অধ্যায় ১৩
ফোনবুথের ভেতর বর্ন তাকে জড়িয়ে ধ’রে রাখলো। আস্তে ক’রে বুথের ছোট্ট সিটটাতে বসিয়ে দিলো তাকে। মেয়েটা কাঁপছে, তার নিঃশ্বাস খুব দ্রুত, চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে। অনেকটা উদাসভাবেই জেসনের দিকে তাকালো সে।
“তারা তাকে খুন ক’রে ফেলেছে। তাকে খুন করেছে! হায় ঈশ্বর, আমি কি করেছি? পিটার!”
“তুমি এটা করো নি! কেউ যদি ক’রে থাকে তো আমি করেছি। এটা নিজের মাথায় ঢোকাও।”
“জেসন, আমি ভয়ে আছি। সে হাজার হাজার মাইল দূরে ছিলো…তারপরও তারা তাকে খুন ক’রে ফেলেছে!”
“ট্রেডস্টোন?”
“আর কে? দুটো ফোন কল করা হয়েছিলো, ওয়াশিংটন…নিউইয়র্কে। সে এয়ারপোর্টে কারো সাথে দেখা করতে গিয়ে খুন হয়েছে।”
“কিভাবে?”
“গুলি করা হয়েছে। গলায়।” ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো সে।
আচমকা বর্নের মাথাব্যাথাঁ শুরু হয়ে গেলো। “কার্লোস?” সে বললো, কেন বললো সেটা সে নিজেও জানে না।
“কি?” মেরি তার দিকে তাকিয়ে রইলো। “তুমি কি বললে?”
“কার্লোস,” আস্তে ক’রে আবারো বললো। “গলায় একটা বুলেট। এটা কার্লোসের কাজ।”
“তুমি কি বলতে চাচ্ছো?”
“আমি জানি না।” সে মেরিকে জড়িয়ে ধরলো। “চলো, এখান থেকে চলে যাই। তুমি কি ঠিক আছো? তুমি হাটতে পারবে?”
সে মাথা নাড়লো। “হ্যা।”
“আমরা মদ খেয়ে নেবো। আমাদের দু’জনেরই সেটার দরকার আছে। তারপর আমরা খুঁজে বের করবো এটা।”
“কি খুঁজে বের করবো?”
“সেন-জার্মেইনের একটা বুক স্টোর।”
.
‘কার্লোস’ ইনডেক্সে তিনটি পুরনো সংখ্যা আছে। পোটোম্যাক ত্রৈমাসিকের তিন বছরের পুরনো একটি এবং লো গ্লোব-এর প্যারিস সংখ্যায়। তারা ওখানে ব’সে লেখাগুলো পড়লো না। তার বদলে তিনটি সংখ্যা নিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরলো। ফিরে এলো হোটেল মঁতোপারোয়াতে। ওখানেই তারা পত্রিকাগুলো পড়লো। মেরি বিছানার উপর আর জেসন জানালার পাশে একটা চেয়ারে। কয়েক মিনিট পরে মেরিই প্রথম মুখ খুললো।
“এখানে আছে,” তার কণ্ঠে আর চোখেমুখে ভয়।
“পড়ো।”
“‘এক পৈশাচিক আর বীভৎস শাস্তি প্রয়োগ ক’রে থাকে কার্লোস অথবা তার ছোট্ট সৈনিকের দলটি। গলায় গুলি ক’রে মারা হয়, প্রায়শই গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি তীব্র যন্ত্রণা ভোগ ক’রে মৃত্যুবরণ করে। এটা তাদের জন্যে বরাদ্দ থাকে যারা গুপ্তঘাতকের সঙ্গে অনুগত্য অথবা নিরব থাকার প্রতীজ্ঞা ভঙ্গ করে। কিংবা যারা কোনো তথ্য দিতে অস্বীকার করে…” মেরি থেমে গেলো, আর পড়তে পারলো না। সে হেলান দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করলো। “সে তাদেরকে কিছু বলে নি তাই তারা তাকে মেরে ফেলেছে। হায় ঈশ্বর…
“সে যা জানে না তা তো বলতে পারে না,” বর্ন বললো।
“কিন্তু তুমি জানতে!” মেরি উঠে বসলো। “তুমি গলায় গুলি করার কথাটা জানতে। তুমি এটা বলেছিলে!”
“আমি জানতাম। কেবল এটাই আমি বলতে পারি।”
“কিভাবে?”
“হায়, এ প্রশ্নের উত্তরটা যদি আমি জানতাম! আমি জানি না।”
“আমি কি একটু মদ খেতে পারি?”
“নিশ্চয়।” জেসন মদ নিয়ে ফিরে এলো। “বরফ এনে দেবো? তাতে খুব জলদি কাজ করবে।”
“না,” ম্যাগাজিনটা ছুড়ে ফেলে তার দিকে তাকালো সে। “আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।”
“তুমি আরেক পাগলের সাথে যোগ দিচ্ছো।”
“আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে চাই। বিশ্বাস করিও। কিন্তু আমি…আমি…”
“তুমি নিশ্চিত হতে পারছো না,” বর্ন বললো। “আমি নিজেও না।” সে তার হাতে গ্লাসটা দিলো। “তুমি কি আমার কাছে থেকে শুনতে চাও? আমি কীইবা বলতে পারি? আমি কার্লোসের একজন যোদ্ধা? আমি কি নিরবতার শপথ ভঙ্গ করেছি? এজন্যেই কি আমি খুন করার ধরণটা জানি?”
“থামো।”
“আমি নিজেকে অনেকবার বলেছি ‘থামো, বন্ধ করো। ভেবো না। স্মরণ করার চেষ্টা করো। বেশিদূর যেয়ো না।’ এটা অনেকটা মাতাল হয়ে ঘুম থেকে ওঠার পরের মতো অবস্থা, কার সাথে মারামারি করেছো, ঘুমিয়েছো, অথবা খুন করেছো নিশ্চিত হতে পারছো না। ধ্যাত্তারিকা…”
“না…” মেরি বললো। “তুমি আমার কাছে তুমিই। এটা নিয়ে কিছু বোলো না।”
“আমিও সেটা করতে চাই না,” জেসন চেয়ারে গিয়ে আবার বসলো। তার মুখ জানালার দিকে। “তুমি হত্যা করার একটা পদ্ধতি খুঁজে পেয়েছো। আমি খুঁজে পেয়েছি অন্য কিছু। আমি সেটা জানতাম। যেমনটি জানতাম হাওয়ার্ড লিল্যান্ডের ব্যাপারে। আমাকে এমনকি সেটা পড়তেও হয় নি।”
“কিসের কথা বলছো?”
বর্ন তিন বছরের পুরনো ত্রৈমাসিক পোটোম্যাক-এর একটি সংখ্যা থেকে একটা খবর বের ক’রে মেরির দিকে বাড়িয়ে দিলো সেটা।
“পড়ো,” বললো সে। ‘রূপকথা অথবা দানব,’ নামের খবরটা। তারপর আমি একটা খেলা খেলতে চাইবো।”
“খেলা?”
“হ্যা। আমি কেবল প্রথম দুটো প্যারাগ্রাফ পড়েছি।”
“ঠিক আছে,” মেরি পড়তে শুরু করলো।
দানব নয়তো মিথ
প্রায় একযুগেরও বেশি সময় ধরে প্যারিস, তেহরান, বৈরুত, লন্ডন, কায়রো এবং আমস্টারডামের অলিগলিতে ‘কার্লোস’ নামটি উচ্চারিত হয়ে আসছে। তাকে গণ্য করা হয় একজন প্রধান এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে। এই খুনির কোনো রাজনৈতিক পরিচয় সেভাবে জানা না গেলেও এটা জানা গেছে, সে পিএলও এবং বাড়ের মেইনহফ নামক সংগঠনের সাথে জড়িত।
কার্লোসের প্রিয় শখ দ্রুতগতির গাড়ি আর সুন্দরী রমণী। অনেকটা এডাম স্মিথ আর ইয়ান ফ্লেমিংয়ের মিশ্রন সে।
তার আসল নাম ইলিচ রামিরেজ সানচেজ। ভেনিজুয়েলার নাগরিক। একজন কট্টর মার্কসবাদী ডাক্তারের ছেলে। ইলিচ নামটা তার বাবা নিজের প্রিয় নেতা লেলিনের নাম থেকে ব্যবহার করেছে। তার বাবাই তাকে রাশিয়াতে পাঠায় লেখাপড়া জন্যে। যার মধ্যে নভগোরোদে গুপ্তচরের প্রশিক্ষণটাও অন্তর্ভূক্ত ছিলো। রাশিয়া বর্তমানে তার সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক স্বীকার করে না। লোকটা প্যারানয়েড, সব ধরণের সমস্যার সমাধান বুলেট আর বোমার সাহায্যে করতে আগ্রহী সে। কার্লোস তার নিজের তৈরি দলের নেতা। রাজনৈতিক এবং আদর্শগত কোনো ক্লায়েন্টের পক্ষে সে গুপ্ত হত্যা ক’রে থাকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে।
সে অনেক ভাষায় কথা বলতে পারে। নিজের মাতৃভাষা স্পেনিশের সাথে রাশিয়ান, ফ্রেঞ্চ এবং ইংরেজি। কার্লোস তার সোভিয়েত প্রশিক্ষণটাকে আরো উন্নত করেছে। দীর্ঘদিন খোঁজখবর নিয়ে সে মস্কোতে বোমা ফাটিয়েছে। অনেকেই মনে করে সেটা কিউবানদের সাহায্যেই করেছে সে। বিজ্ঞানের উপর মাস্টার্স। সব ধরণের বোমা আর অস্ত্রের চালনা সে জানে। চোখ বুজে যেকোনো অস্ত্র মুহূর্তেই খুলে ফেলতে পারে। স্পর্শ আর ঘ্রান শুকেই বোমার ব্যাপারে জেনে যায়। আর অসংখ্য উপায়ে সেগুলো ডেটোনেটও করতে জানে।
সে প্রস্তুত। প্যারিসকে তার কর্মকাণ্ড পরিচালনার ঘাঁটি হিসেবে বেছে নিয়েছে, কিন্তু কথাটা জানাজানি হয়ে গেলে একজন লোককে ভাড়া করা হয়েছে তাকে হত্যা করার জন্যে, বাকিরা সে সাহস দেখায় নি। তার ছবিটা অনেক পুরনো, আর কোনো জন্ম রেকর্ড না থাকার কারণে তার সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। কালোর্সের বয়স কতো? কতোজনকে সে মেরেছে, এর কতোটুকু গল্পগুজব—আত্মস্বীকৃত অথবা অন্যকিছু? কারাকাসের সংবাদ প্রতিনিধি ইলিচ রামিরেজ সানচেজ নামে কোনো বার্থ সার্টিফিকেট খুঁজে পায় নি। তার উপর ভেনেজুয়েলাতে হাজার হাজার সানচেজ আর শত শত রামিরেজ রয়েছে। তবে কারোর নামের আগে ইলিচ নামটি নেই। সেটা কি পরে সংযুক্ত করা হয়েছে? তবে এটা সবাই মানে যে, গুপ্তঘাতকের বয়স পয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে হবে। তবে নিশ্চিত ক’রে কেউ সেটা জানে না।
ডালাসে একটা ঘাসের টিলা?
একটা বিষয় নিয়ে কারো মধ্যে মতভেদ নেই যে, প্রথম কয়েকটি খুন গুপ্তঘাতককে এমন একটি সংগঠন গড়তে সাহায্য করেছে যে, সেটা জেনারেল মটরসের একজন অপারেশন অ্যানালিস্টকে ঈর্ষাকাতর ক’রে তুলতে পারে।
তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলে খুব দ্রুতই মৃত্যু নেমে আসে কিন্তু তার সঙ্গে কাজ করলে প্রচুর টাকা আর বোনাস পাওয়া যায়। মনে হচ্ছে এই সংগঠনটির সর্বত্রই সদস্য রয়েছে। আর এটা যে প্রশ্নের জন্ম দেয় সেটা হলো, কোত্থেকে সে এতো টাকা পায়? সত্যিকারের খুনি কারা? তেরো বছর আগে ডালাসে এরকম একটি প্রশ্ন তোলা হয়েছিলো। জন.এফ কেনেডির হত্যা নিয়ে কতো তর্ক বিতর্কই না হয়েছে, কিন্তু সন্তোষজনক কোনো জবাব পাওয়া যায় নি। কেউ বলতে পারে নি, কি ক’রে তিনশ’ গজ দূরে একটা সবুজ টিলার উপর থেকে ধোঁয়া বের হলো। ধোঁয়াটা ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। মোটরসাইকেলে পুলিশের দুটো রেডিওতে শব্দটা রেকর্ড করা হয়েছিলো। তারপরও গুলির কোনো খোসা অথবা আঙুলের ছাপ পাওয়া যায় নি। সত্যি বলতে কি, তথাকথিত সবুজ টিলার খবরটি সে মুহূর্তে এতোটাই অপ্রাসঙ্গিক ছিলো যে, এফবিআই সেটা ধামাচাপা দিয়ে দেয় আর ওয়ারেন কমিশনের কাছে সেটা কখনই তোলা হয় নি। উত্তর ডালাসের কে এম রাইট এই বক্তব্যটি দিয়েছিলো :
“ওখানে একমাত্র যে বানাচোতটা সবচাইতে কাছাকাছি ছিলো সে হলো বৃদ্ধ বারলাপ বিলি, সে সময় কয়েকশ’ গজ দূরে ছিলো সে।” ‘বিলি’ নামে যাকে উল্লেখ করা হয়েছিলো সে ছিলো ডালাসের একজন ভবঘুরে। তাকে টুরিস্ট এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে দেখা যেতো। ‘বারলাপ’ বলতে মোটা কাপড় দিয়ে তার জুতা পেচিয়ে রাখার বাতিকটাকেই নির্দেশ করছে। আমাদের প্রতিনিধির মতে রাইটের জবানবন্দীটি কখনও প্রকাশ করা হয় নি। ছয় সপ্তাহ আগে এক লেবানিজ সন্ত্রাসী ধরা পড়লে তেলআভিভের জেরার মুখে সে স্বীকার করে, তার মৃত্যুদণ্ড রদ করা হলে সে গুপ্তঘাতক ‘কার্লোস’ সম্পর্কে অসাধারণ এক তথ্য দেবে। ইসরায়েলি ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টটা ওয়াশিংটনে পাঠিয়ে দেয়। আমাদের ক্যাপিটল প্ৰতিনিধি জবানবন্দীটির কিছু অংশ পাঠিয়েছে।
জবানবন্দী : কার্লোস ১৯৬৩ সালের নাভেম্বরে ডালাসে ছিলো। সে একজন কিউবান হিসেবে পরিচয় দিয়ে অসওয়াল্ডের ব্রেনওয়াশ করে। সে ছিলো ব্যাক-আপে। এটা ছিলো তারই অপারেশন। “ প্রশ্ন : “তোমার কাছে কি প্রমাণ আছে?”
জবানবন্দী : “আমি তাকে এ কথা বলতে শুনেছি। সে একটা ছোট্ট ঘাসের টিলার উপর ছিলো। তার রাইফেলটা ছিলো ওয়্যার শ্নেল- ট্র্যাপ সংযুক্ত।”
প্রশ্ন : “এটা কখনও রিপোর্ট করা হয় নি, তাকে কেন দেখা যায় নি?”
জবানবন্দী : “হয়তো তাকে কেউ দেখেছে, তবে কেউ সেটা জানতো না। সে এক বৃদ্ধলোকের পোশাকে ছিলো। ছেঁড়াফাড়া ওভারকোট আর জুতাটা মোটা ক্যানভাস কাপড় দিয়ে মোড়ানো ছিলো যাতে কোনো ছাপ পাওয়া না যায়।”
একজন সন্ত্রাসীর তথ্য নিশ্চিতভাবেই কোনো অকাট্য প্রমাণ নয়, তবে সেটাকে সব সময় অগ্রাহ্য করাও ঠিক না। বিশেষ করে একজন মাস্টার গুপ্তঘাতকের বিষয়ে, যেকিনা ছদ্মবেশ নিতে পারঙ্গম। এই জবাবন্দীটি গুরুত্বসহকারে নিতে হবে। আরো অসংখ্য ঘটনা আছে—ডালাসের হৃদয়বিদারক ঘটনাটি, ‘বারলাপ বিলি’কে কয়েকদিন পরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, ড্রাগ ওভারডোজের কারণে সে মৃত্যুবরণ করেছে। একজন সস্তা মদপানকারী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলো সে, কখনও নারকোটিকস্ ব্যবহার করে নি। সে ওগুলো কেনার ক্ষমতাও রাখতো না।
তাহলে কি ঘাসের টিলার উপরের লোকটা কার্লোসই ছিলো? একটা অসাধারণ ক্যারিয়ার শুরুর জন্যে কতো অসাধারণ শুরুই না ছিলো সেটা! যদি ডালাস আসলেই তার ‘অপারেশন’ হয়ে থাকে তবে কতো মিলিয়ন ডলার তাকে দেয়া হয়েছিলো? নিশ্চয় সারা পৃথিবীব্যাপী একটি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার চেয়ে সেটা বেশি ছিলো।
মিথটার অনেক সারবর্তা রয়েছে। কার্লোস হয়তো একজন রক্তমাংসের দানব, যার প্রচুর রক্ত দরকার।
মেরি ম্যাগাজিনটা নামিয়ে রাখলো। “খেলাটা কি?”
“পড়া শেষ?” জেসন জানালা থেকে ফিরে তাকালো।
“হ্যা।”
“আমি অনেকগুলো বক্তব্য জড়ো করেছি। তত্ত্ব, ধারণা, সমীকরণ। “সমীকরণ?”
“এখানে একটা কিছু ঘটছে, প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ওখানে, একটা সম্পর্ক তো আছেই।”
“মানে সংযোগ,” মেরি বললো।
“ঠিক আছে, সংযোগ। সবই আছে, আছে না?”
“একদিক থেকে তুমি এটা বলতে পারো। এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়, তবে অনেক ‘অনুমান, গুজব আর পরোক্ষ তথ্য আছে।”
“যাইহোক, সত্যতা রয়েছে।”
“বলা ভালো তথ্য রয়েছে।”
“বেশ। তথ্য। ঠিক আছে?”
“খেলাটা কি?” মেরি আবারো জানতে চাইলো।
“এটার সহজ একটি শিরোনাম আছে। এটাকে বলে ‘ফাঁদ।’
“কার ফাঁদ?”
“আমার।” বর্ন মুখোমুখি বসলো। “আমি চাই তুমি আমাকে প্রশ্ন করবে। ওখানে আছে এরকম যেকোনো কিছু নিয়ে। কোনো ব্যাকাংশ, শহরের নাম, গুজব, কোনো টুকরো তথ্য। যেকোনো কিছু। তারপর শোনো আমার জবাবটা কি হয়। আমার অন্ধ জবাব।”
“ডার্লিং, এটা কোনো প্ৰমাণ—”
“প্রশ্ন করো!” জেসন আদেশ করলো।
“ঠিক আছে।” পত্রিকাটা তুলে নিলো মেরি। “বৈরুত,” সে বললো।
“অ্যাম্বাসি,” জেসন জবাব দিলো। “সিআইএ’র স্টেশন হেড একজন অ্যাটাশি হিসেবে দায়িত্বে আছে। পথে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে সে। তিন লক্ষ ডলার।”
মেরি তার দিকে তাকালো। “আমার মনে পড়ছে—” বলতে শুরু করলো সে।
“আমার না!” জেসন বাঁধা দিয়ে বললো। “বলে যাও।”
মেরি আবারো ম্যাগাজিনে চোখ রাখলো। “বাডের মেইনহফ।”
“স্টুটগার্ড। রোজেনবুর্গ। মিউনিখ। দু’জন খুন আর একটা কিডন্যাপিং, বাডের সংগঠনটি স্বীকার করেছে। টাকা পেয়েছে—” বর্ন থেমে গেলো। তারপর বিস্ময়ে নিচু কণ্ঠে বললো, “ইউএসএ’র সোর্স থেকে। ডেট্রয়েট…উইলমিংটন, ডেলাওয়ার।”
“জেসন, এগুলো কি—”
“বলে যাও, প্লিজ।”
“সানচেজ।”
“ইলিচ রামিরেজ সানচেজ,” সে জবাব দিলো। “সে হলো…কার্লোস?”
“ইলিচ কেন?”
বর্ন থামলো, তার চোখ ঘুরছে। “আমি জানি না।”
“এটা রাশিয়ান, স্পেনিশ নয়। তার মা কি রাশিয়ান?”
“না…হ্যা। তার মা। এটা তার মা-ই হবে।…আমার মনে হচ্ছে, তবে নিশ্চিত নই।”
“নভগোরোদ।”
“গুপ্তচর কম্পাউন্ড। কমিউনিকেশন, সংকেত উদ্ধার, ফ্রিকোয়েন্সি ট্রাফিক। সানচেজ ওখানকার একজন গ্র্যাজুয়েট ছিলো।”
“জেসন, তুমি এটা পড়েছো!”
“আমি এটা পড়ি নি। প্লিজ, বলে যাও!”
মেরি আবারো পত্রিকার দিকে তাকালো। “তেহরান।”
“আটজন খুন। একাধিক গোষ্ঠীর দায় স্বীকার—খোমেনি এবং পিএলও। দুই মিলিয়ন ডলার পারিশ্রমিক। সোর্স দক্ষিণ-পশ্চিম সোভিয়েত সেক্টর।”
“প্যারিস,” মেরি দ্রুত বললো।
“সব কিছু প্যারিসের মাধ্যমে হবে।”
“কোন্ চুক্তি?”
“চুক্তি… হত্যা।”
“কার হত্যা? কার চুক্তি?”
“সানচেজ…কার্লোস।”
“কার্লোস? তাহলে সেগুলো কালোর্সের চুক্তি, তার খুন। তাদের সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই।”
“কার্লোসের চুক্তি,” বর্ন মন্ত্রমুগ্ধের মতো বললো। “তাদের সাথে আমার…কোনো লেনদেন নেই,” ফিফিস্ ক’রে বললো সে।
“তুমি বলছো, এসবের সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই!”
“না, সেটা ঠিক না!” বর্ন চিৎকার ক’রে বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মেরির দিকে চেয়ে রইলো। “আমাদের চুক্তি,” সে শান্ত কণ্ঠে বললো।
“তুমি জানো না তুমি কি বলছো!”
“আমি সাড়া দিচ্ছি! অন্ধভাবেই! এজন্যেই আমি প্যারিসে এসেছিলাম!” সে ঘুরে জানালার কাছে গিয়ে ফ্রেমটা ধরলো। “এটাই হলো খেলাটার আসল কারণ,” সে বলতে লাগলো। “আমরা কোনো মিথ্যে খুঁজছি না। সত্য খুঁজছি। মনে আছে? হয়তো আমরা সেটা খুঁজে পেয়েছি, হয়তো খেলাটা এই সত্য উন্মোচিত করেছে।”
“এটা কোনো গ্রহণযোগ্য পরীক্ষা নয়! এটা ঘটনাচক্রে স্মরণ করা, যন্ত্রণাদায়ক একটি কাজ। পোটোম্যাক-পত্রিকার মতো কাগজে যদি এটা ছাপা হয়ে থাকে, তবে দুনিয়ার অর্ধেক কাগজে কাহিনীটা ছাপা হয়েছে। তুমি সেইসব পত্রিকা থেকে পড়ে থাকতে পারো।”
“সত্য হলো আমি সেটা জানি।”
“পুরোপুরি নয়। তুমি জানো না ইলিচ কোত্থেকে এসেছে। কার্লোসের বাবা ভেনেজুয়েলার একজন কমিউনিস্ট অ্যাটর্নি ছিলো। এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। আমার মনে হয়, তুমি কিউবানদের সম্পর্কে কিছুই বলো নি। যদি বলতে তবে সেটা এখানকার লেখা সবচাইতে আতংকজনক অনুমানটির দিকে ধাবিত হোতো। তুমি কিছুই বলো নি সে সম্পর্কে।”
“তুমি কি বলতে চাচ্ছো?”
“ডালাস,” সে বললো। “নভেম্বর ১৯৬৩।”
“কেনেডি,” বর্ন জবাব দিলো।
“এটাই? কেনেডি?”
“সেটাই তো হয়েছে।” জেসন ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।
“হয়েছে। তবে আমি সেটা খুঁজছি না।”
“আমি জানি,” বর্ন বললো। তার কণ্ঠটা কাঁপা কাঁপা শোনাচ্ছে। “একটা সবুজ টিলা…বারলাপ বিলি।”
“তুমি এটা পড়েছো!”
“না।”
“তাহলে এ সম্পর্কে শুনেছো, এর আগে পড়েছো হয়তো।”
“সেটা সম্ভব। কিন্তু সেটা তো প্রাসঙ্গিক নয়, তাই না?”
“বন্ধ করো, জেসন!”
“আবারো সেই কথা। হায়, আমি যদি সেটা করতে পারতাম!”
“তুমি আমাকে কি বলতে চাচ্ছো? তুমিই কার্লোস?”
“হায় ঈশ্বর, না! কার্লোস আমাকে খুন করতে চায়, আর আমি রুশ ভাষায় কথা বলতে পারি না। আমি সেটা জানি।”
“তাহলে কি?”
“শুরুতে যা বলেছি! খেলাটা। খেলাটাকে বলে যোদ্ধাকে ফাঁদে ফেলো।”
“যোদ্ধা?”
“হ্যা। আমি কার্লোসের কাছ থেকে সরে এসেছি। এটাই আমার কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা ব’লে মনে হচ্ছে।”
“তুমি কেন বললে সরে এসেছো?”
“কারণ সে আমাকে খুন করতে চায়। তাকে সেটাই করতে হবে। সে মনে করে আমি তার সম্পর্কে এ দুনিয়ায় সবচাইতে বেশি জানি।”
মেরি বিছানা থেকে একটা পা বের ক’রে দোলাতে লাগলো। “এটা হলো সরে আসার পরিণাম। তাহলে কারণটা কি? যদি এটা সত্য হয়ে থাকে, তাহলে তুমি এটা করেছো…” সে থেমে গেলো।
“সবদিক বিবেচনা ক’রে, নৈতিক অবস্থান খোঁজার জন্যে একটু বেশি দেরি হয়ে গেছে বলেই মনে হয়,” বর্ন বললো, যে মেয়েটিকে সে ভালোবাসে তার মুখে যন্ত্রণার ছাপটি সুস্পষ্টভাবে দেখতে পেলো সে। “আমি কয়েকটি কারণ সম্পর্কে ভাবতে পারি, একেবারে গৎবাধা কিছু কারণ। যেমন, চোরবাটপার কিংবা খুনিদের খপ্পর থেকে বেড়িয়ে আসা।
“সব অর্থহীন!” মেরি চিৎকার ক’রে বললো। “এক বিন্দু প্রমাণও নেই।”
“একগাদা প্রমাণ আছে, তুমিও সেটা জানো। আমি হয়তো চড়া মূল্যে বিক্রি হয়ে গেছি অথবা ফি’র টাকা থেকে বড় একটা অংক চুরি ক’রে সটকে পড়েছি। এ দুটোই জুরিখের একাউন্টটাকে ব্যাখ্যা করে।” একটু থেমে সে বললো, “এতে ক’রে হাওয়ার্ড লিল্যান্ড, মার্সেই, বৈরুত, স্টুটগার্ড…মিউনিখ, সবই ব্যাখ্যা করা যায়। আরেকটা ব্যাপার আছে। আমি কেন তার নাম উল্লেখ করতে এড়িয়ে যেতাম। কেন আমি তার কথা বলি নি। আমি ভয়ে ছিলাম। আমি তাকে ভয় পাই।”
কিছু মুহূর্ত নিরবে চলে গেলো।
মেরি মাথা নেড়ে সায় দিলো। “আমি নিশ্চিত, তুমি সেটা বিশ্বাস করো,” বললো সে। “একদিক থেকে আমিও চাই সেটা যেনো সত্যি হয়। তবে আমি সেটা মনে করি না। তুমি এটা বিশ্বাস করো কারণ এটা তোমার এইমাত্র বলা কথার পক্ষে যায়। এটা তোমাকে একটা জবাব দেয়…একটা পরিচয় দেয়। এটা হয়তো এমন একটা আইডেন্টিটি যা তুমি চাও না। তবে, ঈশ্বর জানে, প্রতিদিন গোলক-ধাঁধায় ঘোরার চেয়ে বিস্মৃতির কানাগলিতে ছোটার চেয়ে এটা অনেক ভালো।” সে আবারো থামলো। “আমিও চাই এটা যেনো সত্য হয়। এটা সত্যি হলে আমরা এখানে থাকতাম না।”
“কি?”
“এটাই হলো বেখাপ্পা, ডার্লিং। সংখ্যা আর প্রতীকগুলো তোমার সমীকরণের সাথে খাপ খায় না। তুমি যা বলছো, তুমি যদি তাই হও, কার্লোসকে ভয় পাও তাহলে প্যারিসে তুমি যাওয়ার কথা কোনোমতেই ভাবতে না। আমরা অন্য কোথাও থাকতাম। তুমি এটা নিজেই বলেছো। তুমি পালিয়ে বেড়াচ্ছো। তুমি জুরিখ থেকে টাকাগুলো নিয়ে উধাও হয়ে যেতে পারতে, কিন্তু তুমি সেটা করছো না। তার বদলে তুমি কার্লোসের গুহায় এসে হাজির হয়েছো। এটা তো ভয় পাওয়া অথবা অপরাধ বোধে ভোগা কোনো লোকের কাজ নয়।”
“আমি প্যারিসে এসেছি খুঁজতে। এটাই তো সহজ সরল ব্যাখ্যা।”
“তাহলে পালাও। সকালেই আমরা টাকাগুলো পেয়ে যাবো। এটাও তো খুব সহজ সরল।” তাকে খুব কাছ থেকে দেখতে লাগলো মেরি।
তার দিকে তাকালো জেসন, তারপর ঘুরে ব্যুরোর কাছে গিয়ে এক ঢোক মদ গিললো। “এখনও ট্রেডস্টোনকে বিবেচনায় নিতে হবে,” সে আত্মপক্ষ সমর্থন ক’রে বললো।
“কার্লোসের চেয়ে বেশি কেন? এখানেই তোমার আসল হিসেব। কার্লোস আর ট্রেডস্টোন। একসময় আমি যাকে খুব ভালোবাসতাম তাকে ট্রেডস্টোন খুন করেছে। আামাদের কাছে এখন সবচাইতে বড় কাজ হলো পালানো, জীবন বাঁচানো।”
“আমার মনে হয় তুমি চাইবে, যে লোক তাকে খুন করেছে তাদেরকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে,” বর্ন বললো।
“চাই। খুব চাই। তবে অন্যেরা তাদেরকে খুঁজে বের করতে পারবে। আমার অন্য অনেক জরুরি কাজ আছে। আর প্রতিশোধ নামক জিনিসটা সেই তালিকায় উপরে দিকে নেই। আমরা, মানে তুমি এবং আমি। নাকি এটা কেবলই আমার ব্যাপার? আমার অনুভূতি?”
“তুমিই ভালো জানো।” মেরির দিকে সরাসরি তাকালো সে। “আমি তোমাকে ভালোবাসি,” ফিফিস্ ক’রে কথাটা বললো।
“তাহলে চলো পালাই!” তার দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসে যন্ত্রের মতো বললো সে। “চলো, এসব ভুলে যাই। সব ভুলে যতো দ্রুত পারি পালাই। অনেক দূরে কোথাও চলে যাই! চলো।”
“আমি…আমি,” তোতলাতে লাগলো সে। একটা কুয়াশা তাকে জড়িয়ে ধরলো আবার। “কিছু ব্যাপার…আছে।”
“কি ব্যাপার? আমরা একে অন্যকে ভালোবাসি। আমরা একে অন্যকে পেয়েছি। আমরা যেকোনো জায়গায় যেতে পারি। কেউ আমাদেরকে থামাতে পারে না। পারবে কি?”
“কেবল তুমি আর আমি,” সে আবারো নরম কণ্ঠে বললো।
কুয়াশাটা এখন এমনভাবে জড়িয়ে ধরলো যে, দম বন্ধ হয়ে এলো তার। “আমি জানি। জানি। তবে আমাকে ভাবতে হবে। অনেক কিছু জানার আছে। অনেক কিছু।”
“তোমর কাছে এটা কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ?”
“এটা…”
“তুমি কি জানো না?”
“হ্যা…না, মানে, আমি নিশ্চিত নই। এখন আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না।”
“এখন নয়তো কখন? কখন জিজ্ঞেস করতে পারবো? কখন সময় হবে? নাকি কখনও হবে না!”
“চুপ করো!” আচমকা সে গর্জে উঠলো। নিচের কাঠের ট্রে’র কাঁচের উপর জোরে আঘাত করলো সে। “আমি পালাতে পারি না। পারবো না! আমাকে এখানে থাকতে হবে। আমাকে জানতে হবে!”
মেরি তার কাছে ছুটে এলো। প্রথমে তার কাঁধে তারপর মুখে হাত রাখলো। কপালের ঘাম মুছে দিলো সে। “এখন তুমি এটা বলেছো। তুমি কি শুনেছো, ডার্লিং? তুমি পালাতে পারছো না কারণ যতো কাছে যাচ্ছো ততোই বেশি তোমাকে উন্মাদ ক’রে তুলছে। আর তুমি যদি পালাতেও, এটা আরো বেশি খারাপ হোতো। তোমার কোনো জীবন থাকতো না। তুমি একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে থাকতে। আমি সেটা জানি।”
“জানো?”
“অবশ্যই। আমি না। তুমিই এটা বলেছো।” মেরি তার বুকে মাথা গুঁজে দিলো। “তোমাকে আমার জোর করতে হয়েছে। হাস্যকর ব্যাপার হলো আমি পালাতে পারি। আমি একটা প্লেনে ক’রে তোমাকে নিয়ে যেকোনো জায়গায় উধাও হয়ে যেতে পারি। তারপর সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারি। তবে তুমি সেটা করতে পারছো না। এখানে, প্যারিসে তুমি তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবে যদি তুমি এটা সহ্য করতে না পারো। এটা হলো পরিহাসের বিষয়, ডার্লিং। আমি এর সাথে বসাস করতে পারবো, তবে তুমি পারবে না।”
“তুমি উধাও হয়ে যেতে পারো?” জেসন জানতে চাইলো। “তোমার পরিবারের কি হবে, তোমার কাজ—যেসব লোককে তুমি চেনো?
“আমি না কোনো অবোধ শিশু, না কোনো বোকা,” সে খুব দ্রুত জবাব দিলো। “আমি আমারটা দেখবো। আমি মেডিকেল এবং ব্যক্তিগত কারণে ছুটি বাড়িয়ে নেবার জন্যে অফিসে অনুরোধ করবো। আমি যেকোনো সময় ফিরে যেতে পারবো সেখানে। ডিপার্টমেন্ট সেটা বুঝবে।”
“আর পিটার?”
“হ্যা।” সে একটু চুপ ক’রে গেলো। “আমরা এক সম্পর্ক থেকে আরেক সম্পর্কের দিকে চলে গেছিলাম। আমার মনে হয় পরেরটাই আমাদের দু’জনের জন্যেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সে একজন দোষত্রুটিযুক্ত ভায়ের মতো, তুমি তার খুঁতগুলো থাকা সত্ত্বেও তার সফলতা চাও। কারণ তার মধ্যে একধরণের সততা আর ভদ্রতাও রয়েছে।”
“আমি দুঃখিত। সত্যি দুঃখিত।”
সে তার দিকে মুখ তুলে তাকালো। “তোমারও একই রকম সততা আর ভদ্রতা আছে। অমায়িক আর ভদ্রলোকেরা পৃথিবীটাকে দখল করে নি, করেছে দুনীর্তিবাজরা। আমার কাছে দুনীর্তিবাজ আর খুনির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।”
“ট্রেডস্টোন সেভেনটি-ওয়ান?”
“হ্যা। আমরা দু’জনেই ঠিক। আমি চাই তাদের মুখোশটা খুলে যাক। আমি চাই, তারা যা করেছে তার প্রাপ্য শাস্তি তারা পাক। আর এও চাই, তুমি কোনো মতেই যেনো না পালাতে পারো।”
মেরির ঠোঁটে ঠোঁট ছোয়ালো সে। তার চুলগুলো মুঠোতে ধরলো। “আমি তোমাকে ছুড়ে ফেলে দেবো,” বললো জেসন। “আমি তোমাকে বলবো, আমার জীবন থেকে বের হয়ে যাও। কিন্তু আমি পারছি না, তবে এটাই আমার করা উচিত।”
“তুমি যদি সেটা করো তবে তাতে কিছুই বদলাবে না। আমি যাবো না, প্ৰিয়।”
.
অ্যাটর্নির অফিসটা বুলেভার্ড দ্য লা শাপেলে অবস্থিত। অনেকগুলো ঘর আছে সেখানে। এইসব ঘরে চুক্তি নয়, ডিল করা হয়। ধবধবে সাদা উকিলের ছাগলা দাড়ি। তার নাকটা খাড়া। ভুল ইংরেজিতে কথা বলতে চাইলো সে। যাতে ক’রে পরে দাবি করতে পারে সে ভুল বুঝেছিলো।
মেরিই বেশিরভাগ কথা বললো। বিষয়টা পরিস্কার ক’রে বোঝালো তাকে। ক্যাশিয়ারের চেকটা বিয়ারার বন্ডে বদলে নেবার কথা বললো সে।
যখন ছাগলা-দাড়ির উকিল তার ফোন সংলাপটি বিব্রতকর আতোঁয়া দামাকোর্তের সাথে শেষ করতে যাচ্ছে, মেরি তার হাত তুলে ধরলো।
“ক্ষমা করবেন, মঁসিয়ে বর্ন চাচ্ছেন মঁসিয়ে দামাকোর্ত আরো দু’লক্ষ ফ্রাঁ নগদে অন্তর্ভুক্ত করবে, একলক্ষ ফ্রাঁ বন্ডের সাথে আর একলক্ষ মঁসিয়ে দামাকোর্তের কাছে। সে বলছে এক লক্ষ ফ্রাঁ এভাবে ভাগ হবে, পচাত্তর হাজার মঁসিয়ে দামাকোর্তের জন্যে আর পচিশ হাজার আপনার জন্যে। সে বুঝতে পেরেছে আপনাদের দু’জনের কাছেই সে ঋণী।”
মেরির কথাবার্তা বেশ দৃঢ় আর স্পষ্ট শোনালো। কি কি করতে হবে সবই বিস্তারিত বলে দিলো সে। বন্ড আর টাকাগুলোর জন্যে মঁসিয়ে বর্ন একটা চামড়ার অ্যাটাশি কেস দেবে। এটা বহন করবে একজন সশস্ত্র কুরিয়ার, সে ব্যাংক থেকে বের হবে ২টা ৩০ মিনিটে, আর পন্ত নোয়েফে মঁসিয়ে বর্নের সাথে দেখা করবে ঠিক ৩টা বাজে। ক্লায়েন্ট নিজেকে পরিচয় দেবে চামড়ার ব্যাগটার একটা ছোট্ট কাটা অংশের সাথে মিলে যায় এমন একটা চামড়ার টুকরো দিয়ে। তাতে একটা কথার বাকি অংশ পূর্ণ হবে : ‘হের কোয়েনিগ জুরিখ থেকে শুভেচ্ছা পাঠিয়েছে।’
কেবল একটা বাদে সবই বিস্তারিত বলা হলো। সেটা মঁসিয়ে বর্নের উপদেষ্টা বুঝিয়ে দিলো পরিস্কার ক’রে।
“আমরা দেখতে পাচ্ছি ফিশের ডিমান্ডটা চিঠির মাধ্যমে মেটানো যাবে। মঁসিয়ে দামাকোর্তও এরকমটি করার প্রত্যাশাই করছেন,” মেরি সেন জ্যাক বললো। “আমরা আরো দেখতে পাচ্ছি, সময়টা মঁসিয়ে বর্নের জন্যে সুবিধাজনক হতে পারে। সেটা যদি তিনি না পান, তবে আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং কমিশনের একজন সার্টিফাইড সদস্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করতে বাধ্য হবে। আমি নিশ্চিত সেটার কোনো দরকার হবে না। আমাদের সবাইকে বেশ ভালো টাকা দেয়া হচ্ছে, নেস্ত-সে পাস মঁসিয়ে?”
“সেস্তে ভেই, মাদাম! ব্যাংকিং আর আইনে…জীবনের মতোই…সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনার ভয়ের কিছু নেই।”
“আমি জানি,” মেরি বললো।
.
বর্ন সাইলেন্সারের চ্যানেলটা পরীক্ষা ক’রে দেখলো। ওখান থেকে ধূলো আর গুঁড়োগুলো সরিয়ে ফেলে সন্তুষ্ট হলো সে। শেষ মোচড়টা দিয়ে ম্যাগাজিনটা বের ক’রে ক্লিপটা পরীক্ষা ক’রে দেখলো। ছয়টা গুলি আছে। প্রস্তুত সে। অস্ত্রটা বেল্টে ঢুকিয়ে লাগিয়ে নিলো জ্যাকেটের বোতাম।
মেরি এর আগে অস্ত্রসহ তাকে দেখে নি। সে পেছন ফিরে বিছানায় ব’সে আছে। কথা বলছে কানাডিয়ান অ্যাম্বাসির অ্যাটাশি ডেনিস করবেলিয়ার সাথে। তার নোট বইয়ের পাশে সিগারেটের ধোঁয়া উড়ছে। করবেলিয়ার তথ্যগুলো টুকে রাখছে সে। তথ্য দেয়া শেষ হলে মেরি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোনটা রেখে দিয়ে দুই তিন সেকেন্ডের জন্যে স্থির হয়ে ব’সে রইলো। পেন্সিলটা এখনও তার হাতে।
“সে পিটারের খবরটা জানে না,” জেসনের দিকে ফিরে বললো সে।
“এটা তো অদ্ভুত।”
“খুবই অদ্ভুত,” বর্ন বললো। “আমার মনে হয় সবার আগে তারই খবরটা পাওয়ার কথা। তুমি বলেছিলে তারা পিটারের ফোন-লগটা দেখেছে। সে তো প্যারিসে করবেলিয়াকে ফোন করেছিলো। তুমি মনে করছো কেউ এটা অনুসরণ করবে।
“আমি এটা এমনকি বিবেচনাও করি নি। আমি সংবাদপত্র আর ওয়্যার সার্ভিসগুলো নিয়ে ভাবছি। পিটারকে আঠারো ঘণ্টা আগে পাওয়া গেছে, আর সে কানাডিয়ান সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তার মৃত্যুর খবরটা গুরুত্ব পাবে, হত্যার খবর তো বিরাট শিরোনাম হবে। কিন্তু তা হয় নি।”
“আজ রাতে অটোয়াতে ফোন করো। খুঁজে বের করো কেন।
“ঠিক আছে।”
“করবেলিয়া তোমাকে কি বললো?”
“ওহ্, হ্যা,” মেরি নোটবুকটা দেখে বললো, “রুই মেদেলিনের লাইসেন্সটা একেবারেই অর্থহীন, দ্য গল এয়ারপোর্ট থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করা হয়েছিলো জ্যঁ পিয়েরে লারুজে যাবার জন্যে।”
“যদু মধু রাম শ্যাম,” জেসন কথার মাঝখানে বললো।
“ঠিক। তোমাকে দেয়া দামাকোর্তের টেলিফোন নাম্বারটার ব্যাপারে তার ভাগ্য ভালো ছিলো। তবে এটা দিয়ে সম্ভাব্য কি হতে পারে সেটা সে বুঝতে পারে নি। সত্যি বলতে কি, আমিও বুঝতে পারি নি।
“এটা কি খুব অদ্ভুত?”
“তাই তো মনে হয়। এটা সেন অনরের একটা প্রাইভেট ফ্যাশন হাউজ। লো ক্লাসিক।”
“ফ্যাশন হাউজ? মানে, একটা স্টুডিও?”
“আমি নিশ্চিত ওখানে ওরকম একটা স্টুডিও আছে। তবে বড় বড় হাউজগুলোতে এরকম স্টুডিও থাকেই। করবেলিয়া বলেছে, এটা রেনের হাউজ নামে পরিচিত।”
“কে?”
“রেনে বারগোঁয়া, একজন ডিজাইনার। তাকে আমি চিনি, তার একটা ডিজাইন করা জামা আমার আছে। খুবই বিখ্যাত লোক।”
“তুমি কি ঠিকানাটা পেয়েছো?”
মেরি মাথা নেড়ে সায় দিলো। “করবেলিয়া কেন পিটারের খবরটা জানে না? কেন সবাই জানে না?”
“হয়তো ফোন করলে জানতে পারবে। প্যারিসের সকালের সংস্করণটির জন্যে খবরটা খুব বেশি দেরি হয়ে গেছে। আমি সান্ধ্যকালীন পত্রিকা যোগাড় করবো।” বর্ন তার টপকোটটা নেবার জন্যে ক্লোসেটের দিকে গেলো। “আমি ব্যাংকে ফিরে যাচ্ছি। পন্ত নোয়েফ পর্যন্ত কুরিয়ারকে অনুসরণ করবো আমি।” কোটটা পরে নিলো সে। মেরি যে তার কথা শুনছে না সে ব্যাপারে সে সচেতন আছে। “আচ্ছা, ঐসব লোকেরা কি ইউনিফর্ম পরে?”
“কারা?”
“ব্যাংক কুরিয়াররা।”
“এটা সংবাদপত্র জানবে না, তবে ওয়্যার সার্ভিসগুলো জানবে।”
“বুঝলাম না, কি বললে?”
“সময়ের পার্থক্য। পত্রিকাগুলো হয়তো খবরটা পায় নি। তবে ওয়্যার সার্ভিস সেটা জানবে। অ্যাম্বেসিগুলোতে টেলিটাইপ রয়েছে। তারাও এটা জানবে। এটা রিপোর্ট করা হয় নি, জেসন।”
“তুমি আজ রাতে ফোন কোরো,” সে বললো। “আমি যাচ্ছি।”
“তুমি কুরিয়ারের ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলে। তারা কি ইউনিফর্ম পরে, তাই না?”
“হ্যা।”
“বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরে। তারা আরমোর্ড ভ্যানও ব্যবহার করে। তবে সেটা চাইতে হয়। ভ্যান ব্যবহার করা হলে এক ব্লক দূরে সেটা পার্ক করা হবে, বাকি পথটুকু কুরিয়ার পায়ে হেটেই যাবে।”
“তোমরা কথা শুনে কিছু বুঝতে পারলাম না। কেন?”
“একজন বন্ডেড কুরিয়ার খুব খারাপ হয়, তবে সে খুব প্রয়োজনীয়। তার ব্যাংক ইন্সুরেন্সের প্রয়োজন পড়ে। একটা ভ্যানকে খুব সহজেই অনুসরণ করা যায় চিহ্নিত করা যায়। আমি জানি তুমি তোমার মত বদলাবে না, তারপরও বলছি, আমাকে তোমার সাথে যেতে দেবে?”
“না।”
“বিশ্বাস করো, উল্টাপাল্টা কিছু হবে না।”
“তাহলে তোমার যাওয়ারও কোনো কারণ নেই।”
“তুমি পেরেশান হয়ে যাচ্ছো।”
“আমি খুবই তাড়ার মধ্যে আছি।”
“আমি জানি। তুমি আমাকে ছাড়া খুব দ্রুত চলাফেরা করতে পারবে।” মেরি তার কাছে চলে এলো। “আমি বুঝেছি।” তাকে চুমু খেলো সে। আচকা বুঝতে পারলো তার বেল্টে পিস্তলটা আছে। সে তার চোখে চোখ রাখলো। “তুমি উদ্বিগ্ন, তাই না?”
“একটু সাবধান থাকছি,” সে হেসে তার গাল স্পর্শ করলো। “অনেক টাকা তো। এটা আমাদেরকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখবে।”
“আমি কথাটা পছন্দ করেছি।”
“টাকা?”
“না, আমাদের বলাতে,” মেরি বললো। “একটা সেফটি ডিপোজিট বক্সের দরকার।”
“তুমি কি বলতে চাচ্ছো?”
“মিলিয়ন ডলালের সার্টিফিকেট তুমি প্যারিসের কোনো হোটেলে রাখতে পারো না। তোমাকে একটা ডিপোজিট বক্সের ব্যবস্থা করতে হবে।”
“সেটা আমরা আগামীকালকে করতে পারবো।” তাকে ছেড়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো সে। “আমি বাইরে গেলে ফোনবুথ থেকে লো ক্লাসিকের নাম্বারটা টুকে একটা রেগুলার নাম্বারে ফোন কোরো। জেনে নিও তারা কখন খোলা রাখে।” কথাটা বলেই সে দ্রুত চলে গেলো।
.
একটা থেমে থাকা ট্যাক্সির পেছনের সিটে ব’সে বর্ন ব্যাংকটার প্রবেশদ্বার দেখছে। ড্রাইভার গুনগুন ক’রে অপরিচিত কোনো সুর ভাজছে আর একটা পত্রিকা পড়ছে। তাকে একটা পঞ্চাশ ফ্রাঁ’র নোট অগ্রীম দেয়া হয়েছে। প্যাসেঞ্জারের অনুরোধে ট্যাক্সিটার ইঞ্জিন অবশ্য বন্ধ করা হয় নি।
পেছনের ডান দিকের জানালা দিয়ে দেখা গেলো আরমোড ভ্যানটা আসছে। জেসনের ট্যাক্সির সামনে এসে গাড়িটা পার্ক করলো। পেছনের দরজার বুলেটপ্রুফ কাঁচের উপরে দুটো ছোটো লাল বাতি জ্বলছে। তার মানে অ্যালার্ম সিস্টেমটা সচল করা হয়েছে।
বর্ন একটু সামনের দিকে ঝুঁকে ইউনিফর্ম পরা লোকটাকে দেখলো। সে গাড়ি থেকে নেমে ব্যাংকের দিকে পা বাড়াচ্ছে। তার মধ্যে স্বস্তি ফিরে এলো। এই লোকটা গতকাল ভালোয়াঁতে তিনজন ফিটফাট পোশাক পরা লোকদের একজন নয়।
পনেরো মিনিট পরে কুরিয়ার ব্যাংক থেকে বের হয়ে এলো। তার বাম হাতে চামড়ার অ্যাটাশি কেস। ডান হাতে একটা হোলস্টারকে আড়াল ক’রে রেখেছে সে। কেটার পাশে এক টুকরো কাটা অংশ দূর থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
জেসন তার শার্টের পকেটে চামড়ার টুকরোটা অনুভব করলো। কোনো অঘটন না ঘটলে এটা তাকে প্যারিস আর কার্লোসের কাছ থেকে বহু দূরে নিয়ে যাবে। এরকম কোনো জীবন যদি থেকে থাকে তবে সে কোনো রকম গোলক-বাঁধা ছাড়াই সেটা গ্রহণ করতে পারবে। যে গোলকধাঁধা থেকে সে পালাতে পারছে না।
কিন্তু এটা তার চেয়েও বেশি। মানুষের তৈরি গোলকধাঁধায় নড়াচড়া করা যায়, কিন্তু তার নিজের গোলকধাঁধাটা একেবারেই অন্যরকম। কোনো গলি বা দেয়াল নেই। আছে কেবল শূন্যতা। রাতের বেলায় সে যখন দুঃস্বপ্ন দেখে, কেবল অন্ধকার, টের পায় প্রবল বাতাস আর পানিতে তলিয়ে যাওয়া। কেন এরকমটি হয়? প্যারাসুট? তারপর কিছু শব্দ আসে। কোত্থেকে আসে তার কোনো ধারণাই নেই। তবে কথাগুলো শোনা যায়।
তোমার স্মৃতি চলে গেলে আর থাকে কি? আর তোমার পরিচয়? মি: স্মিথ? বন্ধ করো!
ভ্যানটা রুই মেদেলিন দিয়ে চলতে শুরু করলো। বর্ন পেছন থেকে ড্রাইভারের কাঁধে মৃদু চাপড় মেরে বললো, “ঐ ভ্যানটা অনুসরণ করো, তবে মাঝখানে কমপক্ষে দুটো গাড়ি রেখে,” ফরাসিতে বললো সে।
ড্রাইভার ঘুরে বললো, “মনে হয় আপনি ভুল ট্যাক্সি বেছে নিয়েছেন, মঁসিয়ে। আপনার টাকা আপনি ফিরিয়ে নিন।”
“আরে বোকা, আমি ঐ ভ্যানটার কোম্পানিতেই কাজ করি। এটা স্পেশাল একটা কাজ।”
“মাফ করবেন, মঁসিয়ে। তাহলে ঐ ভ্যানটাকে কোনো ভাবেই ছাড়ছি না।
ট্যাক্সিটা ভ্যানের পেছন পেছন নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলতে শুরু করলো। পন্ত নোয়েফ থেকে দুই-তিন ব্লক দূরে একটা বৃজের কাছে আসতেই ভ্যানটা ধীরগতির হয়ে গেলো। এখন তিনটা বাজতে তিন মিনিট বাকি। এক ব্লক দূরে ভ্যানটা থামার কথা থাকলেও থামছে কেন? থেমে গেলো। কেন? ট্রাফিক সিগনাল?…হায় ঈশ্বর, অবশ্যই ট্রাফিক সিগনাল!
“এখানেই রাখো,” ড্রাইভারকে বর্ন বললো। “ঐ মোড়টা দ্রুত পার হও!”
“কি হয়েছে, মঁসিয়ে?”
“তুমি খুব ভাগ্যবান,” জেসন বললো। “আমার কোম্পানি তোমাকে আরো বাড়তি একশ’ ফ্রাঁ দেবে যদি তুমি ঐ ভ্যানটার সামনে গিয়ে ড্রাইভারের সাথে কিছু কথা বলো।”
“কি?”
“সত্যি বলতে কি, আমরা তার পরীক্ষা নিচ্ছি। সে একেবারে নতুন। তুমি কি একশ’ ফ্রাঁ চাও?”
“আমি খালি সামনে গিয়ে কিছু কথা কথা বলবো?”
“হ্যা। বড়জোড় পাঁচ সেকেন্ড, তারপর তুমি তোমার ট্যাক্সিতে ফিরে আসবে।”
“কোনো সমস্যা হবে না তো? আমি আসলে কোনো ঝামেলা চাই না।”
“আমার ফার্মটা ফ্রান্সে খুবই নামী প্রতিষ্ঠান। তুমি আমাদের ট্রাক-ভ্যান সব জায়গায় দেখতে পাবে!”
“বুঝতে পারছি না…”
“তাহলে বাদ দাও!” বর্ন দরজা খুলতে উদ্যত হলো।
“কি কথা বলতে হবে?”
জেসন একশ’ ফ্রাঁ’র নোটটা বের ক’রে হাতে নিলো। “কেবল এটা বলবে : ‘হের কোয়েনিগ। জুরিখ থেকে আপনার জন্যে শুভেচ্ছা।’ মনে থাকবে তো?”
“কোয়েনিগ। জুরিখ থেকে আপনার জন্যে শুভেচ্ছা।’ কি আর এমন কঠিন কাজ?”
“তুমি? আমার পেছনে?”
“ঠিক আছে।”
একসাথে ভ্যানটার দিকে পা বাড়ালো তারা। ভ্যানটা কার্লোসের একটা ফাঁদ, ভাবলো বর্ন। গুপ্তঘাতক একটা আরমোড ভ্যান নিয়ে এসেছে। একজন কুরিয়ার সেজে। ভ্যানটার কাছে আসতেই জেসন ট্যাক্সি ড্রাইভারের হাতটা ধরে তাকে থামালো। তার হাতে আরো দুশ’ ফ্রাঁ নোট ধরিয়ে দিলে লোকটা নোটগুলোর দিকে হা ক’রে চেয়ে রইলো।
“মঁসিয়ে?”
“আমার কোম্পানি খুবই উদার। এই লোকটাকে আরো কিছু শিক্ষা দিতে হবে, নতুন তো, তাই তাকে একটু বাজিয়ে দেখতে হচ্ছে।”
“কি করতে হবে, মঁসিয়ে?”
“‘হের কোয়েনিগ। জুরিখ থেকে আপনার জন্যে শুভেচ্ছা,’ বলার পর খালি বলবে, “শিডিউলটা একটু বদলে ফেলা হয়েছে। আমার ট্যাক্সিতে একজন আছেন, যিনি আপার সঙ্গে দেখা করবেন,’ বুঝলে?”
ড্রাইভার নোটগুলোর দিকে তাকালো। “এটা এমন কি কঠিন কাজ?” টাকাটা নিতে নিতে বললো সে।
জেসন ভ্যানটার স্টিলের দেয়ালের পাশে সেঁটে রইলো। তার ডান হাত কোমরে গোঁজা পিস্তলটার উপর। সামনের জানালার দিকে গিয়ে কাঁচে টোকা মারলো ড্রাইভার।
“এই যে, তোমাকে বলছি! হের কোয়েনিগ! জুরিখ থেকে তোমার জন্যে শুভেচ্ছা!” সে জোরে জোরে বললো কথাটা।
কাঁচটা দুই ইঞ্চির মতো নেমে গেলো। “কি হয়েছে?” বেশ জোরে একটা কণ্ঠ পাল্টা বললো। “আপনার তো পন্ত নোয়েফে থাকার কথা, মঁসিয়ে!”
ড্রাইভার কোনো গর্দভ নয়। সেও চাচ্ছে যতো দ্রুত সম্ভব চলে যেতে। “আমি না, গর্দভ!” সে পেছনের দিকে ইঙ্গিত করলো। “আমি তোমাকে সেটাই বলছি যা আমাকে বলা হয়েছে! শিডিউলটা বদলে ফেলা হয়েছে। পেছনে একজন আছে, সে তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে!”
“তাকে বলো তাড়াতাড়ি আসতে,” জেসন পাশ থেকে আরেকটা পঞ্চাশ ফ্রাঁ’র নোট হাতে তুলে ধরে নিচু স্বরে বললো।
ড্রাইভার টাকাটার দিকে তাকিয়ে আবার কুরিয়ারের কাছে ফিরে গেলো। “তাড়াতাড়ি করো! যদি নিজের চাকরিটা বাঁচাতে চাও এক্ষুণি তার সাথে দেখা করো!”
“এবার এখান থেকে চলে যাও!” বললো বর্ন। ড্রাইভারও সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলো। বর্ন নিজের জায়গায়ই রইলো। ভ্যানটার ভেতর থেকে একটা কণ্ঠ শুনে আচমকা সে সতর্ক হয়ে উঠলো। একজন লোক ওয়্যারলেসে কিছু বলছে না, বরং দু’জন লোক একে অন্যের সাথে কথা বলছে।
“এইসব কথাবার্তা তো তুমি শুনেছো।”
“সে তোমার কাছে আসবে। সে নিজেই আসবে।”
“সে তাই করবে। চামড়ার টুকরোটা দেখাবে। যা একেবারে খাপে খাপে মিলতে হবে! তুমি কি আশা করো এই কাজটা আমি এরকম জনাকীর্ণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করবো?”
“আমার এটা পছন্দ হচ্ছে না!”
“তুমি আমাকে টাকা দিয়েছো তোমাকে সাহায্য করার জন্যে, তোমার লোকজন অন্য কাউকে খুঁজে নিয়েছে। চাকরি হারাবো না আমি। আমি যাচ্ছি!”
“এটা অবশ্যই পন্ত নোয়েফে হবে!
“আমার পাছায় চুমু খাও!”
ধাতব মেঝেতে ভারি পায়ের শব্দ শোনা গেলো। “আমি তোমার সাথে আসছি!” প্যান দরজাটা খুলে গেলে জেসন দ্রুত সেটার পেছনে চলে গেলো। তার পেছনে একটা গাড়িতে এক বাচ্চা ছেলে নিজের মুখ কাঁচে লাগিয়ে তাকে দেখছে। তার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটছে সে। গাড়ির হর্নের শব্দ হচ্ছে আশেপাশে। গাড়িগুলো সব থেমে আছে।
ডান হাতে একটা লোহার শিক নিয়ে গাড়ি থেকে নামলো কুরিয়ার। বর্ন প্রস্তুত। কুরিয়ার রাস্তায় নামতেই সে দরজার ডালাটা দিয়ে দ্বিতীয় লোকটাকে সজোরে আঘাত করলে লোকটা চিৎকার দিলো। ধাক্কা ধেয়ে ভ্যানের ভেতর পড়ে গেলো সে। জেসন কুরিয়ারের দিকে চিৎকার ক’রে বললো, তার হাতে চামড়ার টুকরোটা ধরা।
“আমি বর্ন! এই যে তোমার চামড়ার অংশটা! তুমি তোমার পিস্তল হোলস্টারেই রাখো, নইলে কেবল চাকরিই খোয়াবে না, প্রাণটাও হারাবে। বানচোত!”
“আমি কোনো ক্ষতি করবো না, মঁসিয়ে। তারা আপনাকে খুঁজে বের করতে চায়! আপনার ডেলিভারি নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। আমার কথা একদম সত্যি!”
দরজাটা ধপাস ক’রে খুলে গেলে জেসন তার কাঁধ দিয়ে ধাক্কা মেরে আবারো সেটা বন্ধ ক’রে দিলো। তারপর আবারো সেটা খুলে কার্লোসের সৈনিকের চেহারাটা দেখতে চাইলো সে। তার হাত বেল্টে গোজা অস্ত্রটার উপর।
সে যা দেখতে পেলো, তা হলো একটা অস্ত্রের নল। তার দিকে তাক করা। সে ঘুরে সরে গেলো। জানে এক মূহূর্ত দেরি হলেই গুলিটা তাকে ঘায়েল করবে। অ্যালার্মটা চালু ক’রে দিলে তার তীব্র শব্দে কানে তালা লাগার যোগাড় হলো। বিশৃঙ্খলা দেখা গেলো রাস্তায়। কালো পিচের রাস্তায় একটা গুলিবিদ্ধ হলেও তার শব্দ পাওয়া গেলো না।
আরেকবার জেসন দরজার ডালায় আঘাত করলে মেটালের সাথে মেটালের আঘাত লাগার শব্দ শুনতে পেলো সে। কার্লোসের সৈনিকের অস্ত্রটাতে সে আঘাত করতে পেরেছে। নিজের অস্ত্রটা হাতে নিয়ে নিলো। রাস্তায় হাটু মুড়ে ব’সে পড়ে দরজাটা টেনে খুলতেই জুরিখের লোকটাকে দেখতে পেলো সে। এই খুনিটাকে তারা জোহান নামে ডাকে। একে প্যারিসে নিয়ে এসেছে তাকে চিনিয়ে দেয়ার জন্যে। বর্ন পরপর দুটো গুলি করলে লোকটা পেছন দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো। তার কপাল বেয়ে রক্ত পড়ছে।
কুরিয়ার লোকটা। অ্যাটাশি কেসটা!
জেসন তাকে দেখতে পেলো। সে গাড়ির নিচে হামাগুড়ি দিচ্ছে, তার হাতে অস্ত্র। সাহায্যের জন্যে চিৎকার করছে সে। বর্ন ঝট ক’রে উঠে দাঁড়িয়ে অস্ত্রটার নল ধরে ফেললো। সেটা মুচড়িয়ে কেড়ে নিলো কুরিয়ারে হাত থেকে। অ্যাটাশি কেসটা আঁকড়ে ধরে চিৎকার করতে শুরু করলো লোকটা।
“কোনো ক্ষতি করবো না, ঠিক আছে? এটা আমাকে দে, বানচোত!” অ্যাটাশি কেটা ছিনিয়ে নিয়ে লোকটার অস্ত্র ভ্যানের নিচে ছুড়ে ফেলে দিয়ে পথের উন্মাদগ্রস্ত লোকজনের মধ্যে হারিয়ে গেলো সে।
রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছে জেসন। তার সামনের ছুটে চলা লোকগুলো গোলকধাঁধার এক দেয়াল। তবে যে গোলকধাঁধার মধ্যে তার বসবাস, সেটার সাথে এর পার্থক্য আছে। এখানে কোনো অন্ধকার নেই। বিকেলের সূর্যটা খুবই উজ্জ্বল। গোলকধাঁধা দিয়ে তার ছুটে চলার মতোই তীব্র।