অধ্যায় ১৬
নিরবতাটি ঠিক পাঁচ সেকেন্ড ক্ষণস্থায়ী হলো, সেই সময়ে চোখগুলো ঘুরে বেড়ালো একে অন্যের উপর। কয়েকজন গলা খাকারি দিলো, কিন্তু কেউ চেয়ার থেকে নড়লো না। এটা এমন, যেনো কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। টেনিসির পাহাড় থেকে নেমে আসা কংগ্রেসম্যান এফরেম ওয়াল্টার্সকে খুব সহজে এড়িয়ে যাওয়া গেলো না। আজেবাজে জিনিসগুলো বেরিয়ে পড়লো ঠিকই।
তার পাইপটা টেবিলে নামিয়ে রাখলো ডেভিড অ্যাবোট। “কেইনের মতো লোক সম্পর্কে জনগণ যতো কম জানবে আমাদের ততোই মঙ্গল।”
“এটা তো আমার প্রশ্নের জবাব হলো না,” ওয়াল্টার্স বললো। “তবে আমি ধারণা করছি এটা কেবল প্রশ্নের উত্তরটার শুরু।”
“সেটাই। সে একজন পেশাদার গুপ্তঘাতক—খুবই প্রশিক্ষিত—জীবনসংহার করার পদ্ধতি জানা একজন বিশেষজ্ঞ। এই অভিজ্ঞতা আর বিশেষ জ্ঞানটি বিক্রির জন্যে; কোনো রাজনৈতিক অথবা ব্যক্তিগত অনুরক্ত নিয়ে মাথা ঘামায় না সে। তার একমাত্র কাজ হলো মুনাফা করা—আর তার মুনাফা সরাসরি তার সুনামের সাথে আনুপাতিক হারে বাড়ে।”
কংগ্রেসম্যান মাথা নেড়ে সায় দিলো। “তাহলে এই সুনামটি চেপে রেখে আপনারা মুক্ত প্রচার আর বিজ্ঞাপনকে রোধ ক’রে রেখেছেন।”
“ঠিক। পৃথিবীতে অনেক ম্যানিয়াক আছে যাদের সত্যিকার অথবা কল্পিত শত্ৰু রয়েছে, তারা যদি তার সম্পর্কে জানতে পারে তবে খুব সহজেই কেইনের দ্বারস্থ হবে। দুর্ভাগ্যবশত, সেটা হয়েও গেছে। আজ পর্যন্ত সরাসরি আটত্রিশটি খুন করেছে কেইন, আর বারো থেকে পনেরোটির ব্যাপারে তাকে সন্দেহ করা হয়।”
“এটা হলো তার ‘কর্ম সম্পাদনের’ তালিকা?”
“হ্যা। আর আমরা যুদ্ধে হেরে যাচ্ছি। প্রত্যেকটি নতুন খুন তার সুনামকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।”
“কিছুদিনের জন্যে লুকিয়ে ছিলো সে। একেবারে নিষ্প্রভ ছিলো,” সিআইএ’র নোলটন বললো। “তখন আমরা ভেবেছি সে বুঝি মারাই গেছে। খুনিরা অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যাও ক’রে থাকে। ভেবেছিলাম সে হয়তো তাই করেছে।”
“যেমন?” ওয়াল্টার্স জানতে চাইলো।
“মাদ্রিদের একজন ব্যাংকার যে আফ্রিকায় সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত কাজে ইউরোপোলিটান কর্পোরেশনের পক্ষে ঘুষের টাকা দিতো, তাকে পসিয়ো দ্য লা কাস্তেলানা’য় এক চলন্ত গাড়ি থেকে গুলি করা হয়। এক ড্রাইভার কাম দেহরক্ষী তাকে এবং খুনি, উভয়কেই গুলি ক’রে হত্যা করে। কিছুদিন আমরা বিশ্বাস করেছিলাম খুনটা কেইন করেছে।”
“ঘটনাটা আমার মনে আছে। এর জন্যে কে টাকা দিয়েছিলো?”
“যেকোনো কোম্পানি হতে পারে,” জিলেট জবাব দিলো। “যারা গোল্ডপ্লেটেড গাড়ি আর ইনডোর সরঞ্জাম স্বৈরাচারদের কাছে বিক্রি করতে চায়।”
“আর কি? আর কারা?”
“ওমানের শেখ মুস্তাফা কালিগ,” কর্নেল ম্যানিং বললো। “সে একটা ব্যর্থ ক্যু’য়ে নিহত হয়।”
“তা নয়,” অফিসার বললো। “কোনো ক্যু প্রচেষ্টা ছিলো না, জি-টু ইনফর্মাররা সেটা নিশ্চিত করেছে। কালিগ মোটেও জনপ্রিয় ছিলো না, তবে অন্য শেখেরা বোকা নয়। ক্যু’য়ের গল্পটা আসলে গুপ্তহত্যাকে আড়াল করার জন্যে বলা হয়েছে, যা অন্য পেশাদার খুনিদেরকে প্রলুব্ধ করেছে। এজন্যে তিনজন ছোটোখাটো অফিসারকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। কিছুদিন আমরা ভেবেছি তাদের একজন ছিলো কেইন। ঐসময়ে কেইনের সাথে সব রকম যোগাযোগ বন্ধ ছিলো।”
“কালিগকে খুন করার জন্যে কে টাকা দিয়েছিলো?”
“এটা আমরা নিজেদেরকে অসংখ্যবার জিজ্ঞেস করেছি,” বললো ম্যানিং। “একমাত্র যে সম্ভাব্য জবাবটা এসেছে সেটা অবশ্য এক সোর্সের দাবি, তবে সেটা খতিয়ে দেখার কোনো উপায় ছিলো না। সে বলেছে কেইন এটা করেছে, এটা প্রমাণ করার জন্যে যে, এরকম একটা কাজ সে করতে পারে। মনে রাখবেন, তেল ব্যবসায়ী শেখেরা খুব কড়া নিরাপত্তা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।”
“আরো কয়েক ডজন ঘটনা আছে,” নোলটন জানালো। “সেগুলোও ঐ একই রকম, খুবই সুরক্ষিত ব্যক্তিবর্গ খুন হয় আর সোর্স আগ বাড়িয়ে জানায় যে, কাজটা কেইন করেছে।’
“আচ্ছা,” কংগ্রেসম্যান জুরিখের রিপোর্টটা হাতে তুলে নিলো। “তবে আমার কাছে যা আছে তাতে বোঝা যাচ্ছে আপনারা জানেন না সে কে?”
“না, দুটো বর্ণনা একই রকম,” বাঁধা দিয়ে বললো সন্ন্যাসী। “বোঝা যাচ্ছে কেইন ছদ্মবেশ নিতে খুব দক্ষ। এ বিষয়ে তার প্রতিভা রয়েছে।”
“তারপরও লোকে তাকে দেখেছে, কথা বলেছে। আপনার জুরিখের সোস, সে তো তার ব্যাপারে কিছু বলছে না। তবে আপনি তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন। কিছু একটা তো নিশ্চিতে ক’রে জানতেই হবে।”
“আমাদের কাছে প্রচুর তথ্য রয়েছে,” সন্ন্যাসী জবাব দিলো। “তবে বর্ণনার ধারাবাহিকতা তাতে নেই। কেইন কখনও নিজেকে দিনের আলোয় প্রদর্শন করে না। সে রাতের বেলায় মিটিং করে। অন্ধকার ঘরে অথবা সংকীর্ণ কোনো গলিতে। সে কখনও একের অধিক ব্যক্তির সাথে একই সময়ে দেখা করেছে ব’লে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। আমাদেরকে বলা হয়েছে সে কখনও দাঁড়ানো অবস্থায় থাকে না, সব সময়ই ব’সে থাকে—কোনো স্বল্প আলোর রেস্তোরাঁয়, অথবা পার্ক করা গাড়িতে। কখনও সে কালো সানগ্লাস ব্যবহার করে। কখনও কোনো কিছুই না। একবার তাকে দেখা গেছে কালো চুলে। আরেকবার সাদা, লাল অথবা মাথায় টুপি পরা অবস্থায়।”
“ভাষা?”
“এখানে আমরা একটু বেশি নিশ্চিত,” সিআইএ’র ডিরেক্টর বললো। “ইংরেজি এবং ফরাসিতে অনর্গল বলতে পারে, এছাড়াও কয়েকটি প্রাচ্যদেশীয় ভাষা সে জানে।”
“কোন্ কোন্ ভাষা?”
“যেমন ভিয়েতনামী?”
“ভিয়েত—” ওয়াল্টার একটু সামনে ঝুঁকে এসে বললো। “আমার কেন মনে হচ্ছে আমি এমন কিছু জানেত চাই যা আপনি আমাকে বলতে চাচ্ছেন না?”
“এর কারণ, আপনি হয়তো ক্রশ এক্সামিনের ব্যাপারে খুব বেশি স্মার্ট, কাউন্সেলার।” অ্যাবোট নিজের পাইপটা দেয়াশলাই দিয়ে ধরিয়ে বললো।
“সম্ভবত বেশি সতর্ক,” কংগ্রেসম্যান একমত হয়ে বললো। “এবার বলুন সেটা কি?”
“কেইন,” বললো জিলেট। তার চোখ অনেকটা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই ডেভিড এ্যাবোটের দিকে ঘুরলো। “সে কোত্থেকে এসেছে তা আমরা জানি।”
“কোত্থেকে?”
“দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে,” ম্যানিং জবাব দিলো। যেনো ধারালো কোনো ছুরি দিয়ে তাকে আঘাত করা হয়েছে এমন ভঙ্গী করলো সে। “আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, তাতে মনে হচ্ছে সে কম্বোডিয়া আর লাওসের সীমান্ত এলাকার কোনো পার্বত্য অঞ্চলের লোক। সেটা ভিয়েতনামের গ্রামীণ এলাকাও বটে। আমরা এই তথ্যটা মেনে নিয়েছি। এটা খাপ খেয়ে যায়।”
“কোনটার সাথে?”
“অপারেশন মেডুসার সাথে,” কর্নেল তার পাশ থেকে একটা ম্যানিলা এনভেলপ হাতে তুলে নিয়ে সামনে রাখলো। “এটা হলো কেইনের ফাইল,” মাথা নেড়ে ইনভেলপটার দিকে চেয়ে বললো সে। “এটা মেডুসা সংক্রান্ত কাগজপত্র। এটার সাথে কেইনের সম্পর্ক আছে।”
টেনিসির লোকটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বাঁকা হাসি হাসলো। “আপনারা জানেন, আপনারা আপনাদের বড় বড় টাইটেল দিয়ে আমাকে জবাই করছেন। ঘটনাচক্রে এটা খুবই দারুণ; এটা খুবই জঘন্য, খুবই অশুভ। আমার মনে হয়, আপনারা এরকম কোনো কোর্সে ভীতি হলেই ভালো হয়। বলে যান কর্নেল। মেডুসা জিনিসটা কি?”
ম্যানিং ডেভিডন অ্যাবোটের দিকে চেয়ে বললো, “এটা সার্চ এ্যান্ড ডেস্ট্রয় মতবাদের একটি গোপন বিষয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষের ভেতরে ঢুকে কাজ করার উদ্দেশ্যে এটা ডিজাইন করা হয়েছিলো। ষাটের শেষ আর সত্তর দশকের শুরুতে আমেরিকান, ফ্রেঞ্চ, বৃটিশ, অস্ট্রেলিয়ান এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীদেরকে নিয়ে এ দলটি গঠন করা হয় উত্তর ভিয়েতনামের দখলকৃত এলাকায় অপারেশন চালানোর জন্যে। তাদের প্রধান কাজ ছিলো শত্রুপক্ষের যোগাযোগ ব্যবস্থা আর সরবরাহ লাইন ধ্বংস করা, বন্দীশিবিরগুলো চিহ্নিত করা এবং কমিউনিস্টদের সঙ্গে সহযোগীতা করছে এরকম গ্রামীণ নেতাদেরকে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে শেষ ক’রে ফেলা। সম্ভব হলে শত্রুপক্ষের কমান্ডারদেরকেও।”
“এটা হলো যুদ্ধের ভেতর যুদ্ধ,” নোলটন বললো। “দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো জাতিগত, বাহ্যিক বেশভূষা আর ভাষার বিভিন্নতার ফলে তাদের সমন্বয় করাটা দুরূহ হয়ে ওঠে। সেখানে ছিলো জার্মান, ডাচ আন্ডারগ্রাউন্ড, কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসি প্রতিরোধ যোদ্ধারা। সেজন্যে পশ্চিম ইউরোপের নিয়োগগুলোর বেলায় সবসময় যেরকমটি বাছবিচার করার কথা ছিলো তেমনটি হয় নি।”
“সেখানে এরকম কয়েক ডজন টিম ছিলো,” কর্নেল আবার বলতে শুরু করলো। “তবে একমাত্র আশা ছিলো আমেরিকার জয়লাভ। ওখানে অস্ট্রেলিয়ান এবং বৃটিশ ভবঘুরে ছিলো যারা অনেক বছর ধরে বসবাস ক’রে আসছিলো, আরো ছিলো খুবই মটিভেটেড আমেরিকান সৈনিক আর সিভিলিয়ান ইন্টেলিজেন্স ক্যারিয়ার অফিসার। এবং অবধারিতভাবেই বড়সড় অপরাধীদের একটি চক্র। নেতৃত্বে ছিলো চোরাকারবারিরা সমগ্র দক্ষিণ চায়না সাগর এলাকা জুড়ে তারা অস্ত্র, মাদক, স্বর্ন আর হীরা-পাচার করতো। তারা রাতের বেলায় আর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলাফেরা করতো। আমাদের অনেক রিক্রুট করা কর্মী ছিলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে পালিয়ে আসা দাগী আসামী। তাদের মধ্যে অনেকে উচ্চশিক্ষিতও ছিলো। এ সবই বেশ কার্যকরী ছিলো। তাদের অভিজ্ঞতার দরকার ছিলো আমাদের।”
“এটা ছিলো স্বেচ্ছাসেবীদের একটা অংশ,” কংগ্রেসম্যান বললো। “পুরনো লাইনের নেভি আর আর্মি; বৃটিশ এবং অস্ট্রেলিয়ান ভবঘুরের দল, ফরাসি ঔপনিবেশিক এবং চোর বাটপারের দল। আপনারা তাদেরকে এক সঙ্গে কাজ করাতে পারলেন কিভাবে?”
“প্রত্যেককে লোভ দেখিয়ে,” জিলেট বললো।
“প্রতিশ্রুতি,” কর্নেল বেশ জোরে বললো কথাটা। “র্যাংকের নিশ্চয়তা, পদোন্নতি, ক্ষমত্রা। একেবারে নগদ বোনাস, আর কয়েকটি ক্ষেত্রে বিরোধীদের কাছ থেকে চুরি করা তহবিল হাতিয়ে নেবার সুযোগ। বুঝলেন, তারা সবাই একেবারে পাগল হয়ে গেলো। আমরাও সেটা বুঝি। তাদেরকে গোপনে প্রশিক্ষণ দিলাম, কোড ব্যবহার করা, বিভিন্ন ধরণের পরিবহন ব্যবহার করতে শেখা, ফাঁদ পাতা আর খুনের পদ্ধতিগুলোও শেখানো হলে—এমনকি সায়গনের উইপেন কমান্ড এ সম্পর্কে কিছুই জানতো না। পিটার যেমনটি বলেছেন, ঝুঁকিটা ছিলো অবিশ্বাস্য—–ধরা পড়লে অত্যাচার, নির্যাতন আর হত্যা। মূল্যটা ছিলো খুব চড়া আর তারা সেটা চুকিয়েছেও। বেশিরভাগ লোক তাদেরকে মানসিকভাবে অসুস্থ হিসেবেই ভাবতো। তবে তারা খুবই প্রতিভাবান ছিলো। অস্থিরতা তৈরি করা আর খুন-খারাবি ছিলো তাদের প্রধান দায়িত্ব। বিশেষ ক’রে গুপ্তহত্যা।”
“মূল্যটা কি ছিলো?”
“অপারেশন মেডুসা নব্বই পার্সেন্ট হতাহতের করুণ পরিণতি বরণ করে। তবে যারা আর কখনও ফিরে আসে নি তাদেরকেও ধরা হয়েছিলো এরমধ্যে।”
“ঐসব চোরবাটপার আর ফেরারীদের অংশটা?”
“হ্যা। মেডুসা থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা চুরি করে কেউ কেউ। আমরা মনে করি কেইন ছিলো তাদের মধ্যে একজন।”
“কেন?”
“তার মোদাস ওপারেন্দি, মানে পদ্ধতিটা। সে খুনের কাজে যেরকম কোড, ফাঁদ, পদ্ধতি ব্যবহার করেছে সেগুলো আমরা মেডুসায় তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ছিলাম।”
“হায় ঈশ্বর! তাহলে তো আপনরা তার পরিচয়টা জানেন,” ওয়াল্টার্স বললো। “সেগুলো কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে সেটা আমি পরোয়া করি না—আর আমি এও নিশ্চিত আপনারা চান না তাদের ব্যাপারটা জনসম্মুখে জানাজানি হোক, তবে আমার ধারণা তাদের সম্পর্কে সব কিছুই রেকর্ড করা আছে।”
“তা আছে, তবে আমরা সেগুলো গোপন অর্কাইভ থেকে সরিয়ে ফেলেছি। তার মধ্যে এটাও আছে।” অফিসার তার সামনের ফাইলটার টোকা মারলো। “আমরা তথ্যগুলো কম্পিউটারে ঢুকিয়ে সব কিছু খতিয়ে দেখেছি, একেবারে মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে—যতোটুকু সম্ভব দেখেছি। তবে শুরুতে যা বলেছি তার চেয়ে বেশি আমরা কিছু পাই নি।”
“এটা তো অবিশ্বাস্য,” কংগ্রেসম্যান বললো। “অথবা বলা যায় অবিশ্বাস্যরকমের অযোগ্যতা।”
“ঠিক তা নয়,” দ্বিমত পোষণ ক’রে বললো ম্যানিং। “লোকটার দিকে তাকান। আমরা তার সাথে কি কাজ করেছি ভাবুন। যুদ্ধের পর পূর্ব-এশিয়া জুড়ে কেইনের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে; টোকিও থেকে ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং কম্বোডিয়া, লাওস এবং কলকাতা। আমাদের এশিয়ান স্টেশন আর অ্যাম্বাসিতে আড়াই বছর আগে থেকে খবর আসতে শুরু করে একজন মারাত্মক নির্মম গুপ্তঘাতক আছে। ভাড়ায় খুন করে সে। যতো বড়সড় খুন হয় তাতে কেইনের নাম জড়িয়ে পড়ে। সোর্সরা সব সময় খবর দিতো কেইনের ব্যাপারে। কেইন। কেইন আর কেইন। টোকিতে একটা হত্যা, হংকংয়ে গাড়িবোমা; মাদকদ্রব্য বোঝাই কারাভান গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গালে অ্যাম্বুসের শিকার হয় তো কলকাতায় এক ব্যাংকার গুলিবিদ্ধ হয়। মউলমেইনে একজন অ্যাম্বাসেডরের খুন, সাংহাইর পথে রাশিয়ান টেকনিশিয়ান অথবা আমেরিকান ব্যবসায়ীর খুন। সর্বত্রই কেইন। সব গোয়েন্দা সংস্থায় তার নাম উচ্চারিত হতে লাগলো। তারপরেও সমগ্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একজন লোকও তাকে চেনে বা তার পরিচয় জানে ব’লে দাবি করতে এগিয়ে এলো না। আমরা কোত্থেকে শুরু করবো?”
“কিন্তু আপনিই না বললেন, সে মেডুসার সাথে ছিলো?” টেনেসির লোকটা বললো।
“হ্যা, অবশ্যই।”
“তাহলে মেডুসার ডোসিয়ারেই তো তার সম্পর্কে তথ্য রয়েছে!”
কেইনের ফাইলটা ফোল্ডার থেকে বের করলো কর্নেল। “এ হলো হতাহতের তালিকা। শ্বেতাঙ্গ পশ্চিম ইউরোপিয়ানদের তালিকা, যারা অপারেশন মেডুসায় উধাও হয়ে গিয়েছিলো—আর আমি যখন বলবো উধাও হয়ে গেছে, বুঝতে হবে তারা কোনোরকম চিহ্ন না রেখেই অদৃশ্য হয়ে গেছে—এই নিন। তিয়াত্তর জন আমেরিকান, ছেচল্লিশজন ফরাসি, চব্বিশজন অস্ট্রেলিয়ান আর বৃটিশ, এবং আরো পঞ্চাশজন শ্বেতাঙ্গ, যাদেরকে হ্যানয় থেকে রিক্রুট ক’রে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিলো—তাদের বেশির ভাগকেই আমরা চিনি না। দুশ’ ত্রিশ জনের মতো লোক। কতোগুলো অন্ধ গলি? কে বেঁচে আছে? কে মরেছে? এমনকি বেঁচে যাওয়া প্রত্যেকের ব্যাপারে যদি আমরা জানতামও তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায়, সে এখন কোথায় আছে? সে কে? আমরা এমনকি কেইনের জাতীয়তার ব্যাপারেও নিশ্চিত নই। আমরা মনে করি সে আমেরিকান। তবে আমাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই।”
“এমআইএ-দের খুঁজে বের করার ব্যাপারে হ্যানয়কে আমরা যে তাড়া দিয়েছিলাম তাতে কেইনের ব্যাপারটা একটা সাইড ইসু ছিলো,” নোলটন জানালো। “আমরা এইসব নাম ডিভিশনের তালিকায় রেখেছি।
“এখানেও একটা ঘটনা আছে,” আর্মি অফিসার যোগ করলো। “হ্যানয়ের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বাহিনী অনেক মেডুসা সদস্যকে হত্যা করেছিলো। তারা এই অপারেশনের ব্যাপারটা জানতো। আর আমাদের মধ্যে তাদের অনুপ্রবেশের সম্ভাবনাটা একদম বাতিল ক’রে দিতে পারি না। হ্যানয় জানতো মেডসার সদস্যরা কোনো কমব্যাট বাহিনী নয়। তারা কোনো ইউনিফর্ম পরে না। তাই তাদেরকে হত্যা করলে জবাবদিহিতাও করতে হবে না।”
ওয়াল্টার্স হাত বাড়িয়ে বললো, “আমি কি দেখতে পারি?” ফাইলটার দিকে ইশারা করলো সে।
“নিশ্চয়!” অফিসার কংগ্রেসম্যানকে সেটা দিয়ে দিলো। “আপনি অবশ্যই বোঝেন, এই নামগুলো খুবই গোপনীয়, ঠিক মেডুসা অপারেশনটার মতোই।”
“এই সিদ্ধান্তটি কে নিয়েছিলো?”
“জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের রেকমেন্ডশনের উপর ভিত্তি ক’রে পরপর কয়েকজন প্রেসিডেন্ট এই নির্বাহী আদেশটি বহাল রেখেছিলেন। এটা সিনেটের আর্মি সার্ভিস কমিটি কর্তৃকও সমর্থিত হয়েছিলো।”
“তাহলে তো এটাকে ফায়ার পাওয়ার বলা যেতে পারে, পারে না?”
“এটা আমাদের জাতীয় স্বার্থের পক্ষে যাবে ব’লে মনে করা হয়েছিলো, “ সিআইএ’র লোকটা বললো।
“এক্ষেত্রে আর্মি কোনো প্রশ্ন তুলবো না,” ওয়াল্টার্স একমত পোষণ করলো। “তবে আমরা তো কোনো গুপ্তঘাতককে প্রশিক্ষণ দেই না। অথচ এখানে দেখতে পাচ্ছি একজন খুনিকে প্রশিক্ষিত ক’রে মাঠে ছেড়ে দিয়ে আমরা আর তাকে খুঁজে পাচ্ছি না।”
“আমরা সেটা বিশ্বাস করি,” বললো কর্নেল।
“আপনি বলেছেন সে এশিয়াতে তার সুনাম প্রতিষ্ঠা করেছে, তবে পরে ইউরোপে চলে এসেছে। কখন?”
“প্রায় একবছর আগে।”
“কেন? কোনো ধারণা আছে?”
“অবশ্যই,” পিটার- নোলটন বললো। “অনেক বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। কিছু একটা ভুল হয়ে গেছে আর সে খুব নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। হুমকী বোধ করেছে। প্রাচ্যদেশীয় লোকেদের মাঝে একজন শ্বেতাঙ্গ খুনি, খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার। সেজন্যে সে ইউরোপে চলে এসেছে। ঈশ্বর জানে, তার সুনাম বেশ ছড়িয়েছে। ইউরোপে তার কাজের কোনো অভাব হবে না।”
ডেভিড অ্যাবোট গলাটা খাকারি দিয়ে পরিস্কার ক’রে নিলো। “কিছুক্ষণ আগে বলা আলফ্রেডের কথার সূত্র ধরে আমি আরেকটা সম্ভাবনার কথা বলতে পারি।” অ্যাবোট একটু থেমে জিলেটের দিকে তাকালো। “তিনি বলেছিলেন আমরা দত্তবিহীন হাঙরের পিছু নিতে বাধ্য হয়েছি, যেখানে কিনা ‘হিংস্র হাঙরটা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে,’ আমি বিশ্বাস করি এটাই হলো আসল কথা, যদিও আমার ধারণাটা ভুলও হতে পারে।”
“হ্যা,” এনএসসি’র লোকটা বললো। “আমি কার্লোসের কথাই বুঝিয়েছিলাম। কেইনের পেছনে ছোটা আমাদের উচিত হবে না। আমাদের মাথা ঘামাতে হবে কার্লোসকে নিয়ে।”
“অবশ্যই। কার্লোস। আধুনিক ইতিহাসে সবচাইতে পরাক্রমশালী খুনি। সে আমাদের সময়কালে অসংখ্য এবং বড় বড় ট্র্যাজিক হত্যার নায়ক। আপনি ঠিকই বলেছেন, আলফ্রেড। কার্লোসকে আমরা ভুলে যেতে পারি না।”
“ধন্যবাদ,” বললো জিলেট। “বক্তব্যটা বোঝাতে পেরেছি বলে আমি খুশি।”
“তা পেরেছেন। তবে আপনি আমাকে ভাবিয়েছেনও। আপনার কথা শুনে আমার একটা কথা মনে হলো। কেইনের মতো মানুষের জন্যে প্রলুব্ধের ব্যাপারটা কি কল্পনা করতে পারেন, যে কিনা একটা ভয়ংকর জায়গাতে, আবদ্ধ পরিবেশে ভবঘুরে আর ফেরারীদের সাথে দুনীর্তিবাজ সরকারের হয়ে কাজ করেছে? সে কার্লোসকে অবশ্যই ঈর্ষা করবে। সে দ্রুতগতির, উজ্জ্বল আর লাক্সারি ইউরোপকেও হিংসা করবে। সে নিজেকে না জানি কতোবার বলেছে ‘আমি কার্লোসের চেয়ে সেরা।’ এইসব লোকের খুব অহংবোধ থাকে। আমার ধারণা সে ইউরোপে গেছে ভালো আর আরামদায়ক এক দুনিয়ার খোঁজে…এবং অবশ্যই কার্লোসকে উৎখাত করতে। যাদের টাইটেল নেই তারা টাইটেলটা পেতে চায়, স্যার। সে চ্যাম্পিয়ন হতে চায়।”
জিলেট অ্যাবোটের দিকে চেয়ে রইলো। “তত্ত্বটা কৌতুহলোদ্দীপক।”
“তাহলে আপনার কথার সূত্র ধরেই বলছি,” কংগ্রেসম্যান বললো। “কেইনকে অনুসরণ ক’রে আমরা কার্লোস পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবো।”
“ঠিক।”
“ব্যাপারটা বুঝেছি কিনা সেব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই,” একটু উদ্বিগ্ন আর বিরক্ত হয়ে বললো সিআইএ’র ডিরেক্টর। “কেন?”
“এক ঢিলে দুটো পাখি মারা,” ওয়াল্টার্স জবাব দিলো। “তারা একে অন্যের সাথে জড়িয়ে আছে।”
“একজন চ্যাম্পিয়ন স্বেচ্ছায় তার শিরোপা ছেড়ে দেবে না,” অ্যাবোট পাইপটা তুলে নিয়ে বললো। “সে নিজের অবস্থান ধরে রাখার জন্যে প্রাণপণে লড়বে। কংগ্রেসম্যান যেমনটি বলেছেন, আমরা কেইনকে খোঁজা অব্যাহত রাখবো। তবে আমাদেরকে বনের অন্য প্রাণীদের দিকেও তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। আর আমরা যদি কেইনকে খুঁজে পাই, তখন হয়তো আমরা লাগাম টেনে ধরবো। অপেক্ষা করবো তার পিছু পিছু কার্লোসের আসার জন্যে।”
“তখন দু’জনকেই কব্জায় নেয়া যাবে,” মিলিটারি অফিসার বললো।
“খুবই বুদ্ধিদীপ্ত,” বললো জিলেট।
.
মিটিংটা শেষ হয়ে গেলে সবাই চলে গেলো। কিন্তু সন্ন্যাসী হিসেবে পরিচিত ডেভিড অ্যাবোট দাঁড়িয়ে থাকলো পেন্টাগনের কর্নেলের পাশে, যেকিনা মেডুসার কাগজপত্রগুলো ফোল্ডারে ভরে নিচ্ছে। হতাহতের তালিকাটা যখন ঢোকাতে যাবে সে অ্যাবোট তখন তাকে বললো।
“আমি কি একটু দেখতে পারি? আমাদের কাছে কোনো কপি নেই।”
“এগুলো আমাদের ইন্সট্রাকশন,” কাগজটা বৃদ্ধের হাত দিয়ে অফিসার জবাব দিলো। “আমি ভেবেছিলাম এগুলো আপনাদের কাছ থেকেই এসেছে। মাত্র তিনটি কপি আছে। এখানে, এজেন্সিতে এবং কাউন্সিলে।”
“এগুলো আমার কাছ থেকেই এসেছে,” অ্যাবোট নিরবে হাসলো। “শহরের যে অংশে আমি থাকি সেখানে অনেক বেশি সিভিলিয়ান থাকে।”
টেনিসির কংগ্রেসম্যানের প্রশ্নের জবাবটা না শুনেই কর্নেল ঘুরে তালিকার নামগুলোর দিকে নজর বোলাতে বোলাতে চলে গেলো। একটা নাম বাদ দেয়া হয়েছে দেখে সে চমকে উঠলো। একটা নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। জবাবদিহিতা হলো এমন একটা জিনিস যা তারা করে না। কখন। কোথায় সেটা? এই ঘরে সেই হলো একমাত্র লোক যে নামটা জানে। শেষ পৃষ্ঠায় যেতেই সে নিজের হৃদস্পন্দনটার শব্দ শুনতে পেলো। নামটা আছে এখানে।
বর্ন, জেসন সি— শেষ স্টেশন : তাম কুয়ান। আরে, এসব কি?
.
রেনে বারগোঁয়া তার ডেস্কের ফোনটা আছাড় দিয়ে রেখে দিলো। “সবগুলো ক্যাফেতেই আমরা চেষ্টা করেছি, সে যেসব রেস্তোরাঁয় যায় সেখানেও!”
“প্যারিসে এমন কোনো হোটেল নেই যেখানে সে রেজিস্টার করেছে,” সুইচবোর্ডের ধূসর চুলের লোকটা বললো। পাশেই আরেকটা ফোন নিয়ে ব’সে আছে সে। “দুই ঘণ্টা হয়ে গেছে, এরমধ্যে হয়তো সে মরেই গেছে। যদি সে মরে গিয়ে না থাকে তো তার এখন ইচ্ছে করছে সে যেনো মরে যায়।”
“সে তাকে খুব বেশি কিছু বলতে পারবে না,” বারগোঁয়া বললো। “আমাদের চেয়েও কম বলতে পারবে। বুড়ো লোকটার ব্যাপারে সে কিছুই জানে না।”
“সে যথেষ্ট জানে। পার্ক মশিউতে ফোন করেছিলো।”
“সে কেবল মেসেজটা রিলে করেছে। নিশ্চিত ক’রে জানতো না কার কাছে সেটা দিচ্ছে।”
“কিন্তু সে জানে কেন দিচ্ছে।”
“কেইনও তা জানে। আমি তোমাকে আশ্বস্ত করতে পারি। সে পার্ক মশিউতে বিরাট একটা ভুল ক’রে ফেলেছে,” ডিজাইনার সামনে ঝুঁকে বললো। “আমাকে আবার বলো, যতোটুকু তোমার মনে পড়ে, সবটুকু। তুমি কেন এতোটা নিশ্চিত হলে যে, সে-ই বর্ন?”
“আমি সেটা জানি না। আমি বলেছি সে হচ্ছে কেইন। আমি যদি তার মেথডগুলো নিখুঁতভাবে বর্ননা করতে পারতাম, তাহলে বুঝতেন সে-ই কেইন।”
“বর্ন হলো কেইন। আমরা তাকে মেডুসা রেকর্ডে আগাগোড়াই পেয়েছি। এজন্যেই তোমাকে ভাড়া করা হয়েছে।”
“তাহলে সে-ই বর্ন, তবে এই নামটা সে ব্যবহার করে না। অবশ্য মেডুসা-তে অনেক লোক আছে যারা নিজেদের সত্যিকারের নাম ব্যবহার করতো না। তাদের জন্যে ভুয়া পরিচয়টাই বেশি নিরাপদ ছিলো। তাদের অপরাধের রেকর্ড আছে। সে ঐইসব লোকেদেরই একজন হবে।”
“কেন সে? অন্যেরাও তো উধাও হয়েছে। তুমি হয়েছো।”
“কারণ সে এখানে এসেছে, আর এটাই যথেষ্ট। তবে আরো আছে। আমি তাকে কাজ করতে দেখেছি। তার কমান্ডে এক মিশনে আমাকে নিযুক্ত করা হয়েছিলো। এই অভিজ্ঞতাটা ভুলে যাওয়ার মতো নয়। সে তা ভুলে যায় নি। সে-ই কেইন হতে পারে—আপনার কেইন।”
“আমাকে বলো।”
“আমরা তাম কুয়ান’র একটা সেক্টরে এক রাতে প্যারাসুট দিয়ে নামলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো ওয়েব নামের এক আমেরিকানকে উদ্ধার করা। সে ভিয়েত কংদের হাতে বন্দী ছিলো। আমরা সেটা জানতাম না। তবে আমাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিলো খুব ক্ষীণ। এমনকি সায়গন থেকে আমাদের ফ্লাইটটাও ছিলো খুবই বিপজ্জনক। বিমানটা বাতাসের ঝাপটায় এমনভাবে কাঁপছিলো যেনো সেটা ভেঙে পড়বে। তারপরও সে আমাদেরকে জাম্প করার আদেশ করলো।”
“আর তোমরা তাই করলে?”
“তার অস্ত্রটা আমাদের মাথার দিকে তাক্ করা ছিলো। আমরা হয়তো নিচে বাঁচতে পারবো, কিন্তু সামনের বুলেটের হাত থেকে একদমই পারবো না।”
“তোমরা সেখানে কয়জন ছিলে?”
“দশজন।”
“তাহলে তোমরা তো তাকে ঘায়েল করতে পারতে।”
“আপনি তাকে চেনেন না।”
“বলে যাও,” বারগোঁয়া বললো।
“আমাদের মধ্যে আটজন মাটিতে নেমে পুণরায় যোগ দিতে পেরেছিলো। বাকি দু’জন বোধহয় জাম্প ক’রে নিচে ঠিকমতো নামতে পারে নি। মরে গিয়েছিলো। আমি ছিলাম সবচাইতে বয়োজ্যেষ্ঠ, তবে আমি সেই এলাকাটা চিনতাম, সেজন্যে তারা আমাকে পাঠিয়েছিলো।” ধূসর চুলের লোকটা একটু থামলো। “এক ঘণ্টা পরেই আমরা বুঝতে পারলাম এটা একটা ফাঁদ। আমরা জঙ্গল দিয়ে প্রাণপণে দৌড়ালাম। আর রাতের বেলায় সে একাই মর্টার এবং গ্রেনেড নিয়ে নেমে পড়লো হত্যা করতে। ভোরের আগে ফিরে এসে আমাদেরকে বেইজ-ক্যাম্পের কাছাকাছি যাবার জন্যে বাধ্য করলো। এক সময় আমি আত্মহত্যা করার কথাও ভেবেছিলাম।”
“তুমি কেন এটা করলে? সে হয়তো তোমাদেরকে একটা কারণ বলেছিলো, তোমরা মেডুসার সদস্য ছিলে, কোনো সৈনিক তো ছিলে না।”
“সে বলেছিলো এটাই জীবিত হয়ে বের হয়ে আসার একমাত্র পথ। আর তাতে যুক্তিও ছিলো। আমরা শত্রুপক্ষের একেবারে ভেতরে ছিলাম। সরবরাহ পাওয়ার জন্যে আমাদেরকে বেইজ ক্যাম্পটা খুঁজে বের করার দরকার ছিলো—যদি আমরা সেটা নিতে পারি তো। সে বলেছিলো আমাদেরকে নিতেই হবে। আমাদের এছাড়া আর কোনো পথ নেই। কেউ এ নিয়ে তর্ক করলে সে একটা বুলেট খরচ করতে দ্বিধা করতো না—এটা আমরা জানতাম। তৃতীয় রাতে আমরা ক্যাম্পটা খুঁজে পেলে সেটা দখলে নিয়ে নিতে সক্ষম হই। আর সেখান থেকে ওয়েব নামের লোকটাকেও খুঁজে পাই, তবে একেবারে মৃতপ্রায়। ওখান থেকে আমরা আমাদের দলের আরো দু’জন সদস্যকেও জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করি, কিন্তু যা দেখতে পেয়েছিলাম তাতে খুবই হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। এক শ্বেতাঙ্গ আর এক ভিয়েতনামী। আমাদেরকে ফাঁদে ফেলার জন্যে ভিয়েতকংরা তাদেরকে টাকা দিয়ে ছিলো—আমার ধারণা মূলত তাকে ফাঁদে ফেলার জন্যেই।”
“কেইনকে?”
“হ্যা।”
“ভিয়েতনামিটা আমাদেরকে প্রথমে দেখে ফেলে পালিয়ে যায়। কেইন নির্বিকারভাবে শ্বেতাঙ্গ লোকটার মাথা গুলি ক’রে মাথাটা গুঁড়িয়ে দেয়।”
“সে শত্রুপক্ষের কাছ থেকে তোমাকে ফিরিয়ে এনেছিলো?”
“আমাদের চারজন এবং ওয়েব নামের লোকটাকে। পাঁচজন খুন হয়েছিলো। সেই ভয়ংকর ভ্রমণ থেকে ফিরে আমি বুঝতে পারলাম কেন মেডুসার সবচাইতে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া ব্যক্তি।”
“কোন্ দিক থেকে?
“আমার দেখা সবচাইতে ঠাণ্ডা মাথার লোক সে, খুবই বিপজ্জনক, একেবারেই অনুনমেয়। একসময় আমি ভেবেছিলাম তার জন্যে যুদ্ধটা খুবই অদ্ভুত একটি ব্যাপার। তার কোনো ধর্মীয় নীতি ছিলো না, কেবল নিজের অদ্ভুত নৈতিকতা ছাড়া। সব মানুষই তার শত্রু—বিশেষ ক’রে নেতারা, সে দু’পক্ষের কাউকেই পরোয়া করতো না।” লোকটা আবারো থামলো। “মনে রাখবেন, মেডুসা’তে বিপথগামী আর বেপরোয়া লোকজনে ছিলো প্রচুর। অনেকেই ছিলো যারা কমিউনিস্টদেরকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতো। একেবারে বাতিকগ্রস্ত ছিলো তারা। একজন কমিউনিস্টকে খুন করলে জিশু খুশি হবে —খৃস্ট্রিয় শিক্ষার অদ্ভুত এক উদাহরণ। অন্যেরা—যেমন আমার—ভাগ্য খুব ভালো ছিলো যে ভিয়েতমিনরা আমাদেরকে চুরি করেছিলো। একমাত্র সান্ত্বনা হোতো যদি আমেরিকানরা যুদ্ধে জিততো। ফ্রান্স আমাদের দিয়েবুফু’তে পরিত্যাগ করেছিলো। তবে কয়েক ডজন লোক তখনও মেডুসাতে ভাগ্য গড়ে নেবার সুযোগ দেখতে পাচ্ছিলো। পকেটে প্রায়শই থাকতো পঞ্চাশ থেকে সত্তর হাজার ডলার। এক কুরিয়ার অবসরে গিয়ে সিঙ্গাপুর অথবা কুয়ালামপুরে নিজের মাদক ব্যবসা খুলে বসতে পারলো। ট্রায়াঙ্গালে। সেই গ্রুপেই আমি ঐ অদ্ভুত লোকটাকে স্থান ক’রে দিলাম। বলতে পারেন, সে আধুনিক যুগের একজন পাইরেট।”
বারগোঁয়া এবার মুখ খুললো। “দাঁড়াও, তুমি একটু আগে বললে একটা মিশনের কমান্ড ছিলো। মেডুসাতে সেনাবাহিনীর লোক ছিলো, তুমি কি নিশ্চিত সে আমেরিকান সেনাবাহিনীর কোনো অফিসার নয়?”
“আমেরিকান, এটা নিশ্চিত, তবে আর্মির নয়।”
“কেন?”
“সে মিলিটারির সব কিছুই ঘৃণা করতো। সে মনে করতো আর্মির লোকেরা বোকা আর অযোগ্য। তাই সে নিজেই নিজের মতো চলাতো। এক সময় তাম কুয়ানে আমাদের কাছে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে অর্ডারগুলো আসতো। সে ট্রান্সমিশন ভেদ ক’রে একজন রেজিমেন্টাল জেনারেলকে বলেছিলো তার পোঙ মারবে সে—মানে, তার কথা মানবে না। কোনো আর্মি অফিসার এ কাজ করবে না।”
“যদি না সে তার নিজের পেশাটা ছেড়ে দেয়,” ডিজাইনার বললো। “প্যারিস তোমাদের ছেড়ে গেলে তোমরা নিজেরা যতোটুকু করার করেছো, মেডুসা থেকে চুরি করেছো, নিজেদের তথাকথিত দেশপ্রেমিক কর্মকাণ্ড নিজেরাই ঠিক ক’রে নিয়েছো।”
“রেনে, আমার দেশ আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তার সাথে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করারও আগে।”
“কেইনে ফিরে আসি আবার। তুমি বলেছো বর্ন নামটা সে ব্যবহার করতো না। সেটা কি?”
“আমি মনে করতে পারছি না। যেমনটি আমি বলেছি, অনেকের জন্যে পদবীটা প্রাসঙ্গিক নয়। সে আমার কাছে কেবল ‘ডেল্টা’ হিসেবেই ছিলো।”
“মেকং ব-দ্বীপ?”
“না, গৃক বর্ণমালাটার কথা বলছি।”
“আলফা, ব্রাভো, চার্লি…ডেল্টা,” বারগোঁয়া ইংরেজিতে বললো নির্বিকারভাবে। “কিন্তু অনেক অপারেশনে কোড ‘চার্লি’র বদলে ‘কেইন’ ব্যবহার করা হোতো, কারণ, ‘চার্লি’র সাথে কং-এর সাদৃশ্য আছে যা ভিয়েত কং’দের সংক্ষিপ্ত রূপ। তাই ‘চার্লি’ হয়ে গেলো ‘কেইন।”
“একদম সত্য। তাই বর্ন হয়ে গেলো ‘কেইন’। সে ‘ইকো’ অথবা ‘ফক্সট্রট’ কিংবা ‘জুলু’ ব্যবহার করতে পারতো। কোনো পার্থক্য নেই। তোমার বক্তব্যটা কি, বলো?”
“সে কেইন নামটা ইচ্ছাকৃতভাবে বেছে নিয়েছে। এটা প্রতীকি। সে শুরু থেকেই এটা পরিস্কার ক’রে নিতে চেয়েছিলো।”
“কি চেয়েছিলো?”
“কেইন নামটা কার্লোসকে প্রতিস্থাপিত করবে। ভাবুন। চার্লসের স্পেনিশ হলো কার্লোস—চার্লি। ‘কেইন’ ছদ্মনামটা ‘চার্লি’র বিকল্প—মানে কার্লোসের। শুরু থেকেই তার এই উদ্দেশ্য ছিলো। কেইন কার্লোসকে প্রতিস্থাপিত করবে। আর সে চেয়েছিলো এটা কার্লোস জানুক।”
“কার্লোস কি জেনেছিলো?”
“অবশ্যই। খবরটা আমস্টারডাম, বার্লিন, জেনেভা, লিবসন, আর এই প্যারিসে ছড়িয়ে পড়েছিলো। কেইনকে খুব সহজেই পাওয়া যায়। যোগাযোগ করা যায়। তার পারিশ্রমিকও কার্লোসের চেয়ে কম। একেবারে জেঁকে বসলো সে! ক্রমাগতভাবেই কার্লোসের অবস্থানকে গ্রাস করতে শুরু করলো।”
“দু’জন ম্যাটাডোর একই মাঠে। কেবল একজনই থাকতে পারবে সেখানে।”
“সেটা হবে কার্লোস। আমরা বড়সড় চড়ুইটাকে ফাঁদে ফেললাম। সে সেন অনরে থেকে দু’ঘণ্টার দূরত্বে কোথাও থাকে।
“কিন্তু কোথায়?”
“কোনো ব্যাপার না। আমরা তাকে খুঁজে বের করবোই। হাজার হোক সে আমাদের খুঁজে বের করেছে। সে ফিরে আসবে। তার অহং এটা করবে। তখনই ঈগলটা উড়ে এসে চড়ুইটাকে ধরে ফেলবে। কার্লোস তাকে খুন করবে।”
.
বৃদ্ধলোকটা তার বাম হাতের নিচে থাকা সিঙ্গেল ক্রাচটা পাশে রেখে কালো পর্দাটা ফাঁক ক’রে কনফেশনাল বুথে প্রবেশ করলো। খুব একটা ভালো নেই সে। তার চোখেমুখ ফ্যাকাশে। মৃত্যু ভয় জেঁকে বসেছে। পর্দার ওপর পাশের অবয়বটা তার এই অবস্থাটা দেখতে পাচ্ছে না ব’লে সে খুশি হলো। তাকে যদি খুব বিধ্বস্ত দেখায় তবে গুপ্তঘাতক আর তাকে হয়তো কোনো কাজ দেবে না। তার দরকার এখন কাজ। কেবল একটা সপ্তাহ বাকি আছে, আর তার দায়দায়িত্বও রয়েছে। সে কথা বললো।
“অ্যাঙ্গেলাস দোমিনি।”
“অ্যাঙ্গেলাস দোমিনি, ঈশ্বরের পুত্র,” পর্দার ওপাশ থেকে নিচু কণ্ঠস্বরটা বললো। “আপনার দিনকাল কি ভালো যাচ্ছে?”
“দিন ফুরিয়ে আসছে আমার, তবে ভালোই যাচ্ছে।”
“হ্যা। আমার মনে হয় আমার জন্যে এটা আপনার শেষ কাজ। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার পারিশ্রমিকও পাঁচগুন বেড়ে যাবে। আমি আশা করি এটা আপনাকে খুব সাহায্য করবে।”
“ধন্যবাদ কার্লোস, তুমি তাহলে জানো।”
“জানি। এটা এমন কিছু যা আপনাকে অবশ্যই করতে হবে। আর খবরটা আমৃত্যু গোপন রাখবেন। ভুল করার কোনো সুযোগ নেই।”
“আমি সব সময়ই সঠিক আর নিখুঁত ছিলাম। আমি আমৃত্যু তাই করবো।”
“শান্তিতে করুন, পুরনো বন্ধু। এটা খুবই সহজ…আপনি ভিয়েতনামি অ্যাম্বাসিতে যাবেন, ফান লক্ নামের একজন অ্যাটাশিকে চাইবেন। যখন আপনি একা থাকবেন তখন এই কথাগুলো বলবেন : ‘১৯৬৮’র মার্চে মেডুসায়, তাম কুয়ান সেক্টর। কেইন ছিলো। আরেকজনও ছিলো। বুঝেছেন?”
“১৯৬৮’র মার্চে মেডুসায়। তাম কুয়ান সেক্টর। কেইন ছিলো। আরেকজনও ছিলো?”
“হ্যা। সে আপনাকে বলবে কখন ফিরে আসতে হবে। সেটা এক ঘণ্টার মধ্যেই হবে।”