অধ্যায় ৩২
“তারা কেন এটা করছে?” জেসন জানতে চাইলো। জনাকীর্ণ এক ক্যাফেতে মেরির পাশে ব’সে আছে সে। পাঁচ ঘণ্টা আগে অ্যাম্বাসিতে প্রথম ফোন করার পর পঞ্চমবারের মতো ফোন করেছে। “তারা আমাকে দৌড়ের উপর রাখতে চায়। তারা আমাকে বাধ্য করছে দৌড়ের উপর রাখতে। আমি জানি না কেন?”
“তুমি নিজেই নিজেকে বাধ্য করছো,” মেরি বললো। “তুমি ফোনটা হোটেল রুম থেকেই করতে পারতে।”
“না, আমি পারতাম না। কোনো একটা কারণে তারা চায় আমি সেটা জানি। যখনই আমি ফোন করি বানচোতটা আমাকের জিজ্ঞেস করে আমি কোথায় আছি এখন, আমি কি “নিরাপদ জায়গায়’ আছি? হাস্যকর শব্দ, ‘নিরাপদ জায়গা।’ কিন্তু সে অন্য কিছু বলছিলো। সে আমাকে বলছিলো, আমি যেনো প্রতিটি ফোন ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে করি যাতে ক’রে ভেতরে কিংবা বাইরের কেউ আমাকে ট্রেস করতে না পারে। তরা আমাকে কাস্টডিতে দেখতে চায় না। তারা আমাকে চায়, তবে তারা আমাকে ভয়ও পাচ্ছে। এটা আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না!”
“এটা কি সম্ভব যে, তুমি এইসব কল্পনা করছো? কেউ আসলে এরকম কিছু বলে নি।”
“না, তা নয়। তারা কেঁন আমাকে অ্যাম্বাসিতে যেতে বলছে না? মানে অর্ডার করছে না। সেখানে আমাকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। সেটা তো আমেরিকার নিজস্ব এলাকা। কিন্তু তারা সেটা বলে নি।”
“পথেঘাটে নজরদারী করা হচ্ছে, এটা তো তোমাকে বলা হয়েছে।
“আমি সেটা মেনে নিয়েছিলাম —অন্ধের মতো—কিন্তু ত্রিশ সেকেন্ড আগে সেটা মনে পড়ার আগপর্যন্ত। কারা? কারা পথেঘাটে নজরদারী করছে?”
“অবশ্যই কার্লোস। তার লোকেরা।”
“সেটা তুমি জানো, আমি জানি—আমরা সেটা অনুমান করতে পারি—কিন্তু তারা তো সেটা জানে না। আমি হয়তো জানি না আমি কে, কোত্থেকে এসেছি, কিন্তু বিগত চব্বিশ ঘণ্ট ধরে আমি জানি আমার মধ্যে কি হচ্ছে। তারা তো সেটা জানে না।”
“তারাও তো অনুমান করতে পারে, পারে না? তারা হয়তো গাড়িতে ক’রে অথবা আশেপাশে ঘুরঘুর করছে এরকম কিছু অজানা-অচেনা লোককে চিহ্নিত করেছে।”
“কার্লোস এসব ব্যাপারে অনেক প্রতিভাবান। একটি নির্দিষ্ট গাড়ি দ্রুত অ্যাম্বাসিতে ঢোকার অনেক পথ রয়েছে। মেরিন কনটিনজেন্টদের এরকম ট্রেনিং দেয়া থাকে।”
“আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি।”
“কিন্তু তারা সেটা করছে না; এমনকি এরকম কিছু করার কথাও বলে নি। তার বদলে তারা আমার সাথে খেলছে, আমাকে ঘোরাচ্ছে। কিন্তু কেন?”
“এটা তুমি নিজেই বলেছো, জেসন। ছয় মাস ধরে তারা তোমার কোনো খোঁজ পায় নি। তারা সেজন্যে খুব সতর্ক হয়ে কাজ করছে।”
“এভাবে কেন? তারা আমাকে অ্যাম্বাসির ভেতরে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। তারা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তারা আমাকে কারো কাছে দিয়ে দিতে পারে, একটা সেলে ভরে রাখতে পারে। কিন্তু তারা সেটা না ক’রে আমাকে স্পর্শ করতে চাচ্ছে না। আবার আমাকে হাতছাড়া করতেও চাচ্ছে না।”
“তারা ওয়াশিংটন থেকে একজন লোকের আসার জন্যে অপেক্ষা করছে।”
“অ্যাম্বাসির ভেতরের চেয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করার আর কি কোনো ভালো জায়গা আছে?” বর্ন চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। “কিছু একটা সমস্যা আছে। চলো এখান থেকে বের হয়ে যাই।”
.
আটলান্টিক মহাসাগর পেরোতে ট্রেডস্টোনের উত্তরাধিকারী আলেকজান্ডার ককলিনের ঠিক চার ঘণ্টা বারো মিনিট সময় লাগলো। ফিরে যাবার জন্যে সে প্যারিস থেকে কনকর্ডে ক’রে ওয়াশিংটনের ডালেস বিমানবন্দরে পৌঁছাতে পারবে সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে, আর সেখান থেকে ল্যাঙ্গলে’তে পৌঁছে যাবে ৯টা বাজে। এই সময়ের মধ্যে কেউ যদি তাকে ফোন ক’রে খোঁজ করে তবে পেন্টাগনের একজন মেজর ককলিন পরিচয় দিয়ে জবাব দেবে। আর প্যারিস অ্যাম্বাসির ফার্স্ট সেক্রেটারিকে বলা হবে সে যদি ল্যাঙ্গলের লোকটার সাথে ফোনে কথাটা বলাটা কাকাপক্ষীকেও জানায় তবে তাকে ডিমোশন দিয়ে তিয়েরা দেল ফুয়েগো’তে পোস্টিং দিয়ে দেয়া হবে। এটার একদম নিশ্চিত।
ককলিন সারসরি একসারি পে-ফোনের দিকে গিয়ে অ্যাম্বাসিতে একটা ফোন করলো।
“সবই শিডিউল মোতাবেক করা হয়েছে, ককলিন,” অ্যাম্বাসির লোকটা বললো। “বর্ন খুব উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। আমাদের মধ্যে শেষবার যখন কথা হচ্ছিলো সে বার বার বলছিলো তাকে কেন অ্যাম্বাসির ভেতরে আসতে বলা হচ্ছে না।”
“তাই নাকি?” প্রথমে ককলিন খুব অবাক হলেও পরে বুঝতে পারলো। ডেল্টা এমন ভান করছে যেনো সে সেভেনটি ওয়ান স্ট্রটের ব্যাপারে কিছুই জানে না। তাকে যদি অ্যাম্বাসিতে আসতে বলা হোতো তবে সে পালিয়ে যেতো। সে এটা ভালো করেই জানে। এখানে অফিশিয়াল কোনো কানেকশান থাকতে পারে না। ট্রেডস্টোন একটি অবমাননাকর আর ঘৃণ্য কৌশল, বড়সড় একটি বিব্রতকর ব্যাপার। “তুমি কি তাকে বলেছো, পথঘাটে নজরদারি করা হচ্ছে?”
“অবশ্যই। তখন সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো তারা কারা। আপনি ভাবতে পারেন?”
“পারি। তুমি কি বললে?”
“বললাম, আমি যতোটুকু জানি সেও ততোটুকু জানে। আর সবদিক বিবেচনা ক’রে মনে হচ্ছে এসব নিয়ে ফোনে কথা বলাটা ঠিক হবে না।”
“বেশ ভালো।”
“আমিও তাই মনে করি।”
“তখন সে কি বললো? সে কি এটা মেনে নিয়েছে?”
“হ্যা, অদ্ভুতভাবে। সে বলেছে, ‘আচ্ছা’। এই।”
“সে কি তার মত বদলেছে, প্রটেকশানের জন্যে অনুরোধ করেছে?”
“সে এটা অস্বীকার ক’রে আসছে। এমনকি আমি চাপাচাপি করার পরও।” ফার্স্ট সেক্রেটারি একটু থামলো।
“সে চায় না তাকে নজরদারি করা হোক, তাই না?” আস্তে ক’রে বললো সে। “না, সে চায় না। তার পরের ফোনটা কখন আশা করছো?”
“পনেরো মিনিটের মধ্যে।”
“তাকে বোলো ট্রেডস্টোনের অফিসার এসে পৌঁছেছেন।” ককলিন পকেট থেকে ম্যাপটা বের করলো। রুটটা নীল রঙ দিয়ে চিহ্নিত করা আছে। “তাকে বলবে সাক্ষাৎটা হবে দেড়টা বাজে, ভার্সেই থেকে সাত মাইল দক্ষিণে শেভরুইয়ে এবং র্যামবোয়াঁ সড়কের মাঝামাঝি সিমেতিয়ে দ্য নেবলে’তে।”
“দেড়টা বাজে…গোরস্থানে। সে কি জানে ওখানে কিভাবে যেতে হবে?”
“ওখানে সে এর আগেও গিয়েছে। সে যদি বলে সে একটা ট্যাক্সিতে ক’রে যাবে, তবে তাকে বলবে স্বাভাবিক সতর্কতাগুলো যেনো অবলম্বন করে। ট্যাক্সিটা যেনো ছেড়ে দেয়।”
“সেটা কি অদ্ভুত দেখাবে না? মানে, ড্রাইভারের কাছে। শোক করার জন্যে সময়টা তো অদ্ভুত।”
“আমি তোমাকে বলছি সেটা ‘তাকে বলবে’। অবশ্যই সে একটা ট্যাক্সি নেবে।”
“তাতো ঠিকই,” ফার্স্ট সেক্রেটারি বললো সঙ্গে সঙ্গে। “যেহেতু আমি আপনার এখানকার লোককে ফোন করি নি, আমি কি তাকে ফোন ক’রে জানিয়ে দেবো আপনি এসে পৌঁছেছেন?”
“সেটা আমি দেখবো। তোমার কাছে কি তার নাম্বারটা আছে?”
“হ্যা, অবশ্যই।”
“পুড়িয়ে ফেলো সেটা,” ককলিন আদেশের সুরে বললো। “ওটা তোমাকে পুড়িয়ে ফেলার আগেই। আমি তোমাকে বিশ মিনিট পরে ফোন করছি।”
.
একটা মেট্রো ট্রেন নিচের লেভেল দিয়ে ছুটে চললে কম্পনটা পুরো প্লাটফর্মে টের পাওয়া যাচ্ছে। বর্ন পে-ফোনের ফোনটা রেখে সেটার দিকে চেয়ে রইলো। তার মনের গভীরে, বহু দূরে আরেকটা দরজা খুলে গেছে। দেখা যাচ্ছে কিছু ইমেজ। র্যামবোয়ার পথে…একটা লোহার খিলানযুক্ত দরজা…নিরিবিল এক গোরস্থান কিন্তু জায়গাটা গোরস্থানের চেয়েও বেশি কিছু। এমন একটি জায়গা যেখানে মৃতদের মাঝে, নিরব নিথর কবরের পাশেই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আর সব লোকজনের মতোই দু’জন মানুষ শোকের পোশাক পরে এসেছে। শোকসন্তপ্ত লোকজনের ভীড় ঠেলে তারা মুখোমুখি হয়ে নিজেদের মধ্যে যে কথা বলার দরকার ছিলো সেটা বললো। একটা মুখ, কিন্তু ঝাঁপসা, ফোকাসের বাইরে। সে কেবল চোখ দুটো দেখতে পেলো। সেই চোখ দুটো আর আর ঝাঁপসা মুখের লোকটার একটা নাম আছে। ডেভিড…অ্যাবোট। সন্ন্যাসী। যে লোকটাকে সে জানে কিন্তু চেনে না। মেডুসা আর কেইনের সৃষ্টিকর্তা।
জেসন বার কয়েক মাথা ঝাঁকিয়ে চোখ দুটো পিট পিট ক’রে তাকালো যেনো চারপাশে আচমকা কোনো কুয়াশা সরিয়ে দিচ্ছে। সে তার থেকে পনেরো ফিট দূরে একটা দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেরির দিকে তাকালো, চারপাশে কেউ জেসনকে নজরদারী করছে কিনা সেটা দেখার কথা তার। কিন্তু না, সে দেখছে না। সে দেখছে জেসনকে। তার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। বর্ন তার দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত করার ভঙ্গীতে মাথা নাড়লো। সময়টা তার জন্যে খুব একটা খারাপ নয়। বরং তার মাথায় কতোগুলো ইমেজ আসছে। এই গোরস্থানে সে আগেও এসেছিলো ব’লে তার মনে হচ্ছে। সে মেরিরর কাছে গেলো। সামনে আসতেই সে ঘুরে জেসনের পাশাপাশি হাটতে হাটতে বের হবার পথের দিকে পা বাড়ালো।
“সে এখানে এসেছে,” বললো বর্ন। “ট্রেডস্টোন এসে গেছে। আমি তার সঙ্গে র্যামবোয়ায় দেখা করবো। গোরস্থানে।”
।“এটা তো ভয়ঙ্কর ব’লে মনে হচ্ছে। গোরস্থানে কেন?”
“আমাকে আশ্বস্ত করার জন্যে মনে হয়।”
“বলে কি, কিভাবে?”
“এখানে আমি এর আগেও এসেছি। লোকজনের সাথে দেখা করেছি…এই জায়গায় দেখা করতে বলার মধ্য দিয়ে ট্রেডস্টোন আমাকে বোঝাতে চেয়েছে সে আসল।”
মেরি তার হাতটা ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো। “আমি তোমার সাথে যেতে চাই।”
“দুঃখিত।”
“তুমি আমাকে বাদ দিতে পারো না!”
“কিন্তু সেটাই আমাকে করতে হবে। কারণ আমি জানি না ওখানে গিয়ে আমি কি খুঁজে পাবো। আর সেটা যদি আমার প্রত্যাশা অনুযায়ী না হয় তবে আমি চাইবো কেউ আমার পাশে থাকুক।”
“ডার্লিং, আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না! পুলিশ আমাকেও খুঁজছে। তারা যদি আমাকে খুঁজে পায় তবে পরের প্লেনেই আমাকে জুরিখে পাঠিয়ে দেবে। তুমিই এ কথা বলেছো। আমি জুরিখে গেলে তোমার কি লাভ হবে?”
“তুমি না। ভিলিয়ার্স। সে আমাদেরকে বিশ্বাস করে। আমি যদি সকালের মধ্যে ফিরে না আসি অথবা তোমাকে ফোন না করি তবে তুমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। সে অনেক হাউকাউ করতে পারবে। সে-ই আমাদের একমাত্র ব্যকআপ। আরো নির্দিষ্ট ক’রে বলতে গেলে তার বউকে তার মাধ্যমেই ধরা যাবে।”
মেরি মাথা নেড়ে সায় দিলো, যুক্তিটা মেনে নিলো সে। “তুমি র্যামবোয়া’তে যাবে কিভাবে?”
“আমাদের একটা গাড়ি আছে, মনে নেই? আমি তোমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে গ্যারাজের দিকে যাবো।”
.
সে মঁতমার্ত্রের গ্যারাজ কমপ্লেক্সের লিফটে ঢুকলো। তার মন প’ড়ে রইলো গোরস্থানে। একটার মধ্যে সে ওখানে পৌঁছে যাবে। আধঘণ্টা হেটে যাবে আর একজোড়া হেডলাইট অথবা কোনো সিগনালের জন্যে অপেক্ষা করবে। তাহলে অন্য অনেক কিছু তার মনে আসবে।
লিফটের দরজাটা খুলে গেলো। ফ্লোরটার তিন চতুর্থাংশ গাড়িতে পূর্ণ, বাকিটা ফাঁকা। জেসন তার রেনল্টটা কোথায় পার্ক করেছে মনে করার চেষ্টা করলো। মনে পড়লো, শেষ মাথায় এককোণে রেখেছিলো। কিন্তু ডান না বাম, কোন্ দিকে? সে দ্বিধাগ্রস্তভাবেই বাম দিকে এগোলো। কয়েকদিন আগে যখন গাড়িটা রেখেছিলো তখন লিফটের বাম দিকেই রেখেছিলো। সে থেমে গেলো। তার মধ্যে যুক্তি ফিরে এসেছে। ঢোকার সময় লিফটটা তার বাম দিকে ছিলো, বের হবার সময় নয়। তাহলে ডান দিকেই যেতে হবে। সে ঘুরে গেলো।
হয় খুব আচমকা দিক পরিবর্তন অথবা অনভিজ্ঞ নজরদারির জন্যে বর্নের জীবনটা বেঁচে গেলো। তার ডান দিক থেকে একটা গাড়ির ভেতর থেকে এক লোক উঁকি দিলো। এই লোকটা তাকে নজরদারী করছিলো। জেসন নতুন এই পরিস্থিতিটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে আরো দ্রুত হাটতে শুরু করলো। এই লোকটা কে? সে তাকে কিভাবে খুঁজে পেলো? তারপরই জবাটা পরিস্কার হলো তার কাছে। নিজেকে তার খুব বোকা ব’লে মনে হলো। অবার্জ দু কোয়েঁ’র ক্লার্ক ভদ্রলোকটি।
কার্লোস খুবই মেথডিক্যাল—যেমনটি সে সব সময় থাকে—ব্যর্থতার প্রতিটি খুঁটিনাটি সে পরীক্ষা ক’রে দেখে। আর সেই ব্যর্থতার সময় একজন ছিলো, সেই ক্লার্কটি। এরকম একজন লোকের কাছ থেকে তথ্য আদায় করা তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়। একটা ছুরি অথবা অস্ত্র দেখালেই যথেষ্ট।
এখন কথা হলো কতোক্ষণ ধরে তারা এই জায়গাটা নজরদারি করছে? কতোজন লোক নিয়োজিত আছে এ কাজে? ভেতরে এবং বাইরে? বাকিরা কতোক্ষণের মধ্যে এসে পড়বে? কার্লোসও কি আসবে?
এসব প্রশ্ন করাটা এখন গৌণ ব্যাপার। তাকে এক্ষুণি সরে যেতে হবে। গাড়ি ছাড়াও সে সরতে পারবে হয়তো, কিন্তু তাতে ক’রে সমস্যাও হবে। হয়তো অপ্রত্যাশিত কোনো প্রয়োজনে গাড়িটা তার ভীষণ দরকার হয়ে যেতে পারে। তার গাড়ির দরকার রয়েছে, আর সেটা এক্ষুণি। রাত একটা বাজে কোনো ট্যাক্সি তাকে নিরিবিলি গোরস্থানে নিয়ে যেতে রাজি হবে না। রাস্তা থেকে একটা গাড়ি চুরি করার মতো সময়ও তার নেই।
সে থেমে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের ক’রে দেয়াশলাই দিয়ে জ্বালাতে লাগলো। জ্বালানোর সময় ঘাড়টা একটু কাত ক’রে চোখের কোণ দিয়ে একটা ছায়া দেখতে পেলো—ছোটোখাটো, গাট্টাগোট্টা ধরণের এক লোক। সে এখন কাছের একটা গাড়ির পেছনে আছে, লোকটা তার মাথাটা একটু সরিয়ে রাখলো যেনো সে অন্য কিছু খুঁজছে।
জেসন চোখের পলকে নিচু হয়ে বাম দিকে দুটো গাড়ির মাঝখানে নিঃশব্দে ঢুকে পড়লো। হামাগুঁড়ি দিয়ে সে গাড়ি দুটোর মাঝখানে, আরো ভেতরে চলে গেলো এমনভাবে যেনো কোনো মাকড়শা তার জালে চলাফেরা করছে। এখন সে লোকটার ঠিক পেছনে চলে এসেছে। সে একটা গাড়ির হেডলাইটের নিচ দিয়ে উঁকি মারলো। লোকটা সোজা দাঁড়িয়ে আছে। খুব অবাক হয়েছে বোঝা গেলো। আস্তে আস্তে সে তার রেনল্ট গাড়িটার কাছে চলে এলো। উইন্ডশিল্ডের পেছন থেকে আবারো লোকটার দিকে তাকালো। কিন্তু সে যা দেখতে পেলো সেটা তাকে আরো ভড়কে দিলো। কেউ নেই সেখানে। তার সঙ্গে চালাকি করা হয়েছে। সে বুঝতে পারলো, কিন্তু পরিণতির জন্যে অপেক্ষা করলো না। লোকটা রেনন্টের ড্রাইভারকে কিছু বললো, বিপদটা ব্যাখ্যা ক’রে এক্সিট র্যাম্প দিয়ে বের হয়ে যেতে লাগলো।
এখন। জেসন উঠে দৌড়াতে লাগলো। লোকটার পিছু নিলো। তাকে ধরতে হবে। পেছন থেকে লোকটার ঘাড়ে প্রচণ্ড জোরে ঘুষি চালালে সে মেঝেতে পড়ে গেলো। জেসন তার বাম হাতের আঙুল দিয়ে লোকটার দু’চোখ চেপে ধরলো।
“তুমি ঠিক পাঁচ সেকেন্ড সময় পাবে বলার জন্যে। বাইরে কে আছে।” সে কথাটা ফরাসিতে বললো। “বলো! এক্ষুণি!”
“একজন লোক, একজনই!”
জেসন চোখে চাপ দিলো আঙুল দিয়ে। “কোথায়?”
“একটা গাড়িতে। রাস্তার ওপারে পার্ক করা আছে। হায় ঈশ্বর, তুমি দেখছি আমার চোখ গেলে দেবে!”
“এখনও তা করছি না। তবে কথা না শুনলে তাই করবো। গাড়িটা কোন্ ধরণের?”
“বিদেশী। আমি চিনি না। মনে হয় ইতালিয়ান। অথবা আমেরিকান। আমি জানি না। প্লিজ! আমার চোখ!”
“রঙটা কি?”
“কালো! সবুজ, নীল, খুবই গাঢ়। ওহ্ ঈশ্বর!”
“তুমি কার্লোসের লোক, তাই না?”
“কে?”
জেসন আবারো জোরে চাপ দিলো। “তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো না—তোমাকে কার্লোস পাঠিয়েছে!”
“আরে আমি কোনো কার্লোসকে চিনি না। আমরা একটা লোককে ফোন করি, এই যে তার নাম্বার। এছাড়া আর কিছু আমরা জানি না।”
“তাকে কি ফোন করা হয়েছে?” লোকটা কোনা জবাব দিলো না। বর্ন আবারো জোরে তার চোখে চাপ দিলো। “বলো আমাকে!”
“হ্যা। আমাকে করতে হয়েছে।”
“কখন?”
“কয়েক মিনিট আগে। দ্বিতীয় র্যাম্পের কয়েন ফোন থেকে। হায় ঈশ্বর! আমি তো কিছুই দেখতে পারছি না।”
“ওঠো!” জেসন লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে দাঁড় করালো। “গাড়িটার দিকে যাও। জলদি!” বর্ন তাকে পেছন থেকে ঠেলতে ঠেলতে রেনল্টের দিকে নিয়ে গেলো। লোকটা ঘুরে কিছু বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু বর্ন শুনলো না। “আমার কথা বোঝো নি। জলদি!” চিৎকার ক’রে বললো সে।
“আমি কেবল কয়েক ফ্রাঁ কামানোর জন্যে এটা করছিলাম।”
“এখন তুমি তাদের জন্যে গাড়ি চালাবে।” বর্ন তাকে আবারো রেনল্টের দিকে ধাক্কা মারলো।
কয়েক মিনিট পরে ছোট্ট কালো গাড়িটা এক্সিট র্যাম্প দিয়ে কাঁচের বুথের সামনে এসে পড়লো। একজন রেজিস্টারই আছে সেখানে। জেসন পেছনের সিটে ব’সে আছে, তার হাতের অস্ত্রটা সামনের ড্রাইভারের আসনে বসা লোকটার ঘাড়ে তাক্ করা। বর্ন জানালা দিয়ে টিকেটটা বের ক’রে দিলে রেজিস্টার সেটা নিয়ে নিলো।
“চালাও!” বর্ন বললো। “আমি যা বলবো ঠিক তাই করবে!”
লোকটা এক্সেলেটরে চাপ দিলে গাড়িটা ছুটে চললো। পথে নেমেই লোকটা আচমকা ইউ-টার্ন নিলে টায়ারের কর্কশ শব্দ হলো। তাদের সামনে একটা গভীরর সবুজ রঙের শেভ্রলে গাড়ি পড়াতে তাদের গাড়িটা থেমে গেলো। তাদের পেছনে অন্য একটা গাড়ির পেছনের দরজা খুলে গেলে পায়ের শব্দ শোনা গেলো।
“জুলস্? কুয়ে সে পাসে তিল? সেস্ত তোয়ে কূয়ে কয়া?” খোলা জানালা দিয়ে এক লোক উঁকি মারলো।
বর্ন সঙ্গে সঙ্গে লোকটার মুখ বরাবর পিস্তলটা তুলে ধরলো। “দু’পা পিছিয়ে যাও,” ফরাসিতে বললো সে। “বেশি নয়, কেবল দু’পা। এবার সোজা দাঁড়িয়ে থাকো।” সে জুলস্ নামের লোকটার মাথায় টোকা মারলো।
“বের হও, আস্তে আস্তে।”
“আমরা কেবল তোমাকে অনুসরণ করছিলাম,” গাড়ি থেকে নামতে নামতে জুলস্ বললো। “আর তোমার অবস্থানের ব্যাপারে রিপোর্ট করছিলাম।”
“তুমি তারচেয়েও ভালো কিছু করবে এখন,” বর্ন বললো, প্যারিসের ম্যাপটা নিয়ে রেনল্ট থেকে বের হয়ে গেলো সে। “তুমি আমাকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাবে, তোমরা দু’জনেই!”
প্যারিস থেকে পাঁচ মাইল দূরে, শেক্রজে রাস্তার উপর দু’জন লোককে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়া হলো। বেশ অন্ধকার, আলো নেই বললেই চলে। তৃতীয় শ্রেণীর হাইওয়ে। কোনো দোকানপাট, ভবন আর বাড়িঘর নেই। পেছনের তিন মাইলের মধ্যে কোনো ফোনবুথও দেখা যাচ্ছে না।
“কোন্ নাম্বারে তোমাকে ফোন করতে বলা হয়?” জেসন জানতে চাইলো। “মিথ্যে বলো না। তোমার খুবই মারাত্মক সমস্যা হবে।”
জুলস্ তাকে নাম্বারটা দিয়ে দিলো। বর্ন মাথা নেড়ে সায় দিয়ে শেভ্রলের ড্রাইভিং সিটে ব’সে পড়লো।
.
জীর্ণ ওভার কোট পরা বৃদ্ধলোকটি ফাঁকা বুথে টেলিফোনটার পাশে ব’সে আছে। ছোট্ট রেস্তোরাঁটা বন্ধ হয়ে গেছে। এখানে সে আছে কারণ তার পুরনো দিনের এক বন্ধু এটির মালিক। ফোনটার দিকে তাকিয়ে সে ভাবছে কখন এটা বাজবে। খালি সময়ের ব্যাপার। আর যখন এটা বাজবে তখন সে আরেকটা ফোন করবে, সেই ফোন কলটার জন্যে তার সুদিন আবার ফিরে আসবে। স্থায়ী হবে সেটা। সে হবে প্যারিসে কার্লোসের একমাত্র লোক। এই কথাটা ফিফাস্ শোনা যাবে, সবাই তাকে আবার সম্মান করবে।
সশব্দে ফোনটার রিং বেজে উঠলে বৃদ্ধ খুশিতে অনেকটা নেচে উঠলো। এটা হলো একটা সিগনাল। কেইনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়া হয়েছে! ফোনটা সে তুলে নিলো।
“হ্যা?”
“জুলস্ বলছি!” দমবন্ধ হওয়া কণ্ঠটা চিৎকার ক’রে বললো।
বৃদ্ধলোকটার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। তার হৃদস্পন্দন এতোটাই বেড়ে গেলো যে, ভয়ঙ্কর কথাগুলো ঠিকমতো শুনতেই পেলো না। তবে কথাটা সে বুঝেছে।
সে একজন মৃত মানুষ।
চারদিকে সাদা আলোর ঝলকানি দেখতে পেলো সে। কোনো বাতাস নেই। ভো ভো শব্দ হতে লাগলো দু’কানে। ভিক্ষুক মেঝেতে যেনো ডুবে গেলো। ফোনটা সে এখনও ধরে আছে। ফোনের দিকে হা ক’রে চেয়ে রইলো সে। এখন সে কি করতে পারবে? সে এখন কি করবে?
.
বর্ন হাটছে। নিজের মনকে মুক্তভাবে ছেড়ে দিয়েছে সে। পোর্ত নোয়ের ডাক্তার ওয়াশবার্ন এরকমটিই করতে বলেছিলো তাকে। ট্রেডস্টোনের লোকটি বেশ ভালোমতোই সেটা টের পাবে। সে কোনো চুক্তি ভঙ্গ করে নি। বিশ্বাসঘাতকতাও করে নি, অথবা পালিয়ে যায় নি…অসমর্থ ছিলো সে; এটা এরকমই সহজ আর সরল।
তাকে ট্রেডস্টোনের লোকটাকে খুঁজে বের করতে হবে। সে তার কাছ থেকে কি আশা করছে? জেসন একটা বাজার বেশ আগেই গোরস্থানে পৌঁছে গেলো। রেনল্টের চেয়ে শেভ্রলে গাড়িটা অনেক বেশি দ্রুত গতির ছিলো। প্রধান দরজাটা পেরিয়ে সে আরো একশো গজ ভেতরে ঢুকে পড়লো। তারপর রাস্তার একপাশে গাড়িটা নামিয়ে রেখে দিলো যাতে কারোর নজরে না পড়ে। দরজার কাছে ফিরে যাবার সময় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। খুবই ঠাণ্ড বৃষ্টি। এটাকেই বলে মার্চের বৃষ্টি। শান্ত বৃষ্টি নিরবতায় খুব একটা বিঘ্ন ঘটালো না।
অনেকগুলো কবর আর চারপাশে লোহার নিচু রেলিং দিয়ে ঘেরা একটা জায়গা। মাঝখানে একটা আট ফিট উঁচু সৌধ আছে। সেটার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সে। এখানে কি সে এর আগে এসেছিলো? তার মনের আরেকটা দরজা কি খুলে গেলো? নাকি সে নিজেই মরিয়া হয়ে এরকম কিছু খুঁজছে? এরপরই সেটা তার মনে পড়লো। এটা কবরগুলো, রেলিংটা কিংবা সৌধটার জন্যে নয়। বরং বৃষ্টিটা। হঠাৎ ক’রে নামা বৃষ্টি। কালো পোশাক পরা একদল শোকগ্রস্ত মানুষ একটা কবরকে কেন্দ্র ক’রে জড়ো হয়েছে। অনেকগুলো ছাতা তোলা হয়েছে। মৃদু গুঞ্জন হচ্ছে। পকেট থেকে পকেটে, হাতে হাতে একটা লম্বা বাদামী খাম বদল হলো শোকগ্রস্ত লোকগুলোর অগোচরেই।
আরো কিছু আছে। একটা ছবি আরেকটা ছবিকে উস্কে দিচ্ছে। হালকা বৃষ্টি পড়ছে।
পাহাড়ের অন্য দিকে। গেটের কাছাকাছি একটা শ্বেতশুভ্র সমাধি। কেউ হয়তো এটাকে পার্থেনন-এর ক্ষুদ্র সংস্করণ ব’লে ভাবতে পারে। মাত্র পাঁচ মিনিট আগে সে এটা অতিক্রম ক’রে এসেছে। চোখে পড়েছে, কিন্তু ভালো ক’রে দেখে নি। ঐখানেই আচমকা বৃষ্টিটা নেমেছিলো। যেখানে দুটো ছাতার নিচে একটা খাম বদল করা হয়েছিলো। সে তার হাত ঘড়িটার দিকে তাকালো। একটা বেজে চৌদ্দ মিনিট বেজে গেছে। সে পথের দিকে ফিরে গেলো। এখনও সময় আছে। একটা গাড়ির হেডলাইট দেখার জন্যে আরো কিছু সময় রয়ে গেছে…একটা দেয়াশলাই জ্বালানো, অথবা…
একটা টর্চের আলো দেখা গেলো। পাহাড়ের নিচে। আর সেটা উপরে নিচে দুলছে। আবার পরক্ষণেই আলোর রশ্মিটা গেটের উপর এসে পড়ছে। যেনো টর্চ ধরা লোকটা জানে কেউ এসেছে। বর্ন প্রায় দৌড়ে গিয়ে চিৎকার ক’রে বলতে চাচ্ছিলো; আমি এখানে! এই যে আমি। আমি আপনার মেসেজটার অর্থ বুঝেছি। আমি ফিরে এসেছি! অনেক কথা বলার আছে আমার…আর আপনারও আমাকে অনেক কিছু বলার রয়েছে!
