বরফজল
যদিও সেই ডজনখানেক শিশি-কৌটো-স্টিক-টিউব আরও কতো কী যেন চাবি দেওয়া ড্রয়ারে পুরে তবে বেরিয়েছে দীপিকা, তবু ওই বহুবিধ প্রসাধন দ্রব্যের মিশ্রিত সুরভির রেশটা ঘরের বাতাসে যেন গান-থেমে-যাওয়া ঘরে সুরের রেশের মতো পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে। হয়তো আরো অনেকক্ষণই থাকবে এই রেশটা। শব্দের থেকে গন্ধের স্থায়িত্ব অনেক বেশি।
সুরের থেকে সৌরভের।
দীপিকা বেরিয়ে যাবার অনেক পর পর্যন্ত বুবু-টুটুর ঘ্রাণেন্দ্রিয় এই সৌরভের স্বাদ পায়। কারণ এটাই বুবু-টুটুর পড়ার ঘর। অথচ এই ঘরটা ছাড়া নিজেকে একটু ছড়িয়ে বিছিয়ে শিথিল করে প্রসাধিত করবার জায়গা আর কোথায় দীপিকার?
দীপিকার যেটা নিজের ঘর, শোবার ঘর, সেখানে তো সারাক্ষণই সুরঞ্জন। অন্তত দীপিকার বেরোবার সময়টায়। কলেজ থেকে ফিরেই তো পরীক্ষার খাতার পাহাড় নিয়ে বসবে সে। আর পাশের ওই ছোট্ট ঘরটায়? যেখানে নাকি সবচেয়ে সুবিধে হতে পারতো দীপিকার, সেখানে এক চিরশয্যা পাতা হয়েছে।
সুরঞ্জনের রুগণ মা পড়ে আছেন সেখানে অনড় অচল হয়ে। ও ঘরটাতে নেহাত দায়ে পড়ে ছাড়া ঢুকতেই ইচ্ছে করে না দীপিকার, তো সাজ-সজ্জা করবে কী? তাছাড়া—বুড়ির হাত-পা-ই শিথিল হয়ে গেছে, দৃষ্টিটি আদৌ নয়। কটকট করে তাকিয়ে থাকে।
অতএব মেয়েদের পড়ার ঘর ছাড়া গতিরণ্যথা।
ঘরটা পড়ার বললে পড়ার, শোবার বললে শোবার। বুবু-টুটু বড় হয়ে অবধি এই ঘরেই শোয়।
ঘরটা বড়। এঘরে হাত-পা মেলিয়ে সাজ-সজ্জা করা যায়। তাছাড়া মেয়েই তো। নিজেরই মেয়ে। তাদের সামনে আর লজ্জা কী? তারা রাগ করে? বয়েই গেল। তাদের রাগ ধর্তব্য করতে যাবে নাকি দীপিকা?
তা আজকাল আর তারা রাগ করে না, গুম হয়ে বসে থাকে বইয়ের পাতায় চোখ রেখে। আগে করতো রাগ, যখন স্কুলের মেয়ে ছিল। বলত ‘বাবাঃ! যেই আমরা পড়তে বসবো সেই শুরু হয়ে যাবে মা-র সাজ-সজ্জা! উঃ!’
দীপিকা জোরে জোরে ঘাড়ে পাউডার ডলতে ডলতে অথবা মুখে ক্রিম ঘষতে ঘষতে বলতো, ‘তাতে তোমাদের কী ব্যাঘাতটা ঘটছে? ঘরে আমি চেঁচাচ্ছি, না টিন পেটাচ্ছি?’
প্রখরা বুবু ঠোঁট উল্টে বলতো, ‘না করলেই বা কী? তোমার উপস্থিতিটাই আমাদের অনুভূতির উপর টিন পেটানোর সামিল।’
‘ওঃ বড্ড কথা শিখেছিস! বলগে যা না তোদের সোহাগের বাপীকে একটা সাতমহলা বাড়ির ব্যবস্থা করতে।’
‘তার চেয়ে অনেক সোজা তোমার সাজের মাত্রাটা একটু কমানো।’
‘বড় বড় কথা বলিসনে বুবু—’দীপিকা ধমকে উঠতো, ‘বয়সের মতো থাক।’
বুবু তবুও কথা বলতো।
মা-র সাজের উপকরণ নিয়ে নানা মন্তব্য করতো, সাহিত্য-সভায় যোগ দিতে যেতে এতো সাজসজ্জা অবশ্য প্রয়োজনীয় কিনা এমন সব কূট প্রশ্ন তুলতো। অর্থাৎ বুবু বয়েসের মতো থাকতো না।
অথচ এখন বয়স হয়েও চুপ করে থাকে। বইয়ে চোখ ফেলে গুম হয়ে বসে থাকে।
দীপিকা নামের একটা মানুষ যে ঘরের মধ্যে ওই ডজনখানেক কৌটো-বাটা নিয়ে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে, তা যেন দেখতেই পায় না।
আগে এতো রকম উপকরণের ব্যবহার জানতো না দীপিকা, এখন শিখেছে, আরো শিখছে। কারণ এখন দীপিকার নিজের রোজগারের পয়সা হাতে আসছে, আর দীপিকা অনেক বেরোচ্ছে।
না, আগে এতো বেশি বেরোতো না দীপিকা, সংসার-সংসার বাতিকই ছিল বরং তার। তার সঙ্গে লেখার শখ একটু ছিল, অবকাশ সময়ে সেটা নিয়ে বসতো। কদাচ সংসার ভাসিয়ে দিয়ে নয়।
কিন্তু এখন দীপিকার পদ্ধতির বদল হয়েছে, এখন সংসার ভাসাচ্ছে, নিজেকে ভাসাচ্ছে।
কারণ এখন বাজারে দীপিকার লেখার কদর হয়েছে, দীপিকা লেখার জন্যে দাম পাচ্ছে। অর্থাৎ দীপিকা দরের মানুষ হয়ে উঠেছে। দীপিকাকে অতএব প্রায় প্রতিদিনই কোনো-না-কোনো সভায় যোগ দিতে হচ্ছে, যেহেতু দীপিকা মজুমদার নামটা সাহিত্য সমাজের তালিকায় উঠে গেছে।
এখন দীপিকার নামে রাতদিনই আসছে চিঠি-পত্র কার্ড।
গোড়ায় গোড়ায় সুরঞ্জন বলতো, ‘পোস্টে একটা কার্ড এলেও ছুটতে হবে? ওতে মান থাকে?’
দীপিকা তখন বলতো, ‘কার্ডটা যে পাঠিয়েছে মনে করে এটাই যথেষ্ট বাবা, তা নয়তো কী দীপিকা মজুমদারকে গাড়ি এনে সাধবে?’
কিন্তু এখন তো সে ঘটনাও ঘটছে মাঝে মাঝে, গাড়ি এনে সেধেও নিয়ে যাচ্ছে দীপিকা মজুমদারকে। এখন দীপিকা মজুমদার হচ্ছে প্রগতিশীল লেখক-গোষ্ঠীর একজন। তেমন তেমন সভায় প্রধান অতিথির ভূমিকাটিও গ্রহণ করতে হয়। ভূমিকা না জুটলেও গিয়ে জোটে।
সাজবার একটা সুযোগ তো জোটে তাতে।
অবশ্য আড়ালে সবাই হাসাহাসি করে ওর সাজের ঘটা দেখে, কিন্তু তাতে কী এসে গেল, আড়ালে তো লোকে রাজার মাকেও ডাইনি বলে।
নিজের মেয়েরা বিদ্রুপ করে? বুবু টুটু?
বয়েই গেল। দীপিকা ওতে কেয়ার করে না।
আসল কথাটা তো ধরা পড়ে গেছে দীপিকার কাছে। মায়ের এই হঠাৎ ‘নামডাকে’ মেয়েদের হিংসে জেগেছে।
মা ঘর-সংসার করবে, তোদের সুখ-সুবিধে দেখবে, ওদের এই কাগজের স্বর্গে আত্মগোপনকারী বাপকে তোয়াজ করে করে ডেকে ডেকে খাওয়াবে মা, এই ব্যস। বড়জোর অবকাশকালে একটু খাতা-কলম নিয়ে বসবে। আবার কি!
মেয়েরা তো এখন কিছুই বলে না, তবু নিজেই কথা গেঁথে মনে মনে উত্তর দেয় দীপিকা। আর তোমরা? তোমরা ইস্কুল যাবে, কলেজ যাবে, পাস করবে, নাম করবে, আর ম্যাট্রিক-ফেল মাকে—অনুকম্পার দৃষ্টিতে দেখবে। এই তো? এইটাই ছিল ন্যায্য, কেমন? তা হচ্ছে না।
চাকা ঘুরে গেছে।
ম্যাট্রিক-ফেলই ডঙ্কা বাজিয়ে পাদপ্রদীপের সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই তোমাদের গোঁসা, কেমন? দীপিকা বোঝে, তাই গ্রাহ্য করে না মেয়েদের অপছন্দ। ষোল রকম উপকরণ জুটিয়ে এনে ওদেরই সামনে ঘুরে ফিরে হেঁটে চলে ঘণ্টাখানেক ধরে সৌন্দর্যবৃদ্ধির অনুশীলন করে। তারপর বেরিয়ে যায় বহুবিধ প্রসাধন-দ্রব্যের মিশ্রিত সৌরভে ঘরটাকে স্বপ্নাতুর করে রেখে।
জিনিসগুলো চাবি-বন্ধ ড্রয়ারে রেখে যায়। তার কারণ—মেয়েরা ওগুলো দেখে ফেলে এটা দীপিকার ইচ্ছে নয়। কত রকম কলাকৌশলেই যে চেহারাটিকে রাখতে হয়, তা প্রকাশ না করাই ভালো।
ওঁরা হচ্ছেন ঠিক বাপটির মতো, মনে মনে ভাবে দীপিকা, বুনো, জংলি।
কী ছিরি করেই থাকে!
ওরা শাড়ি ধরা পর্যন্ত দীপিকা কি অনেক চেষ্টা করে নি ওদের সভ্য করে তোলবার জন্যে?
করেছে চেষ্টা।
ওরা নেয় নি সেই পরামর্শ, বুদ্ধি, আদর।
টুটু বলেছে, ‘থাক মা ওসব, কমনীয়তা, পেলবতা, চারুতা, ঔজ্জ্বল্য, অতুল্য, তোমার জন্যেই থাক। তোমাকেই মানায় ওসব, আমাদের নিয়ে আর টানা-হেঁচড়া কোরো না।’
আর বুবু বলেছে, ‘মহৎ লক্ষ্য, মহৎ কাজ’ ওসব তুচ্ছ ব্যক্তিদের জন্যে নয় মা, এই আমার লক্ষ্যবিহীন জীবনটা নিয়ে বেশ আছি। শরীরটাকে নিয়ে আর বাগানের মালির মতো খাটতে পারি না।’
‘বাগানের মালি?’
দীপিকা ভুরু কুঁচকেছে।
বুবু ঠাকুর রামকৃষ্ণের ভঙ্গিতে হাত উল্টে বলেছে, ‘তা ছাড়া আর কী? এও তো সেই জল দাও, সার দাও, ছাঁটো-কাটো, পর্যবেক্ষণের ওপর রাখো, উঃ! ও তোমারই পোষায়।’
দীপিকা রেগে লাল হয়েছে, দীপিকা অতএব মেয়েদের হিতচেষ্টা থেকে বিরত হয়েছে। তাই ওরা দুটো তরুণী মেয়ে সাদা শাড়ি পরে, খালি হাত করে আর চুলগুলোকে নুড়ো নুড়ো করে বেড়ায়। আর ওদের মধ্যবয়সী মা মুখে-চোখে রঙের তুলি বুলিয়ে দশ রকম মসলা দিয়ে গা মেজে ছ’ইঞ্চি চওড়া ব্লাউজ পরে সমাজে চরে বেড়ায়।
ইদানীং আবার চুলের নীচে বল বসিয়ে টোপরের মতো খোঁপা বাঁধতে শুরু করেছে। শিখেও ফেলেছে কায়দাটা নিখুঁত করে।
আজও সেই কায়দার জাল বিছিয়ে তার মধ্যে ভেজালের গোলা পুরে খোঁপা-টোপা বেঁধেছে ঘণ্টাখানেক ধরে, খেয়াল করে নি দু দুজোড়া জ্বলন্ত চোখ তার ওই দেবদেউল খোঁপাকে ভস্ম করতেই শুধু বাকি রাখলে।
কিন্তু শুধু ওই সাজটুকুর জন্যেই কি এত বিদ্বেষ আর ঘৃণা বুবু আর টুটুর? লেখিকা দীপিকা মজুমদারের দুই মেয়ের মায়ের এই তুচ্ছ দুর্বলতাটুকুকে ক্ষমার চোখে দেখবার মতো সামান্য উদারতাটুকুও নেই?
ক্ষুদ্র সঙ্কীর্ণ অপরিসর হৃদয়টুকু নিয়ে তাই এই সুরভিভারাচ্ছন্ন ঘরে বসে আছে তিক্ত বিরক্ত মুখ নিয়ে।
বসেছিল।
হাতের বইটায় চোখ রেখে পড়া-পড়া খেলা করছিল দু’জনে টেবিলের ধারে বসে।
হঠাৎ একসময় বইটা সশব্দে বন্ধ করে রেখে বুবু বলে ওঠে, ‘অসহ্য!’
টুটু হয়তো অন্যমনা ছিল, তাই একটু চমকে উঠে বলে, ‘কী অসহ্য?’
‘সবটাই।’
টুটু আবার বইতে চোখ রাখে মাথা নামিয়ে।
বুবু আরো কড়া গলায় বলে, ‘কর কর, মাথাটাই হেঁট কর ভালো করে। ওটাই তো সম্বল হবে শেষ পর্যন্ত। মাতৃদেবী যে রেটে আধুনিক হচ্ছেন! পড়েছিস ওনার লেটেস্ট বইখানা।’
টুটু তেমনি মাথা হেঁট করে বলে, ‘না’।
‘না? কেন? না কেন?’ বুবু উঠে দাঁড়ায়। টুটুর মাথাটা ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, ‘পড়তে হবে। পড়ে দেখতে হবে পাঠক-সমাজ কী চায়। কোন গুণে শ্রীমতী দীপিকা মজুমদার—সাহিত্য-সভার সভানেত্রী হয়ে মঞ্চে ওঠেন।’
টুটু আস্তে হেসে বলে, ‘তা আমার মাথাটা ভাঙছিস কেন?’
‘ইচ্ছে হচ্ছে।’ বুবু চড়া গলায় বলে, ‘তোর আমার বাংলাদেশের পাঠকসমাজের, সকলের মাথা ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে।’
‘পেরে উঠবি না’ বলে টুটু আবার পড়ার বই খোলে।
‘বই রাখ।’ বুবু ওর হাত থেকে বইটা টেনে ফেলে দিয়ে বলে, ‘অথচ আগে মা মন্দ লিখতো না। এক-একটা গল্প বেশ ভালোই লিখতো। কিন্তু এখন মা-র সাহিত্যের প্রধান উপকরণ কি হয়েছে জানিস?’
বুবু দম নিচ্ছিল, টুটু আস্তে বললো, ‘জানি। ব্রেসিয়ার।’
‘ওঃ!’
বুবু আর একবার ওর মাথাটা ধরে নাড়া দিয়ে বলে, ‘তবে যে বললি পড়িস নি?’
‘না পড়লেও বোঝা যায়।’
‘না পড়লেও বোঝা যায়?’
‘নিশ্চয়। নাম হয়েছে যখন, লেখার দাম পাচ্ছে যখন। ধরেই নিতে হবে প্রধান উপকরণটা খুঁজে পেয়ে গেছে।’
বুবু আর একবার ওর মাথাটা ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, ‘তোর রক্তটা কি বরফজল দিদি? তেতে উঠতে জানে না?’
টুটু চোখ তুলে একটু হাসে।
‘আবার? আবার হাসছিস? জানিস, কাল ওই বইটা পড়া পর্যন্ত মা-র দিকে তাকাতে পারছি না আমি—’
‘আর পড়িস না।’ বলে টুটু ফের পড়ার বই হাতে নেয়। কিন্তু বুবু ফের কাড়ে, সরিয়ে রাখে। ত্রুদ্ধ গলায় বলে, ‘আমি না হয় না পড়লাম, দেশসুদ্ধু লোক পড়বে না? আত্মীয়রা? বন্ধুরা? আমাদের কলেজের মেয়েরা? বাবার ছাত্ররা?’
বুবুর মুখটা উত্তেজনায় যেন ফেটে পড়তে চাইছিল। বুবু হাত দুটো মোচড়াচ্ছিল।
টুটু একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, ‘তা পড়েছিস তো কাল, আজ হঠাৎ এতো ক্ষেপে উঠলি কেন?’
‘কেন?’ বুবু সেই লাল লাল মুখে বলে, ‘কেন জানিস? কাল থেকে ভেবেছি, আজ মা যখন এই ঘরে এসে ঘুরে ঘুরে সাজতে শুরু করবে, তখন বলবো—’
‘বলবি? কী বলবি?’
‘বলবো—হয় তোমার ওই লেখা আর এই সাজ ছাড়ো, নয় আমাদের ছাড়ো। বলবো—তুমি যদি ঘরে বাইরে আমাদের মুখ দেখাবার পথ বন্ধ করো তো আমাদের পথ দেখতে দাও। কিন্তু পারলাম না। মনে হল, বললেই হয়তো মা বলে উঠবে, ”সাহিত্যের তোমরা বোঝো কী? সাহিত্যে সুন্দর নেই অসুন্দর নেই, রুচি অরুচি নেই, পাপ নেই পুণ্য নেই, আব্রু নেই বে-আব্রু নেই, সাহিত্য হচ্ছে সাহিত্য।” কবে যেন কোন সভায় বলে এসেছিল এসব মা, কাগজে বেরিয়েছিল, পড়িস নি?’
‘কাগজে বেরিয়েছিল মা-র বক্তৃতা?’
টুটু হেসে ওঠে, ‘তবেই বোঝ? গেরস্তঘরের ভদ্রমহিলা, রাঁধছিল, বাড়ছিল, সংসার করছিল, হঠাৎ খবরের কাগজ ওর ভাষণ ছাপছে, পাবলিশাররা ওর দরজায় হাঁটাহাঁটি করছে—সে তো ওই ‘নেই’-টুকুর জোরে? যদি বলতো সব আছে—পাবলিশার ঝেড়ে জবাব দিতো, ঠিক আছে। তাহলে তুমিও থাকো।’
বুবু বসে পড়ে।
বুবু হতাশ গলায় বলে, ‘সাধে কী বলেছি তোর গায়ে রক্ত নেই, শুধু বরফজল। আমার মাথার মধ্যে রক্ত টগবগিয়ে ফুটছে। মনে হচ্ছে মা হয়তো আমাদেরও মা-র ওই গল্পের নায়িকার মতো মনে করে। যারা—’
বুবু আরো কী বলতে যাচ্ছিল, থেমে যেতে হল। সুরঞ্জনের চটিজুতোর শব্দ পাওয়া গেল।
বুবু হঠাৎ টেবিল থেকে একটা বই তুলে নেয়! মনে করা যেতে পারে, এতক্ষণ বুঝি অখণ্ড মনোযোগে বইটিই পড়ছিল।
সুরঞ্জন এসে ঘরে ঢুকলেন।
স্খলিত অসহায় গলায় বলে উঠলেন, ‘তোমার ঠাকুমা বিকেলে কিছু খেয়েছেন?’
ঠাকুমা!
তিনি খেয়েছেন কিনা সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হবে বুবুদের?
বুবু মাথা নাড়ে, ‘জানি না।’
‘জানো না?’
সুরঞ্জন অসহায় গলায় বলেন, ‘একটু জানবে তো? বুড়ো মানুষ, বিছানায় পড়ে আছেন—’
‘আচ্ছা যাচ্ছি, দেখছি—’ বুবু বলে।
কিন্তু সুরঞ্জন কি শুধু তাঁর মেয়েদের মানবিকতার পাঠ দিতেই এসেছিলেন?
তাহলে আশ্বাস পেয়ে চলে গেলেন না কেন? কেন অকারণ একটু দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর কেন খুব একটা লজ্জিত লজ্জিত গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘হ্যাঁরে, তোদের মা যা-সব লেখে-টেখে পড়িস?’
টুটু তো দূরস্থান, বুবুও বাপের প্রশ্নের সামনে চুপ করে থাকে।
সুরঞ্জন উত্তরের প্রত্যাশায় একটু অপেক্ষা করে আবার বলেন, ‘তোরা তো তোদের মা-র সঙ্গে বন্ধুর মতো ঠাট্টা-তামাশা করে কথা বলিস, তা সেই রকম করেই বলিস না একটু, ওই সব ছাই-পাঁশ লিখে কী হচ্ছে?’
বুবু ওই নম্র মিতবাক মানুষটার অসহায় মুখের দিকে তাকায়, বুবু বোঝে অনেক দুঃখেই বাবা—তাই সে বাবার মুখের দিকে চেয়ে থাকে শুধু। বলে ওঠে না, আহা, বললেই যেন শুনবেন আমাদের মা-জননী! বাঘিনী এখন রক্তের স্বাদ পেয়েছেন তা খেয়াল রাখ? নাম ডাক অর্থ। এর স্বাদ কি সোজা নাকি? এর কাছে ‘লোকে কী বলবে?’ তাহলে আর লোকে ঘুষের টাকায় বাড়ি হাঁকড়ে অপরকে ডেকে ডেকে দেখাত না, চোরা কারবারের টাকায় গাড়ি কিনে লোকের নাকের ওপর ধুলো উড়িয়ে চলে যেত না।
বুবুর মায়া হল। বুবু বলতে পারল না।
কিন্তু বললো টুটু।
যেটা অপ্রত্যাশিত।
টুটু খুব মোলায়েম গলায় বলে উঠল, ‘বারণ করলে মা তাঁর কলমের গতি বদলাবেন বলে মনে হয় তোমার?’
সুরঞ্জন অপ্রতিভ গলায় বলেন, ‘না, নিষেধের কথা বলছি না। মানে আর কী একটু বুঝিয়ে বলবি। এই দেখ না সম্প্রতি কী নাকি একটা লিখেছে—সেটা হাতে করে নিয়ে এসেছিল তোদের দেবুকাকা, বলছিল—’
বুবুকে অবাক করে দিয়ে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করে টুটু, ‘দেবুকাকা শুধু মা-র ওই লেখার কথাই বলে গেলেন? মা-র সাজ-সজ্জার উন্নতির কথা বলে গেলেন না? মা-র আচার-আচরণ, চরে বেড়ানো, এ সব নিয়ে বললেন না?’
সুরঞ্জন লজ্জিত বিপর্যস্ত গলায় বলেন, ‘বলছিল তো সে-সব—’
টুটু গম্ভীর গলায় বলে, ‘আচ্ছা বাবা, তুমি পারো না শাসন করতে? তোমারই করা উচিত।’
‘আমি?’
সুরঞ্জন ম্লান গলায় বলেন, ‘আমি বারণ করলে তো আরো বেশি করে করবে। তোরা মেয়ে; তবু যদি তোদের কথা নেয়। আচ্ছা, ইয়ে, ঠাকুমাকে একবার দেখিস—’
সুরঞ্জন তাড়াতাড়ি চলে যান।
প্রখরা বুবুর বাবার ওই নিরুপায় মুখচ্ছবির দিকে তাকিয়ে মনটা কেমন করে আসে।
ঘরের মধ্যে যে সৌরভসারের রেশটুকু তখনো খেলা করছিল, বুবু যেন তার ঘ্রাণ নেয়।
আস্তে বলে, ‘বেচারা বাবা! আমাদের তো তবু পথ আছে, বাবার জন্যে দুঃখ হয়।’
‘দুঃখ হয়? বাবার জন্যে তোর দুঃখ হয়?’
বুবুকে আশ্চর্য করে দিয়ে ‘বরফজল’ টুটু হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘বলতে লজ্জা করলো না তোর একথা? প্রধান আসামী কে জানিস? ওই ‘ভদ্র’ ব্যক্তিটি। ওই আমাদের ভদ্র সভ্য মার্জিতরুচি বাবাটি। যিনি শুধু নিজের ভদ্রতার খোলশটুকুকে প্রাণপণে সামলে চলা ছাড়া আর কোনো করণীয় খুঁজে পান নি।…..খেয়াল করেন নি বিষের চারাকে চারাতেই নির্মূল করা দরকার। আমার হাতে যদি ক্ষমতা থাকতো, তাহলে কী করতাম জানিস? এই আমাদের বাবার মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন ভদ্রলোকদের কর্তব্যচ্যুতির অপরাধে ধরে ধরে জেলে পাঠাতাম। বলতাম—কেবলমাত্র নিজেকে সভ্য ভদ্র মার্জিত করে রাখাই তোমাদের একমাত্র কর্তব্য ছিল? আর কিছু কর্তব্য ছিল না? রক্তে তোমাদের বরফ ছাড়া আর কিছু নেই?’
—
Its a excellent song. Really touchy,Stimulate blood circulation, beating the heart rapidly…. I cant say any more but really touchy song
আমার যতদূর জানা আছে ~ “মুক্তির মন্দির সোপানতলে” গানটির গীতিকার / লেখক হলেন, “মোহিনী চৌধুরী”…
শ্রদ্ধেয় মোহিনী চৌধুরী → গীতিকার
শ্রদ্ধেয় কৃষ্ণ চন্দ্র দে
তথ্যে ভুল আছে। গানটির গীতিকবি মোহিনী চৌধুরী/ সুরকার কৃষ্ণচন্দ্র দে।
গানটির গীতিকবি: মোহিনী চৌধুরী
সুরকার: কৃষ্ণচন্দ্র দে