অধ্যায় ২
তারা জ্যঁ পিয়েরে নামটি বেছে নিলো। এটা কাউকে চকেও দেয় না, বিরক্তও করে না। পোর্ত নোয়ে’তে এই নামটি খুবই সাধারণ আর পরিচিত।
বইগুলো এলো মার্সেই থেকে। ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির এবং পুরুত্বের; চারটা ইংরেজি, দুটো ফরাসি। এগুলো মাথা এবং মানসিক আঘাতের উপর রচিত মেডিকেল বই। মস্তিষ্কে অনেক ক্রশ-সেকশন আছে, শত শত অপরিচিত শব্দ গ্রহণ করা এবং বোঝার চেষ্টা করা হয় সেখানে। স্মৃতি সংরক্ষণ আর স্মরণ করার কাজ করে একটি অংশ, সেটা আঘাতপ্রাপ্ত হলে অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হলে স্মৃতিভ্রষ্ট তথা অ্যামনেসিয়ার কারণ হয়ে থাকে।
অ্যামনেসিয়া।
“এক্ষেত্রে কোনো নিয়ম নেই,” বললো কালো চুলের লোকটি। টেবিল ল্যাম্পের স্বল্প আলোর কারণে চোখ দুটো ঘষে নিলো। “এটা একটা জ্যামিতিক পাজল; যেকোনো ভাবেই এটা হতে পারে। শারীরিক অথবা মানসিকভাবে — কিংবা কিছুটা উভয় কারণেই। এটা স্থায়ীও হতে পারে, অস্থায়ীও হতে পারে। আবার পুরোপুরি সব অংশেও হতে পারে। কোনো নিয়ম নেই!”
“ঠিক বলেছো,” ঘরের এককোণে একটা চেয়ারে ব’সে হুইস্কিতে চুমুক দিতে দিতে ওয়াশবার্ন বললেন। “তবে আমার মনে হচ্ছে, কী ঘটেছে সে ব্যাপারে আমরা খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। মানে যেটা আমি ভাবছি।”
“কোনটার কথা বলছেন?” লোকটি উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো।
“এইমাত্র যেটা তুমি বললে : ‘উভয় কারণেই।’ যদিও ‘কিছুটা’ শব্দ বদলে ‘মারাত্মক’ হবে। মারাত্মক কোনো আঘাতের কারণে।”
“কি ধরনের মারাত্মক আঘাত?”
“শারীরিক এবং মানুষিক আঘাত। এ দুটো পরস্পর সম্পর্কিত। একে অন্যের পরিপূরক বলা যায় একে অন্যের সাথে বিশেষভাবে জড়িত।”
“কি পরিমাণ মদ খেয়েছেন?”
“যতোটা তুমি ভেবেছো তার চেয়েও কম। এটা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক।” ডাক্তার একটা ক্লিপবোর্ড হাতে নিলেন, ওটাতে কতোগুলো পৃষ্ঠা আছে। “এ হলো তোমার ইতিহাস—তোমার নতুন ইতিহাস—যেদিন থেকে তোমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে তার ইতিহাস। সংক্ষেপে বলি। শারীরিক আঘাতটি আমাদেরকে বলছে তোমার মানসিক আঘাতটিও ব্যাপক ছিলো। প্রচণ্ড চাপ। নয় ঘণ্টা পানিতে থাকার কারণে হিস্টিরিয়ার সৃষ্টি হয়েছিলো। এতে ক’রে মানসিক ক্ষতি হয়েছে। অন্ধকার, হিংসাত্মকভাবে হাত পা ছোড়াছুড়ি, ফুস্ফুসে খুব কম বাতাস থাকা; এগুলো হলো হিস্টিরিয়ার অনুষঙ্গ। এসব কিছুর পরই মস্তিষ্ক স্মৃতিকে মুছে ফেলেছে যাতে তুমি মানিয়ে নিতে পারো, টিকে থাকতে পারো। তুমি কি আমার কথা শুনছো?”
