পৌঁছেছে।”
“জানি। আমরা সেটা জানি ককলিন এবং আমি। আমরাই তো উত্তরাধিকার।”
“আপনি ককলিনের সাথে যোগাযোগ রাখছিলেন?”
“আমি তার সাথে শেষ কথা বলেছি দুপুর একটার দিকে। এটা রেকর্ড করা নেই। সত্যি বলতে কি, সে রেকর্ড না করার ব্যাপারে জোর করেছে।”
“সে ল্যাঙ্গলে থেকে চলে গেছে। তাকে ফোন করার মতো কোনো নাম্বার নেই।”
“আমি সেটাও জানি। কোনো কিছু করার চেষ্টাও করবেন না। যথযথ সম্মানের সাথেই বলছি, সেক্রেটারিকে বলবেন এ নিয়ে যেনো তারা মাথা না ঘামায়। আপনিও মাথা ঘামাবেন না। এসবে জড়িয়ে পড়বেন না।”
“আমরা জড়িত হয়ে পড়েছি, জেনারেল।
“আমরা কানাডিয়ান মেয়েটাকে এখানে নিয়ে আসছি।”
“কিন্তু কেন?”
“আমরা বাধ্য হচ্ছি। মেয়েটা আমাদেরকে বাধ্য করছে।”
“তাহলে তাকে সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ক’রে রাখুন। আপনাকে সেটা করতেই হবে! সে আমাদের। আমরাই দায়ি হবো।”
“আমার মনে হয় আপনাকে এটা বুঝিয়ে বলতে হবে।”
“আমরা একজন মানসিক ভারসাম্যহীন লোককে নিয়ে কাজ করছি। একজন মাল্টিপাল সিজোফ্রেনিক। সে একটা জীবন্ত ফায়ারিং স্কোয়াড। সে এক ডজন নিরীহ লোককে খুন করতে পারে। কিন্তু সে জানে না কেন।”
“আপনি কি ক’রে জানলেন সেটা?”
“কারণ সে এরই মধ্যে খুনখারাবি ক’রে
ক’রে ফেলেছে। নিউইয়র্কের হত্যাকাণ্ডটি—সে-ই করেছে। স্টিভেন্স, ওয়েব আর সন্ন্যাসিকে হত্যা করেছে সে—আর বাকি যে দু’জনকে সে খুন করেছে তাদের সম্পর্কে আপনি কিছু শোনেন নি। আমরা এখন বুঝতে পারছি সেটা। সে দায়ি নয়, তবে তাতে এখন আর কিছুই যায় আসে না। তাকে আমাদের হাতেই ছেড়ে দিন। ককলিনের হাতে।”
“বর্নকে?”
“হ্যা। আমাদের কাছে প্রমাণ আছে। তার আঙুলের ছাপ আছে। ব্যুরো সেটা নিশ্চিত করেছে। সে-ই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটিয়েছে।”
“আপনাদের লোক আকাম ক’রে নিজের আঙুলের ছাপ রেখে গেছে?”
“তাই তো করেছে।”
“এটা তো সে করতে পারে না,” স্টেট ডিপার্টমেন্টের লোকটা অবশেষে বললো।
“কি?”
“আমাকে বলুন কোত্থেকে আপনি এই ধারণায় আসলেন যে, লোকটা মানসিকভাবে অসুস্থ? ঐ যে বললেন না, মাল্টিপাল সিজোফ্রেনিয়া নাকি কি সব রোগ।”
“ককলিন একজন নামকরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলেছে। ডাক্তার সাহেব নিশ্চিত এই রোগটির ব্যাপারে।”
“উনি এটা বলেছেন?” ডাইরেক্টর জানতে চাইলেন।
“হ্যা।”
“ককলিনের কথার উপর ভিত্তি করেই? মানে, ককলিন যা মনে করে তার উপর ভিত্তি ক’রে?”
