অধ্যায় ২৯
ট্যাক্সিটা পার্ক মশিউ’র ভিলিয়ার্সের বাড়ির সামনে এসে থামলো। জেসন পেছনের সিটে ব’সে আছে। পথের দু’পাশে সারি সারি পার্ক করা গাড়িগুলোর দিকে ভালো ক’রে লক্ষ্য করলো সে কিন্তু ধূসর রঙের কোনো সিতরো চোখে পড়লো না যার নেমপ্লেটে এন.ওয়াই.আর লেখা।
কিন্তু ভিলিয়ার্স আছে। নিজের বাড়ি থেকে চারটা বাড়ির পরে একা দাঁড়িয়ে আছে বৃদ্ধ সৈনিক।
দু’জন লোক…একটা গাড়িতে, আমার বাড়ি থেকে চারটা বাড়ি দূরে।
ভিলিয়ার্স এখন সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে যেখানে গাড়িটা ছিলো। এটা একটা সিগনাল।
“আরেতেজ, সিল ভু প্লেইত,” বর্ন ড্রাইভারকে বললো। “লো ভিউ লাবাস। জো ভিউ পার্লার আভেক, লুই।” সে জানালার কাঁচ নামিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে এলো। “মঁসিয়ে?”
“ইংরেজিতে বলেন,” ভিলিয়ার্স ট্যাক্সিটার দিকে এগিয়ে এসে জবাব দিলো। “কি হয়েছে?” জেসন জিজ্ঞেস করলো।
“আমি তাদেরকে আঁটকে রাখতে পারি নি।
“তাদেরকে?”
“আমার বউ আর লাভিয়া এক সঙ্গে বের হয়ে গেছে। যদিও অনেক চেষ্টা করেছি। আমি বউকে বলেছি জর্জ সিঙ্ক-এ আমি তাকে ফোন করবো। খুব জরুরি একটা ব্যাপারে তার মতামত দরকার আমার।”
“সে কি বললো?”
“বললো জর্জ সিঙ্ক-এ যাবে কিনা সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত নয়। তার বন্ধু তাকে নুইলে সুর সেইনের চার্চে গিয়ে এক যাজকের সাথে দেখা করার জন্যে চাপাচাপি করছে। সে বলেছে তার বন্ধুকে সঙ্গ দেয়াটা খুবই দরকার।”
“আপনি কি নিষেধ করেছিলেন?”
“অনেক। আর আমাদের বিবাহিত জীবনে এই প্রথম সে আমার চিন্তাভাবনাটা ধরতে পেরেছে। সে বলেছে, ‘তোমার যদি মনে হয় আমি ওখানে যাচ্ছি না, তবে তুমি চার্চে ফোন ক’রে জেনে নিও। আমি নিশ্চত, কেউ আমাকে চিনতে পারবে, তুমি ফোন করলে আমাকে ডেকে দেবে। সে কি আমাকে পরীক্ষা করছে?”
বর্ন ভাবার চেষ্টা করলো। “হতে পারে। কেউ হয়তো তার সাথে সেখানে দেখা করবে। কিন্তু তাকে একটা ফোন করাটা ঠিক হবে না। তারা কখন চলে গেছে?”
“পাঁচ মিনিট আগে। সিতরোঁ’তে থাকা দু’জন তাদেরকে অনুসরণ করেছে।”
“তারা কি আপনার গাড়িটা নিয়ে গেছে?”
“না। আমার বউ একটা ট্যাক্সি নিয়ে গেছে।”
“আমি সেখানে যাচ্ছি,” জেসন বললো।
“আমারও মনে হয় তুমি সেখানে যাও,” ভিলিয়ার্স বললো। “আমি চার্চটার ঠিকানা খুঁজে বের করেছি।”
.
বর্ন ড্রাইভারকে পঞ্চাশ ফ্রাঁ দিয়ে বললো, “নুয়েলি সুর সেইন চার্চে দ্রুত পৌঁছানোটা আমার জন্যে খুবই জরুরি। যতো দ্রুত পারো যাও। জানো তো সেটা কোথায়?”
“অবশ্যই, মঁসিয়ে। এটা এই এলাকার সবচাইতে সুন্দর চার্চ।”
“তাহলে দ্রুত যাও, আরো পঞ্চাশ ফ্রাঁ দেবো।”
“আমরা একেবারে পরীর ডানায় ভর ক’রে উড়ে চলে যাবো, মঁসিয়ে!”
তারা উড়েই চলে গেলো। পথে কেবল কিছু যানবাহনের কারণে তাদের যাত্রায় একটু বিঘ্ন ঘটলো। চার্চের খুব কাছে আসতেই জেসন ড্রাইভারকে বললো, “আস্তে।” তার মনোযোগ চার্চটা নয়, বরং তার সামনের কয়েকটা গাড়ির পরে একটা গাড়ির দিকে। গাড়িটা এক পাশে মোড় নেবার সময় সে এটাকে দেখলো। ধূসর রঙের সিতরোঁ গাড়ি। সামনের আসনে দু’জন লোক বসা।
তারা একটা ট্রাফিক লাইটের সামনে এসে পড়লো। জেসন পঞ্চাশ ফ্রাঁ’র একটা নোট ড্রাইভারকে দিয়েই গাড়ি থেকে নেমে বললো, “আমি ফিরে আসছি। ট্রাফিক বাতিটা বদলে গেলে আস্তে ক’রে সামনে এগিয়ে যাবে, আমি চলতি গাড়িতেই উঠে পড়বো।”
বর্ন একটু নিচু হয়ে গাড়িগুলোর মাঝখান দিয়ে একটু এগিয়ে দেখতে পেলো নেমপ্লেটে লেখা আছে এন.ওয়াই.আর। এরপরে ৭৬৮ সংখ্যাটা। কিছুক্ষণের জন্যে এই সংখ্যাটা কোনো গুরুত্ব বহন করলো না। ট্যাক্সি ড্রাইভার বাতিটা জ্বললে গাড়িটা চালিয়ে জেসনের পাশে চলে এলো। চারপাশে সবগুলো গাড়ি সাই সাই ক’রে চলতে শুরু করেছে। জেসন দরজা খুলেই ভেতরে ঢুকে পড়লো। “তুমি বেশ ভালো কাজ করেছো,” সে ড্রাইভারকে বললো।
“কি এমন করেছি বুঝতে পারছি না।”
“হৃদয়ঘটিত ব্যাপার। হাতেনাতে বিশ্বাসঘাতককে ধরতে হবে।”
“চার্চে, মঁসিয়ে? কলিকাল আর কাকে বলে।”
তারা চার্চের একেবারে কাছে এসে পড়লো। সিতরোটা মোড় নিতেই তাদের মধ্যে একটা ট্যাক্সি, যাত্রীরা প্রায় একই রকম। জেসনের একটু খটকা লাগলো। দু’জন লোক বেশ খোলামেলাভাবেই উঁকি মারছে গাড়ির ভেতর থেকে। যেনো, কার্লোসের সৈনিকেরা চাইছে ট্যাক্সিতে থাকা কেউ জানুক তারা এখানে আছে।
অবশ্যই! ভিলিয়ার্সের বউ ট্যাক্সিতে আছে লাভিয়ার সাথে। আর সিতরোতে থাকা দু’জন লোক চাচ্ছে ভিলিয়ার্সের বউ জানুক তারা তাদের পেছনেই আছে।
বর্নের গাড়িটা চার্চের অনেক ভেতরে ঢুকে পড়লে ড্রাইভার বললো, “আমি কি করবো, মঁসিয়ে?”
“ঐ খালি জায়গাটাতে যাও,” জেসন পার্কিং এলাকাটা দেখিয়ে বললো। ভিলিয়ার্সের বউয়ের ট্যাক্সিটা এক সেন্টের মূর্তির সামনে এসে থামলো। ভিলিয়ার্সের বিস্মিত বউ প্রথমে বের হলো ট্যাক্সি থেকে। আর ফ্যাকাসে মুখের লাভিয়া বের হলো তার পর পরই। সে একটা কমলা রঙের বড় সানগ্লাস পরেছে, হাতে সাদা একটা পার্স। তবে তাকে আর অভিজাত লাগছে না। তার উঁচু করে রাখা চুলগুলো সোজা ছেড়ে দেয়া আছে মুখের দু’পাশে। তার মোজা জোড়া ছেঁড়াফাড়া। প্রায় তিনশো ফিট দূরে থাকলেও বর্ন তার দ্রুত নিঃশ্বাসের শব্দটা শুনতে পাচ্ছে।
সিতরোটা ট্যাক্সিকে অতিক্রম ক’রে একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে থামলো। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো লোক বের হলো না। তার বদলে ট্রাঙ্ক থেকে একটা ধাতব রড বের হয়ে এলো। একটা রেডিও এন্টেনা সচল করা হচ্ছে। কোড পাঠানো হচ্ছে সুরক্ষিত ফ্রিকোয়েন্সিতে। জেসন মন্ত্রোমুগ্ধ হয়ে গেলো, দৃশ্যটা দেখে নয়, বরং অন্য কিছুর জন্যে। তার কানে কিছু শব্দ শোনা যেতে লাগলো, এমন এক জায়গা থেকে সেগুলো আসছে যে জায়গাটা জেসন চেনে না। কিন্তু শব্দগুলো আসছে।
আলমানাককে বলছি, ডেল্টা; আলমানাককে বলছি, ডেল্টা। আমরা জবাব দেবো না। আবারো বলছি, নেগেটিভ, ব্রাদার। অর্ডার অনুযায়ী জবাব দেবে। পরিত্যাক্ত, পরিত্যাক্ত। এটাই শেষ কথা। আলমানাককে বলছি, ডেল্টা। তুমি খতম, ব্রাদার। জাহান্নামে যাও। ডেল্টা আউট। যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে।
আচমকা তার চারপাশে অন্ধকার ঘিরে ধরলে সূর্যের আলোটা উধাও হয়ে গেলো। চার্চের কোনো টাওয়ার দেখা যাচ্ছে না আর। সব কিছু নড়ছে। সব কিছু। তাকেও নড়তে হবে। না নড়লে মরে যাবে। পালাও! ঈশ্বরের দোহাই, পালাও!
তাদেরকে বের ক’রে নিয়ে আসো। এক এক ক’রে। হামাগুড়ি দিয়ে ভয়কে জয় করো। মারাত্মক ভয়। সংখ্যাগুলো কমিয়ে আনো। অ্যাবোট এটা স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছিলো। চাকু, তার, হাটু, বুড়ো আঙুল; তুমি ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারটা জানো। মৃত্যু।
কম্পিউটারের কাছে মৃত্যু হলো একটা পরিসংখ্যান। আর তোমার কাছে কেবল টিকে থাকাটা।
সন্ন্যাসী।
সন্ন্যাসী।
সূর্যের আলোটা আবার উঁকি দিলে তার চোখ ঝলসে গেলো কিছুক্ষণের জন্যে। সে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়, তার চোখ একশো গজ দূরে ধূসর রঙের সিতরোঁটার দিকে। এই দৃশ্যটা দেখা খুব কঠিন। কেন এটা এতোটা কঠিন? কুয়াশা, ঘোলাটে…এখন আর কোনো অন্ধকার নেই তবে আছে অভেদ্য কুয়াশা। সে গরম। সে ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডা! নিজের মাথাটা ঝাঁকালো সে। আচমকাই সে সচেতন হয়ে উঠলো কোথায় আছে সে, কি করছে। তার মুখটা জানালায় ঠেস্ দেয়া; তার নিঃশ্বাসে কাঁচটা ঘোলাটে হয়ে গেছে।
আমি কয়েক মিনিটের জন্যে বাইরে যাচ্ছি,” বর্ন বললো। “এখানেই থেকো।”
“আপনি চাইলে সারা দিন থাকবো, মঁসিয়ে।”
জেসন তার জ্যাকেটের কলারটা তুলে মাথার টুপিটা সামনের দিকে টেনে চশমাটা পরে নিলো। রাস্তার পাশে একটা ধর্মীয় বাজারের পাশ দিয়ে হেটে গেলো। এক মা আর তার বাচ্চা কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, জেসন তাদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। এখান থেকে সিতরোটা বেশ ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে। পার্ক মশিউ থেকে যে ট্যাক্সিটা এসেছে সেটা নেই। ভিলিয়ার্সের বউ সেটা বিদায় ক’রে দিয়েছে। বর্নের কাছে এটা একটু অস্বাভাবিক ব’লেই মনে হলো, কারণ এখানে ট্যাক্সি পাওয়াটা খুব সহজ নয়।
তিন মিনিট পর, কারণটা পরিস্কার হলো…আর সেটা খুবই আশংকাজনক। ভিলিয়ার্সের বউ হন হন ক’রে চার্চ থেকে বের হয়ে সোজা চলে গেলো সিতরোটার কাছে। সামনে বসা লোকটার সাথে কথা বলে পেছনের দরজাটা খুললো সে।
পার্সটা। একটা সাদা পার্স! ভিলিয়ার্সের বউয়ের হাতে একটা সাদা পার্স যেটা কিছুক্ষণ আগেও লাভিয়ার হাতে ছিলো। গাড়ির পেছনে উঠে বসতেই গাড়িটা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চললো।
জ্যাকুলিন লাভিয়া কোথায়? তার পার্সটা কেন ভিলিয়ার্সের বউয়ের হাতে? বর্ন সামনের দিকে এগোতে গিয়েও থেমে গেলো। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে সতর্ক ক’রে দিলো। একটা ফাঁদ? লাভিয়াকে যদি অনুসরণ করা হয়ে থাকে তবে ঐসব অনুসরণকারীদের পেছনেও কেউ হয়তো আছে।
সে রাস্তার চারপাশে তাকালো। ফুটপাতে চলতে থাকা লোকজনকে নিরীক্ষণ করলো। তারপর প্রতিটি গাড়ি, ড্রাইভার আর যাত্রী। তেমন কিছুই দেখতে পেলো না। সে আসলে অতি সতর্ক আচরণ করছে। নুয়েলি সুর সেইন তার জন্যে কোনো ফাঁদ নয়। সে কাউন্টার থেকে সরে গিয়ে চার্চের দিকে পা বাড়াতেই থেমে গেলো, তার পা দুটো মাটির সাথে আঁটকে রইলো যেনো। কালো সুট, সাদা কলার আর কালো টুপি পরা এক যাজক চার্চের ভেতর থেকে বের হয়ে আসছে। টুপিটার কারণে তার মুখের অনেকটা অংশ ঢেকে আছে। সে এই লোকটাকে এর আগেও দেখেছে। খুব বেশি দিন আগে নয়। কোনো বিস্মৃত অতীতে নয় বরং সাম্প্রতিক সময়ে। কয়েক সপ্তাহ, কয়েক দিন…কয়েক ঘণ্টা। কোথায় সেটা? কোথায়? সে তাকে চেনে! তার হাটাটা, মাথাটা একটু হেলে রাখা, প্রশ্বস্ত কাঁধটা, খুবই চেনা চেনা লাগছে। সে অস্ত্র হাতের লোকটা! কোথায় সেটা?
জুরিখ? ক্যারিলিওন দুলাক? দু’জন লোক মানুষজনের ভীড় ঠেলে ধেয়ে আসছে। মৃত্যুদূত। একজন গোল্ডরিমের চশমা পরা। এটা সেই লোকটা নয়। সেই লোকটা তো মরে গেছে। তাহলে কি ক্যারিলিওন দুলাকের অন্য লোকটি? অথবা গুইসান কুয়ের লোকটা? ধর্ষণকারী এক পশু। এই লোকটা কি সেই লোক? নাকি অন্য কেউ। কালো কোট পরা এক লোক অবার্জ দু’কোয়ের করিডোরে, যেখানে আলো ছিলো। একটা সিঁড়ি ছিলো। একটা ফাঁদ। একটা উল্টো ফাঁদ। যেখানে সেই লোকটা অন্ধকারে গুলি করেছিলো এই ভেবে যে, সে একটা লোককে দেখেছে। এটা কি সেই লোকটা?
বর্ন জানে না। সে কেবল জানে এই পাদ্রীকে এর আগেও দেখেছে। তবে কোনো পাদ্রী হিসেবে নয়। সশস্ত্র এক লোক হিসেবে।
কালো সুট পরা খুনি পাথরের পথটার শেষপ্রান্তে, কংক্রিটের মূর্তির সামনে আসতেই সূর্যের আলোতে তার চেহারাটা কিছুক্ষণের জন্যে পরিস্কার দেখা যেতেই জেসন একেবারে বরফের মতো জমে গেলো। গায়ের চামড়াটা। খুনির গায়ের চামড়াটা শ্বেতাঙ্গদের মতো নয়। সেটা সূর্যের আলোতেও পোড়ানো নয়, জন্মগত। লাতিন!
বর্ন এই দৃশ্যটা দেখে তীব্র আতংকে প্যারালাইজ হয়ে গেলো। সে চোখের সামনে ইলিচ রামিরেজ সানচেজকে দেখছে।
কার্লোর্সকে ধরো। তাকে ফাঁদে ফেলো। চার্লির জন্যে কেইন আর কেইনের জন্যে ডেল্টা।
জেসন তার কোটের বোতাম খুলে কোমরের বেল্টের রাখা অস্ত্রের উপর হাত রেখে দৌড়ে লোকজনকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে সরাতে সামনের দিকে এগোতে লাগলো। ডাস্টবিন থেকে কিছু খুঁজছে এমন একটা ভিক্ষুককে অতিক্রম করলো সে—ভিক্ষুক! ভিক্ষুকের হাতটা তার পকেটে ঢোকানো। বর্ন ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেলো তার হাতে একটা লম্বা নলের পিস্তল, সূর্যের আলোতে সেটা চক্চক্ করছে। ভিক্ষুকটার হাতে অস্ত্র! অস্ত্রটা সে তুলে ধরলো, তার দৃষ্টি স্থির। জেসন দৌড়ে পথে দাঁড় করানো একটা ছোট্ট গাড়ির আড়ালে চলে যেতেই তার কানের পাশ দিয়ে বুলেটের ভোঁতা শব্দগুলো শুনতে পেলো। নিমিষেই লোকজনের মধ্যে তীব্র আতংক আর দৌড়া দৌড়ি শুরু হয়ে গেলো। বর্ন দুটো গাড়ির মাঝখানে নিচু হয়ে রাইলো। ভিক্ষুকটি দৌড়ে পালাচ্ছে এখন।
কার্লোর্সকে ধরো। তাকে ফাঁদে ফেলো। কেইন হলো…!
জেসন উঠে দাঁড়ালো, ছুটে গেলো সামনের দিকে, সামনের সবকিছু সরিয়ে দিয়ে ছুটে চললো গুপ্তঘাতকের দিকে। সে থেমে গেলো, তার দম বন্ধ হয়ে গেছে। বিভ্রান্ত আর ক্ষোভ তার বুকটা চেপে ধরলো যেনো। মাথার তীব্র যন্ত্রণাটা আবার ফিরে এলো। সে কোথায়? কার্লোস কোথায়! তারপরই সে তাকে দেখতে পেলো। খুনি একটা বড় কালো রঙের সিডান গাড়ির পেছনে উঠে বসেছে। জেসন রাস্তার গাড়িগুলোর ছাদ আর ট্রাঙ্কের উপর দিয়েই সেই গাড়িটার দিকে পাগলের মতো ছুটে চললো। হঠাৎ করেই তার গতি রোধ হলো দুটো গাড়ির সংঘর্ষের কারণে। এই ফাঁকে কালো সিডানটা ধরা ছোয়ার বাইরে চলে গেলো। অনেক দেরি হয়ে গেছে। ইলিচ রামিরেজ সানচেজ দ্রুতবেগে চলে গেলো চোখের সামনে দিয়ে।
জেসন পুলিশের হুইসেল শুনে ফিরে তাকালো পেছনে। চারদিকে থেকেই পুলিশ ছুটে আসছে। রাস্তার লোকজন আহত হয়েছে অথবা খুন হয়েছে। অস্ত্র হাতের ভিক্ষুকটি তাদের লক্ষ্য ক’রে এলোপাতারি গুলি করেছে।
লাভিয়া! বর্ন আবারো দৌড়াতে শুরু করলো। এবার তার গন্তব্য চার্চের দিকে। গোথিক চার্চের ভেতরে ঢুকেই সে দেখতে পেলো চারদিকে মোমবাতি জ্বালানো। উঁচু উঁচু দেয়ালের উপরের জানালা থেকে সুর্যের আলো এসে ভেতরে ঢুকেছে। সে দুই দিকের বেঞ্চগুলোর মাঝখান দিয়ে হেটে গেলো। প্রার্থনারত মানুষজনকে ভালো ক’রে লক্ষ্য করলো। সিলভার রঙের চুল আর কড়া মেকআপের এক মহিলাকে খুঁজছে সে।
কিন্তু লাভিয়াকে কোথাও দেখা গেলো না। যদিও সে চার্চ থেকে বের হয় নি। চার্চের ভেতরেই কোথাও আছে। জেসন ঘুরে পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেলো দীর্ঘাকায় এক পাদ্রী সহজ ভঙ্গীতে হেটে আসছে। জেসন তার পথ রোধ করলো।
“ক্ষমা করবেন, ফাদার,” সে বললো। “আমি একজনকে হারিয়ে ফেলেছি।”
“ঈশ্বরের ঘরে কেউ হারায় না, স্যার,” পাদ্রী হেসে জবাব দিলো।
“সে আসলে হারায় নি। আমিই তাকে হারিয়ে ফেলেছি। সে এই চার্চেরই কোথাও আছে। আমি তাকে না পেলে সে খুবই ভড়কে যাবে। তার বাড়িতে জরুরি একটা প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আপনি কি এখানে অনেকক্ষণ ধরে আছেন, ফাদার?”
“হ্যা। এক ঘণ্টা ধরেই তো আছি।”
“কয়েক মিনিট আগে দু’জন মহিলা এসেছিলো। একজন খুবই লম্বা, খুবই আকর্ষণীয়, হাল্কা রঙের কোট পরা। মাথায় কালো রঙের স্কার্ফ আছে। অন্যজন একটু বয়স্ক। খুব বেশি লম্বা নয়, রোগাপাতলা। আপনি কি তাদেরকে দেখেছেন?”
পাদ্রী মাথা নেড়ে সায় দিলো। “হ্যা। বয়স্ক মহিলার চোখেমুখে বিষণ্ণতা ছিলো। তার মুখটা বিবর্ন আর বিষাদে ভরা ছিলো।”
“আপনি কি জানেন সে কোথায় গেছে?” তার অল্পবয়সী বন্ধু তো চলে গেছে দেখলাম।”
“একজন ধর্মভীরু বন্ধু, বলতে পারেন। সে ঐ বেচারিকে কনফেশন করাতে নিয়ে গেছে। তাকে বুথের ভেতরে যেতে সাহায্য করেছে। কঠিন সময়ে পরিশুদ্ধ আত্মা আমাদেরকে সবধরণের শক্তি যোগায়।”
“কনফেশনে?”
“হ্যা—ডান দিকের দ্বিতীয় বুথটা। সে বার্সেলোনার একজন অতিথি ফাদারের কাছে কনফেশন করতে এসেছিলো। সেই ফাদারও একজন অসাধারণ ব্যক্তি। আমি দুঃখের সাথেই জানাচ্ছি, উনি আজকে স্পেনে ফিরে যাচ্ছেন…” পাদ্রী ভুরু তুলে বললো, “এটা কি অদ্ভুত নয়? কিছুক্ষণ আগে আমি ফাদার ম্যানুয়েলকে চলে যেতে দেখলাম। আমার ধারণা তার জায়গায় এখন অন্য কেউ আছে। ভাববেন না, আপনার বান্ধবী ভালো একজনের সঙ্গেই আছেন।”
“আমিও সে ব্যাপারে নিশ্চিত,” বর্ন বললো। “ধন্যবাদ, ফাদার। আমি তার জন্যে অপেক্ষা করবো।” জেসন কনফেশনাল বুথগুলোর দিকে চলে গেলো। তার চোখ পড়লো দ্বিতীয় বুথটার দিকে। একটা সাদা রঙের ফিতা বলে দিচ্ছে ভেতরে কেউ আছে। একটি আত্মা পরিশুদ্ধ হচ্ছে। সামনের সারিতে ব’সে পড়লো সে, তারপর হাটু মুড়ে সামনের দিকে এগোলো। মাথাটা আস্তে ক’রে ঘুরিয়ে চার্চের পেছনের দিকে তাকালো। পাদ্রীটি প্রবেশপথের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মনোযোগ রাস্তার হৈহল্লার দিকে। জেসন বুথের পদাটা একটু সরিয়ে ভেতরে উঁকি মারলো। যা দেখার আশা করেছিলো তাই দেখতে পেলো। কেবল পদ্ধতিটাই একটা প্রশ্ন রেখে গেছে।
জ্যাকুলিন লাভিয়া মরে গেছে, তার শরীরটা বুথের ভেতরের প্রার্থনা স্টলের উপর মাথা রেখে পড়ে রয়েছে। তার মুখটা একপাশে কাত করা। চোখ দুটো পুরোপুরি খোলা। তার কোটটা রক্তে ভেসে আছে। অস্ত্রটা একটা লম্বা চিঠি খোলার চাকু। সেটা তার বাম স্তনের উপরে বিদ্ধ হয়ে আছে।
পায়ের কাছে তার পার্সটা পড়ে আছে—দশ মিনিট আগে যে সাদা পার্সটা তার হাতে ছিলো সেটা নয়। বরং ফ্যাশনেবল একটা পার্স। এর কারণটা খুবই পরিস্কার জেসনের কাছে। ভেতরে কতোগুলো কাগজ আছে। তার করুণ আত্মহত্যার কথাটা লেখা আছে তাতে। এই মহিলা এতোটাই দুঃখেকষ্টে ছিলো যে নিজের জীবনের ভার আর বইতে পারছিলো না। ঈশ্বরের সামনেই সে জীবনাবসান ঘটিয়েছে। কার্লোস একেবারে নিখুত কাজ করেছে। অসাধারণ তার কাজ।
বর্ন পদার্টা ভিজিয়ে দিয়ে বুথ ছেড়ে চলে গেলো। চার্চের কোনো একটা টাওয়ার থেকে সকালের বেলটা বাজতে শুরু করলো।
.
ট্যাক্সিটা নুইলে সুর সেইন-এর রাস্তা দিয়ে লক্ষ্যহীনভাবে ছুটে চলছে। পেছনের সিটে ব’সে আছে জেসন, তার চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। অপেক্ষা করাটা উদ্দেশ্যহীন, সম্ভবত মারণঘাতিও বটে। অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে কৌশলও বদলে যায়, আর সেগুলো একটা মারাত্মক দিকে মোড় নেয়। জ্যাকুলিন লাভিয়াকে অনুসরণ করা হয়েছে। তার মৃত্যুটা ছিলো অনিবার্য তবে একটু জলদি হয়ে গেছে। সে এখনও মূল্যবান ছিলো। তারপরই বর্ন বুঝতে পারলো। সে কার্লোসের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে খুন হয় নি, খুন হয়েছে কার্লোসের কথা না শোনার জন্যে। সে পার্ক মশিউ’তে গিয়েছিলো—এটাই ছিলো তার ক্ষমার অযোগ্য ভুল।
লো ক্লাসিকে আরেকজন রিলে আছে, ফিলিপ দাঁজু নামের একজন ধূসর চুলের সুইচবোর্ড অপারেটর। যার মুখটা দেখে জেসনের মানসপটে হিংস্র কিছু ছবি, অন্ধকার আর ধ্বংসযজ্ঞের শব্দ ভেসে উঠেছিলো। সে বর্নের অতীতে ছিলো, এ ব্যাপারে জেসন নিশ্চিত। আর এজন্যেই শিকার পর্বটা খুব সতর্কতার সাথে করা হবে। সেই লোকটা তার কাছে কি মানে রাখতে পারে সে ব্যাপারে সে কিছুই জানে না। কিন্তু সে একজন রিলে, আর তাকেও নজরদারি করা হচ্ছে, যেমনটি লাভিয়াকে নজরদারি করা হয়েছিলো। আরেকটা ফাঁদের জন্যে বাড়তি একটা টোপ। ফাঁদটা গুটিয়ে ফেললে টোপটাকে পরিত্যাগ করা হয়।
তারা কি কেবল দু’জনই ছিলো? নাকি আরো কেউ আছে? হয়তো অস্পষ্ট, মুখহীন এক ক্লার্ক, যে কিনা আসলে ক্লার্ক নয়, অন্য কিছু? একজন সাপ্লায়ার, যে সেন অনরে’তে অনেক সময় কাটায় ব্যবসাসংক্রান্ত কাজে, কিন্তু আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজও সে করে। অথবা সেই ডিজাইনার রেনে বারগোয়াঁ।
বর্ন হঠাৎ করেই অড়ষ্ট হয়ে গেলো। সাম্প্রতিক একটি স্মৃতি জেগে উঠলো। বারগোয়াঁ। শ্বেতাঙ্গদের মতো চামড়া নয় যার, প্রশ্বস্ত কাঁধ…সরু কোমর। শক্ত দুটো পা দিয়ে খুব দ্রুত চলাফেরা করতে পারে সে, অনেকটা পশুদের মতো, একটা বিড়ালের মতো।
এটা কি সম্ভব? তাহলে কি বাকি মিলগুলো কেবলই কল্পনা, চেনা কোনো ছবির সাথে এমনিতেই মিলে গেছে যার জন্যে তাকে কার্লোস ব’লে মনে হচ্ছে? গুপ্তঘাতক কি তার রিলেদের কাছেও অচেনা—নিজের লোকদের মধ্যেই মিশে থাকে, প্রতিটি মুহূর্ত নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে? তাহলে কি বারগোয়াই?
তাকে এক্ষুণিই ফোন করতে হবে। এক মুহূর্ত দেরি করবে তো তার জবাবটাও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তবে সে ফোনটা নিজে করতে পারবে না। ঘটনাগুলো যেভাবে দ্রুত ঘটে যাচ্ছে তাতে ক’রে নিজেকে তার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নিজের তথ্যগুলো নিজের কাছেই রেখে দিতে হবে।
“কোনো ফোনবুথ দেখলেই গাড়িটা থামাবে,” সে ড্রাইভারকে বললো।
“ঠিক আছে, মঁসিয়ে। তবে আমাকে ফিট গ্যারাজে রিপোর্ট করতে হবে। এটা আপনাকে একটু বুঝতে হবে।”
“বুঝেছি।”
“ঐ যে একটা ফোনবুথ।”
“গাড়িটা রাখো ওখানে।”
লাল রঙের ফোনবুথটা দেখতে অনেকটা ডলস্হাউজের মতো। বর্ন হোটেল টেরাসের ৪২০ নাম্বার রুমে ফোন করলে মেরি ফোনটা ধরলো।
“কি হয়েছে?”
“সব খুলে বলার মতো সময় নেই। আমি চাই তুমি লো ক্লাসিকে ফোন ক’রে রেনে বারগোয়ার খোঁজ করো। সম্ভবত সুইচবোর্ডে দাঁজু থাকবে। তুমি একটা নাম ব’লে বলবে তুমি লাভিয়ার প্রাইভেট ফোনে এক ঘণ্টা ধরে চেষ্টা ক’রে যাচ্ছো কিন্তু পাচ্ছো না। বলবে এটা খুবই জরুরি। তার সাথে তোমাকে কথা বলতে হবে।”
“তাকে পেলে কি বলবো?”
“মনে হয় না তাকে পাবে। যদি পাও ফোনটা রেখে দেবে। আর যদি দাঁজু বলে সে নেই তবে তাকে বলবে কখন তাকে পাওয়া যেতে পারে। আমি তোমাকে তিন মিনিট পরে ফোন করছি।”
“ডার্লিং, তুমি কি ঠিক আছো?”
“আমার খুবই গভীর এক ধর্মীয় অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে। পরে তোমাকে জানাবো।” জেসন তার ঘড়িতে চোখ রাখলো। ত্রিশ সেকেন্ড পরে সে তার নিজের কাউন্টডাউনটা শুরু করলো। হিসেব ক’রে দেখলো তার হার্টবিট সেকেন্ডে আড়াই বার হচ্ছে। দশ সেকেন্ডের মাথায় সে ডায়াল করতে শুরু করলো। চার সেকেন্ডের মাথায় কয়েনটা ঢোকালো। আর টেরাসের সুইচবোর্ড অপারেটরের সাথে কথা বললো মাইনাস পাঁচে। মেরি ফোনট তুলে নিলো ।
“কি হয়েছে?” সে জানতে চাইলো। “আমি ভেবেছিলাম তুমি এখনও কথা বলছো?”
“খুব অল্প কথা। আমার মনে হয় দাঁজু খুবই সতর্ক হয়ে আছে। তার কাছে হয়তো কতোগুলো প্রাইভেট নাম্বার আছে। তবে আমি জানি না। কিন্তু তাকে খুবই দ্বিধাগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছে।”
“সে কি বললো?”
“বারগোয়াঁ ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে কাপড় খুঁজতে গেছে। সে সকালেই বের হয়ে গেছে। কয়েক সপ্তাহের আগে ফিরে আসবে না।”
“এটা সম্ভব যে, আমি তাকে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা থেকে শতশত মাইল দূরে এক জায়গায় এইমাত্র দেখেছি।”
“কোথায়?”
“একটা চার্চে? সে যদি বারগোয়া হয়ে থাকে তবে সে খুবই ধরালো কোনো হাতিয়ার ব্যবহার ক’রে গেছে।”
“তুমি এসব কি বলছো?”
“লাভিয়া মারা গেছে।”
“হায় ঈশ্বর! তুমি এখন কি করবে?”
“আমি চিনি এরকম একজন লোকের সাথে কথা বলবো। তার মাথায় যদি ঘিলু ব’লে কোনো কিছু থাকে তবে সে আমার কথা শুনবে। তাকে হত্যা করার জন্যে চিহ্নিত ক’রে রাখা হয়েছে।”