পর্ব ১
পর্ব ২
পর্ব ৩

বর্ন আইডেন্টিটি – ২৫

অধ্যায় ২৫

রেস্তোরাঁর প্রবেশপথ থেকে দুশ’ গজ দক্ষিণে রেনল্ট গাড়িতে বর্ন অপেক্ষা করছে। গাড়িটা সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই ভিলিয়ার্সকে সে দেখলো ড্রাইভিং সিটে। বাকিরাও একে একে যার গাড়িতে ক’রে চলে গেছে ইতিমধ্যেই। ষড়যন্ত্রকারীরা বিজ্ঞাপন ক’রে বেড়ায় না। আর বৃদ্ধ লোকটি হলো একেবারে খাঁটি একজন ষড়যন্ত্রকারী।

এইতো, গাড়িটার হেডলাইট জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। নিজের গাড়ির হেডলাইটটা বন্ধ রেখে জেসন পিছু নিতে শুরু করলো। কিছু দূর যাবার পর গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলো জেসন। নিরিবিলি গ্রামীণ এলাকাটা দুই মাইল সামনেই। সেখানে তাকে খুব দ্রুত পৌঁছাতে হবে।

এগারোটা দশ বাজে। তিন ঘণ্টা আগে চাঁদের আলোতে এই পাহাড় আর খোলা প্রান্তর ভেসে গিয়েছিলো। এখন সেই চাঁদটা ঠিক আকাশের মাঝখানে। সে পৌঁছে গেলো। জায়গাটা তার কাজের জন্যে খুবই কার্যকরী হবে। এখন প্রশ্ন হলো ভিলিয়ার্সের গাড়িটা কিভাবে থামানো যায়। জেনারেল বৃদ্ধ হলেও দুর্বল নয়। যদি কোনোভাবে বুঝে ফেলতে পারে, তবে ঘাসের উপর দিয়েই দৌড়ে পালাবে। সবকিছুই টাইমিংয়ের উপর নির্ভর করছে।

বর্ন তার রেনল্ট গাড়িটা দ্রুতবেগে ছুটিয়ে আচমকা ইউ-টার্ন নিলো। অপেক্ষা করতে লাগলো হেডলাইটের আলো দেখার জন্যে। দূরে হেডলাইটটা দেখতে পেয়ে নিজের গাড়ির এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে স্টিয়ারিংটা এপাশওপাশ করতে করতে এগোলো সে। যেনো নিয়ন্ত্রণহীন কোনো ড্রাইভার গাড়িটা চালাচ্ছে। সোজা চালাতে পারছে না কোনোভাবেই। কিন্তু গতি ঠিকই বজায় আছে।

ভিলিয়ার্সের কোনো উপায় রইলো না। তার দিকে জেসনের গাড়িটা পাগলের মতো ছুটে আসতেই নিজের গাড়ির গতি কমিয়ে দিলো। যখন দুটো গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ হতে মাত্র বিশ ফিট বাকি তখনই জেসন আচমকা গাড়িটা বাম দিকে ঘুরিয়ে ফেলে ব্রেক কষলো সঙ্গে সঙ্গে। পিচঢালা পথে টায়ারের ঘর্ষণে তীক্ষ্ণ একটা শব্দ হলো। তার গাড়িটা থেমে গেলে সে জানালা খুলে একটা আর্তনাদ করলো। সেটা না চিৎকার না কান্না। কোনো অসুস্থ লোক অথবা মাতালের কন্ঠের মতো শোনালো। তবে তাতে কোনো ভীতিকর কিছু নেই। সে জানালায় কাঁচে হাত দিয়ে আঘাত করতে লাগলো। তার কোলে অস্ত্রটা।

ভিলিয়ার্সের গাড়ির দরজার শব্দটা সে শুনতে পেলো! বৃদ্ধ লোকটার হাতে কোনো অস্ত্র দেখা যাচ্ছে না। মনে হয় সে কোনো সন্দেহ করে নি। সংঘর্ষটা হয় নি ব’লে স্বস্তিবোধ করছে। জেনারেল নিজের গাড়ির হেডলাইটটা জ্বালিয়ে রেখেই রেনল্টের বাম দিকের জানালার সামনে এসে হাজির হলো। তার কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা।

“এসবের মানে কি? তুমি করছোটা কি? ঠিক আছো তো?” সে ফরাসিতে বলে বর্নের গাড়ির জানালার উপর হাত রাখলো।

“হ্যা, কিন্তু আপনি ঠিক নেই,” বর্ন ইংরেজিতে বললো অস্ত্রটা তাক্ ক’রে।

“কি…” বৃদ্ধ লোকটা আৎকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। “তুমি কে, এসব কি?”

জেসন অস্ত্রসহ গাড়ি থেকে বের হয়ে এলো। “আপনার ইংরেজি বেশ ভালো দেখে আমি খুব খুশি হলাম। নিজের গাড়ির দিকে যান। সেটা রাস্তা থেকে নামিয়ে রাখুন।”

“যদি তা না করি?”

“এক্ষুণি আপনাকে খুন করবো আমি। আমাকে ক্ষ্যাপাতে খুব বেশি কিছু লাগে না।”

“তুমি কি রেড বৃগেড-এর লোক? অথবা বাদের মেইনহফের প্যারিস শাখার কেউ?”

“কেন? সেরকম কিছু হলে কি আপনি খুশি হবেন?”

“আমি তাদের থুথু দেই! তোমাকেও!”

“আপনার সাহস নিয়ে কেউ কোনো দিন সন্দেহ করে নি, জেনারেল। গাড়ির দিকে যান।”

“এটা সাহসের কোনো ব্যাপার নয়!” ভিলিয়ার্স একটুও না নড়ে বললো। “এটা যুক্তির কথা। আমাকে খুন ক’রে তুমি কিছুই অর্জন করতে পারবে না, অপহরণ ক’রে আরো কম অর্জন করবে। আমার পরিস্কার আদেশ দেয়া আছে। আমার স্টাফ আর পরিবার সেটা বেশ ভালোভাবেই বোঝে। ইসরায়েলিরা একদম ঠিক বলেছিলো। সন্ত্রাসীদের সাথে কোনো সমঝোতা নয়। বানচোত, তোমার অস্ত্রটা ব্যবহার করো! না হলে এখান থেকে এক্ষুণি চলে যাও!”

জেসন লোকটার দিকে ভালো ক’রে লক্ষ্য করলো। “রেস্তোরাঁর বলছিলেন ফ্রান্স কারোর তল্পিবাহক হবে না। কিন্তু সেই ফ্রান্সেরই এক জেনারেল অন্য একজনের তল্পিবাহক। জেনারেল আঁদ্রে ভিলিয়ার্স, কার্লোসের একজন মেসেঞ্জার। কার্লোসের সৈনিক, কার্লোসের সংযোগ। কার্লোসের তল্পিবাহক।”

ক্ষুব্ধ দৃষ্টিটা আরো প্রসারিত হয়ে গেলো। তবে জেসন যে রকমটি আশা করেছিলো সেরকম নয়। ক্ষোভটা আচমকা ঘৃণায় বদলে গেলো। কোনো হিস্টিরিয়াগ্রস্ত নয়, শুধু গভীর ঘৃনা। ভিলিয়ার্স সোজা বর্নের গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো। তারপর আরেকটা। থাপ্পরটার জোর এতোই বেশি যে, জেসন নিজের পায়ের ভারসাম্য রাখতে হিমশিম খেলো। বৃদ্ধলোকটা আরো এগিয়ে এলো, জেসনের হাতের অস্ত্রটা সে গ্রাহ্যই করছে না। সোজা ঘুষি মারলো। পরপর কয়েকটা।

“শুয়োরের বাচ্চা!” চিৎকার ক’রে ভিলিয়ার্স বললো। “জঘন্য, নোংরা শুয়োর। বানচোত কোথাকার!”

“আমি গুলি করবো! খুন করবো! থামুন! থামুন!” বর্ন টুগার টিপতে পারলো না, নিজের গাড়ির দিকে ফিরে গেলে তার কাঁধ গাড়িটার ছাদে চেপে ধরলো বৃদ্ধলোকটা, তার হাত দুটো এলোপাতারি চলতে লাগলেঅ জেসন বর্নের উপর।

“পারলে তাই কর্—–আস্পর্ধা কতো! নোংরা! নর্দমার কীট!”

জেসন অস্ত্রটা মাটিতে ফেলে হাত দুটো দিয়ে বৃদ্ধের মারগুলো আঁটকাতে লাগলো। তার উপর আক্রমণ! আচমকা সে বাম হাত দিয়ে বুড়োর ডান হাতের কব্জিটা ধরেই উল্টোদিকে মোচড় মারলো। ভিলিয়ার্স হঠাৎ এই আক্রমণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। হাতটার নাজুক অবস্থানের কারণে ঠায় দাঁড়িয়ে পড়লো। একটুও নড়লো না। তাদের দু’জনের মুখ একেবারে কাছাকাছি। মাত্র এক ইঞ্চি দূরত্বে।

“আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনি কার্লোসের লোক নন? আপনি এটা অস্বীকার করছেন?”

ভিলিয়ার্স সামনের দিকে ঝুঁকে এলো। বর্নের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়াতে চাইছে। তার চওড়া বুকটা দিয়ে জেসনের বুকে জোরে আঘাত করলো সে। “আমি তোর বারোটা বাজাবো! শুয়োরের বাচ্চা!”

“আরে—হ্যা অথবা না?”

বুড়ো একদলা থুথু মেরে বসলো বর্নের মুখের উপর। তার চোখের আগুনটা এখন কুয়াশা হয়ে গেছে, অশ্রু ছল ছল করছে।

“কার্লোস আমার ছেলেকে খুন করেছে,” ফিফিস্ ক’রে বললো সে। “সে আমার একমাত্র ছেলেকে রুই দুবাকে খুন করেছে। আমার ছেলের জীবনটা ডিনামাইট দিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে!”

জেসন আস্তে আস্তে তার হাতটা ছেড়ে দিলো। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে সে শান্ত কণ্ঠে বললো। “গাড়িটা নিয়ে মাঠের ওখানে যান; আমাদেরকে কথা বলতে হবে, জেনারেল। কিছু একটা ঘটেছে যা আপনি জানেন না। আমাদের দু’জনেরই সেটা জানা উচিত।”

“কখনও না। অসম্ভব! কোনো কিছু ঘটে নি!”

“ঘটছে,” বর্ন সিডানের সামনের সিটে ভিলিয়ার্সের পাশে ব’সে বললো। “অবিশ্বাস্য একটা ভুল হয়ে গেছে! তুমি জানো না তুমি কি বলছো!”

“কোনো ভুল নয়—আমি কি বলছি সেটা আমি জানি, কারণ আমি নিজে নাম্বারটা খুঁজে পেয়েছি। এটা কেবল সঠিক নাম্বারই নয়, বরং চমৎকার একটি আড়াল। কোনো সুস্থ মানুষ আপনাকে কার্লোসের সাথে সম্পর্কিত করতেও সাহস করবে না। বিশেষ ক’রে আপনার ছেলের মৃত্যুর ঘটনাটা জানার পর। সে যে কার্লোসের হাতে মারা গেছে সেটা কি নিশ্চিত?”

“হ্যা। সুরেতও সেটা জানে। মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স এবং ইন্টারপোলও নিশ্চিত। আমি নিজে রিপোর্টগুলো পড়েছি।”

“তাতে কি বলা ছিলো?”

“কার্লোস তার এক বন্ধুর হয়ে এই কাজটা করেছে। তখন সে রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলো। তুমি তো জানোই, আমার ছেলে উগ্রপন্থীদের বিরোধীতা করতে গিয়ে নিহত হয়েছে।”

“উগ্ৰপন্থী?”

“উগ্রপন্থীরা সমাজতান্ত্রিকদের সাথে একটা অদ্ভুত কোয়ালিশন করেছিলো। আমার ছেলে এটা প্রকাশ ক’রে দিলে তারা তাকে খুন করে।”

“এজন্যেই কি আপনি আর্মি ছেড়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন?”

“অবশ্যই। বাবার কাজ ছেলে বহন করে, এটাই নিয়ম, কিন্তু আমার বেলায় হয়েছে উল্টো। আমি আমার ছেলের কাজ সমাধা করছি। সে কোনো সৈনিক ছিলো না, আমিও কোনো রাজনীতিবিদ নই। তবে আমি অস্ত্র আর বিস্ফোরকের ব্যাপারে একেবারে অজ্ঞ না। সে আমার ধ্যানধারণা পোষণ করতো, আমার দর্শনকে গ্রহণ করেছিলো, আর এসবের জন্যই সে খুন হয়েছে। আমার কাছে আমার সিদ্ধান্তটা খুব পরিস্কার। আমি আমাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসকে ধারণ করবো, রাজনীতিতে সেটা প্রতিষ্ঠিত করবো, আর তার শত্রুদেরকে মোকাবেলা করবো। সৈনিকেরা লড়াই করে, বুঝলে।”

“একজন সৈনিক তাহলে পেলাম।”

“কি বললে?”

“কিছু না।” বর্ন একটু থেমে আবার বলতে লাগলো। “রেস্তোরাঁর ঐ লোকগুলো। তাদের দেখে মনে হলো তারাই ফ্রান্সের অর্ধেক আর্মি চালাতো।”

“তাই করতো তারা, মঁসিয়ে। তারা এক সময়ে সেন সায়ার-এর রাগী-তরুণ কমান্ডার নামে পরিচিত ছিলো। এই রিপাবলিকটা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, মিলিটারি হয়ে গেছে অযোগ্য। তাদের কথা যদি ফ্রান্স শুনতো তবে ফ্রান্সের আজ এই পতন হতো না। তারা ছিলো প্রতিরোধ সংগ্রামের নেতা। তারা ইউরোপ জুড়ে যুদ্ধ করেছে। আফ্রিকায় যুদ্ধ করেছে।”

“তারা এখন কি করে?”

“বেশির ভাগই পেনশনে চলে, অনেকেই অতীত নিয়ে মোহাবিষ্ট। তারা মেরির কাছে প্রার্থনা করে এটা যেনো আবার না ঘটে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তারা এটা ঘটতে দেখছে। মিলিটারিকে ছেটেছুটে পঙ্গু ক’রে ফেলা হয়েছে। কমিউনিস্ট আর সোশালিস্টরা পার্লামেন্ট জেঁকে ব’সে আছে। তারাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। মস্কো এখানে কলকাঠি নাড়ে। একযুগেও এটা বদলাবে না। সর্বত্রই চলছে ষড়যন্ত্র। এটা এভাবে বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয়া যায় না।”

“কেউ হয়তো এটাকে খুবই চরমপন্থী হিসেবে দেখবে।”

“কিসের জন্যে? বেঁচে থাকার জনে? শক্তি? সম্মান? এইসব শব্দ কি, তোমার কাছে পুরনো ব’লে মনে হয়?”

“আমি তা মনে করি না। তবে আমি বলতে পারি সেসবের দোহাই দিয়ে অনেক ক্ষতি করা হয়ে গেছে।”

“আমাদের দর্শন ভিন্ন কথা বলে, আর আমি সেসব নিয়ে তর্ক করতে পরোয়া করি না। তুমি আমার সহকর্মীদের কথা জানতে চেয়েছো, আমি বলেছি, এবার তোমার সম্পর্কে আমাকে বলো। তুমি জানো না পুত্র হারানোর শোক কেমন।”

তীব্র যন্ত্রণাটা ফিরে এলো। কিন্তু সে জানে না কেন।

“আমি সমব্যথি হতে পারি,” জেসন বললো। “তবে এটা খাপ খেয়ে যায়।”

“তাৎক্ষণিকভাবে নয়! যেমনটি তুমি বললে। সুস্থ কোনো লোক আমাকে কার্লোসের সাথে ভাববে না। ঐ খুনি নিজেও তা ভাববে না। এই ঝুঁকিটা সে নেবে না। এটা অচিন্তনীয়।”

“একদম ঠিক। এজন্যেই আপনাকে ব্যবহার করা হয়েছে। এটা অচিন্তনীয়। আপনি হলেন চূড়ান্ত নির্দেশ দেবার মোক্ষম মাধ্যম।”

“অসম্ভব। কিভাবে?”

“আপনার ফোনে কেউ পরোক্ষভাবে, কোড ব্যবহার ক’রে কার্লোসের সাথে যোগাযোগ করে। নির্দিষ্ট কিছু শব্দ ব্যবহার করা হয় সেই লোকটাকে ফোনে পাবার জন্যে। সম্ভবত যখন আপনি না থাকেন। আবার হয়তো আপনি থাকলেও সেটা করা হয়। আপনি কি নিজে আপনার ফোন ধরেন?”

ভিলিয়ার্স ভুরু তুললো। “আসলে আমি ধরি না। সেই নাম্বারটা তো নয়ই। অনেককেই তো এড়াতে হয়। আমার একটা প্রাইভেট লাইন আছে।”

“সেটা ধরে কে?”

“সাধারণত হাউজকিপার। অথবা তার স্বামী, সে বাটলার হিসেবে কাজ করে। আবার আমার ড্রাইভারও সে। আর্মিতে শেষ কয় বছর সে আমার ড্রাইভার ছিলো। তাদের কেউ না ধরলে আমার বউ ধরে। অথবা আমার সহকারী। প্রায়ই সে আমার বাড়িতে এসে কাজ করে। বিশ বছর ধরে সে আমার এডজুটেন্ট।”

“আর কে?”

“আর কেউ নেই।”

“গৃহপরিচারিকারা?”

“কেউই স্থায়ী নয়। তাদের দরকার হলে কিছু সময়ের জন্যে ভাড়া নেয়া হয়। ব্যাংকের সম্পদের চেয়ে ভিলিয়ার্সের নামের মধ্যে যে সম্পদ, তা অনেক বেশি।”

“পরিস্কার করে কয়জন মেয়ে?”

“দু’জন। তারা সপ্তাহে দু’বার আসে। তবে সবসময় একই লোক আসে না।”

“আপনার এডজুটেন্ট এবং ড্রাইভারের উপর নজর রাখুন।”

হাস্যকর! তাদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত।”

“ব্রুটাসেরও তাই ছিলো,” জেসন বললো।

“তুমি কি সিরিয়াস?”

“আমি খুবই সিরিয়াস। আপনাকে সেটা বিশ্বাস করতে হবে। আমি যা বলছি সবই সত্যি।”

“তাহলে তুমি আমাকে সব বলো নি। বলেছো কি? যেমন তোমার নাম।”

“এটা খুব একটা জরুরি নয়। মনে রাখবেন, সব জানলে আপনি কষ্টই পাবেন।”

“কিভাবে?”

“আমি কার্লোসের অনুচরের ব্যাপারে মনে হয় না খুব বেশি ভুল করেছি—এ সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।”

বৃদ্ধলোক মাথা নেড়ে সায় দিলো। “এক নামহীন লোক আমাকে পথে ফাঁদে ফেলে অস্ত্রের মুখে এক অশ্লীল অভিযোগ তুলছে—আর সে আশা করছে আমি তার কথা মেনে নেবো। নামহীন এক লোকের কথা। যার চেহারাও আমি চিনি না। কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণও নেই তার কাছে, কেবল বলছে কার্লোস তাকে খুন করতে মরিয়া হয়ে আছে। বলো, আমি কেন সেই লোকটাকে বিশ্বাস করবো?”

“কারণ,” বর্ন বললো। “সে যদি সেটা বিশ্বাস না করতো তবে সে আপনার কাছে আসার কোনো কারণই খুঁজে পেতো না।”

ভিলিয়ার্স জেসনের দিকে চেয়ে রইলো। “না, তার চেয়ে ভালো কারণ আছে। একটু আগে তুমি আমাকে আমার জীবন দিয়েছো। তুমি অস্ত্রটা ফেলে দিয়েছো, গুলি করো নি। কিন্তু ইচ্ছে করলেই সেটা তুমি করতে পারতে। খুব সহজেই। তবে আমি দেখেছি, তোমার চোখে ছিলো আমার সাথে কথা বলার আকুতি।”

“আমার মনে হয় না আমি কোনো আকুতি জানিয়েছি।”

“তোমার চোখে সেটা ছিলো। সব সময় চোখেই থাকে। খুব কমই সেটা মুখে বলা হয়। তোমার রাগটাও সত্যি ছিলো…আমারটার মতো।” বুড়ো এবার রাস্তা থেকে দশ গজ দূরে রেনল্ট গাড়িটার দিকে মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করলো। “আমার সাথে পার্ক মঁশিউতে আসো। আমার অফিসেই বাকি কথাগুলো বলবো। আমি কসম খেয়ে বলছি তুমি ঐ দু’জন সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করছো। সিজার ব্রুটাসের ব্যাপারে অন্ধ ছিলো। আমি তা নই।”

“আমাকে যদি আপনার বাড়িতে যাবার সময় কেউ দেখে ফেলে তবে আমি খুন হয়ে যাবো। আপনিও।”

“আমার সহকারী আর ড্রাইভার চলে গেছে। তারা সকালের আগে আর বাড়িতে আসবে না। তারপরও, তুমি বাড়ির বাইরে থেকো। আমি ভেতরটা চেক ক’রে দেখে এসে তোমাকে ভেতরে নিয়ে যাবো। আর যদি ভেতরে নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু দেখি তবে বাড়িতে নেবো না তোমাকে। আমি বের হয়ে এসে গাড়ি নিয়ে চলে যাবো, তুমি আমাকে অনুসরণ করবে। তারপর এক জায়গায় এসে আমরা থামবো। কথা বলবো।”

“আপনি কেন আমাকে পার্ক মশিউ’তে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন?”

“তাহলে আর কোথায় নিয়ে যাবো? আমি অপ্রত্যাশিত মুখোমুখি হবার যে আৎকে ওঠা তাতে বিশ্বাস করি। আরো একটা কারণও আছে। তুমি যা বললে আমি চাই আমার বউও সেটা শুনুক। সেও একজন নারী যোদ্ধা ছিলো। তার এমন এনটেনা আছে যা ফিল্ডর অফিসারের কাছে ধরা না পড়লেও তার কাছে ধরা পড়ে যায়। আমি তার বিচার বিবেচনার উপর নির্ভর করি। তোমার কথা শোনার পর সে হয়তো আচরণের কোনো ধরণ সম্পর্কে কিছু ধরতে পারবে।”

বর্নকে কথাটা বলতেই হলো। “আমি আপনাকে ফাঁদে ফেলেছি একটা ভান করে। আপনি আমাকে আরেকটা ভান ক’রে ফাঁদে ফেলতে পারেন। আমি কি ক’রে জানবো পার্ক মশিউ কোনো ফাঁদ নয়?”

বৃদ্ধলোকটি একটুও ইতস্তত করলো না। “ফ্রান্সের একজন জেনারেল তোমাকে কথা দিচ্ছে। তোমার আর কি চাই। সেটা যদি তোমার কাছে যথেষ্ট ব’লে মনে না হয় তবে অস্ত্রটা নিয়ে কেটে পড়ো।”

“যথেষ্ট বলেই মনে হচ্ছে,” বর্ন বললো। “এজন্যে নয় যে, এটা একজন জেনারেলের কথা, বরং এটা এমন একজন লোকের কথা যার ছেলে রুই দুবাকে নিহত হয়েছে।”

.

প্যারিসে ফিরে আসার ভ্রমণটা জেসনের কাছে খুব দীর্ঘ ব’লে মনে হলো। তার মাথায় অসংখ্য ইমেজ হুড়োহুড়ি করেছে। সারা শরীর ঘেমে উঠছে। মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা শুরু হয়ে সেটা বুক থেকে পেটে গিয়ে গিট পাকালো। তার চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে।

আকাশে মৃত্যু… আকাশ থেকে। অন্ধকার নয়, চোখ ঝলসানো আলো। অরণ্যের নিরবতা…নদীর তীর। পাখির কিচির মিচির ডাকের পরই মেশিনের শব্দ। পাখি…মেশিন…আকাশ থেকে নেমে আসছে, চোখ ঝলসানো আলো। বিস্ফোরণ। মৃত্যু। অল্পবয়সীদের। খুবই অল্পবয়সীদের 1

বন্ধ করো! স্টিয়ারিংটা ধরো! রাস্তার দিকে মনোযোগ দাও! কিছু ভেবো না! ভাবনটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক আর তুমি জানো না কেন।

তারা পার্ক দু’মশিউর বৃক্ষশোভিন লাইনে প্রবেশ করলো। ভিলিয়ার্সের গাড়িটা একশো ফিট সামনে। জেনারেলের বাড়ির বাম দিকে একটা খালি জায়গা আছে। সেই জায়গাটাতে তাদের দু’জনের গাড়ির স্থান সংকুলান হবে। ভিলিয়ার্স জানালা দিয়ে হাত বের ক’রে ইশারা করলো, জেসন যেনো তার পেছনে থাকে।

তারপরই জেসন দেখতে পেলো। প্রবেশপথের আলোর দিকে গেলো তাকালো সে। সেখানে একটা অবয়ব। সেই দৃশ্যটা এতোটাই চমকে যাবার মতো যে, তার হাতটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অস্ত্রের দিকে চলে গেলো।

তাকে তাহলে একটা ফাঁদে টেনে আনা হয়েছে? ফ্রান্সের জেনারেলের প্রতিশ্রুতি তাহলে একেবারেই মূল্যহীন?

ভিলিয়ার্স তার সিডানটা জায়গা মতো রাখলে বর্ন চারপাশে তাকালো। কেউ তার দিকে আসছে না। ধারে কাছেও কেউ নেই। এটা কোনো ফাঁদ নয়। এটা অন্য কিছু। বুড়ো সৈনিক যা জানে না এটা তারই একটা অংশ।

ভিলিয়ার্সের দরজার সামনে সিঁড়িতে এক অল্পবয়সী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে; খুবই আকর্ষণীয় এক মেয়ে। সে বিরতিহীন কথা বলে যাচ্ছে। সিঁড়ির উপরের ধাপে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোককে উদ্বিগ্নভাবে কিছু বলছে। লোকটা এমনভাবে মাথা নাড়ছে যেনো সব নির্দেশনা মেনে নিচ্ছে সে। এই লোকটা হলো লো ক্লাসিক-এর সুইচবোর্ডের ধূসর চুলের লোকটা। এই মুখটা জেসন খুব ভালো করেই চেনে। যদিও তাকে জানে না। এই মুখটা অন্য অনেকগুলো ছবি উস্কে দিলো…ছবিগুলো এতোটা হিংস্র আর মন্ত্রণাদায়ক যে, তাকে গত আধঘণ্টা ধরে রেনল্ট গাড়িতে সেটা কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে।

কিন্তু এটা আলাদা। এই মুখটা একটা ঘন অরণ্য আর রাতের আকাশের ছবি নিয়ে এলো। একের পর এক বিস্ফোরণ। বিরামহীন গুলির শব্দ।

বর্ন দরজার দিকে থেকে চোখটা সরিয়ে উইন্ডশিল্ড দিয়ে ভিলিয়ার্সের দিকে তাকালো। জেনারেল হেডলাইটটা বন্ধ ক’রে গাড়ি থেকে বের হচ্ছে। জেসন তার গাড়িটা নিয়ে জেনারেলের গাড়ির পেছনের বাম্পারে আলতো ক’রে আঘাত করলে জেনারেল পেছনে ফিরে তাকালো। জেসন তার হেডলাইটটা বন্ধ ক’রে ভেতরের বাতিটা জ্বালিয়ে দিয়ে হাত উঁচিয়ে ধরলো—হাতের তালু নিচের দিকে তারপর সেটা দু’বার তুলে ধরলো। বুড়ো সৈনিককে বোঝাতে চাইলো গাড়িতেই যেনো থাকে সে। ভিলিয়ার্স মাথা নেড়ে সায় দিলে জেসন ভেতরের বাতিটা নিভিয়ে দিলো।

সে আবার প্রবেশদ্বারের সামনে তাকালো। লোকটা দুয়েক ধাপ নেমে এসে মেয়েটার কথা শুনছে। বর্ন এবার মেয়েটাকে পরিস্কার দেখতে পেলো। মধ্য বয়সী হবে। ছোটো ছোটো ক’রে তার কালো চুলগুলো বেশ স্টাইল ক’রে কাটা। গায়ের চামড়া সূর্যের আলোতে পোড়ানো। মেয়েটা বেশ লম্বা। তার দেহ ক্ষীণ, লম্বা টাইট ফিটিং পোশাকটা ভেদ ক’রে সুডৌল স্তন জোড়া বেশ স্পষ্টভাবেই চোখে পড়ে। মেয়েটা যদি ভিলিয়ার্সের বাড়ির কেউ হয়ে থাকে তবে সে তার কথা উল্লেখ করে নি। তার মানে সে বাড়ির কেউ না। সে একজন অতিথি। সে জানে বুড়ো লোকটার বাড়িতে কখন আসতে হয়। এটা অনুচর থেকে অনুচর-এর কৌশলটার সাথে মিলে যায়। তার মানে মেয়েটার সাথে ভিলিয়ার্সের বাড়ির যোগাযোগ আছে। বুড়ো তাকে চিনবে। কিন্তু কতোটা ভালো ক’রে? জবাবটা অবশ্যই ভালো হবে না।

ধূসর চুলের সুইচবোর্ড অপারেটর শেষবার মাথা নেড়ে বিদায় জানিয়ে পথের দিকে পা বাড়ালে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো। বাড়ির দরজার সামনের সিঁড়িটার দিকে বর্ন তাকালো।

কেন এই বাড়ির সিঁড়ি আর দরজাটা তার কাছে অন্যকিছু মনে হচ্ছে? ছবিগুলো। বাস্তবিকই সেটা বাস্তব নয়।

বর্ন গাড়ি থেকে নেমে জানালার দিকে তাকালো। পর্দার কোনো নড়ন-চড়ন হয় কিনা দেখলো। কিছুই দেখা গেলো না। সে দ্রুত ভিলিয়ার্সের গাড়ির দিকে গেলো। জেনারেলের গাড়ির সামনের জানালার কাঁচ নিচে নামানো। জেনারেলের চোখে মুখে জিজ্ঞাসা।

“তুমি এসব করছো কি?” জানতে চাইলো।

“আপনার বাড়িতে,” জেসন বললো। “এইমাত্র আমি যা দেখলাম তা কি আপনি দেখেছেন?”

“হ্যা। তো?”

“মেয়েটা কে? তাকে চেনেন?”

“আশা তো করি চিনি! সে আমার স্ত্রী।”

“আপনার স্ত্রী?” বর্নের চোখেমুখে স্পষ্ট বিস্ময়।

“আমার মনে হয় আপনি বলেছিলেন…সে একজন বয়স্ক মহিলা। আপনি তার বিচার বুদ্ধির উপর আস্থা রাখেন।”

“ঠিক তা নয়। আমি বলেছি সে একজন পুরনো সৈনিক। আর আমি অবশ্যই তাকে শ্রদ্ধা করি, তার বিচার বুদ্ধির উপর আস্থা রাখি। কিন্তু সে হলো আমার দ্বিতীয় স্ত্রী—আমার যুবতী—আমার প্রথম বউ আট বছর আগে মারা গেছে।”

“ওহ্ ঈশ্বর…”

“আমাদের দু’জনের বয়সের তারতম্য নিয়ে মাথা ঘামাবে না। সে দ্বিতীয় মাদাম ভিলিয়ার্স হিসেবে গর্বিত এবং সুখী। পার্লামেন্টে সে আমাকে বেশ সাহায্য করে।”

“আমি দুঃখিত,” বর্ন নিচু কণ্ঠে বললো। “হায় ঈশ্বর, আমি দুঃখিত।”

“কি ব্যাপারে? তুমি তাকে অন্য কারোর সাথে গুলিয়ে ফেলেছো নাকি? লোকে এরকম হরহামেশাই করে। সে তো খুবই আকর্ষণীয় একটা মেয়ে। আমি তাকে নিয়ে গর্বিত।” ভিলিয়ার্স দরজা খুলতে খুলতে বললো। “তুমি এখানে অপেক্ষা করো। আমি ভেতরে গিয়ে দেখে আসি। সব ঠিক থাকলে আমি দরজা খুলে তোমাকে ইশারা করবো। আর যদি তা নয়, তবে আমি গাড়িটা নিয়ে সোজা চলে যাবো।”

বর্ন ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। “জেনারেল, আপনাকে আমি একটা প্রশ্ন করি। জানি না কিভাবে করবো, কিন্তু করতে হচ্ছে। আমি আপনাকে বলেছিলাম আপনার নাম্বারটা আমি একটা জায়গা থেকে পেয়েছিলাম, কিন্তু জায়গাটার নাম বলি নি। কার্লোস সেই জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে।” বর্ন গভীর ক’রে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আবারো বলতে শুরু করলো। “এবার আমার প্রশ্নটা ভালো ক’রে ভেবে জবাব দেবেন। আপনার স্ত্রী কি লো ক্লাসিক থেকে কাপড় কেনে?”

“সেন অনরের?”

“হ্যা।”

“মনে হয় না।”

“আপনি নিশ্চিত?”

“খুব। এমনকি ঐ দোকানের কোনো বিলও আমি কখনও দেখি নি। তবে সে আমাকে বলেছে ঐ দোকানের পোশাক আর ডিজাইনগুলো সে খুবই অপছন্দ করে। আমার বউ খুব ভালো ফ্যাশন সচেতন।”

“ওহ্, ঈশ্বর।”

“কি?”

“জেনারেল আমি আপনার বাড়িতে যেতে পারবো না। আপনি খুঁজে পান না পান তাতে কিছু যায় আসে না। আমি ওখানে যেতে পারবো না।”

“কেন নয়? তুমি কি বলছো?”

“যে লোকটা আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলো সে কার্লোসের অনুচর। লো ক্লাসিকে তাকে আমি দেখছি।”

জেনারেলের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। নিজের বাড়ির দিকে তাকালো সে। কালো দরজাটা আর পিতলের হাতলগুলো ল্যাম্প পোস্টের আলোতে জ্বলজ্বল করছে।

.

ছোপছোপ দাগযুক্ত ভিখেরি নুয়েলি সুর সেইনের চার্চের ব্রোঞ্জ দরজার দিকে তার টুপিটা ছুড়ে মারলো।

দু’জন যাজকের ভ্রুকুটি উপেক্ষা ক’রে প্যাসেজওয়ে দিয়ে হেটে গেলো সে। দু’জন যাজকই হতাশ হলেন। ভিক্ষুকটি দ্বিতীয় সারির একটা আসনে ব’সে ক্রশ এঁকে হাটু মুড়লো। তার মাথাটা নোয়ানো, প্রার্থনারত। সে তার বাম হাতের হাতা গুটিয়ে ঘড়িটা দেখলো। তার বেশভূষার সঙ্গে এই ঘড়িটা একেবারেই বেমানান। ঘড়িটা ডিজিটাল এবং অনেক দামি। কার্লোস এটা তাকে উপহার দিয়েছে। একবার সে কার্লোসের সাথে কনফেশনে বিশ মিনিট দেরি ক’রে এসছিলো। তাতে ক’রে কার্লোস খুব হতাশ হয়ে তাকে সময়জ্ঞান ঠিক রাখার জন্যে এই ঘড়িটা দিয়েছে। তাদের পরবর্তী সাক্ষাতে কার্লোস সেটা স্বচ্ছ পর্দার নিচ দিয়ে তাকে দিয়েছিলো।

সময় হয়ে গেছে। ভিক্ষুক উঠে দ্বিতীয় বুথের দিকে এগোলো। পর্দাটা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো।

“অ্যাঙ্গেলাস দোমিনি।”

“অ্যাঙ্গেলাস দোমিনি, ঈশ্বরের সন্তান,” চাপা কণ্ঠটা বললো। কালো কোট পরে আছে সে। “আপনার দিন কি ভালো যাচ্ছে?”

“দিন ফুরিয়ে আসছে, তবে ভালোই যাচ্ছে…”

“বেশ,” আবছায়া অবয়বটা কথার মাঝখানে বললো, “কি এনেছেন আমার জন্যে? আমার ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আমি লক্ষ-লক্ষ ডলার দিয়েছি, অযোগ্য আর ব্যর্থ হবার জন্যে। মক্রজে কি হয়েছিলো? মঁতেইন-এর এ্যাম্বাসি থেকে যে মিথ্যে কথাটা বলা হয়েছিলো সেটার জন্যে কে দায়ি? কে সেটা গ্রহণ করেছিলো?”

“অবার্জ দু’কোয়ে-টা ছিলো একটা ফাঁদ, তারপরও কেউ খুন হয় নি। সেটা ঠিক কি তা জানা খুব কঠিন। করবেলিয়া নামের অ্যাটাশিটা যদি বার বার মিথ্যে তথ্য দিয়ে থাকে, তবে আমাদের লোকজন মনে করছে সে এ ব্যাপারটা না জেনেই করছে। সে মেয়েটার কাছে বোকা বনেছে।”

“তাকে কেইন বোকা বানিয়েছে! বর্ন প্রতিটি সোর্স ট্রেস্ করছে। ভূয়া ভূয়া তথ্য তাদেরকে গেলাচ্ছে। এভাবে প্রত্যেককে উন্মুক্ত করছে। কিন্তু কেন? কার কাছে? আমরা এখন জানি সে কি এবং কে? তবে সে ওয়াশিংটনে কিছু রিলে করছে না। সে প্রকাশ্য হতে অস্বীকার করছে।”

“একটা জবাব দেবার জন্যে আমাকে ফিরে যেতে হবে অনেক বছর আগে। তবে এটা সম্ভব সে তার কর্তাদের কাছ থেকে কোনোরকম নাক গলানোটা চাচ্ছে না। আমেরিকান ইন্টেলিজেন্স একে অন্যের সাথে খুব কমই যোগাযোগ ক’রে থাকে। স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ে তথ্য বিক্রি ক’রে তিনচারগুন টাকা কামিয়েছে একই স্টেশনের কাছে। হয়তো কেইন অপেক্ষা করবে, যতোক্ষণ না একটা মাত্র এ্যাকশন নেয়ার সময় আসে। উপরওয়ালার সাথে কৌশল নিয়ে কোনো মতপার্থক্য থাকবে না।”

“বয়স আপনার বুদ্ধিসুদ্ধিকে ভোঁতা করে নি দেখছি, পুরনো বন্ধু। এজন্যেই আমি আপনাকে বার বার ডাকি।”

“কিংবা হয়তো,” ভিক্ষুক আবারো বলতে লাগলো, “সে আসলেই বেঈমানী করেছে।”

“আমার তা মনে হচ্ছে না, তবে তাতে কিছুই যায় আসে না। ওয়াশিংটন তাই মনে করে। অ্যাবোট মারা গেছে, ট্রেডস্টোনের সবাই মারা গেছে। কেইন একজন খুনি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।”

“অ্যাবোট, মানে সন্ন্যাসী?” ভিক্ষুক বললো। “অতীতের একটা নাম। সে বার্লিনে তৎপর ছিলো। ভিয়েনায় তাকে আমরা চিনতাম ভালো করেই। এই হলো আপনার জবাব, কার্লোস। যতোদূর সম্ভব সংখ্যা কামিয়ে আনাটা সন্ন্যাসীর একটা স্টাইল। তাতে সম্ভাবনাগুলো অল্পতে নেমে আসে। সে এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি ক’রে কাজ করতো যে, তার সার্কেলে অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আপোষ করা হয়েছে। সে হয়তো কেইনকে কেবলমাত্র তার কাছেই রিপোর্ট করতে বলেছিলো। কয়েক মাসের নিরবতার ব্যাপারে ওয়াশিংটনের যে বিভ্রান্তি ছিলো, এটা সেটাকেই ব্যাখ্যা করতো।”

“সেটা কি আমাদেরকেও ব্যাখ্যা করে? কয়েক মাসের নিরবতা, একদম তৎপরতা নেই।”

“কতোগুলো সম্ভাবনা আছে। অসুস্থতা, অবসাদ, নতুন কোনো প্রশিক্ষণের জন্যে ফিরে যাওয়া। এমনকি শত্রুপক্ষের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়া। মনে রাখবে, সন্ন্যাসীর অসংখ্য কৌশল ছিলো

“তারপরও, মরার আগে সে তার এক সহযোগীকে বলে গেছে কি হচ্ছে সে ব্যাপারে নাকি সে কিছুই জানে না। এমনকি লোকটা যে কেইন সে ব্যাপারেও নাকি সে নিশ্চিতও নয়।”

“সহযোগীটি কে?”

“জিলেট নামের একজন। সে আমাদের লোক। তবে অ্যাবোট সেটা জানতো না।”

“আরেকটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা আছে। এরকম লোকজনদের ব্যাপারে অ্যাবোটের বেশ ভালো ধারণা ছিলো। ভিয়েনাতে বলা হোতো যে, ডেভিড অ্যাবোট পর্বতের উপরে ঈশ্বরকে অবিশ্বাস ক’রে একটা বেকারি খুঁজতো।”

“এটা সম্ভব। আপনার কথাগুলো স্বস্তিদায়ক। অন্যের যা দেখতে পায় না আপনি সেটা দেখতে পান।”

“আমার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। এক সময় আমি বেশ হোমড়াচোমড়া ছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত টাকা-পয়সা নষ্ট ক’রে ফেলেছি।”

“আপনি এখনও তাই করেন।”

“একজন বেহিসেবী-আমি আর কি বলতে পারি?”

“অবশ্যই অন্য কিছু।

“তুমি খুবই অর্ন্তদৃষ্টিসম্পন্ন, কার্লোস। আমাদের আরো অনেক আগেই দেখা হওয়ার দরকার ছিলো।”

“এখন আপনি বিনয়ী হচ্ছেন।”

“সব সময়ই। আমি জানি তুমি আমার জীবনটা যেকোনো মুহূর্তে শেষ ক’রে দিতে পারো। তাই আমাকে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ন কিছু করতে হয়। আর সেটা কেবল অভিজ্ঞতাপ্রসূত হলে হবে না।”

“আপনি আমাকে কি বলবেন?”

“এটা হয়তো খুব মূল্যবান কিছু নয়, তবে এটা কিছু একটা। আমি বেশ ভালো পোশাক পরে দিনটা কাটিয়ে দিয়েছি অবার্জ দু’কোঁয়েতে। একটা লোক আছে সেখানে, মোটা এক লোক—সুরেত তাকে জিজ্ঞাসাবাদ ক’রে ছেড়ে দেয়—তার চোখ দুটোও খুব অস্থির ছিলো। সে খুব বেশি ঘামছিলো। তার সাথে আমি কথা বলেছি। পঞ্চাশের দশকে বানানো ন্যাটোর একটা আইডি-কার্ড তাকে দেখিয়েছিলাম। মনে হচ্ছে সে গতকাল রাত তিনটার দিকে এক সোনালী চুলের লোক আর এক মহিলার জন্যে একটা গাড়ি ভাড়া করার ব্যাপারে কথাবার্তা বলেছে। বর্ননাটা আর্জেনতুইলে’র থেকে তোলা ছবির সাথে মিলে যায়।”

“ভাড়া করা?”

“সেরকমই। গাড়িটা একদিন পর ফেরত দেয়ার কথা।”

“এটা কখনই ঘটবে না।”

“অবশ্যই না। তবে এটা একটা প্রশ্নের জন্ম দেয়, দেয় না? কেইন কেন এভাবে একটা গাড়ি ভাড়া নিতে যাবে?”

“যতো দ্রুত সম্ভব, অনেক দূরে যাওয়ার জন্যে।”

“তাহলে এই তথ্যটার কোনো মূল্য নেই,” ভিক্ষুক বললো। “কিন্তু সবার অলক্ষ্যে অনেক ভাবেই তো দ্রুত ভ্রমণ করার পথ খোলা আছে। আর বর্ন একজন লোভী ক্লার্ককে বিশ্বাস করবে, সেটা খুবই কম বিশ্বাসযোগ্য ব’লে মনে হচ্ছে। সে হয়তো খুব সহজেই সুরেত’র কাছে খবরটা দিয়ে পুরস্কারের টাকা বাগিয়ে নিতে পারে। অথবা অন্য কেউ।”

“আপনার বক্তব্যটা কি?”

“আমার মনে হচ্ছে, বর্ন এই গাড়িটা নিয়েছে প্যারিসের কাউকে অনুসরণ করার জন্যে। লোকজনের ভীড়ে ঘোরাঘুরি না ক’রে, কারোর দৃষ্টিতে না প’ড়ে, এমন কোনো ভাড়া গাড়ি না নিয়ে যা ট্রেস্ করা যাবে—সে এই গাড়িটা নিয়েছে। একটা সাদামাটা কালো রেনল্ট গাড়ি কারোর চোখে পড়বে না। তবে কাকে দিয়ে তার খোঁজাটা শুরু করবে?”

আবছায়ার অয়বটা ঘুরলো। “লাভিয়া,” গুপ্তঘাতক আস্তে ক’রে বললো। “এবং লো ক্লাসিকে যাদেরকে সে সন্দেহ করেছে। সেটাই একমাত্র জায়গা যেখান থেকে সে শুরু করবে। তাদেরকে নজরদারী করা হবে, আর কয়েক দিনের মধ্যে—কয়েক ঘণ্টা সম্ভবত—একটা সাদামাটা কালো রেনল্ট গাড়ি দেখা যাবে, তাকেও পাওয়া যাবে। আপনার কাছে কি গাড়িটার পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা রয়েছে?”

“পেছনের বাম দিকে তিনটি ফুটো রয়েছে।”

“ভালো, কথাটা ছড়িয়ে দিন। গ্যারাজ, পথঘাট, আর পার্কিংলটগুলো ছেঁকে ফেলুন। যে ওটা খুঁজে পাবে তাকে আর এই জীবনে কাজ করতে হবে না।”

“এরকম বিষয় নিয়ে কথা বলাটা…”

একটা খাম পর্দার নিচ দিয়ে বের হয়ে এলো। “আপনার তত্ত্বটা যদি ঠিক হয় তাহলে এটাকে একটা উপহার হিসেবেই বিবেচনা করবেন।”

“আমার কথা ঠিক, কার্লোস।”

“আপনি কেন এতোটা নিশ্চিত?”

“কারণ কেইন তাই করে যা আপনি করেন—পুরনো দিনে আমিই সেরকমই করতাম। তাকে শ্রদ্ধা করতে হবে।

“তাকে হত্যা করা হবে,” গুপ্তঘাতক বললো। “টাইমিংয়ের সাথে মিল আছে। কয়েক দিনের মধ্যেই পঁচিশে মার্চ আসছে। মার্চ ২৬, ১৯৬৮ সালে জেসন বর্নকে তাম কুয়ান জঙ্গলে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিলো। এখন অনেক বছর পর—আরেকজন জেসন বর্নকে শিকার করা হচ্ছে। আমাদের মতো আমেরিকানরাও তাকে খুন করার জন্যে মুখিয়ে আছে। তবে আমি ভাবছি এবার টুগারটা টানবে কে।”

“তাতে কি কিছু আসে যায়?”

“আমি তাকে চাই,” আবছায়া অবয়বটা নিচু কণ্ঠে বললো। “সে কখনই আসল নয়। আর এটাই আমার বিরুদ্ধে তার অপরাধ। আমাদের লোকদেরকে বলে দিন, কেউ যদি তাকে খুঁজে পায়, তবে কোনো কিছু না করে খবরটা যেনো পার্ক মশিউ’তে জানিয়ে দেয়। তাকে চোখে চোখে রাখা হোক, কিন্তু কিছুই করা হবে না। আমি তাকে পাঁচিশে মার্চে জীবিত চাই। সেদিন তাকে আমি নিজের হাতে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে তার লাশটা আমেরিকানদের কাছে উপহার হিসেবে পাঠাবো।”

“কথাটা এক্ষুণি ছড়িয়ে দেয়া হবে।”

“অ্যাঙ্গেলাস দোমিনি, ঈশ্বরের সন্তান।”

“অ্যাঙ্গেলাস দোমিনি,” ভিক্ষুকটি বললো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *