পর্ব ১
পর্ব ২
পর্ব ৩

বর্ন আইডেন্টিটি – ৩০

অধ্যায় ৩০

“দাঁজু।”

“ডেল্টা? আমি ভাবছি…মানে, মনে হচ্ছে তোমার কণ্ঠটা আমি কোথাও শুনেছি।”

সে এটা বললো! নামটা বলা হলো। যে নামটা তার কাছে কোনো অর্থই বহন করে না, তারপরও এখন সেটা হয়ে গেছে সবকিছু। দাঁজু জানে। ফিলিপ দাঁজু এক বিস্মৃত অতীতের অংশ। কেইন হলো চার্লি আর ডেল্টা হলো কেইন। ডেল্টা! সে এই লোকটাকে চিনতো। এই লোকটার কাছেই জবাবটা রয়েছে! আলফা, ব্রাভো, কেইন, ডেল্টা, ইকো, ফক্সট্রট …

মেডুসা।

“মেডুসা,” সে আস্তে ক’রে বললো। বার বার এই নামটা যেনো তার কানে এক নিরব চিৎকার করছে।

“প্যারিস তাম কুয়ান নয়, ডেল্টা। আমার কাছে তোমার আর কোনো ঋণ নেই। কোনো কিছু পাবার চেষ্টাও করো না। আমরা এখন ভিন্ন ভিন্ন লোকের কর্মচারী।”

“জ্যাকুলিন লাভিয়া মারা গেছে। কার্লোস তাকে খুন করেছে নুয়েলি সুর সেইন-এর চার্চে, আধঘণ্টা আগে।”

“এসব বলার চেষ্টাও করো না। দুই ঘণ্টা আগে জ্যাকুলিন ফ্রান্স ছেড়ে চলে গেছে। সে নিজে আমাকে ওরলি এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করেছিলো। সে বারগোয়ার সাথে যোগ দিচ্ছে—”

“ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে কাপড় কেনার জন্যে?” কথার মাঝখানে জেসন বললো। দাঁজু চুপ মেরে গেলো। “মেয়েটা ফোন ক’রে রেনেকে চাইছিলো। তোমার কথার অর্থ আমি বুঝতে পারছি। এতে কোনো কিছু বদলাবে না। আমি তার সাথে কথা বলেছি, সে ওরলি থেকে ফোন করেছিলো।”

“তাকে এই কথাটা তোমাকে বলার জন্যে বলা হয়েছিলো। তার কথাবার্তা শুনে কি তাকে খুব বেশি নিয়ন্ত্রিত ব’লে মনে হয় নি?”

“সে একটু বিমর্ষ ছিলো। আর সেটা তোমার চেয়ে ভালো অন্য কেউ জানে না। তুমি এখানে বেশ অসাধারণ কাজই করেছো, ডেল্টা। অথবা কেইন। কিংবা তুমি নিজেকে যে নামে পরিচয় দিচ্ছো এখন। অবশ্যই সে স্বাভাবিক ছিলো না। এজন্যেই তো তাকে কয়েক দিনের জন্যে বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।”

“এজন্যেই সে মরেছে। এরপর মরবে তুমি।”

“গত চব্বিশ ঘণ্টা তোমার ছিলো। এখন আর সেটা তোমার নয়।”

“লাভিয়াকে অনুসরণ করা হয়েছিলো। তোমাকেও তাই করা হচ্ছে। তোমার প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ্য করা হচ্ছে।

“যদি তাই করা হয়ে থাকে তবে সেটা আমার নিজের সুরক্ষার জন্যেই।”

“তাহলে লাভিয়া কেন মরলো?”

“আমার মনে হয় না সে মরেছে।”

“সে কি তবে আত্মহত্যা করেছে?”

“কখনই না।”

“নুয়েলি সুর সেইনের চার্চে ফোন ক’রে জেনে নাও। জিজ্ঞেস করবে কনফেশনে গিয়ে এক মহিলা আত্মহত্যা করেছে কিনা। আমি তোমাকে পরে ফোন করছি।” বর্ন ফোনটা রেখে বুথ থেকে বের হয়ে গেলো। পথে নেমেই একটা ট্যাক্সির খোঁজ করলো। দশ ব্লক দূরে গিয়ে দাঁজুকে দ্বিতীয় বারের মতো ফোন করা হবে। মেডুসার লোকটা এতো সহজে পটবে না।

ডেল্টা? আমার মনে হয় আমি তোমার কণ্ঠটা কোথাও শুনেছি…প্যারিস তাম কুয়ান নয়। তাম কুয়ান…তাম কুয়ান, তাম কুয়ান! কেইন হলো চার্লি, ডেল্টা হলো কেইন। মেডুসা!

বন্ধ করো। এসব ভেবো না…তুমি এসব ভাবতে পারবে না। সেটা কি, কেবল তাই নিয়ে মাথা ঘামাও। এখন। কেবল তুমি। অন্যেরা কি বলে সেটা নয়—এমন কি তুমি নিজে নিজেকে কি ভাবো তাও নয়। শুধু বর্তমান। এখনকার লোকটা তোমাকে একটা উত্তর দিতে পারবে।

আমরা ভিন্ন ভিন্ন লোকের কর্মচারি…

এটাই হলো আসল কথা।

আমাকে বলো! ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে বলো! সে কে? আমার চাকরিদাতা কে, দাঁজু?

একটা ট্যাক্সি এসে তার সামনে থামলে জেসন দরজা খুলে ঢুকে পড়লো।

“প্লেস ভেদোয়া,” সে বললো, জানে জায়গাটা সেন অনরের খুব কাছেই। এই জায়গাটার কাছাকাছি থাকাটা খুবই জরুরি। তার একটা বাড়তি সুবিধা আছে। এক ঢিলে দুটো পাখি মারার মতো ব্যাপার। দাঁজু বুঝবে তাকে যারা অনুসরণ করছে তারা তাকে খুন করবে। কিন্তু সেইসব লোকেরা জানবে না যে, অন্য আরেকজন তাদেরকে অনুসরণ করছে।

ভেদোয়াঁ এলাকাটি যথারীতি জনাকীর্ণ। ওখানে একটা ফোনবুথ দেখতে পেয়ে বর্ন ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়লো। লো ক্লাসিকে ফোন করলো সে। নুয়েলি সুর সেইন থেকে ফোন করার চৌদ্দ মিনিট পার হয়ে গেছে।

“দাঁজ?”

“কনফেশন করার সময় একজন মহিলা নিজের জীবন সংহার করেছে, এটা কেবল আমি জানতে পেরেছি।”

“আরে, তুমি দেখছি এখনও নিশ্চিত হতে পারছো না।”

“আমাকে সুইচবোর্ডটা ধরার সময় দাও।” লাইনটা প্রায় চার সেকেন্ডের জন্যে কেটে গেলো। দাঁজু আবার ফিরে এলো। “সাদা চুলের এক মধ্যবয়সী মহিলা। দামি পোশাক পরা। একটা সেন লরেন-এর পার্স। এরকম দশ হাজার মহিলা রয়েছে প্যারিসে। আমি কি ক’রে বুঝবো না যে তুমি তাদের একজনকে খুন করো নি?”

“ওহ্ তাতো ঠিকই। আমি তাকে পুতুলের মতো তুলে চার্চে নিয়ে গেছি। একটু যুক্তিবাদী হও, দাঁজু। আসো বিষয়টা নিয়ে কথা বলি। ঐ পার্সটা তার নয়। সে একটা সাদা চামড়ার ব্যাগ বহন করছিলো। সে তার প্রতিপক্ষের কোনো ফ্যাশন হাউজের পণ্য বিজ্ঞাপন ক’রে বেড়াবে না।”

“আমাকে বিশ্বাস করাতে চাইছো। ঐ মহিলা জ্যাকুলিন লাভিয়া নয়।’

“তার ব্যাগের কাগজপত্র তাকে অন্য কেউ হিসেবে চিহ্নিত করছে। লাশটা খুব জলদিই দাবি করা হবে। কেউ লো ক্লাসিককে স্পর্শ করবে না।

“কারণ তুমি এরকমটি বলছো তাই?”

“না, কারণ এটা আমার জানা কার্লোসের পাঁচটি খুনে ব্যবহৃত একটি পদ্ধতি।” আসলেই সে জানে। এটা খুবই ভীতিকর ব্যাপার। একটা লোককে সরিয়ে ফেলা হবে, পুলিশ বিশ্বাস করবে সে-ই একজন। হত্যাটি রহস্যময়। খুনি অজ্ঞাত। তারপর তারা খুঁজে পাবে খুনি আসলে অন্য কেউ। এই ফাঁকে কার্লোস অন্য কোনো দেশে চলে যাবে। আরেকটা কনট্রাক্ট সমাধা করা হবে। লাভিয়া হলো এই পদ্ধতির একটি বৈচিত্রতা। এই যা।”

“অনেক কথা বলছো, ডেল্টা। তুমি কখনও এতো কথা বলতে না।”

“তুমি যদি আরো তিন চার সপ্তাহ সেন অনরেতে থাকো—যা তুমি করবে না—তাহলে তুমি দেখতে পাবে কিভাবে এসব শেষ হয়। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে একটা প্লেন ক্র্যাশ অথবা নৌকা ডুবি। লাশগুলো এমন অবস্থায় থাকবে যে, চেনা যাবে না কিংবা উধাও হয়ে যাবে। তবে কারা মারা গেছে সেটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। লাভিয়া আর বারগোয়াঁ। তবে একজন অবশ্যই মারা যাবে—মাদাম লাভিয়া। মঁসিয়ে, তোমাকে বলছি, তুমি প্যারিসের মর্গে তালিকাটা আরেকটু বাড়িয়ে দেবে।”

“আর তুমি?”

“পরিকল্পনা অনুযায়ী আমিও মৃত। তারা তোমার মাধ্যমে আমাকে মারার আশা করছে।”

“যুক্তিযুক্ত। আমরা দু’জনেই মেডুসা থেকে এসেছি, তারা সেটা জানে—কার্লোস সেটা জানে। এটা ধরে নেয়া হচ্ছে যে, তুমি আমাকে চিনতে পারবে।”

“এবং তুমি চিনতে পারবে আমাকে।”

দাঁজু চুপ থাকলো। “হ্যা,” সে বললো। “যেমনটি বলেছি, আমরা এখন ভিন্ন ভিন্ন লোকের কর্মচারি।”

“সেই কথাটাই আমি বলতে চাচ্ছি।”

“কোনো কথা নয়, ডেল্টা। তবে পুরনো দিনের দোহাই—তাম কুয়ানে তুমি আমাদের জন্যে যা করেছো, তার জন্যে বলছি—একজন মেডুসানের উপদেশ মেনে নাও। প্যারিস ছাড়ো, নয়তো তুমি মারা যাবে।”

“আমি সেটা করতে পারছি না।”

“তোমার করা উচিত। আমার যদি সুযোগ থাকতো তবে আমি নিজেই টুগারটা টিপে দিতাম, এজন্যে ভালো টাকাও পেতাম।”

“তাহলে আমি তোমাকে সেই সুযোগ দেবো।”

“আমি যদি সেই হাস্যকর জিনিসটা খুঁজে পাই তবে আমাকে ক্ষমা ক’রে দিও।”

“তুমি জানো না আমি কি চাই অথবা এটা পাবার জন্যে আমি কতোটা ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক।”

“তুমি যা-ই চাও না কেন এজন্যে তোমাকে বেশ ঝুঁকি নিতে হবে। তবে আসল বিপদ হলো তোমার শত্রুর। আমি তোমাকে চিনি, ডেল্টা। আমাকে সুইচবোর্ডে ফিরে যেতে হবে। তোমার শিকারপর্ব ভালো হোক, এই কামনা করি, তবে—”  

এখন তার কাছে থাকা একমাত্র অস্ত্রটা ব্যবহার করার মুহূর্তটি এসে গেছে। একমাত্র হুমকি যা দাঁজুকে লাইনে ধরে রাখবে। “পার্ক মশিউ বাদ দেয়ার পরে এখন কার কাছ থেকে নির্দেশনা পাবে?”

দাঁজুর নিরবতার জন্যে উত্তেজনাটা আরো বেড়ে গেলো। যখন সে জবাব দিলো তার কণ্ঠটা খুব মৃদু শোনালো। “তুমি কি বললে?”

“এজন্যেই লাভিয়া খুন হয়েছে, বুঝলে। এজন্যে তুমিও খুন হবে। কার্লোস তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবে না। তুমি অনেক বেশি জেনে গেছো। সে পার্ক মশিউ’তে গিয়েছিলো, তাই সে খুন হয়েছে। তুমিও পার্ক মশিউ’তে গিয়েছো, তুমিও মরবে। সে তোমাকে ব্যবহার করবে আমাকে ফাঁদে ফেলার জন্যে। তারপর সে তোমাকে খুন ক’রে আরেকটা লো ক্লাসিক সেটআপ ক’রে আরেকজন মেডুসানকে যুগিয়ে নেবে। তোমার কি এ ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে?”

এবারের নিরবতাটি আরো বেশি দীর্ঘ হলো। মনে হলো মেডুসার লোকটি নিজেকে প্রশ্ন করছে। “তুমি আমার কাছ থেকে কি চাও? আমাকে ছাড়া। তুমি জানো জিম্মি ক’রে কোনো লাভ হবে না। তারপরও তুমি যা জেনেছো তা দিয়ে আমাকে ক্ষেপিয়ে তুলছো, অবাক করছো। আমি বাঁচি আর মরি তাতে তোমার কিছু যায় আসে না। সুতরাং তুমি চাচ্ছোটা কি?”

“তথ্য। যদি তোমার কাছে সেটা থাকে, তাহলে আমি আজ রাতেই প্যারিস ছাড়বো। কি কার্লোস কি তুমি, আর কখনও আমার কোনো কথা শুনবে না।”

“কোন্ তথ্য?”

“আমি যদি এখন জানতে চাই তবে তুমি মিথ্যে বলবে। তবে আমি জানতে চাইবো যখন তোমার সাথে আমার দেখা হবে। তখন দয়া ক’রে সত্য কথা বোলো।”

“আমার গলায় তার পেঁচিয়ে ধরে সত্য কথা বলাবে?”

“লোকজনের ভীড়ের মধ্যে?”

“লোকজন? দিনের বেলায়?”

“এখন থেকে এক ঘণ্টা পরে। লুভরের বাইরে। সিঁড়ির কাছে। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে।”

“লুভরে? লোকজনের ভীড়ে? তুমি মনে করছো আমার কাছ থেকে তথ্যটা পেলে তুমি দূরে কোথাও চলে যাবে? তুমি আশা করতে পারো না আমি আমার চাকরিদাতার সাথে এ নিয়ে আলোচনা করি?”

“তোমার নয়। আমার।”

“ট্রেডস্টোন?”

সে জানে। ফিলিপ দাঁজুর কাছে জবাবটা আছে। শান্ত থাকো। তোমার উদ্বেগটা প্রকাশ করো না।

“সেভেনটি-ওয়ান,” জেসন যোগ করলো। “খালি একটা সহজ প্রশ্ন, তারপরই আমি উধাও হয়ে যাবো। আর তুমি যখন আমাকে সত্যি জবাবটা দেবে—বিনিময়ে আমিও তোমাকে কিছু দেবো।”

“তুমি আমার কাছ থেকে কি চাচ্ছো?”

“যে তথ্যটা তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। এটার অবশ্য কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে বিশ্বাস করো, আমি যখন বলবো তখন তুমি এটা ছাড়া আর বাঁচতে পারবে না। পার্ক মশিউ, দাঁজু।” .

আবারো নিরবতা। বর্ন দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পেলো ধূসর চুলের মেডুসান তার সুইচবোর্ডের দিকে চেয়ে আছে। প্যারিস জেলার এক ধনাঢ্য ব্যক্তির নামটি বার বার তার কানে প্রতিধ্বনি হতে লাগলো। পার্ক মশিউ’তে খুন হয়েছে। দাঁজু সেটা জানে। সে আরো জানে নুয়েলি সুর সেইনের নিহত মহিলাটি লাভিয়া।

“সেই তথ্যটা কি হতে পারে?”

“তোমার চাকরিদাতার পরিচয়। খামে ক’রে একটা নাম আর যথেষ্ট প্রমাণ সিলগালা ক’রে একজন এটর্নিকে দেবে, যাতে তোমার স্বাভাবিক মৃত্যু হলে সেটা না খোলা হয়। আর যদি কোনোভাবে অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় তবে তাকে বলা হবে সেটা খুলতে। এটা তোমার সুরক্ষা, দাঁজু।”

“আচ্ছা,” মেডুসান লোকটা আস্তে ক’রে বললো। “কিন্তু তুমিই না বললে লোকজন আমার উপর নজর রাখছে। অনুসরণ করছে।”

“লুকিয়ে রাখো নিজেকে। তাদেরকে সত্যটা বলে দাও। তোমার কাছে একটা নাম্বার আছে ফোন করার জন্যে, আছে না?”

“হ্যা, এক লোকের নাম্বার আছে,” বয়স্ক লোকটার কণ্ঠস্বর একটু চড়া হলো। “তাকে ফোন করো, আমি যা বললাম ঠিক তাই তাকে বলো…কেবলমাত্র বিনিময়ের কথাটা বাদ দিয়ে। বলবে আমি তোমার সাথে যোগাযোগ ক’রে তোমার সাথে দেখা করতে চাইছি। এক ঘণ্টা পরে লুভরের বাইরে। সত্যি কথাটাই বলবে।”

“তুমি একটা উন্মাদ।”

“আমি জানি আমি কি করছি।”

“তুমি সব সময় তাই করো। তুমি তোমার নিজের ফাঁদ পেতে নিজের বিপদ ডেকে আনো।”

“সেটা হলে তো তুমি পুরস্কার পাবে।”

“অথবা নিজের মৃত্যু ডেকে আনা হবে। যদি তুমি যা বলছো তাই হয়।”

“তাহলে দ্যাখো, সেটা হয় কিনা। আমি তোমার সাথে কনটাক্ট করবো, যেভাবেই হোক। তাদের কাছে আমার ছবি আছে। তারা জানবে কখন আমি এটা করবো। কোনো অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতির চেয়ে নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতিই বেশি ভালো।”

“এখন আমি ডেল্টার কথা শুনছি,” দাঁজু বললো। “সে নিজের জন্যে কোনো ফাঁদ তৈরি করবে না। সে অন্ধের মতো ফায়ারিং স্কোয়াডে হেটে যাবে না।”

“না, সে তা করবে না,” বর্ন একমত হলো। “তোমার কোনো উপায় নেই, দাঁজু। এক ঘণ্টা। লুভরের বাইরে।”

.

কোনো ফাঁদের সফলতা লুকিয়ে থাকে এর সহজ-সরলতার উপরে। পাল্টা ফাঁদটাও সেজন্যে অবশ্যই সহজ সরল হতে হয়।

সেন অনরের লো ক্লাসিকের বাইরে অপেক্ষা করার সময় কথাটা তার মনে এলো। সে ড্রাইভারকে ব্লকটা দু’বার ঘুরিয়ে আনতে বলেছিলো, একজন আমেরিকান পর্যটক যার বউ এখানকার কোনো এক ফ্যাশন হাউজে কেনাকাটা করতে বেরিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো সে কোনো একটি দোকান থেকে বের হয়ে আসলে তাকে খুঁজে পাবে।

কিন্তু সে খুঁজে পেলো কার্লোসের অনুচরদের। কালো রঙের একটি সিডান থেকে বের হয়ে থাকা এন্টেনাটা প্রমাণ আর বিপদের চিহ্ন। পেছনের সিটে ব’সে সে গাড়ির ভেতরে দু’জন লোককে দেখতে পেলো। তারা যে অন্য যেকোনো লোকের মতো নিছক অপেক্ষা করছে না সেটা বোঝা গেলো তারা কোনো কথা বলছে না দেখে।

ফিলিপ দাঁজু রাস্তায় নেমে এলো। তার মাথায় ধূসর রঙের টুপি। সে রাস্তার দিকে এক ঝলক চেয়ে দেখলো। বর্নকে যেনো বলছে সে লুকিয়ে বের হয়েছে। সে একটা নাম্বারে ফোন করেছিলো। সে তার চমকে দেয়া তথ্যটা রিলে ক’রে দিয়েছে। তাকে যে এখানে কোনো গাড়ি থেকে অনুসরণ করা হচ্ছে সেটা সে জানে।

বোঝাই যাচ্ছে ফোন ক’রে একটা ট্যাক্সি ডেকে আনা হয়েছে। সেটা তার ঠিক পাশে এসে থামলো। দাঁজু ড্রাইভারকে কিছু একটা বলেই গাড়িতে উঠে বসলে রাস্তার ওপাশে একটা এন্টেনা তাড়াহুড়া ক’রে উঠে এলো, শিকার পর্ব শুরু হয়ে গেছে।

ট্যাক্সিটা চলতে শুরু করতেই সিডানটাও পিছু পিছু ছুটলো। এই ব্যাপারটাই জেসনের দরকার ছিলো। সে ঝুঁকে ড্রাইভারের সাথে কথা বললো। “আমি ভুলে গিয়েছিলাম,” সে বিব্রত হয়ে বললো। “আমার বউ বলেছিলো সে লুভরে যাবে। পরে এখানে শপিং করবে। হায় ঈশ্বর, আমার আধ ঘণ্টা দেরি হয়ে গেছে! আমাকে লুভরে নিয়ে যাও, প্লিজ?”

“মেই কুয়ে, মঁসিয়ে, লো লুভর।”

সাইন নদীর তীরে এসে জেসনের ট্যাক্সিটা কালো রঙের সিডানটা অতিক্রম করলো। অতিক্রম ক’রে যাবার সময় জেসন দেখতে পেলো যা তার দেখার দরকার ছিলো। ড্রাইভারের পাশে বসা লোকটা মাইক্রোফোন হাতে অনবরত কথা ব’লে যাচ্ছে। কার্লোস নিশ্চিত ফাঁদটাতে যেনো কোনো ফাঁক না থাকে।

তারা লুভরের বিশাল প্রবেশদ্বারের সামনে এসে পড়লো। “অন্য ট্যাক্সিগুলোর পেছনে লাইন ক’রে এগোও,” জেসন বললো।

“কিন্তু ওগুলো তো ভাড়ার জন্যে অপেক্ষা করছে, মঁসিয়ে। আমার তো প্যাসেঞ্জার আছেই। আমি আপনাকে—”

“যা বললাম তাই করো,” বর্ন বললো। পঞ্চাশ ফ্রাঁ’র একটা নোট বাড়িয়ে দিলো সে।

ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা লাইনে নিয়ে রাখলো। কালো রঙের সিডানটা ডান দিকে বিশ গজ দূরে আছে। মাইক্রোফোন হাতে থাকা লোকটা এখন জানালার কাঁচ নামিয়ে বাইরে তাকাচ্ছে। জেসন তার দৃষ্টি অনুসরণ ক’রে যা দেখতে পেলো সেটাই সে আশা করেছিলো। পশ্চিম দিকে, কয়েকশো গজ দূরে ধূসর রঙের একটা গাড়ি, যে গাড়িটা লাভিয়াকে অনুসরণ করেছিলো। সেই গাড়িটার এন্টেনা নামিয়ে রাখা হয়েছে। কার্লোসের সৈনিকেরা মাইক্রোফোন হাতে আর ব্যস্ত নেই। কালো সিডানটার এন্টেনাও নামানো। যোগাযোগ করা হয়ে গেছে। প্রত্যক্ষভাবে দেখাটা নিশ্চিত করা হয়েছে। চারজন লোক। এরা হলো কার্লোসের কামলা।

বর্ন লুভরের সামনে মানুষজনের দিকে মনোযোগ দিলো। সঙ্গে সঙ্গেই অভিজাত পোশাক পরা দাঁজুকে দেখতে পেলো। সে ধীরে ধীরে সতর্কভাবে পায়চারী করছে প্রবেশপথের সিঁড়ির বাম পাশে।

এখন। ভুল তথ্যটা পাঠানোর সময় হয়েছে। “লাইন থেকে বের হয়ে যাও,” জেসন আদেশ করলো।

“কি বললেন, মঁসিয়ে?”

“আমি যা বললাম ঠিক তাই যদি করো তবে তোমাকে আরো দুশো ফ্রাঁ দেবো। সামনের দিকে যাও। তারপর দুটো মোড় নেবে বাম দিকে, পরের সারিতে আবার ফিরে আসবে।”

“আমি বুঝতে পারছি না, মঁসিয়ে!”

“তোমার তো বোঝার দরকারও নেই। তিনশো ফ্রাঁ পাবে।”

ড্রাইভার আর কোনো কথা না ব’লে জেসনের কথামতো কাজ করলো। বর্ন তার অস্ত্রটা কোমর থেকে বের ক’রে নিয়ে সেটা দুই হাটুর মাঝখানে রাখলো। সাইলেন্সারটা চেক্ ক’রে দেখলো।

“আপনি কোথায় যেতে চাচ্ছেন, মঁসিয়ে?” ট্যাক্সিটা ঘুরে আবারো লুভরের প্রবেশপথের দিকে ঢুকতে গেলে বিস্মিত ড্রাইভার বললো।

“আস্তে,” জেসন বললো। “সামনের বিশাল ধূসর রঙের গাড়িটা দেখেছো?”

“অবশ্যই।”

“সেটাকে আস্তে ক’রে ঘুরে আসো ডান দিক দিয়ে।” বর্ন বাম দিকের দরজার কাছে এসে নামিয়ে দিলো জানালাটা। তার মুখ আর অস্ত্রটা লুকিয়ে রাখলো। দুটোই সে উন্মুক্ত করবে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে।

ট্যাক্সিটা সিডানের ঠিক পাশে চলে এলে জেসন অস্ত্রসহ হাতটা বের করলো। ধূসর সিডানটার পেছনের ডান দিকটা লক্ষ্য ক’রে গুলি চালালো সে। পরপর পাঁচটি ভোঁতা শব্দ জানালার কাঁচ গুড়িয়ে ঢুকে গেলো। ভড়কে গিয়ে চিৎকার ক’রে উঠলো ভেতরের দু’জন লোক। তারা নিচু হয়ে গাড়ির মেঝেতে শুইয়ে পড়লো। তবে তারা তাকে দেখে ফেলেছে। এটাই হলো ভুল তথ্য।

“এখান থেকে বের হয়ে যাও!” তিনশো ফ্রাঁ ছুড়ে দিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত ড্রাইভারকে চিৎকার ক’রে বললো জেসন। ট্যাক্সিটা সাঁই ক’রে লুভরের প্রবেশপথ দিয়ে বের হয়ে যেতে লাগলো।

এবার।

জেসন পেছনের দরজাটা খুলে পাথরের মেঝেতে গড়িয়ে নেমে পড়লো। নামার আগে ড্রাইভারকে তার শেষ নির্দেশনাটি দিয়ে গেলো সে। “যদি বাঁচতে চাও তো এখান থেকে এক্ষুণি চলে যাও!”

ট্যাক্সিটা উদভ্রান্তের মতো ছুটতে শুরু করলো। ড্রাইভার চিৎকার করছে। দুটো পার্ক করা গাড়ির মাঝখানে বর্ন ঝাঁপ দিলো। ধূসর সিডান থেকে নিজেকে আড়াল ক’রে ফেললো সে। এবার আস্তে ক’রে উঠে বসলো। গাড়িগুলোর জানালা দিয়ে উঁকি মারলো। কার্লোসের লোকেরা খুব দ্রুত নিজেদের সামলে নিয়েছে। তারা ট্যাক্সিটা দেখতে পেলো। সঙ্গে সঙ্গে তারা শক্তিশালী সিডানটা দিয়ে ওটার পিছু নিতে শুরু করলো। গাড়ির এন্টেনা আবার উঠে গেছে। প্রবেশপথের সিঁড়ির সামনে থাকা অন্য সিডানটাকে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। ট্যাক্সিটা খুব দ্রুত সাইন নদীর তীর ধরে ছুটতে শুরু করলো। তার পেছন পেছন সিডানটাও।

কয়েক মিনিটের ব্যাপার…তার কেবল কয়েক মুহূর্ত সময় আছে যদি তার বিশ্বাস মতো সব কিছু হয়। দাঁজু! কনট্যাক্টটা তার ভূমিকা পালন করেছে—তার ক্ষুদ্র ভূমিকা—আর ঠিক জ্যাকুলিন লাভিয়ার মতো সে পরিত্যাজ্য।

বর্ন দুটো গাড়ির মাঝখান থেকে উঠে কালো রঙের সিডানটার দিকে দৌড়ে গেলো। পঞ্চাশ গজের বেশি দূরত্ব হবে না। সে দু’জন লোককে দেখতে পাচ্ছে। তারা ফিলিপ দাঁজুর দিকে ছুটে যাচ্ছে, সে পায়চারী করছে মার্বেল পাথরের সিঁড়ির পাশেই। একটা অব্যর্থ বুলেট দাঁজুর জীবনটা কেড়ে নেবে। জেসন দ্রুত দৌড়াতে লাগলো। তার ডান হাতটা কোটের পকেটে ঢোকানো, অস্ত্রটা ধ’রে রেখেছে।

কার্লোসের সৈনিকেরা কেবলমাত্র কয়েক গজ দূরে। দাঁজু কিছু বেঝে ওঠার আগেই কাজটা ক’রে ফেলবে তারা।

“মেডুসা!” বর্ন চিৎকার ক’রে বললো। দাঁজু না বলে সে কেন এটা বললো সে জানে না। “মেডুসা — মেডুসা!”

দাঁজু চমকে তাকালো, তার চোখেমুখে আতঙ্ক। কালো সিডানটার ড্রাইভার অস্ত্র বের ক’রে জেসনের দিকে তাক্ করলো এবার। একই সময়ে তার সঙ্গীটি তাক্ করলো দাঁজুর দিকে। বর্ন তার ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। শূন্যের মধ্যেই সে গুলি করলো। তার নিশানা একেবারে নিখুঁত। দাঁজুর দিকে ছুটে আসা লোকটা একটু পিছিয়ে গেলো। তার পা’টা যেনো প্যারালাইজ হয়ে গেছে এমনভাবে টলে মেঝেতে পড়ে গেলো সে। জেসনের মাথার উপর দিয়ে দুটো ভোঁতা শব্দ ছুটে এলো। বুলেট দুটো তার পেছনে স্টিলের মধ্যে বিদ্ধ হলো। সে বাম দিকে গড়িয়ে দ্বিতীয় লোকটার দিকে তাক্ ক’রে পর পর দু’বার সে টুগার টিপলে ড্রাইভার চিৎকার দিলো। তার মুখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে।

লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। চারদিকে দৌড়াদৌড়ি আর হৈহল্লা শুরু হয়ে গেছে। মা-বাবারা বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে লুভরের ভেতরে ছুটে যাবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে সেজন্যে রক্ষীরাও ভেতর থেকে বাইরে বের হতে পারছে না। বর্ন উঠে দাঁড়িয়ে দাঁজুকে খুজলো। বয়স্ক লোকটা মেঝেতে হামাগুঁড়ি দিয়ে সকে পড়ছে লোকজনের ভীড়ের মধ্যে। তার হাতে একটা অস্ত্র। এই লোকটাই তাকে তার প্রশ্নের জবাবটা দিতে পারবে। ট্রেডস্টোন। ট্রেডস্টোন!

সে ধূসর চুলের মেডুসান লোকটার কাছে পৌঁছে গেলো। “উঠে দাঁড়াও!” আদেশের সুরে বললো। “চলো, এখান থেকে বের হই।!”

“ডেল্টা!…সে কার্লোসের লোক! আমি তাকে চিনি, আমি তাকে ব্যবহার করেছি! সে আমাকে খুন করতে চেয়েছিলো!”

“আমি জানি। আসো! দ্রুত! অন্যেরা খুব জলদি এসে পড়বে। তারা আমাদের খুঁজবে। আসো আমার সাথে!”

বর্ন চোখের কোণে কিছু একটা দেখতে পেয়ে ঘুরতেই নিজের অজান্তেই দাঁজুকে ধরে নিচু ক’রে ফেললো। আর সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সি লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা এক কালো অবয়ব তাদের লক্ষ্য ক’রে গুলি চালালো। তাদের চারপাশে মার্বেল আর গ্রানাইটের টুকরো ছড়িয়ে পড়লো। এটা তো সেই লোকটা! প্রশ্বস্ত কাঁধ, সরু কোমর কালো সুট আর কালো টুপি পরা অশ্বেতাঙ্গ লোকটা। কার্লোস!

কার্লোসকে ধরো! তাকে ফাঁদে ফেলো!

ভূয়া!

ট্রেডস্টোন খুঁজে বের করো! একটা মেসেজ খুঁজে বের করো, একজন মানুষের জন্যে! জেসন বর্নকে খুঁজে বের করো!

সে একেবারে পাগল হয়ে যাচ্ছে! ভয়ঙ্কর বর্তমানের সাথে অস্পষ্ট সব ছবি তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে, তাকে একেবারে উন্মাদ ক’রে ফেলছে। তার মনের দরজা খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে। একবার আলো আরেকবার অন্ধকার। তার মাথার তীব্র ব্যথাটা আবার ফিরে এলো। সে সাদা রুমালে মুখ ঢাকা কালো সুট পরা লোকটার পিছু নিলো। এরপরই সে চোখ দুটো আর অস্ত্রের নলটা দেখতে পেলো। তিনটি কালো বৃত্ত তার দিকে লেজার রশ্মির মতো তাক্ করে আছে যেনো। বারগোয়া?…এটা কি বারগোয়া? অথবা জুরিখের… কিংবা…সময় নেই!

সে বাম দিকে একটু ঝুঁকে ডান দিকে ঝাঁপ দিলো গুলির হাত থেকে বাঁচার জন্যে। বুলেটগুলো পাথরে আঘাত করার শব্দ হলে জেসন একটা থামানো গাড়ির নিচে গড়িয়ে চলে গেলো। দু’চাকার মাঝখান দিয়ে সে কালো অবয়বটাকে দৌড়ে চলে যেতে দেখলো। একটু হামাগুঁড়ি দিয়ে গাড়িটার নিচ থেকে বের হয়ে লুভরের সিঁড়ির দিকে দৌড়ে গেলো।

সে একি করলো? দাঁজু চলে গেছে! কিভাবে এটা হলো? পাল্টা ফাঁদটা আসলে কোনো ফাঁদই নয়। তার নিজের কৌশল তার বিরুদ্ধেই ব্যহার করা হয়েছে, তাকে একটা প্রশ্নের জবাব দিতে পারে এরকম এক লোক তার হাত থেকে ফসকে চলে গেছে। সে কার্লোসের সৈনিককে অনুসরণ করেছে, কিন্তু কার্লোস অনুসরণ করেছে তাকে! সেন অনরে থেকেই। তার মধ্যে একটা শূন্যতা জেঁকে বসলো। এরপরই সে কথাগুলো শুনতে পেলো। তার খুব কাছে থাকা একটা গাড়ির পেছন থেকে সেটা বলা হলো। ফিলিপ দাঁজুকে দেখতে পেলো সে।

“তাম কুয়ান কখনও খুব দূরে নয় বলেই মনে হচ্ছে। আমরা এখন কোথায় যাবো, ডেল্টা? আমরা তো এখানে থাকতে পারবো না।”

.

তারা রুই পিলোয়াঁ’র একটা জনাকীর্ণ ক্যাফের পর্দাঘেরা বুথের ভেতর ব’সে আছে। জায়গাটা সরু একটা গলিতে অবস্থিত। দাঁজু তার দ্বিতীয় গ্লাস ব্র্যান্ডিতে চুমুক দিলো। তার কণ্ঠ নিচু আর সতর্ক।

“আমার এশিয়াতে ফিরে যাওয়া উচিত,” সে বললো। “সিঙ্গাপুরে অথবা হংকং-এ কিংবা সেইচিলেসে হতে পারে। ফ্রান্স আমার জন্যে কখনও খুব বেশি ভালো ছিলো না। এখন তো সেটা একেবারে মারণঘাতি হয়ে উঠেছে।”

“তোমাকে হয়তো সেটা নাও করতে হতে পারে,” বর্ন বললো হুইস্কিতে চুমুক দিতে দিতে। “আমি বেশ জোর দিয়েই বলছি। আমি যা জানতে চাই তুমি তা বলবে। আমি তাহলে তোমাকে—” সে থেমে গেলো। তার একটু দ্বিধা হলো। না, তাকে বলতেই হবে। “কার্লোসের পরিচয়টা দিয়ে দেবো।”

“আমি মোটেও আগ্রহী নই,” জেসনকে খুব ভালোভাবে দেখে মেডুসান লোকটা জবাব দিলো। “আমি যা বলার তোমাকে বলবো। কেন আমি চেপে রাখবো? অবশ্যই আমি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কাছে যাবো না। তবে আমার কাছে যদি এমন তথ্য থাকে যাতে ক’রে কার্লোর্সকে ঘায়েল করা যায় আমি সেটা তোমাকে বলবো, এতে ক’রে পৃথিবীটা আমার জন্যে বেশ নিরাপদ হয়ে উঠবে, তাই নয় কি? ব্যক্তিগতভাবে আমি এসবে জড়িত থাকতে চাই না।”

“তুমি একটুও কৌতুহলী নও?”

“হয়তো একাডেমিক্যালি, তোমার চোখের ভাষা ব’লে দিচ্ছে আমি শক্‌ পাবো। সুতরাং আমাকে তোমার প্রশ্নটা করো তারপর আমাকে অবাক কোরো।”

“অবাক নয়, তুমি শক্‌ পাবে।”

আচমকা দাঁজু নামটা বললো। “বারগোয়া?”

জেসন নির্বাক হয়ে লোকটার দিকে চেয়ে রইলো। দাঁজু বলতে শুরু করলো। “আমি এটা অনেকবার ভেবেছি। তার সঙ্গে যখনই আমি কথা বলতাম অবাক হয়ে তাকে দেখতাম। অবশ্য প্রতিবারই আমার এই ভাবনাটি বাতিল ক’রে দিতাম।”

“কেন?” বর্ন জানতে চাইলো।

“মনে রাখবে, আমি নিশ্চিত ছিলাম না—আমার কেবল মনে হোতো এটা ভুল। সম্ভবত আমি অন্য কারোর চেয়ে রেনে বারগোয়াঁর কাছ থেকেই কার্লোসের ব্যাপারে বেশি জেনেছি। সে কার্লোসকে নিয়ে মোহগ্রস্ত ছিলো। অনেক বছর ধরেই সে কার্লোসের হয়ে কাজ করেছে। খুবই আস্থাভাজন তার। সে তাকে নিয়ে অনেক কথা বলতো, এটাই আমার সমস্যা ছিলো।”

“কালোর্স অন্য লোক সেজে নিজের প্রশংসা করতো, অহংবোধ, বুঝলে?”

“এটা সম্ভব, তবে আমি বারগোয়াকে কার্লোস ভাবতে পারতাম না।”

“তুমি নামটা বলেছো, আমি না।”

দাঁজু হাসলো। কোনো কিছু নিয়ে তোমার ভাববার নেই, ডেল্টা। তোমার প্রশ্নটা করো।”

“আমি ভেবেছিলাম এটা বারগোয়াঁই হবে। আমি দুঃখিত।”

“দুঃখিত হয়ো না। হয়তো সে তা হতেও পারে। তবে সেটা আর আমার কাছে কোনো মানে রাখে না। কয়েক দিনের মধ্যে আমি এশিয়ায় ফিরে যাবো। যেভাবেই পারি সেই ব্যবস্থা করতে পারবো। আমরা মেডুসানরা খুবই করিৎকর্মা, তাই না?”

জেসন জানে না কেন, তবে আদেঁ ভিলিয়ার্সের জীর্ণ মুখটা তার চোখে ভেসে উঠলো। সে তাকে কথা দিয়েছিলো সে যা জানবে তা বৃদ্ধকে জানাবে। সে আর সুযোগটা পাবে না।

“ভিলিয়ার্সের বউ কিভাবে খাপ খায়?”

দাঁজু ভুরু তুললো। “এনজেলিক? পার্ক মশিউ’র, তাই না?”

“কিভাবে-”

সেসব আর এখন তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।”

“আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।”

“ভিলিয়ার্সের বউয়ের ব্যাপারটা কি?” বর্ন বললো।

“তুমি কি তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছো? গায়ের রঙ?”

“তার গায়ের রঙ সূর্যের আলোয় পোড়া।”

“সে তার চামড়ার রঙ ওভাবেই রাখতো। রিভিয়েরা, গৃক দ্বীপ, কোস্তা দেল সল জিস্তাদ। জন্মগতভাবেই তার গায়ের রঙ ওরকম।”

“এটা খুবই আকর্ষণীয়।”

“এটা খুব সফল অস্ত্রও বটে। এটা তাকে আড়াল ক’রে রাখে। তার জন্যে কোনো হেমন্ত কিংবা শীত নেই, কোনো ফ্যাকাশে কিংবা বিবর্ণ মুখ নেই। সবসময়ই একই রকম গায়ের রঙ।”

“তুমি কি বলতে চাচ্ছো?”

“যদিও আকর্ষণীয় এনজেলিক ভিলিয়ার্সকে একজন প্যারিসীয় ব’লে ধরে নেয়া হয়, আসলে সে তা নয়। সে একজন হিসপ্যানিক। ভেনেজুয়েলিয়ান।”

“সানচেজ,” ফিসফিস ক’রে বললো বর্ন। “ইলিচ রামিরেজ সানচেজ।”

“হ্যা। বলা হয়ে থাকে সে কার্লোসের চাচাতো বোন এবং চৌদ্দ বছর বয়স থেকে তার প্রেমিকা। একটা গুজব আছে যে, পৃথিবীতে একমাত্র তাকেই কার্লোস পরোয়া করে।”

“আর ভিলিয়ার্স নিজের অজ্ঞাতে তার হাতে ব্যবহৃত হয়?”

“মেডুসার কথা, ডেল্টা?” দাঁজু মাথা নেড়ে সায় দিলো। “হ্যা, ভিলিয়ার্স তাই ছিলো। কালোর্স অসাধারণভাবেই ফরাসি সরকারের খুবই স্পর্শকাতর ডিপার্টমেন্টের ভেতরে তার অনুচরদের অনুপ্রবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। তার নিজের ফাইলের ব্যাপারেও সে বেশ ভালোভাবে অবগত আছে।”

“অসাধারণই বটে,” জেসন বললো। “কারণ এটা একেবারেই অচিন্তনীয়।”

“একদম।”

বর্ন একটু সামনে ঝুঁকে এসে মদের গ্লাসটা দু’হাতে ধরে বললো, “ট্ৰেডস্টোন। এবার আমাকে ট্রেডস্টোন সেভেনটি ওয়ান সম্পর্কে বলো।”

“আমি কি আর বলতে পারবো?”

“তারা যা জানে সব। কার্লোস যা জানে সবটা।”

“আমার মনে হয় না আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবো। আমি এ সম্পর্কে শুনেছি। টুকরো টুকরো কিছু। কেবল মেডুসা সম্পর্কিত খবরগুলোতে আগ্রহ দেখিয়েছি।”

“তুমি কি শুনেছো? টুকরো টুকরো খবরগুলো জোড়া লাগিয়ে বলো, কি শুনেছো?”

“আমি যা শুনেছি, যা বুঝেছি সেটা সবসময় সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তারপরও আমার কাছে মনে হয়েছে কথাগুলো সত্য।”

“যেমন?”

“যখন আমি তোমাকে দেখেছি আমি বুঝেছিলাম। ডেল্টা আমেরিকানদের সাথে একটা লোভনীয় চুক্তি করেছিলো। আরেকটা লোভনীয় চুক্তি, আগেরটার চেয়ে আলাদা, সম্ভবত।”

“খুলে বলো।”

“এগারো বছর আগে, সায়গনে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছিলো যে, ঠাণ্ডা মাথার ডেল্টা হলো মেডুসানদের মধ্যে সবচাইতে উচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত। অবশ্যই তুমি সবচাইতে বেশি যোগ্য ছিলে বলেই আমি জানতাম। তাই ধরে নিচ্ছি তুমি নিজের মূল্য নিয়ে দরকষাকষি করেছিলো। তুমি এখন যা করছো তার চেয়েও কঠিন কিছু করেছিলে।”

“যেমন? তুমি যা শুনেছিলে তা থেকে বলো।”

“আমরা যা জানি সন্ন্যাসী সেটা মারা যাবার আগে নিশ্চিত ক’রে গেছে, এটাই কেবল তোমাকে বলতে পারি। এর সাথে আগের প্যাটার্নগুলোর মিল রয়েছে।”

বর্ন মদের গ্লাসটা তুলে ধরে দাঁজুর দৃষ্টি এড়ালো। সন্ন্যাসী। জিজ্ঞেস করো না। সন্ন্যাসী মারা গেছে। সে যেই হোক না কেন, এখন আর সে প্রাসঙ্গিক নয়। “আমি আবারো বলছি,” জেসন বললো। “আমি কি করছি ব’লে তারা মনে করছে?”

“আরে ডেল্টা, আমি চলে যাচ্ছি। এটা উদ্দেশ্যবিহীন—”  

“প্লিজ,” বর্ন বাঁধা দিয়ে বললো।

“বেশ। তুমি কেইন হতে রাজি হলে। একজন কাল্পনিক খুনি, সীমাহীন খুনের চুক্তির তালিকা রয়েছে যার কোনো অস্তিত্বই নেই। কালোর্সকে চ্যালেঞ্জ করা এবং সেই সূত্রে তাকে টোপ দিয়ে কাছে টেনে এনে ঘায়েল করাই ছিলো একমাত্র উদ্দেশ্য। এটা ছিলো আমেরিকানদের সাথে তোমার চুক্তি।”

বর্নের মনের দরজাটা খুলে গেলো। কিন্তু খুব দূরে। তারপরও গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে একটু আলো উঁকি দিচ্ছে।

“তাহলে আমেরিকানরা হলো—” বর্ন কথাটা শেষ করলো না এই আশায় যে,  বাকিটা দাঁজু নিজেই শেষ করবে।

“হ্যা,” মেডুসান বললো। “ট্রেডস্টোন সেভেনটি-ওয়ান। স্টেট ডিপার্টমেন্ট- এর কনসুলার অপারেশনের পর আমেরিকান ইন্টেলিজেন্সের সবচাইতে নিয়ন্ত্রিত ইউনিট। যে ব্যক্তি মেডুসা সৃষ্টি করেছিলো সেই একই ব্যক্তি এটি তৈরি করেছে। ডেভিড অ্যাবোট।”

“সন্ন্যাসী,” জেসন আস্তে ক’রে বললো আপন মনে। তার মনের আরেকটা দরজা খুলে যাচ্ছে।

“অবশ্যই। সে ছাড়া আর কে মেডুসায় ডেল্টা হিসেবে পরিচিত একজনকে কেইনের ভূমিকা নেবার জন্যে বলতে পারতো? যেমনটি বলেছি, তোমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম সেটা।”

“একটা ভূমিকা—” বর্ন থেমে গেলো। আলোটা আরো তীব্র হলো। উষ্ণ কিন্তু চোখ ঝলসানো নয়।

দাঁজু একটু সামনের দিকে ঝুঁকে এলো। “এসবই আমি শুনেছি। এটা বলা হয় যে, জেসন বর্ন যে কারণে এসাইনমেন্টটা নিয়েছিলো ব’লে আমি জানতাম সেটা সত্যি নয়। আমি সেখানে ছিলাম। তারা ছিলো না। তারা সেটা জানতে পারবে না।”

“তারা কি বলে? তুমি কি শুনেছো?”

“তুমি একজন আমেরিকান ইন্টেলিজেন্স অফিসার, সম্ভবত মিলিটারির। তুমি কি ভাবতে পারো? তুমি। ডেল্টা! আমি বারগোয়াকে বলেছিলাম এটা অসম্ভব, তবে আমি নিশ্চিত নই সে আমার কথাটা বিশ্বাস করেছে কিনা।”

“তুমি তাকে কি বলেছিলে?”

“যা আমি বিশ্বাস করি। যা আমি এখনও বিশ্বাস করি। এটা টাকার জন্যে নয়—যতো টাকাই হোক না কেন, এই কাজটা তুমি টাকার জন্যে করতে রাজি হও নি—অবশ্যই অন্য কিছু আছে। এগারো বছর আগে অনেকে যে কারণে মেডুসায় এসেছিলো তুমি ঠিক একই কারণে এটা করেছো। তোমার কাছে আগে কিছু ছিলো এরকম কোনো কিছু ফিরে পাবার জন্যে কোথাও কোনো দলকে শেষ ক’রে দেয়ার জন্যে। আমি জানি না। আর আমি আশাও করি না তুমি এটা নিশ্চিত করবে। তবে সেটাই আমি ভাবছি।”

“তোমার কথা ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে,” জেসন বললো। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঠাণ্ডা হিমশীতল বাতাস তার চারপাশের কুয়াশা সরিয়ে দিচ্ছে। এসব কথাবার্তা যৌক্তিক বলেই মনে হচ্ছে তার কাছে। একটা মেসেজ পাঠানো হয়েছে। এটা হতে পারে সেই মেসেজটা। প্রেরককে খুঁজে বের করো। ট্রেডস্টোন খুঁজে বের করো!

“যা আমাদেরকে ডেল্টার কাহিনীতে ফিরিয়ে আনে,” দাঁজু আবার বলতে লাগলো। “সে কে? সে কি? এই শিক্ষিত, শান্ত মানুষটি গভীর অরণ্যে নিজেকে একটি মারাত্মক অস্ত্রে রূপান্তর করে ফেললো। আমরা কখনও সেটা বুঝবো না।”

“এ ছাড়া আর কিছু কি তুমি বলতে পারো? তারা কি ট্রেডস্টোন-এর সঠিক ঠিকানা জানে?”

“অবশ্যই। আমি বারগোয়ার কাছ থেকে সেটা জেনেছি। নিউইয়র্ক সিটির ইস্ট সেভেনটি-ওয়ান স্ট্রটের একটি বাড়ি। যার নাম্বার ১৩৯। এটা কি ঠিক নয়?”

“সম্ভবত…আর কিছু?”

“একমাত্র তুমি যেটা জানো, কৌশলটা। যা আমি ধরতে পারি নি।”

“যেমন?”

“আমেরিকানরা মনে করে তুমি চোখ পাল্টিয়েছো, মানে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো। ভালোভাবে বলতে গেলে, তারা চায় কার্লোস বিশ্বাস করুক তুমি চোখ পাল্টিয়েছো।

“কেন?” সে খুব কাছে এসে পড়েছে। এই তো সেটা!

“কেইন দীর্ঘ দিন ধরে নিরব ছিলো, তারপর তহবিল চুরি করলো, তবে প্রধাণত নিরবতা।”

এটাই সেই মেসেজটা। নিরবতা। পোর্ত নোয়ের কয়েকটা মাস। জুরিখের হট্টগোলটা। প্যারিসের উন্মাদগ্রস্ততা। কেউ জানে না আসলে কি ঘটেছিলো। তাকে বলা হচ্ছিলো বের হয়ে আসার জন্যে। প্রকাশ্য হতে। তুমি ঠিক বলেছো মেরি। আমার ভালোবাসা। তুমি শুরু থেকেই ঠিক ব’লে আসছো।

“তাহলে আর কিছু নেই?” বর্ন জানতে চাইলো। নিজের কণ্ঠের অধৈর্য ভাবটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো। সে এখন মেরির কাছে ফিরে যাবার জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে।

“আমি এ-ই জানি—তৱে দয়া ক’রে বোঝার চেষ্টা করো আমাকে খুব বেশি বলা হয় নি কখনও। আমাকে নিয়ে আসা হয়েছে কারণ আমার মেডুসার ব্যাপারে জ্ঞান রয়েছে—আর এটা প্রতিষ্ঠিত যে কেইন মেডুসা থেকে এসেছে—তবে আমি কখনই কার্লোসের ইনার সার্কেলের অংশ ছিলাম না।”

“তুমি যথেষ্ট কাছাকাছি ছিলে। ধন্যবাদ তোমাকে।” জেসন কিছু ফরাসি মুদ্রা টেবিলে রেখে বুথ থেকে বের হতে উদ্যত হলো।

“আরেকটা ব্যাপার আছে,” দাঁজু বললো। “আমি নিশ্চিত নই এটা প্রাসঙ্গিক হবে কিনা, তবে তারা জানে তোমার নাম জেসন বর্ন নয়।”

“কি?”

“২৫শে মার্চ। তুমি কি মনে করতে পারছো না? মাত্র দু’দিন বাকি আছে। এই দিনটি কার্লোসের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কথাটা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সে পচিশে মার্চে তোমার লাশ চায়। সেদিন সে লাশটা আমেরিকানদের কাছে পাঠাতে চায়।”

“তুমি কি বলতে চাচ্ছো?”

“১৯৬৮ সালের ২৫শে মার্চে জেসন বর্নকে তাম কুয়ানে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিলো। তুমি তাকে হত্যা করেছিলে।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *