অধ্যায় ১১
বার্ন বিমান বন্দরের কাস্টমস্ আর ইমিগ্রেশন পার হবার সময় জেসন দূর থেকে মেরিকে দেখতে লাগলো। এয়ার ফ্রান্সের ডিপার্চার এলাকায় আশেপাশে কেউ আছে কিনা সেই ইশারা পাবার জন্যে অপেক্ষা করছে সে। বিকেল চারটা বাজে, প্যারিসের ফ্লাইটে ব্যস্ততম সময় এটা। গেট পার হবার সময় মেরি তার দিকে তাকালে সে মাথা নেড়ে সায় দিলো। তার চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করলো সে। তারপর পা বাড়ালো সুইস এয়ার লাউঞ্জের দিকে। জর্জ বি. ওয়াশবার্নের জন্যে অরলির প্লেনে ৪টা ৩০ মিনিটে একটা রিজার্ভেশন রাখা হয়েছে।
পরে তারা একটা ক্যাফেতে দেখা করবে। জায়গাটা মেরি অক্সফোর্ডে থাকার সময় থেকেই চেনে। এটাকে বলা হয় অউ কোঁয়ে দ্য ক্লানি, সরবোন থেকে কয়েক ব্লক দূরে সেন মিশেল বুলেভাদে অবস্থিত সেটা। যদি কোনো কারণে সেখানে তাকে না পায় তবে ক্লানি জাদুঘরে রাত ন’টা বাজে দেখা হবে তাদের।
বর্নের দেরি হবে। ইউরোপের সবচাইতে বড় লাইব্রেরিটা সরবোনে আছে। সেই লাইব্রেরিতে পুরনো সংবাদপত্র পাওয়া যায়। সরকারী কর্মচারীরা ওয়ার্কিং আওয়ারে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ব্যবহার করতে পারে না। ছাত্রছাত্রিরা সেটা রাতের বেলায় ব্যবহার করে। প্যারিসে পৌঁছে সেও তাই করবে। কিছু একটা তাকে জানতেই হবে।
প্রতিদিন আমি সংবাদপত্র পড়ি। তিনটি ভাষায়। ছয় মাস আগে এক লোক খুন হয়েছিলো। সেইসব পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় খবরটা ছিলো। জুরিখে মোটাসোটা লোক এ কথা বলেছিলো।
.
সে লাইব্রেরির চেকরুমে তার সুটকেসটা রেখে তৃতীয় তলায় চলে গেলো। সেখানে বড় একটা পড়ারঘর আছে; সল দ্য লেকচার এই ভবনেই অবস্থিত। সংবাদপত্রগুলো সারি সারি তাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
ছয়মাস আগের প্রথম দশ সপ্তাহের পত্রিকাগুলো তুলে নিয়ে কাছের একটা টেবিলে গিয়ে এক এক ক’রে পত্রিকাগুলো ঘাটতে শুরু করলো বর্ন।
মহান সব মানুষেরা নিজেদের বিছানায় মারা গেছে আর অন্যেরা সেই মৃত্যুর খবর ঘোষণা করেছে। ডলারের মূল্যপতন হয়েছে, স্বর্ণের দাম গেছে বেড়ে। সরকার অনেকটা ধীরগতির হয়ে পড়েছে। কিন্তু গুপ্তহত্যার কোনো খবর সেখানে পাওয়া গেলো না—কোনো খবরই নেই।
জেসন আবার তাকগুলোর কাছে ফিরে গেলো। দুই সপ্তাহ, বারো সপ্তাহ, বিশ সপ্তাহ। প্রায় আট মাস ধরে কিছুই হয় নি।
তারপরই ব্যাপারটা তার মাথায় ঢুকলো। সে ছয় মাস আগের পত্রিকা দেখেছে, তারপরের কোনো পত্রিকা নয়। কয়েকটা দিন অথবা দু’য়েক সপ্তাহের মধ্যেও তো হতে পারে। এবার তাক থেকে চার এবং পাঁচ মাস আগের পত্রিকাগুলো তুলে নিলো সে। একে একে দেখতে লাগলো সব। পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কি জুরিখের মোটা লোকটা মিথ্যে বলেছে? সবটাই মিথ্যে? সে কি এমন একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে আছে যাতে ক’রে…
অ্যাম্বাসেডর লিল্যান্ড মার্সেই’তে নিহত!
বড়বড় অক্ষরে লেখা শিরোনামটা চোখে পড়ার মতোই। তার মাথায় চিন চিন ক’রে একটা ব্যথা শুরু হয়ে গেলে শ্বাসপ্রশ্বাসও বন্ধ হয়ে গেলো। লিল্যান্ড নামটাতে তার চোখ আঁটকে রইলো। এটা সে চেনে। লোকটার মুখ স্মরণ করতে পারলো। প্রশ্বস্ত কপালের নিচে পুরু ভ্রূ জোড়া। খাড়া নাক, গালের হাড় দুটো বেশ উঁচু। ধূসর গোঁফের নিচে পাতলা ঠোঁট। সে চেহারাটা চেনে। লোকটাকে চেনে। আর লোকটাকে ওয়াটারফ্রন্টের জানালা থেকে শক্তিশালী একটা রাইফেলের একটি গুলিতে হত্যা করা হয়েছে। অ্যাম্বাসেডর হাওয়ার্ড লিল্যান্ড মার্সেই’র ডকে সেই বিকেল পাঁচটায় হেঁটে যাচ্ছিলো। তার মাথাটা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
বর্ন দ্বিতীয় অনুচ্ছেদটা পড়লো না, যাতে লেখা আছে হাওয়ার্ড লিল্যান্ড ছিলো আমেরিকান নেভির এ্যাডমিরাল এইচ. আর লিল্যান্ড। ওখান থেকে তাকে প্যারিসের আমেরিকান দূতাবাসের অ্যাম্বাসেডর ক’রে একটি অন্তবর্তীকালীন পদে পাঠানো হয়। লেখাটার যে জায়গায় হত্যার আসল কারণ সম্পর্কে অনুমান করা হয়েছে সেটাও সে পড়লো না। সে এসব জানে। লিল্যান্ডের আসল কাজ ছিলো ফরাসি সরকারকে আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধজাহাজ, মিরেজ ফাইটার প্লেনসহ যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি করা থেকে বিরত রাখা।
এ কাজে বেশ সফল হলেও এজন্যে মধ্যপ্রাচ্যের অনেককে ক্ষুব্ধও করেছিলো সে। ধারণা করা হচ্ছে তাকে এসব লোকই খুন ক’রে থাকতে পারে একটা শাস্তি দেবার আশায়, যাতে বাকিরা সাবধান হয়ে যায়। তাকে যারা বা যে-ই খুন করেছে তাকে প্রচুর টাকা দেয়া হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে কোনো আলামতই পাওয়া যায় নি।
জুরিখ। পা-বিহীন এক লোকের কাছে একজন মেসেঞ্জার। আরেকজন ফকেনস্ট্রাস রেস্তোরার মোটা লোকটার কাছে।
জুরিখ।
মার্সেই।
জেসন তার চোখ দুটো বন্ধ করলো। যন্ত্রটা এখন অসহ্য ঠেকছে। তাকে সমুদ্র থেকে পাঁচ মাস আগে উদ্ধার করা হয়েছিলো। ধারণা করা হয়েছিলো সে মার্সেই থেকেই এসেছে। যদি মার্সেই হয়ে থাকে তবে ওয়াটারফ্রন্ট ছিলো তার পালানোর রুট। একটা বোট ভাড়া ক’রে তাকে বিশাল ভূমধ্যসাগরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। সবই বেশ ভালোভাবে মিলে যাচ্ছে। যদি মার্সেই’র কোনো জানালা থেকে কাউকে সে খুন না ক’রে থাকে তবে কি ক’রে এসব জানতে পারলো?
চোখ খুললো সে, তীব্র যন্ত্রণা তার চিন্তাভাবনাকে ধীরগতির ক’রে ফেলছে। তবে সব চিন্তাভাবনাকে নয়। তার সীমিত স্মৃতিতে একটা সিদ্ধান্ত বেশ পরিস্কার। প্যারিসে মেরি সেন জ্যাকের সাথে কোনো দেখা সাক্ষাত হবে না।
হয়তো একদিন সে তার কাছে চিঠি লিখবে। এখন যা বলতে পারছে না তা জানাবে। যদি সে বেঁচে থাকে এবং চিঠি লিখতে পারে তো। এখন সে কিছুই লিখতে পারবে না। ধন্যবাদ অথবা ভালোবাসার কোনো কথা এখন লেখা যাবে না। মেয়েটা তার জন্যে অপেক্ষা করবে কিন্তু তার কাছে সে যাবে না। তার সাথে দূরত্ব বাড়াতে হবে। মেয়েটাকে কোনো ভাড়াটে খুনির সাথে জড়ানো ঠিক হবে না। মেয়েটার ধারণা ভুল। তার ধারণাই ঠিক I
হায় ঈশ্বর। সে হাওয়ার্ড লিল্যান্ডের চেহারাটা দেখতে পাচ্ছে। অথচ তার সামনে লোকটার কোনো ছবি নেই। প্রথম পাতার শিরোনামটাই তাকে সব কিছু স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। দিনটি বৃহস্পতিবার, আগস্ট ২৬। মার্সেই। এই দিনটি সে মনে রাখবে, তার এই জটিল জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এটা তার মনে থাকবে।
বৃহস্পতিবার, ২৬শে আগস্ট….
একটা ভুল হয়ে গেছে। সেটা কি? বৃহস্পতিবার?….বৃহস্পতি তার কাছে কোনো অর্থই বহন করে না। আগস্টে ছাব্বিশ তারিখ?… ছাব্বিশ? এটা ছাব্বিশ হতে পারে না! ছাব্বিশ তারিখটা ভুল! সে এ কথাটা বার বার শুনেছে। ওয়াশবার্নের ডায়রিতে—তার রোগীদের জার্নালে।
তোমাকে আমার এখানে নিয়ে আসা হয়েছিলো আগস্টের চব্বিশ তারিখের সোমবার সকালে। ঠিক সকাল আটটা বিশ মিনিটে। তোমার অবস্থা ছিলো খুবই…
সোমবার, চব্বিশে আগস্ট।
চব্বিশে আগস্ট।
ছাব্বিশ তারিখে সে মার্সেই’তে ছিলো না! সে কোনো লোককে ওয়াটারফ্রন্টের জানালা থেকে গুলি করতে পারে না। হাওয়ার্ড লিল্যান্ডকে সে খুন করে নি!
ছয় মাস আগে এক লোক খুন হয়েছে…তবে এটা ছয় মাস আগে নয়। এটা ছয় মাসের কাছাকাছি, একেবারে ছয় মাস নয়। সে ঐ লোকটাকে খুন করে নি। সে তখন পোর্ত নোয়ে’র মদ্যপ এক ডাক্তারের ঘরে প্রায় মৃত একজন।
কুয়াশা কাটছে। যন্ত্রণাটা তিরোহিত হচ্ছে। তার মধ্যে একরকম উচ্ছ্বাস জেঁকে বসলো। অকাট্য একটা মিথ্যে খুঁজে পেয়েছে সে! এরকম একটা ঘটনা যদি মিথ্যে হয় তো অন্যগুলোও হতে পারে!
বর্ন তার হাত ঘড়ি দেখলো, সোয়া ন’টা বাজে। মেরি ক্যাফে থেকে চলে গেছে। সে এখন অপেক্ষা করছে ক্লানি জাদুঘরের সামনে। পত্রিকাগুলো রেখে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলো সে। তাকে এখন এমন একজনের কাছে যেতে হবে যাকে সে বলবে, এখনও আশা আছে। সে যা ভেবেছে আসলে হয়তো সে তা নয়। মেয়েটার কথাই হয়তো ঠিক।
জাদুঘরের সামনে মেরিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো সে। ঠাণ্ডাবাতাসের কারণে দু’হাত বুকের কাছে রেখে কুঁকড়ে আছে সে। প্রথমে জেসনকে দেখতে পায় নি, তার চোখ সারি সারি বৃক্ষ সমৃদ্ধ রাস্তাটার দিকে। সে অস্থির হয়ে আছে। উদ্বিগ্ন আর অধৈর্য এক মেয়ে আশংকা করছে যার জন্যে অপেক্ষা করছে তাকে হয়তো সে আর দেখতে পাবে না। এ নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে আছে মেয়েটা।
দশ মিনিট আগেও এখানে আসার কথা ভাবে নি সে।
তাকে দেখতে পেলো মেরি! সঙ্গে সঙ্গে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। দু’ঠোঁটে হাসির দেখা মিললো। এগিয়ে এলো তার দিকে। কাছাকাছি হলেও দু’জনের কেউই কিছুক্ষণের জন্যে কোনো কথা বললো না। সেন্ট মিশেলে তারা এখন একা।
“আমি কতোক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি,” দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো সে। “আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিছু হয়েছে নাকি? তুমি ঠিক আছো তো?”
“ঠিক আছি। আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি।”
“কি?”
সে তার দু’কাঁধ ধরলো। “ছয় মাস আগে এক লোক খুন হয়েছিলো…মনে আছে?”
তার চোখমুখ থেকে আনন্দের ছটা হারিয়ে গেলো। “হ্যা, মনে আছে।”
“আমি তাকে খুন করি নি,” জেসন বর্ন বললো। “আমি সেটা করতে পারি নি।”
.
জনাকীর্ণ বুলেভার্ড মতোপারোয়ায় একটা ছোট্ট ঘর তারা খুঁজে পেলো। লবি আর ঘরগুলো জরাজীর্ণ। তবে জায়গাটা খুব শান্ত আর কোলাহলমুক্ত।
জেসন দরজা বন্ধ করার সময় সাদা চুলের বেল ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো। একটু আগে জেসন তাকে বিশ ফ্রাঁ বখশিস দিলে লোকটার নির্বিকার ভাব মুহূর্তেই বদলে গদগদ হয়ে গেছে।
“সে তো তোমাকে একজন প্রাদেশিক ডিকন মনে করছে,” বললো মেরি। “আমি আশা করি তুমি খেয়াল করেছো আমি সোজা বিছানায় চলে এসছি।”
“তার নাম হার্ভে, সে আমাদের দরকারে কাজে লাগবে। সম্পদে ভাগ বসানোর কোনো উদ্দেশ্য তার নেই।” তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো সে। “আমাকে বাঁচানোর জন্যে ধন্যবাদ,” বললো সে।
মেরিও তার মুখটা দু’হাতে ধরলো। “তবে আমাকে এভাবে অপেক্ষায় রেখো না আর। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। আমি কেবল ভাবছিলাম কেউ বুঝি আমাকে দেখে চিনে ফেলবে…হয়তো ভীষণ খারাপ কিছু ঘটে গেছে তোমার।”
“তুমি ভুলে গেছো আমি দেখতে কি রকম সেটা কেউ জানে না।”
“এটাকে হিসেবের মধ্যে রেখো না, কথাটা সত্যি নয়। স্টেপডেকস্ট্রাসে চারজন আছে আর গুইসান কুয়ে’তে আছে ঐ বানচোতটা। তারা এখনও বেঁচে আছে, জেসন। তারা তোমাকে দেখেছে।”
“এটা ঠিক সত্যি নয়। তারা একজন কালো চুলের, ঘাড়ে-মাথায় ব্যান্ডেজ করা লোককে দেখেছে। যে আবার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটে। কেবল দু’জন আমার কাছাকাছি এসেছিলো। তৃতীয় তলার ঐ লোকটা আর গুইসানের শুয়োরটা। প্রথম জন কিছু দিনের জন্যে জুরিখ ছাড়তে পারবে না। হাটতে পারবে না সে, তার হাতের অবস্থাও ভালো নয়। দ্বিতীয় জন চোখে টর্চলাইটের আলোর কারণে আমাকে ঠিক মতো দেখতে পারে নি। ধরে নাও, তারা আমাকে দেখে নি।”
মেয়েটা তাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ বড় বড় ক’রে তার দিকে তাকালো। “তুমি নিশ্চিত হতে পারো না। তারা তোমাকে দেখেছে।”
তোমার চুল বদলে ফেলো…তাহলে বদলে যাবে তোমার মুখটা। পোর্ত নোয়ের ডক্টর জিওফ্রে ওয়াশবার্ন।
“আমি আবারো বলছি, তারা অন্ধকারে একজন কালো চুলের লোককে দেখেছে। চুল ডাই করার ব্যাপারে তুমি কি কিছু জানো?”
“আমি সেটা কখনও ব্যবহার করি নি।”
“তাহলে সকালে একটা দেকান থেকে কিনে আনতে হবে। এখানে ওসব ভালোই পাওয়া যাবে। যারা সোনালী চুলের তারা বেশি ফূর্তি করতে পারে, এটাই তো সবাই বলে, তাই না?”
মেরি তার মুখের দিকে ভালো ক’রে তাকালো। “আমি কল্পনা করার চেষ্টা করছি তোমাকে কি রকম দেখাবে।”
“অন্যরকম। খুব বেশি নয়, তবে সেটাই যথেষ্ট।”
“তোমার কথাই হয়তো ঠিক, আশা করি সেটাই যেনো সত্যি হয়।” জেসনের গালে চুমু খেলো সে। তার আলোচনার সূচনা এটি। “এবার আমাকে বলো কি হয়েছে? এ ব্যাপারে তুমি কি জানলে…ছয় মাস আগের ঘটনাটা?”
“এটা ছয় মাস আগের নয়, আর সেজন্যেই আমি তাকে খুন করি নি।” সে তাকে সবটাই খুলে বললো কেবল ক্ষণিকের জন্যে তাকে ছেড়ে চলে যাবার ভাবনাটি বাদে। তাকে এটা বলার দরকারও ছিলো না। মেরি নিজেই সেটা বললো।
“দিন তারিখটা যদি তোমার কাছে এভাবে পরিস্কার না হোতো তবে তুমি আমার কাছে ফিরে আসতে না, আসতে কি?”
সে মাথা নাড়লো। “সম্ভবত আসতাম না।”
“অপেক্ষা করার সময় আমিও এটা আন্দাজ করেছিলাম। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো তখন। তুমি কি বিশ্বাস করতে পারো?”
“আমি বিশ্বাস করতে চাই না।”
“আমিও না, তবে এটাই ঘটেছিলো।”
তারা পাশাপাশি ব’সে আছে। মেরি বিছানায়, আর জেসন পাশেই একটা চেয়ারে। সে মেরির হাতটা ধরলো। “আমি এখনও নিশ্চিত নই, আমি ওখানে ছিলাম না…আমি লোকটাকে চিনি, তার মুখ আমি দেখেছি। তার খুন হবার আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে আমি মার্সেই’তে ছিলাম।”
“কিন্তু তুমি তাকে খুন করো নি।”
“তাহলে আমি কেন ওখানে ছিলাম? কেন লোকে মনে করে কাজটা আমি করেছি? হায় ঈশ্বর, আমি তো পাগল হয়ে যাবো!” সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তার চোখে যন্ত্রণাটা আবার ফিরে এলো। “কিন্তু আমি পাগল নই, তাই না? কারণ, আমি ভুলে গেছি…ভুলে গেছি আমার আগের সব অতীত।”
“সব প্রশ্নের জবাব তুমি পাবে।”
“সেটা হয়তো সম্ভব নয়। ওয়াশবার্ন বলেছিলো, এটা হলো ইটগুলোকে আবারো নতুন ক’রে সাজানোর মতো, অন্য কোনো সুড়ঙ্গ…অন্য কোনো জানালা।” জেসন জানালার কাছে গিয়ে নিচে শহরের বাড়িগুলো দেখলো। “দৃশ্যগুলো একরকম নয়। কোথাও না কোথাও লোকজন আমাকে চেনে, আমি তাদেরকে চিনি। ওহ্ ঈশ্বর, হয়তো বউ-বাচ্চাও আছে—আমি জানি না। আমি বাতাসে ভাসছি, আর যখনই মাটিতে নেমে আসছি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে শূন্যে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে আবার।”
“আকাশে?” মেরি জানতে চাইলো।
“হ্যা।”
“তুমি একটা প্লেন থেকে ঝাঁপ দিয়েছো,” সে বললো। প্রশ্ন নয়, যেনো এমনিতেই।
বর্ন ঘুরে তাকালো। “আমি তোমাকে এ কথা কখনও বলি নি।”
“অন্য এক রাতে ঘুমের মধ্যে তুমি বলেছিলো। তোমার শরীর ঘেমে মুখটা লাল হয়ে যাচ্ছিলো। তোয়ালে দিয়ে আমি তোমার মুছে দিয়েছিলাম তখন।”
“তুমি কেন কিছু বলো নি?”
“বলেছি, অন্যভাবে। আমি জানতে চেয়েছিলাম, তুমি কি একজন পাইলট ছিলে? অথবা আকাশে উড়তে তোমার কি অস্বস্তি লাগে। বিশেষ ক’রে রাতের বেলায়।”
“আমি জানি না তুমি কি বলছো। তুমি আমাকে চাপাচাপি করো নি কেন?”
“আমি ভয়ে ছিলাম। তুমি তখন হিস্টিরিয়গ্রস্ত ছিলে। এরকম কাউকে কিভাবে সামলাতে হয় আমি জানি না। আমি তোমাকে স্মরণ করার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি, তবে আমি তোমার অচেতন অবস্থার ব্যাপারে কিছু করতে পারি না। আমার মনে হয় না ডাক্তার ছাড়া এটা কেউ করতে পারবে।”
“ডাক্তার? আমি প্রায় ছয় মাস একজন ডাক্তারের সাথেই ছিলাম।”
“তার সম্পর্কে তুমি আমাকে যা বলেছো তাতে আমার মনে হচ্ছে অন্য আরেকজনকে দেখানো দরকার।”
“দেখাবো না!” একটু রেগেই বললো। কিন্তু নিজের রাগের কারণটা নিজেই বুঝতে পারলো না সে।
“কেন দেখাবে না?” মেরি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। “তোমার সাহায্যের দরকার, ডার্লিং। হয়তো একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ – “
“না!” সে চিৎকার ক’রে বললো। যেনো ঘাবড়ে গেছে। “আমি সেটা করবো না। আমি পারবো না।”
“আমাকে বলবে কি, কেন?” শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইলো সে।
“আমি…আমি এটা করতে পারবো না।”
“খালি বলো কেন, আর কিছু না।”
বর্ন তার দিকে চেয়ে রইলো। তারপর মুখটা সরিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলো জানালা দিয়ে। “কারণ আমি ভয় পাচ্ছি। কেউ মিথ্যে বলেছে। আর সেজন্যে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু ধরো কোনো মিথ্যে বলা হয় নি, সবটাই সত্যি। তখন আমি কি করবো?”
“তুমি কি বলতে চাচ্ছো, তুমি খুঁজে বের করতে চাচ্ছো না?”
“ঠিক সেটা নয়!” সে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার পাশে দাঁড়ালো। তার চোখ এখনও বাইরের দিকে। “আমাকে বোঝার চেষ্টা করো,” বললো সে। “আমাকে কিছু জিনিস জানতে হবে…সিদ্ধান্ত নেবার জন্যে যতোটুকু দরকার…তবে, হয়তো সবকিছু নয়। কিছু অংশ জানলেই চলবে। আমার কোনো স্মৃতি নেই। যে লোকের কোনো স্মৃতি নেই তার অস্তিত্বও নেই…অন্তত তার কাছে।” মেরির দিকে ফিরে তাকালো বর্ন।
“আমি তোমাকে যেটা বলার চেষ্টা করছি তাহলো, হয়তো এভাবেই এটা ভালো হয়ে যাবে।”
“তুমি আলামত চাও, কোনো প্রমাণ চাও না। এটাই কি তুমি বলছো?”
“আমি চাই একটা তীর এদিকে নয়তো ওদিকে নির্দেশ করা আছে, আমাকে বলবে আমি দৌড়াবো নাকি দৌড়াবো না।”
“তোমাকে বলবে। আমাদের ব্যাপারটার কি হবে?”
“সেটার জবাব তীরটার সাথেই পাওয়া যাবে। তাই না? তুমিও সেটা জানো।”
“তাহলে চলো খুঁজে বের করি,” মেরি জবাবে বললো।
“সাবধান। সত্যটা কি সেটার সাথে হয়তো খাপ খাওয়াতে পারবে না।”
“আমি তোমার সাথে থাকতে পারবো। আমি আসলেই পারবো।” সে তার কাছে এসে তার মুখটা ধরলো। “আসো। এখন অনটারিও’তে পাঁচটা বাজে। পিটারকে অফিসেই পাওয়া যাবে। সে ট্রেডস্টোনের খোঁজ শুরু করতে পারবে… এখানকার অ্যাম্বাসির একজনের নামও সে দিতে পারবে, যে আমাদেরকে দরকারে সাহায্য করতে পারবে।”
“তুমি পিটারকে বলবে তুমি প্যারিসে আছো?”
“না বললেও অপারেটরের কাছ থেকে সে এটা জেনে নিতে পারবে। তবে কলটা ট্রেস করে এই হোটেলের সন্ধান করা যাবে না। তাই এ নিয়ে ভাববে না। আমি সব কথাই গোপন রাখবো। আমি কয়েক দিনের জন্যে প্যারিসে এসেছি কারণ লিঁও’তে আমার আত্মীয়-স্বজনেরা একেবারেই বিরক্তিকর লাগছে, সে এটা বিশ্বাস করবে।”
“সে কি এখানকার অ্যাম্বাসির কাউকে চিনবে?”
“পিটারের সব জায়গাতেই পরিচিত লোকজন রয়েছে। এটা তার সবচাইতে কার্যকরী তবে কম আকর্ষণীয় দিক।”
“কথা শুনে মনে হচ্ছে তার পরিচিত লোক আছে।” বর্ন তাদের দু’জনের কোটটা হাতে তুলে নিলো। “তুমি কল করার পরই আমরা ডিনার করবো। মনে হয় আমাদের দু’জনের একটু ড্রিংক করা দরকার।”
“চলো রুই মেদেলিনের ব্যাঙ্কে যাই। একটা জিনিস দেখতে চাই আমি।”
“রাতের বেলায় তুমি কি দেখতে পাবে?”
“একটা টেলিফোন বুথ। আশা করি ব্যাংকের কাছেই ওরকম একটা আছে।”
“আছে। ঢোকার মুখেই আছে।”
.
টরটয়েজ-শেল চশমা পরা লম্বা সোনালী চুলের লোকটা রুই মেদেলিনের রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাত ঘড়িটা দেখলো। পেভমেন্টটা জনাকীর্ণ। পথঘাটের যানবাহনের আধিক্য একেবারে প্যারিসের মতোই। টেলিফোন বুথে ঢুকেই ফোনটা তুলে নিলো সে। ফোনটা ক্রেডল থেকে নামানো ছিলো ব’লে লাইনটা বন্ধ ছিলো। এটা অন্য কোনো ব্যবহারকারীকে বলে দিয়েছে ফোনটা খালি নেই। বুথটা দখল হবার সম্ভাবনাকে এটা কমিয়ে দিয়েছে। কাজ হয়েছে এতে।
আবারো তার ঘড়ির দিকে তাকালো সে। সময় শুরু হয়ে গেছে। মেরি আছে ব্যাঙ্কের ভেতরে, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফোন করবে সে। তার কাছে থাকা কয়েকটা কয়েন ফোনের পাশে রেখে দিলো। তার চোখ রাস্তার ওপারে ব্যাঙ্কের দিকে। মেঘের কারণে রোদটা ম্রিয়মান হয়ে গেলে বুথের কাঁচে সে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেলো। মতোপারোয়ার হেয়ারড্রেসার তার চুল সোনালী রঙ ক’রে দিয়েছে। আয়নায় সেটা আবার দেখে সন্তুষ্ট হলো সে। মেঘ সরে গিয়ে রোদ উঁকি মারতেই ফোনটা বেজে উঠলো।
“তুমি? মেরি সেন জ্যাক বললো।
“হ্যা, আমি,” বললো বর্ন।
“নাম আর অফিসের অবস্থানটি নিশ্চিত কোরো যাতে সে বুঝতে পারে তুমি একজন আমেরিকান। তুমি বলবে তুমি প্যারিসের ফোনের ব্যপারে অভ্যস্ত নও। তারপর যেটা যেটা করতে হবে করবে। আমি ঠিক পাঁচ মিনিট পরে আবার ফোন করবো।”
“ঠিক আছে।”
“ও.কে…গুডলাক।”
“ধন্যবাদ।” জেসন লাইনটা কেটে দিয়ে স্মৃতি থেকে আরেকটা নাম্বার ডায়াল করলো।
“লা ব্যাঙ্ক দ্য ভালোয়া। বজুখ।”
“আমার একটু সাহায্য লাগবে,” বর্ন বললো। “কিছুদিন আগে আমি সুইজারল্যান্ড থেকে বেশ মোটা অংকের টাকা ট্রান্সফার করেছি। আমি জানতে চাচ্ছি টাকাগুলো জমা হয়েছে কিনা।”
“এটা আমাদের ফরেন সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট দেখে, স্যার। আমি আপনাকে সেখানে কানেক্ট করে দিচ্ছি।”
একটা ক্লিক্ হবার পর আরেকটা মেয়ে বললো, “ফরেন সার্ভিস।”
জেসন তার অনুরোধটি আবারো জানালো।
“আপনার নামটা বলবেন কি?”
“এটা বলার আগে আমি ব্যাঙ্কের একজন অফিসারের সঙ্গে কথা বলাটাই বেশি পছন্দ করবো।”
“বেশ, তবে আমি আপনাকে ভাইস প্রেসিডেন্টের লাইনে সংযোগ দিয়ে দিচ্ছি।”
ভাইস প্রেসিডেন্ট মঁসিয়ে দামাকোর্তের সেক্রেটারি একটু কম সাহায্যকারী বলেই মনে হলো। ব্যাঙ্ক অফিসারের স্ক্রিনিং প্রসেসটা চালু হয়ে গেছে, যেমনটি মেরি অনুমান করেছিলো। তাই বর্ন আরেকবার মেরির কথাগুলো ব্যবহার করলো। “আমি জুরিখ থেকে একটি ট্রান্সফারের ব্যাপারে জানতে চাচ্ছি। ব্যানহফস্ট্রাসের গেইমেনশেফট ব্যাংক থেকে করা হয়েছিলো। টাকার অঙ্কটা সাত সংখ্যার। মঁসিয়ে দামাকোর্ত, দয়া ক’রে একটু তাড়াতাড়ি করুন। আমার হাতে সময় কম।”
আর বেশি দেরি করাটা সেক্রেটারির পক্ষে সম্ভব হলো না। হতভম্ব ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্টের কণ্ঠটা লাইলে শোনা গেলো।
“আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?”
“আপনি কি দামাকোর্ত?” জেসন জানতে চাইলো।
“আমি আঁতোয়া দামাকোর্ত বলছি। আপনি কে বলছেন?”
“বেশ! জুরিখেই আপনার নামটা আমার দেয়া উচিত ছিলো। পরের বার আমি অবশ্যই ভুল করবো না,” বর্ন বললো। তার বাচনভঙ্গীতে আমেরিকান টান।
“ক্ষমা করবেন, বুঝতে পারলাম না? আপনি কি ইংরেজিতে কথা বলতে বেশি স্বস্তিবোধ করবেন, মঁসিয়ে?”
“হ্যা,” জবাব দিলো জেসন। “এই শালার ফোনটা নিয়ে আমি বেশ সমস্যায় পড়ে গেছি।” ঘড়ির দিকে তাকালো সে। তার হাতে দু’মিনিটেরও কম সময় আছে। “আমার নাম বর্ন, জেসন বর্ন। আট দিন আগে আমি সাড়ে চার মিলিয়ন ফ্রাঁ জুরিখের গেইমেনশেফট ব্যাংক থেকে ট্রান্সফার করেছিলাম। তারা আমাকে আশ্বস্ত করেছিলো এই লেনদেনটা গোপন থাকবে।”
“সব ধরণের লেনদেনই গোপন থাকে, স্যার।”
“দারুণ। আমি জানতে চাচ্ছি, সব কি ঠিক আছে?”
“আমাকে একটু খুলে বলতে হবে,” ব্যাঙ্ক অফিসার বলতে লাগলো। “টেলিফোনে এইরকম লেনদেনের ব্যাপারে কথা বলাটা ঠিক হবে না।”
মেরি ঠিকই বলেছিলো। তার যুক্তিটা জেসনের কাছে পরিস্কার হলো এখন।
“আমিও তাই আশা করি, তবে আমি আপনার সেক্রেটারিকে তো বলেছিই, আমার খুব তাড়া আছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমি প্যারিস ছাড়ছি। আমাকে সবকিছু ঠিক ক’রে যেতে হবে।”
“তাহলে আমি আপনাকে ব্যাঙ্কে আসতে বলবো, স্যার।”
“আমি জানি সেটা,” বর্ন সন্তুষ্ট হয়ে বললো। কারণ মেরি যেমনটি বলেছিলো কথাবার্তা সেদিকেই যাচ্ছে। “আমি কেবল এসে সবকিছু প্রস্তুত দেখতে চাই। আপনার অফিসটা কোথায়?”
“মেইন ফ্লোরেই, মঁসিয়ে। গেটটা পেরিয়ে পেছন দিকে। মাঝখানের দরজাটা। একজন রিসেপশনিস্ট আছে ওখানে।”
“আমি কেবল আপনার সাথেই কথা বলবো, ঠিক আছে?”
“আপনি যেমনটি চান, যদিও অন্য অফিসার—”
“দেখুন মিস্টার,” কর্কশ আমেরিকানটি বললো, “আমরা সাড়ে চার মিলিয়ন ফ্রাঁ নিয়ে কথা বলছি।”
“ঠিক আছে। কেবল আমার সাথেই, মঁসিয়ে বর্ন।”
“চমৎকার,” জেসন ক্রেডলে হাত রেখে বললো। পনেরো সেকেন্ড রয়েছে তার। “দেখুন, এখন ২টা ৩৫ বাজে—” সে লিভারে দু’বার চাপ দিয়ে লাইনটা বিঘ্ন সৃষ্টি করলো তবে বিচ্ছিন্ন করলো না।
“হ্যালো? হ্যালো?”
“এই তো আমি, মঁসিয়ে।”
“বালের ফোন! শুনুন, আমি—” সে আবারো চাপ দিয়ে বিঘ্ন সৃষ্টি করলো। এবার পরপর তিনবার। “হ্যালো? হ্যালো?”
“মঁসিয়ে, প্লিজ—আপনি যদি আপনার ফোন নাম্বারটা আমাকে দিতেন?”
“অপারেটর? অপারেটর?”
“মঁসিয়ে বর্ন, প্লিজ—
“আমি আপনার কথা শুনতে পাচ্ছি না!” চার সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড। “একটু দাঁড়ান। আপনাকে আমি পরে ফোন করছি।” সে ফোনটা রেখে দিলো। তিন সেকেন্ড পরে ফোনটা আবার বেজে উঠলে তুলে নিলো সে। “তার নাম দামাকোর্ত, মেইন ফ্লোরে তার অফিস, পেছনের দিকে। মাঝখানের দরজাটা।”
“ঠিক আছে,” কথাটা বলেই মেরি ফোনটা রেখে দিলো।
বর্ন আবারো ব্যাঙ্কে ফোন করলো।
“জো পারলে আভেক, মঁসিয়ে দামকোর্ত, কোয়ানন্দ অন মা ক্যু…”
“জো রিগরেও, মঁসিয়ে।”
“মঁসিয়ে বর্ন?”
“দামাকোর্ত?”
“হ্যা—আপনার এ রকম সমস্যা হচ্ছে ব’লে আমি খুবই দুঃখিত। আপনি বলছিলেন, সময়ের ব্যাপারে?”
“ওহ্, হ্যা। এখন প্রায় ২টা ৩০ বাজে। আমি ৩টার মধ্যে পৌঁছে যাবো।”
“আপনার অপেক্ষায় থাকবো আমি, মঁসিয়ে।”
জেসন ফোনটা ঝুলিয়ে রেখে বুথ থেকে বের হয়ে দ্রুত হাটতে লাগলো জনাকীর্ণ সামনের দোকানগুলোর দিকে। ঘুরে দেখলো সে। অপেক্ষা করলো। তার চোখ রাস্তার ওপারে ব্যাঙ্কের দকে। সামনের বিশ মিনিট বলে দেবে মেরির কথা ঠিক না বেঠিক। তার কথা সত্যি হলে রুই মেদেলিনে কোনো সাইরেন বাজবে না।
.
হালকা পাতলা মেয়েটি, বড়সড় টুপির কারণে যার মুখের অনেকটা অংশ ঢেকে আছে, সে ব্যাংকের প্রবেশপথের পাশে পাবলিক ফোন বুথে ঢুকলো। পার্স থেকে একটা বাক্স বের ক’রে মেকআপটা চেক ক’রে পার্সটা বন্ধ ক’রে বুথ থেকে আবার বের হয়ে ব্যাংকের মেইন ফ্লোরের দিকে পা বাড়ালো সে। মাঝখানের কাউন্টারে এসে একটা বল পয়েন্ট কলম তুলে নিয়ে ওখান থেকে একটা ফর্মে অর্থহীন কিছু সংখ্যা লিখতে শুরু করলো। দশ ফিট দূরে একটা ছোট্ট পিতলের দরজা। দরজার ওপাশে একটা ডেস্ক। সেখানে হিসাবরক্ষক আর কতিপয় লোক ব’সে আছে। তাদের পেছনে রয়েছে সেক্রেটারিদের ডেস্কগুলো—সব মিলিয়ে পাঁচটি—পেছনের পাঁচটি দরজার সামনে।
মাঝখানের দরজার উপরে সোনালী রঙের অক্ষরগুলোর দিকে তাকালো মেরি।
এম.এ. আর. দামাকোর্ত
ভাইস প্রেসিডেন্ট
কমতে অ্য লেতরোগা অত্ দিভাইসে
যেকোনো সময় এটা হবে—তার কথা যদি ঠিক হয়ে থাকে। আর তার কথা ঠিক হলে তাকে জানতে হবে মঁসিয়ে এম. এ.আর দামাকোর্ত দেখতে কেমন। ঐ লোকের কাছেই জেসন যাবে। তার কাছে যাও, কথা বলো। তবে ব্যাংকে নয়।
এটা ঘটলো। হিসেব মতোই সব হচ্ছে। দামাকোর্তের অফিসের সামনে বসা সেক্রেটারি মেয়েটা তাড়াহুড়া ক’রে নোটপ্যাড হাতে ভেতরে ঢুকলো। ত্রিশ সেকেন্ড পরে আবার বের হয়ে এসে ফোনটা তুলে নিলো সে। তিনটি নাম্বার ডায়াল করলো সে—ইন্টারকম নাম্বার—নিজের প্যাড থেকে দেখে কথা বললো।
দুই মিনিট পার হয়ে গেলো এভাবে। দামাকোর্তের অফিসের দরজা খুলে গেলে দেখা গেলো ভাইস প্রেসিডেন্ট কাজে দেরি হবার জন্যে তাড়া দিচ্ছে। সে মধ্যবয়সী এক লোক, কিন্তু মুখটা বয়সের তুলনায় বেশি বয়স্ক। তবে হাটাচলা দেখে কম বয়সী ব’লে মনে হয়। তার মাথার পাতলা চুল সুন্দর ক’রে আঁচড়ানো। টাক অংশটা ঢেকে রাখা হয়েছে। তার চোখ দুটো ছোটো ছোটো। প্রচুর ভালো মদ খাওয়ার কারণে আরো ছোটো হয়ে গেছে। তবে চোখ দুটোতে কর্তৃত্বের বর্হিপ্রকাশ রয়েছে। সে তার সেক্রেটারিকে উচ্চস্বরে কী যেনো বললে মেয়েটা নিজের চেয়ারে ব’সে দ্রুত কম্পোজ করার চেষ্টা করতে লাগলো।
দামাকোর্ত তার অফিসের দরজা বন্ধ না করেই ফিরে গেলো নিজের অফিসে। রাগী বেড়ালটার খাঁচা খোলা থাকলো। পার হলো আরেক মিনিট। সেক্রেটারি বার বার তার ডান দিকে তাকাচ্ছে। কিছু একটার দিকে তাকাচ্ছে সে। যখন সে ওটা দেখতে পেলো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চোখ দুটো বন্ধ করলো।
দূরের বাম দিকের দেয়ালে একটা সবুজ বাতি আচম্কা জ্বলে উঠেছে। একটা লিফট ব্যবহার করা হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে গেলে বয়স্ক আর অভিজাত দেখতে এক লোক বের হয়ে এলো। তার হাতে ছোট্ট একটা কালো কেস্। মেরি সেটার দিকে দিকে তাকালো। সন্তুষ্ট আর ভীতি একসঙ্গে অনুভব করছে সে। তার অনুমানই ঠিক। কালো কেস্টা থেকে একটা কনফিডেনশিয়াল ফাইল সরানো হয়েছে গার্ডরুমের ভেতর থেকেই। আর সেটা ছেড়ে দেয়া হয়েছে এমন একজন লোকের মাধ্যমে যে সমালোচনা অথবা প্রলুব্ধের ঊর্ধে—বয়স্ক লোকটা দামাকোর্তের অফিসের দিকে পা বাড়ালো।
সেক্রেটারি তাকে দেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানিয়ে দামাকোর্তের অফিসে নিয়ে গেলো তাকে। ঘরে পৌঁছে দিয়েই সে বের হয়ে এসে দরজাটা বন্ধ ক’রে দিলো।
মেরি এক পলকে তার হাত ঘড়িটা দেখে নিলো। আরেক টুকরো আলামত চাইছে সে। যদি এটা ঘটে, তো খুব জলদিই ঘটবে।
মেরি গেটের কাছে গিয়ে তার পার্সটা খুলে রিসেপশনিস্টের দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হেসে ফেললো। মেয়েটা ফোনে কথা বলছে। মেয়েটার কাছে দামাকোর্তের নাম বলে গেটের কাছে গিয়ে দরজাটা খুলে খুব দ্রুত ভেতরে ঢুকে পড়লো সে।
“ক্ষমা করবেন, মাদাম- রিসেপশনিস্ট ফোনে হাত চাপা দিয়ে ফরাসিতে বললো, “আমি আপনাকে কি সাহায্য করতে পারি?”
মেরি আবারো নামটা বললো – এখন একজন ভদ্র ক্লায়েন্ট সে, অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্যে দেরি ক’রে ফেলেছে, আর ব্যস্ত কোনো কর্মচারীর জন্যে আরো দেরি হোক সেটা কোনোমতেই সে চাইছে না। “মঁসিয়ে দামাকোর্ত! আমার আশংকা আমার দেরি হয়ে গেছে। আমি তার সেক্রেটারির সাথে দেখা করবো।” বলতে বলতে সেক্রেটারির ডেস্কের দিকে এগোলো সে।
“প্লিজ মাদাম,” রিসেপনশনিস্ট পেছন থেকে ডাকলো তাকে। “আমি— ইলেক্ট্রক টাইপরাইটার আর মানুষের চাপা কণ্ঠস্বরের আড়ালে হারিয়ে গেলো কথাটা। মেরি হতভম্ব সেক্রেটারির দিকে এগোলো, সেও রিসেপশনিস্টের মতোই বিস্মিত।
“হ্যা? আমি আপনাকে কি সাহায্য করতে পারি?”
“মঁসিয়ে দামাকোর্ত, প্লিজ।”
“উনি তো কনফারেন্সে আছেন, মাদাম। আপনার কি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?”
“ওহ্ হ্যা, অবশ্যই,” নিজের পার্সটা আবারো খুলে বললো মেরি। সেক্রেটারি তার ডেস্কে টাইপ করা শিডিউলটার দিকে তাকালো। “আমি দুঃখিত, এই সময়ে তালিকায় কারো দেখা করার উল্লেখ নেই।”
“ওহ্, কী আজব দুনিয়া!” ভালোয়াঁ ব্যাঙ্কের হতাশ ক্লায়েন্ট অবাক হয়ে বললো। “এইমাত্র খেয়াল করলাম। অ্যাপয়েন্টমেন্টটা আসলে আগামীকালকে। আজকে নয়। আমি দুঃখিত।”
ঘুরে আবারো গেটের দিকে ফিরে গেলো সে। তার যা দেখার সেটা সে দেখে ফেলেছে। আলামতের শেষ অংশটা। দামাকোর্তের টেলিফোনের একটা বাতি জ্বলে উঠলো। সেক্রেটারির কাছে সেটা বাইপাস ক’রে দিয়ে বাইরে একটা কল করলো সে। জেসন বর্নের একাউন্টটার সাথে নির্দিষ্ট এবং গোপন নির্দেশ সংযুক্ত করা আছে। যা একাউন্ট হোল্ডারের কাছে প্রকাশ করা হবে না।
একটা দোকানের ছাউনীর নিচে দাঁড়িয়ে বর্ন তার হাত ঘড়িটার দিকে তাকালো। ২টা ৪৯ বাজে। ব্যাঙ্কের সামনের টেলিফোন বুথে ফিরে আসবে মেরি। পরের কয়েক মিনিটই তাদেরকে প্রশ্নের জবাব দিয়ে দেবে। সম্ভবত মেয়েটা ইতিমধ্যেই সেটা জেনে গেছে।
সে দোকানটার বাম দিকের জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো ব্যাঙ্কের দিকে চোখ রেখেই। একজন ক্লার্ক তার দিকে চেয়ে হাসলে তার মনে পড়ে গেলো সব ধরণের মনোযোগ এড়িয়ে যেতে হবে। সিগারেটের প্যাকেট বের ক’রে একটা সিগারেট ধরালো সে। নিজের ঘড়ির দিকে আবারো তাকালো। তিনটা বাজতে আট মিনিট বাকি।
এরপরই তাকে দেখতে পেলো সে। তাকে। তিনজন কেতাদূরস্ত পোশাক পরা লোক রুই মেদেলিনের দিকে একসঙ্গে হেটে আসছে। একে অন্যের সঙ্গে কথা বলছে তারা। তাদের চোখ সরাসরি সামনের দিকে। তারা তাদের সামনে ধীরেসুস্থে হাটতে থাকা লোকজনকে অতিক্রম ক’রে এগিয়ে আসছে। ‘এক্সকিউজ মি’ বলে সৌজন্যতা দেখাচ্ছে তারা, যা প্যারিসিয়ান ব’লে মনে হচ্ছে না। জেসন মাঝখানের লোকটার দিকে মনোযোগ দিলো। লোকটার নাম জোহান। এটাই সে-ই লোক।
জোহানকে ভেতরে যাবার ইশারা করা হলো। আমরা তাদের জন্যে ফিরে আসবো। একজন লম্বা আর শক্তসামর্থ্য লোক গোল্ডরিম চশমা পরে আছে। সেই লোকটা স্টেপডেকস্ট্রাসে কথা বলেছিলো। জোহান। তারা তাকে জুরিখ থেকে এখানে পাঠিয়েছে। সে জেসন বর্নকে দেখে ফেললো। আর এটাই তাকে কিছু একটা বললো : কোনো ছবি মনের পর্দায় ভেসে উঠলো না এবার।
তিনজন লোক প্রবেশপথের কাছে পৌঁছে গেলে জোহান এবং তার ডান পাশে লোকটা ভেতরে ঢুকে গেলো; তৃতীয় লোকটা থাকলো দরজার বাইরে।
বর্ন টেলিফোন বুথের দিকে পা বাড়ালো। তাকে আরো চার মিনিট অপেক্ষা করতে হবে, তারপর তার শেষ কলটা করতে হবে আঁতোয়া দামাকোর্তকে।
সিগারেটটা বুথের বাইরে ফেলে পা দিয়ে পিষে দরজাটা খুললো সে।
“মঁসিয়ে,” পেছন থেকে একজন বললো। জেসন ঘুরে তাকাতেই তার দম বন্ধ হবার জোগার। একলোক দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তাকে চেনা চেনা লাগছে না।
“লো তেলিফোনে ইন লো মার্শে পা। রিগার্দেজ লা ফোর্সে।
“মাখসি, বুঁয়ো। জো ভে ইসায়ে কোয়ান্দ মেমে।”
লোকটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে গেলে বর্ন ভেতরে ঢুকে পড়লো। চার মিনিট পার হয়ে গেছে। পকেট থেকে কয়েন বের ক’রে ডায়াল করলো সে।
“লা ব্যাঙ্ক দা ভালোয়াঁ। বখ।”
দশ সেকেন্ড পরে দামাকোর্ত ফোনে এলো। তার কণ্ঠটা ফ্যাসফ্যাসে শোনাচ্ছে। “আপনি বলছেন, মঁসিয়ে বর্ন? আমার মনে হয় আপনি বলেছিলেন আপনি আমার অফিসে আসছেন।”
“পরিকল্পনায় একটু রদবদল হয়ে গেছে। আমি আপনাকে আগামীকাল ফোন করবো।” বুথের কাঁচ দিয়ে বর্ন দেখতে পেলো আচমকা একটা গাড়ি ব্যাংকের সামনে এসে থামলো। তৃতীয় যে লোকটা বাইরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির ড্রাইভারকে মাথা নেড়ে ইশারা করলো সে।
“—আমি কি করতে পারি?” দামাকোর্ত জানতে চাইলো।
“কি বললেন?”
“না, মানে জানতে চাইছিলাম, আমি কি আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারি? আমার কাছে আপনার একাউন্টটা আছে। সব কিছু আপনার জন্যে প্রস্তুত ক’রে রাখা হয়েছে।”
আমিও সে ব্যাপারে নিশ্চিত, বর্ন ভাবলো। কৌশলটাতে কাজ হয়েছে। “দেখুন, আমাকে আজ বিকেলেই লন্ডনে যেতে হবে। আমি আগামীকাল ফিরে আসছি একটা শাটল ফ্লাইটে ক’রে। সব প্রস্তুত ক’রে রাখুন, ঠিক আছে?”
“লন্ডনে, মঁসিয়ে?”
“আমি আপনাকে আগামীকাল ফোন করবো। আমাকে অরলিতে যাবার জন্যে একটা ক্যাব খুঁজতে হবে।” ফোনটা রেখে ব্যাঙ্কের প্রবেশপথের দিকে তাকালো সে। আধ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে জোহান আর তার সঙ্গী দৌড়ে ব্যাংক থেকে বাইরে চলে এলো। তারা তৃতীয় লোকটার সাথে কথা বলছে, তারপর অপেক্ষারত গাড়িতে উঠে বসলো সবাই।
খুনিদের গাড়ির গন্তব্য এখন অরলি বিমানবন্দর। জেসন গাড়ির নাম্বার প্লেটটা দেখে নাম্বারগুলো মুখস্ত ক’রে রাখলো। এরপর দ্বিতীয় ফোনটা করলো সে। ব্যাঙ্কের পে-ফোনটা যদি ব্যবহৃত না থাকে তবে রিং হতেই মেরি ফোন তুলে নেবে। তাই হলো।
“হ্যা?”
“কিছু দেখেছো?”
“অনেক। দামাকোর্ত হলো তোমার সেই লোক।”