কিন্তু সে দৌড়ালোও না, চিৎকারও করলো না। বরং বেশ নিয়ন্ত্রণে রাখলো নিজেকে। তাকে খুব স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে। হালকা বৃষ্টির মধ্যেই সে পাহাড়ের দিকে হেটে গেলো।
টর্চের আলোটা। পাঁচশো ফিট নিচে টর্চের আলোটাতে একটু অদ্ভুত ব্যাপার আছে। সেটা একটু উপরে নিচে দুলছে যেনো টর্চটা ধরে রাখা লোকটা আরেকজনকে কিছু বোঝাচ্ছে।
তাকে। জেসন নিচু হয়ে গেলো। বৃষ্টির মধ্যেই দেখানোর চেষ্টা করলো। সে মাটিতে হামাগুঁড়ি দিয়ে এগোলো। তার চোখ টর্চের আলোটার দিকে। এখন সে আরো পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে। সে থেমে গিয়ে মনোসংযোগ করলো। দু’জন লোক আছে। একজন টর্চটা ধরে রেখেছে, অন্যজন ছোটো ব্যারেলের একটা রাইফেল ধরে আছে। বর্নের কাছে অস্ত্রটা খুব বেশি চেনা চেনা লাগছে। ত্রিশ ফিট দূর থেকে এটা দিয়ে গুলি করলে কোনো মানুষকে ছয় ফিট শূন্যে তুলে ফেলতে পারবে। ওয়াশিংটন থেকে পাঠানো একজন অফিসার অব রেকর্ডের জন্যে এরকম একটি অস্ত্র বহন করা খুবই অদ্ভুত ব্যাপার।
টর্চের আলোটা শ্বেতশুভ্র সমাধির উপরে গিয়ে পড়লে রাইফেল হাতের লোকটা দ্রুত পিছু হটে গেলো, টর্চ হাতে থাকা লোকটার থেকে বিশ ফিট দূরে একটা কলামের পেছনে চলে গেলো সে।
জেসনকে ভাবতে হলো না। সে জানে কি করতে হবে। এখানে কোনো অস্ত্ৰ নিয়ে আসার অনেক ব্যাখ্যা দেয়া হতে পারে, কিন্তু সে জানে জিনিসটা তার উপরেই প্রয়োগ করা হবে। হাটুর উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দূরত্বটা মেপে নিয়ে এবার এগোতে লাগলো সে। নিজের কোমরে থাকা অস্ত্রটা টের পেলো, সে মনে করেছিলো এটা তাকে ব্যবহার করতে হবে না।
সে সমাধি থেকে সমাধিতে নিচু হয়ে ছুটে গেলো। পাথর আর মূর্তির আড়ালে আড়ালে এগোতে লাগলো। আস্তে আস্তে ডান দিকে সরতে লাগলো একটি অর্ধবৃত্তাকার পথে। শ্বেত সমাধি থেকে তার দূরত্ব এখন মাত্র পনেরো ফিট দূরে। অস্ত্র হাতের লোকটা বাম দিকের কলামের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছাউনীর নিচে, বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যে। সে তার অস্ত্রটা এমনভাবে ধরে রেখেছে যেনো সেটা তার গোপনাঙ্গ। রাইফেলের ফুটোতে আঙুল চালাচ্ছে খুবই অশ্লীল ভঙ্গীতে।
এখন। বর্ন সমাধির পেছন থেকে হামাগুঁড়ি দিয়ে এগোতে লাগলো, লোকটার সাথে তার দূরত্ব এখন মাত্র ছয় ফিট। এক শিকারী প্যান্থারের মতো সে নিঃশব্দে অভীষ্ট লক্ষ্যের একেবারে কাছাকাছি এসে পড়েছে। বিদ্যুৎ গতিতে একটা হাত রাইফেলটা আর অন্য হাতটা দিয়ে লোকটার মাথা ধরে ফেললো। মাথাটা সজোরে মার্বেলে আঘাত করলে লোকটা টলে গেলো। জেসন লোকটাকে ধ’রে কলামের আড়ালে শুইয়ে রাখলো। লোকটার কোমর থেকে .৩৫৭ ম্যাগনাম পিস্তল, চামড়ার খাপে রাখা ধরালো একটা চাকু আর পায়ে চামড়ার খাপ থেকে একটা .২২ রিভলবার নিয়ে নিলো। কোনোটাই সরকারী মাল নয়। এই লোকটা একজন ভাড়াটে খুনি।
তার আঙুলগুলো ভেঙে ফেলো। বর্নের কাছে কথাগুলো ফিরে এলো আবার। গোল্ডরিম চশমা পরা লোকটা এসব বলেছিলো স্টেপডেকস্ট্রাসে যাবার পথে একটা বিশাল সিডানের ভেতরে। সেই হিংস্র আচরণটির অবশ্যই কারণ ছিলো। জেসন লোকটার হাতের সবগুলো আঙুল মোচড়ে ভেঙে ফেললো। দু’হাতের সবগুলো আঙুলই এভাবে অকেজো ক’রে রাখলো সে। এই কাজটা করার সময় লোকটার মুখ জেসন তার বাহু দিয়ে আর্টকে রাখলো। যেটুকু গোঙানী হলো তা বৃষ্টির শব্দে চাপা পড়ে গেলো। তার হাত আর কোনো অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে না, নিজের হাতটাকেও অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না সে।
জেসন উঠে দাঁড়িয়ে কলামের আড়াল থেকে উঁকি মারলো। ট্রেডস্টোনের অফিসার এখন তার সামনের মাটিতে টর্চের আলো ফেলছে। এটা থেমে থাকার সিগনাল। অন্য কিছুও হতে পারে—পরবর্তী কয়েক মিনিট সেটা বলে দেবে। লোকটা গেটের দিকে পা বাড়ালো এমনভাবে যেনো একটু দ্বিধায় ভুগছে। সে হয়তো কোনো কিছু শুনেছে। আর এই প্রথম বর্ন হাতের লাঠিটা দেখতে পেলো, বুঝতে পারলো লোকটা একটু খোঁড়া। ট্রেডস্টোনের অফিসার অব রেকর্ড একজন পঙ্গু ব্যক্তি।
জেসন প্রথম সমাধিটার দিকেই দৌড়ে চলে গেলো। ট্রেডস্টোনের লোকটা এখনও গেটের দিকে চেয়ে আছে। বর্ন তার ঘড়ির দিকে তাকালো। ১টা ২৭ বাজে। সময় আছে। সে দৌড়ে পাহাড়ের উপরে যেতে লাগলো। একটু থেমে দম নিয়ে নিলো। পকেট থেকে একটা দেয়াশলাই বের করলো।
“ট্রেডস্টোন?” সে বেশ জোরেই বললো যেনো নিচ থেকেও সেটা শোনা যায়।
“ডেল্টা!”
কেইন হলো চার্লি, ডেল্টা হলো কেইন। ট্রেডস্টোনের লোকটা কেইন না বলে ডেল্টা নামটি ব্যবহার করলো কেন? ডেল্টা তো ট্রেডস্টোনের কোনো অংশ নয়। সে মেডুসা থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিলো।
জেসন পাহাড়ের নিচে নামতে শুরু করলো এবার। ঠাণ্ডা বৃষ্টির ঝাপটা তার চোখেমুখে এসে লাগছে। অগোচরেই তার হাতটা কোমরে রাখা অস্ত্রটার দিকে চলে গেলো। শ্বেতশুভ্র সমাধির সামনে বিশাল একটা লন দিয়ে সে হেটে গেলো। ট্রেডস্টোনের লোকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তার কাছে এসে থামলো। টর্চটা তুলে ধরলে বর্ন তীব্র আলোর কারণে চোখ দুটো কুচকে মুখটা সরিয়ে ফেললো।
“অনেক দিন পর,” টর্চটা নামিয়ে পঙ্গু অফিসার বললো। “আমার নাম ককলিন। যদি তুমি ভুলে গিয়ে থাকো সেজন্যে বলছি।”
“ধন্যবাদ, আপনাকে। আসলেই ভুলে গিয়েছিলাম। এটা সেরকমই একটা ব্যাপার।”
“কিসের একটা ব্যাপার?”
“যা আমি ভুলে গিয়েছিলাম।”
“যদিও তুমি এই জায়গাটা স্মরণ করতে পেরেছো। আমার ধারণা ছিলো তুমি পারবে। আমি অ্যাবোটের লগ্টা পড়েছি। এখানেই তুমি শেষবার দেখা করেছিলে। শেষ একটা ডেলিভারি দেয়া হয়েছিলো তোমাকে। কোনো এক রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্যানুষ্ঠানের সময়, মনে হয় একজন মন্ত্রীর ছিলো সেটা, তাই না?”
“আমি জানি না। সেটা নিয়েই তো আমাদের প্রথমে কথা বলতে হবে। আপনি ছয় মাস ধরে আমার কোনো খোঁজ পান নি। সেটার একটা ব্যাখ্যা আছে।”
“তাই নাকি? তাহলে শুনি, সেটা কি।”
“সহজ ক’রে বলতে গেলে আমি আহত হয়েছিলাম, গুলি খেয়েছিলাম, সেটার পরিণতি খুবই মারাত্মক ছিলো…সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো।”
“বেশ লাগছে শুনতে। এর মানে কি?”
“আমার স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। পুরোপুরি। আমি ভূ-মধ্য সাগরীয় অঞ্চলের একটি দ্বীপে কয়েক মাস কাটিয়েছি—মার্সেই’র দক্ষিণে—কোত্থেকে এসেছি, আমি কে, কেউই জানতো না। ওখানে ওয়াশবার্ন নামের এক ইংরেজ ডাক্তার আমাকে চিকিৎসা করেছে। সে সবকিছুর রেকর্ড রাখে। আমি যা বললাম সেটা আপনি খুঁজে দেখতে পারেন।”
“আমি নিশ্চত তার কাছে রেকর্ড রয়েছে,” ককলিন মাথা নাড়তে নাড়তে বললো। “আমি বাজি ধরে বলতে পারি তার কাছে বিশাল একটি রেকর্ড আছে। ঈশ্বর জানে, তুমি তাকে প্রচুর টাকা দিয়েছো!”
“আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?”
“আমাদের কাছেও রেকর্ড আছে। জুরিখের একজন ব্যাঙ্ক অফিসার আছে যে মনে করে সে একটি ট্রেডস্টোন তহবিল ট্রান্সফার করতে দেখেছে। এক মিলিয়ন ডলারেরও বেশি সুইস ফ্রাঁ, মার্সেই’র একটি একাউন্টে পাঠানো হয়েছে যেটা ট্রেস্ করা যাবে না। নামটা আমাদেরকে দেয়ার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।”
“এই ব্যাপারটা আপনাকে বুঝতে হবে। সেই লোকটা আমার জীবন বাঁচিয়েছে, আমাকে আবার বাস্তবে ফিরিয়ে এনেছে। তার কাছে যখন আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় তখন আমি একটা লাশই ছিলাম বলা যায়।’
“তাহলে তুমি সিদ্ধান্ত নিলে যে, মিলিয়ন ডলার খুব ভালো একটি অঙ্ক, তাই না? ট্রেডস্টোনের বাজেটের সৌজন্য।”
“আমি তো বলেছি, আমি জানতাম না। ট্রেডস্টোন আমার কাছে অজানা ছিলো। অনেক দিক থেকে এটা এখনও আমার কাছে অজানাই আছে।”
“আমি ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি তো তোমার স্মৃতি হারিয়েছো। কি যেনো বললে, এলোমেলো?”
“হ্যা, তবে সেটা যথার্থ শব্দ নয়। কথাটা হবে এমনেসিয়া।”
“কিন্তু এলোমেলো শব্দটাই ভালো। কারণ, মনে হচ্ছে তুমি গুছিয়ে টুছিয়ে সোজা জুরিখে চলে গেলে, একেবারে গেইমেনশেফট-এ।”
“আমার উরুর নিচে একটি নেগেটিভ অপারেশন ক’রে ঢুকিয়ে দেয়া ছিলো।”
“অবশ্যই ছিলো। তুমিই তো এ ব্যাপারে বেশি জোর দিয়েছিলে। আমাদের মধ্যে খুব কম মানুষই এটা বুঝতে পেরেছিলো। এটাই ছিলো তোমার জন্যে সবচাইতে সেরা বীমা।”
“আমি জানি না আপনি কি বলছেন। আপনি কি বুঝতে পারছেন না?”
“অবশ্যই। তুমি একটা নাম্বার পেলে আর তাতে করে ধরে নিলে তোমার নাম জেসন বর্ন।”
“ব্যাপারটা সেভাবে ঘটে নি! প্রতি দিন মনে হয় আমি কিছু কিছু শিখছি। কিছু কিছু স্মৃতি ফিরে পাচ্ছি। এক হোটেল ক্লার্ক আমাকে বর্ন নামে ডেকেছিলো। ব্যাঙ্কে যাবার আগে আমি জানতাম না আমার নাম জেসন বর্ন।”
“কোত্থেকে তুমি জানতে পারলে এতো সব করতে হবে,” ককলিন কথার মাঝখানে বললো। “কোনো কথা নেই বার্তা নেই, একেবারে চার মিলিয়ন উধাও।”
“ওয়াশবার্ন আমাকে বলেছিলো কি করতে হবে!”
“তারপর এক মেয়ে এসে হাজির হলো, যে কিনা ফিনান্সিয়াল কাজে খুব দক্ষ। সে তোমাকে বললো কিভাবে বাকি কাজটুকু করতে হবে। আর তার আগে তুমি লাওয়েনস্ট্রাসের চারনাক এবং তিনজন লোককে হত্যা করলে। ঐ তিনজনকে অবশ্য আমরা চিনি না, তবে তারা তোমাকে চিনতো বলেই মনে হয়। এখানে, এই প্যারিসে, ব্যাঙ্ক ট্রান্সফার কাজে নিয়োজিত ট্রাকে গুলি করা হলো। আরেকজন সহযোগী? তুমি বানচোত—সব শেষ ক’রে ফেললে, কেবল একটা জিনিস বাদে।”
“আপনি কি আমার কথা শুনবেন! ঐসব লোক আমাকে খুন করতে চেয়েছিলো। তারা মার্সেই থেকেই আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিলো। এর বাইরে আমি সত্যি বলছি, আপনি কি বলছেন কিছুই জানি না আমি। কখনও কখনও আমার মানসপটে কিছু ছবি, কিছু কথা, কিছু পথঘাট আর জায়গার ছবি ভেসে আসে। কিন্তু সেগুলো আমি ঠিক ধরতে পারি না। আর আসে অনেক নাম—কিন্তু কোনো মুখ নয়। আরে, আপনাকে বুঝতে হবে—আমি একজন এমনেসিয়াক! এটাই হলো সত্যি কথা!”
“সেই সব নামগুলোর মধ্যে কার্লোস থাকে না, থাকে কি?”
“হ্যা, থাকে, আপনি সেটা জানেন। এটাই তো আসল ব্যাপার। আপনি এটা আমার চেয়েও বেশি জানবেন। আমি কার্লোসের ব্যাপারে হাজার হাজার তথ্য বলতে পারি। কিন্তু আমি জানি না কেন। আমাকে এক লোক বলেছে, যে এখন এশিয়ার পথে আছে, ট্রেডস্টোনের সাথে নাকি আমার একটা চুক্তি আছে। লোকটা কার্লোসের হয়ে কাজ করে। সে বলেছে কার্লোস জানে। কার্লোস নাকি আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলছে। আপনি নাকি জানিয়ে দিয়েছেন আমি বিশ্বাসঘাতক হয়ে গেছি। সে কৌশলটা বুঝতে পারে নি। আর আমিও তাকে কিছু বলতে পারি নি। আপনি ভেবেছেন আমি বিশ্বাসঘাতক, কারণ আমি ছয় মাস ধরে লাপাত্তা। আর আমি যোগাযোগ করতে পারি নি, কারণ আমি জানতাম না আপনি কে। আমি এখনও জানি না আপনি আসলে কে!
“অথবা সন্ন্যাসীকে।”
“হ্যা, হ্যা…সন্ন্যাসী। তার নাম অ্যাবোট।”
“খুব ভালো। আর ইয়াখটম্যান? তার কথা তোমার মনে আছে, আছে না? তার বউ?”
“নামগুলো। হ্যা। কোনো চেহারা নয়।”
“এলিয়ট স্টিভেন্স?”
“না।”
“অথবা…গর্ডন ওয়েব।” ককলিন নামটা শান্ত কণ্ঠে বললো।
“কি?” বর্নের বুকটা ধরফর ক’রে উঠলো। মাথায় আবার ব্যথাটা ফিরে এলো। তার দু’চোখ দিয়ে আগুন বের হতে লাগলো! আগুন! বিস্ফোরণ আর অন্ধকার। ঝড়ো বাতাস আর যন্ত্রণা…ডেল্টাকে আলমানাক! পরিত্যাক্ত, পরিত্যাক্ত! অর্ডার অনুসারে জবাব দাও। “গর্ডন…” জেসন তার নিজের কণ্ঠটা শুনতে পেলো। চোখ দুটো বন্ধ ক’রে ফেললো। চারপাশের কুয়াশাটা সরাতে চাইলো। তারপর চোখ খুলে ককলিনের হাতের অস্ত্রটা তার মাথা বরাবর তাক্ ক’রে রাখতে দেখে খুব একটা অবাক হলো না।
“আমি জানি না, তুমি এটা কিভাবে করলে, কিন্তু তুমি করেছো। একটা জিনিসই করা বাকি ছিলো আর সেটাও তুমি করেছো। তুমি নিউইয়র্কে ফিরে গিয়ে তাদের সবাইকে শেষ ক’রে দিয়েছো। তুমি তাদের সবাইকে হত্যা করেছো, বানচোত। আমার ইচ্ছে করছে তোমাকে ওখানে ফিরে নিয়ে গিয়ে ইলেক্ট্রক চেয়ারে বসিয়ে দেই। কিন্তু আমি সেটা করতে পারবো না। তাই আমি এখানেই যা করার করবো। আমি নিজেই তোমাকে শেষ করবো।”
“আমি তো কয়েক মাস ধরে নিউইয়র্কে যাই নি। এর আগে গিয়েছি কিনা তাও জানি না। তবে বিগত ছয় মাসে তো নয়ই।”
“মিথ্যুক! তুমি এটা ঠিক মতো কেন করলে না? তুমি কেন তোমার এই ভেল্কিবাজিটা সময় মতো করলে না যাতে ক’রে শেষকৃত্যে যেতে পারতে? তুমি তাহলে অনেক পুরনো বন্ধুকে দেখতে পেতে। এবং তোমার ভাইকেও! হায় ঈশ্বর! তুমি তার বউকে চার্চে হাত ধরে নিয়ে যেতে পরতে। হয়তো একটা শোকবাণীও পাঠ করতে পারতে। অন্ততপক্ষে যে ভাইকে খুন করেছো তার সমন্ধে কিছু ভালো কথা বলতে পারতে।”
“ভাই?…বন্ধ করুন! ঈশ্বরের দোহাই, থামুন!”
“কেন থামবো? কেইন বেঁচে আছে! আমরা তাকে তৈরি করেছি, সে জীবন পেয়েছে।!”
“আমি কেইন নই। সে কখনও ছিলো না! কখনই না।!
“তাহলে তুমি জানো! মিথ্যুক! বানচোত!”
“অস্ত্রটা সরিয়ে রাখুন। আমি বলছি, সরিয়ে রাখুন!”
“সেটা হবে না। আমি নিজের কাছে প্রতীজ্ঞা করেছি, তোমাকে দুই মিনিট সময় দেবো, কারণ আমি শুনতে চাই তুমি কি বলতে চাও। তো আমি সব শুনেছি। তোমাকে এসব করার অধিকার কে দিয়েছে? আমরা সবাই কিছু না কিছু হারিয়েছি এটা কাজের মধ্যেই পড়ে। আর তুমি যদি এই বালের কাজটা পছন্দ না করো তবে কাজটা ছেড়ে দাও। সেটাই তুমি করেছিলে। উধাও হয় গিয়েছিলে। সেটা ঠিকই ছিলো। কিন্তু না, তুমি আবার ফিরে এলে, তোমার অস্ত্র আমাদের দিকে তাক্ করলে।”
“না! এটা সত্য নয়!”
“কথাটা ল্যাবরেটরির টেকনিশিয়ানদের বোলো, যারা আট টুকরা কাঁচ থেকে আঙুলের ছাপ নিয়েছে। ডান হাতের তৃতীয় এবং তর্জনীর। তুমি ওখানে পাঁচজন লোককে হত্যা করেছো। তুমি সবাইকে হত্যা করেছো। খুব ভালো সেটআপ। ভিন্ন ভিন্ন গুলি। ট্ৰেডস্টোনকে ধ্বংস করেছো তুমি!”
“না, আপনি ভুল বলছেন! এটা কার্লোসের কাজ। আমার নয়। আপনি যা বলছেন সেটা যদি হয়ে থাকে তবে সেটা কার্লোর্সই করেছে। সে জানে। তারা জানে। সেভেনটি ফার্স্ট স্ট্ট। ১৩৯ নাম্বার। তারা এ সম্পর্কে জানে!”
ককলিন মাথা নেড়ে সায় দিলো, তার চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে গেছে। বৃষ্টির মধ্যেও সেই চোখে স্পষ্ট ঘৃণা দেখা গেলো।
“খুবই নিঁখুত,” আস্তে ক’রে বললো সে। “টার্গেটের সাথে হাত মিলিয়ে পুরো পরিকল্পনাটা নস্যাৎ করা। তাহলে চার মিলিয়ন ছাড়াও আর কি নিয়েছো? কার্লোস তোমাকে রেহাই দিয়েছে? তোমরা দু’জনে তো দেখছি বেশ ভালো জুটি হয়ে উঠেছো।”
“এটা তো পাগলের প্রলাপ!”
“কিন্তু সত্যি,” ট্রেডস্টোনের লোকটা বললো। “গত শুক্রবার সাড়ে সাতটার আগে কেবল নয় জন লোকই জানতো ঠিকানাটা। তিন জন নিহত হয়েছে, আর আমরা হলাম বাকি চারজন। কার্লোস যদি সেটা জেনে থাকে তবে একজনই সেটা তাকে দিয়েছে। তুমি।”
“আরে আমি কি ক’রে দেবো? আমি তো এটা জানতামই না। আমি এটা এখনও জানি না!”
“তুমি তো এইমাত্র বললে,” ককলিন বাম হাতে লাঠিটা নিলো গুলি করার প্রস্ততি হিসেবে।
“গুলি করবেন না!” বর্ন চিৎকার ক’রে বললো। জানে এই আকুতির কোনো মূল্য নেই। চিৎকার দিয়েই সে বাম দিকে ঘুরে ডান পা দিয়ে সজোরে লাথি মারলো অস্ত্র ধরে রাখা হাতটাতে। ককলিন পড়ে যাবার সময় লক্ষ্যহীনভাবে একটা গুলি করলো। জেসন অস্ত্রটা ধরে রাখা হাতে আবারো লাথি মারলে অস্ত্রটা হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেলো।
ককলিন মেঝেতে গড়িয়ে গেলো, তার চোখ শ্বেতশুভ্র সমাধিটার কলামের দিকে। ওখান থেকে একটা গুলি এসে তার আক্রমণকারীকে ঘায়েল করবে ব’লে সে আশা করছে। না! সে আবারো গড়িয়ে গেলো। এবার ডান দিকে। ভালো ক’রে দেখে সে ভড়কে গেলো—ওখানে অন্য কেউ!
পরপর চারটা গুলি তার দিকে ছুটে এলে বর্ন মাটিতে শুইয়ে পড়লো। দ্রুত গড়িয়ে নিজের অস্ত্রটা হাতে নিয়ে নিলো। দেখতে পেলো একটা সমাধির কাছেই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। পর পর দু’বার গুলি চালালে লোকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
দশ ফিট দূরে ককলিন ঘাসের উপর দু’হাত ছড়িয়ে শুয়ে আছে। সামনে থাকা অস্ত্রটা নেবার জন্যে হাত বাড়াচ্ছে। জেসন উঠেই তার কাছে ছুটে গিয়ে হাটু মুড়ে বসলো। একহাতে লোকটার ভেঁজা চুল ধরে অন্য হাতে অস্ত্রটা তার মাথায় ঠেকালো। দূরের কলাম থেকে একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ ভেসে এলো।
“এটা আপনার ভাড়াটে গুণ্ডার চিৎকার,” ককলিনের মাথাটা ঝাঁকিয়ে জেসন বললো। “ট্রেডস্টোন খুবই অদ্ভুত লোকজনকে নিয়োগ দিয়েছে। অন্য লোকটা কে?”
‘সে তোমার চেয়ে ভালো লোক,” ককলিন জবাব দিলো। “তারা সবাই। তারা তোমার মতোই সব হারিয়েছে, কিন্তু তারপরও বেঈমানী করে নি। তাদের উপর আমরা নির্ভর করতে পারি!”
“আমি যাই বলি না কেন, আপনি বিশ্বাস করবেন না। আপনি আমার কথায় বিশ্বাস করতে চান না!”
“কারণ আমি জানি তুমি কোন্ জিনিস—তুমি কি করেছো। এইমাত্র তুমি পুরো জিনিসটা আবারো নিশ্চিত করেছো। তুমি আমাকে খুন করতে পারো। কিন্তু তারা তোমাকে ঠিকই ধরবে। তুমি হলে সবচাইতে বাজে টাইপের লোক। তুমি অবশ্য নিজেকে স্পেশাল ভাবো। সবসময়ই তাই ভাবো। নম পেন-এর পরে আমি তোমাকে দেখেছি—সবাই সেখানে হেরেছে, কিন্তু তুমি নয়। কেবল তুমি! তারপর মেডুসাতে! ডেল্টার জন্যে কোনো নিয়ম নেই! পশুটা কেবল হত্যা করতে চায়। আর এরকম পশুরাই বেঈমানী করে। তো, আমিও হেরে গেছি। কিন্তু কখনও বেঈমানী করি নি। চালাও গুলি! খুন করো আমাকে! তারপর কার্লোসের কাছে ফিরে যাও। কিন্তু আমি যখন ফিরে যাবো না তারা সবই বুঝে যাবে। তারা তোমাকে শেষ করার আগপর্যন্ত তোমার পিছু নেবে। চালাও গুলি!”
ককলিন চিৎকার করলেও বর্ন তার কথা খুব একটা শুনলো না বলেই মনে হলো। তার বদলে সে দুটো শব্দ শুনতে পেলো, আর এই দুটো শব্দ তার সমস্ত শরীরে একধরণের শিহরণ বইয়ে দিলো। নম পেন! নম পেন। আকাশে মৃত্যু। আকাশ থেকে মৃত্যু। অল্পবয়সীদের মৃত্যু। পাখির কিচির মিচির আর যন্ত্রের শব্দ। অরণ্য আর নদী। সে আবারো অন্ধ হয়ে গেলো, ক্ষিপ্ত হয়ে গেলো।
তার নিচে ট্রেডস্টোনের লোকটা তার হাত থেকে ছুটে গেলো। হামাগুঁড়ি দিয়ে পঙ্গু লোকটা পাগলের মতো ছুটতে লাগলো। জেসন চোখ দুটো পিটপিট ক’রে বাস্তবে ফিরে আসার চেষ্টা করলো। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলো তাকে অস্ত্রটা দিয়ে গুলি করতে হবে। ককলিন নিজের অস্ত্রটা হাতে তুলে নিলো। কিন্তু বর্ন টুগার টিপতে পারলো না।
সে ডান দিকে সরে গিয়ে ঘাসের উপর গড়িয়ে মার্বেলের কলামটার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলো। ককলিনের গুলিটা লক্ষ্য খুঁজে পেলো না। সে নিজের নিশানা ঠিক রাখতে পারছে না। তার হাত আর পা কাঁপছে। এরপরই গুলি করাটা থেমে গেলে জেসন উঠে দাঁড়ালো। কলামটার পেছন থেকে উঁকি দিলো সে। তার হাতের অস্ত্রটা এবার তাক্ করা হলো সেই লোকটার দিকে, তাকে এখন হত্যা করতে হবে। তা না হলে সেই লোকই তাকে এবং মেরিকে খুন ক’রে ফেলবে। তাদের দু’জনকে কার্লোসের সাথে জড়িয়ে দেবে।
ককলিন খোঁড়াতে খোঁড়াতে গেটের দিকে ছুটে যাচ্ছে। বাইরে একটা গাড়ি তার গন্তব্য। বর্ন তার অস্ত্রটা তুলে গুলি করার জন্যে উদ্যত হলো। এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে সব চুকেবুকে যাবে। ট্রেডস্টোনে তার শত্রুটি মরে যাবে। কিন্তু সে গুলি করতে পারলো না। টুগারটা কোনোভাবেই টিপতে পারলো না। চেয়ে চেয়ে দেখলো ককলিন গাড়িতে উঠে চলে যাচ্ছে।
গাড়ি! তাকে প্যারিসে ফিরে যেতে হবে। একটা উপায় আছে। সেটা ওখানেই আছে। ওখানে মেরি আছে!
.
সে দরজায় টোকা দিলে মেরি টোকাটা বুঝে দরজা খুলে দিলো।
“হায় ঈশ্বর, তোমার একি অবস্থা! কি হয়েছে?”
“সময় নেই,” সে ঘরের ভেতরে টেলিফোনটার দিকে এগোলো জেসন। “ওটা একটা ফাঁদ ছিলো। তারা মনে করছে আমি বেঈমানী করেছি। কার্লোসের কাছে বিক্রি ক’রে দিয়েছি নিজেকে।”
“কি?”
“তারা বলছে আমি নাকি গত সপ্তাহে নিউইয়র্কে গিয়ে পাঁচজন লোককে খুন ক’রে এসেছি…তাদের মধ্যে আমার নিজের এক ভাইও আছে।” জেসন কয়েক মুহূর্তের জন্যে চোখ দুটো বন্ধ করলো। “একজন ভাই আছে—-আমার। আমি জানি না। আমি আর এখন ভাবতেও পারছি না।”
“তুমি তো প্যারিস ছাড়ো নি! এটা তুমি প্রমাণ করতে পারবে!
“কিভাবে? আট, দশ ঘণ্টা সময় দরকার আমার। আমি কি ক’রে সেটা প্রমাণ করবো?”
“আমি করবো। তুমি আমার সাথে ছিলে।”
“তারা মনে করে তুমিও এসবের সাথে জড়িত,” ফোনটা তুলে নিয়ে ডায়াল করতে করতে বর্ন বললো। “চুরি, বিশ্বাসঘাতকতা, পোর্ত নোয়ে, সবই। তারা তোমাকেও আমার সাথে জড়িয়ে ফেলেছে। কার্লোস আমার আঙুলের ছাপ নকল ক’রে ঘটনাস্থলে রেখে দিয়েছে। ঈশ্বর!”
“তুমি এখন কার কাছে ফোন করছো?”
“আমাদের ব্যাকআপ, মনে আছে? আমাদের কাছে ঐ একজনই আছে। ভিলিয়ার্স। আর তার বউ। ঐ মেয়েটা হলো মূল্যবান। তাকে এখন আমাদেরকে কব্জায় নিতে হবে। তার কাছ থেকে কথা বের করতে হবে। দরকার হলে তাকে নির্মম নির্যাতন করা হবে। কিন্তু সেটা করতে হবে না। কারণ সে জিতবে না, তাই মুখ বন্ধ রেখে তার কোনো লাভও হবে না…ধ্যাত্তারিকা! ফোনটা ধরছে না কেন?”
“তার প্রাইভেট ফোনটা তো তার অফিসে থাকে। এখন রাত তিনটা বাজে। সে হয়তো—”
“ধরেছে! জেনারেল? আপনি বলছেন তো?” জেসন জিজ্ঞেস করলো।
“হ্যা, আমি বলছি। বন্ধু। আমার বউয়ের সাথে উপরের ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম।”
“তার ব্যাপারেই আমি ফোন করেছি। আমাদেরকে চলে যেতে হবে। এখনই। ফরাসি ইন্টেলিজেন্স, ইন্টারপোল এবং আমেরিকান অ্যাম্বাসিকে সতর্ক ক’রে দিন। কিন্তু তাদেরকে বলে দেবেন আমি আপনার বউকে না দেখা পর্যন্ত, কোনো কথা না বলা পর্যন্ত যেনো তারা কোনোরকম নাক না গলায়।”
“আমার তা মনে হচ্ছে না, মি: বর্ন…আমার বউয়ের সাথে কোনো কথা বলাটা মনে হয় সম্ভব হবে না। মানে, আমি তাকে খুন ক’রে ফেলেছি।”