“আর কিছু বলতে পারবো না। তাকে আমাদের হাতেই ছেড়ে দিন। সে আমাদের সমস্যা, আমরাই সেটা সমাধান করবো।”
“আপনি একটা বোকাচোদা, জেনারেল। আপনার উচিত আপনাদের ডাটা ব্যাঙ্কে একটু খোঁজ করা।”
“আমি সেটা করতে পছন্দ করি না।”
“পছন্দ করেন না। আমি যা মনে করছি সেটা যদি আপনি ক’রে থাকেন তবে আপনি আর কিছু করেন নি, কেবল অপছন্দ আর ঘৃণা ছাড়া।”
“বুঝিয়ে বলুন,” ক্রফোর্ড রুক্ষ্মভাবে বললো।
“আপনি কোনো অসুস্থ লোককে মোকাবেলা করেন নি, এরকম সিজোফ্রেনিয়া কিংবা মানসিক বৈকল্য সম্পন্ন কাউকে। আমার ধারণা আপনি আমার চেয়ে এসব বেশি জানেন না। আপনি এমন একজনকে মোকাবেলা করছেন যার কোনো স্মৃতি নেই। কয়েক মাস ধরে সে খুঁজে বেড়াচ্ছে সে কে, কোত্থেকে এসেছে। আর আমরা যা জানতে পেরেছি তাতে বোঝা যাচ্ছে সে আপনাকে ককলিনকে বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু ককলিন কিছুই শোনে নি। আপনারা কেউই শোনেন নি…আপনারা একজন লোককে তিন বছরের জন্যে ডিপ কভারে পাঠিয়েছিলেন- কার্লোসকে পাকড়াও করার জন্যে। আর যখনই পুরো কৌশলটা ভেস্তে গেলো আপনার সবচাইতে বাজে কাজটা করার চিন্তা করলেন।”
“স্মৃতিভ্রষ্ট?…না, আপনি ভুল করছেন! আমি ককলিনের সাথে কথা বলেছি; সে সব শুনেছে। আপনি বুঝতে পারছেন না। আমরা দু’জনেই জানতাম “
“আমি তার নামটা শুনতে চাই না!” কনসুলার অপারেশনের ডাইরেক্টর চিৎকার ক’রে বললো।
জেনারেল একটু চুপ মেরে রাইলো। “আমরা দু’জনেই জানতাম…বর্ন…কয়েক বছর আগে। আপনি তো জানেনই কোথায়; আপনি নামটা আমার কাছে বলেছিলেন। সে আমার দেখা সবচাইতে অদ্ভুত এক লোক। বলা চলে, একেবারে প্যারানয়েড একজন। সে এমন সব মিশন গ্রহণ করেছে যা কোনো সুস্থ মানুষ কখনও করবে না। তারপরও সে কিছু দাবি করে নি। তার ভেতরে শুধু ঘৃণা। ঘৃণা আর ঘৃণা।”
“আর এজন্যেই সে দশ বছর পরে এক সাইক্রিটুক ওয়ার্ডে একজন রোগী হয়ে গেলো?”
“সাত বছর,” ক্রফোর্ড শুধরে দিলো। “আমি তাকে ট্রেডস্টোনে নিয়োগ দিতে বাঁধা দেবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সন্ন্যাসী বলেছিলো সে সবচাইতে সেরা। আমি অবশ্য এ ব্যাপারে কোনো তর্ক করি নি। তবে আমি আমার আপত্তির কথাটা জানিয়ে দিয়েছিলাম। তার মানসিক ভারসাম্য একেবারে শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিলো। আমরা জানতাম সেটা কেন। অবশেষে আমার কথাই ঠিক হলো।”
“আপনার কোনো কথা ঠিক হয় নি, জেনারেল। আপনি আপনার লোহার পাছাটা নিয়ে পতিত হবেন। কারণ সন্ন্যাসির কথাই ঠিক। আপনাদের লোকটাই সেরা ছিলো। তার স্মৃতি থাকুক আর নাই থাকুক, সে কার্লোসকে টেনে নিয়ে এসেছে। একেবারে আপনাদের দরজার সামনে। বর্নকে যদি খুন না করেন, তবে তাই হবে।” ক্রফোর্ড একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। “আপনি ককলিনের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন না, পারবেন কি?” সে জানতে চাইলো।
“না।”
“তার পতন হয়েছে, হয়েছে না? নিজের সব ব্যবস্থা ক’রে ফেলেছে সে, তৃতীয় অথবা চতুর্থ পার্টির মাধ্যমে পেমেন্ট করেছে। যারা একে অন্যেকে চেনে না। সোর্সটা ট্রেস্ করা যাবে না। এজেন্সি আর ট্রেডস্টোনের সাথে সব রকম যোগাযোগের আলামত নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। আর এখন, অনেক লোকের হাতে কিছু ছবি চলে গেছে ককলিন যা জানে না, চিনবেও না। আমাকে ফায়রিং স্কোয়াডের কথা বলবেন না। আপনারটা জায়গা মতোই আছে, তবে আপনি সেটা দেখতে পারছেন না—আপনি জানেন না সেটা কোথায় আছে। তবে এটা প্ৰস্তত করা হচ্ছে—দোষী মানুষটাকে দেখামাত্রই আধ ডজন রাইফেল গুলি করার জন্যে প্রস্তত হয়ে আছে। আমি কি চিত্রটা প’ড়ে শোনাবো?”
“আমি এই প্রশ্নের জবাব দেবো সেটা আপনি আশা করতে পারেন না, “ ক্রফোর্ড বললো।
“আপনাকে সেটা করতে হবে না। আমি কনসুলার অপারেশন, আমি সেখানে ছিলাম। তবে আপনি একটি বিষয়ে ঠিক বলেছেন। এটা আপনাদের সমস্যা। আপনাদের কোর্টেই সেটা ফিরে আসবে। আপনাদের সাথে আমরা কোনো যোগাযোগ রাখবো না। আমি এটাই সেক্রেটারিকে অনুরোধ করেছি। আপনি কে সেটা স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানার ক্ষমতা রাখে না। এই ফোন কলটাকে আনলগ বলেই ভাববেন।”
“বুঝেছি।”
“আমি দুঃখিত,” ডাইরেক্টর বললো। জেনারেলের কণ্ঠে হতাশাটা টের পেলো। “যে কোনো সময় এটা বিষেস্ফারিত হবে।”
“হ্যা। আমরা মেডুসায় এটা শিখেছি। মেয়েটাকে নিয়ে কি করতে চান আপনারা?
“আমরা এমনকি এটাও জানি না আপনাকে নিয়েই বা কি করবো?”
“সেটা তো সহজ। আমরা চালিয়ে যাবো। আমরা জুরিখের বুকগুলো থেকে মেয়েটার রেকর্ড সরিয়ে দিতে পারবো।”
“আমরা মেয়েটাকে বলে দেবো। এতে হয়তো সাহায্য হবে। আমরা সবখানে ক্ষমা চাইবো। মেয়েটাকে নিয়ে আমারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বোঝাপড়া করতে পারবো।”
“আপনি নিশ্চিত?” ক্রফোর্ড বললো।
“বোঝাপড়া নিয়ে?”
“না। স্মৃতিভ্রষ্ট ব্যাপারটা নিয়ে। আপনি কি পজিটিভ?”
“আমি কমপক্ষে বিশবার টেপটা শুনেছি, তার কণ্ঠটা শুনেছি। আমি খুবই নিশ্চিত। ঘটনাচক্রে কয়েক ঘণ্টা আগে আরো একবার তার অবস্থান সম্পর্কে জানতে পেরেছি। সে পিয়েরে হোটেলে আমাদের কব্জায় আছে। আমরা কি করবো সেটা ঠিক করার পরই তাকে সকালে ওয়াশিংটনে নিয়ে আসবো।”
“দাঁড়ান!” জেনারেলের কণ্ঠটা চড়া হলো। “আগামীকালকে নয়! মেয়েটা এখানে…? তার সঙ্গে আমার দেখা করার ক্লিয়ারেন্স দিতে পারবেন?”
“নিজের কবর আর বেশি খুড়বেন না, জেনারেল। মেয়েটা যতো কম নাম জানবে ততোই সবার জন্যে মঙ্গল। বর্ন যখন অ্যাম্বাসিতে ফোন করেছিলো তখন সে তার সঙ্গেই ছিলো। সে ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং সম্ভবত ককলিনের ব্যাপারে জেনে গেছে। সে নিজেই নিজের পতন ঘটাক। আপনি এসব থেকে দূরে থাকুন।”
“এইমাত্র আমাকে বললেন দূরে সরে থাকতে।”
“এভাবে নয়। আপনি একজন ভদ্রলোক, আমার মতোই। আর আমর হলাম পেশাদার লোক।”
“আপনি বুঝতে পারছেন না! আমাদের কাছে ছবিগুলো আছে, হ্যা, তবে সেগুলো হয়তো কোনো কাজে লাগবে না। তিন বছরের পুরনো সেগুলো। বন বদলে গেছে, আমূল বদলে গেছে। এজন্যেই ককলিন দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়েছে—কোথায়, আমি জানি না—তবে সে ওখানে আছে। সে-ই একমাত্র ব্যক্তি যে তাকে দেখেছে। তবে সেটা রাতের বেলায়, বৃষ্টির মধ্যে। মেয়েটা হতে পারে আমাদের একমাত্র সুযোগ। সে বর্নের সাথে ছিলো — কয়েক সপ্তাহ ধরেই ছিলো। তাকে সে ভালো করেই চেনে। অন্য কারোর চেয়ে সে-ই তাকে দ্রুত চিনতে পারবে।”
“আমি বুঝতে পারছি না।”
“আমি খুলে বলছি। বর্নের অনেকগুলো গুনের মধ্যে নিজের বেশভূষা আমূল পাল্টে ফেলার সক্ষমতা রয়েছে। রয়েছে জনতার ভীড়ে নিজেকে মিশিয়ে ফেলার দক্ষতা। আপনার আশেপাশে থাকবে অথচ আপনি তাকে দেখতে পাবেন না। তাকে মেডুসায় একটা নামে ডাকা হোতো…বহুরূপী।”
“সেটা তো কেইন, জেনারেল।”
“আমাদের ডেল্টা। তার মতো কেউ নেই। আর এজন্যেই মেয়েটা সাহায্য করতে পারবে। এখন। আমাকে তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দিন। তার সঙ্গে কথা বলতে দিন।”
“আপনাকে সেই সুযোগ দিয়ে আমরা আপনাকে স্বীকার ক’রে নেবো। আমার মনে হয় না সেটা আমরা করতে পারি।”
“ঈশ্বরের দোহাই, আপনি এইমাত্র বললেন আমরা দু’জন ভদ্রলোক! আমরা তার জীবনটা বাঁচাতে পারি! মেয়েটা যদি আমার সাথে থাকে আর তাকে যদি আমরা খুঁজে পাই তবে আমরা তাকে সেখান থেকে বের ক’রে আনতে পারবো!”
“সেখান থেকে? আপনি কি আমাকে বলছেন ঠিক কোথায় সে যেতে পারে?”
“হ্যা।”
“কিভাবে?”
“কারণ সে এছাড়া আর কোথাও যাবে না।”
“আপনি জানেন সে কখন ওখানে যাবে?”
“হ্যা। আজ হলো তার নিজের মৃত্যুদণ্ডের তারিখ।”