অধ্যায় ১
ট্রলারটা গভীর অন্ধকারে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত সাগরের মধ্যে যেনো ডুবেই গেলো, যেনো কোনো শ্বাসরোধ হওয়া প্রাণী পানিতে তলিয়ে যাবার সময় নিজেকে বাঁচানোর ‘আপ্রাণ চেষ্টা ক’রে যাচ্ছে। সাগরের ঢেউ পর্বতসম উঁচু হয়ে আছড়ে পড়ছে ভয়ংকর গর্জ্জনে। চারপাশে সর্বত্রই প্রাণহীন যন্ত্রণার শব্দ। কাঠের সাথে কাঠের সংঘর্ষ, দঁড়ি মোচড়ানোর আওয়াজ। প্রাণীটা মরতে বসেছে।
দুটো বিস্ফোরণের শব্দ সাগরের বাতাস আর নৌযানের গর্জনকে বিদীর্ন করলো। শব্দ দুটো এসেছে ট্রলারের মৃদু আলোর কেবিন থেকে। দরজা খুলে এক হাতে রেলিং আর অন্য হাতে নিজের পেটটা ধরে এক লোক এগিয়ে যাচ্ছে।
তার পেছন পেছন আরেকজন লোক, যার ভাবভঙ্গী খুবই সতর্ক আর হিংস্র। কেবিনের দরজাটা বন্ধ ক’রে হাতের অস্ত্রটা তুলে আবারো গুলি চালালো সে। পর পর কয়েকটা।
রেলিংয়ের লোকটা সঙ্গে সঙ্গে দু’হাতে নিজের মাথাটা ধরে ফেললো। চতুর্থ বুলেটটার আঘাতে একটু পেছনে টলে গেলো সে। ট্রলারটা আচমকা দুটো দৈত্যাকৃতির ঢেউয়ের মাঝখানে পড়ে গেলে আহত লোকটা একটু শূন্যে ভেসে উঠলো যেনো। সে বাম দিকে ঘুরে গেলেও অন্য হাতটা মাথা থেকে সরাতে পারলো না। ট্রলারটা একটু উপরে উঠে আবার নিচে আছড়ে পড়লে সাগরের পানিতে পুরো ডেক ভেসে গেলো মুহূর্তে। এর ফলে কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা কেবিনের ভেতর হুরমুড় ক’রে উল্টে পড়ে গেলে পঞ্চম গুলিটা এমনিতেই অস্ত্র থেকে ছিট্কে বের হয়ে গেলো। তীব্র এক চিৎকার দিয়ে কিছু একটা ধরার জন্যে হাত বাড়ালো গুলিবিদ্ধ লোকটি। রক্তের প্রবাহ আর সমুদ্রের পানির ছটায় সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। এমন কিছু নেই যে সে ধরতে পারে। ট্রলারটা আবারো ভয়ংকরভাবে দুলে উঠলে ভারসাম্য হারিয়ে আহত লোকটি নিচের সুকঠিন গাঢ় অন্ধকার পানিতে পড়ে গেলো।
.
টের পেলো প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পানি তাকে জাপটে ধরছে। গিলে ফেলছে চারপাশ থেকে, নিচের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। বৃত্তাকারের কুণ্ডলীর মধ্যে পড়ে গেছে সে। তারপরই একটু পানির উপর ভেসে উঠলো আবার—কেবলমাত্র এক দমে একটু নিঃশ্বাস নেবার সুযোগ পেলো সে। ঐ পর্যন্তই। আবারো তলিয়ে গেলো নিচে।
প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে সে তীব্র উষ্ণতাও টের পাচ্ছে। তার মাথায় অদ্ভুত এক ভেঁজা উষ্ণতা তাকে গিলে ফেলা কঠিন শীতল পানিতেও তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। এই উষ্ণতা এমন এক আগুন যে আগুনে কিছু পোড়ে না। কিন্তু চারপাশের প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় তার বুক, পেট, হাত-পা অদ্ভুত এক শীতলতায় অবশ হয়ে যাচ্ছে। সুকঠিন হিমশীতল সমুদ্রটা টের পাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে সে একটু ঘাবড়ে গেছে। পানির ঘূর্ণির বিপরীতে উদ্ভ্রান্তের মতো সে হাত-পা ছুড়তে শুরু করলো এবার। অনুভব করতে পারছে, ভাবতে পারছে, দেখতে পাচ্ছে, আঁচ করতে পারছে সুতীব্র ভীতি আর বেঁচে থাকার সংগ্রামকেও। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, একধরণের প্রশান্তিও বোধ হচ্ছে তার। যেনো ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন এক দর্শক সে, যে কিনা এগুলো টের পেলেও এসবে মোটেও জড়িত নয়।
তারপর আরেক ধরণের ভীতি তার মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো। উষ্ণতা, শীতলতা আর বিচ্ছিন্নতাকে ভেদ ক’রে ঢুকে পড়ছে সেটা। কোনো প্রশান্তির মধ্যে আর নিজেকে রাখতে পারছে না সে! এখন নয়! যেকোনো মুহূর্তে এটা ঘটবে; তবে সে নিশ্চিতও নয় কি ঘটবে। কিন্তু এটা ঘটবেই।
উদ্ভ্রান্তের মতো পানিতে লাথি মারতে শুরু করলো সে। উপরের জলরাশির দেয়ালটাকে খামচে ধরার চেষ্টা করলো। তার বুক দাউ দাউ ক’রে জ্বলছে। পানির উপরে উঠে এলে ঘনকালো ঢেউয়ের উপরে থাকার চেষ্টা করলো। উপরে ওঠো উপরে ওঠো!
একটা দৈত্যাকৃতির ঢেউ এসে আবার তাকে গিলে ফেলতে গেলে সে ঢেউয়ের উপরেই ভেসে রইলো। তার চারপাশে সাগরের ফেনা আর ঘন অন্ধকার। ঘোরো! ঘোরো!
ঘটনাটি ঘটলো। প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণ। সাগরের গর্জন আর বাতাসের তীব্রতা ছাপিয়ে শব্দটা কানে এলো তার। এই দৃশ্য আর শব্দ যেভাবেই হোক না কেন তার মধ্যে এক ধরণের প্রশান্তির সূচনা ঘটালো। আকাশটা আগুনের বৃত্তে আলোকিত হয়ে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে। সেই আলোতে দেখা গেলো টুকরো টুকরো কিছু বস্তু ছিটকে পড়ছে চারপাশের অন্ধকারে।
সে জিতে গেছে। যাইহোক না কেন, সে জিতে গেছে।
আচমকা আবারো নিচের দিকে একটি গহ্বরের ভেতরে তলিয়ে গেলো সে। তার কাঁধে সবেগে ছুটে আসা পানির আঘাত টের পাচ্ছে। মাথার উষ্ণতা আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে এখন…
তার বুক। তার বুকে তীব্র ব্যথা অনুভূত হচ্ছে! তার মাথায় আঘাত লেগেছে—আঘাতটা খুবই তীব্র আর অসহ্য। আবারো এটা ঘটলো! আমাকে একা থাকতে দাও! আমাকে শান্তি দাও!
আবারো!
আবারো সে লাথি মারতে শুরু করলো, চেষ্টা করলো খাচে ধরার…যতোক্ষণ পর্যন্ত না সে ওটা টের পেলো। মোটা, তেলতেলে একটা বস্তু, যা কেবলমাত্র সমুদ্রের সঞ্চালনেই নড়ছে। সে বলতে পারবে না এটা কি, কিন্তু জিনিসটা আছে, আর এটার অস্তিত্ব টের পাচ্ছে, ধরতেও পারছে সে।
ওটা ধরো! ওটা তোমাকে প্রশান্তির দিকে বয়ে নিয়ে যাবে; গাঢ় অন্ধকারের নিস্তব্ধতায়… প্রশান্তির দিকে।
.
পূব আকাশের কুয়াশা ভেদ ক’রে ভোরের সূর্যটা উদিত হলে ভূ-মধ্য সাগরের বুক চক্চক্ ক’রে উঠলো। ছোট্ট মাছ ধরার ট্রলারের ক্যাপ্টেন, যার চোখ দুটো লাল টকটকে আর দু’হাতে রোদে পোড়ার চিহ্ন, বোটের সম্মুখভাগে ব’সে গোলোয়ে ব্যান্ডের সিগারেট খাচ্ছে। শান্ত সমুদ্রটা দেখে খুশি হয়ে খোলা হুইল হাউজের দিকে তাকালো সে; তার ছোটো ভাই সামনের দিকে চেয়ে আছে। অন্য একজন ক্রু কয়েক ফিট দূরে একটা জাল নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে আর কিছু একটা নিয়ে হাসাহাসি করছে। এটা খুবই ভালো কথা, গতরাতে তো হাসার মতো কিছু ছিলো না। ঝড়টা এসেছিলো কোত্থেকে? মার্সেই’র আবহাওয়া সংবাদে এ ব্যাপারে কিছুই বলা হয় নি। তারা যদি সেটা জানাতো তবে উপকূলের নিরাপদ আশ্রয়েই থাকতো তারা। সকালের মধ্যেই এখান থেকে আশি কিলোমিটার দূরে দক্ষিণের লা সিয়েনসুর মে’তে যেতে চায় সে। ট্রলারটা মেরামত করতে হবে। আজকাল কম টাকায় কি কোনো জিনিস মেরামত করা যায়?
গতরাতে এরকম একটা মুহূর্তও এসেছিলো যে আরেকটুর জন্যে তার নিজের জীবনটাই খরচ হয়ে গিয়েছিলো।
“তুয়ো ফাতিগ, হেঁই, মোয়া ফ্রেরে?” তার ভাই চিৎকার ক’রে বলে দাঁত বের ক’রে হাসলো। “ভা তে কুশে মেহঁতেনা। লেইসে মোই ফেয়ার।”
“দাকোর্দ,” সে জবাবে বলেলো। সিগারেটটা ফেলে দিয়ে চলে গেলো তাদের দিকে। “একটু ঘুমালে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না।”
হুইলে নিজের একজন ভাই থাকা খুবই ভালো একটি ব্যাপার। কোনো পারিবারিক বোটে পরিবারের একজন সদস্যেরই পাইলট হওয়া উচিত। তার যে ভাইটি খুব নম্র আর ভদ্রভাবে কথা বলে, শিক্ষিত লোকের মতো আচরণ করে সে তীব্রভাবেই এর বিরোধীতা করেছিলো। পাগল! একবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েই তার ভাইটি নিজের ট্রলার নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে চায়। বদ্ধ পাগল। গতরাতে যখন তার মাছধরার ট্রলারটি উল্টে যেতে বসেছিলো তখন তার ঐসব বইপুস্তকের জ্ঞান কি এমন ভালো কাজে এসেছিলো?
চোখ বন্ধ ক’রে ডেকের উপর ঢেউয়ের ছিটায় নিজের হাত দুটো ভিজিয়ে নিলো সে। হাতে দড়ির ঘষার কারণে যে ক্ষতচিহ্ন হয়েছে তার জন্যে সমুদ্রের নোনা জল বেশ উপকারী। ঝড়ের সময় দড়িগুলো আঁটকে রাখতে গিয়ে হাতে এরকম ফস্কা পড়েছে।
“দ্যাখো! ঐযে ওখানে!”
তার ভাই বললো। বোঝাই যাচ্ছে, পরিবারের এক সদস্যের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির কারণে ঘুমের বারোটা বাজলো বুঝি।
“ওটা আবার কি?” সে পাল্টা চিৎকার ক’রে জানতে চাইলো।
“পানিতে একজন মানুষ! সে কিছু একটা ধরে রেখেছে! কোনো ধ্বংসাবশেষ মনে হয়। মনে হচ্ছে প্লাংকটন জাতীয় কিছু।”
.
ক্যাপ্টেন এখন নিজেই হুইল ধরে আছে। পানিতে ভাসমান শরীরটার দিকে ট্রলারটা ঘুরিয়ে নিয়ে ইঞ্জিনটা বন্ধ ক’রে গতি কমিয়ে ফেললো সে। দেখে মনে হচ্ছে একটু মৃদু আলোড়ন হলেই লোকটার হাতে ধরে থাকা কাঠের টুকরোটা হাত ছাড়া হয়ে যাবে। তার হাত দুটো ধধবে সাদা হয়ে গেছে। শুধু হাত দুটোই পানির উপরে, বাকি শরীরের বেশিরভাগই পানির নিচে।
“দড়ি ফেলো!” ক্যাপ্টেন তার ভাই আর ক্রুম্যানকে চিৎকার ক’রে বললো। “তার পায়ে দড়িটা আঁটকে দাও। আস্তে! ওটা তার কোমরের কাছে নিয়ে আসো। আস্তে আস্তে টানো এবার।”
“তার হাত তো কাঠটা ধরে রেখেছে, ছাড়ছে না!”
“আরেকটু কাছে গিয়ে টেনে তোলো। মনে হয় মরে গেছে।”
“না। সে বেঁচে আছে…তবে অবস্থা খুবই খারাপ। ঠোঁট দুটো নড়ছে। কিন্তু কোনো সাড়া-শব্দ নেই। তার চোখও নড়ছে না। মনে হয় না সে আমাদেরকে দেখতে পাচ্ছে।”
“হাতটা ছেড়ে দিয়েছে!”
“টেনে তোলো তাকে। কাঁধটা ধরে টেনে ওঠাও। আস্তে!”
“হায় ঈশ্বর, তার মাথাটা দ্যাখো!” ক্রুম্যান আর্তনাদ ক’রে উঠলো। “একেবারে ফেঁটে হা হয়ে আছে।”
“ঝড়ের সময় এই কাঠটার সাথে আঘাত লেগেই এমনটি হয়েছে,” ভাইটি বললো।
“না,” ক্যাপ্টেন ভিন্নমত পোষণ করলো। আঘাতটার দিকে সে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। “মনে হয় ধারালো কিছু দিয়ে একেবারে নিখুঁতভাবে কাঁটা হয়েছে। বুলেটের আঘাত। তাকে গুলি করা হয়েছে।”
“তুমি এতোটা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারো না।”
“একটা জায়গায় নিয়ে গেলেই সব পরিস্কার বোঝা যাবে,” ক্যাপ্টেন বললো তার চোখ লোকটার শরীর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। “আমরা পোর্ত নোয়ে যাবো, ওটাই সবচাইতে কাছাকাছি দ্বীপ। ওখানকার ওয়াটারফ্রন্টে একজন ডাক্তার আছে।”
“ঐ ইংরেজটা?”
“সে ওখানে চিকিৎসা করে।”
“যখন সে করতে পারে আর কি,” ক্যাপ্টেনের ভাইটি বললো। “প্রচুর মদ খায় যখন কেবল তখনই পারে। মানুষের চেয়ে পশুপাখির ব্যাপারেই তার সফলতা বেশি।”
“তাতে কিছুই যায় আসে না। ওখানে পৌঁছানোর আগেই এই লোকটা লাশ হয়ে যাবে। ঘটনাক্রমে যদি সে বেঁচেও যায় তবে আমি তার কাছ থেকে বাড়তি পেট্রল এবং যে পরিমাণ মাছ ধরতে পারি নি তার জন্যে টাকা চাইবো। ঔষুধের বাক্সটা নিয়ে আসো। তার মাথাটা বেঁধে দিতে হবে। এছাড়া আমরা আর কীইবা করতে পারি।”
“দ্যাখো!” ক্রুম্যান চিৎকার ক’রে বললো।”তার চোখটা দ্যাখো।”
“চোখের আবার কি হয়েছে?” ভাইটি জানতে চাইলো।
“একটু আগেও ওগুলো একেবারে স্টিলের তারের মতো ধূসর ছিলো। এখন নীল হয়ে গেছে!”
“রোদ উঠে গেছে,” ক্যাপ্টেন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো। “অথবা চোখে ভুল দেখেছো তুমি। মৃতের চোখে কোনো রঙ থাকে না।”
.
গাঙচিলের ডাকের মাঝে মাঝে মাছ ধরার ট্রলারগুলোর হুইসেলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এ দুয়ে মিলে জন্ম দিয়েছে ওয়াটারফ্রন্টের চিরায়ত কোলাহলের। পড়ন্ত বিকেল এখন। আগুনের গোলার মতো সূর্যটা একটু ম্রিয়মান হয়ে পশ্চিম দিকে হেলে রয়েছে। বাতাস থেমে আছে, একটা ভ্যাপসা গরম আবহাওয়া। জেটি আর বেড়াগুলোর ওপাশে পিচঢালা পথ আর কয়েকটা সাদা সাদা ঘরবাড়ি। এই দুয়ের মাঝখানে রয়েছে অযত্নে অবহেলায় বেড়ে ওঠা ঘাস। কয়েক যুগ আগে এখানকার বাসিন্দারা ভুলবশত মনে করেছিলো পোর্ত নোয়ে আরেকটা ভূ-মধ্য সাগরীয় অঞ্চলের ব্যস্ততম এলাকা হয়ে উঠবে। কিন্তু সেটা কখনই হয় নি।
প্রধান সড়কের সাথে সবগুলো বাড়িরই রাস্তা রয়েছে। কিন্তু সারি সারি বাড়িগুলোর মধ্যে শেষ বাড়িটার পথ যে অন্য বাড়িগুলোর তুলনায় একটু বেশি ঘোরানো প্যাঁচানো সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এই বাড়ির মালিক এক ইংরেজ ভদ্রলোক, আট বছর আগে এই পোর্ত নোয়ে’তে এসে আস্তানা গেঁড়েছে এমন একটি কারণে যা এখানকার কেউ বোঝে না, বোঝার চেষ্টাও করে না। সে একজন ডাক্তার আর এই ওয়াটারফ্রন্টে একজন ডাক্তারের দরকার আছে। হুক, সুঁচ আর ছুরি, কাঁচি খুব দ্রুতই জীবনধারণের পাথেয় হয়ে উঠলো, সেই সঙ্গে হয়ে উঠলো অযোগ্যতার একটি নিদর্শনও। ভালো কোনো দিনে লো দত্তুরের ভাবসাব দেখলে খারাপ ব’লে মনে হবে না। কিন্তু মদ আর হুইস্কি খাওয়া অবস্থায় দেখলে এ কথা বলা যাবে না। তার সেলাইয়ের কাজগুলোকে খুব একটা খারাপ বলা যায় না। তবে সত্যি কথা বলতে কি, পেটে বেশি মদ পড়লেই তার কাজ ভালো হয়।
তাস্ত পিস্! তার চেয়ে ভালো কোনো ডাক্তার তো এখানে নেইও।
কিন্তু আজ না; আজকে কেউ এই পথটি ব্যবহার করছে না। আজ রোববার, আর এটা সবাই জানে, প্রতি শনিবারেই ডাক্তার সাহেব মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে থাকেন। হাতের কাছে থাকা যেকোনো পতিতাকে নিয়ে রাতটা শেষ করেন তিনি। তবে এটাও ঠিক, বিগত কয়েকটি শনিবার ডাক্তার সাহেব তার এই রুটিনটা বদলে ফেলেছেন। তাকে গ্রামে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এইটুকু পরিবর্তন ছাড়া আর কিছুই বদলায় নি। স্কচের বোতল ডাক্তারের ঘরে নিয়মিত সরবরাহ করা হয়। তিনি নিজের ঘরেই থাকছেন আজকাল। লা সিওতাত থেকে মাছ ধরার নৌকাটা সেই অজ্ঞাত লোকটিকে, যাকে দেখলে মানুষের চেয়ে লাশ বলেই মনে হয়, নিয়ে আসার পর থেকেই তিনি ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।
.
ডাক্তার জিওফ্রে ওয়াশবার্ন একটু চমকে জেগে উঠলেন। তার থুতনীটা কাঁধের হাড়ের উপর গিয়ে ঠেকলে নিজের মুখের গন্ধ নাকে প্রবেশ করেছিলো। এটা মোটেই সুখকর কিছু নয়। তিনি কয়েক পলক ফেলে একটু ধাতস্থ হয়ে শোবার ঘরের খোলা দরজাটার দিকে তাকালেন। তার রোগীর আরেকটা ঘ্যানঘ্যানানির জন্যেই কি তার এই ঘুমে ব্যাঘাত ঘটেছে? না, কোনো শব্দ তো হচ্ছে না। এমন কি বাইরের গাঙচিলগুলোও দয়া ক’রে শান্ত আছে। পোর্ত নোয়ে’তে আজ ছুটির দিন। মাছ ধরার কোনো ট্রলার আসবে না।
ওয়াশবার্ন তার চেয়ারের পাশে টেবিলে রাখা অর্ধেক খালি হওয়া মদের বোতল আর গ্লাসের দিকে তাকালেন। এটা উন্নতির একটা লক্ষণ। অন্য কোনো রোববার হলে দুটো বোতলই খালি হয়ে যেতো অনেক আগে। গত রাতের যন্ত্রণাটা স্কচের কারণে আরো বেশি জেঁকে ধরেছিলো তাকে। মনে মনে তিনি হাসলেন। আরেকবার কভেন্ট্রির বৃদ্ধ সিস্টার তার স্টাইপেন্ডের টাকায় এটা পাঠিয়ে তাকে আশীর্বাদ করেছেন। মহিলা খুবই ভালো। ঈশ্বর জানে, মহিলা যা পাঠিয়েছেন তার চেয়ে অনেক বেশি পাঠানোর ক্ষমতা তার রয়েছে। তবে মহিলা যা করেছেন তার জন্যে তিনি খুবই কৃতজ্ঞ। একদিন তিনি এটা বন্ধ ক’রে দেবেন, টাকা পাঠানোও বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর সস্তা মদের দ্বারস্থ হবেন তিনি, আর এটা চলতে থাকবে মৃত্যুর আগপর্যন্ত।
তিনি এটা প্রায় মেনেই নিয়েছিলেন…যদি তিন সপ্তাহ পাঁচ দিন আগে এই অর্ধমৃত আগন্তুকটা না আসতো। জেলেরা তাকে পানি থেকে টেনে তুলেছে, তবে লোকটা কে, সেই পরিচয় তারা বের করতে পারে নি। বের করার কোনো পারোয়াও তারা করে নি। তাদের কাজটা ছিলো মানবিক, এসবে জড়িত হওয়ার কোনো ইচ্ছে তাদের নেই। ঈশ্বরই সেটা ভালো বুঝবেন।
লোকটা গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
কিন্তু জেলেরা যা জানতে পারে নি, তা হলো বুলেটগুলো লোকটার শরীরের অনেক ভেতরে ঢুকে গেছে। ঢুকে গেছে মনেরও গভীরে।
ডাক্তার সাহেব নিজের ভারি শরীরটা চেয়ার থেকে তুলে জানালার কাছে গিয়ে পোতাশ্রয়ের দিকে তাকালেন। চোখ দুটো একটু সরিয়ে কুচকে ফেললেন সূর্যের আলোর কারণে। তারপর নিচের রাস্তার যেখান থেকে হৈহল্লাটা আসছে সেখানে ভালো ক’রে তাকালেন। ঘোড়ায় টানা একটা গাড়ি; এক জেলে পরিবার ছুটির দিনে বাইরে যাচ্ছে বেড়াতে। এরকম দৃশ্য অন্য কোথাও কি কেউ দেখতে পাবে? তারপরই তার মনে পড়ে গেলো লন্ডনে পর্যটকদের পরিবহনে ব্যবহৃত ঘোড়ার গাড়িগুলোর কথা। তুলনাটা করতেই তিনি উচ্চস্বরে হেসে ফেললেন। তবে তার হাসিটা ক্ষণস্থায়ী হলো, সেই জায়গায় যেটা প্রতিস্থাপিত হলো সেটা তিন সপ্তাহ আগেও অচিন্তনীয় ছিলো। তিনি ইংল্যান্ড দেখার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেটা সম্ভব। এই আগন্তুকের জন্যে সেটা সম্ভব হতেও পারে।
যদি তার অনুমানটি ভুল না হয়ে থাকে তবে এটা যেকোনো একদিন ঘটবে, যেকোনো দিন, যেকোনো সময়। পায়ে, পেটে আর বুকের আঘাতটি খুবই মারাত্মক; এটা এজন্যে নয় যে, বুলেটগুলো শরীরের ভেতর রয়ে গেছে, বরং সেখানে সমুদ্রের পানি ঢুকে গিয়েছিলো। বুলেটগুলো বের করাটা তেমন বিপজ্জনক নয়, মাংস নরম আর পরিস্কার হয়ে গেছে, ছুরি চালানোর জন্যে একেবারে যথার্থ অর্থেই প্রস্তুত বলা চলে। কোরানিয়াল আঘাতটি হলো আসল সমস্যা। দেখে মনে হচ্ছে এটা থালামাস আর হিপোক্যাম্পাস এলাকাটি ঘেষে চলে গেছে। আর এক মিলিমিলিটার এদিক ওদিক হলেই উভয় দিকের বিরাট ক্ষতি হয়ে যেতো। বুলেটগুলো বাধাগ্রস্ত হয় নি, তাই ওয়াশবার্ন একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। ছত্রিশ ঘণ্টা ধরে একেবারে পানি স্পর্শ করলেন না। একজন মানুষের পক্ষে যতো বেশি পরিমাণ সম্ভব মদ আর রুটি খেলেন তারপর লন্ডনের ম্যাকক্লিন্স হাসপাতাল থেকে বরখাস্ত হবার পর সবচাইতে জটিল কাজটি করতে নেমে পড়লেন তিনি। আস্তে আস্তে ক্ষতস্থানটি পরিস্কার ক’রে তাতে চাকু চালিয়ে চামড়া ভেদ করলেন। জানেন একটু এদিক ওদিক হলেই রোগীর মৃত্যু হবে।
এই অজ্ঞাত পরিচয়ের রোগীটি কোনো কারণে মারা যাক সেটা তিনি চান না।
কাজটা শেষ হবার পরও যখন লক্ষণগুলো আগের মতোই থাকলো তখন ডা: জিওফ্রে ওয়াশবার্ন তার রাসায়নিক এবং মানসিক তৃপ্তিতে ফিরে গেলেন। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে রইলেন। তবে একেবারে বদ্ধ মাতাল হলেন না। কোথায় আছেন, কি করছেন, সেই জ্ঞানটা থাকলো। নিশ্চিতভাবেই এটা একটা উন্নতি।
সম্ভবত এখন থেকে যেকোনো দিন, যেকোনো সময় আগন্তুক হয়তো চোখ খুলে কোনো বুদ্ধিদীপ্ত শব্দ আওড়াবে।
এমন কি যেকোনো মুহূর্তেও সেটা হতে পারে।
.
শব্দটাই আগে এলো। সেটা এমনভাবে ঘরে ভেসে বেড়ালো যেভাবে ভোরের সামুদ্রিক নির্মল বাতাস ঘরটাকে ঠাণ্ডা ক’রে দেয়।
“ওখানে কে? এই ঘরে কে?”
ওয়াশবার্ন নিজের খাটে আস্তে ক’রে ধীরসুস্থে উঠে বসলেন, আচমকা কোনো শব্দ বা চমকে যাবার মতো কিছু করলে রোগীর মানসিক অবস্থায় বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এরকম সময় প্রথম কয়েক মিনিট অপারেশন করার মতোই নাজুক। তার নিজের ভেতরের ডাক্তার সত্তাটি খুব দ্রুত প্রস্তুত হয়ে গেলো।
“একজন বন্ধু,” তিনি নরম কণ্ঠে বললেন।
“বন্ধু?”
“তুমি ইংরেজিতে কথা বলছো দেখছি। আমিও তাই ভেবেছিলাম। ধারণা করেছিলাম আমেরিকান কিংবা কানাডিয়ান হবে। তোমার দাঁতের যে ডাক্তারি অপারেশন আমি দেখেছি সেটা বৃটেন কিংবা প্যারিসে হওয়ার কথা নয়। এখন তোমার কেমন লাগছে?”
“বুঝতে পারছি না।”
“একটু সময় লাগবে। তুমি কি পেট পরিস্কার করবে এখন?”
“কি?”
“একটা টিসুপেপার নিয়ে নাও, বুড়ো খোকা। এজন্যেই তো তোমার পাশে প্যানটা রাখা আছে। সাদাটা তোমার বাম দিকে।”
“কি বললেন?”
“খুবই স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড। আমি তোমার ডাক্তার। আমার নাম জিওফ্রে ওয়াশবার্ন। তোমার নাম কি?”
“কি?”
“আমি বলছি, তোমার নাম কি?”
আগন্তুক একপাশের সাদা দেয়ালটার দিকে তাকালো। রোদ এসে পড়েছে সেখানে। এরপর সে ফিরে তাকালে তার নীল চোখ জোড়া ডাক্তারের দিকে সরাসরি নিক্ষিপ্ত হলো। “আমি জানি না।”
“হায় ঈশ্বর।”
.
“আমি তো তোমাকে বলেছিই, সময় লাগবে। যতো বেশি মনে করার জন্যে চাপাচাপি করবে ততো বেশি খারাপ হবে পরিস্থিতি। খুবই খারাপ হবে।”
“আপনি মদ খেয়েছেন।”
“সবসময়ই তো খাই। এটা নিয়ে তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে। শোনো, আমি তোমাকে কিছু কু দিতে পারি। যদি তুমি আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো।”
“আমি শুনছি।”
“না, তুমি শুনছো না, তুমি মুখ সরিয়ে নিচ্ছো। তুমি নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছো। নিজের মনটাকেও রেখেছো কোনো বাক্সে বন্দী ক’রে। আমার কথাটা আবার শোনো।”
“আমি শুনছি।”
“তুমি যখন দীর্ঘদিন কোমায় ছিলে, মানে অচেতন ছিলে, তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলেছো তখন। ইংরেজি, ফরাসি আর এমন একটা অদ্ভুত ভাষা যা আমার মতে কোনো প্রাচ্যদেশীয় ভাষাই হবে। তার মানে তুমি বহু ভাষায় দক্ষ। তুমি পৃথিবীর অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছো। একটু ভৌগলিকভাবে ভাবো। তুমি কোন্টাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করো?”
“অবশ্যই ইংরেজি।”
“ঠিক আছে। তাহলে অস্বস্তি লাগে কোন্টাতে?”
“আমি জানি না।”
“তোমার চোখ দুটো বৃত্তাকার, ছোটো নয়। আমি নিশ্চিত করেই বলবো প্রাচ্যদেশীয়।”
“অবশ্যই।”
“তাহলে এ ভাষায় কথা বলছো কেন? এবার একটু ভালো ক’রে খেয়াল করো। আমি কিছু শব্দ লিখছি। সেগুলো শোনো। আমি শব্দগুলো উচ্চারণ করছি। মা-কাওয়া। তাম-কুয়ান। সি-সাহ্। এসব শুনে তোমার মনে সবচাইতে প্রথমে যা এলো সেটা আমাকে বলো।”
“কিছুই মনে আসছে না।”
“বেশ ভালো পারফর্মেন্স।”
“আপনি চাচ্ছেনটা কি?”
“কিছু একটা। যেকোনো কিছু।”
“আপনি মাতাল।”
“এটা আমি আগেই স্বীকার করেছি। সবসময়ই তাই থাকি। তবে আমিই কিন্তু তোমার এই জীবনটা বাঁচিয়েছি। মাতাল হই আর যা-ই হই, আমি একজন ডাক্তার। এক সময় খুবই ভালো একজন ডাক্তার ছিলাম।”
“কি হয়েছিলো?”
“রোগী ডাক্তারকে প্রশ্ন করছে?”
“কেন করবে না?
ওয়াশবার্ন একটু থেমে জানালা দিয়ে বাইরের জলরাশির দিকে তাকালেন। “আমি মাতাল ছিলাম,” বললেন তিনি। “তারা বললো আমি অপারেশন টেবিলে মাতাল হয়ে অপারেশন ক’রে দু’জন রোগীকে মেরে ফেলেছি। তারা এ থেকে খুব সহজেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। আমার মতো কোনো মানুষকে কখনও এই সম্মানজনক পোশাক আর ছুরি দেবে না, বুঝলে।”
“তার কি কোনো দরকার আছে?”
“কোটার কথা বলছো?”
“মদের বোতলের।”
“হ্যা। অবশ্যই দরকার আছে।” জানালার দিক থেকে মুখ সরিয়ে এনে ওয়াশবার্ন আস্তে ক’রে বললেন। “সেটা আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। আর ডাক্তার কোন্ বিষয়ে মনোযোগ দেবে সেটা রোগীর ঠিক ক’রে দেবার কথা নয়।”
“দুঃখিত।”
“তোমার দেখি ক্ষমা চাওয়ার বিরক্তিকর অভ্যাস আছে। তবে তুমি এরকম ক্ষমা চাওয়ার লোক এটা আমি মোটেও বিশ্বাস করি না।”
“তার মানে আপনি এমন কিছু জানেন যা আমি জানি না।”
“তোমার ব্যাপারে, হ্যা। অনেক কিছু। তবে খুব কমই বুঝতে পেরেছি।”
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে লোকটা সামনাসামনি বসলো। তার শার্টের খোলা বোতাম দিয়ে বুকের ব্যান্ডেজটা দেখা যাচ্ছে। সে তার হাত দুটো বুকের কাছে এনে ভাঁজ ক’রে রাখলো। তার হাত দুটো বেশ পেশীবহুল। “আমি যখন কোমায় ছিলাম তখন কি এমন কিছু বলেছি যাতে ক’রে আপনার এরকম ধারণা হয়েছে?”
“না, ঠিক তা নয়। গুগুলোর বেশির ভাগই অর্থহীন প্রলাপ। আমি বলছি ভাষার ব্যাপারটা, তোমার ভৌগলিক জ্ঞান—এমন সব শহরের নাম বলেছো যা আমি কখনও শুনি নি—কোনো নাম উচ্চারণ না করার বাতিক আছে তোমার, তুমি চাইলেও সেটা এড়িয়ে গেছো। তোমার কথাবার্তায় আক্রমণ, পশ্চাদপসরণ, লুকানো, পালানো ইত্যাদি ছিলো—সবই হিংসাত্মক। এজন্যে ক্ষতস্থানগুলো রক্ষা করার জন্যে তোমার দু’হাত আমাকে বেঁধে রাখতে হয়েছিলো। তবে এগুলো ছাড়াও আরো কিছু ব্যাপার রয়েছে।”
“কি বলতে চাচ্ছেন? সেগুলো কি? সে কথা কেন আমাকে বলেন নি?”
“কারণ, ওগুলো দৈহিক ব্যাপার। আমি বুঝতে পারছি না কথাটা শোনার জন্যে তুমি প্রস্তুত কিনা।”
লোকটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। তার চোখ দুটোতে ভাবনা খেলে যাচ্ছে এখন। “আমি প্রস্তুত আছি। আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, বলুন?”
“আমরা কি আরো বেশি গ্রহণযোগ্য কিছু নিয়ে শুরু করতে পারি না, মানে তোমার মাথাটা নিয়ে? বিশেষ ক’রে মুখের ব্যাপারটা।”
“সেটার আবার কি হয়েছে?”
“এটা এমন কিছু যা নিয়ে তুমি জন্মাও নি।”
“কি বলতে চাচ্ছেন?”
“একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে ভালো ক’রে দেখলে অপারেশনের চিহ্ন স্পষ্ট বোঝা যায়। তোমার চেহারা বদল করা হয়েছে, বুড়ো খোকা।”
“বদলানো হয়েছে?”
“তোমার গাল দুটো একটু বেশি উঁচু। আমি বলতে পারি ওটাতে অপারেশন করা হয়েছে। তোমার গালের উপরের হাড়টার কথা বলছি—তোমার গালের হাড়ও একটু উঁচু। সেটাতেও অপারেশনের চিহ্ন রয়েছে। আমি বলবো, একটা আচিল সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তোমার নাকটা ইংলিশ নাক। আগের চেয়ে এটা একসময় আরেকটু বেশি খাড়া ছিলো। এটা এখন একটু পাতলাও হয়েছে। তোমার তীক্ষ্ণ চেহারাটা একটু নরম নরম লাগছে। তুমি কি বুঝতে পারছো আমি কি বলছি?”
“না।”
“তুমি দেখতে খুবই আকর্ষণীয়, তবে তোমার চেহারাটা একটু অন্য ধরণের।”
“অন্য ধরণের?”
“হ্যা। তোমার আদল ক্রিকেট কিংবা টেনিস-কোর্টে দেখা প্রতিদিন অসংখ্য এ্যাংলো-স্যাক্সন লোকদের মতো। অথবা বলতে পারি, মিরাবেলের বারে দেখা লোকগুলোর মতো। এসব চেহারা একে অন্যের সাথে খুব বেশি আলাদা ব’লে মনে হয় না, তাই না? সবকিছুই ঠিকঠাক মতো আর জায়গামতো আছে, দাঁতগুলো সোজা, সমান, কান দুটো মাথার তুলনায় চ্যাটানো বা ফ্ল্যাট—ভারসাম্যহীন কিছু নেই, সবই যেখানে থাকার কথা সেখানেই আছে, কেবল একটু নরম।”
“নরম?”
“মানে, ‘বিকৃত’ শব্দটাকে আদর ক’রে বলছি আর কি। নিশ্চিতভাবেই তুমি আত্মবিশ্বাসী, এমনকি উন্নাসিকও, নিজের মতো ক’রে চলতে অভ্যস্ত।”
“আমি বুঝতে পাপরছি না আপনি কি বলতে চাচ্ছেন।”
“তাহলে এটা একটু চেষ্টা ক’রে দ্যাখো। তোমার চুলের রঙ বদলে ফেলো, দেখবে তোমার চেহারাটা একেবারেই বদলে যাবে। হ্যা, একটু ছোপ ছোপ হবে, ডাই করবে। চশমা পরো অথবা গোঁফ রাখো, তাহলেই দেখবে তুমি একেবারে আলাদা একজন হয়ে গেছো। আমার ধারণা তোমার বয়স মধ্য-ত্রিশে, তবে তুমি তার চেয়েও দশ বছরের বেশি বড় হতে পারো, অথবা পাঁচ বছরের।” ওয়াশবার্ন একটু থেমে লোকটার প্রতিক্রিয়া দেখলো, যেনো তার প্রতিক্রিয়া দেখেই সে সিদ্ধান্ত নেবে আরো বলবে, নাকি বলবে না। “চশমার কথা বলছিলাম, তোমার কি সেইসব এক্সারসাইজগুলো মনে আছে, এক সপ্তাহ আগে আমরা যে টেস্টগুলো করেছিলাম?”
“অবশ্যই।”
“তোমার চোখের পাওয়ার একদম ঠিক আছে। তোমার চশমার কোনো দরকার নেই।”
“আমার মনে হয় না আমি চশমা পরতাম।”
“তাহলে তোমার রেটিনা এবং চোখের পাপড়িতে কনট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে কেন?”
“আমি জানি না। কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“আমি কি সম্ভাব্য একটি ব্যাখ্যা দেবো?”
“আমি সেটাই শুনতে চাচ্ছি।”
“তুমি হয়তো খুশি হবে না।” ডাক্তার জানালার সামনে গিয়ে উদাস হয়ে চেয়ে থাকলেন। “কিছু কনট্যাক্ট লেন্স আছে যা কেবল চোখের রঙ বদল করার জন্যে পরা হয়। সাধারণত যারা ধূসর অথবা নিল চোখের হয় তারাই বেশি পরে থাকে। তোমারটা মিশ্র। এরকম আলোতে পিঙ্গলবর্ণের কিংবা ধূসর, আরেক রকম আলোতে সেটাই আবার নীল হয়ে যায়। প্রকৃতি এক্ষেত্রে তোমার পক্ষে। রঙ বদলানোর জন্যে কোনো কিছুরই দরকার নেই তোমার।”
“কিসের দরকার নেই?”
“তোমার বেশভূষা খুবই পেশাদারীভাবে বদলাবার কথা বলছি আর কি। ভিসা, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স—এসব নেবার জন্যে অনেকেই এটা ক’রে থাকে। চুলে ধূসর, বাদামী, সাদা, সোনালী ইত্যাদি রঙ করা যায়। কিন্তু চোখ— সবুজ, ধূসর, নীলে বদলাতে পারবে না, পারবে কি?”
চেয়ার থেকে একটু কষ্ট ক’রে উঠে দাঁড়ালো রোগী। ওঠার সময় তার শ্বাস কষ্টও হলো। “আপনি হয়তো ঠিক ধরতে পেরেছেন, আবার এমনও হতে পারে, ভুল অনুমান করছেন।”
“চিহ্নগুলো আছে। সেটাই তো আলামত।”
“সেটা তো আপনার ব্যাখ্যা, খুব বেশি মদ গিলেছেন তাই হয়তো সন্দেহবাতিকতায় আক্রান্ত হচ্ছেন। ধরুন আমার একটা দূর্ঘটনা হয়েছিলো, সেজন্যেই অপারেশন করতে হয়েছিলো। এটা কি হতে পারে না?”
“তোমার চিহ্নটা যেরকম তাতে দূর্ঘটনাজনিত ব’লে মনে হচ্ছে না। ডাই করা চুল, হাড়ের সংকোচন আর একটা আঁচিলের অপসারণ তা বলছে না।”
“আপনি তো সেটা জানেন না!” অজ্ঞাত পরিচয়ের লোকটি রেগেমেগে বললো। “বিভিন্ন ধরণের দূর্ঘটনা আছে, তার জন্যে অপারেশনও রয়েছে আলাদা আলাদা রকম। আপনি তো সেখানে ছিলেন না। আপনি নিশ্চিত হতে পারেন না।”
“ভালো! আমার সাথে আরো রাগ দেখাও। তুমি তো সচরাচর এরকমটি আমার সাথে করো না। আর তুমি যখন ক্ষেপে যাবে, সেই মুহূর্তের একটু ভাববে। তুমি কি ছিলে? কে তুমি?”
“একজন সেলস্ম্যান…বহুজাতিক কোম্পানির এক্সিকিউটিভ, দূরপ্রাচ্যের ওপর অভিজ্ঞ কেউ। সেটা তো হতে পারে। অথবা একজন শিক্ষক…ভাষার শিক্ষক। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের। এটাও তো সম্ভব।”
“চমৎকার। এ থেকে যেকোনো একটা বেছে নাও তাহলে। এখনই!”
“আমি…আমি পারছি না।” লোকটার চোখেমুখে অসহায়ত্বের ছাপ দেখা যাচ্ছে এবার।
“কারণ তুমি বিশ্বাস করো তুমি এগুলোর কোনোটাই নও।”
লোকটা সজোরে দু’পাশে মাথা নাড়লো। “না, তা করি না। আপনি করেন কি?”
“করি না,” ওয়াশবার্ন বললেন। “একটা নির্দিষ্ট কারণেই সেটা আমি বিশ্বাস করি না। ঐসব পেশায় শারীরিক শক্তির কোনো ব্যবহার হয় না। কিন্তু তোমার এমন একটি শরীর আছে যাতে শারিরীক পরিশ্রম আর শক্তির ব্যাপার রয়েছে। ওহ্, তার মানে আমি এই বলছি না যে, তুমি একজন ক্রীড়াবিদ অথবা সেরকম কিছু। তুমি এরকম সাধারণ কেউ নও। তোমার মাংসপেশী বেশ সুগঠিত। শক্তিশালী হাত তোমার। আমি বরং তোমাকে সেদিক থেকে কোনো শ্রমিকই বলবো। যে কিনা ভারি ভারি জিনিস তোলে অথবা সমুদ্রে জাল ফেলে সারাদিন পরিশ্রম করে। কিন্তু তোমার জ্ঞানের পরিধি দেখে বলতে বাধ্য হচ্ছি, সেটাও বাদ দিতে হচ্ছে আমাকে।”
“আমার কেন মনে হচ্ছে আপনি অন্য কিছুর দিকে ইঙ্গিত করছেন?”
“কারণ, কয়েক সপ্তাহ ধরে খুব ঘনিষ্ঠভাবে এবং প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আমরা একসাথে কাজ ক’রে যচ্ছি। তোমার একটা প্যাটার্ন আছে।”
“তাহলে আমি ঠিকই আছি?”
“হ্যা। আমাকে এটাও লক্ষ্য রাখতে হয়েছে এইমাত্র বলা আমার কথাগুলো তুমি কিভাবে গ্রহণ করবে। মানে এর আগের করা সার্জারি, চুলের ব্যাপারটা আর কনট্যাক্ট লেন্সের কথা বলছি।”
“আপনার এই পরীক্ষায় আমি কি পাস করেছি?”
“টেনেটুনে। এখন সময় হয়েছে, এটা না বলে আর উপায়ও নেই। খুলেই বলি তোমাকে, আমার অতো ধৈর্য নেই। এসো আমার সাথে।” ওয়াশবার্ন লোকটাকে পাশের একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। বোঝাই যাচ্ছে এই ঘরটাই তার ডিসপেন্সারি। এক কোণে একটা প্রজেক্টরের কাছে গেলেন তিনি। “এটা আমি মার্সেই থেকে এনেছি,” প্রজেক্টরটা চালু ক’রে বললেন। “এটা তেমন ভালো না হলেও আমাদের কাজ চলবে। জানালার পর্দাগুলো নামিয়ে দেবে কি?” নামহীন অথবা স্মৃতিহীন লোকটাকে বললে লোকটা জানালার পর্দাগুলো নামিয়ে দিতেই সঙ্গে সঙ্গে ঘরটা অন্ধকারে ডুবে গেলো। ওয়াশবার্ন প্রজেক্টরটা সচল করলে দেয়ালে ভেসে উঠলো একটা সাদা রঙের চারকোনা উজ্জ্বল আলো। এরপর তিনি ছোট্ট একটা সেলুলয়েড লেন্সের সামনে ঢুকালে সেই চারকোনা সাদা উজ্জ্বল আলোটার মাঝখানে কতোগুলো বড় বড় অক্ষর ভেসে উঠলো এবার।
গেইমেনশ্যাফট ব্যাংক
ব্যানহফস্ট্রাস। জুরিখ।
০-৭-১৭-১২-০-১৪-২০-২০-৬-০
“এটা কি?” নামহীন লোকটা জানতে চাইলো।
“এটা দ্যাখো। ভালো ক’রে দ্যাখো। ভাবো।”
“এটা তো কোনো ব্যাংক একাউন্ট বলেই মনে হচ্ছে।”
“ঠিক। একটা ব্যাংকের ঠিকানা। কিন্তু নিচের হাতের লেখাটা একাউন্টের মালিকের স্বাক্ষর। স্ট্যান্ডার্ড নিয়ম।”
“এটা আপনি কোত্থেকে পেলেন?”
“তোমার থেকে। এটা খুবই ক্ষুদ্র একটি নেগেটিভ। আমার অনুমান, পয়ত্রিশ মিলিমিটারের অর্ধেক আকারের হবে ফিল্মটা। এটা প্রোথিত ছিলো—সার্জিক্যাল অপারেশন ক’রে তোমার ডান ঊরুর চামড়ার নিচে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিলো। সংখ্যাগুলো তোমার হাতেরই লেখা। স্বাক্ষরটাও তোমার। এটা দিয়ে তুমি জুরিখের একটা ভল্ট খুলতে পারবে।”