উপসংহার
বৃগেডিয়ার জেনারেল ক্রফোর্ড সোফার পাশে ফাইল ফোল্ডারটা রেখে দিলো। “এটা আর আমার দরকার নেই,” কথাটা সে সামনের চেয়ারে বসা সেন মেরি জ্যাকের উদ্দেশ্যে বললো। “আমি এটা বার বার দেখেছি। চেষ্টা করেছি কোটা মিস্ করেছি সেটা খুঁজে বের করতে।”
“যা কেউ করবে না তা আপনি করছেন,” হোটেলের সুটে অন্য যে লোকটা ছিলো সে বললো। সে হলো মনোবিজ্ঞানী ডাক্তার মরিস পানোভ। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। সকালের প্রথম আলোটা তার মুখে এসে পড়েছে। “আমি এসবের সঙ্গেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবো।”
“প্রায় দু’সপ্তাহ হয়ে গেলো,” অধৈর্যের সাথে মেরি বললো। “আমি বিস্তারিত জানতে চাই। আমার মনে হয় আমি এটা চাইতেই পারি। এটা জানার অধিকার আমার আছে।”
“তা আপনার আছে। এটা হলো একটা মানসিক ভারসাম্যহীনতা, যাকে বলা যেতে পারে একধরণের ক্লিয়ারেন্স।”
“মানসিক ভারসাম্যহীনতা,” পানোভ এক মত হয়ে বললো।
“সুরক্ষা?” মেরি ভুরু তুলে বললো।
“সেটাতে আমরা আসছি,” পানোভের দিকে তাকিয়ে বললো জেনারেল। “সবার দৃষ্টিকোণ থেকেই এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার বিশ্বাস আমরা সবাই এটা মেনে নেবো।”
“প্লিজ! জেসন—কে সে?”
“তার নাম ডেভিড ওয়েব। সে ফরেন সার্ভিসের একজন অফিসার ছিলো। দূরপ্রাচ্যের উপর পারদর্শী একজন। পাঁচ বছর আগে সরকারের সঙ্গে তার বিচ্ছেদের আগ পর্যন্ত সে তা-ই ছিলো।”
“বিচ্ছেদ?”
“আপোষে পদত্যাগ করা আর কি। মেডুসাতে তার কর্মকাণ্ড স্টেট ডিপার্টমেন্ট অনুমোদন করে নি। ‘ডেল্টা’ খুবই কুখ্যাত হয়ে উঠেছিলো, আর অনেকেই জানতো সে হলো ওয়েব। এ ধরণের লোককে কোনো ডিপ্লোমেটিক কনফারেন্স টেবিলে মানায় না।”
“তারা বলে সে সবখানেই ছিলো? মেডুসায়?”
“হ্যা। আমি ওখানে ছিলাম। তারা যা বলে সে তার সবটাই।”
“এটা তো বিশ্বাস করা কঠিন,” মেরি বললো।
“সে নিজের খুবই ব্যক্তিগত কিছু হারিয়েছিলো, আর সেটা সে মেনে নিতে পারে নি। ধ্বংসলীলায় মেতে উঠলো সে।”
“কি হারিয়েছিলো সে?”
“তার পরিবার। তার স্ত্রী ছিলো এক থাই মেয়ে। তাদের দুটো সন্তানও ছিলো। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। তার পোস্টিং ছিলো নম পেন-এ। মেকং নদীর কাছেই। এক রবিবার বিকেলে তার বউ-বাচ্চারা নদীর তীরে একটা ডকের উপর যখন ছিলো তখন একটা বোমারু বিমান থেকে বোমা ফেলা হয় তাদের আশেপাশে। ডেভিড ওখানে পৌঁছার আগেই ডকটা গুড়িয়ে যায় বোমার আঘাতে। তার বউ-বাচ্চারা তখন নদীর জলে ভাসছে। তাদের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলো।”
“ওহ্ ঈশ্বর,” মেরি আফসোস ক’রে বললো। “প্লেনটা কাদের ছিলো?”
“এটা কখনও চিহ্নিত করা যায় নি। হ্যানয় এটা অস্বীকার করেছে। সায়গন বলেছে এটা তাদের ছিলো না। মনে রাখবেন, কম্বোডিয়া ছিলো নিরপেক্ষ। কেউ দায়দায়িত্ব নিতে চায় নি। ওয়েব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। সায়গনের উদ্দেশ্যে রওনা হলো সে, মেডুসায় প্রশিক্ষণ নিয়ে ডেল্টা বনে গেলো।”
“তখনই কি সে দাঁজুর সাথে পরিচিত হয়েছিলো?”
“হ্যা, ঠিক তারপরই। ডেল্টা তখন কুখ্যাত একজন। উত্তর ভিয়েতনামি ইন্টেলিজেন্স তার মাথার জন্যে চড়া দাম ঘোষণা করেছিলো। আর আমাদের নিজেদের লোকদের মধ্যে অনেকেই প্রকাশ্যে আশা করতো যে, ভিয়েতনামিরা এতে সফল হবে। এরপরই হ্যানয়, জানতে পারলো ওয়েবের ছোটো ভাই সায়গনের একজন আর্মি অফিসার, সে ডেল্টার উপর স্টাডি করছে—তারা জানতো দু’ভায়ের মধ্যে বেশ ভালো সখ্যতা ছিলো—তারা ঠিক করলো একটা ফাঁদ পাতা হবে। তাদের তো হারাবার কিছু ছিলো না। লেফটেনান্ট গর্ডন ওয়েবকে তারা অপহরণ ক’রে উত্তর ভিয়েতনামে নিয়ে যায়, একজন ভিয়েত কং ইনফর্মারকে এই খবর দিয়ে পাঠায় যে, তাকে তাম কুয়ান সেক্টরে বন্দী ক’রে রাখা হয়েছে। ডেল্টা সেই ইনফর্মারকে নিয়ে—যে কিনা একজন ডাবল এজেন্ট ঐ এলাকাটা ভালো ক’রে চেনে এরকম কয়েকজন মেডুসানকে এক ক’রে একটা দল গঠন করলো। এমন এক রাতে বিমান থেকে সেই এলাকায় নামলো যখন কেউ ওখানে নামার দুঃসাহস করবে না। দাঁজু সেই ইউনিটেই ছিলো। সেই দলে আরেকজন ছিলো যাকে ওয়েব চিনতো না। এক শ্বেতাঙ্গ, যাকে হ্যানয় নিয়ে এসেছিলো। সে একজন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ছিলো। অন্ধকারেও সে ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি খুলে আবার ঠিকমতো লাগিয়ে নিতে পারতো। ঠিক এই কাজটাই সে করেছিলো। ইউনিটের অবস্থান শত্রুপক্ষকে জানিয়ে দেয় সে। ওয়েব ফাঁদটা এড়িয়ে তার ভাইকে খুঁজে পায়। সে ঐ ডাবল এজেন্ট আর শ্বেতাঙ্গকেও খুঁজে পায়, ঘটনাস্থলেই ডেল্টা তাদেরকে হত্যা করে।”
“আর সেই লোকটা?” মেরির চোখ ক্রফোর্ডের দিকে ঘুরলো।
“জেসন বর্ন। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে আসা এক মেডুসান। একজন অস্ত্রবাজ মাদক ব্যবসায়ী। পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে সে কাজ করতো। খুবই হিংস্র একজন, যার ছিলো অপরাধের রেকর্ড। মেডুসার স্বার্থে তার মৃত্যু সংক্রান্ত খবরাখবর ধামাচাপা দেয়া হয়েছিলো। সে একটি বিশেষ ইউনিটের একজন এম.আই.এ হয়ে উঠলো। কয়েক বছর পরে যখন ট্রেডস্টোন গঠন করা হয় তখন ওয়েবকে ডেকে পাঠানো হলো। ওয়েব নিজেই বর্ন নামটি গ্রহণ করেছিলো। এটার বিশ্বাসযোগ্যতা ছিলো। সে এমন এক লোকের নাম গ্রহণ করেছিলো যে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, যাকে সে নিজে তাম কুয়ান-এর জঙ্গলে হত্যা করেছে।”
“তাকে যখন ট্রেডস্টোনের জন্যে ডাকা হলো তখন সে কোথায় ছিলো?” মেরি জানতে চাইলো। “সে করছিলো কি?”
“নিউ হ্যাম্পশায়ারের এক ছোট্ট কলেজে শিক্ষকতা করছিলো। বিচ্ছিন্ন এক জীবনযাপন করছিলো তখনও। অনেকের মতে ধ্বংসাত্মক জীবনযাপন করছিলো। তার নিজের জীবনটা ধ্বংস করছিলো আর কি।” ক্রফোর্ড ফোল্ডারটা তুলে নিলো। “এইসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, মিস্ সেন জ্যাক। বাকিটা ডাক্তার পানোভ বুঝিয়ে দেবেন। তিনি বুঝিয়ে দেবেন আমার এখানে উপস্থিত থাকার কোনো দরকার নেই। অবশ্য একটা তথ্য বাকি আছে, যেটা পুরোপুরি বোঝা দরকার। এটা হোয়াইট হাউজের সরাসরি অর্ডার।”
“সুরক্ষা,” কোনো প্রশ্ন নয়, মেরি এমনি এমনিই বললো।
“হ্যা। সে যেখানেই যাক, যে পরিচয়ই সে পরিচিত হোক, তাকে সারাক্ষণ নজরে রাখা হবে। যতো দিন দরকার পড়বে ততো দিনই এটা করা হবে।”
“প্লিজ, এটা একটু বুঝিয়ে বলুন।”
“সে-ই একমাত্র জীবিত ব্যক্তি যে কার্লোসকে নিজের চোখে দেখেছে। মানে কার্লোস হিসেবে। সে তার পরিচয়টা জানে। কিন্তু সেটা তার মস্তিষ্কে তার বিস্মৃত অতীতের একটি অংশ হিসেবে বন্দী হয়ে আছে। তার কথায় আমরা জানতে পেরেছি, কার্লোস হলো এমন একজন লোক যাকে অনেকেই চেনে—কোনো সরকারের ভেতরের একজন লোক, যার মুখটা খুবই পরিচিত, অথবা কোনো মিডিয়া কিংবা আর্ন্তজাতিক ব্যাঙ্কিংয়ের একজন কর্তা সে। এটা বিদ্যমান তত্ত্বের সাথে খাপ খায়। আসল কথা হলো, এই পরিচয়টা একদিন ওয়েবের কাছে উন্মোচিত হবে। আমরা বুঝতে পারছি ডাক্তার পানোভের সঙ্গে আপনার কয়েকবার আলাপ আলোচনা হয়েছে। আমার বিশ্বাস আমি যা বললাম সেটা তিনি আপনাকে আরো ভালো ক’রে বুঝিয়ে দিতে পারবেন।”
মেরি মনোবিজ্ঞানীর দিকে ঘুরলো। “এটা কি সত্যি, মো?”
“এটা সম্ভব,” পানোভ বললো।
ক্রফোর্ড চলে গেলে মেরি তাদের দু’জনের জন্যে কফি বানিয়ে আনলো। ক্রফোর্ড যেখানে বসেছিলো সোফার ঠিক সেই জায়গায় বসলো পানোভ।
“ক্রফোর্ডের জায়গাটা এখনও গরম আছে। ক্রফোর্ডের বিখ্যাত পাছাটা ঘামছিলো তাহলে। এরকমটি হবার কারণও আছে।”
“কি ঘটবে এখন?” মেরি জানতে চাইলো।
“কিছুই না। যতোক্ষণ না আমি তাদেরকে বলবো কিছু করতে ততোক্ষণ তারা কিছুই করতে পারবে না। আর সেটা কয়েক মাসের ব্যাপার হবে না। আমার ধারণা সেটা হবে কয়েক বছরের। সে পুরোপুরি সেরে ওঠার আগপর্যন্ত তো নয়ই।”
“কিসের থেকে?”
“প্রশ্নগুলো থেকে। এবং ছবিগুলো অনেক ছবি। তার দেয়া বিক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে তারা একটা ফটোগ্রাফিক এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরি করছে। আমাকে ভুল বুঝবেন না। একদিন তাকে এটা শুরু করতেই হবে। সে এটা করতে চাইবে। আমরা সবাই সেটা চাই। কার্লোসকে ধরা পড়তেই হবে। কিছু না ক’রে তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করাটা আমার উদ্দেশ্য নয়। অনেক লোককে অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে। সে তো আরো বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছে। তবে এখন তার কথাই আগে আসবে। আগে আসবে তার মাথাটা।”
“এটাই আমি বোঝাতে চাইছি। তার কি হবে?”
পানোভ তার কফিটা নামিয়ে রাখলো। “আমি এখনও নিশ্চিত নই। আমি মানুষের মনকে শ্রদ্ধা করি। ভুল মানুষের হাতে পড়েছে অনেকেই। আমি সবগুলো কনফারেন্সে ছিলাম। আমি অন্য সব ডাক্তার আর নিউরো সার্জনের সঙ্গে কথা বলেছি। এটা সত্যি যে, আমরা ছুরি হাতে স্টর্ম সেন্টারে যেতে পারি, তার উদ্বিগ্নতা কমিয়ে তাকে এক ধরণের শান্তি এনে দিতে পারি। এমনকি সে যা তাতেও তাকে ফিরিয়ে আনতে পারি। তবে এই শান্তিটা সে চাচ্ছে না…এতে অনেক বিপদ রয়েছে। আমরা হয়তো অনেক কিছু উপড়ে ফেলবো, সে যা খুঁজে পেয়েছে তা কেড়ে নেবো—যত্নের সাথেই। সময়ের সাথে।”
“সময়?”
“হ্যা, আমি এটা বিশ্বাস করি। কারণ প্যাটার্নটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। বাড়ছে সেটা। চিনতে পারা এবং উত্তেজনার সুতীব্র এক যন্ত্রণা। এটা কি আপনাকে কিছু বোঝাচ্ছে?”
মেরি পানোভের গভীর কালো, ক্লান্ত দু’চোখের দিকে তাকালো। সেখানে এক ধরণের আলো দেখতে পেলো সে। “আমাদের সবাইকে বোঝাচ্ছে,” মেরি বললো।
“তা ঠিক। এক দিক থেকে সে আমাদের সবারই একটি কর্মক্ষম ক্ষুদ্র সংস্করণ। মানে, আমরা সবাই খোঁজার চেষ্টা করছি আমরা আসলে কে, তাই না?”
মেরি ওয়াটারফ্রন্টের কটেজের জানালার কাছে গেলো, যার পেছনে আছে একটা বড়সড় টিলা। চারদিকে প্রাচীর ঘেরা। প্রহরীর দল টহল দিচ্ছে। প্রতি পঞ্চাশ ফিট অন্তর অন্তর একজন ক’রে সশস্ত্র প্রহরী। সে তাকে কয়েকশ’ গজ দূরে সমুদ্র সৈকতে দেখতে পাচ্ছে। পানির উপর দাঁড়িয়ে সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউ দেখছে। সপ্তাহগুলো তার জন্যে ভালোই কেটেছে। তার শরীরে ক্ষতচিহ্ন থাকলেও সেরে উঠছে সে। আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে ক্রমশ। তবে দুঃস্বপ্নটা এখনও আছে। দিনের বেলায় কখনও কখনও তার মধ্যে যন্ত্রণাগুলো ফিরে আসে। কিন্তু আগের মতো ভীতিকরভাবে নয়। সে মানিয়ে নিতে শুরু করেছে। আবারো হাসতে শুরু করেছে সে। পানোভ ঠিকই বলেছে। তার স্মৃতি আস্তে আস্তে ফিরে আসবে। ছবিগুলো ধীরে ধীরে পরিস্কার হয়ে উঠবে। আগে যেখানে কোনো অর্থ ছিলো না সেখানে সব কিছু আরো বেশি অর্থবহ হয়ে উঠবে।
কিছু একটা হলো! ওহ্, ঈশ্বর, সেটা কি? সে নিজেকে পানিতে নিক্ষেপ ক’রে চিৎকার করছে। তারপর আচমকা ঢেউয়ের উপর ভেসে উঠে আসছে সৈকতে। দূরে একজন সশস্ত্র রক্ষী দৃশ্যটা দেখে সঙ্গে সঙ্গে হাতের ওয়্যারলেসটা দিয়ে কাউকে কোনো খবর পাঠাতে লাগলো।
ভেঁজা বালুর উপর দিয়ে বাড়িটার দিকে ছুটে আসছে সে। সেটা কি?
মেরি জ’মে গেলো। তারা জানতো এ রকম একটি মুহূর্ত হয়তো আসতে পারে। তার জন্যে প্রস্ততই ছিলো।
দরজা দিয়ে হুরমুর করে ঢুকলো সে, তার বুক নিঃশ্বাসে ওঠানামা করছে। মেরি কখনও তার চোখ দুটো এতো পরিস্কার দেখে নি। এতো আস্তে আস্তে কথা বললো যে, মেরি খুব একটা শুনতে পেলো না। তবে কথাটা কি, বুঝতে পারলো।
“আমার নাম ডেভিড…”
মেরি তার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো।
“হ্যালো, ডেভিড,” বললো সে।
-সমাপ্ত-