“হ্যা, শুনছি। মানব মস্তিষ্ক নিজেই নিজেকে রক্ষা করে।”
“মাথাটা নয়, মনটা। এ দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মাথার প্রসঙ্গে আবার আসছি। তবে সেটাকে আমরা মস্তিষ্ক বলেই চিহ্নিত করবো।”
“ঠিক আছে। মন, মাথা নয়…মানে মস্তিষ্ক।”
“ভালো।” ওয়াশবার্ন পৃষ্ঠাগুলো ওল্টালেন। “এখানে কয়েকশ’ অবজারভেশন লিপিবদ্ধ করা আছে। সাধারণ মেডিকেল তথ্য–ডোসেজ, সময়, প্রতিক্রিয়া, এরকম কিছু—কিন্তু মূল বক্তব্যটি তোমাকে নিয়ে। যে শব্দ তুমি ব্যবহার করো, যে শব্দে তুমি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করো এগুলো আর কি। যেসব পদবাচ্য তুমি ব্যবহার করো—কোমায় থাকার সময় অথবা ঘুমের মধ্যে যখন ছিলে তখন আমি শব্দগুলো লিখে রেখেছিলাম। এমনকি তুমি যেভাবে কথা বলো, কোনো কিছু দেখে চমকে যাও, কিংবা আগ্রহী হয়ে ওঠো। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে অনেকগুলো বৈপরীত্য আছে তোমার মধ্যে। তোমার মনের গহীনে হিংসাত্মক ব্যাপার আছে, তুমি সেটা নিয়ন্ত্রণে রেখেছো সবসময়, তবে খুবই প্রকটভাবে সেটা তোমার ভেতরে রয়েছে। তোমার আরেকটা ঔদাসীন্য রয়েছে, মনে হয় সেটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক। তবে তুমি সেটা খুব কমই প্রকাশ করো। যে যন্ত্রণা তোমাকে ক্ষেপিয়ে তোলে সেটাও কমই প্রকাশ করো।”
“আপনি এখন কিন্তু আমাকে ক্ষেপিয়ে তুলছেন,” লোকটা বাঁধা দিয়ে বললো। “আমরা একই শব্দ আর পদবাচ্য নিয়ে বার বার কথা বলেছি—”
“আমরা সেটাই অব্যাহত রাখবো,” ওয়াশবার্ন বললেন। “যতোক্ষণ না কোনো উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।”
“কোনো উন্নতি হয়েছে ব’লে আমার তো মনে হচ্ছে না।”
“পরিচিতি এবং পেশাগত ব্যাপারে হয় নি। মানে, তোমার পরিচয় কি, পেশা কি, সেটা এখনও জানা যায় নি। তবে আমরা খুঁজে বের করবো, ঠিক কিসে তোমার স্বস্তি লাগে। কোন্ কাজটাতে তুমি সেরা। এটা একটু ভীতিকরও বটে
“কোন্ দিক থেকে?”
“একটা উদাহরণ দেই।” ডাক্তার ক্লিপবোর্ডটা রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দেয়ালের একটা আলমারির ড্রয়ার খুললেন তিনি। সেখান থেকে বড় একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বের করলে স্মৃতিহীন লোকটা একটু বিচলিত হয়ে উঠলো। ওয়াশবার্ন এই প্রতিক্রিয়াটি খেয়াল করলেন। “এটা আমি কখনই ব্যবহার করি নি, কিভাবে করতে হয় সেটাও জানি না। কিন্তু আমি তো ওয়াটারফ্রন্টে থাকি, তাই এটা রাখতে হয়।” তিনি হাসলেন। আচমকা, কোনো রকম পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই অস্ত্রটা তার দিকে ছুড়ে মারলেন। অস্ত্রটা শূন্যেই ধরে ফেললো সে। খুবই নিখুঁতভাবে। বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে। “এটা খুলে ফেলো তো দেখি।”
“কি?”
“অস্ত্রটার বিভিন্ন অংশ খুলে ফেলো।”
লোকটা অস্ত্রের দিকে তাকালো। তারপর নিরবে তার হাতের আঙুল অস্ত্রটার উপর বিচরণ করতে লাগলো বেশ দক্ষতার সাথে। ত্রিশ সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে অস্ত্রটার বিভিন্ন অংশ খুলে টুকরো টুকরো ক’রে ফেলা হলো। এবার ডাক্তারের দিকে তাকালো লোকটা।
“বুঝতে পেরেছো আমি কি বোঝাতে চাইছিলাম?” ওয়াশবার্ন বললেন। “তোমার দক্ষতার মধ্যে অস্ত্র সংক্রান্ত অসাধারণ জ্ঞান রয়েছে।”
“সেনাবাহিনী?” লোকটা জানতে চাইলো খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে।
“একদমই মনে হচ্ছে না,” জবাব দিলেন ডীক্তার। “তুমি যখন কোমা থেকে প্রথম জ্ঞান ফিরে পেলে কথাটা তোমাকে বলেছিলাম। মানে তোমার দাঁতের ব্যাপারে। আমি তোমাকে আশ্বস্ত ক’রে বলছি, ওগুলো সেনাবাহিনীর কোনো কাজ নয়। আর অবশ্যই সার্জারির কথাটা তো বলতেই হয়। সেটা তোমাকে সেনাবাহিনীর একজন হিসেবে নাকচ করে দিচ্ছে।”
“তাহলে কী দাঁড়ালো?”
“সেটা নিয়ে ভেবো না এখন। কি ঘটেছে তাতে ফিরে যাই আমরা। মন নিয়ে কথা বলছিলাম, মনে আছে? মানসিক চাপ, হিস্টিরিয়া। মস্তিষ্কের কথা বলছি না, মানসিক চাপের কথা বলছি। আমি কি পরিস্কার বোঝাতে পেরেছি?”
“বলে যান।”
“আঘাতটা সরে যেতেই, চাপটা থেকে মুক্ত হতেই মস্তিষ্ক আর নিজেকে রক্ষা করার জন্যে পূর্বের অবস্থায় থাকবে না। ধীরে ধীরে তোমার দক্ষতা, প্রতিভা ফিরে আসতে থাকবে। সব কিছুই মনে পড়ে যাবে তোমার। তবে একটা ফাঁক থেকে যাবে, আর সেইসব ফাঁকে যা কিছু থাকবে তার সবটাই হবে স্থায়ী।” ওয়াশবার্ন হেসে আবার চেয়ারে বসে গ্লাসটা তুলে নিয়ে চোখ বন্ধ ক’রে মদে চুমুক দিতে লাগলেন তিনি। তার চোখেমুখে উদ্বিগ্নতার ছাপ।
“বলুন,” লোকটা চাপা কণ্ঠে বললো।
ডাক্তার চোখ খুলে সরাসরি তার রোগীর দিকে তাকালেন। “আমরা আবার মাথায় ফিরে আসি, যাকে আমরা মস্তিষ্ক ব’লে ডাকবো। মস্তিষ্কে রয়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন কোষ। তুমি সেটা বইতে পড়েছো। এসবের একটু ওদিক হলেই বিরাট কিছু হয়ে যেতে পারে। সেটাই তোমার হয়েছে। ক্ষতিটা শারীরিক। এটা এরকম, যেনো কোনো ব্লকের রি-অ্যারেঞ্জ করা হয়েছে। শারিরীক গঠন বা কাঠামোটি আর আগের অবস্থায় নেই,” ওয়াশবার্ন থেমে গেলেন।
“আর?” লোকটা জানতে চাইলো।
“শারীরিক চাপগুলোর অপসারিত হলে তোমার প্রতিভা আর দক্ষতা ধীরে ধীরে ফিরে আসবে। সেটাই হচ্ছে এখন। তবে আমি মনে করি না সেগুলো জড়ো ক’রে একসূত্রে গেঁথে তুমি তোমার অতীতকে বের করতে পারবে।”
“কেন, কেন পারবো না?”
“কারণ শরীরবৃত্তীয় যে অংশটি স্মৃতিকে সম্প্রচার বা সঞ্চারণ করে সেটা বদলে ফেলা হয়েছে। এমনভাবে পুণর্গঠন করা হয়েছে যেটা আর কোনোদিন ঠিক করা যাবে না। এসবের মূল উদ্দেশ্য ছিলো সেগুলোকে ধ্বংস করা।”
লোকটা ভাবলেশহীনভাবে ব’সে রইলো। “এই প্রশ্নের জবাব আছে জুরিখে,” সে বললো।
“এখন নয়। তুমি এখনও প্রস্তুত হও নি। তোমার শক্তিও এখন তেমন একটা নেই।”
“আমি আমার শক্তি ফিরে পাবো।”
“হ্যা, অবশ্যই তুমি পাবে।”
.
কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে গেলো। ফিরে আসতে লাগলো লোকটার শক্তি। ভাষাগত অনুশীলনটা চলতে লাগলো পুরোদমে। উনিশতম সপ্তাহের সকালের মাঝামাঝি সময়, দিনটা খুবই উজ্জ্বল, ভূমধ্যসাগরটা বেশ শান্ত আর চক্চক্ করছে। অভ্যাস অনুযায়ী লোকটা ওয়াটারফ্রন্ট আর পাহাড়ের উপরে কয়েক ঘণ্টার দৌড়ানো শেষ করেছে মাত্র। প্রতিদিন প্রায় বারো মাইলের মতো দৌড়ায় সে। আর প্রতিদিনই তার গতি বাড়ছে। ক্রমাগতভাবেই কমে আসছে বিশ্রামের সময়। সে ব’সে আছে তার শোবার ঘরের জানালার পাশের চেয়ারে। খুব দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে, ঘামে একেবারে ভিজে গেছে তার টি-শার্টটা। পেছনের দরজা দিয়ে অন্ধকার হলওয়ে পেরিয়ে লিভিংরুম হয়ে শোবার ঘরে ঢুকেছে সে। এটা একেবারেই সহজ একটি কাজ। লিভিংরুমটা ওয়াশবার্নের ওয়েটিংরুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সেখানে এখনও দু’য়েকজন কাটা-ছেঁড়ার রোগী চেয়ারে ব’সে আছে চোখেমুখে ভয় আর আশংকা নিয়ে। ডাক্তারের অবস্থা কি সেটা নিয়ে ভাবছে তারা। সত্যি বলতে কী, আজ ডাক্তারের অবস্থা ভালোই আছে। জিওফ্রে ওয়াশবার্ন মদ খেয়ে চুর হয়ে আছেন। তবে তিনি নিজ বাড়িতেই আছেন আজ। স্মৃতিভ্রষ্ট লোকটা বুঝতে পেরেছে। সব প্রশ্নের জবাব নিহিত আছে জুরিখের ব্যানহফস্ট্রাসের একটি ব্যাংকে। জুরিখের পথঘাট কেন খুব সহজেই তার মনে ভেসে এলো?
শোবার ঘরের দরজাটা খুলে গেলে ডাক্তার হুড়মুড় ক’রে প্রবেশ করলেন, দাঁত বের ক’রে হাসছেন তিনি। তার সাদা কোটে রোগীর রক্ত লেগে রয়েছে।
“আমি পেরেছি!” তার কণ্ঠে সুস্পষ্ট বিজয় উল্লাস। “আমি নিজের জন্যে ভাড়া করা একটি হল খুলবো, কমিশন পেয়ে বেঁচে থাকবো। একটু থিতু হওয়া যাবে।”
“আপনি কি বলছেন এসব?”
“এরকম একটা কিছুই তোমার দরকার ছিলো। তোমাকে বাইরে কাজ করতে হবে। দুই মিনিট আগে মঁসিয়ে জ্যঁ পিয়েরে নামের নামহীন ব্যক্তিটি একটা চাকরি পেয়ে গেছে! অন্ততপক্ষে এক সপ্তাহের জন্যে।”
“আপনি কিভাবে এটা করতে পারলেন? ভেবেছিলাম এখানে এরকম কোনো সুযোগ নেই।”
“ক্লদ লাশের সংক্রমিত পায়ে অপারেশন করার মধ্য দিয়েই সুযোগটা এসেছে। আমি জানিয়েছি, আমার লোকাল অ্যানেস্থেটিক সরবরাহ খুবই সীমিত। আমাদের মধ্যে সমঝোতা হলো; আর তুমি হলে সেই পণ্যবিনিময়ের মুদ্রা।”
“এক সপ্তাহের জন্যে?”
“তুমি যদি মোটামুটি ভালো কাজ করো তাহলে হয়তো সে তোমাকে আরো বেশি দিন রেখে দেবে,” ওয়াশবার্ন একটু থামলেন। “যদিও সেটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাই না?”
“আমি অবশ্য কিছুই বুঝতে পারছি না। একমাস আগে হলে হয়তো দেখা যেতো, কিন্তু এখন না। আমি তো আপনাকে বলেছিই, আমি চলে যাবার জন্য প্রস্তুত। আমার ধারণা আপনিও তাই চান। জুরিখে আমার কাজ আছে।”
“আমিও চাই তুমি তোমার সেই কাজটা ভালোমতো করো। আমার স্বার্থটা খুবই স্বার্থপর ধরণের, কোনো ধরণের কাটছাটের অনুমতি দেয়া হবে না।”
“আমি প্রস্তুত।”
“আমার কথাটা মনে রেখো, পানিতে দীর্ঘ সময় থাকাটা তোমার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছুটা সময় রাতেও থাকবে। কোনো নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নয়। একজন যাত্রী হিসেবেও নয়। একটু কঠিন আর কষ্টকর পরিবেশে সত্যি বলতে কী, যতো কঠিন হবে ততোই ভালো।”
“আরেকটা পরীক্ষা?”
“এই আদিম-অসভ্য পোর্ত নোয়ে’তে এছাড়া আমি আর কী করতে পারি। আমার পক্ষে যদি তোমার জন্যে একটা ঝড় অথবা জাহাজডুবির ঘটনা ঘটানো সম্ভব হোতো, তবে আমি তাই করতাম। অন্যদিক থেকে বলতে গেলে, লামুশে নিজেই একটা ঝড়। লোক হিসেবে সে খুবই কঠিন। তার পায়ের ব্যথা যতো বাড়বে সে তোমাকে ততো বেশি ঘৃণা করবে। অন্যদেরকেও। তুমি অন্য কারোর স্থলাষিক্ত হচ্ছো।”
“অনেক ধন্যবাদ।”
“এটা আর বলার দরকার নেই। আমরা দুটো চাপকে একত্র করার চেষ্টা করছি। কমপক্ষে এক অথবা দু’রাত পানিতে থাকবে। লামুশে যদি তার শিডিউলটা ঠিক রাখে তাহলে এই দূর্গম আর কঠিন পরিবেশ তোমার হিস্টিরিয়ায় বেশ ভালো অবদানই রাখবে। তোমার চারপাশের লোকদের থেকে সন্দেহ আর ঘৃণার যে প্রকাশ ঘটবে সেটা প্রাথমিক চাপ হিসেবে কাজ করবে।”
“ধন্যবাদ আবারো। ধরা যাক্ তারা আমাকে জাহাজ থেকে ছুড়ে ফেলে দেবার সিদ্ধান্ত নিলো? আপনি তো এরকমই একটা পরীক্ষা চাচ্ছেন, না? কিন্তু আমি যদি পানিতে ডুবে যাই তাহলে আমার আর কী ভালো হবে সেটা বুঝতে পারছি না।”
“ওহ্, এরকম কিছু হবে না,” ওয়াশবার্ন বললেন।
“আপনি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলাতে খুব খুশি হলাম।”
“তাই হওয়া উচিত। চিন্তা কোরো না, আমি তো আছিই। হয়তো আমি ক্রিশ্চিয়ান বার্নাড অথবা মাইকেল ডি. বেকি নই, তবে আমি সেইসব লোকের খুবই প্রয়োজনীয় একজন ব্যক্তি, আমাকে তাদের দরকার আছে। আমাকে হারানোর ঝুঁকি তারা নেবে না।”
“কিন্তু আপনি তো চলে যেতে চান। আর আমি হলাম আপনার চলে যাবার পাসপোর্ট।”
“মাই ডিয়ার রোগী, তুমি এটা বুঝবে না। এবার আসো তো। লামুশে চাচ্ছে তুমি ডকে যাও, যাতে তার যন্ত্রপাতির সাথে তুমি পরিচিত হয়ে উঠতে পারো। আগামীকাল ভোর চারটা বাজে তুমি কাজ শুরু করবে। সমুদ্রের এক সপ্তাহ সময়টা কিভাবে কাজে লাগাবে ভেবে নাও। এটাকে একটা সমুদ্রযাত্রা হিসেবে মনে করো।”
.
এটাকে কোনোভাবেই সমুদ্র ভ্রমণ বলা যাবে না। নোংরা গালিগালাজ আর তেল চিটচিটে মাছ ধরার ট্রলারের ক্যাপ্টেন হলো ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের মতোই জঘন্য। নিঃসন্দেহে পোর্ত নোয়ের জঘন্য লোকটাই একমাত্র ব্যক্তি যে কিনা লাশের সাথে ক্রু হিসেবে কাজ করছে। নিয়মিত পঞ্চম সদস্যটি ছিলো প্রধান নেটম্যানের আপন ভাই। সকাল চারটা বাজে হার্বার ত্যাগ করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই এই ব্যাপারটা টের পেয়ে গেলো জ্যঁ পিয়েরে নামের লোকটা।
“তুমি আমার ভায়ের রুটিরুজি কেড়ে নিয়েছো!” সিগারেটে বিরামহীন টান দিয়ে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে নেটম্যান রেগেমেগে বললো। “তার বাচ্চাদেরকে অভুক্ত রেখেছো!”
“মাত্র এক সপ্তাহের জন্যে,” জ্যঁ পিয়েরে প্রতিবাদ ক’রে বললো। ওয়াশবার্নের স্টাইপেন্ড থেকে তার চাকরিচ্যুত হওয়া ভাইকে সান্ত্বনা হিসেবে কিছু টাকা দিয়ে দেয়াটা খুবই সহজ একটা কাজ হোতো। কিন্তু ডাক্তার আর তার রোগী এরকম আপোষ না করার জন্যে আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলো।
“আশা করি জালের কাজে তুমি বেশ দক্ষ!”
সে মোটেও দক্ষ নয়!
পরবর্তী বাহাত্তর ঘণ্টায় এমন একটি মুহূর্ত এলো যখন জ্যঁ পিয়েরে নামের লোকটি টাকা দিয়ে দেয়াটাকেই বেশি ভালো কাজ হোতো ব’লে মনে করতে শুরু করলো। তাকে সারাক্ষণই পেরেসানির মধ্যে রাখা হচ্ছে, এমনকি রাতের বেলায়ও। যেনো একজোড়া চোখ তাকে নিরীক্ষণ করছে, যেই মুহূর্তে সে একটু বিশ্রাম নেবে কিংবা দু’চোখে বন্ধ করবে ঘুমানের জন্যে অমনি শুরু করে দেয়।
“তুমি! পাহারা দাও গিয়ে! মেট খুব অসুস্থ। তুমি তার জায়গায় কাজ করবে।”
“ওঠো! ফিলিপ তার ডায়রি লিখছে! তাকে বিরক্ত করা যাবে না।”
“উঠে দাঁড়াও! আজকে বিকেলে তুমি একটা জাল ছিড়ে ফেলেছো। আমরা তোমার বোকামীর জন্যে কোনো ক্ষতি মেনে নেবো না। আমরা সবাই তা মনে করি। এক্ষুণি ওটা মেরামত করো!”
জালগুলো আর কি।
কোনো কাজে যদি দু’জন লোক লাগে তো সেই কাজটা তাকে একা একা করতে হয়। কোনো কিছু যদি দু’জনে মিলে তুলতে যায় তো সে থাকলে অন্য জন এমন অলসভাবে শক্তি প্রয়োগ না ক’রে কাজ করে যে, তাকে প্রায় পুরো বোঝাটাই একা সামলাতে হয়, নয়তো বা সেটা সামলাতে গিয়ে পড়ে যেতে হয়।
আর লামুশে। এক খোড়া শয়তান, যে কিনা প্রতি ইঞ্চি পানি থেকে মাছ ধরতে চায়। তার কণ্ঠটা ভাঙা, ফ্যাফ্যাসে, ফাঁটা বাঁশের মতোই পীড়াদায়ক। সবার নামের আগেই একটা অশ্লীল শব্দ ব্যবহার ক’রে ডাকে সে। এর ফলে স্মৃতিভ্রষ্ট লোকটা খুব দ্রুতই ক্ষেপে গেলো। তবে লামুশে ডাক্তার ওয়াশবার্নের এই রোগীটির গায়ে হাত তোলে নি।
তৃতীয় দিনের সূর্যাস্তের সময় লাশের পোর্ত নোয়ে’তে ফিরে আসার কথা। মাছগুলো নামানো হবে। পরের দিন সকাল চারটা পর্যন্ত ক্রুকে ঘুমানো, মদ খাওয়া অথবা যৌনসঙ্গম করার সুযোগ দেয়া হবে, ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে এই তিনটিই সে করতে পারবে। স্থলভাগের দেখা পাওয়া মাত্রই এটার বাস্তবায়ন শুরু হবে।
জালগুলো ভিজিয়ে ভাঁজ ক’রে রাখা হলো। নেটম্যান আর তার সহকারী এই কাজটা সেরে নিলো জাহাজেই। জ্যঁ পিয়েরে নামের নতুন যে ক্রুকে তারা ‘পরগাছা বলে গালি দেয় সে লম্বা হাতলওয়ালা একটা ব্রাশ নিয়ে ডেক পরিস্কার করছে আর বাকি দু’জন ক্রু সমুদ্র থেকে বালতিতে ক’রে পানি নিয়ে ফেলছে তার ব্রাশের সামনে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই পানি ডেকে না ফেলে পরগাছাটার উদ্দেশ্যেই ফেলা হচ্ছে যাতে সে পানিতে ভেসে যায়।
এক বালতি পানি এমনভাবে ফেলা হলো যে, ওয়াশবার্নের রোগীর চোখে-মুখে লেগে গেলো। কয়েক মুহূর্তের জন্যে কিছুই দেখতে পেলো না সে। ফলে ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো। ভারি ব্রাশটা ঘুরিয়ে সজোরে আঘাত হানা হলো নেটম্যানের ঊরুতে। ধাতব হাতলের কারণে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো সে।
“মার্দে আলোয়া!”
“দিসোলে,” চোখমুখ থেকে পানি ঝেড়ে ফেলে ক্ষিপ্ত লোকটি বললো।
“কি বললে!” চিৎকার ক’রে বললো নেটম্যান।
“আমি বলছি, আমি দুঃখিত,” জ্যঁ পিয়েরে নামের লোকটি জবাব দিলো। “তোমার বন্ধুদেরকে বলো আমার উপরে নয়, জাহাজের ডেকে পানি ফেলতে।”
“আমার বন্ধুরা আমার সাথে তো এরকম করে না।”
“আমার সাথে কিন্তু এইমাত্র করেছে।”
নেটম্যান ব্রাশটার হাতল ধরে সেটাকে বেয়নেটের মতো উঁচিয়ে ধরলো। “তুমি আমার সাথে লাগতে চাও, শালার পরগাছা?”
“ওটা আমাকে দিয়ে দাও।”
“আনন্দের সাথেই দিচ্ছি, শালার পরগাছা। এই যে!” নেটম্যান ব্রাশটা দিয়ে গুঁতো দিলে স্মৃতিভ্রষ্ট লোকটির শার্টের বোতাম গলে ব্রাশের আঁশ ঢুকে গেলো। হয় আগের সেই আঘাতের স্থানে লাগার জন্যে নয়তো বিগত তিন দিন ধরে নানান রকম হয়রানির শিকার হয়ে লোকটার একেবারে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে গেলো। তবে সে জানে না কেন। কেবল জানে তাকে এর সমুচিত জবাব দিতে হবে। আর জবাবটা যে এরকম হবে এটা সে নিজেও কল্পনা করতে পারে নি।
সে হাতলটা ডান হাতে ধরে লোকটার পেটে সজোরে গুঁতো মারলো। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝটকায় ব্রাশের লম্বা হাতলটা, যেটা এখন লাঠি বলেই মনে হচ্ছে, সেটা দিয়ে লোকটার বাম পায়ে এবং গলায় আঘাত ক’রে বসলো সে।
“তাও!” তার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবেই এই আর্তনাদটি বেরিয়ে এলো। সে জানে না এর মানে কি।
কোনো কিছু বোঝার আগেই সে তার ডান পা দিয়ে নেটম্যানের বাম কিডনি বরাবর একটা লাথি মেরে বসলো।
“সি-শা।” চাপা কণ্ঠে বললো সে।
নেটম্যান পিছু হটে গেলেও পরক্ষণেই পাল্টা আঘাত হানলো। তীব্র ব্যথায় আর ভয়ে সামনের দিকে ছুটে এলো সে। তার হাত দুটো বাঘের থাবার মতো লাগছে এখন। “শূয়োরের বাচ্চা!”
স্মৃতিভ্রষ্ট লোকটি একটু নিচু হয়ে ডান হাত দিয়ে নেটম্যানের বাম হাতের কব্জি ধরে সজোরে ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিকে মোচর দিলো। তারপর লোকটার পিঠে হাঁটু দিয়ে প্রচণ্ড শক্তিতে আঘাত করলে হুড়মুড় ক’রে জালের উপর গিয়ে পড়লো ফরাসি লোকটা। গানেলের সঙ্গে আঘাত লাগলো তার মাথায়।
“সি-সাহ!” আবারো অজ্ঞাত শব্দটি উচ্চারণ করলো সে।
পেছন দিক থেকে একজন ক্রু তার গলাটা চেপে ধরলে ডাক্তার ওয়াশবার্নের রোগী তার বাম হাতের মুঠি দিয়ে লোকটার জননেন্দ্রীয়তে আঘাত হানলো। তারপরই এক ঝটকায় সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটু মুড়ে ব’সে পড়ে আক্রমণকারীর বাহুটা ধরে বাম দিকে সজোরে মোচর মারলে লোকটা মেঝেতে ব’সে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে লোকটার মুখে প্রচণ্ড জোরে একটা লাথি মারলে সে ছিটকে গিয়ে পড়লো বড়সড় একটা পুলির মাঝখানে।
বাকি দু’জন লোক তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কিল-ঘুষি আর লাথি মারতে শুরু করলো। যদিও জাহাজের ক্যাপ্টেন বার বার তাদেরকে সতর্ক ক’রে দিচ্ছে।
“লো দোক্তুর! রাপেলোঁয়া লো দোক্তুর! ভা দোসমেন্দ!”
কিন্তু দৃশ্যটি দেখে ক্যাপ্টেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। রোগীটি এক লোকের কব্জি ধরে এক ঝটকায় উল্টো দিকে মোচড় দিয়ে ভয়ংকরভাবে সেটা ভেঙে ফেললো। তীব্র যন্ত্রণায় একটা গোঙানী দিলো লোকটা।
ওয়াশবার্নের রোগী নিজের দু’হাত হাতুড়ির মতো এক সঙ্গে ক’রে হাতভাঙা ক্রুকে এমন সজোরে আঘাত করলো যে, লোকটা ডেকের উপর আছড়ে পড়লো।
“কোয়া-সাহ্!” নিজের কথাটা নিজের কানেই প্রতিধ্বনিত হলো তার। চতুর্থ লোকটি পিছু হটে গিয়ে স্মৃতিভ্রষ্ট লোকটির দিকে চেয়ে দেখতে পেলো তার দিকেই তাকিয়ে আছে সে।
খেল খতম। লাশের তিনজন ক্রু অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, তারা যা করেছে তার জন্যে একটু বেশিই শাস্তি পেয়ে গেছে। ভোর চারটা বাজে ডকে নামার মতো কেউ থাকবে কিনা সে ব্যাপারে ঘোরতর সন্দেহ আছে।
লামুশের কথাবার্তায় বিস্ময় আর ক্ষোভের বহিপ্রকাশ দেখা গেলো। “তুমি কোত্থেকে এসেছো আমি জানি না। তবে তোমাকে এই ট্রলার থেকে নেমে যেতে হবে।”
স্মৃতিভ্রষ্ট লোকটি ক্যাপ্টেনের অবস্থা বুঝতে পারলো। আরে, আমিও তো জানি না আমি কোত্থেকে এসেছি।
.
“তুমি এখন আর এখানে থাকতে পারবে না,” অন্ধকার শোবার ঘরে ঢুকেই জিওফ্রে ওয়াশবার্ন বললেন। “আমি সত্যি বিশ্বাস করতাম আমি তোমার উপর যেকোনো মারাত্মক আক্রমণ প্রতিহত করতে পারবো। কিন্তু এখন এই ঘটনার পর আমি আর তোমাকে রক্ষা করতে পারবো ব’লে মনে হচ্ছে না।”
“ওরাই আমার সাথে ঝগড়া বাধিয়েছে।” আমাকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলো।”
“ঝগড়া না বলে বলো মারামারি। একটা ভাঙা হাত, কাঁটাছেঁড়া, মাথার খুলিতে আর মুখে এক লোকের সেলাইয়ের দরকার হয়েছে। মাথায় গুরুতর আঘাত আর কিডনিতে মারাত্মক ইনজুরি? বিচিতে সজোরে লাথি মারাটা বাদই দিলাম, নাকি? আমি বিশ্বাস করি শব্দটি হবে খুব বেশি বাড়াবাড়ি রকমের মারামারি।”
“আমি যদি কিছু না করতাম তবে নির্ঘাত খুন হতাম,” রোগীটি একটু থামলো। কিন্তু ডাক্তার কিছু বলার আগেই আবার সে বলতে লাগলো, “আমার মনে হচ্ছে আমাদেরকে কথা বলতে হবে। কয়েকটি ব্যাপার ঘটে গেছে। অন্য সব ভাষাও আমার মুখ দিয়ে বের হয়েছে। আমাদেরকে এ নিয়ে কথা বলতে হবে।”
“আমাদের কথা বলা উচিত, তবে আমরা বলতে পারছি না। সময় নেই। তোমাকে এক্ষুণি চলে যেতে হবে। আমি সব ব্যবস্থা ক’রে ফেলেছি।”
“এখনই?”
“হ্যা। আমি তাদেরকে বলেছি তুমি সম্ভবত মদ খেতে গ্রামে চলে গিয়েছো। ওদের পরিবারের লোকজন তোমাকে খুঁজবে। ভাই-বোন জামাই, চাচাতো-মামাতো ভাই, পরিবারের সক্ষম সবাই তোমাকে খুঁজবে। তারা যখন তোমাকে খুঁজে পাবে না, তখন তারা এখানে আসবে। তোমাকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত তারা থামবে না।”
“এমন একটা লড়াইয়ের জন্যে যেটা আমি শুরু করি নি?”
“না, সেটা নয়। এর কারণ তুমি তিনজন মানুষকে এমনভাবে মেরেছো যে, তারা একমাস পর্যন্ত কোনো কাজই করতে পারবে না। আরেকটা কারণও আছে, যা সীমাহীনভাবেই গুরুত্বপূর্ণ।”
“সেটা কি?”
“অপমান। এই পোর্ত নোয়ে’তে একজন বহিরাগত তিনজন সম্মানিত জেলেকে ধরাশায়ী করেছে। এটা খুবই অপমানজনক।”
“সম্মানিত?”
“শারীরিক দৃষ্টিকোণ থেকে। লামুশের ক্রুরা এই ওয়াটারফ্রন্টে সবচাইতে জাঁদরেল লোক হিসেবে পরিচিত। এখানে সবল লোকদেরকে সম্মানিত লোক হিসেবেই মনে করা হয়।
“এটা তো হাস্যকর।”
“তাদের কাছে নয়। এটা তাদের সম্মান…এবার তাড়াতাড়ি করো। নিজের জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নাও। মার্সেই থেকে একটা ট্রলার এসেছে। ক্যাপ্টেন তোমাকে নিতে রাজি হয়েছে। সে তোমাকে লা সিওতাতের উপকূল থেকে আধ মাইল দূরে নামিয়ে দেবে
স্মৃতিভ্রষ্ট লোকটি নিজের নিঃশ্বাস বন্ধ ক’রে রাখলো। “তাহলে যেতেই হবে,” আস্তে ক’রে বললো সে।
“যেতেই হবে,” ওয়াশবার্ন জবাব দিলেন। “আমি জানি তুমি কি ভাবছো। নিজেকে খুব অসহায় মনে করছো। চাকা ছাড়া গাড়ি চালানোর মতো আর কি আমি ছিলাম তোমার ঢাকা। কিন্তু আমি তোমার সাথে থাকতে পারছি না। এ ব্যাপারে আমি কিছুই করতে পারবো না। কিন্তু আমার কথা বিশ্বাস করো, আমি যখন বলছি তুমি অসহায় নও, তখন তুমি জানবে আসলেই তুমি অসহায় নও। তুমি তোমার পথ খুঁজে নিতে পারবে।”
“জুরিখে,” রোগীটি বললো।
“হ্যা, জুরিখে,” ডাক্তারও একমত হলেন। “এখানে, এই সব জামাকাপড়ের মধ্যে আমি তোমার জন্যে কিছু জিনিস রেখেছি। এটা তোমার কোমরে জড়িয়ে নাও।”
“কি জিনিস?”
“আমার সমস্ত টাকা-পয়সা। দু’হাজার ফ্রাঁ’র মতো হবে। খুব বেশি নয়। তবে শুরু করার জন্যে তোমার সাহায্যে লাগবে। আর আমার পাসপোর্ট, এটা দিয়ে যা পারো কোরো। আমাদের দু’জনের বয়স প্রায় একই, আর এটা আট বছর আগেরকার। সবার চেহারাই বদলায়। কাউকে এটা বেশি ভালোভাবে নিরীক্ষণ করতে দিও না। এটা একেবারেই অফিশিয়াল কাগজপত্র।”
“আপনি কি করবেন?”
“তোমার কাছ থেকে কোনো সংবাদ না পেলে বা তোমার দেখা না পেলে এটা আমার কোনো দরকার হবে না।”
“আপনি খুবই ভালো একজন মানুষ।
“আমার মনে হয় তুমিও তাই…যেমনটি তোমাকে জেনেছি আমি। কিন্তু তারপরও বলতে হয়, তোমাকে আমি আগে থেকে চিনতাম না। তাই আমি তোমার জন্যে কোনো প্রতীজ্ঞা করতে পারছি না। আমার ইচ্ছে হচ্ছে করতে, কিন্তু সেরকম কিছু করার কোনো সুযোগ আমার নেই।”
.
লোকটা রেলিংয়ে ঝুঁকে ক্রমশ অপসৃয়মান পোর্ত নোয়ে’র দৃশ্য দেখতে লাগলো দূর থেকে। মাছ ধরার ট্রলারটা অন্ধকারের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছে। আর আজ থেকে প্রায় পাঁচ মাস আগে সে এই অন্ধকারে অনুপ্রবেশ করেছিলো।
যেমনটি এখন আবার আরেক অন্ধকারে প্রবেশ করছে সে।