অধ্যায় ১২
দোকানের দিকে গেলো তারা, কাউন্টার থেকে কাউন্টারে কথা বললো। মেরি অবশ্য জানালার পাশেই রইলো কিন্তু চোখ রাখলো রুই মেদেলিনের ব্যাঙ্কের প্রবেশদ্বারের দিকে।
“আমি তোমার জন্যে দুটো স্কার্ফ নিয়েছি,” বৰ্ন বললো।
“তার তো কোনো দরকার ছিলো না। এখানকার দাম অনেক বেশি।”
“এখন প্রায় চারটা বাজে। সে যদি এখন না বেরিয়ে আসে তবে অফিস আওয়ার শেষ হবার আগে বের হয়ে আসবে না।”
“হয়তো না। সে যদি কারো সাথে দেখা করতে যায়, ইতিমধ্যে সেটা সেরে ফেলেছে। তবে আমাদেরকে সেটা জানতে হবে।”
“আমার কথাটা মনে রেখো, তার বন্ধুরা এখন অরলিতে আছে। প্লেন থেকে প্লেনে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তারা কোনোভাবেই বলতে পারবে না আমি প্লেনে যাচ্ছি, নাকি যাচ্ছি না। কারণ তারা জানে না আমি কোন্ নামটা ব্যবহার করছি।”
“তারা জুরিখের লোকটার উপর নির্ভরশীল, কেননা সে-ই কেবল তোমাকে চেনে।”
“সে কালো চুলের খোঁড়া এক লোককে খুঁজবে, আমাকে নয়। আসো, ব্যাঙ্কে যাই। তুমি দামাকোর্তকে দেখিতে দিতে পারবে।”
“সেটা সম্ভব নয়,” মাথা দোলাতে দোলাতে মেরি বললো। “সিলিংয়ের ক্যামেরাগুলোর লেন্স ওয়াইড অ্যাঙ্গেলের। তারা যদি টেপ চালিয়ে দেখে তো তোমাকে চিহ্নিত করতে পারবে।”
“আমাকে নয়, সোনালী চুলের চশমা পরা এক লোককে।”
“অথবা আমাকে। আমি ওখানে গেছি। রিসেপনশনিস্ট অথবা সেক্রেটারি মেয়েটা আমাকে চিনতে পারবে।”
“তুমি বলছো ওখানে নিয়মিত ক্যামেরাগুলোর টেপ চেক করা হয়। আমার তাতে সন্দেহ আছে।”
“অনেক কারণেই তারা টেপটা চালিয়ে দেখতে পারে,” মেরি থেমে জেসনের হাতটা ধরলো। তার চোখ জানালার বাইরে ব্যাঙ্কের দিকে। “ঐ তো। ওভারকোট আর কালো ভেলভেটের কলার পরা দামাকোর্ত!”
“হাতা গোটাচ্ছে যে লোকটা?”
“হ্যা।”
“ঠিক আছে। আমি তোমার সাথে হোটেলে দেখা করছি।”
“সাবধানে থেকো। খুব সাবধানে।”
“কাউন্টারে স্কার্ফটার টাকা দিয়ে দিও।”
স্টোর থেকে বের হয়ে গেলো জেসন। দামাকোর্ত ডান দিকে মোড় নিয়ে হেলেদুলে হেটে যাচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না কারো সাথে দেখা করতে যাচ্ছে সে। ব্যাংকারের পেছন পেছন চলতে লাগলো জেসন। দামাকোর্ত একটা সংবাদপত্র বিক্রয় কেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে একটা পত্রিকা কিনলো। ঠিক পাশেই একটা খেলার সামগ্রীর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো জেসন। তারপর আবারো ব্যাংকারকে অনুসরণ করতে শুরু করলো সে।
সামনে একটা ক্যাফে। জানালাগুলোতে কালো রঙের কাঁচ লাগালো। প্রবেশ দরজাটা ভারি কাঠের। ভেতরটা কেমন সেটা ভাবার জন্যে কল্পনা করার কোনো দরকার নেই। এটা হলো পুরুষদের ড্রিংক করার একটি জায়গা। এখানে নারীরা কেবল পুরুষ সঙ্গী নিয়েই আসতে পারে। জায়গাটা আতোয়া দামাকোর্তের সঙ্গে আলাপ করার জন্যে উপযুক্ত জায়গা। জেসন দ্রুত হেটে দামাকোর্তের পাশে চলে এলো। ফোনে যে ভাষায় কথা বলেছিলো সেই ভাষা আর বাচন ভঙ্গীতে বললো সে।
“বজুঁখ মঁসিয়ে। জো…পেঁয়া কুয়ে ভু…এত মঁসিয়ে দামাকোর্ত। আপিনই তো, তাই না?”
ব্যাঙ্কার থেমে গেলো। তার শীতল চোখ দুটোতে ভয় জেঁকে বসেছে। “বর্ন?” ফিফিস্ ক’রে বললো সে।
“আপনার বন্ধুরা এখন খুবই গোলমালের মধ্যে পড়ে যাবে। আমি আশা করছি তারা এখন অরলি বিমান বন্দরটা চষে বেড়াচ্ছে। হয়তো ভাবছে আপনি তাদেরকে ভুল তথ্য দিয়েছেন। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই।”
“কি?” তার ভয়ার্ত চোখ দুটো আরো বড় হয়ে গেলো।
“আসুন ভেতরে ঢুকি,” দামাকোর্তের হাতটা শক্ত ক’রে ধরে জেসন বললো। “মনে হচ্ছে আমাদের কথা বলতে হবে।”
“আমি কিছুই জানি না! আমি কেবল একাউন্টের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করেছি। আমি এসবে জড়িত নই!”
“দুঃখিত। আমি যখন আপনার সঙ্গে প্রথমে কথা বলেছিলাম আপনি বলেছিলেন এরকম একাউন্টের বেলায় আপনারা টেলিফোনে কোনো তথ্য দেন না। আপনি যাকে চেনেন না তার সাথে এ সংক্রান্ত কোনো আলোচনা করবেন না। কিন্তু বিশ মিনিট বাদে আপনি বললেন সব রেডি ক’রে রেখেছেন। এটা কি ঠিক হলো? ভেতরে চলুন।”
ক্যাফের ভেতরটা অনেকটা জুরিখের ড্রেই এলপেনহসারের ক্ষুদ্র সংস্করণ। পার্টিশনগুলো উঁচু উঁচু আর ভেতরের জ্বলছে ডিম লাইট।
বর্ন কর্নারের একটা বুথে গিয়ে বসলো।
“ড্রিংক করবেন,” বললো জেসন। “এটা আপনার দরকার হবে।”
“আপনার ধারণাই ঠিক,” ব্যাংকার শীতল কণ্ঠে জবাব দিলো। “আমি হুইস্কি নেবো।” ড্রিংক আসার আগে সংক্ষিপ্ত সময়টাতে দামাকোর্ত নার্ভাসভাবে একটা সিগারেট ধরালো। বর্নই ম্যাচ দিয়ে জ্বালিয়ে দিলো সিগারেটটা।
“মাখসি।” দামাকোর্ত সিগারেটে একটা টান দিয়ে এক চুমুক হুইস্কি পান করলো। “আমার সাথে আপনার কথা বলে কোনো লাভ হবে না,” বললো সে।
“তাহলে কার সাথে বললে লাভ হবে?”
“হয়তো ব্যাংকের একজন মালিকের সাথে তবে আমি সেটা জানি না। আমি নই, সেটাই কেবল বলতে পারি।”
“খুলে বলুন।”
“সরকারী ব্যাংকের তুলনায় বেসরকারী ব্যাংকগুলো তার স্টক হোল্ডারদের সাথে অনেক বেশি যোগাযোগ রাখে।”
“কি রকম?”
“এখানে অনেক বিষয়ে অনেক বেশি সুযোগ রয়েছে। বিশেষ কোনো ক্লায়েন্ট কিংবা সিস্টার ব্যাংককে তালিকাভুক্ত কোম্পানির চেয়ে অনেক কম অনুসন্ধান করা হয়। গেইমেনশেফট ব্যাংক জুরিখ হলো এরকমই একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান।”
“গেইমেনশেফট থেকে এরকম ডিমান্ড করা হয়েছিলো?”
“ডিমান্ড…অনুরোধ…বলতে পারেন সেরকমই। “ভালোয়ার মালিক কে?”
“কে? অনেকেই—এটা একটা কনসোর্টিয়াম। দশ থেকে বারোজন লোক এবং তাদের পরিবার পরিজন জড়িত এখানে।”
“তাহলে আমি আপনার সাথেই কথা বলবো, তাই না? মানে, সারা প্যারিস চষে বেড়ানোটা তো আমার পক্ষে একটু বোকামীই হয়ে যাবে।”
“আমি কেবল একজন এক্সিকিউটিভ। সামান্য কর্মচারী,” বাকি মদগুলো পান ক’রে দামাকোর্ত বললো। আরেকটা সিগারেট ধরানোর জন্যে ম্যাচ তুলে নিলো সে।
“কি কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?”
“আমি আমার চাকরি হারাতে পারি, মঁসিয়ে।”
“আপনি আপনার জীবনটাও হারাতে পারেন, মঁসিয়ে,” জেসন বললো। কথাটা খুব সহজেই তার মুখ দিয়ে বের হলো ব’লে একটু বিব্রতও হলো সে।
“আপনি যেরকমটি ভাবছেন সে রকম কোনো কাজ আমি করি নি।”
“আপনি নিজেকে যতোটা অজ্ঞ হিসেবে আমার কাছে তুলে ধরছেন সেটা আমি মোটেই বিশ্বাস করি না,” বললো জেসন বর্ন। “আপনার মতো লোক সবখানেই আছে। আপনার মতো একজন লোক ভালোয়াঁ ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ তো আর এমনি এমনি পাবে না। আপনি নিজেকে আড়াল করছেন। আপনি নিজের পাছা বাঁচানোর আগপর্যন্ত কোনো কিছু করেন না। এখন বলুন, কি ধরণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? আপনি আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন। আমি কি পরিস্কার বোঝাতে পারছি?”
দামাকোর্ত ম্যাচ থেকে কাঠি বের ক’রে জেসনের দিকে তাকালো। “আমাকে কোনো হুমকী দেবার দরকার নেই আপনার। আপনি অনেক ধনী। আমাকে তাহলে এজন্যে টাকা দিচ্ছেন না কেন?” ব্যাংকার নাভার্সভাবে হাসলো। “আপনি ঠিকই বলেছেন। প্যারিস তো আর জুরিখ নয়।”
বর্ন একটু পেছনে হেলে ব’সে চোখের চশমাটা খুলে ফেললো। “একটা নায্য দাম বলুন,” অবশেষে বললো সে, “আমরা সেটা নিয়ে আলোচনা করবো।”
“মূল্যটা আপনার হাতেই ছেড়ে দিলাম। সারা বিশ্বের ব্যাংকাররাই তাদের ক্লায়েন্টের কাছে কৃতজ্ঞ থাকে। আমি আপনাকে একজন ক্লায়েন্ট হিসেবেই দেখতে চাই।”
“আমিও নিশ্চিত আপনি তা করবেন,” বর্ন হেসে লোকটার দিকে চেয়ে মাথা নাড়লো। “তাহলে আমরা ঘুষ থেকে সরে গিয়ে কৃতজ্ঞতায় স্থানান্তরিত হলাম।”
দামাকোর্ত কাঁধ ঝাঁকালো। “আমি আপনার কথাটা মেনে নিচ্ছি। আপনি কি প্রশ্নটা আবার করবেন?”
“কি কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?”
“জুরিখ থেকে আমাদের ব্যাংকে কোনো তহবিল ট্রান্সফার করলে সেটা উনে ফিশে কনফিদেনতেইল—”
“উনে ফিশে?” জেসন বললো। গেইমেনশেফট ব্যাংকে এপফেলের অফিসের কথা মনে পড়ে গেলো তার। “কথাটা আগেও আমি শুনেছি। সেটা কি?”
“এটা আসলে পুরনো একটা শব্দ। এসেছে ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে। ঐ সময় ব্যাংকিং হাউজগুলোতে এর চর্চা হেতো।”
“ধন্যবাদ আপনাকে। এবার বলুন, এর বিশেষত্ব কি?”
“একাউন্টটার ব্যাপারে যখন কোনো প্রশ্ন তোলা হয় তখন ভিন্ন ভিন্ন সিল করা তথ্যগুলো খোলা হয়।”
“প্রশ্ন তোলা?”
“তহবিল সরানো অথবা জমা করা।”
“ধরুণ আমি একজন টেলারের কাছে গেছি, একটা ব্যাংক বই উপস্থিত ক’রে টাকা চাইলাম?”
“ট্রানজাকশান কম্পিউটারে একটা ডাবল তারকা চিহ্ন ভেসে উঠবে। আপনাকে পাঠিয়ে দেয়া হবে আমার কাছে।”
“যেভাবেই হোক আমাকে আপনার কাছে পাঠানো হবে। অপারেটর আমাকে আপনারই নাম্বার দিয়েছিলো।”
“ফরেন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে আরো দু’জন অফিসার আছে। যেকোনো একজনের সাথে আপনাকে যদি সংযোগ দেয়া হয় ফিশেটা ডিটেক্ট করতো যে, আপনাকে আমার কাছে পাঠানো হবে। আমি একজন সিনিয়র এক্সিকিউটিভ।”
“বুঝেছি,” কিন্তু বর্ন আসলে বোঝে নি। এই ব্যাপারটায় একটা ফাঁক রয়েছে। সেটা পূরণ করা দরকার। “দাঁড়ান। আপনার অফিসে কোনো একাউন্ট পাঠানো হলে আপনি ফিশের ব্যাপারে কিছু জানেন না।”
“আমি কেন সেটা জিজ্ঞেস করবো?” দামাকোর্ত একটা প্রশ্ন হবে অনুমান ক’রে বললো। “একটু যৌক্তিক হোন, মঁসিয়ে। নিজেকে আমার জায়গায় ভাবুন। এক লোক ফোন ক’রে নিজের পরিচয় দিলো, তারপর সে বললো চার মিলিয়ন ফ্রাঁ’র ব্যাপারে কথা বলবে। চার মিলিয়ন। আপনি কি উদ্বিগ্ন হবেন না? এখানে সেখানে আইনের ব্যত্যয় ঘটাবেন?”
ব্যাঙ্কারের দিকে তাকিয়ে জেসন বুঝতে পারলো যে কথাটা সে বলেছে সেটা কোনো চমকে দেয়ার মতো কথা নয়। “নির্দেশগুলো কি ছিলো?”
“তালিকাভূক্ত নয় এমন একটা টেলিফোন নাম্বার দিয়ে ফোন করা হয়েছে, সব তথ্য রিলে করা হয়েছে।”
“আপনার কি নাম্বারটা মনে আছে?”
“এরকম স্মৃতিশক্তি আমার নেই।”
“আমি বাজি ধরে বলবো আপনি মনে রেখেছেন। সেটা কি, বলুন?”
“আমার নিজেকে রক্ষা করতে হবে, মঁসিয়ে।”
“তার মানে আপনার কাছে জবাবটা আছে। সেটা আমি কিভাবে পেতে পারি “এই জুরিখে, কেবল ব্যানহফস্ট্রাস ব্যাংকেরই নয়, সুইজারল্যান্ডের সবচাইতে কঠিন আইনটি ভাঙার জন্যে আপনাকে অনেক টাকা দিতে হবে।”
“লোকটা কে, সেটা আমি জানি,” বর্ন বললো, কোয়েনিগের মুখটা ভেসে উঠলো তার চোখের সামনে। “সে ইতিমধ্যেই এই অপরাধটি করেছে।”
“গেইমেনশেফটে? আপনি ঠাট্টা করছেন?”
“মোটেও না। তার নাম কোয়েনিগ, তৃতীয় তলায় তার ডেস্ক!”
“আমার সেটা মনে থাকবে।”
“আমি নিশ্চিত তা থাকবে। নাম্বারটা?”
দামাকোর্ত তাকে সেটা দিলে জেসন পেপার ন্যাপকিনে নাম্বারটা লিখে রাখলো। “আমি কি ক’রে জানবো এটা সঠিক?”
“আপনার কাছে সেটার যথার্থ একটা ইন্সুরেন্স আছে। আমাকে এখনও এর জন্যে কোনো টাকা দেন নি আপনি।”
“বেশ।”
“যতোক্ষণ না আমাদের আলোচনায় টাকার ব্যাপারটা প্রধান আর মুখ্য বিষয় থাকবে, ততোক্ষণ আমি বলবো এটা হলো দ্বিতীয় টেলিফোন নাম্বার। প্রথমটা বাতিল করা হয়েছে।”
“খুলে বলুন।”
দামাকোর্ত সামনের দিকে ঝুঁকে এলো। “অরিজিনাল ফিশের একটা ফটোকপি একাউন্ট-কুরিয়ারের সাথে আসে। সেটা কালো রঙের একটা কেসে সিল মারা থাকে। সেই রেকর্ড সিনিয়র কিপারের কাছে গেলে তিনি স্বাক্ষর দিয়ে সেটা ছেড়ে দেন। ভেতরের কার্ডটা গেইমেনশেফট ব্যাংকের একজন অংশীদার কর্তৃক অনুমোদন করা থাকে। সুইস নোটারি কর্তৃক সাধারণ কাউন্টার সাইন করা হয়। নির্দেশগুলো খুব সহজ সরল। খুবই পরিস্কার। সব কিছুই জেসন সি. বর্নের একাউন্ট সংশ্লিষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রে একটা ট্রান্স আটলান্টিক কল করা হবে সঙ্গে সঙ্গে, সব কিছু রিলে করা হবে…এখানে কার্ডটা বদলে ফেলে নিউইয়র্কে নাম্বারটা মুছে ফেলা হবে। প্যারিসের একটা নাম্বার ঢুকিয়ে দিয়ে ইনিশিয়াল দেয়া হবে।”
“নিউইয়র্ক?” বন বাঁধা দিয়ে বললো। “আপনি কিভাবে জানলেন এটা নিউইয়র্কের?”
“টেলিফোনের এরিয়া কোডটা সংযুক্ত করা থাকে নাম্বারটার ঠিক আগেই। সেটা খোলা হয় না। অক্ষতই থাকে। এরিয়া কোডটা হলো ২১২। ফরেন সার্ভিসের একজন প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমাকে এরকম কল প্রতিদিন করতে হয়।”
“বদলে ফেলাটা খুবই সহজ দেখছি।”
“সম্ভবত। সেটা খুব দ্রুত করা হতে পারে। অথবা পুরোপুরি না বুঝেই। অন্যথায়, পুণরায় নোটারি করা ছাড়া নির্দেশগুলো মুছে ফেলার কোনো সুযোগ নেই। নিউইয়র্কের ফোনগুলোর নাম্বারের জন্যে একটা ছোট্ট ঝুঁকি নিতে হয়। যেভাবেই হোক, এরফলে আমার এক বা একাধিক প্রশ্ন করার অধিকার জন্মে যায়। যে কোনো ধরণের পরিবর্তন একজন ব্যাংকারের কাছে সবচাইতে অপছন্দের বিষয়।” দামাকোর্ত তার বাকি মদটুকু খেয়ে ফেললো।
“আরেকটু নেবেন?” জানতে চাইলো জেসন।
“না, ধন্যবাদ আপনাকে। এতে ক’রে আমাদের আলোচনা লম্বা হয়ে যাবে।”
“আপনিই হলেন সেই ব্যক্তি যে এটা দ্রুত শেষ করতে পারে।”
“আমি ভাবছি, মঁসিয়ে। আমি শুরু করার আগে আপনার মনে হয়তো অস্পষ্ট কোনো সংখ্যা উঁকি দিচ্ছে।”
“এটা হতে পারে পাঁচ,” বললো বর্ন।
“পাঁচ কি?”
“পাঁচ অঙ্কের।”
“আমি বলছি। এক মহিলার সাথে কথা বলেছি আমি—”
“একজন মহিলা? আপনি কিভাবে শুরু করলেন?”
“সত্যি সত্যি বলছি। আমি ভালোয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট। আমাকে জুরিখের গেইমেনশেফটের নির্দেশ অনুসরণ করতে হয়। এখানে আর কি বলার আছে?”
“বলে যান।”
“আমি বলেছি আমার সাথে জেসন বর্ন নামের একজন লোক যোগাযোগ করেছে। মহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করলো কয় দিন আগে, জবাবে আমি বললাম কয়েক মিনিট আগে। তারপর মহিলা আমাদের কথাবার্তা জানার জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। তখনই আমি আমার উদ্বেগের কথাটা তাকে বললাম। ফিশে’তে নির্দিষ্ট ক’রে বলা ছিলো প্যারিসে নয়, নিউইয়র্কে ফোন করতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই মহিলা বললো এটাতে আমার উদ্বেগের কিছু নেই। আর পরিবর্তনটা আমার স্বাক্ষরে অথোরাইজ করা হবে। আমি জুরিখকে এটা জানানোর তাগিদ অনুভব করলাম যে, ভালোয়া’র একজন অফিসার গেইমেনশেফটের নির্দেশ মানতে অস্বীকার করছে।”
“রাখেন, রাখেন,” জেসন বাঁধা দিয়ে বললো। “মহিলাটি কে?”
“সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই।”
“তার মানে আপনি তার সঙ্গে এতো কথা বললেন আর সে আপনাকে তার নামটা পর্যন্ত বলে নি? আপনিও জিজ্ঞেস করেন নি?”
“এটাই তো ফিশের নিয়ম। যদি কোনো নাম বলা হয় তো ভালো। কিন্তু না বলা হলে সেটা জানতে চাওয়া হয় না। কেউ সেটা করবেও না।”
“টেলিফোন নাম্বারটা চাইতে কিন্তু আপনি ইতস্তত করেন নি।”
“আমি তথ্য চেয়েছি। আপনি সাড়ে চার মিলিয়ন ফ্রাঁ ট্রান্সফার করেছেন, বিপুল পরিমাণের টাকা। বিশেষ ক’রে ক্লায়েন্ট যদি উদ্বিগ্নতার সাথে কথা বলে তখন একটু খোঁজ নিতেই হয়। আবার কোনো তথ্য থাকলেও একটু সতর্ক হতে হয়। আমি আপনাকে আশ্বস্ত করছি, মহিলা ঐ রকমই কিছু বলেছে।”
“কি বলেছে?”
“আপনাকে একজন বিপজ্জনক ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।”
“কোন্ দিক থেকে?”
“স্পষ্ট ক’রে কিছু বলে নি। তবে আমি জানতে চেয়েছিলাম এ ব্যাপারে সুরেত কেন জড়িত নয়। মহিলার জবাবটা ছিলো একেবারেই কৌতুহলোদ্দীপক। ‘সুরেত আর ইন্টারপোলের চেয়েও বড় কিছু জড়িত আছে এ ঘটনায়,’ মহিলা বলেছে।
“এতে আপনি কি বুঝলেন?”
“যেকোনো বিচারেই এটি একটি জটিল ব্যাপার। তবে আপনার সাথে কথা বলে আমি অন্য কিছু বুঝতে পারছি।”
“সেটা কি?”
“সেটা হলো, আপনি আমাকে আসলেই বেশ ভালো অঙ্কের টাকা দেবেন, এজন্যে আমি অসম্ভব সাবধান থাকবো। আপনাকে যারা খুঁজছে তারা সুরেত আর ইন্টারপোলের চেয়েও বেশি শক্তিশালী।”
“এ বিষয়ে আমরা পরে কথা বলবো। আপনি সেই মহিলাকে বলেছিলেন, আমি আপনার অফিসে আসছি?”
“বলেছি পনেরো মিনিটের মধ্যে আপনি আসছেন। মহিলা আমাকে বললো টেলিফোনে আরো কিছুক্ষণ আপনার সাথে কথা চালিয়ে যেতে। তারপর মহিলা আরেকটা ফোন ক’রে ফিরে এসে তার চূড়ান্ত নির্দেশগুলো জানালো। আপনাকে যেনো আমার অফিসে আঁটকে রাখা হয়, যতোক্ষণ না আমার সেক্রেটারির কাছে একজন লোক এসে জুরিখের ব্যাপারে তদন্ত করে। আর আপনি যখন চলে যাবেন, তখন আপনাকে ইশারা অথবা ইঙ্গিতের সাহায্যে চিহ্নিত করা হয়। এতে যেনো কোনো ভুল না হয়। অবশ্যই লোকটা এসেছিলো, তবে আপনি আর এলেন না। তারা অপেক্ষা করলো। কিন্তু আপনি যখন ফোন ক’রে আমাকে জানালেন আপনি লন্ডনে যাচ্ছেন, আমি আমার অফিস থেকে বের হয়ে লোকটাকে এ কথা বললাম। বাকিটা তো আপনি জানেনই।”
“আপনার মনে কি এ প্রশ্ন জাগে নি যে, তারা আমাকে চেনে না?”
“ব্যাপারটা খুব বেশি অদ্ভুত নয়। ফিশে মানে হলো ফোনকল, মুখ দেখাদেখির ব্যাপার নেই তাতে—কিন্তু সরাসরি জড়িত হলে অবশ্য অন্য কথা। আমি মহিলাকে তাই বলেছি।”
“মহিলা আপনাকে কি বললো?”
দামাকোর্ত গলাটা পরিস্কার ক’রে নিলো। “মহিলা এটা পরিস্কার বুঝিয়ে দিলো যে, সে যাদেরকে প্রতিনিধিত্ব করে তারা আমার এই সহযোগীতার কথাটা মনে রাখবে। আপনি তো বুঝতেই পারছেন, আমি কোনো কিছুই অস্বীকার করছি না…বোঝাই যাচ্ছে, তারা জানে না আপনি দেখতে কি রকম।”
“ব্যাংকের এক লোক আমাকে জুরিখে দেখেছে।”
“তাহলে তার সহযোগীরা তার দৃষ্টিশক্তির উপরে আস্থা রাখে না।”
“আপনি এটা কেন বললেন?”
“একদম নিজস্ব বিবেচনা থেকে বলছি, মঁসিয়ে। মহিলা খুবই দৃঢ় প্রতীজ্ঞ ছিলো। আপনি অবশ্যই বুঝতে পারছেন। আমি তীব্রভাবে যেকোনো ধরণের গোপন কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে আপত্তি জানিয়েছি। এটা তো ফিশের চরিত্র নয়। মহিলা বলেছিলো আপনার কোনো ছবি নেই। অবশ্যই সেটা ডাহা মিথ্যে কথা।”
“তাই কি?”
“স্বাভাবিকভাকেই। সব পাসপোর্টেই তো ছবি থাকে। এমন কোনো ইমিগ্রেশন অফিসার আছে যাকে কেনা যায় না? পাসপোর্ট কন্ট্রোল রুমে দশ সেকেন্ডেই একটা ছবি থেকে আরেকটা ছবি বানিয়ে নেয়া যায়। না, তারা সেটা করে নি। বিশাল একটা ভুল করেছে তারা।”
“আমারও তাই মনে হয়।”
“আর আপনি,” দামাকোর্ত বলতে লাগলো। “আমাকে অন্য কিছু বলুন। হ্যা, এরজন্যে আপনাকে আসলেই বেশ মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হবে।”
“এইমাত্র আপনাকে আমি কি বললাম?”
“বললেন যে, আপনার পাসপোর্ট আপনাকে জেসন বর্ন হিসেবে চিহ্নিত করে না। আপনি কে, মঁসিয়ে?”
জেসন প্রথমে কিছু বললো না। সে তার চশমাটা আবারো ঠিক ক’রে নিলো। “এমন একজন যে আপনাকে প্রচুর টাকা দেবে,” বললো সে।
“এটাই যথেষ্ট। আপনি কেবল বর্ন নামের একজন ক্লায়েন্ট। আর আমি খুব সতর্ক থাকবো।”
“নিউইয়র্কের টেলিফোন নাম্বারটা আমি চাই। সেটা কি আপনি দিতে পারবেন? মোটা অঙ্কের টাকা দেবো।”
“যদি পারতাম তো দিতাম। তবে আমি কোনো উপায়ই দেখছি না।”
“সেটা ফিশে কার্ডটাতে তোলা আছে।”
“যখন বলেছি সেটা মুছে ফেলা হয়েছে, তার মানে এটা বোঝাচ্ছি না যে, ওটা এখনও আছে। ওটা মুছে ফেলা হয়েছে, মঁসিয়ে।”
“তাহলে সেটা জুরিখের কারো কাছে আছে।”
“অথবা সেটা ধ্বংস ক’রে ফেলা হয়েছে।”
“শেষ প্রশ্ন,” জেসন বললো। চলে যাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠলো সে। “এটা আপনাকে নিয়ে। কেবল এভাবেই আপনি টাকাগুলো পাবেন।”
“প্রশ্নটা করুন।”
“আমি যদি আপনাকে কোনো ফোন না ক’রে কোনো কিছু না বলে ভালোয়া’তে গিয়ে হাজির হই, তাহলে কি আপনি আরেকটা কল করবেন?”
“হ্যা। ফিশে কে কেউ অসম্মান করতে পারে না। এটা এসেছে শক্তিশালী বোর্ড রুম থেকে। অন্যথা করলেই চাকরি চলে যাবে।”
“তাহলে আপনি টাকাগুলো পাবেন কি ক’রে?”
দামাকোর্ত ঠোঁট কামড়ালো। “একটা উপায় আছে। এ্যাবসেনসিয়ার সাহায্যে টাকা তোলা। ফরম পূরণ করা হবে, নির্দেশনাগুলো আসবে চিঠিতে, একটা শক্তিশালী অ্যাটর্নি ফার্ম কর্তৃক আইডেন্টিফিকেশন নিশ্চিত করা হবে। তাহলে আমি আর নাক গলাবো না।”
“যদিও আপনি তখনও কল করতে পারবেন।”
“এটা সময়ের ব্যাপার। এমন একজন অ্যাটর্নি যার সাথে ভালোয়াঁ অসংখ্য কাজ করেছে সে আমাকে ফোন ক’রে প্রস্তুত করতে বললে আমি সেটা করবো। তাকে বলতে হবে সে পূর্ণাঙ্গ ফরম পাঠাবে, চেকটাসহ, তাহলে সেটা হবে ‘বিয়ারার’, বেশি ট্যাক্সের এই যুগে এটা খুব বেশি অপ্রচলিত নয়। খুবই ব্যস্ততম সময়ে একজন মেসেঞ্জোর চিঠিটা নিয়ে আসবে আর আমার সেক্রেটারি—খুবই বিশ্বস্ত একজন কর্মচারী—কাউন্টার সিগনেচার আর আমার ইনিশিয়ালের জন্যে চিঠিটা আমার কাছে নিয়ে আসবে।”
“তাতে কোনো সন্দেহ নেই,” বর্ন বললো, “অন্যান্য কাগজপত্রের সাথে আপনি সেটা সাইন ক’রে দেবেন।”
“ঠিক। তারপর আমিও একটা কল করবো, হয়তো মেসেঞ্জারকে তার বৃফকেসটাসহ চলে যেতে দেখার পরই।”
“আপনি তা করবেন না, কোনোভাবেই না। প্যারিসের কোনো ল-ফার্মের কথা কি মনে আছে আপনার? অথবা কোনো অ্যাটর্নির?”
“সত্যি বলতে কি, এইমাত্র একজনের নাম আমার মনে পড়েছে।”
“সে কতো টাকা নেবে?”
“দশ হাজার ফ্রাঁ।”
“এটা তো খুবই ব্যয়বহুল।”
“মোটেই না। সে একজন জজ ছিলো, বেঞ্চে বসতো। সম্মানিত মানুষ।”
“আর আপনার ব্যাপারটা কি হবে, আসুন, এটাও ঠিক ক’রে ফেলি।”
“যেমনটি বলেছি, আমি খুব বোধজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ। সিদ্ধান্তটা আপনার। যেহেতু আপনি উল্লেখ করেছেন পাঁচ অঙ্কের কথা, তাহলে আপনার কথা অনুযায়ী আমি পনেরো হাজার ফ্রাঁ চাইবো।”
“এটা তো অনেক বেশি!”
“আপনি যা করেছেন সেটার চেয়ে বেশি নয়, মঁসিয়ে বর্ন।”
.
“উনে ফিশে কনফিদেনশেইল,” জানালার পাশে ব’সে মেরি বললো। “তাহলে, এভাবেই তারা কাজটা করেছে, এই পদ্ধতিটাই তারা ব্যবহার করেছে।”
“আমি তোমাকে আরেকটু ইমপ্রেস করতে পারি—আমি জানি এটা কোত্থেকে এসেছে।” ব্যুরো থেকে একটা মদের বোতল নিয়ে এসে জেসন বিছানার পাশে বসে ঢাললো। “তুমি কি শুনতে চাও?”
“আমার শুনতে হবে না,” জানালা দিয়ে তাকিয়ে সে জবাব দিলো। “আমি জানি ঠিক কোত্থেকে সেটা এসেছে, আর তার অর্থ কি। এটা খুবই আশংকার কথা।”
“কেন? আমি ভেবেছিলাম তুমি এরকম কিছুই প্রত্যাশা করছো।”
“হ্যা, ফলাফলগুলোর ব্যাপারে, কিন্তু মেকানিজমটা নয়। ফিশে হলো আইন- কানুনের উপর একটি পুরনো ক্ষত। প্রায় সব মহাদেশীয় ব্যাংকেই এটা সীমিত আকারে করা হয়। আমেরিকান, কানাডিয়ান এবং ইউ.কে আইন এটাকে ব্যবহার করতে নিষেধ করে।”
বর্নের মনে পড়ে গেলো দামাকোর্তের কথাটা। সে কথাটা বললো, “এটার উৎস শক্তিশালী বোর্ডরুম’—এটাই সে বলেছিলো।”
“সে ঠিকই বলেছে।” মেরি তার দিকে ফিরলো। “তুমি কি বুঝতে পারছো না? আমি জানতাম তোমার একাউন্টের সাথে ঐ ফ্ল্যাগ লাগিয়ে দেয়া আছে। আমার ধারণা কাউকে ঘুষ দেয়া হয়েছে তথ্যগুলো দেবার জন্যে। এটা এমন কোনো অভাবনীয় ঘটনা নয়। তবে এটা খুবই ভিন্ন। জুরিখের এই একাউন্টটা প্রতিষ্ঠিত— একেবারে শুরু থেকেই এর কর্মকাণ্ডের সাথে ফিশে একটা অংশ। তোমার নিজের জ্ঞান থেকেই এটা বোঝা যায়।”
“ট্রেডস্টোন সেভেনটি-ওয়ান,” জেসন বললো।
“হ্যা। ব্যাংকের মালিকেরা ট্রেডস্টোনের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করে। তোমার একসিসের স্বাধীনতা বিবেচনা ক’রে বলা যায় এটা সম্ভব যে তারা যা করেছে সে ব্যাপারে তুমি অবগত।”
“তবে কাউকে ঘুষ দেয়া হয়েছে। কোয়েনিগ একটা ফোন নাম্বার থেকে আরেকটা নাম্বার স্থানান্তর করেছে।”
“তাকে বেশ ভালো টাকা দেয়া হয়েছে, এটা আমি তোমাকে বলতে পারি। সে সুইস জেলখানায় দশ বছর জেল খাটতে পারে।”
“দশ? এটা বাড়াবাড়ি রকমের।”
“যেমনটি সুইস আইন কানুন।”
“কর্লোস,” বর্ন বললো। “কার্লোস…কেন? আমি তার কি করেছি? আমি এটা নিজেকে বার বার জিজ্ঞেস করছি। নামটা আমি বার বার বলছি। কিছুই পাচ্ছি না…আমি জানি না।”
“কিন্তু কিছু একটা তো আছেই, তাই না?” মেরি সামনে এসে বসলো। “সেটা কি, জেসন? তুমি কি ভাবছো?”
“আমি ভাবছি না…আমি কিছু জানি না।”
“তাহলে তুমি অনুভব করছো। কিছু একটা। সেটা কি?”
“আমি জানি না। হয়তো ভয়…রাগ। আমি জানি না।”
“মনোযোগ দাও!”
“ধ্যাত্তারিকা, তুমি কি মনে করো আমি মনোযোগী নই? মনে করো আমার মনোযোগ নেই? তোমার কি কোনো ধারণা আছে সেটা কি রকম?” বর্ন তার নিজের এই রাগের জন্যে নিজেই বিব্রত বোধ করলো। “দুঃখিত।”
“দুঃখিত হয়ো না। এগুলো হলো ইঙ্গিত, ব্লু, যা তুমি খুঁজছো—আমাদেরকে সেটা খুঁজতে হবে। তোমার পোর্ত নোয়ের ডাক্তার বন্ধুই ঠিক বলেছে, তোমার মনে ওগুলো আসবে। অন্য কিছুর দ্বারা উত্তেজিত হবে। যেমনটি তুমি নিজে বলেছো, একটা দেয়াশলাই, একটা মুখ, কোনো রেস্তোরাঁর সামনের অংশ। আমরা এটা ঘটতে দেখেছি। এখন এটা একটা নাম। এমন একটা নাম যা তুমি আমার কাছে এক সপ্তাহের মতো গোপন রেখেছিলে। তোমার বলা উচিত ছিলো তবে তুমি তা করো নি। এটা কি তোমার কাছে কোনো অর্থ বহন করে? এটা তোমার ভেতরে কোনো কিছু উস্কে দেয়, তারা বের হয়ে আসতে চায়।”
“আমি জানি।” জেসন মদ পান করলো।
“ডার্লিং, সেন-জ্যার্মেইন বুলেভার্ডে একটা বিখ্যাত বইয়ের দোকান আছে, তারা একটা ম্যাগাজিন বের করে। পুরো একটা ফ্লোর হাজার হাজার পুরনো পত্রিকায় ঠাসা। তারা এমনকি বিষয় অনুযায়ী ক্যাটালগও ক’রে থাকে, লাইব্রেরিয়ানের মতো ইনডেক্স তৈরি ক’রে রাখে। কার্লোস সেই ইনডেক্সে আছে কিনা সেটা আমি খুঁজে দেখতে চাই। তুমি কি সেটা করবে?”
বর্ন তার বুকে তীক্ষ্ণ একটা ব্যথা অনুভব করলো, এই ব্যথাটার সাথে ক্ষতস্থানের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা ভয় থেকে উৎসারিত। মেরি সেটা দেখতে পেয়ে বুঝতে পারলো। কিন্তু সে নিজে অনুভব করছে অথচ বুঝতে পারছে না। “সরবোনে পুরনো পত্রিকার সংগ্রহ আছে।” সে বললো তার দিকে চেয়ে। “তাদের একটা আমাকে যারপরনাই খুশিতে ফেলে দিয়েছিলো কিছুক্ষণের জন্যে। যতোক্ষণ না আমি এটা নিয়ে ভেবেছি।”
“একটা মিথ্যে উন্মোচিত হয়েছিলো। সেটাই আসল কথা।”
“কিন্তু আমরা এখন কোনো মিথ্যে খুঁজছি না। তাই না?”
“এবার আমরা সত্য খুঁজছি। ভয় পেয়ো না, ডার্লিং। আমি তো পাচ্ছি না।”
জেসন উঠে দাঁড়ালো। “ঠিক আছে। সেন জার্মেইনে যাচ্ছি। এই ফাঁকে অ্যাম্বাসির লোকটাকে ফোন করো।” বর্ন পকেট থেকে পেপার ন্যাপকিনটা বের করলো যাতে ফোন নাম্বার লেখা আছে। রুই মেদেলিনের ব্যাংকের সামনে থেকে যে গাড়িটার নাম্বার টুকে নিয়েছিলো সেটাও লেখা আছে এখানে। “এই যে দামাকোর্ত আমাকে নাম্বারটা দিয়েছে। গাড়ির প্লেট নাম্বারটাও আছে। দ্যাখো, সে কি করতে পারে।”
“ঠিক আছে।” মেরি ন্যাপকিনটা নিয়ে ফোনের কাছে চলে গেলো। ফোনের পাশেই ছোট্ট একটা নোটবুক রাখা আছে। সে পাতা ওল্টালো, “এই যে। তার নাম ডেনিশ করবেলিয়া। পিটার বলেছে সে তাকে দুপুরের মধ্যে ফোন করবে।”
“পিটার তাকে চেনে, তাই না?
“তারা টরেন্টো ইউনিভার্সিটিতে এক সঙ্গে পড়েছে। আমি তাকে এখান থেকে ফোন করতে পারি, পারি না?”
“অবশ্যই। তবে তাকে বোলো না তুমি কোথায় আছো!”
“পিটারকে যা বলেছি ঠিক তাই বলবো তাকে। আমি এক হোটেল থেকে আরেক হোটেলে যাচ্ছি। আমার নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই।” সে মঁতে এভেনুতে অবস্থিত কানাডিয় অ্যাম্বাসিতে ফোন করলে পনেরো সেকেন্ড পরে অ্যাটাশি ডেনিশ করবেলিয়া ফোনটা ধরলো।
“পিটার তোমাকে বলেছিলো আমার কিছু সাহায্যের দরকার,” প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মেরি প্রসঙ্গে চলে এলো।
“তারচেয়েও বেশি,” করবেলিয়া জবাব দিলো। “সে বলেছে তুমি জুরিখে আছো। আমি বলছি না সে যা বলেছে তার সবটাই আমি বুঝেছি, তবে একটা ধারণা পেয়েছি। মনে হচ্ছে আজকাল অর্থনৈতিক দুনিয়ায় অনেক চালাকি চলছে।”
“তারচেয়েও বেশি। সমস্যাটা হলো কেউ বলতে চাচ্ছে না কে কার সাথে চালাকিটা করছে। এটাই হলো আমার সমস্যা।”
“আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”
“আমার কাছে একটা লাইসেন্স আর টেলিফোন নাম্বার আছে। দুটোই প্যারিসের। ফোন নাম্বারটা তালিকাবহির্ভূত। আমি যদি ফোন করি তবে সেটা খুব অস্বস্তিকর হতে পারে।”
“সেগুলো আমাকে দাও।” মেরি তাই করলো। “আ মারি আসকুয়ে আদ মারি,” করবেলিয়া বললো। তাদের দেশে জাতীয় মোটোটা আওড়ালো সে। “দেখি কি করতে পারি। আগামীকালকে আমার সাথে লাঞ্চ করো তাহলে? খবরগুলো তখনই জানাবো।”
“আমিও সেটা চেয়েছিলাম, কিন্তু আগামীকালকে না। আমি আমার এক পুরনো বন্ধুর সাথে সময় কাটাচ্ছি। অন্য একদিন হবে।
“পিটার বলেছে আমি যদি চাপাচাপি না করি তবে আমি একটা গর্দভ। সে বলেছে তুমি একজন অসাধারণ মহিলা।”
“সে খুব ভালো, তোমার মতোই। আমি তোমাকে আগামীকাল বিকেলে ফোন করবো।”
“চমৎকার। আমি খোঁজ করতে শুরু ক’রে দেই তাহলে।”
“আগামীকাল কথা হবে, আবারো ধন্যবাদ।” মেরি ফোনটা রেখে ঘড়ি দেখলো। “তিন ঘণ্টার মধ্যে আমি পিটারকে ফোন করবো। আমাকে স্মরণ করিয়ে দিও।”
“তুমি কি আসলেই মনে করছো সে খুব জলদি আমাকে খবরটা দেবে?”
“দেবে। সে গতরাত থেকেই ওয়াশিংটনে ফোন করা শুরু করেছে। করবেলিয়াও তাই বললো। আমরা সবাই বিনিময় করছি। এখানকার একটা তথ্যের বিনিময়ে ওখানকার একটা পাবো।”
“কথাটা অস্পষ্টভাবে বিশ্বাসঘাতকতা ব’লে মনে হচ্ছে।”
“বিপরীত। আমরা টাকা নিয়ে কাজ করছি, কোনো মিসাইল নিয়ে নয়। চারপাশে এসব টাকা ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিদেশী আইন আমাদের স্বার্থের পক্ষে। যদি না তুমি চাও আরবি শেখেরা গ্রুমান এয়ারক্রাফটের মালিক হবে। তারপর আমরা মিসাইল নিয়ে কথা বলবো…সেগুলো লাঞ্চিং প্যাড থেকে ছেড়ে দেবার পর।”
“আচ্ছা।”
“সকালে প্রথম দিকেই আমরা দামাকোর্তের লোকটাকে দেখবো। ভেবে রাখো তুমি কি পরিমাণ টাকা ওঠাতে চাও।”
“পুরোটা।”
“সবটাই?”
“ঠিক। তুমি যদি ট্ৰেডস্টোনের ডিরেক্টর হতে তবে কর্পোরেট একাউন্ট থেকে ছয় মিলিয়ন ফ্রাঁ উধাও হয়ে গেলে কি করতে?”
“বুঝেছি।”
“দামাকোর্ত বলেছে বিয়ারার চেকগুলো তৈরি করা হবে।”
“সে এটা বলেছে? চেকগুলো?”
“হ্যা, কোনো সমস্যা?”
“অবশ্যই। সেইসব চেকগুলোর নাম্বার জাল টেপের সাহায্যে পাঞ্চ করা হতে পারে, সব ব্যাংকেও পাঠাতে পারে। সেগুলোকে ক্যাশ করার জন্যে তোমাকে একটা ব্যাংকে যেতে হবে। পেমেন্টগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।”
“সে খুবই সেয়ানা, তাই না? দু’দিক থেকেই ফায়দা লুটবে সে। আমরা কি করবো?”
“সে তোমাকে যে অর্ধেকটা বলেছে সেটা বাদে—বিয়ারারের অংশটা। তবে চেকগুলো নয়। বন্ড। বিভিন্ন মূল্যের বিয়ারার বন্ডগুলো, সেগুলো খুব সহজেই ভাঙা যায়।”
“তুমি এইমাত্র একটা ডিনার জিতে নিলে,” জেসন তার কাছে গিয়ে মুখটা ধরে বললো।
“আমি আমার জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছি, স্যার,” তার হাতটা ধরে বললো সে। “প্রথমে ডিনার, তারপর পিটার…সেখান থেকে সেন-জার্মেইনের বইয়ের দোকানে।”
“সেন-জার্মেইনের একটি বইয়ের দোকান,” বর্ন প্রতিধ্বনি করলো। বুকের ব্যথাটা আবার শুরু হয়েছে। সেটা কি? সে কেন এতো ভয় পাচ্ছে?
.
তারা বুলেভার্ড রাসপেইল রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে রুই ভগিরার্দের টেলিফোন কম্প্লেক্সের দিকে গেলো। অসংখ্য টেলিফোন বুথ আছে সেখানে।
“ভীড় খুব একটা বেশি না, মাদাম,” ক্লার্ক মেরিকে বললো। “আপনার ফোন কলটা কয়েক মিনিটেই পৌঁছে যাবে। বারো নাম্বারে যান, প্লিজ।”
“ধন্যবাদ। বারো নাম্বার বুথে?”
“হ্যা, মাদাম। ঐতো, ওখানে।”
তারা বুথের কাছে যেতে থাকলে জেসন তার হাতটা ধরলো। “আমি জানি লোকে কেন এসব জায়গা ব্যবহার করে,” সে বললো। “এগুলো হোটেলের ফোনের চেয়ে একশ’ গুন বেশি দ্রুত।”
“এটাই একমাত্র কারণ।”
মেরি বুথে ঢুকলো। তার হাতে নোটবুক আর পেন্সিল। ফোনটা তুলে নিলো সে।
ষাট সেকেন্ড পরে বর্ন মেরির দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো ফ্যাকাশে মুখে সে দেয়ালের দিকে চেয়ে আছে। চেঁচামেচি শুরু ক’রে দিয়েছে, পার্সটা হাত থেকে পড়ে গেলে মেঝেতে সব জিনিস ছড়িয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ঢুকে পড়লো জেসন। মেরি একেবারে জ্ঞান হারাবার পথে।
.
“আমি মেরি সেন জ্যাক, প্যারিস থেকে বলছি, লিসা। পিটার আমার ফোনের জন্যে অপেক্ষা করছে।”
“মেরি? হায় ঈশ্বর…” সেক্রেটারির কণ্ঠটা মিলিয়ে গেলো, আশেপাশে অন্যান্য কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। কণ্ঠগুলো উত্তেজিত। তারপর হৈচৈ আর দৌড়াদৌড়ির শব্দ। ফোনটা অন্য কাউকে দেয়া হলো অথবা কেউ সেটা কেড়ে নিলো।
“মেরি, আমি এ্যালান বলছি,” সেকশনের প্রথম অ্যাসিটেন্ট ডিরেক্টর বললো। “আমরা সবাই পিটারের অফিসেই আছি।”
“কি হয়েছে, এ্যালান? আমার হাতে সময় নেই। আমি কি তার সঙ্গে কথা বলতে পারি?”
নিরবতা নেমে এলো। “কি ক’রে যে বলি, আমি বুঝতে পারছি না। পিটার মারা গেছে, মেরি।”
“সে…কি?”
“কিছুক্ষণ আগে পুলিশকে খবর দেয়া হয়েছে। তারা আসছে।”
“পুলিশ? কি হয়েছে? হায় ঈশ্বর, সে মরে গেছে? কি হয়েছিলো?”
“আমরা সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি। আমরা তার ফোন লগটা পরীক্ষা ক’রে দেখছি। তবে আমরা তার ডেস্কের কিছু স্পর্শ করছি না।”
“তার ডেস্ক…?”
“নোট আর মেমোগুলো।”
“এ্যালান! আমাকে বলো কি হয়েছে?”
“আমরা কিছু জানি না। সে তো আমাদের কিছু বলে নি। কেবল এটুকুই জানি, সে আমেরিকা থেকে দুটো ফোন পেয়েছিলো। ওয়াশিংটন আর নিউইয়র্ক থেকে। দুপুরের দিকে লিসাকে বলেছিলো সে এয়ারপোর্টে যাচ্ছে কারো সাথে দেখা করতে। সে বলে নি কার সাথে। পুলিশ তাকে এক ঘণ্টা আগে এয়ারপোর্টের গুদামঘরের টানেল থেকে পেয়েছে। ভয়ংকর ব্যাপার, মেরি। গলায়…গুলি করা হয়েছে। মেরি…? মেরি?”
.
হলুদ চোখ আর সাদা দাড়ির বৃদ্ধ লোকটি অন্ধকার কনফেশন-রুমে চোখ পিটপিট করছে, ওপাশের স্বচ্ছ পর্দার আড়ালে মাথায় হুড দেয়া লোকটার দিকে ভালো ক’রে তাকানোর চেষ্টা করছে সে। আশি বছরের বৃদ্ধের জন্যে দৃষ্টিশক্তি ভালো থাকার কথাও নয়। তবে তার মাথাটা এখনও বেশ পরিস্কার আছে।
“অ্যাঙ্গেলাস দোমিনি,” সে বললো।
“অ্যাঙ্গেলাস দোমিনি, ঈশ্বরের পুত্র,” বললো হুড দেয়া লোকটা। “আপনার দিনকাল কি ভালো যাচ্ছে?”
“দিনগুলো সমাপ্তির দিকে যাচ্ছে। তবে ভালোই কাটছে।”
“বেশ…জুরিখের কথা বলুন।”
“তারা গুইসান কুয়ের লোকটাকে খুঁজে পেয়েছে। সে আহত হয়েছে। তারা ভারব্রেখারওয়েল্ট নামের একজন ডাক্তারের সাহায্যে খুঁজে পেয়েছে তাকে। কড়া জেরার মুখে সে মেয়েটাকে লাঞ্চিত করার কথা স্বীকার করেছে। কেইন মেয়েটার জন্যে ফিরে এসেছে। কেইনই তাকে গুলি করেছে।”
“তাহলে মেয়েটা আর কেইনের একটা ব্যবস্থা করতে হবে।”
“গুইসান কুয়ের লোকটা তা মনে করে না। সে ঐ দু’জনের একজন, যে মেয়েটাকে লাওয়েনস্ট্রাসে থেকে তুলে এনেছিলো।”
“সেও একটা গর্দভ। সে ওয়াচম্যানকে খুন করেছে?”
“সে এটা স্বীকার ক’রে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছে। পালানোর জন্যে এছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিলো না।”
“তাহলে তাকে আত্মপক্ষসমর্থন করার দরকার নেই। সে যা করেছে সেটা খুবই বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে। তার কাছে কি ওর অস্ত্রটা আছে?”
“আপনার লোকজনের কাছে আছে।”
“ভালো। জুরিখ পুলিশে একজন দক্ষ লোক আছে। সেই অস্ত্রটা তাকে যেনো দেয়া হয়। কেইন খুবই রহস্যময়, মহিলাটি তার চেয়ে অনেক কম রহস্যময়। তার অটোয়াতে লোকজন আছে। তারা লেগে থাকবে। আমরা মেয়েটাকে ফাঁদে ফেলে তাকে ধরবো। আপনার পেন্সিল কি প্রস্তুত আছে?”
“হ্যা, কার্লোস।”