অধ্যায় ২০
লিমোজিনটা নক্সা করা ব্রাউনস্টোন ভবনের বাইরে দুটো ল্যাম্পপোস্টের মাঝখানে পার্ক ক’রে রাখা আছে। সামনের আসনে ইউনিফর্ম পরা ব’সে আছে শফার, এ ধরণের পথঘাটে এরকম গাড়ি আর এরকম ড্রাইভার অহরহই দেখা যায়। ব্যতিক্রম হলো দু’জন লোক পেছনের অন্ধকার আসনে ব’সে আছে। বের হওয়ার কোনো লক্ষণ তাদের মধ্যে নেই। তার বদলে তারা ব্রাউনস্টোন ভবনটার প্রবেশ্বদ্বারের দিকে লক্ষ্য রাখছে। তারা নিশ্চিত ইনফ্রারেড ক্যামেরায় তাদেরকে দেখা যাচ্ছে না।
এক লোক তার চশমাটা ঠিক ক’রে নিলো। মোটা কাঁচের পেছনে চোখ দুটো পেচার মতো। ন্যাশনাল সিকউরিটি কাউন্সিলের পারসোনেল স্ক্রিনিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন ডিরেক্টর আলফ্রেড জিলেট কথা বললো। “যখন কোনো উঁচু নাক ভেঙে গুঁড়িয়ে যায় তখন সেটা দেখতে কতোটাই না আনন্দের লাগে।”
“আপনি আসলেই তাকে অপছন্দ করেন, তাই না?” জিলেটের সঙ্গী, কালো রেইন কোট পরা ভারি কাঁধের এক লোক, ইউরোপের কোনো শ্লাভিচ ভাষার টান আছে যার কথায়, সে বললো।
“আমি তাকে ঘৃণা করি। আমি ওয়াশিংটনের যেসব জিনিস ঘৃণা করি সে ঐসব জিনিসের পক্ষে দাঁড়ায়। রাইট স্কুল, জর্জ-টাউনের বাড়ি, ভার্জিনিয়ার খামার, তাদের ক্লাবের গোপন মিটিংগুলো। তাদের আছে শক্তপোক্ত ছোট্ট এক দুনিয়া যেখানে তুমি ঢুকতে পারবে না—তারাই সব কিছু চালায়। বানচোতের দল। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ওয়াশিংটনের আত্মম্ভরি ভদ্রলোকেরা। তারা অন্য লোকের বুদ্ধি মত্তা ব্যবহার ক’রে নিজেদের সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে। আর তুমি যদি বহিরাগত হও তাহলে তুমি হয়ে যাবে মদন। ‘চমৎকার একজন কর্মচারী’!”
“আপনি বাড়িয়ে বলছেন,” ইউরোপিয়ানটি বললো। তার চোখ ভবনটার দিকে। “আপনি ওখানে খুব খারাপ কিছু করেন নি। যদি করতেন তো আপনার সাথে আমরা কখনও যোগাযোগ করতে পারতাম না।”
জিলেট ভুরু কুচকালো। “আমি যদি বাজে কিছু ক’রে না থাকি তাহলে তার কারণ আমি ডেভিড অ্যাবোটের মতো অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলাম। আমার মাথায় এমন হাজার হাজার তথ্য আছে যা তারা এমনকি স্মরণও করতে পারবে না। তাদের জন্যে খুব সহজ ছিলো, যখনই কোনো প্রশ্ন করা হোতো, সমস্যা দেখা দিতো তখনই আমাকে সেটা সামলাতে বলতো, সমাধান করতে বলতো। পারসোনেল স্ক্রিনিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের পরিচালক! তারা এই পদটি সৃষ্টি করেছে আমার জন্যে। জানো কেন?”
“না, আলফ্রেড,” ইউরোপিয়ান ভদ্রলোকটি হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বললো। “আমি জানি না, কেন?”
“কারণ তারা হাজার হাজার রিজিউম আর ডোসিয়ার নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানোর ধৈর্য রাখে না। তারা বরং সান সুচি’তে ডিনার করতেই বেশি পছন্দ করে। অথবা সিনেট কমিটির সামনে ব’সে স্মার্টনেস দেখাতে পারে। অন্যের তৈরি করা কাগজ থেকে পড়তে পারে—যে কাজগুলো ভালো স্টাফরা তৈরি ক’রে দেয়।”
“আপনি খুবই তিক্ত একজন মানুষ,” ইউরোপিয়ানটি বললো।
“তুমি যতোটুকু জানো তারচেয়েও বেশি। ঐসব বানচোতের কাজ করতে করতে জীবন পার ক’রে দিয়েছি। কিসের জন্যে? একটা পদ আর মাঝে মধ্যে ডেভিড অ্যাবোটের মতো কর্তাদের সঙ্গে লাঞ্চ করার জন্যে! আমার মতো লোকজন ছাড়া তারা কিছুই না।”
“লোকটাকে খাটো ক’রে দেখবেন না। কার্লোস কিন্তু তা করে না।”
“কিভাবে সে করবে? সে তো জানে না কিভাবে মূল্যায়ণ করা হয়। অ্যাবোট যা করে তা গোপনীয়তার চাদরে ঢেকেই করে। কেউ জানে না সে কতো ভুল করেছে। আর কখনও যদি কোনো ভুল প্রকাশ হয়ে পড়ে তবে তার জন্যে আমাদের মতো লোকদেরকে দোষ দেয়া হয়।”
ইউরোপিয়ান লোকটি জিলেটের দিক থেকে মুখ সরিয়ে জানালার দিকে তাকালো। “আপনি খুবই আবেগপ্রবণ, আলফ্রেড,” সে শান্ত কণ্ঠে বললো। “আপনি এসব ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন।”
আমলা লোকটি হাসলো। “সেরকম কিছু কখনও হবে না : আমি বিশ্বাস করি কার্লোসের প্রতি আমার অবদান সেটা নিশ্চিত করবে। বলতে পারো আমি এমন একটা যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছি যা আমি এড়িয়ে যেতে পারি না।”
“সৎ বক্তব্য,” ভারি কাঁধের লোকটা বললো।
“তোমার ব্যাপারটা কি? তুমি আমাকে খুঁজে পেয়েছো?”
“আমি জানি কি খুঁজতে হয়,” জানালার দিক থেকে মুখ সরিয়ে ইউরোপিয়ানটি বললো।
“মানে, বলতে চাচ্ছি, কার্লোসের জন্যে তুমি যে কাজ করো।”
“আমার কাছে কোনো জটিল কারণ নেই। আমি এমন এক দেশ থেকে এসেছি যেখানে শিক্ষিত লৈাকেরা মার্ক্সিস্ট বয়ান আওড়ায় মুর্খের মতো। কার্লোসও জানে কি খুঁজতে হয়।”
জিলেট হেসে ফেললো। “আমরা তাহলে খুব বেশি ভিন্ন নই।”
“হয়তো,” ইউরোপিয়ানটি বললো। আবারো ঘড়ির দিকে তাকালো। “খুব বেশি দীর্ঘ হবে না। অ্যাবোট সবসময়ই মধ্য রাতের শাটল ধরে, তার প্রতিটি ঘণ্টা ওয়াশিংটনে জবাবদিহি করতে হয়।”
“তুমি নিশ্চিত সে একা বের হয়ে আসবে?”
“সে সবসময়ই তা করে, এটা নিশ্চিত তাকে এলিয়ট স্টিভেন্সের সাথে দেখা যাবে না। ওয়েব এবং স্টিভেন্স সবসময়ই আলাদা আলাদাভাবে যাতায়াত করে। বিশ মিনিটের মতো ব্যবধান থাকে।”
“তুমি ট্রেডস্টোনটা কিভাবে খুঁজে পেলে?”
“সেটা খুব কঠিন ছিলো না। আপনার অবদান আছে, আলফ্রেড। আপনি ভালো স্টাফদেরই একজন।” লোকটা হেসে ফেললো, তার চোখ ব্রাউস্টোন ভবনটার দিকে। “কেইন মেডুসা থেকেই এসেছে। আপনি সেটা আমাদেরকে বলেছেন, আর কার্লোসের সন্দেহটা যদি যথার্থ হয়, তাহলে সেটা সন্ন্যাসীই। আমরা সেটা জানি। এটা তাকে বর্নের সাথে জুড়ে রেখেছে। অ্যাবোটকে চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারী করার জন্যে কার্লোস আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছে। কিছু একটা হচ্ছে। যখন জুরিখের গুলির শব্দ ওয়াশিংটনে শোনা গেলো তখন অ্যাবোট সন্ন্যসীটা একেবারে উতলা হয়ে উঠলো। তাকে আমরা এখানে অনুসরণ করলাম। এটা খুবই জরুরি ব্যাপার।”
“এটাই তোমাকে কানাডায় নিয়ে গেছে? অটোয়ার সেই লোকটার কাছে?”
“অটোয়ার লোকটা, ট্রেডস্টোনের খোঁজ করতে গিয়ে নিজেকে উন্মোচিত ক’রে ফেলেছিলো। আমরা যখন জানতে পারলাম মেয়েটা কে, তখনই ট্রেজারি বোর্ডকে নজরদারীতে রাখতে শুরু করলাম। প্যারিস থেকে একটা ফোন এলো। মেয়েটা করেছিলো সে ফোন। তাকে একটা জিনিস খোঁজার কথা বললো। আমরা জানতাম না কেন। তবে আমরা সন্দেহ করলাম বর্ন হয়তো ট্রেডস্টোন চাউড় ক’রে দেবার চেষ্টা করছে। বর্ন যদি বেঈমানী করে থাকে, তবে টাকাগুলো নিয়ে বের হওয়ার একটামাত্র পথই আছে। তাতে কিছু যায় আসে না। আচম্কা, এই সেকশনের প্রধান এমন একটা বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো যেটা কানাডার সরকারের বাইরে কেউ কখনও শোনে নি। ইন্টেলিজেন্স যোগাযোগ ব্যবস্থা তাদের তারগুলো পুড়িয়ে ফেললো। তার মানে কার্লোস ঠিকই ধারণা করেছে। আপনিও সঠিক, আলফ্রেড। কেইন ব’লে কিছু নেই। সে একটা উদ্ভাবন, একটা ফাঁদ।”
“শুরু থেকেই,” জিলেট বললো। “আমি তোমাকে সেটা বলেছি। তিন বছর ধ’রে ভূয়া রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। সোর্সগুলো খতিয়ে দেখা হয় নি। সবই ওখানে আছে।
“শুরু থেকেই,” ইউরোপীয়ান ভদ্রলোক বললো। “সন্দেহাতীতভাবেই এটা অ্যাবোটের সেরা সৃষ্টি…যতোক্ষণ না কিছু একটা ঘটলো, আর তার সৃষ্টিটা তার সঙ্গেই বেঈমানী করলো।”
“স্টিভেন্স এখানে এসেছে সেটা কনফার্ম করতে। প্রেসিডেন্ট সব কিছু জানতে চান।”
“তাকে তা জানতেই হবে। অটোয়াতে সন্দেহ করা হচ্ছে যে, ট্রেজারি বোর্ডের সেকশন হেড আমেরিকান ইন্টেলিজেন্সের হাতে খুন হয়েছে।” ইউরোপিয়ানটি এবার আমলার দিকে তাকালো। “মনে রাখবেন আলফ্রেড, আমরা খালি জানতে চাই কি হয়েছে। আমরা সেগুলো জানার জন্যেই আপনাকে জানিয়ে দিয়েছি। এগুলো একেবারেই তর্কাতীত। অ্যাবোট সেগুলো অস্বীকার করতে পারবে না। তবে সেগুলো অবশ্যই এমনভাবে উপস্থিত করতে হবে যেনো সেগুলো আপনার নিজের সোর্সরা নিজস্ব কায়দায় সংগ্রহ করেছে। আপনি খুবই ভড়কে যাবেন। আপনি একটা জবাবদিহিতা দাবি করবেন। পুরো ইন্টেলিজেন্স সম্প্রদায়কে বোকা বানানো হয়েছে।”
“তাই তো হয়েছে!” জিলেট আতিশয্যে বললো। “বোকা বানিয়েছে, ব্যবহার করা হয়েছে। ওয়াশিংটনের কেউ জানে না বর্ন কে, ট্রেডস্টোন কি। তারা সবাইকে অন্ধকারে রেখেছে। এটা তো ভয়ংকর কথা। আমাকে ভান করার কোনো দরকারই হবে না। শালারা সব উন্নাসিক বানচোতের দল।”
“আলফ্রেড,” অন্ধকারে হাত তুলে সতর্ক ক’রে দিয়ে ইউরোপীয়ানটি বললো। “মনে রাখবেন, কার হয়ে আপনি কাজ করছেন। হুমকীটা আবেগের উপর ভিত্তি ক’রে হতে পারে না। বরং ঠাণ্ডা মাথায় পেশাদারিত্বের সাথে হতে হবে। সে আপনাকে সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহ ক’রে ফেলবে। আপনাকে খুব দ্রুত এইসব সন্দেহ দূর করতে হবে। আপনি অভিযোগকারী, সে নয়।”
“মনে থাকবে।”
“বেশ।” হেডলাইটের আলো কাঁচের উপর আছড়ে পড়লো। “অ্যাবোটের ট্যাক্সিটা এখানে। আমি ড্রাইভারকে সামলাবো,” ইউরোপিয়ান তার ডান দিকের একটা সুইচে হাত রাখলো। “পথের পাশে আমি আমার গাড়িতে থাকবো, শুনতে থাকবো।” সে তার ড্রাইভারকে বললো। “যেকোনো মুহূর্তে অ্যাবোট বের হয়ে আসবে। তুমি জানো তোমাকে কি করতে হবে।”
ড্রাইভার মাথা নেড়ে সায় দিলে দু’জন লোকই গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। ড্রাইভার বেরিয়ে এসে এমনভাবে তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো যেনো এই শহরের কোনো ধনী লোক সে। পেছনের জানালা দিয়ে জিলেট দেখতে পেলো দু’জন লোক কিছু দূর গিয়ে আলাদা হয়ে গেলো। তারপর ইউরোপিয়ানটি ক্যাবের দিকে এগিয়ে এলো, তার হাতে একটা বিল, সে হাতটা তুলে রাখলো। ট্যাক্সিটাকে পাঠিয়ে দেয়া হবে। পলিকল্পনাটা বদলে গেছে।
ড্রাইভার রাস্তার উত্তর দিকের ট্রেডস্টোন সেভেনটি ওয়ান’র প্রবেশদ্বারের সিঁড়ি থেকে দুটো বাড়ির আগে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গায় লুকিয়ে রইলো।
ত্রিশ সেকেন্ড পরে জিলেট ব্রাউনস্টোন ভবনটার দিকে তাকালো। অধৈর্য ডেভিড অ্যাবোট বেরিয়ে আসছে। রাস্তার এপাশ-ওপাশ দেখে নিলো সে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে খুবই বিরক্ত হলো। ট্যাক্সিটা আসতে দেরি করছে অথচ তাকে একটা প্লেন ধরতে হবে। শিডিউলটা খুবই নিখুঁতভাবে অনুসরণ করার কথা। অ্যাবোট রাস্তায় নেমে বাম দিকে পা বাড়ালো, সে ট্যাক্সিটা খুঁজছে। সেটার জন্যে প্রতীক্ষা করছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সে ড্রাইভারকে অতিক্রম করবে। তাই করলো। দু’জন লোকই এখন ক্যামেরার আওতার বাইরে।
পথ রোধটা খুব দ্রুত হলো, আলাচনাও চললো সমান তালে। কয়েক মুহূর্ত বাদে বিস্মিত ডেভিড অ্যাবোট লিমোজিনে ঢুকে পড়লে ড্রাইভার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলো।
“তুমি!” অ্যাবোটের কণ্ঠে তিক্ততা আর ক্রোধ। “তোমরাই তাহলে।”
“আমার মনে হয় না আপনি এখন এমন অবস্থায় আছেন যে, ঘৃণা করতে পারেন….উন্নাসিক হতে পারেন।”
“তোমরা করেছো কি! কতো বড় আস্পর্ধা তোমাদের? জুরিখ। মেডুসা রেকর্ড। তুমিই তাহলে সেটা করেছো!”
“মেডুসা রেকর্ড, জুরিখ? হ্যা, আমিই করেছি। তবে আমি কি করেছি সেটা কোনো প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হলো আপনি কি করেছেন। আমরা আমাদের লোকগুলোকে জুরিখে পাঠিয়েছি, বলে দিয়েছি কি খুঁজতে হবে। আমরা এটা খুঁজে পেয়েছি। তার নাম বর্ন, তাই না? তাকেই আপনারা কেইন বলে ডাকেন। যে লোকটাকে আপনারা আবিষ্কার করেছেন।
অ্যাবোট নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখলো। “এই বাড়িটা কিভাবে খুঁজে পেলে?”
“লেগে থাকলে সবই সম্ভব। আমি আপনাকে অনুসরণ করেছি।”
“তুমি আমাকে অনুসরণ করেছো? তোমরা এসব কি করছো?”
“একটা রেকর্ড গড়ার চেষ্টা করছি। আপনার মিথ্যে আর বিকৃত করার রেকর্ড। আমাদের কাছ থেকে সত্যকে লুকিয়ে রাখার রেকর্ড। আপনি কি করছেন?”
“ওহ্, ঈশ্বর, তুমি আস্ত একটা বোকা!” অ্যাবোট গভীর একটা নিঃশ্বাস নিলো। “তুমি এটা কেন করলে? তুমি নিজে কেন আমার কাছে এলে না?”
“কারণ আপনি কিছুই করেন নি। আপনি পুরো ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটিকে কুক্ষিগত করেছেন। লক্ষ-লক্ষ ডলার, অকথিত হাজার মানুষের হাজার লক্ষ ঘণ্টা শ্রম। এ্যাম্বেসি আর স্টেশনগুলোকে মিথ্যে তথ্য গিলিয়েছেন, এমন একজন খুনির ব্যাপারে যার কোনো অস্তিত্বই নেই। ওহ্, আপনার কথাগুলো আমার মনে পড়েছে—কার্লোসের জন্যে কি দারুণ চ্যালেঞ্জ! কতো অপ্রতিরোধ্য একটা ফাঁদই না পেতেছিলেন! আর আমরা হলাম আপনার ঘুঁটি। সিকিউরিটি কাউন্সিলের একজন দায়িত্ববান সদস্য হিসেবে আমি তীব্রভাবেই সেটা ঘৃণা করি। আপনারা সবাই একরকম। কারা আপনাদেরকে ঈশ্বর হিসেবে নির্বাচন করেছে যে যখন খুশি আইন ভাঙতে পারেন—না, কেবল আইন নয়, নিয়মনীতি সব? আমাদেরকে বোকা হিসেবে প্রতিপন্ন করেছেন আপনি।”
“আর কোনো উপায় নেই,” বৃদ্ধলোকটি ক্লান্তভাবে বললো। “কতোজন জানে? আমাকে সত্যি কথা বলো।”
“আমি সেটা নিজের কাছেই রেখেছি। আমি সেটা আপনাকে দেবো।”
“সেটা হয়তো যথেষ্ট হবে না। হায় ইশ্বর!”
“সেটা হয়তো শেষও নয়,” আমলা লোকটা সহমর্মিতার সাথে বললো। “আমি জানতে চাই কি ঘটেছে।”
“কি ঘটেছে?”
“আপনার এই বিখ্যাত কৌশলটার। মনে হচ্ছে সেটা…ভেঙে পড়ছে।”
“তুমি এটা কেন বললে?”
“এটা তো খুবই পরিস্কার। আপনি বর্নকে হারিয়েছেন, আপননি তাকে খুঁজে পাবেন না। আপনার কেইন জুরিখের ব্যাংক থেকে সৌভাগ্যের মিলিয়ন ডলার নিয়ে উধাও হয়ে গেছে।”
অ্যাবোট কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকলো। “দাঁড়াও। এতে তোমার ক্ষিপ্ত হবার কি আছে?”
“আপনি,” জিলেট খুব দ্রুত বললো। সতর্ক লোকটা তার আসল প্রশ্নটা উত্থাপন করলো। “আমি বলবো, যে মানুষটি সেটা সৃষ্টি করেছে তার মুখোমুখি ব’সে যখন পেন্টাগনের ঐ গাধাটা অপারেশন মেডুসা নিয়ে কথা বলছিলো…আপনি তখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন, এটা আমি খুব প্রশংসা করি।”
“ইতিহাস,” বৃদ্ধলোকটির কণ্ঠ এখন খুব শক্তিশালী শোনাচ্ছে। “সেটা অবশ্য তোমাকে কিছু বলে নি।”
“বলা যায়, আপনার কিছু না বলাটাই বরং অস্বাভাবিক। মানে, টেবিলে আপনি ছাড়া আর কে ছিলো যে মেডুসার ব্যাপারে আপনার চেয়ে বেশি জানে? কিন্তু আপনি একটা কথাও বলেন নি। আর সেটাই আমাকে ভাবাতে শুরু করেছে। তাই আমি চরমভাবে এই কেইন খুনিকে টাকা দেয়ার ব্যাপারে বিরোধীতা করেছি। আপনি বাঁধা দিতে পারতেন, ডেভিড। আপনি কেইনকে খোঁজার কাজ অব্যাহত রাখার জন্যে গ্রহণযোগ্য কারণ বলতে পারতেন। আপনি কার্লোসকে শিকারের জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন।”
“এটাই সত্য,” অ্যাবোট বাঁধা দিয়ে বললো।
“অবশ্যই এটা সত্য। আপনি জানেন কখন এটা ব্যবহার করতে হয় আর আমি জানি কখন এটাকে থামাতে হয়। ধূর্ত। মেডুসার মাথা থেকে একটা সাপ টেনে বের করা হয়েছে। বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে তাকে একটা মিথ তৈরির জন্যে। প্রতিযোগী চ্যাম্পিয়নের রিংয়ে ঝাঁপ দিয়ে ঢুকে পড়েছে তার সাথে লড়াই করার জন্যে।”
“এটা শুরুর দিককার কথা।”
“কেন নয়? যেমনটি আমি বলেছি। খুবই ধূর্ত একটি কৌশল ছিলো সেটা। এমনকি কেইনের নিজের লোকেরা তার বিরুদ্ধে কাজ করলেও সে টিকে গিয়েছে। সমস্ত পদক্ষেপ আর গোপন তথ্য চল্লিশজনের জনের কমটিতে যে লোক প্রত্যেকের কাছে গোপন অপারেশনের রিপোর্ট পেশ করতো সে ছাড়া আর কে কেইনের কাছে কে জানিয়ে দিতো? আপনি আমাদের সবাইকে ব্যবহার করেছেন!”
অ্যাবোট মাথা নাড়লো। “বেশ। একদিক থেকে তোমার কথা ঠিক। আমিও মনে করি অনেক অপব্যবহার হয়েছে, সবই জাস্টিফাই করা হয়েছে—তবে তুমি সেরকমটি ভাবছো না। চেক এ্যান্ড ব্যালান্স সব সময় করতে পারতাম না। ট্রেডস্টোনে সরকারের সবচাইতে আস্থাভাজন কতিপয় লোকের একটি দল অন্তর্ভুক্ত আছে। তাদের মধ্যে আর্মির জি-টু থেকে সিনেট, সিআইএ, নেভাল ইন্টেলিজেন্স এবং এখন, সত্যি বলতে কি, হোয়াইট হাউজের লোকও ঢুকে পড়েছে। সত্যিকার অর্থে কোনো অন্যায় বা অপব্যবহার হলে এইসব লোকের যে কোনো একজন অপারেশনটা থামিয়ে দিতে ইতস্তত করবে না। কিন্তু কেউই এখন পর্যন্ত তা করে নি। আমি তোমার কাছে আবেদন করবো, তুমিও তা কোরো না।”
“আমি কি ট্রেডস্টোনের অংশ?,”
“তুমি এখন সেটার অংশ হয়ে গেছো।”
“আচ্ছা। এখন বলুন, কি হয়েছে? বর্ন কোথায়?”
“হায় ঈশ্বর, আমি যদি সেটা জানতাম! আমরা এমনকি নিশ্চিত নই যে, সে-ই বর্ন।”
“আপনারা নিশ্চিত নন কিসের ব্যাপারে?”
.
“আচ্ছা। এখন বলুন, কি হয়েছে? বর্ন কোথায়?”
“হায় ঈশ্বর, আমি যদি সেটা জানতাম! আমরা এমনকি নিশ্চিত নই যে, সে-ই বর্ন।”
“আপনারা নিশ্চিত নন কিসের ব্যাপারে?”
ইউরোপিয়ান ভদ্রলোকটি ড্যাশবোর্ডের সুইচে হাত রাখলো। সেটা অফ ক’রে দিলো সে। “এই তো,” সে বললো। “এটাই শুধু আমাদের জানার দরকার ছিলো, সে তার পাশে ড্রাইভারের দিকে ফিরলো। “এক্ষুণি সিঁড়ির পাশে চলে যাও। মনে রাখবে, তাদের কেউ যদি বের হয়ে আসে, দরজা বন্ধ হবার আগে তোমার হাতে সময় থাকবে ঠিক তিন সেকেন্ড। দ্রুত কাজ করবে।”
প্রথমে ড্রাইভার বের হয়ে সে ট্রেডস্টোন সেভেনটি ওয়ান-এর দিকে পা বাড়ালো। পাশের একটা ব্রাউনস্টোন ভবন থেকে মধ্যবয়সী এক দম্পতি তাদের নিমন্ত্রণদাতাকে উচ্চস্বরে গুডবাই জানাচ্ছে। ড্রাইভার হাটা ধীরগতির ক’রে ফেললো। দাঁড়িয়ে থেকে একটা সিগারেট বের ক’রে জ্বালালো। ইউরোপিয়ানটি সব দেখছে। তারপর তার কালো রেইন কোর্টের বোতাম খুলে ভেতর থেকে একটা সাইলেন্সার লাগানো রিভলবার বের করলো। সেটি লকটা বন্ধ ক’রে অস্ত্রটা আবারো হোলস্টারে রেখে গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার অপর পাশের লিমোজিনটার দিকে পা বাড়ালো। আয়নাগুলো এমন এ্যাঙ্গেলে রাখা আছে যে, ভেতরে থাকা কোনো মানুষ সেটা দিয়ে তাকে আসতে দেখবে না। গাড়ির পেছনের ট্রাংকটার সামনে এসে ইউরোপিয়ান লোকটা একটু থেমে গেলো। তারপর বিদ্যুৎবেগে সামনের ডান দিকের দরজাটা এক ঝটকায় খুলে ভেতরে ঢুকেই অস্ত্রটা সিটের উপর তাক্ করলো।
আলফ্রেড জিলেট আৎকে উঠে বাম দিকের দরজাটার হাতলের দিকে হাত বাড়ালো। ইউরোপিয়ান লোকটি চারটা দরজার লক্ সুইচে চাপড় করলো। ডেভিড অ্যাবোট একটুও নড়লো না, অনুপ্রবেশকারীর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে সে।
“শুভ রাত্রি, অ্যাবোট,” ইউরোপিয়ান বললো। “আরেকজন, যে আমাকে প্রায়ই বলতো ধর্মীয় স্বভাবে বিশ্বাস রাখতে। সে আপনাকে তার কংগ্রাচুলেশান্স পাঠিয়েছে। কেবল কেইনের জন্যে নয়, বরং আপনার ট্রেডস্টোনের নিজস্ব লোকদের জন্যেও। যেমন ধরেন, ইয়াখট-এর ড্রাইভার। একসময় খুবই উঁচু স্তরের এজেন্ট ছিলো সে।”
জিলেট তার কণ্ঠটা খুঁজে পেলো। এটা ফিফিসানি আর আর্তনাদের একটি মিশ্রন। “এসব কি? তুমি কে?” সে বললো।
“ওহ্, আরে পুরনো বন্ধু, এর কোনো দরকার নেই,” অস্ত্র হাতের লোকটা বললো। “আমি মি: অ্যাবোটের মুখের অঙ্গভঙ্গী দেখেই বুঝেছি যে, তোমার ব্যাপারে তার প্রথম দিককার সন্দেহটা যথার্থ। কারোর প্রথম প্রকাশটাই সব সময় বিশ্বাস করা হয়, তাই না অ্যাবোট? আপনার কথাই ঠিক। আমরা আরেকজন অসন্তুষ্ট লোককে খুঁজে পেয়েছি। আপনাদের সিস্টেমটা এরকম লোক খুব বিপজ্জনক হারেই উৎপাদন ক’রে চলেছে। সে-ই আমাদেরকে মেডুসা ফাইলগুলো দিয়েছে। আর সেই সূত্রেই আমরা বর্নের খোঁজ পেয়েছি।”
“তুমি করছো কি?” জিলেট চিৎকার ক’রে বললো। “তুমি এসব কি বলছো?”
“তুমি খুবই বিরক্তিকর, আলফ্রেড। তবে তুমি সবসময়ই ভালো স্টাফদের একজন ছিলো। তুমি জানো না কোন্ স্টাফ কার সাথে আছে, এটা খুবই খারাপ। তোমার মতো লোকে এটা কখনই করে না।”
“তুমি…” জিলেট মুখ ক’রে নিজের সিট থেকে উঠতে উদ্যত হলো। ইউরোপিয়ান লোকটা সঙ্গে সঙ্গে গুলি করলো। লিমোজিনের ভেতরে শব্দটা আরো ভোতা শোনালো। আমলা ভদ্রলোক গড়িয়ে প’ড়ে গেলো সিটের নিচে। তার পেচার মতো চোখ স্থির হয়ে চেয়ে রইলো শূন্যে।
“আমার মনে হয় না আপনি তার জন্যে শোক প্রকাশ করবেন,” ইউরোপিয়ান লোকটা বললো।
“মনে হয় না,” অ্যাবোট পাল্টা বললো।
“বর্ন বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপনি জানেন। কেইন বেঈমানী করেছে। সে মুখ খুলছে। দীর্ঘ নিরবতার অবসান হয়েছে। মেডুসার মাথার সাপটি ঠিক করেছে এবার নিজেকেই ছোবল মারবে সে। অথবা, হতে পারে সে বিক্রি হয়ে গেছে। এটাও সম্ভব। তাই না? কার্লোস অনেক লোককেই কিনে থাকে, আপনার পায়ের নিচে প’ড়ে থাকা লোকটাও সেরকম একজন।”
“তুমি আমার কাছ থেকে কিছুই জানতে পারবে না। সেই চেষ্টাও কোরো না।”
“জানার আর কিছু নেই। আমরা এখন সবটাই জানি। ডেল্টা, চার্লি…কেইন। তবে নামগুলো আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারা কখনও গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। কেবল রয়ে গেলো চূড়ান্ত বিচ্ছিন্নতা—যে সিদ্ধান্ত নেয় তাকে সরিয়ে ফেলা। আপনার কথা বলছি। বৰ্ন ফাঁদে পড়ে গেছে। শেষ হয়ে গেছে সে।”
“সিদ্ধান্ত নেবার আরো অনেক লোক আছে। তাদের নাগাল পাবে সে।”
“যদি সে তা করে, তবে তারা তাকে দেখামাত্রই গুলি করবে। যে লোকটা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তার চেয়ে ভয়ংকর কিছু আর নেই। সে আপনাদের সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করেছে। এ ব্যাপারে কার্লোসের কাছে প্রমাণ রয়েছে। বৰ্ণ আপনাদের লোক। তার উৎসটা মেডুসা ফাইলের আর বাকি সব কিছুর মতোই খুব স্পর্শকাতর।”
বৃদ্ধলোকটা ভ্রু কুচ্কালো। সে ভয় পেয়ে গেছে, তার নিজের জীবনের জন্যে নয়, বরং এমনি কিছুর জন্যে যা সীমাহীনভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। “তুমি পাগল হয়ে গেছো,” সে বললো। “কোনো প্রমাণ নেই।”
“এটাই হলো খুঁত, আপনাদের খুঁত। কার্লোস খুবই হিসেবী। তার সদস্যরা যেকোনো গোপনীয় জায়গায় পৌঁছে যেতে পারে। আপনাদের দরকার ছিলো মেডুসার একজন লোককে, যে বেঁচে থাকবে এবং উধাও হয়ে যাবে। আপনি একজন লোককে বেছে নিলেন যার নাম বর্ন, কারণ তার উধাও হওয়ার সব কিছু মুছে ফেলা হবে, প্রতিটি রেকর্ড থেকে মুছে ফেলা হবে—অথবা এরকমটিই আপনি বিশ্বাস করেন। তবে আপনি হ্যানয়ের নিজস্ব ফিল্ড পারসোনেলের কথাটা বিবেচনায় রাখেন নি, যে কিনা মেডুসার অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করেছিলো। সেইসব রেকর্ডের অস্তিত্ব আছে। মার্চ ২৫, ১৯৬৮ সালে জেসন বর্নকে এক আমেরিকান ইন্টেলিজেন্স অফিসার তাম কুয়ান-এর জঙ্গলে গুলি ক’রে হত্যা করে।”
সন্ন্যাসী সামনের দিকে ঝুঁকে এলে আর কিছুই করার থাকলো না। ইউরোপিয়ান লোকটি গুলি ক’রে বসলো।
.
ব্রাউনস্টোন ভবনটার দরজা খুলে গেলে প্রবেশদ্বারের সিঁড়ির পাশে অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা ড্রাইভার লোকটি হাসলো। হোয়াইট হাউজের সহকারী ট্রেডস্টোনে বসবাসরত বৃদ্ধলোকটার সঙ্গে বের হয়ে এলো। এই লোকটাকে তারা ইয়াখটম্যান ব’লে ডাকে। খুনি জানে এখন প্রাইমারি এলার্মগুলো বন্ধ করা আছে। খুবই অল্প সময় তার হাতে আছে। দরজাটা বন্ধ হতেই এলার্ম সিস্টেমটা আবার সচল হয়ে যাবে।
“আপনাকে এগিয়ে দিতে পেরে খুব ভালো লাগছে স্যার,” ইয়াখটম্যান তার সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে বললো।
“আপনাকেও ধন্যবাদ, স্যার।”
এগুলোই ছিলো এই দু’জন মানুষের বলা শেষ কথা। সিঁড়ির পাশ থেকে বেরিয়ে এসে ড্রাইভার পরপর দুটো গুলি করলো। ইয়াখটম্যান দরজার চৌকাঠ ধরে ব’সে পড়লো। হোয়াইট হাউজের লোকটা তার বুকের একপাশ ধরে রেখেছে। সেও দরজার চৌকাঠ ধ’রে কোনোরকম নিজের ভারসাম্য ধরে রাখার চেষ্টা করলো। ড্রাইভার ঘুরে এসে সিঁড়ি দিয়ে উঠে হোয়াইট হাউজের লোকটাকে শক্ত ক’রে ধরে তাকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দরজার ভেতরে টেনে নিয়ে গেলো। তারপর দরজার ভেতরের দিকের অংশটার দিকে ঘুরলো। সে জানে কি খুঁজতে হবে। সে ওটা পেয়ে গেলো। উপরের তাকের অংশটা দেয়ালের মধ্যে ঢুকে গেছে। সেখানে একটা মোটা ক্যাবল আছে। দরজাটা বন্ধ ক’রে ক্যাবলটার দিকে তাক্ ক’রে গুলি চালালো। গুলির শব্দটার অব্যবহিত পরেই স্পিকার থেকে ঘর্ঘর্ শব্দ হলো। তারপর স্ফুলিঙ্গের। সিকিউরিটি ক্যামেরাগুলো গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে গেলো। মনিটরগুলোর পর্দা এখন কালো হয়ে গেছে।
সিগনাল দেবার জন্যে সে দরজাটা খুললো। এটার দরকার আছে। ইউরোপিয়ান লোকটা রাস্তা দিয়ে হেটে এসে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো। ফয়ার আর হলওয়ের দিকে তাকালো সে। এক সঙ্গে তারা দু’জন ফয়ার থেকে কার্পেটটা তুলে ধরলো। নিচে সিকিউরিটি যন্ত্রটা বসানো আছে। কোনো ব্যাক-আপ এলার্ম সচল হবে না। দু’জনেই জানে যদি আবিস্কারটা করতে হয়, খুব দ্রুত করতে হবে। উপরতলা থেকে দরজা খোলার শব্দ হলে পায়ের শব্দ শোনা গেলো। একটা নারী কণ্ঠের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
“ডার্লিং! আমি এইমাত্র খেয়াল করলাম ক্যামেরাটা বন্ধ হয়ে গেছে। তুমি কি সেটা চেক ক’রে দেখবে?” একটু বিরতি। আবার মহিলা বললো, “আচ্ছা, ডেভিডকে কেন বলছো না?” আবারো বিরতি, একেবারে আগের মতোই নিখুঁত টাইমিং। “জেসুইটকে বিরক্ত করো না, ডার্লিং। ডেভিডকে বলো!”
দুটো পদশব্দ। নিরবতা। কাপড় সরানোর শব্দ। ইউরোপিয়ান লোকটি সিঁড়ির দিকে লক্ষ্য করলো। একটা বাতি নিভে গেলো। ডেভিড। জেসুইট… সন্ন্যাসী!
“মহিলাকে ধরো!” সে ড্রাইভারকে গর্জে বললো। ঘুরে নিজের অস্ত্রটা হলওয়ের শেষপ্রান্তের দরজার দিকে তাক্ করলে ড্রাইভার সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উঠে গেলো। একটা গুলির শব্দ হলো। শক্তিশালী একটা অস্ত্র থেকে—সাইলেন্সারের ভোঁতা কোনো শব্দ নয়। ইউরোপিয়ান লোকটা উপরের দিকে তাকালো। ড্রাইভার লোকটা নিজের কাঁধ ধরে রেখেছে। গলগল ক’রে রক্ত ঝরছে সেখান থেকে। তার পিস্তলটা হাতে ধরা, সিঁড়ির উপরে থেকে কয়েকবার থুথু ফেললো সে।
হলওয়ের শেষপ্রান্তের দরজাটা ধপাস ক’রে খুলে গেলো। তীব্র আতংকে মেজর দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। তার হাতে একটা ফাইল ফোল্ডার। ইউরোপিয়ান লোকটি দু’বার গুলি চালালো। গর্ডন ওয়েব হুমড়ি খেয়ে পেছন দিকে প’ড়ে গেলো। তার গলাটা ছিঁড়ে ফাঁক হয়ে গেছে, হাত থেকে ফোল্ডারটা ছিটকে পড়লে কাগজপত্রগুলো তার আশেপাশে ছড়িয়ে পড়লো। রেইনকোট পরা লোকটা সিঁড়ির দিকে ড্রাইভারের কাছে ছুটে গেলো। উপরের রেলিংয়ে ধূসর চুলের মহিলা মাথায় আর ঘাড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মরে পড়ে আছে। “তুমি কি ঠিক আছো? তুমি হাটতে পারবে?” ইউরোপিয়ান লোকটি জিজ্ঞেস করলো।
ড্রাইভার মাথা নেড়ে সায় দিলো। “কুত্তীটা আমার কাঁধের অর্ধেকটা উড়িয়ে দিয়েছে। তবে আমি সামলে নিতে পারবো।”
“তোমাকে পারতেই হবে!” আদেশ করলো তার উপরওয়ালা। নিজের কোটটা খুলে ফেললো সে। “আমার কোটটা পরে নাও। আমি অ্যাবোটকে এখানে চাই! জলদি!”
“হায় ঈশ্বর!….”
“কার্লোস সন্ন্যাসীকে এখানে চায়!”
আহত লোকটি কোটটা পরে তীব্র যন্ত্রণা নিয়েই সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। ইউরোপিয়ান লোকটি তাকে দেখলো। নিশ্চিত হতে চাইছে কাজটা সে করতে পারবে কিনা। সে পারবে। সে একটা ষাড়। সব দিক থেকেই কার্লোসকে সন্তুষ্ট করতে পারে সে। ড্রাইভার ডেভিড অ্যাবোটের মৃতদেহটা বয়ে নিয়ে আসবে এই ভবনটার ভেতরে, এমনভাবে নিয়ে আসবে যেনো কোনো মাতালকে বাড়ি ফিরতে সাহায্য করা হচ্ছে। তারপর তাকে নিজের রক্তপাত বন্ধ ক’রে আলফ্রেড জিলেটের মৃতদেহটা নদীতে ফেলে দিয়ে আসতে হবে।
কার্লোসের লোকজন এরকম কাজ করতে সক্ষম। তারা সবাই ষাড়। অসন্তুষ্ট ষাড়গুলো একজন লোকের মধ্যে নিজেদের জীবনের স্বার্থকতা খুঁজে পেয়েছে।
ইউরোপিয়ান লোকটি ঘুরে হলওয়ে দিয়ে এগিয়ে চললো। কিছু কাজ করতে হবে। জেসন বর্ন নামের লোকটার চূড়ান্ত বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে।
.
আশার চেয়েও এটা বেশি। প্রকাশিত ফাইলগুলো অবিশ্বাস্য। তাতে রয়েছে কল্পনায়ক কেইনের ব্যবহার করা প্রতিটি যোগাযোগের পদ্ধতি আর কোডগুলো। এখন আর তাকে কল্পনায়ক ব’লে মনে হচ্ছে না। কাগজগুলো একসাথে জড়ো করতে করতে ইউরোপিয়ান লোকটা ভাবলো। দৃশ্যগুলো সেট করা হলো। অভিজাত লাইব্রেরিতে চারটা লাশ সাজিয়ে রাখা হলো। ডেভিড অ্যাবোট একটা চেয়ারে বসা অবস্থায়, তার দু’চোখ খোলা। তাতে তীব্র আতংক। এলিয়ট স্টিভেন্স দাঁড়িয়ে আছে। ইয়াখটম্যানকে একটা টেবিলের উপরে শোয়ানো হলো। তার হাতে মুখখোলা হুইস্কির একটা বোতল। গর্ডন ওয়েব হাত পা ছড়িয়ে মাটিতে প’ড়ে আছে। তার হাতে তার বৃফকেসটা ধরা।
যেরকম হিংস্রতাই ঘটে থাকুক না কেন, সেটিংটা একেবারে অপ্রত্যাশিত কিছুকেই ইঙ্গিত করবে। কথাবার্তার মাঝখানে এলোপাতারি গুলি চালানো হয়েছে। ইউরোপিয়ান লোকটা চামড়ার হাত দস্তানা পরে নিজের শৈল্পিক কাজটা আগ্রহ ভরে দেখে নিলো। আসলেই একটা শৈল্পিক কাজ হয়েছে। সে ড্রাইভারকে বিদায় দিয়ে প্রতিটি দরজার হাতল, নব, চক্চক্ করা কাঠের উপরিভাগ মুছে ফেললো। এবার চূড়ান্ত টাচ্ দেবার সময়। সে একটা টেবিলের কাছে গেলো, যেখানে একটা সিলভার ট্রে’তে ব্র্যান্ডির- গ্লাসগুলো রাখা আছে। একটা গ্লাস নিয়ে আলোর কাছে তুলে ধরলো। যেমনটি সে প্রত্যাশা করেছিলো, এটা একেবারে ছাপহীন। গ্লাসটা নামিয়ে রেখে পকেট থেকে প্লাস্টিকের ছোট্ট একটা কেস্ বের ক’রে সেখান থেকে একটা স্বচ্ছ টেপের টুকরো বের করলো। সেটাও আলোর সামনে তুলে ধরলো। এই তো আছে, একেবারে ছবির মতোই পরিস্কার—এগুলো যেকোনো ছবির মতোই অকাট্য।
এগুলো নেয়া হয়েছে জুরিখের গেইমেনশেফট ব্যাংকের অফিসের একটা পেরিয়ারের গ্লাস থেকে। এগুলো জেসন বর্নের ডান হাতের আঙুলের ছাপ। ইউরোপিয়ান লোকটি সেই স্বচ্ছ টেপটা গ্লাসে চেপে ধরলো, তারপর আস্তে ক’রে সেটা তুলে ফেললো। আবার সে গ্লাসটা আলোর সামনে তুলে ধরে দেখলো। ছাপটা নিখুঁতভাবে গ্লাসে লেগে গেছে।
সে গ্লাসটা এক কোণে নিয়ে গিয়ে মেঝেতে আস্তে ক’রে ফেলে দিলো। হাটু মুড়ে ব’সে গ্লাসের ভাঙা টুকরোগুলো দেখলো। কয়েকটা সরিয়ে, বাকিগুলো কার্পেটের নিচে রেখে দিলো।
এগুলোই যথেষ্ট।