পর্ব ১
পর্ব ২
পর্ব ৩

বর্ন আইডেন্টিটি – ৩

অধ্যায় ৩

ফরাসি উপকূলে কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না; ম্রিয়মান চাঁদের আলোয় কেবল তটরেখাটা দৃশ্যমান। তারা স্থলভাগ থেকে মাত্র দুশো গজ দূরে আছে এখন। মাছ ধরার ট্রলারটা আস্তে আস্তে ঘর্ঘর্ শব্দ করতে করতে থেমে গেলে ক্যাপ্টেন উপকূলের দিকে ইশারা করলো।

“ঐখানে, দুটো পাহাড়ের মাঝখানে একটা সৈকত আছে। খুব বড় নয়, ডান দিক দিয়ে সাঁতার কাটলে সহজেই পৌঁছে যাবে। আমরা বড়জোড় আরো ত্রিশ- চল্লিশ গজ ভেতরে যেতে পারি, এর বেশি নয়।”

“আমার প্রত্যাশার চেয়েও আপনি বেশি করছেন। এজন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।”

“তার কোনো দরকার নেই। আমি আমার ঋণ শোধ করেছি।”

“আমাকে সাহায্য করে?”

“অবশ্যই। পোর্ত নোয়ে’র ডাক্তার সাহেব পাঁচমাস আগে সেই ঝড়ের রাতে আমার তিনজন আহত ক্রু’কে চিকিৎসা দিয়েছিলেন। কেবল তোমাকেই তার ওখানে নিয়ে আসা হয় নি, বুঝলে।”

“ঝড়ের কথা বলছেন? আপনি আমাকে চেনেন?”

“তোমাকে ডাক্তারের টেবিলের উপর একেবারে চকের মতো সাদা দেখেছি। তবে আমি তোমাকে চিনি না চিনতে চাইও না। তখন আমি কোনো মাছ ধরতে পারি নি। আমার কাছে কোনো টাকাও ছিলো না। ডাক্তার বলেছিলেন, আমার যখন সক্ষমতা হবে তখন যেনো তার ঋণ পরিশোধ ক’রে দেই। তুমি হলে আমার ঋণ শোধ।”

“আমার কিছু কাগজপত্র লাগবে,” সাহায্য পাওয়া যাবে টের পেয়ে রোগীটি বললো। “আমার একটা পাসপোর্ট দরকার।”

“আমাকে বলছো কেন?” বললো ক্যাপ্টেন। “আমি একটা প্যাকেজ লা সিওতাতের দক্ষিণে রেখে দিয়ে আসবো ব’লে কথা দিয়েছি। কেবল এটাই বলেছি আমি।”

“আপনি কিন্তু এটা বলেন নি, আপনি অন্য কোনো সাহায্য করতে পারবেন না।”

“আমি তোমাকে মার্সেই’তে নিয়ে যেতে পারবো না। পেট্রলবোটের কাছে ধরা খাওয়ার কোনো ঝুঁকি আমি নেবো না। ফরাসি সুরেত গার্ডরা কড়া নজর রাখে সব জায়গায়। আর মাদকদ্রব্য বিরোধী টিমটা তো একেবারে উন্মাদই বলা যায়। হয় তুমি তাদেরকে টাকা দেবে নয়তো বিশ বছর জেলের ভাত খাবে।”

“তার মানে আমি মার্সেই থেকে কাগজপত্র জোগাড় করতে পারবো। আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন।”

“আমি কিন্তু সেটা বলি নি।”

“হ্যা, আপনি বলেছেন। আমার যেখানে গেলে কাজ হবে সেখানে আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন না—যদিও ওখানে গেলেই কাজটা হবে। আপনি এটাই বলেছেন।”

“বলেছি কি?”

“বলেছেন, আপনি মার্সেই’তে আমার সাথে কথা বলবেন— যদি আমি আপনাকে ছাড়া ওখানে যাই। শুধু বলুন, কোথায়?”

ক্যাপ্টেন রোগীর চেহারা ভালো ক’রে লক্ষ্য করলো। সিদ্ধান্তটি হালকভাবে নেয়া হলো না। “রুই সারাসিনে একটা ক্যাফে আছে। পুরনো হার্বারের দক্ষিণ দিকে লো চোখ দ্য মার। আজ রাত নয়টা থেকে এগারোটার মধ্যে আমি সেখানে থাকবো। কিছু টাকা লাগবে। অগ্রীম দিতে হবে।”

“কতো?”

“সেটা তুমি এবং যে লোকটার সাথে কথা বলবে সেই দু’জন ঠিক ক’রে নেবে।”

“আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।”

“তোমার কাছে কোনো ডকুমেন্ট থাকলে সস্তায় কাজ হবে, তা না হলে কারো কাছ থেকে সেটা চুরি করতে হবে।”

“আমি তো আপনাকে বলেছিই, আমার কাছে ওরকম একটা আছে।”

ক্যাপ্টেন কাঁধ ঝাঁকালো। “পনেরোশ’, মানে দু’হাজার ফ্রাঁ। আমরা কি সময় নষ্ট করছি?”

রোগী তার কোমরে জড়ানো কাপড়টার কথা ভাবলো। এটা খরচ করলে মার্সেই’তে একেবারে ফতুর হয়ে যাবে সে। তবে সেটা দিয়ে একটা পাসপোর্ট আর জুরিখের ব্যাংকের ভল্টও খোলা যাবে। “তাহলে আজ রাতে দেখা হচ্ছে,” সে বললো।

মৃদু আলোর উপকূলের দিকে তাকালো ক্যাপ্টেন। “এ পর্যন্ত আমরা যেতে পারি, এর বেশি না। এখন নিজের পথ নিজে দ্যাখো। মনে রেখো, তুমি যদি মার্সেই’তে আমার সাথে দেখা না করো, তবে আমাকে আর তুমি কখনও দেখতে পাবে না, আমিও তোমাকে কখনও দেখতে পাবো না। আমার কোনো ক্রু’ও তোমাকে কখনও আর দেখবে না।”

“আমি ওখানে থাকবো। লো চোখ দ্য মার, রুই সারাসিন, পুরনো হারবারের দক্ষিণে।”

“সব ঈশ্বরের হাতে,” ক্যাপ্টেন বললো। হুইলে থাকা এক ক্রু’কে ইশারা করলে ট্রলারটার ইঞ্জিন চালু হয়ে গেলো। “ভালো কথা, লো চোখ-এর ঐ লোকটা প্যারিসের টানে কথা বলতে অভ্যস্ত নয়। তোমার জায়গায় আমি হলে সেটাকে একটু গ্রাম্য ক’রে নিতাম।”

“উপদেশের জন্যে ধন্যবাদ,” রোগীটি এ কথা বলেই পানিতে নেমে পড়লো। সে তার কাপড়ের পুটুলিটা এক হাতে নিয়ে পানির উপর তুলে রাখলো যাতে ভিজে না যায়। নিজের পা দুটো কাঁচির মতো ব্যবহার ক’রে শরীরটা ভাসিয়ে রাখলো সে। “আজ রাতে দেখা হচ্ছে,” কালো রঙের বিশাল ট্রলারটাকে আস্তে আস্তে দূরে সরে যেতে দেখে চিৎকার ক’রে সে বললো।

কেউ নেই। ক্যাপ্টেন রেলিং থেকে চলে গেছে। কেবল ঢেউ আর ইঞ্জিনের শব্দই শোনা যাচ্ছে এখন।

এখন তুমি তোমার নিজের পথে নেমে গেছো।

ঠাণ্ডা পানি তার শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিলো। আস্তে আস্তে ডান দিকে সাঁতার কেটে উপকূলের দিকে যেতে লাগলো সে।

.

এক সময় পায়ে বালুর স্পর্শ পেলো। পাড়ি দেবার জন্যে শেষ ত্রিশ গজ দূরত্বটা খুব বেশি কষ্টকর হলো তার জন্যে। তা সত্ত্বেও হাতের কাপড়ের পুটলিটা একটুও ভিঁজে গেলো না।

কয়েক মিনিট পর, ঘাস্ত্রের উপর বসে আছে সে। সকালের প্রথম আলো আকাশে উঁকি ঝুঁকি মারছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সূর্যোদয় হবে। তাকেও রওনা দিতে হবে তখন।

পুটলিটা খুলে একজোড়া বুট, মোজা, ট্রাউজার আর মোটা জিন্সের একটা শার্ট বের করলো। তার অতীতে সে খুব অল্প জায়গায় বেশি সংখ্যক কাপড়চোপড় ভাঁজ ক’রে রাখার বিদ্যেটা শিখেছিলো। পুটলিটার মধ্যে যতোটুকু কাপড় থাকার কথা তার চেয়েও অনেক বেশি রাখা আছে। এসব সে কোত্থেকে শিখেছে? কেন? প্রশ্নগুলো কখনই থামছে না।

ভেঁজা কাপড়গুলো ঘাসের উপর মেলে রাখলো শোকাবার জন্যে। সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সৈকতে। তার পেটে এক ধরণের যন্ত্রণা আর অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। যন্ত্রণাটা ভয়ের, সে জানে। উত্তেজনাটাও বুঝতে পারলো সে।

প্রথম পরীক্ষায় সে পাস করেছে। এক ঘণ্টা আগেও তার সামনে নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য ছিলো না। কেবল জানতো জুরিখই হলো তার লক্ষ্য। কিন্তু এটাও জানতো সেজন্যে কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট করেই কিছু সীমান্ত অতিক্রম করতে হবে তাকে। আট বছরের পুরনো একটা পাসপোর্ট, সেটাও আবার নিজের নয়, এটা তো যেকোনো মাথা মোটা ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে এক পলকেই ধরা পড়ে যাবে। আর সে যদি তা দিয়ে সুইজারল্যান্ডে কোনোভাবে ঢুকেও যেতে পারে, তাকে তো আবার ওখান থেকে বের হতে হবে। তার ঝুঁকি অনেক গুণ বেড়ে যাবে তাতে। এটা সে হতে দিতে পারে না। এখন তো নয়ই। যতোক্ষণ না সে নিজের পরিচয়টা জানে। উত্তরটা জুরিখে আছে, তাকে মুক্তভাবে ভ্রমণ করতে হবে। সে একজন ক্যাপ্টেনকে এই কাজটা সম্ভব করার জন্যে রাজি করিয়েছে।

তুমি অসহায় নও। তুমি তোমার পথ খুঁজে নেবে।

দিন শেষ হবার আগেই সে ওয়াশবার্নের পাসপোর্ট বদলে নেবে কোনো পেশাদার লোকের সাহায্যে, সেটা দিয়ে ভ্রমণের একটা লাইসেন্স ক’রে নেবে। এটা হবে প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু তার আগে টাকার কথাটা এসে যায়। ডাক্তারের দেয়া দু’হাজার ফ্রাঁ একেবারেই অপ্রতুল। এ দিয়ে একটা পাসপোর্টও করা যাবে না। খালি একটা লাইসেন্স দিয়ে কিভাবে ভ্রমণ করা যাবে?

টাকা। তাকে টাকা যোগাড় করতে হবে। এ নিয়ে ভাবতে হবে তাকে।

পুটলি থেকে বের করা পোশাকগুলো ঝেড়ে নিয়ে পরে ফেললো। বুট জোড়া পায়ে দিয়ে বালুর উপর সটান শুয়ে পড়ে আকাশের তারা দেখতে লাগলো সে। আকাশটা আস্তে আস্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। দিনের জন্ম হচ্ছে, যেমনটি হচ্ছে তার।

.

লা সিওতাতের সংকীর্ণ পথ ধরে সে হাটছে। দোকানে দোকানে ঢুকে ক্লার্কদের সাথে কথা বললো। লোকজনের ভীড়ের মধ্যে তার এক ধরণের অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। তার মনে পড়ে গেলো ক্যাপ্টেনের উপদেশ বাণীটা, তাই নিজের ফরাসিটা একটু ভেজাল ক’রে নিলো সে। এর ফলে নিজেকে শহরের একজন বৈশিষ্ট্যহীন, সাধারণ অচেনা ব্যক্তি হিসেবে প্রতিপন্ন করতে পারবে।

টাকা।

লা সিওতাতের একটা অংশে বেশ ধনীরা থাকে। দোকানগুলো ঝকঝকে পরিস্কার আর জমকালোভাবে সাজানো। মাছগুলো টাটকা, মাংসগুলোও সুন্দর ক’রে কেটে রাখা হয়েছে। এমনকি তরিতরকারিগুলোও চকচক করছে। অনেক অজ্ঞাত জিনিস উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে রপ্তানী ক’রে আনা হয়েছে। এলাকাটা যেনো এক টুকরো প্যারিস। ছোট্ট একটা সুন্দর ক্যাফে দেখা যাচ্ছে, যার লনটা খুবই সুন্দর ক’রে সাজানো।

টাকা।

একটা কসাইর দোকানে ঢুকলে বুঝতে পারলো দোকানী তার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করছে। তার চার্নিটাও বন্ধুসুলভ নয়। লোকটা মধ্যবয়সী এক দম্পতির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

“গত সপ্তাহের গরুর মাংসটা মোটেই ভালো ছিলো না,” মহিলা বললো। “এবারেরটা দেখেশুনে দেবেন, তা না হলে আমি মার্সেই থেকে অর্ডার দিতে বাধ্য হবো।”

“আরেক দিন রাতে মার্কুইজ আমাকে বলেছে খাসির মাংসের টুকরোগুলো নাকি বেশি পাতলা ছিলো। সোয়া এক ইঞ্চির মতো ছিলো ওগুলো।”

মালিক লোকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঁধ ঝাঁকালো, একেবারে ক্ষমাপ্রার্থী আর আশ্বস্ত করার ভঙ্গী করলে মহিলা তার স্বামীর দিকে ফিরলো।

“প্যাকেজগুলোর জন্যে অপেক্ষা করো, ওগুলো গাড়িতে নিয়ে রাখো। আমি মুদি দোকানে গেলাম। ওখানে এসো।”

“অবশ্যই, মাই ডিয়ার।”

মহিলা চলে গেলো। দরজার বাইরে যেতেই মহিলার স্বামী দোকানের মালিকের দিকে তাকালো। তার ভাবসাব একেবারে বদলে গেছে এখন। হম্বিতম্বি ভাবটা চলে গিয়ে দাঁত বের করা হাসির দেখা মিললো।

“আর সব দিনের মতোই, তাই না মার্সেল?” সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের ক’রে বললো সে।

“মাংসের টুকরোগুলো কি আসলেই খুব পাতলা ছিলো?”

“হায় ঈশ্বর, মোটেই না। তবে আমার বউ মনে করে অভিযোগ করলে পরের বার আরো ভালো পাওয়া যাবে। বোঝোই তো।”

“শালার মার্কুইস এখন কোথায় আছে?”

“পাশের বাড়িতে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে আছে। তুলোন থেকে আসা কোনো পতিতার জন্যে অপেক্ষা করছে সে। আমি বিকেলে গিয়ে তাকে তুলে আনবো, তারপর আস্তাবলে নিয়ে যাবো। নিজের গাড়িটা পর্যন্ত চালাতে পারবে ব’লে মনে হয় না। সে জ্যঁ পিয়েরের রান্নাঘরের ঘরটা ব্যবহার করছে, জানো।”

“শুনেছি।”

জ্যঁ পিয়েরে নামটি উল্লেখ করতেই ওয়াশবার্নের রোগীটি পোলট্রির ডিসপ্লে থেকে চোখ সরিয়ে তাদের দিকে তাকালো। এটা স্বয়ংক্রিয় একটি প্রতিক্রিয়া। কিন্তু এই চমকানোর ফলে কসাই কেবল তার উপস্থিতিটা টের পেলো।

“কি হয়েছে? কি চাচ্ছেন আপনি?”

সময় হয়েছে তার ফরাসিটা একটু দুর্বলভাবে বলার। “নাইসের এক বন্ধু আমাকে আপনার কথা বলেছে,” রোগীটি বললো, তার বাচনভঙ্গী লো চোখ দ্য মারের চেয়ে কুয়ে দরসি বলেই বেশি মনে হচ্ছে।

“ওহ্?” দোকান মালিকের ভাবভঙ্গী সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেলো। তার কিছু ক্রেতার মধ্যে, বিশেষ ক’রে তরুণ-যুবকেরা নিজেদের স্ট্যাটাসের বিপরীত পোশাক পরে থাকে। সাধারণ বাস্ক শার্ট আজকাল ফ্যাশন হয়ে উঠেছে। “আপনি এখানে নতুন, স্যার?”

“আমার বোটটা রিপেয়ার করা হচ্ছে, আজ রাতে মার্সেই’তে পৌঁছাতে পারবো ব’লে মনে হচ্ছে না।”

“আমি কি আপনার কোনো কাজে লাগতে পারি?”

রোগীটি হাসলো। “আপনি হয়তো বাবুর্চির কাজে লাগতে পারেন, আমি সেটা বলতে পারছি না। একটু পরেই সে এখানে এসে পৌঁছাবে, এখানে আমার কিছু ক্ষমতাশালী পরিচিত লোকজন আছে।”

কসাই আর বন্ধুটি হেসে ফেললো। “আমিও সেরকমই মনে করি, স্যার,” দোকানি বললো।

“আমার দরকার এক ডজন কচি হাঁসের মাংস আর আঠারোটি শ্যাঁতুব্রাইয়ে।”

“অবশ্যই।”

“ভালো। আমি আমার ছেলেটাকে সরাসরি আপনার কাছে পাঠিয়ে দেবো।” রোগীটি মধ্যবয়সী লোকটার দিকে ফিরলো। “ভালো কথা, আপনাদের কথা আমার কানে এসেছে, আমার কিছু করার ছিলো না…তবে এ নিয়ে অতোটা ভাববেন না। আপনরা কি মার্কুইস দামবোয়ের সেই গাধাটার কথা বলছিলেন? আমার মনে হয় কেউ আমাকে বলেছে সে এখানে, আশেপাশে কোথাও থাকে।”

“ওহ্, তা নয়, স্যার,” চাকর লোকটি বললো। “আমি মারকুইস দামবোয়েকে চিনি না। আমি মারকুইস দ্য শামফোর্দের কথা বলছিলাম। সে খুবই চমৎকার একজন ভদ্রলোক, স্যার। তবে তার সমস্যা আছে। খুবই কঠিন একটি বিয়ে, স্যার। খুবই কঠিন। এটা লুকোছাপার কোনো বিষয় নয়।”

“শামফোর্দ? হ্যা, আমার মনে হয় এর আগে আমাদের দেখা হয়েছিলো। একটু বেটে লোকটা, তাই না?”

“না স্যার, খুবই লম্বা। আপনার মতোই হবে।”

“তাই নাকি?”

.

দোতলার ক্যাফেটার বিভিন্ন প্রবেশপথ আর সিঁড়িগুলো খুব দ্রুত দেখে নিলো ওয়াশবার্নের রোগীর কুভোয়ার একজন ডেলিভারিম্যান সে, ঠিকানাটা নিয়ে খুবই দ্বিধান্বিত সে। একটা রান্নাঘর থেকে দ্বিতীয় তলার যাবার জন্যে দুটো সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে। অন্যটা সামনের ফয়ারের ঠিক পাশেই। এটা কাস্টমাররা দোতলায় গিয়ে হাত ধোয়ার জন্যে ব্যবহার ক’রে থাকে। ওখানে একটা জানালাও আছে, যা দিয়ে কেউ ইচ্ছে করলেই বাইরে থেকে এই সিঁড়িটা যে ব্যবহার করবে তাকে দেখতে পারবে। রোগীটি নিশ্চিত হলো, সে যদি খুব বেশি সময় ধরে এখানে অপেক্ষা করে তবে সে দু’জন লোককে সেটা ব্যবহার করতে দেখবে।

তারা সন্দেহাতীতভাবেই আলাদা আলাদাভাবে উপরে যাবে। তাদের কেউই হাত ধোবার ঘরে যাবে না, যাবে রান্নাঘরের উপরে শোবার ঘরে। রোগীটি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো বাইরে পার্ক ক’রে রাখা কোন্ গাড়িটা মারকুইস দ্য শামফোর্দের হতে পারে।

টাকা।

মেয়েটা এসে পৌঁছালো একটা বাজার ঠিক একটু আগেই। তার চুলগুলো একেবারে সাদা ধবধবে। তার বিশাল বক্ষ নীল রঙের সিল্কের ব্লাউজ উপচে পড়ছে যেনো। লম্বা পায়ে স্পাইকের হিল জুতো। আঁটোসাঁটো সাদা স্কার্ট। শামফোর্ডের হয়তো সমস্যা রয়েছে, তবে মেয়েটারও রুচি আছে।

বিশ মিনিট বাদে সে জানালা দিয়ে সাদা রঙের স্কার্টটা দেখতে পেলো। মেয়েটা দোতলায় উঠছে। ষাট সেকেদন্ডরও কম সময় বাদে আরেকজন লোক জানালার ফ্রেমে দেখা গেলো। কালো রঙের ট্রাউজার আর ব্লেজার পরা, সতর্কভাবে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। রোগীটি সময় গুনতে লাগলো। আশা করলো মার্কুইসের কাছে একটা হাতঘড়ি থাকবে।

তার ক্যানভাস ঝোলাটা কোমরে বেঁধে নিয়ে রোগীটি রেস্তোরাঁর প্রবেশপথের দিকে পা বাড়ালো। ভেতরে ঢুকে ফয়ারের বাম দিকে মোড় নিলো সে। সিঁড়ি দিয়ে ধীরেসুস্থে উঠতে থাকা এক বয়স্ক লোককে মাফ করবেন ব’লে অতিক্রম ক’রে গেলো। দ্বিতীয় তলায় উঠেই বাম দিকে মোড় নিলো আবার। সেখানে একটা করিডোর দিয়ে ভবনের পেছনে রান্নাঘরের উপরে চলে এলো। হাত ধোয়ার ঘরটা পেরিয়ে সংকীর্ণ একটা হলওয়ের শেষ মাথায় থাকা বন্ধ একটা দরজার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে পড়লো সে। দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালো। বয়স্ক লোকটা হাত ধোয়ার ঘরে ঢোকার জন্যে অপেক্ষা করছে। তারপর লোকটা যখন প্যান্টের জিপার খুলতে যাচ্ছে তখনই দরজাটা আস্তে ক’রে খুলে ফেললো সে।

রোগীটি কোনোরকম ভাবনা চিন্তা না করেই তার পুটলিটা তুলে দরজার প্যানেলের উপর রাখলো। দু’হাতে ওটা ধরে রেখে একটু পিছিয়ে গিয়ে তড়িৎ গতিতে নিজের বাম কাঁধ দিয়ে সেই পুটলিটাতে প্রচণ্ড শক্তিতে আঘাত করলো সে। দরজাটা সটান খুলে গেলে ডান হাতটা দিয়ে দরজাটা সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেললো যাতে দেয়ালে গিয়ে সেটা আঘাত না করে। নিচের রেস্তোরাঁর কেউই এই মৃদু শব্দটি শুনতে পেলো না। বুঝতে পারলো না অযাচিতভাবে একজন প্রবেশ করছে

“নম দ্য দিউ!” মহিলা কাঁপতে কাঁপতে বললো, “কুয়ে ইস্ত সে…”

“চুপ করুন।”

মারকুইস দ্য শামফোর্দ সাদা চুলের মহিলার নগ্ন শরীরের উপর থেকে এক ঝটকায় পল্টি খেয়ে বিছানার শেষ প্রান্তে চলে গেলো। সেখান থেকে একেবারে মেঝেতে। তাকে দেখে কমিক বইয়ের চরিত্রের কথাই মনে পড়বে। এখনও শার্ট, হাটু পর্যন্ত মোজা আর টাই পরে আছে। এই পর্যন্তই। তার শরীরে এর বেশি আর কিছু নেই। মহিলা চাদর টেনে নগ্ন শরীরটা ঢেকে ফেললো। এই বাজে অবস্থাটা যতোদূর সম্ভব ভদ্রস্থ করার চেষ্টা করলো সে।

রোগীটি সঙ্গে সঙ্গে একটা আদেশ জারি করলো। “জোরে কথা বলবে না। আমি যেমনটি বললাম ঠিক সেরকম করলে কারো কোনো ক্ষতি হবে না।”

“আমার বউ তোমাকে ভাড়া করেছে!” শামফোর্দ আর্তনাদ ক’রে বললো। তার গলা কাঁপছে, চোখ দুটো কুতকুত করছে। “আমি তোমাকে তার চেয়েও বেশি টাকা দেবো!”

“ভালোই বলেছো,” ডা: ওয়াশবার্নের রোগী জবাবে বললো। “তোমার শার্ট আর টাইটা খুলে ফেলো। মোজাগুলোও।” সে মারকুইসের হাতে চকচকে সোনার একটা ব্যান্ড দেখতে পেলো সে। “হাত ঘড়িটাও।”

কয়েক মিনিটের মধ্যেই অদলবদলের কাজটি সম্পূর্ণ হয়ে গেলো। মারকুইসের পোশাক-আশাকগুলো একেবারে ফিট না হলেও ওগুলো যে খুব দামি সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ঘড়িটা গিরাদ পেরেগোঁয়া কোম্পানির, আর শামফোর্ডের পকেটে তেরো হাজার ফ্রাঁ আছে। গাড়ির চাবিটা আরো বেশি চমৎকার।

“ঈশ্বরের দোহাই, তোমার কাপড়গুলো আমাকে দাও!” মারকুইস বললো।

“আমি দুঃখিত, এটা আমি করতে পারবো না,” অনুপ্রবেশকারী জবাব দিলো। সাদা চুলের মেয়েটির আর নিজের কাপড়চোপড়গুলো এক সঙ্গে জড়ো করলো সে।

“তুমি আমারগুলো নিতে পারো না!” চিৎকার ক’রে বললো মহিলা।

“আমি তো বলেছিই, জোরে কথা বলবে না।”

“ঠিক আছে, ঠিক আছে,” মহিলা আবার বলতে লাগলো, “কিন্তু তুমি এসব faco…”

“অবশ্যই আমি এসব নিতে পারি।” রোগী ঘরের ভেতরটা তাকিয়ে দেখলো। জানালার পাশে একটা টেলিফোন রাখা আছে। ফোনটা হাতে নিয়ে তারটা বিচ্ছিন্ন ক’রে ফেললো এক টানে। “এখন আর কেউ তোমাদের বিরক্ত করতে পারবে না,” কথাটা বলেই তার ঝোলাটা তুলে নিলো সে।

“তুমি আমার হাত থেকে বাঁচতে পারবে না, বুঝলে!” শামফোর্দ ক্ষেপে বললো। “তুমি এসব নিয়ে পালাতে পরবে না! পুলিশ তোমাকে খুঁজে বের করবেই!”

“পুলিশ?” অনুপ্রবেশকারী জানতে চাইলো। “তুমি কি আসলেই মনে করো তুমি পুলিশকে জানাবে? তাহলে তো এসবই জানাতে হবে তাদেরকে। আমার মনে হয় না এটা ভালো কোনো কাজ হবে। আমার মনে হয় তোমার উচিত হবে ঐ লোকটার জন্যে অপেক্ষা করা, যে তোমাকে একটু পরে নিতে আসবে। আমি তার কাছ থেকে এরকমটিই বলতে শুনেছি। সব কিছু বিবেচনা ক’রে আমার মনে হচ্ছে তোমার উচিত হবে না পুলিশ-টুলিশ ডাকা। যা ঘটেছে তার চেয়ে অনেক ভালো গল্প তুমি বানিয়ে নিতে পারবে।”

অজ্ঞাত পরিচয়ের চোরটি ঘর থেকে চলে যাবার সময় ভাঙা দরজাটা ভিজিয়ে দিয়ে গেলো।

.

তুমি অসহায় নও। তুমি তোমার পথ খুঁজে নেবে।

এ পর্যন্ত সে তাই করেছে আর সেটা একটু ভীতিকরই। ওয়াশবার্ন কি বলেছিলেন? তার দক্ষতা আর প্রতিভা ফিরে আসবে…তবে আমার মনে হয় না সেগুলো দিয়ে তুমি তোমার অতীতকে কিংবা অতীতের সাথে কোনো রকম সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হবে। অতীত। বিগত চব্বিশ ঘণ্টায় সে যে ধরণের দক্ষতা দেখিয়েছে তাতে কী ধরণের অতীতকে নির্দেশ করে সেটা? নিজের পা আর হাত দুটোকে হাতুড়ির মতো করে চমৎকার ব্যবহার ক’রে তোলার শিক্ষাটা সে কোত্থেকে অর্জন করেছে? ঠিক কোথায় ঘুষি মারতে হবে সেটাই বা সে জানলো কী করে? হিংসাত্মক কাজ করার শিক্ষাটা তাকে কে দিলো? কি করেই বা সে দ্রুত হিসেব কষে ঘটনা ঘটাতে পারছে? কসাইয়ের দোকানে গিয়ে অন্যদের কথাবার্তা আঁড়ি পেতে শোনার শিক্ষাটাই বা কে তাকে দিলো? তার চেয়েও বড় কথা, অপরাধ করার সিদ্ধান্ত চট ক’রে নেবার ব্যাপারটা। হায় ঈশ্বর, সে কিভাবে করতে পারে এসব?

তুমি যতো বেশি জোর ক’রে মনে করতে চাইবে, ততো বেশি ক্ষতি হবে। খুবই বাজে হবে সেটা।

সে পথঘাট আর মারকুইস দ্য শামফোর্ডের জাগুয়ারের ড্যাশবোর্ডের দিকে মনোযোগ দিলো। সামনের যন্ত্রপাতিগুলো তার কাছে অপরিচিত নয়। তার অতীত অভিজ্ঞতার মধ্যে এরকম কোনো গাড়ির সম্পর্ক নেই। সে ধারণা করলো এটা তাকে একটা কিছু বলছে।

এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে সে প্রশ্বস্ত খালের উপর একটা বৃজ অতিক্রম ক’রে ফেললো, সে জানে মার্সেই’তে পৌঁছে গেছে সে। চারকোনা পাথরের বাড়িঘর সব। মনে হচ্ছে পানির উপর থেকে মাথা উঁচু ক’রে দাঁড়িয়ে আছে সর্বত্রই সংকীর্ণ পথঘাট আর দেয়াল —পুরনো হারবারের প্রান্তসীমা। সে এটার সবই জানে, তারপরও সে এটা চেনে না। দূরের এক পাহাড়ের চূড়ায় একটা ক্যাথেড্রাল দেখা যাচ্ছে, ভার্জিন মেরির একটি মূর্তিও দৃশ্যমান। নতরদেম দালা গার্দে। নামটা তার মনে পড়লো। এটা সে আগেও দেখেছে—তারপরও এটা সে দেখে নি।

ওহ্, ঈশ্বর! এটা থামাও!

কয়েক মিনিটের মধ্যে সে শহরের কেন্দ্রে এসে পড়লে জনাকীর্ণ পথঘাট দিয়ে গাড়িটা চলতে লাগলো। দামি দামি সব দোকানপাট। দু’পাশের মূল্যবান কাঁচে বিকেলের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। ফুটপাতের একপাশে অসংখ্য ক্যাফে আছে। সে বায়ে হারবারের দিকে মোড় নিলো। ওয়্যারহাউজ আর ছোটো ছোটো কারখানা অতিক্রম করলো একে একে। দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর।

সহজাত প্রবৃত্তি। সহজাত প্রবৃত্তিকে অনুসরণ করো। প্রতিটি জিনিসেরই তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহার উপযোগীতা রয়েছে। যদি ছোড়া হয় তো একটা পাথরেরও ব্যবহার আছে। অথবা একটা যানবাহন, যদি কেউ চায় সেটা। যেখানে নতুন আর পুরনো গাড়ি পার্ক ক’রে রাখা আছে সেরকম একটি জায়গায় সে গাড়িটা পার্ক ক’রে গাড়ি থেকে বের হয়ে এলো।

বেড়ার পেছনে একটা গ্যারাজ দেখা গেলো, যন্ত্রপাতি হাতে মেকানিকের দল ছোটাছুটি করছে। বেশ অনায়াস ভঙ্গীতে ভেতরে হাটতে লাগলো সে; হালকা পাতলা স্ট্রাইপ শার্ট পরা এক লোককে সে দেখতে পেয়ে তার সহজাত প্রবৃত্তি বলছে সেই লোকটার সাথে কথা বলতে হবে।

গাড়ির চাবিটার বিনিময়ে পাওয়া গেলো ছয় হাজার ফ্রাঁ। এটা শামফোর্ডের গাড়িটার পাঁচ ভাগের এক ভাগ দাম। এরপর ডাক্তার ওয়াশবার্নের রোগী একটা ট্যাক্সি নিয়ে ড্রাইভারকে বললো কোনো বন্ধকী দোকানে নিয়ে যেতে তবে প্রতিষ্ঠিত কোনো দোকানে নয়। ঐসব দোকানে খুব বেশি প্রশ্ন করা হয়। আধঘণ্টা পরেই গিরাদ পেরেগোঁয়া ঘড়িটা তার হাতে আর শোভা বর্ধন করলো না। তার বদলে পাওয়া গেলো একটা সিকো ঘড়ি আর সেই সঙ্গে নগদ আটশো ফ্রাঁ। বাস্তবতার নিরিখে সব কিছুরই মূল্য রয়েছে। এই ঘড়িটা শক্‌ প্রুফ।

পরবর্তী গন্তব্য হলো লা ক্যনাাবিয়ের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের একটা মাঝারি গোছের ডিপার্টমেন্ট স্টোর। জামা-কাপড় পছন্দ করা হলে মূল্য পরিশোধ ক’রে ফিটিংরুমে গিয়ে সেগুলো পরাও হলো। বাজেভাবে ফিটিং হওয়া একটা ব্লেজার আর ফুলপ্যান্ট ফেলে দেয়া হলো পরিত্যাক্ত অবস্থায়।

আরেক তলায় গিয়ে একটা নরম চামড়ার সুটকেস কিনে তাতে বাড়তি কাপড় আর আগের কাপড়ের ঝোলাটা রেখে দিলো সে। রোগীটি তার নতুন ঘড়ির দিকে তাকালো, বিকেল পাঁচটা বাজে প্রায়। একটা আরামদায়ক হোটেল খুঁজে বের করতে হবে এখন। সে কয়েক দিন ধরে সত্যিকার অর্থে ঘুমায় নি। রুই সারাসিনের ক্যাফে লো চোখ দ্য মারের মিটিংয়ের আগে তাকে একটু বিশ্রাম নিতে হবে। এই মিটিংটা সফল হলেই সে জুরিখে যেতে পারবে।

.

বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে চেয়ে আছে সে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের বাতির আলো জানালা দিয়ে ঢুকে ছাদে বিভিন্ন ধরণের আলোর নাচন হচ্ছে। মার্সেই’তে রাত নামতেই রোগীর মনে হতে লাগলো তার মুক্তিও ঘনিয়ে আসছে। সে নিজের সম্পর্কে ভিন্ন কিছুও জানতে পারছে; রাতের বেলায় বেশি স্বস্তি বোধ করে সে। অর্ধ ক্ষুধার্ত বেড়ালের মতো রাতকেই খাবার অন্বেষণের জন্যে বেশি সুবিধাজনক মনে করে। তারপরও স্ববিরোধীতা আছে, আর সে নিজেও সেটা জানে। পোর্ত নোয়ের কয়েক মাসের সময়টাতে সে সূর্যালোকের জন্যে ব্যাকুল ছিলো। প্রতি ভোরে তার জন্যে অপেক্ষা করতো সে। কেবল কামনা করতো অন্ধকার যেনো বিতারিত হয়।

তার মধ্যে কিছু একটা ঘটছে। বদলে যাচ্ছে সে।

কিছু একটা ঘটেছে। চার ঘণ্টা আগে সে ভূ-মধ্যসাগরে একটা মাছ ধরার ট্রলারে ছিলো, পকেটে ছিলো দু’হাজার ফ্রাঁ আর মনে ছিলো একটা উদ্দেশ্য। দু’হাজার ফ্রাঁ হোটেল লবিতে এক্সচেঞ্জ ক’রে পাওয়া গেলো পাঁচশ’রও কম আমেরিকান ডলার। এখন সে মোটামুটি দামি পোশাক পরে, দামি একটা হোটেলে শুয়ে আছে, তার পকেটে আছে মারকুইস দ্য শামফোর্ডের কাছ থেকে নেয়া তেইশ হাজার ফ্রাঁ। তার মানে ছয় হাজার আমেরিকান ডলার।

সে কোত্থেকে এসেছে যে, এরকম কাজ করতে সক্ষম হলো?

এটা ভেবো না! এসব ভাবা বন্ধ করো!

.

রুই সারাসিন শহরটা খুবই পুরনো। ইটের প্রশ্বস্ত পথঘাটগুলো বড় বড় সড়কের সাথে গিয়ে মিশেছে, সবই শত বছরের পুরনো। কিন্তু এটা হলো মার্সেই। প্রাচীন সহাবস্থান করে পুরনোর সাথে। রুই সারাসিন দুইশত ফিটের বেশি দীর্ঘ হবে না। পাথরের দেয়ালে সময় জমে আছে। হারভার থেকে ভেসে আসা কুয়াশায় ল্যাম্পপোস্টের বাতির আলো ম্রিয়মান হয়ে গেছে।

একমাত্র যে শব্দ আর আলো দেখা যাচ্ছে সেটা আসছে লো চোখ দ্য মার থেকে। প্রশ্বস্ত গলির মাঝখানে ক্যাফেটা অবস্থিত। এটা ঊনিশ শতকীয় একটি অফিস ভবনের অংশ। চেয়ার টেবিলের জায়গা দখল করেছে সুদীর্ঘ বার আর টুল। অনেকগুলো টেবিল চেয়ার রাখা হয়েছে মিটিং করার জন্যে। একটা বড় পর্দা দিয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে। কোনো দরজা নেই।

জনাকীর্ণ টেবিলগুলোর মাঝখান দিয়ে রোগীটি ঘন ধোয়া আর মাতাল লোকদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চললো। মদে মত্ত সৈনিক আর মৎস্যজীবিরা হৈ হল্লা করছে। এক মুঠো ফ্রাঁ’র বিনিময়ে বিছানায় যেতে মুখিয়ে আছে লাল মুখের বেশ্যারা। চারপাশে খোঁজাখুঁজি ক’রে অবশেষে ক্যাপ্টেনের দেখা পাওয়া গেলো। তার সঙ্গে টেবিলে আরেকজন লোক ব’সে আছে। হালকা-পাতলা, ফ্যাকাশে মুখের, ছোটো ছোটো চোখে সে কৌতুহলী বাচ্চা ছেলের মতো চেয়ে আছে।

“বসো,” ক্যাপ্টেন বললো। “আমি ভেবেছিলাম একটার আগেই তুমি এখানে এসে পড়বে।”

“আপনি বলেছিলেন নয়’টা থেকে এগারোটার মধ্যে। এখন তো পৌনে এগারোটা বাজে।”

“তুমি বেশি সময় নিয়েছো, সুতরাং হুইস্কির পয়সা তুমিই দেবে।”

“খুশি মনে দেবো, তাদের কাছে আরো ভালো কিছু থাকলে অর্ডার দিন।”

হালকা পাতলা লোকটি হাসলো। কাজটা বেশ ভালো মতোই হবে মনে হচ্ছে। তাই হলো। এই পৃথিবীতে পাসপোর্ট এদিক ওদিক করাটাই সবচাইতে কঠিন কাজ, তবে বেশ যত্ন নিয়ে, ভালো যন্ত্রপাতি আর দক্ষ হাতে করতে পারলে সেটা করা যেতে পারে।

“কতো লাগবে?”

“এইসব কাজ খুব একটা সস্তায় করা যায় না। পঁচিশশ’ ফ্রাঁ।”

“সেটা আমি কখন পাবো?”

“যত্নসহকারে, ভালো মতো করতে গেলে সময় লাগবে। তিন থেকে চারদিন তো লাগবেই। তারপরও কাজটা যে করবে তার উপর বেশ চাপ পড়ে যাবে। সে আমাকে রীতিমতো গালাগালি করতে শুরু ক’রে দেবে।”

“আগামীকাল দিতে পারলে বাড়তি আরো এক হাজার ফ্রাঁ দেবো।”

“সকাল দশটার মধ্যে,” ফ্যাকাশে মুখের লোকটা খুব দ্রুত বললো। “আমি তাহলে গালাগালিটা সহ্য ক’রে নিলাম।”

“সেই সঙ্গে এক হাজার ফ্রাঁ,” ঘোৎঘোৎ ক’রে ক্যাপ্টেন বললো। “পোর্ত নোয়ে থেকে তুমি কি নিয়ে এসেছো? ডায়মন্ড নাকি?”

“প্রতিভা,” রোগীটি জবাব দিলো, যদিও শব্দটার মানে সে ঠিকমতো বুঝতে পারছে না।

“আমার একটা ছবির দরকার হবে,” পাশের লোকটা বললো।

“আসার পথে সেটা তুলে এনেছি,” রোগীটি বললো। পকেট থেকে একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি বের করলো সে। “আমি নিশ্চিত মহামূল্যবান যন্ত্রপাতির সাহায্যে আপনি এটা আরো ভালো করতে পারবেন।”

“পোশাকটা চমৎকার,” ক্যাপ্টেন কথাটা বলেই ছবিটা তুলে নিয়ে পাশের লোকটার কাছে দিয়ে দিলো।

“দর্জি খুব ভালো ছিলো,” রোগীটি একমত হয়ে বললো।

সকালে দেখা করবার জায়গাটি ঠিক করা হলো, চুকানো হলো মদের মূল্যও, আর টেবিলের নিচ দিয়ে ক্যাপ্টেনকে দেয়া হলো পাঁচশ’ ফ্রাঁ। আলোচনা পর্বের সমাপ্তি হলে ক্রেতা টেবিল ছেড়ে উঠে ভীড় ঠেলেঠুলে দরজার দিকে চলে গেলো।

এতো দ্রুত, এতো আচমকা আর অপ্রত্যাশিতভাবে এটা ঘটলো যে, ভাববার কোনো সময়ই পেলো না। কেবল প্রতিক্রিয়া।

ধাক্কাটা আচমকা লাগলো, কিন্তু যে চোখটা তার দিকে চেয়ে আছে সেটা মনে হচ্ছে অন্য কিছু। মনে হচ্ছে চক্ষু দুটো কোটর থেকে বের হয়ে আসবে। অবিশ্বাসে হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো গোল গোল হয়ে আছে সেটা।

“না! হায় ঈশ্বর, না! এটা হতে পারে না—”  

রোগীটি সামনের দিকে এগিয়ে গেলে লোকটা ভীড়ের মধ্যেই ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হলে জেসন পেছন থেকে লোকটার কাঁধে হাত রাখলো।

“একটু দাঁড়ান!”

লোকটা তার কাঁধ থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে আবারো সামনের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললো, “তুমি! তুমি মরে গেছো! তুমি বেঁচে থাকতে পারো না।”

“আমি বেঁচে আছি। তুমি কি জানো?”

মুখটা এবার বিকৃত হয়ে গেলো। প্রচণ্ড ভয় জেঁকে বসলো তার চোখে-মুখে। চোখ দুটো কুচ্‌কে আছে। মুখটা হা করা। লোকাটার হলুদ রঙের নোংরা দাঁত দেখা যাচ্ছে। আচমকা একটা ছুরি বের ক’রে রোগীর পেটের দিকে মারতে উদ্যত হলো লোকটি। “আমি জানি, আমাকেই এটা শেষ করতে হবে।” লোকটা আপন মনে বিড়বিড় ক’রে কথাটা বললো। রোগীটি তার ডান হাত দ্রুত পেন্ডুলামের মতো ঘুরিয়ে দিলে তার সামনে তেড়ে আসা হাতটাকে সরিয়ে দিলো।

ঘুরে তার বাম পা-টা শূন্যে ভাসিয়ে দিয়ে আক্রমণকারীকে কষে একটা লাথি মারলো সে। আঘাতটা লাগলো মূলত গোপনাঙ্গে।

“সি-সাহ্।” কথাটা তার কানে প্রতিধ্বনি করলো।

লোকটা হুমড়ি খেয়ে তিনজন মাতালের উপর গিয়ে পড়লে হাতের ছুরিটাও ছিটকে মেঝেতে পড়ে গেলো। অস্ত্রটা সবাই দেখতে পেয়ে হৈ হল্লা শুরু ক’রে দিলো। কয়েক জন লোক একসঙ্গে এগিয়ে এসে তাদের দু’জনকে মারামারি করা থেকে বিরত রাখলো। “বেরিয়ে যাও এখান থেকে!”

“বাইরে গিয়ে ইচ্ছেমতো ঝগড়াঝাটি করো!”

“আমরা চাই না পুলিশ এখানে আসুক, শালার মাতালের দল। বানচোত কোথাকার!”

ক্ষুব্ধ মার্সেই’র গালাগালি লো চোখ দ্য মারের হৈহল্লা ছাপিয়ে শোনা গেলো। রোগীটি ফিরে তাকিয়ে দেখলো তার আক্রমণকারী নিজের বিচি ধরে কোনো মতে বের হয়ে যাচ্ছে। দরজা খুলে গেলে রুই সারাসিনের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো লোকটা।

তাকে মারতে চাইছিলো যে লোকটা সে জানতো সে মরে গেছে। কিন্তু এখন জেনে গেছে সে বেঁচে আছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *