পর্ব ১
পর্ব ২
পর্ব ৩

বর্ন আইডেন্টিটি – ১০

অধ্যায় ১০

তাদের দু’জনের কেউই জানলো না কখন সেটা ঘটলো, অথবা সত্যি বলতে কী, সেটা আসলেই ঘটেছে কিনা বুঝতে পারলো না। যদি ঘটেও থাকে, কতোক্ষণ এটা চলবে, অথবা কতো গভীরে যাবে তাও বুঝতে পারলো না তারা। শুরুতে কোনো নাটকীয়তা ছিলো না, ছিলো না বিজয়ী হবার জন্য কোনো বাঁধাও। কেবল দরকার পড়লো ভাব বিনিময়ের। কথা আর চাহ্নীর সাহায্যে আর অবশ্যই নিচু এবং মৃদু হাস্যরসের মধ্য দিয়ে।

তাদের ঘরটা একেবারে হাসপাতালের মতো। দিনের বেলায় মেরি কাপড়চোপড়, খাবার দাবার, মানচিত্র আর সংবাদপত্রগুলোর ব্যবস্থা করলো। চুরি করা গাড়িটা দশ মাইল দক্ষিণে রেইনাখ শহরে পরিত্যাক্ত অবস্থায় ফেলে একটা ট্যাক্সি নিয়ে লেনজবুর্গে ফিরে এলো সে নিজে। মেরি বাইরে গেলে একটু বিশ্রাম নিলো বর্ন। একটু আধটু হাটাচলাও করলো। তার বিস্মৃত অতীত থেকে কেবল বুঝতে পারলো সেরে ওঠার জন্যে এ দুটো জিনিসের দরকার আছে। আরো দরকার নিয়ম নিষ্ঠা আর ব্যায়ামের। সে এটা এর আগেও করেছে…পোর্ত নোয়ে’রও আগে।

তারা একসাথে থাকার সময় কথা বললো স্বাভাবিক জীবন যাপন করার উদ্দেশ্যে। ঠিক তখনই জেসন তার জীবন রক্ষাকারী মেয়েটার সম্পর্কে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি জানতে পারলো। মৃদু প্রতিবাদ ক’রে সে বললো তার সম্পর্কে মেরি প্রায় সব জানলেও সে নিজে মেরির সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। কোত্থেকে সে এসেছে? কেন একজন আকর্ষণীয়, লাল চুলের মেয়ে, যে কিনা একটা খামারে ছিলো, সে ইকোনোমিক্সে ডক্টরেট করলো?

“কারণ, সে খামারের ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিলো,” মেরি জবাব দিলো।

“ঠাট্টা করছো? একটা খামার, সত্যি খামারে ছিলে?”

“আসলে ছোট্ট একটা র‍্যাঞ্চের মতো। আলবার্তার বিশাল একটা খামারের তুলনায় সেটা ছোটোই বলা চলে। আমার বাবার সময়ে ফরাসিদের পক্ষে পশ্চিমে গিয়ে জমি কেনার ব্যাপারে কিছু অলিখিত বিধিনিষেধ ছিলো। তিনি প্রায়শই বলতেন তার নাম যদি সেন জ্যাক না হয়ে সেন জেসন হোতো তবে তিনি আজ অনেক বড় ধনী হতে পারতেন।”

“তিনি একজন র‍্যাঞ্চার ছিলেন?”

মেরি হেসে ফেললো। “না, তিনি একজন একাউন্টেন্ট ছিলেন, তবে যুদ্ধের কারণে একজন র‍্যাঞ্চার হয়ে গেলেন। রয়্যাল কানাডিয়ান এয়ার ফোর্সে একজন পাইলট ছিলেন তিনি। আমার মনে হয় তিনি যখন আকাশ দেখতেন তখন তার কাছে একাউন্টিং অফিসটা অনেক বেশি বিরক্তিকর ব’লে মনে হতো।”

“সেই কাজের জন্যে খুবই নার্ভের জোর লাগে।”

“তুমি যা জানো তারচেয়েও বেশি। তিনি এমন সব গরু-বাছুর বিক্রি করলেন যা তার নিজের ছিলো না। র‍্যাঞ্চ কেনার আগে তার কাছে কোনো গরু-মহিষ ছিলো না। লোকজন বলতো জাতে একেবারে ফরাসি।”

“আমার মনে হয় আমি তাকে পছন্দ করতাম।”

“তাই করতে।”

আঠারো বছর বয়সের আগে সে তার বাবা-মা আর দুই ভায়ের সঙ্গে ক্যালগারি’তে বসবাস করতো। তারপর মন্ট্রিলের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে এমন একটি জীবন শুরু করলো যার পরিকল্পনা সে কখনও করে নি। এক উদাস ছাত্রি, যে কিনা আলবার্তার কনভেন্ট স্কুলে ঘোড়ার পিঠে চড়ে মাঠঘাট চষে বেড়াতে বেশি পছন্দ করতো, সে আবিস্কার করলো তার নিজের মস্তিষ্কটা ব্যবহার করার ব্যাপারে দারুণ উত্তেজনা বোধ করে।

“এরকমই সহজ ছিলো সেটা,” মেরি তাকে বললো। “আমি বইকে খুবই শত্রু জ্ঞান করতাম, কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলাম আমার চারপাশের লোকজন বই নিয়ে মজে আছে। দারুণ সময় উপভোগ করছে তারা। সারাক্ষণ শুধু কথা হোতো। দিনে রাতে সব সময়। ক্লাশরুমে, সেমিনারে, জনাকীর্ণ ক্যান্টিনে, বিয়ারের সাথে চলতো আডডা। আমার মনে হয় সেইসব কথাবার্তাই আমাকে বদলে ফেলেছিলো। কিছু বুঝলে?”

“আমি কিছু মনে করতে না পারলেও বুঝতে পারছি ঠিক ঠিক,” বৰ্ন বললো। “কলেজ নিয়ে আমার কোনো স্মৃতি নেই। তবে আমি একদম নিশ্চিত, আমি ওখানে ছিলাম।” সে হাসলো। “বিয়ার হাতে আড্ডা মারাটা খুবই পরিচিত মনে হচ্ছে।”

সেও হাসলো। “ডিপার্টমেন্টে আমি খুব উজ্জ্বল ছিলাম। ক্যালগারি থেকে আসা শক্তসামর্থ্য দীর্ঘাঙ্গী এক মেয়ে, মন্ট্রিল বিশ্ব বিদ্যালয়ের অর্ধেক ছেলের চাইতেও বেশি বিয়ার খেতে পারতো সে।”

“তোমাকে অবশ্যই অপছন্দ করতো।”

“না, ঈর্ষা করতো।”

মেরি সেন জ্যাকের সামনে নতুন এক দুনিয়ার দ্বার খুলে গেলো। সে আর তার পুরনো জগতে ফিরে গেলো না। কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি ছাটায় বাড়ি যেতো। আস্তে আস্তে সেটাও কমতে শুরু করলো। মন্ট্রিলে তার বন্ধুবান্ধব আর পরিধিও বেড়ে গেলো। গ্রীষ্মে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে কাজ করতো। প্রথমে সে ইতিহাসে আগ্রহী হলেও পরে বুঝতে পারলো বেশিরভাগ ইতিহাসই অর্থনৈতিক শক্তির দ্বারা আকার লাভ করে—তাই সে অর্থনীতিই বেছে নিলো। ডুবে গেলো তাতে।

পাঁচ বছর ম্যাকগিলে ছিলো। ওখান থেকে মাস্টার্স ডিগ্‌ সম্পন্ন ক’রে কানাডিয়ান সরকারের ফেলোশিপ নিয়ে অক্সফোর্ডে চলে এলো সে।

“আমার মনে হয় আমার বাবাকে দুরারোগ্য কোনো রোগে ধরেছিলো। একদিন তিনি নিজের দামি র‍্যাঞ্চটা ছেলের হাতে দিয়ে আমার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে চলে এলেন আমার কাছে।”

“কথা বলার জন্যে? কেন? তিনি তো একজন একাউন্টেন্ট, আর তুমি ইকোনোমিক্সে ডক্টরেট করছো।”

“ভুল কোরো না,” মেরি ঝটপট বললো। “একাউনন্টেন্ট আর ইকোনোমিস্ট হলো একে অন্যের শত্রু। একজন গাছ দেখে, অন্যজন বন। তাছাড়া আমার বাবা কানাডিয়ান ছিলেন না, তিনি ছিলেন ফ্রেঞ্চ-কানাডিয়ান। আমার মনে হয় তিনি আমাকে ভার্সেই’র একজন বিশ্বাসঘাতক হিসেবেই দেখতেন। কিন্তু আমি যখন তাকে বললাম, ফেলোশিপের একটা কমিটমেন্ট হলো সরকারের হয়ে তিন বছর কাজ করতে হবে, তখন বাবা একেবারে দমে গেলেন। তিনি বললেন আমি ‘ভেতরে থেকেই ভালো সেবা দিতে পারতাম।’ ভিভেকুইবেক লিবারে—ভিভা লা ফ্রান্স!”

তারা দু’জনেই হেসে ফেললো। অটোয়ার সাথে তিন বছরের কমিটমেন্টটা সঙ্গত কারণেই বাড়ানো হলো। যখনই সে চলে যাবার কথা ভাবতো তার গ্রেড বাড়িয়ে দেয়া হোতো। তাকে প্রমোশন দেয়া হোতো। বড় অফিস আর স্টাফ দেয়া হোতো তাকে।

“অবশ্যই ক্ষমতা দুনীর্তির জন্ম দেয়,” সে হেসে বললো। “আর আমাদের চেয়ে এটা ভালো কেউ জানে না। তবে আমার মনে হয় নেপোলিওন এটা ভালো বলেছিলেন : ‘আমাকে যথেষ্ট মেডেল দাও, আমি তোমাদেরকে যেকোনো যুদ্ধে জয় এনে দেবো। তাই আমি থেকে গেলাম। নিজের কাজটা অসম্ভব পছন্দ করতাম আমি।”

জেসন তাকে কথা বলার সময় ভালো করে লক্ষ্য করলো। তার নিয়ন্ত্রিত একটা বহিরাবরণের নিচে শিশুসুলভ চপলতা রয়েছে। তবে সে যা করে বেশ দক্ষতার সাথেই করে। “আমি নিশ্চিত, তুমি খুব ভালো কাজ করতে, কিন্তু তাতে করে তুমি অন্যকিছু করার সময় পেতে না, তাই না?”

“অন্যকিছু মানে?”

“স্বামী, সংসার, বাড়িঘর, এইসব।”

“সেগুলো হয়তো একদিন আসবে। আমি ওগুলো বাতিল ক’রে দিচ্ছি না।”

“কিন্তু ওগুলো তো আসে নি।”

“না। তবে খুব কাছাকাছি কয়েকবার পৌঁছে গিয়েছিলাম, কিন্তু চূড়ান্ত পরিণতির দিকে গড়ায় নি।”

“পিটার কে?”

তার হাসিটা উবে গেলো। “আমি ভুলে গিয়েছিলাম, তুমি ক্যাবলটা পড়েছো।”

“আমি দুঃখিত।”

“দুঃখিত হয়ো না।…পিটার? আমি পিটারকে খুব পছন্দ করি। আমরা প্রায় দু’বছর ধরে একসঙ্গে থেকেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু হয় নি।”

“বোঝাই যাচ্ছে সে কোনো কিছু বেশি দিন ধরে রাখতে পারে না।”

“তা পারে না!” সে আবার হেসে ফেললো। “সে আমাদের সেকশনের পরিচালক, আশা করছে খুব জলদিই ক্যাবিনেটে ঠাঁই পাবে।

“সে বলেছে সে তোমাকে ছাব্বিশ তারিখে এয়ারপোর্ট থেকে তুলে নেবে। তুমি তাকে ক্যাবল ক’রে দাও।”

“হ্যা, আমি জানি।”

মেরির চলে যাওয়া নিয়ে তারা কোনো কথা বললো না। তারা সেই কথাটা এড়িয়ে গেলো, যেনো সেটা দূরের কোনো বিষয়। কি ঘটেছে সেটার সাথে এর কোনো সম্পর্কই নেই। এটা হচ্ছে এমন কিছু যা হতে যাচ্ছে। মেরি বলেছিলো সে তাকে সাহায্য করতে চায়। জেসন সেটা মেনে নিয়েছে। ধরে নিয়েছে মেয়েটা তাকে ভূয়া কৃতজ্ঞতা দেখাচ্ছে, তার সাথে একটা দিন থাকার জন্যে আর সে তার জন্যে কৃতজ্ঞই। তবে অন্য কিছু হওয়াটা একেবারেই অচিন্তনীয় ব্যাপার।

এজন্যেই তারা এ নিয়ে কথা বললো না। কথা আর চানি বিনিময় হলো কেবল। শান্ত আর মৃদু হাসির উদ্রেক হলো এক সময়। এক অদ্ভুত মুহূর্তে তারা খুবই ঘনিষ্ঠ আর উষ্ণ হয়ে উঠলে দু’জনেই ব্যাপারটা বুঝে ফেলে সরে গেলো। অন্য কিছু হওয়া একেবারেই অচিন্তনীয়।

তাই তারা স্বাভাবিকতায় ফিরে এলো। জেসনের কাছে তাদের এই ঘনিষ্ঠতা একেবারেই অযৌক্তিক একটি ব্যাপার। সুইজারল্যান্ডের ছোট্ট একটা গ্রামে এক সঙ্গে আছে তারা। অস্বাভাবিক। নিয়মিত জীবনে অভ্যস্ত মেরির জন্যে এটা একেবারে অভাবনীয়। মেয়েটার জন্যে কোনো সময় হাতে নেই; মেয়েটাও তা জানে, আর এটাই তাকে কঠিন অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।

.

“তুমি যখন সংবাদপত্র পড়ো তোমার তখন কি মনে হয়?”

“মিশ্র অনুভূতি। মনে হয় এটাই চিরন্তন।”

“সিরিয়াস হও। তোমার কাছে কি পরিচিত ব’লে মনে হয়?”

“প্রায় সবকিছুই, তবে আমি তোমাকে বলতে পারবো না কেন।”

“আমাকে একটা উদাহরণ দাও তো।”

“আজ সকালে গূসে আমেরিকান একটি অস্ত্রের চালানের গল্প এবং সেটা নিয়ে জাতিসংঘে তর্কবিতর্কের খবর পড়লাম। রাশিয়া বিরোধীতা করেছে। আমি এর তাৎপর্যটা বুঝতে পারি, এটা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের আধিপত্য নিয়ে লড়াই, মানে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে।”

“আরেকটা উদাহরণ দাও।”

“আরেকটা গল্প আছে, ওয়ারশো’তে অবস্থিত বন সরকারের লিয়াজো অফিস নিয়ে পূর্ব জার্মানির নাক গলানো। ইস্টার্ন ব্লক, ওয়েস্টার্ন ব্লক। এগুলো আমি বুঝি।”

“তুমি সম্পর্কটা বোঝো, তাই না? রাজনীতি, ভূ-রাজনীতি, সব তোমার কাছে খুবই চেনা।”

“অথবা সাম্প্রতিক বিশ্বের ব্যাপারে আমার বেশ ভালো জ্ঞান আছে বলতে পারো। আমার মনে হয় না আমি কখনও একজন কূটনৈতিক ছিলাম। গেইমেনশেফট ব্যাংকের টাকাগুলো সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর ব্যাপারটাকে বাতিল ক’রে দেয়।”

“আমিও একমত। তারপরও, তুমি রাজনৈতিকভাবে বেশ সচেতন। মানচিত্রগুলোর ব্যাপারে কি বলবে? তুমি আমাকে মানচিত্র কিনতে বলেছো। সেগুলোর দিকে তাকালে তোমার মনে কি আসে?”

“কিছু কিছু ক্ষেত্রে নামগুলো শুনে বা দেখে আমার মনে অসংখ্য ছবি ভেসে ওঠে, যেমনটি হয়েছে জুরিখে। বিল্ডিং, হোটেল, পথঘাট…কখনও কখনও কতোগুলো মুখ। তবে কখনও কোনো নাম নয়। মুখগুলোর কোনো নাম থাকে না।”

“তারপরও বলতে হয়, তুমি প্রচুর ভ্রমন করেছো।’

“আমারও তাই মনে হয়।”

“তুমিও সেটা জানো।”

“ঠিক আছে, আমি ভ্রমণ করেছি।”

“তুমি কিভাবে ভ্রমণ করেছো?”

“কিভাবে বলতে কি বোঝাচ্ছো?”

“সেটা কি সাধারণত প্লেনে ক’রে হোতো, নাকি গাড়িতে ক’রে?”

“আমার মনে হয় দুটোই। কেন?”

“বিমান মানে অনেক দূরের পথ। তোমার সাথে কি লোকজন দেখা করে? হোটেল বা এয়ারপোর্টে কোনো মানুষ?”

“পথঘাটে,” সে জবাব দিলো।

“পথঘাটে? পথঘাটে কেন?”

“আমি জানি না। পথেঘাটে লোকজনের সাথে আমার দেখা হয়…নিরিবিলি পরিবেশে। অন্ধকারে।”

“রেস্তোরার? ক্যাফেতে?”

“হ্যা। আর ঘরে।

“হোটেলের ঘর?”

“হ্যা।”

“অফিসে না? ব্যবসায়ীক অফিসে?”

“কখনও কখনও। সাধারণত নয়।”

“ঠিক আছে, লোকজনের সাথে তোমার দেখা হয়। লোকগুলো কি মহিলা না পুরুষ? নাকি উভয়ই?”

“বেশিরভাগ সময়ই পুরুষ। কিছু মহিলাও আছে, তবে পুরুষই বেশি।”

“তারা কি নিয়ে কথা বলে?”

“আমি জানি না।”

“মনে করার চেষ্টা করো।”

“আমি পারছি না। কোনো কণ্ঠস্বর নেই। কোনো শব্দও শোনা যায় না।”

“কোনো শিডিউল থাকে? তুমি লোকজনের সাথে দেখা করো, তার মানে তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। তারা তোমার সাথে দেখা করার জন্যে প্রতীক্ষা করে। তুমিও তাই করো। কে এইসব অ্যাপয়েন্টমেন্টগুলো ঠিক করে? কাউকে তো করতেই হয়?”

“ক্যাবলের মাধ্যমে। টেলিফোনে।”

“কার কাছ থেকে? কোত্থেকে?”

“আমি জানি না। তারা আমার কাছে আসে।”

“হোটেলে?”

“বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হোটেলেই।”

“তুমি আমাকে বলেছো ক্যারিলিওন হোটেলের অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার তোমাকে বলেছে তুমি মেসেজ গ্রহণ করেছো।”

“তাহলে তারা হোটেলেই এসেছিলো।’

“অন্য কেউ, অথবা সেভেনটি-ওয়ানের?

“স্ট্রোডস্টোন।”

“ট্রেডস্টোন। এটা তো তোমার কোম্পানি, তাই না?”

“এতে তো কিছুই বোঝা যায় না। অন্তত আমি কিছু খুঁজে পাই নি।”

“মনোযোগ দাও!”

“মনোযোগ দিচ্ছি। সেটা তালিকায় নেই। আমি নিউইয়র্কে ফোন করেছিলাম।”

“মনে হয় তুমি ভাবো এটা খুবই অস্বাভাবিক। কিন্তু আসলে তা নয়।”

“কেন নয়?”

“এটা হতে পারে কোনো কোম্পানিরই আলাদা একটি ডিভিশন অথবা একটি ব্লাইন্ড সাবসিডিয়ারি—এতে ক’রে একটি কর্পোরেশন তার প্যারেন্ট কোম্পানির পক্ষে কিছু কেনার জন্যে দরদামের বেলায় বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে। এরকমটি প্রতিদিনই করা হয়।”

“তুমি তাহলে কাকে বোঝানোর চেষ্টা করছো?”

“তোমাকে। এটা একেবারেই সম্ভব যে, তুমি আমেরিকার অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্যে একজন ভ্রাম্যমান মধ্যস্থতাকারী। সব কিছুই এর সাথে খাপ খেয়ে যায়। তাৎক্ষণিক পুঁজির জন্যে একটা তহবিল গঠন করা, কোর্পোরেট অনুমোদনের জন্যে গোপনীয়তা মুক্ত করা। একজন পারচেজিং এজেন্টকেই ইঙ্গিত করে সেটা। অথবা, প্যারেন্ট কোম্পানির বিশাল শেয়ার হোল্ডার, কিংবা সেই কোম্পানি একটি অংশে মালিক।”

“তুমি খুব দ্রুত কথা বলছো।”

“আমি এমন কিছু বলি নি যা অযৌক্তিক।”

“তোমার কথায় একটা বা দুটো ফাঁক আছে।”

“কোথায়?”

“একাউন্টটাতে কোনো টাকা ওঠানোর নজীর নেই। কেবল ডিপোজিট করা হয়েছে। এটা তো কেনাকাটা সংক্রান্ত হতে পারে না। এটা বিক্রি সংক্রান্ত হতে পারে।”

“তুমি সেটা জানো না। তুমি তো স্মরণ করতে পারো না। পেমেন্টটা শর্ট ফল ডিপোজিটের মাধ্যমে দেয়া হতে পারে।”

“আমি এমন কি জানিও না এটার মানে কি?”

“একজন ট্রেজারার এটা ভালো করেই জানবে। অন্য ফাঁকটা কি?”

“কোনো কিছু কম দামে কেনার জন্যে লোকজন খুনখারাবি ক’রে বেড়ায় না। তাতে ক’রে সমস্যাই বেশি হবে।”

“হবে, যদি বিশাল কোনো ভুল ক’রে থাকে। অথবা কোনো লোক যদি অন্য কারোর জন্যে ভুলটা ক’রে থাকে। আমি যেটা বলার চেষ্টা করছি সেটা হলো তুমি যা নও তা তুমি হতে পারো না। কে কি বললো তাতে কিছু যায় আসে না।”

“তুমি এটাতে সন্তুষ্ট।”

“আমি এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট। তোমার সাথে আমি তিন দিন ধরে আছি। আমরা কথা বলেছি, শুনেছি। একটা বড়সড় ভুল হয়ে গেছে। অথবা এটা এক ধরণের ষড়যন্ত্র।”

“কে জড়িত? কার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র?”

“ঠিক এটাই তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে।”

“ধন্যবাদ।”

“আমাকে বলো তো, টাকার কথা ভাবলে তোমার মনে কোন্ ভাবনাটা আগে আসে?”

বন্ধ করো! এটা কোরো না। তুমি কি বুঝতে পারছো না? তুমি ভুল করছো। যখন আমি টাকার কথা ভাবি তখন আমার খুন করার কথাই মনে আসে।

“আমি জানি না,” সে বললো। “আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমি ঘুমাতে চাই। সকালে তুমি তোমার ক্যাবলটা পাঠিয়ে দিও। পিটারকে বোলো তুমি আসছো।”

.

মধ্যরাত পেরিয়ে গেলে চতুর্থ দিনের শুরু হলো। তারপরও চোখে ঘুম আসছে না। বর্ন ছাদের দিকে চেয়ে আছে। ঘরের বাতি জ্বালিয়ে রেখেছে মেরি।

সকালে মেয়েটা চলে গেলে তার নিজের পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন শুরু হবে। সে এখানে আরো কয়েকটা দিন থাকবে। ওলেন থেকে ডাক্তারকে ডেকে সেলাই খোলানো হবে। তারপরই প্যারিসে চলে যাবে সে। টাকাগুলো প্যারিসেই আছে। অন্য কিছুও আছে সেখানে। এটা সে জানে, টেরও পাচ্ছে। একটা চূড়ান্ত জবাব নিহিত আছে ওখানে।

তুমি অসহায় নও। তুমি তোমার নিজের পথ খুঁজে পাবে।

কি খুঁজে পাবে সে? কার্লোস নামের এক লোককে? কে এই কার্লোস? জেসন বর্নের সাথে তার কি সম্পর্ক?

কাপড়-চোপড় ঝাড়ার শব্দ শুনে সে দেয়ালের পাশে রাখা সোফার দিকে তাকালো। মেরি ঘুমায় নি দেখে একটু চমকে গেলো সে। তার দিকেই চেয়ে আছে মেয়েটা।

“তোমার ধারণা ভুল, তুমিও সেটা জানো,” সে বললো।

“কিসের ধারণা?”

“তুমি যা ভাবছো।”

“আমি কি ভাবছি তা তুমি জানো না।”

“হ্যা, আমি জানি। আমি তোমার চোখ দেখে বুঝেছি।”

“হতে পারে,” সে জবাব দিলো। “স্টেপডেকস্ট্রাসের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করো। ড্রেই এলপেনহসারের মোটা লোকটার ব্যাপারেই বা কী বলবে?”

“আমি কিছু বলতে পারবো না, তুমিও পারবে না।”

“তবে তাদের আমি দেখেছি।”

“খুঁজে বের করো কেন। তুমি যা নও তা তুমি হতে পারো না, জেসন। খুঁজে বের করো।”

“প্যারিসে,” সে বললো।

“হ্যা, প্যারিসে,” মেরি সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো। একটা হালকা হলুদ রঙের নাইট গাউন পরে আছে সে। তার পাশে এসে তার দিকে চেয়ে নিজের গাউনের বোতামগুলো আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করলো সে। গাউনটা তার শরীর থেকে খসে পড়লে ব’সে পড়লো তার পাশে। দু’হাতে তার মুখটা ধরে চোখে চোখ রাখলো। “আমাকে বাঁচানোর জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ,” ফিফিস্ ক’রে বললো সে।

“আমার জীবন বাঁচানোর জন্যেও তোমাকে ধন্যবাদ,” সে বললো। জানে মেয়েটা কি ভাবছে। তার তো কোনো নারীসঙ্গের স্মৃতি নেই। হয়তো সে ছাড়া আর কাউকে সে কল্পনা করতে পারবে না। মেরি বাতি নিভিয়ে দিলো। তার সব যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিলো সে।

মেরিকে কথাটা বলতে ভয় পাচ্ছে সে। আর এখন কিনা সেই মেয়েটিই বলছে ঠিক আছে। সে তাকে একটা স্মৃতি দিচ্ছে মনে করার জন্যে, কারণ মেয়েটা নিজেও ভয়ংকর অভিজ্ঞতা থেকে মুক্ত করতে উন্মুখ হয়ে আছে। সমস্ত দুশ্চিন্তা তিরোহিত হলো, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে এলো স্বস্তি। এর বেশি তো সে চাইতে পারে না, কিন্তু ঈশ্বর, মেয়েটাকে তার কতোই না দরকার!

দু’হাতে তার স্তন ধরে ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো সে। তার ঠোঁটের আদ্রতা উদ্দীপ্ত করলো তাকে। সরিয়ে দিলো সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব।

চাদর টেনে মেয়েটা চলে এলো তার কাছে।

.

মেয়েটা তার বাহুডোরে, বুকে মাথা রেখে তার কাঁধের ক্ষতস্থানটি সাবধানে এড়িয়ে শুয়ে আছে। বাহুর উপর ভর দিয়ে একটু উঠে বসলো সে। জেসন তার দিকে তাকালে কয়েক মুহূর্তের জন্যে তাদের দু’জনের চোখাচোখি হতেই হেসে ফেললো দু’জনে। মেয়েটা তার বাম হাতের তর্জনী জেসনের ঠোঁটে রেখে মৃদু কণ্ঠে বললো।

“আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই, আর আমি চাই না তুমি আমার কথার মাঝখানে কোনো কথা বলো। আমি পিটারকে ক্যাবল পাঠাচ্ছি না। আপাতত।”

“শোনো, আমার কথাটা শোনো,” মেয়েটার হাত ধরে বললো সে।

“প্লিজ কথা বোলো না। আমি বলেছি ‘আপাতত।’ তার মানে আমি পাঠাচ্ছি না তা নয়, তবে এখন পাঠাচ্ছি না। আমি তোমার সাথেই থাকছি। তোমার সাথে প্যারিসে যাচ্ছি আমি।”

সে জোর ক’রে বললো, “ধরো আমি তোমাকে চাই না।”

সে আরো কাছে এসে তার গালে ঠোঁট ঘষলো। “এতে কাজ হবে না। কম্পিউটার এটা রিজেক্ট করছে।”

“তোমার জায়গায় আমি হলে আমি এতোটা নিশ্চিত হতাম না।”

“কিন্তু তুমি তো আর আমি না। আমি হলাম আমি। আমি জানি তুমি আমাকে অনেক কথা বলতে চাচ্ছো কিন্তু বলতে পারছো না। মনে হয়, আমরা দু’জনেই একে অন্যকে অনেক কিছু বলতে চাচ্ছি। কি ঘটেছে সেটা আমি ব্যাখ্যা করতে পারবো না। হয়তো এটা কোনো পাগলামী, দু’জন কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ এক সঙ্গে নিজেদেরকে নরকে নিক্ষেপ করছে। হয়তো ব্যাপারটা তাই। কিন্তু এ থেকে আমি পালাতে পারি না। তোমার কাছ থেকে আমি পালাতে পারি না। কারণ আমাকে তোমার দরকার। তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছো।”

“কি ক’রে বুঝলে তোমাকে আমার দরকার?”

“তোমার জন্যে আমি এমন কিছু করতে পারি যা তুমি নিজে করতে পারো না। গত দু’ঘণ্টা ধরে আমি সেটাই ভাবছিলাম।” নগ্ন অবস্থায় সে উঠে বসলো। “তুমি বিপুল পরিমাণের টাকা-পয়সার সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে পড়েছো। তবে আমি মনে করি না তুমি খরচের ব্যাপারে অভিজ্ঞ। আগে হয়তো ছিলে, কিন্তু এখন নয়। আমি জানি। আরো কিছু ব্যাপার আছে। আমি কানাডিয় সরকারের র‍্যাঙ্কিং পজিশনে আছি। সব ধরণের ইনকোয়ারির জন্যে ক্লিয়ারেন্স আর প্রবেশাধিকার রয়েছে আমার। আন্তর্জাতিক অর্থনীতি পচে গেছে আর কানাডা হয়েছে ধর্ষিত। আমরা আমাদের নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছি। আমি সেটার অংশ। এজন্যেই আমি দেখতে এবং রিপোর্ট করতে জুরিখে এসেছি, কেবল বিস্মৃত সব তত্ত্ব কপচাতে নয়।”

“তুমি তোমার এই ক্ষমতা দিয়ে, অবস্থান দিয়ে আমাকে সাহায্য করতে পারবে?”

“আমার মনে হয় পারবো। এবং অ্যাম্বাসির প্রোটেকশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। তবে কোনো রকম মারামারি-খুনাখুনি দেখলে আমি ক্যাবল পাঠাবো, এখান থেকে চলে যাবো। আমার নিজের ভয়ের কথা বাদ দাও। সেরকম অবস্থায় আমি তোমার বোঝা হতে চাইবো না।”

“মারামারি দেখলেই,” বর্ন কথাটা আবার উচ্চারণ করলো। “সেটা কখন কোথায় হবে আমি ঠিক করি?”

“আমি এ নিয়ে তোমার সাথে কোনো তর্ক করবো না।”

তার চোখে চোখ রেখে আবারো বলতে লাগলো, “তুমি কেন এসব করছো? তুমি কেবল বলছো। আমরা দু’জনেই কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ যারা নরক থেকে কোনো রকম জানটা নিয়ে পালিয়ে এসেছে। আমাদের কাণ্ডজ্ঞানের কি কোনো মূল্য আছে?”

মেয়েটা স্থির হয়ে ব’সে রইলো। “আমি তো বলেছি আরো কিছু আছে। হয়তো তুমি ভুলে গেছো। চারদিন আগে এক লোক এসে নিজের জীবন বিপন্ন ক’রে আমাকে বাঁচিয়েছে। আমি সেই লোকটাকে বিশ্বাস করি। সে আমাকে যতোটা বিশ্বাস করে তার চেয়েও বেশি। এটাই কেবল আমি বলতে চাচ্ছি।”

“আমি মেনে নিচ্ছি,” তার হাত দুটো ধরে বললো সে। “আমার এটা করা ঠিক হচ্ছে না, তবে আমি মেনে নিচ্ছি। তোমার এই বিশ্বাসটা আমার ভীষণ দরকার।”

“এখন তুমি কথা বলতে পারো,” ফিফিস্ ক’রে বলে চাদরটা নামিয়ে তার শরীরের কাছে চলে এলো সে। “আমার সাথে প্রেম করো, আমার এখন এটার খুব দরকার।”

.

আরো তিনরাত চলে গেলো। আরো ঘনিষ্ঠভাবে তারা খুঁজে পেলো নিজেদেরকে। তারা জানে যেকোনো সময় এসব কিছু বদলে যাবে। আর যখন এটা আসবে, খুব দ্রুতই আসবে। তাই কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলার দরকার যা আর কোনোমতেই এড়ানো যাচ্ছে না।

টেবিলে ধোয়া উঠলো, সাথে গরম আর তেতো কফি। ওয়েটার ছেলেটা তাদের দেখে চলে গেছে কয়েক মিনিট আগে। পেতিত দিউয়ার আর জুরিখ সংবাদপত্রটি দিয়ে গেছে সে। ইংরেজি এবং ফরাসি দুটো ভাষায়। জেসন আর মেরি মুখোমুখি ব’সে পত্রিকাগুলো দেখে যাচ্ছে।

“কিছু পেলে?” বর্ন জানতে চাইলো।

“গুইসান কুয়ের সেই বৃদ্ধ ওয়াচম্যান গত পরশু সমাহিত হয়েছে। পুলিশ এখনও কোনো কূলকিণারা ক’রে উঠতে পারে নি। ‘তদন্ত কাজে অগ্রগতি হচ্ছে, ‘ বলছে তারা।”

“এখানে আরো বেশি কিছু আছে,” ব্যান্ডেজ বাধা বাম হাতে পত্রিকাটা নিয়ে জেসন বললো।

“এখন কি অবস্থা?” হাতের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো মেরি।

“ভালো। আমি এখন আরো বেশি আঙুল ব্যবহার করতে পারবো, খেলার জন্যে।”

“জানি।”

“তুমি খুবই অশ্লীল কিছু ভাবছো,” পত্রিকাটা ভাঁজ করে বললো সে। “এই যে এটা। অন্য দিন তারা যা বলেছে আবারো সেটা বলছে। “টিস আর রক্তগুলো পরীক্ষা করা হচ্ছে।” বর্ন চোখ তুলে তাকালো। “তবে তারা আরো কিছু যোগ করেছে। কাপড়ের টুকরোগুলো; এটা আগে উল্লেখ করা হয় নি।”

“এটা কি কোনো সমস্যা?”

“আমার জন্যে নয়। আমার কাপড়চোপড়গুলো মার্সেই থেকে কেনা হয়েছে। তোমারগুলো? সেটা কি বিশেষ কোনো ডিজাইনারের কাপড়?”

“তুমি আমাকে বিব্রত করছো, ওগুলো সেরকম কিছু ছিলো না। আমার সব জামা কাপড়ই অটোয়ার এক মহিলা বানিয়েছে।”

“তাহলে সেটা আর ট্রেস্ করা যাবে না?”

“আমি তো দেখতে পাচ্ছি না কিভাবে করবে। সিল্ক কাপড়টা এসেছে হংকং থেকে।”

“তুমি কি হোটেলের দোকান থেকে কিছু কিনেছিলে? রুমাল, পিন, এরকম কিছু?”

“না। আমি খুব বেশি শপিং করি না।”

“ভালো। তোমার বন্ধু এইসব ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করে নি?”

“ডেস্কে কিছু জিজ্ঞেস করে নি, আমি তোমাকে সেটা বলেছি। কেবল দু’জন লোক, যাদেরকে তুমি আমার সঙ্গে লিফটে দেখেছো।”

“ফরাসি আর বেলজিয়াম প্রতিনিধি দলের দু’জন।”

“হ্যা।”

“চলো, পরীক্ষা করে দেখি।”

“পরীক্ষা করার কিছু নেই। পল- যে ব্রাসেলস্ থেকে এসেছে—সে কিছু দেখে নি। চোয়ার থেকে মেঝেতে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে এখানে রয়ে গেছে সে। ক্লদ—যে আমাদেরকে থামাতে চেষ্টা করেছিলো, মনে আছে?—আমি ছিলাম মঞ্চের উপর, আলোর মধ্যে। কিন্তু পুলিশের কাছে যাবার আগেই সে লোকজনের ভীড়ে আহত হয়, হাসপাতালে নেয়া হয়েছে তাকে—”

“তখন ওখানে হয়তো সে কিছু বলেছে,” জেসন কথার মাঝখানে বললো।

“হ্যা। তবে আমার ধারণা সে কনফারেন্সে আমার থাকার আসল উদ্দেশ্যটা জানতো। আমার প্রেজেন্টেশন তাকে বোকা বানায় নি। যদি তাই হোতো তবে সে এটা থেকে দূরে থাকতে সিদ্ধান্ত নিতো।”

বর্ন তার কফির মগটা তুলে নিলো। “তুমি…মিত্র খুঁজছো?”

“সত্যি বলতে তাই। একটু আভাস পেতে চাচ্ছি আর কি। কেউ তো আর সরাসরি বলবে না, তারা তাদের তাদের দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থটা দেখছে অথবা অন্য কোনো মার্কেট থেকে কানাডার জন্যে কাঁচা মাল কিনবে। তবে কারা কার সাথে দেখা করছে, একসাথে ডিনার করছে সবই তুমি দেখেবে।”

“আমি এসবের কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“বোঝা উচিত। তোমার নিজের দেশ এই বিষয়ে খুবই স্পর্শকাতর। কে কিসের মালিক? কতো সংখ্যক আমেরিকান ব্যাংক ওপেক-এর টাকায় চলে? কতো সংখ্যক শিল্পকারখানা ইউরোপিয়ান আর জাপানিদের মালিকানায় আছে? ইংল্যান্ড ইটালি আর ফ্রান্স থেকে উড়ে আসা টাকায় কতো হাজার হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে? আমরা সবাই এ নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকি।”

“আমরা?”

মেরি হেসে ফেললো। “অবশ্যই। কোনো পুরুষ যখন জানে, তার দেশ ক্রমাগত বিদেশীদের হাতে চলে যাচ্ছে তখন সে জাতীয়তাবাদী না হয়ে থাকতে পারে না। যুদ্ধে হেরে যাওয়াটা এক সময় মানিয়ে নিতে পারে—নিজেকে প্রবোধ দিতে পারে শত্রু খুব শক্তিশালী ছিলো—কিন্তু অর্থনীতি হারানো মানে শত্রু খুবই স্মার্ট। এক্ষেত্রে দখলদারিত্ব দীর্ঘমেয়াদী হয়, আর তার ক্ষতও হয় দীর্ঘস্থায়ী।”

“তুমি এনিয়ে অনেক ভাবো, তাই না?”

অল্প কয়েক মুহূর্তের জন্যে মেরির চোখে হাস্যরসের প্রকাশটি তিরোহিত হলো। খুব সিরিয়াসলি জবাব দিলো সে, “হ্যা, তা ভাবি। আমার মনে হয় এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

“জুরিখে কি তুমি কিছু শিখেছো?”

“চমকে ওঠার মতো কিছু না,” বললো সে। “সব জায়গায় টাকা ওড়ে। সিন্ডিকেটগুলো যেখানে অভ্যন্তরীন বিনিয়োগ করার চেষ্টা করছে সেখানে আমলারা অন্য দিকে চেয়ে আছে।”

“ঐ ক্যাবলগ্রামে পিটার বলেছে তোমার দৈনিক রিপোর্টটা খুবই উঁচুমানের ছিলো। এটা দিয়ে সে কী বুঝিয়েছে?”

“আমি কিছু সংখ্যক ইকোনোমিক দালাল খুঁজে পেয়েছি আমার ধারণায় তারা কানাডিয়ান ক্ষমতাহীন কর্তাব্যক্তিদের ব্যবহার করছে কিছু কানাডিয়ান সম্পত্তি কেনার জন্যে। আমি একেবারে অজ্ঞ ছিলাম না; এটা হয়তো তোমার কাছে কোনো মানে রাখে না।”

“আমি কোনো কিছু জানতে করতে চাচ্ছি না,” জেসন পাল্টা বললো। “তবে আমার মনে হয় তুমি ভাবছো আমি তাই করতে চাচ্ছি।”

“আমি সেটা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছি না। তুমি যদি অবৈধ কেনাবেচার করে এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থাকো তবে সেটা আমি ট্রেস করতে পারবো। কিন্তু সেই কাজটা আমি টেলিফোনে করতে চাই। সেখানে কোনো কথা লেখা থাকে না।”

“এখন আমি জানতে চাচ্ছি। কিভাবে করবে সেটা?”

“ট্রেডস্টোন সেভেনটি ওয়ান নামে যদি কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোর্পোরেট থেকে থাকে তবে সেটা খুঁজে বের করা যাবেই। আমি পিটারকে প্যারিসের টেলিফোন স্টেশন থেকে ফোন করবো। তাকে বলবো জুরিখে ট্রেডস্টোন সেভেনটি-ওয়ান নামের একটি প্রতিষ্ঠান খুঁজে বেড়াচ্ছি আমি, কিন্তু পাচ্ছি না। আমি তাকে সি.এস করতে বলবো–মানে গোপন তল্লাশী-তাকে বলবো আমি তাকে পরে ফোন করবো।”

“সে যদি ওটা খুঁজে পায়?”

“ওটা যদি ওখানে থাকে তবে সে খুঁজে পাবেই।”

“তারপর আমি সার্টিফাইড ডিরেক্টর হিসেবে যারা আছে তাদের সাথে যোগাযোগ করবো, তাই না?”

“খুবই সাবধানে,” মেরি বললো। “মধ্যস্থতাকারীদের সাহায্যে। যদি বলো তো আমি নিজেই সেটা করবো।”

“কেন?”

“কারণ, তারা আমার সাথে যা করেছে তার জন্যে। অথবা যা করে নি তার জন্যে।”

“যেমন?”

“প্রায় ছয়মাস ধরে তারা তোমাকে ধরার চেষ্টা করে নি।”

“তুমি সেটা জানো না—আমি নিজেই তো সেটা জানি না।”

“ব্যাংক সেটা জানে। মিলিয়ন ডলার অক্ষত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। যেনো কোনো ভুলের কারণে পরিত্যাগ করা হয়েছে তোমাকে।”

বর্ন চেয়ারে হেলান দিয়ে তার হাতের ব্যান্ডেজের দিকে তাকালো। “তুমি বলতে চাচ্ছো আমি যদি পরিত্যাক্ত হয়ে থাকি, তার কারণ ট্রেডস্টেনের ডিরেক্টররা সেই ভুলটাকে সত্যি ব’লে ধরে নিয়েছে।”

“সম্ভবত। তারা ধরে নিয়েছে, তুমি তাদেরকে কোনো অবৈধ লেনদেনে জড়িয়ে ফেলেছো—তার সঙ্গে আছে অপরাধীদের সংযোগ—তাতে তাদের আরো মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হবে। ক্ষুব্ধ সরকারের কাছে কোম্পানিটা প্রকাশিত হয়ে পড়লে ঝুঁকিটা আরো বেড়ে যাবে। অথবা তুমি আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রের সঙ্গে যোগ দিয়েছো, সম্ভবত না জেনেই। যেকোনো কিছু হতে পারে। এজন্যে তারা ব্যাংকের ধারে কাছেও যায় নি। তারা সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত হতে চাচ্ছে না।”

“তাহলে বলা যায়, তোমার বন্ধু পিটার যাই জানুক, আমি আমার আগের অবস্থাই থাকবো।”

“আমরা আগের অবস্থায় ফিরে আসবো, তবে সবকিছু আর আগের মতো থাকবে না। অনেকটা দশের মধ্যে সাড়ে চার পাঁচে উন্নীত হওয়া আর কি।”

“দশ না হয়ে নয় হলেও তাতে কিছু যায় আসে না। লোকজন আমাকে খুন করতে চায় অথচ আমি জানি না কেন। অন্যেরা তাদেরকে থামাতে পারে, তবে তারা সেটা করছে না। ড্রেই এলপেনহসারের লোকটা বলেছিলো ইন্টারপোল আমাকে ধরার জন্যে জাল পেতেছে। আমি যদি সেই জালে আঁটকা পড়ে যাই তবে আমি কোনো জবাবই খুঁজে পাবো না। আমি এমন একজন অপরাধী যে জানে না তার অপরাধটা কি। কোনো স্মৃতি না থাকাটাই আত্মপক্ষ সমর্থনের পক্ষে যথেষ্ট নয়। আর এটাও সম্ভব, আমি হয়তো আত্মপক্ষ সমর্থন করার সময়ই পাবো না।”

“আমি সেটা বিশ্বাস করতে পারছি না, তোমারও তাই করা উচিত।”

“ধন্যবাদ।”

“আমি সত্যি বলছি, জেসন। এসব বলা বন্ধ করো।”

বন্ধ করো। কতোবার আমি নিজেকে এ কথা বলি? তুমি আমার ভালোবাসা, একমাত্র নারী যাকে আমি জানি। তুমি আমাকে বিশ্বাস করো, তাহলে আমি কেন নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছি না?

নিজের পা’টা পরীক্ষা করার জন্যে বর্ন উঠে দাঁড়ালো। তার পায়ে চলৎশক্তি ফিরে এসেছে। আঘাতটা ধারণার চেয়ে কম গুরুতর বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে এখন। সেই রাতে ওলেনের ডাক্তার ভদ্রলোকের সাথে দেখা ক’রে সেলাইগুলো খুলে ফেললো সে। পরিবর্তনটা আসবে আগামীকাল।

“প্যারিস,” জেসন বললো। “জবাবটা প্যারিসেই আছে। আমি কেবল জানি না কোত্থেকে শুরু করতে হবে। এটা খুবই পাগলামী ব’লে মনে হচ্ছে। আমি এমন একজন মানুষ যে কিছু ছবির জন্যে অপেক্ষা করে, কোনো শব্দ বা সংলাপের জন্যে মুখিয়ে থাকে—অথবা একটা দেয়াশলাইয়ের জন্যে—আমাকে কিছু ইঙ্গিত করবে সেজন্যে।”

“পিটারের কাছ থেকে খবর পাওয়ার আগপর্যন্ত অপেক্ষা করছি না কেন? আমি তাকে আগামীকাল ফোন করবো। আমরা আগামীকালই প্যারিসে যেতে পারি।”

“কারণ তাতে কিছুই যায় আসে না। তুমি কি সেটা বুঝতে পারছো না? সে যে খবরই সংগ্রহ করুক না কেন, আমি যে জিনিস জানতে চাই সেটা তার কাছে পাবো না। ঐ একই কারণে ট্রেডস্টোন ব্যাংকের ধারে কাছেও ঘেঁষে নি। আমাকে জানতে হবে লোকজন কেন আমাকে খুন করতে চায়, কেন কার্লোস নামের একজন আমাকে খুন করার বিনিময়ে বিশাল অঙ্কের টাকা দেবে।”

এই পর্যন্তই সে বলতে পারলো, টেবিলে একটা শব্দ হতেই ছেদ পড়লো তার কথায়। মেরি হাতের কাপটা ফেলে দিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে আছে তার দিকে। ফ্যাকাশে হয়ে আছে তার মুখটা। যেনো তার মাথা থেকে সব রক্ত নেমে গেছে। “তুমি এইমাত্র কি বললে?” জানতে চাইলো সে।

“কি বলেছি? বলেছি আমাকে জানতে হবে…”

“নামটা। তুমি এইমাত্র কার্লোসের নামটা বলেছো।”

“হ্যা।”

“এতো ঘণ্টা ধরে, এতো সময় ধরে আমরা কথা বলছি তুমি তো কখনও তার নাম উল্লেখ করো নি।”

বর্ন তার দিকে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করলো। কথাটা সত্যি। সে তাকে সব বললেও কোনো না কোনোভাবে কার্লোসের নামটি বাদ দিয়ে গেছে…অনেকটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই, যেনো তথ্যটা গোপন করার জন্যেই করেছে সেটা।

“মনে হয় কথাটা বলি নি,” সে বললো। “আর এখন তো এও মনে হচ্ছে তুমি জানো কার্লোস কে?”

“তুমি কি ঠাট্টা করছো? যদি ক’রে থাকো তাহলে ঠাট্টাটা মোটেও ভালো হয় নি।”

“আমি ঠাট্টা করার চেষ্টা করছি না। আমার মনে হয় না এটা কোনো ঠাট্টার ব্যাপার। কার্লোস কে?”

“হায় ঈশ্বর—তুমি জানো না!” সে বিস্মিত হয়ে বললো, তার দিকে ভালো ক’রে চেয়ে দেখছে এখন। “তোমার কাছ থেকে যা কেড়ে নেয়া হয়েছে এটা তারই অংশই।”

“কার্লোস কে?”

“একজন গুপ্তঘাতক। তাকে বলা হয় ইউরোপের গুপ্তঘাতক। এমন একজন লোক যাকে বিশ বছর ধরে খোঁজা হচ্ছে। বিশ্বাস করা হয় সে পঞ্চাশ থেকে ষাটজন রাজনীতিক আর সামরিক ব্যক্তিকে হত্যা করেছে। কেউ জানে না সে দেখতে কী রকম…তবে বলা হয় সে প্যারিসের বাইরে থেকে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।”

বর্নের শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল একটা প্রবাহ বয়ে গেলো।

.

ওলেনের ট্যাক্সিটা ইংলিশ ফোর্ড, আর সেটার মালিক বোর্ডিংয়ের ওয়েটারের মেয়ের জামাইর। জেসন আর মেরি পেছনের সিটে বসে আছে। জানালার বাইরে অন্ধকারে ঢেকে থাকা গ্রামীণ এলাকাগুলো অতিক্রম ক’রে যাচ্ছে তারা। সেলাইগুলো খোলা হয়েছে। সে জায়গায় হালকা ব্যান্ডেজ করা হয়েছে স্কচটেপ দিয়ে।

“কানাডায় ফিরে যাও,” খুব নরম ক’রে জেসন কথাটা বললে তাদের মধ্যে নিরবতা ভাঙলো।

“যাবো, আমি তোমাকে বলেছি সেটা। আমার হাতে আরো কয়েকটা দিন আছে। আমি প্যারিস শহরটা দেখতে চাই।”

“আমি চাই না তুমি প্যারিসে যাও। আমি তোমাকে অটোয়াতে ফোন করবো। তুমি ওখানে গিয়ে ট্রেডস্টোনের ব্যাপারে তল্লাশী করে খবরটা আমাকে ফোনে জানাতে পারো।”

“আমার মনে হয়, তুমি বলেছিলে এতে কিছুই যায় আসে না। তুমি জানতে চাও কেন। যতোক্ষণ না তুমি বুঝতে পারছো সব ততোক্ষণ কে এর পেছনে আছে সেটা জানা তোমার কাছে অর্থহীন।”

“আমি একটা পথ খুঁজে নেবো। আমার কেবল দরকার একজন লোককে। তাকে আমি খুঁজে বের করবোই।”

“কিন্তু তুমি তো জানো না কোত্থেকে শুরু করতে হবে। তুমি হলে এমন একজন, যে একটা ছবির জন্যে শব্দের জন্যে প্রতীক্ষায় থাকে। সেগুলো হয়তো আদতে নেই।”

“কিছু না কিছু তো আছেই।”

“কিছু আছে, তবে তুমি সেটা দেখছো না। আমি দেখছি। এজন্যেই আমাকে তোমার দরকার। আমি শব্দগুলো, পদ্ধতিগুলো জানি। তুমি জানো না।”

বর্ন আবছায়ার মধ্যেই তার দিকে তাকালো। “আমার মনে হয় তুমি আরো পরিস্কার ক’রে বললে ভালো হয়।”

“ব্যাংক, জেসন। ব্যাংকের সঙ্গে ট্রেডস্টোনের একটা সংযোগ রয়েছে। তবে তুমি যেভাবে ভাবছো হয়তো সেভাবে নয়।”

.

কুঁজো বৃদ্ধলোকটি একটা ছেঁড়াফাড়া ওভারকোট পরে হাতে কালো রঙের টুপি নিয়ে আরপায়েন গ্রামের চার্চের পথ ধরে হেটে যাচ্ছে; জায়গাটা প্যারিস থেকে দশ মাইল দক্ষিণে। সন্ধ্যার ঘণ্টা বেজে উঠলে লোকটা পঞ্চম সারিতে এসে ঘণ্টা থামার জন্যে অপেক্ষা করলো। এটা তার সিগনাল। সে জানে কিছুক্ষণ আগে একজন তরুণ—জীবিত মানুষের মধ্যে সবচাইতে হিংস্র তার পৈশাচিক একজন—ছোট্ট চার্চটা ঘুরে দেখে গেছে, বাইরে এবং ভেতরের সবাইকে লক্ষ্য ক’রে গেছে সে। লোকটা যদি এমন কাউকে দেখতে পেতো যে তার জন্যে হুমকীস্বরূপ তবে কোনো প্রশ্ন না করেই তাকে হত্যা ক’রে ফেলতো। এটাই কার্লোসের ধরণ।

কার্লোস কোনো ঝুঁকি নেয় না। সেটা যাই হোক না কেন। একমাত্র সান্ত্বনা হলো, যদি কোনো লোক তার কাজ করতে গিয়ে অথবা তার হাতে মারা যায় তবে বিধবার অথবা তার বাচ্চা-কাচ্চাদের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা পৌঁছে যাবে। বলা হয়ে থাকে : কার্লোসের জন্যে কাজ করাটা খুবই মর্যাদার একটি ব্যাপার। ঔদার্যের কোনো ঘাটতি থাকে না। এটাই তার ছোট্ট অথচ সুদৃঢ় সেনাবাহিনীকে গঠিত করতে সাহায্য করেছে। বৃদ্ধ লোকটাও সেটা বোঝে।

মেসেঞ্জার তার টুপিটা ধরে চার্চের ভেতরে হাটতে শুরু করলো আবার। বাম পাশের দেয়াল সংলগ্ন কনফেশনাল বুথগুলো আছে। পঞ্চম বুথের সামনে গিয়ে পর্দাটা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো সে। অন্যপাশে জ্বলতে থাকা একটা মোমবাতির আলোতে ভালো ক’রে কিছু দেখা যাচ্ছে না। তার চোখ এই স্বল্প আলোটা মানিয়ে নেবার জন্যে একটু সময় নিলো। ওপাশে আছে যাজক। যাজক আর পাপীর মধ্যে স্বচ্ছ একটা পর্দার আড়াল রয়েছে। সে ছোট্ট একটা কাঠের চেয়ারে ব’সে ওপাশের পবিত্র মূর্তিটার দিকে তাকালো। সব সময়ের মতো মাথায় হুড ফেলা একজন সন্ন্যাসীর বেশে ব’সে আছে অবয়বটা। লোকটা দেখতে কেমন সেটা ভাবতে চাইলো না মেসেঞ্জার। একরম ভাবাটা তার মানায় না। তার অবস্থানও সেরকম নয়।

“অ্যাঙ্গেলাস দোমিনি” সে বললো।

“অ্যাঙ্গেলাস দোমিনি, ঈশ্বরের সন্তান,” হুড পরা লোকটি নিচু কণ্ঠে বললো। “আপনার দিনকাল কি ভালো যাচ্ছে?”

“আমার তো সময় শেষ। ক্রমশ সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি,” বৃদ্ধলোকটি জবাব দিলো। “তবে আরামে আছি বলা যায়।”

“ভালো। আপনার যা বয়স তাতে নিরাপত্তার জ্ঞান থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।” কার্লোস বললো। “আসল কথায় আসি। আপনি কি জুরিখ থেকে খবর পেয়েছেন?

“পেঁচাটা মারা গেছে, সেই সাথে বাকি দু’জন। সম্ভবত তৃতীয়জনও। আরেকজন হাতে মারাত্মকভাবে আহত পেয়েছে। সে কাজ করতে পারবে না। কেইন উধাও হয়ে গেছে। তারা মনে করছে মেয়েটা তার সঙ্গেই রয়েছে।”

“ঘটনাগুলো অদ্ভুত এক দিকে মোড় নিয়েছে,” বললো কার্লোস।

“আরো আছে। মেয়েটাকে খুন করার অর্ডার যাকে দেয়া হয়েছে তার কোনো খবর নেই। মেয়েটাকে গুইসান কুয়ে’তে নিয়ে যাবার কথা ছিলো তার; কেউ জানে না কী ঘটেছে।”

“কেবল মেয়েটার বদলে ঐ ওয়াচম্যান খুন হয়েছে। সম্ভবত মেয়েটা মোটেই কোনো জিম্মি ছিলো না। একটা টোপ ছিলো সে। সেই টোপ গিলেছে কেইন। আমি সেটা নিয়ে ভাবতে চাই। এই ফাঁকে আমি কিছু নির্দেশনা দিচ্ছি : আপনি কি প্রস্তুত?”

বৃদ্ধলোকটি পকেট থেকে একটা পেন্সিল আর কাগজের টুকরো বের করলো। “বলুন।”

“জুরিখে ফোন করুন। কেইনকে দেখেছে এবং তাকে দেখে চিনতে পারবে এমন একজন লোককে আমি আগামীকাল প্যারিসে চাই। জুরিখের গেইমেনশেফট ব্যাঙ্কের কোয়েনিগের কাছে যান, তাকে বলবেন, তার টেপটা নিউইয়র্কে পাঠিয়ে দিতে। সে যেনো ভিলেজ-স্টেশনের পোস্ট অফিস বক্স ব্যবহার ক’রে।”

“প্লিজ,” বৃদ্ধ লোকটি বাঁধাঁ দিয়ে বললো। “এই বুড়োর হাত আগের মতো অতো দ্রুত লিখতে পারে না।”

“ক্ষমা করবেন আমাকে,” কার্লোস নিচু কণ্ঠে বললো। “আমি খুব ব্যস্ত তাই তাড়াহুড়া ক’রে ফেলেছি। দুঃখিত।”

“দুঃখিত হবেন না, একদমই না। বলে যান।”

“আমি চাই রুই মেদেলিনের ব্যাঙ্কের এক ব্লকের আশেপাশে আমাদের দলটি কয়েকটা ঘর ভাড়া নেবে। এবার কেইন আর রক্ষা পাবে না। ভানকারী তার ভুল অহংকারের কারণে ধ্বংস হবে। যদি না সে… অন্য কিছু হয়ে থাকে।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *