পর্ব ১
পর্ব ২
পর্ব ৩

বর্ন আইডেন্টিটি – ২৬

অধ্যায় ২৬

যুবকটির পাশে পাশে জ্যোৎস্না প্লাবিত রোয়ে দ্য বুলোয়ার পথ ধরে হাটছে বৃদ্ধ সৈনিক। যেহেতু অনেক কথাই বলা হয়ে গেছে তাই কেউই কোনো কথা বলছে না—স্বীকার, চ্যালেঞ্জ, অস্বীকার, আর পুণরায় আশ্বস্ত করা হয়েছে। ভিলিয়ার্সকে বিশ্লেষণ করতে হচ্ছে, মানতে হচ্ছে, আবার বর্জনও করতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে সে ক্ষেপেও যাচ্ছে—সে যে সব কথা শুনেছে তা যদি মিথ্যে হয় তবেই তার জীবনে স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে। কিন্তু সে কিছুই করলো না। সে একজন সৈনিক, হাল ছেড়ে দেয়া তার কাজ নয়।

এই তরুণটির কথায় অনেক সত্যতা আছে। এটা তার চোখ, তার কণ্ঠ শুনলেই বোঝা যায়। নামহীন লোকটা মিথ্যে বলছে না। অনিবার্য বেঈমানটা ভিলিয়ার্সের বাড়িতেই আছে। এটা এমন অনেক কিছুকে ব্যাখ্যা করছে যা এর আগে সে প্রশ্ন করতেও সাহস করে নি। একজন বুড়ো প্রাণ খুলে কাঁদতে চাচ্ছে এখন।

স্মৃতিহীন লোকটার মধ্যে অবশ্য তেমন একটা পরিবর্তন অথবা নতুন কিছু জানার ব্যাপার নেই। বহুরূপী কোনো অনুরোধ করছে না। তার গল্পটা খুবই বিশ্বাসযোগ্য, কারণ সেটা সত্যের উপর ভিত্তি ক’রে দাঁড়িয়ে আছে। কার্লোসকে তার খুঁজে বের করতেই হবে। গুপ্তঘাতক যা জানে সেটা তাকে জানতে হবে। ব্যর্থ হলে তার কোনো জীবন থাকবে না। এর বাইরে সে আর কিছুই বলছে না। সেন মেরি অথবা পোর্ত নোরেয় কথা বলা হলো না।

তার বদলে কার্লোস সে যা জানে সব কিছু স্মরণ করলো। এই ব্যাপারে তার জ্ঞান এতো ব্যাপক যে, ভিলিয়ার্সকে যখন কথাগুলো বললো বুড়ো জেনারেল তখন বিস্ময়ে চেয়ে রইলো। বুঝতে পেরেছিলো তথ্যগুলো খুবই গোপনীয়। বিদ্যমান অনেক তত্ত্বকে সেটা নাড়িয়ে দিলেও জেনারেলের মনে হয়েছে কথাগুলো সত্য। কারণ সেও এসব কিছু কিছু আগে থেকেই জানতো। তার ছেলের কারণে জেনারেলকে কার্লোসের উপর তার দেশের সবচাইতে গোপন ফাইলগুলো দেখার সুযোগ দেয়া হয়েছিলো। তবে স্মৃতিহীন লোকটার কথার সাথে সেই ফাইলের অনেক কথারই মিল নেই।

“যে মেয়েটার সাথে তুমি আর্জেনতুইলে কথা বলেছো, যে আমার বাড়িতে ফোন ক’রে থাকে, যে তোমার কাছে সব স্বীকার করেছে সে একজন অনুচর…”

“লাভিয়া,” বর্ন কথার মাঝখানে বললো।

জেনারেল থেমে গেলো। “ধন্যবাদ। সে তোমার ছবি তুলেছে।”

“হ্যা।”

“তাদের কাছে আগে কোনো ছবি ছিলো না?”

“না।”

“তাহলে তুমি যেমন কার্লোসকে পাকড়াও করতে চাচ্ছো তেমনি কার্লোসও তোমাকে পাকড়াও করতে চাইছে। অথচ তোমার কাছে তার কোনো ছবি নেই। তুমি কেবল দু’জন কুরিয়ারকে চেনো। যার মধ্যে একজন আমার বাড়িতে আছে।”

“হ্যা।”

বুড়ো মুখটা সরিয়ে নিলে আবারো নিরবতা নেমে এলো।

.

পথের শেষপ্রান্তে এসে পড়লো তারা, যেখানে একটা ছোটোখাটো হ্রদ আছে। হ্রদের চারপাশ কংক্রিটের ওরাকওয়ে দিয়ে বাঁধানো। ওয়াকওয়ের পাশে অনেকগুলো বেঞ্চ আছে বসার জন্যে। তারা নিরবে দ্বিতীয় বেঞ্চটার দিকে এগোলো। ভিলিয়ার্সই আগে মুখ খুললো।

“একটু বসি, এই বয়সে এতো শক্তি আমার নেই। এটা আমাকে মাঝে মাঝে বিব্রত করে।”

“আপনার ব্রিবত হওয়া উচিত না,” বর্ন তার পাশে বসতে বসতে বললো।

জেনারেল বর্নের দিকে তাকিয়ে বললো। “উচিত না জানি। তবে হই।” একটু চুপ থেকে জেনারেল আবার বললো, “বিশেষ ক’রে আমার বউয়ের সঙ্গে যখন থাকি।”

“সেটা অবশ্য খুব একটা গুরুত্বপূর্ন নয়,” জেসন বললো।

“তুমি ভুল করছো,” বুড়ো বললো। “আমি বিছানার কথা বলছি না। কখনও কখনও আমি আমার কাজকর্ম কমিয়ে ফেলে কয়েক সপ্তাহের জন্যে উধাও হয়ে যাই—মেডিটেরিনিয়ানে কাটিয়ে আসি।”

“বুঝতে পারছি না।”

“আমি আর আমার বউ প্রায়ই আলাদা থাকি। অনেক দিক থেকেই আমরা আলাদা আলাদাভাবে বসবাস করি। আনন্দ লাভ করি, একে অন্যের মতো ক’রে।”

“আমি এখনও বুঝতে পারছি না।”

“আমি নিজেকে আরো বিব্রত করবো কি?” ভিলিয়ার্স বললো। “যখন এক বৃদ্ধলোক কোনো আকর্ষণীয়া নারীর সাথে বসবাস করার ব্যাপারে অনীহা দেখায়, কয়েকটা বিষয় তখন বোধগম্য হয়ে ওঠে। অবশ্যই অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা আছে, আমার ক্ষেত্রে পাবলিক এক্সপোজারও রয়েছে। বড় বড় বাড়িতে প্রবেশ, সেলিবৃটিদের সাথে সহজেই বন্ধুত্ব করা।” বুড়ো একটু বিরতি দিলো। “সে কি কোনো প্রেমিক জুটিয়ে নিয়েছে?” জেনারেল নরম কণ্ঠে বলতে লাগলো আবার। “সে কি তরুণ আর শক্ত সামর্থ্য কারোর জন্যে মুখিয়ে আছে? যদি সে সেটা ক’রে থাকে, তবে সেটা মেনে নিতেই হয়—স্বস্তি লাভের জন্যে হলেও—কেবল আশা করি যে তার যেনো বুদ্ধিসুদ্ধি ঠিক থাকে। একজন নিবীর্য আর স্ত্রৈণ রাজনীতিক মাতাল রাজনীতিকের চেয়েও বেশি দ্রুত জনপ্রিয়তা হারায়। তার মানে ঐ রাজনীতিক একদম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। উদ্বিগ্ন হবার আরো কিছু আছে। মেয়েটা কি আমার নাম ব্যবহার করছে?”

“তাহলে আপনি অনুভব করতে পারছিলেন?” শান্তকণ্ঠে বললো জেসন।

“অনুভব করা আর বাস্তবতা এক জিনিস নয়!” বুড়ো জেনারেল পাল্টা বললো।

“মাঠ পর্যবেক্ষণে এসবের কোনো স্থান নেই।”

“তাহলে আপনি আমাকে কেন এসব বলছেন?”

“আজরাতে আমরা দু’জন যা দেখেছি তার একটা সরল ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। আমি প্রার্থনা করি সেটাই যেনো ঠিক হয়। তবে আমার মন বলছে তা হবে না। আমি সেটা জানি, যখন তুমি আমাকে লো ক্লাসিকের কথা বললে, তখনই আমার মধ্যে কিছু যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার উদয় হয়েছিলো। গত দু’ঘণ্টা ধরে আমি নিজের সাথে লড়াই করেছি। সেটা করার আর কোনো মানে হয় না। এই মহিলার আগে আমার নিজের সন্তানের অবস্থান।”

“কিন্তু আপনি বলেছিলেন, আপনি তার বিচারবুদ্ধির উপর আস্থা রাখেন। সে আপনাকে অনেক সাহায্য করে।”

“সত্য। আমি তাকে পাগলের মতো বিশ্বাস করতে চাই। দুনিয়ায় সবচাইতে সহজ কাজ হলো নিজেকে বোঝানো যে, তুমিই ঠিক। বুড়োদের বেলায়ও এটা প্রযোজ্য।”

“আপনি তাহলে বুঝতে পরেন নি?”

“যে সাহায্য সে আমাকে করে, যে বিশ্বাস আমি তাকে করি তাতে তো আমি এরকমটি করতে পারি না,” জেসনের দিকে তাকালো সে। “কার্লোসের ব্যাপারে তোমার অসাধারণ জ্ঞান রয়েছে। আমি নিজের হাতে তাকে গুলি করতে চাই। কিন্তু লোকটা সম্পর্কে আমি ফাইলে যা পড়েছি তার সাথে তোমার কথার খুব কম মিলই রয়েছে। তারপরও বলতে হয় তোমার মনোযোগ তার দক্ষতা, তার পদ্ধতি আর খুন করার ধরনের ওপরই বেশি। তুমি কার্লোসের অন্য দিকটা এড়িয়ে গেছো। সে কোনো অস্ত্র বিক্রি করে না, সে বিক্রি করে একটি দেশের গোপনীয়তা।”

“আমি সেটা জানি,” বর্ন বললো। “এটা সেই দিক নয়—”  

“উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি,” জেনারেল আবার বলতে লাগলো যেনো জেসনের কথাটা সে শুনতে পায় নি। “আমি ফ্রান্সের মিলিটারি এবং নিউক্লিয়ার সিকিউরিটি সংক্রান্ত গোপন দলিলগুলো দেখেছি—সম্ভব আরো পাঁচজন লোক দেখেছে, যারা খুবই আস্থাভাজন। আমরা দেখেছি মস্কো এটা জানে, ওয়াশিংটন ওটা জানে, পিকিং জানে অন্য কিছু।”

“আপনি এইসব বিষয় নিয়ে আপনার বউয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন?” বর্ন অবাক হয়ে জানতে চাইলো।

“অবশ্যই না। ঐসব পেপার যখন বাড়িতে নিয়ে আসলে একটা সিন্দুকে সেগুলো রাখতাম। আমি ছাড়া আর কেউ ঐ সিন্দুকটা খুলতে পারে না। তবে এটার আরেকটা চাবি আছে আমার বউয়ের কাছে। অন্য কেউ যদি এসব জানে তো সেটা আমার বউই জানে।”

“আমার মনে হয় সেটা হোতো খুবই বিপজ্জনক। চাবি আর তথ্য, দুটোই আপনার বউয়ের কাছ থেকে জোর ক’রে আদায় করা যেতে পারে।”

“এর অবশ্য কারণও আছে। আমি যে বয়সে এসে পৌঁছেছি তাতে যেকোনো দিন শেষ সময় ঘনিয়ে আসতে পারে। আমার যদি কিছু হয় তো তাকে বলা আছে সে মিলিটারি কনসিলারকে ফোন ক’রে জানাবে। আমার অফিসে গিয়ে নিরাপত্তারক্ষীরা না আসা পর্যন্ত সেখানেই অপেক্ষা করবে।”

“সে কি দরজার পাশে থাকতে পারে না, একেবারে সিন্দুকের পাশেই থাকতে হবে?”

“আমার বয়সী লোকেরা নিজের ডেস্কেই বেশি মৃত্যুনরণ ক’রে থাকে।” ভিলিয়ার্স দু’চোখ বন্ধ করলো। “সে আমার নিজের স্ত্রী। একটা বাড়িতে, একটা জায়গায় থাকি, সে এরকম কিছু করবে সেটা কেউই বিশ্বাস করবে না।”

“আপনি নিশ্চিত?”

“অনেকটা। সে-ই আমাকে বিয়ে করার জন্যে চাপ দিয়েছিলো। আমি বার বার আমাদের বয়সের পার্থক্যকার কথা বলেছি, তবে সে মানে নি। সে একটা প্রস্তাব দেয়, আমার কোনো সম্পত্তি দাবি করবে না ব’লে একটা কাগজে স্বাক্ষর করার কথা বলে। অবশ্য আমি তাকে দিয়ে সেই স্বাক্ষরটা করাই নি। আমার কাছে মুখে বলাটাই যথেষ্ট ছিলো। প্রবাদের কথাই ঠিক : বৃদ্ধলোক হলো বোকার হদ্দ। তারপরও সব সময়ই সন্দেহ থাকতো, সেগুলো ভ্রমণ আর অপ্রত্যাশিতভাবে আলাদা থাকার সময় হোতো।”

“অপ্রত্যাশিত?”

“তার অনেক বিষয়ে আগ্রহ ছিলো। আজ গ্রেনোবেলে একটা ফ্রাঙ্কো-সুইস জাদুঘর তো কাল আর্মস্টারডামের ফাইন আর্টসের একটা গ্যালারি, পরশু আবার মার্সেই’তে কোনো সমুদ্রবিজ্ঞানের উপর কনফারেন্স। এসব নিয়ে আমাদের মধ্যে উত্তপ্তবাক্য বিনিময় হোতো। আমি চাইতাম সে প্যারিসেই থাকুক। আমার সাথে কোনো কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে যাক। আমি চাইতাম সে অবশ্যই যাবে। সে যেতো না। অন্য কোথাও চলে যেতো। যেনো কেউ তাকে অর্ডার দিয়েছে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট জায়গাতে হাজির থাকতে হবে।”

গ্রোনোবেল—সুইস সীমান্ত সংলগ্ন একটি অঞ্চল, জুরিখ থেকে এক ঘণ্টার পথ। বুলোয়া-সরমে-চ্যানেলের তীরে অবস্থিত, লন্ডনে থেকে এক ঘণ্টার পথ। মার্সেই…কার্লোস।

“মার্সেই’র কনফারেন্সটা কবে হয়েছিলো?” জেসন জানতে চাইলো।

“মনে হয় গত আগস্টে। মাসের শেষের দিকে।”

“২৬শে আগস্ট, বিকেল পাঁচটায়। এ্যাম্বাসের হাওয়ার্ড লিল্যান্ড মার্সেই’র ওয়াটারফ্রন্টে নিহত হন।”

“হ্যা, আমি জানি,” ভিলিয়ার্স বললো। “তুমি এটা আগেও বলেছো। আমি লোকটার মৃত্যুতে দুঃখিত, তবে তার বিচার বুদ্ধির উপর আমার আস্থা ছিলো না।” বুড়ো সৈনিক থেমে বর্নের দিকে তাকালো। “মাই গড,” সে বিড়বিড় ক’রে বললো। “সে তাহলে তার সাথেই ছিলো। কার্লোস তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলো। সে তার কাছে গিয়েছিলো। অক্ষরে অক্ষরে তার আদেশ পালন করেছে!”

“আমি অবশ্য এতোটা ভাবি নি,” জেসন বললো। “আমি কেবল ভেবেছিলাম সে একজন তথ্যদাতা, মানে তথ্য রিলে ক’রে থাকে—-একজন অন্ধ রিলে। আমি এতোটা ভাবি নি।”

আচমকা বৃদ্ধলোকটি চিৎকার ক’রে উঠলো। তার চিৎকারে আছে সুগভীর মর্ম যাতনা। দু’হাতে নিজের মুখটা ঢেকে ফেললো সে।

বর্ন কিছুই করলো না। কিছু করারও নেই। “আমি দুঃখিত,” সে কেবল এটাই বললো।

জেনারেল নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বললো, “আমিও। আমার ব্যবহারের জন্যে ক্ষমা চাচ্ছি।”

“তার কোনো দরকার নেই।”

“আমার মনে হয় এ নিয়ে আর কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। যা করতে হবে আমি তাই করবো।”

“কি করবেন?”

জেনারেল উঠে দাঁড়ালো। তার চোয়ালটা খুব দৃঢ়। “তুমি কি সেটা জিজ্ঞেস করতে পারো?”

“আমাকে সেটা জিজ্ঞেস করতেই হবে।”

“সে যা করেছে তার জন্যে একটাই শাস্তি আছে। আমার ছেলের হত্যাকারীর সাথেই কেবল তার সংযোগ নেই সে এখন দেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে। যে দেশের জন্যে সারাজীবন আমি লড়াই করেছি, সেবা করেছি।”

“আপনি তাকে খুন করবেন?”

“আমি তাকে খুন করবো। সে আমাকে সত্য কথাটা বলবে এবং সে মরবে।”

“সে সব কিছু অস্বীকার করবে।”

“আমার তাতে সন্দেহ রয়েছে।”

“এটা তো পাগলামী!”

“শোনো, আমি অর্ধশতাব্দী ধরে ফ্রান্সের শত্রুদের সাথে লড়াই ক’রে আসছি। তাদের মধ্যে ফরাসিও আছে। সত্যটা আমাকে শুনতেই হবে।”

“সে কি করবে ব’লে আপনি মনে করেন? আপনি বলবেন আর ঠাণ্ডা মাথায় সে সব স্বীকার করে নেবে?”

“সে কোনো কিছুই ঠাণ্ডা মাথায় করবে না। তবে সে রাজি হবে। সে এটা বলবেই।”

“কেন বলবে?”

“কারণ তাকে আমি যখন অভিযুক্ত করবো, সে আমাকে খুন করার সুযোগ পেয়ে যাবে। আর যখনই সে ঐ চেষ্টাটা করবে, আমি আমার ব্যাখ্যা পেয়ে যাবো। পাবো না?”

“আপনি সেই ঝুঁকিটা নেবেন?”

“আমাকে যে নিতেই হবে।”

“ধরুণ সে আপনাকে খুন করার কোনো চেষ্টা করলো না?”

“এটা হবে না। আমরা দু’জনেই সেটা জানি। আমি তোমার চেয়ে অনেক বেশি পরিস্কার জানি।”

“আমার কথা শোনেন,” জেসন বললো। “আপনি বলেছিলেন আগে আপনার ছেলে, তার কথাটা ভাবুন! খুনির পিছু নিন। তার অনুচরের নয়। ঐ মহিলা আপনার জন্যে বড় একটা ক্ষত। কিন্তু কার্লোস তার চেয়েও বড়। আপনার ছেলেকে যে খুন করেছে তাকে আগে ধরুন! তাহলে দু’জনকেই ধরতে পারবেন। বউকে এখন কিছু করবেন না। কার্লোস সম্পর্কে যা জানেন সেটা ব্যবহার করুন। আমার সাথে মিলে শিকার করুন তাকে। এ পর্যন্ত কেউ তার এতো কাছে আসতে পারে নি।”

“তুমি এমন কিছু চাইছো যা আমি দিতে পারবো কিনা সন্দেহ আছে,” বুড়ো জেনারেল বললো।

“যদি আপনি আপনার ছেলের কথা না ভাবেন, যদি নিজের কথাই শুধু ভাবেন, তাহলে ঠিক আছে।”

“তুমি খুবই রুক্ষ্মভাবে বলছো, মঁসিয়ে।”

“আমি ঠিকই বলছি, আর আপনিও সেটা জানেন।”

“হ্যা, তোমার কথাই ঠিক,” সে বললো। “খুবই রূঢ় কিন্তু ঠিক। খুনিটাকে ধরতে হবে, ঐ খানকিটাকে নয়। আমরা কিভাবে একসাথে কাজ করবো? শিকার করবো একত্রে?”

বর্ন স্বস্তিবোধ ক’রে চোখ দুটো কয়েক মুহূর্তের জন্যে বন্ধ করলো। “কিছু করবেন না। কার্লোস আমাকে সারা প্যারিস তন্ন তন্ন ক’রে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি তার লোকদেরকে হত্যা করেছি। তার অনুচরদের প্রকাশ ক’রে ফেলেছি। একটা কনটাক্ট খুঁজে বের করেছি। আমি তার খুব কাছে এসে পড়েছি। আমরা যদি ভুল না করি, আপনার টেলিফোনটা খুব ব্যস্ত হয়ে উঠবে। এটা আমি নিশ্চিত করতে পারি।”

“কিভাবে?”

“আমি লো ক্লাসিকের আধডজন কর্মচারীকে পাকড়াও করবো। কয়েকজন কেরাণী, লাভিয়া, বারগোঁয়া এবং অবশ্যই সুইচবোর্ডের লোকটাকে। তারা মুখ খুলবে। আমিও মুখ খুলবো। তারপর আপনার ফোনটা খুব ব্যস্ত হয়ে উঠবে।”

“কিন্তু আমি কি করবো?”

“বাড়িতে থাকুন, বলবেন আপনার শরীর খারপ। আর যখনই ঐ ফোনটা বাজবে, যে-ই জবাব দিক না কেন, আশেপাশে থাকবেন। কথাগুলো শুনবেন। কোডগুলো ধরার চেষ্টা করবেন। চাকর-বাকরদের প্রশ্ন করবেন তারা তাদেরকে কি বলেছে। আপনি নিজেও শুনতে পারেন। আপনি যদি কিছু শুনতে পান ভালো, তবে আপনি শুনতে পাবেন না হয়তো। লাইনে যে-ই থাকুক না কেন সে জানবে আপনি আছেন। তারপরও আপনি এই রিলেটাকে বিভ্রান্ত ক’রে দেবেন। সেটা নির্ভর করছে আপনার বউ কোথায় আছে তার উপর—”

“ঐ বেশ্যাটা?” সৈনিকটি ক্ষিপ্ত হয়ে বললো।

“—কার্লোসকে তার বুহ্য থেকে আমরা বের হয়ে আসতে বাধ্য করবো।”

“কিভাবে?”

“তার যোগাযোগের লাইনগুলোতে বিঘ্ন ঘটাবো। তার নিরাপদ এবং অচিন্তনীয় রিলেগুলোতে বিঘ্ন সৃষ্টি করবো, ফলে সে আপনার স্ত্রীর সাথে একটা মিটিং করতে চাইবে।”

“সে তার নিজের অবস্থানের কথা একটুও জানাবে না।”

“আপনার স্ত্রীকে তার বলতেই হবে।”

বর্ন থামলো। আরেকটা ভাবনা তার মাথায় এলো। “যদি খুব বেশি বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয়, তবে একটা ফোন কল আসবে, অথবা এমন একজন লোক আপনার বাড়িতে আসবে যাকে আপনি চেনেন না। আর তখনই আপনার বউ তাকে বলে দেবে অন্য কোথায় দেখা করবে। যখন এটা ঘটবে তখন তার কাছ থেকে চাপাচাপি ক’রে একটা নাম্বার নিয়ে নেবেন যাতে তাকে পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে বেশ সতর্ক থাকবেন। আপনি তাকে যেতে বাঁধা দেবেন না। তবে দরকার হলে তাকে যেনো পান সে ব্যাপারটা নিশ্চিত করবেন। তাকে বলবেন খুবই স্পর্শকাতর মিলিটারি এক ব্যাপারে তার সঙ্গে আপনার কিছু কথা বলার দরকার হতে পারে। সেজন্যে একটা ফোন নাম্বার যেনো দিয়ে যায়, যাতে করে তার সাথে প্রয়োজনে আপনি যোগাযোগ করতে পরেন। এতে হয়তো সে খুবই আগ্রহী উঠবে।”

“এতে কি ফল পাওয়া যাবে?”

“সে কোথায় যাচ্ছে সেটা বলবে। হয়তো কার্লোসের ওখানেই সে যাবে। যদি কার্লোস নাও হয়, তার ঘনিষ্ঠ কেউ হবে। তারপর সেই খবরটা আপনি আমাকে জানিয়ে দেবেন। আমি আপনাকে একটা হোটেল আর রুম নাম্বার দেবো। রেজিস্ট্রির নামটা ভূয়া, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।”

“তুমি তোমার আসল নামটা কেন আমাকে বলছো না?”

“কারণ সচেতন বা অসচেতনভাবে যদি সেটা কখনও উল্লেখ করেন—আপনি মারা যাবেন?”

“আমি কোনো জরাগ্রস্তবৃদ্ধ নই।”

“না, আপনি তা নন। কিন্তু আপনি বেশ আহত বোধ করছেন। অনেক কষ্ট পেয়েছেন জীবনে। আপনি হয়তো আপনার জীবন নিয়ে ঝুঁকি নিতে পারেন। আমি সেটা করতে পারি না।”

“তুমি খুবই অদ্ভুত মানুষ, মঁসিয়ে।”

“হ্যা। আর শুনুন, আমাকে ফোন ক’রে যদি দেখেন একটা মেয়ে ধরেছে তবে ঘাবড়াবেন না। সে জানবে আমি কোথায় আছি। আমরা মেসেজটার জন্য সময় ঠিক করে রাখবো।”

“একটা মেয়ে?” জেনারেল একটু অবাক হলো। “তুমি কোনো মেয়ে বা অন্যকারো সম্পর্কে তো কিছু বলো নি!”

“আর কেউ নেই। তাকে ছাড়া আমি বাঁচতাম না। কার্লোস আমাদের দু’জনকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। সে আমাদের দু’জনকে খুন করার চেষ্টা করছে।”

“সে কি আমার ব্যাপারে কিছু জানে?”

“হ্যা। সে-ই আমাকে বলেছিলো আপনার সাথে কার্লোসের সম্পর্কটা সে বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি ভেবেছিলাম আপনি কার্লোসের লোক।”

“হয়তো তার সাথে আমি দেখা করবো।”

“কার্লোসকে শেষ করার আগে নয়—যদি তাকে শেষ করতে পারি– আপনি হযতো আমাদের দু’জনকে আর দেখতে পাবেন না। এরপর—যদি এরপর কিছু থাকে—আপনি হয়তো নিজেই আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চাইবেন না। আমি আপনার সাথে কোনো অসততা করছি না।”

“বুঝেছি। আমি কার্লোসের সাথে জড়িত নই, এটা ভাবার জন্যে ঐ মেয়েটাকে আমার হয়ে ধন্যবাদ দিয়ে দিও।”

বর্ন মাথা নেড়ে সায় দিলো। “আপনি কি নিশ্চিত হতে পারবেন যে, আপনার প্রাইভেট লাইনটাতে আঁড়িপাতা হচ্ছে না?”

“অবশ্যই। এটা নিয়মিতই চেক্ করা হয়।

“যখনই আপনি আমার কাছ থেকে ফোন আশা করবেন ফোনে হ্যালো বলেই দু’বার গলা খাকারি দেবেন। তাহলে আমি জানবো ফোনটা আপনিই ধরেছেন। যদি কোনো কারণে আপনি কথা বলতে না পারেন, আমাকে বলবেন সকালে যেনো আমি আপনার সেক্রেটারিকে ফোন করি। আমি আপনাকে দশ মিনিট বাদেই ফোন করবো। নাম্বারটা এবার বলুন?”

ভিলিয়ার্স নাম্বারটা দিলো। “তোমার হোটেল?” সে জানতে চাইলো।

“টেরাস। রুই দ্য মায়েস্ত্রো। যঁতমাত্রে। রুম ৪২০।”

“কখন তুমি শুরু করবে?”

“যতো শীঘ্র সম্ভব। আজকের বিকেলে।”

“একেবারে নেকড়ের মতো হয়ে যাও,” বৃদ্ধ সৈনিক বললো। এমন ভাবে সামনে এগিয়ে এলো যেনো কোনো কমান্ডার তার অফিসারকে নির্দেশ দিচ্ছে।

“দ্রুত আঘাত হানো।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *