পর্ব ১
পর্ব ২
পর্ব ৩

বর্ন আইডেন্টিটি – ২১

অধ্যায় ২১

“এবার,” বর্ন বিছানায় সুকেসটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললো, “এখান থেকে আমাদেরকে চলে যেতে হবে।”

মেরি চেয়ারে ব’সে আছে। সে সংবাদপত্রের আর্টিকেলটা থেকে কয়েকটি অংশ বেছে নিয়ে সেগুলো আবারো পড়লো। তার মনোযোগ একবারেই নিখুঁত। সে গোগ্রাসে গিলছে, নিজের বিশ্লেষণের ব্যাপারে আরো বেশি আস্থাশীল হচ্ছে।

“আমার কথাই ঠিক, জেসন। কেউ আমাদেরকে একটা মেসেজ পাঠিয়েছে।”

“এটা নিয়ে আমরা পরে কথা বলবো। আমারা এখানে অনেকক্ষণ ধরে আছি। এক ঘণ্টার মধ্যে এই পত্রিকাটি হোটেলের সবার কাছেই পৌঁছে যাবে। আর সকালের পত্রিকাটা তো হবে আরো খারাপ। হেলাফেলা করার সময় এখন নয়। হোটেল লবিতে তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে, তোমাকে অনেকেই দেখেছে। তোমার জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নাও।”

মেরি উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু নড়লো না। তার বদলে সে আবারো নিজের জায়গায় ব’সে পড়লো, তাকে তার দিকে তাকাতে বাধ্য করলো সে। “আমরা পরে অনেক কিছু নিয়েই কথা বলবো,” দৃঢ়ভাবে বললো সে। “তুমি আমাকে ছেড়ে যাচ্ছো জেসন, আমি জানতে চাচ্ছি কেন?”

“বলেছি তো, তোমাকে সেটা বলবো,” সে কোনো রকম দেরি না করেই জবাব দিলো, “কারণ, আমিও মনে করি তোমাকে এটা জানতে হবে, বুঝলে!”

সে চোখ দুটো পিট পিট করলো। তার আচমকা রাগে একটু অবাকই হয়েছে সে। “হ্যা, অবশ্যই,” ফিফিস্ ক’রে বললো সে।

তারা লবিতে অবস্থিত লিফটে ঢুকলো। মার্বেলের ফ্লোরটা দৃষ্টিতে এলে বর্নের মনে হলো তারা একটা খাঁচায় আছে। তাদেরকে সবাই দেখে ফেলছে, তাদের অবস্থা খুবই নাজুক। লিফট থামলেই তারা ধরা পড়ে যাবে। তারপরই বুঝতে পারলো কেন তার এরকম তীব্র অনুভূতি হচ্ছে। নিচের বাম দিকে একটা ফ্রন্টডেস্ক আছে। দ্বাররক্ষী ঠিক তার পেছনেই বসা। তার ডান পাশে রয়েছে একগাদা সংবাদপত্র। তাদের কাছে যে সংবাদপত্রটি আছে ওখানেও সেটা রয়েছে। দ্বাররক্ষী একটা পত্রিকা তুলে নিয়ে পড়ছে আর টুথপিক দিয়ে নিজের দাঁত খোচাচ্ছে। তার মনোযোগ সবকিছু বাদ দিয়ে সাম্প্রতিক কেলেংকারীটার দিকেই যে ধাবিত হবে সেটা নিশ্চিত।

“সোজা হেটে যাবে,” জেসন বললো। “থামবে না, সোজা দরজার দিকে চলে যাবে। আমি বাইরে তোমার সাথে দেখা করবো।”

“হায় ঈশ্বর,” দ্বাররক্ষীকে দেখে বললো মেরি।

“যতো দ্রুত সম্ভব আমি তাকে কিছু টাকা দিয়ে দেবো।”

মেরির হিলের শব্দটা জেসন কোনোভাবেই কামনা করছে না। জেসন দ্বাররক্ষীর সামনে আসতেই লোকটা মুখ তুলে তাকালে জেসন তার দৃষ্টিপথ আটকে দাঁড়ালো।

“খুব ভালো সময় কেটেছে,” সে ফরাসিতে বললো, “তবে আমার খুব তাড়া আছে, আজরাতে আমাকে গাড়ি চালিয়ে লিঁও’তে যেতে হবে। মোট বিলের সাথে এই পাঁচশো ফ্রাঁও রাখেন। বোনাস রেখে যাওয়ার মতো সময় আমার নেই।”

এই অর্থনৈতিক টোপটা উদ্দেশ্য চরিতার্থ করলো। দ্বাররক্ষী খুব দ্রুত বিলটা হাজির করলো। জেসন টাকা দিয়ে উপুড় হয়ে সুকেসটা নিতে যেতেই দ্বাররক্ষীর মুখ থেকে বের হওয়া অস্ফুট একটা শব্দ শুনে তাকালো। লোকটা তার ডান পাশে স্তুপ করা সংবাদপত্রে মেরির ছবিটার দিকে চেয়ে কাঁচের দরজাটার দিকে আবার তাকালো। মেরি বাইরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তার বিস্মিত দৃষ্টি এবার বর্নের দিকে ফিরলো। তাদের চোখাচোখি হলে লোকটা আচমকা ভয় পেয়ে গেলো।

জেসন সোজা কাঁচের দরজাটার দিকে চলে গেলো। কাঁধ দিয়েই সেটা ধাক্কা মেরে খুলে পেছনের ডেস্কের দিকে তাকালো। দ্বাররক্ষীটি টেলিফোন ধরার জন্যে হাত বাড়াচ্ছে।

“চলো!” সে মেরিকে চিৎকার ক’রে বললো। “একটা ক্যাব দ্যাখো!”

তারা হোটেল থেকে পাঁচ ব্লক দূরে রুই লেকুর্বে এসে একটা পেলো। বর্ন একজন অনভিজ্ঞ আমেরিকান পর্যটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো। ভাঙা ভাঙা ফরাসি ব্যবহার করলো যেটা তাকে ভালোয়াঁ ব্যাংকে বেশ সাহায্য করেছিলো। সে ড্রাইভারকে বোঝালো যে, সে আর তার পেতিত এমি সেন্ট্রাল প্যারিস থেকে দূরে কোথাও নিরিবিলিতে কয়েকটা দিন সময় কাটাতে চাচ্ছে। হয়তো ড্রাইভার তাদেরকে সেরকম কয়েকটা জায়গার সন্ধান দিতে পারবে।

ড্রাইভার তাই করলো। “একটা ছোট্ট পান্থ নিবাস আছে, সেটা লে মলিনোয়া’র বাইরে। নামটা হলো লা মেইসোয়া কোয়ারি,” সে বললো। “আরেকটা আছে আইভরি সুরসিয়াা’তে, আপনি হয়তো সেটা পছন্দ করবেন। জায়গাটা খুবই নিরিবিলি, মঁসিয়ে। অথবা মঁক্রজের অবার্জ দু কোয়েঁ। ওটা খুবই চমৎকার।”

“তাহলে প্রথম জায়গাটাতেই নিয়ে চলুন,” জেসন বললো। “এটাই তো আপনার প্রথম মনে এসেছে। কতোক্ষণ লাগবে?”

“পনেরো থেকে বিশ মিনিটের বেশি লাগবে না, মঁসিয়ে।”

“ভালো।” বর্ন মেরির দিকে চেয়ে নিচু কণ্ঠে বললো, “তোমার চুলটা বদলে ফেলো।”

“কি?”

“চুলটা বদলে ফেলো। খোপা ক’রে নাও, অথবা পেছনের দিকে টেনে রাখো। যাইহোক, এরকম কিছু একটা করো। পাশের আয়নাটা দিয়ে দেখে নাও। জলদি!”

কিছুক্ষণ পরে লম্বা দীর্ঘ চুলগুলো একেবারে টেনে পেছনে নিয়ে যাওয়া হলো। মাথার পেছনে একটা রাবার দিয়ে খোপার মতো ক’রে বেঁধে রাখা হলো চুলগুলো জেসন তার দিকে মৃদু আলোতে তাকালো। “তোমার লিপস্টিকটা মুছে ফেলো। সবটা।”

সে একটা টিসু নিয়ে মুছে ফেললো। “ঠিক আছে?”

“হ্যা। তোমার কাছে কি কোনো আই ব্রু পেনসিল আছে?”

“অবশ্যই।”

“তোমার ভ্রুগুলো মোটা ক’রে নাও। একটু। আধ ইঞ্চির মতো বাড়িয়ে নাও। শেষ প্রান্তটি একটু বাঁকিয়ে দিও।”

আবারো সে তার কথামতো কাজ করলো। “এবার?” মেরি জানতে চাইলো।

“ভালো,” তাকে ভালো ক’রে দেখে সে জবাব দিলো। পরিবর্তনটা খুব সামান্য হলেও বেশ কার্যকরী। মেরি একজন নরম শান্ত মেয়ে থেকে উগ্র আর কর্কশ নারীতে রূপান্তরিত হয়ে গেলো। অন্ততপক্ষে সংবাদপত্রে ছাপা হওয়া ছবির সাথে কেউ তাকে প্রথম দেখায় মেলাতে পারবে না। আর এটাই হলো আসল কথা।

“আমরা যখন মউলিনিয়োঁ’তে পৌঁছাবো,” সে নিচুস্বরে বললো, “জলদি বের হয়ে যাবে। ড্রাইভার যেনো তোমাকে দেখতে না পায়।”

“একাজ করার জন্যে একটু বেশি দেরি হয়ে গেছে না?”

“যা বলছি কেবল তাই করো।”

আমার কথা শোনো, মেয়ে। আমি হলাম বহুরূপি, যার নাম কেইন, যেসব জিনিস তোমাকে শেখানোর কোনো ইচ্ছে আমার নেই সে সব জিনিস আমি তোমাকে শেখাতে পারবো। আমি আমার রঙ বদলে ফেলতে পারি যেকোনো পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে। আমি গন্ধ শুকে বাতাস চিনে ফেলতে পারি। আমি মানুষের তৈরি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নিজের পথ খুঁজে নেবো। আলফা, ব্রাভো, চার্লি, ডেল্টা…ডেল্টা’তে চার্লি আর চার্লিতে কেইন। আমি কেইন। আমি মৃত্যু। তোমাকে আমার অবশ্যই বলতে হবে আমি কে, আর সেটা বললেই তোমাকে আমি হারাবো।

“ডার্লিং, কি দেখছো?”

“কি?”

“তুমি আমার দিকে চেয়ে আছো। তুমি শ্বাস নিচ্ছো না। তুমি কি ঠিক আছো?”

“দুঃখিত,” অন্য দিকে তাকিয়ে সে বললো। “আমি আমাদের পরিকল্পনাটা নিয়ে ভাবছি। ওখানে যাবার পর আমি কি করবো সেটা ভালো ক’রে আমাকে জানতে হবে।”

তারা পান্থ নিবাসে এসে পৌঁছালো। ডান দিকে একটা পার্কিংলট আর বেড়া দেয়া আছে। দেরি ক’রে ডিনার করতে আসা কয়েকজন লোক এসেছে। বর্ন একটু সামনে ঝুঁকে দেখলো।

“আমাদেরকে পার্কিং এলাকায় নামিয়ে দাও,” ড্রাইভারকে সে বললো।

“ঠিক আছে, মঁসিয়ে,” ড্রাইভার বললো।

বৃষ্টিটা এখন কুয়াশার মতো হয়ে গেছে। গাড়িটা চলে গেলে বর্ন আর মেরি পান্থ নিবাসের পাশে একটা ঝোঁপের দাঁড়িয়ে রইলো যতোক্ষণ না গাড়িটা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলো। জেসন সুকেসটা মাটিতে নামিয়ে রাখলো।

“অপেক্ষা করো এখানে,” বর্ন বললো।

“তুমি কোথায় যাচ্ছো?”

“একটা ট্যাক্সির জন্যে ফোন করতে।”

দ্বিতীয় ট্যাক্সিটা তাদেরকে মঁতেরুজ জেলায় নিয়ে গেলো। এই ড্রাইভার তাদের দু’জনকে দেখে মোটেও খুশি হচ্ছে না। মফশ্বল থেকে আসা কোনো দম্পতি সস্তা কোনো লজ খুঁজছে। সে যদি পত্রিকা তুলে এক ফরাসি-কানাডিয়ান মেয়ের ছবিসহ খবরটা পড়ে, যাতে জুরিখে তিনটি খুনের সাথে তাকে জড়িয়ে খবর দেয়া হয়েছে, তারপরও সে তার গাড়ির পেছনের সিটে বসা মেয়েটাকে দেখে চিনতে পারবে না।

যে রকম ভাবা হয়েছিলো অবার্জ দু কোয়াঁ সেরকম নয় মোটেও। এটা কোনো গ্রাম্য পান্থ নিবাসের মতো দেখতে নয়। বরং, এটা একটা বড়সড় ফ্ল্যাট, মহাসড়কের সিকি মাইল দূরে অবস্থিত। এখানে টাকার বিনিময়ে অতিথিদের পরিচয় গোপন রাখার নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে। মিথ্যে নাম পরিচয় দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করাটা সম্ভব হবে ব’লে ধরে নেয়া যায়।

তারা ভূয়া নামে রেজিস্ট্রেশন করলে তাদেরকে একটা সস্তা রুম দেয়া হলো যেখানকার আসবাবগুলো বিশ ফ্রাঁ’র উপরে হবে না। দেয়ালগুলো নিম্নমানের ফরমিকা দিয়ে মোড়ানো। এই জায়গাটার একমাত্র ইতিবাচক দিকটি হলো নিচের হল ঘরে একটা আইসমেশিন আছে। তারা জানে মেশিনটা কাজ করছে, কারণ দরজা বন্ধ হবার পরও তারা এটার ঘর্ঘর্ শব্দটা শুনতে পাচ্ছে।

“ঠিক আছে। এবার বলো, কে আমাদেরকে মেসেজ পাঠাচ্ছে?” বর্ন জানতে চাইলো। তার হাতে হুইস্কির গ্লাস।

“আমি যদি জানতাম তবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম,” একটা ছোট্ট ডেস্ক চেয়ারে ব’সে মেরি বললো। জেসনকে খুব ভালো ক’রে দেখছে সে। “এটার সাথে তুমি কেন এভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছো তার কানেকশান থাকতে পারে।”

“যদি তাই হয়ে থাকে তবে এটা একটা ফাঁদ।”

“এটা কোনো ফাঁদ নয়। এপফেলের মতো একজন লোক এরকম কোনো ফাঁদ পাততে পারে না।”

“আমি অবশ্য এ ব্যাপারে অতোটা নিশ্চিত নই,” বর্ন প্লাস্টিকের একটা চেয়ারে ব’সে বললো। “কোয়েনিগ করেছে। সে আমাকে ওখানকার ওয়েটিং রুমে দেখেছে।”

“সে একজন ঘুষখোর ফুট সোলজার, ব্যাংকের কোনো অফিসার নয়। সে একা একাই কাজ করে। এপফেল তা করে না।”

জেসন মুখ তুলে তাকালো। “কি বলতে চাচ্ছো?”

“এপফেল’র বক্তব্যটা তার উপরওয়ালার নির্দেশেই দেয়া হয়েছে। সেটা ব্যাঙ্কের নামে করা হয়েছে।”

“তুমি যদি নিশ্চিত হও তবে চলো জুরিখে ফোন করি।”

“তারা সেটা চায় না। হয় তাদের কাছে কোনো জবাব নেই, নয়তো তারা সেটা দেবে না। এপফেলের শেষ কথাটা ছিলো, তার আর এ ব্যাপারে কোনো বক্তব্য নেই। এটাও মেসেজটার একটা অংশ। আমাদেরকে অন্য কারো সাথে যোগাযোগ করতে হবে।”

বর্ন মদে চুমুক দিলো। তার এলকোহলের দরকার আছে। কিছুক্ষণ পরেই তাকে কেইন নামের একজন খুনির গল্প বলতে হবে। “তাহলে আমরা কাছে ফিরে যাচ্ছি?” সে বললো। “সেই ফাঁদে আবার ফিরে যাচ্ছি।”

মেরি ডেস্ক থেকে সিগারেট তুলে নিলো। “তুমি মনে করছো তুমি জানো কে, তাই না? এজন্যেই তুমি পালাচ্ছো, না?”

“দুটো প্রশ্নের জবাব হলো, হ্যা।” সময় এসে গেছে। মেসেজটা পাঠিয়েছে কার্লোর্স। আমি হলাম কেইন আর তোমাকে আমার ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমি তোমাকে হারাবো। তবে প্রথমে জুরিখ আর তোমাকেও সেটা বুঝতে হবে। “ঐ আর্টিকেলটা আমাকে খুঁজে বের করার জন্যে লেখা হয়েছে।”

“এটা নিয়ে আমি তোমার সাথে তর্ক করবো না,” মেরি বললো। কথার মাঝখানে কথা বলাতে বর্ন একটু অবাকই হলো। “ভাবার মতো সময় আমার আছে। তারা জানে এভিডেন্সটা ভূয়া—একেবারেই হাস্যকর। জুরিখ পুলিশ আশা করে আমি এক্ষুণি কানাডিয়ান অ্যাম্বাসির সাথে যোগাযোগ করি—” মেরি থামলো। তার হাতের সিগারেটটা জ্বালানো হয় নি। “হায় ঈশ্বর, জেসন, তারা তো সেটাই চায়, আমরা যেনো সেটাই করি!”

“কে চায়?”

“যে আমাদের কাছে মেসেজটা পাঠিয়েছে। তারা জানে এ্যাম্বাসিতে ফোন না ক’রে আমার আর কোনো উপায় থাকবে না। কানাডিয় সরকারের আশ্রয়ে যেতে হবে। আমি এই কথাটা ভাবি নি তার কারণ আমি ইতিমধ্যেই অ্যাম্বাসিতে ফোন করেছি ডেনিস করবেলিয়া নামের একজনের কাছে। আর তার কাছে বলার মতো কিছুই ছিলো না। সে কেবল তাই করেছে যা আমি বলেছি। আর কিছু না। তবে সেটা ছিলো গতকালকের, আজকের নয়।” মেরি বিছানার পাশের টেবিলের দিকে গেলো।

বর্ন চেয়ার থেকে দ্রুত উঠে তার হাতটা ধ’রে ফেললো। “এটা করো না,” বেশ জোর দিয়ে সে বললো।

“কেন নয়?”

“কারণ তোমার ধারণা ভুল।”

“আমার ধারণাই ঠিক, জেসন! আমাকে সেটা প্রমাণ করতে দাও।”

বর্ন তার সামনে এসে দাঁড়ালো। “আমার মনে হয় আমি যা বলি সেটাই তোমার শোনা উচিৎ।”

“না!” সে চিৎকার ক’রে বললে মেরি একটু চমকে উঠলো। “আমি সেটা এখন শুনতে চাই না। এখন নয়!”

“একঘণ্টা আগে প্যারিসে তুমি কেবল এই কথাটাই শুনতে চেয়েছিলে। শোনো বলছি!”

“একঘণ্টা আগে আমি ভয়ে মরে যাচ্ছিলাম। তুমি আমাকে ছেড়ে পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে। আমি জানি এটা থামানো না গেলে তুমি বারবার এরকম করবে। তুমি কিছু কথা শোনো, ছবি দেখো, টুকরো টুকরো ঘটনা তোমার মনে পড়ে যা তুমি বোঝো না। তুমি কেবল নিজেকে দুষছো। তুমি কি, কে, এটা কেউ প্রমাণ করার আগপর্যন্ত তুমি শুধু নিজেকেই দুষবে…অন্যেরা তোমাকে ব্যবহার করছে, যারা তোমাকে বলির পাঠা বানাবে। তবে এমন কেউও তো আছে যে তোমাকে সাহায্য করতে চায়, আমাদেরকে সাহায্য করতে চায়। এটাই হলো মেসেজটা! আমি জানি আমার কথাই ঠিক। আমি সেটা তোমার কাছে প্রমাণ করতে চাই। আমাকে সেটা করতে দাও!”

বর্ন মেরির হাতটা ধরে চুপ মেরে রইলো। তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো। তার চমৎকার মুখটা যন্ত্রণা আর অর্থহীন আশায় পূর্ণ। তার চোখে আকুলতা। তবে তাদের জন্যে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমি হলাম কেইন…”ঠিক আছে, তুমি ফোন করতে পারো। তবে সেটা হতে হবে আমার কথা মতো।” সে তার হাতটা ছেড়ে দিয়ে টেলিফোনের কাছে গিয়ে অবার্জ দু কোঁয়ে’র ফ্রন্টডেস্কে ফোন করলো। “রুম ৩৪১ থেকে বলছি। আমি এইমাত্র প্যারিসে আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে খবর পেলাম। তারা কিছু দিনের জন্যে আমাদের সাথে যোগ দিতে এখানে আসছে। নিচের হলে কি তাদের জন্যে একটা ঘরের ব্যবস্থা করা যাবে? চমৎকার। তাদের নাম হলো বৃগস্, এক আমেরিকান দম্পতি। আমি নিচে এসে অগ্রিম টাকা পরিশোধ ক’রে যাচ্ছি, ঘরের চাবিটা আমাকে দিয়ে দেবেন। ঠিক আছে, দারুণ। ধন্যবাদ আপনাকে।”

“তুমি করছো কি?”

“তোমার কাছে একটা কিছু প্রমাণ করতে,” সে বললো। “আমাকে একটা পোশাক দাও,” সে আবার বললো। “সবচেয়ে লম্বা যেটা আছে তোমার কাছে।

“কি?”

“তুমি যদি তোমার ফোনটা করতে চাও তো আমি যা বললাম তাই করো।”

“তুমি পাগল হয়ে গেছো।”

“আমি সেটা মানছি,” সে বলেই সুটকেস থেকে প্যান্ট আর শার্ট বের করলো। “পোশাকটা দাও তো, প্লিজ।”

পনেরো মিনিট বাদে, ৩৪১ নাম্বার ঘর থেকে ছয় দরজা পরে, মি: আর মিসেস বৃগসের ঘরটা প্রস্তুত হয়ে গেলো। জামাকাপড়গুলো ঠিকমতো রাখা হয়েছে। বেছে নেয়া কিছু বাতি জ্বালিয়ে রাখা হলো, বাকিগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সব কিছু ঠিবঠাক ক’রে জেসন তাদের ঘরে ফিরে এলো। মেরি টেলিফোনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। “সেট ক’রে ফেলেছি।”

“তুমি কি করেছো?”

“যা আমি করতে চেয়েছি। যা আমাকে করতে হোতো। এখন তুমি তোমার ফোনটা করতে পারো।”

“দেরি হয়ে গেছে। ধরো সে নেই, তাহলে?”

“আমার মনে হয় সে থাকবে। না থাকলে তারা তোমাকে তার বাড়ির ফোন নাম্বারটা দিয়ে দেবে। আটোয়ার টেলিফোন লগে তার নাম আছে। থাকারই কথা।

“আমারও তাই মনে হয়।”

“আমি তোমাকে কি বলেছি সেটা কি তোমার মনে আছে?”

“হ্যা, তবে এটা কোনো ব্যাপার নয়, এটা প্রাসঙ্গিকও নয়। আমি জানি আমার ধারণা ভুল নয়।”

“আমরা সেটা দেখবো। কেবল আমি যা বললাম তা বলো। আমি তোমার পাশে থেকে তোমার কথা শুনছি। ফোন করো।”

মেরি ফোনটা তুলে নিয়ে ডায়াল করলো। সাত সেকেন্ড পরেই সে এ্যাম্বাসিতে লাইন পেয়ে গেলো। ওপাশ থেকে ডেনিস করবেলিয়ার কণ্ঠটা শোনা গেলো। রাত সোয়া এগারোটা বেজে গেছে।

“ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, তুমি কোথায়?”

“তাহলে তুমি আমার ফোনের জন্যে অপেক্ষা করছিলে?”

“আমি তোমার ফোনের জন্যে ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। এই জায়গাটা একেবারে হট্টগোলে পূর্ণ হয়ে আছে। আজকের বিকেল পাঁচটা থেকে আমি এখানে অপেক্ষা করছি।”

“এ্যালানও তাই করেছিলো। অটোয়াতে।”

“এ্যালান কে? তুমি কি বলছো? তুমি আছো কোথায়?”

“প্রথমে আমি জানতে চাইবো তুমি আমাকে কি বলবে।”

“বলবো?”

“তোমার কাছে আমার জন্যে একটা মেসেজ আছে, সেটা কি?”

“কি মেসেজ?”

মেরির মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। “জুরিখে আমি কোনো খুন করি নি। আমি…”

“তাহলে ঈশ্বরের দোহাই, এখানে আসো! আমরা তোমাকে সব ধরণের নিরাপত্তা দেবো। এখানে তোমাকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে না।”

“ডেনিস, আমার কথা শোনো! তুমি আমার ফোনের জন্যে অপেক্ষা করছিলে, করছিলে না?”

“হ্যা, অবশ্যই।”

“কেউ তোমাকে অপেক্ষা করতে বলেছে, তাই না?”

কোনো সাড়া শব্দ নেই। কিন্তু করবেলিয়া যখন কথা বললো তখন তার কণ্ঠটা একটু শান্ত শোনালো। “হ্যা, সে বলেছে। তারা বলেছে।”

“তারা তোমাকে কি বলেছে।”

“তোমার এখন আমাদের সাহায্যের দরকার আছে। খুবই দরকার।”

মেরি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। “তারা আমাকে সাহায্য করতে চায়?”

“আমাদের মাধ্যমে,” করবেলিয়া জবাব দিলো, “তুমি বলছো সে তোমার সাথেই আছে, তাহলে?”

বর্নের মুখটা তার কাছই ছিলো। সে কান পেতে করবেলিয়ার কথা শুনছে। মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।

“হ্যা,” সে জবাব দিলো। “আমরা একসাথেই আছি, তবে সে কয়েক মিনিটের জন্যে বাইরে গেছে। এটা মিথ্যে। তারা তোমাকে সেটাই বলেছে, তাই না?”

“তারা যা বলেছে তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে, রক্ষা করতে হবে। তারা তোমাকে সাহায্য করতে চায়। তারা তোমার জন্যে একটা গাড়ি পাঠাতে চাচ্ছে। আমাদের কূটনৈতিকদের একটি গাড়ি।”

“তারা কারা?”

“তাদেরকে আমি নামে চিনি না। চেনার কথাও নয়। তবে আমি তাদের র‍্যাঙ্ক জানি।”

“র‍্যাঙ্ক?”

“স্পেশালিস্ট, এফএস-ফাইভ। এরচেয়ে বেশি তুমি জানতে পারো না।”

“তুমি তাদেরকে বিশ্বাস করো?”

“হায় ঈশ্বর, হ্যা! তারা অটোয়ার মাধ্যমে আমার সাথে যোগাযোগ করেছে। তাদের অর্ডারগুলো এসেছে অটোয়া থেকে।”

“তারা এখন এম্বাসিতে আছে?”

“না, তারা বাইরে আছে।” করবেলিয়া থামলো। “হায় ঈশ্বর, তুমি কোথায় আছো, মেরি?”

বর্ন আবারো মাথা নাড়লে মেরি কথা বললো। “আমরা মÍজের অবার্জ দু কোয়ে’তে আছি। বৃগস্ নামে।”

“আমি এক্ষুণি তোমার জন্যে একটা গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

“না, ডেনিস!” মেরি বাঁধা দিয়ে বললো। জেসনের দিকে তাকালে সে তাকে তার নির্দেশ মতো কথা চালিয়ে যেতে ইশারা করলো।

“সকালে পাঠিও। খুব সকালে—এখন থেকে চার ঘণ্টা পরে।”

“আমি সেটা করতে পারবো না! তোমার নিজের ভালোর জন্যেই।”

“পারতেই হবে। তুমি বুঝতে পারছো না। সে ফাঁদে পড়ে গেছে। খুব ভয়ে আছে। এখন পালাতে চাইছে। সে যদি জানে আমি তোমাকে ফোন করেছি তবে সে এখনই পালাবে। আমাকে একটু সময় দাও। আমি তাকে ধরা দেবার জন্যে রাজি করতে পারবো। সে খুবই বিভ্রান্তির মধ্যে আছে, তবে সে জানে আমার কথাই ঠিক।” মেরি কথাটা বলেই বর্নের দিকে তাকালো।

“লোকটা কি ধরণের বানচোত?”

“খুবই ভয়ংকর রকমের,” মেরি জবাব দিলো। “এমন একজন যার ব্রেইন ওয়াশ করা হয়েছে। আমার সময়ের দরকার। আমাকে সেটা দাও।”

“মেরি…?” করবেলিয়া থেমে গেলো। “ঠিক আছে, সকালের প্রথম দিকে। ধরো…ছয়টা বাজে। আর মেরি, তারা কিন্তু তোমাকে সাহায্য করতে চায়। তারা তোমাকে সাহায্য করতে পারবে।”

“আমি জানি। গুডনাইট।”

মেরি ফোনটা রেখে দিলো।

“এখন আমরা অপেক্ষা করবো,” বর্ন বললো।

“আমি জানি না তুমি কি প্রমাণ করতে চাচ্ছো। সে অবশ্যই এফএস-ফাইভকে ডাকবে, আর তারাও এখানে এসে হাজির হবে। তুমি কি আশা করো? সে কি করবে, কি করার কথা ভাবছে, সেটা তোমাকে বলবে।”

“এই সব এফএস-ফাইভ কূটনৈতিকরাই আমাদের কাছে মেসেজটা পাঠিয়েছে?”

“আমার ধারণা যারা মেসেজটা পাঠিয়েছে তারা আমাদেরকে তাদের কাছেই নিয়ে যাবে। অথবা যারা পাঠিয়েছে তারা যদি খুব বেশি দূরে থাকে তাহলে আমাদেরকে তাদের সাথে সংযোগ ঘটিয়ে দেবে। আমি আমার পেশাদারি জীবনে এরকম নিশ্চিত আর কখনই ছিলাম না।” বর্ন তার দিকে তাকালো। “আমি আশা করি তোমার কথাই ঠিক, কারণ তোমাকে নিয়েই আমার যতো চিন্তা। যদি তোমার বিরুদ্ধে জুরিখের এভিডেন্সগুলো কোনো মেসেজের অংশ না হয়ে থাকে, যদি এটা আমাকে খুঁজে বের করার জন্যে করা হয়ে থাকে—জুরিখ পুলিশ যদি এটা বিশ্বাস করে—তাহলে করবেলিয়াকে এইমাত্র তুমি যে বললে আমি একজন ভয়ংকর মানুষ আমি ঠিক সেটাই হবো। আমার চেয়ে আর কেউ চায় না তোমার কথাটা ঠিক হোক। তবে আমার মনে হয় না, তোমার কথা ঠিক।”

.

দুটা বেজে তিন মিনিট পরে, মোটেলের করিডোরের লাইটটা ফটকাতে ফটকাতে নিভে গেলে দীর্ঘ হলওয়েটা একেবারে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেলো। সিঁড়ি ঘরের ফাকফোকরগুলোই এখন একমাত্র আলোর উৎস। বর্ন তাদের ঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো, তার হাতে পিস্তল, ঘরের বাতিগুলো নিভিয়ে ফেলা হয়েছে। দরজাটা একটু ফাঁক ক’রে করিডোরটা দেখলো সে। মেরি তার পেছনে দাঁড়িয়ে তার কাঁধের উপর দিয়ে তাকালো, কেউ কোনো কথা বলছে না।

পায়ের শব্দগুলো ভোঁতা কিন্তু শোনা যাচ্ছে। খুব সতর্ক আর হিসেব করে দু’ জোড়া পা সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে। কয়েক সেকেন্ড পরেই, ডিমলাইটের আলোতে দু’জন লোকের অবয়ব দেখা গেলো। মেরি অজান্তেই চাপা একটা আর্তনাদ করলে জেসন তার মুখটা চেপে ধরলো। মেরি দু’জনের মধ্যে যেকোনো একজনকে চিনতে পেরেছে। যে মানুষটাকে সে কেবল একবারই দেখেছিলো। জুরিখের স্টেপডেকস্ট্রাসে, আরেকজন লোক তার মৃত্যুদণ্ড দেবার আদেশ করার ঠিক আগে। এটা হলো সেই সোনালি চুলের লোকটা, যাকে বর্নের রুমে পাঠানো হয়েছিলো। এখন এই বদমাশটাকে পাঠানো হয়েছে তার হাত ফসকে যাওয়া টার্গেটটাকে চিহ্নিত করার জন্যে। তার বাম হাতে ছোট্ট একটা পেন্সিল লাইট, ডান হাতে লম্বা নলের একটা অস্ত্র, সাইলেন্সার লাগানো।

তার সঙ্গীটি ছোটোখাটো। অনেক বেশি শক্তসামর্থ্য, তার হাটা অনেকটা শিকারী পশুদের মতো। তার টপকোটের বুকের অংশটা খোলা। তার মাথাটা একটা টুপির কারণে ঢেকে আছে। মুখটা তাই পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না। বর্ন সেই লোকটার দিকে তাকালো। তাকে খুব চেনা চেনা লাগছে তার। তার হাটা, মাথার ভঙ্গী। সেটা কি? কি? সে তাকেঁ চেনে।

তবে ভাবার মতো সময় এখন নেই। লোক দুটো মি: আর মিসেস বৃগসের জন্যে রিজার্ভ করা ঘরটার দিকে এগোচ্ছে। সোনালী চুলের লোকটা দরজায় লেখা নাম্বারটার ওপর পেন্সিল লাইটটা ধরলো। তারপরই নব্ আর লকটার দিকে আলো ফেললো।

এরপর যা ঘটলো তা তাকে অবাকই করলো। ছোটোখাটো লোকটা হাতে একটা চাবির রিং নিয়ে টর্চের আলোতে তুলে ধ’রে সঠিক চাবিটা বেছে নিলো। তার ডান হাতে সাইলেন্সার লাগানো অস্ত্রটা যে ভারি ক্যালিবারের সেটা বর্ন বুঝতে পারলো। এই অস্ত্রটা অনেকটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান গেস্টাপো বাহিনীর ব্যবহার করা লুগার পিস্তলের মতো। এর বুলেট স্টিল আর কংক্রিট ভেদ করতে পারে। এটার শব্দ এতোটাই ভোঁতা আর মৃদু হবে যে, টার্গেট বুঝতেই পারবে না তাকে গুলি করা হয়েছে। আশেপাশের কেউ তো টেরই পাবে না।

বেটে লোকটা চাবি ঢুকিয়ে আস্তে ক’রে নিঃশব্দে ঘোরালো। তারপর অস্ত্রটা লকের দিকে তাক্ ক’রে পর পর তিনটি গুলি করলো। নিঃশব্দ গুলি। কেবল একটু আলো হলো। লটার চারপাশের কাঠ গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে গেলে দরজাটা খুলে গেলে দু’জন খুনি বিদ্যুৎ বেগে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়লো।

একটু নিরবতা, তারপরই ভোঁতা একটা গুলির শব্দ হলো অন্ধকারেই। দরজাটা সশব্দে বন্ধ ক’রে দেয়া হলেও বন্ধ হলো না। ভেতর থেকে ধস্তাধস্তির শব্দ হলো। অবশেষে একটা বাতি খুঁজে পেয়ে জ্বালানো হলো অল্প সময়ের জন্যে, তারপরই একটা ল্যাম্প মেঝেতে ছুড়ে ফেলে হলে কাঁচ ভাঙার শব্দ হলো। একজন ভয়ার্ত মানুষের অস্ফুট আর্তনাদ।

খুনি দু’জন হুড়মুড় ক’রে বের হয়ে এলো অস্ত্র দুটো তুলে ধরে। তাদের চোখেমুখে বিস্ময় আর ফাঁদে পড়ার আতংক। ভেতরে কেউ নেই। তারা সিঁড়ির কাছে যেতেই এইমাত্র হানা দেয়া ঘরটার পাশের ঘরের দরজাটা একটু খুলে গেলে একজন গেস্ট চোখ পিট পিট করতে করতে বের হয়ে এলো। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে ভেতরে চলে গেলে অন্ধকার হলওয়ে জুড়ে আবারো নিরবতা নেমে এলো।

বর্ন ঠাঁয় দাড়িয়ে মেরি সেন জ্যাককে এক হাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। মেয়েটা কাপঁছে, তার মাথা জেসনের বুকে। অবিশ্বাসে অনেকটা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে গেছে সে। জেসন আরো কয়েকটা মিনিট পার করলো যাতে মেরির কাঁপুনিটা একটু কমে গিয়ে সে ধাতস্থ হয়। সে আর অপেক্ষা করতে পারলো না। মেরিকে নিজের চোখেই দেখতেই হবে ঘটনাটা। অবশেষে সে বুঝতে পারবে। আমি হলাম কেইন। আমি হলাম মৃত্যু।

“আসো,” সে নিচু কণ্ঠে বললো।

তারা দু’জন একসঙ্গে ভাঙা দরজাটা দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়লো।

মেরি নির্বাক দাঁড়িয়ে রাইলো। দৃশ্যটা একই সঙ্গে তিক্ত আর হতবুদ্ধিকর। ঘরের ভেতর ডান দিকে মৃদু আলোতে একটা আবছা অবয়ব দেখা যাচ্ছে। এটার পেছনের বাতিটা খুবই মৃদু আলোর তাই কেবল অবয়বটার আউটলাইনই দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারে চোখ সয়ে যাবার পর বোঝা গেলো অবয়বটা লম্বা গাউন পরা এক মেয়ের। কাপড়টা খোলা জানালা দিয়ে আসা বাতাসের কারণে একটু দুলছে।

জানালা। তার পাশে আরেকটা অবয়ব। সেটাও বাতাসে একটু আধটু নড়ছে।

“ওহ্ ঈশ্বর,” মেরি বললো। সে বরফের মতো জমে আছে। “বাতি জ্বালাও, জেসন।”

“কোনোটাই কাজ করছে না,” সে জবাব দিলো। “কেবল দুটো টেবিল ল্যাম্প; তারা একটা ভেঙে ফেলেছে।” সে অন্য ল্যাম্পটা খুঁজতে লাগলো। সেটা পাশের দেয়াল ঘেষে মেঝেতে পড়ে আছে। সে ওটা তুলে জ্বালালে মেরি কেঁপে উঠলো।

বাথরুমের দরজার সামনে মেরির গাউনটা একটা আঙটার সাহায্যে টাঙানো আছে। সেটা বুলেটে ফুঁটো হয়ে গেছে। জানালার পাশে, বর্নের শার্ট আর প্যান্টটা জানালার ফ্রেমের সাথে আঁটকে রাখা হয়েছে এমনভাবে যেনো কোনো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। শার্টের হাতা দুটো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। শার্টটার বুকে কয়েকটা বুলেটের চিহ্ন। কম পক্ষে এক ডজন হবে।

“এই হলো তোমার মেসেজ,” জেসন বললো। “এবার তো জানতে পারলে এটা কি। আমার মনে হয় এখন তোমার উচিত সেটাই করা যেটা আমি বলবো।”

মেরি তার কথার কোনো জবাব দিলো না। তার বদলে সে আস্তে আস্তে পোশাকটার দিকে হেটে গিয়ে সেটা হাতে নিয়ে পরীক্ষা ক’রে দেখলো, যেনো এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না সে। আচমকা সে ঘুরে দাঁড়ালো। তার চোখে জল।

“না! এটা ভুল! একটা মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে! এ্যাম্বাসিতে ফোন করো।”

“কি?”

“যা বললাম তাই করো। এক্ষুণি!”

“চুপ করো, মেরি। তোমাকে বুঝতে হবে।”

“না, কোনো বোঝার দরকার নেই! তোমাকে বুঝতে হবে! এটা এভাবে ঘটতো না। এটা এভাবে হতে পারে না।”

“তাই তো হয়েছে।”

“অ্যাম্বাসিতে ফোন করো! ঐ যে, ওখান থেকে ফোনটা নিয়ে এক্ষুনি ফোন করো। করবেলিয়াকে চাও। দ্রুত। ঈশ্বরের দোহাই! তোমার কাছে আমার যদি কোনো মূল্য থাকে, যা বললাম তাই করো!”

বর্ন তার কথা ফেলতে পারলো না। “তাকে আমি কি বলবো?” ফোনের কাছে যেতে যেতে সে জানতে চাইলো।

“আগে তাকে পাও! এটা নিয়েই তো আমি আশংকা করছি…ওহ্ ঈশ্বর। আমি প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছি!”

“নাম্বারটা বলো?”

সে তাকে নাম্বারটা দিলে জেসন ডায়াল করলো। রিং হচ্ছে। যখন লাইন পাওয়া গেলো অপারেটর তীব্র ভয়ে কথাবার্তা গুলিয়ে ফেললো। এক পর্যায়ে তার কথা কিছুই বোঝা গেলো না। অপারেটরের আশেপাশে চিৎকার চেঁচামেচি আর আদেশ নির্দেশ শোনা যাচ্ছে। ইংরেজি এবং ফরাসিতে। কয়েক সেকেন্ড পরেই সে বুঝতে পারলো।

কানাডিয়ান অ্যাম্বাসির অ্যাটাশি ডেনিস করবেলিয়া মতেই’র অ্যাম্বাসি অফিস থেকে রাত ১টা ৪০মিনিটে বের হতেই গলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে।

“এটা হলো মেসেজটার অন্য দিক, জেসন,” মেরি ফিফিস্ ক’রে বললো। তার দিকে চেয়ে আছে। “এখন তুমি যা বলবে আমি তাই শুনবো। কারণ কেউ একজন আছে যে তোমার সাথে দেখা করতে চায়। তোমাকে সাহায্য করতে চায়। একটা মেসেজ পাঠানো হয়েছে, আমাদের কাছে নয়, আমার কাছে তো নয়ই। কেবল তোমার কাছে। আর কেবল তুমিই সেটা বুঝতে পারবে।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *