পর্ব ১
পর্ব ২
পর্ব ৩

বর্ন আইডেন্টিটি – ২৩

অধ্যায় ২৩

রাত তিনটা বাজার দশ মিনিট আগে বর্ন অবার্জদু কোঁয়ের ফ্রন্টডেস্কে গেলেও মেরি প্রবেশদ্বারের দিকেই চলে গেলো। কাউন্টারে কোনো সংবাদপত্র নেই দেখে বর্ন একটু স্বস্তি পেলো। তবে পেছনে বসা লেটনাইট ক্লার্ক ঠিক প্যারিসের ঐ লোকটার মতোই। টেকো মাথার, গাট্টাগোট্টা ধরণের। চোখ দুটো বোজা বোজা। চেয়ারে হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছে সে। তবে এই রাতটা সে অনেক দিনই মনে রাখবে, বর্ন ভাবলো—উপর তলার ঘরটার ক্ষয়ক্ষতি বাদেই, যেটা সকালে আবিষ্কার করা হবে। একজন নাইট ক্লার্কের নিশ্চয় কোনো গাড়ি আছে।

“আমি এইমাত্র কুঁয়ে’তে ফোন করেছি,” জেসন বললো। তার হাতটা কাউন্টারের উপরে। একজন ক্ষিপ্ত লোক সে, নিজের ব্যক্তিগত জীবনে এক ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেছে। “আমাকে এক্ষুণি হোটেল ছাড়তে হবে, এক্ষুণি একটা ভাড়া করা গাড়ি দরকার আমার।”

“কেন নয়?” লোকটা চেয়ার ছেড়ে উঠে বললো। “আপনি কোন্‌টা পছন্দ করবেন, মঁসিয়ে? একটা সোনার রথ অথবা জাদুর কার্পেট?”

“কি বললেন?”

“আমরা ঘর ভাড়া দেই, গাড়ি ভাড়া দেই না।”

“আমাকে সকালের আগেই কুঁয়ে’তে পৌঁছাতে হবে।”

“অসম্ভব। যদি না কোনো পাগল ট্যাক্সিচালক আপনাকে এই রাতবিরাতে নিয়ে যেতে রাজি হয়।”

“আমার মনে হয় না আপনি বুঝতে পারছেন। আটটার মধ্যে আমি আমার অফিসে হাজির থাকতে না পারলে বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে। খুবই সমস্যায় পড়ে যাবো। এজন্যে আপনাকে টাকা দিতেও রাজি আছি।”

“আপনি সমস্যায় প’ড়ে গেছেন, মঁসিয়ে।”

“অবশ্যই। এখানে নিশ্চয় এমন কেউ আছে যে তার নিজের গাড়িটা আমাকে ধার দেবে, ধরুণ…এক হাজার, পনেরোশ’ ফ্রাঁ।”

“এক হাজার…পনেরোশ’, মঁসিয়ে?” লোকটার অর্ধনির্মিলিত চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেলো এবার। “নগদ, মঁসিয়ে?”

“স্বাভাবিকভাবেই। আমার সঙ্গী গাড়িটা আগামীকালকেই ফেরত দিয়ে যাবে।”

“তাড়াহুড়ার কিছু নেই, মঁসিয়ে।”

“গোপনীয়তার জন্যে টাকা দেয়া হবে।

“আমি জানবো না গাড়িটা কোথায় যাচ্ছে,” ক্লার্ক বাঁধা দিয়ে বললো। “সত্যি কথা বলতে কি আমার রেনল্ট গাড়িটা খুব বেশি নতুন নয়। সম্ভবত সেটা সবচাইতে দ্রুতগতির গাড়িও নয়। তবে কাজ চলবে।”

বহুরূপী তার রঙটা আবারো বদলালো। সে সম্পুর্ন অন্য একজন লোকের মতো আচরণ করছে এখন। কিন্তু এখন সে জানে সে কে আর সে সেটা বুঝতেও পারছে।

.

সকাল বেলা। গ্রামের পান্থ নিবাসে কোনো উষ্ণ ঘর নেই। জানালা দিয়ে কোনো রোদ এসেও ঢুকে না। পাশেই আছে সেন-জার্মেইন-এনলায়ে। তারা ব’সে আছে ছোট্ট পার্কিং এলাকায়, জায়গাটা ফাঁকা একটা রাস্তার পেছনে। গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে বের হচ্ছে।

আমার জীবন শুরু হয়েছে ছয় মাস আগে, ছোট্ট একটা ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপে, যার নাম ইল দ্য পোর্ত নোয়ে…এ কথা দিয়ে শুরু করলো।

নিরব একটা ঘোষণা দিয়ে শুরু করলো : আমি কেইন নামে পরিচিত।

সে সবটাই বললো, তার মনে পড়ে এরকম কোনো কিছুই বাদ দিলো না। আর্জেনতুইল-এর মোমবাতিপূর্ণ রেস্তোরাঁয় ব’সে জ্যাকুলিন লাভিয়ার বলা কথাটা শুনে তার মনের পর্দায় যে ছবি ভেসে উঠেছিলো সেটাও বাদ দিলো না। নামগুলো, ঘটনাসমূহ, শহরগুলো…হত্যাকাণ্ডগুলো।

“সবই খাপ খেয়ে যায়। এমন কিছু নেই যা আমি জানি না। আমার মাথায় এমন কিছু নেই যেটা বের করার চেষ্টা করতে পারি। এটাই সত্য ভুল?”

“এটাই সত্য,” মেরি প্রতিধ্বনি করলো।

জেসন তাকে খুব কাছ থেকে দেখলো। “তুমি কি দেখছো না, আমাদের ধারণা ভুল?”

“হতে পারে। তবে ঠিকও হতে পারে, তোমারটা ঠিক, আমারটা ঠিক।”

“কিসের ব্যাপারে?”

“তোমার ব্যাপারে। আমাকে এটা আবারো বলতে হচ্ছে, শান্তভাবে, যৌক্তিকভাবে। তুমি আমাকে ভালো ক’রে চেনার আগেই আমার জন্যে তোমার নিজের জীবন বিপন্ন করেছিলো। তুমি যেরকম লোকের বর্ননা দিচ্ছো, এটা তো সেরকম কোনো লোকের কাজ হতে পারে না। যদি সেই লোকটার অস্তিত্ব থেকে থাকে, তাহলে সে আর ঐ মানুষটি নেই।” মেরির চোখে আকুলতা। যদিও তার কণ্ঠটা নিয়ন্ত্রিত “তুমি নিজেই এটা বলেছো, জেসন। ‘যে মানুষের স্মৃতি নেই, তার কাছে তার অস্তিত্বও নেই। হয়তো এটাই তুমি মুখোমুখি হচ্ছো। তুমি কি এ থেকে পালাতে পারো?”

বর্ন মাথা নাড়লো। ভয়ংকর মুহূর্তটা এসে গেছে। “হ্যা,” সে বললো। “তবে একা। তোমাকে নিয়ে নয়।”

মেরি সিগারেটে টান দিয়ে তাকে ভালো ক’রে দেখলো, তার হাত কাঁপছে। “বুঝলাম। তাহলে এটাই তোমার সিদ্ধান্ত?”

“সেটাই তো হওয়া উচিত।”

“তুমি বীরেচিতভাবে উধাও হয়ে যাবে যাতে আমার কোনো ক্ষতি না হয়।”

“সেটাই।”

“তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, তুমি নিজেকে কি মনে করো, অ্যাঁ?”

“কি?”

“তুমি নিজেকে কি ভাবো?”

“আমি এমন একজন লোক যাকে তারা কেইন ব’লে ডাকে। অনেক সরকার আমাকে চায়, তাদের কাছে আমি দাগী আসামী—এশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত। ওয়াশিংটনের লোকেরা আমাকে খুন করতে চায় কারণ তারা মনে করছে আমি মেডুসার ব্যাপারে জানি; কার্লোস নামের এক গুপ্তঘাতক আমাকে গলায় গুলি ক’রে খুন করতে চাচ্ছে, কারণ আমি তার অনেক ক্ষতি করেছি। এটা একটু ভাবো। আমি কতোক্ষণ এইসব লোকদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবো ব’লে তুমি মনে করো? এভাবে কি তুমি তোমার জীবনটা শেষ করতে চাও?”

“মোটেই না!” চিৎকার ক’রে মেরি বললো। তার বিশ্লেষণী মাথায় কিছু একটা ঘুরপাক খাচ্ছে নিশ্চিত। “আমি জুরিখে যা করি নি তার জন্যে সুইস কারাগারে পঞ্চাশ বছর ধরে পচতে অথবা ফাঁসিতে ঝুলবো।”

“জুরিখের ব্যাপারটা সামলানোর একটা পথ রয়েছে। আমি এটা নিয়ে ভেবেছি আমি এটা করতে পারবো।”

“কিভাবে?” সে সিগারেটটা এসট্রেতে ফেলে দিলো।

“ঈশ্বরের দোহাই, তাতে কি আসে যায়? একটা স্বীকারোক্তি। আমি নিজেকে ধরা দেবো। পরে আবার জবানবন্দীটা অস্বীকার করবো!”

“না, সেভাবে নয়।”

“কেন নয়?”

মেরি তার মুখটা ধরলো। তার কণ্ঠটা এখন আরো নরম আর শান্ত। “কারণ আমি আমার ধারণাটা আবারো প্রমাণ করতে পেরেছি। অপরাধীরাও তার অপরাধের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকে। তুমি যা করার কথা বললে সেটা কেইন নামের লোকটা কখনও করবে না। যে কারোর জন্যেই হোক না কেন, সে এটা করবে না।”

“আমিই কেইন!”

“আমি যদি জোর করেও তোমার সাথে এ বিষয়ে একমত হই, তারপরও তুমি তা নও।”

“অনিবার্য পুনর্বাসন? মস্তিষ্ক-বিকৃত একজনের? সব স্মৃতি হারানো একজনের? সেটা সত্যই। কিন্তু আমাকে যারা খুঁজছে, তাতে তো আর তারা থেমে যাবে না। টুগার টানতেও বাঁধা দেবে না।”

“সেটা হবে খুবই খারাপ, আর সেটা আমি মেনে নিতে প্রস্তুত ন‍ই।”

“তাহলে তুমি সত্যের অন্বেষণ করছো না।”

“আমি দুটো সত্য খুঁজছি, মনে তুমি সেটা বুঝতে পারছো না। আমি এগুলোর সাথে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবো কারণ আমি দায়ি। দু’জন লোক নৃশংসভাবে খুন হয়েছে কারণ তারা তোমার এবং তোমার কাছে পাঠানো একটা মেসেজের মধ্যে এসে পড়েছিলো। আর সেটা হয়েছে আমার মাধ্যমেই।”

“তুমি করবেলিয়া’র মেসেজটা দেখেছো। কতোগুলো বুলেটের ছিদ্র রয়েছে তাতে? দশটি, পনেরোটি?”

“তাহলে তাকে ব্যবহার করা হয়েছে! তুমি ফোনে তার কথা শুনেছো, আমিও শুনেছি। সে মিথ্যে বলে নি, সে আমাদেরকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। তোমার জন্যে যদি নাও হয়, তো আমার জন্যে।”

“এটা…সম্ভব।”

“যেকোনো কিছুই সম্ভব। আমার কাছে কোনো জবাব নেই, কেবল পার্থক্য হলো, ব্যাপারগুলো কখনও ব্যাখ্যা করা যাবে না—অথচ ব্যাখ্যা করা উচিত। তুমি নিজের সম্পর্কে যা বলেছো, তা হয়তো তুমি নও।”

“আমিই সেই লোক।”

“আমার কথা শোনো-। তুমি আমার খুবই প্রিয়, ডার্লিং। এটা আমাকে অন্ধ ক’রে দিতে পারে, আমি সেটা জানি। তবে আমি আমার নিজের সম্পর্কেও কিছু জানি। আমি কোনো বাচ্চা মেয়ে নই। এ পৃথিবীর একটা বড় অংশ আমি দেখেছি 1 আর আমাকে যারা আকর্ষণ করে তাদেরকে খুব ভালোভাবে, ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি।” সে একটু থেমে তার কাছ থেকে সরে গেলো। “আমি একজন লোককে নির্যাতিত হতে দেখেছি—নিজের দ্বারা, অন্যের দ্বারা—আর সে চিৎকার ক’রে কাঁদতেও পারে না। তবে তুমি সেগুলোকে অন্যের উপর চাপিয়ে দাও নি, কেবল নিজে নিজে বয়ে বেরিয়েছো। বরং তুমি নিজেকে খুঁড়ে খুঁড়ে রক্তাক্ত করো, বোঝার ষ্টো করো, এটা কোনো ঠাণ্ডা মাথার খুনির মনমানসিকতা হতে পারে না। তুমি আমার জন্যে যা করেছো, যা করতে চাও, সেটার সাথেও এটা খাপ খায় না। আমি জানি না তুমি এর আগে কি ছিলে, অথবা কি অপরাধ তুমি করেছো, তবে তুমি তা নয়, যা তুমি বিশ্বাস করো। আমি এমন মানুষকে ভালোবাসি যাকে ভালো করেই জানি, চিনি। তুমি কেবল সেটা আবারো নিশ্চিত করলে। কোনো খুনি এমন প্রস্তাব করবে না, যা তুমি এইমাত্র করলে। আর সেই প্রস্তাবটা, স্যার, আমি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করছি।”

“তুমি একটা বোকা মেয়ে!” জেসন চটে গেলো। “আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি; তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারো না! ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে কিছু একটা করতে দাও!”

“আমি সেটা করতে পারি না! এভাবে তো নয়ই…” আচম্‌কা মেরি ভেঙে পড়লো। তার ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগলো। “আমার মনে হয় আমি এইমাত্র সেটা করেছি।” সে ফিফিস্ ক’রে বললো।

“কি করেছো?” বর্ন রেগেমেগে বললো।

“আমাদের দু’জনকে কিছু একটা দাও,” তার দিকে ফিরলো সে। “আমি সেটা এইমাত্র বলেছি। এটা দীর্ঘদিন ধরেই আছে। ‘অন্যেরা তোমাকে যা বিশ্বাস করাতে চায়…’

“তুমি কি বলছো এসব?”

“তোমার অপরাধগুলো…অন্যেরা তোমাকে যা বিশ্বাস করাতে চায়।”

“ওগুলো আমিই করেছি, ওগুলো আমার নিজস্ব অপরাধ।”

“দাঁড়াও। হয়তো ওগুলো সংঘটিত হয়েছে, তবে তোমার দ্বারা নয়? হয়তো আলামতগুলো সাজানো—জুরিখে আমাকে যেভাবে ফাঁসানো হয়েছে, সাজানো হয়েছে সব—ওগুলো অন্য কারোর অপরাধ। জেসন —তুমি জানো না কখন তুমি তোমার স্মৃতি হারিয়েছো।”

“পোর্ত নোয়ে’তে।”

“না, সেখানে তুমি তোমার স্মৃতি হারাও নি। ওখান থেকে তোমার শুরু হয়েছে। পোর্ত নোয়ে’র আগের কথা বলছি। এটা অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করতে পারে। এটা তোমাকে, আর লোকে তোমাকে যা ভাবে, সবই ব্যাখ্যা করতে পারবে।”

“তুমি ভুল করছো। যে স্মৃতি, যে ছবি আমার মাঝে ফিরে আসে সেটা কোনো কিছুই ব্যাখ্যা করতে পারে না।”

“হতে পারে তোমাকে যা বলা হয়েছে, তুমি কেবল সেটাই মনে করতে পারছো,” মেরি বললো। “বারবার, অজস্রবার তোমাকে সেটা বলা হয়েছে। যতোক্ষণ না অন্য কিছু তোমার মধ্যে থাকে। ফটোগ্রাফ, রেকর্ডিং, দৃশ্যগত এবং শব্দগত উদ্দীপনা।”

“তুমি একজন চলতে ফিরতে পারা, কাজ করতে সক্ষম কুমড়াপটাশের কথা বলছো যাকে ব্রেইনওয়াশ করা হয়েছে। সেটা আমি নই।”

মেরি তার দিকে তাকালো, নরম ক’রে বললো, “আমি একজন বুদ্ধিমান, এবং প্রচণ্ড অসুস্থ এক লোকের কথা বলছি। যার ব্র্যাকগ্রাউন্ড অন্যলোকের চিন্তাভাবনা সাথে খাপ খেয়ে যায়। তুমি কি জানো এরকম লোকজন কতো সহজে পাওয়া যায়? তারা সব হাসপাতালে, প্রাইভেট মানসিক আশ্রমে আর মিলিটারি ওয়ার্ডে আছে।” সে একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলো। “ঐ সংবাদপত্রের আর্টিকেলটায় অন্য আরেকটা সত্যের কথা বলছে। আমি কম্পিউটারের উপরে বেশ দক্ষ। আমি যদি কোনো বিকৃত উদাহরণ খুঁজি যা বিচ্ছিন্ন ফ্যাক্টরগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে, তাহলে আমি জানবো সেটা কিভাবে করা হয়েছে। পক্ষান্তরে, কেউ এমন একজন লোককে খুঁজছে যে স্মৃতিভ্রষ্ট, যার ব্যাকগ্রাউন্ডে রয়েছে সুনির্দিষ্ট কিছু দক্ষতা, ভাষা, জাতিগত বৈশিষ্ট্য, তাহলে মেডিকেল ডাটা ব্যাংক সে রকম কারোর খোঁজ দিতে পারবে। ঈশ্বর জানে, তোমার মতো কেস খুব বেশি নেই; হয়তো খুবই কম। হতে পারে কেবলমাত্র একটিই। তবে একজনকেই তারা খুঁজছে। যা তাদের দরকার।”

গ্রামীণ এলাকাটার দিকে তাকালো বর্ন, নিজের মনের লৌহ দরজাটা খুলে উঁকি মারার চেষ্টা করলো। মেরি যে আশার কথা বলছে সেটার সাযুজ্য খোঁজার চেষ্টা করলো সে। “তুমি কি বলতে চাচ্ছো আমি একটা পুণরুৎপাদিত হওয়া বিভ্রান্তি,” সে কথাটা নির্বিকারভাবে বললো।

“এটা হলো শেষ ফলাফল, তবে আমি তা বলছি না। আমি বলছি, এটা সম্ভব যে, তোমাকে ম্যানিপুলেট করা হয়েছে, মানে তোমার মস্তিষ্কের উপর কিছু একটা করা হয়েছে কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার জন্যে। এটা অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করবে।” সে বর্নের হাতটা স্পর্শ করলো। “তুমি আমাকে বলো, অনেক সময় নাকি তোমার ভেতর থেকে কিছু বের হয়ে আসতে চায়—তোমার মাথাটা ফাটিয়ে দিতে চায়।”

“কথাবার্তা—–বিভিন্ন জায়গার দৃশ্য, নাম—তারা অনেক কিছু উস্কে দেয়।”

“জেসন এটা কি সম্ভব নয় যে, তারা ভূয়া কিছু উসকে দিচ্ছে, যা তোমাকে বলা হয়েছে? কিন্তু তুমি মুক্তি পাচ্ছো না। তুমি সেগুলো স্পষ্টভাবে দেখতেও পাও না। কারণ সেগুলো তোমার নয়।”

“আমার তাতে সন্দেহ আছে। আমি কি করতে পারি সেটা আমি দেখেছি। আমি সেগুলো আগেও করেছি।”

“তুমি সেগুলো অন্য কারণেও করতে পারো।…তোমার নিকুচি করি, আমি আমার জীবন নিয়ে শংকিত! আমাদের দু’জনের জীবন নিয়েই।…ঠিক আছে। তুমি ভাবতে পারো, অনুভব করতে পারো। এখন অনুভব করো, ভাবো! আমার দিকে তাকাও, বলো তুমি তোমার ভেতরটা দেখেছো, তোমার ভেতরকার ভাবনা আর অনুভূতিগুলো, আর তুমি কোনো সন্দেহ ছাড়াই জানো যে, তুমি কেইন নামের একজন খুনি! তুমি যদি তা করতে পারো—তবে আমাকে জুরিখে নিয়ে যাও। সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে নাও। আমার জীবন থেকে বের হয়ে যাও! আর সেটা যদি না পারো, তাহলে আমার সাথেই থাকো, আমাকে সাহায্য করতে দাও। আর ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে ভালোবাসো। ভালোবাসা, জেসন।”

বর্ন তার হাতটা ধরলো। যেনো এক রাগী বাচ্চা ছেলে শক্ত ক’রে ধরে রেখেছে তার হাতটা। “এটা ভাবার অথবা অনুভবের প্রশ্ন নয়। আমি গেইমেনশেফটের একাউন্টটা দেখেছি। এন্ট্রিগুলো অনেকদিন আগের। সেগুলোর সাথে আমি যা জানি, সবই খাপ খেয়ে যায়।”

“কিন্তু সেই একাউন্টটা আর ঐসব এন্ট্রি গতকালকে অথবা গত সপ্তাহে, কিংবা ছয় মাস আগেও তৈরি করা হতে পারে। তুমি তোমার সম্পর্কে যা পড়েছো, যা শুনেছো সবই ঐ সব লোকের সাজানো হতে পারে, যারা তোমাকে কেইনের জায়গায় দেখতে চায়। তুমি কেইন নও। তবে তারা তোমাকে সেরকমই ভাবাতে চায়। তবে এমন কেউও আছে যারা জানে তুমি কেইন নও। আর তারা সেটাই তোমাকে বলার চেষ্টা করছে। আমার কাছেও প্রমাণ রয়েছে। আমার প্রেমিক বেঁচে আছে, কিন্তু দু’জন বন্ধু মারা গেছে, কারণ তারা তোমার এবং যে তোমাকে মেসেজটা পাঠিয়েছে তার মাঝখানে এসে পড়েছিলো। তারা তোমার জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছে। তারা মারা গেছে ঐসব লোকের হাতে যারা তোমাকে কার্লোসের কাছে কেইনের বদলে বলি দিতে চায়। তুমি বলছো সবই খাপ খেয়ে যায়। আসলে খাপ খায় না, জেসন, তবে আমারটা খাপ খায়। এটা তোমার অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করে।”

“বারুদবিহীন একটা ফাঁপা শ্নেল, যার এমন কি নিজের স্মৃতিও নেই, সে মনে করে তার সেটা আছে? যার ভেতরের শয়তানগুলো বের হয়ে আসবার জন্যে ছটফট করছে? এটা তো খুব সুখকর সম্ভাবনা নয়।”

“ওগুলো শয়তান নয়, মাই ডার্লিং। ওগুলো তোমারই অংশ—রাগ, ভয়, চিৎকার করছে বের হয়ে আসার জন্যে, কারণ তারা তোমার নয়, যা তুমি শেলের ভেতরে ঢুকিয়েছো।”

“আমি যদি সেই শ্নেলটা ভেঙে ফেলি, আমি কি খুঁজে পাবো?”

“অনেক কিছু। কিছু ভালো কিছু খারাপ। আর প্রচুর সংখ্যক থাকবে ক্ষত। তবে কেইন ওখানে থাকবে না, সেটা আমি তোমাকে বলতে পারি। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, ডার্লিং। দয়া ক’রে হাল ছেড়ে দিও না।”

সে দূরত্ব বজায় রাখলো, একটা কাঁচের দেয়াল তাদের দু’জনের মাঝখানে। “কিন্তু আমাদের ধারণা যদি ভুল হয়ে থাকে? তাহলে কি হবে?”

“সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। অথবা খুন করবে। আমি পরোয়া করবো না।”

“আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

“জানি। এজন্যেই আমি ভয় পাই না।”

“আমি লাভিয়ার অফিস থেকে দুটো ফোন নাম্বার খুঁজে পেয়েছি। প্রথমটি জুরিখের, দ্বিতীয়টি প্যারিসের। ভাগ্য ভালো থাকলে ওগুলো আমাকে আমার দরকারী একটা নাম্বারের সন্ধান দিতে পারবে।”

“নিউইয়র্ক? ট্রেডস্টোন?”

“হ্যা, জবাবটা ওখানেই আছে। আমি যদি কেইন না হই, তবে ঐ নাম্বারের কেউ না কেউ জানে আমি কে।”

.

তারা এই ভেবে গাড়িতে ক’রে প্যারিসে ফিরে এলো যে, নিরিবিলি গ্রামীণ এলাকা থেকে প্যারিসের জনাকীর্ণ এলাকাটাই বেশি নিরাপদ হবে। সোনালী চুলের এক মেয়ে, চশমা পরা, খুবই আকর্ষণীয় এবং দৃঢ়চেতা এক নারী, মেকআপ আর চুল বাঁধার ধরণ পাল্টে ফেলে সে হয়ে গেছে সরবোনের কোনো ছাত্রি। এই মতঁমার্ত্রে- তে এরকম ছাত্রি সচরাচর দেখা যায়। তারা রুই দ্য মায়েস্তের টেরাসে একটা ঘর নিলো, ব্রাসেসের এক বিবাহিত দম্পতি হিসেবে তারা রেজিস্টার্ড হলো।

ঘরে ঢুকে তারা কিছুক্ষণ নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলো। তারা যা দেখছে আর টের পাচ্ছে তাতে কথা বলার কোনো দরকার নেই। তারা একত্রে জড়িয়ে পড়েছে অষ্টেপৃষ্ঠে। একটা গভীর খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। একজন পড়লে, আরেকজনও তার সাথে পড়ে যাবে। অতল গহ্বরে।

বর্ন তার চুলের রঙ বদলাতে পারে নি সময়ের অভাবে। “আমাদেরকে একটু বিশ্রাম নিতে হবে,” বললো সে। “একটু ঘুমাতে হবে। অনেক কাজ করতে হবে আজ।”

তারা মিলিত হলো। বেশ শান্তভাবে, ধীরে ধীরে আর পরিপূর্ণভাবেই। দু’জনেই বিছানায় বেশ ছন্দময় ভঙ্গীতে ব্যাকুল হয়ে উঠলো একে অন্যেকে পেতে। এক সময় একটা আসন ঠিক করার সময় যখন এলো দু’জনেই হেসে ফেললো। প্ৰথমে বিব্রতকর হাসি, তারপর নিজেদের বোকামীর কথা ভেবে হেসে উঠলো তারা। যতো সময় গড়ালো একে অন্যকে আরো বেশি তীব্রভাবে জড়িয়ে ধরলো। একে অন্যের মাঝে ব্যাকুলভাবে হারিয়ে যেতে চাইলো, যেনো যে অন্ধকার আর ঝড়ো বাতাস তাদেরকে জাপটে ধরে রেখেছে চারপাশ থেকে, সেটা থেকে তারা এভাবেই পরিত্রাণ পাবে। আচমকা তারা বাস্তব জগৎ ছেড়ে এমন একটা জগতে প্রবেশ করলো যা অসাধারণ সৌন্দর্য নিয়ে তাদের সামনে উদ্ভাসিত হচ্ছে। চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল দিন আর নীল রঙের জলরাশি অন্ধকারকে প্রতিস্থাপিত করলো। অবশেষে এরকম একটা জগৎ খুঁজে পেলো তারা।

নিঃশেষ হয়ে দু’জনেই ঢলে পড়লো ঘুমে। ঘুমের মধ্যেও একে অন্যের হাত ধ’রে রাখলো তারা।

নিচের রাস্তার যানবাহনের হর্ন আর হৈ হল্লা টের পেয়ে বর্নই আগে জেগে উঠে হাত ঘড়িতে সময় দেখলো। একটা বেজে দশ মিনিট বেজে গেছে। দুপুর। তারা প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়েছে। সম্ভবত তাদের দরকারের চেয়েও কম সেটা। তবে যথেষ্টই বলা চলে। দিনটা হবে খুবই দীর্ঘ, অনেক কাজ করতে হবে, তবে কি করবে সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত নয়। সে কেবল জানে তার কাছে দুটো ফোন নাম্বার আছে যা তাকে তৃতীয় আরেকটা নাম্বারের সন্ধান দেবে। নিউইয়র্কের

মেরি তার পাশে শুয়ে গভীর নিঃশ্বাস নিচ্ছে, সে তার দিকে ফিরলো। মেরির ঠোঁট জোড়া একটু ফাঁক হয়ে আছে। কী চমৎকার লাগছে তাকে। বর্ন তার ঠোঁটে চুমু খেলো। চোখ দুটো বন্ধ থাকলেও মেরি সাড়া দিলো গভীর চুম্বনের সাথে।

“তুমি হলে একটা ব্যাঙ, আমি তোমাকে রাজকুমার বানাবো,” সে ঘুমঘুম কণ্ঠে বললো। “নাকি অন্য কোনো পথ আছে?”

“আমার বর্তমান আকৃতি ব্যাঙের মতো নয়।”

“তাহলে তুমি ব্যাঙই থাকো। লাকিয়ে বেড়াও ছোট্ট ব্যাঙ। কিভাবে লাফাও সেটা আমাকে দেখাও তো।”

“কোনো প্রলোভনে নয়, আমি কেবল মাছি ধ’রে খাওয়ার জন্যেই লাফাই।”

“ব্যাঙেরা মাছি খায় নাকি? মনে হয় খায়। ঘোৎ ঘোৎ ক’রে তারা কাঁপে। কি বিচ্ছিরি।”

“আসো, চোখ খেলো। আমাদের দু’জনকেই এখন লাফাতে শুরু করতে হবে। আমাদেরকে শিকারে বের হতে হবে।”

মেরি চোখ দুটো পিটপিট ক’রে খুলে বললো, “শিকার, কার জন্যে?”

“আমার জন্যে,” সে বললো।

.

রুই লাফায়েতের একটা ফোনবুথ থেকে মিঃ বৃগস্ নামের একজন জুরিখের একটা নাম্বারের ফোন করলো। বর্ন জানে জ্যাকুলিন লাভিয়া ঐ নামটা জানাতে কোনো সময় নষ্ট করবে না। জুরিখে এটা ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে।

রিংয়ের শব্দ হতেই জেসন ফোনটা মেরির হাতে ধরিয়ে দিলো। মেরি জানে তাকে কি বলতে হবে। এটা না বলে তার আর কোনো উপায় নেই। ইন্টারন্যাশনাল অপারেটরের কণ্ঠটা লাইনে শোনা গেলো।

“আমি দুঃখিত, যে নাম্বারটাতে আপনি ফোন করেছেন সেটা আর সচল নেই।”

“এটা খুবই জরুরি, অপারেটর। আপনার কাছে কি অন্য কোনো নাম্বার আছে?”

“টেলিফোনটা সচল নেই, মাদাম। অন্য কোনো বিকল্প নাম্বারও নেই।”

“হয়তো ভুল কোনো নাম্বার দেয়া হয়েছে। এটা খুবই জরুরি। এই নাম্বারটা যার বা যাদের, সেই নামটা কি আপনি দিতে পারবেন?”

“এটা সম্ভব নয়।”

“বললাম না, খুবই জরুরি। আমি কি আপনার পদস্থ কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে পারি?”

“টনি আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারবে না। এই নাম্বারটা তালিকায় অপ্রকাশিত একটি নাম্বার। গুড আফটারনুন, মাদাম।”

লাইনটা কেটে গেলো। “লাইন কেটে গেছে,” মেরি বললো।

“এটা খুঁজে বের করতে অনেক সময় লাগবে,” রাস্তার এদিক-ওদিক চেয়ে বর্ন জবাব দিলো। “চলো, এখান থেকে।”

“তুমি মনে করছো তারা এটা ট্রেস্ করতে পারবে? প্যারিসে? একটা পাবলিক ফোনে?”

“তিন মিনিটেই একটা এক্সচেঞ্জ ডিস্টিক্টটা বের করতে পারবে, চার মিনিটে ব্লকগুলো।”

“তুমি কি ক’রে জানো?”

“বলতে পারলে তো বলতামই। এবার চলো।”

“জেসন। একটু দূরে গিয়ে দেখি না কেন? লুকিয়ে লুকিয়ে?”

“কারণ আমি জানি না কিসের জন্যে দেখবো, আর তারাই বা কি করবে। তাদের কাছে একটা ছবি আছে। তারা এই এলাকার সবখানে লোকজন ছড়িয়ে দিতে পারে।”

“আমাকে তো পত্রিকার ছবিগুলোর মতো দেখাচ্ছে না।”

“তোমাকে না। আমাকে দেখাচ্ছে। চলো।”

তারা লোকজনের ভীড় ঠেলে দশব্লক দূরে বুলেভার্দ মলেশার্বের আরেকটা ফোন বুথের কাছে চলে এলো। এবার আর কোনো অপারেটরের মাধ্যমে নয়। এটা প্যারিসের একটা নাম্বার। মেরি কয়েন ঢুকিয়ে ডায়াল করলো।

কিন্তু লাইনের কথাটা দারুণ অবাক করলো মেরিকে :

“লা রেসিদেন্স দু জেনেরাল ভিলিয়ে। বর্জুখ?… আলো? আলো?”

কয়েক মুহূর্তের জন্যে মেরি কথা বলতে পারলো না। সে কেবল ফোনটার দিকে চেয়ে রইলো। “জেমেক্সিউজ,” ফিফিস্ ক’রে বললো সে। “উনে এরেওয়ে।” সে ফোনটা রেখে দিলো।

“ব্যাপার কি?” কাঁচের দরজাটা খুলে বর্ন জিজ্ঞেস করলো। “কি হয়েছে? কে সে?”

“কিছুই বুঝতে পারছি না,” মেরি বললো। “আমি ফ্রান্সের সবচাইতে সম্মানিত এবং ক্ষমতাধর এক ব্যক্তির বাড়িতে ফোন করেছি।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *